ক্রিশ্চান জ্যঁ শার্লকে দিয়ে লজ্জা অনুবাদ করাচ্ছেন। এখন লজ্জা নিয়ে তিনি আর ভাবছেন না। ভাবছেন আমার অন্য বই নিয়ে। জ্যঁ শার্ল লন্ডন থেকে আমার বাংলা বই কিনে এনেছে। শোধ, নিমন্ত্রণ, ভ্রমর কইও গিয়া সবই তাঁর পড়া হয়ে গেছে। শোধের গল্পটি সে ক্রিশ্চানকে শুনিয়েছেন। খাতা কলম বের করে ক্রিশ্চান লিখে নিলেন কি কি বই এ পর্যন্ত লিখেছি আমি। কি কি তাঁকে আমি এখন দিতে পারব ছাপতে। এ পর্যন্ত আমি যা লিখেছি সবই তিনি চান এবং এখন যেটি লিখছি, কোরানের নারী, সেটিও তাঁর চাই। সব তাঁর চাই, যা আছে। কবে পাঠাতে পারব সব। কখন। সব তাঁর জানা চাই। বাংলায় পাঠাই, ইংরেজিতে পাঠাই তাঁর কোনও অসুবিধে নেই। ইংরেজিতে পাঠালে তিনি নিজে অনুবাদ করে নেবেন। বাংলায় হলে বাংলা জানে এমন কাউকে দিয়ে প্রাথমিক অনুবাদ করিয়ে নিয়ে নিজে তিনি সংশোধন করবেন। আমি প্যারিসে থাকাকালীনই তিনি আমাকে দিয়ে কনট্রাক্ট ফর্ম সই করাতে চান। বারবারই বললেন, ‘তসলিমা, তোমার নামকে নয়, আমরা তোমার লেখাকে ছাপতে চাই।’
টেলিভিশনের জন্য ক্রিশ্চানের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞেস করিনি, নিজেই বললেন যে আমার সম্পর্কে জরুরি যে কথাটি বলেছেন তা হল, ‘তসলিমার হাতে একটি অস্ত্র আছে, অস্ত্রটির নাম কলম।’
আমার ঘড়িটি প্যারিসে আসার পথেই বন্ধ হয়ে আছে। ক্রিশ্চানও ঘড়ি পরতে পছন্দ করেন না। এদিকে দিন দেখে বোঝার উপায় নেই কটা বাজে। যে দেশে রাত দশটা অবদি আলো থাকে, কি করে অনুমান করব কখন সে দেশে দুপুর হয়, কখন বিকেল আর কখন সন্ধে। হোটেলে ফিরতে হবে, এডিশন স্টক থেকে ফটোগ্রাফার আসবে ছবি তোলার জন্য। দ্য ফাম প্রকাশনীর মিশেল ইডেল আসবেন। মিশেলএর সঙ্গে আমার দেখা করার ইচ্ছে কারণ মিশেলই প্রথম ফরাসি প্রকাশক আমার সঙ্গে ঢাকায় যোগাযোগ করেছিলেন। দ্য ফাম থেকেই আমার বই চাওয়া হয়েছিল সবার আগে। ওদেরই প্রথম আমি কথা দিয়েছিলাম লজ্জা বইটি ওদেরই দেব। শেষ পর্যন্ত লজ্জা আমি এডিশন স্টককে, ক্রিশ্চানের প্রকাশনীকেই দিই। মিশেল ওদিকে বইয়ের জন্য ফোন করছেন রাত দিন। জ্ঞদেখ তসলিমা আমরাই প্রথম তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, আর তুমি কেন চুপ করে আছ, কেন বার বার ফোন করেও তোমাকে পেতে পারি না। কেন তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছ না। টাকার প্রয়োজন তোমার? কত টাকা চাও? এডিশন স্টক কত টাকা দিতে চাইছে তোমায়, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা আমরা দেব। তবু লজ্জা ছাপার অনুমতি আমাদের দাও।’ লজ্জা ছাপবেন বলে কনট্রাক্ট ফর্ম পাঠিয়েছেন, নিজেদের ছাপানো বই পত্র পাঠিয়েছেন যেন দেখে সিদ্ধান্ত নিই। বলেছেন, ‘দেখ তসলিমা দয়া করে আমাদের অনুমতি দাও লজ্জা ছাপার। আমরা আং সাং সুচির বই ছেপেছি, সুচি ইউনেস্কো পুরস্কার পেয়েছে। আন্তোনেত ফুক তোমার জন্যও ইউনেস্কো পুরস্কারের ব্যবস্থা করবেন।’ শুনে ভীষণ বিব্রত আমি। আমাকে কি লোভ দেখানো হচ্ছে! আমি তো লোভে পড়ছি না, টোপমাখা বাক্য শুনে বরং লজ্জায় পড়ছি। লজ্জার জন্য দুটো প্রকাশনী এমনই উন্মাদ হয়ে উঠেছে যে মাঝখানে পড়ে আমি লজ্জায় মুখ লুকোই। দুজনকেই আমি বোঝাতে চেষ্টা করেছি, দেখ লজ্জা এমন একটা বই নয় যেটা তোমাদের পাঠকের আদৌ ভাল লাগবে,বইটি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিয়ে লেখা, তার ওপর বইটি তথ্যভিত্তিক বই। ফরাসি পাঠকের এই বই মোটেও ভাল লাগবে না, ওরা বুঝবেও না। না, আমার কথা কেউ মানবেন না। তাঁদের বই চাই, চাইই, যে করেই হোক চাই। ক্রিশ্চানের চাপে আর তাপে বইটি তাঁকে ছাপার অনুমতি দেওয়ার পর মিশেলের জন্য সত্যিই আমার কষ্ট হতে থাকে। লজ্জার মত অসাধারণ একটি বই তিনি পেলেন না বলে নয়, তাঁর ইচ্ছের আমি মূল্য দিইনি বলে তিনি যে কষ্ট পেয়েছেন, সে কারণে। হোটেলে সাড়ে পাঁচটায় পৌঁছে দেখি চারটা থেকে অপেক্ষা করছে এডেন, ছবি তোলার মেয়ে। অপেক্ষা করছে মিশেল ইডেল। মিশেলের বয়স চল্লিশের ওপর। আমাকে আমার দেশে লম্বা মেয়ে বলা হয়, আমার চেয়েও দেড় হাত লম্বা মিশেল, নিখুঁত সুন্দরী। মুখে হাসি লেগেই আছে। ডানে ক্রিশ্চান বামে মিশেলকে নিয়ে আমি তখন কী করি, কোথায় যাই বুঝতে পারছি না। সত্যি, এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় আমি আর পড়িনি। সারাপথ ক্রিশ্চান বলে বলে এসেছেন, ‘প্রকাশক একজন থাকা উচিত তোমার এ দেশে। দুজন প্রকাশক থাকবে কেন! কারণ কি বল! এখানে কোনও লেখকই একাধিক প্রকাশককে বই দেন না। তুমি দেখ আমাদের প্রকাশনীটিকে! দেখ আমরা কী ধরনের বই প্রকাশ করছি। কী মানের বই তুমি নিজে এসে দেখে যাও। আজে বাজে ছোট প্রকাশকের সঙ্গে তোমার দেখা করাই উচিত নয়। আমি অবাক হয়ে যাই তোমার রুচি দেখে। দ্য ফাম!! তারা? তাদের তুমি পছন্দ করলে কি করে? তারা সব বাজে। জঘন্য। নারী নারী নারী বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলল! যত্তসব। এইসব বাজে জিনিস দেখেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রকাশনায় যাওয়ার। তসলিমা, কোনও কিছুর জন্য আমি তোমাকে চাপ দিতে চাই না। দেব না। তোমার অধিকার আছে যা কিছু করার, যাকে খুশি বই দেবার। কিন্তু তোমার তো রুচি থাকা উচিত। অন্তত সামান্য রুচি তো তোমার কাছে আশা করি। তুমি কি করে ওদের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলে? উফ, ভাবতেই পারি না। ভাল যে আমি এসে বাঁচিয়েছিলাম তোমাকে ওদের হাত থেকে। এখন আবার বলছ যে তুমি ওদের সেমিনারে যাবে? তোমার কি মাথা টাথা খারাপ হয়েছে? থার্ড ক্লাস। থার্ড ক্লাস। গেলেই বুঝবে। শোনো, মাথায় যদি তোমার সামান্য ঘিলু থেকে থাকে, তবে আমার কথা তুমি রাখবে, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, যেও না। যেও না ওদের সেমিনারে। নিজের মানটা নষ্ট কেরো না। হাস্যকর পরিবেশে গিয়ে নিজেকে হাস্যকর কোরো না।’ একটি প্রার্থনাই আমি মনে মনে করেছি হোটেলে ফেরার পথে, মিশেল ইডেল আমার জন্য হোটেলে অপেক্ষা করতে করতে আমি ফিরছি না বলে যেন তিনি বিরক্ত হয়ে ফিরে যান। আমার প্রার্থনা কোনও খোদা বা ভগবানের কাছে নয়, এই জগতের রহস্যময় জটিল প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতি আমার ডাকে সাড়া দেয় না। মিশেল ইডেল তাঁর হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা নিয়ে হোটেলের দরজায় দণ্ডায়মান। আমি আর ক্রিশ্চান মুখোমুখি মিশেলের। আমি এখন কাকে সামলাবো। ক্রিশ্চান মোটেও মিশেলের দিকে ফিরে না তাকিয়ে একদমে বলে যান, ‘তসলিমা, তোমাকে এখন ছবি তুলতে হবে, এডেন বসে আছে অনেকক্ষণ। তাড়াতাড়ি চল। ছবি তুলে তারপর তো তোমাকে অপেরায় যেতে হবে, জানো তো! জ্যঁ শার্ল আসবে ঠিক সাতটায়। মনে আছে তো! তাড়াতাড়ি কর।’
আমি মরা কণ্ঠে এডেনকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি ঘরে ছবি তুলবে, না কি বাইরে? সুন্দরী এডেন মধুর হেসে বলল, বাইরে।
বাইরে?
ইতস্তত করি।
এডেন আবারও হেসে বলল, দূরে নয়। কাছেই। কাছেই পেলে দ্য রয়াল। ওখানকার বাগানে।
খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে কিন্তু। বেশি সময় নেই আমার। কারণ.. ক্রিশ্চানের দিকে যতটা সম্ভব না তাকিয়ে বলি, কারণ মিশেল এসেছে আমাকে নিতে, সেমিনারে যেতে হবে।
ক্রিশ্চান হা হা করে উঠল, কিসের সেমিনার? কোন সেমিনার? তুমি না অপেরায় যাচ্ছ! জ্যঁ শার্ল তোমাকে নিতে আসবে। ও টিকিট করে রেখেছে।
এবার আমাকে একটি পক্ষ নিতে হবে। ক্রিশ্চান বিদেয় হলে এখন আমি বাঁচি। এ সময় মিশেলকে ফিরিয়ে দেওয়া আমার উচিত নয়। এত বড় অমানবিক কাজটি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমি সেমিনারে যাবো, কথা যখন দিয়েছি, যাবই।
ক্রিশ্চানকে এড়িয়ে আমি বলি, চল একটা ট্যাক্সি ডাকি, এডেন মিশেল আর আমি একসঙ্গেই চল বাগানটিতে যাই। ওখান থেকে মিশেল আর আমি চলে যাব।
ক্রিশ্চান গাড়ির দিকে যাচ্ছে, যেন আমার কথা শোনেনি, বলল, চল চল বাগানে চল, আমি তোমাদের দুজনকে নিয়ে যেতে পারব। এডেন এসো, তসলিমা এসো।
আরে বাবা মিশেল কোথায় যাবে! মিশেলের কি হবে? মিশেল হতভম্ব দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি তাঁর হাত ধরে বললাম, আপনিও চলুন।
মিশেল গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন, ক্রিশ্চান বলেন, আমার গাড়িতে তো দুজনের বেশি জায়গা হবে না।
হবে হবে। আমি বলি, সামনে আমি বসছি। পেছনে ওরা দুজন বসবে, জায়গা হবে না কেন! ঠিকই হবে।
ক্রিশ্চান ভেতরে গজগজ করছেন তা ঠিকই বুঝি। বাগানে ফটাফট কটি ছবি তুলে আর সময় দিতে পারব না বলে কেটে পড়ি। মিশেল একটি ট্যাক্সি ডেকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, ওতে উঠে পড়ি। দুজনে কথা বলতে থাকি বিরতিহীন, যেন অনেককালের সম্পর্ক আমাদের। আমাকে মিশেল নিয়ে গেলেন অনুষ্ঠানে, বিশাল সেমিনার কক্ষটির মঞ্চের দিকে, যে মঞ্চে বসে আছেন কয়েকজনের সঙ্গে হুইল চেয়ারে একজন, সেই একজনের দিকে, আন্তোয়ানেত ফুকের দিকে। ষাট দশকের নারী আন্দোলনের নেষনী এই ফুক। এখন ইউরোপীয় পার্লামেণ্টে সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য। এডিশন দ্য ফাম নামের প্রকাশনীর মালিক প্রকাশক তিনিই। তাঁকেই মিশেল ইডেল গুরু মানেন। ফুকের সঙ্গে করমর্দন হল। হাসি বিনিময় হল। চুমোচুমি হল। মঞ্চ থেকে ঘোষণা করে দেওয়া হল আমার আগমন বার্তা, তসলিমা শব্দটি শুধু চিনতে পারলাম একগাদা ফরাসি শব্দের ভিড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বিশাল ঘর ভর্তি নারী পুরুষ প্রচণ্ড হাততালি দিতে শুরু করলেন, হাততালি দিতে দিতে দাঁড়িয়ে গেলেন সকলে। এমন দৃশ্য আগে কখনও দেখিনি। এত মানুষ আমাকে অভিবাদন জানাচ্ছেন। আমি অভিভূত। বিস্মিত। শিহরিত। কিছুটা বিব্রতও। চোখে আমার জল চলে এল। আজ কি সত্যিই এখানে এসে পৌঁছেছি আমি! এ কি আমার জন্য অতিরিক্ত নয়! এত আমার প্রাপ্য ছিল না। আমাকে কিছু বলতে বলা হল মঞ্চে দাঁড়িয়ে। কী বলব! কী কথা বলা যায় এখানে। সকলের চেয়ারের সামনে লেখার জন্য টেবিল। নারীবাদের ওপর দামি দামি কথাবার্তা হচ্ছিল এখানে, সকলে লিখে নিচ্ছিলেন আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো। সব থামিয়ে দেওয়া হল আমি বক্তৃতা দেব বলে! কোনও কিছু কি আমি বলতে পারবো যা এঁদের কাছে নতুন! মিশেল আর আন্তোয়ানেতকে মিনমিন করে বললাম, দেখ আমাকে তো আগে বলা হয়নি যে আমাকে বক্তৃতা করতে হবে! আমার তো কোনও প্রস্তুতি নেই, তাছাড়া আমি ক্লান্ত, আমাকে যেতেও হবে এক্ষুনি। এত অপ্রতিভ বোধ করছিলাম যে বেরিয়েই এলাম। বেরিয়ে এসে মনে হল আহা ওই অভিবাদনের উত্তরে অন্তত ধন্যবাদ জানানো উচিত ছিল।
আমার আর মিশেলের পেছন পেছন কয়েকজন তরুণী বেরিয়ে এল। মিশেলকে বললাম, আমার কিছু বলা উচিত ছিল ওখানে। সবাই নিশ্চয়ই মন্দ বলবে।মিশেল হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘কী যে বলছ তসলিমা। সবাই ভীষণ খুশি তোমাকে দেখে। তোমার উপস্থিতিটাই বড়। বলতেই যে হবে এমন কোনও কথা নেই।’ সবাই আমরা কাছের একটি ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম। এক ফরাসি তরুণী কাঁপা কাঁপা হাতে আমার হাত ছুঁয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি ধন্য হলাম। ক্যাফেতে আমাকে ঘিরে বসে সবাই আমি কেমন আছি, কি করছি, কি ভাবছি, সবই জানতে চাইছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানে না তারা, জানে কেবল আমাকে। আমার জন্য সবাই দুশ্চিন্তা করছে। ফতোয়ার খবর পাওয়ার পর প্যারিসের রাস্তায় নেমেছিল নারীবাদীরা, বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে আমরা তসলিমার সমর্থক লেখা বড় বড় প্ল্যাকার্ড নিয়ে। তারা আমার লেখা পড়তে চায়। কবে বেরোবে বই জানতে অস্থির হয়ে ওঠে। হবেই তো। পৃথিবীর অপর প্রান্তে কোনও এক বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের দেশের এক মেয়ে নারী স্বাধীনতার কথা লিখতে গিয়ে ফতোয়ার শিকার হয়েছে, কী লিখেছে সে যে এত লোক ক্ষেপে গেল, তা জানার আগ্রহ তো এদের থাকবেই। মনে মনে ভাবি, এই যে লজ্জা বইটির জন্য এমন অপেক্ষা করে বসে আছে পড়বে বলে, লজ্জায় তো নারীবাদের কথা নেই। কেউ যদি ভেবে থাকে ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলেছি বলে লজ্জা বাজেয়াপ্ত করেছে বাংলাদেশ সরকার অথবা ইসলামি মৌলবাদীরা আমার মাথার মূল্য ধার্য করেছে তবে তা যে সম্পূর্ণ ভুল তা আমি কী করে কাকে বোঝাবো! ক্যারোল টাং ও অপেক্ষা করছেন আমার বই পড়ার জন্য। ক্যারোল টাং ইওরোপীয় পার্লামেণ্টের মন্ত্রী। তিনিই উদ্যোগ নিয়েছিলেন কুড়ি দফা দাবি পেশ করার, আমার পাসপোর্ট যদি ফেরত না দেওয়া হয়, নিরাপত্তা যদি না দেওয়া হয় আমাকে তবে ইউরোপ থেকে বাংলাদেশের কোনও অর্থ-সাহায্য পাওয়ার বারোটা বাজবে ইত্যাদি। রেসোলুশনটি পাশ হয়েছে এপ্রিলের একুশ তারিখে।
ফ্রান্স থেকে কদিন পরই দেশে ফিরে যাচ্ছি শুনে সকলে অবাক হয়। বিস্ফারিত চোখ একেকজনের।
–ওখানে তো আপনাকে মেরে ফেলবে। দেশে ফেরা আপনার উচিত হবে না।
–দেশে কি আর আমি একা লড়াই করছি। আমার পাশে অনেকে আছেন।
–আপনার জীবন মূল্যবান। আপনাকে লিখতে হবে। দেশে যদি আপনাকে মেরে ফেলে তাহলে লিখবেন কি করে? আপনি ফ্রান্সে থাকুন। লিখতে হলে বেঁচে থাকতে হবে তসলিমা।
–লেখালেখি দেশে বসেই করব। দেশ ছাড়ব না।
–এ কোনও কথা হল? আপনার ভয় করে না?
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকদিন থেকে আছি, এভাবে থাকাটাই এখন অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। লড়াই করে বাঁচতে চাই। পালিয়ে নয়। যদি মরতে হয়, মরে যাবো। এ আর এমন কী! কত লোকে মরছে।
সকলের বিস্মিত চোখের সামনে সাতটা বেজে গেলে আমি উঠে পড়ি। মিশেল আমাকে হোটেলে পৌঁছে দেবার সময় বার বার করে বললেন যেন আন্তোয়ানেতের জন্য কোনও একদিন সময় রাখি। আমাকে নিয়ে তাঁরা প্যারিসের বাইরে কোথাও যেতে চান। আরও অনেক কিছুর ইচ্ছে আছে। সেজেগুজে পাটবাবুটি হয়ে যথারীতি হোটেলে অপেক্ষা করছিলেন জ্যঁ শার্ল। আমার যে অপেরায় যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল তা নয়, অনেকটা জ্যঁ শার্লকে আহত না করার জন্য, যেহেতু যথেষ্টই করা হয়েছে ইতিমধ্যে, আর কিছুটা জিলকে এড়াবার জন্য আমার এই অপেরায় যাওয়া। জিল বারবারই বলেছে, আমি যেন একটু ফাঁক পেলেই তাকে ফোন করি, ফোন করলেই চলে আসবে সে। আমি চাইছিলাম না জিলকে ফোন করতে। থাকে সে মপঁলিওতে। ফ্রান্সের দক্ষিণ প্রান্তের এক শহরে। আর তার প্রেমিকা বাস করে প্যারিসে। নাতালির সঙ্গে তার সময় কাটানো নিশ্চয়ই আনন্দের, অন্তত আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর চাইতে। তাছাড়া জিলকে আমার এত ভাল লাগে যে, তার জন্য মন কেমন করা থেকে নিজেকেও একরকম বাঁচাতে চাই। নাহ, জিল নাতালির সঙ্গে সময় কাটাক, আমার জন্য তার সারাদিনটি নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। জিল নাতালিকে ভালবাসে, বাসুক। আমার মন যেন এত জিলে পড়ে না থাকে। আসলে, এত চমৎকার না হলেও সে পারত। আমার চেয়ে বয়সে সে চার বছরের ছোট। আশ্চর্য, কখনও কোনওদিন আমার চেয়ে অল্প বয়সের কারও জন্য আমার মন কেমন করেনি। জিলের জন্য কেন করে বুঝিনা।
প্যারিসের নতুন অপেরাটি আধুনিক স্থাপত্যের একটি উদাহরণ বটে। ফরাসি লেখক জর্জ পেরেক এটিকে অবশ্য বড় মাপের পাবলিক টয়লেটের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ফরাসিরা শহর ভর্তি চমৎকার পুরোনো স্থাপত্যের মধ্যে হুট করে একটি বেঢপ দালান তুলতে মোটেও রাজি ছিল না। রাস্তায় নেমে রীতিমত আন্দোলন করেছে নতুন অপেরাটির নির্মাণের বিপক্ষে। আন্দোলনে কাজ হয়নি, শেষ অবদি ফরাসি নন্দনতাত্ত্বিকদের বিচারে যে বস্তুটি একটি কুৎসিত স্থাপত্য, সেটিই আধুনিক অপেরা হিসেবে ঠিক ঠিক দাঁড়িয়ে গেল। অপেরায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল জ্যঁ শার্লের স্ত্রী নাতাশা। আমাকে মাঝখানে বসিয়ে দু পাশে বসে গেল দুজন। নাতাশা নাদুস নাদুস মেয়ে। তার হাঙ্গেরিয়ান মা ওয়ার এণ্ড পিস পড়ে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে কন্যা জন্মালে নাম রাখলেন নাতাশা। নাতাশা আর জ্যঁ শার্ল তাদের ছেলের নাম রেখেছে সত্যজিৎ। শুনে এত ভাল লাগে। প্যারিসের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সেদিন দেখেছি সত্যজিৎ রায়ের ছবি চলছে, সাতদিনের সত্যজিৎ উৎসব। আনন্দে এমনই ভেসেছিলাম যে চোখে জল চলে এসেছিল। হয় এমন।
এখানকার নাটক থিয়েটারের শেষে যে জিনিসটি হয়, তা আমাদের দেশের নাট্যমঞ্চে দেখিনি। নাটকের শেষে শিল্পীরা যখন সবাই মঞ্চে এসে দাঁড়ায় বিদায় জানাতে, দর্শকরা তাদের করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানায়। কিন্তু দর্শকের যদি কোনও নাটক খুব ভাল লাগে, সেই করতালি আর সহজে থামে না। যতক্ষণ না থামে ততক্ষণ বার বারই শিল্পীদের মঞ্চে এসে এসে অভিনন্দন গ্রহণ করতে হয়। অপেরা থেকে রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেতে গিয়ে রেস্তোরাঁয় একটি টেবিল পেতেই আমাদের অপেক্ষা করতে হয় এক ঘন্টা। অনেক রাত অবদি রেস্তোরাঁয় বসে তরুণ তরুণীর পরস্পরকে যথারীতি জড়িয়ে ধরা, একশ লোকের সামনে চুমু খাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে গল্প করতে থাকি। গল্পে গল্পে এইডসের প্রসঙ্গ ওঠে। নাতাশা আর জ্যঁ শার্ল দুজনেই বলল, প্রায় প্রতিদিনই এই রোগে কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে ফ্রান্সে। তিরিশ হাজার ফরাসি এইডস রোগে ভুগছে। ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সেই সবচেয়ে বেশি এইডস রোগী। ফরাসিদের মধ্যে এখন সচেতনতা বেড়েছে। এইডসের ভয়ে অনেকে আগ্রহ হারাচ্ছে যৌনসম্পর্কে, এমনকী প্রেমেও। এইডসের রোগীরা ক্রমে ক্রমে নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে, কেউ মিশতে চাইছে না, কাজ করতে চাইছে না তাদের সঙ্গে। এসব মন খারাপ করা ঘটনা শুনে হোটেলে যখন ফিরে আসি আমি, বড় ক্লান্ত। শরীরটিকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে আসার আগে চোখ পড়ে জিলের দেওয়া লিস ফুলে। কি সুন্দর ফুটে আছে ফুলগুলো। জিল কেমন আছে। কী করছে! নিশ্চয়ই ঘরে নেই। শনিবার রাতে কেন সে ঘরে থাকবে! নাতালিকে নিয়ে নিশ্চয়ই রাতের প্যারিস জুড়ে আনন্দ করছে। যারা যারা ফোন করেছিল, হোটেলের লোক কাগজে লিখে রাখে। নামগুলোর ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে জিলের নাম খুঁজি। নেই।
4 number episode deoa hoi nai naki!
দেয়া হয়েছিল। ভুলে অন্য একটা ক্যাটাগরিতে চলে গেছিল। সরি। এখানে দেখতে পারেন – http://ebanglalibrary.com/6454/