কবি – ১০

কবি – ১০

সন্ধ্যায় রাজা বেশ সমারোহ করিয়া আসর পাতিল। রাজা পরিশ্রম করিল সেনাপতির মত; বিপ্রপদ বসিয়া ছিল রাজা সাজিয়া। বেচার বাতব্যাধিতে আড়ষ্ট শরীর লইয়া নাড়া-চাড়া করিতে পারে না, চীৎকারেই সে সোরগোল তুলিয়া ফেলিল। অবশ্য কাজও অনেকটা হইল। মুদী, কয়লাওয়ালা বিপ্ৰপদর ব্যঙ্গশ্লেষের ভয়ে শতরঞ্চি বাহির করিয়া দিল, বণিক মাতুল তাহার পেট্রোম্যাক্স আলোটা আনিয়া নিজেই তেল পুরিয়া জালিয়া দিল। লোকজনও মন্দ কেন—ভালই হইল। সন্ত্রান্ত ভদ্র ব্যক্তিরা কেহ না আসিলেও দোকানদার শ্রেণীর লোকেরাই হংসশ্রোতার মত যথাসাধ্য সাজিয়া-গুজিয়া জাঁকিয়া বসিল, নিম্নশ্রেণীর লোকেরা একেবারে ভিড় জমাইয়া চারিদিক ঘিরিয়া দাঁড়াইল। মাঝখানে আসর পড়িল ঝুমুর নাচের; নিতাই প্রত্যাশা করিয়াছিল উহাদের দলের কবিয়ালের সঙ্গে একহাত লড়িবে অর্থাৎ গাওনার পাল্লা দিবে। অনেক ঝুমুর দলের সঙ্গে এক একজন নিম্নস্তরের কবিয়াল থাকে –স্বতন্ত্রভাবে গাওনা করিবার যোগ্যতা না-থাকা হেতু ওই ঝুমুর দলকে আশ্রয় করিয়া থাকে তাহারা। পথে কোন গ্রামে বা মেলার এমনি ধারার ঝুমুর দলের দেখা পাইলে পাল্লা জুড়িয়া দেয়। মেলায় ঝুমুরের সহিত কবির আসর যোগ হইলে আসরও জোরালো হয়। এ দলেরও এমন একজন কবিয়াল আছে। কিন্তু সে আজ দলের সঙ্গে আসে নাই। কাজের জন্য পিছনে পড়িয়া আছে। দলটার গন্তব্যস্থান আলেপুরের মেলা। কথা আছে, দুই দিন পরে সে সেইখানে গিয়া জুটিবে। নহিলে নিতাই একটা আসর পাইত। কবিয়ালের অভাবে আসর বসিল শুধু নাচগানের। ঢোল, ডুগি তবলা, হারমোনিয়ম, একটা বেহালা লইয়া ঝুমুর দলের পুরুষের আসর পাতিয়া বসিল। তাহদের তেল-চপচপে চুলে বাহারের টেরী, গায়ে রংচঙে ছিটের ময়লা জামা। মেয়েদের গায়ে গিলটির গয়না—কান, ঝাপ্টা, হার, তাগা, চুড়ি, বালা; পরনে সস্তা কাপড়ের বাতিল ফ্যাশানের বডিস, রঙিন কাপড়। কেশবিন্যাসের পারিপা্ট্যে আধুনিকতা অনুকরণের ব্যর্থ অপকৃষ্ট ভঙ্গি। ঠোঁটে-গালে লালরঙ, তার উপর সস্তা পাউডার এবং স্নো’র প্রলেপ, পায়ে আলতা, হাতেও লাল রঙের ছোপ। দর্শকদের মনে কিন্তু ইহাতেই চমক লাগিতেছে। মেয়েগুলির মধ্যে বসন্তই ঝলমল করিতেছে, মেয়েটার সত্যই রূপ আছে। তার সঙ্গে রুচিও আছে। মেয়েটা সাজিয়াছে বড় ভাল। কবিয়াল নিতাই ফরসা কাপড় জামার উপর চাদরখানি গলায় দিয়া ঝুমুর দলেরই গা ঘেঁষিয়া বসিল। মুখে তাহার গৌরবের হাসি। এ আসরে সে বিশিষ্ট ব্যক্তি কারণ সে কবিয়াল!
গাওনা আরম্ভ হইল। খেমটার অনুকরণে নাচ ও গান। মেয়েরা প্রথমে গান ধরে, মেয়েদের পরে দোয়ারের সেই গানেরই পুনরাবৃত্তি করে, মেয়েরা তখন নাচে। একালে খেমটা নাচের প্রসার দেখিয়া তাহাদের ঝুমুর নাচ ছাড়িয়া এই ধরিয়াছে। কিছুটা অবশ্য ঝুমুরের রঙ রাখিয়াছে। সেটুকু সবই অশ্লীলতা।
প্রৌঢ়া মধ্যস্থলে পানের বাটা লইয়া বসিয়াছিল, সে নিতাইকে বলিল—বাবা, তুমিও ধর।
নিতাই হাসিল। কিন্তু দোয়রদের সঙ্গে সে গান ধরিল না। প্রথম গানখানা শেষ হইতেই মেয়েরা বিশ্রামের জন্য বসিল। সঙ্গে সঙ্গে নিতাই উঠিয়া পড়িল। কবিয়ালের ভঙ্গিতে চাদরখানা কোমরে বাঁধিয়া সে হাতজোড় করিয়া বলিল—আমি একটি নিবেদন পাই।
চারিদিকে নানা কলরব উঠিয়া পড়িল।
—সঙ নাকি?
—ব’স ব’স!
—এই নিতাই!
একজন রসিক বলিয়া উঠিল—গোঁফ কামিয়ে এস্! গোঁফ কামিয়ে এস!
অকস্মাৎ সকল কলরবকে ছাপাইয়া রাজা হুঙ্কর দিয়া উঠিল—চোপ সব, চোপ।
বিপ্রপদও একটি ধমক ঝাড়িল—অ্যা—ও!
সকলে চুপ করিয়া গেল। নিতাই সুযোগ পাইয়া বলিল—আমি একপদ গাইব আপনাদের কাছে।
—লাগাও ওস্তাদ, লাগাও। রাজার কণ্ঠস্বর।
নিতাই গান ধরিয়া দিল। বা হাতটি গালে দিয়া, ডান হাতটি মুখের সম্মুথে রাখিয়া অল্প ঝুঁকিয়া আরম্ভ করিল—
“আহা রাঙাবরণ শিমুলফুলের বাহার শুধু সার–
ওগো সখি দেখে যা বাহার।”
কলিট প্রথম দফা গাহিয়া ফেরতার সময় সে হাতে তালি দিয়া তাল দেখাইয়া বলিল—
এই–এই,—এই বাজাও তবলাদার –বলিয়াই সে আবার ধরিল—
“শুধুই রাঙা ছটা, মধু নাই এক ফোঁটা, গাছের অঙ্গে কাটা খরধার।
মন-ভোমরা যাস্‌ নে পাশে তার। ”
নিতাইয়ের কণ্ঠস্বরখানি মধুর এবং ভরাট, এক মুহূর্তে মানুষের মন দখল করিয়া লয়।
লইলও তাই। লোকের আপত্তি গ-য়ে গোমাতার মত গানে, কিন্তু এখানে তাহার আভাস না পাইয়া লোকে জমিয়া বসিল।
রাজা বাহবা দিয়া উঠিল—বাহা রে ওস্তাদ, বাহা রে!
বিপ্রপদও দিল—বহুত আচ্ছা।
বণিক মাতুল বলিল—ভাল, ভাল।
লোকেও বাহবা দিল।
নিতাই উৎসাহে মৃদু মৃদু নাচিতে আরম্ভ করিল। একবার চারিদিকে দৃষ্টি বুলাইয়া লইল, মুখে তাহার মৃদু হাসি। রাজার পিছনেই রাজার স্ত্রী, তাহার পাশে ঠাকুরঝি। শ্রদ্ধাম্বিত বিস্ময়ে সে তাহার দিকে চাহিয়া আছে। মুহূর্তের জন্য নিতাই গান ভুলিয়া গেল, ঠাকুরঝিকে অবহেলা দেখাইলেও ঠাকুরঝি তাহাকে অবহেলা করে নাই। তাহার গৌরবের গোপন অংশ লইতে সে আসিয়াছে। মুহূর্তের জন্য সে গানের খেই হারাইয়া ফেলিল।
ঝুমুর দলের ঢুলীটা সুযোগ পাইয়া ঢোলে কাঠি মারিয়া চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল— হ্যাঁ এই কাটল। অর্থাৎ নিতাইয়ের তাল কাটিয়া গেল। মুহূর্তে নিতাই সজাগ হইয়া গান ছাড়িয়া দিয়া হাতে তালি দিয়া বলিল—গান নয়, এবার ছড়া।
হুঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ বলিয়া তালি মারিতে মারিতে পুনরায় ধরতার মুথে ধরিয়া দিল—
“ফল ধরে না ধরে তুলো, চালের বদলে চুলো—”
সঙ্গে সঙ্গে সে নাচিতে শুরু করিল। পরের কলি ভাবিবার এই অবকাশ। নাচিতে নাচিতে সে ফিরিয়া চাহিল—আসরের দিকে। ঝুমুর দলের মেয়েগুলি মুখ টিপিয়া হাসিতেছে। কেবল বসন্তর চোখে খেলিতেছে ছুরির ধার। নিতাই তাহার দিকে চাহিয়াই ছড়া কাটিল—
“ফুলের দরে তা বিকালো, মালা হ’লো গলার।”
নিতাইয়ের সঙ্গে চোখোচোথি হইতেই বসন্ত যেন ক্ষেপিয়া গেল। সে উঠিয়া দাঁড়াইল, প্রৌঢ়াকে বলিল—আমি চললাম মাসী। শিমুল ফুলের অর্থ সে বুঝিয়াছে।
—কোথায়?
—বাসায়, ঘুমুতে।
—ঘুমুতে!
—হ্যাঁl
—তুই কি ক্ষেপেছিল নাকি? ব’স।
—না। এ আসরে আমি গান গাই না। যে আসরে বাঁদর নাচে সে আসরে আমি নাচি না।
বেশ উচ্চকণ্ঠেই কথা হইতেছিল। নিতাই মুহূর্তে স্তব্ধ হইয়া গেল। দর্শকের অধিকাংশই চীৎকার করিয়া উঠিল—এই, এই, তুমি থাম।
চটিয়া উঠিল রাজু, সে উঠিয়া দাঁড়াইল—কেয়া?
বসন্ত কোনও উত্তরই দিল না, কেবল একবার ঘাড় বাঁকাইয়া, নিতান্ত তাচ্ছিল্যভরে একটা চকিত দৃষ্টি হানিয়া আসর হইতে বাহির হইয়া যাইবার উপক্ৰম করিল। চারিদিকে একটা রোল উঠিল, কেহ নিতাইয়ের উপর চটিয়া চীৎকার শুরু করিল, কেহ অর্থের চুক্তিতে আবদ্ধ ঘৃণিত পথচারিণী মেয়েটার দুবিনীত স্পর্ধায় ক্রুদ্ধ হইয়া আস্ফালন তুলিল। কিন্তু মেয়েটা কোন কিছুতেই ক্ৰক্ষেপ করিল না; সম্মুখের মানুষটিকে বলিল—পথ দাও তো ভাই।
সে পথ ছাড়িয়া দিত কি দিত না কে জানে, কিন্তু সে কিছু করিবার পূর্বেই পিছন হইতে সম্মুখে আসিয়া পথ-রোধ করিয়া দাঁড়াইল নিতাই। হাত জোড় করিয়া সে হাসিমুখে বিনয় করিয়া বলিল—আমার দোষ হয়েছে। যেও না তুমি, ব’স। আমার মাথা খাও!
বসন্ত কথার উত্তর দিল না, কিন্তু ফিরিয়া আসিয়া আসরে বসিল। গোলমাল একটু স্তিমিত হইতেই সে উঠিয়া গান ধরিল। গানখানি বাছাই করা গান। ভদ্রজনের আসরে যেখানে খেউর গাওয়া চলে না সেইখানে গাওয়ার জন্য তাহাদের ভাণ্ডারে মজুত আছে। গানখানি বসন্তর বড় প্রিয়; নাচের সঙ্গে কোথায় যেন যোগ আছে। বাছিয়া তাই সে এইথানাই ধরিল—

ঝুম ঝুমঝুম বাজে লো নাগরী;
নূপুর চরণে মোর। ও সে থামিতে না চায় গো।
তোরা আয় গো!
জল ফেলে কাঁখে তুলে নে গো সখি গাগরী।
রজনী হইল ভোর;–আয় সখি আয় গো; নিশি যে ফুলায় গো!
নূপুর চরণে মোর থামিতে না চায় গো!
ঝুম ঝুমাঝুম, ঝুমাঝুম ঝুমাঝুম!

ঝুম ঝুমাঝুমের সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ করিল নাচ। আসরটা স্তব্ধ হইয়া গেল। এমন কি ক্রুদ্ধ রাজা পর্যন্ত মুগ্ধ হইয়া গেল। মেয়েটার রূপ আছে, কণ্ঠও আছে। ছুরির ধারের মত উচ্চ সু-কণ্ঠ। তাহার উপর মেয়েটা যেন গান ও নাচের মধ্যে নিজেকে ঢালিয়া দিয়াছে। দ্রুত হইতে দ্রুততর তানে লয়ে সঙ্গীত ও নৃত্য শেষ করিয়া মুহূর্তে একটি পূর্ণচ্ছেদের মত স্থির হইয়া দাঁড়াইল; এতক্ষণে আসরে রব উঠিল—বাহবার রব। চারিদিক হইতে ‘পেলা’ পড়িতে আরম্ভ হইল—পয়সা, আনি, দোয়ানি, সিকি, দুইটি আধুলি; দোকানী ঘনশ্যাম দত্ত একটা টাকাই ছুঁড়িয়া দিল। মেয়েটার সেদিকে লক্ষ্য করিবার বোধ হয় অবসর ছিল না, তাহার সর্বাঙ্গে ঘাম দেখা দিয়াছে, বুকখানা হাপরের মত হাপাইতেছে; গৌরবর্ণ মুখখানা রক্তোঞ্ছাসে ভরিয়া উঠিয়াছে। প্রৌঢ়া নিজে উঠিয়া পেলাগুলি কুড়াইয়া হইল।
চারিদিক হইতে রব উঠিল—আর একথানা, আর একখানা!
নিতাই বসন্তর দিকে চাহিল, চোখে চোখে মিলিতেই নমস্কার করিয়া সে তাহাকে অভিনন্দিত করিল।
প্রৌঢ়া বসন্তর গায়ে হাত দিয়া বলিল—ওঠ,! কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই শিহরিয়া উঠিল,—এ কি বসন, জ্বর যে আজ অনেকটা হয়েছে!
হাসিয়া বসন বলিল—একটুকুন মদ থাকে ত দাও।
সামান্য আড়াল দিয়া খানিকটা নির্জলা মদ গিলিয়া সে আবার উঠিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু প্রথমবারের মত গতি বা আবেগ কিছুঁই আনিতে পারিল না, সে হাঁপাইতেছিল, গতির মধ্যে ক্লান্তির পরিচয় সুপরিস্ফুট। গান ধরিয়াও গাহিতে পারিল না; দোহারেরা গাহিল। তেহাই পড়িতেই নাচ শেষ করিয়া সে শিথিল ক্লান্ত পদক্ষেপে আসর হইতে বাহির হুইয়া গেল। কেহ কোন কথা বলিল না, যেন তাহদের দাবি ফুরাইয়া গিয়াছে, চোখের উপর দেনা-পাওনার ওজন-দাঁড়িতে তাহার দুইখানা গান ও নাচের ভার তাহদের পেলার ভারকে তুচ্ছ করিয়া পাথরের ভারে মাটির বুকে চাপিয়া বসিয়াছে। পথের ধারে যাহারা দাঁড়াইয়া ছিল তাহার আরও একটু সরিয়া দাঁড়াইয়া পথ পরিষ্কার করিয়া দিল।
প্রৌঢ়া নিতাইকে বলিল—দেখ তো বাবা! আচ্ছা একগুঁয়ে মেয়ে!
নিতাইও বাহির হইয়া আসিল। চারিদিকে চাহিয়া সে বসন্তর সন্ধান করিল। মনে মনে এই মেয়েটির কাছে সে হার মানিয়াছে। ‘শিমুল’ ফুল বলা তাহার অন্যায় হইয়াছে—অন্যায় নয়, অপরাধ। নূতন গানের কলি তাহার মনের মধ্যে গুনগুনানি আরম্ভ করিয়াছে। কিন্তু বসন্ত গেল কোথায়? ঝুমুর দলের বাসা তো এই বটগাছতলা। গাছতলাটায় একখানা চ্যাটাইয়ের উপর বসিয়া আছে একটা পুরুষ—দলের মধ্যে শক্তিশালী পুরুষটা। মহিষের মত প্রচণ্ড আকার, তেমনি কালো, রাঙা গোল চোখ; বোবার মত নীরব; তৃষ্ণার্ত মহিষ যেমন করিয়া জল খায়—তেমনি করিয়া মদ খায়, সারাদিন শুইয়া থাকে, সন্ধ্যার পর হইতে পড়ে তাহার জাগরণের পালা। আগুন জালিয়া আগুনের সম্মুখে বসিয়া লোকটা জিনিসপত্র আগলাইতেছে। সেখানে নিতাই দেখিল বসন্ত নাই। সে জ্যোৎস্নালোকিত চারিদিকে দৃষ্টি প্রসারিত করিল। এ কি! তাহার বাসার দরজায় কয়জন লোক দাঁড়াইয়া কেন? সে আগাইয়া আসিয়া প্রশ্ন করিল—কে?
—আমরা।
নিতাই চিনিল, ব্যাপরী কাসেদ সেখের ছেলে—নয়ান ওরফে ননাইয়ের দল। সে প্রশ্ন করিল—কি? এখানে কি?
—মেয়েট তোর বাসায় এসে ঢুকেছে।
—এসেছে তা’—তোমরা দাঁড়িয়ে কেনে?
দলকে দল অট্টহাসি হাসিয়া উঠিল।
নিতাই বলিল—যাও তোমরা এখান থেকে। নইলে হাঙ্গামা হবে। আমি রাজাকে ডাকব, কনেস্টবল আছে—তাকে ডাকব। নয়ান সেথ নিতাইকে গ্রাহ্য করে না, কিন্তু রাজাকে গ্রাহ্য করে; সে তবুও বলিল—শোন্‌ না, তোকে বকশিশ করব। নেতাই!
নিতাই একটা অবজ্ঞার দৃষ্টি হানিয়া বাড়ী ঢুকিয়। দরজা বন্ধ করিয়া দিল। কিন্তু কোথায় বসন্ত? কোখাও তো নাই। কিন্তু ঘরের দরজার শিকল খোলা। দরজায় হাত দিয়া সে দেখিল—হ্যাঁ, দরজা ভিতর হইতে বন্ধ।
নিতাই ডাকিল-ওহে ভাই, শুনছ। আমি–আমি।
—কে?
—তোমার ‘কয়লা-মাণিক’।
—কে! ওস্তাদ?
—ওস্তাদ কি ফোস্তাদ যা বল তুমি।
এবার দরজাটা খুলিয়া গেল। নিতাই ঘরে ঢুকিয়া দেখিল—বসন্ত ততক্ষণে আবার শুইয়া পড়িয়াছে। তাহারই বিছানাট পাড়িয়া দিব্য আরাম করিয়া শুইয়াছে। বসন্তই বলিল— দরজাটা বন্ধ ক’রে দাও।
—বাইরের দরজা বন্ধ আছে।
—পাচিল টপকে ঢুকবে ভাই—বন্ধ কর। বসন্ত ক্লান্ত অথচ বিচিত্র হাসি হাসিল। নিতাই তাহার কপালে হাত দিয়া চমকাইয়া উঠিল—এ কি? এ যে অনেকটা জ্বর!
—মাথাটা একটু টিপে দেবে?
হাসির নিতাই মাথা টিপিতে বসিল। বসন্ত হাসিয়া বলিল–না, তুমি কোস্তাদ নও, ভাল ওস্তাদ—গানখানি কিন্তুক খাসা। তোমার বাঁধা?
—হ্যাঁ। কিন্তু ও গানটা বাতিল করে দিলাম!
—কেনে? চোখ বন্ধ করিয়াই বসন্ত প্রশ্ন করিল।
—ওটা আমার ভুল হয়েছিল।
মেয়েটি কোন উত্তর দিল না, শুধু একটু হাসিল।
—আবার নতুন গান বাঁধছি। সে গুন গুন করিয়া আরম্ভ করিল—

“করিল কে ভুল, হ্যায় রে!
মন-মাতানো বাসে ভ;রে দিয়ে বুক
করাত-কাঁটার ধারে ঘেরা কেয়াফুল।”

বসন্তর মুখে নিঃশব্দ মৃদু হাসি দেখা দিল, বলিল—তারপর?
—তারপর এখনও হয় নাই।
–গানটি আমাকে নিকে দিয়ে।
—আমার গান তুমি নিকে নেবে? গাইবে?
–হ্যাঁ।
জানালার দিকে চাহিয়া নিতাই বলিল—আজই শেষ করব –কে? কে?
জানালার পাশ হইতে কে সরিয়া যাইতেছে! বসন্ত হাসিয়া বলিল—আবার কে! যত সব নরুকেদের দল।
নিতাই কিন্তু ওই কথা মানিয়া বসিয়া থাকিতে পারিল না। তাড়াতাড়ি আসিয়া জানালার ধারে দাঁড়াইল। সে যাহা দেখিয়াছে সে-ই জানে। হ্যাঁ—ওই যে দুধবরণ কোমল জ্যোৎস্নার মধ্যে মানুষটি রেল লাইনের দিকে চলিয়াছে। দ্রুত চলন্ত কাশফুলের মত চলিয়াছে। মাথায় কেবল স্বর্ণবিন্দুটি নাই। ঠাকুরঝি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *