চব্বিশ জুলাই, রবিবার
ভোরের কাগজ আজ কজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মন্তব্য ছেপেছে।
শিরোনাম। প্রসঙ্গঃ তসলিমা
ভূমিকা। তসলিমা নাসরিন এখন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক কূটনীতির এক বিরাট ইস্যু। গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করা হয়েছে এবং তিনি আত্মগোপন করে আছেন। এসব প্রসঙ্গে আমরা টেলিফোনে কথা বলেছি কজন বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে। তবে এর বাইরেও আমরা যোগাযোগ করেছিলাম কয়েকজনের সঙ্গে, তাঁরা এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
শামসুর রাহমান, কবি
ভলতেয়ার বলেছিলেন, আমি তোমার সঙ্গে একমত নই, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকার আমি রক্ষা করতে চাই আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে। যে কোনও লেখকের মত প্রকাশের অধিকার আছে। যেমন আছে প্রতিটি নাগরিকের। সবাই এক বিষয়ে একমত হবে, এমন নয়। একমত না হলে সেটা খণ্ডন করা যাবে লেখা দিয়ে। কিন্তু তা না করে জেল বা প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া ফ্যাসিবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। আধুনিক সভ্য সমাজে এটা চলতে পারে না। এমনটা হতে পারে বর্বর সমাজে, যেমন ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল ভিন্নমত প্রকাশ করার কারণে। যারা মানবতাবাদী, গণতান্ত্রিক, তারা সব সময়ই বাক স্বাধীনতা হরণের চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়ে যাবেন। তসলিমা নাসরিন স্পীকারের কাছে চিঠিতে বলেছেন, যে উক্তির জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তা তিনি বলেননি। এরপরও তার প্রাণনাশের হুমকি আসছে। অথচ সরকার নির্বিকার। যারা প্রকাশ্যে নাগরিকদের প্রাণনাশের হুমকি দেয়, তাদের বিরুদ্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে পত্রিকার সম্পাদক লেখকদের গ্রেপ্তার করছে। এটা নিন্দনীয়।
নাসরিন যে আত্মগোপন করেছেন তাছাড়া কি বা তাঁর করার ছিল। মৌলবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে লেগেছে। সরকার সাহায্য করছে না। তাঁর তো নিজেকে রক্ষা করতে হবে।
হুমায়ুন আজাদ, কবি, অধ্যাপক
নাসরিন নামের একটি তুচ্ছ বস্তুকে বাংলাদেশের অপদার্থ সরকার, আনন্দবাজার আর হিন্দু মুসলমান মৌলবাদীরা আন্তর্জাতিক বস্তুতে পরিণত করেছে। এটা এখনকার সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার। বাংলাদেশের সরকার যে কাজটি করেছে অর্থাৎ যে জামিনবিহীন গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করেছে, এটাকে আমি অত্যন্ত অন্যায় কাজ বলে মনে করি। এটা শুধু অন্যায় নয়, এটা প্রগতিশীলতার সঙ্গে একটি বড় ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। সরকার এখন নিজের নির্বুদ্ধিতার জালে নিজেই জড়িয়ে পড়েছে এবং সম্ভবত ভবিষ্যতে আরও পড়বে। সে যে ধরা দিচ্ছে না এতে বোঝায় যে বাংলাদেশের আইন ও বিচারের ওপর তার কোনও আস্থা নেই এবং এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, বাংলাদেশের আইন ও বিচারের ওপর এখন আস্থা রাখা সত্যিই অসম্ভব হয়ে উঠেছে। সে সম্ভবত এখন শক্তিশালীদের আশ্রয়ে রয়েছে, যারা বাংলাদেশের সরকারের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। কাজেই সরকারের ওই পরোয়ানা সরকারকেই গিলে ফেলতে হবে। আমার মনে হয় তার ধরা না দেওয়াই ভাল। এটি একটি শক্তির পরীক্ষা হয়ে যাবে। এই সময়ের একটি বেশ হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, নাসরিনের মত একটি তুচ্ছ বস্তুকে নিয়ে সারা পৃথিবীর মেতে ওঠা। পশ্চিম ইওরোপ তার জন্য দরজা খুলে দিয়েছে।
ফয়েজ আহমদ. সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
আসলে সাম্প্রদায়িকতাকে শক্তিশালী করার জন্য তসলিমা ও তার রচনাকে সুকৌশলে ইস্যু করা হচ্ছে। এর সঙ্গে ভারতীয় সাম্প্রদায়িক শক্তি ও পশ্চিম দেশীয় খ্রিস্টানদের একটি অংশ জড়িত রয়েছে। এবং সেই কারণে স্থানিক সাম্প্রদায়িক ও হত্যার হুমকিদানকারী অপশক্তি তাদের বল বৃদ্ধি করার সুযোগ পাচ্ছে।
কোনও ইসলামী দেশ যদি খলিফা দ্বারা পরিচালিত হয় এবং সেই খলিফা যদি কোনও ধর্মীয় পণ্ডিতকে মুফতী হিসেবে নিয়োগ করেন তবে কেবল সেই মুফতীরই ইসলাম ধর্মের বিধিবিধান অনুযায়ী ফতোয়া জারি করার অধিকার আছে। বাংলাদেশ কোনও খলিফাশাসিত দেশ নয়। সুতরাং এখানে ফতোয়া জারি করার অবকাশ নেই। দেশের সাম্প্রদায়িক এবং রাষ্ট্রদ্রোহী শক্তি ব্যাপক তৎপরতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেষেন অশুভ প্রভাব বিস্তার করছে। যারা হুমকি দেয়, যারা যে কোনও লোককে মুরতাদ বলে ঘোষণা দেয়, রাষ্ট্রীয় আইনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত। এটা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে রহস্যজনক নীরবতা অবলম্বন করছে। এই মুহূর্তে তসলিমার নীতি, তার বক্তব্য এবং তার সাহিত্যনীতি নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই। শুধু তসলিমাকে নয়, একটি গণতান্ত্রিক দেশে কাউকে হত্যা করার হুমকি কেউ দিতে পারে না।
আমহদ ছফা, লেখক
তসলিমা নাসরিন ভারতের সৃষ্টি। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। এখানে হচ্ছে তার প্রতিক্রিয়া। পৃথিবী যখন ভারতকে হিংস্র বলতে লাগল তখন তসলিমার বই তাদের হাতে গেল। ভারতের পত্রিকাগুলো তসলিমার ইমেজ গড়ার জন্য উঠেপড়ে লাগল। বিজেপি তসলিমাকে দেবীর আসনে বসালো। ভারত বোঝাতে লাগল, আমরা নই বাংলাদেশই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করেছে। তার প্রমাণ তসলিমার বই। তসলিমার ব্যাপারে একটা দীর্ঘ প্রবন্ধে সব বলতে চেষ্টা করেছি। এখন সাম্প্রতিক প্রসঙ্গে আসি। তসলিমার কারণে আমরা একটা নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছি। স্টেটসম্যান পত্রিকায় বলেছে, কোরআনের মোটা দাগের সংশোধন হওয়া উচিত। তার সেই অধিকার নেই। কোরআন তসলিমা কিংবা তার বাবা লেখেনি। মানা না মানা তার ব্যাপার। ধর্মগ্রন্থ বিশ্বাস করে সব সমাজে এমন মানুষ অনেক। তাদের অনুভূতিতে আঘাত করার অধিকার কারওনেই। স্টেটসম্যান পত্রিকার একটা নিরপেক্ষতার সুনাম ছিল। যে দেশে ১৫ কোটি মুসলমান বাস করে তাদের অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কথা তারা ছাপল কেন বুঝি না। তসলিমা কত কথাই বলে সব তো ছাপে না। এটা কেন? এই আমার জিজ্ঞাসা। বাংলাদেশের মৌলবাদীদের ইচ্ছে করে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য পত্রিকাটি এই অপকর্ম করেছে। মৌলবাদীরা তসলিমার মস্তক দাবি করেছে। কোনও সভ্য মানুষ এটা সমর্থন করতে পারে না। বিবেকবান মানুষের এটা প্রতিবাদ করা উচিত। কিন্তু অন্যদিক থেকে তসলিমা এবং তাকে যারা সমর্থন করে তারা মৌলবাদকে এমনভাবে উস্কে দিয়েছে, স্বাধীন চিন্তাভাবনার লোক মস্ত বিপদে পড়ে গেছেন। মৌলবাদীরা এখন ব্লাসফেমি আইন পাস করার দাবি করছে। এটা পাস হলে স্বাধীনভাবে চিন্তার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষকরা স্বাধীনভাবে শিক্ষাদান করতে পারবে না। তসলিমা এবং তার সমর্থকদের অবিবেচনার কারণে দেশের সমস্ত চিন্তাশীল ব্যক্তি একটি সঙ্কটের সম্মুখে পড়েছে। এটা সঙ্কটের এক দিক। অন্যদিক হল, ভারত কূটনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে বিদেশে তসলিমার ইমেজ সৃষ্টি করে ফেলেছে। ক্লিনটন, জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলেছেন। ভারতের আনন্দিত হওয়া উচিত, কারণ তাদের সব পরিকল্পনা সফল হয়েছে। এখন আমরা মৌলবাদ ঠেকাবো না কি দেশে দেশে আমাদের জাতির নামে যে কলঙ্ক লেপন হচ্ছে তার প্রতিবাদ করব? তসলিমা একটি অমঙ্গলের শক্তি। শক্তিমান রাষ্ট্রগুলো তসলিমাকে সমর্থন জানাচ্ছে। আমাকে যাতে কেউ ভুল না বোঝে সে জন্য বলব, তসলিমার ওপর সবরকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতন বন্ধ করা হোক। তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হোক। তার বিরুদ্ধে যে হত্যার হুমকি আসছে তার মোকাবিলা করা হোক। এটা সমাজের চিন্তার স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন, নইলে এখানে বাস করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
ফরিদা রহমান, সাংসদ, বিএনপি
ঐসব আজেবাজে লেখা ছেড়ে দিয়ে তসলিমার মাফ চাওয়া উচিত। তারপর সাধারণ জীবনযাপন করা উচিত। উনি যা করেছেন তাতে জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। ধর্মের প্রতি আমাদের অগাধ বিশ্বাস। তাই তাকে ক্ষমা চাইতে হবে। জনগণ যদি ক্ষমা করে তারপর আমরা সাধারণ মহিলারা যেভাবে জীবনযাপন করি সেভাবে তার জীবনযাপন করতে হবে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সাংসদ, গণতন্ত্রী পার্টি
হোল ড্রামা ইজ ক্রিয়েটেড বাই দ্য গভরমেন্ট।
ফরিদা রহমান আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর সঙ্গে আমার আলাপ নেই। ফরিদা রহমান বিএনপি দলের সবচেয়ে প্রগতিশীল মানুষ বলে সকলেই জানেন। যখন বিএনপির বড় বড় নেতা নেত্রীরা চুপ হয়ে আছেন মৌলবাদীদের উত্থানের পরও, ফরিদা রহমান ক্ষুব্ধ হয়ে দাবি জানিয়েছেন যে একাত্তরের ঘাতকদের বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচার করতে হবে। তিনি মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধন দাবি করছেন। আমার বিশ্বাস যাঁরা আমার প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি, তাঁরাও আমাকে হুমায়ুন আজাদের মত তুচ্ছ মনে করেন বলে চাননি মন্তব্য করতে। তাঁদের অনেককে আমি হয়ত এতকাল ভেবে বসেছিলাম যে আমাকে সমর্থন করেন, আমার যে কোনও বিপদে তাঁরা আমার পাশে থাকবেন।
ঝ এই মন্তব্যগুলো পড়ে খুব খুশি, বললেন, দেখেছো, তোমাকে কতজন সাপোর্ট করছে! তোমার আর চিন্তা কি!
এসময় প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কেউ যে বলেননি যে আমার মুন্ডুটা কেটে নেওয়া উচিত সেটিই আমার সৌভাগ্য অবশ্য।
আজকের বাকি খবরগুলো হল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এস এম মুস্তাফিজুর রহমান বলেছেন হুলিয়া জারির পর তসলিমা আত্মগোপন করে আছে, আদালতে আত্মসমর্পণ করছে না, তার মানে সে এ দেশের আইন লঙ্ঘন করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ মন্তব্যটি ছাপা হয়েছে ফ্রান্সের ল মন্দ পত্রিকায়। আরেকটি খবর, ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আন্তর্জাতিক হেরাল্ড ট্রিবিউনে চিঠি লিখেছেন যে তসলিমা নাসরিন কোনও হয়রানির শিকার হননি বরং সরকার তাঁকে রক্ষার জন্য আইনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। যেহেতু আমাকে নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে বিদেশের পত্রিকায়, বলা হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বাংলাদেশের সরকার। তাই সরকারি আদেশে এখন বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর কাজ হল খবরগুলোর প্রতিবাদ করা। এদিকে তাহফুজে হারমাইন পরিষদের সভাপতি মাওলানা সাদেক আহমেদ সিদ্দিকী সরকারকে সাবধান করে দিচ্ছেন এই বলে যে তসলিমা নরওয়ের সাহিত্যঅনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে, তাকে কিছুতেই যেন দেশ ছাড়তে দেওয়া না হয়। যদি এই সরকার তসলিমাকে দেশ ছাড়তে দেয়, তবে এই সরকারের সব্বনাশ করে ছাড়বে দেশের মানুষ। ২৯ তারিখের লং মার্চের আগে যে করেই হোক তসলিমাকে গ্রেফতার করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান মাওলানা।
মৌলবাদীদের নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ১৩টি মৌলবাদী দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে বায়তুল মোকাররমের খবিতের নেতৃত্বে গড়া সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ আগামী ২৯ তারিখ লং মার্চ করবে বলে বলেছে। শহরের সবচেয়ে প্রশস্ত রাস্তা মানিক মিয়া এভিনিউতে মহাসমাবেশ হবে, সারা দেশ থেকে লং মার্চ করে লোক আসবে এখানে। প্রথম এই লং মার্চের ঘোষণা দিয়েছিল খেলাফত মজলিশ। এখন লুফে নিচ্ছে অন্য দলগুলো।
এ কি খেলা শুরু হয়েছে দেশে! এ খেলার শেষ কোথায়! জানিনা কিছুই।
Leave a Reply