প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

২২. আয়ুধজীবী গণ ও বার্তাশস্ত্রোপজীবী গণ

আয়ুধজীবী গণ ও বার্তাশস্ত্রোপজীবী গণ

ব্যাপক অর্থে যে-ধ্যানধারণাগুলিকে আমরা লোকায়তিক বা তান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে থাকি সেগুলির বেলাতেও একই কথা। গ্রাম-সমবায়, জাতপ্রথা, লোকাচারমূলক আইনকানুন আর ব্রতের বেলায় যে-রকম,–সেই রকমই। বস্তুত, ওই তান্ত্রিক ধ্যানধারণাগুলির উৎস ও আদিতাৎপর্য অনুসন্ধান করবার উদ্দেশ্যে এগিয়েই আমরা এই অন্যান্য বিষয়গুলির আলোচনায় বিক্ষিপ্ত হয়েছিলাম; কেননা, যে মূল-প্রকল্পের উপর নির্ভর করে আমরা এই তান্ত্রিক ধ্যানধারণাগুলিকে চেনবার চেষ্টা করেছি সেইটি্র ব্যাখ্যা এবং সেটির পক্ষে আনুষঙ্গিক নজির দেখাবার তাগিদ ছিলো।
আমরা বলেছি, ট্রাইব্যাল সমাজেরই কোনো এক পর্যায়ের মধ্যে এই তান্ত্রিক ধ্যানধারণাগুলির উৎস আবিষ্কার করবার সম্ভাবনা আছে।
অতএব আমরা আমাদের পদ্ধতি অনুসারে প্রথম প্রশ্ন তুলবো : ট্রাইব্যাল-সমাজের পর্যায়-ভেদ সম্বন্ধে সাধারণভাবে জানতে পারা তথ্য বলতে ঠিক কী বোঝায়? বর্তমান পৃথিবীর নানা জায়গায় এখনো যে-সব ট্রাইব টিকে রয়েছে সেগুলির বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করলে এ-প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে।
অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন (২৮৪) দেখাচ্ছেন, খাদ্য আহরণ ও খাদ্য-উৎপাদনের সবচেয়ে মৌলিক ব্যবস্থার দিক থেকে আজকের পৃথিবীর ট্রাইবগুলিকে নিম্নোক্ত পর্যায়ে ভাগ করা যায় :

১): শিকার-জীবী। দুটি স্তর।
নিম্নস্তরের শিকার-জীবীরা ফলমূল আহরণ করে এবং পশু শিকার করে নিজেদের খাদ্যসরবরাহের ব্যবস্থা করে। উচ্চ-স্তরের শিকার-জীবীরা পশু শিকার ছাড়াও মাছ ধরতে শিখেছে। নিচুস্তরে শিকারের অস্ত্র বলতে বর্শা, উঁচুস্তরে বর্শা ছাড়াও তীর-ধনুক। তাছাড়া, এই উঁচুস্তরটিতে হাঁড়িকুড়ি তৈরি, কাপড় বোনা ও পশুকে পোষ-মানাবার কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যায়।
২): পশুপালন-জীবী। দুটি স্তর।
দ্বিতীয় স্তরটিতে পশুপালন ছাড়াও কিছুকিছু চাষবাসের পরিচয় পাওয়া যায়।
৩): কৃষিজীবী। তিনটি স্তর।
তৃতীয় স্তরের বৈশিষ্ট্য হলো, কোদাল দিয়ে ছোটো জমিতে চাষ করবার চেষ্টা ছাড়িয়ে রীতিমতো বড়ো ক্ষেত লাঙল দেবার ব্যবস্থা এবং চাষবাসের সঙ্গে পশুপালনও।

অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন (২৮৫) দেখাচ্ছেন, পশুপালনের উচ্চ স্তর এবং কৃষির তৃতীয় স্তর থেকে কারিগরি, স্থায়ী আবাস-স্থাপন এবং ধাতুর কাজ বহুলভাবে বাড়তে থাকে এবং ফলে এই দুটি স্তর থেকেই দেখা যায়, অকৃত্রিম ট্রাইব্যাল-সংগঠনে ভাঙন ধরছে।
মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর সব-মানুষই যে আগে পশুপালনজীবী ও তারপর কৃষিজীবী হয়েছে তা নয়। মানবজাতির সব-শাখাই অবশ্য শুরু করেছে শিকারজীবী হিসেবে; তারপর কোনো শাখা এগিয়েছে পশুপালনের দিকে আবার অপর-কোনো শাখা কৃষিকাজের দিকে। এই রকম তফাত কেন? প্রধানতই প্রাকৃতিক পরিবেশের দরুন : পশুবহুল পরিবেশের মানুষেরা স্বভাবতই পশুপালনের দিকে এগিয়েছে, স্বভাব-উর্বর বুনো শস্যবহুল পরিবেশের মানুষেরা এগিয়েছে কৃষিকাজের দিকে (২৮৬)।
ট্রাইব্যাল সমাজে ভাঙন ধরবার পর? শ্রেণীসমাজ। রাষ্ট্রব্যবস্থা।
সভ্যমানুষদের প্রাগৈতিহাসিক অতীত প্রসঙ্গে আমরা ইতিপূর্বে মর্গান-কৃত পর্যায়-বিভাগের উল্লেখ করেছি। তাঁর পরিভাষায়, বর্বর-দশার মধ্য স্তরের পর থেকেই অকৃত্রিম ট্রাইব্যাল সংগঠনে ভাঙন শুরু হয়—শুরু হয় শ্রেণীবিভাগের সূচনা। কেন হলো? তার কারণ, কোথাও বা পশুপালনের উন্নতি এবং কোথাও বা কৃষিকাজের উন্নতি। পশুপালনের উন্নতির ফলেই কী ভাবে নতুন শ্রেণীবভক্ত সমাজের সূচনা হয় তার দৃষ্টান্ত হিসেবে এঙ্গেলে্‌স্‌ (২৮৭) আর্যজাতির কথা উল্লেখ করছেন। এঙ্গেল্‌স্‌-এর সময়ে সিন্ধুসভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়নি। আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদেরা (২৮৮) বলছেন, প্রাচীন মিশরের মতোই এই সিন্ধুসভ্যতার ঐশ্বর্যের ভিত্তি ছিলো কৃষির উন্নতি।
তাহলে, ভারতবর্ষের ইতিহাসেই আদিম-সমাজে ভাঙন ধরবার দুটি ধারার পরিচয় পাওয়া যায় : এক, বৈদিক মানুষদের জীবনে পশুপালনের উন্নতি ট্রাইব্যাল-সমাজে ভাঙন নিয়ে এলো। দুই, হরপ্পা-মহেনজোদারোর মানুষদের জীবনে কৃষির উন্নতি নগর সভ্যতা ও রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করলো।
অধ্যাপক গর্ডন-চাইল্ড-ও (২৮৯) বৈদিক সাহিত্যের আভ্যন্তরীণ তথ্য পর্যালোচনা করে যে-সিদ্ধান্তে আসছেন সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে মানতে হবে, যারা বৈদিক সাহিত্য রচনা করেছিলো, তারা পশুপালনের দ্বিতীয় পর্যায়টিতেই জীবন ধারণ করতো। এই পর্যায়টি হলো প্রাক্‌-বিভক্ত সমাজ এবং শ্রেণী-সমাজের সীমারেখে—একদিকে আদিম ট্রাইব্যাল সমাজ ভেঙে যাচ্ছে, আর একদিকে জন্ম হচ্ছে নতুন সমাজের। এর পরও বৈদিক মানুষদের জীবনে ট্রাইব্যাল-সমাজের যে-সব চিহ্ন পড়ে থেকেছে সেগুলি ফাঁপা কাঠামোর মতো।
সংক্ষেপে : ট্রাইব্যাল-সমাজ ছেড়ে শ্রেণী সমাজের দিকে অগ্রসর হবার দুটি পথ। এই দুটি পথকে পশুপালনের পথ ও কৃষিকর্মের পথ বলা যায়।
অবশ্যই বৈদিক মানুষেরা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসেছিলো কি না সে-প্রশ্ন নিয়ে বিশেষজ্ঞ-মহলে মতান্তর আছে। যদি শেষ পর্যন্ত এই কথাই প্রমাণিত হয় যে বৈদিক মানুষেরা ছিলো আদি অকৃত্রিম ভারতবাসী, এবং ভারতবর্ষ থেকেই এই আর্যদের কোনো কোনো শাখা প্রাচীন ইরান হয়ে প্রাগৈতিহাসিক ইজিয়ার দিকে অগ্রসর হয়েছিলো, (২৯০) তাহলে মানা যাবে ভারতবর্ষের বুকেই আদিম সমাজ ছেড়ে শ্রেণীসমাজের দিকে অগ্রসর হবার দুটি পথেরই পরিচয় রয়েছে : বৈদিক মানুষের বেলায় প্রথম পথটির এবং সিন্ধুসভ্যতার প্রবর্তকদের বেলায় দ্বিতীয় পথটির। কিন্তু ভারতবর্ষে আর্যোদয় সংক্রান্ত সবচেয়ে প্রচলিত মতটিই যদি শেষ পর্যন্ত অভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়,–অর্থাৎ, শেষ পর্যন্ত যদি এই কথাই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, বৈদিক মানুষেরা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসে এখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলো,–তাহলে স্বীকার করতে হবে উপরোক্ত প্রথম পথে ভারতবর্ষের বুকে রাষ্ট্রের আবির্ভাবের নজির এখনো পাওয়া যায়নি।
আমাদের পক্ষে এখানে ওই আলোচনা নিয়ে বেশিদূর অগ্রসর হবার উপায় নেই। কিন্তু এই দুটি পথের পার্থক্যের কথা মনে রাখা আমাদের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজন। এবং এ-কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, ভারতবর্ষের বুকের উপর পশুপালনের পথ ধরে সভ্যতার দিকে অগ্রসর হবার নিজির যদিও বা সুপ্রমাণিত হয় তাহলেও মানতে হবে আপেক্ষিকভাবে সে-পথটার গুরুত্ব অনেক কম। ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ, পশুপালন-প্রধান নয়—যদিও অত্যন্ত বিস্তৃত দেশ বলেই এখানে পশুপালনের নজিরও অসম্ভব নয়।
অতএব আমরা বিশেষ করে এই দ্বিতীয় পথটির দিকেই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখবো।
এই পথটির কথা বিশেষভাবে মনে রাখলে খাদ্য-আহরণ ও খাদ্য উৎপাদনের দিক থেকে অকৃত্রিম ট্রাইব্যাল-সমাজের দুটি পর্যায়ের কথা স্বীকার করা দরকার। এক, শিকার-জীবী; দুই, প্রাথমিক কৃষিজীবী—অর্থাৎ, কৃষিজীবিকার বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্য স্তর—কেননা, কৃষিজীবিকার উচ্চ স্তর থেকেই অকৃত্রিম ট্রাইব্যাল সমাজের ভাঙন শুরু।
এবার এই তথ্যগুলিকে সাধারণভাবে জানতে-পারা সত্য হিসেবে গ্রহণ করে দেখা যাক, প্রাচীন পুঁথিপত্রের কোনো কোনো উক্তিকে নতুন করে বোঝবার সুযোগ হয় কিনা।

 

আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি, গণ বলে সেকালের পুঁথিপত্রে যে-শব্দটির ব্যবহার হয়েছে তার প্রকৃত তাৎপর্য হলো ট্রাইব। ট্রাইব্যাল সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের কথাও আমরা আলোচনা করলাম; খাদ্য-আহরণ বা খাদ্য-উৎপাদনের দিক থেকে ট্রাইব্যাল সমাজকে প্রধান দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যাচ্ছে—শিকারজীবী এবং কৃষিজীবী। কৃষি-ব্যবস্থায় উন্নতি হতে হতে একটা স্তরে পৌঁছোবার পর থেকেই ট্রাইব্যাল সমাজে ভাঙন দেখা দেয়।
পাণিনির এবং কৌটিল্যের রচনা থেকেও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, আমাদের দেশে কোনো কোনো গণ ছিলো শিকারজীবী, আর কোনো কোনো গণ ছিল কৃষিজীবী। প্রাচীনদের পরিভাষায়, প্রথম ধরনের গণগুলি হলো আয়ুধজীবী এবং দ্বিতীয় ধরনের গণগুলি বার্তাশস্ত্রোপজীবী।
এক ধরনের গণের বিশেষণ হিসেবে পাণিনি (২৮১) আয়ুধজীবী শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আয়ুধ বলতে বোঝায় অস্ত্র। কিন্তু অস্ত্র শিকারের জন্যেও হতে পারে, যুদ্ধের জন্যেও হতে পারে। জয়সওয়াল (২৯২) প্রমুখ বিদ্বানেরা গণকে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে কল্পনা করেন; তাই তাঁদের পক্ষে এই প্রসঙ্গে আয়ুধ শব্দটিকে শিকারের হাতিয়ার অর্থে গ্রহণ করা কঠিন। ফলে পাণিনির আয়ুধজীবী গণকে তাঁরা এই বলে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করছেন যে, এ-ছিলো সেকালের ভারতবর্ষের এক-রকম মিলিটারি রিপাব্‌লিক্‌–অর্থাত কিনা, এমন ধরনের প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যার প্রধান বৃত্তিই হলো যুদ্ধ। কিন্তু স্বয়ং বিঘ্নরাজই আধুনিক ঐতিহাসিকদের এই ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিঘ্ন সৃষ্টি করেন এবং আয়ুধজীবী গণকে শিকারজীবী ট্রাইব হিসেবেও ব্যাখ্যা করবার প্রচেষ্টাকে প্রশ্রয় দেন।
এ-বিষয়ে গণেশের কাছ থেকে ঠিক কোন ধরনের তথ্য পাওয়া যায়?
আমাদের দেশের দেবদেবীরা খালি হাতে থাকেন না; তাঁদের হাতে সাধারণত কোনো অস্ত্র বা প্রতীক-চিহ্ন থাকে। এ-গুলিকে বলা হয় আয়ুধ-পুরুষ—অর্থাৎ কিনা এগুলা হলো দেবদেবীর আয়ুধ, যদিও অবশ্য আয়ুধগুলিকে এ-ক্ষেত্রে খানিকটা ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন হিসেবে কল্পনা করা হয়। কিন্তু মানুষ হিসেবে কল্পনা করার চেষ্টাটা যে কৃত্রিম, অতএব অর্বাচীন, তার প্রমাণ আছে : আয়ুধগুলিকে কখনো পুরুষ আবার কখনো স্ত্রীলোক হিসেবে দেখবার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু এই স্ত্রী-পুরুষের পার্থক্যটা নির্ভর করে আয়ুধবাচক সংস্কৃত শব্দটির ব্যাকরণগত লিঙ্গের ওপর (২৯৩)। স্ত্রীলিঙ্গের শব্দ দিয়ে যদি আয়ুধটির নাম হয় তাহলে আয়ুধটিও স্ত্রীলোক হয়ে যাবে। এই ব্যবস্থা দেখলেই বোঝা যায়, আয়ুধগুলির পক্ষে স্ত্রী-রূপে কল্পিত হওয়া আর পুরুষরূপে কল্পিত হওয়া দুই-ই,–অর্থাৎ মনুষ্যরূপে কল্পিত হবার ঘটনাটিই,–কৃত্রিম চিন্তার পরিচায়ক।
তাহলে, আয়ুধ-পুরুষের কথা বাদ দিয়ে এগুলিকে শুধুমাত্র আয়ুধ বলেই দেখবার চেষ্টা করা যায়। প্রশ্ন নিশ্চয়ই উঠবে, দেবদেবীর হাতে এই জাতীয় আয়ুধ থাকবার তাৎপর্যটা কী? বলাই বাহুল্য, এ-বিষয়ে উত্তরকালের ধর্মগ্রন্থে কিছু কিছু আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টাই স্বাভাবিক। ললিতসহস্রনামের (২৯৪) টীকায় ভাস্কররায় এ-জাতীয় আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করছেন। বরাহপুরাণেও (২৯৫) বলা হয়েছে, শঙ্খ হলো অবিদ্যা-বিনাশকের প্রতীক, খড়্গ হলো অজ্ঞানচ্ছেদ-এর প্রতীক, ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং এই জাতীয় আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার জটিলতা দেখেই গোপীনাথ রাও (২৯৬) বলছেন,

Thus we may see that, in relation to these various weapons and emblems found in the heads of the images Hindu gods and goddesses, these us a consensus of opinion, showing that the early Hindus had probably a systematised symbolism as appertaining to their iconographic art in its application to religion. The key to this symbology is evidently lost and cannot be easily recovered…Till this lost key is recovered…nothing more than making mere guesses in the dark regarding the meaning and moral aim of Hindu icons is really possible.
অর্থাৎ, সংক্ষেপে, দেবদেবীদের হাতের ওই আয়ুধগুলির কোনো গূঢ় সাংকেতিক অর্থ নিশ্চয়ই ছিলো। কিন্তু সে-অর্থ উদ্ধারের চাবিকাঠি হারিয়ে গিয়েছে—এবং সেই হারানো চাবিকাঠিটি যতোদিন না খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে ততোদিন পর্যন্ত প্রতিমাকল্পনার গূঢ় অর্থ ও নৈতিক তাৎপর্য সংক্রান্ত কথা আন্দাজে ঢিল ছোঁড়বারই সামিল।

গূঢ় আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের সম্ভাবনায় বিহ্বল না হয়ে ওই হারানো চাবিকাঠি খুঁজে পাবার আশায় একান্ত লোকায়তিক প্রশ্ন তোলা যাক এবং দেখা যাক লোকবন্ধু গণপতি এ-বিষয়ে আমাদের সত্যিই সাহায্য করেন কি না।
ভারতবর্ষের নানান জায়গায় গণেশকে পাওয়া যায় নানান রূপে। পুঁথিপত্রগুলিতেও গণেশের নানা রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। স্বভাবতই, এই সব বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর হাতের আয়ুধগুলি যে একই রকম হবে তা মনে করা ঠিক নয়। গণেশের নানা কল্পনায় তাঁর হাতে নানা রকমের আয়ুধ দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু, যেটা বিশেষ করে লক্ষ্য করবার কথা, এতো পার্থক্য সত্ত্বেও গণেশের পরিকল্পনায় দুটি আয়ুধ প্রায় অবিচ্ছেদ্যভাবেই থাকতে দেখা যায়। একটি হলো পাশ—lasso; আর একটি হলো অঙ্কুশ—elephant goad। উচ্ছিষ্ট গণপতি, উন্মত্ত-উচ্ছিষ্ট গণপতি, বিঘ্নরাজ গণপতি, বীরবিঘ্নেশ্বর, হেরম্ব, নেত্যগণপতি প্রভৃতি গণেশের আদিম রূপের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে তরুণগণপতি, লক্ষ্মীগণপতি, প্রসন্নগণপতি, ভুবনেশ গণপতি, হরিদ্রা গণপতি প্রভৃতি উন্নত ও মার্জিত পরিকল্পনাগুলি পর্যন্ত প্রায় সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে গণেশের হাতে রয়েছে ওই পাশ ও অঙ্কুশ (২৯৭)।
পাশ আর অঙ্কুশ হাতে গণেশ কী করছিলেন,–কী করা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর? আমরা যদি এই সহজ প্রশ্নটি তুলতে রাজি হয় তাহলে তার একমাত্র একটিই জবাব পাওয়া যেতে পারে : পাশ আর অঙ্কুশের সাহায্যে তিনি নিশ্চয়ই হাতি-শিকার করছিলেন। কেননা, তাছাড়া এ-দুটি জিনিস আর কোন কোন কাজে ব্যবহৃত হতে পারে? আমরা ইতিপূর্বেই বলেছি, গণেশের গজানন-রহস্যের মূলে আছে টোটেম্‌-বিশ্বাস এবং আমাদের যুক্তির বর্তমান পরিস্থিতিতে উল্লেখ করা দরকার, নৃতত্ত্বের সাধারণ সিদ্ধান্ত অনুসারে টোটেম্‌-বিশ্বাসের উৎস ট্রাইব্যাল-সমাজের শিকারজীবী পর্যায়েরই (২৯৮)। তার মানে যে-কারণে গণেশের ওই গজানন, সেই কারণেই তাঁর হাতে পাশ আর অঙ্কুশ বলে দুটি আয়ুধ—শিকারের অস্ত্র।
গণেশের হাতের ওই আয়ুধ দুটির সাক্ষ্য সত্যিই মূল্যবান। হিন্দু দেবদেবীদের হাতের আয়ুধগুলির আদি-তাৎপর্য উদ্ধারের সমস্যা ছাড়াও ট্রাইব্যাল-সমাজ সংক্রান্ত আমাদের মূল আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার উপর এগুলি আলোকপাত করে। সমস্যাটা হলো, আয়ুধজীবী গণের বেলায় আয়ুধ শব্দটিকে কোন অর্থে গ্রহণ করা হবে—যুদ্ধের অস্ত্র, না, শিকারের হাতিয়ার? যদি দেখা যায়, স্বয়ং গণপতির হাতেই এমন আয়ুধ রয়েছে যা কিনা যুদ্ধ ব্যাপারে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক,–প্রাসঙ্গিক শুধুমাত্র শিকারের ব্যাপারেই,–তাহলে আয়ুধজীবী গণকে যুদ্ধবৃত্তিপরায়ণ রাষ্ট্র মনে না করে শিকারজীবী ট্রাইব বলাই স্বাভাবিক নয় কি?
কিন্তু ট্রাইব্যাল-সমাজ শুধুমাত্র শিকারজীবী পর্যায়েরই নয়। শিকারজীবী পর্যায়ের পর কৃষিজীবী পর্যায়। কৃষিজীবী পর্যায়ের গণ-সমাজ সম্বন্ধে আমাদের পুওনো পুঁথিপত্রে কি কোনো নজির পাওয়া যায়? তাছাড়া, যেহেতু নামেই প্রমাণ যে, গণ থেকেই গণপতির পরিকল্পনা সেইহেতু এ-কথা আশা করাও হয়তো অবিবেচনার লক্ষণ হবে না যে, গণপতির ইতিহাসটাও শুধুমাত্র শিকারজীবী পর্যায়ের প্রতিচ্ছবিতেই পরিসমাপ্ত হয়নি। অর্থাৎ, শিকারজীবী পর্যায় পেরিয়ে গণসমাজ যখন কৃষিজীবী পর্যায়ে পৌঁছেছে তখন গণপতির পরিকল্পনা থেকে যদিও পুরোনো পর্যায়ের স্মৃতিচিহ্ন সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি, তবুও তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন পর্যায়ের কিছুকিছু নতুন চিহ্ন।
প্রথমে দেখা যাক, পুরোনো পুঁথিপত্রে আয়ুধজীবী গণ ছাড়া আর কোন ধরনের গণের পরিচয় পাওয়া যায় কি না।
কৌটিল্য (২৯৯) গণ বা সংঘগুলিকে দু’ভাগে ভাগ করছেন। দুটির নাম দিচ্ছেন রাজশব্দোপজীবী এবং বার্তাশস্ত্রোপজীবী। রাজশব্দ যে কী করে উপজীবিকা হতে পারে অবশ্যই বোঝা কঠিন; তাই ‘রাজশব্দোপজীবী’র আক্ষরিক অর্থ অনেকাংশেই অস্পষ্ট এবং আধুনিক বিদ্বানেরা (৩০০) এর যে-সব ব্যাখ্যা করেছেন তা স্পষ্টতই চেষ্টাকল্পিত। কিন্তু বার্তাশস্ত্রোপজীবী বলে কথাটির মানে খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। বার্তা মানে প্রধানতই চাষবাস, বার্তাশস্ত্র তাই চাষবাসের যন্ত্রপাতি,–বার্তাশস্ত্রোজীবী গণ বলতে কৃষিভিত্তিক ট্রাইব্যাল সমাজ।
তাহলে পাণিনির পাশাপাশি কৌটিল্যের রচনা মনে রাখলে অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে, আমাদের দেশের প্রাচীন পুঁথিপত্রেই শিকারজীবী এবং কৃষিজীবী—উভয় পর্যায়ের ট্রাইব্যাল সমাজেরই পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাচীনদের পরিভাষায় এই দুটির নাম হলো, আয়ুধজীবী গণ এবং বার্তাশস্ত্রোপজীবী গণ।
গণপতির পরিকল্পনায় কি আয়ুধজীবী পর্যায়ের চিহ্ন ছাড়াও বার্তাশস্ত্রোপজীবী পর্যায়ের কোনো নতুন লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়? উত্তরে বলবো, বহু পরিচয়। যেমন, পাশ আর অঙ্কুশ ছাড়াও গণেশের হাতে দেখা দিলো ডালিম ফল, নারকোল, আম্রপল্লব, কল্পকলতা, পদ্ম, ইত্যাদি (৩০১)। আমরা একটু পরেই দেখতে পারো, এই প্রতীকগুলির প্রত্যেকটিই কৃষি আবিষ্কারের পরিচায়ক।
বস্তুত, গণেশের পরিকল্পনার সঙ্গে কৃষির যোগাযোগ এতো বহুল যে, এখানে তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা করবার অবকাশ নেই। তাছাড়া, কৃষি-আবিষ্কার সংক্রান্ত সাধারণভাবে জানতে-পারা তথ্যের আলোচনা করবার আগে গণেশের রূপপরিকল্পনায় এই চিহ্নগুলির উল্লেখ অনেকাংশেই দুর্বোধ্য থেকে যাবে।
আমরা তাই এখানে কয়েকটি প্রশ্নের শুধুমাত্র অবতারণাই করে রাখবো। প্রশ্নগুলির মীমাংসা পাওয়া যাবে কৃষি-আবিষ্কার সংক্রান্ত সাধারণভাবে জানতে-পারা তথ্যের আলোচনা করবার পর।
প্রথম প্রশ্ন হলো, গণেশের সঙ্গে রক্তবর্ণের একান্ত নিবিড় সম্পর্ক নিয়ে।
মন্ত্রমহার্ণবে (৩০২) বলা হয়েছে, গণেশের মূর্তি হবে রক্তবর্ণ। তন্ত্রসার (৩০৩) অনুসারে গণেশের তান্ত্রিক ধ্যানে ‘সিন্ধুরাভং’, ‘রক্তবস্ত্রাঙ্গরাগং’ প্রভৃতি কথা পাওয়া যাচ্ছে। শঙ্করবিজয়ে (৩০৪) গাণপত্য-সম্প্রদায় প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, গাণপত্যরা কপালে রক্তবর্ণ ফোঁটা আঁকে—এই রক্তবর্ণতিলকই তাদের বৈশিষ্ট্য। রাঙাজবাকে বলে গণেশ-কুসুম (৩০৫), সিঁদুরের নাম হলো গণেশভূষণ (৩০৬)। নর্মদার তীরে গণেশকুণ্ডের কাছে একটি রক্তবর্ণ শিলাখণ্ডের নাম দেওয়া হয় গণেশশিলা (৩০৭)। মহামহোপাধ্যায় পি. ভি. কানে (৩০৮) দেখাচ্ছেন, বিষ্ণুর উপাসনায় যে-রকম শালগ্রামশিলা ব্যবহার করা হয়, গণেশের উপাসনায় তেমনি একটি রক্তবর্ণ শিলাখণ্ড ব্যবহার করার নির্দেশ আছে। এইভাবে, গণেশের সঙ্গে নানান দিক থেকে রক্তবর্ণের ঘনিষ্ট যোগাযোগ দেখতে পাওয়া যায়। প্রশ্ন হলো, ওই রক্তবর্ণের তাৎপর্যটা ঠিক কী? তার সঙ্গে কৃষিকর্মমূলক কোনো আদিম বিশ্বাসের যোগাযোগ আছে কি না? ভারতবর্ষের পিছিয়ে-পড়া মানুষদের দিকে চেয়ে দেখলে নিশ্চয়ই সে-রকম যোগাযোগের কথাই অনুমান করতে হয়। ভীল-রা ক্ষেতে বীজ বোনবার আগে একটি শিলাখণ্ডের উপর সিঁদুর মাখায়—শিলাটিকে তারা বলে গণেশ (৩০৯)।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, ভারতবর্ষীয় মূর্তিরচনার ক্ষেত্রে এবং নানা ভাস্কর্যে দেখতা পাওয়া যায় গণেশের সঙ্গে এক বা একাধিক স্ত্রী-মূর্তির যোগাযোগ ঘটছে। ইলোরার গুহায় (৩১০) গণেশ আর একা নন; তাঁর সঙ্গে সাতটি মাতৃমূর্তির—সপ্তমাকৃকার—যোগাযোগ হয়েছে। গণেশের একজাতীয় মূর্তির নাম শক্তিগণপতি (৩১১)। শক্তিগণপতির নানান রূপ : লক্ষ্মী-গণপতি, উচ্ছিষ্ট গণপতি, মহাগণপতি, ঊর্ধ্ব-গণপতি, পিঙ্গল-গণপতি। এই মূর্তিগুলির প্রত্যেকটির ক্ষেত্রেই দেখা যায় গণেশের সঙ্গে একটি করে নারীমূর্তি সংযুক্ত হয়েছে। নারীমূর্তিগুলিকে বলা হয় গণেশের শক্তি। তন্ত্রসাহিত্যে (৩১২) পঞ্চাশটি গণেশের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং তান্ত্রিক মতে প্রত্যেকটি গণেশের সঙ্গেই একটি করে শক্তির যোগাযোগ আছে। তাই প্রশ্ন ওঠে, এই সব ক্ষেত্রে গণেশ একা নন কেন? কেন অমন অবধারিতভাবে নারীমূর্তির সঙ্গে গণেশ সংযুক্ত হচ্ছেন? তার সঙ্গেও কি কৃষি-আবিষ্কার-মূলক কোনো ব্যাপারের সম্পর্ক আছে?
তৃতীয়ত, গণেশের সঙ্গে তান্ত্রিক ধ্যানধারণার যোগাযোগ। তান্ত্রিক সাহিত্যে গণেশ যে কী রকম গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখন করে আছেন তার আলোচনা ইতিপূর্বে অনেকেই (৩১৩) করেছেন। এখানে আমাদের পক্ষে একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করাই যথেষ্ঠ হবে। আনন্দগিরির শঙ্করবিজয়ে (৩১৪) গাণপত্যসম্প্রদায়ের একটি শাখার—অর্থাৎ, উচ্ছিষ্টগণপতির উপাসকদের—বক্তব্য-বর্ণনায় বলা হয়েছে :

কিঞ্চ মদীয়াচারে ধর্ম্মদ্বয়মেবানুবর্ত্তনীয়ম্‌। পুরুষাণাং সর্ব্বজাতিকানাং একজাতিবৎ ইত্যেকঃ ধর্মঃ। স্ত্রীণাং সার্ব্ববর্ণিকানাং একজাতিবৎ ইত্যেকঃ ধর্ম্মঃ। তেষাং তাসাঞ্চ সংযোগে-বিয়োগে চ দোষাভাবঃ। অস্যা অয়মেব পতিরিতি নিয়ামকাভাবাৎ তাসু রজঃসিক্তাদৌ সুসম্পর্কে জাতে রুধিরবাহুল্যাৎ আনন্দাধিক্যাচ্চ। (সর্ব্বে বর্ণাঃ সমানজাতয়ঃ দাম্পত্যব্যবস্থা নাস্তি। যেন কেনাপি পুরুষেণ স্বস্ব হেরম্বতাং বিভাব্য যাং কাঞ্চিৎস্ত্রিয়ং তচ্ছক্তিং বিচিন্ত্য সুরতেন সম্ভোগঃ কার্য্যঃ। ইত্যধিকঃ ক্বচিৎ)। আনন্দপ্রাপ্তিরেব ব্রহ্মপ্রাপ্তিরিতি তস্য সচ্চিদানন্দলক্ষণাচ্চ। তস্মাৎ উচ্ছিষ্টগণপতেঃ অখণ্ডানন্দ্রূপত্বেন ব্রহ্মরূপত্বেন চ তন্মতম্‌ অনন্যভেদঃ। তাদৃশাঃ সর্ব্বে ব্রহ্মাদয়ো দেবাঃ। অংশাশিনো অভেদঃ প্রতিপাদিতো রুদ্রকাণ্ডে। নমো কেপি নমো গণেভ্যো গণপতিভ্যশ্চ বো নমো নম ইতি। গণরূপেভ্যো গণপতিরূপেভ্যশ্চ রুদ্রেভ্যো নম ইত্যনেন গণত্বং গণপতিরূপত্বঞ্চ একস্মিন্‌ রুদ্রে ঘটতে।
অর্থাৎ,
উপরন্তু আমাদের মতে দুইটি ধর্মের অনুসরণ করা উচিত। বিভিন্ন জাতীয় পুরুষগণের একজাতির ন্যায় ব্যবহার—এই একটি ধর্ম। সমস্ত বর্ণের স্ত্রীলোকদিগের একজাতির ন্যায় ব্যবহার—এই আর একটি ধর্ম। এই পুরুষগণের এবং এই নারীগণের পরস্পর মিলনে এবং বিচ্ছেদে কোনো দোষ নেই; কেননা ওই বিশেষ পুরুষই এই নারীর পতি, এমন কোন নিয়ম নেই। রজঃপ্রকৃতি সিক্ত হইলে উপযুক্ত মিলনজাত রুধিরবাহুল্য হেতু আনন্দাধিক্য উপজাত হয়। (সমস্ত বর্ণগুলিই এক-জাতীয়, তাদের মধ্যে কোনো দাম্পত্য ব্যবস্থা নাই। যে-কোন পুরুষই নিজেকে হেরম্ব বলে বিবেচনা করে এবং যে-কোন স্ত্রীলোককে শক্তিরূপে বিবেচনা করে সুরত কার্যের দ্বারা সম্ভোগ করতে পারে।) আনন্দলাভই ব্রহ্মপ্রাপ্তি—তাই-ই সচ্চিদানন্দের লক্ষণ। এই জন্যই উচ্ছিষ্টগণপতির অখণ্ডানন্দরূপ এবং ব্রহ্মরূপ পরস্পর এক ও অভিন্ন। ব্রহ্মাদি দেবগণও এই রূপ। অংশ এবং অংশীর প্রভেদ রুদ্রকাণ্ডে প্রতিপাদিত হয়েছে। “গণদিগকে এবং গণপতিদিগকে, এই সকলকেই আমি নমস্কার করি।” “গণের রূপসমূহকে, গণপতির রূপসমূহকে, রুদ্রদিগকে নমস্কার করি”—ইহার দ্বারা গণত্ব ও গণপতিরূপত্ব একই রুদ্রে আরোপিত হয়।

অবশ্যই, “রজসিক্তাদৌ সুসম্পর্কে জাতে রুধিরবাহুল্যাৎ”—ইত্যাদির আদি ও অকৃত্রিম তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা পরে তোলা যাবে। এই উদ্ধৃতিটির মধ্যে চিত্তাকর্ষক তথ্য একটি নয়, একাধিক। যেমন ধরা যায়, গাণপত্য সম্প্রদায়ের পক্ষে ওই অংশ-অংশী-অভেদ-ন্যায়ের সাহায্যে গণ এবং গণপতির মধ্যে অভেদ-প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আমাদের বর্তমান আলোচনায় যে-কথাটি সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সেটি হলো, উচ্ছিষ্টগণপতিকে কেন্দ্র করে অত্যন্ত প্রকট বামাচারী ধ্যানধারণা। গাণপত্যসম্প্রদায়ের এই শাখাটির সঙ্গে সহজিয়া প্রভৃতিদের পার্থক্য কতটুকু? বস্তুত, শঙ্কর-বিজয়ের লেখক (৩১৫) অত্যন্ত স্পষ্টভাষায় একাধিকবার বলে দিচ্ছেন, এই গাণপত্যসম্প্রদায়টি বামমার্গাবলম্বী, বামাচারী। আমাদের প্রশ্ন হলো, গণেশকে কেন্দ্র করে এই যে বামাচারী ধ্যানধারণাগুলির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে এর সঙ্গে “বার্তাশস্ত্রোপজীবী গণ”-এর কোনো সম্পর্ক আছে কি না? অর্থাৎ এই ধ্যানধারণাগুলির উৎসে কৃষিআবিষ্কার পর্যায়ের বিশ্বাসই খুঁজে পাওয়া যায় কি না?

————–
২৮৪. G. Thomson SAGS 33.
২৮৫. Ibid. 33.
২৮৬. F. Engels OFPPS 259ff.
২৮৭. Ibid. 259.
২৮৮. G. Childe WHH, S. Piggot PI ইত্যাদি দ্রষ্টব্য।
২৮৯. G. Childe A 78-93.
২৯০. বর্তমান ঐতিহাসিক গবেষণা ক্রমশই এ-সিদ্ধান্তের পক্ষপাতী হচ্ছে।
২৯১. পাণিনি ৪.৩.৯ এবং ৫.৩.১১৪
২৯২. K. P. Jayaswal HP 1:ch. V.
২৯৩. T. A. G. Rao EHI 1:287
২৯৪. Ibid. 1:294.
২৯৫. Ibid. 1:295.
২৯৬. Ibid. 1:295-6.
২৯৭. Ibid. 1:52-63.
২৯৮. G. Thomson AA ch.1.
২৯৯. অর্থশাস্ত্র (বসাক) ২০৯।
৩০০. জয়সয়াল মজুমদার প্রমূখের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
৩০১. T. A. G. Rao EHI 1:52-63.
৩০২. Ibid. 1:54.
৩০৩. বৃহৎতন্ত্রসার (বসুমতী) ৩১।
৩০৪. cf. Colebrooke ME 1:212.
৩০৫. বিশ্বকোষ ৫:২০৬।
৩০৬. ঐ ৫:২০৮।
৩০৭. ঐ ৫:২০৫।
৩০৮. P. V. Kane HD 2:716.
৩০৯. W. Crooke RFNI 250.
৩১০. A. Getty G plate 2c.
৩১১. T. A. G. Rao EHI Vol. I Part I.
৩১২. বিশ্বকোষ ৫:২০২।
৩১৩. A. Getty G7; ERE 6:176; বিশ্বকোষ ৫:২০২; T. A. G. Rao EHI Vol. I Part I.
৩১৪. আনন্দগিরি : শঙ্করবিজয়, সপ্তদশ প্রকরণ।
৩১৫. “বামবাহুল্যাৎ” শব্দ দ্রষ্টব্য : পৃ. ১১৫।