দশ জুন, শুক্রবার
–তসলিমা, ঘুমিয়েছো রাতে?
–না।
–ঘুম আসছে না?
–নাহ!
–তুমি জানো আজ তোমার বিরুদ্ধে বায়তুল মোকাররমে গণবিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে!
–জানি।
–জানো আজ মিছিল তোমার বাড়ির দিকে যাবে! তোমার বাড়ি ঘেরাওএর কর্মসূচি আছে, জানো?
–জানি।
–তুমি জানো যে ৩০ তারিখ তোমার ফাঁসির দাবিতে সারাদেশে হরতাল ডাকা হয়েছে?
–জানি।
–তুমি জানো যে তোমার ঠিকানায় বিদেশ থেকে আসা চিঠিপত্র পত্রপত্রিকার পার্সেল কাস্টমসএ আটক করা হয়েছে?
–না।
–আজ পত্রিকা পড়েছো?
–না।
–কেন পড়নি? ভয় হয় বুঝি! আবার যদি দেখ তোমার পক্ষে কোনও বিবৃতি কেউ দেয়নি! তোমার বাক স্বাধীনতার পক্ষে কেউ কথা বলেনি! ভয় কেন! মানুষের সত্যিকার চেহারাটা এবার একটু চিনে নাও। ওঠো। দেখ। পড়। বোঝো।
–কেউ কি লিখেছে কিছু আজ?
–তোমার মত বোকা আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। আজও সব পত্রিকায় বিবৃতি গেছে, গতকাল কুলিয়ে উঠতে পারেনি ছেপে। আজও বিবৃতিতে ভরে আছে পত্রিকা! কেউ বলেনি তোমার কথা। তোমার কথা বলবে কেন? তুমি কে? তুমি কিμছু না। তুমি একটা ঘোড়ার ডিম। তুমি বোকার মত একা বসে বসে কেবল লিখেছো, সমাজের সমস্ত অন্ধকার দূর করার জন্য লিখেছো। কি লাভ হয়েছে লিখে? আজ সবাই জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের মুক্তি চেয়েছে, তাদের মামলা হুলিয়া তুলে নেওয়ার দাবি করেছে। একটা কথা কি জানো? ধর্মের সমালোচনা তো অনেকেই করে, কিন্তু মৌলবাদীরা তোমাকে টার্গেট করেছে কারণ তারা জানে যে তুমি একা, তুমি অসহায়, এ দেশে তোমার পক্ষে দাঁড়াবার মত কোনও ব্যক্তি নেই, সংগঠন নেই, কোনও রাজনৈতিক দল নেই। মৌলবাদীদের এই উত্থানে মদত দিচ্ছে কারা, তা জানো? দিচ্ছে তাবৎ রাজনৈতিক দল, প্রগতিশীল ব্যক্তি, সংগঠন, আর বুদ্ধিজীবী – বিবৃতিঅলাদের নীরবতা। তোমাকে ফাঁসি দিচ্ছে আসলে মৌলবাদীরা নয়, ফাঁসি দিচ্ছে প্রগতিশীলরা। আজও মৌলবাদীদের পত্রিকা ছাড়া আর সব পত্রিকায়, বাংলা বল ইংরেজি বল সব পত্রিকায় জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সরকারের মামলা দায়েরের নিন্দা করে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, উপসম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। কলাম ছাপা হয়েছে। কোথাও কেউ ভুলেও যোগ করছে না তোমার নাম। কেউ ভুলেও প্রতিবাদ করছে না তোমার মামলার।
–কেউই আমার কথা উল্লেখ করেনি? কেউই না?
–না। কেউ না। তবে একজন উল্লেখ করেছেন। গোটা কলামটাই তিনি তোমাকে নিয়ে লিখেছেন। তিনি বদরউদ্দির উমর। লিখেছেন তোমার কোনও অধিকার নেই প্রগতিশীল হওয়ার, কারণ তুমি কোনও দিন মিছিলে যাওনি, কোনওদিন স্লোগান দাওনি।
–মিছিলে না গেলে, স্লোগান না দিলে কি প্রগতিশীল হওয়া যায় না?
–উমর তো বলছেন হওয়া যায় না।
–তবে আমি কী? প্রতিক্রিয়াশীল?
–তুমি তারও চেয়ে অধম। তুমি একটা বাজে লেখক। লিখতে জানো না। রাজনীতির কিμছু জানো না। ধর্ম সম্পর্কে তোমার যা মত, তা পেটের ভেতর রাখতে পারো না, বিপদ জেনেও ফটফট করে বলে দাও। ধর্মের বিরুদ্ধে লিখে প্রগতিশীল আন্দোলনের ক্ষতি করেছো। তোমার লেখালেখির কারণে মৌলবাদীরা একটা ইস্যু পেয়েছে।
–বদরুদ্দিন উমর কি জনকণ্ঠের সাংবাদিকদেরও দোষ দিয়েছেন? কারণ জনকণ্ঠকেও তো মৌলবাদীরা ইস্যু করেছে!
–না তা দেননি, তিনি বিবৃতি দিয়েছেন জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের ওপর থেকে মামলা আর হুলিয়া তুলে নেওয়ার জন্য।
–আমার বিরুদ্ধে সরকারের মামলা আর হুলিয়া তুলে নিতে বলেননি?
–না। তুমি ধর্মের সমালোচনা করেছো, তোমার এসব শাস্তি প্রাপ্য ছিল, এমনই তাঁর মত। তিনি লিখেছেন তুমি অন্যের ক্রীড়নক হয়ে লিখছ।
–কার?
–অনুমান করে নাও। জানো তো কী দোষ তোমাকে দেওয়া হয়! বিজেপির, আনন্দবাজারের তুমি ক্রীড়নক!
–এগুলো তো মোল্লারা বলে। প্রগতিশীল বামপন্থীও বললেন? তিনি কি কোনও প্রমাণ দিতে পারবেন তাঁর এইসব মিথ্যের? পারবেন না। আমি কি বিজেপির একটি লোককে চিনি? চিনি না। আনন্দবাজারের কেউ কি আমাকে বলে দেয় আমি কী লিখব না লিখব? কখনই না। পশ্চিমবঙ্গে আমার লেখা পাঠক পড়তে চায় বলে আনন্দবাজার আমার লেখা ছাপে বা বই ছাপে।
–তুমি আনন্দ পুরস্কার পেয়েছো, এটাকে তোমার দোষ বলে ভাবা হচ্ছে।
–এ কী করে আমার দোষ হয়? আনিসুজ্জামান পেয়েছেন, শামসুর রাহমানও তো আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন, কই তাদের তো কেউ দোষ দিচ্ছে না?
–তাঁরা তো অনেক বড়। তাঁরা পেতেই পারেন আনন্দ পুরস্কার। তুমি এত ছোট হয়ে কেন পেলে, সেটাই তোমার দোষ। তুমি যদি কোনও পুরস্কার না পেতে, তুমি যদি পাঠক না পেতে, তাহলে আজ হয়ত তুমি করুণা পেতে কিছু!
–আচ্ছ!, আমি কি প্রগতিশীল আন্দোলনের ক্ষতি করেছি, নাকি মৌলবাদীরা করছে ক্ষতি? মৌলবাদীদের পক্ষ নিয়ে এই সরকার করছে ক্ষতি?
–বদরউদ্দিন উমর কোনও মৌলবাদীকে বা বিএনপি সরকারকে দোষ দিচ্ছেন না। দোষ দিচ্ছেন কেবল তোমাকে। বলছেন তুমি করেছো ক্ষতি। কেবল তিনিই নন তসলিমা, প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রায় সব নেতাই এটা বলছেন। তুমি যাদেরকে বন্ধু মনে করতে, তাঁরাই বলছেন।
–এ কি করে হয়? আমি তো দেশটির মঙ্গলের জন্য লিখছিলাম, আমি তো বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখছিলাম, আমি তো একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন করছিলাম।
–কাজী শাহেদ আহমেদ আজকের কাগজে তোমার লেখা চাইতেন। তোমার লেখা থাকলে পত্রিকার কাটতি বাড়ে, তাই বলতেন তিনি। তুমি তো নিয়মিত লিখেছো ওই পত্রিকায়। তাঁর খবরের কাগজ, সাপ্তাহিক পত্রিকাটিতেও নিয়মিত লিখতে। তোমাকে তিনি নিমন্ত্রণ করতেন, এবং তাঁর অনেক বন্ধু যাঁরা তোমার লেখার অনুরাগী, তিনি নিজে খুব গর্ব করে পরিচয় করিয়ে দিতেন তাঁদের সঙ্গে তাঁর লেখকের। কি করেছেন সেই কাজী শাহেদ আহমেদ তুমি জানো? তিনি কাল একটি সভা ডেকেছেন, ডেকে তোমার মামলার কথা সম্পূর্ণ এড়িয়ে জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে জারি করা মামলার প্রতিবাদ করলেন। তা বিস্তারিত আজ ছাপাও হয়েছে আজকের কাগজ পত্রিকায়। তুমি তো যায় যায় দিন পত্রিকাতেও লিখতে। ওই পত্রিকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় কলামটি ছিল তোমার। যায় যায় দিন পত্রিকার শফিক রেহমান একই কাজ করেছেন। সভা ডেকেছেন। সভায় জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের ওপর থেকে মামলা তুলে নেওয়ার দাবি করলেন, তোমার ওপর থেকে মামলা তুলে নেওয়ার কথা কিন্তু বলেননি। যে সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো প্রতি সপ্তাহে তোমার ছবি আর খবর ছেপে ব্যবসা করেছে এতকাল, সেসব পত্রিকার সম্পাদকও সাংবাদিকদের মুক্তি চাইল, ওদের মামলা প্রত্যাহার করতে বলল। তোমাকে নিয়ে ব্যবসা করল, পয়সা করল, আর প্রতিবাদের বেলায় দায়িত্ব অনুভব করল অন্যের জন্য। তোমাকে বাদ দিয়ে। আসলে জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের পক্ষে ওরা ব্যক্তিগত পরিচয়ের কারণে প্রতিবাদ করছে না, করছে একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার দায়িত্ব থেকে। এ যাবৎ লিখে, মৌলবাদীদের অত্যাচার নিরন্তর সয়ে তুমি কিছুই অর্জন করতে পারোনি তসলিমা, সব শূন্য। জীবন বিয়োগ দিয়ে যোগের ঘরে শূন্য জমেছে তোমার।
–তবে কি আমার বিরুদ্ধে মামলা কোনও অন্যায় মামলা নয়?
–তারা তা মনে করছে না। জনকণ্ঠ একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান আর তুমি হচ্ছ একা। তোমার মাথার ওপর মৌলবাদী শক্তি আর সরকার, উভয়ে খড়গহস্তে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু জনকণ্ঠের সঙ্গে মৌলবাদী আর সরকারের খুব বেশি বিরোধ কখনও হবে না। রাজনৈতিক কারণেই হবে না। তারা কোনও না কোনও ভাবে একে অপরের পরিপূরক। তাছাড়া জনকণ্ঠের পেছনে বড় একটি শক্তি আছে, আওয়ামী লীগ। বিবৃতিকারীরা তাই কোনও একটি শক্তির পক্ষে গেল, স্রোতের পক্ষে গেল। যে একা, যার পক্ষ নিলে বিপদ, মৌলবাদীরা সত্যিকার অর্থে যার বিপক্ষে, সরকার যার অনিষ্ট করতে চায়, তার পক্ষে কথা বলা যাবে না। তা না হলে কোরান অবমাননার অভিযোগের এই ইস্যুর মধ্যে প্রগতিশীলরা কেন একটি পক্ষ নিচ্ছেন! যদি তাঁরা বলেন যে তোমার লেখালেখি পছন্দ হয় না, তাতে কি? মতবাদ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু যে কারণে তোমার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেটি তো নিঃসন্দেহে অন্যায় একটি মামলা, তা কি তাঁরা জানেন না? ঠিকই জানেন। তোমার লেখালেখি পছন্দ হবে না বলে বিবেকবান মানুষ, নীতিবান মানুষ তোমার বিরুদ্ধে মামলাটি সমর্থন করবেন কেন!
–কিছু বুঝতে পারছি না । সব কিছু কেমন যেন খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে।
–অদ্ভুতই ছিল। তুমি কেবল বুঝতে ভুল করেছিলে আগে। কাল জামাতের গণসভা হল। এখন তারা জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে তেমন কিছু বলছে না। তারাও বুঝে গেছে যে জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে চেঁচিয়ে লাভ হবে না। লাভ হবে তসলিমার ফাঁসি চেয়ে। এতে কাজ হয়। সকলের সমর্থন পাওয়া যায়। তোমার ফাঁসি চাইছে, প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছে তারা তোমাকে মেরে ফেলবে, তারপরও সরকার চুপ, সবাই চুপ, এই সুযোগে জামাতিরা ব্লাসফেমি আইন করার দাবি জানাচ্ছে। নীরব-বাদীরা কি একবার ভেবেছে এই আইন এলে কি অবস্থা হবে দেশের? হয়ত ভেবেছে, তারা তো আর ধর্ম নিয়ে তসলিমার মত বাড়াবাড়ি লেখা লেখে না, তারা পার পাবে। সংসদে কে বিরোধিতা করবে এর? কেউ না। খুব সহজেই এই বিলটি সংসদে পাস হয়ে যাবে।
–এরকম ভয়ংকর আইনটি সহজে পাস হবে, কেন যেন আমার বিশ্বাস হয় না।
–ব্লাসফেমির শাস্তি তো মৃত্যুদণ্ড। যখন তখন যাকে তাকে বলা হবে সে ব্লাসফেমি করেছে। পাকিস্তানে হচ্ছে না? খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহার হচ্ছে। এখানেও অমুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে। এখানেও ফতোয়ার বিরুদ্ধে যারাই বলবে, যারাই শরিয়া আইনের সমালোচনা করবে ব্লাসফেমি করেছে বলে বলা হবে। কে মুক্তি পাবে তখন মৌলবাদী ছাড়া!
–সংসদে বিরোধী দল নিশ্চয়ই এটিকে আইন করতে দেবে না।
–শোনো, শেখ হাসিনা আজ সরকারের এই মামলা, যে মামলায় জনকণ্ঠের দুজন সাংবাদিককে ধরা হয়েছে, তাদের মুক্তি দাবি করেছেন। তাদের ওপর থেকে হুলিয়া প্রত্যাহার করার দাবি করেছেন। তাদের ঝামেলা করাতে সরকারের নিন্দা করেছেন। শেখ হাসিনা চারজন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। নাম উল্লেখ করেছেন স্পষ্ট করে এই জন্য যে ভুলেও যেন আবার কেউ মনে না করে যে তিনি তোমার মামলারও প্রত্যাহার চান। এই যদি হয় বিরোধী দলের নেষনী, তবে কি তুমি আশা কর যে সংসদে যখন তোমাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য ব্লাসফেমি আইন আনা হবে, তখন তিনি প্রতিবাদ করবেন? না, তিনি প্রতিবাদ করবেন না, প্রতিবাদ তিনি করবেন না এই কারণে যে তিনি তবে ইসলাম বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবেন। আরও একটি কারণ হল, বিএনপি যেমন জামাতকে খুশি করতে চাইছে, আওয়ামী লীগও চাইছে। জামাতের এখন পোয়াবারো। জামাত এখন দুদলকেই নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। আসলে দুদলেরই জামাতকে দরকার। যে দলই জামাতকে সঙ্গী হিসেবে নেবে, সে দলই বিপক্ষ দলের চেয়ে শক্তিতে বড় হবে। দেখ, বুদ্ধিজীবিরা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদ করলেন, তাঁরা কিন্তু ব্লাসফেমি আইন জারি করার জন্য এত যে চিৎকার করছে মৌলবাদীরা, এই ব্লাসফেমি আইনের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ করেননি। কোনও বুদ্ধিজীবীর মধ্য থেকেও প্রতিবাদ আসবে না, কারণ তাঁরা নিশ্চিত যে তাঁরা কখনও ব্লাসফেমির মত অপরাধ করছেন না, তাঁরা পেটে রেখে দিচ্ছেন তাঁদের ব্লাসফেমি, তসলিমাই কেবল পেটে রাখতে পারে না, উগলে দেয়। তাই এই ব্লাসফেমির বিরুদ্ধে আইনটি কেবল তসলিমার জন্যই দরকার।
–কিন্তু আইন যদি বহাল হয়ে যায়, তবে আইন কি তাদের কি ছেড়ে দেবে?
–দেবে না। কিন্তু তারা হয়ত ভাবছেন, দেবে। দেবে, কারণ তারা তো তসলিমার মত বোকা নন। তারা বুঝে সুঝে কথা বলেন। তুমি একা তসলিমা। তোমার পাশে কেউ নেই। তুমি ভেবেছিলে তুমি ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধত্ব, অশিক্ষা, মৌলবাদ–সব তারা যেমন সরাতে চায়, তুমিও তেমন চাও। ভেবেছিলে তুমি যা বলনি তার ভিত্তিতে সরকার তোমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে, হুলিয়া জারি করেছে, তোমার বিরুদ্ধে সরকারের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ সবাই করবে, ভেবেছিলে মৌলবাদীরা তোমার ফাঁসির দাবিতে দেশজুড়ে তাণ্ডব করছে, এই দুঃসময়ে প্রগতিশীল শক্তিটি তোমাকে সমর্থন করবে, মত-পার্থক্য থাকলেও ভেবেছিলে তাঁরা অন্তত বাকস্বাধীনতার জন্য হলেও তোমাকে সমর্থন করবে। কিন্তু তুমি ভুল ভেবেছিলে। কেউ তোমার পাশে নেই। তুমি একা। তুমি একা বিশাল এক মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে লড়ছিলে। তুমি একা তসলিমা, কেউ নেই তোমার। এখন তোমাকে যদি ফাঁসি দেয়, যাদের তুমি বন্ধু ভাবতে, ভাবতে একই আন্দোলনে জড়িত তোমরা, তারা দূরে দাঁড়িয়ে দেখবে তোমার ফাঁসি। তুমি কি মনে করছ তোমাকে হত্যা করছে মৌলবাদীরা? না। ছুরি তোমার পিঠে কোনও মৌলবাদী বসাচ্ছে না। মৌলবাদীরা রাস্তায় নামছে, নেপথ্যে দাঁড়িয়ে আছে প্রগতিশীল বলে দাবি করে, সেই ভণ্ডগুলো। তুমি যাদের আপন ভাবতে তারা। কত বড় ভণ্ড হলে আজ প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী কেউই তোমার ওপর সরকারি আর মৌলবাদী জঘন্য ভয়াবহ হামলার প্রতিবাদ না করে জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের ওপর হামলার ওপর প্রতিবাদ করে! কারা ওই সাংবাদিক? কি করেছে ওরা এ পর্যন্ত? কজন মানুষ পড়েছে ওদের লেখা? মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ওরা কি কোনও চ্যালেঞ্জ ছিল, সমাজ কতটুকু বদলাতে চেয়েছে ওরা? অন্ধত্ব কতটুকু ঘোচাতে চেয়েছে ওরা? তোমার প্রগতিশীল প্রতিবাদী বন্ধুদের সঙ্গে ওদের কতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল? ওরা কি কোনও নাম মৌলবাদবিরোধী বা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে? যারা আজ তোমাকে বাদ দিয়ে ওদের জন্য কাঁদছে, তারা কি ওদের লেখা পড়েছে? চেনে ওদের? তারপরও এটা ঠিক, যে, সরকার ওদের বিরুদ্ধে মামলা করে অন্যায় করেছে। প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে সরকারের আচরণের বিরুদ্ধে, কিন্তু গতকাল বা আজ যে বিবৃতিগুলো দেওয়া হল, কেন তোমাদের পাঁচজনের কথা উল্লেখ করা হল না একসঙ্গে, কেন ওদেরকে আলাদা করে কেবল ওদেরই মুক্তি চাওয়া হল! কেবল ওদের বাক স্বাধীনতার কথা বলা হল! তোমার বুঝি বাক স্বাধীনতা থাকতে নেই! যেদিন মামলা হল ওদের বিরুদ্ধে, তার পরদিনই এত শত শত বিবৃতির সই যোগাড় হয়ে যায় কেন? তোমার বেলায় হয় না কেন? কেউ তোমার পক্ষে দাঁড়াতে চায় না। তোমার পক্ষে না দাঁড়াক, তোমার ওপর অন্যায়ের বিপক্ষেও দাঁড়াতে চায় না। কেন চায় না জানো? চায় না কারণ তুমি একা। আবারও বলছি, বারবার বলছি, বলছি যে তুমি একা। এত বার তোমাকে এ কথা শোনাচ্ছি কারণ তুমি বিশ্বাস করতে চাও না যে তুমি একা। জনকণ্ঠ পত্রিকা একা নয়, জনপক্ষ পত্রিকা একটি বড় শক্তি। সবলের পক্ষ নিলে কোনও ঝুঁকি নেই। দুর্বলের পক্ষে ঝুঁকি আছে। তোমার সঙ্গে আজ অনেকে মানসিক ভাবে আছেন, গোপনে গোপনে আছেন, কিন্তু বিবৃতিতে নেই, প্রতিবাদে নেই, প্রকাশ্যে নেই। তুমি সুন্দরী যুবতী, তোমার সঙ্গে মানসিক ভাবেই থাকা নিরাপদ কি না।
–বাজে কথা বোলো না। মানসিকভাবে সঙ্গে থাকাই তো সবচেয়ে বড় থাকা। আমি জানি যে তিনি আমার পক্ষে আছেন। তিনি আমার জন্য উদ্বিগ্ন। তিনি আমাকে ভালবাসেন।
–মানসিকভাবে থাকলে তোমার কী লাভ এখন? এখন তোমার বিবৃতি দরকার, সমর্থন দরকার। তা না থাকলে তোমার উকিল তোমার জন্য কিছুই করতে পারবেন না। পত্রিকায় বিবৃতির মাধ্যমে, আন্দোলনের মাধ্যমে, একই ধারার মামলার আসামী জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের সঙ্গে আছেন, আর তোমার সঙ্গে আছেন নিভৃতে, গোপনে, মানসিকভাবে। শামসুর রাহমান বলেছেন সই করার লোক পাওয়া যায়নি বলে তিনি তোমার পক্ষে বিবৃতি দিতে পারেননি। তিনি কি একাই বিবৃতি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বড় ব্যক্তিত্ব নন? তোমার মত হতভাগা কেউ নেই। তিনি একটি কবিতা লিখেছেন তোমাকে নিয়ে, তোমাকে সেই কবিতাটা দিয়েছিলেন শারদীয়া দেশ এর জন্য পাঠিয়ে দিতে? পাঠিয়েছিলে?
–পাঠাইনি। সময় পেলাম কোথায়? হুলিয়া জারি হয়েছে পরদিনই।
–মনে হয় তিনি আর চাইবেন না কবিতাটি কোথাও ছাপা হোক।
–কেন চাইবেন না? নিশ্চয়ই চাইবেন। নিজের কবিতা কেউ কি আড়াল করে?
–এখন অন্যরকম অবস্থা তসলিমা। তোমার পক্ষে কবিতা লিখতে, কলাম লিখতে এখন লেখক বুদ্ধিজীবীরা ভয় পান। যদি লোকে মন্দ বলে, তাই ভয়। যদি লোকে ছি ছি করে তাই ভয়। সংখ্যালঘুদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলে, সুরঞ্জনদের কষ্ট দেখে কেঁদেছো। কিন্তু তুমি কি জানো, তুমি সুরঞ্জনদের চেয়েও অসহায়! যে সুরঞ্জনরা আজ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাদের জীবন কি তোমার চেয়ে অনিশ্চিত, নিরাপত্তাহীন! যে কোনও সংখ্যালঘুর চেয়ে বড় সংখ্যালঘু তুমি। যারা বিপদে আছে তাদের চেয়ে তুমি সহস্রগুণ বিপদে আছো। তুমি আরও অবাক হবে যদি শোনো যে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সমিতি আজ বিবৃতি দিয়েছে জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের পক্ষে, তোমার কথা তারা উল্লেখ করেনি। কেউ তোমাকে মর্যাদা দেয়না তসলিমা। তুমি খামোকাই লিখেছো মানুষের জন্য। মানুষ তোমাকে ভালবাসে না। দেশ দেশ করে মরো, দেশ তোমাকে কী দিল? দেশ তোমাকে ঘৃণা দিল, অবজ্ঞা দিল, এবং খুব শীঘ্র তোমাকে ফাঁসি দেবে। যদি ফাঁসির হাত থেকে বেঁচে যেতে পারো, তুমি এ দেশে থেকো না তসলিমা।
–কোথায় যাবো?
–চলে যাও অন্য কোনও দেশে। এ দেশ তোমার যোগ্য নয় অথবা তুমি যোগ্য নও এদেশের। কোনও সভ্য দেশে চলে যাও।
–কেন যাবো? আমাকে কি এ দেশের কেউ একটুও ভালবাসে না?
–ভালবাসে। তারা ভালবাসে যাদের দিকে তুমি কখনও ফিরে তাকাওনি। যাদের ভালবাসার সময় তোমার একটুও হয়নি। তুমি ব্যস্ত থেকেছো তোমার প্রগতিশীল কবি সাহিত্যিক বন্ধুদের নিয়ে, তোমার লেখালেখি নিয়ে, অন্যের ভালর জন্যই ভেবেছো কেবল। তোমাকে ভালবাসে তোমার বাবা, মা, ভাই, বোন। কোনওদিন কি সময় হয়েছে তোমার, তোমাকে যারা নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসে, তাদের কথা একটু ভাবার? তোমার বাবার চেম্বারে তোমার বিরুদ্ধে পোস্টার পড়েছে, তাঁর সামনে দিয়ে প্রতিদিন মিছিল যাচ্ছে। যে কোনও সময় তোমার বাবার ওপর হামলা হবে, যেহেতু তিনি তোমার বাবা। চেনা পরিচিত অনেক বন্ধুই এখন তোমার বাবার কাছে আর আসেন না। রোগীরাও তাঁর কাছ থেকে আর চিকিৎসা নিতে আসে না। তোমার বাবা বলে তিনি মানুষের ঘৃণা পাচ্ছেন। তারপরও তিনি তোমাকে সমর্থন করছেন। তোমার ভাইরাও বন্ধু হারাচ্ছে। তোমার ভাইয়ের ছেলেরা ইশকুলে গেলে তাদের ছি ছি করছে ইশকুলের ছাত্ররা, বলছে তোর ফুপুকে তো জেলে নেবে, তোর ফুপুর তো ফাঁসি হবে। কেউ লজ্জায় ভয়ে ঘর থেকে বেরোতে পারছে না। তোমার বোনের চাকরিটি যাবে, কারণ সে তোমার বোন। সবাই তোমার জন্য ভুগছে, কিন্তু তোমাকে অসম্ভব রকম ভালবাসছে। তোমার বাবার কথাই ভাবো, তিনি মধ্যরাতে যখন রোগী দেখে চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরেন, তিনি তো একা ফেরেন, তখন কেউ যদি পেছন থেকে তাঁর পিঠে ছুরি বসায়! যে কোনও দিন, তোমার ওপর আক্রোশে ধর্মান্ধ লোকেরা তো এই কাণ্ডটি করে ফেলবে। একই রকম তোমার দাদাকেও করবে। তোমার দাদাও তো সেই কত রাতে ওষুধের দোকান বন্ধ করে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরেন। ময়মনসিংহে ধর্মান্ধদের সভা হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে, ওরা তো তোমার বাবাকে ভাইকে চেনে। তোমার ভাইয়ের ছেলে শুভকে একদিন ইশকুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে তুলে নেবে কেউ, নিয়ে কোনও ডোবায় পুঁতে রাখবে। আর ঢাকায়, তোমার শান্তিনগরের বাড়িতে! বোন তোমার রাস্তায় বেরোলে মেরে ফেলবে। অথবা বাড়িতে ঢুকেই ওরা ছুরি বসাবে বুকে। ছুরি বসানো তো ওদের কাছে ডালভাত। পড় না খবর কত জনকে ওরা যে এভাবে মারছে! যাকেই পছন্দ হচ্ছে না, যার ওপরই রাগ, তাকেই জবাই করে ফেলে রাখছে। শিবিরের সন্ত্রাসে আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাঁপছে পর্যন্ত। এগুলো গলা কাটা রগ কাটা ছুরি বসানো খুন করা ওদের কাছে ডাল ভাত। একদিন তুমি পত্রিকার পাতায় পড়বে, গত রাতে তসলিমার বাড়িতে ঢুকে একদল সশস্ত্র যুবক তার মা, ভাই, বোন, বোন বোনের মেয়েকে জবাই করেছে। তোমার আশংকা হয় না! চলে যাও এ দেশ ছেড়ে..
–আমার এই প্রিয় দেশ ছেড়ে, আমার ভালোবাসার মানুষদের ছেড়ে, প্রিয় নদী মাঠ বৃক্ষতল.ছেড়ে ..
–কত মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যায়..। তাতে কি? যে দেশের মানুষ তোমাকে ভালবাসে না, সে দেশে থাকতে তোমার ইচ্ছে করে কেন বুঝি না।
–কিন্তু আমি তো পালাতে চাই না।
–পালাবার তোমার কোনও পথও নেই। তোমার নিরাপত্তা কোথাও নেই। জেলে নেই, আদালতে নেই। পালাবার পথেও নেই। জামিনের কথা কল্পনাও কোরো না। জামিন নিতে গেলে আদালতে যেতে হয়। আদালতে তোমার নিরাপত্তা কি? ওখানে তুমি কি ভেবেছো পুলিশ তোমাকে নিরাপত্তা দেবে? যাকে পুলিশ খুঁজছে গ্রেফতার করার জন্য, তাকে কেন নিরাপত্তা দেবে! তোমাকে বরং পুলিশই ছেড়ে দেবে লক্ষ্য থাবার মধ্যে। উন্মত্ত মোল্লা-কুকুরগুলো তোমাকে ছিঁড়ে খাবে, আর তোমার বন্ধুরা দূর থেকে মজা দেখবে, যেমন দেখেছিল গতবছর বইমেলায় তোমার ওপর হামলা হচ্ছিল যখন। বইমেলার সেই হামলার সঙ্গে তুলনাও করো না এই হামলার। এই হামলা সেই হামলার চেয়ে লক্ষগুণ ভয়ংকর হবে। আদালতে গোপনে হঠাৎ করে কাকপক্ষী না জানে এমন ভাবে জামিন চাইতে যাবে! তোমার উকিল বলেছেন, তোমার জন্য হাইকোর্টে জামিন চাইতে যাবেন। যাও আদালতে, মরো গিয়ে। তুমি ভাবছো, মোল্লারা খবর পাবে না তুমি যে যাচ্ছে!! বোকা, বুঝতে পাচ্ছে! না! খবর তো মোল্লাদের আদালত থেকেই দেওয়া হবে। কত বিচারক আছেন জামাতে ইসলামি দলের, জানো না? কত উকিল আছেন মোল্লা, জানো না? শায়খুল হাদিসের দলকে, আমিনীর দলকে, ইয়ং মুসলিম সোসাইটিকে খবর আদালতের লোকেরাই দেবে। জেলে যাবে, জেলেই বা তুমি বাঁচবে কি করে, ওখানেও তো কামড় বসাবে তোমার গায়ে, চোর ছ্যাঁচোড় সবারই ধর্মের প্রতি অনুরাগ ভীষণ। যদি জেলে তোমার মৃত্যু না হয়, যদি বেঁচে থাকো, জেল থেকে বাইরে বেরোলেও তো তোমার নিরাপত্তা নেই। তোমার কোথাও নিরাপত্তা নেই। তারপরও যদি বেঁচে যাওয়া অলৌকিক ভাবে সম্ভবই হয় তোমার, এ দেশে থেকো না। মানুষ তো মরবেই, তুমিও মরবে, আর যাই কর, মোল্লাদের হাতে নিজেকে মরতে দিও না। তুমি দেশে থাকলে ওরা তোমাকে একদিন না একদিন খুন করবেই।
–সত্যের জন্য যদি মরে যেতে হয়, মরব।
–খুব গ্যালিলিও গ্যালিলেই হয়ে গেছো! নিজেকে তোমার খুব জিয়োর্দানো ব্রুনো মনে হচ্ছে, তাই না! মনে রেখো, এই পৃথিবীতে অনেক লেখকের ওপর নির্যাতন হয়েছে, তারা নির্বাসনে জীবন কাটিয়েছেন। তুমি একা নও।
–না, আমি নির্বাসনে যাবো না। ডক্টর কামাল হোসেন আমার জন্য লড়বেন। তিনি খুব বড় ব্যারিস্টার।
–দেখ, তোমার উকিল হতাশ হতে হতে, লোকের ধিককার পেতে পেতে হুমকি পেতে পেতে তোমার মামলা থেকে সরে দাঁড়ান কি না। । এরকম কিছু হওয়া এখন অসম্ভব নয় তসলিমা।
–আমার যে কত পাঠক ছিল! আমার পাঠকেরা আমাকে তো ভালবাসত। কত মেয়েরা! তারা কি হঠাৎ করে আমার বিরোধী হয়ে উঠেছে? নিশ্চয়ই নয়।
–সাধারণ মানুষের কথা বলছ তো! তুমি টের পাওনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও তোমার সমর্থন হ্রাস পেয়েছে। বই হয়ত বিক্রি হয়েছে অনেক। তোমার বই তো মোল্লারাও কেনে। কি লিখেছো, কত বাজে কথা লিখেছো, তা জেনে তোমাকে আক্রমণ করার জন্য কেনে। তাছাড়া হঠাৎ করেই পাঠকের সমর্থন তোমার কমে গেছে।
–কেন ?
–অপপ্রচার, তসলিমা, অপপ্রচার। গসিপ ম্যাগাজিনগুলোয়, মৌলবাদী আর সরকারি প্রচার মাধ্যমগুলোয় প্রতিদিন তোমাকে নিয়ে নানারকম গল্প বানিয়েছে, দেখনি? যা তুমি লেখোনি, তাই তোমার উদ্ধৃতি দিয়ে চালিয়েছে। তুমি বিজেপির কাছ থেকে ৪৫ লক্ষ, কেউ কেউ বলেছে ৪৮ বলছে, টাকা নিয়ে নাকি লজ্জা লিখেছো, আনন্দবাজার তোমাকে ইসলামবিরোধী লেখায় প্রেরণা দিয়ে ৩০ লক্ষ টাকা দিয়ে সল্টলেকে নাকি একটি বাড়ি তৈরি করে দিচ্ছে। তুমি দেশদ্রোহী, তুমি রএর এজেন্ট, ভারত থেকে টাকা পেয়ে তুমি দেশে বাড়ি গাড়ি কিনেছো, তুমি মেয়েদের সংসার ভেঙে দিতে চাও, মেয়েদের নষ্ট করছ, তুমি ফ্রি সেক্স বিশ্বাসী, তুমি পুরুষদের ধর্ষণ করতে চাও, একশ একটা পুরুষের সঙ্গে তোমার অবৈধ সম্পর্ক, তুমি জরায়ুর স্বাধীনতা চাও। সরকারি দৈনিকগুলোয় এসব খবর প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। এসব অপপ্রচার তোমার পাঠক নষ্ট করেছে।
–কিন্তু যারা এসব শুনেও আমার লেখা পছন্দ করেছে, তারা আজ কোথায়?
–তারা আছে। চুপচাপ ঘরে বসে আছে। তারা সংগঠিত নয়। বিবৃতি দেবার মত ব্যক্তিত্ব তারা নয়। প্রতিবাদ করার মত সাংগঠনিক জোর তাদের নেই। তার ওপর একটা ব্যাপার তো আছেই, ভয়। এগিয়ে আসতে ভয় পায় অনেকে। এবং এদের সংখ্যাই বেশি। মুখ খুলতে ভয় পায়। তোমার লেখা পছন্দ করলেও মুখ ফুটে বলবে না কিছু, তোমার ওপর অন্যায় হচ্ছে জেনেও বলবে না কাউকে যে অন্যায় হচ্ছে। যাদের এগিয়ে আসতে কোনও ভয় নেই, যাদের খুঁটির জোর ভাল, তারাই যখন চুপ হয়ে আছে, তখন অন্যদের আর দোষ দিয়ে লাভ কি! হতভাগা তসলিমা, চার সাংবাদিকের জন্য আজ ভালবাসায় মমতায় কাঁদছে সবাই, কেবল তোমার জন্য কেউ নেই দু কথা উচ্চারণ করার। তুমি লেখালেখি ছেড়ে দাও তসলিমা, আর লিখো না।
–অসম্ভব, আমি ছাড়ব না লেখা।
–তুমি কেন লিখবে? কার জন্য লিখবে? যারা তোমাকে জেলে পাঠাচ্ছে, ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে, তাদের জন্য? এত উদার হবে কেন তুমি? ঘাতকদের পায়ে ফুল নিবেদন করবে কেন, বল! যদি বেঁচে থাকো, লেখালেখি সম্পূর্ণ বাদ দিও। তবে এদেশে নয়, অন্য কোনও দেশে।
–না, এ আমি ভাবতেই পারি না।
–তোমাকে ভাবতে হবে তসলিমা। এই দেশে তোমার দাঁড়াবার কোনও জায়গা নেই আর। তোমাকে হতেই হবে দেশান্তরী। আর যদি গোঁয়াড়ের মত মরতে চাও, তবে থাকো এ দেশে। মরো। সপরিবার মরো। তবে আমার উপদেশ, বেঁচে থাকলে অলেখক, অবিপ্লবী হয়ে বেঁচে থেকো। কোনও ঝুট ঝামেলা নেই, হুমকি হুংকার নেই, জেল ফাঁসি নেই, পত্রিকা নেই, সাক্ষাৎকার নেই, এরকম একটি শান্ত স্নিগ্ধ নিশ্চিত শান্তির জীবন বেছে নিও।
–বিদেশের অনেক মানবাধিকার সংগঠন, লেখক সংগঠন আমাকে নিরাপত্তা দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে বলছে।
–−ছাঃ! বিদেশের সব আবেদনই ময়লা ফেলার ঝুঁড়িতে চলে যাচ্ছে, দেখ গিয়ে। দেশে কি হচ্ছে সেটা বড় কথা। আগে তো ঘর সামলাও, তারপর বাহির। আগে গদি সামলাও, তারপর অন্য কিছু। আচ্ছ! বল তো, হলিডের সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান কি মৌলবাদী?
–না।
–তাঁর পত্রিকায় আজ তিনি তোমার লজ্জা বইটির সমালোচনা ছেপেছেন। ভূমিকায় সম্পাদক লিখেছেন, তুমি বিজেপির লোক, তুমি সাম্প্রদায়িক, দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার মিশন নিয়েছো। এ সময় এসব কথা লেখার অর্থ কি জানো তো! লোক ক্ষেপানো। মোল্লা লেলিয়ে দেওয়া তোমার পেছনে। সরকারকে ইন্ধন যোগানো। তুমি জেলে গেলে, তোমার ফাঁসি হলে, এরাই খুশি হবে বেশি। এরাই হাততালি দেবে বেশি। কি, চুপ করে আছো যে! কি ভাবছো!
–না, কিছু ভাবছি না।
–ভাবছো, ভাবছো তোমার কমপিউটারের হার্ডডিস্কের লেখাগুলোর কি হবে! লেখা লেখা লেখা। লেখাগুলো পুলিশেরা নষ্ট করে ফেলবে কি না ভাবছো! লেখা সব তোমার নষ্ট হয়ে যাক। পুলিশ নিয়ে নিক। লেখার কথা ভাবা বাদ দাও। বেঁচে যদি থাকো, তবে আর যাই হও, লেখক হওয়ার চিন্তাও কোরো না, আবারও বলছি। লেখক হওয়ার সাধ তোমার আশাকরি পূরণ হয়েছে। লেখক হয়ে অন্ধকার দূর করতে চেয়েছিলে, অন্ধকারই তো সবলে গ্রাস করে নিল তোমাকে। সবাই তো বাইরের আলোয় হাঁটছে, আনন্দ করছে, তুমি একা পড়ে আছো অন্ধকারে, অন্ধকারই এখন তোমার ঠিকানা। লিখে তুমি এই পেয়েছো। এই তোমার পুরস্কার। এখানে এই গুমোট ঘরটিতে বসে বসে এখন জেলখানায় অথবা কবরে থাকার মহড়া দিচ্ছ।
–কিন্তু আমার তো অনেক স্বপ্ন ছিল..
–স্বপ্ন! তুমি হাসালে। তোমার মত বেচারা আবার নানারকম স্বপ্ন দেখতেও জানত। তোমার স্বপ্নগুলো এখন মৃত, বিস্মৃত। তোমার স্বপ্নগুলো কাকে খাওয়া, চিলে নেওয়া, তোমার স্বপ্নগুলো লোকের কফ কাশির সঙ্গে পড়ে আছে। তোমার স্বপ্নগুলো লোকের জুতোয় তলায়।
–থামো, এগুলো শুনতে ইচ্ছে করে না।
–ইচ্ছে না করলেও এগুলো সত্য, তুমিও তা জানো। তুমি যে হেরে গেছো, তুমি জানো। ভেবেছিলে, তুমি সমাজের মঙ্গল কিছুটা হলেও বুঝি করতে পেরেছো, ভেবেছিলে নারী পুরুষের বৈষম্যহীনতার কথা বলে তুমি কিছুটা হলেও মানুষকে বৈষম্যের ব্যাপারে সচেতন করতে পেরেছো। ভেবেছিলে সামান্য হলেও সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, অন্ধকার, কুসংস্কার দূর করতে পেরেছো। কিμছু পারোনি তসলিমা। তুমি প্রচণ্ডভাবে হেরে গেছো। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বই লিখে তুমি সাম্প্রদায়িক আখ্যা পেয়েছো। যাদের ভেবেছিলে সহযাষনী, তারাই আজ মৌলবাদের হিংস্র থাবার মধ্যে তোমাকে তুলে দিচ্ছে। এই তোমার এতকালের সংগ্রামের পুরস্কার। এই পুরস্কার মাথা পেতে নিতে কাল বা পরশু তুমি কারাগারে ঢুকবে অথবা তুমি ফাঁসিকাঠে ঝুলবে, তুমি অবধারিত মৃত্যুর দিকে রওনা হবে। তসলিমা, তোমার জন্য খুব মায়া হয় আমার। খুব মায়া হয়। তোমার মত এমন দুর্ভাগ্য নিয়ে আর যেন কারও জন্ম না হয় এই পৃথিবীতে।
–আমাকে একা থাকতে দাও। কথা বোলো না। বিরক্ত কোরো না।
–থাকো, একা থাকো। তুমি তো একাই। ….কাঁদছো? কাঁদো তসলিমা, কাঁদো। অনেকদিন তুমি কাঁদোনি। অনেকদিন প্রাণভরে এমন করে কাঁদোনি। কাঁদো।
বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদি আমি। আমার কান্নার শব্দ যেন কোথাও যেতে না পারে, তাই শব্দটিকে আটকে রেখে কাঁদি। যখন মাথা তুলি, চ আর চর বাচ্চাজ্ঞটর কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। এ ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু ছিল একজন, নিশ্চয়ই ছিল, দীর্ঘক্ষণ যার সঙ্গে কথা হয়েছে আমার, সে ছিল। মানুষটি তো ওখানেই বসেছিল, ওই চেয়ারে, তারপর বিছানায় এসে বসল। আমাকে স্পর্শ করেছিল, কপালে একটি শীতল হাত এসে একবার থেমেছিল। আমাকে কাঁদতে বলল। আশা করেছিলাম একবার অন্তত বলবে, অনেক কেঁদেছো, আর কেঁদো না। আমাকে একটিবার বুকে টেনে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেবে। আশা করেছিলাম, কাঁধে একটি হাত রাখবে সে।
দরজাটি ভেতর থেকে সিটকিনি আঁটা ছিল, এখন খোলা। আশ্চর্য, দরজা খুলে আমাকে না বলে নিঃশব্দে চলে গেছে সে! একবার বলে যাবে না!
Leave a Reply