১৬. আমজাদ একদিন খবর আনিল

আমজাদ একদিন খবর আনিল, শৈরমীর পুত্র মারা গিয়াছে। তার পঙ্গু জীবনের অবসানে জননী অন্তত সোয়াস্তি পাইবে। দরিয়াবিবি পুত্রের সঙ্গে সেইসূত্রে নিজেদের বহু কাহিনী টানিয়া আনিল। বেচারা শৈরমী।

দরিয়াবিবি বলিয়াছিল, শৈরমীকে একবার ডেকে আনবি। মোনাদির ও আমজাদ বাগ্‌দীপাড়া হইতে পরদিন ফিরিয়া আসিল। শৈরমীও শরমী ও শয্যাশায়ী। প্রতিবেশীরা এতদিনে তার প্রতি কৃপাপরবশ। শৈরমীর দূরাত্মীয়া এক বিধবা ননদ তার সেবা শুশ্রূষার ভার লইয়াছে।

আরো দুইদিন কাটিয়া গেল। আমজাদ রোজই তার খবর লইয়া আসে।

আজ অপরাহ্নে আসিয়া সে বলিল : মা, শৈরমী পিসি আর বাঁচবে না।

বাঁচবে না! দরিয়াবিবি ম্রিয়মাণ মুখে পুত্রের দিকে চাহিয়া রহিল।

না গো, মা। একে পাতলা চেহারা, রোগে-শোকে বুড়িকে চেনা যায় না।

দরিয়াবিবি এই বাগদী রমণীর সখিত্বের বহু স্মৃতি স্মরণপথে টানিয়া আনিল। বন্ধক ঘড়াটি আর ছাড়ানো হয় নাই। মাসে সংসারের খরচ বাড়িতেছে। আয়ের সংস্থান কোথায়? চন্দ্র কোটাল নূতন কোনো ব্যবসা দিবার আয়োজন করিতেছে। মূলধনহীন কোনো ব্যবসা আরম্ভ করা যায় কিনা। কয়েক মাসে শুধু যুক্তি-পরামর্শই সার হইয়াছে। দরিয়াবিবি ভাবিল, সন্ধ্যায় একবার দেখা যাক, ঘড়া ছাড়ানোর টাকাটা যদি কোথাও থেকে যোগাড় করে আনতে পারি। প্রাচীন সামগ্রী ঘরছাড়া হইবে। কিন্তু শৈরমী কার কাছে বন্ধক রাখিয়া আসিয়াছে, সে জানে না।

দরিয়াবিবি আবার জিজ্ঞাসা করিল, বাঁচবে না?

আমজাদ মাথা দোলাইল : না গো, মা।

মোনাদির তার সঙ্গে গিয়াছিল, সেও মন্তব্য সমর্থন করিল।

ঘড়া চুলোয় যাক, একবার শৈরমীর সঙ্গে কি দেখাও হইবে না! এই চিন্তা দরিয়াবিবিকে বেশি পীড়িত করিতেছিল। বাগ্‌দীপাড়া দূর নয়। পনেরো মিনিটের পথ। গা ঢাকা অন্ধকারে আব্রু ও পর্দা বাঁচাইয়া সে সহজেই শৈরমীকে দেখিয়া আসিতে পারে। কিন্তু আজহার রাজি হইবে কি? এই একটি বিষয়ে দরিয়াবিবি আজহারকে ভয় করে। চাষীবাসীর সংসারে পর্দার অত ঝামেলা নাই। পাড়াপড়শীদের সঙ্গে দরিয়াবিবি স্বচ্ছন্দে দেখা করিতে যায়। কিন্তু ভিন পাড়ার, বিশেষ করিয়া বাগ্‌দীপাড়ার ব্যাপারটা প্রকাশ হইয়া পড়িলে মুসলমান পাড়ায় আর তাদের কোনো ইজ্জত থাকিবে না।

হৃদয়ের ঐশ্বর্য জাতিধর্মের বালাই লুকাইয়া রাখে। শৈরমীর সরল প্রাণের পরিচয়পত্র যতই দরিয়াবিবির নিকট গাঁথা স্মৃতির সড়ক বাহিয়া উড়িয়া আসিতে লাগিল, সে ততই অস্থির হইয়া উঠিল। আমজাদের ছোটবেলায় একবার খুব ম্যালেরিয়া হয়। জীবনের কোনো আশা ছিল না। শৈরমী প্রতিদিন তাকে দেখিতে আসিত। একদিন সে কয়েকটি বাতাসা আনিয়া দরিয়াবিবির হাতে দিয়াছিল।

কী হবে, শরীদি?

খোকাকে খাইয়ে দাও একটা।

 কিসের বাতাসা?

শৈরমী মিথ্যা কথা বলে নাই। গ্রামের বারোয়ারতিলায় শিবালয়ে সে হরির লুট দিয়া আসিয়াছে আমজাদের নামে। তারই বাতাসা। ধর্মে বাধেই তো। দরিয়াবিবির মনেও খটকা লাগিয়াছিল। মরণাপন্ন পুত্রের শিয়রে দরিয়াবিবি কারো প্রাণে আঘাত দিতে রাজি ছিল না। যদি বাছার গায়ে বদদোয়া লাগে। শৈরমীর সম্মুখেই সে আমজাদকে বাতাসা খাইতে দিয়াছিল। আল্লা কি মানুষের মন দেখেন না, যিনি সব দেখেন? অখ্যাত পল্লীর জননী-হৃদয়েও সেদিন এই প্রশ্নই বারবার জাগিয়াছিল।

প্রত্যহ শৈরমীর জীবনের বহু অধ্যায় কল্পনায় পাঠ করিতে লাগিল দরিয়াবিবি। দুঃখের দিনে প্রতিবেশীদের কাছে যে লজ্জা বিরাট দীনতার প্রকাশ, দোসর পাইলে তার চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট থাকে না। শৈরমীর মতো দোসর দরিয়াবিবির দৈনন্দিতায় আকস্মিক আসিয়া জুটিয়াছিল।

তোর পিসি কথা বলতে পারে, আমজাদ?

বড় ক্ষীণ গলার আওয়াজ।

একবার তাকে দেখতে যেতে ইচ্ছে করে।

আমজাদও মুরুব্বি চালে বলিল, তুমি বাগ্‌দীপাড়া যাবে?

যেতে দোষ কী? তারা মানুষ নয়?

 মোনাদির বলিল : মা, তুমি অতদূর যেতে পারবে না, তোমার এই শরীর?

দরিয়াবিবি নিজের শরীরের দিকে চাহিয়া লজ্জিত হইল। তার স্ফীত জঠর পুত্রের চোখেও ধরা পড়িয়াছে। আর এক সমস্যা। পূর্ণ গর্ভবতী একটি মেয়ে নিশাচর সাজিয়া বাগ্‌দীপাড়া গিয়াছে শুনিলে আজহার তাকে খুন করিয়া ফেলিবে। এই ব্যাপারে স্বামী কেউটে সাপের চেয়েও বিপজ্জনক। অথচ কত নিরীহ আজহার। এই নিরীহ লোকটি ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের ত্রুটি দেখিলে কেন এইরূপ রক্তোন্মত্ত হইয়া যায়, দরিয়াবিবি ভাবিতে লাগিল।

পরামর্শ ঠিক হইয়া গেল তিনজনের মধ্যে। আজহার ঘুমাইয়া পড়িলে আমজাদ, মোনাদির ও দরিয়াবিবি শৈরমীকে দেখিতে যাইবে। শুধু-হাতে রুগ্ন সখীর নিকট যাওয়া অশোভন। অন্তত দুআনা পয়সা দরকার। যা হাতটান। সে ভার গ্রহণ করিল আমজাদ। আশেজ্জানের নিকট হইতে সে দুআনা পয়সা আদায় করিয়া আনিবে।

সুযোগ আসিল সহজে। সারাদিনের খাটুনির পর আজহার ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল সেদিন। তিনজনে গ্রামের অন্ধকার পথে পাড়ি দিল।

ফিসফিস কণ্ঠে পথ চলার সময় দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল : আমজাদ, পথ চিনিস?

খুব। রোজ এই রাস্তা চষে ফেললাম।

মোনাদির পথটির সহিত বিশেষভাবে পরিচিত নয়, সে চুপ করিয়া রহিল।

সরু সড়কের পাশে ঘন ঝোঁপজঙ্গল। বাতাস বহিতেছিল। পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির আকাশ বিহারের মতো নেশা লাগে দরিয়াবিবির গায়ে। ঘরের আনাচ, কানাচ, বড়জোর প্রতিবেশীদের সীমানা ছাড়াইয়া পৃথিবীকে দেখিবার খুব বেশি সুযোগ ঘটে নাই তার।

প্রহর দুই রাত্রি অতীত। চাষীদের সদরে পিদিম জ্বলিতেছে এখনও। তাসের আড্ডা চলিয়াছে বোধহয়। পথে লোকজন নাই। দরিয়াবিবি নিঃসঙ্কোচেই হাঁটিতেছিল। অন্ধকারেও সরুপথের শুভ্র দাগ চকচক করিতেছে।

শৈরমীর ঘরে ঢুকিয়া দরিয়াবিবি শিহরিয়া উঠিল। ঝুপড়ি ঘর। পুরাতন হাঁড়িকুঁড়িপূর্ণ। ময়লা মাদুরের উপর আরো ময়লা একটি বালিশ মাথায় শৈরমী শুইয়াছিল। ঘরের চারিদিকে কোনো জানালা নাই। ঝড়ের উপদ্রব জীর্ণ কুটিরের পাঁজরে সহ্য হইবে না, তাই এই ব্যবস্থা সহজে মানিয়া লয় গরিব কৃষকেরা। দম আটকাইয়া যাইতেছিল দরিয়াবিবির। তবু মমতার বিজয়ী আহ্বান সব অসোয়াস্তির চিহ্ন মুছিয়া ফেলে। শৈরমী চোখ খুলিয়া বিস্ময়ে অনেকক্ষণ চাহিয়া রহিল।

দরিয়াবিবি ডাক দিল, সই।

শৈরমী জবাব দিল না। হাত-ইশারায় উপবেশন করিতে অনুরোধ করিল। দরিয়াবিবি দ্বিরুক্তি করিল না। শৈরমীর আত্মীয়া শিয়রে বসিয়া পাখা দোলাইতেছিল।

দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল, এখন কেমন আছে?

কোথায় ভালো, মা।

আত্মীয়া মেয়েটি ম্রিয়মাণ কণ্ঠে জবাব দিল।

আবার ডাক দিল দরিয়াবিবি : সই। কেমন আছ?

গলায় কফ জমিয়াছিল শৈরমীর। ঘড়ঘড় শব্দ হয় শ্বাসনালীর ভিতর। সে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করিল।

নারীকণ্ঠের ক্ষীণ শব্দ শোনা গেল : ভালো-ভালো।

আবার হাঁপাইতে লাগিল শৈরমী। বিধবা মেয়েটি আদিখ্যেতা শুরু করিল : কপাল দেখো, মা। গরিব আমরা, দেহটা যদি ভালো থাকে। শোকের ওপর আবার এই রোগ। ভগবানের কি ফুটো চোখও একটা আছে?

দরিয়াবিবির দিকে অদ্ভুত ক্লান্ত স্তিমিত দৃষ্টি মেলিয়া শৈরমী চাহিয়াছিল, চোখের পাতা আর পড়ে না। দরিয়াবিবিরও চক্ষু ফিরাইবার সামর্থ্য ছিল না যেন।

শৈরমী এবার গলা পরিষ্কার করিল কয়েকবার খকখক কাশিয়া।

 সই, ভালো হই, যাব।

দরিয়াবিবি তার রেখাঙ্কিত ময়লা হাতটি স্পর্শ করিয়া দেখিল। জ্বর নাই বোধ হয়। শীতল, ঠাণ্ডা হাত।

হ্যাঁ, এসো আবার।

 মাথা দোলাইল শৈরমী।

সই।

 সই।

তোমার ঘড়াটা, জয়া দাও তো। কথা বলিতে রীতিমতো কষ্ট হইতেছিল শৈরমীর, ঘরের হাঁড়িকুঁড়ির জঙ্গলের দিকে সে হাত বাড়াইল।

আবার মৃদু ঠোঁট সঞ্চারিত হইল : আমি– আমি ছাড়িয়ে এনে রেখেছিলাম, টাকাটা আমার হাতে দিও।

শৈরমীর চোখের কোণ হইতে অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। জয়া একটি পিতলের ঘড়া দরিয়াবিবির সম্মুখে রাখিল। সে-ও দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া ব্যজনরত হইল।

শৈরমীর চোখমুখ দেখিয়া মনে হয়, বহু-কথন প্রয়াসী সে। কিন্তু চুপ করিয়া রহিয়াছে। শ্বাসনালীর শব্দ আরো দ্রুত হইতেছে। বসিয়া রহিল দরিয়াবিবি নির্মম পাথরের মতো। দারিদ্রের হিংস্র রূপ তার কাছে অপরিচিত নয়। কিন্তু এত বিভীষিকাময় তার অট্টহাস্য, দরিয়াবিবি আর কোনোদিন শোনে নাই, শিহরিয়া উঠিতেছিল সে বারবার।

চৌকিদার প্রহর হাঁকিয়া গেল। ছেলে দুটি নির্বোধ দর্শকের মতো বসিয়াছিল। তাহাদের চোখের পাতায় ঘুম। দরিয়াবিবি আর বিলম্ব করিল না। জয়ার হাতে দুয়ানিটি খুঁজিয়া দিয়া বিদায় লইল। তবু একজন সমব্যথী পাইয়াছে শৈরমী। মেয়েটি ভিটার নিচে আগাইয়া আসিল।

কপাল মা। তবু ভিন পাড়া থেকে এসে দেখে গেলে। কেউ চোখও দেয় না। রাতটা কাটবে না। আর দেরি করব না। কফটা আবার এলো কিনা।

দ্রুত চলিয়া গেল জয়া।

ঘড়াটি মোনাদিরের বগলদাবা। আকাশে মেঘ জমিয়াছিল। চাঁদ আরো ঘনীভূত অন্ধকারে হারাইয়া গিয়াছে। জঠরের সন্তানের প্রতি মমতাবশতই বোধহয় দরিয়াবিবি সন্তর্পণে পা ফেলিতেছিল, নচেৎ চলৎশক্তি তার রহিত হইয়াছে।

ঘন বাঁশবনে বাতাসের আর্তনাদ মাথা কুটিতেছিল। হঠাৎ শৈরমীর ভিটা হইতে আকস্মিক রোদন নিনাদ শোনা গেল।

একবার থাম্‌, আমু।

 দরিয়াবিবি ক্রমশ নিরস্ত হইয়া উৎকর্ণ হইল। জয়ার বুকফাটা চিৎকার।

হ্যাঁ, চিৎকার।

আমু বলিল, মরে গেল গো পিসি।

দরিয়াবিবি দাঁড়াইয়া রহিল জড়পদার্থের মতো। রক্তমাংসের নিচে মানুষে মানুষে সঙ্গীভূত হওয়ার যে পরিপ্লাবী উৎসধারা যুগ-যুগান্তের শিকড় উৎপাটন করিয়া নব নব সভ্যতার বীজ ছড়াইয়া যায় তারই সর্বস্বীকারহীন চঞ্চল আর্তনাদ তরঙ্গের মতো দরিয়াবিবির বুকে আছড়াইয়া পড়িতেছিল। তারই আহ্বান তো এত নিশীথ রাত্রে ঘরছাড়া করিয়া আনিয়াছে তার মতো গর্ভবতী জননীকে।

দরিয়াবিবি শৈরমীর ভিটার দিকে মুখ ফিরাইল।

আমজাদ বলিল : কোথা যাও, মা। হিন্দুদের মড়া, হিন্দুদের ঘর, সেখানে গিয়ে তুমি কী করবে?

উচ্ছ্বসিত কান্নায় বুক চাপিয়া পথের উপর বসিয়া পড়িল দরিয়াবিবি।

সকালে শৈরমীর মৃত্যুসংবাদ ছড়াইয়া পড়িল। দরিয়াবিবির কেমন মায়া বসিয়াছিল বাগদী এই রমণীর উপর। সাংসারিকতার ভিতরেও সেদিন মন হাল্কা করিতে পারিল না আজহার-পত্নী।

.

মোনাদিরের জিদেই বিকালে আমিরনের বাড়ি গেল দরিয়াবিবি।

অবেলায় মুরগী হাঁস লইয়া ব্যস্ত ছিল আমিরন। বহুদিন পরে দরিয়াবিবির আগমনে সে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। আম্বিয়া মোনাদিরকে দেখিয়া মুখ টিপিয়া হাসিতে লাগিল।

দুই পল্লীরমণী সংসারের খেদোক্তি জুড়িয়া দিল। মোনাদির-আমজাদ চুপ করিয়া বসিয়া থাকার পাত্র নয়। আম্বিয়ার সঙ্গে প্রাঙ্গণ ছাড়িয়া তাহারা সড়কের ধারে আসিয়া দাঁড়াইল।

পল্লীর এই অংশে গাছপালা থাকিলেও ঘন জঙ্গল মনে হয় না। আমজাদের এইজন্য এলাকাটা খুব পছন্দ। মার্বেল খেলিবার এমন সুপ্রশস্ত চত্বর অন্যদিকে নাই।

দুই ভাই খেলা করিতে লাগিল। আম্বিয়া দর্শক মাত্র।

গাব্বুর ভেতর মার্বেল পিল করিতে করিতে মোনাদির বলিল : আম্বিয়া, তুই মতবে যাস?

মখতবে যাব না কেন? বুড়ো হতে বসেছি, লেখাপড়া শিখব না?

বড় পাকা কথা। কথার চেয়ে ঝাঁঝ আরো বেশি।–আরে আমার দাদিসাহেবা। কৈ চল, কী পড়িস দেখব।

মোনাদির মার্বেল খেলা ছাড়িয়া দিল।

চলো। আম্বিয়া হাত ধরিয়া সেদিনের মতোই তাহাকে টানিতে টানিতে অঙ্গনে প্রবেশ করিল। সে পড়ার বই বাহির না করিয়া একটি ছড়ার বই বাহির করিল মোনাদিরের সম্মুখে। শিশু-পাঠ্য, সুন্দর প্রচ্ছদপট, একটি পুস্তক। ছড়া ও ছবি-পূর্ণ। মোনাদির এমন পুস্তক পূর্বে দেখে নাই। বেশ মজা পাইতেছিল সে।

তুই, এই বই পড়তে পারিস?

ঠোঁট উল্টাইয়া আম্বিয়া জবাব দিল, পারব না কেন?

একটি ছড়া মিহিকণ্ঠে সে আবৃত্তি করিতে লাগিল।

বেশ তো। এই বই পেলি কোথায়?

মখতবে রহিম বকশ চৌধুরীর মেয়ে পড়ে। তারই কোনো আত্মীয় পুস্তকটা উপহার পাঠাইয়াছে।

মন্তব্যে মোনাদিরও পশ্চাৎপদ নয়।

তুই বেশ কাজের বুড়ি। পাকা বুড়ি।

 মুখ ভেংচাইয়া উঠিল আম্বিয়া : বুড়ি বলবার কে তুমি? মোটে সাত বছর বয়েস।

আমজাদ সশব্দে হাসিয়া উঠিল। অনেকক্ষণ চলিল ছড়া পাঠ। অবেলার বাতাসে শিশুকণ্ঠের গুঞ্জন।

তুমি এসো আর একদিন, অন্য বই আনব।

আমজাদ মোনাদিরের কাছে নিষ্প্রভ হইয়া যায়। আগন্তুক বালকের উপর তার হিংসা হয়, কিন্তু তা নিবৃত্তির একটা সহজ উপায়ও সে এই কয়েক মাসে আয়ত্ত করিয়াছে। মার উপর তার দরদ ক্রমশ হ্রাস পাইতেছে। দর্শকের মতো আমজাদ ছড়াপাঠের সভায় যোগ দিয়াছিল।

আমিরন চাচি হাঁক দিল : এই হতচ্ছাড়ি, এই বই নিয়ে হল্লা কেন এত? কদ্দিন বা তোকে মতবে পাঠাতে পারব।

দরিয়াবিবি ধমক দিল : খামাখা তুমি মেয়েকে ধমকাও। বেশ লক্ষ্মী মেয়ে। চালাক, পড়াশুনায় ঝোঁক আছে।

চালাক। পাঁচ বছর বাদ বুকে পাথর হয়ে বসবে ঐ মেয়ে। বেওয়া মায়ের আবার স্নেহ যত্ন শান্তি।

খোদার দিন খোদা চালায়। ভেবে ভেবে আমারও পাঁজরা ঝাঁঝরা হয়ে গেল। ভাবি, দূর ছাই আর চিন্তা করব না, তবু সব গোল পাকিয়ে আসে।

মোনাদির তখন একটি ছড়া আবৃত্তি করিতেছিল। শেষ হইলে আম্বিয়া উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিল, আর একটা পড়ো না মানু ভাই। তোমার মুখে বেশ মানায়।

প্রশংসায় মোনাদিরের বুক ভরিয়া উঠিতেছিল। তবু ধমক দিয়া বলিল : হ্যাঁ, আর ফাজলেমি করতে হবে না। বদমাইশ।

মোনাদির আর একটি ছড়া আবৃত্তি করিল। জননীদের মধ্যে তখন দুঃখ-দারিদ্র্যের কথোপকথন চলিতেছিল। আমিরন চাচির পাড়ার আত্মীয়রা মোটেই সদয় নয়। ভিটেমাটি ছাড়া হইলে, এই কয়েকটি গাছপালা ও পুকুর পুঙ্কুরিণীর উপর দৌরাত্ম করিতে পারিলে তারা সন্তুষ্ট হইবে।

দরিয়াবিবি অতীত আত্মীয়দের ব্যবহারের স্মৃতি বয়ান করিতে লাগিল।

বহুদিন এইদিকে দরিয়াবিবি আসে নাই। বড় পরিচ্ছন্ন আমিরনবিবি। দীনতার ভিতর এমন সৌন্দর্যের তৃষ্ণা বাঁচিয়া রহিয়াছে। উঠান, ঘাটের পথ, দাওয়া ঝকঝকে; গৃহলক্ষ্মীর স্বর্গ রহিয়াছে মাচাঙ, সবজি ও গাছপালার উপর।

সন্ধ্যা নামিতেছে। আর দেরি চলে না, ছড়ার আসরও ভাঙিতে হইল। মোনাদির। এখানে পরিচিত মনের সন্ধান পাইয়াছে। কয়েকদিন আগেকার অসোয়াস্তি ভুলিয়া গেল। আম্বিয়া ও আমিরন সড়ক পর্যন্ত আগাইয়া আসিল।

সড়কে আবার ভারী হইতে থাকে দরিয়াবিবির মন। এতক্ষণ বেশ ছিল সে। শৈরমী শাকের বোঝা মাথায় অবসন্ন সন্ধ্যায় সড়কে হাঁটিতেছে যেন, তারই সম্মুখে।

.

১৭.

শকরগঞ্জ আলুর চাষে অনেক লোকসান গিয়াছিল। চন্দ্র কোটাল হাসিমুখেই বলিল : খ সাহেব, আমাদের কপালটা পাথর চাপা।

আজহার নিরুত্তর ছিল। সংসারে পোষ্য সংখ্যা বাড়িতেছে। আয়ের অঙ্ক যদি নড়চড় হয়, বাঁচার আর কোনো আস্বাদ থাকে না।

চিন্তায় আজহারের ঘুম হয় না ঠিকমতো। তার মস্তিষ্কের কলকজা এমনিই চালু নয়। মনের অন্ধকারে হামাগুড়ি দেওয়ার মধ্যেই সে শান্তি পায়।

চন্দ্র কোটাল অলস নয়। রোজগারের পন্থা সে সহজে আবিষ্কার করে। আজহার অবাক হইয়া গেল। চন্দ্র কোটাল বাস্তুর ঢিবির পাশেই আর এক চালাঘর তুলিয়াছে। তার ভিতর একটি ভাঙা হারমোনিয়াম, পুরাতন বেহালা, পরচুলা আর বাইজি সাজার পোশাক। চন্দ্র ভিতরে বসিয়া একজন যুবকের সঙ্গে কথাবার্তা বলিতেছিল।

এ কী, চন্দ্র? আজহার জিজ্ঞাসা করিল।

এসো, মাদুরের উপরে বসো। সব বলছি। একটা ভাঁড়-নাচের দল করলাম আবার।

আজহার মাদুরের উপর বসিয়া তামাক ফুঁকিতে লাগিল।

ছ্যা ছ্যা। শেষে আবার বুড়ো বয়সে এইসব কাজে হাত দিলে!

জঠরের উপর হাত বুলাইয়া চন্দ্র হাসিয়া উঠিল।

 বুড়ো বয়স। কিন্তু এই জায়গাটা বুড়ো হতে জানে না।

আজহার বলিল, তোমাদের মহড়া চলছে?

চন্দ্র। খুব জোরেশোরে চলছে। এবার বস্ত্রহরণ পালা করব।

আজহার। ওটা তুমি ভালোই করতে। এত সাজগোজ। টাকা পেলে কোথা?

চন্দ্র পার্শ্বে উপবিষ্ট যুবকের পিঠে হাত থাপড়াইয়া জবাব দিল : এই যে আমার রাজেন্দ্র ভায়া আছে। ও বহুত দিন শহরে ছিল। শহরের ছাঁটকাট এনেছে কিন্তু পয়সা আনতে পারেনি।

রাজেন্দ্র এই গ্রামের কৃষকপল্লীর সন্তান। সত্যই তার ছাঁটকাট শহুরে। পরনে ধুতি, গায়ে হাফশার্ট। চুল দশ-আনা ছ-আনা।

রাজেন্দ্র লজ্জিত হইয়া বলিল, আর কেন ওসব চন্দ্রদা। এতেও যে পয়সা আসবে, মনে হয় না। তবে ফুর্তি করে দিনটা কাটানো যায়।

চন্দ্র। দাও না ভাই একটা গান শুনিয়ে।

তৌবা বলিয়া আজহার খুব কাঁচুমাচু করিল। রাজেন্দ্রের গান-গাওয়ার তেমন উৎসাহ ছিল না, গুনগুন করিতে লাগিল। চন্দ্র একটু অপ্রস্তুত হইল বৈকি।

চন্দ্র। দেখো খাঁ ভাই, এবার যখন রাজেন্দ্রকে পেয়েছি, দল ঠিক চলবে। ওর হাত গলা দুই সমান চলে। বেহালার ছড়ি ধরতে ওর জুড়ি নেই। যাত্রার দল সব ফেল মারবে দেখো।

আজহারের এই আবহাওয়া ভালো লাগে না। কয়েকটি পুরাতন শাড়ি ঝুলিতেছিল আলনায়। জিজ্ঞাসা করিল, ওগুলো কি নাচের সাজ?

জবাব দিল চন্দ্র : হ্যাঁ। রাজেন্দ্র এনেছে সঙ্গে করে।

আজহার সহজেই সবকিছু গ্রহণ করিতে পারিল না। রাজেন্দ্রের বদনাম অনেক। বাউরীপাড়ার একটি বিবাহিতা মেয়ে লইয়া সে উধাও হইয়াছিল দেশ হইতে সাতবছর পূর্বে। বাউরী মেয়েটির স্বামী ও দেবর গত বৎসর মারা গিয়েছে। নচেৎ রাজেন্দ্র দেশে ফিরিতে সাহস করিত না। তার প্রবাস জীবনের কত কাহিনী গুজবের আকারে পল্লীগ্রামে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। বাউরী মেয়েটি এখন নিষিদ্ধপল্লীতে আশ্রিতা। রাজেন্দ্র তার উপার্জনে আশ্রিত। থিয়েটারের এক বাইজি রাজেন্দ্রের প্রেমে পড়িয়াছিল। তার পশ্চাতে সে খোয়র হইয়া বর্তমানে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে। বহু টাকার মালিক রাজেন্দ্র দাস, অধর দাসের পুত্র। হাতেম বস খাঁর সন্তানেরা শহরে তার কল্যাণে ময়ূর উড়াইয়া বেড়াইতেছে কার্তিকের মতো। গুজবের শেষ নাই।

এইজন্য আজহার পরিচয় পাইয়া বড় বিগড়াইয়া গিয়াছিল মনে মনে। রাজেনকে চেনা দায়। রঙটি ফরসা। শহরের ছায়ায় আরো জৌলুশ খুলিয়াছে; সংলাপে কৃষকপল্লীর কোনো খুঁৎ পড়ে না। যেন কতদিন সে বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়াছে।

এমন লোকের সঙ্গে চন্দ্র জঘন্য ব্যবসা ফাঁদিতে গেল! কোটাল নেশা করে, সুতরাং অচিরেই সে গোল্লায় যাইবে। মুখ ফুটিয়া আজহার কোনো কথা বলিতে সাহস করিল না।

চন্দ্র কোটালের উৎসাহের অন্ত নাই। সুদীর্ঘ গোঁফে সে ঘন ঘন তা দিতে লাগিল।

দেখো আজহার ভাই, এবার ফসল যদি ভালো হয়, আমাদের বায়নার অভাব হবে না।

ফসল আল্লার মেহেরবানি। নিস্তেজ কণ্ঠে জবাব দিল আজহার।

রাজেন্দ্র হারমোনিয়াম টানিয়া রীড টিপিতে লাগিল। পড়ন্ত দুপুর। চন্দ্র কোটাল মাদুরের উপর তাল দিতে ব্যস্ত। আজহারের মুখে কোনো কথা নাই।

আজহার ভাই চন্দ্র মুখ টিপিয়া টিপিয়া হাসিয়া উঠিল।

আজহার কিছু বুঝিতে পারে না। নূতন রোজগারের পন্থা জুটিয়াছে। মরীচিৎকার স্বপ্নে চন্দ্র কোটালের মুখে আনন্দের বন্যা আসিয়াছিল। নিষ্ক্রিয় আজহারকে সে ডাক দিল, কিন্তু তার মধ্যে বিদ্রুপের ভাব প্রচ্ছন্ন। আজহার ইহার বিন্দুবিসর্গ উপলব্ধি করিতে পারিল না।

তোমার সঙ্গে আমার আরো কথা আছে, চলো আজহার ভাই। রাজেন্দ্রের দিকে কোটাল দৃষ্টি বিনিময়ের সাহায্যে তাকে অপেক্ষা করিতে বলিল।

খাঁ সাহেব, তুমিও আমাদের দলে ঢুকে পড়ো।

আজহার চন্দ্রের দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল।

কোটালের দাওয়ায় বসিয়া আজহার আরো বিস্মিত হইল। শ্ৰী লাগিতেছে তার। ঘরে। বাঁশের নড়বড়ে খুঁটি বদলাইয়া একটি কাঠের খুঁটি লাগাইয়াছে সে। আলুচাষে নিশ্চয় কোটাল তাকে ফাঁকি দিয়াছে। চন্দ্রমণির অসুখ সারিয়া গিয়াছে। শাদা পরিষ্কার থানকাপড় পরনে। খানিক আগে পান খাইয়াছিল। রাঙাঠোঁটে তাকে বেশ মানায়, দুই সন্তানের জননী বলিলে ভুল করা হইবে। আজহার কোটাল সম্বন্ধে কোনো নীচতা মনে প্রশ্রয় দিতে পারে না। ফাঁকি দেওয়ার লোক সে নয়। নূতন দলের জন্য রাজেন্দ্র বোধহয় খরচ করিতেছে। তার সম্বন্ধে এত গুজব, তবে ভিত্তিহীন নয়।

আজহারের অভ্যর্থনার ত্রুটি হয় না কোথাও। কোটাল বলিল : আজহার ভাই, সত্যি, বুড়ো বয়সে কোমর নাচান আর ভালো লাগে না। রাজেন্দ্র ছোঁড়াটা ধরে বসল। দেখি কপাল ঠুকে যা আছে ভাগ্যে।

চন্দ্র কোটাল পূর্বে ভাড়-নাচের দলে কাজ করিত। দশ-বিশ মাইল দূরে গঞ্জে গঞ্জে তাহাদের ডাক পড়িত। এমন প্রবাস জীবনের সময় এলোকেশীকে সে এক মাহিষ্য বাড়িতে সঙ্গিনীরূপে পাইয়াছিল। এলোকেশী তার বিবাহিতা স্ত্রী নয়। রাজেন্দ্রের। কীর্তিকলাপের খোটা দিয়া চন্দ্রের নিকট আজহার কোনো অভিযোগ করিতে সাহস করিল না।

স্তিমিত স্বর আজহারের : চেষ্টা করে দেখ। আমার সঙ্গে আর একটা চাষবাস কর।

নিশ্চয় নিশ্চয়। জাত ব্যবসা আমি ছাড়ব না। ওটা তো বাড়তি কাজ। বায়না পাব, কি না পাব কে জানে।

সংসারে আর ভালো লাগে না।

আমারও ওই দশা।

চন্দ্রমণি বেশ ফুটফুটে প্রজাপতির মতো। স্বাস্থ্যের জৌলুশের সঙ্গে তাকে আরো সুন্দরী মনে হয়। ছেলে দুইটি উঠানে লাফালাফি করিতেছে। আজহার কল্পনায় এমনই সাংসারিক চিত্র আঁকিতে লাগিল। তার সংসারে কি স্বাচ্ছন্দ্যের এমন হাওয়া লাগিবে না?

তামাক নিঃশেষ করিয়া আজহার উঠিয়া পড়িল। বলিল : ভেবে দেখ, চন্দ্রর। যদি পুঁজি পাও।

আচ্ছা, আচ্ছা।

কোটালের কণ্ঠস্বরে আনন্দের উচ্ছ্বাস। হিংসা হয় আজহারের মুহূর্তের জন্য।

মাঠের নিঃসঙ্গ পথে ঔদাসীন্যের বোঝা আজহারের বুকে জগদ্দলের মতো চাপিয়া বসিতেছে যেন। হারমোনিয়ামের আওয়াজ ভাসিয়া আসিতেছিল। জুড়ি গান ধরিয়াছে রাজেন্দ্র ও চন্দ্র কোটাল।

.

১৮.

 আঁতুরঘরে আর কোনোদিন এত দীর্ঘকালব্যাপী দরিয়াবিবিকে পড়িয়া থাকিতে হয় নাই। সুঠাম স্বাস্থ্য তার। পাঁচদিন পার হইলেই সে আবার সংসার গুছাইয়া লইত। আসেকজান এই কয়দিন তাকে সাহায্য করিত। বর্তমানে তার দৃষ্টিশক্তি অন্তর্হিত। অকেজো বুড়ি সংসারের কোনো কাজে লাগিল না। আমিরন চাচির শরণাপন্ন হইল আজহার খাঁ। সেও বিধবা মানুষ। সংসারের আগল পাগল হইয়া ব্যস্ত। কিন্তু আমিরন-চাচি সহজে রাজি হইয়া গেল। তার সিদ্ধান্ত সত্ত্বর সংসার-শৃংখলার ছবি আঁকিয়া লইল। গরু দুটি এই কয়েকদিন আর মাঠে ছাড়া হইবে না। গোয়ালে শুইয়া শুইয়া খড় খাক। মুরগি হাঁস আম্বিয়ার তদারকে। নিশ্চিন্ত আমিরন চাচি।

দরিয়াবিবি কৃতজ্ঞতায় ডুবিয়া গেল।

আসেকজানের ঘরটি বর্তমানে আঁতুরঘর। অন্ধকার। দিনের আলো সেঁধোয় না। কোণে কোণে পুরাতন ঝুল জমিয়া রহিয়াছে। অস্বাস্থ্যকর গন্ধে দম বন্ধ হইয়া আসে। ইহার ভিতর দরিয়াবিবি শুইয়াছিল। পাশে সদ্যোজাত শিশু মেয়েটি। অর্ধ পরিষ্কৃত ন্যাকড়ায় প্রস্তুত কাথার উপর যেন পদ্মফুল ফুটিয়া রহিয়াছে। মার আদল নবজাতকের চোখেমুখে।

দরিয়াবিবি শিশুর দিকে চাহিয়া বলিল : আমি বুবু তোমার দয়ায় এ যাত্রা হয়তো বেঁচে যাব।

ছি ছি, বুবু। তোমাকে শক্ত মেয়ে মনে করতাম। তুমি এত কাতর হয়ে পড়ছ?

আর কোনোদিন এমন হয়নি। শরীল খুব ভালো ঠেকছে না।

দাওয়ায় আস্তানা পাতিয়াছিল আসেকজান। তার কানে কথাটা সহজে প্রবেশ করে। সে খেদোক্তি আরম্ভ করিল : আমারও নসিব, বৌ। চোখের মাথা খেয়ে বসে আছি। আগে তবু ফাঁই-ফরমাশ এই অকালে শুনতে পারতাম।

দরিয়াবিবির জ্বর হইতেছিল অল্প অল্প। কবিরাজ আসিয়াছিল একদিন। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ডিস্পেন্সারি হইতে বর্তমানে ঔষধ আনা হয়। কবিরাজের ঔষধে কিছুই ফল হইল না। কিন্তু ডিস্পেন্সারি প্রায় তিন মাইল দূরে। আমজাদ ও মোনাদিরের মুখ রৌদ্রের তাপে শুকাইয়া যায়। আজহার খাঁর জমির কাজ ও টাকা ঋণের উপায় লইয়া ব্যস্ত সংসার লণ্ডভণ্ড। সময়মতো সকলের খাওয়া হয় না। নঈমার দুই চোখে এমন পিচুটি জমে যে, দুপুরের আগে সে চোখ খুলিতে পারে না। দাওয়ায় বসিয়া আসেকজানের নিকট সে নাকি কান্না কাঁদিতে থাকে। শুইয়া শুইয়া দরিয়াবিবি তিরস্কার করে। তখন মুহূর্তের জন্য সে থামে। আবার শুরু হয় ক্রন্দন।

আমিরন চাচিকে কোনো দোষ দেওয়া চলে না। গৃহিণীপনায় সে কম নয়। পরের সংসার অনভ্যাসের ফলেই গুছাইতে এত বিলম্ব।

মোনাদির স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। মার পাশে গিয়া আর বসিয়া থাকিতে ভালোবাসে না। দরিয়াবিবির আহ্বানে সাড়া দিলেও, কোনো উৎসাহ পায় না সে। এই আবহাওয়া সে যেন বরদাস্ত করিতে পারিতেছে না। কিন্তু বোনটির দিকে চাহিয়া সে একরকমের লজ্জা অনুভব করে। কোনো সচেতন কারণ অবশ্য তার উপলব্ধির বাহির। সৌন্দর্যের পুত্তলি। মোনাদিরের দুই চক্ষু কোনো আনন্দের উপকরণ খুঁজিয়া পায় না। এইজন্য মোনাদির পাড়ার গাছগাছালির তলায় বেশিক্ষণ থাকিতে ভালোবাসে। সঙ্গে আম্বিয়া বা আমজাদ। অথচ মার ফাঁই-ফরমাশের জন্য এই সময় তাদের ঘরে থাকা উচিত।

খোলা টাঁটির ফাঁক দিয়া বাহিরের জগৎ যা দরিয়াবিবির চোখে পড়ে। কর্মনিষ্ঠ, চঞ্চল তার মনও স্থিতি পায় না এই অন্ধকারে। শুইয়া শুইয়া খবরদারি গ্রহণে তার কার্পণ্য নাই। মুনি খেয়েছে কিনা, আমু কোথা, নঈমার চোখ কিরকম। হাজার সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন। জেলা বোর্ডের ডিস্পেন্সারির ডাক্তার বিছানায় শুইয়া থাকিতে আদেশ দিয়াছিল। প্রসূতি কতটুকু বা তা পালন করিতে পারে? উঠিতে হয় বৈকি দরিয়াবিবিকে। আমিরন চাচি এই জন্য বড় বিব্রত। প্রস্রাব পায়খানা ফেলিবার ভারটুকু সে অতি কষ্টে দরিয়াবিবির নিকট হইতে গ্রহণ করিল।

তুমি ভালো হয়ে নাও তারপর শোধ নিও।

শোধ! বলিয়া মুখ কুঞ্চিত করিল দরিয়াবিবি। নবজাতক হাতপা নাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিতে সে তাকে বুকের কাছে টানিয়া লইল। পুরাতন সূত্রের আবার খেই চলে : শোধ এ জন্মে নয়। আমার মোনাদিরটা বড় হোক।

চুপ করিয়া গেল দরিয়াবিবি। মাথার যন্ত্রণা হইতেছে।

আমিরন বিবি জিজ্ঞাসা করিল, একটু মাথা টিপে দিই?

না। তুমি রান্না সেরে ফেল।

 হ্যাঁ, সেরে ফেলি। এক দৌড়ে বাড়ি যেতে হবে। ডাবায় পানি দিতে বলেছিলাম গরু দুটোকেও কি চোট বালতি করে পানি তুলেছে কিনা কে জানে। সারাদিন শুকিয়ে মরবে।

তা যেয়ো। তুমি যা দিলে বোন, শোধ-শোধ আর ইহজন্মে কেউ করতে পারে না।

এত কাঙালীপনা কেন? অথচ দরিয়াবিবির প্রশান্ত মনের সম্মুখে ঝড়ঝঞ্ঝা কত তুচ্ছ। কাতুরে কিশোরীর মতো দরিয়াবিবি।

কিছু ভেবো না। সব দুঃখ আল্লাই তরাবেন।

আল্লা-আল্লা।

বিদ্রুপের ভ্রুকুটি খুলিয়া গেল দরিয়াবিবির মুখের উপর।

আল্লাই যদি সব করেন, তবে আমাদের এত দুঃখ দিয়ে কী পান তিনি? আমার ঈমান নেই, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বুবু।

ছি, ও কথা মুখে আনতে নেই।

থাক আল্লা। রোগ হলে ওষুধ খেলে ভালো হয়।

এই ভালো হওয়ার রাস্তাটা তো মানুষকে খুঁজে বের করতে হয়েছে। ওটা তো আন্না মগজে ঢুকিয়ে দেননি। তবে আর আল্লার কথা কেন মুখে। দুনিয়ার দুঃখকষ্ট রোগভালাই সবকিছুর পিতিকার আমাদেরই করতে হবে। আল্লা থাকে থাক্‌, না থাকে থাক্। দু-তিন বছরে আমার ঈমান গেছে।

স্তম্ভিত আমিরন চাচি!

কী বলছ রোগের ঝেকে! ওসব আমি বুঝিনে।

দরিয়াবিবি ক্লিষ্ট বেদনায় চোখ বন্ধ করিল। তার জগতের উপর কালো ছায়া নামিয়াছে।

আবার উন্মীলিত পক্ষ দৃষ্টি আমিরনের সর্বাঙ্গ কৃতজ্ঞতায় লেহন করিতে থাকে।

রাগ কর না, বুবু। তুমি নামাজ পড়। আমি পড়া ছেড়ে দিয়েছি। মন বসে না। খামাখা যাতে মন নেই, তা করে কোনো লাভ নেই।

আমিরন চাচি দরিয়াবিবির মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, এখন চুপ কর। তোমার মাথা ঠিক নেই।

হুঁ!

পায়ের গাঁটে অসহ্য যন্ত্রণা, সটান পা লম্বা করিতে লাগিল দরিয়াবিবি।

ঘুমাও তুমি। আমি কাজ সেরে আসবো।

খোকাদের একটু ডেকে দাও।

আচ্ছা, বলিয়া আমিরন বিবি রান্নাঘরের দিকে নিষ্ক্রান্ত হইল।

খোকারা কেউ এই তল্লাটে ছিল না। হাসুবৌ মাঝে মাঝে খোঁজখবর লইয়া যায়। দরিয়াবিবির শারীরিক পরিচর্যা সে ফুরসৎ মতো সম্পন্ন করে। বেশিক্ষণ বাহিরে থাকার জো নাই তার। শ্বাশুড়ি এই নির্বোধ রুগ্ন বধূটিকে চোখে চোখে রাখিতে চায়। জিন ভূতের পাল্লায় সর্বনাশ হইতে চলিয়াছে তার। সংসারে বংশধর না আসিলে পুত্র আর ঘরমুখো হইবে না। বধূর ওপর খর মেজাজ ফলাইলেও সাকেরের মা আসলে করুণা পরবশ। ছেলেগুলিকে কয়েকদিন নিজের কাছে রাখিতে চাহিয়াছিল হাসুবৌ। দরিয়াবিবি রাজি হয় নাই। তাহাদের সংসারও খুব সচ্ছল নয়। আত্মীয়তার দৌরাত্মে মনের সাধারণ মিলটুকু পাছে হারাইতে হয়, দরিয়াবিবি সে আশঙ্কা করিয়াছিল। কিন্তু তার পুত্রবধূ গাছগাছালির উৎসঙ্গে আদর না পাইলে হাসুবৌর কাছেই ছুটিয়া যায়, সেখানে আহারাদি করে না। মোনাদির মার কড়া হুকুম পালন করিত। হাজার সাধাসাধির পরও সে হাসুবৌর বাড়িতে কোনো খাবার হাতে লইত না।

কাঁচা দুপুরে তারই অভিনয় চলিতেছিল। হাসুবৌর হাতে কয়েকটি সন্দেশ। তক্তপোশে আমজাদ, আম্বিয়া ও মোনাদির।

হাসুবৌ। লক্ষ্মী ছেলেদের মতো খেয়ে ফেলো। হা হা শব্দ করিল হাসুবৌ।

না, আমি খাব না। মা বকবে।

 মা দেখতে আসছে নাকি?

এরা বলে দেবে।

ওরাও যে খাবে।

মোনাদিরের আর কোনো ভয় নাই। হাত পাতিয়া সে সন্দেশ গ্রহণ করিল। তারপর যৌথ হা-হামের পালা। হাসুবৌ হাসিয়া লুটোপুটি খাইতে লাগিল।

সাকেরের মা ঘরে ঢুকিয়া একচোট হাসিয়া লইল।

বৌমা রান্নাবানা দেখ। অভাগীর বেটি কপাল এনেছিস কী, ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করবি।

হাসুবৌ পাথর হইয়া যায়। আমজাদ ইত্যাদিরা সন্দেশে কামড় দিয়া বসিয়া থাকে, আর মুখ নড়ে না।

আপন মনেই বকিতে লাগিল বুড়ি : যত-সব অভাগীর কপাল। একটা ছেলের হা পিত্যেশ মিটল না। সাকেরটা গেছে কোথা লাঠি নিয়ে কোনোদিন কী কপালে আছে আল্লা জানে।

বাহির হইয়া গেল বুড়ি। বুড়ি তো নয়, আপদ! ঘরে আবার হাসির হরা।

মোনাদির একটি গল্পের বই পড়া শুরু করিল। সকলে মন দিয়া শোনে। হাসুবৌ মোনাদিরের নিকটে। তার চালচলন, পঠনভঙ্গি বড় সুন্দর দেখায়।

অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। মোনাদির গল্প শেষ করিয়া বাহিরের দিকে চাহিল। দুপুর ঢলিয়া পড়িতেছে। না, আর বসা যায় না। ক্ষুধা লাগিয়াছে তার।

আম্বিয়াকে সে বলিল : চল্ না, বাড়ি যাবি না?

 চল না, মুনিভাই।

হাসুবৌ বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল : আম্বি, তুই যেতে চাস, যা। আবার ওকে কেন টানাটানি!

আমি ওর সঙ্গে যাব। কাঁচুমাচু খাইয়া আম্বিয়া জবাব দিল।

না, আমিও যাব।

মোনাদির তক্তপোশ হইতে নামিয়া দাঁড়াইল। হাসুবৌ আক্রোশ বিফল দেখিয়া অনুরুদ্ধ কণ্ঠে বলিল : মুনি, দরিয়াবুবুকে দেখে আসব।

তবে চল।

খুব উৎফুল নয় মোনাদির। স্বাভাবিক শালীনতা যেন সে এই বয়সে আয়ত্ত করিয়াছে। হাসুবৌ জবাব দিল : আমি তোমাকে হেঁটে যেতে দিচ্ছি নে, আমার কোলে চড় দেখি, সোনা।

বাধা দিল মোনাদির : আমি কি খোঁড়া, না আমার পায়ে মেহদি দিয়েছি?

কোনো বাধা হাসুবৌ স্বীকার করিল না। মোনাদিরকে সে কোলে তুলিয়া লইল।

আমজাদ ফুট কাটিল : ধেড়ে ছেলে কোলে উঠেছে।

শাসাইয়া জবাব দিল হাসুবৌ : তোর কী রে! দশ-এগারো বছর বয়সে যদি ধেড়ে, তুই কী?

মোনাদির কোলে চড়িয়াছিল, কিন্তু আরাম নাই তার বুকে। পাড়ার লোকে হাসিবে বৈকি!

গমন-উদ্দেশ্যে পা বাড়াইয়া হাসুবৌ মোনাদিরকে বলিল : লক্ষ্মী, আমার গলাটা জড়িয়ে ধর, না-হলে আছাড় খেয়ে পড়ে যাবে।

.

ঘরে আদৌ মন টেকে না মোনাদিরের। হাসুবৌ দরিয়াবিবির মাথা টিপিয়া দিতেছিল। মোনাদির কয়েক মিনিট মার সঙ্গে বাক্যালাপ করিয়া উঠিয়া গেল। আমিরন চাচি সকলের খাবার দিতেছিল। আজহারের ভাত রান্নাঘরে চাপা থাকে। মাঠের কাজ ছাড়া চন্দ্র কোটালের সঙ্গে সে কোথায় কী করিতেছে তার কেউ হদিশ জানে না।

খাওয়া শেষ হওয়ার পর মোনাদির একটিবার মার ঘরে উঁকি দিয়া পাড়ায় উধাও হইয়া গেল। আম্বিয়া দুপুরবেলা ঘরে গিয়াছে, সেদিকেই খেলা ভালো জমিবে।

হাসুবৌ ডাক দিয়া কোনো সাড়া পাইল না। দরিয়াবিবি বিষমুখে বলিল, আমি বিছানায় পড়া-অব্দি ওর যে কী হয়েছে।

হাসুবৌ জবাব দিল, এই কদিন আমার কাছে নাহয় থাকত। তুমি আবার রাজি হও না।

না বৌ, সে হয় না। একে অনেক কষ্টে ও ফিরে এসেছে। আমার চোখে চোখে থাক।

খুব তো তোমার চোখে চোখে আছে!

হাসুবৌ খানিক পরে চলিয়া গেল।

সেদিন সন্ধ্যায় কিন্তু এলোমেলো সাংসারিক জটাজাল কুণ্ডলী পাকাইয়া গেল।

ভর সন্ধ্যা। তবু একটি ছেলে ঘরে ফেরে নাই। আসেকজান আজকাল রাত্রি কাটাইবার সুযোগ অন্য কোথাও পাইলে এখানে থাকে না। কী বা সাহায্যে লাগে সে। নঈমা দাওয়ায় বসিয়া ঝিমাইতে জানে শুধু। সন্ধ্যার পর সে-ও ভালো দেখিতে পায় না। হাসপাতালের ডাক্তার চোখ দেখিয়া পথ্যের তালিকা প্রস্তুত করিয়া দিয়াছেন। অত পয়সা খাঁ-পরিবারে কারো নাই যে, আহার্য রোগের প্রতিষেধকরূপে ব্যবহৃত হইবে। আমিরন চাচি মুরগি-হাঁস তুলিতে কিছুক্ষণের জন্য বাড়ি গিয়াছে।

দরিয়াবিবি করুণ সুরে ডাকিতেছিল : একটি পানি দিয়ে যা– কণ্ঠস্বর তার রোগেশোকে ক্ষীণ। অনেকক্ষণ কারো জবাব না পাইয়া সে প্রাণপণে একবার চিৎকার করিয়া উঠিল, তোরা কি মরে গেছিস সব?

নঈমা জবাব দিয়াছিল। অক্ষমের আর কোনো চারা নাই। এই সময় আজহার খাঁ ফিরিয়া আসিল। তখনও তার কাঁধে লাঙল। দরিয়াবিবির আর্তনাদ শুনিয়া আজহার আর গোয়ালঘরে লাঙল রাখিতেও যায় নাই।

কী হল, দরিয়াবৌ?

একটু পানি।

উঠানেই লাঙল রাখিয়া কলস হইতে পানি গড়াইল আজহার। দরিয়াবিবি নিশ্চিন্তে পান সমাধা করিয়া গ্লাস স্বামীর হাতে দিয়াছে, দেখা গেল উঠানের উপর আমজাদ একটি কঞ্চি হাতে অগ্রসর হইতেছে, পশ্চাতে মোনাদির।

গ্লাস মাটিতে নামাইয়া আজহার খাঁ তীরবেগে ছুটিয়া আসিল, কোথায় ছিলি হারামজাদা? দাঁড়া– বলিয়া সে আমজাদের কান ধরিয়া চপেটাঘাত ও পরে আছাড় দিয়া উঠানে ফেলিয়া দিল। ইহার পর শুরু হইল মোনাদিরের উপর ঐ প্রচণ্ড শাস্তি। হাতের কঞ্চি লইয়া আজহার খাঁ দুইজনকে একই সঙ্গে প্রহার শুরু করিল : যত সব পর-খেগো হারামীর বাচ্চা। খেয়ে টইটই ঘুরে বেড়াবে। শুয়োরের বাচ্চা, মরো নি তোমরা–।

নঈমা চিৎকার করিয়া কাঁদিতেছিল। তার পরিবেশে কী ঘটিতেছে সে না দেখিলেও নির্মমভাবে উপলব্ধি করিয়াছিল। তারই ফলে ক্রন্দন ও চিৎকার।

আজহার খাঁ ছুটিয়া আসিয়া তাকেও দু-ঘা চাবকাইল।

উঠানে হাঁকাহাঁকি পড়িয়া গিয়াছে। নিরীহ আজহার খাঁ সে হঠাৎ এমন পাষণ্ড হইতে পারে, কল্পনার বাহিরে।

দরিয়াবিবিও বিছানা ছাড়িয়া বাহিরে আসিল। সেও চিৎকার আরম্ভ করিয়াছে : দাঁড়াও তোর মরদের গুষ্টিতুষ্টি করেছে। এত বড় বুকের পাটা, আমার ছেলেদের গায়ে হাত।

ছুটিয়া আসিল দরিয়াবিবি উঠানের উপর। দাওয়ার উপর হইতে পীড়িত শরীরে কিরূপে অবতরণ করিল, সেই মুহূর্তটুকু তার জবাব দিতে পারে।

আজহার রণে ভঙ্গ দিয়া লাঙল কাঁধে দহলিজের দিকে চলিয়া গেল।

উঠানের উপর ধূলি-লুণ্ঠিত অবস্থায় মোনাদির ও আমজাদ। কয়েক জায়গা ফাটিয়া গিয়া রক্ত পড়িতেছে শরীর হইতে।

দরিয়াবিবি আগাইয়া আসিবার পূর্বে স-চিৎকার মূর্চিত হইয়া পড়িল মাটির উপর।

একটু পরে আসিল লণ্ঠন-হাতে সাকের, হাসুবৌ ও তার শাশুড়ি।

.

১৯.

আমিরন চাচির সেবার অপূর্ব দক্ষতায় এই যাত্রা সত্যই বাঁচিয়া গেল দরিয়াবিবি। গরিবের সংসারে বিনা চিকিৎসায়, বিনা পথ্যে শুধু মনের জোরেই নিজকে চাঙা করিয়া তুলিল খাঁ পত্নী। এই তিন সপ্তাহে সে আরো একটি দোসর পাইয়াছে জীবনে আমিরন ও আম্বিয়া। রোগশয্যায় শৈরমীর দীন-মৃত্যুচ্ছবি দরিয়াবিবির মানসপটে ফুটিয়া উঠিত। হয়তো তেমন মৃত্যু হইবে তার। আমিরন চাচি ধীরে ধীরে তার মানসিক স্বাস্থ্যও ফিরাইয়া আনিয়াছে। নূতন কচি মেয়েটির দিকে চাহিয়া দরিয়াবিবি ক্ষুব্ধ মনে মনে। এই রূপরাশি দরিদ্র্যের কুটিরে তামা হইয়া যাইবে। আমজাদ ও মোনাদিরকে লক্ষ্য করিয়া দরিয়াবিবি স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম করিয়াছে।

.

এই কয়েকদিনে পুরাতন স্বাস্থ্য ফিরিয়া আসিত দরিয়াবিবির। মোনাদির তাকে দাগা দিয়া গিয়াছে। তার কোনো খোঁজ নাই। মার খাইয়া সে বিছানায় মুখ খুঁজিয়া পড়িয়াছিল। পরদিন ভোরবেলা হইতে সে নিরুদ্দেশ। সাকের দরিয়াবিবির আগেকার বাড়িতে সন্ধান লইয়াছিল। মোনাদির সেখানে যায় নাই।

কান্নাকাটির কসুর করিল না দরিয়াবিবি। আজহারের সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। দৈনন্দিনতার চাকায় মিশিয়া গিয়াছিল দরিয়াবিবি। স্ত্রীর সমস্ত কর্তব্য সে সম্পন্ন করে। কিন্তু নির্বাক। তার নির্মম মুখের দিকে চাহিয়া আজহার কথা বলিতে সাহস করে না। সংসারে দুইজন জীব একসঙ্গে বসবাস করিতেছে মাত্র। পশুর মতো একে অপরের ভাষা বোঝে না, সেইজন্য বাক্যালাপেরও কোনো প্রয়োজন নাই।

চন্দ্র কোটাল ভাড়-নাচ লইয়া খুব মজিয়াছিল। কয়েকটি মঞ্চে ইতিমধ্যে সে আসর জমাইয়া আসিয়াছে। দরিয়াবিবির অসুখের সময় এলোকেশী চন্দ্রমণি কয়েকদিন আসিয়া দেখিয়া গিয়াছিল। মোনাদির আজহারের তিরস্কারে এই ঘর পরিত্যাগ করিয়াছে, তাও জানিত চন্দ্র কোটাল। কিন্তু তা লইয়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নিঃশব্দের পাহাড় মাথা তুলিয়াছে, এই সংবাদ তার জানা ছিল না।

আজহার একদিন সমস্ত বৃত্তান্ত কোটালকে বলিয়া লজ্জায় মাথা হেঁট করিল।

তোমারও রাগ আছে তা হলে?

হাসিতে লাগিল চন্দ্র। মেনি বিড়ালেরা মাঝে মাঝে রুইমাছের মুড়া গিলিয়া ফেলে। আজহার রাগিতে পারে, আশ্চর্যের বিষয় নয়।

হঠাৎ, অমন মারা উচিত হয়নি।

ভাবীর পায়ে ধরেছ?

গোঁপে তা দিতে লাগিল চন্দ্র।

তৌবা। তুমি একবার গিয়ে বলল, এমন করে সংসার চলে?

চলুক। বেশ তো, দশবছর কথা বলেছ, এখন কথা না বললে চলবে না?

দূর পাগল।

এইবার ভালো ফসল হইয়াছিল। আজহার খুব সংসার-বিব্রত নয়। কল্পনায় ছবি আঁকিতে সে-ও ভালোবাসে।

চন্দ্র কোটাল সেইদিন দরিয়াবিবিকে হাস্য-কৌতুকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল।

ভাবী, আমার ভাঁড়-নাচ তোমাকে দেখাতে পারলাম না। যা ধর্মের কড়াকড়ি তোমাদের।

একদিন দেখে আসব তোমার বাড়ি গিয়ে।

টাঁটির আড়াল হইতে দরিয়াবিবি জবাব দিল।

আমার সঙ্গে কথা বলছ। আর খাঁয়ের সঙ্গে কেন কথা নাই?

চুপ করিয়া গেল দরিয়াবিবি। একটু পরে আসিল উত্তর, আমার ছেলেকে যদি কেউ তাড়িয়ে দেয়

সেটা নিশ্চয় অপরাধ। আমি যদি মুনি খুড়োকে এনে দিই।

আগে এনে দাও।

নিশ্চয় এনে দেব। নিশ্চয়।

আমজাদকে মারল, আমি রাগ করিনি। কিন্তু একটা হতভাগ্য এখানে ঠাই নিয়েছিল, তার উপর হাত চালালে। আমার দিকে একবার দেখলে না।

সেটা ভারি অন্যায় করেছে।

চন্দ্র কোটালের বাক্য সমাপ্ত হওয়ার আগে দরিয়াবিবি বলিতে লাগিল, বড় দুঃখী আমার মুনি, তার গায়ে হাত দিলে হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিল দরিয়াবিবি। চন্দ্র কোটাল তা উপলব্ধি করিতে পারে। সাহ্যপ্রিয় তার মতো মানুষটি আর কথা বলিতে সাহস করিল না।

দহলিজে ফিরিয়া আজহার খাঁকে সে খুব ধমক দিল।

সত্যি খাঁ ভাই, ভারি অন্যায় করেছ। বোঝ না ছেলের মায়া?

আজহার গুড়ুক ফুঁকিতেছিল। বলদের মতো নিস্তেজ দুই চক্ষু বুজিয়া সে জবাব দিল, হু।

চন্দ্র কোটাল আজ হারিয়া গিয়াছে। সে চুপ করিয়া রহিল।

খোঁজ করে দেখ না, চন্দর।

আমি লোক লাগাচ্ছি। আমার বায়না আছে শ্যামগজ্ঞে। দেখা যাক।

চন্দ্র কোটাল আজ বিশেষ ভণিতা না করিয়া উঠিয়া পড়িল।

আজহার গুড়ুক ফুঁকিয়া যায়। নিস্পৃহ হইয়া উঠিতেছে সে সব বিষয়ে।

বিঘে দুই জমির ভালো ফসল পাইয়াছিল। এই বছর সংসারে মাস তিন টানাটানি চলিতে পারে টাকা পয়সা। আজহার দরিয়াবিবির জন্য একটি তাঁতের শাদা শাড়ি কিনিয়া আনিল। কথাবার্তা নাই দম্পতির ভেতর। তক্তপোশে শাড়ি রাখিয়া দরিয়াবিবির উদ্দেশে সে কয়েকটি কথা বলিয়াছিল মাত্র।

কয়েকদিন পরে আরো ফসল আসিল ঘরে। আজহার দেখিল তার দেওয়া কাপড় পরিয়া রহিয়াছে আসেকজান। চাহিয়া রহিল সেইদিকে কিয়ৎক্ষণ। নিরীহ মানুষটির বুকেও শত প্রশ্নের কল্লোল উঠিয়াছে।

সেইদিন বৈকালে আজহার খাঁ সুতা-কনিক-সুর্মি হাতে ভিনগাঁয়ের পথ ধরিল।

পরদিন আমজাদ একবার পিতার প্রসঙ্গ তুলিয়াছিল। তাহাকে ধমকে স্তব্ধ করিয়া দিল দরিয়াবিবি।

.

২০.

আলু-পেঁয়াজের গস্ত করিতে ইয়াকুব গঞ্জে আসিয়াছিল। সেদিন ভালো বেপারী জোটে নাই। বেশি মাল কেনা হইল না। পাঁচ ক্রোশ বাড়ি ফিরিয়া আবার গঞ্জে আসা মহা হাঙ্গামা। আজহারের বাড়ি নিকটে, পুরাতন আত্মীয়তা ঝালাই করা হবে তবু। তাই ভাবিয়া সে বহু বছর পরে গরিব মামাতো ভাইয়ের অঙ্গনে পা বাড়াইয়াছিল।

দরিয়াবিবি ইয়াকুবকে সহজে চিনিতে পারে নাই। কয়েক বছরে তাহার চেহারা বেশ বদলাইয়া গিয়াছে।

আমাকে চিনতে পারলে না? আমি তোমার সেই দেবর– যে বড্ড বেশি বিরক্ত করত।

এসো, এসো।

দরিয়াবিবির সম্ভাষণে স্মৃতিশক্তি পুনরুজ্জীবন লাভ করে।

ভাবী, গঞ্জে এসে মুশকিলে পড়েছিলাম। মাল কেনা হয়নি।

তাই বুঝি গরিবের কুঁড়েঘরে হাতি

ইয়াকুব কথা লুফিয়া লইল : হাতি নয়, বরং চামচিকে বলুন, তা-ও সহ্য হবে।

বহুদিন আগে ইয়াকুব এই বাড়ি আসিয়াছিল। তবে বেশভূষার পরিবর্তন ঘটিয়াছে। সে লম্বা-কোঁচা ধুতি পরিয়াছিল। নাকের সোজাসুজি টেরি, চুলগুলি ঢেউ খেলানো, পায়ে কারো পাম-শ্য, গায়ে ঝুলা-পাঞ্জাবি। পানের দাগ দাঁতের গোড়ায়। হাসির ভিতর বাঁকা মনের পরিচয় ফুটিয়া উঠে।

ইয়াকুব সম্পর্কে আজহারের ফুপাতো ভাই। জোত-জমি আছে শ-বিঘা। তার ধান, তাছাড়া মওসুমে আলু, পটল, পেঁয়াজ, পাট ইত্যাদি লইয়া সে ব্যবসা করে। গত কয়েক বছরে সে বেশ পয়সা রোজগার করিয়াছে, এ সংবাদ দরিয়াবিবি জানিত। তার আরো প্রমাণ, বর্তমানে তার সংসারে দুই স্ত্রী বর্তমানে। কয়েক মাস আগে আর একটি বিবাহের যোগাড় করিয়াছিল। প্রতিবেশী ও দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মীয়দের জুলুমে। ইয়াকুব সে সদিচ্ছা পরিত্যাগে বাধ্য হইয়াছিল।

আজহার ভাই কোথা? একটি মাদুরের উপর বসিয়া ইয়াকুব জিজ্ঞাসা করিল।

দরিয়াবিবি আগে এক গ্লাস পানি দিয়াছিল। এখন ইয়াকুবের জন্য পান সাজিতেছিল। সে পান-ই সাজিতে লাগিল, কোনো জবাব দিল না।

ইয়াকুব আবার প্রশ্ন করিল, ভাই কোথা?

আমি কী জানি? আজ পনেরো দিন বেরিয়েছে। একটা খবর পর্যন্ত দেয়নি।

আচ্ছা মজার লোক। খালি দোকান-দোকান আর ব্যবসার ঝোঁক। ওসব ভালোমানুষ দিয়ে ব্যবসা হয় না।

ইয়াকুবের হাতে পানের খিলি দিয়া দরিয়াবিবি জবাব দিল, কে বোঝাবে বল। মাঝে মাঝে খেয়াল চাপে।

আজহার ভাই ওই রকম। কত জায়গায় কত রকমের ব্যবসা ফেঁদেছে। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না। সেটা ওর মহাদোষ।

অবেলা। দিনের আলো ক্রমশ নিভিয়া আসিতেছিল। ইয়াকুব হাসির ঢেউ তুলিয়া পকেট হইতে একটি দশ টাকার নোট বাহির করিল।

ভাবী, কিছু মনে করবেন না। আমি রাত্রে খিচুড়ি খাব। ঘি আর ভালো চাল কিনে আনাও। মুরগি পাড়ায় পাওয়া যায়?

পাড়ায় পাওয়া যায় না, তবে আমার ঘরে আছে।

 বহুত আচ্ছা।

দরিয়াবিবি নোট গ্রহণ করিতে রাজি হইল না। এমন মেহমান না আসাই ভালো। অপমানিত হওয়ার ক্লিষ্টতা তার বুকে গিয়া বিধিল। ইয়াকুব নাছোড়বান্দা। আমজাদ ও নঈমা পাশে দাঁড়াইয়া পিতার ফুপাতো ভাইয়ের কাণ্ড দেখিতেছিল।

ইয়াকুব দুইজনের হাতে দুটি পাঁচটাকার নোট খুঁজিয়া দিল।

 খোকা-খুকি, তোমরা মিষ্টি কিনে খেয়ো।

দরিয়াবিবি আরো প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু ইয়াকুব কর্ণপাত করিল না।

এমন ব্যাপার করলে আমার বাড়ি এসো না, ভাই। আমরা গরিব।

অভিমান-ক্ষুণ্ণ ইয়াকুব কহিল : আমার ভাইপো ভাইঝিরা আমার পর? বেশ, তুমি যা খুশি বল। আজহার ভাই আসুক না।

আবার প্রাণ খুলিয়া হাসিতে লাগিল ইয়াকুব, সে যেন কত রসিকতা করিয়া ফেলিয়াছে।

দরিয়াবিবিকে অগত্যা উঠিতে হইল। খাতিরদারির সরঞ্জাম অল্প নয়।

আমজাদ নিজের নোটটি সযত্নে ভাঁজ করিয়া মার হাতে দিল। তার ফুরসৎ নাই। ঘিয়ের জন্য কৈবর্তপাড়ায় যাইতে হইবে। এমন মজুরি পাইলে সে কাজে অবহেলা করিতে রাজি নয়। একটি বোতল হাতে সে চলিয়া গেল। মুরগি জবাই করা হইল তখনই। দরিয়াবিবির একটি বড় মোরগ ছিল, সেটি এখনও বাড়ি ফেরে নাই। কত দেরি হইবে কে জানে। বাড়ির মুরগি নষ্ট করিলে আয়ের পথ বন্ধ হইয়া যায়। ডিম আর বাচ্চা রোগীর জন্য অনেকে ক্রয় করে।

রান্নাঘরে দরিয়াবিবি খুব ব্যস্ত। ছোট খুকিটা ভয়ানক কান্না জুড়িয়াছিল।

ইয়াকুব অভয় দিল, ভাবী, রান্না কর। আমি খুকিকে কোলে নিই।

খুকির কান্না থামিয়া গেল। তাকে কোলে লইয়াই ইয়াকুব রান্নাঘরে প্রবেশ করিল। দরিয়াবিবি বসন সংযত করিতে সময় পায় না।

অপ্রস্তুত হইয়া ইয়াকুব বাহিরে ফিরিয়া বলিল : ভাবী, তোমার খুকিটা বেশ।

 হ্যাঁ, ভাই। বেশ সুন্দর হয়েছে মেয়ে।

ইয়াকুব আবার খুকিকে দোলাইতে দোলাইতে রান্নাঘরে প্রবেশ করিল।

হাসিয়া সে বলিল, তা হবে না, মা কেমন?

লজ্জায় রাঙা হইয়া ওঠে দরিয়াবিবির মুখ। গোস্তের হাঁড়িতে মশলা দিতেছিল সে। ধনে-ভাজা নাই। একটি তাওয়া চড়াইয়া দিল দরিয়াবিবি। ইয়াকুবের উপস্থিতি একটু অসোয়াস্তিকর।

দরিয়াবিবি ডাকিল, ইয়াকুব ভাই।

জি।

বাইরে যাও না। তুমি কী রান্না শিখবে?

কে শেখায়, ভাবি।

থাক, আর শিখে কাজ নেই। দুই বাঁদির ঘর– তার রান্না শিখতে হয় না।

হয় বৈকি।

তুমি খুকিকে বাতাসে নিয়ে যাও। যা ধোঁয়া এখানে।

দরিয়াবিবি নিজমনে রান্না করিতে লাগিল।

ইয়াকুবের কথা শেষ হয় না। সে আবার আসিল খুকিকে কোলে করিয়া।

ভাবী, আজহার ভাই পনেরো দিন গেছে, খবর দেয়নি?

না।

তুমি বলে তার সংসার কর। এমন লোক খবর দেবে না তা বলে।

আমরা তো তার কেউ নই।

দরিয়াবিবি চুলায় ফুঁক দিতেছিল বাঁশের চোঙ্গার সাহায্যে। ধোঁয়ায় ভরিয়া উঠিতেছিল সারা রান্নাশালা।

আহা। এমন সুন্দর খুকি, তার মায়া তাকে বেঁধে রাখতে পারে না।

বড় বিরক্তি বোধ করিতেছিল দরিয়াবিবি।

টাকার মায়া সবচেয়ে বড়। আবার কোথাও কিছু ফেঁদে বসেছে, লাখ টাকা কামাবে। সেবার চন্দ্র কোটাল ওর খোঁজ পেয়ে তবে ফিরিয়ে আনে।

দেখা যাক, আমিও চেষ্টা করব।

অত দয়ার কাজ নেই। নেই আসুক সে।

ইয়াকুব দরিয়াবিবির চোখের দিকে চাহিল, জলে ভরিয়া উঠিয়াছে। হয়তো ধোঁয়ায়, হয়তো সাংসারিক তাড়নার আঘাতে। ইয়াকুব তা উপলব্ধির চেষ্টা করিল।

দরিয়াবিবি কোনো সহানুভূতি চায় না। ইয়াকুব উঠিয়া গেলে সে সন্তুষ্ট হয়। আড়চোখে তার দিকে দরিয়াবিবি ধূমায়িত চুলায় আরো ধোঁয়া করিতে লাগিল, তারপর বলিল : ওঠে যাও না, ভাই। খুকিদের বড় চোখের দোষ হয় ধোঁয়া লেগে।

ইয়াকুব অনিচ্ছাসত্ত্বে ওঠিয়া গেল।

গেরস্থালির কাজ, মেহমানের জন্য বিশেষ রান্না। বহু দেরি হইয়া গেল। দুটি মাত্র ঘর। ইয়াকুবের শোয়ার জায়গা আর এক সমস্যা। আজ আমজাদকে দাওয়ায় শুইতে হইল।

গঞ্জের কাজ সারিয়া আরো তিনদিন ইয়াকুব এইখানে রহিয়া গেল। আজহারের তল্লাশি করিতেছে সে। কৃতজ্ঞতায় গলিয়া দরিয়াবিবি, খাতিরদারির ত্রুটি না হয়, সেদিক বিশেষ লক্ষ্য রাখিয়াছিল। দুহাতে খরচ করিতেছিল ইয়াকুব। সন্দেশের স্বাদ এই বাড়ির ছেলেরা মৌলুদ শরিফ বা পাড়ার কোনো বিশেষ উপলক্ষে চাখিতে পায়। ইয়াকুব নানা রকমের মিষ্টি কিনিয়া আনিয়াছিল। ময়দা, ঘি, পরটা, আরো চৰ্য– চুষ্যের ব্যবস্থা সে রীতিমতো করিতেছিল।

বাড়িতে ধুম লাগিয়াছে উৎসবের। আসেকজানকে পর্যন্ত ইয়াকুব বাহির হইতে দেয় নাই। সেও অতিথি এই বাড়ির।

দরিয়াবিবি চক্ষুলজ্জার জন্য কোনো কথা ইয়াকুবকে বলে নাই। নচেৎ সে-ও এই মহসিনীপনা খুব ভালো চোখে দেখিতেছিল না।

আরো দুইদিন থাকিয়া বিদায় লইল ইয়াকুব। আমজাদ অনেকদূর তার সঙ্গে আসিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *