৪. সীতারাম চক্ষু বুজিয়াছিলেন

সীতারাম চক্ষু বুজিয়াছিলেন। তাঁহাকে বিরক্ত করা বাঞ্ছনীয় নহে। যশোবতী সম্মুখের কলাপাতা হইতে একমুঠা ধান্য লইয়া পিতৃঋণ শোধ করিবার কালে অসম্বরণ করিতে পারিলেন না। বন্ধনের সকল কিছু সামগ্রীর উপর তিনি ভাঙ্গিয়া পড়িলেন। লক্ষ্মীনারায়ণের বুক ফাটিয়া গেল, তিনি চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে স্থান ত্যাগ করিলেন; অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা তাঁহার জন্য ভেড়ীর উপরে অপেক্ষা করিতেছিলেন, এবং পরে তাঁহাদের আর দেখা গেল না।

একমাত্র, যশোবতী এই দিবালোকে, মানুষের সহজাত বেদনা লইয়া রোরুদ্যমানা, এ সময় একখানি ভয়ঙ্কর হাত তাঁহার চোখের সম্মুখে গাছ কৌটা এবং বিক্ষিপ্ত ধান্যের মধ্যে ভেকের মত স্তব্ধ। নড়িল। পাখীরা উড়িয়া গেল। হাতখানি যশোবতাঁকে আশ্বাস দিয়া উঠানামা করে, ধীরে আপন সম্বিতের সুক্ষ্মতার কলমকাটা পথ বহিয়া তাঁহার, যশোবতীর মুখমণ্ডলে উঠিল। এখনও তাঁহার মুখে চোখে ধান লাগিয়া আছে, তথাপি বৃদ্ধের দিকে তাকাইলেন, কাল আহত, বৃদ্ধ কুঞ্চিত, অভিজ্ঞ ওষ্ঠদ্বয় কম্পিত, তাহা হইতে, “আমি আছি…আছি.” একথা আসিল।

যশোবতী এই উক্তি আপনার ধর্মের ঘোরে বিশ্বাস করিয়াছিলেন; নির্ভরতা যাহাতে অনায়াসে তাহার মধ্যে প্রবেশ করিতে পারে, সেই হেতু আপনার চক্ষুদ্বয় স্ফীত করিলেন।

সীতারাম বলিলেন, “বউ বউ…জোর পাচ্ছি…”

যশোবতী উদগ্রীব আগ্রহভরে তাঁহার দিকে চাহিলেন; দেখিলেন, সীতারাম তাঁহার বাম হস্তের তর্জ্জনী কোনমতে নাসা গহ্বরের নিকটে লইয়া যাইতেছেন, পুনৰ্ব্বার কিঞ্চিৎ সরাইয়া আনিতেছেন, এদৃশ্য তাঁহার মত সুকুমারমতি যুবতীর মনে ক্লৈব্যের সঞ্চার করে, তথাপি তিনি নিশ্চলা। এহেন আশ্বাস লইয়া সুখনিদ্রার জন্য চক্ষুদ্বয় নিমীলিত।

.

তখন বৈকাল হইবে। সীতারাম বেশ তৎপরতা ফিরিয়া পাইয়াছেন, শিশু যেমন উর্দ্ধে হস্ত উত্তোলন করে তেমনি আপনার হস্তদ্বয় উঠাইবার চেষ্টা করিতেছিলেন। সহসা আপনার জানুর নিকটে শায়িত যশোবতাঁকে দেখিবার চেষ্টা করিয়া কহিলেন, “বউ, সকাল কখন হবে!” আশ্চৰ্য্য যে এই শব্দগুলি স্পষ্টই বাহির হইয়া আসিল। বৃদ্ধের আপনার কানে তুলা থাকা সত্ত্বেও নিজেই পরিষ্কার শুনিতে পাইলেন। এ কথাও তিনি বুঝিয়াছিলেন নিশ্চিত যে তাঁহার প্রশ্নের কোন অর্থ হয় না।

যশোবতী নিশ্চিত জাগ্রত ছিলেন, তিনি ধীরে চক্ষু উন্মীলন করিলেন। ইত্যাকার কথায়, কিছু মনে হইবার পূর্বেই দেখিলেন একটি অদ্ভুত লম্বা শলাকার মত চাবিকাঠি সমেত হাত তাঁহার দৃষ্টি সমক্ষে নড়িতেছে।

যশোবতীর হঠাৎ মনে হইল এ চাবি স্বর্গের নাকি’, এই সঙ্গে সীতারামের গলার স্বর, “মোহর মোহর”–সত্যই চাবিকাঠি নববধূকে পরিহাস করিয়াছিল, নিঃশ্বাস কাঙাল জীবনের কাছে ইহা ভ্রুকুটি মাত্র; জমি হইতে উচ্ছেদ হওয়া কৃষক যেভাবে আপনার জমিতে পা দিতে ভীতি অনুভব করে, সেইরূপ তাঁহার মনোভাব; পৃথিবী তাঁহার কাছে পারঘাটা বৈ অন্য কিছু নহে! অভিমানে ক্ষোভে যশোবতী উন্মাদ, তাঁহার রগ স্ফীত, স্বীয় চূর্ণ কুন্তলের নিম্নে নীলাঞ্জনছায়াকে তাঁহার রেশমী নখগুলি ক্ষত বিক্ষত করিল, রোমকূপে জোনাকি জ্বলিল; ক্ষিপ্ত হইয়া তিনি চাবিকাঠি লইয়া দূরে নিক্ষেপ করিলেন। চাবিকাঠি গঙ্গার প্রায় নিকটে পড়িল। যশোবতী আপনার ক্রোধ সম্বরণ করিতে অপারগ হইলেন, তাঁহার কল্যাণময়ী হস্ত বৃদ্ধের ব্যাকুল হস্তকে নিপীড়ন করিল! বৃদ্ধ শিশুর মত কাঁদিয়া উঠিলেন।

চাবিকাঠি গঙ্গার কিনারে পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে বলরাম ছুটিয়া আসিয়া চাবিটি তুলিয়া লইয়া দৌড়াইতে আরম্ভ করিল। হরেরাম পিতাকে ক্রন্দনরত দেখিয়াও শুধু মাত্র প্রশ্ন করে, “মা, তুমি কি চাবিকাঠি…” আর কিছু জানিবার নাই, কারণ পলায়মান ভ্রাতাই তাহার সদুত্তর, সুতরাং সেও তাহার পশ্চাদ্ধাবনে ব্যাপৃত হয়।

.

দূরে বৈজুনাথ, এ দৃশ্য তাহার সমক্ষে ঘটিতেছিল! এবং সে নিমেষেই ভেড়ী পথে উঠিয়া দেখিতে লাগিল, ধাবমান দুই ভাই দৃষ্টির বহির্ভূত হইতেই সে সরল ভাবে হা-হা করিয়া হাসিয়া অতর্কিতে থামিয়া শ্মশানের দিকে তাকাইল, কেননা এমত সময়ে তাহার কানে ক্রন্দনধ্বনি পৌঁছায়।

বৃদ্ধের শিশুহারা রমণীসুলভ ক্রন্দন, নিকটস্থ সৃষ্টিসমূহকে, সৃষ্টির অন্তরীক্ষের সহনশীলতাকে, সহনশীলতার মধ্যে হিরন্ময় কোষকে, হিরণ্য কোষের সহজ তত্ত্বকে আগ্রহান্বিত করিল।

এবং যশোবতী–তাঁহার আত্মা যেরূপ দেহকে ভালবাসেন, দেহ যেরূপ আত্মাকে, এবং এই বিচ্ছেদশীল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের গুণে বাহিরের জগতেও সাড়া দিলেন, তিনি বিচলিত। একথাও সত্য যে, তিনি অনুতপ্তা। ত্বরিতে তিনি উঠিয়া বৃদ্ধের ব্যথিত হস্তখানি যেমন বা শিশুহস্ত, তাহার ব্যথা মহা আবেগভরে আপনার কপোল দ্বারা ধীরে ধীরে অপনোদন করিবার চেষ্টা করিলেন। একারণে তাঁহার যৌবন-বিলাসপটু শরীর করুণা রসে পরিষিক্ত হয়।

বৃদ্ধ এখনও ক্রন্দনরত; যশোবতী সস্নেহে স্বীয় আঁচলপ্রান্ত দ্বারা তাঁহার চক্ষু মুছাইলেন, নাক মুছাইলেন, সহসা তিনি বুঝিলেন, যে বৃদ্ধ হাতখানি ঘুরাইতে চাহিতেছেন, ইদানীং বিচলিত যশোবতী তাঁহাকে সাহায্য করিলেন। সীতারামের হাত এখন তাঁহার গালেই ছিল, সুতরাং নববধূ স্মিতহাস্য করত মুখ আনত করিলেন।

অদূরে কাহার চিতা জ্বলিতেছিল, তাহারই আঁধার আসে। এবং এ-সময় বিরাট রাজসিক একটি দীর্ঘশ্বাস–স্বভাবত মেঘ দর্শনে উতলা, দূর পথদর্শনে প্রগম্ভ, নবোঢ়া দেহের বিসর্পিল চক্রান্ত ভাঙ্গিয়াই ক্রমে উঠিল; বৃদ্ধের হাত বাদুড়সদৃশ এবং তাঁহার, যশোবতীর কপোল–প্রত্যুষের প্রথম আকাশে যাহার উপমা–সেই কপোল অবলম্বন করত ঝুলিতেছিল।

যশোবতী যিনি স্বয়ং মোহিনী মায়া, তিনি অকাতর, এখন আর হায়া ছিল না, তাঁহার শূন্য দৃষ্টি চিতার প্রতি নিবদ্ধ; সহসা লক্ষ্য করিলেন যে সেই চিতার উপর দিয়া অর্থাৎ এক পার্শ্ব দিয়া একটি দৃপ্ত ভাবগম্ভীর মুখমণ্ডল উঠিতেছে, ফলে তিনি চকিত হইয়াছিলেন। কোথাও বা দগ্ধ অর্ধদগ্ধ দেহবিকারের পশ্চাতে এই মুখোনি, ঐশ্বৰ্যশালিনী নীলান্ধিবসনা এই ধরিত্রীর দাম্ভিক প্রতিভা যেমত বা। এই মুখমণ্ডলের বর্ণচ্ছটায় উদাত্ত ধীর গম্ভীর বেদগান ছিল; এ বেদগানের মধ্যে যেমন আনন্দ, আনন্দের মধ্যে যেমন প্রণাম, প্রণামের মধ্যে যেমন পুষ্পের রহস্য, পুষ্পের রহস্যের মধ্যে যেমন সরল রেখা– তাহা ওতপ্রোত হইয়া উদাত্ত, এতদ্ভিন্ন যুধিষ্ঠিরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উত্তরের রূপময় বাস্তবতা। পৃথিবীতে বার্ধক্য নাই, জরা নাই, একই ভাব স্থির। তদ্দর্শনে বালিকাবধূর শরীর যেমন বা আপনার মেরুদণ্ডে দৃঢ়ভাবে গাঁথিয়া যাইতে লাগিল।

বৈজুনাথ কোন এক শবদাহে ব্যাপৃত, কেননা শবযাত্রীগণ শব ফেলিয়া পলায়ন করিয়াছে।

সে চিতাগ্নির মধ্যে বীভৎস অঙ্গগুলিকে লাঠিদ্বারা একত্রিত করিতে করিতে কহিল, “হারে, মায়াকান্নায় ড্যাঙা ভাসে, লাস ফেলে পালান। …ওলাউঠো হোক ওলাউঠো…শাল্লা কান্নায় পোঁদের তেনা সপসপ করে, মরি কি মায়ার বাহার গো” বলিয়া অতঃপর অনতিদূরে গিয়া একটি কাষ্ঠখণ্ড তুলিয়া চিতায় নিক্ষেপ করিল, আর একটি খণ্ড উঠাইতেই এক অপার্থিব বিভূতি দর্শনে আপনার দমের ‘‘ আওয়াজ করিয়াই সে জ্ঞানরহিত, সে চলৎশক্তিহীন, অত্যধিক বিস্ময়ে মন্ত্রমুগ্ধ এবং একারণে দেহ বক্র, ওষ্ঠদ্বয় বিভক্ত, সময়ও দিকবিরহিত।

পশ্চাতে পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা জবুস্থবু, উর্ধে অম্বর, সম্মুখেই স্বামী-সোহাগলালিত যশোবতী, এ কোন ঘোর বাস্তবতা! এই কি পৃথিবী! তথাপি এ হেন দৃশ্যে গোলাপ ছিল, এ হেন দৃশ্যের স্বাদ ছিল। অন্যপক্ষে, লজ্জিতা যশোবতী ধীরে স্বামীর হস্তখানি নামাইয়া লইতে প্রয়াস পাইলেন, এবং নিজের বাম হস্তদ্বারা আপনার বক্ষের সুসজ্জিত বস্ত্রকে সুরক্ষিত করিলেন। বৈজুনাথ, তদৃষ্টে, জিহ্বদ্বারা আপনার ওষ্ঠ চিন্তিতভাবে লেহন করত হস্তধৃত কাষ্ঠখণ্ডে শ্বাপদ আক্রোশে থুথু দিয়া চিতায় নিক্ষেপ করিল। সে যেমত বা পরাভূত। মনে হয় ধরিত্রী যেন তাহার বাদ সাধিয়াছে।

সেইহেতু সে, বৈজুনাথ, মতিভ্রমে উন্মাদ। কণ্টকিত, ধৰ্ম্মশূন্য রূপচরিত্রহীন, তামসিক, অবিচলিত, খর পায়ে নবদম্পতির অভিমুখে যাইতেই প্রজ্বলিত চিতা তাহার পথ রোধ করিল।

প্রজ্বলিত চিতা তাহার পথ রোধ করিল; যে চিতা, যাহা দাহ্যমান, যাহা অনির্বাণ, যাহা শেষ, যাহা। বন্ধুহীন! বৈজুনাথ আপনার জিহ্বা দ্বারা আপন গাত্র বুলাইতে চাহিল। কিন্তু হায়, অমোঘ অবস্থা, শুধু মেদ গন্ধ, নিষ্ঠুর অগ্নি ও তাহার দাহিকা শক্তি আমাদের দেওয়া নাম ও বাস্তবতা–এক হইয়া ক্রমাগত সেখানে অঙ্ক কষিতেছে। এবম্প্রকার মহামারী অজর সত্য হইতে চক্ষু তুলিল, অথবা সত্য ক্ষণেকের জন্য নিমেষেই অচিরাৎ আপন মায়া অপসরণ করে, সে অনতিদূরে দেখিল।

উহারা কে এখন যাহারা এক! কোথাও তাহার, অবোধ কোমলাঙ্গ কৌমার্য রসময়ী, কোথাও বীজবৎ শুষ্ক, কভু পাণ্ডুর, হঠাৎ শুভ্র, পরক্ষণেই আরবার রক্তিম! এই অবাস্তব–এই কঠিন, অন্ধকারহীন। দাম্পত্যজীবনমিথুন তাহাকে এককালে অলৌকিক, এবং বিস্ময়ে আরূঢ় করিল–অদ্ভুত এক অনুভবে, যদিচ তাহা রম্য উপলব্ধি, সৰ্বাঙ্গ সঙ্গীন! চণ্ডাল বৈজুনাথের বিভ্রম ঘটিল হয়ত বা, চিতার অন্যধারে ইদানীং যে দাম্পত্য মাটি স্পর্শ করিয়া আছে–তাহা যেন তাহারই সমগ্র অন্তর! এখনও সে স্তম্ভিত, আচম্বিতে সে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া কয়েক পদ অগ্রসর হয়। বেলাতটের ঐ দৃশ্য তাহাকে গুণ করিয়াছিল, সে কয়েক ছটা পিছু হটিল; তদনন্তর নিজের হস্তদ্বয় দেখিয়াই জন্তুর মত শব্দ করত ঊর্ধে লম্ফ প্রদান করিয়া ভূপতিত হইল।

এ হেন তেজোময় শরীর রৌদ্রকৰ্ম্মা আক্রোশে ঝটিতি ধরাশায়ী। ইহাতে শ্মশানভূমির ধূলিকণাসকল চমকিত, আর যে, তাহার পতনে স্থাবর জঙ্গম অতিমাত্রায় বিষাদগ্রস্ত; এই ঘটনার পিছনে কতটুকু অভিমান–যতটুকু অভিমানে পিতা কর্তৃক ধৃত স্বীয় হস্ত মুক্ত করিয়া যে কোন শিশু আপনার স্বাবলম্বন চায়। এখন বৈজুনাথের চক্ষুদ্বয় তমসাচ্ছন্ন, আঁখিপল্লব মুদিত, অনন্তর সে কোনক্রমে, সাহসে চোখ খুলিল, দেখিল। দৃষ্টি ফিরাইয়া ভয়ার্ত চোখে নৈকট্য, সান্নিধ্য, সাযুজ্য দর্শন করে–যাহার এক অংশ ব্রীড়া, অন্য অংশ জটিল বাস্তবতা! পতনের বেদনা এসময় তীব্র হইয়া দেখা দেয়, আর মাথা তুলিয়া থাকা সম্ভবপর নয়। সে ধীরে ভূমি উপরি আপনার মস্তক স্থাপনা করিল। সমগ্র বিশ্ব যেমন বা চক্রাকারে শরীরের মধ্যে ঘূর্ণায়মান, আপনার দেহগত ভাবনা তাহাকে বিশেষ আলোড়িত করিতে থাকিল। হায় সে সামান্য জীব–সে বড় দুঃখের! মন হইতে ভালবাসা ধীরে নিষ্ক্রান্ত হইয়া যে অধঃ মধ্য নভের অনৈসর্গিক মহিমা রহস্যে রূপান্তর লাভ করত পুনরায় সৌন্দৰ্য্য নামে প্রত্যাবর্তন করে, কোন সূত্রেই তাহা সে টের পায় নাই। অদ্যও : নির্বোধ, দিনের পর দিন মৃতকে লইয়া কালাতিপাত করিয়াছে। মড়া পুড়াইয়াছে।

এখন বৈজুনাথ কিয়ৎপরিমাণে সুস্থ; সে আকাশের দিকে মুখ রাখিয়া তাহার বজ্র-দেহটি মেলাইয়া দিল। অনেকক্ষণ এইভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর, সহসা বুঝিল, কাহার কণ্ঠস্বরকে সুগম সুস্পষ্ট করিবার নিমিত্ত সমগ্র শব্দ তরঙ্গ অনড়, নিথর এবং লোকচরাচরে কেহ নাই এবং শুধু ক্রমাগত একটি ‘ডাক’ ধ্বনিত হইতেছে। ঔৎসুক্যপরতন্ত্র চণ্ডাল তাহার মর্ম গ্রহণ মানসে একাগ্র। কে যেমন বা তাহাকে ডাকিতেছে, এবং আশ্চৰ্য্য তাহাকে ‘ও ঘুম, ও ঘুম’ নামে সম্বোধন করে। নিয়ত এই ‘ও ঘুম’ বাক্যটি শুনিতে শুনিতে তাহার চিত্তে দুৰ্যোগময়ী ঘোর সমুপস্থিত। তথাপি ইহা বোধ করি সত্য যে, তাহার সাড়া দিবার বাসনা জাগরূক হইল। এমত অবস্থায় সে অনুভব করে আপনকার দীর্ঘ ক্ষমতাবান শরীর যেমন বা কর্দম-স্বরূপ, অবলীলাক্রমে তাহার চক্ষুদ্বয় উন্মীলিত হইল, নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে অনেক কিছুই দেখিতে চাহিল কিন্তু পারিল না; আপনার বক্ষের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিল, দেখিল, তাহার নিঃশ্বাস বাত্যায় বক্ষস্থিত লোমরাজি শরৎকালীন ধান্যক্ষেত্রের মত ব্যস্ত; বেলাভূমির মাটিতে তাহার হাত দুইখানি আঁকড়াইয়াছিল। তাহার দৃপ্ত চোখের তারকায় সফরী চঞ্চলতা, তাহার অন্তরীক্ষ স্ফীত।

যদিও সে জাগ্রত, যদিও নরবসার গন্ধে এ স্থান পার্থিব, যদিও.বেদনা অনুভব এখনও তাহাকে নিঃশ্বাস লইতে সাহায্য করিতেছিল, তবু ইতিপূৰ্বের সৃষ্টিছাড়া ডাক তাহাকে কণ্টকিত করিয়াছিল। অনন্তর আপনার সম্পর্কে তাহার অসম্ভব সন্দেহ উপস্থিত হইল। তাহার অস্তিত্ব কেহ কি জানে! না সত্যই সে ঘুম! ঘোর বিপৎকালে মেঘঘটা যামিনীর তীক্ষ্ণ মুহুর্মুহুঃ বজ্রপাতে, অথবা ভূমিকম্পে আপনার কুশলবার্তা অর্থাৎ আমি আছি, এ বার্তা গ্রামান্তরে শঙ্খধ্বনি করত সে কখনই পৌঁছাইয়া দেয় নাই।

‘আমি কি ঘুম!’

‘আর জন্মে আমার নাম কি ঘুম ছিল?’ বৈজুনাথ, যাহার কোনদিন ভয় ছিল না অথবা যে কোনদিন ব্রাসিত নয়, সে ইদানীং যারপরনাই ভীত, শঙ্কিত, ত্রস্ত পাণ্ডুর। এ মহাশ্মশান, যেখানে সে একাকী, নির্ভীক কালযাপন করে, এখানকার রাত্র তাহার নিকট স্বাভাবিক যন্ত্র মাত্র। গঙ্গার জড়-মধ্যরাত্রের বায়ু সঞ্চালনে এ স্থানসমূহ যখন বিশ্রী তখন তাহার, বৈজুনাথের, বন্ধুগণ–ক্রীড়াসহচরগণ আইসে। বীভৎস, চৈত্যবৃক্ষ সম ভয়ঙ্কর প্রেত সকল মিলিয়া নৃত্য আরম্ভ করে, বিপুল আনন্দে দিগ্বিদিক অধৈৰ্য্য; কিছু দূরের নিদ্রা, কিছু অজানিত বিশ্রাম অন্তরালে বীজদৃপ্ত ভাবনাকে–মার্জার যেমন মূষিককে–ব্যতিব্যস্ত করে সেইরূপ বিঘ্ন সাধন করিয়া থাকে। এ খেলায় অবৈধ প্রণয়ের গর্ভপাত-হেতু ভ্রণপিণ্ড যাহা প্রেত-পরিণত সেও আপন পিণ্ডময় শরীর আন্দোলিত করত মহানন্দ প্রকাশে অস্থির; অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মৃত রমণীর প্রেত অধিক রসময়ী; ক্রমাগত ইহারা, ভয়ঙ্করদর্শন প্রেত-সকল, এবং বৈজুনাথ ঘুরিয়া ঘুরিয়া খেলা করে; খেলার শেষে তাহারা ক্রমান্বয়ে বলে, “তেষ্টা তেষ্টা।”

বৈজুনাথ বালকসুলভ চাপল্যে তাহার অঙ্গুলিদ্বারা গঙ্গাকে নির্দ্দেশ করে।

কখনই সে ভয় পায় নাই।

সে প্রশ্ন করিল, “আমি, আমি কি ভূত! না না না…নিশ্চয় প্রেত…না আমি চণ্ডাল? হয়ত আমি চিতা! এখন পুনরায় তাহার কণ্ঠে প্রসন্নতা বর্তমান। কেননা গঙ্গার স্রোত তাহার সহিত কথা কহিয়াছে।

.

এখন অপরাহু সন্ধ্যাগত।

যশোবতী কেশবিন্যাস কালে কিছু কিছু অনাবৃত হইয়া পড়িবার ভয়ে সকল দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। তবুও প্রসাধনরত এই ডালিমের বাস্তবতাকে আর একজন অলক্ষ্য হইতে দেখিতেছিল। স্বামী সীতারাম অধুনা যেন কেমন অনড়, ফলে যশোবতীর নিজের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়াছিল; পুত্রদ্বয়ের কথা তাঁহার স্মরণ হইল, অবশ্য তাহাদের যে কি হইল তাহা ভাবিবার পর্যন্ত তাঁহার উৎসাহ। ছিল না। তথাপি তিনি বেণী রচনা করিতে করিতে চকিত পদে খানিক দূর অতিক্রম করিয়া থমকাইয়া দাঁড়াইলেন, আপনার স্বাধীনতাকে অচিরাৎ সাক্ষাৎ করিয়া গম্ভীর, যতদূর এখান হইতে দেখা যায় ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, টিয়ার ঝাঁকে তাহা যেন আত্যন্তিক প্রসারী, এই স্বাধীন মনোভাব দিয়া আপন বেণী বন্ধন কাৰ্যে মনঃসংযোগ করিলেন।

পদচারণে ব্যাপৃতা, এ শ্মশানে নির্ভয়ে আপন গোপনতাকে সন্ধ্যা সমাগমের জন্য প্রস্তুত করা একমাত্র তাঁহার দ্বারাই সম্ভব; তৎকালে নিশ্চয়ই পুষ্পবৃষ্টি হইয়া থাকিবে, তৎকালে ধ্রুবসত্য যে, গোলাপ তাঁহার অনুগামিনী হইয়া থাকিবে। তিনি আবার ফিরিয়া আসিলেন।

সীতারাম প্রশ্ন করিলেন, “কি?” অর্থাৎ কোথায়?

যশোবতী এমত প্রশ্নে ঈষৎ অবাক। তাহার পর কহিলেন, “ছেলেরা” এবং স্বামীর কানের তূলা সরাইয়া কহিলেন, “আঁধার হল…ছেলেরা ত কেউ…”

“মরুক…আমি আছি…”

বৃদ্ধের ঘোষণাউক্ত ‘আমি’ বাক্য সৌষ্ঠবে যে ক্ষুদ্র তন্মাত্ৰা বৰ্ত্তমান, তদনুরূপ ক্ষুদ্র একটি ক্ষণস্থায়ী নির্ভরতা যশোবতীর মনে সঞ্চারিত হইয়াছিল। তিনি নোলকটি একটি অঙ্গুলিদ্বারা ঈষৎ আন্দোলিত করিতে করিতে অন্যমনস্কা হইলেন এবং এককালেই শুনিয়াছিলেন “কাজল”।

বৃদ্ধের চোখে দিবার নিমিত্ত একটি কাজললতা ছিল, তাহা খুলিয়া, যশোবতী সস্নেহে তাঁহাকে কাজল পরাইতে লাগিলেন। এখন, নিশ্চয়ই মনে হইল এ কাজল–এ অন্ধকার, শিখাতে দাহ্য হয় নাই, আলো পার হইয়া আসিয়াছে। পথশ্রমে উহা কাতর বা ম্লান কভু নহে।

কাজলচৰ্চ্চা কালে তিনি বার বার স্বামীর মুখাবলোকন করিয়াছিলেন, এ কারণে যে, তাঁহার সকল সময় মনে হইতেছিল, সীতারাম এখনও হস্তের আঘাত-প্রসূত ব্যথায় মর্মাহত, এখনও তাঁহার অশ্রুসিক্ত নিঃশ্বাস ক্রমে ক্রমে পড়ে, এবং এইহেতু এই প্রথম যশোবতীর চিন্তাসূত্র গৃহী হইল। ইতঃপূৰ্ব্বে শুধু সংস্কার ছিল। এক্ষণে বুঝিলেন সম্মুখে যাহা, তাহা গঙ্গা, তাহার প্রতিটি জলবিন্দুতে মেঘ এবং সে মেঘের পিছনে প্রশান্ত, সুন্দর, শান্ত, অক্ষয়, পিতা নীলিমাসুতরাং বৃদ্ধের জন্য ব্যাকুলতায় পদদ্বয় নাচিয়া উঠিল, তিনি যেমন স্বামীর জন্য বিশ যোজন পথ অক্লেশে দৌড়াইতে দৌড়াইতে আসিতেছেন–রক্ত, মাংস, গোঙানি, জিহ্বা–তাঁহার এ পথে মায়া সৃষ্টি করিতে পারে নাই। তিনি সিদ্ধা।

সীতারামের চক্ষুর্ঘয়ে বিদ্যুৎ খেলিতে আরম্ভ করিয়াছিল, কোথা হইতে জোয়ালঠেলা ক্ষমতা সঞ্চয় করিয়া তিনি নিজেকে প্রকাশ করিতে চাহিলেন, সন্তরণ অভিজ্ঞ পুরুষ যেমত সহজেই জলের তলদেশ হইতে উল্কা গতিতে উপরের দিকে আসে সেইরূপ তিনি উঠিয়া আসিলেন, বারম্বার ওষ্ঠদ্বয় কম্পিত হইল, কিন্তু বাক্যস্ফূৰ্ত্তি হয় নাই। করুণভাবে আপনার স্ত্রীর প্রতি চাহিয়া, প্রাণান্ত করিয়া কণ্ঠে শুদ্ধ স্বর আনিতে চাহিলেন, চক্ষে জল আসিল।

পতি ব্যাকুলা যশোবতী বস্ত্রপ্রান্ত দ্বারা স্বামীর ওষ্ঠভাগ, যাহা জলসিক্ত, সযতনে মুছাইলেন, কেননা ইদানীং তাঁহার আপনকার দেহবর্ণের স্বর্ণ-পীত এবং দূর অম্বরের নীল, আর এক অনন্য সবুজতার সৃষ্টি করিয়াছে–তিনি আড়নয়নে এ-শোভা দেখিয়া সম্মোহিত রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিলেন। এই গূঢ় উপলব্ধিতে আপনার দেহের ভিতরে কাহারা…যেন বা আলিঙ্গন করিতে লাগিল।

“চাঁদ”…

যশোবতী ‘চাঁদ’ বুঝিয়া লইয়া স্বামীর প্রতি স্মিতহাস্য করত চাহিলেন।

“চাঁদ”…

যশোবতী এক্ষণে তাঁহার বাক্য, বোধ করি, অনুধাবন করিতে পারিয়া চাঁদোয়া টানাইবার জন্য ব্যগ্র হইলেন। সীতারাম অত্যধিকভাবে প্রতিবাদ করত করিলেন, “না না…।”

যশোবতী ইহাতে স্বামীর কানের তূলা বিশেষ সন্তর্পণে বাহির করিয়া কল্পনাতীত স্নেহস্বরে বলিলেন, “হিম পড়বে যে…” একথা বলিতে বলিতে হঠাৎ তাঁহার বাল্যের স্মৃতি জাগিল। একদা ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ত্রস্ত দুধের লাউ গাছ দেখিয়া মনে বড় দুঃখ হইয়াছিল।

সীতারাম আকাশ দেখিয়া, হিম স্মরণে, সম্মত হইলেন।

চাঁদোয়া খাটান হইল। সীতারাম এই মুহূর্তটুকুর জন্য যেন বা সকল শক্তি সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছিলেন; তিনি যে অথৰ্ব্ব একথা ভুলিবার প্রয়াস পাইয়াছিলেন। নববধুর প্রতি তাকাইয়া বলিলেন, “আকাশ…বড় ভয়…”

উদগ্রীব হইয়া তাঁহার কথা শুনিয়া, যশোবতী সগর্বে বলিলেন, “কেনে গো, আমি আছি” আবার স্পষ্ট করিয়া বলিলেন, “ভয় কি, ভগবান আছেন।”

তাঁহার কথা যেন বা বৃদ্ধের মনঃপূত হইল না, অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া নববধূর হস্তটি স্পর্শ করিয়া বুলাইতে চাহিলেন, পরে কোনমতে আপনার গণ্ডদেশে লইয়া চাপিয়া ধরিয়াছিলেন। যশোবতী অনুভব করিলেন, বৃদ্ধ কাঁদিতেছেন।

বার্ধক্যের অশ্রু যশোবতাঁকে বহু জন্মের পুঞ্জীভূত সঙ্গ, বন্ধুত্ব, সৌহার্দ্য, অন্তরঙ্গতা, মিত্রতা, মিত্রতার মধ্যে যেমন গঙ্গাজল, গঙ্গাজলের মধ্যে যেমন আপনি, আপনার মধ্যে যেমন অক্ষর, তাহা এক নিমেষেই দান করিল। এখন তিনি যেন তাঁহার স্বামী হইতেও আতুর, একদা মনে হইল সীতারাম শিশুবৎ, ইহাকে সাদরে কোলে লওয়া যাইতে পারে, পরক্ষণেই কৰ্ত্তব্যজ্ঞান ফিরিয়া পাইয়া তাঁহার চক্ষুদ্বয় মুছাইয়া বলিলেন, “কাঁদো কেনে গো…”

“আমি…বাঁচব…”

সীতারামের উক্ত ‘আমি’ কথাটা যশোবতাঁকে অভিমানী করিল, যেখানে তিনি, যশোবতী, বন-মায়া, তিনি বলিতে চাহিলেন, ‘আমি’ বল না, শুধু বল বাঁচব কিন্তু তবু আপনার বিরক্তি দাঁতে কাটিলেন।

“আমায় ত ভগবান এনেছেন তোমায় বাঁচাবার জন্য গো।”

“বউ ভয় মায়া” বলিয়া অঙ্গুলি দ্বারা যশোবতীর প্রতি ইঙ্গিত করিলেন।

“মায়া…”

“আমার জন্য?” এইটুকু মাত্র প্রশ্ন করিতে যশোবতী কোনক্রমে সক্ষম হইয়াছিলেন।

তাঁহার আজন্ম সযত্নে রক্ষিত অভিমান, দেহের মধ্যে পলকেই কুম্ভকের সৃষ্টি করিল, প্রথমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস এবং তদনন্তর নেত্রে অশ্রু দেখা দিল, এখন বিগলিত হয়; তবু এ সত্য অনস্বীকার্য যে, অষ্টলক্ষণ সমুদয় প্রভাবসম্পন্ন, ফলত ললাটে স্বেদবিন্দু ও অন্তরের পুলক আকল্প-নবীন একভাবের সূচনা-নয়নে উন্মীলন আকাঙ্ক্ষায়, কৃষ্ণ মেঘোদয়ে ময়ূরসমান; এবং ধীরা, নবোঢ়া, লাজুক, শীলা, বিহুলা, বিড়ম্বিত, মুহ্যমান–বিষাদময়ী যশোবতী প্রগম্ভ হইলেন, আপনকার দেহ হইতে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হইল; তিনি মুহুর্মুহুঃ বলিতে লাগিলেন, “সত্যিই…সত্যিই মায়া হয়” বলিতে বলিতে আপনার ভগ্নস্বরে আপনি সম্মোহিত হইয়া, জরাজীর্ণ কালাহত স্বামীর কণ্ঠ ঝটিতি আবেষ্টন করত রমণী জীবনের, প্রকৃতি জীবনের, প্রথম, মধ্য এবং শেষ এবং শ্রেষ্ঠ আশ্রয় গ্রহণ করিলেন।

তাঁহার, যশোবতীর জীবন সার্থক হইয়াছিল।

অদ্যের এই বেলাতটের পড়ো-নিঃসঙ্গ সৌন্দর্য্যের বাস্তব-বিদ্যমানতার জন্য, এই আদিষ্ট ভূমি– ভূতগ্রামের জন্য, তিনি নিজেই বর প্রার্থনা করিয়াছিলেন; এবং বালকস্বভাব ভোলানাথ, যিনি সৰ্ব্বমঙ্গলময়, যিনি চিৎস্বরূপ, যাঁহার বিভূতির অন্তর্গত দৃশ্যাদৃশ্য সৃষ্টি, যিনি অদ্বিতীয় পুরুষ, ষড়ৈশ্বৰ্য্যময়ী শ্যামার চরণাশ্রিত প্রৌঢ়শিলাবৎ অনড়; ইদানীং যিনি শঙ্কর, যাঁহার বাম জঙঘাপরি নবারুণ প্রকট-চম্পকদীপ্ত-বিদ্যুৎপর্ণা আসীনা, অর্থাৎ পাৰ্ব্বতী, অধরে মধুরার ‘মিথুন-হাস্য’ এবং উদাসীকে প্রেক্ষণব্যস্ত–সেই পাৰ্বতীপ্রিয় শঙ্কর, যিনি অবিচারিত চিত্তে মানুষকে চারিফল দান করেন, তিনি নিশ্চয়ই, যশোবতীর প্রার্থনায়, বলিয়াছিলেন–”তাহাই হউক”। এবং তিনি, যশোবতী, বৃদ্ধকে জড়াইয়া ধরিলেন।

উদ্ভিন্ন বনজযৌবনার মৃণালসদৃশ ভুজবন্ধনে বৃদ্ধ’ পরিত্রাহি ডাক ছাড়িলেন, আকুল সমুদ্রের প্রায়-নিমজ্জমান ব্যক্তির ন্যায় মুখব্যাদান করিলেন। আকাশ অন্ধকার হয়। যশোবতী ভীতা হইয়া তাঁহার হাতখানি অপসারণ করিতে গিয়া পুনরপি কণ্ঠ আবেষ্টন করিয়াছিলেন। বৃদ্ধের কণ্ঠরোধ হইবার উপক্রম হইল। নববধূর হাতখানি সরিয়া গেল, তিনি শশব্যস্তে ব্যগ্রতার সহিত, “কি হয়েছে গো অমন করছ। কেনে…লেগেছে?” অত্যন্ত সরল কণ্ঠে বলিলেন।

অনন্তর, বিশুদ্ধ বায়ু লইবার মানসে সীতারামের মস্তক সঞ্চালিত হয়, তাঁহার প্রাণ বুঝি যায়; ইদানীং যে প্রাণ তাঁহার সহজ বন্ধন মাত্র। যশোবতীর শরীর আড়ভাবে ন্যস্ত ছিল। তিনি উপস্থিতবুদ্ধিরহিত, কেবলমাত্র আকৰ্ণবিস্তৃত নয়ন যুগল তড়িৎ ভঙ্গিমা চকিত, কোনমতে আলুথালু বেশে উঠিয়া বৃদ্ধের প্রতি মনোনিবেশ করিলেন।

বৃদ্ধ স্বাভাবিক ভাবে শুইয়া আছেন।

দুঃখিনী বন্ধুহীনা যশোবতী উন্মত্তের ন্যায় সমস্ত দিগদর্শন করিলেন, কেহ নাই। সর্পদেহী– আপকাল দেখিয়া তিনি শঙ্কিতা, জরায়ুস্থিত আসনে তাঁহার সর্ব শরীর বক্র হয়। কিয়ৎক্ষণ পরে নির্জীব কণ্ঠে বারংবার কহিলেন, “ওগো কথা বল, কথা বল…” এবং স্বামীর কর্ণের নিকটে মুখ লইয়া তারস্বরে বলিলেন, “কথা বল”। এই ব্যাকুলতা শূন্যতায় প্রতিধ্বনিত হইল, তাঁহার শিহরণ উপস্থিত, মুখ তুলিয়া প্রতিধ্বনির দিকে তাকাইবার চেষ্টা করিয়া চন্দ্রালোক দেখিলেন, যে চন্দ্রালোক জলে স্থলে– এখানে সেখানে।

“বউ…”

নাগরাজ বাসুকির দ্বারা নববধূর দেহটি আন্দোলিত হইল। বিস্ময়ে যশোবতীর মুখ খুলিয়া গেল, পলকেই মুখনিঃসৃত লালা আসিয়া পড়িল। তিনি তৎপরতার সহিত তাহা অপসারিত করিয়া বলিলেন, “এই যে আমি, খুব লেগেছিল হ্যাঁ গো” এবং সেইকালে সৰ্ব্বদিক অবলোকন করিয়া ‘আমি’ প্রতিধ্বনি বাক্যটিকে লক্ষ্য করিয়াছিলেন। পরে অতীব মধুর কণ্ঠে কহিলেন, “খুব লেগেছিল।”

“না না” বলিয়া বৃদ্ধ অতি ধীরে তদীয় পত্নীর হস্ত স্পর্শ করিলেন।

.

যশোবতী অতি সন্তর্পণে স্বামীর অভিপ্রায় মত পুনৰ্ব্বার কণ্ঠ আলিঙ্গন করত আনন্দ বর্ধন করিয়াছিলেন। উপত্যকার শান্ত হ্রদের ব্রাহ্ম মুহূর্তে সন্তরণরত শ্বেত মরাল আপনার দীর্ঘ, ব্য, সর্পিল গ্রীবা বাঁকাইয়া এই সপ্তবন্ধনের নিঃশ্বাসকে তির্যকভাবে দেখিয়াছিল। বৃদ্ধের ভাঙা ভাঙা কুঞ্চিত ওষ্ঠে নিশ্চিত হাসি ছিল। রাত্রনিহিত, তৃপ্তির অনন্য মরীচিকা, সুন্দর জোছনায় হেমন্তের শিশিরসিক্ত শেফালিকার মধ্যস্থতায় ব্যক্ত, উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।

“আমি খুব ভয় পেয়েছিলুম”–নববধূ কহিলেন। এমন যে তাঁহার গাত্রবাস স্পন্দিত হইয়া উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে।

“ভয়!” এ বাক্য উক্তির সহিত তাঁহার, বৃদ্ধের, মুখগহ্বর দেখা যায়, মাড়ি অস্পষ্ট, উল্লিখিত ফলে, তাহা নিজেই ভীতির কারণ হইল।

এ কথা শ্রবণে যশোবতী সমস্ত প্রকৃতি আলোড়ন করিলেন, আপনার সুবৃহৎ চক্ষুদ্বারা দিক সকল দেখিয়া কহিলেন, “ভয় কি গো?” এবং পুনরপি বাস্তবজগৎ নিরীক্ষণ করত বলিলেন, “এই দেখ” বলিয়া কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠে “ইংহি ইক ইক” বলিয়া রক্ত মন্থনকারী এক অদ্ভুত ধ্বনি তুলিলেন। এই হৃদয়-উদ্বেল-পটু শব্দে একমাত্র রাহুই সাড়া দেয়-জলপানরত ভয়ঙ্কর জীবসকল প্রাণভয়ে স্থির। চাঞ্চল্য দারুভূত। তিনি যেন হাসিয়াছিলেন।

একমাত্র বৃদ্ধ তাঁহার এ হেন দুর্ধর্ষ ডাকে নিশ্চিন্ত হইয়া জাগিয়া উঠিলেন। কিছুই তখনও চক্ষু মেলিতে সাহস করে নাই।

গঙ্গার শীতল বায়ুচাঞ্চল্যে জোনাকি-ঝাঁক তরঙ্গায়িত কভুবা ছত্রভঙ্গ, কোথাও কেহ নাই; লোক চরাচর স্তব্ধ। অলৌকিক দাম্পত্যজীবন যাহা তেজোময় দুস্পধর্ষ, আমাদের ক্রন্দন, আমাদের প্রতিবিম্ব, শ্মশানভূমিতে ইদানীং অশরীরী।

যশোবতী তপ্ত-উষ্ণ নিঃশ্বাস-বায়ুর মধ্য হইতে প্রশ্ন করিলেন, “হ্যাঁ গো তোমার কত কষ্ট হয়েছে, না গো…”

“না…না…ভাল…”

নববধূ স্বামীকে সচেতন মায়াময় করিবার মানসে শ্রীযুক্ত কণ্ঠে কহিলেন, “তোমার যদি কিছু হত, আমি গঙ্গায় ঝাঁপ দিতুম…”

বৃদ্ধ অবাক হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। তিনি যেমন বা ধারাবর্ষণ-ক্ষান্ত ধরিত্রী দর্শন করিলেন। অনর্গল বৃষ্টি হেতু সমস্ত প্রান্তর জলময়, তথাপি প্রাণকুল ব্যস্ত।

“এ জীবন গেল, কি হয়েছে? আবার জন্মাব আবার ঘর পাতব”–এ কথায় এই লোকক্ষয়কারী শ্মশানভূমি যেন পক্ষীশাবকের ন্যায় কাতর হইয়া উঠিল। কেননা তাঁহার, ভাগ্যবতী যশোবতীর, অঞ্চলে তুরুপের ইহলোক, তাহার বীজ এবং বাঁচিবার ইচ্ছা-চিন্তা সকলই বাঁধা ছিল।

 “আমার…সঙ্গে?”

শিশুর মত মাথা দোলাইয়া যশোবতী কহিলেন, “হিঁ গো, তুমি ছাড়া আর কে…! জান, আর জন্মে নিশ্চয় তোমায় কষ্ট দিয়েছিলুম, তাই এত দেরী হল আসতে। জান আমি ভূত হয়ে ঘুরছিলাম! তুমি যখন মাঠে মাঠে খেলেছ, ফড়িং ধরেছ, তখন কত হাততালি দিয়েছি, আমি সব দেখেছি…” এ কথায় যশোবতীর গভীর সংস্কার ছিল না। বিশ্বাস ছিল। সীতারাম যুবকের মত স্ত্রীর উরুতে চাপড় দিলেন, শাশ্বত সত্য কম্পিত; রমণীর জরায়ু মহানন্দে মহুয়া-বেসামাল নৃত্য করিতে লাগিল, আর যে কাহারা– মর্ত্যবাসী সম্ভবত, ঘোররবে অট্টহাস্য সহকারে মাদল বাজাইতে উন্মাদ। সমগ্র চক্ষুষ্মন, সমগ্র পরমায়ু আশ্বস্ত, একারণ যে তাহারা এক মনোহর দিব্য দৃশ্য দেখে–যে, এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড একটি মহতী জরায়ু, যেখানে বাঁশরীগীত প্রতিধ্বনিত এবং আপাতত বলিলেন, “আবার হবে”।

বৃদ্ধ সীতারামের সরল বাক্যে যশোবতী অল্পমাত্রায় স্থানীয় হিমবায়ু অনুভব করিলেন। তন্নিবন্ধন শুধুমাত্র বুঝিয়াছিলেন তাঁহার ইদানীং আদিত্যবর্ণ দেহ নানাবিধ অলঙ্কারভূষিতা, এবং এমন কি যাহা ধূলা, তাহাই তাঁহার স্নেহাস্পদ, কেননা ধূলাই তাঁহার প্রথম সন্তান; তিনি রমণী।

প্রৌঢ়শিলাসম সীতারাম এখন স্পন্দিত, প্রথমত যশোবতীর প্রাণ উচাটনকারী ঘোর রবে, দ্বিতীয়ত আপনার দেহে ক্ষণমাত্রস্থায়ী বিদ্যুৎ দর্শনে, স্বভাবে অধিষ্ঠিত হইয়া কহিলেন, “বউ গান বল।”

এ কথায় যশোবতী হাস্য সম্বরণ করিতে অপটু, মুখে বস্ত্রখণ্ড প্রদান করিলেন, দেহ-সকালের উড্ডীয়মান পারাবত যুথ যেমত সহসা ছত্রভঙ্গ হয়, তেমনি–ছত্রভঙ্গ হইল।

“বল” বৃদ্ধ কহিলেন। এ বাক্যের ভিত্তিতে এই ইচ্ছা ছিল যে কাল পরাস্ত হউক।

যশোবতী সেই ভাবেই মাথা নাড়িয়া প্রকাশ করিলেন, সঙ্গীত তাঁহার আয়ত্তে নাই। অনন্তর মহা আগ্রহে বলিলেন, “তুমি বল না।”

“না তুমি…”;

বৃদ্ধ অপেক্ষা করিলেন, তাহার পর অভিমানে মুখ ঘুরাইয়া লইলেন। যশোবতী অভিমানী স্বামীকে তুষ্ট করিবার জন্য, কোন মতে ‘বেহাগে’ গাহিতে লাগিলেন।

“তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা,
অমানিনা মানদেন কীৰ্ত্তনীয়ঃ সদা হরি”…

সদ্য যৌবনপ্রাপ্তির সুললিত মধুস্বর লীলা ভক্তির ঔদার্যে বাত্ময় হইয়া উঠিল। হাজার হাজার বৎসর, তাহার সেতু, তাহার হৰ্ম্মরাজি, জলযান, তাহার যুদ্ধ বিগ্রহ, তাহার প্রমোদক নন, রভস, ছুন্নৎ, হারেম, একটি আদরণীয় নবপ্রসূত মেষ শাবকের চপলতায়, রম্য ছায়ায় অবাক হইল। এমত সময় একটি বিরক্ত স্বর মৃত্যুমুখী নিঃশ্বাসের গড় গড় ধ্বনি তাঁহাকে বাধা দিল, বৃদ্ধ তিক্ত স্বরে কহিলেন, “হরিধ্বনি দাও না তার থেকে”…।

পতিপ্রাণা যশোবতী অপ্রস্তুত হইয়া থামিলেন, এখন তাঁহার শিরায় রক্ত প্রবাহ নিখাদকে কেন্দ্র করিয়া মন্থর গতিতে আবর্তিত হইতেছিল, তিনি সৃষ্টি ও স্থিতির মধ্যবর্ত্তী কোন স্বর যুক্ত করত ভাবিলেন, কি গাহিবেন! অবশেষে ধরিলেন–

“যাই যাই যাই যাই লো আমায় বাঁশীতে কে ডেকেছে,
পড়ে থাক ভেসে যাক কলস আমার–যমুনায়,
আমায়–বাঁশীতে কে ডেকেছে…”

যশোবতীর করতল মৃদু মৃদু বৃদ্ধের হস্তে আপনার গীতের তাল রক্ষা করিতে ব্যস্ত। গানের অন্তরীক্ষে যে সৌখীনতা তাহা নিয়ত জোনাকির পশ্চাদ্ধাবন করিল। সীতারামের শিরা উপশিরা, ঝড় সমাগমে স্বলিত কবরীর কেশরাশির ন্যায় ইতস্ততঃ প্রক্ষিপ্ত, উড়ন্ত, বাউরী, আসক্ত, বলবান, কোটি সর্পের মত–সম্মুখে বিদ্যমান মুখমণ্ডল তথা দেহটিকে কখনও বাঁধিতে কখনও বা কশাঘাতে সুস্ফীত করত–দীর্ঘায়ত করত মধুপান করিতে চাহিতেছে।

ঐ গীত ভেদ করিয়া হরিধ্বনির অট্টরোল উঠিল। পুনরায় জলদগম্ভীর শ্লেষাত্মক ত্রুর নিষ্ঠুর কর্কশ কণ্ঠে ‘হরিধ্বনি’ শ্রুত হইল। বৃক্ষস্থিত পক্ষীসকল ব্রাসিত, কাহারও বা স্বীয় অসাবধানতা বশত, বক্ষ রক্ষিত ডিম্ব সকল, পরস্পর আঘাতে শব্দ করিয়া উঠিল।

যশোবতী গীত না থামাইয়াই এই ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনিয়াছিলেন এবং তদবস্থায় ভেড়ীপথের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করত দেখিলেন, ইহা শব যাত্রীদের হরিধ্বনি নহে, মাত্র একজন লোকই স্কন্ধে একটি বাঁক লইয়া অল্প দুলিতেছে। দেখিলেন, এই কায়ার পদনিম্ন হইতে মৃত্তিকা খসিয়া গেল, সে কোনমতে আপনাকে সামলাইয়া কিছুক্ষণ পরে বাঁক লইয়া একভাবে নামিয়া গেল। কায়াটিকে আর দেখা গেল না। কেন কি জানি, তাঁহার মনে হইল, পুনৰ্ব্বার বিকট হরিধ্বনি হইবে। তিনি গীত থামাইয়া স্বামীর কানে তুলা ভরিয়া দিবার কালে দেখিলেন, সীতারাম অদ্ভুত আরামে নিশ্চিহ্ন। তাঁহার দেহ যশোবতীর সুখকর প্রীতিবৰ্ধক স্পর্শ দ্বারা আমোদিত, প্রহৃষ্ট করিতে প্রয়াস পাইলেন।

যশোবতী অন্যমনা হইয়া ভেড়ী পথের দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন। সেখানে কেহ নাই। কেবলমাত্র পূৰ্ব্বকার ঘটনার স্থানটি দর্শনে নববধূ শিহরিয়া উঠিলেন, একদা যাঁহার স্বরভেদ প্রলয়কালীন অবস্থার সূচনা করিয়াছিল, তাঁহার এ বৈলক্ষণ সমুৎপন্ন! এই ক্ষুদ্র ছাউনির আশ্রয় যতটুকু আশ্বাস নির্ভর, তাহা তাঁহার দেহে সঞ্চারিত করিয়াছিল! এখনকার ছায়াই তাঁহার নির্ভরতা!

“বউ…” ইহার পর বৃদ্ধ অসম্ভব শক্তি সঞ্চয় করিয়া কহিলেন, “মাটি মাটি, ভিজে ভিজে…”

যশোবতী ইহার অর্থ সঠিক করিতে না পারিয়া ভাবিলেন স্বামী বোধ করি কোন ঔষধ চাহিতেছেন। ইতিমধ্যে বৃদ্ধ কিছু বলিবার আপ্রাণ চেষ্টায় পরিশ্রান্ত। যশোবতী অত্যন্ত ব্যগ্র তৎপরতার সহিত মস্তকের নিকটে রক্ষিত ছোট হাঁড়ি খুঁজিতে গিয়া তুলসী গাছটি হেলিয়া স্বামীর কাঁধে পড়িল, যশোবতী এক হাতে তুলিয়া ধরিলেন।

“গাছ…”

যশোবতী, তুলসী চারাটি তাঁহার কাছে লইয়া যাইতেই গাছটি নিকটে পাইয়া বৃদ্ধ যেন উচ্ছ্বসিত; তিনি কী অনুযোগ করিয়াছিলেন তাহা আর স্মরণ ছিল না। গাছটি যেমন প্রস্ফুটিত চম্পকদাম, বৃদ্ধের আগ্রহ-আতিশয্যে যশোবতী ইহাকে বৃদ্ধের হস্তস্পর্শ করিবার সাহায্য করিলেন।

বৃদ্ধ সীতারাম এক্ষণে তাঁহার হস্ত দ্বারা যশোবতীর সাহায্যে গাছটির নিম্নে কি যেন খুঁজিতে খুঁজিতে–অন্ধকারে এতদিন পরে সব্বার্থসাধক কিছু অন্বেষণে একাগ্র, হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, “শিকড়” কোন ক্রমে নিজের নাসিকার নিকটে আনিলেন। কণা কণা মৃত্তিকা পড়িল। মুখগহ্বরে প্রবেশ করিল, তিনি আস্বাদ গ্রহণ করিয়াই “মাটি” বলিয়াই অসম্ভব জোরে স্ত্রীর ঊরুদেশে আহ্লাদে এক চাপড় মারিলেন। তুলসী গাছটির নিম্নের মৃত্তিকাকে এই আশ্চর্যভাবে আস্বাদন করিতে দেখিয়া নববধূর মনে হইল যেন স্বামী তাঁহারই, যশোবতীর, প্রথম সন্তানের আস্বাদ গ্রহণ করিতে উৎফুল্ল।

বৃদ্ধের মস্তক উত্তেজনায় অনেকখানি ছাড়িয়া উঠিয়া আবার যথাস্থানে ফিরিল। “আঃ আঃ বউ…” কোন ইন্দ্রিয় যেন চরিতার্থ হইয়াছে। যদিও যশোবতী স্বামীর এরূপ ব্যবহারকে উন্মত্ততার লক্ষণ বলিবার মত সময় পান নাই, তথাপি ইহা যথার্থ যে, তিনি কিঞ্চিত্র বিচলিত হইয়াছিলেন। সকল সময়ই তাঁহার মনে হইতেছিল, বাবলাকাঠ নির্ম্মিত হালের ফলা যেমত বৎসরে একদা লক্ষ মাণিক্যের বিভা ফিরিয়া পায়, তদ্রূপ, বৃদ্ধ যেমন বা শক্তি ফিরিয়া পাইয়া বলীয়ান হইয়া উঠিয়াছেন। ইহাতে, তাঁহার ইচ্ছা হইল, তিনি যেন স্বামীর ছায়ার মত হইবার সৌভাগ্য লাভ করেন, তাঁহার ইচ্ছা হইল ইহার আড়ালে যেন তাঁহার স্থান হয়।

গাছটিকে বৃদ্ধের মস্তকে স্পর্শ করাইয়া যথাস্থানে রাখিয়া বস্ত্র সম্বরণপূর্বক একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করত স্বামীকে সহসা নূতন করিয়া আবিষ্কার করিলেন।

বৃদ্ধের ক্ষীণ চক্ষু বৈদূৰ্য্যমণির ন্যায় প্রভাসম্পন্ন এবং বৃদ্ধ ওষ্ঠ বিভক্ত করিয়া মহাবিশ্বাসে ক্রমে ক্রমে, “বউ আমি আবার ঘর পাতব…” এবং কিয়ৎ পরিমাণে দম লইয়া কহিলেন, “ছেলে দুব”। এ হেন অহঙ্কারে স্থাবর ও জঙ্গমসমূহ উলুধ্বনি করে, বিশাল বিন্দুতে পরিণত হইল। হায়, ইহার পরই কি ঘোর যুদ্ধের শুরু, ইহার পরই কি বসুধা শিশু হস্তীর মত মহারঙ্গে দুলিয়াছিল? ব্রীড়াবনত নববধূ মুহূর্তের জন্য দিকসমূহ এবং ত্রিলোক লইয়া নিশ্চিন্তে কড়ি-খেলা করিলেন।

“এখন থাম, তুমি আর কথা বল না” বলিয়াই স্বামীর কর্ণের নিকটে গিয়া গান শুরু করিলেন। বুঝিলেন তাঁহার কর্ণের তূলা অপসারণ করা হয় নাই, তদ্দণ্ডেই তূলা অপসারণ করিয়া কহিলেন, “কি হচ্ছে গো…”

“বড় মন কেমন করছে।”

একথা শুনিয়া দয়িতার মন ভাবাবেগে অধীর; তদুত্তরে কিছু বলিবার ছিল না, আপনার পুষ্প-তীর্থ নয়নের, এক্ষেত্রে, অবলোকই সর্বৈব সত্য। তবু তাঁহার স্বর শ্রুত হইল। “আর ভেব না গো…” বলিয়া স্বামীকে ঘুম পাড়াইবার চেষ্টায় তাঁহার সুখস্পর্শ হাতখানি পালকের মত অনুভব বৃদ্ধের কপালে দান করিল।

সীতারাম সম্ভবত ঘুমাইলেন।

যশোবতী অনেকক্ষণ পর্যন্ত বৃদ্ধের সমান নিঃশ্বাস বায়ুর গমনাগমন নিরীক্ষণে বিস্ময়াভিভূত তন্ময়। একদা আপন সরলতাবশে, স্বীয় নিঃশ্বাস প্রশ্বাস কিঞ্চিত্র অনুভব করত তিনি স্বাভাবিকতা আশ্রয়ী। তাঁহার নিদ্রা নাই, জাগরণ লইয়া অপেক্ষমাণ হওয়া, বসিয়া থাকার এই সূত্রপাত, তৎকালেই তিনি ইহাও দেখিয়াছিলেন যে, নিকটে, দূরে, বায়ুও দুর্দিনকারিণী মহতী মায়ায় আরূঢ় হইয়া তথা প্রতিকূলতা স্ফীত হইয়া উঠিয়া ইতস্ততঃ বিচরণশীল এবং মধ্যে মধ্যে ভস্মরাশি লঘু স্বচ্ছ মেঘের ন্যায় বেলাতট অতিক্রম করিয়া অবশেষে লতাগুল্মতরুরাজির গহনতায় বিলুপ্ত। আর যে, যশোবতী এ জাগরণ লইয়া একভাবে বসিয়া কালক্ষয়ে নিমগ্না, যে জাগরণের কোন চিত্ররূপ নাই, ইহা মনোরম দীপ্তি সমম্বিতা সৰ্ব্বদাই বাস্তবতাকে পরোক্ষভাবে জ্ঞান করে, পদ্ম এবং ভ্রমরের মিলন, একটি অভিনব ইসারায় তাঁহারই সমক্ষে উপস্থিত; যদিচ ইহা অমোঘ সত্য যে, এখন পুত্রবৎসলা তথাপি এখন মদিরনয়না চন্দ্রনিভানন গুরুনিতম্বিনী যশোবতী আপনার জাগরণে বিনিদ্র।

অনেকক্ষণ পরে যশোবতী ধীর কণ্ঠে সলজ্জভাবে স্বামীর দেহের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, “হ্যাঁ গো, আমার তরে তোমার মায়া হয়?”

ইহা কি জিজ্ঞাসা? অথবা সন্দেহ? এ জিজ্ঞাসার উপর দিয়া কি যাযাবররা পুনরায় অশ্ব ছুটাইবে; রাত্রে, অগ্নিকে কেন্দ্র করত মণ্ডলাকারে জনগণ, ইহাকে বিষয় করিয়া শুধু গীত গাহিতে গাহিতে শুধুই নৃত্য করিবে; দুঃখময় অজস্র বৃত্তাকার পদক্ষেপ।

এ প্রশ্নে সৰ্ব্বত্রেই বিষাদ দেখা দিল। যশোবতী আবার এই পুরাতন প্রশ্ন করিলেন, “হ্যাঁ গা, আমার তরে তোমার মায়া হয়?”

তাঁহার এই অনাথা, নিঃস্ব, ভিখারী, ভাঙাকপালে, কাঙাল প্রশ্নের উত্তরে সহসা শুনিলেন, “কনে বউ, কনে বউ।”

খুব চাপা স্বর এবং খুট্‌ খুট্‌ শব্দ। এ স্বর যেন অন্নময়। এ স্বর মধুর হইলেও ক্ষেত্ৰ-দাহের বীভৎস নিষ্ঠুর আওয়াজের বিকার ছিল। এই ডাকে গোলাপের শোভা নষ্ট হইল; যেন কাব্য প্রলয়ে সমাচ্ছন্ন হইয়াছে, যেন চিত্র-সংজ্ঞা ধূলাদষ্ট হইয়াছে, যেন মহতী কীৰ্ত্তি অবসন্না হইয়াছে, যেন শ্রদ্ধা অপমানিতা, প্রজ্ঞা ক্ষীণ, যেন দেবস্থান বিধ্বস্ত হইয়াছে, নদী স্বল্পতোয়া, বেদ-ব্রাহ্মণ ধূসরিত হইয়াছে। অথচ বৃদ্ধের ওষ্ঠদ্বয় নির্বাক। ফলে এখন, তিনি চারিভিতে চাহিলেন। একদা ভেড়ীপথের দিকে, আচম্বিতে গঙ্গার প্রতি; দিত্মণ্ডলে আলোকিত অন্ধকার। তখনও নববধূ উপলব্ধির অবকাশ পান নাই যে, তাঁহার চিত্ত ঝাক্ষিপ্ত। তিনি বিমূঢ় অন্যথা তিনি চঞ্চল। ঝটিতি গঙ্গা প্রতি দৃষ্টিপাতে যশোবতী ভূতগ্রস্ত; গঙ্গা চন্দ্রালোক বিচ্ছুরিত উদ্বেল, বেলাতটে মাংসপিণ্ডবৎ, কৃষ্ণবর্ণ স্পন্দিত শরীরকুম্ভীর যেমত, কে যেন আসিতেছে দৃশ্যমান হইল; তদ্দর্শনে তিনি সম্মোহিতা, আবিষ্ট, নাস্তিক, শক্তিরহিত। একদা তাঁহার স্বীয় অজর-প্রশ্নআত্মক গীতের রেশ তাঁহার কানে আসিল এবং চকিতে তিনি সম্বিত ফিরিয়া পাইয়া পদদ্বয় গুটাইয়া লইয়া আধো-উঠা অবস্থায় স্বামীর দিকে সরিয়া গিয়াছিলেন।

পুনরায় “কনে বউ কনে বউ” ডাক।

সম্মুখে অপকীৰ্ত্তি। নীল মেঘসদৃশ অবয়ব এখনও গতিশীল। তিনি ব্যাঘাক্রান্ত যূথভ্রষ্টা হরিণীর ন্যায়, যেন নিজ শরীর মধ্যে প্রবিষ্টা হইয়া অধিকতর কম্পিত হইলেন। ইহা ব্যাকরণ-সংস্কারহীন অর্থান্তর প্রতিপাদক বাক্যের ন্যায়, অনেক কষ্টে বুঝিতে পারিয়াছিলেন উহা একটি দেহ; উহা শ্মশান ও চৈত্যবৃক্ষের ন্যায়, উহা চণ্ডাল।

চণ্ডাল বৈজুনাথ সাষ্টাঙ্গ বিস্তার করত, বুকে হাঁটিয়া আসিতেছে আর মধ্যে মধ্যে কলস ভাঙ্গানি খোলামকুচি–যাহা তাহার আগমনে বিঘ্ন উৎপাদন করে, তাহা কুড়াইয়া হুঁড়িয়া হুঁড়িয়া পিছনের দিকে। ফেলিতেছে; এই ভয়ঙ্কর সর্পিল গতিকে ছাপাইয়া বড় আপনার করিয়া ‘কনে বউ’ ডাকটি শোনা যাইতেছিল, সে ক্রমশঃ অগ্রসর হইতেছে। ইহাতে যশোবতী ত্রস্ত হইয়া, কি জানি কেন, অচিরেই স্বামীকে আগলাইয়া দেহটির দিকে চাহিলেন। কি জানি কেন এই মরু-রাত্রে এ হেন বাধাকে, সহসা হাস্যোদ্দীপক মজার, রগড়, আমোদজনক মনে হয় কিন্তু নিমেষেই সেই প্রতিক্রিয়া আবছায়া, ক্রমে লুপ্ত এবং তিনি পদাঘাত নিমিত্ত পা উঠাইয়া ক্ষণেক তদবস্থায় রাখিয়া ধীরে ধীরে যথাস্থানে পাটি রাখিলেন, একারণে যে তিনি বুঝিয়াছিলেন, শত্রু তাঁহার আস্ফালনের বহু দূরে।

সেখানে এখনও ভাঙা খোলামকুচির টুকরা ঊর্ধ্বে উঠিয়া অদৃশ্য, এই খোলামকুচির টুকরা অগণন দেহের পথ প্রদর্শন করে–যে দেহগুলি বীভৎস, ভয়াল, শ্লেষ্মবৎ এবং অশরীরী; তাহারা সকলেই তৃষ্ণার্ত, তাহারা সকলেই বৈজুর অন্তরঙ্গ; যাহাদের লইয়া সে খেলা করে। নববধূ উপলব্ধি করিলেন সেই প্রেতগুলির কাহারও হস্তে মরুভূমি, কাহারও হস্তে অপঘাত, কাহারও বা হস্তে চোরাবালির আজ্ঞা। ইহারা অগ্নিকে স্বীকার করে না। ইহারা অন্তঃসত্ত্বা ছাগলকে ভালবাসে…। এই ভয়ঙ্কর শোভাযাত্রা বৈজুর ঊর্ধেই প্রতিভাত, তাঁহার তালু শুষ্ক, যেখানে সিক্ততা নাই আর্দ্রতা নাই জল নাই, সেখানে শব্দও নাই; যশোবতী তৃষ্ণার্ত্ত; আর ভৌতিক দৃশ্য ক্রমশঃ অগ্রসর হয়।

বৈজুনাথ অনুচ্চ রবে হাসিল, এ সময় বক্ষখানি তুলিয়া ধরিয়াছিল, এবং একটি নিঃশ্বাস লইয়া কহিল, “কনে বউ, আমি ভূত নই, প্রেত নই… আমি বৈজু বটে গো।”

যশোবতীর সঘন, উপর্যুপরি নিঃশ্বাসে কবরী খুলিয়া গেল, তাঁহার মস্তক আন্দোলিত হয়।

“তবে বটে, ভূত প্রেতের সঙ্গে আমার কথা হয়, তারা আমার স্যাঙাৎ” বলিয়া মাটির নিকটে মুখ রাখিয়া হাস্য করিতে কিঞ্চিৎ ধূলা উড়িল এবং সে যুগপৎ কহিল, “আমাকে এক বেটা ও ঘুম এই ঘুম বলি ডাকে, আমি সে শালার বুকে লাথি মারি”–একথা শেষ হওয়ায় উর্ধস্থিত অশরীরী যাহারা তৃষ্ণার্ত্ত–তাহারা হা-হা করিয়া হাসিয়া খুসী হইল। পুনরায় ভগ্নস্বরে সে বলিতে আরম্ভ করিল, “তুমি জান…তুমি কি? দোসর…ভাঙ্গা কুলো। আমি বৈজুনাথ, আমার বটে মড়া পুড়বে সহ্য হয়” বলিয়া বালকের ন্যায় আহ্লাদিত হইয়া, ভঙ্গী সহকারে কহিল, “চিতায় যে কত লোক আমার হাতে ঠেঙা খায়, আমার দরদ নাই…” আবার অনুচ্চ হাসির শব্দ করিয়া দৃষ্টি নামাইল। পরক্ষণে বুকফাটা কণ্ঠে কহিল, “কিন্তু জ্যান্ত কেউ পুড়বে আমার আমার…কষ্ট হয়…” বলিয়া দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া, আপনার হস্ত ঠেটিতে ঘষিতে লাগিল; তাহার পশ্চাতে, নিম্নে, সমতল গঙ্গা স্রোতোময়ী।

“ওগো বাবু আমি ভাবের পাগল নই–আমি ভবের পাগল! তুমি পুড়বে চচ্চড় করে…ভাবতে আমার–চাঁড়ালের বুক ফাটছে গো” এবং বৈজুনাথ কহিল, “তুমি পালাও না কেনে।” এ স্বর যেমত বা দাড়িম্বকে বিদীর্ণ করিয়া উৎসারিত।

যশোবতী একথা শুনিবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তিনি আপনার হস্তের একটি বলয় তাহার প্রতি নিক্ষেপ করিবার মানসে প্রায় খুলিতে গিয়া মৃতপ্রস্তর; তিনি প্রমাদ গণিলেন।

বৈজুনাথকে নববধূর দেহস্থিত কিয়দংশে অবিড়ম্বিত চন্দ্রালোক যেন উৎসাহিত করিল, ধীরে ধীরে কহিল, “আমি বড় গতরক্যাঙলা লোক গো, কনে বউ, তুমি পুড়বে, আকাশ লাল হবে, ভয়ে গোরু পৰ্য্যন্ত বিইয়ে ফেলবে গো। তুমি গেলে, কি আর বলব আমি চাঁড়াল, দেশে আকাল দেখা দেবে…লাও…লাও তুমি পালাও…কনে বউ পালাও।”

ইতিমধ্যে হস্ত হইতে বলয়খানি বিচ্যুত হইয়া তাঁহার হিতাহিত জ্ঞানকে স্পষ্টতর করে, পুনরপি বলয়টি ঝটিতি তির্যকভাবে দেখিলেন, দেখিলেন গত সন্ধ্যায় তিনি সম্যক স্বাধীনতা দিয়া তিনিই বন্ধনলীলায় মুমুক্ষু; আর যে বন্ধন-তিতিক্ষার নামই ত স্বাধীনতা! এবং ভগবান তাঁহার কোলে, ফলে নয়ন নিমীলিত করত পথ অনুসন্ধান মানসে কিয়ৎক্ষণ যাপন করিলেন। অনন্তর যশোবতী বৈজুনাথের সকল কথা যাহা তখনও নিকটস্থ শূন্যতাকে বিচলিত করিয়া ঘূর্ণায়মান, তাহা শুনিতেছিলেন; কিন্তু কতখানি যে তাহার মর্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা নির্ণয় করা কঠিন নহে। অসম্ভব রাগান্বিত হইয়া কি যেন বলিলেন; হায় এখনও তিনি তৃষ্ণার্ত অথবা ঊর্ধ্বলোকের বীভৎস প্রেতসকলের, যাহারা নিয়ত তৃষ্ণার্ত–তাহাদের প্রতিধ্বনি মাত্র; শুধু শব্দ হইল। যে শব্দের অর্থ নাই। ইহার পর তিনি শক্তি সঞ্চয় করিয়া মাটিতে একটি পদাঘাত করিলেন…।

…সঙ্গে সঙ্গে বৈজুনাথ গড়াইয়া কিছু দূরে গেল, তাহার গাত্র ধূসরিত হরিশোভা, সে সংযত চিত্তে বলিল, “কনে বউ তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছ, আকাশের লেগে ভয় পাও হে, মাটির লেগে ভয় কেনে?” বলিয়া আর এক পাক দিল; ইহার পরে বেলাতটের দিকে চাহিয়া কহিল, “তুমি আকাশ কালো করবে গো, হাতী হাতী ধোঁয়া উঠবে, সতী হবে, তোমার নামে কত মানত, কত নোয়া শাঁখা জমা হবে। তোমার নামে অপুত্রের পুত্র হবে, নিধনের ধন হবে।” ক্ষিপ্রবেগে মুখ ফিরাইয়া বলিল, “তোমার বরে হিজড়ে ঢ্যাঁড়া দিবে হাটে–হো সতীর বরে গো মানুষ হইলাম” বলিয়া হাসিয়া আরবার কহিল, “তোমার স্বল্প বাস হবে, পান তামাক পাবে। হ্যাঁ গা কনে বউ, স্বগটা কেমন গো-দুধ আলতায়?” ইহার পর অদ্ভুত হাস্য করত আপনকার মস্তক মাটিতে স্থাপনা করে; এ-মাটি বড় সুন্দর, তাহার কেশরাশিতে মৃত্তিকা লাগিল।

যশোবতীর হিম রোমাঞ্চ ক্ৰমে শব্দ হইয়া আসিল।

বৈজুনাথ, তদ্রূপ, পূৰ্ব্বের ন্যায় পাক দিয়া ঘুরিয়া গেল। বলিল, “কনে বউ ভাবের ঘরে চুরি…ভাল লয়…” এই বচনের মধ্যে শ্লেষময় সাবধানতার হুঙ্কার ছিল। কহিল, “ভাবের ঘরে চুরি ভাল লয়” মনে হয় সে যেন কানে কানে কথাটি কহিতেছে। বাণবিদ্ধ পশু যেমত মুখোনি হন্তার দিকে তুলিয়া চাহিয়া থাকে, সেইভাবে বৈজুনাথ মুখটি তুলিল। ক্রমে পতিতপাবনী গঙ্গার দিকে চাহিয়া উচ্চারণ করিল, “ভাবের ঘরে চুরি।” অবশেষে তাহার মুখটি নিস্তব্ধ না’য় পরিস্ফুট।

“ছাই মেখে বসে থাকলে কি মতে ঠাকরুণ, তুমি ত আর পান্না ভৈরবী লও গো, যে নোড়াকে শিব বলবে হে! যত ছাই মাখো হে, সোনার প্রতিমা সূৰ্য্য সূৰ্য্যই; তুমি বড় সুন্দর গো, শ’ শয়ে দেখেছি, তোমার মত দেখি নাই” বলিয়াই পাক দিয়া আবার সে ঘুরিয়া নিকটে আসিল। খোলামকুচি সকল গায়ে বিদ্ধ হয়। বলিল, “আমি ভাবের কথা বললাম না হে…আমি ভবের পাগল, আমি জাত চাঁড়াল, ভাব পাব কোথা গো, ভাব আকাশগাছের ফল, তবে হ্যাঁ তুমি যদি বল…কেনে গো চাঁড়াল? হাটভাতারী। খানকি মাগীর দুয়ারের মাটি যেমন সত্য হয়, পুণ্যের হয়; তেমনই হে, শ্মশান মশানের মাটিতে” বলিয়া এক মুঠা মাটি তুলিয়া মুষ্টি উন্মুক্ত করিতে করিতে বলিল, “তুমি বলবে, এই মাটিতে ভাবের কথার হরিনুট…তুমার আবার ভাবনা কি গো” ইহার পর নিজেই উত্তর করিল, সে মাগী যেমন খানকিই থাকে পুণ্য পায় না; হারে কপাল! তেমনি, আমি ভাব পাই না গো, খোল বড় ভালবাসি গো, দেখনা কেনে ভূতগুলো আমার পড়শী স্যাঙাত!” বলিয়া হাতের উপর মস্তক রাখিয়া শুইয়া একদৃষ্টে যশোবতীর প্রতি চাহিয়া রহিল।

কিছুকাল অতিবাহিত হইয়াছে, যশোবতী হৃত শক্তি ফিরিয়া পাইয়াছেন। দক্ষিণহস্তে কাজললতা মুষ্টিবদ্ধ করিয়া কহিলেন, “চাঁড়াল”–এই সম্বোধনবাক্য তাঁহার কণ্ঠবিবর হইতে ক্ষিপ্ত জন্তুর মত লম্ফ দিয়া বাহির হইল। এবং করস্থিত বলয় ছুঁড়িয়া অন্যান্য দুই একটি অলঙ্কার ঝটিতি খুলিয়া উন্মত্তের ন্যায় ছুঁড়িয়া বলিলেন, “এই নাও…ডাকাত…” তাঁহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইল।

চণ্ডাল বৈজুনাথ ইহার জন্য প্রস্তুত ছিল না, তাহার দশাসই দেহ বাঁকিয়া চুরিয়া গেল। যশোবতীর উক্ত বাক্য প্রতিধ্বনিত হইল। অলঙ্কার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া চণ্ডাল মাটি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখে ক্ষুব্ধ অসহায়তা, ক্রমে কুটির হাসি, পদ্মপত্রে জলের মত চঞ্চল। সে তাহার বাম পদখানি মৃত্তিকার উপর দিয়া সম্মুখে পশ্চাতে লইয়া যাইতে লাগিল গোরু যেমনে ক্ষুর ঘর্ষণ করে, এবং শেষ বারের মত দৃষ্টি নিক্ষেপ করত কহিল, “মর” বলিয়া দ্রুতপদে স্থান পরিত্যাগ করিয়া সে এখন আপনার আড়ায় অদৃশ্য, আর যেন তাহার ছায়াও অন্তর্হিত হইল। ইদানীং তাহার স্থানেই নিম-শূন্যতা, ভ্রমর, দিবাস্বপ্ন।

জ্যোতির্মণ্ডলের যে মনঃস্বিতা অবলীলায় শ্যামঘন পৃথিবীকে আপনার বিচিত্রতায় রাখিতে চাহিয়াছিল, উদ্বুদ্ধ করে, তাহা যেন নাই। যশোবতী ছাউনিতে চিত্রার্পিতের ন্যায়, তিনি নববধু, তিনি মিলন অভিলাষিণী তাঁহার মাংসল যৌবনকে লইয়া, যে, দূরত্বের ইঙ্গিত সকল, সাফল্যের তন্দ্রা সকলই, হিম তুষার সফেন তরঙ্গ, লাল কম্পনে অরুণাভ গিরিপ্রান্তর সকল যে খেলা করিবে, এ গীত আমন্ত্রণ তিনি শুনিয়াছিলেন। তাহারা বলিয়াছিল, আমাদের বাহু নাই তথাপি তোমাকে তড়িৎ-আলিঙ্গন করিব, আমাদের ওষ্ঠ নাই তথাপি তোমাকে চুম্বন করিব, আমরা সদেহে তোমার মধ্যে প্রবেশ করত তোমাকে আনন্দ দান করিব। কেননা আমরা নব্য, কেননা যেহেতু আমাদের কল্পনা নাই। তিনি একদা রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিয়া সম্মুখবর্ত্তী অবকাশ দেখিলেন, আপনার অলঙ্কারগুলি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত, ক্লান্ত পতঙ্গ যেমন বা; সোনাকে অবলম্বন করিয়া কোন ঝা শ্বেত হয়! যশোবতী একইভাবে আপনার মিলন-আগ্রহকে স্পর্শ করিয়াছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *