০৮. বিবাহ-পূর্ব যৌন সংসর্গ

০৮. বিবাহ-পূর্ব যৌন সংসর্গ

হিন্দুদের মধ্যে বিবাহের পূর্বে যৌন সংসর্গ কখনও বরদাস্ত করা হয়না। আগেকার দিনে এরূপ ঘটনা ঘটলে বাপ-মায়ের জাত যেতে এবং সে মেয়ের কখনও বিয়ে হতে না । এটাই ছিল হিন্দুসমাজের প্রতিষ্ঠিত রীতি। আজকালকার দুর্নীতির দিনে বাপ-মাকে আর এরূপ দণ্ডভোগ করতে হয় না এবং মেয়েকেও অবিবাহিতা থাকতে হয় না।

আদিবাসীসমাজের কথা অবশ্য ভিন্ন। আদিবাসীসমাজের অনেকস্থলে বিবাহের পূর্বে ছেলেমেয়েদের পরস্পরের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করবার সুযোগ ও সুবিধা দেওয়া হয়। এর জন্য অনেক উপজাতির মধ্যে ছেলেমেয়েদের রাত্রিযাপনের জন্য “ঘুমঘর” আছে । ঘুমঘরগুলি সাধারণত দুরকমের হয়। ছেলে ও মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র ঘুমঘর ও ছেলেমেয়েদের একত্রে রাত্রিযাপনের যৌথ ঘুমঘর। স্বতন্ত্র ঘুমঘরগুলি নানাবিধ দক্ষতালাভের প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসাবে কাজ করে। আর যৌথ ঘুমঘরগুলি তরুণীদের যৌনচর্চার দক্ষতা অর্জনের সংস্থা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যপ্রদেশের গোগুদের মধ্যে প্রচলিত ঘুমঘরগুলিকে “ঘোটুল” বলা হয়। মুণ্ড ও বিরহোররা এগুলিকে “গিতিওড়া” বলে। আসামের গাড়োরা এগুলিকে “লোকপাণ্ডে” বলে । নাগাদের মধ্যে এগুলিকে বলা হয় “মোরাং” । যৌথ ঘুমঘরগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে মুরিয়াদের মধ্যে প্রচলিত ঘোটুল। ঘুমঘর পশ্চিম বঙ্গ ও বিহারের সাওতালদের মধ্যে, বিহারের ওরাওদের মধ্যে, ওড়িষ্যার খরিয়া, জুয়াঙ, খণ্ড ও ভুঁইয়াদের মধ্যে এবং ত্রিবাঙ্কুরের মুড় বন, মায়ান ও পালিয়ানদের মধ্যেও বিদ্যমান আছে। অনেক জায়গায় এগুলি মাত্র বিলীয়মান প্রথার চিহ্নমাত্র বহন করছে।

মুরিয়াদের মধ্যে বিদ্যমান ঘোটুল পূর্ণবিকশিত ঘুমঘরের প্রতীক । এদের মধ্যে ঘোটুল সাধারণত নির্মিত হয় গ্রামের কেন্দ্রস্থলে, কাঠের খুটির দ্বারা পরিবেষ্টিত এক প্রাঙ্গণের মধ্যে। ঘোটুলের মধ্যে দাওয়া বিশিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় গৃহ থাকে এবং ইহার সংলগ্ন ছোট ছোট অনেকগুলি ঘর থাকে। ঘোটুলের ভেতরটায় নানারকম চিত্র অঙ্কিত ও খোদিত থাকে। অনেকস্থলেই এ সকল চিত্র যৌন অর্থব্যঞ্জক। মাঝখানের কাঠের খুটিটির গায়ে একটি বৃহদাকার স্ত্রীযোনি খোদিত থাকে। আবার কোন কোন জায়গায় প্রকাণ্ডাকার পুরুষাঙ্গবিশিষ্ট এক তরুণ এক তরুণীকে আলিঙ্গন করে ধরে আছে এইরূপ চিত্র অঙ্কিত থাকে।

ঘোটুলের ছেলেদের বলা হয় “চেলিক” আর মেয়েদের বলা হয় “মতিয়ারি”। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর সমস্ত ছেলেমেয়ে ঘোটুলে এসে সমবেত হয়। ঘোটুলে প্রথম প্রবেশ ( বা দীক্ষা ) উপলক্ষে কোন অনুষ্ঠান পালিত হয় না। তবে ঘোটুলের সদস্যভুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক । সকুল ছেলেমেয়েকেই ঘোটুলে প্রবেশ করতে হয়। কোন কারণেই কাহাকেও অব্যাহতি দেওয়া হয় না। ঘোটুলের নিয়মানুবর্তিত হচ্ছে খুব কঠোর। এই কারণে ঘোটুলের নিয়ম-কানুন কেউ অগ্রাহ করতে সাহস করে না। ঘোটুলের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ একজনকে দলপতি নির্বাচিত করা হয় । তাকে বলা হয় “শিলাদার” বা “চালাও”। সেই ঘোটুলের ছেলেমেয়েদের মাতববর হিসাবে কাজ করে। চেলিক ও মতিয়ারিদের সেই পরিচালনা করে।

ঘোটুলের মধ্যে রকমের নিয়মানুবর্তিত দেখা যায়। প্রথম রকমের নিয়মানুবর্তিত অনুযায়ী কোন বিশেষ ছেলে কোন বিশেষ মেয়ের সঙ্গে “জুরিদার” সম্পর্ক স্থাপন করে। তারা বিবাহিতের ভণিতা নিয়ে বাস করে, তবে যে কোন সময় তারা এ সম্পর্ক চ্যুত করতে পারে। তবে যতদিন তারা “বিবাহিত” থাকে ততদিন তাদের পক্ষে ব্যভিচার দণ্ডনীয় হয়। দ্বিতীয় রকমের নিয়মানুবর্তিত অনুযায়ী যে কোন ছেলে যে কোন মেয়ের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, তবে পরপর তিনদিনের বেশী যদি কেউ কোন মেয়ের সঙ্গে এক বিছানায় শয়ন করে তবে তার জন্য তাকে দণ্ড পেতে হয়। যেখানে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে “জুরিদার” সম্পর্ক স্থাপিত হয় সেখানে প্রায়ই দেখা য়ায় যে তাদের মধ্যে সম্পর্ক স্থায়ী হয়। তবে প্রকৃত .বিবাহের বয়স হলে তাদের নিয়মানুগ বিবাহ করতে হয়।

ঘোটুলের দ্বিতীয় রকমের সম্পর্ককে “মুণ্ডি বদলানা” বলা হয়। এ সম্পর্ক কখনও স্থায়ী হয় না, কেননা কোন ছেলে পরপর তিনদিনের বেশী কোন মেয়েকে নিজের অধিকারে রাখতে পারে না। যদি রাখে তা হলে সেটা ব্যভিচার বলে গণ্য হয়। ভবিষ্যতে অপরের সঙ্গে বিবাহের প্রস্তুতি হিসাবে স্থায়ী সম্পর্ক ভাল নয় বলে মনে করা হয়। তারা বলে যে “বিবাহের আগে অধিক প্রেম মানে বিবাহের পর স্বল্প প্রেম”। এছাড়া মুরিয়ার আরও বিশ্বাস করে যে অনবরত জুরিদার পরিবর্তন করলে যৌনসংসর্গে সন্তানবতী হবার সম্ভাবনা কম থাকে। কার্যক্ষেত্রে শিলাদার বা চালাও প্রত্যেক ছেলের জন্য মেয়ে নির্বাচন করে দেয়। ঘোটুলের একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, কী সুন্দরী, কী কুৎসিত সকল মেয়েই সমান অধিকার পায় যৌন চর্চার জন্য। ছেলেদের পক্ষেও ঠিক তাই প্রযোজ্য।

ঘোটুলের মধ্যে কেহ ব্যভিচার করলে তাকে ঘোটুল থেকে বহিস্কৃত করে দেওয়া হয়। ঘোটুল থেকে বহিস্কৃত ছেলে বা মেয়ের প্রকৃত বিবাহের সময় কোন নাচ-গান করা হয় না। মুরিয়াদের মধ্যে বিবাহে নাচ-গানের ভূমিকা এত গুরুত্বপূর্ণ যে বিবাহের সময় নাচ-গান না হলে সেটা গুরুতর শাস্তি বলে ধরা হয়। এ ছাড়া অন্য রকমের শাস্তিও আছে। যেমন, ব্যভিচারিণী মেয়ের যোনির মধ্যে ছাই ভরে দেওয়া হয়।

ঘোটুলের কোন মেয়ের বিবাহের পর তাকে আর ঘোটুলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কিন্তু বিবাহের আগে যেদিন সে ঘোটুল থেকে শেষবারের মত বিদায় নেয় সেদিন তাকে ঘোটুলের সমস্ত ছেলের চিত্তবিনোদন করতে হয়। ছেলেদের বেলায় কিন্তু নিয়ম স্বতন্ত্র। বিবাহের পর যতদিন না ঘোটুলের সমস্ত সদস্যদের সে ভোজ দেয় ততদিন তাকে ঘোটুলে আসতে দেওয়া হয়। তবে এরূপ ভোজ সাধারণত তিন চার মাসের মধ্যেই দেওয়া হয়। ভোজ দেওয়৷ হয়ে গেলে তাকে চিরদিনের মত ঘোটুল থেকে বিদায় নিতে হয়।

ঘোটুলের প্রচলন সম্বন্ধে মুরিয়ার নানা রকম যুক্তি দৰ্শায়। তার মধ্যে প্রধান যুক্তি হচ্ছে, ছেলে-মেয়েদের সামনে বাপ-মায়ের যৌন ক্রিয়া করা পাপ। সেইহেতু যখনই ছেলেমেয়ে যৌন ক্রিয়ার অর্থ বুঝতে পারে তখনই তাকে ঘোটুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যদি কোন কারণে রাত্রে কোন মেয়ে ঘোটুল থেকে বাড়ীতে ফিরে আসে এবং বাপ-মাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় দেখে তবে তার বাপ-মা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে তিরস্কার করে বলে “তোর কি ঘোটুল নেই, তুই কিজস্য এখানে এসেছিস ?”

বাপ-মায়ের যৌনজীবন ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে গোপন রাখা ছাড়া ঘোটুলের অপর উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, উত্তরকালে ছেলে-মেয়ের যৌনজীবন যাতে সার্থকতা ও পূর্ণতা লাভ করতে পারে সে সম্বন্ধে ঘোটুল প্রস্তুতি শিক্ষা দেয়।

ঘোটুলের ছেলেমেয়েদের পক্ষে সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে, ঘোটুলের ভেতর কী ঘটেছিল তা ঘোটুলের বাইরে কারুকে বলা । সেজন্য তাদের বিশ্বাস যে তারা ঘোটুলের ভেতর কী করেছে বা না করেছে তা তাদের বাপ-মা কেউ টের পায় না । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাপ-মা সবই জানে। তবে পরস্পরের কাছে প্রকাশ করাটা দূষণীয় বলে মনে করে। এর জন্য ঘোটুলের উপর ছেলেমেয়েদের আস্থা দৃঢ়তর হয়। এই কারণে ঘোটুলের মধ্যে অজাচারের জন্য কোন দণ্ড দেওয়া হয় না। কিন্তু এরূপ অজাচারের ফলে যদি ঘোটুলের কোন মেয়ে সস্তানবতী হয় তা হলে ঘোটুলের ভেতরে ও বাইরে উভয় স্থানেই তাকে দণ্ড দেওয়া হয়।

ঘোটুলের মধ্যে মেয়ে থাকাকালীনই মুরিয়া পিতামাতা অপরের সঙ্গে তার বিবাহ দেওয়া সম্বন্ধে বাগদান করে। যেখানে বাগদত্ত কোন মেয়ে ঘোটুলের মধ্যে সস্তানবতী হয় সেক্ষেত্রে যাকে বাগ দান দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গেই তার বিবাহ দেওয়া হয় এবং তাকেই সন্তানের পিতা বলে গণ্য করা হয়। ’

এখানে একথা বলা দরকার যে বিবাহের পূর্বে মেয়ের গর্ভবতী হওয়া মুরিয়ারাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে অশোভনীয় নয়। মুরিয়ারা বলে, “হাতী যখন মোটা মোট চারটে পা থাকা সত্ত্বেও হোচট খায় তখন ছোট ছোট মেয়েদের কা কথা ।”

অবশ্য ঘোটুলের মধ্যে গর্ভ হওয়া খুব বিরল ঘটনা। এ সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, ঘোটুলের মধ্যে তরুণ-তরুণী ঘনঘন যৌন সঙ্গম করা সত্ত্বেও গর্ভ হয় না কেন ? এ সম্পর্কে মুরিয়ারা বলে যে, তাদের দুই দেবতা “লিঙ্গ পেন” ও “ধরিত্রী দেবী” মেয়েদের গর্ভবতী হওয়া থেকে তাদের রক্ষা করে। তবে কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় যে ঋতুর পর যে সময়ট গর্ভধারণের পক্ষে প্রশস্ত সে সময়টা তাৰা যৌনসঙ্গমের জন্য পরিহার করে। তাছাড়া ঘনঘন জুরিদার পরিবর্তনও গর্ভধারণের বিরোধী। এ সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা বলেন যে কৈশোরে মেয়েদের বয়ঃসন্ধির পূর্বে এমন একটা সময় আছে, যে সময় তাদের গর্ভধারণ শক্তি থাকে না। বাস্তবক্ষেত্রে প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় যে প্রথম ঋতুসঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গেই মেয়ের গর্ভধারণ করে না। প্রথম ঋতুসঞ্চারের সময় থেকে গর্ভধারণ করবার শক্তি অর্জন করা পর্যন্ত কিছুকালের জন্য একটা সময়ের ব্যবধান থাকে। এই কারণেই ঘোটুলের মেয়েদের মধ্যে খুব কম মেয়ে গর্ভবতী হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *