১১. আজহার হিসেবি বটে

আজহার হিসেবি বটে, কিন্তু পরিবেশের কোনো উপাদান সে তলাইয়া দেখিতে শেখে নাই কোনোদিন। কপাল-ঠোকা গাণিতিক বিদ্যা দোকান করার পূর্বে তার একমাত্র ভরসা ছিল। পদে পদে নিজের ভুল দেখিতে পাইয়াছিল আজহার। সংসার-অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা এইসব ব্যাপারে তবু চোখ বুজিয়া বিধাতার দিকেই বারবার চাহিয়া থাকে।

স্টেশন হইতে সড়ক ধরিয়া বহু যাত্রী গ্রামের দিকে হাঁটিয়া যায়। তাহাদের অধিকাংশই শহর-প্রবাসী। মনিহারী দ্রব্য নগরে শস্তা পায় বলিয়া কেউ এইসব অঞ্চলে খরিদ করে না। যারা নিজ গ্রামে থাকে, তারা সামর্থ্যহীন। এক মাস দোকান চালানোর পর আজহার তা নির্মমভাবেই উপলব্ধি করিয়াছিল। ভবিষ্যতের অন্ধকারে মায়াময় হাতছানি লুকাইয়া থাকে; আজহারের মতো নামাজি পরহেজগার ব্যক্তি এই কুহকের রঙকে মনে করিত ঈমানের অঙ্গ। সুতরাং সর্বব্যাপারে নির্বিকার। দোকান খুলিয়া অবসর যাপনই একমাত্র দিন গুজরানের শ্রেষ্ঠ পন্থা। আজহারের সামান্য পুঁজি ছিল, ইতিমধ্যে সে বাড়িতে একবার টাকা পাঠাইয়াছে, অবশিষ্ট মূলধন ভাঙাইয়া ভবিষ্যতের দিগন্ত জরিপ ছাড়া আর কোন্ পথ খোলা আছে?

মাঝে মাঝে হাট-ফেরত পসারিণীরা আজহারের দোকানে ভিড় করে। তারা কোনোদিন শহর দেখে নাই, শহরের জিনিসের জন্য লোভ বেশি। কপয়সার সওদা বা তারা আঁচলে তুলতে পারে? একটা শস্তা স্যালুলয়েডের চিরুনি, দু-পয়সার রঙিন। ফিতা, সঁচ-সূতা অথবা এক ডিবা আল্তা। কেবল গঞ্জের দিনে এই মহিয়সীদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।

আজহারের ধ্যানধারণা, কল্পনার সৌধ এই দোকানকে কেন্দ্র করিয়া গড়িয়া উঠিতেছিল। ঈমানদার লোকের দিন আটকাইয়া থাকে না, আজহার এই মূলমন্ত্রটি সহজে বিস্মৃত হইত না। তাহারও দিন অতিবাহিত হইত বৈকি! কোনোদিন রান্নাই হইল না। ময়রার দোকান হইতে দুপয়সার মুড়ি ও বাতাসায় নৈশভোজ সমাপ্ত হইত। নিজেকে লইয়া আজহার খর কোনো লোভ ছিল না বলিয়া সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস এক মুহূর্তও টলিত না।

শুক্রবারে দুপুরবেলা শাদা লুঙি পরিয়া কিস্তি টুপি মাথায় সে তিন মাইল দূরে মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়িতে যাইত। এই সময় দোকান বন্ধ থাকিত মাত্র। নচেৎ শেষ বাস স্টেশনে যাওয়া পর্যন্ত দেখা যাইত, আজহারের দোকানে চিনিওয়ালা ছোট দেওয়ালির বাতি জ্বলিতেছে।

দুই মাস কাটিয়া গেল। দোকানে কোনো আয় নাই দেখিয়া আজহার আবার মিস্ত্রিদের কাজে জুটিল। গহর মিস্ত্রী সেদিন খুব হাসিয়াছিল। আজহার তার সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ। করিয়াছে। এমন হিংসাতুর মন কোথা হইতে আপদের মতো তার সঙ্গ লইয়াছে অকস্মাৎ, আজহার কোনোদিন তা ভাবিয়া দেখে নাই। সারাদিন কাজের পর সন্ধ্যায় আবার দোকান খোলা হইত। গঞ্জের দিন কাজে যাইত না আজহার। সেদিন দু-পয়সা বিক্রি হয়, তাই।

গহর মিস্ত্রি একদিন অযাচিতভাবে আলাপ আরম্ভ করিল।

আজহার ভাই, আমার সঙ্গে কথা বলো না। সাধে আমি রাগ করি? কপালে মুগুর মেরে এসেছি-ভাই, এ জন্মে আর কিছু হবে না।

আজহার তার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। গহর বলিয়া যায় : পয়সা কামাবার হেকমত আছে, ফিকির আছে, ফন্দি আছে, তা যদি না জানো, দোকান দিলেই কি পয়সা হয়?

গহরের সহানুভূতি আদৌ খাদ মিশ্রিত নয়, আজহার বুঝিতে পারে।

তুমি তো কথা বলবে না, খা। আমিই বলে যাই, শোনো, দোকান খুলে খদ্দের ঠকাতে হবে। তার কত ফন্দি। কথায় কথায় হলফ করো, সাতবার মাইরি বলো। বলল, কেনা দামে বেচছি, হুজুর। যদি লাভ নিই তো হারাম শুয়োর খাই। এমনি করে সাতশ শুয়োর খেলে তবে পয়সা হয়। পয়সা হলে হয়তো হাজিসাহেব হোয়ে আসতে পার। মক্কা-মদিনা ঘুরে এলে, ব্যাস। সব সাফ।

গহরের শরীর পাতলা বলিয়া কথার ভারসাম্য রক্ষার জন্য তার পায়ে চাঞ্চল্য খুব। বেশি ফুটিয়া উঠে।

আজহার এইবার মুখ খুলিল : লাভ না নিলে কারবার চলে, ভাই?

তা হলেই মিথ্যে কথা বলতে হবে। আর যদি সাচ্চা কথাই বলো, বেশি লাভ হবে, হয়তো একদমই হবে না। তাতে সংসার চলে না।

কথাগুলি আজহারের খুব মনঃপূত। ভয়ানক ছোট হইয়া যায় সে। তবু যেন গোলক ধাঁধা হইতে পরিত্রাণ পাইতে তার মন আকুলিবিকুলি করে।

ঈমানদার হলে সংসার করা দায়।

শুধু দায়, চৌদ্দপুরুষ জড়িয়ে পড়ে সুদ্ধ। বলিয়া গহর একটি বিড়ি ধরাইল।

বাসায় আরো মিস্ত্রি কাজ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিল। আজহার আজ দোকান খুলিতে যায় নাই। বাসার আড্ডা তার ভালো লাগিতেছিল।

গহর ডাকিল : ওদু। আছিস

ওদু-মিস্ত্রি বাসার এককোণে শায়িত অবস্থায় গল্পের দিকে কান খাড়া রাখিয়াছিল।

কি রে! সে জবাব দিল।

তোর মনে আছে, সে-বার, বেলেঘাটার আড়ৎদারের কাজ করি। এক ব্যাটা চামার আমাদের কী ঠকান না ঠকালে।

ওদুর শরীর ক্লান্ত, তাই সে ঘুমাইবার চেষ্টা করিতেছিল। এইবার উঠিয়া বসিল।

গহর, সেই আড়ৎদারের নাম-ডাক কত জানিস, দুটো মসজিদ তৈরি করে দিয়েছে এবার। অথচ আমাদের খাটনির দামটা দিলে না। কত টাকা বাকি ছিল, গহর?

চৌদ্দ টাকা ছ আনা।

গহর বিড়ির ছাই টোকা দিয়া ফেলিয়া পুনরায় কহিল, ব্যাটা চৌদ্দ বছর দোজকে জ্বলবে।

আজহার জবাব দিল : তা কি আর হয় ভাই। কেরামিন-কাতেবিন আমাদের গোনা আর নেকির কথা লিখছে। হাশরের ময়দানে যেদিন বিচার হবে, দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে দেখবে নেকি আর বদীর কোন্ পাল্লা ভারি। চৌদ্দ টাকা মেরে মসজিদ দিলে কোনো গোনা থাকে না, নেকির পাল্লা ভারি হয়ে যায়।

গহর ব্যঙ্গ করিয়া উঠিল : আজহার ভাই, তোমার ওয়াজের থলিমুখ বন্ধ করো। চৌদ্দ টাকায় মসজিদ হয়? কত চৌদ্দজনের কত টাকা মেরেছে তার খবর রাখো?

আজহার সায় দিল : ঠিক বলেছ, ভাই! আমি অন্য কথা ভাবছিলাম কিনা।

ঐরকম ভাবলে আর দোকান চলে না। মজিদওয়ালা আড়ৎদারের মতো ভাবো, জাল-জোচ্চোরি শেখো, কপাল খুলবে।

তৌবা!

গহর মিস্ত্রি খিলখিল শব্দে হাসিয়া উঠিল। মুখ তার বন্ধ থাকে না।

তবেই তুমি কারবার চালিয়েছ। জুম্মার দিনে দেখি তোমার দোকান সারাদুপুর বন্ধ পড়ে থাকে। খদ্দের যা আসে তা ওই সময় আসে। তখন দোকান বন্ধ রাখলে চলে?

আজহার সহসা উত্তেজিত হয় না। আজ ঝোঁকের মাথায় সে প্রতিবাদ করিয়া বসিল : এ কী কথা তোমার মুখে, গহর ভাই! এবাদতের চেয়ে পেট এত বড়!

অত ঈমানদার হলে ফকিরি নিতে হবে।

আবার ব্যঙ্গের হাসি গহরের কণ্ঠে। একটু দম লইয়া সে ডাক দিল : খলিল চাচা, একটু তামাক সেজে আনো।

বাসার এক কোণায় রান্না চলিতেছিল। খলিল তরকারির হাঁড়িতে জ্বাল দিতেছিল। বয়সে ছোট বলিয়া বাসার সকলের ফাঁইফরমাশ তাকে শুনিতে হয়।

দিচ্চি, চাচা।

গহর অবশ্য খলিলের চাচা নয়, ওদুর সঙ্গে একত্র কাজ করে বলিয়া সে আত্মীয়তা গুছাইয়া লইয়াছে।

ধোঁয়া দে বাবা, ধোঁয়া দে। আর এসব ভালো লাগে না।

খলিল তামাক সাজিয়া আনিল।

গহর কল্কে আজহারের হাতে দিয়া বলিল : খায়ের পো, তুমিই প্রথমে আরম্ভ করো।

থাক, তুমি শুরু কর। নরম সুরে জবাব দিল আজহার।

গহর অত্যন্ত বিনয়ী এখন, কল্কে গ্রহণ করিল না।

আজহার কয়েক টান দিয়া ধোঁয়া ছাড়িতেছে আরামে চোখ বুজিয়া। তখন গহর সহাস্যে আবার বলিতে থাকে : বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁ দাও, খায়ের পো। বড় কঠিন ঠাই দুনিয়াটা।

নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছিল আজহার। সে চোখ বুজিয়া ধূমপান করিতে লাগিল।

ওদুও কল্কের প্রত্যাশী, আজহারের মুখের দিকে সে চাহিয়াছিল। খলিল কর্তব্যস্থলে ফিরিয়া গিয়াছে। চুলায় চেলাকাঠ জ্বলিতেছিল, আগুনের আভায় দেখা যায় তার মুখ ঘামিয়া উঠিয়াছে।

গহর কল্কে হাতে লইয়া কথাবার্তা শুরু করে। জীবনের অভিজ্ঞতা তার অফুরন্ত। ব্যবসাজগতের বহু মানুষ, মিস্ত্রীরূপে সে দেখিয়া আসিয়াছে। উপনীত মন্তব্য তার সব জায়গায় এক; ঈমানদারের জায়গা নাই সংসারে।

আজহারের পকেটে তবি থাকে। ঠোঁটের এত তোড়ের মধ্যে সে এক-একটি দানা টিপিয়া লইতেছিল। অবাক হইয়া যায় আজহার, এই বয়সে এত অভিজ্ঞতা সঞ্চয়। করিয়াছে গহর!

ওদু!

ওদু আবার আড় হইয়া শুইয়াছিল বিছানার উপর। সে নিদ্রিত কিনা তারই পরীক্ষা লইল গহর!

কে রে।

ওদু, শোনো একটা মজার গল্প। সেবার আমি হাওড়ায় থাকি। এক ব্যাটা এসে বলে, মিস্ত্রি, আমার কাছে তোমার পাঁচ-সাত দিনের কাজ হবে, ফুরোনে ঠিক করে নাও। পাঁচ টাকা রফা হল। আমি টাকা চাইতে বলে এই তো, কাছেই আমার বাড়ি। দশটাকার নোট আছে, খুচরো নেই। তুমি পাঁচটা টাকা দাও, আমি দশটাকা বাড়ি থেকে দিয়ে দেব। আমার সঙ্গে এসো। যো হুকুম। পাঁচটা টাকা তার হাতে দিলুম। মিনিট দশেক দুজনে হাঁটার পর সে বললে, ঐ আমার বাড়ি। তুমি দাঁড়াও বাইরে, আমি টাকা আনি। মুসলমানদের বাইরে চটের পর্দা ঝুলছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি, দাঁড়িয়েই রইলাম। এক ঘণ্টা গেল, সে আর আসে না। শেষে চেঁচামেচি জুড়ে দিলাম। একটা আধবয়সী মেয়ে বেরিয়ে এল ডিপা হাতে। কাকে চাও? বাড়িওয়ালাকে, জবাব দিলাম। মেয়েটা হেসে বলে, এখানে বাড়িওলী থাকে, বাড়িওয়ালা থাকে না। ভেতরে আসবে নাকি? আমি তো অবাক! একদম বেউশ্যে পাড়া। গলির ওপাশ দিয়ে রাস্তা আছে, আমার বাড়িওয়ালা সে পথে পগার পার।

ওদু রস-নিষিক্ত গল্পের মহিমায় বোধহয় আবার উঠিয়া বসিল। মৃদু হাস্যে সে বলে, তারপর?

তারপর ঘোড়ার ডিম। বোকার মতো ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকা।

বাড়িওয়ালীর কাছে অপেক্ষা করলে না?

শুধু হাতে আর অপেক্ষা চলে না। শোনো, আরো আছে। বছর সাতেক পরে পোস্তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, দেখি একটা বড় কারবারি বসে আছে। আমার চোখে ধাঁধা লেগে গেল। সেই লোকটা গদির উপর, আর কত কর্মচারী চারপাশে।

ওদু তুড়ি মাড়িয়া বলিল, শেষে টাকা আদায় করলে বলো তা হলে।

আদায়! অবিশ্বাসের হাসি গহরের কণ্ঠে।

ভয়ে পালিয়ে এলাম। আমার ময়লা চিরকুট কাপড় আর এই চেহারা, সেখানে থু দিতে পারি?

আজহার তসবি টিপিলেও গহরের দিকে তার মোল আনা খেয়াল ছিল।

লোকটা ঠিক চিনেছিলে?

আলবৎ। কাবলীদের মতো চোখ। অত ভুল হয় না খায়ের পো। ঐরকম জুচ্চোরী ফন্দি এঁটে শেঠ হয়ে বসেছে এখন। ঈমানের কাল আছে আর?

তাহলে বেঈমান না হলে দুনিয়ায় বেঁচে থাকা যায় না। আর কোনো উপায় নেই?

আর্তনাদের মতো শোনায় আজহারের প্রশ্ন। গহরের মুখের দিকে এমন বিষণ্ণ দৃষ্টি ফেলিয়া সে চাহিয়া রহিল যে, গহর চোখ ফিরাইতে বাধ্য হইল। সেও এবার গম্ভীর হইয়া যায়, কণ্ঠে তার আভাস ফুটিয়া উঠিতেছিল।

উপায় যদি জানতুম, তাহলে এই দশা! আমার বিদ্যেতে কুলোয় না।

হতাশার তীব্র ব্যঞ্জনা মানুষের কণ্ঠস্বরে এমন করিয়া সহজে বাজে না। রূপকথা শুনিতে শুনিতে তার বাস্তব পদক্ষেপ যেন কাহিনীকার ও শ্রোতার সম্মুখে হঠাৎ উপস্থিত হইয়াছে, রূপকথা তাই আর জমিতেছে না; সভায় বোবার মতো সকলে দুই চোখ খুলিয়া কেবল চাহিয়া রহিয়াছে–যার কাজল গহনে শুধু বিস্ময়, ভয়, আর ভঙ্গুর মানস বুদ্বুদের জনতা।

সকলেই চুপচাপ। ঘরের কোণে জ্বলন্ত চুলার উপর হাঁড়ির ভেতর ছুঁই ছুঁই শব্দ উঠিতেছিল কেবল।

আজহার যন্ত্রচালিতের মতো তসৃবির দানা এক এক করিয়া টিপিয়া যাইতেছিল। দ্রুত চলে তার আঙুল। গহর পর্যন্ত কেন নির্বাক হইয়া গিয়াছে? সেও জবাব দিতে পারে না।

খলিল বাহিরে গিয়াছিল ভাতের ফ্যান গড়াইতে। তার অদ্ভুত চিৎকার শোনা গেল। আজহার ঈষৎ তড়িৎস্পৃষ্টের মতো হঠাৎ বলিয়া ওঠে : গহর, বাইরে কী হল?

স্ব স্ব পৃথিবীতে সবাই যেন আবার ফিরিয়া আসিয়াছে। ওদু, গহর, আজহার তাড়াতাড়ি বাহিরে ছুটিয়া আসিল।

খলিল তখন ফোপাইয়া কাঁদিতেছে। একপাশে ভাতের হাঁড়ি বসানো।

কী হয়েছে? সকলের মুখে ওই এক কথা।

আমার হাত পুড়ে গেছে। ও, মা গো

বয়সে ছোট বলিয়া সকলেই খলিলের মেহনতে নিজেদের বিশ্রামের আরাম খোঁজে। গহর এইদিকে বারোআনা গড়িমসি করে। নিজের ভাইপো বলিয়া ওদু একদম নবাব বনিয়া গিয়াছে।

আজহার অতি ব্যস্ততার সহিত বলিল, ঘরের ভেতর চলো। আলোয় দেখা যাক। একটু সাবধান হতে হয়, বাবা।

ওদু ধমক দিতে আরম্ভ করিল, এতবড় ছেলে, একটু উঁশগুশ নেই। পরের ছেলে নিয়ে এসে মুশকিল!

গহর অন্যান্য দিন নাবালকের উপর ওদুর তবি উপভোগ করে। আজ সে পর্যন্ত চটিয়া গেল।

ওদু, যা মুখে আসে তাই বলছিস! ওইটুকু ছেলে, দেড় সের চালের ভাত পসানো চাট্টিখানি কথা নাকি? নিজে তো ছমাসে একবারও হাঁড়ি ছুঁসনে।

ওদু গজর গজর করিতে লাগিল। গহরের কুঁড় ভয়ানক ধারালো, ওদু আর কথা বলিতে সাহস করিল না।

হুকুমজারি কণ্ঠেই গহর বলিল : আমরা দেখছি ওকে, হাঁড়িটা নিয়ে যাও ঘরে। না, কুকুরের মেহমানদারি হবে আজ।

ওদু নীরবে আদেশ পালন করিল। কিন্তু সে এমন চটিয়াছিল যে, খলিলের দিকে আর চাইয়াও দেখিল না।

খলিলের ডানহাতের আঙুলের আগাগুলো ফোস্কায় ভরিয়া উঠিয়াছে। গহর বারবার আপসোস করিতে লাগিল।

চুলায় জ্বাল দাও, দিয়ো। এসব কাজে আর হাত দিয়ো না, বাবা।

গহরের মুখে এমন সুমিষ্ট বাণী। খলিলের দগ্ধ আঙুলের যন্ত্রণা সামান্য উপশম হয় যেন। তাড়ি গিলে এসেছে নাকি গহর, হঠাৎ এমন কথাবাতা?

আজহার বলিল, আমি আলু বেটে দিচ্ছি। ফোঁসকার উপর জ্বালা বন্ধ হয়ে যাবে।

চটপট আলু বাটিতে বসিল আজহার। ততক্ষণে গহর ফোস্কার উপর তালের পাখার বাতাস করিতে লাগিল। তরকারি এখনও রান্না হয় নাই। হাঁড়ি লইয়া পড়িয়াছিল ওদু। এদিকে সে নির্বিকার।

ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়া আলুর পুলটিশ বাঁধিয়া দিল আজহার। হাতের যন্ত্রণা কমিয়া আসিতেছে ধীরে ধীরে।

আজও কৃতজ্ঞতার সহিত খলিল আজহারের মুখ অবলোকন করিতে লাগিল।

নিজের মনেই সে প্রশ্ন করিল : চাচা, তোমার দোকানটা বড় হলে আমাকে দোকানদার করবে?

আজহার তার মুখের দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাস্য করিল, কোনো জবাব দিল না।

সম্মতির এই আর এক নূতন পদ্ধতি মনে করিয়া আরো উৎফুল্ল হইয়া উঠিল খলিল।

আমার এই কাজ ভালো লাগে না।

ওদু খলিলের দিকে একবার চাহিয়া আবার রান্নায় মন দিল। দৃষ্টির ভেতর তার কী ছিল দেখা গেল না।

গহর এখনও হাত হইতে পাখা ফেলে নাই। মাঝে মাঝে খলিলের মুখ হইতে আহ্ উহ্ শব্দ উচ্চারিত হইতেছিল। জ্বালা থামিলেও কব্জি পর্যন্ত টনটন করিতেছিল তার।

আজহার চাচা, আল্লা আপনার দোকানটার বাড় দিত!

আজহার জবাব দিল : তোমার মুখে সুবন (সুবর্ণ) বষুক, চাচা।

গহর কোনো মন্তব্যের দিকে গেল না। পাখা রাখিয়া উঠিয়া পড়িল সে। তার হাত মুখ ধয়া দরকার। আজহার আবার বাতাস করিতে লাগিল।

ওদুকে যমের মতো ভয় করে খলিল। চাচা ভাইপোয় কদাচিৎ প্রাণ খুলিয়া বাক্যালাপ হয়।

দ্বিধা দ্বন্দ্বে দুলিয়া তবু বলে : ওদু চাচা, আমার মাকে খবর দিও না, সে বড় কাঁদবে। ওদু প্রথমে জবাব দিল না। কিছুক্ষণ থামিয়া বলিল, না, কাল-পরশু বাড়ি রেখে আসব তোকে। এখানে খামাখা বসে বসে খোরাকি খাওয়া।

প্রথমে উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল খলিলের মুখ, চাচার শেষ কথাগুলো তার সারা শরীরে কালি লেপিয়া দিল।

না চাচা, কাজ না শিখে আর ঘরে যাব না।

আচ্ছা তাই হবে, আর ডাল হবে, বলিয়া ওদু দুই ঠোঁট চাপিয়া তরকারির হাঁড়ির ঢাকনি খুলিল। শোঁ শোঁ শব্দ উঠিতেছিল, খলিল ক্লান্ত দৃষ্টি সেইদিকে মেলিয়া দিল। গহর ফিরিয়া আসিয়া পুনরায় পাখা হাতে লইল। সন্ধ্যার আড্ডা তার মেজাজ খারাপ করিয়া দিয়াছে, সহজে না কোনো বাঁকা কথা, না বাঁকা হাসি তার মুখে নিঃসৃত হইতেছিল।

রান্নার পর খলিলের বাসনে ডাল তরকারি মাখিয়া দিয়াছিল গহর। আজহার নিঃশব্দে এক লুমা তার মুখে তুলিয়া দিতে লাগিল। দগদগে হইয়া উঠিয়াছিল এতক্ষণে খলিলের আঙ্গুলের ফোসকা।

.

জুম্মার দিন। আজহার দুপুরের আগেই ভিনগায়ে নামাজ পড়িতে গিয়াছিল। দোকান বন্ধ রাখিতে হয় নাই, খলিল বিপত্তির জন্য কাজে বাহির হইতে অক্ষম। তাই সে-ই দোকান তদারক করিতেছিল। বসিয়া বসিয়া খোরাকি খাওয়া চাচা পছন্দ করে না, তাই আজহারের নিকট সে দুআনা মজুরি চাহিয়াছিল। অবশ্য নানা অনুনয়ের ত্রুটি করে নাই খলিল। গরীব বলিয়া সে এমন নির্লজ্জ প্রস্তাব উত্থাপন করিয়াছে। এ-কথা সে বারবার বলিয়াছিল। মজুরি লইয়া খলিল বাসায় খাইতে গিয়াছে, আসরের নামাজের সময় সে দোকানে আসিবে। আজহার চুপচাপ বসিয়াছিল। আজ খরিদ্দার বিশেষ নাই। সকাল ঝোঁক যা সামান্য বিক্রয় হইয়াছে। জোরে বাতাস বহিতেছিল। রাস্তার ধুলোয় জিনিসপত্র সাফ রাখা মুশকিল। আসবাবপত্র আজহার পরিষ্কার করিয়া আবার বিশ্রামে রত হইল।

দোকানের পশ্চাতে ঝাঁকড়া শিরীষের ডালে শশন্ শব্দ উঠিয়াছিল। মেঘের রং ঈষৎ কাজল, হয়তো ঝড় উঠিতে পারে। নিরুদ্দিষ্ট আকাশের যাত্রীদের সঙ্গী হইয়াছিল একঝক শীতের পাখি। আজহার তার কোনো সংবাদ জানিল না।

আনমনা বসিয়া থাকিলে নানা রাজ্যের চিন্তা আসিয়া ভিড় করে, সোয়াস্তি পায় না আজহার।

বাতাসের স্রোত হঠাৎমন্দীভূত হইয়া গেল। একটি কোকিলা কর্কশ শব্দ করিয়া সম্মুখের বাঁশবনের ঝোপে আসিয়া বসিল। একটু পরে পথের মোড়ে শিসের শব্দ শোনা গেল।

আরো নূতন পাখি আসিল নাকি? শিসের শব্দ ক্রমশ নিকটবর্তী হইতে লাগিল।

সড়কের দিকে মুখ ফিরাইয়া আজহার অবাক হইয়া গেল।

 চন্দ্রের সর্বাঙ্গে দৃষ্টি বুলাইবার পূর্বে সে সুইৎ শব্দে শিসধ্বনির সমাপ্তি-রেখা টানিয়া আজহারের দোকানের সম্মুখস্থ বাঁশের উঁটির উপর বসিয়া পড়িল।

কোটাল, তুমি?

কৌতূহলে চন্দ্র কোটালের চক্ষুতারকা নাচিতে থাকে। আবার শিস দিয়া সে গুনগুন করিতে লাগিল :

মথুরায় ফিরে এসে
ভুলে গেছ বিন্দাবনের কথা।
আমি তোমায় চিনেছি শ্যাম,
খাইনি চোখের মাথা।

আজহার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য উন্মুখ। কোটালের গান আর থামে না।

চন্দর, একটু থামো ভাই। জোর গলায় ডাকিল আজহার।

 আগে বিড়ি দাও।

পা নাচাইতে থাকে চন্দ্র।

বিড়ি পান তামাক সব দিচ্ছি। বাড়ির ছেলেপুলেরা কেমন আছে?

গোঁফে তা দিয়া কোটাল জবাব দিল না, মুখ নিচু করিয়া বিড়ালের হাসি হাসিতে লাগিল।

অধৈর্য হইয়া উঠিয়াছিল আজহার, সব ভালো আছে?

আবার গোঁফে লম্বা তা। মাথা দোলাইয়া চন্দ্র জবাব দিল, আমি তার কী জানি?

হাতের তালু প্রসারিত করিয়া চন্দ্র মিটিমিটি হাসিতে লাগিল।

ছেলেরা ভালো আছে?

আসরের নামাজের সময় নিকটবর্তী। খলিল দোকানের সম্মুখে আসিয়া নীরবে দাঁড়াইল। এই লোকটিকে দেখিয়া সেও হতবাক। মনে মনে ভয়ানক হাসি পাইতেছিল তার।

খলিলের দিকে নজর পড়িল চন্দ্র কোটালের।

কার ছেলে, আজহার ভাই? ও বাবা, এখানে তাহলে সংসার পেতেছ? নিকে করলে নাকি ছেলেসুদ্ধ?

খলিল লজ্জায় মরিয়া যাইতেছিল। আজহার অসোয়াস্তি প্রকাশ করিয়া বলিল : চন্দর, থাম্ একটু। ও দোকান দেখেশোনে মাঝে মাঝে। আমাদের এক মিস্তিরির ভাইপো।

তাই ভালো। ঘরেও সব ভালো। আগে একটা বিড়ি দাও, তবে সব খুলে বলব।

আজহার জবাব দিল : কোটাল, একটু মিষ্টি আনিয়ে দিই, তারপর বিড়ি খাও।

না, ওসব দরকার নেই।

অগত্যা আজহার বিড়ি-দেশলাই বাহির করিয়া দিল।

চন্দ্র কোটাল নিশ্চিন্তে ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে বলিল : সব ভালো আছে, ভগবানের দিন তো আটকে থাকে না কারো জন্য। তবে কখনো কখনো দুপায়ে চলে আর কখনো হামাগুড়ি দিয়ে, কখনো চার হাতপায়ে চালাতে হয়।

প্যাঁচ কষা কথা আজহারের সহজে বোধগম্য হয় না, আজ অবশ্য পরোক্ষ অনুভূতির সাহায্যে নির্দয়ভাবে সবকিছু উপলব্ধি করিল।

খাঁ এইদিকে চতুর। মনের হঠাৎ-জাগা কোনো বেদনা সে অন্য কথায় ঢাকিতে চায়।

অনেক দূর থেকে এসেছ। চলো, একটু ঠাণ্ডা হয়ে মিষ্টি খাও। আর কোনো কাজ আছে?

কাজ! চন্দ্র কোটাল ভ্রুকুটি করিল। অনেক কাজ। দোকানটার মালপত্র গুটিয়ে এখনই মহেশডাঙা রওনা হতে হবে।

আজহার যেন সব ঘুলাইয়া ফেলিতেছে।

শিগগির কেন? দোকানটা কিছুদিন দেখব।

চন্দ্র এবার সত্যই গম্ভীর হইয়া উঠিল। ভয়ানক তিক্তকণ্ঠেই সে জবাব দিল : ওসব রাখো। আর লাখ টাকা কমাতে হবে না। কমাসে ঘরের কী দুর্দশা হল দেখে আসবে চলো। জমি কবিঘে পর্যন্ত রহিম বখশ নিয়ে নিল। কদ্দিন ফেলে রাখবে সে। দরিয়াভাবী বলে সংসার চলছে, আর কেউ হলে ঢি ঢি করে ছাড়ত।

আজহার লজ্জায় মাথা নিচু করিল, চোখের কোণ তার সজল হইয়া উঠিয়াছে।

হাঁড়ির খবর আর হাটে ভেঙে লাভ নেই। তোমার চাদর দিয়ে এইতো কটা জিনিসপত্তর–বেঁধে নিয়ে, চলো সরে পড়ি।

খলিল বোবা অবোধ শিশুর মতো আগন্তুক খ্যাপা লোকটির গতিবিধি আড়চোখে লক্ষ্য করিতেছিল।

ঢের উপায় হয়েছে বিদেশে। চলো মহেশডাঙা। শাকপাতা খেয়ে চোখের উপর তবু সংসারটা দেখতে পাবে।

শিকড়-বশীভূত সাপের মতো আজহার আর মাথা তুলিল না।

চন্দ্র সত্যই নাছোড়বান্দা। আজহার মৃদুভাবে নানা আপত্তি জানাইল, কিন্তু কিছুই টিকিল না। এক ঘণ্টার মধ্যে চাঁদরে মনিহারী পণ্যগুলি বাঁধা পড়িল। চন্দ্র নিজে সড়কের ওপাড়ে এক পানওয়ালার নিকট কাঠের শেফ কটা বিক্রয় করিয়া দিল। ক্ষতি হইল এক পয়সা। সে তো আজহার খাঁ নয়।

কেমন বর্বর মনে হয় চন্দ্র কোটালকে খলিলের নিকট। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সুগোল, গুম্ফবিশিষ্ট কোনো দৈত্য নয়, হঠাৎ শাহানপুরে আসিয়া সব লণ্ডভণ্ড করিয়া দিয়া গেল।

আজহার প্রদত্ত একমুঠো মুড়ি-লজেঞ্চুস যা একমাত্র সান্ত্বনা।

বাসায় তখনও মিস্ত্রিরা ফিরিয়া আসে নাই। কারো সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজনও ছিল না আজহার খাঁর। নিজের সূমি কন্নিকা-পাটা গুছাইয়া লইবার জন্য সে একবার বাসায় গিয়াছিল। খলিলের মনমরা ভাব দেখিয়া সে সত্যই ব্যথিত হইল।

একবার সময় এলে আমাদের গায়ে এসো। মহেশডাঙা, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ধারে।

আচ্ছা, চাচা।

অনেক দূর আগাইয়া আসিল খলিল। জল্লাদখানার গহ্বরে সে একজন সমব্যথী হারাইল।

চন্দ্র কোটাল দোকানের মালপত্র পিঠে ঝুলাইয়া লইয়াছিল।

হাঁটিতে হাঁটিতে সে বলিল : ঘাবড়ে যেও না, খা ভাই। সামনে পুন্য মতে পীরের মেলায় সব বিক্রি হয়ে যাবে।

আজহার ছোট একটি পুঁটলি লইয়া হাঁটিতেছিল, কোনো জবাব দিল না।

পড়ন্ত দিনের শেষভাগ। রৌদ্র মরিয়া গিয়াছে। গাছপালা ছায়া দীর্ঘতর হইয়া সড়কের উজ্জ্বলতা মুছিয়া দিতেছে।

জনপদ ছাড়াইয়া চন্দ্র গান ধরিল :

মথুরা ছেড়ে কোটাল যমালয়ে চলে,
মাঠে মাঠে গোপিনীরা ভাসে চোখের জলে,
ও-ও-ও-ও-ও।

আজহার হাসিয়া উঠিল। বলিল : চন্দর, আবার ভাড়-নাচের দলটা জমাও। গান বাঁধতে এখনও বেশ পারো।

চন্দ্র মাথা দোলায়, সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের বোঝা দুলিতে থাকে।

 দেশে মানুষের দশা ভালো থাকলে চন্দরকে কি আর এত বোঝা বইতে হয়!

ঘাড়ের বাম দিকে বোঝা ঝুলিতেছিল, কোটাল ডাহিনে লইয়া একবার ঝাঁকুনি দিল।

শুয়ো ওয়ো-ওয়ো_শ্যাম, এত দুক্ষু দাও রে
ধিকিধিকি তুষের আগুন মাঠের উদাস বাও রে

সড়কের সর্পিলতা দূরে নিয়ামতপুরে গিয়া মিশিয়াছে। আরো দশমাইল দূরে মহেশডাঙা। দ্বাদশীর চাঁদ আকাশে বহুক্ষণ আগেই আসর জুড়িয়াছিল। প্রান্তরের হাহাশ্বাস বাতাসের মূচ্ছনায় বিলীন কোনো দিনের ইতিহাস যোজনা করিতেছিল। শব্দায়িত বিষণ্ণতা জলা-জাঙালে।

চন্দ্র শিস দিতে লাগিল, শ–ওয়ো–ওয়ো–ওয়ো—

.

১২.

অঘ্রান মাসের ভোরবেলা। দরিয়াবিবির ঘুম ভাঙিয়াছিল অনেকক্ষণ। ধান সিদ্ধ করিবার জন্য রাত্রির বিশ্রামটুকু বহু আগেই তাকে বিসর্জন দিতে হইয়াছে।

সামান্য শীত পড়িয়াছিল। তরল কুয়াশায় আচ্ছন্ন গাছপালার উপরে নিষ্প্রভ তারকার দ্যুতি তখনও মিটিমিটি জ্বলিতেছিল।

মোটা শাড়ির আঁচলে পুরু করিয়া বুক ঢাকিয়া দরিয়াবিবি সিদ্ধ ধান আঙিনার একদিকে ঢালিয়া রাখিতেছিল। ডাবা হইতে ভিজে ধান হাঁড়ি-ভর্তি করার সময় ভয়ানক শীত ধরে। চুলার নিকটে অবশ্য উত্তাপ পাওয়া যায় কিছুক্ষণের জন্য।

রাত্রে ভালো ঘুম হয় নাই। বারবার হাই উঠিতেছিল দরিয়াবিবির। আজহার-নঈমা ঘুমাইয়া রহিয়াছে। আসেকজানের কাছে আমজাদ এখনও নিদ্রায় অচেতন। দরমায়। মাঝে মাঝে মোরগ ডাকিতেছিল। বড় কর্কশ মনে হয় তার শব্দ।

চুলায় জ্বাল দিতে দিতে ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল দরিয়াবিবি। মাস চার পরে নূতন সন্তানের জননীর শিরোপা মিলিবে, এই চিন্তা বারবার পীড়া দিতেছিল তাকে। স্ফীত জঠর লইয়া পরিশ্রমের কামাই নাই। দরিদ্রের গৃহে ইহারা কেন ভিড় করিতে আসে? নঈমার চোখের পিচুটি ভালো হইতেছে না। যদি অন্ধ হইয়া যায় সে। গরিব মেয়ের হয়তো বিবাহই হইবে না। সদরের দাঁতব্য হাসপাতাল পাঁচ মাইলের পথ। অতদূর কচিমেয়ে হাঁটিয়া যাইতে পারিবে? আমজাদের মতবে পড়া শেষ হইয়া যাইবে এই বৎসর। তার আগামী শিক্ষার কোনো বন্দোবস্ত নাই। চন্দ্র কোটাল জমিগুলি নিজের নামে বিলি করিয়া লইয়াছিল বলিয়া তবু চাষাবাদের জীবিকার সম্বল রহিয়াছে–নচেৎ তা-ও ধূলিসাৎ হইত।

হঠাৎ ফিক ব্যথা ধরিয়াছিল দরিয়াবিবির জঠরে। চুলার আগুনে তার ফ্যাকাশে পাষাণ-স্তব্ধ মুখটি আরো কালো হইয়া গেল। পেটের কাপড় খুলিয়া চুলার উত্তাপ লাগাইতে রত হইল দরিয়াবিবি। আরো আঁকিয়া আসে ব্যথা। এখনও দু-হাঁড়ি ধান সিদ্ধ করিতে হইবে। দরিয়াবিবির মুখে কোনো আর্তনাদের শব্দ উত্থিত হইল না। উঠানে সিদ্ধ ধানের স্থূপ, তখনও উত্তপ্ত ধোঁয়াটে বাষ্প উখিত হইতেছে। দরিয়াবিবি তাড়াতাড়ি তারই উপর ঈষৎ জঠর চাপিয়া শুইয়া পড়িল। বারবার আশঙ্কিত হইতে লাগিল, এখনই সে অজ্ঞান হইয়া পড়িবে।

একটু আগে শীতে কাঁপিতেছিল। এখন সর্বাঙ্গ ঘামিয়া উঠিয়াছে। কপালে স্বেদবিন্দু চকচক করিতেছিল।

দরিয়াবিবি চারিদিকে চোখ ফিরাইল। বাস্তুর নিচে গাছপালা স্তব্ধতায় ভোরের আলোক পান করিতেছে। নীল কলাবনের উপরটার শুকতারা অন্য দিনের চেয়ে আজ উজ্জ্বলতর মনে হয়। তবু ধূসর আকাশের চত্বরভূমি।

অকস্মাৎ সটান হইয়া ধানের স্তূপ আলিঙ্গন করিয়া শুইয়া পড়িল দরিয়াবিবি। অসহ্য বেদনায় তার পা কাঁপিতে থাকে। একবার শব্দ করিয়া দাঁতে দাঁতে চাপিয়া নিশ্চল পড়িয়া রহিল উলঙ্গ ইভের প্রতীক বহনকারিণী ভূলুণ্ঠিতা জননী।

সিদ্ধধানের উত্তাপে বেদনার কিঞ্চিৎ উপশম হইলে আবার চুলার মুখে আসিয়া বসিল দরিয়াবিবি। ধান টিপিয়া দেখিল, এইবার নামাইবার সময় হইয়াছে। দ্রুত হাত চালাইতে লাগিল সে।

এমন কর্মোন্মত্ত কেন দরিয়াবিবি? সংসারে শুধুমাত্র তারই স্কন্ধের জন্য! তার স্বামী নাই, আজহার নাই?

এক হাঁড়ি নামাইবার পর চুলায় জ্বাল দিতে দিতে দরিয়াবিবি পুনরায় চিন্তাস্রোতে মগ্ন হইয়া যায়। জগদ্দল প্রস্তর-শিলার বুকে প্রস্রবণের বুদ্বুদ উপল-রেখায় মৃদু তরঙ্গে সমাহিতি চায়।

চোখ বুজিয়া আসিতেছে ঘুমে, তবু কর্তব্যের বেড়ির নাগপাশ শিথিল করিবার কোনো উপায় নাই। ধীরে ধীরে চুলায় জ্বাল দিতে লাগিল দরিয়াবিবি। উবু হইয়া বসার ফলে শিরদাঁড়া টনটন করিতেছে। একটি পিড়া সে টানিয়া আনিল ঘরের দাওয়া হইতে।

দিগ্বলয়ে প্রভাতের আলোর জোয়ার আরম্ভ হইয়াছে মাত্র। বনানীর নিঃসঙ্গে রাত্রি চরা পাখি বিশ্রামের জন্য ঠাই খুঁজিতেছে। প্রত্যুষের মনোহরণ ঝঙ্কারে জাগিয়া উঠিতেছে পশু-পাখি তরু-লতা কিষাণ-জনপদের অধিবাসীরা। গ্রামান্তর হইতে মুয়াজ্জিনের আল্লাহু আকবর ধ্বনি-মূর্ঘনার রেশ রাখিয়া গেল মহেশডাঙার জলা-জাঙালে।

খাঁ-পাড়ার আশেপাশে স্নানার্থী যুবতী-বধূ ছাড়া আর বোধহয় কেহ জাগে নাই। আরো কত না রাত্রি দরিয়াবিবি একাকী জাগিয়া এমন সাংসারিকতায় নিজের সামান্য বিশ্রামটুকু বিসর্জন দিয়াছে। কোনো ক্ষোভ নাই মনে। নিপ্রাণ লৌহকঠিন পাথরের মূর্তির মন ঝাক্ষুব্ধ প্রহরে বর্ষণের আঘাত নীরবে সহিয়া যাওয়া শুধু, প্রান্তরের দিকে ভাস্করের দূরপ্রসারী দৃষ্টির ছায়া মেলিয়া দিয়া। আজও তেমনই নীরবতায় নিজেকে আবৃত করিয়াছিল দরিয়াবিবি। অলক্ষিতে কখন চোখের কোণে অশ্রু জমিয়াছে, তারও খোঁজ রাখে নাই সে। পেশি, স্নায়ু আর মনের মিতালি অজানিতেই আসিয়াছে।

গণ্ডদেশে তপ্ত একফোঁটা অশ্রু-পতনে দরিয়াবিবি সজাগ হইয়া উঠিল। চোখ মুছিয়া চারিদিকে করুণা-বিহ্বল দৃষ্টির সাহায্যে অবলোকন করিতে লাগিল।

দাওয়ার পাশে রান্নাঘর, তার পাশে টাটির বেড়া। গোয়ালঘরে যাওয়ার পথ। ভিটের ধারে গাছপালা আছে বলিয়া এইদিকে এখনও অন্ধকারের ভিড়। চুলার আলোর ঝলকানি তার ঠোঁটের উপর পড়িয়াছিল। হঠাৎ মানুষের ছায়া দেখিয়া দরিয়াবিবি দৃষ্টি আরো সজাগ করিল। মানুষের শিরোদেশের ভাঙা-ভাঙা ছায়াই তো বটে!

সকালে চোর আসে না, দরিয়াবিবিও ভয় পাওয়ার পাত্রী নয়; সে উঠিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু অগ্রসর হওয়ামাত্র ছায়া সরিয়া গিয়াছে। টাটি খুলিয়া দরিয়াবিবি চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। না, কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন নাই। মনে একটু খটকা লাগিল। আনমনা দরিয়াবিবি আবার চুলাশালে ফিরিয়া আসিল।

এইবার চোখকে অবিশ্বাসের কিছু নাই। সেই ছায়া তেমনই অবিকল টাটির উপর। কিন্তু অগ্রসর হওয়ামাত্র মিলাইয়া গেল।

ভয়ানক ধাঁধায় পড়িয়াছিল দরিয়াবিবি। জিন-ভূতের ব্যাপার নয় তো। একটু ভীত হইল আজহার-পত্নী। কিন্তু তৃতীয়বার টাটি খুলিয়া দেখিল, একটি দশ-বারো বছর বয়সের বালক কাঁঠালগাছের ছায়ায় দাঁড়াইয়া আছে। ভোরের আলো তখনও এখানে অপরিচিত, ছেলেটির মুখে উজ্জ্বলতা পড়ে নাই।

এই খোকা। দরিয়াবিবি ডাক দিল। ছেলেটি ভোরের আলোকের ছায়ায় পা-পা করিয়া কিছুদূর আগাইয়া গেল।

দাঁড়াও। আপ্ত রমণীর কণ্ঠ ধ্বনিত হয়। ছেলেটির গমন নিরস্ত, হঠাৎ মুখ ঢাকিয়া সে ফোঁপাইতে লাগিল।

দরিয়াবিবি ছেলেটিকে কোলে টানিয়া বলিল : কাদের ছেলে, খোকা? বাপ মরেছে বুঝি? পালিয়ে এসেছ?

সে কোনো জবাব দিল না। ফোঁপাইতেছিল, এখন স্তব্ধ হইয়া গেল। মাঝে মাঝে তবু ফোপানির শব্দ ভোরের বাতাসে আলোড়ন তোলে।

কাদের খোকা তুমি? দরিয়াবিবি তাকে তপ্ত বক্ষের পাশে গভীরে টানিতে লাগিল অচেতন স্নেহে।

দরিয়াবিবির ঠোঁটে হাসি খেলিয়া যায়। বেশ ছেলে তো। জবাব দেবে না?

এখনও এখানে অন্ধকারের ঘোর কাটে নাই। গাছের পাতায় অলস সমীরণের কানাকানি ধ্বনিত হয়।

আবার ফোঁপাইতে শুরু করিয়াছে ছেলেটি। কোনো জবাব নাই তার মুখে।

অগত্যা দরিয়াবিবি বলিল : তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি নে, চলো আমাদের ঘরে।

মন্ত্র-মোহিতের মতো বালকটি দরিয়াবিবির বাহুবেষ্টনে থাকিয়া হাঁটিতে লাগিল।

উঠানে ভোরের আকাশ থামিয়া পড়িয়াছে। মানুষের পরিচয় স্বচ্ছ দৃষ্টির কাছে অগোচর থাকে না।

খোকা, তোমার নাম কী।

বালকটি দরিয়াবিবির ডাগর চোখের দিকে নিজের আকৰ্ণবিস্তৃত দুই নয়ন মেলিয়া দিল। গভীর মমতাময়ী আঁখিপল্লবের অন্ধকার দূর হইতে-না-হইতে দরিয়াবিবির চোখে পড়িল বালকের জ্বর উপরে কালো দাগ।

বিস্মৃতির তিমির কে যেন এক নিমেষে মুছিয়া দিল।

মোনাদির, আমার মুনি! অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে কয়েকটি কথা আধস্পষ্ট গুঞ্জরিত শুধু হয় নাই। সেইখানে বালকটিকে গভীরে বুকে বাঁধিয়া অকস্মাৎ বসিয়া পড়িল দরিয়াবিবি। তারপর শুরু হইল অঝোর আঁখির উৎসমুখের প্রস্তর-বিদারণ।

ডুকরাইয়া কাঁদিতে লাগিল মোনাদির মার কোলে মাথা খুঁজিয়া। বাইরের প্রভাত স্নিগ্ধ আলো আর বায়ুতে আজ আর এতটুকু মমতাও ছড়ানো নাই।

একটু বসো, বাপ আমার।

সিদ্ধধান একটু আঁচ ধরিয়াছিল, পোড়া গন্ধ উঠিতেছে। দরিয়াবিবি মোনাদিরকে বসাইয়া রাখিয়া তাড়াতাড়ি হাঁড়ি নামাইল।

ধান ঢালা হইল যথাশীঘ্র। মোনাদির মাঝে মাঝে ফোঁপাইয়া কাঁদিতেছে। অপরিচিত পরিবেশে তার চোখ কৌতূহলের কোনো নেশায় ডুবিয়া যায় না। সে মার মুখের দিকে বারবার চাহিয়া থাকে।

কাজ শেষ হইয়া গেল, সে মোনাদিরের কচি মুখ তুলিয়া তার ডাগর চোখের দিকে চাহিয়া রহিল।

গরিব দাসীমাকে এতদিনে মনে পড়ল? ধরা-গলায় কথা শেষ করিয়া দরিয়াবিবি কচি ঠোঁটে-মুখে বারবার চুম্বন করিতে লাগিল। মাঝে মাঝে সে-ও ঊর্ধ্ব-নিবদ্ধ নয়নে নীলিমার প্রশান্তি চয়ন করিবার উদ্দেশ্যে বোধহয় আকাশের দিকে মুখ ফিরাইয়াছিল।

বেশ ভালো ছিলে, মুনি?

মুনি সলজ্জ কণ্ঠে জবাব দিল : হ্যাঁ, মা।

দরিয়াবিবি তাহাকে কোলে তুলিয়া খুঁটিনাটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল।

একটু পরে আসিল আজহার। ফজরের নামাজ শেষ করিয়া সে দহলিজ হইতে ফিরিতেছিল। দরিয়াবিবির কোলে একটি অপরিচিত বালক দেখিয়া সে বিস্মিত।

কার ছেলে কোলে?

মাথায় তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া দিয়া দরিয়াবিবি নম্রকণ্ঠে জবাব দিল, আমার ছেলে এসেছে।

বাঃ, বেশ সুন্দর ছেলে তো। কী সুন্দর চোখদুটো।

দরিয়াবিবির মুখ রাঙা হইয়া উঠিতেছিল।

বাপ মুনি, তোমার আব্বাকে সালাম করো।

যন্ত্রচালিতের মতো মোনাদির আজহারের পায়ে কদমবুসি শেষে আবার মার কোলে ফিরিয়া আসিবার উপক্রম করিল।

তোমাকে যেতে দেব না।

আজহার চিবুক ধরিয়া তার মুখ নিরীক্ষণ করতে লাগিল।

তুমি আমার বাবাজি আজ থেকে। আমি তোমার ছেলে।

নিজের রসিকতায় আজহার হাসিতে থাকে। তার স্বভাবের রীতিমতো ব্যতিক্রম।

তোমার নাম বলল।

মোনাদির লজ্জায় মাথা নিচু করিল। জবাব দিল দরিয়াবিবি, মোনাদির হোসেন খাঁ। আমি মুন ডাকতাম।

বেশ, বেশ। আমার মুনি বাবাজি।

হঠাৎ আজহার চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিল, আমু-নঈমা-আমু

তারা বিছানা ছাড়িয়া সকলে ছুটিয়া আসিল কয়েক মুহূর্তে। ভোরের বেলা বিছানায় জাগিয়া কল্পনা করিতে আমজাদের খুব ভালো লাগে।

দেখে যা আমু-নঈমা, তোদের বড়ভাইকে দেখে যা।

তারা বিস্মিত নয়নে শিশুসুলভ বিহ্বলতায় মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

আজহারের উচ্ছ্বাস দেখিয়া দরিয়াবিবি মনে মনে আনন্দিত হয়। তার কোলে মোনাদির উপবিষ্ট বলিয়া নঈমা আমজাদ দূরে দাঁড়াইয়াছিল।

আয়, কাছে আয়, তোদের বড়ভাই।

মোনাদির কোনো কথা বলিল না। আমজাদের হাত নাড়াচাড়া করিতে লাগিল। তার সস্নেহ দৃষ্টি নঈমার উপর পড়িলেও পিচুটি-ভরা চোখের জন্য কেমন যেন লাগিতেছিল তাকে।

দরিয়াবিবি নৈরাশ্য-ক্লান্তি নিমেষে কখন ভুলিয়া গিয়াছে। ফল্গুধারার মতো আনন্দের অন্তঃস্রোত তার পাঁজরে নূতন মেঘের মতো খেলিয়া যায়।

তুমি ছেলেদের সঙ্গে ভাব করিয়ে দাও। একটা কলার কাঁদিতে রঙ ধরেছে দেখে। এসেছিলাম কাল, আজ পেকে গেছে নিশ্চয়। সকালবেলাটা ছেলেদের ভালো নাস্তা হবে।

দরিয়াবিবি দ্রুতগতি চলিয়া গেল। মোনাদির মার গমনপথের দিকে চাহিয়া থাকে।

আজহার বলিল : তোমরা খেলা করো, আমি হুঁকোটা ধরিয়ে আনি। আমজাদ, তোর আজ মক্তবে গিয়ে কাজ নেই।

আনন্দে সে উঠানময় ছুটাছুটি করিতে লাগিল।

.

১৩.

হঠাৎ নূতন কর্মোদ্যম ফিরিয়া আসিয়াছে দরিয়াবিবির। আজহার অবাক হইয়া যায়। স্বামী-স্ত্রীর ভেতর সংসার-যাপনের যুগ্ম-বন্ধন থাকিলেও, এতদিন বড় ফাঁকা ঠেকিত সবকিছু। দরিয়াবিবি পাষাণই তো বটে। আজকাল হৃদ্যতার নব মুকুল প্রস্ফুটিত হইতেছে কিষাণ-দম্পতিকে ঘিরিয়া। স্নেহযত্নের আতিশয্যের কোনো কূল-কিনারা করিতে পারে আজহার।

মোনাদির কয়েক দিনেই অপরিচয়ের বেড়াগুলি ভাঙিয়া ফেলিয়াছে। আজহার আমজাদ অপেক্ষা মোনাদিরকেই যেন বেশি স্নেহ করে। কোনো ফাঁই-ফরমাশ তাকে। খাঁটিতে হয় না। গাঁ হইতে এক মাইল দূরে মাইনর স্কুলে আজহার তাকে ভর্তি করিয়া দিয়াছে। মাইনাপত্র যোগাইবার সাহস আছে তার। দরিয়াবিবির উৎসাহ কম নয়। পুরাতন দিনগুলির স্মৃতি কিছুটা উত্তাপ অবশ্য হ্রাস করিয়া ফেলে। আমজাদের মতবের পড়া আর দুমাস পরে শেষ হইয়া গেলে দু-ভাইয়ে একসঙ্গে স্কুল যাইবে। এখনও দুমাস। একা একা মোনাদির স্কুলে যায়, দরিয়াবিবি তার জন্য খুব উতলা হইয়া পড়ে। নদীর ধারে ছেলেদের সঙ্গে খেলা করিতে করিতে একদিন তার বাড়ি ফিরিতে প্রায় সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল, সেদিন সকলের খাওয়াদাওয়া সারিতে রাত্রি বারোটা বাজিয়া গেল। বিকালে দরিয়াবিবি রান্না চড়ায় নাই।

মোনাদির আসেকজানকে দুচোখে দেখিতে পারে না। তার নোংরামির নানা কীর্তন করে সে মায়ের কাছে। আমজাদ অবশ্য কোনো বিপত্তি তোলে নাই। ঘর মাত্র দুখানা। মোনাদির আসেকজানের কাছে ঘুমাইতে নারাজ।

বুড়ির মাথায় যা উকুন। অগত্যা দরিয়াবিবি নিজের ঘরেই তাকে স্থান দেয়। এখানেও উশখুশ করে মোনাদির। তার সহজে ঘুম হয় না, সে উপলব্ধি করিয়াছিল। এইজন্য আর একটি চালা তৈরির বায়না ধরিয়াছিল দরিয়াবিবি। ঘরে চালের সঙ্গে চাল বাড়াইয়া একটি ছোট ছোট বেড়ার কামড়া প্রস্তুত করিয়া ফেলিল আজহার। চন্দ্র কোটাল শুধু তার গতরের মেহনত নয়, খড়ও দিয়াছিল দশগণ্ডা। এই ঘরে মোনাদির আর আমজাদ। লেখাপড়া করে, বইপত্র রাখে। পাশে উদ্বাস্তু এলাকা, গাছপালায় ভরা। জোছনা রাত্রে আমজাদ মোনাদির দুইজনে প্রাণ খুলিয়া গল্প করিতে করিতে ঘুমাইয়া পড়ে। আসেকজান এইজন্য আফসোস করে নাই। আমজাদ তার কাছ হইতে সরিয়া গিয়াছে। কোনো কোনো রাত্রে বুড়ি হামাগুড়ি দিয়া তাদের কামরায় প্রবেশ করে। হয়তো এতক্ষণ গল্প চলিতেছিল, বুড়ির আগমনে চুপ হইয়া যায় দুই ভাই। মোনাদিরকে বুড়িও খুব ভালো। চোখে দেখে না। বুড়ো পাখি কী পোষ মানে বৌমা, চাল-ছোলা খাওয়ানোই সার। দরিয়াবিবির ধমকে আসেকজান আর এমন কথা কোনোদিন মুখে তোলে নাই। সে মনে মনে তুষের আগুন ধোঁয়াইয়া রাখিয়াছিল। আমজাদকে একা পাইলে বুড়ি নানা মন্ত্রণা দিয়া মনের ঝাল মেটায়। আমজাদও সহজে আসেকজানের ছায়া মাড়ায় না। তোমার ব্যাটা, দরিয়াবৌ, মদ্দ হয়ে গেছে, আর আমার কাছে শোবে কেন? ক্ষোভ মিশিয়া থাকে কথাটায়।

তবু মোনাদির এই সংসারে এক ব্যাপারে অনাত্মীয়। দারিদ্রের কোনে ছায়া তার। চোখে পড়ক, দরিয়াবিবি তা পছন্দ করে না। স্বামী-স্ত্রী ফিফিস্ করিয়া দেনা-পাওনার কথা বলে। ঘরে চাল বাড়ন্ত হইলে দরিয়াবিবি পূর্বের মত আর হৈ-চৈ করে না স্বামীর সঙ্গে। পাছে কথাটা মোনাদিরের কানে পড়ে। হয়তো তার ফলে একদিন আবার চলিয়া যাইবে সে। পরাশ্রিত, তবু নিশ্চয় এমন গরীব হালে সেখানে মোনাদির দিন কাটায় নাই। আজহার খাঁর লুঙি ছিঁড়িয়া গিয়াছিল। নামাজ শুদ্ধ (সহীহ) হয় কি না সন্দেহ। সিজদার সময় হাঁটু বাহির হইয়া পড়ে। সে নিজে লুঙি না কিনিয়া মোনাদিরের হাফপ্যান্ট ও শার্ট কিনিয়া দিল। বালক হইলেও মোনাদির সংসারের শ্রী সম্পর্কে সচেতন। মার অনাত্মীয়ভাব সে কোনোদিন তলাইয়া দেখে নাই। মার সঙ্গীই তো আশীবাদের সমান। অন্য কিছু নিষ্প্রয়োজন।

মোনাদিরের সবচেয়ে ভাব হাসুবৌর সঙ্গে। মাত্র কয়েকদিনে এমন আপন করিয়া লইয়াছে সে দরিয়াবিবির এই সন্তানটিকে। যেদিন স্কুল থাকে না, সারাদুপুর কাটে সাকেরের বাড়িতে। আমজাদ আর মোনাদির বইয়ের গল্প পড়িয়া শোনায়। অসহায় এই বধূটি নূতন করিয়া প্রাণপ্রাচুর্যের সন্ধান পায়। সাকেরের সঙ্গে মোনাদিরের মাখামাখি। আরো বেশি। আমজাদ পূর্বে সাকেরকে এড়াইয়া চলিত। সে-ও আজকাল মোনাদিরের দেখাদেখি সাকের চাচার সঙ্গে সখ্য পাতাইয়াছে। মোনাদিরকে সে লাঠিখেলা শেখায়। দরিয়াবিবি তা পছন্দ করে নাই। তার সুন্দর কিশোর পুত্র চোয়াড় না হইয়া যায়।

জলা-জাঙাল, গোঠ-মাঠ নূতন ভাষা খুঁজিয়া পাইয়াছে। আমজাদও ফাঁইফরমাশ শুনিতে চায় না, কেবল মোনাদিরের সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়াইতে ভালোবাসে। আজহার বর্তমানে পরিশ্রমের মাত্রা বাড়াইয়া দিয়াছে সংসারে একজন প্রাণী বাড়িয়াছে বলিয়া। আমজাদকে এই সময় তার বেশি দরকার। সে কিন্তু ধরাছোঁয়া দেয় না।

চন্দ্র কোটালের সঙ্গে আজহার খাঁ শকরগঞ্জে আলুর চাষ করিয়াছিল। কচি লতায় নদীর চর পূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। গোড়ায় আলু ধরে নাই তখনও। মোনাদির আমজাদের সঙ্গে এই কচি গাছ তুলিয়া মূলের মিষ্টতা আস্বাদ করিতে খুব ভালোবাসে।

একদিন চন্দ্র কোটাল দুইজনকে হাতেনাতে ধরিয়া ফেলিল।

সব আলুমূল খাওয়া হচ্ছে।

এক বাবলা বনের আড়ালে তাড়ি গিলিয়া শুইয়াছিল কোটাল। কিশোর কণ্ঠের আওয়াজে ঘুম ভাঙিয়া গেলে তার চোখে পড়িল এই অপচয়-দৃশ্য। চোখ আরো বড় করিয়া গোঁফ ফুলাইয়া সে গম্ভীরকণ্ঠে বলিল : আলুমূল খাওয়া হচ্ছে, চৌকিদার চৌকিদার

এমন চিৎকার করিতে লাগিল, যেন গ্রাম জুড়িয়া ডাকাত পড়িয়াছে।

আমজাদ ভয় পাইয়াছিল। মোনাদির পূর্বে এই লোকটিকে দেখিলেও এমন মূর্তি আর দেখে নাই।

না কোটাল চাচা, তুলে দেখছিলাম। আলু হয়েছে নাকি।

আলু হয়েছে নাকি আসুক চৌকিদার। পালিয়ো না, খবরদার।

আমজাদ ওকালতি করিতে আসিল, ও আমার বড়ভাই।

তুমিও চোর। চৌকিদার দুজনকেই ধরবে।

 মোনাদির ভয়ে এতটুকু হইয়া গেল, তার চোখে প্রায় পানি আসিয়া পড়িয়াছে।

চারিদিকে মাঠের প্রসারণ নীল-সবুজ রঙের মোহনা রচনা করিয়া চলিয়াছে। অবেলার মেঘে বর্ণ-কেলির সমারোহ নূতনতর মনে হয়।

কোটাল চারিদিকে চাহিয়া একবার হাই তুলিল।

চৌকিদার আসছে না, তাহলে আমাকেই নিয়ে যেতে হবে। দুই চোর। চলো আমার সঙ্গে

আমজাদ থ বনিয়া গেল। তার পা আর নড়ে না।

আমি নাছোড়বান্দা। গোঁফে তা দিতে লাগিল কোটাল।

তোমরা পায়ে হেঁটে যাবে না। ও, বুঝেছি। তারপর চন্দ্র উবু হইয়া বসিয়া পড়িল ও বলিল : আচ্ছা, দুই চোর আমার কাঁধে ওঠো।

মোনাদির অগত্যা কী বা করিতে পারে। সুশীল-সুবোধ ছেলের মত দুইজনে চন্দ্র কোটালের কাঁধে চড়িল। ভয় হয় তাহাদের, পাছে পড়িয়া যায়। দুইজনে কোটালের বাবরি চুল কষিয়া ধরিল।

ওরে বাবা, সব পাঠানের বাচ্চা, একদম ঘোড়া-চড়া করেছে–বলিয়া চন্দ্র হাঁটিতে লাগিল। আরোহীদের ভয়ের অন্ত নাই। আমজাদের চোখে পানি গড়াইতেছে। মোনাদির চুপচাপ।

কোটালের বপুর দোলনে আরোহীরা আনন্দ পায় না।

 হঠাৎ হি হি শব্দে হাসিয়া উঠিল চন্দ্র কোটাল।

–এই চোর চাচারা, চল্ সব চাচীর থানায়। এলোকেশী ঘরে আছে নাকি কে জানে?

মোনাদির ও আমজাদ মাথার উপর চোখ চাওয়াচাওয়ি করে। দুইজনের মুখে হাসির রেখা ফুটিয়া উঠিতে লাগিল।

চন্দ্র কোটাল গান ধরিল, দুজনের ঠোঁটে হাসি আর ধরে না।

প্রাণ যদি দিলে তুমি
প্রাণ-চোর শেষে।
কোকিল কেন রেখে গেলে
এমন পোড়া দেশে।

মেঠো বাউলের সুরে প্রান্তরের বুক ভরিয়া উঠিতে থাকে। আমজাদ ও মোনাদির দূরে দূরে দৃষ্টি ছড়াইয়া অবেলা উপভোগ করিতে লাগিল।

মোনাদির বলিল : চন্দ্র চাচা, আমাদের নামিয়ে দাও।

না, সেটি হবে না। তোমার চাচির থানায় চলো, লাল আলু আছে, সারারাত আলু খাওয়াবে।

আমজাদ সব চিনিতে পারে। খালের সেঁতো পার হইয়া তালগাছের সারি, শেষে চন্দ্র চাচার ঢিবি। সেইদিকেই কোটাল অগ্রসর হইতেছে। ধীর-সমীরে খড়ি বনে শ্যুশন শব্দ উত্থিত হয়। কোটালের কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। বিরহিণী কোকিলের ডাকে জর্জরিত হৃদয়, তারই বিলাপোক্তি কণ্ঠে বাজিতে থাকে শুধু।

ঢিবির উপর এলোকেশী চন্দ্রমণির উকুন বাছিতেছিল। উঠানে খেলাব্যস্ত যোগীন ও গোপাল। তারা এই দৃশ্য দেখিয়া হাসিয়া খুন।

চন্দ্রমণি ডাকিল : ও দাদা, পায়ে পড়ি, নামিয়ে দাও। পরের ছেলে পড়ে গেলে জোরে হাঁকিল চন্দ্র, পড়ে গেলে পণ্ডিত হয়ে যাবে।

মোনাদির এইবার খিল খিল করিয়া কাঁধের উপর হাসিতে লাগিল।

ও বাবা–থানার কাছে এসে চোরেদের আবার হাসি দ্যাখো, চলো, চাচির থানায়, খাওয়াবে লাল আলু।

আমজাদও হাসিতে থাকে।

চন্দ্রমণি বলিল, দাদা, ভিটের উপর কাঁধে নিয়ে চড়ো না, তোমার ঘাড়টা ভাঙবে

খামাখা ভাঙবে। অবিশ্বাসের হাসি হাসিয়া দুই-তিন লাফে চন্দ্র একদম ঢিবির শীর্ষে পৌঁছিল।

কোটালের কাঁধ হইতে নামিয়া মোনাদির বড় লজ্জিত হয়। এই মাঠে সে আর কোনোদিন আসে নাই। অপরিচিত জায়গা বলিয়া সে বিব্রত, নচেৎ অন্য কোনো খটকা। তার মনে নাই।

চোখ নামাইয়া গান করিতে লাগিল কোটাল। এলোকেশী চন্দ্রমণির উপর কৃত্রিম ক্রোধ প্রকাশ করিয়া বলিল : ঠাকুরঝি, তোমার মাথায় রাজ্যের উকুন।

দাদার মগজে আর বোনের মাথায়।

গান থামাইল চন্দ্র।

আমার মগজে? কই, বেছে দাও না।

তখন এলোকেশীর হাসি থামে না।

মাথায় ঝাঁকড়া চুল, মগজ দেখা যাবে কেন?

একটি মুগুর পড়িয়াছিল উঠানে। সেটি নির্দেশ করিয়া চন্দ্র কপট-কোপন জবাব দিল।

ঐটা দিয়ে দাও এক ঘা। মগজ বেরিয়ে যাক।

 চন্দ্রমণি ভারি রাগিয়া যায়।

দাদা, তোমার মুখে যা আসে তাই বলো, ভারি অনাছিষ্টি।

নে, আবার নাকিকান্না। লাল আলু থাকে তো ছেলেগুলিকে খাওয়া।

আমজাদ যোগীন-গোপালকে চেনে, সে দৌড়াদৌড়ি শুরু করিয়া দিল বাস্তুর উপর।

 হুঁকা-কল্কের সদ্ব্যবহার করিতে লাগিল চন্দ্র।

লাল আলু আনিয়াছিল কোটাল গঞ্জ হইতে। এলোকেশী বাঁশের ডোলে মুড়ি ও সেদ্ধ আলু মোনাদির-আমজাদকে খাইতে অনুরোধ করিল।

বড় লাজুক মোনাদির এইসব ব্যাপারে। তবু ধীরে ধীরে ঠোঁট সঞ্চালন বন্ধ থাকে না।

কোটালের চোখের তারা বারবার নাচে।

মিষ্টি আলু খাও যত পারো, আর গাছের কাছে যেও না। এবার ঠিক খোঁয়াড়ে দিয়ে আসব।

গোপাল মামার কথার প্রতিবাদ করিল, লোককে আবার খোঁয়াড়ে দেয়, মামা!

দেয় বাবা, দেয়। আমজাদের দিকে ফিরিয়া কোটাল বলিল, তোমার বাবাকে খোঁয়াড়ে রেখে আসব। ভারি ঘর ছেড়ে পালায়।

ধেৎ।

আমজাদ মুড়ি চিবাইতে চিবাইতে ঠোঁট বাঁকাইল। মোনাদির মুচকি হাসিল শুধু। বেলা-শেষ ধরিত্রীর বুকে সন্ধ্যার পূর্বরাগ শব্দে-বর্ণে-কুহর-কূজনে। ভিটার উপর হইতে দূরান্তের আবছা গ্রামগুলি এমন দেখা যায়, মোনাদির কোনোদিন কল্পনা করে নাই। লাল আলু মুখে দিতে দিতে সে আনুমনা হইয়া যায়। তার সুন্দর ডাগর চোখের চাহনি নিকটস্থ কোনো বস্তুর উপর ক্ষণেকের জন্য আলোকতরঙ্গ ছড়ায় না। ছবির মতো স্তব্ধ তালগাছের সারি, নিচে শাদা গেঁয়ো পথ, হয়তো দুএকটি পথিক, পথশ্রান্ত শাদা বাছুর, মেঘ আর পাখির ঝাঁক, তার বালকমনের পর্দায় বিচিত্রার ইশারা রাখিয়া যায়।

চন্দ্র সকলের সঙ্গে তুড়ি দিয়া জমাইতেছিল। আনমনা কেবল মোনাদির।

 মুনিভাই, সাঁঝ হয়ে এল, চলো বাড়ি যাই। আমজাদ তার চমক ভাঙাইল।

আর একটু বস্ না। চাঁদনী রাত আছে, না-হলে চন্দর চাচা পৌঁছে দিয়ে আসবে।

অসম্মতি জানাইল চন্দ্র। না চাচা, আমার অনেক কাজ। গরু-বাছুর, তোলা হয়নি। এই শীতে মুগরী-পাংগুলো রাখতে হবে। জোয়ার আসতে বেশি দেরী নেই।

আমজাদ কহিল, মরা গাঙে মাছ পড়ে?

 চন্দ্র : না চাচা, রান্নাটা চলে যায়।

মোনাদিরের গায়ে শার্ট ছিল। বাতাসে শীতের আমেজ তাকে তেমন কাবু করে না।

আমজাদের জন্যই অগত্যা উঠিতে হইল। অন্ধকার হইয়া গিয়াছে দূর গ্রাম-সীমানা। গৃহবাসীর স্নেহের প্রতীক্ষায় গোঠে বাঁধা গাই হাম্বা-স্বরে আবেদন জানাইতেছিল।

দুই কিশোর হৃষ্টমনে গাঁয়ের পথ ধরিল। মোনাদির যেন বোবা হইয়া গিয়াছে। মাঠের এই বিস্তীর্ণ এলাকায় তো সে কোনোদিন আসে নাই।

হঠাৎ সে মুখ খুলল : চন্দর চাচা একটা পাগল।

আব্বাও ওই কথা বলে।

কিশোর-মনের সিদ্ধান্ত এত সুনিশ্চিত যে, প্রৌঢ়জনও হার স্বীকার করিবে–এই সাফল্যের গৌরবে যেন দুই ভাই খিলখিল শব্দে হাসিতে লাগিল।

আমজাদ বলিল : মুনিভাই, তুমি গান জানো না?

গান আমি গাইতে পারি, লজ্জা করে।

একটা গান গাও, মুনিভাই।

মোনাদির চাচার আশ্রয়েও কারো তোয়াক্কা রাখিত না। রাত্রে সকলে ঘুমাইয়া গেলে, সে গঞ্জের যাত্রাশালে সারারাত্রি কাটাইয়া দিত। তবি চলিত পরদিন।

মোনাদির রামপ্রসাদী বাউল ঢঙের গান আরম্ভ করিয়াছিল। তার অর্থ সে আদৌ বোঝে না। কণ্ঠের মিষ্টতায় কেবল মূৰ্ছনা অপূর্ব পুলকাবেশ সৃষ্টি করে কিষাণ-পল্লীর প্রেয়সীদের বুকে। আমজাদ জানিত না মোনাদিরের কণ্ঠ এত মিষ্টি।

মুনিভাইয়ের প্রতি তার শ্রদ্ধা আরো বাড়িয়া যায়।

গান শেষ হইলে সে বলিল : মুনিভাই, তুমি চন্দ্র চাচার কাছে গান শেখো না কেন?

গান জানে চন্দ্র চাচা?

ভাঁড়-নাচের দল ছিল, আর গান জানে না? শুনলে না, কেমন গায়?

বেশ, ভালো লাগে। আমি বলব আর একদিন।

 আব্বা কিন্তু গান পছন্দ করে না। বলে, ওসব শিখলে মানুষ খারাপ হয়ে যায়।

দূর-র-র! আমি কিন্তু গান শিখব।

আমজাদ মাথা দোলাইয়া অন্ধকারে সায় দিল।

.

পরদিন পড়ন্ত দুপুরে হাসুবৌর ঘরে আড্ডা জমিয়াছিল।

মোনাদিরের মতে, চন্দ্র কোটাল নামে এই গ্রামে একটি পাগল আছে। তার কাহিনী ফলাও করিয়া সে বর্ণনা করিতেছিল। আমজাদও এই বিষয়ে একমত। হাসুবৌ তো অন্য কোনো মতই দিতে পারে না।

সাকেরের মা ঘরে ঢুকিতে গল্পস্রোত মন্দীভূত হইয়া গেল।

মোনাদিরকে লক্ষ্য করিয়া সে বলিল, বেশ ছেলে বৌমা। থাকো ভাই-মার কাছে। পর কী কখন আপন হয়?

মোনাদির এই কাহিনী শুনিতে প্রস্তুত ছিল না।

সাকেরের মা বকিয়া যায় : জানো বৌমা, একেই বলে খুনের টান। চাচা সোনাদানা দিয়ে মানুষ করত, শেষে একটা শ্লেট ভেঙে ফেলেছিল তা সইল না। তোমার চাচা কী করে, ভাই?

মোনাদির স্তব্ধ হইয়া যায়।

থাকো, মায়ের কাছে থাকো। পাঁচ-সাত বছর মায়ের কাছ-ছাড়া বলে কি আর মা পর হয়ে যায়?

ভয়ানক বিরক্ত হয় মোনাদির মনে মনে। হাসুবৌ শাশুড়িকে দজ্জাল আখ্যা মনে মনেই দিতে থাকে। কাঠকুড়োনী বুড়ি বলিলে তবে আমজাদের গায়ের রাগ যায়।

সাকেরের মা কোন সাড়া না পাইয়া বকর বকর করিতে করিতে চলিয়া গেল। আবার ভাঙা আসর নূতন করিয়া জমিয়া উঠিল।

সাকেরের ঘরে আসবাবপত্র বিশেষ নাই। তৈজসপত্রই বেশি। এককোণে একটা বড় তক্তপোশ পাতা। তারই উপর একদিকে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে হাসুবৌ উপবিষ্ট। বই হাতে মোনাদির। বালিশের আড় হইয়া শ্রোতারূপে আমজাদ।

আলীবাবা ও চল্লিশ দস্যুর কাহিনী পাঠ করিতেছিল মোনাদির। কাসেম রত্নগুহার মধ্যে আবদ্ধ। বাহিরে আসিবার মন্ত্র সে ভুলিয়া গিয়াছে। সিসেম খো এইটুকু শব্দ মোনাদিরের মুখে–আবার তাকে পাঠ থামাইতে হইল। সাকের চাচা ঘরে ঢুকিয়াছে।

কিগো চাচারা, গল্প পড়া হচ্ছে?

জি।

হাসুবৌ মাথায় ঘোমটা টানিয়া দিল। গৃহে প্রবেশকতার দিকে তার চোখ সজাগ।

মোনাদির জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় যাবে চাচা?

দাঙ্গার খবর আছে, লাঠি নিতে এসেছি। কোণে তার তৈল-চিক্কণ লাঠির উপর সকলের নজর গেল।

হাসুবৌ মেঝের উপর দাঁড়াইয়া অনুরোধ করিল : না, কোথাও যেতে হবে না।

না, আগাম টাকা নিয়েছি। গম্ভীর কণ্ঠ সাকেরের।

মোনাদিরও চাচির পক্ষ গ্রহণ করিল।

না চাচা, সন্ধ্যায় আমাদের খেলা শেখাবে। আজ কোথাও যেও না।

আমজাদ ওকালতির প্রথম দীক্ষা গ্রহণ করিল। লাঠি-হাতে সাকের কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল। হাসুবৌর শান্ত-গম্ভীর মুখ তার চোখে পড়িয়াছিল বৈকি। কিশোর বালকগুলির জিদ বোধহয় জীবনে তাকে প্রথম জিদ-ছাড়া করিল।

বেশ, তোমরা গল্প করো। বলিয়া সাকের চলিয়া গেল।

গল্প আর পড়া হইল না। হাসুবৌ নিজেই গল্প করিতে লাগিল। মোনাদিরকে কত স্নেহ-মমতায় ডুবাইয়া রাখিতে চায় সে।

বেশ খোকা, বলিয়া হঠাৎ বিছানার উপর শায়িত মোনাদিরকে বুকে জড়াইয়া বারবার চুম্বন করিতে লাগিল। মাতৃস্নেহ যেন নূতন আধার পাইয়াছে।

মোনাদির নিশ্বাস ফেলিতে পারে না। তার ডাগর চোখ, সুন্দর গৌর কচি-ঠোঁটে যুবতীর ওষ্ঠ বিস্বাদ আনে একরকমের।

বাড়ি ফিরিবার পথে মোনাদির আমজাদকে জিজ্ঞাসা করিল : এই, হাসুবৌ চুমু খায়, না কামড়ায় রে?

কেন? অবোধ বালকের মতোই প্রশ্ন করিল আমজাদ।

এই দ্যাখ না, আমার গালে কত দাঁতের দাগ।

.

১৪.

এই গ্রাম মোনাদিরের খুব ভালো লাগে। শূন্য ভিটা, ছোটখাটো তরুলতার জঙ্গল, বনানীর নিচে কোথাও কোথাও সরু পথ–তার মন আকর্ষণ করে। লুকোচুরি খেলার এমন জায়গা তাদের গ্রামে ছিল না। এই পার্থক্যটুকু তার মনোহরণ করে।

আমজাদও আজকাল ঘর-পলাতক। দুইজনে বাউণ্ডেলের মতো গ্রাম তন্নতন্ন করিয়া বেড়াইতে লাগিল। আমজাদও ধীরে ধীরে দুঃসাহসী হইয়া উঠিয়াছে। বাড়ির ফাঁই ফরমাশ পূর্বের মতো সম্পন্ন হয় না। দরিয়াবিবি মাঝে মাঝে খুব চটিয়া যায়। কিন্তু মোনাদির সম্বন্ধে সে খুব সচেতন। পাছে এতটুকু অনাদর-অবহেলার জন্য তাকে হারাইতে হয়। মোনাদিরের স্বভাব এমনিই বেপরোয়া, মাথার উপর তন্বি করিবার লোক নাই, এই সুযোগে সে আরো বেপরোয়া হইয়া উঠিল।

গোরস্থানের জঙ্গলের পশ্চিমদিকে খেজুরগাছের সংখ্যা অনেক। নীল থোকা-থোকা কাঁচা খেজুর পাক ধরিতে এখনও দুইমাস। অত ধৈর্য বালকদের নাই। আমজাদের সহিত যুক্তি করিয়া মোনাদির একদিন এক কাঁদি কাঁচা খেজুর কাটিয়া আনিল। তার জন্য অসীম দুঃসাহসের দরকার। বেতবনের ঘন ঝোপে বিষাক্ত সাপ থাকা বিচিত্র নয়। তা ছাড়া বুনোলতায় গা-হাত এমন কুটোয় যে অনেকেই খেজুর পাকিলেও এদিকে পা বাড়াইতে সাহস করে না।

মোনাদির পথপ্রদর্শক। লতাগুল্ম ফাঁক করিয়া সে অগ্রসর হইয়াছিল। বুনোলতার স্পর্শ সে প্রথমে সহ্য করিয়াছে। কিন্তু আমজাদের গা কুটাইতেছিল ভয়ানক। জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া সে কাঁদিয়া ফেলিল। মোনাদির অগ্রজের মতোই তাকে শান্ত করিল। কিন্তু ঘরে দরিয়াবিবি ক্ষোভে আশঙ্কায় স্তব্ধ হইয়া গেল।

দুজনে আমার মাথা খেয়ে ছাড়বি কোনোদিন। পয়পয় করে মানা করেছি, কবরস্থানের দিকে যাসনে বাবা–বাবারা কান কুলো করে বসে থাকবে।

দুই ভাই কোনো জবাব দিল না। দরিয়াবিবি গরম পানিতে গামছা ভিজাইয়া পুত্রদের গা মুছাইয়া দিল।

মুনিভাই বললে, কাঁচা খেজুর খেতে খুব মজা।

আমজাদ মাকে বলিতেছিল।

মোনাদির প্রতিবাদ করিল : আমি বুঝি বলেছি মজা। খুব কষা।

আড়চোখে মোনাদিরের দিকে অপ্রসন্ন দৃষ্টিপাত করিয়া আমজাদের গা মুছাইতে লাগিল পুনরায় দরিয়াবিবি। মোনাদির তখন মৌন। দরিয়াবিবি ইহা লক্ষ্য করিয়া আবার মোনাদিরের দিকে দৃষ্টি ফিরাইল।

আয় মুনি, তোর গা-টা আবার মুছে দিই।

অভিমান-ক্ষুদ্ব কণ্ঠ মোনাদিরের : না থাক, আমার গা আর কুটোয় না।

 দরিয়াবিবি কোনো প্রতিবাদ কানে তুলল না।

দ্যাখ দিকি বাবা, গায়ে কালো কালো দাগ পড়ে গেছে। অত ঘন জঙ্গলে আর যেয়ো না। বড় বড় সাপ আছে।

কী সাপ আছে, মা? আমজাদ জিজ্ঞাসা করিল।

খুব বিষ সাপের, জাতসাপ আছে।

মোনাদির হাসিয়া উঠিল–হ্যাঁ, সাপ আছে হাতি। কই, আমরা একটা সাপের লেজও দেখিনি।

আমজাদ হাসিতে যোগ দিল।–মা, বড়ভাই সাপের লেজ দেখেনি। সাপ কাটলে লেজ খসে যায়। না,মা?

হ্যাঁ।

মোনাদির বিশ্বাস করে না এই প্রসঙ্গ।

হ্যাঁ, কাটলে লেজ খসে না ঘোড়ার ডিম। আমার চাচার একটা বেড়ে কুকুর ছিল, সে এত লোককে কেটেছে, তার লেজ একদম থাকত না তা হলে।

দরিয়াবিবি এতক্ষণ গম্ভীর হইয়াছিল, সেও উচ্চহাস্যে পুত্রদের আসরে যোগদান করিল।

আরে আমার বোবা ময়না, কুকুরের আবার লেজ খসে!

মোনাদির গা চুলকাইতে চুকাইতে বলিল, তবে যে আমু বলে।

 তোর গা কুটোচ্ছে? জিজ্ঞাসা করিল দরিয়াবিবি।

না, মা।

 তবু আমার কাছে লুকোবে?

 মোনাদির সস্নেহে হঠাৎ মার কোমর জড়াইয়া আমজাদের দিকে আঙুল বাড়াইল।

ঐ তো আমাকে নিয়ে গেল।

কৃত্রিম কোপনদৃষ্টি প্রতিভাত হয় দরিয়াবিবির।

আমজাদ অভিমান করিয়া বলিল, তোমার সঙ্গে আর যদি কোথাও যাই, মুনিভাই–

পরদিন আমজাদ তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিল। স্কুলের ছুটির পর দুইজনেই গ্রামপথে ঘুরিয়া বেড়াইল। অন্যান্য ছেলেরা স্কুলের গ্রাউন্ডে ফুটবল খেলে, মোনাদির সেখানে থাকতে চায় না। ভয়ানক ছোট হইয়া যায় সে অন্যান্য পড়য়াদের নিকট। তাহাদের বেশভূষা স্বতন্ত্র, পরিচ্ছেদে চিক্যতা থাকে। মোনাদির আমজাদের সঙ্গ-মাধুর্যে তাই পরিতৃপ্তির আস্বাদ পাইয়াছিল।

আজও স্কুলের ছুটির পর দুইজনে মাঠের দিকে চলিয়া গেল। চন্দ্র কোটাল বাড়ি নাই, ফসল লইয়া গঞ্জে গিয়াছে– সেখানে ভালো জমিল না। আমজাদ মজা খালের একটি ধারে কতকগুলি চিলের পালক কুড়াইয়া মোনাদিরকে উপহার দিল। ভালো কলমের কাজ চলিবে।

সন্ধ্যার পূর্বে লুকোচুরি খেলার সময় মোনাদির আমজাদের সঙ্গচ্যুত হইল। দুইজনে খেলার মাতামাতিতে পথ হারাইয়া ফেলিয়াছিল। আমজাদের সঙ্গে দেখা না হইলেও মোনাদির বেশি বেগ পায় নাই। একটি বাঁক ফিরিতেই পরিচিত পথ দেখিয়া সে পুলকিত হইয়া উঠিল। ওই শীর্ণ রাস্তাটি শাদা ফিতের দাগৈর মতো আঁকাক সমন্বয়ে পাড়ার ওদিকে মিশিয়া গিয়াছে। দুইপাশে শুধু নানা রকমের গাছ। সন্ধ্যা আসন্ন। ভয়াতুর মসৃণ অন্ধকার জমিয়া। উঠিতেছে খানাখোন্দলে, পত্রপুঞ্জের অনাবৃত বুকে। শাদা ঘাস ধূসরিমায় শিহরিয়া উঠিতেছে। পথের কিনারায় কেঁচো-মাটির দাগ, পায়ের আঙুলে অস্তিত্বের প্রমাণ জানায়! কত ক্ষুদ্র টিলা! মোনাদিরের দৃষ্টি মিশিয়া যায় চারিদিকে। বোবার মতো বিস্ময়ে সে চাহিয়া থাকে।

একটু আগাইতেই পাতে মাদারের ঘন বেড়া চোখে পড়িল। নিচে কেবল লতার উলঙ্গ মূল, উপরে পাতার নীল আভরণ। পাশে একটি পানাছাওয়া ডোবা, জলের আলোড়ন-ধ্বনি শোনা গেল। কৌতূহলে মোনাদির উবু হইয়া দেখিতে লাগিল সূর্যের লালিমা ডোবার উপর। রঙিন ঘাটের পৈঠায় একটি পিতলের কলস, গ্রাম্য কোনো বধূ স্নান করিতেছে। তার গৌর মুখ দেখা যায়।

অন্ধকার হইয়া আসিতেছে, এই ভয়ে মোনাদির পদক্ষেপ দ্রুত করিল। পুরাতন বড় আমের গাছ পড়িয়াছিল, গুঁড়িসহ একটি মোটা ডাল পথের সহিত মিশিয়া রহিয়াছে। মালিকেরা সামান্য ডালপালা কাটিয়া লইয়া গিয়াছে, ধড়টি এখনও বর্তমান। ফাঁকড়া ডালের উপর বসিয়া মোনাদিরের দুলিতে ইচ্ছা করে। সময় নাই। আরো অন্ধকার হইয়া গেলে ঘরে ফেরা দায় হইবে। কয়েক পা আগে একটি শূন্য ভিটে, পথ এখানে সামান্য উত্রায়ের রূপ গ্রহণ করিয়াছে। ভিটার তিনদিকে আমগাছের পাহারা; ফাঁক দিয়া দূরে সন্ধ্যাকাশের স্নান অঙ্গনে হলুদ রঙের মতো মেঘ! মোনাদির দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। তার চোখে শূন্যতার এই আকার জ্ঞানরাজ্যের কোনো বাতা বহিয়া আনে না; তবু অসোয়াস্তি অনুভব করে সে। আবার ঢালু-পথ সমান্তরাল কয়েক বিঘা মাত্র। এইটুকু শেষ হইয়া গেলে সে পাড়ার অন্দরে ঢুকিয়া পড়িবে। এইখানে সে হাঁটিয়াছে আরো কয়েক দিন, কৌতূহলের নেশা আর এমন কোনদিন চাপিয়া বসে নাই। অন্ধকার প্রলেপ টানিতেছে ধরিত্রীর উপর মেঘের আলোয় সাদা পথের রেখা মুছিয়া যায় না। পানা-ভরা একটি ক্ষুদ্র পুষ্করিণীর পাড়ে বাঁশবনে নীড়-প্রত্যাগত বকের দল গুলতান করিতেছে। শাবকগুলির কক কক শব্দে উত্যু হয় মোনাদির। পুকুরের পাড়ের কোণে জীর্ণ কয়েকটি সুপারি গাছ, পাশে গোয়ালঘর। একটি বাছুর হাম্বার ছাড়িতেছে। সড়কের পাশে, ইহার পর তালপাতার বেড়ার রেখা। ওদিকে গেরস্থদের সায়ং-জীবন শুরু হইয়াছে। জমাট ধোঁয়া উঠিতেছে গাছপালার ভিতর দিয়া।

দ্রুত হাঁটিতেছিল মোনাদির। বেড়ার উপর শুষ্ক কলাপাতার দোদুল রেখামূর্তি, বাতাসে দুলিতেছে। হঠাৎ পথের পাশে খরখর শব্দ হইল। ভয় পাইয়াছিল প্রথমে,পরে সে কৌতূহলবশত থমকিয়া দাঁড়াইল। সাপ-খোপ নয় তো! এইখানে একটি শুষ্ক কাঁঠালগাছ বেড়ার খুঁটিরূপে ব্যবহৃত হইয়াছে। আবার শব্দ হইল। মোনাদির দৌড় মারিবার জন্য পা তুলিয়াছে!

এমন সময় বালিকার কণ্ঠের সাবধানবাণী শোনা গেল : এই খোকা–

মোনাদির ভাবিল কোনো বর্ষীয়সী বোধহয় তার গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছে। দৌড় বন্ধ করিয়া সে বেড়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিল।

এই খোকা

কোনো না বর্ষিয়সী নয়, একটি কচিমুখ কলাপাতার আড়াল ফাঁক করিয়া মৃদু ঠোঁট সঞ্চালন করিতেছে।

বালিকার মুখের একাংশ মাত্র দেখা যায়। মরা কাঁঠালগাছের গুঁড়ির উপর বসিয়া সে আড়াল হইতে কেবল মুখটি বাহির করিয়া দিয়াছিল। আকাশের আলোয় মুখাবয়বের ডান দিক শুধু আলোকিত।

কোনো জবাব যোগাইতেছিল না মোনাদিরের মুখে। এমন অবস্থায় বালিকা তাকে যথেষ্ট সাহায্য করিল।

কোন্ পাড়ার ছেলে?

আমতা আমতা করিয়া জবাব দিল মোনাদির : ঐ পাড়ার। অঙ্গুলি নির্দেশ করিতে সে বিস্মৃতি হইল না।

ঐ পাড়ার।

ফিকফিক করিয়া মেয়েটি হাসিয়া উঠিল। –ঐ পাড়ার নাম নেই?

তোমার নাম আছে?

বড় মুখরা তো মেয়েটা। মোনাদির রাগিয়া উঠিয়াছিল মনে মনে।

আমার নাম নেই, তোর নাম আছে? তোর শব্দটাতে বেশ জোর দিয়াছিল সে।

আমার নাম আছে, তোমার নামও আছে।

মোনাদির জিভ ভাসাইয়া শব্দ করিল : আমার ..না..ম আছেই– তারপর জিভ যদূর সম্ভব বাহিরে প্রসারিত করিয়া বলিল : তোর নাম আছে?

ভারি বজ্জাত ছেলে তো। কাদের ছেলে রে?

মোনাদির আবার ব্যঙ্গ করিল। বেড়ায় আড়াল ফাঁক করিয়া গুঁড়ির উপর সে সশরীরে বাহিরে আসিল। মোনাদির দেখিল ফালি পরা একটি সুডোল তনু, বছর নয় কী দশের বালিকা। চুলগুলি এলোমেলো পিঠের উপর দোল খাইতেছে। মুখটি গোলাকার, গৌর রঙের উজ্জ্বলতা-উচ্ছল। টানা চক্ষুতারকা চড়ুই পাখির মতো জ্বর নিচে চঞ্চলতায় অস্থির।

কাদের ছেলে রে? মেয়েটি ভেংচি দিতে বিলম্ব করিল না। মোনাদির এবার রীতিমতো রাগিয়াছিল। পথের উপর ঢেলা ইত্যাদি কিছু না পাইয়া আক্রোশে সে ফুলিতেছিল।

দেবো পা ধরে নিচে ফেলে চিৎপটাং।

মেয়েটি তাড়াতাড়ি পা গুটাইয়া ভেংচি কাটিয়া বলিল, আমার পায়ে সালাম করবি নাকি?

মোনাদির হাতের তালুর ভিতর অন্য হাতের মুঠি কচলাইতে লাগিল।

 দেবো পা ধরে ফেলে।

দাঁড়া তো রে বজ্জাত, বলিয়া মেয়েটি গাছের গুঁড়ি হইতে বেড়ার আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেল। তার পদধ্বনি শোনা যায়। ভয় পাইল মোনাদির। সে ছুট দিল এইবার সড়কের সোজাসুজি।

পশ্চাতে বালিকাকণ্ঠের ডাক শ্রুত হয় : এই খোকা, শুনে যাও কিছু বলব না তোমাকে

মোনাদির আবেদনে কোনো সাড়া দিল না। ভীত-ত্রস্ত সে। কিছুদূর গিয়া গাছের কোলজোড়া অন্ধকারে থামিয়া একবার পশ্চাতে চাহিল। অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি আলুলায়িত কুন্তলা চকিত-দেখা কিশোরী দাঁড়াইয়া রহিল। হ্যাঁ, সে-ই তো। ভুল হয়নি কিছু।

কেমন যেন মনমরা হইয়া বাড়ি ফিরিল মোনাদির।

.

১৫.

 পরদিন দুপুরে আহার সমাপ্তির পর মোনাদির কৌতূহলবশত পাড়ার পথে বাহির হইল। গত সন্ধ্যায় আবছা-দেখা সড়কের জগৎ। আজ দুপুরে চারিদিকে আমনা দৃষ্টি ছড়াইতে তার কাছে নূতন ঠেকিল সবকিছু। হারানো পথরেখা নূতন করিয়া সন্ধান করিতে লাগিল সে।

দুপাশে তালপাতার বেড়া। মাঝখানে শুষ্ক কাঁঠাল গাছের গুঁড়ি। জায়গাটা চিনিতে বেশি বিলম্ব হইল না। অবাক হইয়া মোনাদির অবলোকন করিতে লাগিল চারিদিক। কীট পতঙ্গের ক্ষুদ্র জীবনলীলা। শুষ্ক কাঠের সেতু বাহিয়া একদল পিপীলিকা আহার মুখে অগ্রসর হইতেছে। ক্ষুদে লাল পিঁপড়ের সারি ছোঁড়া ঘুড়ির সূতার মতো যেন বাতাসে কাঁপিতেছে। আঁকাবাঁকা গতি একটি তালপাতার আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে।

মোনাদির একবার দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরাইল। জোড়া সুপারিগাছের ওধারে গেরস্থ বাড়ি। ডিডিগ শব্দে একটি খুদে পাখি তেঁতুলবনে পতঙ্গ সন্ধান করিতেছিল।

এই, কাদের বোকা ছেলে রে। বালিকা কণ্ঠের ডাক। হঠাৎ ভয় পাইয়া মোনাদির পেছনে ফিরিবে কী, আর একটি কোমল হস্তে সে বন্দী। গত সন্ধ্যায় দেখা সেই বালিকাই। তার হাত চাপিয়া ধরিয়াছে। মোনাদির প্রস্তুত ছিল না। মেয়েটি হাত ধরিয়া তাকে টানিতে টানিতে গেরস্থবাড়ির দিকে অগ্রসর হইতেছিল। মাকড়শার জালে যেন প্রতিবাদ করিবার অবসর নাই, দুমিনিটের ভিতর ভোজভাজির মতো কী যেন ঘটিয়া গেল। আর একটি গেরস্থর আঙিনায় সে এতক্ষণে অপরাধীর মতো দাঁড়াইয়া আছে।

ও মা, শিগ্‌গির বেরোও, দেখো কাদের ছেলে।

খিলখিল শব্দে হাসিতেছিল মেয়েটি।

 কিরে আম্বিয়া।

আঙিনার সম্মুখে একটা খোড়ো চালের ঘর, তার দাওয়া হইতে একজন মেয়ে জবাব দিল। সে ঘরের দেওয়ালের মাটির ছোপ দিতেছিল।

আম্বিয়া আর একবার সমস্ত হাসি নিঃশেষ করিয়া দিল।

কী চুরি করবে বলে আজ বেলাবেলি বেরিয়েছে, মা।

মেয়েটি কর্মব্যস্ত। সে একবার এইদিকে চাহিয়া কাজ বন্ধ করিল।

আম্বিয়া, কাদের এমন সুন্দর ছেলে?

হাসির স্রোতে ভাটা নাই।

সুপুরিগাছের কাছে দাঁড়িয়েছিল, ধরে এনেছি।

লালমাটি মাখা ন্যাকড়া হাতে মেয়েটি দাওয়া হইতে নামিয়া আসিল। আম্বিয়ার মার নাম আমিরন।

খোকা, কোথায় থাকো?

এমন ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া যাইবে মোনাদিরের মতো চটপটে ছেলে, বিশ্বাস করা যায় না। আজ তার কণ্ঠে বাক্য হোঁচট খাইতেছিল।

আ-মি- খাঁ-পাড়ায় থাকি।

আমিরন বদনার পানি লইয়া হাত ধুইয়া ফেলিল। খা-পাড়ার কার ছেলে?

মোনাদির সঙ্কোচে মিশিয়া যাইতেছিল মাটির সঙ্গে। আর যা-ই হোক, আজহার খাঁ তার পিতা নয়।

আমার মা দরিয়াবিবি।

আমিরন দরিয়াবিবির চেয়ে বয়সে বড়। প্রৌঢ়ত্বের ছাপ মুখাবয়বে স্পষ্ট। রোগা শরীর। গাল দুটি সুষমায় উজ্জ্বল হইলেও, বয়সের দাগ পড়িয়াছে। একরকমের কৃত্রিম গাম্ভীর্যে তার মুখোনি ছাওয়া।

অভ্যর্থনার হাসি উচ্ছলিত হইয়া পড়ে।

দরিয়াবুবুর ছেলে, দরিয়াবুবুর ছেলে, বলিতে বলিতে আমিরন আগাইয়া আসিল।

আম্বিয়া তখনও হাসিতেছিল।

কৃত্রিম ক্রোধে তার দিকে ফিরিয়া আমিরন বলিল : হতচ্ছাড়ি, হিড়হিড় করে কাকে ধরে আনলি। মাফ চা।

আত্মীয়তার যোগসূত্র আছে এই কিশোরের সঙ্গে, আম্বিয়া তা কল্পনা করে নাই।

তুমি এসেছ শুনেছি, বাবা। গরিব মানুষ, কাজকর্মে সারাদিন যায়। খেটে খেটে আর পারি না। আজ কদিন যে খাঁ-পাড়ার দিকে যাইনি।

আম্বিয়া কৌতূহল-দৃষ্টি দিয়া মা ও আগন্তুক কিশোরের গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছিল। হঠাৎ নখে মাটি খুঁটিতে লাগিল সে।

আমিরন হাঁক দিল : এই হতচ্ছাড়ি– একদম ভিজে বেড়ালছানা বনে গেলি যে, দাওয়ায় একটা বসবার জ্যাগা দে। চলো, বাবা।

আম্বিয়া মার আদেশ নীরবে পালন করিল। মোড়ার উপর যন্ত্রচালিতের মতো বসিয়া পড়িল মোনাদির। তার পাশে বসিয়া আমিরন সংসারের কাহিনী-জাল বুনিতে থাকে।

মোনাদির এতক্ষণ মুখ খোলে নাই। আমিরন বিবি বলিল, বাবা, একদম বোবার ব্যাটা। কথা বলো। আজকে আসি, চাচি।

না, একটু বসো। কিছু খাও।

আমি ভাত খেয়ে এসেছি।

কোনো প্রতিবাদ শুনিল না আমিরন। ডোলে করিয়া সামান্য মুড়ি তাহার সম্মুখে পরিবেশন করিল।

গরিব চাচি। কিছু কি ঘরে আছে, চাঁদ। তোমার চাচা আজ দুবছর হল ইন্তেকাল করেছে। ঐ হতভাগীকে নিয়ে জ্বলেপুড়ে মরছি। কথা শুনবে না, খালি গাছতলায় ঘুরে ঘুরে বেড়াবে।

জননী-কন্যার দৃষ্টি বিনিময় হইল। ভারি গম্ভীর হইয়া গিয়াছে আম্বিয়া।

তুমি কদ্দিন এসেছো?

অনেকদিন হোয়ে গেল। মুড়ি চিবাইতে চিবাইতে জবাব দিল মোনাদির।

ফুরসৎ নেই, বাবা। সকাল থেকে কত কাজ, গাই-গরু আছে একটা। মুরগি-হাঁস, ছাগল-পাগল আর ঐ (আম্বিয়ার দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ) পাগলী আমার সংসারে একফোঁটা দম ফেলার উপায় নেই। খাঁ-পাড়ার মুখ দেখিনি কমাস।

মোনাদির অনুভব করিল, তার নূতন চাচি অনর্গল বকিতে অপটু নন। মাথা দোলাইয়া আমিরন নিজের কথায় সায় দেয় : বেশ সুন্দোর ছেলে। আমার দরিয়াবুবু কেমন? তার ছেলে রাজপুতুরের মতো দেখতে হবে না?

লজ্জায় রাঙা হইতে থাকে মোনাদিরের কিশোর দুই কপোল।

কোনো রকমে বেঁচে আছি, খোকা। কপালে মেহনত ছাড়া আর কিছু লেখন দিয়ে আসি নি। তোমার চাচা ভালো লোক ছিলেন। তোমার এই বাপের মতো দশ চড়ে মুখ খুলত না। তার ফল আজ ভোগ করছি। দু-তিন বিঘে জমি ছিল, সব পরের গবে।

তারপর ফিসফিস শব্দে কথা বলতে বলতে আঙুল বাড়াইয়া আমিরন আঙিনার ওপারে কয়েকটি খড়ো চাল দেখাইল।

ওই যে আম্বিয়ার মেজ চাচা। একদম খান্নাস। বেওয়া মানুষ, তার দু-বিঘা মেরে নিল। ফসল দিত না, শেষে লুকিয়ে রেজেস্টারি করে নিজের জমির সাথে ঢুকিয়ে দিলে। নিক হতভাগারা, আল্লা তার ইসাফ করবে। কত কত জিনিস আনে বাবা। এতিম মেয়েটার হাতে যদি একটু ছোঁয়ায়। স্বত্যে আছে কী?

মোনাদির ম্রিয়মাণ শিশুর মতোই কাহিনী কান পাতিয়া শুনিতেছিল। আম্বিয়াও তার মত এতিম। মনের কোণায় কোণায় মৃদু নিঃশ্বাস রুদ্ধ আবেগের ঝটিকা ফুকার রচনা করে। তবুও বিদায়ের জন্য উশখুশ করিতেছিল মোনাদির।

গেল বছর বর্ষায় ঘরে একমুঠো চাল নেই। ধার করতে গেলাম। এক কুনকে চাল দিল না বেটি। একদিন উপোস করে মরি। আমার জমি নিলে, আমার পেটে দানা নেই।

আমিরনের চোখের কোণায় পানি জমিয়া উঠিতেছিল, আঁচলের খুট দিয়া মুছিতে লাগিল।

মোনাদির আসি চাচি বলিয়া উঠিয়া পড়িল। আর কেউ তোক করুণ কাহিনীর শ্রোতা। কিছুই ভালো লাগে না তার।

আনমনা সড়কের সম্মুখে আসিয়া সে পিছনে তাকাইল একবার। কখন অজানিতে পিছু পিছু আসিয়াছিল আম্বিয়া, সে লক্ষ্য করে নাই। একবার উৎকর্ণ হইল মোনাদির। হ্যাঁ, কান্নারই আওয়াজ। আমিরন চাচি মৃত স্বামীর উদ্দেশে অশ্রু বিসর্জন দিতেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *