৬. যশোবতী বিমূঢ় হইয়া গঙ্গার দিকে চাহিলেন

যশোবতী বিমূঢ় হইয়া গঙ্গার দিকে চাহিলেন। এক্ষেত্রে কি করিবেন তাহা মনে আসিলেও তিনি সঙ্কুচিত হইয়াছিলেন, তাঁহার পদনখগুলি চঞ্চল।

বৈজুনাথের কাষ্ঠের আঘাতপ্রসূত জ্বালাভাব তখনও ছিল, ভাগ্যশঃ কাষ্ঠের উপর ভস্ম আবৃত এবং তাহার একটি স্থানেই অগ্নি প্রজ্বলিত থাকার ফলে বিশেষ কিছু আহত করিতে সক্ষম হয় নাই। তথাপি সে কোনক্রমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া স্বলিত পদে দম্পতির নিকট আসিয়া দাঁড়াইয়া কহিল–”এ তোমার স্বামী,…”

মুখমণ্ডল আন্দোলিত করিয়া তুলিয়া যশোবতী কহিলেন–”হ্যাঁ।”

বৈজুনাথ কহিল-”সরো গো।”

যশোবতী দৃঢ়তার সহিত আপন স্বামীকে আঁকড়াইয়া রহিলেন।

“লাও সর কনে বউ–উঠ, দিয়ে আসি।”

এ অনুরোধে যখন যশোবতীর ভাবান্তর হইল না, তখন বৈজুনাথ ঝটিতি দেহটি তুলিয়া লইল, চণ্ডালের হস্তস্পর্শে ব্রাহ্মণকন্যা ক্ষিপ্রবেগে জাতিসম্রম রক্ষা মানসে সরিয়া গিয়াছিলেন। তিনি মাটি ছাড়িয়া সত্বর উঠিয়া স্বামীর জন্য পাগল হইয়া কাড়িয়া লইতে গেলেন। চণ্ডালের অঙ্গস্পর্শ হইবামাত্র তিনি যখন ইতঃস্তত করিতেছিলেন, তখন চণ্ডাল সীতারামের মস্তক দ্বারা তাঁহাকে ঠেলা দিয়া সীতারামকে গালাগাল দিতে দিতে অগ্রসর হইল।

বৈজুনাথ লম্বা লম্বা পায় চলিতেছে। তিনি আধো ছুটন্ত, স্বামীর মাথাটা ঝুলিয়া পড়িয়াছে দেখিয়া তিনি ব্যথিত হইয়া অনেক কথাই বলিতেছিলেন। কখন বা মস্তকটি তুলিয়া ধরিবার ইচ্ছা ব্যগ্র হইয়াছিল!

বৈজুনাথ সীতারামকে শোয়াইয়া দিয়া হাঁফ ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “লাও ঘর কর!”

যশোবতী তাহার দিকে এখন কঠিনভাবে কটাক্ষপাত করিলেন, আর সে নির্বোধের মত স্থানত্যাগ করিতে উদ্যত হয়।

চণ্ডাল বৈজুনাথ কিছুকাল সম্মুখের সংস্থানটির বিদ্যমান আলো অন্ধকারের উপর নিজের মুখোনি বুলাইয়া, ফিরিয়া দাঁড়াইয়া, আপনার স্তব্ধতাকে এই শ্মশানে শায়িত দেখিয়া একটি পা বাড়াইল; সে, সম্বিৎ, নিশ্চয়ই লাভ করে। তাহার পৃষ্ঠস্থিত আঘাতের চিহ্ন, এ হেন চন্দ্রালোকে, যশোবতীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। একারণে, তর্দশনেই তিনি এককালে ম্লান এবং গম্ভীর হইয়াছিলেন।

বৈজুনাথ, আপনার হৃতস্তব্ধতা আবার পাইয়া, ঘুরিয়া, তাঁহাকে তদবস্থায় দেখিয়া অবাক হয়, নিঃশ্বাস লইয়া কহিল, “কনে বউ, বেগোড় বুঝ দিও না গো।” বলিয়াই সে প্রস্থান করিল।

যশোবতী তাহার বাক্যে কর্ণপাত করিলেন না, কেননা শ্মশান আর শবাসনে নাই, ইহা খাড়া–এ সত্য হইতে তিনি ধীর নিঃশ্বাস লইয়াছিলেন। নিজেই আপনার অশ্রুজলের উষ্ণতা অনুভব করত রোদন করিলেন, এমত সময় দৃষ্টিপথের উপর দিয়া একটি শুষ্কপত্র–শুষ্কপত্রের মধ্যে যেমন অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতার মধ্যে যেমন স্বীকারোক্তি, স্বীকারোক্তির মধ্যে যেমন বেদনা, বেদনার মধ্যে যেমন আলিঙ্গন, আলিঙ্গনের মধ্যে যেমন বুদ্বুদ, একটি শুষ্কপত্র খরখর খর করিয়া চলিয়া গেল। তিনি স্বামীর দিকে চাহিলেন, বৃদ্ধকে সিক্ত দেখিয়া, কর্দমাক্ত দেখিয়া, তাঁহার কৰ্ত্তব্যবোধ আসিল; সুতরাং বৃদ্ধের নোংরা। বস্ত্র কারণ বৃদ্ধ অসংযত হন, খুলিয়া তাঁহার সর্বাঙ্গ সযত্নে সংস্কার করিয়া, একটি অন্য কটে’ পরাইয়া। দিলেন, তদনন্তর বস্ত্র ধৌত করিবার জন্য মনস্থির করিতে প্রস্তুত হইলেন।

ক্রমাগত স্রোতের দিকে চাহিয়া, তাঁহার আপনাকে বড় সহায়সম্বলহীন, ফলত বড় আপনার বলিয়া বোধ হয়; কোন কিছুর স্মৃতি মনে উদয় হইল না, শুধু মাত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অন্ধকার ছোটাছুটি করিতেছে; যিনি উপরে আছেন, মাটিতে আর আর যাহারা, সকলই এক্ষণে নামমাত্র বৈ অন্য নহে।

এক এক সময় আত্মনিগ্রহ করিতে বাসনা হইল, দংশন করিতে ইচ্ছা করিল। এ কারণ যে, এই দুৰ্বত্তের অস্তিত্ব তাঁহাকে অধিকতর কাতর করিয়াছিল। স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি পর্যন্ত রহিত হইয়াছিল। এক্ষণে যে কি করা উচিত তাহা ভাবিয়া কিনারা করিতে পারিতেছিলেন না। অথচ সত্বর বস্ত্র ধৌত না। করিলে শুচিতা রক্ষা হয় না। স্বামীকে চক্ষের আড়াল করিতে তাঁহার কোন ক্রমে সাহস হইতেছিল না।

অনন্যউপায় তিনি স্বামীর কাপড়টি, আলগোচে লইয়া নৌকার পাশে যে অল্প আড়াল ছিল, সেখানে বসিয়া কাপড়টি কাচিলেন এবং একার্য সম্পাদনের মধ্যে বার বার উঠিয়া স্বামীকে দেখিয়াছিলেন। নিজের পট্টবস্ত্র অশুদ্ধ হওয়াতে ভাল মত ভিজাইয়া তীরে উঠিয়া স্বামীর কাপড়টি নৌকায় মেলিয়া দিয়া দেখিলেন, স্বামী শয্যায়, এবং কোথাও কেহ নাই; সত্বর জলের নিকটে আসিয়া গামছাখানি কোনমতে অঙ্গাচ্ছাদন করিয়া আপনার কাপড়খানি কাচিয়া মেলিয়া দিয়া পুনৰ্ব্বার গঙ্গার মাটি ভালভাবে গাত্র মার্জনার পর, স্নান সমাপন করত তীরে উঠিয়া, আপনকার বক্ষ সংলগ্ন গামছাপ্রান্ত খুলিয়া নিঙড়াইতে লাগিলেন, এ সময় তাঁহার দেহ বক্র হয়।

বৈজুনাথ এই বস্তুসংস্কার দেখিল; স্নানলীলা দেখিতে দেখিতে সে উজ্জ্বল হইয়া গেল, ক্ষীণমধ্যা অপূৰ্ব্ব ললিতপদ বন্ধনে দেহ তাহাকে, চণ্ডালকে, যেন বা মনুষ্যোচিত করিল। ভেড়ীর পিছনে সে দণ্ডায়মান, একটি পা শীতকাতর কম্পিত! নিঃশ্বাসে সম্মুখের বৃক্ষপত্র সরিয়া যায়, এবং একারণে। চক্ষুর্ঘয়ের মধ্য দিয়া জিহ্বা বাহির হইয়া পড়িতেছিল। সে আর স্থির থাকিতে পারিল না, জন্তুর মত সেই স্থান বাহিয়া উঠিবার চেষ্টা করিল। মাটি ধ্বসিল, পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করিয়া ভেড়ী পথে উঠিয়া দাঁড়াইয়া, আপনার গতি সংযত করিতে না পারিয়া, এই পার্শ্বের কলমকাটা পথ বাহিয়া,–মাভৈঃ মাভৈঃ গর্জন করিতে করিতে নামিয়া আসিয়া, গঙ্গার তীরে কর্দমের উপর পড়িয়া গেল; তাহার, সম্মুখের হস্ত দুইখানি কর্দমে, সে পশুর মত তাঁহার, যশোবতীর, দিকে চাহিয়া স্থির। যশোবতী এখন বিমূঢ়, সমস্ত দেহ যেন তাঁহার বক্ষে আশ্রয় করিয়াছে, দুই হস্ত সেখানে স্থাপন করত লজ্জায়, শঙ্কায়, ত্রাসে সঙ্কুচিত হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। এবম্প্রকার অঘটনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। বৈজুনাথ কাদা ভাঙ্গিয়া পশুর মতই থপ থপ করিয়া আসিতেছে, লোলজিহ্বায় জোনাকির আলো। ভূততাড়িতের মত তিনি পলাইতে উদ্যতা হইলেন।

বৈজুনাথ উঠিয়া এক লম্ফে আসিয়া তাঁহার গামছাপ্রান্ত আকর্ষণ করিল, তিনি অনিচ্ছাসত্ত্বে ঘুরিয়া গেলেন; সে অতর্কিতে তাঁহার একটি হাত ধরিল এবং নিজের হস্তের গামছা মাটিতে ফেলিয়া একটি লাথি মারিয়া–কেননা এনীচ কার্যে সম্ভবত বসুন্ধরা বাধাদান করিয়াছিলেন–ইহার পরক্ষণেই যশোবতীর সুন্দর রূপলেখা, নশ্বর দেহখানি দুই হস্তে তুলিয়া ধরিল।

যশোবতী প্রথমত আপনকার বিবস্ত্র অবস্থার নিমিত্ত, দ্বিতীয়ত যে তাঁহার দেহ পরপুরুষের বন্ধনে উপলব্ধি করিয়া এককালে লজ্জায়, ক্ষোভে, নিশ্চয় দুঃখে, নিশ্চিত ব্যথায়, কাতরতায়–নিৰ্বাপিত, বিন্দুমাত্র, চেতনাহীন হইয়া গিয়াছিলেন। সহসা স্বীয় দেহের মধ্যে অসম্ভব বিস্ফোরণের শব্দ শুনিতে। পাওয়া মাত্রই, পলকেই এ দুযোগময়ী অজ্ঞানতা নিশ্চিহ্ন হয়, এবং ক্রমে অধীরতায়, ক্রোধে, অপমানে, মুখ দিয়া দেখিতে, কান দিয়া বলিতে, নাসিকা দ্বারা শুনিতে চাহিলেন।

বৈজুনাথ মুখোনি তুলিয়া মুখোনি এমত ভাবে ঘুরাইল যেন সে আপনার দৃষ্টিপথকে পরিষ্কার করিয়া লইতেছে, যেহেতু তাহার ভ্রম হইয়াছিল মনে হয়, কেননা সে, যশোবতীর অনাবৃত দেহে, স্পষ্টতই শুভ্র। সুদীর্ঘ উপবীত দেখিয়াছিল, যেমন পান্না ভৈরবীর অঙ্গে সে ইতঃপূৰ্বে দেখিয়াছে–ফলে সে বড় দ্বিধায় পড়িল, একদা আপন মনে প্রশ্ন করিল, এই কি কনে বউর সাধনা…? এবং এ-প্রশ্নের কি যে উত্তর দিয়াছিল সে-ই জানে। তবে একথা সত্য যে তাহার মন পূৰ্ব্ব হইতেই পৃথক হয়, কেননা সে বলিয়া চলিয়াছে, “এখন তুমি শব, শব ছাড়া কিছু নও।” এ হেন নেতি-বিচারসম্মত উক্তিতে সে আপনাকেই সম্মোহিত করিবার অবশ্যই চেষ্টা করিতেছিল, যেরূপে কালিনী কন্যার সম্মুখে ভক্ত শূন্যতার মন্ত্র উচ্চারণ করে, আপনার দেহস্থিত অস্থিমালা ঘুরায়।

যশোবতী রাবণ কর্তৃক ধৃত সীতার মতই আর্তনাদ করিয়া উঠিলেন, এবং যুগপৎ এই নীচকুলোদ্ভবকে আঁচড়াইতে চেষ্টা এবং দংশন করিবার জন্য মরীয়া হইয়া উঠিলেন, প্রচণ্ড দুর্ধর্ষ বৈজুনাথ ক্রমাগতই তাঁহাকে নিবৃত্ত করিতেছিল এবং এ সময় তিনি কৰ্ত্তা কৰ্ত্তা’ বলিয়া এত উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়াছিলেন যে, নিশাচর পক্ষিকুল ইহাতে বিমোহিত হয়।

“কনে বউ, কনে বউ শব হয়ে থাক।…মিছাই রাত কাটাও হে…মিছাই…মা আমার কোম্পানী, তিনি বলেছে গো, তুমার মরণ নাই; মেয়েদের মরণ নাই…”

“কৰ্ত্তা কৰ্ত্তা…”

“অখণ্ড তোমার কৰ্ত্তা, তুমি মরবে কেনে গো…আমি আছি, বাঁচাব…এমন ঠাঁই ছেড়ে আসব তোমাকে, ফরসা হবে, তেনা (কাপড়) নাই আসতে লারবে, তুমি ইহকাল পাবে…” সে ইহার পর অনেক কিছু বলিতে চাহিল, কিন্তু পৃথিবী তাহার কাছে অতীব ডাগর, ডবকা, দশাসই, মনোরম; ছোট করিয়া কিছু বলিতেও পারিল না…।

“চাঁড়াল, চণ্ডাল…তোমার ভাল …”

“আমার আবার ভাল, কি বল্লিস গো কনে বউ…চুপ চুপ, আমার ঘরণী হাসবে বটে!”

“চণ্ডাল আমি যদি বামুনের মেয়ে…”

“আমার যেন সতীদাহ হয়, ভাবের ঘরে চুরি ভাল লয় গো…”

“চণ্ডাল আমি অভিশাপে…”

এই কথায় সে, বৈজুনাথ, উল্লসিত হইয়া চৌকিদারের মত ‘হোই’ দিয়া কহিল, “গল্প জান গো, অভিশাপ লাগবে না, দেহচিতায় মন যার পুড়ে” বলিয়াই হাসিল; একারণে যে এ বাক্য দ্ব্যর্থবোধক।

দুঃখিনী যশোবতী কহিলেন, “আমি জানি, শয়তান বজ্জাত।”

বৈজুনাথ থামিতে থামিতে, থামিল।

“নরকের কীট হয়ে জন্মাবি…খল।”

এবম্প্রকার উক্তি বৈজুনাথ এমনভাবে শুনিতে চেষ্টা করিল যেমন বা, মনে হয়, এ কথা অন্যত্র হইতে আসিতেছে।

“তোর (!) মতলব…আমি…” যশোবতীর কণ্ঠ লজ্জায় ক্ষোভে রুদ্ধ হইল।

বৈজুনাথ ইহাতে অধাৰ্মিক, নিন্দনীয় ইঙ্গিত বুঝিল। তাহার ডাগর চক্ষুৰ্ধয় রাগে বন্ধ হইল; যশোবতীর উক্তি যেন বা তাহার চোখে পড়িয়াছে, সে কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করিয়া মুখ দ্রুত সঞ্চালিত করত, আপনাকে সুস্থির করিবার প্রয়াস পাইল। আর যে, চকিতেই সে অস্ত্রাঘাতপ্রাপ্ত শাপদের ন্যায়, আকাশকে যুঁড়িয়া, ফুসিয়া গর্জিয়া, উঠিয়াছিল। সেই হেতু যশোবতীর ক্রন্দন, ক্ষণেকের জন্য থামিয়া যায়, এবং সে, বৈজুনাথ, আপনার দাঁতে দাঁতে ঘর্ষণ করত কহিল, “কি বল্লিস গো কনে বউ, তুমার মনে এই ছিল হে, শ্মশান আমার ঘরণী আমি তার শ্বশুর ঘর, ছি গো ছি, তুমি নারী কি পুরুষ তা আমি জানি না, ভেবেছিলুম তুমি পান্না ভৈরবীর মত সাদা!” বলিয়াই সে অত্যধিক ঘৃণ্য সামগ্রীর মতই যশোবতাঁকে যেমত বা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল।

যশোবতী নিশ্চয়ই আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, কিছুকাল এলো এঁটেল বেলাতটে অদ্ভুতভাবে পড়িয়া রহিলেন, কেবল ক্রন্দনের হেতু তাঁহার সোহাগের শরীর উঠে নামে। এখন অপমান এবং ক্ষুব্ধধৰ্ম্ম তাঁহার মনোযন্ত্রণার কারণ হইয়াছিল। অগণন সিক্ত কেশরাশি ঝটিতি মস্তক আন্দোলনে সরাইয়া একটি হাতের কনুইয়ের উপর সমস্ত উত্তমাঙ্গের ভার ন্যস্ত করিয়া, অন্যহাতের তর্জ্জনী দ্বারা তাঁহাকে ইঙ্গিত করত শোকাভিভূত স্বরে কহিলেন, “বদমাইস শয়তান, আমার স্বামী অথৰ্ব্ব…তাই তোর এত আস্পর্ধা”– এইটুকুতেই বুঝা গেল যে তাঁহার স্বরভঙ্গ হইয়াছে।

বৈজুনাথ অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়াছিল, সে শুধু কহিল, “ছি গো গো, ছি” এবং ইহার পর বারম্বার শুনিল ‘আমার স্বামী অথৰ্ব্ব’–ইত্যাকার কথা তাহাকে বড়ই ছোট করিয়াছিল, এবং সে যথাযথ উত্তর মুখে আসিলেও বলিতে পারে নাই; পরক্ষণেই সে দ্রুত পদবিক্ষেপে ভাওলিয়া নৌকার কাছে আসিয়া, খানিক দূরে শায়িত বৃদ্ধকে দেখিল। এখন সে একটি ডাল কুড়াইয়া যশোবতীর পট্টবস্ত্র যাহা কিঞ্চিৎমাত্র শুষ্ক হইয়াছে, তাহা কোন উপায়ে ডাল দ্বারা তুলিয়া, কিছুদূর পর্যন্ত আসিয়া তদনন্তর নৌকাভিমুখে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া, বেলাতটে এখনও ক্রন্দনরত যশোবতীর দিকে পিছু হাঁটিতে লাগিল। বেশ নিকটে পৌঁছাইয়া কোনরূপে পট্টবস্ত্র প্রদান করত কহিল, “কাপড় কনে বউ যেন শ্মশান আমার ঘরণী, আমি কিছু নই, কেউ নই, নই’-এর আমি কিছু…”

বস্ত্রখণ্ড, যশোবতীর অনতিদূরে, বজ্রাহত পক্ষীর মত পড়িল; বিদ্যুৎবেগে কাপড়খানি ধরিতে গিয়াই তিনি প্রায় উন্মাদের ন্যায় হইয়াছিলেন, দেহ পুড়িতেছে, বস্ত্রদর্শনে লজ্জা বেশী করিয়া তাঁহাকে গ্রাস করিল। অপমান তাঁহাকে নিগৃহীত, নিপীড়িত করে; মনে হইল বস্ত্র তাঁহার এ-লজ্জাকে কোন ক্ষেত্রেই ঢাকিতে সমর্থ হইবে না, এবং নিঃস্ব মুষ্টি আস্ফালন করিয়া, ‘আমি’ বলিয়াই তিনি মুহ্যমান, বিমূঢ়; সৰ্বসময় তাঁহার মনে হইতেছিল যেমত বা কোন অমূল্য সম্পদ হারাইয়াছেন, ফলে ‘আমি যদি সতী’ একথা তাঁহার বাধিল, অশ্রুপ্লুত নয়নে স্পন্দিত ওষ্ঠে তিনি কহিলেন, “তুই কৃমি কীট হয়ে থাকবি…” এ-ভয়ঙ্কর অভিশাপ তাঁহার বক্ষ উদ্বেলিত, স্বরকে আপ্লুত করিয়া উচ্চারিত হয়।

“মনুষ্য জনমে গড় করি, আমি আর চাইনা কনে বউ…কৃমিকীট কুকুর হওয়া ভাল গো, তাদের জাগা-ঘরে চুরি নেই, যাতনাও দেয় না। হে মা আমার কোম্পানী, সামনে আছেন, তোমার শাপ যেন ফলে।” এইসকল মনোভাব ব্যক্ত করিবার কালে, বৈজুনাথের হস্ত অঞ্জলিবদ্ধ ছিল, যে অঞ্জলির মধ্যে দক্ষতা ছিল না, এ কারণে যে তাহা করফেঁড়ে পরিণত হয় নাই, তথাপি তাহা দ্বিধা দোমনা নয়। এখন সে আবার কহিল, “লাও তোমার হইয়ে আঙুল মটকালুম গো, তিন সত্য করে কলির পাপ সত্যযুগ ঘুরে এল। …বড় বেগোড় বুঝলে হে…”

“দেখতুম শয়তান, উনি যদি জোয়ান হতেন…”

বৈজুনাথ এই বাক্যে খুব মজা পাইল, জিহ্বা দংশন করত কহিল, “ইঃ…হায় হায় গো! কি পাপ! তখন আমি তোমার সামনে দাঁড়াবার ভরসা রাখতুম। কি বলিস গো কনে বউ, তখনও কুকুর বেড়ালের সঙ্গে গা চাটাচাটি করে মণ্ডা খেতুম হে, আমি জাত চাঁড়াল।…ঘাট মানছি…” বলিয়া দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিল; পৃথিবী শুদ্ধ হইল।

.

যশোবতী রোদনে যেন কূল পাইতেছিলেন না, ফলে বৈজুনাথ তাহার কণ্ঠ কিঞ্চিৎ উচ্চগ্রামে তুলিয়া বলিল, “শ্মশান আমার ইহকাল, আমার মনে পুণ্য নাই পাপও নাই, যদি থাকত!… তুমিই কাল হতে কনে বউ…লাও, আমি দাঁড়াব না তোমারও সময় হয়ে এল, কাল পূর্ণিমা…আমি যাব। লাস যদি আসে…তারাই দেখবে; তুমি পুড়বে আমি দেখতে…হ্যাঁ জেনো হে আমার মনে শুকের (শুকদেব) বাস” বলিয়া সে চলিয়া গেল। চন্দ্রালোক বর্ধিত হইল।

যশোবতীর আপনকার ব্যথা ইন্দ্রিয়সমূহকে এরূপ জর্জরিত করিয়াছিল যে বৈজুনাথের কোন কথাই তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করে নাই। তিনি নিজেকে একা পাইয়া, অবুঝের মতই কাঁদিয়া উঠিলেন, বারম্বার মিলন অভিলাষিণী নববধূ বলিলেন, “আমার কেউ নেই গো, আমার কেউ নেই।”

ভেড়ীর উপর হইতে বৈজুনাথ দেখিল।

দূরে, স্রোতক্ষুব্ধ বেলাতটে, একাকিনী যশোবতী, তিনি দণ্ডায়মানা, হস্তোপরি মুখমণ্ডল ঢাকিয়া ক্রন্দনরত, একপার্শ্বে কেশদাম হাওয়ায় সর্পিল, নিম্নে জলোচ্ছাস। এখন তিনি উর্দ্ধে মুখ তুলিয়া হস্তদ্বয় আশায় উত্তোলন করত ডাকিলেন, “ভগবান ভগবান” বলিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। একদা, কাহাদের যেন বা সম্মুখের আকাশে দেখিলেন, দেখিলেন… আরব্য রজনী সমূহ এখানেই স্বপ্ন কুড়ায় আর কাহারা তাহাদের অনুনয় করে, “আমাদের বিনিদ্র রজনীর বারমাস্যা নিয়ে যাও, নিয়ে যাও…” তিনি আরও দেখিলেন, গোলাপের কেশরাশ্রিত পরাগ, যাহা ভ্রমরের অঙ্গীভূত হয়, আঃ ভ্রমর! তুমি বুদ্বুদের বাহন, দুঃখের বাহক। সে পরাগ শূন্যতার মোহিনী মায়াতে বিমোহিত হইয়া অচিরাৎ ভ্রমর অঙ্গচ্যুত–খসিয়া পড়িয়া ইদানীং উঠানামা করে…এরূপ নানাবিধ দর্শনে তিনি ভীতা, আৰ্ত্ত। কাক যেমত সূৰ্য্য দর্শনে ব্রাসিত হয়–কেননা, সূৰ্য অন্ধকারকে নিশ্চিহ্ন করিয়াছেন, অন্ধকার কালো, যেহেতু, সে, কাকও কালো, তাই ভয়ার্ত–তেমনি সেইরূপ ত্রস্ত শঙ্কিত হইলেন। তাঁহার ক্রন্দন উত্তরোত্তর বর্ধিত হইল, সে ক্রন্দনধ্বনি পত্র-মৰ্ম্মরের সংঘাতে বর্ণ, এবং বর্ণসমূহ স্রোতের সংঘর্ষে এবং শূন্যতার গভীরতা দ্বারা শব্দব্যঞ্জনালাভে একটি পদবিন্যাস সৃষ্টি করিল…ভগবান তোমার চাতুৰ্য মেলা-বিলাসী বালককে মোহিত করুক; আমি জানি জল বাষ্প হয়, আমি মধ্যপথে নিশ্চিহ্ন হয় না, আমি জানি বাষ্পবিন্দুকে সূৰ্যতেজ ধ্বংস করিতে সক্ষম হয় না, আমি জানি যখন তাহা মেঘতনু লাভ করে তখনই বিগলিত– এ চাতুৰ্য্য, এ বিভূতির জন্য, আমার মন নাই, মোক্ষ নাই, কেননা আমিই বিভূতি, আমিই তোমার চাতুৰ্য্য, আমি তোমার সুদীর্ঘ স্বাধীনতা, এ জীবনকে ‘খেলা’ বলি; তুমি আমার স্বাধীনতা, আমি বন্ধুহীন, দীন, তুচ্ছ। ইদানীং তোমার ক্ষণিকত্ব বহনে আমি বড় ক্লান্ত।

.

তিনি ঊর্ধ্বলোকে নির্ভীকভাবে অবলোকন করিলেন, যেখানে বিন্দুর অণিমার ক্রমাগত উঠানামা–ইহার পর স্বামীর কাপড়খানি তুলিয়া স্থলিতপদে স্বামীর শয্যাপার্শ্বে আসিয়া কিঞ্চিৎ গঙ্গাজল আপনকার মস্তকে ছিটাইলেন। মানুষের কখনই কেহ নাই একথা সত্য, নিকটে কেহ নাই একথা ভয়ঙ্কর সত্য। নিভৃত গোপন নিঃসঙ্গ নির্জনতা লইয়া কতকাল কাটাইবে, বিরহ কবে অরুণোদয় দেখিবে–যে ভগবান আমার জন্য ক্ষুদ্র হইয়াছেন…

“বউ”…

“কিগো” বলিয়াই মনে পড়িল স্বামীর দুর্গতির কথা, তিনি ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। বারম্বার বলিতে লাগিলেন, “তুমি তুমি…”

“তুমি…কোথা…”

“এই কাপড় কাচতে…”

“এ্যাঁ”…

যশোবতী কানের তূলা খুলিয়া বলিলেন, “তোমার কাপড় কাঁচতে…”

“কেন?” যশোবতী আশ্চর্য্য হইলেন, বৃদ্ধের মুখপানে চাহিয়া দেখিলেন, কহিলেন, “তোমার কাপড় নোংরা হয়েছিল যে”…

“কষ্ট কষ্ট”

“না না…” তাঁহাকে আশ্বস্ত করিতে চাহিলেন। হঠাৎ কিসের শব্দ হইল। তিনি দেহকে খানিক উঁচু করিয়া লইয়া চারিদিকে দেখিলেন, অনন্তর শুনিলেন ছাগলের স্বর। দেখিলেন, বৈজুনাথের নৌকার ছইএর মত আড়াখানি, যাহা উল্টাইয়া পড়িয়া আছে, এবং অন্যদিকে ভেড়ীপথের উপর দাঁড়াইয়া কে একজনা ছাগলটিকে টানিতেছে। সে নিশ্চয়ই সে, এবং সেইক্ষণে একথা বুঝিলেন যে বৈজুনাথ সত্যই চলিয়া গেল।

যশোবতী স্বামীর পাশ ঘেঁষিয়া বসিলেন। কিছু পূৰ্ব্বে সংগ্রাম এবং ইদানীং ক্লান্তি অবর্ণনীয় নির্লিপ্ততার মধ্যে তাঁহাকে আনিতেছিল; বৈজুনাথের বিদায় গ্রহণ তাঁহাকে জাগ্রত করে, ক্রমে শৈত্য অনুভব এবং কিছুপরে শিবা ধ্বনি এবং তদুত্তরে পেচকের পীড়াদায়ক খর স্বর তাঁহাকে একীভূত করিল। ক্রমে দিত্মণ্ডলের বিনিষ্কন্দ্র মৌনতা ত্রিতাপহারিণী বহমান গঙ্গাকে ভয়াল করিয়া তুলে। ইহাতে যশোবতী সত্যই আতঙ্কিত, অনন্য উপায়ে নির্জীব প্রাচীন স্বামীর দিকে ভরসা করিয়া তাকাইলেন, বক্ষে হস্ত স্থাপন করত ইষ্ট দেবতা গোপীবল্লভকে স্মরণ করিতে বসিলেন। বারম্বার চক্ষু খুলিয়া গেল, অর্ধসিক্ত বসনের হিম তাঁহাকে শিহরিত করিল, ওষ্ঠ দংশন করিয়া কি যেন ভাবিলেন, রাত্র গণনা। করিলেন; জাঁতিটি লৌহ, ফলে স্বামীর শিয়রের তলে পুঁজিয়া নিজের হস্তমধ্যে অস্ত্রস্বরূপ কাজললতাটি লইলেন। চণ্ডাল নাই একথা ভাবিতেই–একাকী এই শ্মশানে, দংশনোম্মুখ বৃশ্চিকের মতই যাহার বর্তমানতা–স্বামীকে লইয়া সমস্যা বিড়ম্বনায় সঙ্গীন অবস্থায় পড়িলেন; আর একবার চণ্ডালের আড়ার দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন।

“বউ…”

স্বামীর ডাকে তাঁহার দেহ যেমত বা মোচড় দিয়া উঠিল, এ ডাকটিকে হস্তদ্বারা ধরিতে চাহিলেন; কেননা, মনে হয়, এহেন দুর্বিপাকে তাহা ব্রহ্মাস্ত্রের মতই কাজ দিবে, এবং এ ডাক শ্রবণমাত্রই তিনি উত্তর করেন, “এই যে গো, কেনে?” কিন্তু সীতারাম কোনই সাড়া দিলেন না, নিশ্চয়ই তিনি ঘুমের মধ্য হইতে আপন পত্নীকে সম্বোধন করিয়াছিলেন। বৃদ্ধ ঘুমে অচৈতন্য, কারণ পরিশ্রান্ত, তাঁহার নিঃশ্বাসে বক্ষের ঘড় ঘড় ধ্বনি এই চক্ষুহীন নির্মম স্থানটিকে পুনঃপুনঃ রক্তাক্ত, পাংশু, ফ্যাকাশে, শব, অস্বাভাবিক, রুক্ষ, প্রেতাত্মক করিতেছিল।

যশোবতী, এ শ্মশান–যাহার পৈশাচিক রূপটি, প্রত্যেক জিহ্বাকে নাবালক, প্রত্যেক দৃষ্টিপথে জ্যোতির্মণ্ডলের বীজ ছড়াইয়া দেয় এবং এখানকার কিঞ্চিত্র শব্দে অন্য স্তব্ধতা থরহরি–এই সেই রমণী একদা যাঁহার মারাত্মক প্রলয়ঙ্করী শব্দে ত্রিভুবন মথিত হয়–তিনি আৰ্ত্ত, তিনি আর সহ্য করিতে অক্ষম। পলাতক জন্তুর পদধ্বনি শ্রবণে কতবার চমকাইলেন, তিনি যেন প্রাণপণ মাটি আঁকড়াইয়া থাকিতে প্রস্তুত, আর সম্ভব হইল না, হিতাহিত বিবেচনা অদৃশ্য হইল, তিনি আপন স্বামীকে ছাড়িয়া দৌড়াইয়া ভেড়ীপথে উঠিলেন।

মাঠে আবছায়া কুয়াশা, যে কোন বস্তুতেই নীচকুলোদ্ভব চণ্ডাল বিদ্যমান হইল, যশোবতী ছোট করিয়া হাঁক ছাড়িলেন, স্বর বক্র হইল। কণ্ঠ পরিষ্কার করিয়া চৌকিদারী কণ্ঠে হাঁকিলেন।

এ এক অদ্ভুত স্থান হইতে তিনি আর এককে ডাকিতেছেন, যে মানুষ তাঁহার আসন্ন ভীতি হইতে রক্ষা করিবে। এ স্থান লতা গুল্ম তৃণ বৃক্ষে আচ্ছন্ন, আর তিনি একটি বেশী প্রকাশ। এ ভাবনায় তাঁহার দেহ দুলিয়া উঠিল, তথাপি আত্মসম্বরণ করিলেন।

অনেকবার এইরূপ করা হইল, কিন্তু প্রতিটি হাঁকই করুণ প্রতিধ্বনি হইয়া ফিরিয়া আসিল। মহা আক্ষেপে যশোবতী বৃক্ষ আঁচড়াইলেন, এবং প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ করিবার কালে তাঁহার মনে হইল শেষবারের মত ডাকিয়া চলিয়া যাইবেন। সুতরাং এইবার হাঁক দিলেন।

তদুত্তরে নিকটস্থ বৃক্ষের পার্শ্ব হইতে ছাগধ্বনি আসিল। দুঃখিনী যশোবতী মহাউদ্বেগে যত্রতত্র দৃষ্টি সঞ্চালন করিলেন। আর, আবার, ছাগলের খেদধ্বনি শোনা গেল। যশোবতী বালিকাই বটে…তাঁহার মধ্যে ছাগটিকে আলিঙ্গনের বাসনা দেখা দেয়। আর যে, পরক্ষণেই মনে হইল, ছাগ আছে বলিয়াই যে চণ্ডাল আছে এমন নহে; এ বড় ন্যায়ের কথা। পলকেই সবিস্ময়ে শুনিলেন ছলাৎ করিয়া একটি শব্দ; ব্যগ্র নয়নে দেখিলেন, একটি বাঁকলগ্ন কলস হইতে জলীয় কিছু পড়িল; যদিচ আধো আলো আধো অন্ধকার, ইহার পর প্রকৃতির রজগুণরাশির তথা পাতা লতাগুল্মের ছায়া যাহার সৰ্ব্বশরীরে-সশরীরে বাঁক কাঁধে বৈজুনাথকে দেখা গেল।

যশোবতী প্রথমে সচকিত, কেননা ভয়, দ্বিতীয়ত লজ্জিতা যেহেতু আত্মাভিমান, বৃক্ষের পিছনে মুখ লুকাইলেন।

“কনে বউ”–বৈজুনাথ কোনক্রমে উচ্চারণ করিল।

অন্ধকার তাঁহার মুখমণ্ডলকে বৈচিত্র্য দান করত চলিয়া গেল, কেননা মলয় পবন ক্ষণিকের জন্য পত্র-রাশিকে শতচ্ছিন্ন করে, এ হেন সময়ে সহসা আলো আসিল; যশোবতী আপনার মধ্যে পদ্মগন্ধ। উপলব্ধি করিলেন, অল্পক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বৃক্ষ গাত্রে নখরাঘাত করিতে করিতে বলিলেন, “আড়া ভেঙে দিলে যে…” ইহা ব্যতীত তিনি কি আর প্রশ্ন করিতে পারেন!

“আড়া ছাড়া কি আর ভাঙব হে, উঁচু যারা তারা উনুন ভেঙে চলে যায়, আমার উনুন চিতা…তাই আড়া…তুমি আমায় ডাকতে কেনে এসেছ হে তা জানি বটে, বলব…”

যশোবতী তাহার দিকে চাহিলেন, দেখিলেন পত্রগুল্মের ছায়াচিত্রিত একটি মানুষ।

“শ্মশানে একা বড় ডর, না হে? শব না হলে শ্মশানে থাকে কে গো, শিব নিজে এখানে শব হয়ে থাকে, আমরা কোন ছার–এ বড় কঠিন ঠাঁই, দিন রাতে দেখা নাই। ভয় কেনে গো, তিনকুড়ি তন্ত্র আরজন্মে করেছ, এখনও মায়া…তাহলে? আমি কলসীর ভার কমাবার জন্য একটু সেবা করেছিলুম হে তাই…দেখা, কনে বউ। চণ্ডাল হয়ে জন্মেছি বলে আমি দোষ দিইনি রাগ করিনি, আমি ধম্ম খোয়াইনি, লাথি ঝাঁটা খেয়ে আছি…কিন্তু তুমি…” বলিতে বলিতে তাহার কণ্ঠে যেন বা পোকা ঢুকিল। সে কিছুকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বাঁক নামাইয়া সত্বর মদ্যপান করত দাঁড়াইয়া উঠিয়া কহিল, “এক গল্প বলি হে, তোমার রঙ যেমন দুধে আলতায়, আমার রক্তে তেমন দুধে আলতায়…কেনে? যে কোম্পানী। উপরে, সে আমাদের রক্তে দুধ দিইছে, যেমন তোমাদের বুকে দুধ দেয় গো, আমাদের রক্তে দুধ দেয় হে। চিতার আগুন আমার কিছুই চ্যামটে খয়রা করেনি হে, বড় কষ্ট হয় তাই…যা কিছু জেনো বটে হে শ্মশানেই আমার আঠা…তোমার শাপ মনে লয়, আমার মনে ড্যাঙ্গাডহর আছে, বীজ বৈখরী…চায়…পাপ আছে…”

“চণ্ডাল, আমি…”

“আমি! আমি! তুমি কার আমি। তুমি ত এক প্রহরের শ্বাস টানা শব; কাল এতক্ষণ চাঁদ যখন লাল, তখন লয়…তাই আমি বলেছিলুম বটে হে…রক্ত আমার দুধে আলতায় গো।”

“এখন না মরে আমার উপায় কি বলতে পার…আমায় ফেন দেবার লোক কই…”

“তোমার কেউ নেই…তোমাদের জাতে কুটুম…”

“আমাদের, কেউ থাকে না…”

“বড় ডাগর জটাধারী কথা গো, গঙ্গার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পার…”

“তুমি ভুল বুঝলে হে, আমার স্বামী ত আছেন, যাক ও কথা, তুমি আজ রাত্রে যেও না” বলিয়া চলিয়া গেলেন, কেননা এ সময় পুনরায় আপনার দেহে তীব্র পদ্মগন্ধ আলোড়িত হয়।

.

ক্রমাগত পাখী ডাকিতেছে, হাওয়া ছিন্নভিন্ন; সীতারাম যেন প্রাণ লাভ করিয়া সটানা কণ্ঠে ভোরাই গাহিতেছিলেন, “রাই জাগো রাই জাগো।” যশোবতী, শ্রান্ত, ঝড় বিলুণ্ঠিত বৃক্ষ বা, ঘুমে অচৈতন্য। ক্রমাগত গীত আসিতেছিল, ক্রমে তিনি নয়নযুগল উন্মীলন করিলেন; যে পৃথিবী প্রাণময়, যে পৃথিবী প্রতিবিম্বময়, তাহা রঙীন হইল; স্বামীর গান তাঁহাকে মোহিত করিয়াছিল। ভাবের ভাবি করিতেছিল। ভালো লাগিতেছিল।

“বউ ভোর গো”…

যশোবতী কোনমতে স্বামীর কানের তুলা খুলিয়া, “এখানে শ্বশুর শাশুড়ী ত কেউ নেই, ঘুমোই না” শিশুর মত কহিলেন।

“ঘুমাও ঘুমাও”…

“না গো, আমি” বলিয়া উঠিয়া বসিলেন, আলস্য বিদূরিত করিবার পর স্বামীর প্রতি চাহিলেন।

“বল তুমি আছ বলে বড় বাঁচবার সাধ হচ্ছে…”

“কি করে এত স্পষ্ট বলছ গো, ওমা…”

বৃদ্ধ হাসিলেন। “তোমার জন্য বাঁচবার…”

“ঠাকুর ঠাকুর…তোমাকে বাঁচতেই হবে।”

“তোমার উপর বড় মায়া পড়ে গেছে, মায়া হয়…বুক চিরে দেখাব…”

যশোবতী অবাক হইলেন, নিঃশব্দে কহিলেন, “ঠাকুর ঠাকুর…”

.

“আমার বড় খিদে পাচ্ছে…” বৃদ্ধ কিছু পরে কহিলেন।

“চিঁড়ে খাবে? পারবে?”

“হ্যাঁ!…আচ্ছা আমায় তোমার মনে ধরেছে…”

“ছিঃ ছিঃ…কি যে…”

“আমার বড় আয়না দেখতে সাধ হয়।”

“ফর্সা হোক…”

অনেকক্ষণ পর ইতস্ততঃ করিয়া সহসা কি যেন বা তাঁহার, বৃদ্ধের, স্মরণ হয়; ফলে তিনি অবিচারিত চিত্তে বলিলেন, “আচ্ছা বউ, আমাদের ফুলশয্যা…” এবম্প্রকারের কথা বলিবার পরক্ষণেই তাঁহার সম্ভবত লজ্জা হইল।

যশোবতী নীরব থাকিয়া কহিলেন, “কেন হবে না…”

সম্ভবতঃ পূৰ্বের উক্তি চাপা দিবার জন্য বৃদ্ধ কহিলেন, “বউ…আমি যদি মরি তোমার মন কেমন করবে?”

অকপটে যশোবতী কহিলেন, “খুব”–এ বাক্যে আন্তরিকতা ছিল, গঙ্গার বাস্তবতা ছিল।

“হুঁ…মিছাই”

“মিথ্যা আমার মরণেও নেই, কৰ্ত্তা।”

“সত্যি “…

“সত্যি “…

যখন রীতিমত আলো হইল তখন সীতারাম সলজ্জভাবে স্ত্রীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “বউ আমি উঠব, বসব।”

“কষ্ট হবে না…”

“না, বসে একটু ডাকব…”

সীতারামের ঠিক পিছনে, যাহাতে তিনি হেলান দিতে সমর্থ হন, তাহার উপযোগী করিয়া একটি কলস উল্টাইয়া বসাইয়া দিয়া বৃদ্ধকে কোন ক্রমে উঠিয়া বসিতে সাহায্য করিলেন। এ সময়, সীতারাম বক্ষে কর স্থাপন করত আকল্পনবীনা এই পৃথিবী দর্শন করিয়া ইষ্টমন্ত্র জপ করিয়া, “রাধা শ্যাম” স্মরণ করিলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই চক্ষু খুলিয়া গেল, চতুর্দিকে চাহিয়া ভারী খুসী হইলেন, “বউ বড় ভালো লাগছে গো–”

ইহাতে যশোবতীর বড় আনন্দ হয়, এবং বৃদ্ধের ক্রমাগত গাল-চোষার মুদ্রাদোষ আর তাঁহার চোখে পড়িল না।

“বহুদিন পরে যেন দেখছি…” বলিয়া তিনি একটি গভীর নিঃশ্বাস লইয়া পরে ত্যাগ করিবার কালে অল্প কিঞ্চিৎ কাশিলেন এবং তৎসহ একটি “আঃ” শব্দে স্বস্তির ধ্বনি শোনা গিয়াছিল। গঙ্গাকে প্রণাম করিতে করিতে কহিলেন, “মা মা মাগো”–পুনৰ্ব্বার খুসী মনে, টপ্লাগায়কের মত, চারিদিকে চাহিলেন। বলিলেন, “মনে হয় সব যেন আমার…”

অনন্তর মাটিতে হাত চাপড়াইতে চাপড়াইতে কহিলেন, “আঃ কি সুন্দর…” সহসা হাতটি লইয়া লেহন করিলেন।

যশোবতী সত্বর তাঁহার হস্তটি ধরিয়া ব্যাকুলভাবে আপনকার অঞ্চল প্রান্ত দ্বারা পরিষ্কার করিতে করিতে বলিলেন, “ছিঃ গো ছেলেমানুষী করছ গো, শ্মশানের মাটি…কেউ মুখে দেয়…বৈরাগ্য হবে যে গো, আমার থেকে মন উঠে যাবে, এ দেহ দেখে নেতিবিচার করবে” বলিয়া স্বেচ্ছায় আপন লজ্জা ত্যাগ করত চটুল হাসি হাসিয়া বৃদ্ধের-দেখা পৃথিবীটিকে নিরীক্ষণ করিলেন।

“তা বটে তা বটে…আচ্ছা বউ আমার বুক দশ মরদের মত না, আ… আয়না…”

“আয়না কোথায় পাব…আমি তো জলে…”

“আমাকে দাও…”

যশোবতী একটি মালসায় জল লইয়া আসিলেন। অধৈৰ্য্য বৃদ্ধ জলপূর্ণ মালসাটি লইবার জন্য মন্ত্রবলে অত্যুগ্র আগ্রহ হস্ত প্রসারিত করিলেন, যশোবতী তাঁহার হস্তে দিলেও মালসা ছাড়েন নাই, তিনি নতজানু হইয়া স্বামীর সম্মুখেই বসিয়া ছিলেন। বৃদ্ধ যশোবতাঁকে অজস্রবার মৃদু ভর্ৎসনা করিলেন, “আঃ ঠিক করে ধর না–কি কচ্ছ পাগল–কখনও স্থিরভাবে নিজের, একদৃষ্টে প্রতিবিম্বের দিকে, জীবনের দিকে চাহিয়া রহিলেন–তাঁহার শীর্ণ স্কন্ধ স্পন্দিত হইল–ধীরে মুখোনি তুলিয়া পত্নীর দিকে তাকাইয়া কহিলেন, “আমায় সুন্দর–”

যশোবতী আপনকার সুন্দর মুখোনি আন্দোলিত করিলেন, বৃদ্ধের, স্বামীর, উক্তি সমর্থিত হইল।

বৃদ্ধ সীতারাম স্বীয় প্রতিবিম্বের পশ্চাতে অম্বর, কখনও মেঘমালা এবং উড়ন্ত পক্ষী দেখিলেন– দুস্তর গাম্ভীৰ্য আসিল, এবং প্রশ্ন করিলেন। বৃদ্ধ আপনার চক্ষু দেখিলেন, মমত্ববোধ আসিল এবং সেই প্রশ্ন করিলেন, বৃদ্ধ আপনার দন্ত দেখিতে মাড়ি দেখিলেন, ঝটিতি জিহ্বা দেখিলেন ভয় আসিল, সত্বর প্রশ্ন করিতে গিয়া দেখিলেন, ভয়ঙ্কর কাশির ধমকের মধ্যে মালসা দু’জনের হস্তচ্যুত হইয়া ভাঙ্গিয়া খান খান হওয়ার মধ্যে, এ বিপর্যয়ের মধ্যেও একটি প্রশ্ন শোনা গেল। যশোবতী বারম্বারই বলিয়াছিলেন, “তুমি সুন্দর তুমি সুন্দর তুমি সুন্দর।”

যশোবতী তাঁহার স্বামীকে ধরিয়া যত্নে কলসে ঠেস দিয়া ধরিয়া রহিলেন। অসুস্থতা প্রশমিত হইল। গঙ্গোদক দিয়া স্বামীর চোখ মুছাইয়া দিলেন।

“আমায় সত্যিই সুন্দর দেখতে, না…”

“হ্যাঁ…”

“তুমি…ঠাট্টা? আমায় রাজপুতুল বলত…”

যশোবতী করুণ স্বরে উত্তর দিলেন, “কেন এ কথা বলছ গো”

বৃদ্ধ রূঢ়ভাবে তাঁহার দিকে কটাক্ষপাত করিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন। যশোবতী বুঝিলেন স্বামী মনঃক্ষুণ্ণ হইয়াছেন; কি ভাবে যে বুঝাইবেন তাহা ভাবিয়া পাইলেন না, অবশেষে তাঁহার বক্ষ স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “মিথ্যা বললে পাপ হয়, আমার মরণে মিথ্যা নাই গো…সত্যিই তুমি সুন্দর”

বৃদ্ধ আনন্দে বিহ্বল হইয়া কি যে বলিবেন স্থির করিতে পারিলেন না, “জরা যেন কে নিয়েছিল?”

“তোমার তো জরা নেই, যদি থাকে জরা সে তো আমি, আবার জন্মাবে আবার আসব…” বৃদ্ধ পত্নীর আশা শুনিয়া কহিলেন, “আমাকে তোমার মনে ধরেছে…” “মনই তো সব।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *