প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

২৪. কৃষি-আবিষ্কার ও মাতৃপ্রাধান্য

২৪. কৃষি-আবিষ্কার ও মাতৃপ্রাধান্য

এরেনফেলস-এর রচনা থেকে উদ্ধৃত অংশটিতে দেখতে পাওয়া যায়, মেয়েদের পক্ষে কৃষি-বিদ্যা আবিষ্কার হওয়ার কথা এবং মাতৃপ্রধান সমাজের কথা তিনি এক-নিঃশ্বাসে একই সঙ্গে বলছেন। তার কারণ, এই কৃষিবিদ্যা আবিষ্কারের ফলে সমাজ-সংগঠনে এক মৌলিক পরিবর্তন দেখা দেয়। পরিবর্তনটি হলো, (সাময়িকভাবে) পিতৃপ্রাধান্যের বা পুরুষপ্রাধান্যের পরিবর্তে মাতৃপ্রাধান্য বা নারীপ্রাধান্যের প্রবর্তন।
লোকায়তিকের যেহেতু বার্তাকেই একমাত্র বিদ্যা বলে ঘোষণা করছে সেইহেতু এই লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস-সন্ধানে বার্তা-বিদ্যা আবিষ্কারের সঙ্গে সমাজে মাতৃপ্রাধান্যের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা তুলতে মরা বাধ্য। এবং আমরা আশা করতে পারি যে, এইদিক থেকে আমাদের মূল সমস্যাটির উপর কিছুটা আলোকপাত হবার সম্ভাবনা আছে। কেননা প্রাচীনেরা বলেছেন, লোকায়তিক ধ্যানধারণার সঙ্গে ভান্ত্রিক ধ্যানধারণার সম্পর্ক ছিলো এবং এই তান্ত্রিকেরা শাক্ত—তন্ত্র-সাহিত্যে প্রধান বলতে শক্তিই—অর্থাৎ নারীই। তাই, এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে, এই ধ্যানধারণাগুলির মধ্যে মাতৃপ্রধান সমাজেরই প্রতিবিম্ব খুঁজে পাওয়া যাবে। বস্তত, শ্রদ্ধেয় রমাপ্রসাদ চন্দ (৩৩১) প্রমুখ কোনো কোনো বিদ্বান ইতিপূর্বেই উক্ত সিদ্ধান্তে পৌছোবার চেষ্টা করেছেন :

…it may be assumed that Saktism arose in India under the same social conditions as those under which Astarte was conceived in Syria, Cybele in Asia Minor, and Isis in Egypt. Regarding the origin of Astarte, Professor Paton writes: “There is a large body of evidence to show that the Semites before their separation passed through a matriarchal stage of society. In such a society the chief deity of the tribe must have been conceived as a counterpart of the human matriarch…This view is confirmed by the fact that all those traits which are oldest and most permanent in the character of Ashtart-Ishtar are those which for other reasons we must predicate of the ancient Semitic tribal mother.” In Asia Minor, the home of the cult of the Great Mother Cybele, matriarchate,…a social system which traces descent and transmits property through women and not through men, “lingered in Lycia down to historical period; and we may conjecture that in former times it was widely spread through Asia Minor” (Frazer). In Egypt, the home of Isis, “the archaic system of mother-kin, with its preference for women over men in matters of property and inheritance, lasted down to Roman times” (Frazer)…… The Sakta conception of the Devi as Adyasakti, ‘the primordial energy,’ and Jagadamba, ‘the mother of the universe,’ also very probably arose in a society where matriarchate or mother-kin was prevalent.
অর্থাৎ, এ-কথা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, সিরিয়ায় যে-সামাজিক অবস্থায় অস্টারটি দেবীর আবির্ভাব হয়েছিলো, এলিয়া-মাইনরে আবির্ভাব হয়েছিলো সিবেলি দেবীর, ইজিপ্ট-এ আইসিস-এর,—সেই সামাজিক পরিস্থিতিতেই ভারতবর্ষে আবির্ভাব হয়েছিলো শক্তিবাদের। অস্টারটি দেবীর আবির্ভাৰ প্রসঙ্গে অধ্যাপক পেটন লিখছেন, “সেমাইটরা বিভক্ত হয়ে যাবার আগে যে মাতৃপ্রধান সমাজের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছিলো সে-বিষয়ে বিস্তর প্রমাণ পাওয়া যায় ।…এ-জাতীয় সমাজে প্রধান দেবী ট্রাইবের প্রধান মহিষীর প্রতিরূপ হিসেবেই কল্পিত হতে বাধ্য।…এই মতবাদটির সমর্থনে দেখা যায়, এ্যাস্টার্টইস্থারের চরিত্রের সবচেয়ে আদিম ও সবচেয়ে স্থায়ী লক্ষণগুলি আসলে সেই সব চারিত্রিক লক্ষণই, যেগুলিকে আমরা অন্যান্য কারণে প্রাচীন সেমিটক ট্রাইবের মাতার চারিত্রিক লক্ষণ বলেই চিনে থাকি।” সিবেলি দেবীর দেশ এসিয়া মাইনরে দেখা যায় মাতৃপ্রাধান্য, অর্থাৎ কিনা যে-সামাজিক ব্যবস্থায় মায়ের দিক থেকে বংশ-নির্ণয় হয় এবং উত্তরাধিকারস্বত্র নারীগত হয়, –এই প্রথা “ঐতিহাসিক যুগ পর্যন্ত লিসিয়ায় বর্তমান ছিলো; এবং আমরা অনুমান করতে পারি যে, আগেকার যুগে সারা এসিয়া-মাইনর জুড়ে এই ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো (ফ্রেসার)”। আইসিস্ দেবীর দেশ ইজিপ্ট-এ “মায়ের দিক থেকে জ্ঞাতি-নির্ণয়ের আদিম ব্যবস্থা,—যে-ব্যবস্থা অনুসারে সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকার ব্যবস্থায় পুরুষদের বদলে মেয়েরাই প্রধান,—রোমান যুগ পর্যন্ত টিকে ছিলো (ফ্রেসার )।”… শাক্ত-মতে দেবীকে যে আদ্যাশক্তি ও জগদম্বা মনে করা হয় তার উৎসও খুব সম্ভব মাতৃপ্রধান সমাজেই।

আমাদের ধারণায়, শাক্ত মতবাদের উৎস সংক্রান্ত এমন প্রগাঢ় অনুমান আধুনিক বিদ্বান মহলে আর কারুর রচনায় দেখতে পাওয়া যায় না। তন্ত্রের গৃঢ়তম তাৎপর্য আলোচনার নামে একান্ত একালের ধ্যানধারণাকে সেকালের ধ্যানধারণার উপর আরোপ করবার পণ্ডশ্রম (৩৩২) না করে আধুনিক পণ্ডিতের যদি ঐযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয়ের এই নির্দেশ অনুসরণ করে তান্ত্রিক ধ্যানধারণার উৎস সন্ধানে অগ্রসর হতেন তাহলে ভারতীয় সংস্কৃতির আলোচনায় যুগান্তর আসতে পারতো। অবশ্যই স্যর জন মার্সাল (৩৩৩) হরপ্পা-মহেনজোদারোর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আলোচনার সময় ঐযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয়ের এই মন্তব্যের তাৎপর্যকে উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। সে আলোচনায় আমরা পরে প্রত্যাবর্তন করবো। তার আগে আমাদের পক্ষে প্রয়োজন মাতৃপ্রাধান্য সংক্রান্ত যে-তথ্য সাধারণভাবে জানতে পারা গিয়েছে তারই আলোচনা।
অধ্যাপক জর্জ টমসন (৩৩৪) দেখাচ্ছেন, গত শতাব্দীতে ব্যাকোফেন্‌-এর গবেষণা অনুসরণ করে নৃতত্ত্ববিদেরা প্রায় সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, আদিতে বংশপরিচয় নিয়ন্ত্রিত হতো মায়ের দিক থেকে। আজকের দিনে অধিকাংশ নৃতত্ত্ববিদই এই মতবাদটিকে বর্জন করতে চান, যদিও পালটা মতবাদ হিসেবে কোনটা যে সত্যি সে-বিষয়ে তারা একমত নন। কিন্তু রবার্ট ব্রিফল্ট ব্যাকোফেনের ওই পুরোনো মতবাদটিকেই নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেছেন; এবং সে-উদ্দেশ্যে তিনি যে-বিশাল পরিমাণ তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন তার অংশমাত্রও তাঁর বিপক্ষদের রচনায় চোখে পড়ে না। প্রসঙ্গত বলে রাখা যায়, মর্গান, মার্কস, এঙ্গেলস সকলেই ব্যাকোফেনের এই মতটি গ্রহণ করেছিলেন এবং ব্রিফল্ট নিজে ক্রমে ক্রমে বাস্তব তথ্যের প্রেরণায় মার্ক স্পন্থী হয়েছিলেন (৩৩৫)। কথাটা জরুরি। কেননা, এঙ্গেল সে-সময়ে মর্গানের মাতৃপ্রাধান্যমূলক মতবাদকে বিনা-সংশোধনে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মার্ক পন্থী ব্রিফল্ট, এবং এ-বিষয়ে ত্ৰিফণ্টকে অনুসরণ করে মার্কসপন্থী জর্জ টমসনও বিনা সংশোধনে মর্গানের সমস্ত মন্তব্য গ্রহণ করেন না (৩৩৬)। বিজ্ঞান বলেই মার্ক স্বাদ কয়েকটি কল্পিত সনাতন সত্যের গুচ্ছ নয়। বাস্তব তথ্যের তাগিদে যেখানে মর্গানের সিদ্ধান্ত এঙ্গেলস্-সমর্থিত হওয়া সত্ত্বেও সংশোধন-সাপেক্ষ সেখানে সংশোধন-প্রচেষ্টায় দ্বিধা অ-বৈজ্ঞানিক, অতএব অ-মার্কসবাদী মনোভাবের পরিচায়ক।
অধ্যাপক জর্জ টমসন লিখছেন, উনবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিকেরা মাতৃত্বসূত্রে বংশপরিচয়ের উৎস ব্যাখ্যা করতে পারেননি। মর্গানের মতে, সমাজ-বিকাশের প্রাকৃত পর্যায়ে ছিলো যৌথ-বিবাহ; এ-অবস্থায় সন্তানের পিতাকে সনাক্ত করা সম্ভব নয়, তাই সন্তানেরা মাতার গোত্রান্তর্গত হতো। কিন্তু অধ্যাপক জর্জ টমসন দেখাচ্ছেন, এ-পর্যায়ে সন্তানের ব্যক্তিগত মাতাপিতাকে সনাক্ত করবার প্রশ্ন ওঠে না। নিউ ব্রিটেনের এক আদিবাসী সগৰ্বে বলেছিলো, তার তিনজন মা আছে ; মেয়ে তিনটিও একইভাবে বলেছিলো, “আমরা তিনজনেই ওর জন্ম দিয়েছি । যৌথ-বিবাহ ভেঙে যাবার আসল কারণ, সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত অধিকার জন্মাতে শুরু হবার দরুন ব্যক্তিগতভাবে কে-কার-সন্তান তা নির্ণয় করবার প্রয়োজন হয়। তাই এখানে মর্গানের মতবাদ শুধরে নেওয়া দরকার (৩৩৭) ।
রবার্ট ব্রিফল্ট, এবং ব্রিফণ্টকে অনুসরণ করে অধ্যাপক জর্জ টমসন, যে-সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন (৩৩৮) তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন।
মানবসমাজের প্রাকৃততম পর্যায়ে যে মাতৃপ্রাধান্য ছিলো, এ-বিষয়ে মর্গানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে তাদের বক্তব্যের কোনো প্রভেদ নেই। প্রভেদ হলো, মাতৃপ্রাধান্যের কারণ কী, এবং মাতৃপ্রাধান্য কেন ধ্বংস হলো—সেই প্রশ্ন নিয়ে। মর্গান বলতে চেয়েছিলেন, এ-অবস্থায় (যৌথ-বিবাহের দরুন) পিতৃত্বনিরূপণ অসম্ভব এবং শুধুমাত্র মাতৃত্ব-নিরূপণ সম্ভবপর বলেই মাতৃপ্রাধান্যের প্রাচুর্ভাব হয়েছিলো। কিন্তু ব্রিফণ্ট দেখাতে চান, এ-অবস্থায় মানবসমাজে পুরুষ এবং নারীর মধ্যে নারীর উপরই দায়িত্ব আপেক্ষিকভাবে বেশি ছিলো এবং মাতৃপ্রাধান্যের মূল কারণ তাই। একেবারে প্রাকৃত অবস্থায় মানুষ খাদ্য-উৎপাদন করতে শেখেনি ; খাদ্য-আহরণ করে জীবন-ধারণ করতো। এবং এইভাবে খাদ্য অন্বেষণ ও আহরণ করবার ব্যাপারে পুরুষ ও নারীর মধ্যে কারুর দায়িত্ব আপেক্ষিকভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। অপরপক্ষে, নারীর উপর একটি অন্য ধরনের বিশিষ্ট দায়িত্ব ছিলো, এবং সেই দায়িত্বের গুরুত্বেই তার প্রাধান্য সম্ভবপর হয়েছিলো। এই বিশেষ দায়িত্ব হলো, শিশুপালনের দায়িত্ব। ব্রিফল্ট (৩৩৯) সুদীর্ঘভাবে আলোচনা করে দেখাচ্ছেন, মানুষের পক্ষে পশুর পর্যায় ছেড়ে আসবার একটি মূল লক্ষণ হলে, মানবশিশু বড়ো হতে বা পরিণতি পেতে অনেক বেশি সময় নেয়। পরিণতি পাবার ও বড়ো হবার জন্যে প্রয়োজনীয় এই দীর্ঘ সময়টি ধরে মানবশিশুর পক্ষে অনেক রকমের শিক্ষাদীক্ষা পাওয়ার কথা। এবং ওই শিক্ষাদানের দায়িত্ব মেয়েদেরই উপর ছিলো। তাই, অর্থনৈতিক দায়িত্বের দিক থেকে যখন পুরুষ ও নারী উভয়েই সমান (কেননা, খাদ্য-উৎপাদনের কাজ তখন শুরু হয়নি, খাদ্যআহরণের উপরই জীবনধারণ নির্ভর করতো), তখন শিশুপালনের ও শিশুকে শিক্ষা দান করবার বাড়তি দায়িত্বের দরুন দলের মধ্যে মেয়েদের একটা বাড়তি গুরুত্ব ছিলো। পুরুষেরা তখন শুধুমাত্র জন্মদাতা; কিন্তু পুরো দলটির অভ্যাস, ব্যবহারের মাপকাঠি, ঐতিহ্য,—এক কথায়, সে-পর্যায়ে মানব-সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় তার সবটুকুকেই,—রূপ দেওয়া এবং নতুন বংশের মানুষদের কাছ পর্যস্ত পৌছে দেওয়া—এ-সব ব্যাপারের ভার ছিলো মেয়েদের উপরই। তাই সামাজিকভাবে মেয়েরাই হয়ে উঠেছিলো প্রধান। বংশপরিচয়ও স্বভাবতই মায়ের দিক থেকেই।
অবস্থাটার কিন্তু পরিবর্তন হতে বাধ্য হলো, শিকার,—বিশেষ করে উন্নত পদ্ধতিতে শিকার,—করতে শেখবার পর থেকে। কেননা, শিকারই যখন প্রধানতম জীবনোপায় তখন যাদের উপর শিকারের দায়িত্ব, সামাজিকভাবে তাদেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া স্বাভাবিক। এবং শিকারজীবী পর্যায়ের আগে পর্যন্ত যে-শিশুপালনের দায়িত্ব সামাজিকভাবে মেয়েদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলো, শিকারজীবী পর্যায়ে পৌছে সেই দায়িত্বই মেয়েদের অপ্রধান করে তুললো। গর্ভাবস্থায় এবং স্তন্যদানের সময়ে, মেয়েরা নিশ্চয়ই বনে-জঙ্গলে ঘুরতে পারে না। ভাই, শিকারজীবী পর্যায়ে তারা পুরুষদের সঙ্গে সমানে-সমান হতে পারে না। শিকার প্রধানতই পুরুষদের কাজ। আর তাই, শিকারজীবী পর্যায়ের ট্রাইবেরা স্বভাবতই পুরুষ-প্রধান। আজো পৃথিবীতে যে-সব শিকারজীবী ট্রাইব টিকে আছে তাদের বেলায় দেখা যায় শিকারের দায়িত্বটা পুরুষদের উপর ; মেয়ের এ-অবস্থায় আগের মতোই খাদ্য-আহরণের কাজে লিপ্ত। তাই, আদিম মাতৃপ্রাধান্য ভেঙে যাবার কারণ সন্তানের পিতৃত্ব-নিরূপণের তাগিদ নয় ; খাদ্য-সরবরাহর দিক থেকে পুরুষদের প্রাধান্য। এই বিষয়ে তাই রবার্ট ব্রিফল্ট ও জর্জ টমসন মর্গানের মতবাদকে শুধরে নিতে চাইছেন (৩৪০) ।
পুরুষপ্রাধান্য ও নারী-প্রাধান্য—এর সঙ্গে খাদ্য-সরবরাহ ব্যবস্থায় পুরুষ ও নারীর আপেক্ষিক গুরুত্বের সম্পর্ক আছে। তাই কৃষি-আবিষ্কারের প্রাথমিক পর্যায়ে মানবসমাজে আবার সাময়িকভাবে মাতৃপ্রাধান্য দেখা দিতে বাধ্য। কেননা, আমরা আগেই দেখেছি, কৃষিবিদ্যা মেয়েদের আবিষ্কার। অর্থাৎ, এই পর্যায়ে খাদ্য-উৎপাদনের দিক থেকে পুরুষেরা প্রধান নয়, মেয়েরাই প্রধান। কিন্তু এই মাতৃপ্রাধান্য স্বভাবতই সাময়িক। যতোদিন পর্যন্ত কৃষিকাজ বলতে প্রধানতই হলো জমি কুপিয়ে ছোটো ছোটো ক্ষেত ধরনের তৈরি করা শুধু ততোদিনই কৃষিকাজের প্রধান দায়িত্ব মেয়েদের উপর। বড়ো ক্ষেতে এবং হাল-লাঙলে জানোয়ার জুতে চাষবাস শুরু করবার উন্নততর পর্যায়ে পৌছোনোর পর কৃষিকাজ আর মেয়েদের এক্তিয়ারে থাকেনি। পুরুষদের হাতে এলো। ফলে, এই পর্যায়ে আবার পিতৃপ্রাধান্যের প্রত্যাবর্তন হতে দেখা যায়।
কিন্তু তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে, সামাজিক ব্যবস্থাদিতে, এবং বিশেষ করে ধ্যানধারণার ক্ষেত্র থেকে মাতৃপ্রাধান্যের সমস্ত স্মারক সঙ্গে সঙ্গে মুছে যেতে বাধ্য হলো। বস্তুত, প্রাচীন মিশর, মহেনজোদারো প্রভৃতি দৃষ্টান্তে স্পষ্টই চোখে পড়ে যে, কৃষির উন্নতির ফলে সুবিশাল রাষ্ট্রশক্তি ও এমন কি নির্মম শ্রেণীশোষণের পর্যায়ে পৌছুবার পরও মানবসমাজে এবং মানবচেতনায় মাতৃপ্রাধান্যের খুবই স্পষ্ট ও প্রকট স্মারক টিকে থেকেছে। কিন্তু আমরা বিশেষ করে বলতে চাই, এগুলি নিয়ে আলোচনা করবার সময় স্পষ্টভাবে মনে রাখা দরকার যে, এগুলি স্মারকমাত্র। অর্থাৎ, মহেনজোদারোর নগর পত্তন, ব্যবসা, বাণিজ্য, রাষ্ট্রশক্তি প্রভৃতির পিছনে কৃষিকাজের উন্নতির যে-পর্যায়টির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে, ওই মাতৃপ্রাধান্যের চিহ্নগুলি সে-পর্যায়েরই অবদান নয়, তার চেয়ে অনেক প্রাকৃত এক পর্যায়ের অবদান,—যখন কৃষিকাজ সবে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং মেয়েরাই সে-আবিষ্কার করেছে। আমরা একটু পরেই মহেনজোদারোর শক্তিপ্রধান চিন্তাচেতনার আলোচনা তুলবো। সে-আলোচনা প্রসঙ্গে এ-কথা স্পষ্টভাবে মনে রাখতে হবে যে, প্রত্নতত্ত্বের প্রমাণে মহেনজোদারো মানব উন্নতির যে-পর্যায়ের পরিচায়ক এই শক্তিপ্রধান চিস্তাচেতনা তার অবদান নয়—তার চেয়ে অনেক পুরোনো পর্যায়ের স্মারক। অর্থাৎ, এগুলির আদি ও অকৃত্রিম তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যাবে উন্নততর কৃষিকর্মের পর্যায়ে নয় ; তার বদলে কৃষিকর্মের প্রাকৃত পর্যায়টিতেই,—যে-পর্যায়ে মেয়েরাই মানবইতিহাসের এই চরম বিস্ময়কর আবিষ্কারটি সবে করেছে।
মহেনজোদারোর কথায় পরে ফেরা যাবে। আপাতত, মাতৃপ্রাধান্যমূলক সাধারণ যুক্তিটির প্রতি দৃষ্টি আবদ্ধ রাখা যাক।
মর্গানের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলে বলা হয়, আজকের পৃথিবীতে যে ট্রাইবগুলি সবচেয়ে পিছিয়ে-পড়া অবস্থায় আটকে রয়েছে সেগুলির মধ্যে মাতৃপ্রাধান্যের পরিবর্তে পিতৃপ্রাধান্যই চোখে পড়ে ; আর যদি তাই হয় তাহলে কী করে স্বীকার করা যাবে যে, মানবসমাজের আদিমতম পর্যায়ে মাতৃপ্রাধান্যই বর্তমান ছিলো? অধ্যাপক জর্জ টমসন (৩৪১) দেখাচ্ছেন, এ-প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে বর্তমান পৃথিবীর ওই প্রাচীনতর পর্যায়ের ট্রাইবগুলির অর্থনৈতিক পরিস্থিতিটা বিশ্লেষণ করলে। আসলে এগুলি খাদ্য-আহরণ বা food-gathering পর্যায়ের ট্রাইব নয় ; শিকারজীবী পর্যায়েরই ট্রাইব । এদের মধ্যে যে পিতৃপ্রাধান্য চোখে পড়ে তার কারণ হলো এই ট্রাইবগুলির অর্থনৈতিক জীবন শিকারজীবী পর্যায়েই আটকে থেকেছে।
অপরপক্ষে মর্গানের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলে সত্যিই বলা যায়, শিকারজীবী পর্যায়ের তুলনায় অনেক উন্নততর পর্যায়ের ট্রাইব মাতৃপ্রধান হয়ে থেকেছে। দৃষ্টান্ত-স্বরূপ ভারতবর্ষের গারো ও খাসিদের কথা আপাতত না তুলেও আমেরিকার ইরোকোয়া ও পিউবৃলো ইণ্ডিয়ানদের উল্লেখ করা যায়। মর্গানের নিজের বর্ণনা (৩৪২) অনুসারে ইরোকোয়াদের পরিবার মাতৃপ্রধান : প্রধানত মেয়েরাই মোড়ল নির্বাচন করে এবং ট্রাইব্যাল-পঞ্চায়েং-এর মধ্যে মেয়েরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। পিউবৃলো ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে মাতৃপ্রাধান্যের বর্ণনা অন্যান্য লেখকরাও (৩৪৩) দিয়েছেন। তুলনায়, অস্ট্রেলিয়ার নানা ট্রাইবের মধ্যে পিতৃপ্রাধান্য চোখে পড়ে। অথচ, মর্গানের স্তর-নির্ণয় অনুসারেই অস্ট্রেলিয়ার ওই ট্রাইবগুলি ইরোকোয়া ও পিউলো ইণ্ডিয়ানদের চেয়ে অনেক প্রাকৃত স্তরের (৩৪৪)। তাই, অস্ট্রেলিয়ার ট্রাইবগুলির এই পিতৃপ্রাধান্যের পাশাপাশি ইরোকোয়া ও পিউবৃলো ইণ্ডিয়ানদের মাতৃপ্রাধান্যের ব্যাখ্যা অন্য দিক থেকে খোজ করা দরকার ; মর্গানের নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সে-ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এই ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব রবার্ট ব্রিফল্ট ও জর্জ টমসন মর্গানের সিদ্ধান্তকে যে-ভাবে শুধরে নিতে চান সেদিক থেকে : পিতৃপ্রধান অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা শিকারজীবী, ইরোকোয়া আর পিউবৃলো ইণ্ডিয়ানরা কৃষিজীবী।
আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, মানবজাতির সব শাখা যে একইভাবে শিকারজীবী পর্যায় থেকে কৃষিজীবী পর্যায়ের দিকে অগ্রসর হয়েছে তা মনে করবার কারণ নেই। কোনো কোনো জাতির বেলায় দেখা যায় শিকারজীবী পর্যায়ের পর পশুপালনজীবী পর্যায় এবং পশুপালন থেকে একেবারে হাল-লাঙলে বলদ জুতে চাষবাস করবার আয়োজন—অর্থাৎ, উন্নততর পর্যায়ের কৃষিকাজই। স্বভাবতই, মানবজাতির এই শাখাগুলির বেলায় কৃষিবিদ্যার প্রাথমিক স্তরের দরুন যে অন্তর্বর্তী মাতৃপ্রাধান্য, তা চোখে পড়বার কথা নয়।
এখানে, রবার্ট ব্রিফল্ট-এর (৩৪৫) রচনা থেকে মুদীর্ঘ উদ্ধৃতির প্রয়োজন আছে :

Definite economic power was first placed in the hands of men by the domestication of animals, which are always regarded as appertaining to the province of the hunter, and by the development of pastoral societies. That power has commonly been used to buy off the claims of women and of their families to the allegiance and services of husbands; women are purchased for cattle, and patriarchal society with patrilocal marriage becomes inevitably established among pastoral peoples. Where, on the other hand, agriculture, which from the first has been the province of women, has developed on an important scale without any intervening pastoral stage, the matriarchal order has often persisted and has even become accentuated in relatively advanced phases of culture. This has been the case in North America, where no domestication of animals has taken place, and most conspicuously among those tribes, such as the Iroquois and the Pueblos, in which agriculture attained in the hands of women an important development. Similarly, the matriarchal order is found persisting among the peoples of Indonesia, and of Micronesia, where the culture of rice and of paddy supply the staple means of subsistence and pastoral conditions have not existed. The matriarchal character of society has been preserved among many African peoples who have remained chiefly agricultural. This happened notably in Egypt which owed its wealth and culture to the Nile and to the fields which it fertilised, and where pastoral property never attained to any degree of importance. Elsewhere the stage of highly developed agriculture has been reached only after passing through a purely pastoral phase of long duration, as with the ‘Aryans’ of India and the Semites of Western Asia, who were driven by the desiccation of their pastoral lands towards the great alluvial plains, the granaries of the world. Among the Semitic nations of Western Asia women retained many relics of their primitive influence; their position, specially in earlier times, was very far from one of degradation and oppression. The code of Hammurabi shows countless provisions protecting the status of women, more particularly of priestesses; women could own property, homes, slaves; they conducted business and commerce, and could plead in court. Yet the contrast of Babylonian society with Egypt is sharp and conspicuous in this respect; “the man is more important than the woman, the father than the mother, the husband than the wife.” Assyrian pictorial art, in glaring contrast with that of Egypt, scarcely even represents a woman; only once the queen of Ashurbanipal appears in a court picture at Kuyunijk by the side of her lord. That subordinate position of women becomes in time more pronounced. The development of agriculture in its most productive from in those societies which were originally pastoral, instead of raising the economic power and importance of the earth-cultivating women, has accentuated beyond measure the already established supremacy of the owners of flocks and herds, and given rise to the most pronounced type of patriarchal society.
অর্থাং (সারমর্ম), শিকারবুত্তি থেকেই পশুপালনের উৎপত্তি এবং পশুপালনের ফলে পুরুষের হাতে প্রথম সুনিশ্চিত অর্থনৈতিক ক্ষমতা এলো। এই ক্ষমতার সাহায্যে প্রায়ই মেয়েদের কিনে নেওয়া শুরু হলো। গৃহপালিত পশুর বিনিময়ে মেয়েদের কেন হতো। পশুপালনমূলক সমস্ত সমাজই অনিবাৰ্যভাবে পিতৃপ্রধান, বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুরঘর করতে যায়। অপরপক্ষে, কৃষিকাজ শুরু থেকেই মেয়েদের এক্তিয়ারে ; তাই যাদের বেলায় পশুপালনমূলক কোনো মধ্যবর্তী পর্যায় বাদ দিয়ে ভালো রকমের কৃষিকাজ দেখা দিয়েছে তাদের মধ্যে প্রায়ই মাতৃপ্রাধান্য বর্তমান থেকেছে ও এমন কি আপেক্ষিকভাবে সংস্কৃতির উন্নতর পর্যায়ে এই মাতৃপ্রধান্য কোথাও কোথাও দৃঢ়তর হয়েছে। এই ঘটনাই ঘটেছে উত্তর আমেরিকায়। সেখানে পশুপালন দেখা দেয়নি। এ-ব্যাপার বিশেষ করে ইরোকোয় এবং পিউলোদের মধ্যে চোখে পড়ে—তাদের বেলায় মেয়েদের চেষ্টায় কৃষিকাজের বিশেষ উন্নতি হয়েছে। তেমনি, ইন্দোনেসিয়া এবং মাইক্রোনেসিয়ায় মাতৃপ্রাধান্য টিকে থাকতে দেখা যায় ; এ-সব জায়গায় প্রধানতম খাদ্য হলো চাল এবং এখানে পশুপালনের অবস্থা কখনোই ছিলো না। আফ্রিকার জায়গায় জায়গায়, যেখানে মানুষেরা কৃষিপ্রধান হয়ে রয়েছে সেখানে, দেখা যায় মাতৃপ্রাধান্য টিকে থেকেছে। বিশেষ করে ইজিপ্ট-এ এই ঘটনা ঘটতে দেখা যায়—সেখানে পশুপালনমূলক সম্পত্তি কখনোই খুৰ গুরুত্বপূর্ণ রূপ নেয়নি এবং সেখানে ঐশ্বর্ষেরমূলে ছিলো নীল নদের প্লাবনেউর্বর জমি। অপরাপর ক্ষেত্রে, সুদীর্ঘ পশুপালনজীবী পর্যায়ের পরই বিশেষ উন্নত কৃষিজীবী পর্যায়ে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে। যেমন, ভারতবর্ষে ‘আর্যদের বেলায় এবং পশ্চিম এসিয়ায় সেমাইটদের বেলায়। পশুপালনের জমি নিঃশেষ হবার ফলেই তারা শেষ পর্যন্ত পলিপড়া উপত্যকায় এসে পৌছেছিলো—সেউপত্যক পৃথিবীর শস্যভাণ্ডারের মতো। পশ্চিম এসিয়ার সেমিটক জাতিগুলির মধ্যে মেয়েদের আদিম যুগের প্রভাব-প্রতিপত্তির কিছুকিছু স্মারক থেকে গিয়েছিলো। বিশেষ করে শুরুর দিকে তাদের অবস্থা মোটেই নির্যাতিত এবং অবদলিতের মতো নয়। হামুরাবির আইনে দেখা যায় মেয়েদের, বিশেষত পৌরোহিত্য-কর্মে লিপ্ত মেয়েদের, সন্মান রক্ষার জন্ত অনেক বিধি ব্যবস্থা রয়েছে। মেয়েরা সম্পত্তির, বাড়ির এবং কৃতদাসের মালিক হতে পারতো। তবুও, এদিক থেকে মিশরের সমাজের সঙ্গে ব্যাবিলোনিয়ার সমাজের তফাতটা অত্যন্ত প্রকট। ব্যাবিলোনিয়ায়, “নারীর তুলনায় পুরুষের, মাতার তুলনায় পিতার, স্ত্রীর তুলনায় স্বামীর স্থান অনেক গুরুত্বপূর্ণ”। মিশরের চিত্রকলার সঙ্গে বিরাট তফাত হিসেবে দেখা যায়, অসিরিয় চিত্রকলায় মেয়েদের যেন কোনো স্থানই নেই ; কেবলমাত্র একটি ছবিতে চোখে পড়ে রাজদরবারের দৃশ্যে রাজা অসুরবানিপালের রানী, তাও তিনি স্বামীর পাশে রয়েছেন। মেয়েদের এই গৌণ অবস্থা ক্রমশই আরো প্রকট হয়ে পড়তে থাকে। যে-সব সমাজে পশুপালনের পর উন্নত কৃষিকর্মের উদ্ভব হয়েছে সেগুলির ক্ষেত্রে দেখা যায় মাটি কোপানোয় নিযুক্ত মেয়েদের অর্থনৈতিক শক্তি ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবার পরিবর্তে গৃহপালিত পশুর মালিক পুরুষদের ইতিপূর্বেই যে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সেই প্রাধান্য ঢের বেড়ে গিয়েছে। এবং এই সব ক্ষেত্রে তাই বিকশিত হয়েছে চূড়ান্ত পিতৃপ্রধান সমাজের রূপ।

অবশ্যই, ব্রিফল্ট-এর পক্ষে সিন্ধুসভ্যতার আলোচনা তোলা সম্ভবপর হয়নি; স্তর জন মার্শাল-এর “মোহেনজোদারো এবং সিন্ধুসভ্যতা” পরে প্রকাশিত হয়েছিলো। অথচ, সিন্ধুসভ্যতার চিহ্নগুলি থেকে ব্রিফল্ট-এর সিদ্ধান্তের অত্যন্ত স্পষ্ট সমর্থন পাওয়া যায় : এগুলির মধ্যে কৃষিপ্রাধান্য ও মাতৃপ্রাধান্য দু’-এরই পরিচয় রয়েছে। বৈদিক “আর্য”দের বেলায় ঠিক এর বিপরীত। তাঁরা ছিলেন প্রধানতই পশুপালনজীবী যোদ্ধার দল। র্তারা কৃষিকাজকে ঘৃণার চোখেই দেখতে চেয়েছিলেন। ফলে তাদের সাহিত্যে মাতৃপ্রাধান্য বা দেবীপ্রাধান্যের পরিচয় পাওয়া যায় না। রবার্ট ব্রিফল্ট (৩৪৬) লিখছেন :

Mother Earth has scarcely any place in the cosmological or religious conceptions and rites of peoples in pre-agricultural stages. Even far above the level of primitive culture, where advanced material and intellectual civilization has been attained by peoples who have never truly become cultivators of the soil, Mother Earth plays no part. The Hindu Aryans, for example, developed the highest type of Oriental civilization and culture without ever becoming agriculturists. It was as a society of pastoral warriors that they established themselves in the fertile plains of Northern India; they never took up the cultivation of the soil, leaving it to the native inhabitants; and, indeed, they, like all pastoral warriors, profoundly despised agriculture as the occupation of the conquered races. The Laws of Manu forbid agricultural work to members of Brahminical and warrior castes. “Some declare that agriculture is something excellent”, states the official codes of Brahminical Laws, “but that means of subsistence is blamed by the virtuous”. A Brahmin at the present day will not so much touch a plough. In Vedic literature, accordingly, and in Hindu religion we find no great Earth Mother…Goddesses occupy a subordinate position in Vedic religion.
অর্থাৎ, প্রাক্-কৃষিপর্যায়ের মানুষদের বিশ্বরহস্ত কল্পনায়, ধৰ্মমূলক ধ্যানধারণায় ও আচার-অনুষ্ঠানে বসুমাতার বিশেষ কোনো স্থান নেই। যারা কৃষিকাজে প্রবৃত্ত না হয়েই আদিম সংস্কৃতির চেয়ে অনেক উচ্চতর পার্থিব ও পারমার্থিক সভ্যতার স্তরে পৌঁছেছিলো, তাদের মধ্যে বসুমাতার প্রচলন নেই। যেমন, হিন্দু আর্যরা কৃষিকাজে কখনোই আত্মনিয়োগ না করেও প্রাচ্য সভ্যতার চূড়ান্ত নিদর্শন গড়ে তুলেছিলো। উত্তর ভারতের উর্বর উপত্যকায় পশুপালক যোদ্ধা হিসেবেই তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করলো; তারা নিজেরা কখনোই কৃষিকাজের দায়িত্ব নেয়নি, সে-দায়িত্ব স্থানীয় আদিবাসীদের উপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। এবং, সমস্ত পশুপালক যোদ্ধাদের মতোই তারাও এই কৃষিকাজকে বিজিত জাতিদের বৃত্তি হিসেবে ভয়ানক ঘৃণা করতো। মনুর আইন অনুসারে, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের পক্ষে কৃষিকাজ নিষিদ্ধ। ব্রাহ্মণদের আইনের বইতে বলা হয়েছে, “কোনো কোনো পণ্ডিত কৃষিকে ভালো বলেন। কিন্তু তাছা ঠিক নহে। উহা সাধুজন কর্তৃক নিন্দিত”। (কৃষি: সাধ্বিতি মন্যন্তে সা বৃত্তিঃ সদ্বিগৰ্হিতা: মনু, ১০, ৮৪)। আজকের দিনে কোনো ব্রাহ্মণ লাঙল স্পর্শ করতে পর্যন্ত রাজি নয়। ফলে বৈদিক সাহিত্য এবং হিন্দুধর্মে বসুমাতার স্থান নেই।..বৈদিক ধর্মে দেবীরা গৌণ।

বলাই বাহুল্য, মনুস্মৃতির উদ্ধৃতি থেকেই বোঝা যায় এখানে প্রাচ্য-সভ্যতার ও সংস্কৃতির উন্নততম পর্যায় বলতে বৈদিক মানুষদের প্রাকৃততর পর্যায়ের উল্লেখ করা হচ্ছে না,—যে-পর্যায়ে, আমরা. আগে দেখাবার চেষ্টা করেছি, তাদের মধ্যেও গণ-সমাজ বর্তমান ছিলো। তেমনি, হিন্দু ধর্ম বলতে এই প্রসঙ্গে বৈদিক ধৰ্মই বুঝতে হবে। আমাদের মূল যুক্তির পক্ষে যে-দুটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য তা হলো :
১ ) পশুপালন-প্রাধান্যের দরুনই বৈদিক ধ্যানধারণায় মাতৃপ্রাধান্যের বা শক্তিপ্রাধান্যের বিকাশ হয়নি।
২ ) যাদের সাধারণত স্থানীয় অনার্য বলা হয় তারা প্রধানতই কৃষিজীবী ছিলো এবং কৃষিজীবীই থেকে গিয়েছিলো। (অর্থাৎ, তাদের অর্থনীতিটা পশুপালন-প্রধান নয়। (এখানে, এই অনার্যদের মধ্যে আয়ুধজীবী পর্যায়কে অস্বীকার করা হচ্ছে না ; বার্তাশন্ত্রোপজীবীগণের পাশেই আয়ুধজীবীগণের দৃষ্টান্ত ছিলো নিশ্চয়ই—কিন্তু এগুলি হলো এগিয়ে-যাওয়া দলের পাশে পিছিয়ে-পড়ে-থাকা দল। ) ফলে, আমরা দেখবো, এদেরই মধ্যে মাতৃপ্রাধান্যের বিকাশ ঘটেছিলো।
ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য বোঝবার জন্যে এই ছুটি বিষয়েরই সুস্পষ্ট আলোচনা হওয়া দরকার।
বৈদিক ঋষিরা যখন স্বর্গ ও মর্তের দূরত্ব বর্ণনা করবার জন্তে সহস্র গাভীকে উপর উপর দাঁড় করাবার হিসেব দেন, (৩৪৭) বা, একই শব্দ ব্যবহার করে ‘গোরু পাবার বাসনা’ ও ‘যুদ্ধ’ দুই-ই বোঝাতে চান (৩৪৮)–তখন নিশ্চয়ই সন্দেহ থাকে না যে, তারা প্রধানতই পশুপালক ছিলেন। বস্তুত, রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র (৩৪৯), উইন্টারনিংস্ (৩৫০), গর্ডন চাইল্ড (৩৫১) প্রমুখ আধুনিক পণ্ডিতেরা প্রায় একবাক্যেই স্বীকার করছেন যে, বৈদিক মানুষেরা প্রধানতই পশুপালনজীবী ছিলেন। উইন্টারনিংস্ (৩৫২) বলছেন, যদিও পরের যুগে ভারতবর্ষীয়দের প্রধান খাদ্য বলতে চাল-ই, তবুও ঋগ্বেদে তার উল্লেখ নেই। The chief source of income was cattle-raising (৩৫৩)–ধনলাভের প্রধানতম উপায় বলতে ছিলো পশুপালন। পূর্ববর্তী গবেষকেরা এই কথাটি প্রমাণ করবার জন্তে এতো তথ্য সংগ্রহ করেছেন যে, আমাদের পক্ষে এ-বিষয়ে আজ আর কোনোরকম সন্দেহ পোষণ করবার সুযোগ নেই। প্রশ্ন ওঠে, এই পশুপালনজীবী সমাজে নারীর স্থান কী রকম ছিলো? কার্ল মাক্স বলেছিলেন, পৌরাণিক কাহিনীতে (দেবতাদের তুলনায় ) দেবীদের স্থান থেকেই প্রাচীন সমাজে নারীদের স্বাধীন ও গৌরবময় সত্তা অনুমান করা যায়।

as Marx observes, the position of goddesses in mythology represents an earlier period when women still occupied a freer and more respected place (৩৫৪).

বৈদিক সাহিত্যে কী রকম ? ম্যাকডোন্যান্ড-এর ‘বেদিক মাইথোলজি’ (৩৫৫) অনুসরণ করে এখানে সে-বিষয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করবার চেষ্টা করা যাক। তিনি বলছেন, বৈদিক বিশ্বাস ও পূজার মধ্যে দেবীদের স্থান অভ্যন্ত গৌণ। দেবীর বৈদিক সাহিত্যের কোথাও-ই পৃথিবীর অধিশ্বরী বলে বর্ণিত হননি। দেবীদের মধ্যে একমাত্র যাঁর কিছুটা বা গৌরব আছে তিনি হলেন উষা। কিন্তু উষার গৌরবও খুব বেশি নয়। সংখ্যায় কতোবার উল্লেখিত হয়েছেন—এই বিচারে উষা বৈদিক দেবলোকের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়েন। অন্যান্য সমস্ত দেবতারাই যজ্ঞাহুতির অংশ পেয়ে থাকেন ; কিন্তু উষা তা পান না। দেবীদের মধ্যে উষার পর স্থান হলো সরস্বতীর ; কিন্তু তিনি নিম্নতম শ্রেণীতেই পড়েন। আর কয়েকটি দেবী আছেন যাদের কথা মাত্র একটি করে সূক্তে উল্লেখিত হয়েছে। যেমন, পৃথিবী (তাও, পৃথিবী এক নন, দ্যাবাপৃথিব্যৌ হিসেবে ), রাত্রি। এইভাবে ম্যাকডোন্যান্ড দেখাচ্ছেন, বৈদিক সাহিত্যে আর যে-কয়েকটি দেবীর উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে তাঁদের স্থান নিতান্ত গৌণ। এবং ইন্দ্রাণী প্রভৃতি দেবপত্নী হিসেবে যাঁদের পরিচয় পাওয়া যায়, তাদের না আছে স্বাতন্ত্র্য, না, বিশেষ কোনো গৌরব।

অতএব, দেবীমাহাত্ম্যে দেবীকে যেভাবে বেদবন্দিতা (৩৫৬) বলতে শোনা যায় তা আর যাই হোক বৈদিক ঐতিহ্যের পরিচায়ক নয়। কেননা ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দেবীমূক্ত যে অনেক অর্বাচীন, এ-কথায় আধুনিক গবেষকেরা একমত (৩৫৭)। বৈদিক সাহিত্যের এই বৈশিষ্ট্যটির কথা আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যে অনেকেই (৩৫৮) উল্লেখ করছেন। কিন্তু এর ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা সকলে করেন না। আমাদের যুক্তি হলো, বৈদিক মানুষদের জীবনে পশুপালন-প্রাধান্য থেকেই ওই পুরুষপ্রধান বৈদিক দেবলোকের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
বৈদিক ধ্যানধারণা যে পুরুষপ্রধান তার নজির হিসেবে ম্যাকডোন্তান্ড প্রমুখ আধুনিক বিদ্বানের প্রধানতই বৈদিক দেবলোকটিকে এইভাবে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন ; এ-দেবলোক পুরুষমাহাষ্মে পূর্ণ, দেবীদের দৃষ্টান্ত এখানে দুর্লভ। কিন্তু বৈদিক ধ্যানধারণার ওই পুরুষ-প্রাধান্যের আরো চূড়ান্ত নিদর্শন হলো ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের বিখ্যাত পুরুষসূক্ত (৩৫৯):

পুরুষং এবেদং সৰ্ব ষদ্ভূতং যচ্চ ভব্যম্
উতামৃতত্বস্যেশানো যদন্নেনাতিরোহতি।।
ইত্যাদি। ইত্যাদি।
শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্তর (৩৬০) তর্জমা থেকে এখানে পুরুষসূক্তের কিয়দংশ উদ্ধৃত করা যাক :
যাহা হইয়াছে, অথবা যাহা হইবেক, সকলি সেই পুরুষ। তিনি অমরত্বলাভে অধিকারী হয়েন, কেননা তিনি অন্নদ্বারা অতিরোহন করেন।
তাঁহার এতাদৃশ মহিমা, তিনি কিন্তু ইহা অপেক্ষাও বৃহত্তর। বিশ্বজীবসমূহ তাঁহার একপাদ মাত্র, আকাশে অমর অংশ তাঁহার তিনপাদ।
পুরুষ আপনার তিনপাদ লইয়া উপরে উঠলেন। তাহার চতুর্থ অংশ এই স্থানে রহিল। তিনি তদনন্তর ভোজনকারী ও ভোজনরহিত তাবৎ বস্তুতে ব্যাপ্ত হইলেন। ইত্যাদি। ইত্যাদি।

এই পুরুষসূক্তকে অবলম্বন করে বহু আধ্যাত্মিক আলোচনার (৩৬১) অবতারণা করা হয়েছে। কিন্তু বিদ্বানেরা এখনো এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নটি উত্থাপন করেননি : এখানে নারীর বদলে পুরুষকেই কেন আদি-কারণ বলে বর্ণনা করা হয়েছে? প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক। কেননা, আদি-কারণ হিসেবে পুরুষের বদলে নারীকেও বর্ণনা করা সম্ভব। বস্তুত, আমাদের দেশেই বৈদিক চিন্তাধারা ছাড়াও আর একটি চিন্তাধারা প্রবাহিত ছিলো। সেই ধারা অনুসারে বিশ্বের আদি-কারণ পুরুষ নয়—নারী। এই অবৈদিক চিন্তাধারাটির নাম তন্ত্র। তন্ত্রমতে নারীই আদ্যাশক্তি, জগদম্বা।
আমাদের মন্তব্য হলো, মানুষের ধ্যানধারণা স্বয়ম্ভু নয়। তার মধ্যে বাস্তব সমাজ-জীবনের প্রতিবিম্ব খুজে পাওয়া যায়। ওই পুরুষসূক্তে পুরুষপ্রধান সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। এবং বৈদিক সমাজ যে পুরুষপ্রধান ছিলো তাও অকারণ নয় : বৈদিক মানুষদের প্রধানতম জীবনোপায় বলতে পশুপালনই।
বলাই বাহুল্য, তার মানে এই নয় যে, বৈদিক সাহিত্যে কৃষিকাজের কোনো পরিচয় নেই। কৃষিকাজেরও পরিচয় পাওয়া যায়। এ-বিষয়ে অনেকেই (৩৬২) ইতিপূর্বে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এমনকি, অশ্বমেধ যজ্ঞাদির আলোচনা প্রসঙ্গে কপ্পারস্‌ (৩৬৩), এরেনফেলস্ (৩৬৪) প্রমুখ কোনো কোনো আধুনিক গবেষক দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, বাজসনেয়ী সংহিতায় নারী-প্রাধান্যমূলক ধ্যানধারণা ও আচার-অনুষ্ঠানের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। আমরা ইতিপূর্বে (পৃ. ১৩৪) বাজসনেয়ী সংহিতা থেকে কিছুটা অংশ বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করেছি এবং ওই বামাচারী অনুষ্ঠানটির সঙ্গে কী ভাবে ক্ষেত্রে বীজবপনের প্রসঙ্গ উঠলে সে-দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। অতএব, সংহিতা-সাহিত্যের এই অংশে যদি নারীপ্রাধান্যের পরিচয় সত্যিই পাওয়া যায় তাহলে তার সঙ্গে কৃষিকর্মের যোগাযোগের ইঙ্গিতটুকুও অস্পষ্ট নয়। আলোচনার বর্তমান পর্যায়ে আমাদের যুক্তি হলো, এই জাতীয় নারীপ্রাধান্য ও কৃষিকর্মের পরিচয় বৈদিক সাহিত্যের মুখ্য অঙ্গ নয়। অর্থাৎ, বেদে কৃষিকর্মের নিদর্শন আবিষ্কার করা সম্ভব হলেও বৈদিক মানুষদের প্রধানতম জীবনোপায় বলতে পশুপালনই। তেমনি, বৈদিক মানুষদের চেতনায় ও আচার-অনুষ্ঠানে নারীপ্রাধান্যের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া অসম্ভব না হলেও সে-চেতনার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো পুরুষপ্রাধান্য।
বৈদিক সাহিত্য সম্বন্ধে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হবার আগে মনে রাখা দরকার, এ-সাহিত্য সুবিশাল ও জটিল। সেই সঙ্গে একথাও মনে রাখা দরকার যে, আমাদের দেশে বৈদিক ঐতিহ্যই একমাত্র ঐতিহ্য নয়। অ-বৈদিক মানুষদের মধ্যে যারা আয়ুধজীবী পর্যায়কে পিছনে ফেলে এগিয়ে এসেছিলো তারা পশুপালনের দিকে অগ্রসর না হয়ে প্রধানতই বার্তাশস্ত্রোপজীবী পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলো। এই কারণেই, ভারতীয় সংস্কৃতির অ-বৈদিক ধারাটি শক্তি-প্রধান বা মাতৃপ্রধান।

২ : সাধারণত যাদের স্থানীয় অনার্য বলে উল্লেখ করা হয় তারা কৃষিজীবী ছিলো এবং কৃষিজীবী হিসেবেই থেকে গিয়েছিলো। এবং এর ফলে তাদের মধ্যে মাতৃপ্রাধান্যের বিকাশ ঘটাই স্বাভাবিক। শ্ৰীযুক্ত ক্ষিতিমোহন সেন (৩৬৫) বলছেন, “আর্যদের মধ্যে প্রধান হলো পুরুষ। তাকে বলে বীজপ্রাধান্য। পরে দ্রাবিড়াদি জাতির মাতৃতন্ত্র সমাজের প্রভাবে মায়ের জাতই সন্তানেরা পেতে লাগলেন। তার নাম ক্ষেত্রপ্রাধান্য। তা অনার্য প্রভাবের ফল।” এবং “শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে গুরু এবং মাতামহ, মামা, ভাগ্নে, দৌহিত্র, জামাতা, মাসতুত-পিসতুত ভাই প্রভৃতি কন্যাগত সম্বন্ধযুক্তদেরই আদর বেশি। কন্যাতন্ত্রতাও আর্যদের নয়। কূর্মপুরাণে বলেন, মাতৃযাগ না করে বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ করলে মাতৃগণ হিংসা করেন। অকৃত্বা মাতৃযাগন্তু য: শ্ৰাদ্ধন্তু নিবেশয়েং। তস্ত ক্ৰোধসমাবিষ্ট হিংসামিচ্ছন্তি মাতরঃ।” (৩৬৬) শ্ৰীযুত ক্ষিতিমোহন সেন-এর মতে এটা অবশুই অনার্য প্রভাবের ফল।
ওই তথাকথিত দ্রাবিড় বা আর্য-বহির্ভূতদের মধ্যে মাতৃপ্রাধান্যের বিকাশ কেন হয়েছিলো ? এই সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে তাদের কৃষিপ্রাধান্য থেকেই। এবং আমরা দেখবার চেষ্টা করবো, এই কৃষিবিদ্যার দিক থেকেই লোকায়তিক, তথা তান্ত্রিক, ধ্যানধারণার উৎস আবিষ্কার করা অসম্ভব নয়। তাই, আর্য-বহির্ভূত ওই কৃষিজীবীদের বিষয় নানা দিক থেকে আলোচনা তোলবার প্রয়োজন হবে। কিন্তু বর্তমানে আশাকরি এটুকু বলা অসঙ্গত নয় যে, ব্রত ও বামাচার-প্রসঙ্গে আমরা ইতিপূর্বে একটি সমস্যার অবতারণা করেছিলাম এবং আমাদের আলোচনার বর্তমান পর্যায়ে পৌছে সে-সমস্যার সমাধান পাওয়ার সম্ভাবনা হয়েছে।
সমস্যাটা কী? আমরা ইতিপূর্বে (পৃ. ১৫১) দেখেছি যে, বৈদিক অনুষ্ঠান এবং আদি অকৃত্রিম ব্ৰতগুলির তুলনা করতে গিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলছেন, “আর্য এবং আর্যপূর্ব ইজনেরই সম্পর্ক, যে-পৃথিবীতে তারা জন্মেছে তাকেই নিয়ে,…স্কু’জনে ব্রত করছে যা কামনা করে, সেটা দেখলে এটা স্পষ্টই বোঝা যাবে ; কেবল পুরুষের চাওয়া আর মেয়েদের চাওয়া, বৈদিক অনুষ্ঠান পুরুষদের এবং ব্ৰত অনুষ্ঠান মেয়েদের, এই যা প্রভেদ।” উপনিষদে বামাচারের স্মারকগুলি নিয়ে আলোচনা করবার সময়েও লোকায়তিক বামাচারের সঙ্গে আমরা এরই অনুরূপ একটি প্রভেদ দেখেছি (পৃ. ১১৬) : বৈদিক বামাচার পুরুষপ্রধান, লোকায়তিক বামাচার স্ত্রী-প্রধান। সমস্যা হলো, এই প্রভেদের কারণ কী? আলোচনার বর্তমান পর্যায়ে পৌছে আমরা এই প্রভেদের কারণটি অনুমান করবার সুযোগ পাই। ভারতীয় সংস্কৃতির ওই ছুটি মূল ধারা, অর্থাৎ বৈদিক ও অ-বৈদিক ধারার মধ্যে মৌলিক তফাত আছে : বৈদিক সংস্কৃতি পুরুষ-প্রধান, অ-বৈদিক সংস্কৃতি নারী-প্রধান। এবং এই প্রভেদের কারণ হলো, বৈদিক মানুষদের জীবিকা-বৃত্তি প্রধানতই পশুপালন-মূলক, তথাকথিত অনার্য বা আর্যপূর্ব মানুষদের জীবিকা-বৃত্তি প্রধানতই কৃষিমূলক।

——————

৩৩১. R. P. Chanda IAR 150-1.
৩৩২. দৃষ্টান্ত বিরল নয়। বস্তুত তন্ত্র-প্রসঙ্গে আধুনিক বিদ্বানদের বেশির ভাগ
আলোচনাই এই জাতীয়।
৩৩৩. J. Marshall MIC 1:51.
৩৩৪. G. Thomson SAGS 41.
৩৩৫. Ibid. 144.
৩৩৬. Ibid. 43.
৩৩৭. Ibid.
৩৩৮. R. Briffault M &IV G Thomson SAGS 149-50.
৩৩৯. R. Briffault M 1:96-100, 195-267.
৩৪০. G. Thomson SAGS 149ff.
৩৪১. Ibid. 43.
৩৪২. H. L. Morgan AS 62.
৩৪৩. R. Briffault op. cit. 1:316ff.
৩৪৪. H. L. Morgan op. cit. 10-1.
৩৪৫. R. Briffault op. cit. 2:25If.
৩৪৬. Ibid. 3:59.
৩৪৭. A. B. Keith RPVU.
৩৪৮. M. Winternitz HIL 1:64.
৩৪৯. R. L. Mitra IA ch. xx.
৩৫০. M. Winternitz op. cit. 64.
৩৫১. S G. Childe A 78ff.
৩৫২. Ibid. 64.
৩৫৩. Ibid.
৩৫৪. F. Engels OFPPS 103.
৩৫৫. A. Macdonell VM 124ff.
৩৫৬. মার্কণ্ডেয় পুরাণ ৯২ ৷
৩৫৭. M. Winternitz op, cit. 1:57; A. & Macdonell HSL45; A. B. Keith in CHI 1:77-8.
৩৫৮. A. A. Macdonell HSL 103, VM 124ff. ; R. G. Bhandarkar VS
142ff. W. Crooke in Folk-lore 30284sq., ইত্যাদি।
৩৫৯. ঋগ্বেদ ১০.৯০।
৩৬০. ঋগ্বেদ (রমেশচন্দ্র দত্ত) ১৫৭১।
৩৬. S. Radhakrishnan IP 104, osts
৩৬. A. B. Keith RPVU 57, 186-7, 256. 366. A. A. Macdonell. HSL 166. i.
৩৬. O. R. Ehrenfels MRI 2.
৩৬. Ibid 2, 98, 113.
৩৬৫. ক্ষিতিমোহন সেন : ভারতের সংস্কৃতি ১১ ৷
৩৬৬. ঐ ১৬।