একটি পার্কার কলম কেনার শখ হল হঠাৎ। ভীষণ দাম।
–জিল, আমাদের দেশেও পার্কার কলম পাওয়া যায়। কিন্তু এত দাম নয় তো ওগুলো!
–ওগুলো নিশ্চয়ই আসল নয়, নকল। তাই দাম কম। তুমি প্যারিস থেকেই পার্কার কেনো। এগুলো আসল।
–পার্কারের গায়ে ঠিক এরকমই তো লেখা থাকে, কেন আসল হবে না আমাদের দেশেরগুলো?
জিল বলে, হয়ত নিবটা এত ভাল না, এগুলোর যেমন ভাল।
জিল তার মত পাল্টাবে না কিছুতেই। শেষ অবদি দাম দিয়েই একটি পার্কার কলম কেনা হয়। যে কোনও দাম দেখলেই আমি আট দিয়ে গুণ করে ফেলি। বইয়ের দোকানে ঢুকেও কিছু আর কেনা সম্ভব নয়। বিশাল একখানা বই ল্যুভরের ওপর। দামেও কুলোতে পারব না, ওজনেও না। তাই বাদ। আরও কিছুক্ষণ বইয়ের দোকানগুলোয় সময় কাটাবো, তার সময় নেই। টেলিভিশনে যেতে হবে, জিল তাড়া দিল।
–ধ্যুৎ এত টেলিভিশন আমার ভাল লাগে না। হলই তো কত।
–এটিই শেষ। জিল মিনতি করে।
একপ্রশ্ন, এক উত্তর। আর ভাল লাগে না। লজ্জা কেন সরকার বাজেয়াপ্ত করল, ফতোয়া দিল কেন, আমার কেমন লেগেছে ফতোয়ার পর, কোনও সমর্থন আছে কি না দেশে, এসবই তো। ফরাসিরা তো শুনেছেই এসব, আর কত শুনবে! আমার ভাল লাগে না।
জিল বলে, বুঝি আমি। আমি যদি তুমি হতাম, আমারও এমন লাগত, যেমন লাগছে তোমার। কিন্তু ওরা এমন করে ধরেছে, এবারটিই শেষ, তোমাকে আর কষ্ট দেব না। আমি শান্ত গলায় বলি, জিল, আমি সাধারণ একজন মানুষ। খুব সরল ভাষায় খুব সাধারণ জিনিস লিখি। আমাকে নিয়ে এত হৈ চৈ কেন! আমি তো ভেবেছিলাম স্ট্রাসবুর্গে অনুষ্ঠানটি করে ফিরে যাবো দেশে। মাঝখান থেকে প্যারিসটা দেখব। প্যারিস দেখারইচ্ছে আমার বহুদিনের। এইসব রেডিও টেলিভিশন এত না করে প্যারিসটা ঘুরে বেড়ালে ভাল লাগত। অথবা তোমাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে।
জিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জিলও সম্ভবত বাঁধা তার এই সংগঠনের চাকরিতে। তারও কিছু করার নেই। আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স আর আর্তে টেলিভিশন, এত খরচ করছে এরা আমার পেছনে, না হয়, যা অনুরোধ করছে, মেনেই নিলাম কিছু। কালই তো চলে যাবো। হোটেলে পৌঁছে জিল বলল, তোমাকে তিন মিনিট সময় দিলাম। এর মধ্যে তৈরি হয়ে নাও।
জিলের কাছে আবদার করে দশ মিনিট সময় নিয়ে স্নান করে একটি বালুচরি শাড়ি পরলাম। গাঢ় খয়েরি রঙের। জিলের এই রংটি খুব পছন্দ। আগেই এই শাড়িটি দেখে বলেছিল, এটি তোমাকে একদিন পরতে হবে,অন্তত আমার জন্য। শাড়িটির আঁচলে একটি মেয়ে কলসি হাতে, একটি ছেলে ঘোড়া চালাচ্ছে এসব দেখে বলেছিল, প্রেমের গল্প বুঝি!
আমি নিচে নেমে এলে জিল শাড়ির আঁচলটি হাতে নিয়ে মিষ্টি করে হাসে। চোখদুটোও হাসে তার। টেলিভিশনে গিয়ে দেখি প্রচণ্ড সব ব্যক্তিত্বের মহিলা। আমার খুব ভাল লাগে মেয়ে-সাংবাদিক আর মেয়ে-ফটোগ্রাফারদের দেখতে। আমাদের দেশে হাতে গোনা মেয়ে সাংবাদিকতার কাজ করে। করবেই বা কি! লেখাপড়া শেষ করতে না করতেই তো তাদের বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়, আর প্রভু স্বামীরা যা আদেশ করে মেয়েরা তো তাই মাথা নত করে পালন করে। পুরুষের পাশাপাশি বসে লেখালেখি করা, খবর যোগাড় করতে ছুটোছুটি করার কাজ মেয়েদের মানাবে না সিদ্ধান্তই নিয়ে নেওয়া হয়। যে মহিলাটি আমার সাক্ষাৎকার নেবেন, তিনি আমাকে বাংলায় প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ফরাসিরা ইংরেজি পছন্দ করে না। ইংরেজি জানলেও পারতপক্ষে বলতে চায় না। মাতৃভাষাটিই এদের কাছে পছন্দ। কথা বললে আমি আমার মাতৃভাষায় কথা বলব, অনুবাদক তারা যত খরচা হোক আনিয়ে নেবে, তবু আমাকে ইংরেজিতে কথা বলতে দেবে না। ইংরেজি ভাষাটি ফরাসিরা মোটেও পছন্দ করে না। ইংরেজের সঙ্গে এদের দীর্ঘ দীর্ঘ কালের বিরোধ এর পেছনে কাজ করে সম্ভবত।
কাকে ডাকবে বাংলা থেকে ফরাসি অনুবাদের জন্য? জ্যঁ শার্ল দাঁতের ডাক্তারের কাছে গেছে, আসতে পারেনি। সাড়ে ছটায় এটি প্রচার হবে, সুতরাং এক্ষুনি লাগবে। অতএব নাতালি, তুমি পারবে? নাতালি ভয়ে নীল হয়ে, তার ওইটুকু বাংলা বিদ্যে নিয়ে মোটে ভরসা পায় না। অতএব আমাকেই বাংলায় বলে বাংলাটুকুর ইংরেজি অনুবাদ লিখে দিয়ে আসতে হয়, নাতালি ও থেকে ফরাসি করে নেবে। সে রয়ে যায় টিভিতে। হোবিয়া মিনা বলবেন আমাকে নিয়ে, আমার পরই।
জিল এবার আমাকে নিয়ে গেল, প্রায় দৌড়ে, শার্লস এ লিজের ফন্যাকে। ফন্যাককে সাহিত্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বলা যায়। বই পত্র, গানের যন্ত্র, ক্যাসেট সিডি সব বিক্রি হয়, পাশাপাশি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি হয়। প্রায়ই লেখকরা তাঁদের বই থেকে পড়েন। আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম দিবস পালন হচ্ছে ফন্যাকে। বড় একটি প্রদর্শনী হচ্ছে। রিপোটার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স এখানে আয়োজন করেছে আলোচনা সভার। জিল বলল, তোমার এখানে ইংরেজিতেই বলতে হবে মনে হচ্ছে। জ্যঁ শার্ল তো আসতে পারছে না। বাংলা থেকে ফরাসি করার কেউ নেই। আমার ইংরেজির যে হাল, পছন্দ মত কোনও শব্দই খুঁজে পাওয়া যায় না। রেডিও টিভিতে যা হোক ফরাসিতে তক্ষুনি তক্ষুনি অনুবাদ হয়ে যায় যা বলি। কিন্তু একেবারে দর্শক শ্রোতার সামনে! একটি চেয়ারও খালি নেই। ঘরটি পুরো ভরে গেছে। ফরাসিরা ভাল ইংরেজি জানে না, এটিই আমার ভরসা। এরকম যখন ভাবছি, তখনই দেখি এক ঝাঁক বাঙালি। ঝাঁকের মধ্যে নীলরতন, পার্থপ্রতিম মজুমদার। পার্থ বাংলাদেশের ছেলে, মূকাভিনয়ে পাকা। ঢাকায় আমার সঙ্গে দেখা করতে আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন, তখনই আলাপ। পার্থর সঙ্গে প্যারিসের অভ্যেসে হাত মেলালাম।
–একজন বাঙালি খুঁজছিলাম, আপনাকে পাওয়া গেল।
বাঙালিরা ততক্ষণে আমাকে ঘিরে ধরেছে, কবে এসেছি, কোথায় উঠেছি, কতদিন থাকব, ইত্যাদি হাজার রকম প্রশ্ন। উচ্ছঅজ্ঞসত সব।
পার্থপ্রতিম, যেন আমার হাজার বছরের বন্ধু, বারবারই বলতে লাগলেন, ‘কেন আমাদের খবর দাওনি যেদিন এলে? সেদিনই ফোন করে দেওয়া যেত না! আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে পারতাম!’ পার্থর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোক বললেন, ‘চলুন আমাদের বাড়িতে যাবেন আজকে, একবেলা অন্তত খাবেন।’ কালই চলে যাবো শুনে ইস ইস আহা আহা করে ওঠে সবাই। কেন আগে থেকে ওরা জানল না, কোথায় আছি আমি। তাহলে তো আমাকে হোটেল থেকে তুলে নিয়ে যেতে পারতেন। আগে জানলে আমরা তো একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারতাম। এখানে বাঙালিদের ছোটখাটো সংগঠন আছে, সব সংগঠনের পরিচালকরাই চুক চুক করে দুঃখ করছেন। সকলকেই আমার বিনীত স্বরে জানাতে হল, এখন তো আর সময় নেই ভাই। কালই চলে যাবো। কেন আর কটা দিন থাকছি না। এভাবে প্যারিসে এসে তাদের বাড়িতে না গিয়ে দুটো বাঙালি খাবার না খেয়ে বিদায় নেব, এ কেমন কথা হল!
গপ্প করলে চলবে না, মঞ্চে বক্তারা বসে গেছেন। আমাকে ডাকা হচ্ছে। মঞ্চে আমাকে নিয়ে বসালেন রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্সের সভানেষনী, অনুষ্ঠানের উপস্থাপকপি রচালক। সভানেষনীর বাঁ পাশে বসনিয়ার সাংবাদিক, ডান পাশে আমি, আমার পাশে ক্যামেরুন, ক্যামেরুনের ডানে আলজেরিয়া। ফ্রান্সের লোকেরা আফ্রিকার খবর খুব ভাল রাখে। আলজেরিয়া তো বলতে গেলে ফ্রান্সের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। বসনিয়ার খবরও বেশ রাখে। কেবল ভারতবর্ষ সম্পর্কে আগ্রহ খুব নেই। জানেও না খুব বেশি কিছু।
এক এক করে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন সাংবাদিকরা। সকলেই ফরাসি ভাষায় বলছেন। আমাকেই কেবল ইংরেজিতে বলতে হবে। ইংরেজি থেকে ফরাসিতে অনুবাদ করে দেবে কেন। যেহেতু এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদ করতেই হবে, তখন বাংলা থেকেই নয় কেন। বাঙালির দলটির দিকে যেই না প্রস্তাবটি দেওয়া হল, প্রীতি সান্ন্যাল নামের এক বাঙালি মহিলা মঞ্চে এলেন আমার অনুবাদ করতে। একটি উত্তরের অনুবাদ করে তিনি দর্শকের আসনে বসা কাউকে দেখে আমার চেয়ে ভাল অনুবাদক একজনকে দিচ্ছি বলে নিজে কেটে পড়ে যাঁকে পাঠালেন, তিনি অমিতাভ চক্রবর্তী। প্রীতি সান্ন্যালের নিজের ওপর আস্থা কিছুটা কম। জিল দাঁড়িয়ে আছে, চেয়ার একটিও খালি নেই যে বসবে। বার বার তার দিকে আমার চোখ চলে যায়। জিলের চেয়ে সুদর্শন আর কোনও ফরাসিকে কি আমি এ অবদি দেখেছি! নাহ! দেখিনি। জিল গলগল করে ফরাসিতে কথা বলে, শুনতে বেশ লাগে। তার ইংরেজি বলাও বেশ মজার, বেশির ভাগ বাক্যই সে শুরু করে আই অ্যাম গোয়িং দিয়ে। আই অ্যাম গোয়িং টু কাম টু ইয়োর হোটেল, আই অ্যাম গোয়িং টু গো টু নাতালিস হাউস, আই অ্যাম গোয়িং টু বাই এ টিকেট এরকম। হঠাৎ নাতালিকে দেখি, নীলরতনকেও। নীলরতন আমার দেওয়া শার্টটি পরে এসেছে। অমিতাভ চক্রবর্তী অনর্গল আমার কানের কাছে মুখ এনে বলে যাচ্ছেন মঞ্চের বক্তারা কে কি বলছেন। বক্তাদের বক্তব্য শেষ হলে দর্শকদের মধ্য থেকে প্রশ্ন শুরু হল। মূলত ফরাসি-ভিড় থেকে প্রশ্ন। একজন জার্মান ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, ইউরোপ থেকে তাঁরা কি করে আমাকে সাহায্য করতে পারেন। আমি বললাম, দেশ ও বিদেশের যুক্তিবাদী বিবেকবান সচেতন মানুষের সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব হত না। পশ্চিমের দেশগুলো যে দেশগুলো বাক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারে বিশ্বাস করে, অনেকে আমার পাসপোর্ট ফেরত দেবার জন্য, আমার নিরাপত্তার জন্য, লজ্জা বইটির ওপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার জন্য প্রচুর চিঠি লিখেছেন। তাদের আন্দোলনের ফলেই আমি আমার পাসপোর্ট ফেরত পেয়েছি। আপনাদের কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। হয়ত একদিন আমি নিরাপত্তা পাবো দেশে। হয়ত লজ্জা বইটির ওপরও আর নিষেধাজ্ঞা থাকবে না।
একসময় দেখি লাল একটি জামা পরে নাতালি ঢুকছে, জিলের নাতালি। নাতালি ঢুকেই জিলকে নিয়ে দরজার বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল। জিল কি এখন নাতালির সঙ্গে চলে যাচ্ছে কোথাও! আমার মন খারাপ হয়ে যায়। জিল, তুমি তো বলেছো নাতালির সঙ্গে তোমার গভীর কোনও প্রেম নেই! তবে যাচ্ছে! কোথায়!
মিশেল ইডেলের সংগঠনের মেয়ে তেরেসকে দেখি । মিশেল ফোন করেছিলেন হোটেলে, আমাকে নিতে আসবেন সন্ধ্যা সাতটায়। আন্তোয়ানেত ফুকের বাড়িতে নেমন্তন্ন। জিল উদয় হয়। মন ভাল হয়ে যায়। হোবিয়া মিনার হাসি-মুখটিও পলকের জন্য চোখে পড়ে। লোকটি আমার ছায়া মাড়ান না। ভাষার অসুবিধের জন্য এই দূরত্ব তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। ইচ্ছে করে ফরাসি ভাষাটি শিখে নিতে, কিন্তু কি করে সম্ভব! নাতালির সঙ্গে চেষ্টা করে দেখেছি, হয় না। জিভকে গোল করে পেঁচিয়ে গলার তল থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ ওরা বের করে, ওরকম শব্দ শত চেষ্টা করলেও আমার গলা থেকে বেরোবে বলে মনে হয় না। অনুষ্ঠান শেষ হতেই আমাকে ঘিরে ধরলো অনেকে। জার্মানি থেকে এসেছেন এক নারী সংগঠনের নেষনী। তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন জার্মানির অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার।
আমি বলে দিই, দেশে গিয়ে জানাবো আপনাকে। এখনই কথা দিতে পারছি না। অনুষ্ঠানের ফরাসি দর্শকরা আমার কাছে ভিড় করেন অটোগ্রাফ পেতে।
আপনার বই কবে বেরোবে?
সম্ভবত সেপ্টেম্বরে।
আমরা অধীর আগ্রহে বসে আছি আপনার বই পড়ব বলে।
আমি বিষণ্ন হাসি। আমার দিকে বড় মায়ায় তাকিয়ে একটি মেয়ে বলল, আপনি কি ফ্রান্সেই থাকবেন এখন থেকে?
না, আমি কাল দেশে ফিরে যাচ্ছি।
দেশে কেন ফিরবেন? ওখানে যদি আপনাকে মেরে ফেলে!
আমি দেশে ফিরছি শুনে আরও পাঁচ ছজন ফরাসি মেয়ে বিস্ময়ের ঘোরে বলতে থাকে, না না না দেশে ফিরবেন না। দেশে আপনি কি করে বেঁচে থাকবেন ফতোয়া নিয়ে! এমন একটা ফতোয়া দিয়ে দিল, আর আপনি ফেরার কথা ভাবছেন, কি করে ভাবছেন!
তাই বলে নিজের দেশ ছাড়ব! অসম্ভব।
আপনার বুঝি প্রাণের মায়া নেই? যে করেই হোক বেঁচে থাকতে হবে তো। বেঁচে না থাকলে লিখবেন কি করে!
মানুষগুলোর চোখের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা মায়া মমতাগুলো আমি অনুবাদ করে নিই।
এরপর যে কজন বাঙালি এসেছিলেন অনুষ্ঠানে, আবার ঘিরে ধরলেন আমাকে। চলুন আমাদের বাড়ি চলুন।
আজ তো পারছি না ভাই। রাতে নেমন্তন্ন আছে।
তবে কাল!
কাল চলে যাবো।
আমরা কি কিছুই করতে পারবো না আপনার জন্য?
এবার তো হল না। পরের বার এলে নিশ্চয়ই যাবো আপনাদের বাড়িতে।
পার্থ প্রতিম পরিচয় করিয়ে দিলেন শিশির ভট্টাচার্যের সঙ্গে। শিশির কালো মত খাটো মত বাচ্চা বাচ্চা চেহারার এক লোক। শিশিরকে বললাম, শুনেছি ভাল অনুবাদ করেন, আপনার কথা আমি আমার প্রকাশককে বলব, এখানকার ফরাসিদের বাংলায় আমার খুব একটা আস্থা নেই।
সকলেই খুশি হল যে বাঙালিদের কাউকে দিয়েই অনুবাদের কাজ হবে বলে। খানিক পর পার্থ আমাকে খানিকটা দূরে সরিয়ে প্রলয় রায় নামের এক লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, প্রলয় রায় চট্টগ্রামের ছেলে। বহুদিন থেকে আছেন এদেশে। প্রলয় বেশ ভাল অনুবাদ করতে পারবে। কিছু অনুবাদও করেছে। তুলনা হয় না। কোনও বাঙালিই ওর মত ভাল ফরাসি লিখতে পারে না।
প্রলয় আর শিশির দুজনের নম্বরই পার্থর কাছ থেকে নিলাম। জ্যঁ শার্ল এর বাংলায় আমি মোটেও সন্তুষ্ট নই। প্রলয়ের নামই না হয় ক্রিশ্চান বেসের কাছে প্রস্তাব করব, ভাবি মনে মনে। এক জাপানি দাঁড়িয়ে ছিল হাঁ করে। কাছে এসে বললেন, জাপান থেকে তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান। আমি যেন কী একটা বিশাল কিছু হয়ে গেছি। কিন্তু আমি কি হয়েছি কিছু? খুব ভাল জানি যে আমি কিছুই হইনি। যে আমি, সে আমিই আছি, অবকাশের আমি, গোবেচারা আমি, খানিকটা বোকা বুদ্ধু, খানিকটা আদর্শ মানা, খানিকটা স্রোতে গা ভাসানো, কিছু বোঝা, কিছু না বোঝা মেয়ে।
জিলের সঙ্গে বাকিটা সময় কাটানো সম্ভব হয়নি। মিশেল ইডেল আর আন্তোয়ানেত ফুকের সঙ্গে মধ্যরাত অবদি কাটাতে হয়।
Leave a Reply