৪. নূতন হাওয়া এসে

নূতন হাওয়া এসে জনশ্রুতিও যথাসময়ে উড়িয়ে নিয়ে যায়, পশ্চাতে কোনো আক্ষেপ-আফসোস না রেখে। এবার যে-জনশ্রুতি ওঠে সেটি পূর্ববর্তী জনশ্রুতির একটি পরিবর্তিত সংস্করণ বলে মনে হয়, এবং এটাও চড়ার অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করে না। এবার তারা বলে, হ্যাঁ, চড়াটা বেশ বড় রকমেই পড়েছে যে-জন্যে এ-পথে স্টিমারের চলাচল আর সম্ভব নয়, তবে এবার স্টিমারের পরিবর্তে লঞ্চের প্রচলন করা হবে। এ-জনশ্রুতিটাও কেউ অবিশ্বাস করে না।

এ-সব জনশ্রুতি যেমন কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের কল্পনাশক্তি বা উদ্ভাবনক্ষমতার পরিচয় দেয় তেমনি তাদের চারিত্রিক সরলতাও প্রকাশ করে, কারণ সরলচিত্ত মানুষের পক্ষেই সে-ধরনের জনশ্রুতি এমন সোৎসাহে এবং গভীর বিশ্বাসে গ্রহণ করা সম্ভব। তবে মনের অতলে সত্য কথাটি থেকে-থেকে উঁকি দিতে চেষ্টা না করলে তাদের কল্পনাশক্তি বা উদ্ভাবনক্ষমতা কি এমন তীক্ষ্মভাবে প্রকাশ পেত বা সরলচিত্ত বিশ্বাস এমন গভীর রূপ ধারণ করত? হয়তো নিরাশা-ঢাকা তাদের কাছে নিতান্ত দুরূহ মনে হয়েছিল বলেই তাদের আশা এমন উৎকটভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

এবং সে-জন্যেই হয়তো নানারকমের জনশ্রুতির উদ্ভাবন বা সে-সব জনশ্রুতির বিতরণের মধ্যে কোনো চপলতাও দেখা যায় নি, সে-সব অটুট গাম্ভীর্যের সঙ্গেই তারা গ্রহণ করে। অতএব কোনো জনশ্রুতির ওপর সমস্ত বিশ্বাস স্থাপন করে একটি লোক যদি হাস্যকর কাণ্ড করে বসে তাতে কেউ উপহাসের কিছু দেখতে পায় নি। একদিন বারো বছরের মৃতপ্রায় ছেলেকে কোলে নিয়ে মোক্তার হাবু মিঞা ঊর্ধ্বশাসে স্টিমারঘাট অভিমুখে রওনা হলে এবং শীঘ্র তাকে অনুসরণ করে অনেক লোক পথে বেরুলে কেউ অমোদিত বোধ করে নি বা হাসে নি-তখনো নয় যখন সমস্ত ব্যাপারটি কীভাবে শুরু হয়েছিল তা জানতে পায়। সকালে হাবু মিঞা নদীতীর থেকে মাছ কিনে বাড়ি ফিরছিল। পথে রতনলাল মুহুরির ছেলে তাকে বলে, খবর এসেছে স্টিমার আজই আসবে। হাবু মিঞা কথাটি বিশ্বাস করে নি। স্টিমার নিশ্চয়ই আসবে, তবে আসতে আরো দিন কয়েক সময় নেবে। স্টিমারের কথা ভুলে গিয়ে দুপুরের দিকে দলিলপত্র নিয়ে মগ্ন হয়ে আছে এমন সময় সহসা সে সুপরিচিত বংশীধ্বনিটি শুনতে পায়। চমকিত হয়ে সে কান খাড়া করে। না, কানের ভুল নয়, স্টিমারেরই বংশীধ্বনি। এখনো দূরে, তবে স্টিমারটি যেন স্রোতে ভেসে আসছে, বংশীধ্বনিটিও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তারপর কীভাবে সে দৌড়ে বাড়ি গিয়ে ছেলেকে বুকে তুলে নিয়ে ঘাটে পৌঁছেছিল তা নিজেও বলতে পারবে না।

না, স্টিমার যে শীঘ্র কুমুরডাঙ্গায় ফিরে আসবে তাদের সে-বিশ্বাসের কারণ যা-ই হোক তাতে ফাঁক-ছিদ্র ছিল না, থাকলে সেদিন যারা স্টিমার ধরতে গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছিল তার দু-একদিন অপেক্ষা করে যাওয়ার একটা উপায়ের সন্ধান করত ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা না হলেও অন্ততপক্ষে তারা, যাদের জন্যে যাওয়াটা একান্ত জরুরি। যাওয়ার যে অন্য উপায় রয়েছে, তা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যেই ততদিনে অনেক নৌকা ঘাটে এসে মোতায়েনও হয়েছিল। সে-সব নৌকা রাতারাতি চলে এসেছিল নদী পাড়ি দিয়ে, খাল-বিল অতিক্রম করে, পাল তুলে দাঁড় বেয়ে লগি ঠেলে। কত রকমের নৌকা : হোট-বড়, ঢঙের-বেঢঙের, এমন তুফান উপেক্ষা করে, আবার তেমন নৌকাও। যাতে খাল অতিক্রম করতে ভরসা হয় না; কোনো নৌকা হয়তো পানিতে কাৎ হয়ে ছিল, তাকে তুলে তার গা-এ গাব ঘষে কোনোপ্রকারে ভাসিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে, আবার কোনো নৌকা বেশ শক্ত মজবুত, আয়তনেও বড় কিন্তু যা ব্যবসাজীবন্ত লঞ্চ স্টিমার-নৌকায় সমাকীর্ণ জনসঙ্কুল কোনো ঘাটে-গঞ্জে তীক্ষ্ম প্রতিযোগিতার দরুণ নিষ্ফল আশায়ই দিন কাটাত। সক্ষম-অক্ষম নৌকার মধ্যে আবার বেমানান নৌকাও কম ছিল না-যে-সব নৌকাদের লালসাই টেনে নিয়ে এসে থাকবে : ঘাস-নৌকা, কুমোর-নৌকা, জন্তুজানোয়ারের নৌকা। তাছাড়া দু-টি বজরাও এসে দলে যোগ দিয়েছিল যার একটিতে হয়তো অন্য কোনো যুগে শৌখিন লোকেরা বাঈজি-গাইয়ে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আমোদবিহারে বের হত। এখন তার রঙ নেই, খড়খড়ির অভাবে একটি জানালা খাঁ খাঁ করে, জোড়াতালি-দেয়া দেহটাও কেমন সৌষ্ঠবহীন। তবে অন্যটি ছোটখাটো ছিপছিপে, গায়ের রঙটাও তাজা। সেটি শ্রী-যৌবনের পরিমায় কিছুটা উদ্ধতভাবে অন্য বজরা থেকে দূরত্ব বজায় রেখে যাত্রীর জন্যে অপেক্ষা করে।

রাতারাতি সমাগত এ-সব নৌকা-বজরা কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের হয়তো শকুনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, যে-শকুন সদলবলে এসে মরণোন্মুখ জন্তুর চতুর্দিকে জমা হয়ে তার শেষনিঃশ্বাসের জন্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। তবে তারা বিচলিত হয় না। তাদের মনে হয়, শকুন যা জানে নৌকার মাঝিরা তা জানে না : নৌকার মাঝিরা জানে কুমুরডাঙ্গা ঘাটে স্টিমার ফিরে আসবে।

কিছুদিন আগেও মুহাম্মদ মুস্তফার মা আমেনা খাতুনকে তার স্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তার স্বামীর নাম ছিল খেদমতুল্লা। কখনো সে খেদমতুল্লা শেখ, কখনোবা কোনো কারণে মুন্সী খেদমতুল্লা বলে নিজের নাম-পরিচয় দিত। তবে আমরা উত্তর ঘরের ছেলেরা তাকে খেদুচাচা বলে সম্বোধন করতাম।

চাচী আমেনা খাতুনকে খেদুচাচার কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই আশায় যে তার সম্বন্ধে বিধবা স্ত্রীর কাছে এমন কিছু শুনতে পাব যা আগে কখনো শুনি নি।

আমেনা খাতুন মধ্যে-মধ্যে তার প্রথম স্বামী আফজল শেখের কথা বলে থাকে যদিও প্রথম স্বামীর স্মৃতিটা আজ তার মনে তেমন উজ্জ্বল নয়। বস্তুত তার নাম নিয়ে যে-সৌম্য চেহারার লম্বা-চওড়া মানুষের দৈহিক আকৃতি বা অশেষ চারিত্রিক গুণের বর্ণনা দেয় সে-মানুষ নিতান্ত কল্পনাপ্রসূত, যার সঙ্গে আসল মানুষটির সাদৃশ্য নেই বললে চলে। সেটা হয়তো অস্বাভাবিক নয়। আফজল শেখের যখন বিয়ে হয় তখন আমেনা খাতুন বালিকামাত্র। তাদের দাম্পত্যজীবনও স্থায়ী হয় নি, কারণ বিয়ের মাস। পাঁচেক পরে বসন্তরোগে আফজল শেখের মৃত্যু ঘটে। তবে যে-মানুষের সঙ্গে দীর্ঘ পনেরো বছর বসবাস করেছে সে-মানুষের কথা আমেনা খাতুন কদাচিত্র বলে থাকে। হয়তো মানুষটি এখনো তাকে বিহ্বল করে, হয়তো তার সঙ্গে পনেরো বছরের বসবাসের স্মৃতিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে তার সাহস হয় না।

খেদমতুল্লার নাম শুনে আমেনা খাতুন কয়েকমুহূর্ত স্তব্ধ হয়েছিল, চোখে ক্ষণকালের জন্যে অস্বাভাবিক চাঞ্চল্যও দেখা দিয়েছিল। আমেনা খাতুনের চোখ বড়, যাকে এক সময়ে লোকেরা ডাগর-চোখ বলত। তবে অনেকদিন হল তার চোখের মৃত্যু ঘটে গিয়েছে। আমেনা খাতুন চোখ বোজে চোখ খোলে, তার দৃষ্টি এধার-ওধার যায় নড়ে-চড়ে, কিন্তু অন্ধের মতো জ্যোতিহীন সে-চোখে প্রাণের ক্ষীণতম স্পর্শও নেই। আরো মনে হয়, সে-চোখে দশজনের মতো দেখতেও পায় না যদিও তাতে ছানি নেই দুর্বলতা নেই। তাই সে-চোখে সহসা চাঞ্চল্য লক্ষ্য করে আশান্বিত হয়েছিলাম। আমেনা খাতুনের পক্ষে মানুষের আচরণ-ব্যবহারের অর্থ বা তার জীবন-উদ্দেশ্য বোঝা সহজ নয়। কিন্তু সহসা সে কি তার দ্বিতীয় স্বামী খেদমতুল্লার আচরণ-ব্যবহারের অর্থ বা তার জীবন-উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে?

আমেনা খাতুনের চোখ শীঘ্র আবার নিথর নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল, সে কিছু বলেও নি।

প্রথম স্বামী আফজল শেখের মৃত্যুর পর আমেনা খাতুন শ্বশুরালয়ে কিছুদিন অনাদরে কাটিয়ে সামান্য মনোমালিন্য ঝগড়া-ফ্যাসাদের পর সে-বাড়ির সঙ্গে চিরদিনের জন্যে যোগাযোগ ছিন্ন করে বাপের ভিটেয় ফিরে এলে দিন-কয়েকের মধ্যেই গ্রামের ব্যস্তবাগীশ চিরউৎফুল্ল যুবক খেদমতুল্লার দৃষ্টি পড়ে তার ওপর। অস্থির প্রকৃতির হলেও প্রাণবন্ত সজীবতা এবং অফুরন্ত রসিকতার জন্যে খেদমতুল্লা তখন সকলের প্রিয়পাত্র। অল্প বয়স থেকে নানাদিকে তার মন, এটা ওটা হবার সখের অন্ত নেই, হবার হয়তো ক্ষমতাও ছিল। গাইয়েদের সঙ্গে ধুয়া ধরা, কবিওয়ালাদের সঙ্গে ছন্দ মেলানো, ফকির দরবেশের গন্ধে দেশান্তর হওয়া, আবার ঝোঁক উঠলে চরে গিয়ে লাঠিবাজি করা-কিছুই তার অতীত ছিল না। তারপর সহসা ব্যবসার দিকে তার মন ছোটে। মুখে দাড়িগোঁফ ভালো করে গজাবার আগেই সে সুপারি চালান হতে শুরু করে নৌকা-খাটানো পর্যন্ত নানাপ্রকার ব্যবসায় হাত মক্স করে নিয়েছিল। তবে কোনো ব্যবসায়েই এ-সময়ে কপাল লাগে নি। সে যখন অপ্রত্যাশিতভাবে আমেনা খাতুনের মুরুব্বির কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় তখন পানের ব্যবসায়ে অকৃতকার্য হয়ে শূন্যহাতে, হয়তো সাময়িকভাবে উজ্জ্বল কোনো পরিকল্পনার অভাবে, ঘরে বসে। তবু সে-প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কোনো যুক্তি কেউ দেখতে পায় নি; বরঞ্চ আত্মীয়স্বজন, মুরুব্বিরা এবং গ্রামের নেতৃস্থানীয় লোকেরা সবাই সেটি এককণ্ঠে সমর্থন করে। আমেনা খাতুনের অল্পবয়সে বৈধব্যদশা, ওদিকে ব্যবসায়ে বদনছিবের বদনাম ছাড়া খেদমতুল্লার নামে নিষ্কলঙ্ক। বিয়ের বছরখানেক পরে মুহাম্মদ মুস্তফার জন্ম হয়। তখনো খেদমতুল্লা কোনো ব্যবসায়ে সার্থক হয় নি। সংসারে অনটন, বস্তুত খাদ্যবস্তু উভয়েরই কষ্ট। তবু সে-সব কষ্ট নিত্য-হাসিমুখ স্নেহশীল স্বামীর সাহচর্যে আমেনা খাতুন অম্লানবদনেই সহ্য করেছে।

বছর কয়েক পরে হঠাৎ খেদমতুল্লার কপাল খোলে। তখন কাপড়ের কল সস্তা কিন্তু শৌখিন ঢঙের নূতন শাড়ি বাজারে ছেড়েছে। হাটে-বাজারে দুচারটা শাড়ি বিক্রি করতে শুরু করে দেখতে-না-দেখতে সারা অঞ্চলে কলের কাপড়ের বড় রকমের ব্যবসা ফেঁদে বসে, তারপর হাতে বেশ পয়সা হলে তিন ক্রোশ দূরে চাঁদবরণঘাটে বাড়ি করে সেখানে সপরিবারে বাসস্থান স্থানান্তরিত করে; সহসা খেদমতুল্লার জীবনে সুদিন দেখা দেয়। কেবল সে-সুদিন স্থায়ী হয় নি।

তখন সে-অঞ্চলে মাড়োয়ারিদের বড় প্রভাব-প্রতিপত্তি। তাদেরই একজনের দৃষ্টি পড়ে খেদমতুল্লা এবং তার হঠাৎ প্রস্ফুটিত লাভজনক ব্যবসার ওপর এবং বেড়াল যেমন তার নাকের খেদমতুল্লা এবং তার ব্যবসাটির ওপর নজর পড়লে সে-মাড়োয়ারিও বিস্মিত-আমোদিত বোধ করে তেমনি খেদমতুল্লা এবং তার ব্যবসাটির ওপর নজর পড়লে সে-মাড়োয়ারিও বিস্মিত-আমোদিত বোধ করে থাকে। তারপর আকস্মিকভাবে থাবা নেবে আসে। অতর্কিতভাবে ব্যবসাটি হারিয়ে খেদমতুল্লা হয়তো জীবনে প্রথম একটি গভীর আঘাত বোধ করে, ন্যায়বিচারহীন নিষ্ঠুরতার বিষয়েও সজ্ঞান হয়। কিছুদিন পরে সহসা একটি পরিবর্তন দেখা দেয় তার মধ্যে। প্রথমে কেমন সংসার পরিবার বিষয়ে উদাসীন হয়ে ওঠে, তারপর ক্রমশ গোপনকারী হয়ে পড়ে। মাস কয়েকের মধ্যে সে রহস্যময় ব্যবসাটিও ধরে। আস্তে-আস্তে সাক্ষী হিসেবে আদালতে তার হাজিরা শুরু হয়ে শীঘ্র সেটি একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়। প্রথমে মহকুমার কাছারি-আদালতে, তারপর জেলা-সদরে, পরে আরো দূরে প্রদেশের রাজধানীতেও তার যাতায়াত হতে থাকে। ন্যায়-সুবিচারের মতো উচ্চ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই এ মামলায় সে-মামলায় সাক্ষী দিতে শুরু করে নি-সে-কথা একদিন কারো অগোচর থাকে না, বিশেষ করে যখন নানা নির্দোষ পরিবারের ধ্বংসের, পরম দুঃখের এবং অপমান লাঞ্ছনার কথা প্রচারিত হতে শুরু হয়। তবে তাতে সে দমে নি; একবার শঠতাকে পেশা বলে গ্রহণ করার পর শঠতার অপবাদকে ভয় করলে চলে না। নূতন ব্যবসাটি বিপদজনক হলেও অতিশয় লাভজনক : শঠতা ফলবতী হচ্ছে এ-জ্ঞানে সে গভীর তৃপ্তি লাভ করে। কেবল তৃপ্তিটা কেমন বিচিত্র যেন, কেমন বিষময়ও, কারণ সমগ্র মন-প্রাণ দিয়ে উপভোগ করা সে-তৃপ্তিই তার অন্তরকে বিষমভাবে বিকৃত করে তোলে। ক্রমশ তার চরিত্র থেকে সর্বপ্রকার মনুষ্যত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, সে-সবের স্থান নেয় হিংস্রতা, কুটিলতা, হাসি-আনন্দশূন্য উকট ধরনের একরোখা ভাব, মানুষের প্রতি ঘোর অবিশ্বাস এবং অকথ্য কৃপণতা।

অকস্মাৎ কোনো কারণে ভীত হয়ে শেষবারের মতো এক ধনী মানুষের মামলায় দাও মেরে বিপদজনক অসৎ ব্যবসাটি ছেড়ে এবার সে পাটের ব্যবসা ধরে। তবে তার চরিত্রের আর পরিবর্তন হয় না : সে-চরিত্র যেন চিরকালের জন্যে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, স্নেহমমতার কাছ থেকেও চিরবিদায় নিয়েছিল। এ-সময়ে বাদি রাখার সখও চাপে তার এবং দ্বিতীয় বার বিয়ে না করে নূতন নূতন যুবতী বাদির আমদানি করতে শুরু করে এ গ্রাম সে-গ্রাম থেকে। বাদির বসবাসের জন্যে উঠানের পেছনে একটি আলাদা ঘর তুলে নেয়।

পরিবারের প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখা দেয় তার মধ্যে চারিত্রিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই। আর্থিক সচ্ছলতা সত্ত্বেও অকথ্য কৃপণতার জন্যে স্ত্রী-পুত্রকে কিছু দিতে হাত উঠত না, কী-একটা দুর্বোধ্য হিংস্রতার তাড়নায় কারণে-অকারণে তাদের মারত ধরতও। খেদমতুল্লার বিশেষ শাস্তিবিধান ছিল কনই মারা। সে-শাস্তির উপকারিতায় তার অখণ্ড বিশ্বাস জন্মেছিল বলে কনুই মারার কৌশলটি সযত্নে করায়ত্ত করেছিল, হাতবাহু একত্র করে কনুইটা বিদ্যুৎবেগে পিঠে বসিয়ে দিলে তার ক্রোধের পাত্র নিমিষেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলত। মুছল্লি মানুষের কপালে যেমন গাট্টা পড়ে তেমনি তার কনুইতে গাট্টা পড়েছিল।

সচরাচর মুহাম্মদ মুস্তফার পিঠেই সে-ভীষণ শাস্তিটা নেবে আসত। মুহাম্মদ মুস্তফা নীরবে সহ্য করত সে-শাস্তি এবং বাপের অন্তরে কোথাও পিতৃসুলভ স্নেহমমতা না থেকে পারে না, যা করছে তা অতিশয় নিষ্ঠুর হলেও ছেলের ভালোর জন্যেই করছে-এ সব যুক্তির ওপর সমস্ত বিশ্বাস ন্যস্ত করে তার মা আমেনা খাতুনও চোখ-কান বুজে সহ্য করত। তবে একদিন হয়তো ব্যাপারটি তার সহ্যাতীত হয়ে পড়ে।

অনেক রাত করে জেলাশহর থেকে ফিরে খেদমতুল্লা দেখতে পায় মুহম্মদ মুস্তফা পেছনের বারান্দায় অন্ধকারের মধ্যে বজ্রাহত মানুষের মতো দাঁড়িয়ে। তখন মুহাম্মদ মুস্তফার বয়স তেরো হবে। বাপকে দেখেও সে না নড়ে পূর্ববৎ দাঁড়িয়ে থাকলে খেদমতুল্লা এবার রুষ্ট কণ্ঠে তার আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু কোনো উত্তর পায় না। বিস্মিত হয়ে ছেলের নিকটে গিয়ে তার মুখের দিকে তাকায়, ছেলেও তাকায় তার দিকে ভীত হয়ে। তবে সেদিন শীঘ্র তার ভয় কাটে, কারণ তার মনে হয় সে যেন তার বাপের চোখে ক্রোধ নয়, কেমন স্নেহসূচক উৎকণ্ঠাই দেখতে পেয়েছ। কল্পিত বা সত্য সে-স্নেহের আভাস বালককে পরাভূত করে।

লুঙ্গি ভিজে গিয়েছে, এবার মুহাম্মদ মুস্তফা উত্তর দেয়।

কথাটি বুঝতে খেদমতুল্লার কিছু সময় লাগে। কিন্তু তারপর বিদ্যুৎঝলকের মতো তার অর্থ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে, বালক মুহাম্মদ মুস্তফা আর বালক নয়, সে তার জীবনের একটি নূতন অধ্যায় শুরু করেছে। তবে খেমতুল্লা কেবল সে-কথাই বুঝতে সক্ষম হয়, অজ্ঞানতার জন্যে এবং ঘটনাটির আকস্মিকতার জন্যে বালক মুহাম্মদ মুস্তফা যে ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়ে থাকবে, এ-সময়ে সে যে সমবেদনার প্রয়োজন বোধ করতে পারে বা জীবনবিষয়ে অভিজ্ঞ আপনজনদের কাছে তার রহস্যসময় আবিষ্কারের গূঢ় অর্থ জানবার জন্যে গভীর ব্যাকুলতা অনুভব করতে পারে এ-সব কথা অতর্কিতে জাগ্রত নিদারুণ ক্রোধের জন্যে বুঝতে পারে নি, বুঝবার ক্ষমতাও হয়তো তার ছিল না। নিমিষে একটি সর্বনাশী ক্রোধ খেদমতুল্লাকে গ্রাস করে, কারণ ঘটনাটিতে একটি ভয়ানক পাপ ও অকথ্য কলুষতাই সে দেখতে পায়; বালক ছেলে তার ক্রোধান্ধ দৃষ্টিতে একটি দুশ্চরিত্র লম্পটের রূপ গ্রহণ করে।

সে-রাতে খেদমতুল্লা ছেলেকে কনুই মারে নি; ঐ নির্মম শাস্তিটিও সে-রাতে তার কাছে হয়তো যথেষ্ট মনে হয় নি। প্রথমে ছেলেকে উঠানে টেনে নিয়ে গিয়ে একটি শক্ত বাঁশ দিয়ে তার দেহের পশ্চাদভাগে মত্ত ক্রোধপ্রসূত প্রচণ্ড শক্তির সাহায্যে অবিশ্রান্তভাবে প্রহার করে, তারপর কতক্ষণ উন্মত্ত মানুষের মতো অত্রযত্র লাথি মারে। মুহাম্মদ মুস্তফা একটি শব্দ করে নি। তার রহস্যময় অভিজ্ঞতা, তারপর তারাখচিত আকাশের তলে এই নির্দয় প্রহার-সবই তার কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়ে থাকবে। তার পক্ষে বেশি ভাবাও সম্ভব হয় নি, কারণ বাপের লাথিতে এক সময়ে সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। বাপও এ-সময়ে থামে, সংজ্ঞাহীন ছেলেকে উঠানে ফেলে সে ঘরে উঠে আসে। তবে ফিরে আসতে তার দেরি হয় নি, নূতন এক ক্রোধের ঢেউ এসে তাকে আচ্ছন্ন করলে সে আবার ক্ষিপ্ত মানুষের মতো বেরিয়ে আসে।

বাকিটা আমেনা খাতুন দেখে নি। খিড়কির দরজা দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে সে অন্ধের মতো হাঁটতে শুরু করে অন্ধকার রাত্রির মধ্যে দিয়ে, চোখ অশ্রুহীন, তবে সর্বাঙ্গে অদম্য কম্পন। কোথায় যাচ্ছে সে-বিষয়ে ধারণা নেই, সে চলতেই থাকে। এক সময়ে সহসা কোত্থেকে একটি পরী এসে উপস্থিত হয়। পরীটি সস্নেহে তার হাত চেপে ধরে, তারপর তাকে নিয়ে একটি গাছের তলে বসে সুমিষ্ট কণ্ঠে তার সঙ্গে কথালাপ করে। বস্তুত দু-জনে অন্তরঙ্গ সখীর মতো গল্পগুজব করে আনন্দেই সময় কাটায়। কেবল খেদমতুল্লা যখন লণ্ঠন নিয়ে গাছের নিচে হাজির হয় তখন সে পরীটিকে দেখতে পায় নি, স্বামীকেও চিনতে তার কষ্ট হয়েছিল।

শত চারিত্রিক অবনতি, নিষ্ঠুরতা এবং পরিবারের প্রতি গভীর উদাসীনতা সত্ত্বেও একটি ব্যাপারে খেদমতুল্লা কখনো সংকল্পবিচ্যুত হয় নি। সংকল্পটি এই যে মুহাম্মদ মুস্তফাকে উচ্চশিক্ষা দেবে। সে নিজে প্রায় অশিক্ষিত ছিল। কাজেই শিক্ষা বস্তুটি কী, বিদ্যার্জনের দীর্ঘ পথের জন্যে কী পাথেয় সামগ্রীর প্রয়োজন-সে-সব বিষয়ে তার স্পষ্ট ধারণা ছিল না। যা সে পরিষ্কারভাবে বুঝত বা দেখতে পেত, তা সার্থক শিক্ষার ফলাফল, বিদ্যার্জনের পুরস্কার। সে স্থির করেছিল, ছেলে বড় হয়ে উকিল হবে। জজ হকিম নয়, উকিল হবে-সেটাই ছিল তার স্বপ্ন। জজ-হাকিমের মান-সম্মান নয়, উকিলের আইন নিয়ে খেলা করার সুযোগই তাকে অধিকতর আকৃষ্ট করত। তার মনে হত, ওকালতিতে মানুষ যতটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারে জজিয়তি-হাকিমিতে ততটা পারে না; জজ-হাকিম শুধু দিনকে দিন রাতকে রাত প্রমাণ করে, উকিল দিনকে রাত রাতকে দিন করার ক্ষমতা রাখে।

ছেলে উকিল হবে একবার স্থির করলে সে অধৈর্য হয়ে পড়ে; সে ভাবত তাড়াহুড়া করলেই দীর্ঘ পথ সংক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে, সময়কে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হবে। সে আরো ভাবত, প্রহার দ্বারাই স্মৃতিশক্তির অভাব মেটানো যায়, দৈহিক মানসিক শ্রান্তি দূর করা যায় অতি শ্রমের সাহায্যে। বস্তুত তার ভাবটি ছিল অনেকটা নির্বোধ গাড়োয়ানের মতো, যে-গাড়োয়ান শ্রান্তক্লান্ত মৃতপ্রায় জানোয়ারকে কেবল অঙ্কুশাঘাতেই গন্তব্যস্থলের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে।

তবারক ভুইঞা বলে : সেদিন প্রত্যুষে নিদ্রাভঙ্গ হতেই উকিল কফিলউদ্দিন সাহেব কেমন উস্ফুল্ল বোধ করে, কারণ তার কেমন মনে হয় প্রতিবাদপত্রটি কার্যকর হয়েছে, সরকার প্রথমে স্টিমার-কোম্পানির পক্ষ নিলেও অবশেষে বুঝতে পেরেছে এমন দিনে দুপুরে ডাকাতি ঢাকা যায় না, সমর্থন করাও যায় না।

ততদিনে উকিল সাহেবও কিছু নমনীয়তা দেখিয়েছে দুনিয়াতে বাস করতে হলে সমঝোতা করতে হয়, নিতে হলে দিতে হয়। সে চড়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছে। যা স্বীকার করে নি তা এই যে সে-চড়ার জন্যে স্টিমার-চলাচল বন্ধ করা প্রয়োজন। স্টিমারঘাট সম্বন্ধে যে-সব জনশ্রুতি তার কানে এসে পৌঁছায় তাতে তাই প্রথমে নারাজ হয়ে পারে নিঃ কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীরা কী দুর্বলতা দেখাতে শুরু করেছে। তারা দুর্বল হয়ে পড়লে একা কী করে লড়াই করবে, কাদের জন্যেই-বা লড়াই করবে? তবে সে আশ্বস্ত হয় এই দেখে যে সে-সব জনশ্রুতি যে-রকম রূপ ধারণ করুক না কেন কেউ আর বিশ্বাস করে না স্টিমারঘাট স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। যারা এমন মত প্রকাশ করে তাদের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করতে দ্বিধা করে নি উকিল সাহেব। দুদিন ধরে ডাক্তার বোরহানউদ্দিনের সঙ্গে কথা বন্ধ; ডাক্তারের এখনো যেন বিশ্বাস, কোম্পানি লাচার হয়ে স্টিমার তুলে দিয়েছে। গত পরশুদিন বড় হাকিমের সঙ্গে বেশ উঁচুগলায় কথা বলেছেঃ বড় হাকিম কোম্পানির সাফাই গাইবার চেষ্টা করেছিল। তার মেজাজটা তখুনি গরম হয়ে ওঠে। সে বলে, চড়া পড়ে নি তেমন কথা সে কোনোদিন দাবি করে নি, শুধু বলেছে সে-চড়া পাশ কাটিয়ে স্টিমার বেশ দিব্যি নির্বিঘ্নে আসা-যাওয়া করতে পারে এবং কিছু যদি স্টিমারের আসা-যাওয়া বন্ধ করে থাকে তা বালির চড়া নয়, অর্থলালসার চড়া: সে-চড়াই একটি শহরের সুখ-সুবিধা দুঃখ-কষ্ট সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে মস্ত প্রতিবন্ধকের সৃষ্টি করেছে।

নিত্যকার মতো সেদিন উকিল কফিলউদ্দিন যখন কয়েকজন মক্কেলের সাথে কাছারি-আদালত অভিমুখে রওনা হয় তখনো সে মনে-মনে উৎফুল্ল বোধ করে, কেবল তা মুখের থমথমে ভাবের তলে আত্মগোপন করে থাকে; বুকে শোকব্যথা বোধ না করলেও সে সর্বসমক্ষে কৃত্রিম সম্পাত করতে সদা প্রস্তুত, কিন্তু কোনো কারণে ভেতরে আনন্দের ধারা প্রবাহিত হলেও তা প্রকাশ করতে তার দ্বিধা হয়। যা বিরল তা অতি মূল্যবান : তা দেখাতে সঙ্কোচ হয়।

অনেকক্ষণ হাঁটার পর উকিল কফিলউদ্দিনের আরেকটি খেয়াল হয় যাতে তার মনের উফুল্লভাবটা আরো বেড়ে যায় যেন। খেয়ালটা এই যে, প্রতিবাদপত্রটি কার্যকর হয়েছে শুধু তাই নয়, দু-চারদিনের মধ্যেই স্টিমার কুমুরডাঙ্গায় ফিরে আসবে। এমন খেয়ালের যুক্তি-যথার্থতা কী, কীই-বা ভিত্তি? তা বলতে পারবে না, তবে সে জানে এমনভাবে যে-সব খেয়াল মাথায় আসে তা কদাচিই ভুল হয়। জীবনে এমনটা অনেকবার হয়েছে : কিছু ঘটবার আগেই কী করে জানতে পেয়েছে তা ঘটবে। তার যেন কী-একটা অদ্ভুত ক্ষমতা, ভবিষ্যতের কথা কী করে জানতে পায় সে। মাসখানেক আগে একদিন হঠাৎ তার খেয়াল হয়, কে যেন আসবে। কারো আসার কথা ছিল না, খেয়ালটি তাই অহেতুক মনে হয়, কিন্তু পরদিন মুটের মাথায় বিছানাপত্র চাপিয়ে তার স্ত্রীর ছোট ভাই আশেক মিঞা অপ্রত্যাশিতভাবে দোরগোড়ায় দেখা দেয়। অপ্রত্যাশিতভাবে অন্যের জন্যে, তার জন্যে নয়। সেদিন স্টিমার ধরতে গিয়েছিল মেয়ে হোসনার সম্বন্ধে মনে কেমন একটা খেয়াল জেগেছিল বলেই। যেতে না পারলে জামাইর কাছে তার পাঠিয়েছিল : কোনো খবর নেই বলে সে চিন্তিত। পরদিন উত্তর পায়, হোসনার সামান্য সর্দি-কাশ হয়েছে, তাছাড়া সব ভালো, চিন্তার কোনো কারণ নেই। মনে-মনে সে বড় তৃপ্ত হয়েছিল এই বুঝে যে তার এমনই ক্ষমতা যে মেয়ের একটু সর্দি-কাশি হলেও কী করে সে খবর পেয়ে যায়।

হঠাৎ পেছনের দিকে অর্ধেক মুখ ফিরিয়ে সে প্রশ্ন করে, আজ বিষ্যুৎবার নাকি?

হ্যাঁ, আজ বিষ্যুৎবার । দুটি লোক সমস্বরে বলে ওঠে।

প্রশ্নটি কেন জিজ্ঞাসা করে তার আভাস না দিয়ে সে নীরবে হাঁটতে থাকে। তবে ততক্ষণে সে দিনটা ঠিক করে নিয়েছে : স্টিমার আসবে শনিবার। মন যেন তাই বলছে। তাই যদি হয় তবে রবিবারই সে সদর অভিমুখে রওনা হয়ে পড়বে। মেয়ে হোসনা সম্বন্ধে মনে আবার কোনো দুশ্চিন্তা দেখা দেয় তা নয়, তবে হঠাৎ তাকে দেখবার জন্যে কেমন অধীরতা বোধ করতে শুরু করে, এবং সঙ্গে-সঙ্গে মেয়েটির চেহারাও সুস্পষ্টভাবে জেগে ওঠে তার মনশ্চক্ষে। হোসনা চোখের সামনে না থাকলে তার যে-চেহারাটি সে দেখতে পায় তা তার বালিকাবয়সের চেহারা, যেন বাপের চোখে মেয়েটি বড় হয়ে যুবতীতে পরিণত হবার অবকাশ পায় নি, তার বিয়ে হয় নি, একটি ছেলের মাও হয় নি সে। কখনো-কখনো মেয়েটি চোখের সামনে থাকলেও উকিল। সাহেব তার বেশ কয়েক বছর আগের চেহারাটিই দেখতে পায় : কোঁকড়ানো চুলের মধ্যে মিষ্টি একটি মুখ, বড় বড় চোখে দাম্ভিকতার ভাব। তখন তার বয়স সাত-আট। সে-বয়সেই মেজাজটা বেশ উধরনের হয়ে উঠেছিল, কিছু চেয়ে সঙ্গে-সঙ্গে না পেলে বা কোনো শখ আবদার তৎক্ষণাৎ না মেটালে চোখ কালো হয়ে উঠত ঠোঁট ফুলে . উঠত। গোপনে-গোপনে স্ত্রীকে বলত, মেয়েটির মেজাজ শাহজাদির মতো। স্ত্রী উত্তর দিত, বাদশাহ কোথায় যে শাহজাদি হবে? মনে মনে সে উত্তর দিত : কুমুরডাঙ্গার বাদশাহ সে, সে বাদশাহের মেয়ে হল হোসনা।

আজ বিষ্যুৎবার? আবার উকিল সাহেব প্রশ্ন করে, যেন সেবার উত্তরটি শুনতে পায় নি।

এবার পশ্চাৎ থেকে চারটি লোক বেশ জোরগলায় বলে, হ্যাঁ, আজ বিষ্যুৎবারই উকিল সাহেব।

তবে মধ্যে একটি মাত্র দিন, তারপর স্টিমার আসবে। এবং দুটি দিন-আজকার এবং সদর অভিমুখে রওনা হওয়ার মধ্যে। একবার তার ইচ্ছা হয় কেন প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেছিল তা মক্কেলদের বলে, কিন্তু শেষপর্যন্ত নীরব থাকাই সমীচীন মনে করে; ইতিমধ্যে মেয়েকে দেখবার জন্যে রবিবারে সদর অভিমুখে রওনা হয়ে পড়ার পরিকল্পনাটি যদি করে না ফেলত তবে হয়তো বলতে বাধা বোধ করত না।

ততক্ষণে উকিল কফিলউদ্দিন কুমুরডাঙ্গার একমাত্র বাঁধানো সড়কের নিকটে এসে পড়েছে। সড়কটি কাছারি-আদালতের সামনে মাঠের এক পাশ দিয়ে শুরু হয়ে নদীর ধার দিয়ে পোয়া-মাইলখানিক গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। পোয়া-মাইল দীর্ঘ সড়কটির অবস্থা বড়ই শোচনীয়, কারণ অনেকদিন মেরামত হয় নি বলে এখানে-সেখানে নানা আয়তন-গভীরতার গর্ত, আবার যেখানে গর্ত নেই সেখানে ধারালো ইট-কঙ্করের নির্লজ্জ দন্তবিকাশ। বস্তুত, সে-বাঁধানো সড়কে জুতা নিয়েও পা-দেয়া দুষ্কর, এবং বাঁধানে: অংশটি এড়িয়ে তার এক পাশে দিয়ে মানুষেরা বাধ্য হয়ে যে পায়ে-হাঁটার পথ করে নিয়েছে সে-পথ ধরেই সবাই হাঁটে। একদা ইংরেজের আমলে কেউ তার নাম দিয়েছিল ই.বি. ক্র্যাংশ রোড-যে-নাম রাস্তার এক প্রান্তে একটি ছায়াশীতল বড় গাছের গুঁড়িতে পোতা কাষ্ঠলকে এখনো বিরাজমান, যদিও ঝুলে-পড়া লতাপাতার জন্যে তা নজরে পড়ে না, পড়লেও দীর্ঘদিনের রোদবৃষ্টিতে আপাঠ্য-হয়ে-উঠা অক্ষরগুলির অর্থোদ্ধার করা সম্ভব হয় না।

ব্যবহারের অযোগ্য সে-সড়কের পাশে পায়ে-হাঁটার পথে উঠেছে এমন সময় কফিলউদ্দিন সাহেব একটি আওয়াজ শুনে চমকিত হয়ে থেমে পড়ে। আওয়াজটি যেন স্টিমারের বাঁশির আওয়াজ। তবে কি স্টিমার ফিরে এসেছে? শনিবারে নয়, আজই। এসে পড়েছে? দিনক্ষণের বিষয়ে কিছু ভুল হলেও মনে যে-কথাটি এসে দেখা দিয়েছিল তা তবে সত্য?

কিসের আওয়াজ শুনলাম যেন। উকিল কফিলউদ্দিন বলে।

পশ্চাতের মক্কেলরাও দাঁড়িয়ে পড়ে নদীর দিকে তাকিয়ে শুনবার চেষ্টা করছিল। সেখান থেকে স্টিমারঘাট নজরে পড়ে না। শীঘ্র একজন মক্কেল উত্তেজিত ভাবে বলে,

বোধ হয় স্টিমার এসেছে।

আরো কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে উকিল কফিলউদ্দিন বাকশক্তি-রহিত মানুষের মতো নীরবে আবার হাঁটতে শুরু করে, কোনো অবস্থাতেই যে-মানুষের ধীর-মন্থর পদক্ষেপে তারতম্য দেখা যায় না তারই পদক্ষেপে যেন ঈষৎ চাঞ্চল্য, কেমন একটু অধীরতা এসে পড়ে।

কাছারি-আদালতের সামনে পৌঁছুলে উকিল কফিলউদ্দিন দেখতে পায়, সামনের মাঠের পথ দিয়ে অসংখ্য লোক দৌড়াচ্ছে। তারা যে ঘাটের দিকেই যাচ্ছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। উকিল সাহেবের একবার ইচ্ছা হয় সেও ঘাটের দিকে পা বাড়ায়, কিন্তু নিজেকে সংযত করে মাঠে নেবে পড়ে। কেবল একবার গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে, স্টিমারই এসেছে।

তবে পরে উকিল সাহেব আসল খবরটি জানতে পায়।

যারা ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘাটে উপস্থিত হয় তারা স্টিমারের স্থলে ছোটখাটো একটি লঞ্চ দেখতে পেয়ে কিছু নিরাশ বোধ করে কিন্তু ব্যাপারটি ঠিক বুঝতে পারে না। তারা ভাবে, তবে স্টিমারের পরিবর্তে লঞ্চই চালু করা হয়েছে বুঝি। অবশ্য লঞ্চের আগমনের কারণ শীঘ্র তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে : সেটি যাত্রী নিয়ে আসে নি, যাত্রী নিতেও আসে নি, এসেছে ঘাট থেকে ফ্ল্যাটটি সরিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাবার জন্যে। তাদের মধ্যে থেকে দু-চারজন লোক ছুটে এসে উকিল সাহেবকে স্টিমার-কোম্পানির বিশ্বাসঘাতকতার নতুন একটি প্রমাণের খবর দিলে প্রথমে উকিল সাহেবের মনে হয় সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে নাঃ এমন আস্পর্ধার কথা কি সহজে বিশ্বাস হতে চায়? শোনায় যে গলতি হয় নি বা যারা খবরটি নিয়ে এসেছে তারা যে ভুল করে নি, এ-বিষয়ে নিশ্চিত হলে সে পুলিশকে এত্তেলা দেবে স্থির করে, তারপর পুলিশ যে আবার হাকিম-সুবার নির্দেশ ছাড়া নড়ে না তা বুঝে নিজেই বড় হাকিমের এজলাসে হাজির হয়, চোখে সংযত আগুন, কণ্ঠে ভীতিজনক গাম্ভীর্য। তবে ততক্ষণে স্টিমারঘাটে লঞ্চে করে যারা এসেছিল তারা কাজে লেগে গিয়েছে। যে-ফ্ল্যাট বহুদিন ধরে একই স্থানে দাঁড়িয়ে থেকে স্থাবর রূপ গ্রহণ করেছিল সে-ফ্ল্যাটটি চোখের পলকেই তারা ঘাট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। দেখতে-না-দেখতে তারা সামনের এবং পেছনের দুটি নোঙর নদীর নরম বুক থেকে উঠিয়ে নেয়, তারপর এখানে-সেখানে কিছু দড়িদড়া খোলে, অবশেষে তীরের দিকে বালুতে বিধে থাকা কাঠের পুলটা তুলে নেয় : সব কিছু অতি সহজে উঠে আসে, কোনো কিছুই বিন্দুমাত্র বাধা প্রদান করে না, একটু আপত্তিও জানায় না। ইতিমধ্যে ফ্ল্যাটটির দেহের তুলনায় হাস্যকরভাবে ছোট কিন্তু চটপটে, ব্যস্তবাগীশ লঞ্চটি ফ্ল্যাগটিকে পাশাপাশিভাবে বেঁধে নিয়েছিল, এবার তার কেবল পথ ধরা বাকি। পথ ধরতে দেরিও করে না, কুমুরডাঙ্গার সঙ্গে ফ্ল্যাটের দীর্ঘ দিনের সম্বন্ধ নিমিষে সমাপ্ত করে তীরের ওপর নীরবে দণ্ডায়মান সে শহরের স্তব্ধ বিমূঢ় শত শত অধিবাসীর চোখের সামনে দিয়ে রওনা হয়ে পড়ে, কেউ তার পথরোধ করবার চেষ্টা করে না।

সে সময়ে এজলাসে বড় হাকিম তার বিরক্তি হাসিতে ঢাকবার বৃথা চেষ্টা করে বলছিল, ফ্ল্যাট ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকলেই কি স্টিমার চলবে? নদী যদি ঠিক হয় তবে সব ফিরে আসবে। ঘাট ফিরে আসবে, স্টিমার ফিরে আসবে।

এবার নীরবে উকিল কফিলউদ্দিন এজলাস ত্যাগ করে। কেউ তার মুখের দিকে তাকাতে সাহস পায় নি।

সে রাতে কুমুরডাঙ্গা শহরে একটি বিচিত্র নীরবতা নাবে। ঝড়ের আগের নীরবতা নয়, ঝড়-উত্তর সর্বস্বান্ত নিঃস্ব নীরবতা। তবে কুমুরডাঙ্গার পথে স্টিমার-চলাচল সত্যি বন্ধ হয়েছে, সন্দেহের আর কোন অবকাশ নেই : ঘাটটি হঠাৎ শূন্য হয়ে খাঁ-খাঁ করতে শুরু করে সব সন্দেহ দূর করেছে। কেউ হা-হুতাশ করে না, কিন্তু কেমন নিস্তেজ হয়ে থাকে কী-একটা মনভারে। হয়তো তারা মনে মনে কিছু লজ্জা বোধ করে। সকালের ঘটনাটি কি অপ্রত্যাশিত? সত্য কথা কি তারা জানে না? তা স্বীকার করতে চায় নি বলেই কি ফ্ল্যাটটি অনর্থক ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকবে যেন কিছু হয় নি, কোথাও চড়াও পড়ে নি? হয়তো সহসা অন্য একটি কথা বুঝতে পারে বলে তাদের মনে গভীর ব্যথার সৃষ্টি হয়। সেটি এই যে, তাদের বাকাল নদী স্টিমারের গমনাগমনের জন্যে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে শুধু তাই নয়, মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। যে-নদীর অপর তীরে শরৎকালীন কাশবনের দিকে তাকিয়ে তারা উদাস হয়, যার বুকে পাল-দেয়া নৌকার চলাচল দেখে। অন্তরে সুদূরের আহ্বান শোনে, কখনো তাতে সূর্যাস্তের শোভা দেখে নয়ন তৃপ্ত করে, সে-নদী মরতে বসেছে। হয়তো এ-সময়ে অকস্মাৎ এ-কথাও তাদের মনে পড়ে যে তারা নদীকে ব্যবহার করেছে, ঝড়ের দিনে প্লাবনের সময়ে ভয় করেছে কিন্তু কখনো ভালোবাসে নি। নদীকে ভালোবাসার কথা কেউ বলে না, ভালবাসতে শেখায়ও না, আবার নিজে থেকেই তার প্রতি একটু ভালোবাসা বোধ করলে সে-ভালোবাসা প্রথম সূর্যের ক্ষীণ উষ্ণতায় শিশিরবিন্দুর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মতো শীঘ্র অদৃশ্য হয়ে যায়; যা সুন্দর কোমল তা জীবনের স্কুল বাস্তবতায় শীঘ্র বিলীন হয়ে যায়। কোনো না কোনো সময়ে কে না শুনতে পায় হঠাৎ বেজে-ওঠা অদৃশ্য হাতের চুড়ির অস্ফুট শব্দ, কে না দেখতে পায় সন্ধ্যাকাশের মধ্যে আচম্বিতে দৃশ্যমান হওয়া রহস্যময় হাতছানি, ক্ষণকালের জন্যে হলেও কার বুকে না জাগে অন্তর-নিঃস্ব-করা হাহাকার? তবে সবই অবিলম্বে শেষ হয়, পরে চোখ অন্ধ হয়, কান বধির হয়। হয়তো তারা নদীর প্রতি ভালোবাসা বোধ করে না, তার মৃত্যুর কথায় মানুষের মৃত্যুর কথাই মনে পড়ে বলে। তারা বিচলিত হয়ে পড়ে। নদীটি যেন মানুষের মতো মরতে বসেছে। একদিন তবে মানুষের মতো তার যৌবন ছিল যে-যৌবন আর নেই। পরে প্রৌঢ়বয়সের স্থৈর্য-গাম্ভীর্যে প্রশান্ত হয়ে উঠেছিল, এক সময়ে সেদিনেরও অবসান ঘটে। তারপর ধীরে-ধীরে বার্ধক্য ঘনিয়ে আসে দিনান্তের মতো, এবং এবার তার আয়ু ফুরিয়ে এলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে; মানুষের জীবনের মতো নদীর জীবনও নশ্বর। সে-কথাই তাদের মন ভারী করে তোলে।

তবে সে-রাতে মোক্তার মোছলেহউদ্দিনের মেয়ে সকিনা খাতুন বিচিত্র কান্নার আওয়াজটি শুনতে পায়।

একদিন তারা গভীর রাতে কামলাতলা বিল থেকে খেদমতুল্লার লাশটি উদ্ধার করে চাঁদবরণঘাটের বাড়িতে নিয়ে আসে। আমেনা খাতুন বা মুহাম্মদ মুস্তফা লাশটি প্রথমে শনাক্ত করতে পারে নি, কারণ দা-এর নির্মম আঘাতে খণ্ড-বিখণ্ড মাথা-মুখের শনাক্তযোগ্য অবস্থা ছিল না। তারপর আমেনা খাতুনের চোখ পড়ে আঙটির ওপর এবং সে-আঙটি দেখেই রাতের নীরবতা বিদীর্ণ করে সে আর্তনাদ করে ওঠে; বেশ কয়েক বছর আগে ব্যবসায়ে সর্বপ্রথম কপাল খুললে সদর শহরে এক জহুরীর দোকান থেকে বড় শখ করে খেদমতুল্লা লালপাথর বসানো সোনার আঙটিটি কিনেছিল।

আমি তখন চাঁদবরণঘাটে বেড়াতে এসেছিলাম। আমেনা খাতুনের আকস্মিক আর্তনাদ নিঃসন্দেহে আমার নিদ্রা-অবশ কানে পৌঁছেছিল, কিন্তু সে-আর্তনাদ জেগে উঠেই থেমে গিয়েছিল বলে ঘুমটা ভাঙে নি, আর্তনাদটিও আমার স্বপ্নে রহস্যময় গুহাগহ্বরে বার-কয়েক প্রতিধ্বনিত হয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকবে। তারপর হয়তো গভীর নীরবতার জন্যে এক সময়ে বুঝতে পারি কোথাও অসাধারণ কোনো ঘটনা ঘটেছে; এ সব ঘটনা শুধু শব্দের মধ্যে দিয়ে নয়, নিঃশব্দতার মধ্যে দিয়েও আত্মপ্রকাশ করে থাকে।

আমি যখন ভেতরের বারান্দায় উপস্থিত হই ততোক্ষণে যারা খেদমতুল্লার মৃতদেহটি বহন করে নিয়ে এসেছিল তারা একটি সাদা চাদর দিয়ে মৃতদেহটি ঢেকে লণ্ঠন হাতে চাঁদহীন অন্ধকার রাতের মধ্যে দিয়ে ফিরতি-পথ ধরেছে। প্রথমে মাতা পুত্রকে দেখতে পাই। বারান্দার মধ্যখানে একটি লণ্ঠন জ্বলছিল। সে-আলোতে দেখতে পাই আমেনা খাতুন একটি পিঁড়ির ওপর নিশ্চল হয়ে বসে, মুখে স্তব্ধভাব কিন্তু বেদনা বা আঘাতের কোনো আভাস নেই, চোখে অশ্রু নেই। অদূরে হাঁটু তুলে পায়ের ওপর ভর দিয়ে চৌদ্দ বছরের ছেলে মুহাম্মদ মুস্তফাও বসে, দৃষ্টি মেঝের দিকে। তারপর বাঁদিটিকেও দেখতে পাই। রান্নাঘরের পাশে তার ঘর থেকে উঠে এসে বারান্দার প্রান্তে সে পা ঝুলিয়ে বসেছে। শুধু তারই দৃষ্টি মৃতদেহটির ওপর : চোখে বিহ্বলতা, যে বিহ্বলতা কেমন যেন জমে গিয়েছে কারণ বোধ-বুদ্ধির স্রোত কোথাও সহসা থেমে পড়েছে। এবার আমার নজর পড়ে দেয়াল-ঘেঁষে-রাখা সাদা চাদরে আবৃত লাশটির ওপর। তবু তখনো সবটা বুঝি নি। চাদরের নিচে নিথর দেহ-মুখের অস্ফুট রেখাগুলির অর্থোদ্ধার করবার চেষ্টা করছি এমন সময় দূরে কোথাও একটি হুতুম পাখির ডাক শুনতে পাই। হুতুম পাখি নিত্যই ডাকে, তবে আমার সহসা কেমন মনে হয় সে-ডাক কখনও শুনি নি। হয়তো মনে একটি প্রশ্ন দেখা দিয়ে থাকবে : হুতুম পাখি ডাকছে কেন? তারপর এক সময়ে কোনো পূর্বাভাস না দিয়ে বৃষ্টি নাবে, যে-বৃষ্টির আওয়াজও চিনতে কষ্ট হয়; বৃষ্টিটা যেন মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে নয়, রাত্রির অন্ধকার থেকেই ঝরছিল, পানি নয়, উপছে-পড়া পরিপূর্ণ স্তব্ধতা। বাঁদি মেয়েটি না নড়ে বারান্দার প্রান্তে বসে থাকে, শীঘ্র তার মুখ, তার নগ্ন হাত-বাহু এবং শাড়ি ভিজে ওঠে। ক্রমশ সবই আমার কাছে বিস্ময়কর ঠেকে : মাতা-পুত্রের এবং বদিটির নিশ্চল হয়ে বসে থাকা, প্রায় অদৃশ্যভাবে ঝরতে-থাকা বৃষ্টি। রহস্যভেদ করবার জন্যেই যেন সাদা চাদরে আবৃত মৃতদেহটির দিকে আরেকবার দৃষ্টি দেই। এবার কী করে চাদরের মধ্যে দিয়ে জেগে-থাকা নিথর মুখের অস্ফুট রেখাগুলি একটা অর্থ গ্রহণ করে, যদিও কিছু দেখা সম্ভব হয় না তবু বুঝতে পারি খেদমতুল্লা আর হুঙ্কার দেবে না; যে-হুঙ্কার গত ক-বছরে পশুর আর্তনাদের মতো হয়ে উঠেছিল, মানুষের মনে অকথ্য সন্ত্রাস সৃষ্টি করত, সে হুঙ্কার আর কেউ শুনতে পাবে না।

তারপর ধীরে-ধীরে পূর্বাকাশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে, একটি নূতন দিন শুরু হয়।

সেদিনই মুহাম্মদ মুস্তফা উক্তিটি শুনতে পায়। কেউ বলে, বদলোকের নছিবে অপঘাতে মৃত্যুই বরাদ্দ থাকে।

কেবল সেদিন কথাটি সে বুঝতে পারে নি। পরে ধীরে-ধীরে, খণ্ড-খণ্ডভাবে সব জানতে পায়। সে জানতে পায়, তার বাপ অতিশয় দুর্বৃত্ত মানুষ ছিল। সে জানতে পায়, অনেক মানুষকে তার বাপ ধ্বংসের পথে বসিয়েছিল, হক-দাবি-প্রাপ্য থেকে তাদের বঞ্চিত করেছিল, নিরপরাধ শিশুদের জীবনের জন্যে দণ্ডিত করেছিল। কখনো ইঙ্গিতে বলা কোনো কথায়, কখনো নির্দয়ভাবে দেয়া বৃত্তান্তসমৃদ্ধ বিবরণে, কখনো তীব্র ঘৃণাভরা কণ্ঠে নিক্ষিপ্ত অভিযোগে, কখনো আবার স্পষ্টতই পরস্পরবিরোধী বিবৃতিতে-এ-সবে মিলে মুহাম্মদ মুস্তফার মনে ক্রমশ যে-মানুষের চিত্র স্পষ্টাকার রূপ ধারণ করে সে মানুষকে সে যে চিনতে পারে তা নয়, তবু তাকে প্রত্যাখান করতেও সাহস হয় না তার। কখনো-কখনো তার মনে হয় সে যেন এমন একটি মানুষের কথা শুনছে জীবনে। যার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। ঘোর পাপিষ্ঠ মানুষের জীবনে উদ্দেশ্য থাকে; লোভ হিংসা হীনতা নীচতা নিষ্ঠুরতার দ্বারা তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইলেও সে উদ্দেশ্যহীন নয়। উদ্দেশ্যহীন মানুষ আর মানুষ নয়, সে অমানুষ। তার বাপ খেদমতুল্লা কি অমানুষ ছিল? তবে এই প্রশ্নটিও স্পষ্টভাবে জিজ্ঞাসা করতে তার সাহস হয় নি। সে শুনে যায়, এবং হয়তো প্রত্যেক কথাই গ্রহণ করে বিনা প্রশ্নে, তা যতই নিষ্ঠুর বা বেদনাদায়ক হোক না কেন। হয়তো তার জন্মদাতার বিষয়ে যা সে শোনে তার সত্যাসত্য বিচার করার প্রয়োজনও দেখে না : বাপ খেদমতুল্লা দুর্বৃত্ত  তোক ছিল তা একবার গ্রহণ করে নেবার পর কোথায় কে একটু অতিরঞ্জন করেছে বা কোথায়- বা ঈষৎ বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে-এ-সবের বাছাই-ছাঁটাই অবান্তর মনে হয় তার কাছে। বাপের শাস্তিটা অপরাধের তুলনায় যে মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে তেমন কথা মনে হয়ে থাকলে আবার হয়তো ভেবেছে, সে-বিষয়ে চুলচেরা বিচার অর্থহীন এই কারণে যে একটি বিশেষ স্তর পেরিয়ে যাবার পর মানুষের পাপ-দুষ্কর্ম আইনের দাঁড়িপাল্লায় হয়তো ওজন করা যায় কিন্তু অন্তরের দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা যায় না। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাকে উপদেশ দেয়, যে বা যারা কামলাতলা বিলে জঘন্য কাজটি করেছে তার বা তাদের যথাবিধি শাস্তি বিধান হওয়া উচিত, কারণ খেদমতুল্লা সৎলোক ছিল না বটে কিন্তু তার খুনের কথা নির্বিবাদে গ্রহণ করা যায় না। তবে এই উপদেশটি তাকে বিস্মিত করে, যেন খেদমতুল্লার দুর্বৃত্ত চরিত্রের কথা গ্রহণ করে নিলেও কেউ যে তাকে নির্মমভাবে খুন করে থাকবে, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারে নি। হয়তো ছেলের পক্ষে তার বাপ সম্বন্ধে প্রথম কথার চেয়ে দ্বিতীয় কথাই গ্রহণ করা দুষ্কর। লোকেরা তাকে এ-কথাও বলে, যে বা যারা নিষ্ঠুর হত্যার জন্য দায়ী তার বা তাদের সন্ধান। পাওয়া তেমন কঠিন কাজ নয়; বস্তুত একটি নাম সকলেই কানাঘুষায় শুনতে পেয়েছিল। কিন্তু সে-বিষয়েও সে কোনো ঔৎসুক্য প্রকাশ করে নি।

তখন মুহাম্মদ মুস্তফা নাবালক। তবে সাবালক হওয়ার পরেও কোনো ঔৎসুক্য দেখায় নি।

মুহাম্মদ মুস্তফার মনোভাব থেকে-থেকে অনেকদিন আমাকে কেমন বিচলিত করেছিল। সে কোনো-প্রকার জিঘাংসা বোধ করে নি বলে নয়, অতি সহজে বিনাবাক্যে তার জন্মদাতার দুর্বৃত্ত চরিত্রের কথা মেনে নিয়েছিল বলে এবং কে যে তার খুনী সে বিষয়ে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করে নি বলে অন্তরে কী-একটা বিহ্বলতা, কী একটা ব্যথা অনুভব করতাম। মনে হত তার আচরণ রক্তসম্বন্ধশূন্য মানুষের মতো যেন। বাপ অতিশয় দুর্বৃত্ত  লোক-সে-কথা ছেলে হয়েও অনাত্মীয় মানুষের মতো স্বীকার করে নিয়েছে, অনাত্মীয় মানুষের মতো অপরাধীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার জন্যে কোনো বিশেষ আগ্রহ বোধ করে নি, এমনকি তাদের মতোই যেন বিশ্বাস করে কেউ যদি।

খেদমতুল্লার দুস্কৃতির বদলা নেবার জন্যে তাকে খুন করে থাকে তবে খুনীর দোষটা তেমন গুরুতর নয়। তবে আমি আমার কিছু বিহ্বল কিছু বিচলিত মনকে প্রবোধ দেই এই বলে যে, মুহাম্মদ মুস্তফার চরিত্রটা তেমনই : ছোট-বড় সাধারণ-অসাধারণ সব কথা সে সহজে বিনাবাক্যে গ্রহণ করে নেয়।

খেদমতুল্লার মৃত্যুর কিছুদিন পরে চাঁদবরণঘাটের বাসাবাড়িটা পানির দরে বিক্রি করে মাতা-পুত্র গ্রামের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করে। কিছুদিন মনে-প্রাণে নিঝুম হয়ে থাকার পরে মুহাম্মদ মুস্তফা একটি বিষয়ে দৃঢ়সংকল্প হয়; সে পড়াশুনা বন্ধ করবে না, যেমন করে হোক স্কুল শেষ করবে, তারপর সম্ভব হলে কলেজে এবং আরো পরে বিশ্ববিদ্যালয় যাবে। শীঘ্র সংকল্পটি সে কার্যে পরিণত করতে উদ্যত হয়। তারপর ধীরে-ধীরে, পায়ে-পায়ে সে এগিয়ে যায়, কোথাও যে যাচ্ছে সে-কথা না ভেবে, একে একে সব প্রতিবন্ধক যে পেরিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে সচেতন না হয়ে। প্রথমে তেমন আর্থিক সঙ্কট দেখা দেয় নি। তবে শীঘ তা বিষম সমস্যায় পরিণত হয়। এত শঠতা অসৎ কলাকৌশল সত্ত্বেও খেদমতুল্লা কেবল সামান্য কিছু জমিজমাই রেখে গিয়েছিল। সে-জমিজমাও ধরে রাখা সম্ভব হয় নি, রাখার চেষ্টাও সে করে নি; অসৎ মানুষ যদি সদুপায়ে কিছু সংগ্রহ করে থাকে তাও কলঙ্কময় এবং না-জায়েজ মনে হয়। কঠোর পরিশ্রম এবং একনিষ্ঠতার দ্বারা সর্বপ্রতিবন্ধক সকল প্রকারের বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে সক্ষম হয় মুহাম্মদ মুস্তফা।

ধীরে-ধীরে মুহাম্মদ মুস্তফার মধ্যে কেমন পরিবর্তন এসে যায়। সে মাত্রাতিরিক্তভাবে নিরীহ নম্রভদ্র হয়ে পড়ে। তবে সে-নিরীহতা নম্রতা ভদ্রতা এমনই যে সে-সব তাকে যেন কেমন নিশ্চিহ্ন করে ফেলে; মানুষের পরিবর্তে সে একটি ছায়ায় পরিণত হয়। সে যে অসামাজিক হয়ে ওঠে বা অন্যদের কাছ থেকে লুকিয়ে বা আলাদা হয়ে থাকে তা নয়, বরঞ্চ বেশ নিয়মিতভাবে সামাজিক বা মাজহাবি জামাতে-বৈঠকে হাজির হতে থাকে। তবে এ-সামাজিকতার আসল উদ্দেশ্য যেন তার বিষয়ে সমাজের কৌতূহল এড়ানোই; সে যেন বুঝতে পারে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ না করার, এমনকি গা ঢাকা দিয়ে থাকার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় সমাজের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা। এ-সময়ে মজলিস-মাহফিলে উপস্থিত হলে তার উপস্থিতির বিষয়ে কদাচিৎ মানুষেরা সজ্ঞান হত এবং কখনো তার কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও সে যা বলত তা মানুষেরা পরমুহূর্তেই ভুলে যেত কারণ কথা বলেও সে কখনো বিশেষ কিছু বলত না : যেন ক্বচিৎকখনো সে মুখ খুলত কেবল তার হাজিরা ঘোষণা করার জন্যে। হাসিও তেমন দেখা যেত না তার মুখে। যদি-বা কখনো ক্ষীণভাবে হাসত সে-হাসির মধ্যে কখনো কোনো তারতম্য ধরা পড়ত না, একই হাসির সাহায্যে সে প্রভূত মনোভাব ব্যক্ত করত : কৃতজ্ঞতা, আনন্দ, লজ্জা, বিস্ময়, সম্মতি-অসম্মতি। দুর্লভ ঈষৎ হাসিটির ব্যাখ্যার ভার পড়ত দর্শকের ওপর। তবে তা ব্যাখ্যা করে দেখার আগ্রহ কেউ তেমন বোধ করত কিনা সন্দেহ। বস্তুত, মুহাম্মদ মুস্তফা এমনভাবে নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে সক্ষম হয় যে চোখের সামনে সে বসে থাকলেও অনেক সময়ে কেই সহসা বলে উঠত, কোথায় গেল মুহাম্মদ মুস্তফা?

কখনো-কখনো আমার মনে হত, এ-সবের মধ্যে কোথায় যেন একটি গূঢ় অর্থ। মুহাম্মদ মুস্তফা অনেক কথাই বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছে, যে-সব ছেলের পক্ষে অতিশয় দুর্বিষহ। তার বাপ খেদমতুল্লা দুর্বৃত্ত  লোক ছিল; তার দুষ্কৃতির শাস্তিও অনিবার্য, সে শাস্তি মানুষই দিক আর খোদাই দিক; এবং যারা তাকে শাস্তি দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পোষণ করাও অন্যায়, কারণ অভিযোগের অধিকার কারো যদি থেকে থাকে তা তাদেরই ছিল। তবু দুর্বৃত্ত  বাপের প্রতিও ছেলের কি কোনো দায়িত্ব নেই? হয়তো সে-দায়িত্বের কথা বুঝিয়ে বলা শক্ত; পিতা-পুত্রের মধ্যে দায়িত্বের ব্যাপারে তাদের রক্তসম্বন্ধের মতোই রহস্যময় যা সাধারণ বুদ্ধির বহির্গত। কেবল সে-দায়িত্ব সম্বন্ধে বিস্মৃত হওয়া কোনো ছেলের পক্ষে সম্ভব নয়। সে-দায়িত্বের কথা ভুলে ছেলে যদি তার জীবন গড়ার চেষ্টা করে এবং গড়ে তুলতে সক্ষমও হয়, তার জীবন কি চোরাবালির ওপরই গড়া হবে না, তার সঙ্গে কি একটি অবাস্তবতা একটি অসত্যতা চিরদনিই জড়িত থাকবে না? যে-দায়িত্ব প্রতি মুহূর্তে রক্তের স্রোতে অশান্তির ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি করে, সর্বদা কী-একটা অস্বস্তিকর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তা অস্বীকার করা যায় না। হয়তো কী-করে এই কথা বুঝে সে স্থির করে, নিজের সততা সচ্চরিত্রতার সাহায্যে বাপের কলঙ্ক দুর্নাম মুছে ফেলবে, নিজের নিরীহ সজ্জনতার দ্বারা তার দুর্বৃত্ত  চরিত্রের স্মৃতি নিশ্চিহ্ন করে দেবে : সন্তানের সুচরিত্র পিতার দুশ্চরিত্র সম্পূর্ণভাবে ঢেকে ফেলবে একদিন। হয়তো এই জন্যেই তার চরিত্রে এমন একটি পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল।

তবে তেমন কথা ভাবতে ভালো লাগলেও জানতাম, আসলে জীবন সম্বন্ধে কী একটা নিদারুণ ভীতিই তাকে ক্রমশ আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। এমন মানুষ নিজের কণ্ঠস্বরেও আতঙ্কিত হয়। এরাই নিজেদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলে।

তবারক ভুইঞা বলছিল : যেদিন ঘাট থেকে ফ্ল্যাট সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিন রাতেই মোক্তার মোছলেহউদ্দিনের মেয়ে সকিনা খাতুন একটি বিচিত্র কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। তখন হয়তো গভীর রাত, কী কারণে ঘুমটা হাল্কা হয়ে উঠেছিল। আওয়াজটি শুনতে পেলে সে সম্পূর্ণভাবে জেগে ওঠে। কিন্তু শীঘ্র আওয়াজটি সহসা থেমে যায়। তারপর সে-ও আবার নিন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

সকিনা খাতুন মেয়েদের মাইনর স্কুলে মাস্টারনীগিরি করে। পরদিন সকালে সে স্কুলে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে এমন সময়ে আবার আওয়াজটি শুনতে পায় : কোথায় একটি নারী কাঁদছে। কে কাঁদে, কোথায়ই-বা কাঁদে? তবে স্কুলের তাড়াতাড়িতে সে বিষয়ে তখন বিশেষ ভাবা হয়ে ওঠে নি, সারা দিন কথাটি মনেও পড়ে নি। সন্ধ্যার পর আবার আওয়াজটি শুনতে পায়। এবার বেশ স্পষ্টভাবেই শুনতে পায়। নিঃসন্দেহে কণ্ঠটি কোনো নারীর, আওয়াজটা যেন নদীর দিক থেকে আসছে।

তারপর থেকে সময়ে-অসময়ে সে কান্নাটি শুনতে পায়-যে কান্না কখনো আচমকা ঝড়ের মতো কখনো ধীরে-ধীরে বিলম্বিত বিলাপের মতো শুরু হয়। কী কারণে কান্নাকাটির কথা প্রথমে অন্যদের কাছ থেকে গোপন করে রাখে, যেন ব্যাপারটি বুঝতে পারে না বলে সে-বিষয়ে চুপ থাকা বুদ্ধিসঙ্গত মনে করে। কান্নাটি যেন কেমন। তাছাড়া যখন-তখন শুনতে পেলেও যখন তা শুনতে পায় না তখন ভাবে, সত্যিই সে কি কিছু শুনতে পায়? গোপন রেখে এ-ও তার মনে হয়, বালিকাবয়সে যেমন ছড়ার কথার গোপন করে রাখত তেমনি কিছু করছে। ছড়ার কথা কখনো কাউকে বলে নি। তার ঠোঁটের নিঃশব্দ সঞ্চালন লক্ষ্য করে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করত সে কী বলছে, সে নির্বিকারভাবে উত্তর দিত, কিছু না সে-সময়ে থেকে-থেকে নিঃশব্দে ঠোঁট সঞ্চালন করে সে একটি ছড়া আবৃত্তি করত। ছড়াটি এখনো তার মনে পড়ে : ক-এ কলাগাছ আর কচুরিপাতা কলমিশাক খাই, কঞ্চি আনো কলমকাঠি ক লিখিরে ভাই। ছড়াটি আবৃত্ত করার কোনো অর্থ ছিল না, কেবল তা এমনি একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল যে কখন শব্দগুলি অন্তরের কোন্ নিভৃত কক্ষ থেকে উঠে এসে তার ঠোঁটে নিঃশব্দ তরঙ্গের সৃষ্টি করত নিজেই বলতে পারত না। কোনো-কোনদিন তার মায়ের মুখে-চোখে আশঙ্কা দেখা দিত। মা জিজ্ঞাসা করত, কী বিড়বিড় করছিস? মায়ের মুখে-চোখে আশঙ্কা অনুমান করে তার দৃষ্টি এড়িয়ে সে-দিন রাগতভাবে বলত, কোথায় বিড়বিড় করছি? মধ্যে-মধ্যে সহসা মুখে লজ্জার ঝাঁজও ধরত, মুদ্রাদোষটির সত্যি কোনো অর্থ নেই। তবু ছড়ার কথা কোনোদিন কাউকে বলে নি, জারুনার মা নামক মেয়েলোকটির নামও তোলে নি যদিও মেয়েলোকটির কথা ছড়ার মতোই সে-সময়ে অহরহ মনে জাগত, তার মুখটিও মানসচোখে ভেসে উঠত, বিশেষ করে তার ফোকলা দাঁত এবং আকর্ণ দিলখোলা হাসিটি। সেই সম্পূর্ণ অশিক্ষিতা মেয়েলোকটির কাছে ছড়াটা শিখেছিল। মেয়েলোকটি বলত, মনের কথা কখনো ফাঁস করতে নেই। সকিনা খাতুনও মনের কথা গোপন করত, করে একটি গভীর তৃপ্তি অনুভব করত এই ভেবে যে সে নিজস্ব একটি গোপন জগৎ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে যে-জগতে কারো প্রবেশের অধিকার নেই। জারুনার মার কাছে একটি নয়, অনেক ছড়া শিখেছিল, যার একটি বলতে গেলে ছুঁচে বিঁধেই তার অন্তরে স্থান নিয়েছিল। সে-দিন জারুনার মা জাদুকরের হাত-সাফাইর ভঙ্গিতে ধাঁ করে তার দুটি কানের তুলতুলে নরম প্রান্ত ছেঁদা করে দিয়েছিল। ব্যাপারটা বোঝার পর পিঁড়িতে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থেকে আস্তে হাত তুলে কান স্পর্শ করে দেখে সেখানে না ঝুমকো না কোনো দুল, কেবল দুটি ক্ষুদ্র কাঠির মতো কী যেন সদ্য ফুটানো ছিদ্র দুটি দখল করে রয়েছে। পরে সেখানে ঘায়ের মতো হয়, একটু ব্যথা ব্যথা করে, এবং কান ছেদার উপলক্ষে তার বাপ সরু আংটির মতো একজোড়া যে সোনার অলঙ্কার তাকে এনে দিয়েছিল তা বেশ কিছুদিন পরতে পারে নি। কেন পরতে পারে নি সে-কথাও তার মাকে বলে নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *