১০. হিন্দুসমাজে গণিকার স্থান

১০. হিন্দুসমাজে গণিকার স্থান

বিবাহ বহিভূত যৌন সংসর্গের মধ্যে গণিকাবৃত্তি এক বিশেষ স্থান অধিকার করে। গণিকা বলতে আমরা সেই স্ত্রীলোককে বুঝি যে স্ত্রীলোক অর্থের বিনিময়ে পুরুষনির্বিশেষে যৌনমিলনে রত হয় বা নিজের দেহ সমর্পণ করে।

অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে গণিকাবৃত্তি প্রচলিত হয়ে এসেছে। রামায়ণ ও মহাভারত—এই উভয় মহাকাব্যেই গণিকার উল্লেখ আছে। বস্তুত প্রাচীন ভারতের নাগরিক জীবনে গণিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকাব করতো। নাচ-গান করবার জন্য উৎসবের সময় প্রায়ই তাদের ডাকা হতো। পুরাণে উক্ত হয়েছে যে, গণিকা দর্শনে দিন ভাল যায়। বিষ্ণুস্মৃতিতে বলা হয়েছে যে যদি কেহ যাত্রায় শুভ চায় তা হলে সে যেন নিশ্চয় গণিকার মুখ দেখে বের হয়। এ ছাড়াও গণিকার প্রাচীন ভারতে মর্যাদাপূর্ণ স্থান অধিকাব করতো ও উৎসব উপলক্ষে তাদের বসবার জন্য বিশিষ্ট আসন দেওয়া হতো। মহাভারতে উল্লিখিত হয়েছে যে উৎসবের সময় তারা রক্তবর্ণ বস্ত্র, মালা ও স্বর্ণালঙ্কার পরতো। উৎসবে যোগদান ছাড়া যুদ্ধের সময়ও তারা সৈন্যবাহিনীর অনুচারিণী হতো। রাজা-রাজড়ারাও অনেক সময় তাদের প্রাসাদ অভ্যন্তরে রাখতেন । এ ছাড়া ভিন্ন দেশীয় কোন নৃপতি এলে বারাঙ্গনার নগরের বাইরে গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করে আনতো। তাছাড়া আগন্তুক অতিথি রাজার অধিকার থাকতো সম্পূর্ণ মুক্তভাবে গণিকাদের গৃহে গমন বা প্রবেশ করবার। এক কথায় প্রাচীন ভারতের সামাজিক জীবনে গণিকার বিশেষ গৌরবময় ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান ছিল।

একদিকে যেমন মহাকাব্যসমূহে বারাঙ্গনাদের গৌরবময় চিত্র অঙ্কিত করা হয়েছে অপরদিকে আবার স্মৃতিকাররা তাদের নিন্দ করে গেছেন। বৃহস্পতি (২২৯ ) তাদের প্রবঞ্চক ও জুয়ারীদের সঙ্গে একই শ্রেণীভুক্ত করেছেন। অন্য স্মৃতিকাররাও তাদের প্রবঞ্চক ও তস্কর বলে অভিহিত করেছেন। মনু বলেছেন যে, ব্রাহ্মণ কিংবা গৃহস্থব্যক্তির পক্ষে তাদের কাছ থেকে দান কিংবা ভক্ষদ্রব্য গ্রহণ করা দুষণীয়। একথাও বলা হয়েছে যে, ব্রাহ্মণ কখনও গণিকাগৃহে গমন করবে না এবং যদি যায় তাহলে তাকে কৃচ্ছসাধন করে পুত হতে হবে। পরাশর ( ৯|১০|১২ ) ও মহানির্বাণ তন্ত্রে ( ৪০৪৩ ) বলা হয়েছে যে গণিকার সঙ্গে যৌনমিলন ও পুংমৈথুন একই শ্রেণীভুক্ত। গৌতম (২২২৩ ) বলেছেন যে, যদি কেহ কোন বারাঙ্গনাকে হত্যা করে তবে তার জন্য তাকে কোন শাস্তি পেতে হবে না ।

স্মৃতিকাররা নির্দেশ দিয়েছেন গণিকারা যেন তাদের বৃত্তি সম্মানের সঙ্গে অনুসরণ করে। যাজ্ঞবল্ক (২।২৯২) বলেছেন যদি কোন বারাঙ্গন কোন ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করে এবং পরে তার সঙ্গে যৌন মিলনে অনিচ্ছুক হয় তা হলে তাকে গৃহীত অর্থের দ্বিগুণ প্রত্যপণ করতে হবে। অগ্নিপুরাণও তার প্রতিধ্বনি করে অনুরূপ বিধান দিয়ে বলেছে যে, দ্বিগুণ অর্থ প্রত্যপণ করা ছাড়া তাকে রাজকোষেও কিছু অর্থ দণ্ড দিতে হবে। কৌটিল্যওকোন কোন ক্ষেত্রে অর্থ প্রত্যপণ করবার কথা বলেছেন। কৌটিল্য আরও বলেছেন যে যদি কোন গৃহীত ব্যক্তির সহিত কোন গণিকার বিবাদ হয় তা হলে প্রধান গণিকা ওই বিবাদের মীমাংসা করে দেবে।

তন্ত্রে গণিকাদের এক প্রশস্ত স্থান দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, চক্রপূজায় পাঁচ শ্রেণীর গণিকা শক্তি বা দেবীর স্থান অধিকার করতে পারে। এই পাঁচ শ্রেণীর গণিকার নাম দেওয়া হয়েছে রাজবেশ্যা, নাগরী, গুপ্তবেশ্যা, দেববেশ্যা ও ব্ৰহ্মবেশ্যা বা তীর্থগ।

এথেকে প্রকাশ পাচ্ছে যে প্রাচীনকালে গণিকাদের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ ছিল। রাজবেখ্যা বলতে বুঝাতে রাজার দ্বারা অনুগৃহীত গণিকা, নাগরী বলতে বুঝাতে নগরবাসিনী গণিকা, গুপ্তবেশু বলতে বুঝাতে সদ্বংশীয় নারী, যে গোপনে অভিসার করে, দেববেশু বলতে মন্দিরের দেবদাসীদের বুঝাতো এবং ব্রহ্মবেশুদ বা তীর্থগ বলতে বুঝাতো তীর্থস্থানে যারা গণিকাবৃত্তি করতো।

উপরের এই বিবরণ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, জগতের অন্যান্য জাতির তুলনায় একমাত্র হিন্দুদেরই গণিকার প্রতি একটা অমুকুল মনোভাব ছিল, যদি গণিকারা সম্মান ও শ্লীলতার সঙ্গে তাদের বৃত্তির অনুশীলন করতো। এই কারণে প্রাচীন ভারতে গণিকাদের বিষয় নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এরূপ রচয়িতাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন দত্তক। দত্তক পাটলিপুত্র নগরেব বারাঙ্গনাদের সম্বন্ধে তার গ্রন্থ রচনা করেছিলেন । দত্তকের ওই রচিত গ্রন্থ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার গ্রন্থের সারাংশ বাৎসায়ণ র্তার কামসূত্র গ্রন্থের মধ্যে নিবদ্ধ করেছিলেন। যদিও এই বিববণ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারের তথাপি গণিকাদের সম্পর্কে এরূপ বিশদ বিবরণ প্রাচীন সাহিত্যে আর কোথাও পাওয়া যায় না। কামসূত্রের এই বিবরণের কিছু কিছু অংশ নীচে দেওয়া গেল।

গণিকা তার বৃত্তির অনুশীলন করে কেবল যে যৌনসুখ লাভ করে তা নয়, সে এর দ্বারা নিজের জীবিকাও অর্জন করে। গণিকা সুসজ্জিত ও সালস্কৃত হয়ে উপবিষ্ট থাকবে তার গৃহদ্বারে এবং নিজেকে অধিকমাত্রায় প্রকট বা প্রদর্শন না করে পথের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকবে যে জুর উপর পথচারীদের দৃষ্টি পড়বে। বারাঙ্গনাদের কী কী লক্ষণ থাকা দরকার সে সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, তাকে সুন্দরী, মিষ্টভাষিনী ও সুলক্ষণ হতে হবে। অপরের অর্থের প্রতি যে তার লোভ থাকবে তা নয়, অপরের গুণের প্রতিও তার অনুরাগ থাকা চাই ও অপরের সঙ্গে প্রেম ও সঙ্গম করে তার আনন্দ পাওয়া চাই যেসব ব্যক্তিকে সে মনোরঞ্জনের জন্ত গ্রহণ করবে না সে সম্বন্ধেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরূপ ব্যক্তির অন্তৰ্ভুক্ত হচ্ছে, ক্ষয়রোগাক্রান্ত ব্যক্তি অসুস্থ ব্যক্তি, যে ব্যক্তির শ্বাসপ্রশ্বাস ও মুখ থেকে পুরীষের মত দুৰ্গন্ধ নির্গত হয়, লোভী ব্যক্তি, নিষ্ঠুর ব্যক্তি, তস্কর, অধিকমাত্রায় আত্মগৰ্বী ব্যক্তি, তুকতাকে পারদর্শী ব্যক্তি, যে ব্যক্তি অপরকে সম্মান প্রদর্শন করতে জানে না, যে ব্যক্তি নিজ শত্রু দ্বারা ও অর্থের দ্বারা বশীভূত হয় এবং যে ব্যক্তি অত্যন্ত লজ্জাশীল। আগত ব্যক্তিকে কিভাবে আপ্যায়ন করবে সে সম্বন্ধে বলা হয়েছে, প্রমোদকারী যখন তার গৃহে আসবে সে তখন তাকে তাম্বুল, মাল্য ও সুগন্ধ দ্রব্য দ্বারা সংবৰ্দ্ধনা করবে, তাকে শিল্পকলায় নিজের পারদর্শিতা দেখাবে, তার সঙ্গে আলাপনে নিযুক্ত থাকবে, পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে উপহার বিনিময় করবে এবং যৌনকর্মে নৈপূণ্য দেখাবে। আচার্যগণ বলেন, পরিচিত প্রমোদকারীর পরিবর্তে সম্পূর্ণ অপরিচিত প্রমোদকারীকেই সে সব সময় নির্বাচন করবে। আচার্যগণের এই উক্তি উদ্ধৃত করে বাৎসায়ণ বলেছেন যে, যেহেতু পরিচিত প্রমোদকারী অপেক্ষা অপরিচিত প্রমোদকারীর কাছ থেকে অধিক পরিমাণ অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে সেই হেতু অপরিচিত প্রমোদকারীকেই তার পছন্দ করা উচিত|

গণিকাবৃত্তি হিন্দুযুগ থেকে আরম্ভ করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত চলে এসেছে। যদিও ইংরাজরা গণিকাবৃত্তিকে খুব আনুকুল্যের দৃষ্টিতে দেখতেন না তথাপি তাঁরা এর বিলোপের কোন চেষ্টা করেন নি। তবে গণিকাবৃত্তির জন্য বিদেশী মেয়ে যাতে এদেশে না আসে তার প্রতি তাঁরা সযত্ব ছিলেন ।

বর্তমানে ভারতীয় দণ্ডবিধি আইন অনুযায়ী ১৮ বৎসরের কম বয়স্ক মেয়েদের দ্বারা গণিকাবৃত্তি করানো অপরাধ। এ ছাড়া অনেক জায়গায় বেশ্যালয় সংরক্ষণও অপরাধ বলে গণ্য হয়। আরও অনেক বিষয় দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করার জন্য আইন রচিত হয়েছে। এ সকল অপরাধের অন্তভুক্ত হচ্ছে—রাস্তায় বা প্রকাশ্যস্থানে দাড়িয়ে খরিদ্দার আহ্বান করা, গণিকার আয়ের উপর জীবিকা নির্বাহ করা, গণিকাবৃত্তির জন্য স্ত্রীলোক সংগ্রহ করা, অসৎ উদ্দেশ্যে স্ত্রীলোককে আটক রাখা, প্রকাশ্যস্থানে গণিকাবৃত্তির অনুশীলন করা, বেশ্যলয় রক্ষণ বা পরিচালনা করা, বেশ্যালয় হিসাবে ব্যবহারের জন্য বাড়ী ভাড়া দেওয়া এবং নিষিদ্ধ অঞ্চলে গণিকাবৃত্তির অনুশীলন করা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *