৬. আজহার প্রতিবেশী সাকের

সকালে আজহার প্রতিবেশী সাকেরের খোঁজ লইতে গেল।

পাশের পাড়া। ভিটা ছাড়িয়া সামান্য কলাবাগান হইতে বেশি সময় লাগে না। আজহার ভাবিতেছিল, সাকেরের কাছে টাকা আছে। সে পেশাদার লাঠিয়াল। খা বংশের মহিমা বরং একমাত্র সে বজায় রাখিয়াছে। চোয়াড়ে প্রকৃতির চেহারা সাকেরের। লম্বা ঘন গোঁপের উপর ভাটার মতো দুই চক্ষু শিশুর আতঙ্কের পক্ষে যথেষ্ট। এই সময় তার কাছে টাকা থাকা সম্ভব। মাত্র দুইদিন আগে রোহিণী চৌধুরীর কোনো তালুকে প্রজা ঠেঙাইতে গিয়াছিল সে। জমিদারদের কল্যাণে তার অবস্থা অন্যান্য প্রতিবেশী অপেক্ষা ভালো। দাঙ্গার জন্য আরো ভিন গায়ে তার ডাক পড়িত।

চোয়াড়ে হোক সাকের, কিন্তু আজহার খাঁর সম্মুখে সে ভারি বিনয়ী, খুব মোলায়েম কণ্ঠে কথা বলে। আজহারের ধারণা সাকের তাকে শ্রদ্ধা করে। কোনোদিন তার কাছে টাকা হাওলাত করিতে যায় নাই। মুখের কথা সে অবহেলা করিবে না সহজে। আর চন্দ্রও যেমন বেয়াড়া! তার সঙ্গে বন্ধুত্বের জুলুম সহ্য করিতে কোনো কষ্ট হয় না।

সাকের ঘরে ছিল না। তার মা আজহারকে দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া বলিল, আমার পেটে এমন ডিংরে ছেলে জন্মল, বাবা। আর পারি নে। লাঠিখেলা কেন যে শিখেছিল। এক দণ্ড শান্তি নেই। ও দাঙ্গা করতে যাবে, আর এদিকে আমাদের শাশুড়ি-বৌয়ের পেটে ভাত সেঁধোবে না।

সাকের কোথা গেছে, চাচি?

কাল সন্ধ্যায় বেরিয়েছে আর দেখা নেই।

উদ্বিগ্ন আজহার প্রশ্ন করে, দাঙ্গায় যায়নি তো?

না। লাঠিটা ঘরে রয়েছে। ঐ বাঁধানো লাঠি ছাড়া সে বেরোয় না। কিন্তু কোথা যে গেল!

আজহার নীরব। নিরাশার আঘাতে বারবার চন্দ্রের মুখ তার মনে পড়িতে থাকে। চন্দ্রটা এমন–

সাকেরের মা সংসারের কথা জুড়িল।

ছেলেমানুষ বৌটা তেমনি হয়েছে। ভয়েই মরে। চাষবাস করে খেতে বল, নিজের মানুষকে হাত কর। তা না। খালি দিনরাত ছেলের জন্য কান্না। কাঁচা বয়েস। ছেলে হওয়ার সময় কি পার হয়ে গেছে, বাবা?

হঠাৎ সুপ্তোত্থিতের মতো আজহার জবাব দিল : না, আমাদের হাসুবৌর আর কত বা বয়েস। কুড়ি পেরোয়নি।

এখনই ছেলের জন্যে হাঁপাহাঁপি। দোয়া তাবিজ আমি কি কম করতে বাকি রেখেছি! তবে মাস দুই হল নিস্তার। কপালে যদি থাকে।

সব আল্লার মরজি, চাচি। তোমার আমার মতো গোনাগার বান্দা আর কী করতে পারে?

না বাবা, আল্লা মুখ তুলে চেয়েছে। তারপর চাচি জোর গলায় হাসিল।

জানো বাবা, অভাগীর বেটি বলে কী—

আজহার জিজ্ঞাসু নয়নে চাচির মুখের দিকে তাকাইল।

বৌমা বলে, ছেলের মুখ না দেখলে ওসব লোক আর সংসারী হবে না। ও জোয়ান হওয়া অব্দি ভয়ে ভয়ে সারা জনমটা গেল। কি দিন কি রাত, বেঁচে সুখ নেই বাবা।

আজহার চুপ করিয়া শোনে, কোনো মন্তব্য করে না। তার দৃষ্টি প্রাঙ্গণের উপর। হঠাৎ মুখ অন্যদিকে ফিরাইতে সে বাধ্য হইল। সাকেরের স্ত্রী ঘাট হতে কলস কাঁখে ফিরিতেছিল। ভাশুরকে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি উঠানের লাউগাছের ঈষৎ আড়ালে আড়ঘোমটা টানিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

নিজকে বিব্রত মনে করে আজহার খাঁ। সত্যই বড় কাঁচাবয়স সাকেরের স্ত্রীর। মুখখানা ভারি করুণ মনে হয়। পূর্ণ যুবতী, তবু মুখের আদলে সজীবতা নাই। যৌবনের শ্যামস্পর্শ যেন ক্ষণেক উঁকি দিয়া বিদায় লইয়াছে।

উঠানে লাউগাছের মাচাঙ। সূর্যের আলো সেঁধোয় না, নিচে এমন ঘন লতার পরিবেশ। দুই-একটি লাউ ঝুলিতেছে মাথার উপর। গোড়ার দিকে দশ-বারোটি সর্পিল রেখার আলিঙ্গন মাটির বুকের সহিত। সাকেরের স্ত্রীর কাপড়ের কোনো কোনো অংশ দেখা যায়।

আজহার যেন কত বিপদে পড়িয়াছে। বেগানা আওরতের সম্মুখে এমনভাবে বসিয়া থাকা শোভন নয়। সে উঠি-উঠি করিতেছিল। কিন্তু সাকেরের মার কথা আর ফুরায় না।

দোয়া করো, বাবা। বৌমার নিয়েৎ পুরা করুক খোদা।

আল্লার দোয়া। বান্দার কথায় আর কী হয়? মাঠে কাজ আছে, চাচি। আজ আর বসতে পারব না।

উঠিয়া পড়িল আজহার।

আচ্ছা, এসো বাবা। দরিয়াবৌকে এদিকে আসতে বলো। বৌমার মাস দুই হল, দরিয়াবৌর সাথে কতগুলো কথা আছে।

সাকের বাড়ি ফিরলে আমাকে একবার খবর দিও।

দুইপাশে কঞ্চির বেড়া। এই পথে কলাগাছের ছায়ান্ধকার জমিয়া উঠিতেছে। সূর্য উঠিতেছে তেজে। চারিপাশের আলো প্রখরতায় অস্পষ্ট জায়গায় অন্ধকার আরো ঘন মনে হয়। আজহার খাঁর মন নানা সন্দেহে দোলে। সকালটা কোনো কাজে আসিল না।

হঠাৎ চাচির খন্‌খনে গলার আওয়াজ শোনা যায়। ঘুলি-পথের উপর উৎকর্ণ আজহার থমকিয়া দাঁড়াইল। হ্যাঁ, চাচিরই গলার আওয়াজ বটে, দূর হইতেও স্পষ্ট বোঝা যায়।

হারামজাদী, ঘরে টাকাপয়সা নেই, সে বাড়ি থাকতে বললি নে কেন? মুখের হ্যাঁদা বুজে গেছে বুঝি?

আরো গালিগালাজের অগ্ন্যুৎপাত। চাচি আদৌ বৌকে দেখিতে পারে না, আজহার জানে। কিন্তু আজ সেজন্য বিশেষ মাথাব্যথা নাই তার। সাকেরের ঘরেও টাকা নেই। বুকটা দমিয়া গেল আজহার খাঁর। চাচিকে শান্ত করিতে সে আর একবার ফিরিয়া আসিত, সে উৎসাহও ধীরে ধীরে নিভিয়া গেল।

গোয়ালঘরে সামান্য কাজ বাকি ছিল। আজহার খাঁ আজ যন্ত্রচালিতের মতো তাহা সম্পন্ন করিল। চন্দ্র কোটালের কাছে একবার খবর দেওয়া দরকার। সে আশায় আশায় থাকিবে। পাড়ার আর কারো কাছে হাত পাতা নিরর্থক। গফুর খাঁর গঞ্জের দোকান দিন দিন ফাঁপিয়া উঠিতেছে। তার পুরাতন ঋণ দুই বছরে শোধ হয় নাই। সে পথও রুদ্ধ। আরো কয়েকজন সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিবেশীর কথা মনে পড়িল আজহার খাঁর। কিন্তু চারিদিকে খটকা।

দরিয়াবিবি পূর্বতন শ্বশুরবাড়ির দুইটি দুল আনিয়াছিল। গত বৎসর আমজাদ ও নঈমার অসুখে তা-ও পোদ্দারের দোকানে বাঁধা পড়িয়াছে।

চন্দ্র হুঁশিয়ার লোক। ব্যবসায় কপাল-খোলা বিচিত্র নয়। কিন্তু রুদ্ধ অদৃষ্টের কপাট খুলিতে সামান্য কুঞ্জিকার কথা, আজহার ভাবিতে পারে না।

মাঠের পথে চিন্তা-ভারাক্রান্ত মনে সে উপায়ের কল্পনা করিতে লাগিল। হঠাৎ আকাশে মেঘ জমিয়াছে। সূর্যের আলো পলাতক। বর্ষাকাল, যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামিতে পারে। এই মনে করিয়া আজ গরু মাঠে ছাড়িয়া দেয় নাই আজহার।

সে কোটালের বাড়ির কাছাকাছি আসিয়াছে এমন সময় দমকা বৃষ্টি নামিল। দুপুরে গোসল করিতে হইবে, তাই বৃষ্টির কোনো তোয়াক্কা রাখে না আজহার। সোজাসুজি সে গাঙের ধারে আসিয়া থামিল। চতুর্দশীর জোয়ারের সময় চন্দ্র ঘরে থাকার বান্দা নয়। তা ছাড়া মাছ ধরা একটা নেশা কোটালের।

খালের দুই ধারে ঝাপসা গাছপালা। ঝমঝম বৃষ্টি ঝরিতেছে। কোনো জনপ্রাণী চোখে পড়ে না। সকলেই বোধহয় আশ্রয়ে ঢুকিয়াছে। বামে ডিঙি নড়ার ঠকঠক শব্দ শোনা গেল। উৎফুল্ল হইয়া ওঠে আজহার। চন্দ্র ছোট্ট পিনিসের উপর দাঁড়াইয়া জাল গুটাইতেছে। নৌকার গলুই একটি বাঁশের সঙ্গে বাঁধা। স্রোতের টানে বাঁশ ও কাঠের সমবায়ে একরূপ ঘর্ষণধ্বনি বৃষ্টির আওয়াজকে ছাপাইয়া উঠিতেছে।

আজহার হাঁকিল, চন্দর!

খালের দুই পাড়ে তার প্রতিধ্বনি ছড়াইয়া পড়ে।

সামান্য বৃষ্টির প্রকোপ মন্দীভূত। মেঘ হুড়ম-হুঁড়ম করিতেছে।

বোধহয় হাঁক চন্দ্র শুনিতে পায় নাই। আজহার নিজেই তার কাছে আগাইয়া আসিল। লম্বা বেড়াজালে জোয়ারের পূর্বে খালের মুখ ঘিরিয়াছিল চন্দ্র। ভাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার জাল গুটাইতেছে। বড় শান্ত সে। দুই বাহুর পেশি স্পষ্ট ফুলিয়া উঠিয়াছে। তার দৃষ্টি শুধু জালের দিকে।

চন্দ্র চোখ না তুলিয়াই বলিল, খাঁ ভাই, একটু দাঁড়াও।

জাল গুটানো সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আফসোস করে, না ভাই, মজুরি পোষাল না। অনেকক্ষণ খাটছি।

মাত্র সের দুই মাছ পড়িয়াছে। দশ-বারোটি তপসে মাছ কেবল চন্দ্রের চোখে আনন্দের প্রলেপ টানিয়া যায়।

ভাবছিলাম, খিয়ে জাল দিয়ে আর একটু চেষ্টা করা যাক। না, তুমি এসেছ ভালোই হল।

দুজনেই বাড়ি অভিমুখী। চন্দ্র শীতে কাঁপিতেছিল। অনেকক্ষণ সে বৃষ্টির পানিতে ভিজিয়াছে। কোটাল-পুত্র তাই নির্বাক। মাছভরা খালুই হাতে দ্রুত হাঁটিতেছিল সে।

পা চালাও, খাঁ। একটান তামাক না টানলে আর নয়। জননী-৫

পিছল পথে সাবধানে পা ফেলে আজহার। বৃষ্টি এখনও সম্পূর্ণ থামে নাই। পাখির পাখনা-ঝাড়া ধোঁয়ার মতো ইলশেগুঁড়ি আকাশ হইতে ঝরিতেছে।

উঠানে হাঁকাহাঁকি করে চন্দ্র : সাজো, সাজো।

হাসিমুখে এলোকেশী ও চন্দ্রমণি বাহির হইয়া আসে।

 দাদা যেন যুদ্ধের হাঁক ছাড়ছে।

এলোকেশী বোঝে, কী সাজিবার হুকুম কোটাল রাজার। সে আর দাঁড়ায় না, দাওয়ায় চন্দ্রমণিকে একটি আসন আগাইয়া দেওয়ার হুকুম দিয়া সে চলিয়া গেল।

এই চন্দ্রমণি! আজহার অবাক হইয়া যায়। মাঠে আসিয়া সে বহুদিন চন্দ্রের এই সহোদরাকে দেখিয়াছে। পাতলা চেহারার গঠন, ফরসা রঙ, বয়সে সে চন্দ্রের অনেক ছোট। অগ্রজই বহু চেষ্টা করিয়া তার বিবাহ দিয়াছে। কিন্তু এ কী ছিরি হইয়াছে তার। পাটকাঠি বা পাকাটির মানবিক সংস্করণ যেন গায়ে নাজেল হইয়াছে।

আমার কাপড়চোপড় ভিজে গেছে মণি, খড়ের বিড়েটা আর নষ্ট করব না। এমনি বসছি। কিন্তু তুই এমন হয়ে গেছিস্ কেন?

কপাল ভাঙলে আর কার গতর ভালো থাকে, দাদা!

আজহার চুপ করিয়া গেল। পঁচিশ পার হয় নাই, ওই কচি মেয়েটা আল্লার কাছে কী গোনাহ্ করিয়াছিল, যার শাস্তি এমন নির্মম! আজহার এদিকে ধর্মপ্রাণ বুদ্ধি দিয়া যার নাগাল পায় না, সেখানে আল্লার মক্করের সন্ধান সে সহজেই লাভ করে।

জ্বর হয় তোর, মণি?

আজহারও মুষড়াইয়া যায়। আল্লার বান্দার বেশিরভাগ এই একই দশায় উপনীত! গাঁয়ের দশটা ঘর খুঁজিয়া পাওয়া মুশকিল, অভাব-অনটনপ্রসূত কোনো ঝঞ্ঝাট যেখানে অনুপস্থিত।

ম্যালেরিয়া জ্বরে দুমাস ভুগছি। তবে শরীর আগে থেকেই খারাপ।

দাওয়ার এককোণায় চন্দ্রমণি বসিয়া পড়িল। শাদা থানকাপড় পরনে। তার ফ্যাকাশে রক্তহীন শরীরের সঙ্গে রঙের ভালো সামঞ্জস্য হইয়াছে।

দুইটি উলঙ্গ কালো ছেলে চন্দ্রমণির কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। আজহার ইহাদের। আগে দেখে নাই।

পিতৃহীন অনাথদের পরিচয় তার অনুমানের কাছে অজানা নয়। তবু সে জিজ্ঞাসা করে : তোমার ছেলে না, মণি?

হ্যাঁ, দাদা। বড় গোপালের বয়স মোটে পাঁচ। যোগীন তিন বছরের। ওদের নিয়েই তো আমি জ্বলেপুড়ে মরলুম। একটা কানাকড়ি যদি বিধবা হওয়ার সময় রেখে যেত–

চন্দ্রমণির কোটরাগত নিষ্প্রভ চক্ষু হইতে টস্ট পানি পড়ে। গোপাল ও যোগীন মার কাছ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া থাকে।

চন্দ্রমণি আচ্ছন্ন চোখেই আবার বলিল, দাদা ছিল বলে মাথা গোঁজার ঠাই আছে। কিন্তু দাদার অবস্থা তো দেখছ, ছেলেপুলে মরে গেল। তার ওপর আবার আমার বোঝা।

শুকনা গামছা পরিয়া কল্কেয় দম দিতে দিতে চন্দ্র বাহিরে আসিল। তার চোখ পড়ে মণির উপর।

এই আবার প্যানপ্যান শুরু করেছিস। এই মণি, অমন করবি তো যা নিজের জায়গায়। দেখ না আজহার ভাই, ওর হয়েছে কী। আমি তো মরে যাইনি।

চন্দ্র ধমক দিল আবার : যা উঠে, কিছু হয়নি। খেটে খেটে আমাদের জন্য শরীরটা কী হচ্ছে!

ভাগ-ভাগ– আর মুখ খুলিস নি। কী হয়েছে আমার শরীরের?

আজহারের হাতে কল্কে দিয়া চন্দ্র হাতের পেশি ফুলাইয়া বলে : দ্যাখ, মণি দ্যাখ। ঘুষি মেরে কোন্ বাপের ব্যাটা এটা নোয়াক দেখি।

মলো যা-যা রান্নাশালে।

গোঁফে তা দিয়া চন্দ্র ঠোঁট বাঁকাইল।

এলোকেশী চন্দ্রমণির হাত ধরিয়া টান দিল। সে বলিল : চলো না ঠাকুরঝি। ভাইবোনে আর সতীনের ঝগড়া দরকার নেই।

মৃদু হাসি এলোকেশীর ঠোঁটে।

যা-যা, নিয়ে যা শিগ্‌গির।

যোগীন মামার কাণ্ড দেখিয়া হাসিতে থাকে।

 তুমি হাসছ! দেখি পাঞ্জা ধরো তো।

তিন বছরের শিশু। ভয় পায় না সে। কচি পাঞ্জা বাড়াইয়া দিল যোগীন।

গোপাল বড় নীরিহ। সে ছোটভাইয়ের খেলা দেখে। ভয়ে গোপাল মামার কাছে ঘেঁষে না।

এইরকম করে লড়তে শেখ বেটা। বড় হলে ডাকাতি করবি।

আজহার ঠোঁট হইতে কল্কে নামায়।

বেশ তালিম দিচ্ছ ভাগনেকে।

চন্দ্র লম্বা গোঁপে তা দিল একবার।

সত্যি, ডাকাত করব ছেলেগুলোকে। লুটেপুটে খাবে, খেটে তো খেতে পাবে না। নিজেও ডাকাতের দলে ঢুকব।

আজহার ভাবে, চন্দ্রের মাথায় ছিট আছে। তবু চুপ করিয়া যায় না সে।

তুমিও ডাকাতি করবে?

করব না? এত মেহনত করে লাভ কী? ধম্ম-উম্ম-ভগবান ওসব মানিনে। খেটে খেতে না-পাওয়ার চেয়ে চুরি করায় পাপ নেই।

আজহারের চোখ কপালে উঠিতেছে যেন।

 কী সব বকছ, চন্দর!

সত্যি বলছি, মনমেজাজ বিগড়ে গেছে আমার। তুমি বিশ্বাস করো ভগবান আছে, আল্লা আছে?

তৌবা, তৌবা, তৌবাস্তাগফের।

আজহার মনে মনে দরুদ শরিফ পড়িতে লাগিল।

যোগীন মাতুলের সঙ্গে তখনও পাঞ্জা লড়িতেছে।

চন্দ্র কোটালের মুখ বন্ধ থাকে না : আমরা খেটে খেতে পাই না। ওরা বসে-বসে তামাক ফোঁকে, গদিতে শুয়ে খেতে পায়। বলে, ভগবানের ইচ্ছে, কপাল! তেমন অবিচারী ভগবানে আমার দরকার? লুট করেঙ্গা– খায়েঙ্গা।

গঞ্জে মেড়ো ব্যবসায়ীদের নিকট চন্দ্র হিন্দি জবান শোনে। আজ তার সুযোগ গ্রহণ করিল।

চন্দ্র যোগীনকে তাল দিতে শেখায়। গান করে সঙ্গে সঙ্গে : লুট করেঙ্গা– খায়েঙ্গা। লুট করেঙ্গা

আজহার খাঁর মুখাবয়বের উপর চন্দ্রের দৃষ্টি পড়ামাত্র গান থামিয়া গেল।

গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিয়াছে আজহার খাঁ।

হাত বাড়াইয়া দিল চন্দ্র তার দিকে। বলিল, রাগ করছ? আচ্ছা, এখন আসল কথা পাড়া যাক।

জিজ্ঞাসা করে আজহার, কী কথা?

কী বলেছিলাম?

সে-প্রশ্ন এতক্ষণ আজহার খাঁর মনে কোনো চিহ্ন বজায় রাখে নাই। নিতান্ত নির্বোধের মতোই সে উত্তর দিল।

কী বলেছিলে?

একচোট হাসিয়া লইল চন্দ্র।

তা আর মনে থাকবে কেন। মাছ-ব্যবসা তোমার সঙ্গে?

আরো অপ্রতিভ হয় আজহার খাঁ।

লজ্জায় সে অস্পষ্ট কণ্ঠেই জবাব দিল, জানো তো আমার অবস্থা। টাকাও ধার পাওয়া গেল না।

খামাখা এতক্ষণ আমার সঙ্গে তর্ক জুড়েছিলে। চোখে চেয়ে দ্যাখো না। পেট চলে, ব্যবসা করব। তা একটা কানাকড়ি পুঁজি নেই।

তারপর চন্দ্র চুপ করিয়া গেল। চন্দ্রমণি নিঃশব্দে আসিয়া তাহাদের কথাবার্তা শুনিতেছিল। সে-ই নীরবতা ভাঙিল।

–দাদা, মাছের ব্যবসার জন্য যোগীনের বাবারও খুব ঝোঁক ছিল।

 চন্দ্র হুঁ শব্দে সায় দিল মাত্র।

যোগীনের মামার সঙ্গে খেলা বন্ধ। সে অভিমানীর মতো বসিয়া আছে। চন্দ্র তার দিকে দৃষ্টি ফেলিয়া জোরে হাসিয়া উঠিল।

এই ছোটমামা, আমাদের যুক্তি আঁটাই রইল। না, আর ব্যবসা করব না। চাষবাষ করব না।

আজহার মনে করে চন্দ্র তার উপর বিরক্ত। খটকা মুছিয়া ফেলিবার জন্য সে সরস কণ্ঠেই বলিল, আমার উপর রাগ করো না, চন্দর। গেল দুবছর কী করে যে সংসার চালিয়ে নিয়ে আসছি, আমিই জানি।

চন্দ্র যোগীনের মাকে আর এক কল্কে তামাক আনিবার জন্য আদেশ করিল।

তোমার উপর রাগের কী আছে। রাগ সব ওই-যে তুমি কী বলো–কপাল, কপালের উপর।

আজহার ভিজা কাপড়ে বসিয়াছিল। সে যেন কত অপরাধ করিয়াছে। সহজে চন্দ্রের দাওয়া হইতে উঠিতে পারিতেছিল না।

চন্দ্রমণি গগনে এক কল্কে আগুন লইয়া হাজির হইল। আজহার নির্জীবের মতো দুএক টান দিয়া কল্কে আবার প্রত্যর্পণ করিল।

খাঁ, চলো, জমির ধানগুলো দেখে আসি। তুমিও বাড়ি যাবে।

দুজনেই সড়ক ধরিয়া অগ্রসর হয়। চন্দ্রের হাতে দুটি লালগোঁফ তপসে মাছ। আজহার আনমনা, কোনো দিকে তার দৃষ্টি নাই। কোটালের কোনো সাহায্য করিতে পারিল না, এই চিন্তা তার মনে কোথায় যেন বিধিতে থাকে।

চন্দ্র বেপরোয়া। সে তার স্বকীয় পদক্ষেপের ভঙ্গি বিস্মৃত হয় না।

বৃষ্টির পর দিগন্তের আবিলতা মুছিয়া গিয়াছে। শাদা বকের দল বিলের ধারে কোলাহলরত। খালের তীরে নলখাগড়ার ঝোঁপের পাশে একটি মাছরাঙা বাসা হইতে গলা বাড়াইয়া আবার সন্ত্রস্ত নীল আকাশে মিশিয়া গেল নিমেষে। চন্দ্র কোটালের চটুল চাহনি এক জায়গায় স্থির থাকে না।

আজহার পেছনে-পেছনে হাঁটিতেছিল। হঠাৎ চন্দ্র পাশ ফিরিয়া চাওয়ামাত্র আজহার ধরা-গলায় বলে : চন্দর, মনে করিসনে কিছু, ভাই। আমারও বরাত। কপাল তো খুলল না। ব্যবসা করে একবার দেখা যেত।

চন্দ্র কোটাল অবাক।

নিশ্চয় রাগ করব। তপসে মাছদুটো যদি ছেলেপুলে নিয়ে ভেজে না খাও, রাগ করব না?

হাসিমুখে চন্দ্র আজহারের হাতে মাছদুটি খুঁজিয়া দিল।

চন্দ্র কোটালের মনে চন্দ্রমণি, সংসার, যোগীন, পোপাল সকলে এক-একবার উঁকি দিয়া যায়। দুঃখের পশরা যেন হালকা হইয়া গিয়াছে। আজহারের সঙ্গ তার আরো ভালো লাগে।

আজহার ভাই, তোমার সঙ্গে একবার বিদেশে যাব। রাজমিস্ত্রির কাজ শিখিয়ে দাও সামান্য।

আজহারের নিকট হইতে কোনো জবাব আসিল না। চন্দ্র তার বিষণ্ণ মুখের দিকে একবার মাত্র চাহিয়া নীরবে হাঁটিতে লাগিল।

একটা শাদা গাঙচিলের তীক্ষ্ণ স্বর প্রান্তরে মূছীহত স্বপ্নিল আবেশের মতো বিলীন হইয়া যায়।

.

০৭.

কয়েক কাঠায় আউশ ধান দিয়াছিল আজহার।

বর্ষার মাঝামাঝি পাকা রঙ ধরিয়াছে আউশের ধানে। হঠাৎ সে রাজমিস্ত্রির কাজে কনিক ইত্যাদি লইয়া ভিনগায়ে চলিয়া গেল। সমস্ত সংসার রহিল দরিয়াবিবির উপর। পূর্বে বিদেশে যাওয়ার আগে আজহার খাঁ শলাপরামর্শ করিত স্ত্রীর সহিত। এবার কোনো কথা সে উচ্চারণ করে নাই। দরিয়াবিবি আজহারকে যন্ত্রপাতি লইতে দেখিয়াছিল। কোনো ভিনগাঁয়ে যাইতেছে সে, এমন ধারণা দরিয়াবিবির মনে ঘুণাক্ষরে উদিত হয় নাই। পরে আমজাদ আসিয়া খবর দিয়াছিল। পিতার বিদেশযাত্রার সংবাদ শুধু সে-ই প্রথমে অবগত হয়।

তুই ঝুট বলছিস, আমু।

না মা। আব্বা বললে, কোথায় নিয়ামতপুর আছে, সেখানে কাজে যাচ্ছে।

অবেলা সঙ্গীদের সঙ্গে আমজাদ তেপান্তর-জরিপে বাহির হইয়াছিল। আকস্মিক সাক্ষাৎ পিতা-পুত্রে। নিতান্ত দৈবাতের যোগসাজশ মাত্র।

দরিয়াবিবি কিছুক্ষণ গুম হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এমনও লোক সংসারে আছে! বিদেশে যাইতেছে, তা-ও বাড়ির লোকদের একটু খবরমাত্র দেওয়া প্রয়োজন মনে করিল না।

হুই ইস্টিশনের দিকে গেল। মা, আব্বাকে দেখলে একটা পাগল মনে হয়। মুখে কথা নেই। মাথা গুঁজে চলেছে তো চলেছেই। হুঁসগুস নেই।

দরিয়াবিবির ঠোঁটে এতটুকু দাগ পড়িল না।

মা, কী হাসি লাগে আব্বার ছিরি দেখলে। লুঙিটা পর্যন্ত ভালো করে পরতে জানে না। কোনোরকমে কোমরে গুঁজলেই বুঝি কাপড় পরা হয়? তার উপর ছেঁড়া পিরহান।

দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল দরিয়াবিবি।

যা, আর কথার খৈ ফোঁটাতে হবে না।

আমজাদ কেঁচো বনিয়া গেল।

দরিয়াবিবি লক্ষ্য করে, সন্ধ্যা নামিয়া আসিতেছে। ঘন কৃষ্ণপক্ষ। আজ আর চাঁদ উঠিবে না সড়কের উপর। ইস্টিশনের পথ অনেক দূর।

তোকে আর কিছু বলেনি, তোর আব্বা?

আমজাদের ত্রস্ত-সঙ্কুচিত চিবুক ছুঁইয়া দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল। পিতৃহীন কোনো অনাথের চিবুক যেন স্পর্শ করিতেছে দরিয়াবিবি। কণ্ঠ তার নুইয়া পড়ে ভাবাবেগের আতিশয্যে। হঠাৎ এমন দীনতার প্রলেপ তার মনে ও শরীরে! অসোয়াস্তি অনুভব করে জননী। বালকপুত্রের জবাব আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিশিয়া যায়।

খলিল বলিল, আমু, কাজে যাচ্ছি নিয়ামতপুর।

নিয়ামতপুর কোথা মা?

দরিয়াবিবি কোনো উত্তর দিল না। আজ ক্ষোভ হয় তার। হিংসা-উদ্ভূত ক্ষোভ। সমস্ত সংসারকে এমনই নির্বিকার চিত্তে সে দেখিতে পারিত! রাত পোহাইলে শত কাজ, মনের চারিদিকে আরো সহস্র বেড়ির সর্পিলতা।

আমজাদ সম্মুখে না থাকিলে অবোধ বালিকার মতো কাঁদিয়া ফেলিত দরিয়াবিবি। দৃষ্টি নেপথ্যে মিলাইয়া, বালকপুত্রের উপর ঈষৎ ভর দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল সে স্থাণু প্রতিমার মতো।

নঈমা পিতার ন্যাওটা। পাড়ার কোনো বালকের মুখে সে বাবার বিদেশযাত্রার ৭০

কথা শুনিয়াছিল। তার কান্না আর থামে না। রোদন-আতুর কন্যার কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙিল দরিয়াবিবির।

মা, আমাকে আব্বা নিয়া গেল না। নঈমা চিৎকার করে।

চুপ। না হলে মার খাবি।

মার ধমকে নঈমা শান্ত হয়।

দরিয়াবিবি বলে, আমু, ওকে তোমার মতবের বইয়ের ছবি দেখাও।

তখনও সন্ধ্যা দেওয়া হয় নাই, দরিয়াবিবির খেয়াল ছিল না। তাই আবার বলিল, আমি ডিপে জ্বেলে দিচ্ছি, একটু সবুর কর বাবা।

নাচ-দুয়ারে প্রদীপ দেখাইতে আসিয়া দরিয়াবিবি গরুগুলির চেহারাও একবার দেখিয়া লইল। যদি বৃষ্টি না হয়, কিছুক্ষণ চরাটের জন্য ছাড়িয়া দেওয়া হইবে। আমু ছেলেমানুষ। অপরের ফসলে না পড়ে, সে ভয়ও আছে। খোয়াড়ের পয়সা যোগানের ক্ষমতা যাদের আছে তাদের গরু-বাছুর ছাড়া থাকে ফসলের দিনেও।

নিমগাছের নিচে পোয়াল-খড়ের গাদাটি বড় অদ্ভুত ঠেকিল আজ দরিয়াবিবির। নিঃসঙ্গ মনে হয় ভিটের আশপাশ। প্রদীপ দেখাইয়া তাই তাড়াতাড়ি সে পুত্র-কন্যার নিকট ফিরিয়া আসিল।

একজোড়া পেঁচা উড়িয়া গেল। অমঙ্গলের আশঙ্কায় দরিয়াবিবির বুক দুরুদুরু করে। ছেলেদের কাপড় চুরি গেল কয়েকটি। হাত-ছাচড়ের উপদ্রবে রাত্রির ঘুম ব্যাহত হয়। পুরুষমানুষ ছিল ঘরে, তবু ভরসা। নিঃসঙ্গতা আর একবার হানা দিয়া গেল। বেলাবেলি গেরস্থালির কাজ শেষ হইয়া গিয়াছিল। দরিয়াবিবি আমজাদের পাশে বসিয়া তার পড়া শোনে : একদা দিল্লী নগরীর পথে।

নঈমা হি হি শব্দে হাসে : দিল্লী-বিলী হি-হি।

 চুপ করে শোন্। গোলমাল করিসনে, নঈমা। বড় সজাগ আজ দরিয়াবিবির কান।

আমু পড়াশোনা করিতেছে, তার গোলমাল নেহাত কম নয়। তবু বেড়ার ধারে কি পৈঠার কাছে সামান্য শব্দ হইলে দরিয়াবিবি উৎকর্ণ হইয়া পড়ে।

ধূসর ভবিষ্যৎ যোজন-বিসারী প্রান্তরে ছড়াইয়া পড়িতেছে। তার চারিদিকে শুধু রুক্ষতা; সবুজ রঙের ফিকে আভাস পর্যন্ত নাই। দৃষ্টি মেলিয়া দিলে চাচর বালুর অকরুণ হাসিই একমাত্র সত্যরূপে প্রতিভাত হয়।

দরিয়াবিবি কোনোদিন বাস্তবের সম্মুখে ভাঙিয়া পড়িতে শিখে নাই। আজ সামান্য ব্যাপারটুকু কেন্দ্র করিয়া এতকিছু ঘটিয়া গেল।

সপ্তাহ কবে শেষ হইয়া যায়, আজহার খর কোনো খবর নাই। পিয়নকে আমজাদ অনর্থক বিরক্ত করে। দরিয়াবিবিও চিন্তিত হয়। অবশ্য আউশ ধান কাটা বাকি আছে। তার পূর্বে আজহার খাঁ নিশ্চয় বাড়ি ফিরিয়া আসিবে, দরিয়াবিবির মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।

ধীরে ধীরে আরো দুই সপ্তাহ কাটিয়া গেল। সাকেরকে ডাকিয়া দরিয়াবিবি বহু খেদোক্তি করিল। জওয়ান মরদ বিদেশে গিয়াছে, তার জন্য এত ভাবনাচিন্তা ভালো নয়। এই উপদেশ দিয়া সে সরিয়া পড়িল।

দরিয়াবিবি চারিদিকে অন্ধকার দেখে। হাত-খরচ শেষ হইয়া গিয়াছে। ছোট ছেলে আর মেয়ের মুখে দৈনন্দিন আহাৰ্যটুকু কি শেষে যোগাইতে পারিবে না, ধার-কর্জ করিয়া কতদিনই চলিবে?

দরিয়াবিবি উপায়ের খোঁজে অন্ধকারে হামাগুড়ি দিতে থাকে। ছাগলছানা দুটি থাকিলে দুর্দিনে কাউকে বিক্রয় করা যাইত। সে পথেও আল্লা বাধ সাধিয়াছেন। পুরুষমানুষ ঘরে থাকলে কোনো-না-কোনো পথের হদিশ মিলিত। বর্ষাকাল, পাড়া-প্রতিবেশীরা। কোনোরকমে দিন গুজরান করে। বীজধান খাইয়া অনেকে শেষ করিয়া ফেলিয়াছে। এই সময় জন-মুনিশ লোকে কম খাটায়। চারিদিকে বিপদের বেড়াজাল। প্রত্যেকে আত্মবিব্রত। গরিব কৃষক-পল্লীর ভেতর সহানুভূতি বুক-ফাটা নিঃশ্বাসের রূপ ধরিয়া বাতাসে ধ্বনিত হয়। আর তিন-চার দিনের খোরাক আছে। তারপর?

পরদিন সাকেরের মার সঙ্গে দরিয়াবিবি দেখা করিতে গেল। বৃদ্ধার গণ্ডস্থল আনন্দে স্বচ্ছ হইয়া উঠে। হাসুবৌর নিয়ত আল্লা পুরা করিয়াছে এতদিনে। আনন্দে সাকেরের মা এই বয়সেও অস্থির হয়। দরিয়াবিবি ঠাট্টাচ্ছলেই দাওয়াতের কথা পাড়িয়াছিল। বৃদ্ধা শুধু রাজি হইয়া গেল না, রীতিমতো পীড়াপীড়ি শুরু করিল। দরিয়াবিবি আজ সরলচিত্তে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিতে পারে না। কোথায় যেন মনে ব্যাপারটা বেঁধে। ঘরে ভাত নাই, এমনদিনে দাওয়াত স্বীকার করিলে পাড়াপড়শীরা হীনচোখে দেখিবে। তবু রাজি হইয়াছিল দরিয়াবিবি। এক বেলার খোরাক অন্তত বাঁচিয়া গেল। আসেকজানও সেইসঙ্গে নিমন্ত্রিত হইয়াছিল।

এতদিন আসেকজানের প্রতি দরিয়াবিবির একরূপ করুণা-মিশ্রিত অবজ্ঞার ভাব ছিল। ইদানীং অন্য চোখে দেখে এই বৃদ্ধাকে। সংসারে নিজেদের অসহায়তার সঙ্গে আসেকজানের দশা সমান পাল্লায় ওজন করা চলে, দরিয়াবিবি তা গভীরে উপলব্ধি করিতে শিখিয়াছে। পূর্বে তার কোনো খোঁজখবরই সে লইত না। কখন খায়, ঘুমোয় বা অভুক্ত থাকে তার হিসাবের প্রয়োজন ছিল না দরিয়াবিবির। বর্তমানে মনের এই বোঝাবাহী প্রবৃত্তির তাড়না সে নিজেই অনুভব করে।

বর্ষায় আসেকজান বাহির হইয়া যায়। দাপাদাপি বৃষ্টি তোড় চলিতেছে, সে কিন্তু থামে না। হয়তো তার দাওয়াত থাকে অথবা থাকে না কিন্তু দাওয়াতের বাহানা সে যোলো আনা করে।

ঘরে চাল শেষ হইয়া আসিতেছে। আসেকজান সব খবরই রাখে। এই বিষয়ে আমজাদ তার সহায়। রাত্রিবেলা ঘুমাইতে গেলে আসেকজান খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া সব জিজ্ঞাসা করে।

জালায় আর বেশি চাল নেই, দাদি। মা কত রাগ করছিলেন আব্বার উপর।

আসেকজান প্রশ্নের জবাবে চুপ করে কিছুক্ষণ, আবার বলে : আজ পেটপুরে ভাত খেয়েছ?

হ্যাঁ, দাদি। মা কিন্তু ভালো করে খায় না।

 আসেকজান স্তব্ধ হইয়া গেল আবার।

এমন সংলাপের বিনিময় চলে।

পরদিন জালার ভেতর হঠাৎ বেশি চাউল দেখিয়া দরিয়াবিবি আমজাদকে ডাকাইল।

 দরিয়াবিবি : জালায় চাল এল কোথা থেকে?

আমজাদ : আমি কী জানি, মা।

দরিয়াবিবি ব্যাপারটা সহজে আন্দাজ করে। অন্যদিন হইলে এতক্ষণে কুরুক্ষেত্র বাধিয়া যাইত। সকা-জাকাতের চালে তার শিশুদের জঠর-সেবা চলিতে পারে না। আজ দরিয়াবিবি নিজেই অন্যদিকে কথার স্রোত ফিরাইল।

তুই পিয়নকে জিজ্ঞেস করেছিলি, টাকা বা চিঠি কিছু নেই?

 আমি রোজ জিজ্ঞেস করি, মা।

কাল আর একবার যাস।

মার কণ্ঠ এত মোলায়েম হইতে পারে, আমজাদের বিশ্বাস হয় না।

বড় মিষ্টি মনে হয় মার গলা : আমু, ধান পেকেছে নাকি দেখে আসবি কাল। মুনিশ করে কাটাতে হবে আর কী।

আমজাদ মাথা দোলাইয়া সায় দিল।

রান্নার জন্য মা চাউল মাপতে আসিয়াছিল। হঠাৎ আমজাদকে আদর করিতে আরম্ভ করিল দরিয়াবিবি। যেন কত কথা আছে আরো, তা আজ বলিয়া শেষ করা যায় না। তাই স্নেহের ছোঁয়াচে সমাপ্তি-রেখা টানা হইতেছে। মার চুম্বনে বিব্রত হয় আমজাদ।

বাইরে বাঁশবনে মির্মির শব্দ শোনা যায়।

পরদিন দুপুরে আমজাদ স্তম্ভিত হইয়া গেল। সামান্য অন্যায়ে মা এমন শাস্তি দিতে পারেন। মক্তবের বেতন চাহিয়াছিল সে। হয়তো মার মেজাজ ভালো নয়, সেইজন্য চাওয়া উচিত হয় নাই; কিন্তু জননী এমন বেদেরেগ হাত চালাইতে পারে, তার জানা ছিল না।

মার খাইয়া দাওয়ায় বসিয়া সে নীরবে অশ্রুপাত করিল বহুক্ষণ। নঈমা পাশে দাঁড়াইয়াছিল। অনুতপ্ত জননীকে যদি একটিবার পাওয়া যায়। দরিয়াবিবি শত কাল্লাম জুড়িয়াছিল। আজহার ও তার চৌদ্দপুরুষের চল্লিশার আয়োজন হইতেছিল দরিয়াবিবির ঠোঁটে। আমজাদ আনমনা অলক্ষিতে ভিটা হইতে সরিয়া পড়িল।

মাঠে আসিয়া সে শান্তি পায়। আজহারও এই প্রান্তরের বুকেই দীর্ঘশ্বাসের মর্যাদা দিতে পারে। রক্তের শৃঙ্খলে বোধহয় আমজাদ বাঁধা পড়িয়াছিল।

সে অনেকক্ষণ ঘুরিয়া বেড়াইল মাঠে মাঠে। আকাশে মেঘ ছিল, বৃষ্টি ছিল না। ঘুরিয়া বেড়াইতে কোনো বাধা নাই।

বেলা ঢলিয়া পড়িতে তার ভয়ানক ক্ষুধা লাগিল। বর্ষাকালে ধান ছাড়া অন্য চাষ নাই মাঠে। গ্রীষ্মের দিন হইলে তরমুজ-শশা খাইয়া আমজাদ মার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করিত। অদৃশ্য হাতের টানেই সে চন্দ্র কোটালের কুঁড়ের দিকে অগ্রসর হইল।

নদীর মোহনার কাছে একটা পিঠুলি গাছের তলায় বসিয়া আমজাদ আবার আকাশ পাতাল ভাবিতে লাগিল। চন্দ্রাকার বাড়ি সোজাসুজি যাইতে আজ বাধে। মনের আবহাওয়া অতটুকু খোকাও সহজে মুছিয়া ফেলিতে পারে না। চন্দ্রমণি একবার কলস-কাঁখে খালের ধারে আসিয়াছিল। আমজাদকে দেখিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, এখানে বসে আছ যে–?

আমজাদ জবাব দেয় না। তার মুখ শুষ্ক। চোখের পাতার নিচে কান্নার শুষ্ক ছাপ।

রাগ করে এসেছ বুঝি বাড়ি থেকে?

চন্দ্রমণি ঠিকই আন্দাজ করিয়াছিল।

 চলো, তোমার কাকা ঘরে আছে। কী হয়েছে?

আমজাদ শুধু মাথা হেঁট করিয়া থাকে। চন্দ্রমণির অনুরোধ সে রক্ষা করে না।

এই সময় চন্দ্র কোটালও আসিয়া উপস্থিত হইল।

কি রে চাঁদমণি। এই দ্যাখো না, দাদা। তোমার বন্ধুর ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে।

চন্দ্র আমজাদের গতিবিধি লক্ষ্য করিল। সে নির্বাক নিশ্চল। তার কচি সুন্দর দুই চোখও দূরে উদাও।

হাসিয়া ফেলিল চন্দ্র।

আরে চাচা, গাছের তলায় শেষে তপ করতে বসেছ নাকি? তোমার বাবা বড় নামাজি-মুসল্লি। তার ছেলে।

আমজাদ কারো দিকে চায় না।

কোটালরা দুই ভাইবোনে খুব হাসিতে থাকে।

 সিস দিয়া চন্দ্র গান ধরিল–

কথা কয় না।
আমার ময়না।

তবু আমজাদের ঠোঁটে কোনো আভাস নাই। চন্দ্র এইবার একটা সিস দিয়া সুৎ শব্দ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমজাদকে পাঁজাকোলা করিয়া একদম কাঁধে তুলিয়া লইল।

মৌনী বাবা এবার ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কান্না শুরু করিল।

কথা কয় না।
আমার ময়না,
হায়, হায় রে ….

চন্দ্র খালের সড়কে হাঁটে।

চন্দ্রমণি ডাকে, ও দাদা, ছেলেটাকে দুটো মুড়ি খাইয়ে নিয়ে যাও।

মাথা দোলায়।

হ্যাঁ, বড় কথা মনে করেছিস, মণি।

কোটাল আবার ঘরের দিকে মুখ ফিরাইল।

.

০৮.

বৃষ্টি ঝরিতেছিল অঝোরে। মাঠের খোলা জায়গায় জমাট টুইটম্বুর পানির উপর আকাশের ছায়া পড়ে। বর্ষা থামিলেই শালিখ-চড়াই আসিবে স্নানের লোভে ছুটিয়া।

দরিয়াবিবি সদর ছাড়িয়া সড়কের ঘুলি-পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। জীবনে আর কোনোদিন সে এতদূর আসে নাই, মাথায় চটের থলি টোকার মতো করিয়া দেওয়া। পায়ের তলায় বৃষ্টিস্রোত বহিয়া যাইতেছে। চটের থলি পানি রোধ করিতে পারে না। ইতিমধ্যে উপরদিক ভিজিয়া গিয়াছে।

দরিয়াবিবি নির্বিকার দাঁড়াইয়াছিল। বেশ ঠাণ্ডা লাগিতেছে, তবু খেয়াল নাই। কার প্রতীক্ষায় সে দাঁড়াইয়া আছে?

সড়কের একপাশে গাছপালার নৈরাজ্য অল্প, তাই দূরে মাঠ দেখা যায়। অন্যান্য দিকে আকাট লতা আর গাছপালার জঙ্গল। মেঘমেদুর আকাশের আচ্ছাদনে নীরব নিবিড় পল্লীর এই বিজন কোলটুকু ভয়াবহ, প্রেতায়িত– সামান্য শব্দে চমক লাগে।

সড়কে দরিয়াবিবি দাঁড়াইয়া থাকে। চঞ্চল চোখ বারবার সড়কের দূরতম রেখায়। তার গম্ভীর মুখাবয়ব আকাশের বাদল যেন।

হঠাৎ দরিয়াবিবির দুই চোখ উজ্জ্বল হইয়া উঠে। দূরে একটি বালকমূর্তি দেখা গেল। আমজাদ দ্রুত পা ফেলিয়া অগ্রসর হইতেছে। একটিমাত্র লাল গামছা তার মাথায়।

বৃষ্টির পতন-রেখার ভেতর দিয়া তার বালকমূর্তি অপরূপ দেখায়। একটি পুতুল লাফাইয়া চলাফেরা করিতেছে।

দরিয়াবিবি আকস্মিক উৎফুল্ল হইয়া উঠে। আমজাদ তার নিকটে পৌঁছিবার পূর্বেই জিজ্ঞাসা করে, শৈরমীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

বৃষ্টিস্নাত তার সমগ্র শরীর। শীতে আমজাদ কাঁপিতেছিল। সহজে জবাব দিতে পারে না।

মার কাছে ঘেঁসিয়া সে হাঁফ ফেলে কিছুক্ষণ, তারপর বিষণ্ণমুখেই জবাব দেয় : না গো মা। তবে শৈরমী-ফুফুর জা বললে, সে মাঠ থেকে তোদের বাড়ি যাবে।

শৈরমী জাতে বাগদী। কৈবর্তপাড়ার ঠেস ছাড়াইয়া গেলে জনপদের একটেরে বাগ্‌দীদের বাস। শৈরমীর সংসারে একমাত্র পঙ্গু পুত্র জীবিত। বহুদিন পূর্বে তার স্বামী পরলোকে। গণেশ দীর্ঘকাল রোগে ভুগে পরে হঠাৎ অকেজো হইয়া পড়ে। সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারে না, এক হাত বাঁকিয়া গিয়াছে। বৃদ্ধ বয়সেও শৈরমীকে এই পুত্রের ভরণ-পোষণের ভার গ্রহণ করিতে হইয়াছে। পাড়ায় সে ঘঁটে দেয়, মাঠের শাক তুলিয়া বেচে, কারো বাজার-সওদা কিনিয়া আনে। ফাঁইফরমাশেই তার জীবিকা সংগ্রহ হয়। জওয়ান পুত্রের এই দুরবস্থা। কায়িক পরিশ্রমের চাপেই শৈরমী তা সহ্য করিতে শিখিয়াছিল। দরিয়াবিবির সঙ্গে কয়েক বছরের পরিচয়। শৈরমী এই বাড়ি ঘুঁটে দিয়া যায়। সেই সূত্রেই হৃদ্যতা গড়িয়া উঠিয়াছিল। শৈরমী গ্রামেরই ঝিউড়ি বলিয়া সে দরিয়াবিবিকে ভাবী সম্বোধন করিত।

আমজাদ শীতে কাঁপিতেছিল। সেদিকে দরিয়াবিবির লক্ষ্য নাই। কাদার উপর দাঁড়াইয়া থাকিতে যেন কত ভালো লাগে।

বিষণ্ণ-মুখ পুত্র ও জননী।

বৃষ্টি একটু কমিয়াছিল। গাছে-পাতায় মৃদু নিনাদে অহর্নিশ বাজিতেছে। পাখির ভিজে পাখনা-ঝাড়ার শব্দ এবার শোনা যায়।

যদি না আসে। নীরবতা ভাঙিল দরিয়াবিবি।

না গো মা, আসবে। ঘরে চলো, আমার শীত পেয়েছে।

হুঁশ হয় যেন দরিয়াবিবির। আঁচলের একপাশ শুষ্ক ছিল, তা দিয়া সে আমজাদের মাথা মুছাইয়া দিল।

এখানে মুছে কি হবে মা, বিষ্টি পড়ছে যে!

গৃহকর্মে নিপুণ দরিয়াবিবির কোনো কাজে যেন সুডৌল নাই। বৃষ্টি পড়িতেছে, এখন চুল মুছাইয়া দেওয়া বৃথা, এই কথাটুকু সে যেন উপলব্ধি করিতে পারে না।

একটা অশথ গাছের গোড়ায় অনেক ব্যাঙ লাফাইতেছে। শীতে কাঁপিতেছে, তবু মজা লাগে বেশ আমজাদের। খপ খপ করিয়া একটি ব্যাঙ সড়কের উপর বসিয়া বাদল পোকা খাইতেছে নীরবে।

আমজাদ জোরে এক সুট দিয়া বলিল : মা, দ্যাখো ফুটবল খেলছি।

ধপাস শব্দে কয়েক হাত দূরে ব্যাঙটি আবার মাটির উপর পড়িল। চার হাত-পা ছাড়িয়া ফোক-ফোক শব্দ করে ব্যাঙের বাচ্চা।

দরিয়াবিবি এই সময় হাসি চাপিয়া রাখিতে পারে না।

আরে আমু, তোর ছেলেমি আর যায় না।

নিজের কৃতিত্বে আমজাদ গম্ভীর হইয়া যায়। মাথা দোলাইয়া সে বলে, ঘরে আমাকে কিন্তু গরম ভাত খেতে দিতে হবে। এত ভিজেছি, আমার বুঝি খিদে লাগে না।

দরিয়াবিবি চুপ করিয়া গেল। তার মুখের হাসি নিভিয়া যায় তখনই।

আরো আকাশে মেঘ জমিতেছে। আরো কতদিন বর্ষা লাগিয়া থাকিবে বাংলাদেশের গ্রামে?

নঈমা কোথাও যায় নাই, আসেকজানের সঙ্গে সে বাগ-বিতণ্ডা করিতেছিল। দুজনে মাঝে মাঝে কৃত্রিম বিবাদ চলে। গতকাল আলেঙ্কান কিছু চাল ভিক্ষা করিয়া আনিয়াছিল। তারই সঙ্গতি হইতেছে।

পান্তাভাত ছিল সকালের। দরিয়াবিবি রান্নার আয়োজন করে নাই। আমজাদ ঝাঁকিয়া বসিল, সে পান্তাভাত খাইবে না।

মেজাজ খারাপ, তবু দরিয়াবিবি আজ চুপ করিয়া গেল। অভিমানে আমজাদ কিছুই স্পর্শ করিল না। বিছানায় শুইয়া শুইয়া ক্ষুধার্ত জঠরেই ঘুমাইয়া পড়িল।

দরিয়াবিবি ভিজা কাপড় ছাড়িয়া বসিয়া রহিল। গোয়ালে গরুগুলি খড় চিবাইতেছে। আজ আর কোনো হাঙ্গামা নাই। কত নিশ্চিন্ত যেন দরিয়াবিবি। নঈমা আসেকজানের ঘরে খেলা করিতেছিল, তার আওয়াজ কানে পৌঁছায়।

বৃষ্টির কামাই নাই।

নিদ্রিত আমজাদের দিকে চাহিয়া দরিয়াবিবি বুকে শত তরঙ্গের আলোড়ন চলিতেছিল। বাহিরে তার প্রকাশ নাই। দরিয়াবিবি চুপচাপ বসিয়া। বহুদিনের যেন অবকাশ মিলিয়াছে। কর্মক্লান্ত জীবনে খুঁটিনাটি দিনগুলি তাই স্মরণে গাঁথা হইতেছে।

সামান্য পান্তা ভাত ছিল। দরিয়াবিবি খাওয়ার কথা সহজেই ভুলিয়া যায়। তারও ঘুমে চোখ বুজিয়া আসে। দেওয়ালে ঠেস দিয়া দরিয়াবিবি ঢুলিতে থাকে।

কোথা গো ভাবী, শব্দে চমকিয়া উঠিল দরিয়াবিবি।

সত্যই শৈরমী আসিয়াছে। ভিজে কাপড়। হাতে একটি ন্যাকড়া কাপড়ে বাঁধা শাকের পুঁটুলি।

দাওয়ার উপর বোঝা রাখিয়া শৈরমী বলিল : কেন ডেকেছিলে, ভাবী?

দরিয়াবিবি শৈরমীর কাছে যেন ছুটিয়া আসে। ঘুম উবিয়া গিয়াছে তার।

এই রাস্তায় যে ছায়া পড়ে না আর দিদির।

শৈরমীর রং কালো। বৃদ্ধ বয়সে চামড়া লাল হইয়া গিয়াছে।

রেখা-সংবলিত শরীরে আবার বৃষ্টিপাত শৈত্যের জুলুম। কুঁকড়াইয়া এতটুকু হইয়া গিয়াছে শৈরমী। বড় কুৎসিত দেখায় তার শরীর।

কিন্তু তার কণ্ঠে হৃদয়ের অপূর্ব আভাস বাজে : কত কাজে থাকতে হয়, তোমার কাছে কি অজানা ভাবী। বর্ষাকালে ছেলেটাকে নিয়ে কষ্টের সীমা নেই।

এইবার রীতিমতো হাঁপায় শৈরমী।

দরিয়াবিবি গণেশকে কোনোদিন দেখে নাই। তবু শৈরমীর দুর্দশা তার কাছে বাস্তব। কোনো কল্পনার প্রয়োজন হয় না তার।

নসিব, বোন। তোমার অমন রোজগারী পুতের এমন অসুখ দিলে, আল্লা।

শৈরমী বুকে দুই হাত রাখিয়া উত্তাপ খোঁজে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে চায় না সে। দরিয়াবিবি সহজে কোনো কথা পাড়িতে দ্বিধাগ্রস্ত, কেবল দেরির বাহানা তার।

পুঁটলিতে কী আছে, দিদি?

শৈরমী জবাব দিল : ভাবী, কটা শাক আছে। একটু তেল আনন, একদম চান্ করে ঘরে ঢুকব।

দরিয়াবিবি ঘরের ভেতর হইতে সরিষার তেলের ভাঁড় আনিল।

শৈরমী তখন পুঁটলি খুলিতেছে। সে একরাশ শাক দাওয়ার উপর রাখিয়া দরিয়াবিবির মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিল।

আর দেব, ভাবী?

না, এত মেটে শাক কী খাওয়া যায়! আর কি আছে পুঁটলিতে?

কিছু নেই।

কৌতূহলের ছলে দরিয়াবিবি শাকে হাত দেওয়া মাত্র তার নিচে শামুক দেখিতে পাইল।

বেশিদূরে সে অগ্রসর হইল না। দরিয়াবিবি বুঝিতে পারে, শৈরমী তো খুব সুখে নাই। হাঁসের জন্য শামুক লইয়া গেলে এমন গোপনের কী আছে। আর বেশি কথা জিজ্ঞাসা করিল না দরিয়াবিবি।

ভাবী, এবার উঠি।

আর একটু বসো। বুড়ো হাড়ে কি এত শীত ঢুকেছে?

 কৃত্রিম কোপনতার সঙ্গে বলে দরিয়াবিবি।

শৈরমী অনুনয় করে : ভাবী, আর একদিন এসে গল্প করে যাব। যাই, ছেলেটাকে বর্ষায় ঘরে একা রেখে মন মানে না। পাছে কিছু হয়।

দরিয়াবিবি কিয়ৎক্ষণ কোনো জবাব দিল না। সিঁড়ির উপর বসিয়াছিল মাথা নিচু করিয়া, তেমনই বসিয়া রহিল। মুখের উপর কালো ছায়া পায়চারি করে তার।

হঠাৎ এক দমকা নিশ্বাসে দরিয়াবিবি বলিয়া ফেলিল : দিদি, তোমার গুণধর ভাই তিন হপ্তা ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে মুখ কালা করে। ঘরে বড্ড টানাটানি। একটা পুরাতন ঘড়া আছে– রেখে যদি কেউ পাঁচটা টাকা দেয়। আমি সুদ দেব মাসে মাসে।

শৈরমী বিশ্বাস করে না। মিছামিছি বলছ, ভাবী।

দরিয়াবিবি হৃদ্যতার জন্যই শৈরমীকে কোনোদিন কোনো দুঃখের কথাই বলে নাই, বরং শৈরমীকে এক-আধটা পয়সা দিয়া সাহায্যের চেষ্টা করিয়াছে, আধ পয়সার শাক এক পয়সায় কিনিয়াছে।

হৃদ্যতার এই আর এক সোপান।

আজহারের উপর দরিয়াবিবির ক্রোধের অন্ত থাকে না।

দ্যাখো না, দিদি। ঘর ছেড়ে পালাল। আমিও বয়েস থাকলে কাউকে নিয়ে বেরিয়ে যেতাম। এমন লোক ভূ-ভারতে না জন্মায়। এমন–

শৈরমী ধমক দিয়া বলিল, কী-সব অনাছিষ্টির কথা মুখে আনছ অবেলায়, ছিছি! তুমিও দিদি, সামান্য বাতাসেই হেলে পড়ো?

দরিয়াবিবি স্তব্ধ হইয়া যায় হঠাৎ।

আচ্ছা, ঘড়াটা দাও। অধর সাঁতের মার কাছে রেখে পাঁচটা টাকা আন্‌ব। বুড়ি দু পয়সা সুদ চায় মাসে।

তাকেই দিও।

 ধীরে কথা বলে দরিয়াবিবি। দুই চোখ ছলছল করে তার।

বাবাজি বিয়ের সময় যৌতুক দিয়েছিল। আগে কপাল ভেঙেছিল। সেখান থেকে অতিকষ্টে ঘড়া আর পেতল-কাঁসার কটা জিনিস এনেছিলাম।

সজল ডাগর দুইচক্ষু দরিয়াবিবির বাম্পায়িত। থমথমে আকাশের মতো মুখাবয়ব বড় সুন্দর দেখায়। পরিশ্রম-মলিন গৌর রঙ বিদ্যুতের আভাসের মতো খেলিয়া গেল।

শৈরমী দুঃখ প্রকাশ করে : দাদার এমন উচিত হয়নি। ভালো ঘরের বউড়ী বাইরে বেরোয় না, সংসার দেখবে কে?

তুমি-ই বলল দেখি, দিদি।

দরিয়াবিবি কয়েক মিনিটের জন্য ঘরে ঢুকিল। যখন বাহির হইল তার হাতে একটি পুরাতন পিতলের ঘড়া।

মাটির উপর রাখামাত্র ঠুন শব্দ হয়।

 শৈরমী বারবার ঘড়াটি পরীক্ষা করিতে লাগিল।

দেখব ভাবী, যদি দুএক টাকা বেশি দেয়। যে মজবুত জিনিস।

বৃষ্টি থামিয়াছিল কিয়ৎক্ষণের জন্য।

দরিয়াবিবি একটি পান শৈরমীর হাতে দিয়া বলিল : দিদি, আঁচলের আড়ালে নিয়ে যাও। কেউ জিজ্ঞেস করলে যেন বলল না, আমাদের ঘড়াটা। দিব্যি রইল, দিদি।

ভাবী, এতদিনে আমাকে এমন কাল কেউটে ঠাওরালে। অদেষ্ট খারাপ না হলে ঘরের লক্ষ্মী পরের ঘরে কেউ রেখে আসে?

শৈরমী উঠিয়া পড়িল। আবার বৃষ্টি শুরু হইয়াছে। দরিয়াবিবি তখনও ঘড়াটা নাড়াচাড়া করে। কত অনিচ্ছার প্রতিরোধ মনে, তবু ধীরে ধীরে পিতলের সামগ্রী শৈরমীর হস্তে তুলিয়া দিতে হইল।

কাউকে বলো না কিন্তু, দিদি। আমার মাথার দিব্যি।

শৈরমী চলিয়া গেল।

সামান্য চাল আছে, আমজাদের জন্য ভাজা হইবে। রাত্রে আর কিছুর ঝঞ্ঝাট নাই দরিয়াবিবির।

দূরে মেঘ-গর্জন প্রান্তর হইয়া ভাসিয়া আসে। সবুজের বন্যায় তরুলতা লুটোপুটি খায়। অবেলার মৌন আকাশ দরিয়াবিবির মুখের উপর বার বার ছায়া ফেলে।

***

এই দুর্দিনে চন্দ্র কোটাল অনেক সাহায্য করিল। একটা কানাকড়ি সে দেয় নাই। গতরে মেহনত আর সহানুভূতির কোনো মূল্য নিরূপণ করা যায় কী? আরো দুই হপ্তাহ কাটিয়া। গেল। আজহারের কোনো পাত্তা নাই। বর্ষায় গোবর হইয়া যাইত এতদিন পাকা আউশ ধান। চন্দ্র কোটাল মুনিশ করিয়া নিজে সব খড় আজহার খাঁর ঘরে পৌঁছাইয়া দিয়া গেল। এবার ভালো ধান ফলে নাই। তবু বর্ষার পর দুমাস কোনো রকমে কাটিয়া যাইবে। দরিয়াবিবি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বুক বাঁধে। চন্দ্র কোটালের উপদেশেই সে কোনো দেনা শোধ করিল না। দুমাসে যদি আজহারের সংবাদ না আসে– যদি আর কোনো দিনই না আসে। কুটিল হতাশার চক্ররেখায় নিষ্পিষ্ট হইতে থাকে দরিয়াবিবি।

আমজাদ একদিন মতব হইতে ফিরিয়া বলিল : মা, মৌলবী সাহেব মাইনে চেয়েছে। দরিয়াবিবি বিরক্ত হয় : থাক্ রোজ রোজ তাগাদা করতে হবে না মৌলবী সাহেবকে। কাল থেকে আর মতবে যাসনে।

আমজাদের মুখ শুকাইয়া যায়।

দরিয়াবিবি একরাশ খুদের কাঁকর চয়ন করিতেছিল। আমজাদের দিকে চাহিয়া তার বিরক্তির ছায়া অদৃশ্য হয়। মুখ গম্ভীর করিয়া দরিয়াবিবি বলে : মৌলবী সাহেবকে বল, আমার বাপ এলে সব চুকিয়ে দেব।

আমজাদ তবু নড়িল না। সে জানে, মা ঐ এক বাক্যে বহুদিন মৌলবী সাহেবকে স্তোক দিয়াছে।

সাহসের উপর দিয়া আমজাদ মার কথার প্রতিবাদ করিল : তুমি তো রোজ ঐ কথা বলো।

দরিয়াবিবি অবনত মুখে কাঁকর বাছিতে থাকে, আমজাদের দিকে আর চাহিয়াও দেখে না।

আমজাদ গুটিসুটি মারিয়া গতিবিধি লক্ষ্য করে শুধু।

বহুক্ষণের নিস্তব্ধতা জগদ্দল ঠেকে আমজাদের নিকট। উশখুশ করে সে।

দরিয়াবিবি তার পুত্রের অস্তিত্ব যেন বিস্মৃত হইয়াছে।

মা হঠাৎ ডাকিয়া ফেলে; আমজাদ। আড়ষ্ট ঠোঁট হইতে কোনোরকমে নিঃসৃত।

গম্ভীর দুই নেত্র প্রসারিত করিয়া দরিয়াবিবি একবার পুত্রের দিকে চাহিল মাত্র।

 মা।

আমজাদের সম্বোধন আরো বাড়িয়া যায়।

এবার তীক্ষ্ণস্বরে জবাব আসে, কী?

না। কাল থেকে আর মখৃতবে গিয়ে কাজ নেই। ঢের হয়েছে লেখাপড়া।

আমজাদ মনে মনে উল্লসিত হয়। মতবের ছেলেদের ভালো লাগে। মতব তার আদৌ ভালো লাগে না।

তবে কী করব, মা?

ব্যঙ্গস্বরে জবাব দিল দরিয়াবিবি : কী করবি আবার! চাষার ছেলে জাতব্যবসা ধরবি।

আমজাদ এইবার মাথা হেঁট করে। কৃষির মতো কঠোর পরিশ্রমে কোনো সম্মান নেই।

মুখের হাসি অম্লান রাখিয়া সে জবাব দিল : আমি এই আট বছর বয়সে লাঙল ঠেলতে পারব?

তোর ঘাড় পারবে।

আমজাদ ভয় পায়, মা রীতিমতো ক্রুদ্ধ।

এমন সময় হঠাৎ চন্দ্র কোটালের ডাক শোনা গেল দহলিজে।

আমজাদ হাঁফ ফেলিয়া বাঁচিল।

এমনি আসিয়াছে কোটাল। আজহারের কোনো সংবাদ পাওয়া গেল কিনা। নিয়ামতপুরে ধানব্যবসায়ীরা প্রায়ই যায়। তারা কোনো খোঁজ দিতে পারে নাই। অতবড় গঞ্জে আজহার খাঁর মতো নগণ্য মানুষের তালিকা কোথাও লেখা থাকে না।

আমজাদ কোটালের সঙ্গে আলাপ জুড়িয়া দিল। একটু পরে দহলিজের আড়াল হইতে দরিয়াবিবি নিজেই কোটালকে ডাকিয়া বলে : কোটাল মশায়, আমজাদের একটা বন্দোবস্ত করে দিন।

চন্দ্র অবাক হইয়া যায়। আজ পর্দানশীনা দরিয়াবিবি নিজেই কথা বলিতেছে।

লজ্জায় চন্দ্র কোটালের কণ্ঠস্বরে তার স্বাভাবিক গমক থাকে না।

কেন, কী হল, ভাবী?

গরিবের ছেলে, খামাখা মখতবে মাইনা গুনে লাভ কী?

চন্দ্রের স্বাভাবিক রসিকতা-পটু কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল সে।

তা ঠিক। তবে দুই-এক বছর দেখা উচিত। ঐ তো কচি ছেলে।

না, যখন বেশিদূর টানতে পারব না। খামাখা টাকা খরচ করে লাভ নেই।

 চন্দ্র আর কোনো আপত্তি উত্থাপন করিল না।

ভাবী, বরং আমার সঙ্গেই থাকুক। মাছ-ধরা নৌকা বাওয়া শিখুক।

দরিয়াবিবি রাজি হইয়া গেল। ঐটুকু ছেলে এখনও সাঁতার শেখে নাই! সে নৌকা বাইবে? চন্দ্রের উপর সব নির্ভর করা চলে।

পান খাইয়া আমজাদকে একটু আদর করিয়া চন্দ্র কোটাল গায়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিল।

পরদিন সকালে আমজাদ অবাক হইয়া গেল। একটি ছোট লগী হাতে মা কোটালের নিকট পুত্রকে প্রেরণ করিতেছে। সত্যই নৌকার জীবন আরম্ভ হইবে নাকি!

মার দৃঢ় মুখাবয়ব দেখিয়া আর কোনো আপত্তি করিল না আমজাদ। সামান্য মুড়ি কোঁচড়ে সে নদীর পথ ধরিল।

দু-বছর আগেও দরিয়াবিবি এমন ঘটনাস্রোতের কল্পনা করে নাই। কত স্বপ্ন ছিল তাঁর চোখে শিশুপুত্র লইয়া!

তুমি কি আর স্বপ্ন দেখো না, দরিয়াবিবি?

.

০৯.

মৌন মহিমায় বর্ষার আকাশে জাগিয়াছিল তারা ক্ষত অন্তর লইয়া।

মফস্বল শহরের অন্তঃপাতী গণ্ডগ্রাম। সড়কের একটেরে আজহার ও কয়েকজন রাজমিস্ত্রি বাসা ভাড়া লইয়াছিল।

স্টেশনে যাত্রী পৌঁছাইয়া দেওয়ার জন্য এ অঞ্জলের শেষ বা বহুক্ষণ সড়কের উপর টায়ারের দাগ আঁকিয়া গিয়াছে।

আজহার একমনে তখনও নারিকেলি হুঁকা টানিতেছিল। কল্কের দমের সঙ্গে সঙ্গে আগুনের ফুলকি ওড়ে বাতাসে। কিয়ৎক্ষণের জন্য অন্ধকার সরিয়া যায়। বাসার দরজা চোখে পড়ে। আজহার চৌকাঠের উপর।

বাসার আয়তন সংকীর্ণ। একদিকে মাত্র ছোট জানালা। মাটির দেওয়ালে চুন-বালি ছোপানো কোথাও রঙ ধসিয়া গিয়াছে। মেঝে সুসমতল নয়। তারই উপর মাদুর পাতিয়া আজহারের সঙ্গী ঘুমাইতেছিল। সারাদিন বৃষ্টির পর ভ্যাপসা গরমে ঘরের ভেতর আজহারের দম বন্ধ হইয়া আসিতেছিল। কিছুক্ষণ পূর্বেই বিছানা ছাড়িয়া সে চৌকাঠে ধোঁয়ার আসর জমাইতে মগ্ন হইয়াছিল।

সড়কের পাশে একটি ডোবায় ব্যাঙ ডাকিতেছিল। এই অঞ্চলে ভয়ানক মশা। খালিগায় শোয়া-বসার উপায় নাই। নিস্তেজ ক্লান্তির ছায়ায় কল্কে টানিতে টানিতে তার চোখ বুজিয়া আসে। আশেপাশে মশা ভন্‌ভ করে। এক-একবার গামছার ঝটকা মারে আজহার, আবার ধোঁয়ার সঙ্গে মিতালি চলে।

সড়কের গাছপালায় অন্ধকার জমিয়া রহিয়াছে। শীতল রাত্রির ডাকে জোনাকিদের চোখ নিদ্রাহীন। পানা-পুকুরের ধারে এই নিরীহ পতঙ্গের দেয়ালি উৎসবে কোনো ছেদ পড়ে না।

ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে আজহার নীরবে চারিদিক অবলোকন করে। পঙ্গু মন তার নিঃসাড় হইয়া গিয়াছে। চিন্তার এলোমেলো জটাজাল অন্ধকারে হামাগুড়ি দেওয়া পর্যন্ত বিস্মৃত। কোনো কিছু মনে পড়ে না আজহার খাঁর।

নিয়ামতপুরে দুদিন ছিল সে মাত্র। কাজ জুটিয়াছিল ভালো। কয়েক সপ্তাহ কাজ চলিত স্বচ্ছন্দে। জায়গাটা খুব পছন্দসই নয়। ইতর মাতালদের আড্ডা তার ভালো লাগে নাই। এখানের অন্যান্য রাজমিস্ত্রি বড় বদ-চরিত্রের। সামান্য দুদিনের রোজগার তাঁকে খুঁজিয়া আজহার পথে পাড়ি দিয়াছিল। কাজ কোথা-ও-না কোথাও জুটিবেই, সে ভরসা ছিল তার। সড়কের পথেই নতুন ইমারতের কাঠামো দেখিয়া সে আশান্বিত বুকেই এখানে গৃহস্বামীর উমেদার হইয়াছিল। সঙ্গী মিস্ত্রিরা লোক মন্দ নয়। রোজ কম। তবু আজহার কোনো প্রতিবাদ করে নাই, সহজেই সে কাজে লাগিয়াছিল।

গ্রামের নাম শাহানপুর। দু-মাইল দূরে স্টেশন। তারই আবহাওয়ায় গ্রাম ও শহরের যৌথ লীলাভূমিরূপে জায়গা মন্দ নয়। আজহারও আকর্ষিত হইয়াছিল।

রেলস্টেশন মাত্র বছর-দুই আগে ভোলা হয়। এখনও বহু ব্যবসার ভবিষ্যৎ এই গ্রামে উঁকি মারিতেছে। কয়েকদিন অবস্থানের পর আজহার তাহা নীরবেই উপলব্ধি করিয়াছিল। যদি কোনো পুঁজি জমানো যায়! আজহার তাই কায়ক্লেশে রীতিমতো কৃচ্ছসাধন আরম্ভ করিয়াছিল।

সারাদিন খাটুনির পর আজ শরীর ভালো না, তার উপর বাসার ভেতর ভ্যাপসা গরম। সব মিলিয়া বড় অসোয়াস্তি বোধ করিতেছিল আজহার। তার কোনো স্পষ্ট চেতনা কিন্তু দাগ কাটে না কোথাও। নীরবে তাই হুঁকা পানই করিতেছিল। কয়েকবার হাই উঠিল।

আজহার খাঁ নিশ্চিন্তে বসিয়া থাকে। তামাক প্রায় নিঃশেষ। অন্যদিকে কার আওয়াজের কামাই নাই।

স্মরণের প্রান্তর নিঃশেষে মুছিয়া দিয়াছে কালো অন্ধকারের প্রলেপ। শিরার দ্রুত কম্পন রাত্রির তরঙ্গশীর্ষে ঈষৎ ঝিলিকের রেখা টানিয়া আবার শান্ত হইয়া আসে।

প্রাগৈতিহাসিক বর্বরের আলস্যমুখর অদ্ভুত বিরাম আকাক্ষা আজহার খাঁর মেরুদণ্ডে ঘা দিয়া গেল।

এইবার জোরে কল্কে ফোঁকে আজহার। তামাক-না-দারাৎ। অসন্তুষ্ট চিত্তে সে কল্কে চৌকাঠের কোণে রাখিয়া দিল।

আর এক ছিলিম পাইলে মন্দ হইত না। সে হাই তুলিল। হঠাৎ আজহার তার পাশেই আর একজনের উপস্থিতি অনুভব করে। অন্ধকারে অপরিচিত মানুষটি।

আজহার মৃদুকণ্ঠে ডাকে : কে?

আমি, চাচা।

একটি বালকের কণ্ঠস্বর অন্ধকারে ঢেউ তোলে।

খলিল, এত রাত্রে বাইরে এসেছ?

 জিজ্ঞাসা করে আজহার।

ঘুম ধরে না, চাচা।

ফোঁপানির শব্দ আসে আজহার খাঁর কানে।

খোয়ারি ভাঙিয়া যায় তার। কার কণ্ঠনালী-দুমড়ানো এই শব্দ, প্রথমে আজহার স্থির করিতে পারে না।

নিবিড় অন্ধকার। চৌকাঠের অপরদিকে আজহার হাত বাড়াইয়া দিল। খলিলের নাগাল পায় সে। হাঁটুর ভেতর মাথা খুঁজিয়া সে বসিয়া আছে। এতক্ষণ এই অবস্থায় সে ধীরে ধীরে জবাব দিতে ছিল তবে।

আজহারের সঙ্গী মিস্ত্রির নাম ছিল ওদু। তারই ভাইপো খলিল। বয়স বারো হইবে কিনা সন্দেহ। বালক-বয়সেই চাচার সঙ্গে মিস্ত্রির কাজ শেখার জন্য এই প্রবাস-জীবনের গ্লানি বহন করিতেছে।

আজহার খলিলের নিকটে সরিয়া আসিল। তার গায়ে ঈষৎ নাড়া দিয়া সরস কণ্ঠে আজহার সম্বোধন করে : কী হয়েছে, চাচা? .

খলিল মাথা তুলিতে চায় না। হাঁটুর ভেতর মাথা খুঁজিয়া যেন বিশ্বের সমস্ত কলঙ্কের নিকট হইতে পরিত্রাণ চায় সে।

কিছু হয়নি তো, চাচা?

আবার আজহার নাড়া দিয়া বলিল : মাথা তুলে কথা বলো না, কী হয়েছে?

খুব মৃদুস্বরেই আলাপ বিনিময় চলিতেছে। ঘরের ভেতর সকলে দিনমজুর। কারো ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে।

খলিল নীরব।

আজহারের কৌতূহল মিটিল না। সে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিল।

খলিল এইবার কোনো জবাব দিল না। আদুল গায়েই সে বসিয়াছিল। আজহারের হাত নিজের পিঠের উপর ধীরে রাখিয়া আবার খলিল ফোঁপাইতে লাগিল।

আজহার আঙুলের ডগায় যেন বিছা দংশন করিয়াছে। সে তড়িৎগতি খলিলের পিঠ হইতে হাত তুলিয়া লইয়া সচিৎকার জিজ্ঞাসা করে : তোমার পিঠে এত দাগ?

খলিল আজহারের মুখে হাত চাপিয়া নিদ্রিত ব্যক্তিদের দিকে তাকায়। না, কারো কানে আজহারের চিৎকার পৌঁছায় নাই।

আজহার খলিলকে বুকের কাছে টানিয়া লইল।

বারবার হাত বুলায় সে খলিলের পিঠে।

কুয়াশানিদ্রিত প্রান্তর আবার জাগিয়া উঠিতেছে। মনে পড়িল বৈকি আজহারের আমজাদের কথা, নঈমার মুখ, মহেশডাঙার জলাজাঙ্গাল। আর দরিয়াবিবি? না, আজহারের মানসপটে পরিশ্রমপটু, সংসার-অভিজ্ঞ, সুঠাম-তনু দরিয়াবিবির কোনো ছায়া ভাসিয়া উঠে না। হয়তো ভাসিয়া উঠিয়াছিল ক্ষণিক আলোর মলিন রেখায়। নিবীর্য একরকমের অস্থিরতা আজহারকে ব্যথিত করে বলিয়া সে তখন ছায়ার অন্যান্য জনতায় চিন্তার প্রহরীদের অজ্ঞাতবাসে পাঠাইল।

কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া আজহার জিজ্ঞাসা করল : কেউ মেরেছে বুঝি?

হ্যাঁ চাচা।

হঠাৎ উত্তেজিত হইয়া উঠিল আজহার।

কচি গায়ে কার এমন আজারে হাত উঠল?

খলিল কোনো জবাব দিল না। নীরবে বসিয়া রহিল।

কে মেরেছে?

আজহার অস্থিরচিত্তে জিজ্ঞাসা করিল।

খলিল অন্ধকারে চারিদিকে দৃষ্টি মেলে। তারপর আজহারের কানে কানে সে বলিল: ওদু চাচা চেলাকাঠ দিয়ে

ঢোক গিলিয়া খলিল আবার ফোঁপাইতে থাকে।

এ্যাঁ, ওদু এমন কড়া-জান?

খলিলের গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে আজহার বলিয়া যায় : কী করেছিলে তুমি যে, এমন করে হাত চালায়?

গহর মিস্ত্রির সুর্মী ভেঙে ফেলেছি। ইটের উপর পড়ে গেল কিনা।

গহর রাজমিস্ত্রি। সে-ও বাসার ভেতর নিদ্রিতের দলে। পাছে তার কানে কোনো শব্দ যায়, ধরা-গলায় খলিল জবাব দিয়া চুপ করিল।

ছোট একটা সুর্মী ভেঙেছ, তার জন্য এত মার মারলে?

ফোঁপাইয়া কান্না আরম্ভ করিল খলিল।

আড়ষ্ট উচ্চারণের মধ্যদিয়া বোঝা যায় তার আবেদন : আমি চাচার সঙ্গে বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম কিনা।

ওদু আজ বাড়ি গেছে?

 হ্যাঁ, চাচা!

আজহার সান্ত্বনা দিতে চায় ওই অবোধ বালককে।

ওদু যাক না বাড়ি। আমরা রয়েছি, তোমার কোনো ভয় নেই।

চৌকাঠের একপাশে কখন সরিয়া গিয়াছে খলিল। আবার হাঁটুর মধ্যে তার মাথা গোঁজা। বিভীষিকাময়ী পৃথিবীর অবলোকনের সাহস তার নাই।

একটু পরে ঘাড় গুঁজিয়াই খলিল জবাব দিল : আমার মন টেকে না চাচা।

ব্যাটাছেলে, কাজ-কাম না শিখলে চলবে কেন? বিদেশ তো ব্যাটাছেলেদের জন্যই। তা মন অমন এক-আধটু খারাপ করে।

নিঃসাড় হইয়া গেল খলিল। কোনো জবাব আসে না তার নিকট হইতে।

 তোমার বাপ বেঁচে আছে, চাচা?

 জিজ্ঞাসা করিল আজহার।

খলিল অন্ধকারে মাথা তোলে না। ক্লান্ত স্বর তার বাইরে আর্তনাদের মতো শোনায় না!

আবার মাথা গুঁজে বসে আছ? ভাবনা কিসের? আমরা তো রয়েছি। ওদু কাল-পরশু ফিরে আসবে।

আজহার খলিলের দিকে হাত প্রসারিত করে। খলিল ধীরে ধীরে খার পাশে সরিয়া আসিল। ক্লান্ত দুইচোখ তার সড়কের দিকে।

পরে আজহারের মুখোমুখি দৃষ্টিপাত করিয়া সে বলিল : আজ দুমাস এসেছি, চাচা। মার জন্যে মন কেমন করে-যে। ওদু-চাচা এইবার নিয়ে চারবার ঘরে গেল।

বিদেশে থাকতে শেখো। কাজ শিখলে তবে তো বড় মিস্ত্রি হবে। দুঃখ ঘুচবে। এই দ্যাখো না, আমরা দেশে চাষবাস করতাম, শহরে আসিনি। কুকুরের হাল।

কোনো আশ্বাস পায় না খলিল।

পেট-ভাতায় ছমাস কাজ শিখলে তবে নাস্তার পয়সা বেরোবে। মাকে এক পয়সাও দিতে পারিনি। নাস্তার পয়সা বেরোলে তা বাঁচিয়েও কিছু পাঠাতে পারতাম।

আজহার খাঁ বিগলিত হৃদয়ে ওই দুগ্ধপোষ্য বালকের দিকে চাহিয়া থাকে। এত অল্প বয়সে পৃথিবীর রঙ চিনিতে শিখিয়াছে সে। এমন ছেলের উন্নতি আল্লা নিশ্চয় দেবেন। নসিব খুলবে বৈকি।

পুনরায় সরব হয় আজহার : আর কটা মাস, চাচা। তারপর নাস্তার পয়সা বেরোলে তোমার মাকে টাকা পাঠিয়ো। কেন, তোমার মা কিছু করেন না?

ধান কুটে ভাত জোটাতে হয়।

কথা সমাপ্ত করিয়া বড় লজ্জিত হয় খলিল। কুটুনীর ছেলে সে, এমন পরিচয় দিতে মাথা কাটা যায়। আবেগের স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছিল খলিল।

আজহার আর কোনো জিজ্ঞাসাবাদে মত্ত হয় না। নিঝুম সেও বসিয়া থাকে। এতটুকু ছেলে মার দুঃখের সঙ্গী। তিন-চার বছর পরে আমজাদ কোথায় গিয়া দাঁড়াইবে কে জানে?

মাত্র এক পলকের জন্য আমজাদের মুখ মনে পড়িল আজহারের। চন্দ্র কোটাল তাকে স্বপ্ন দেখিতে শিখাইয়াছে। তার কুয়াশা-আবর্তিত ফেনিল পটে কারো মুখ আর স্থিতি পায় না। স্টেশনের নিকট বর্ধিষ্ণু এই গ্রামে ব্যবসা-পত্তনের অশেষ সুযোগ রহিয়াছে। খোদা কি মুখ তুলিয়া চাইবেন না একটিবার?

অজানিত ভীতির ফুকার আজহারের চিত্ত আরো অস্থির-উন্মত্ত করিয়া তোলে। তিনবার বুকে কুলহু আল্লা পড়িয়া ফুঁক দিল সে।

খলিলের ঘন ঘন হাই উঠিতে ছিল, আজহারের খেয়াল হয়। তার দিকে ফিরিয়া সে বলে : চাচা, আবার সকালে কাজে বেরোতে হবে। ঘুমিয়ে পড়ো।

তুমি ঘুমোবে না, চাচা?

অবোধ কণ্ঠের নিনাদ বড় লাগিল আজহারের কানে।

না, চাচা। আর এক ছিলিম খেয়ে শোব।

খলিল বাসার ভেতর প্রবেশ করিল। আজহার নূতন ছিলিম সাজে।

ঠাণ্ডা বাতাস বহিতে থাকে শেষরাত্রে। খণ্ড মেঘ ছড়াইয়া পড়ে গ্রাম-বনানীর উপর।

আকাশের মুখ কালো হইয়া গেল এক নিমিষে।

.

আজহার খাঁর সিদ্ধান্ত স্থির ছিল।

সপ্তা দুই পরে এই বাসার নিকটে বাসস্ট্যান্ডের নিকট সে তিন টাকা দিয়া একটি ছোট চালাঘর ভাড়া লইল। ঘরের বারান্দা দুইহাত মাত্র প্রস্থে। তারই একপাশে সঙ্গী ছুতারের সাহায্যে সে একটি শেল্ফ তৈয়ারি করিল। দোকানের ঘটা ছিল বেশি। অবশ্য মাল খুব পর্যাপ্ত নয়। আজহার কোনোরকমে গোটা পঁচিশেক টাকা জমাইয়াছিল। তিন টাকা লইল মিস্ত্রি। বাকি বাইশ টাকায় সঁচ-সুতো, মেয়েদের টিপ, স্কুলের ছেলেদের পেনসিল, লজেন্স– এই জাতীয় ছোটখাটো মনিহারী পণ্যসম্ভারে সে দোকান সাজাইল।

পানের দোকান সঙ্গে রাখিবারও ইচ্ছা ছিল আজহার খাঁর। আরো কয়েকটি পানওয়ালা পূর্বেই আসর জমাইয়া রাখিয়াছে। তবু লোভ আছে খার। ভবিষ্যতে যদি নসিবে জৌলুশ লাগে, আরো নতুন পণ্যের দোকানঘর চমকাইয়া দিবে সে।

কয়েকদিন ভয়ানক মেহনতে কাটিয়া গেল। স্টেশন হইতে চার মাইল দূরে গঞ্জের উপর গোলদারী দোকান। একজন মাড়োয়ারী খুব বড় ব্যবসা ফাদিয়াছে। তার নিকটে এইসব জিনিস পাওয়া যায়। চার-পাঁচ মাইল হাঁটার কসরৎ বাড়ে। সঙ্গী মিস্ত্রির ধরনা দিতে হয়। শত অনুরোধে সে রাত্রি-রাত্রি পরিশ্রম করিয়া শেলফ তৈয়ারি করিয়া দিয়াছে।

গহর মিস্ত্রি ব্যাপারটা সোজাভাবে গ্রহণ করিল না। আজহার চলিয়া যাইতেছে, বাসা ভাড়া বেশি লাগে। সে নিরুৎসাহ করিবার বাগ্‌অস্ত্র নিক্ষেপ করিল শত শত। একটু হিংসাও হইতেছিল বৈকি তার। গহর জানে না, পঁচিশটি টাকা জমাইতে আজহার কত নিপীড়ন সহ্য করিয়াছে। বাউণ্ডেলের মতো সংসারের কোনো খোঁজ নাই। তার উপর কায়িক জুলুম। এত সহ্যের ক্ষমতা কয়জনারই বা আছে?

গহর বলিল, মিস্ত্রি তাহলে শেষে এইখানে দোকান ফাঁদলে। দেখো, যদি পাকা বাড়ি ওঠে।

আজহার নিরীহ বেচারা। কোনো জবাব দিল না। কিন্তু কথাটা সোজাসুজি তার মর্মে বিধিতে থাকে।

কিছু করে-কষ্মে খেতে হবে তো ভাই। তাই মন গেল, একটা দোকান করলাম।

গহরের রঙ ফরসা দীর্ঘতায় তালগাছ। কিন্তু ভয়ানক পাতলা শরীর। অবশ্য বাঁধন মজবুত। দাঁতগুলি খুব পরিষ্কার। সে পান খায় না।

না, তাতে আর কী। আচ্ছা, একটা বিড়ি দাও।

আজহার সহজে রাগে না। কিন্তু গহরের কথার ঝাল সে-ও আজ অনুভব করিল।

বিড়ি নেই, ফুরিয়ে গেছে।

মিথ্যা কথা বলিতে বাধে না আজহারের।

উঠিয়া পড়িল গহর।

চালাও দোকান, যদি পাকা বাড়ি ওঠে। একসঙ্গে কাজ করেছি বলে একদিন এসে থাকা যাবে।

গহরের পদক্ষেপের দিকে চোখ ফেলিয়া স্তব্ধ হইয়া যায় আজহার। মনে মনে বলিল, আমার মতো হাভাতে গরিবকেও হিংসা করার লোক আছে পৃথিবীতে।

লজেঞ্চুসের বোতলের পাশে পিঁপড়া উঠিতেছিল, আজহার সেদিকে মনোনিবেশ করিল।

একটু পরে আসিল খলিল। ভারি উৎফুল্ল সে।

চাচা, আপনার দোকাটা বেশ সুন্দর হয়েছে। যখন তোক রাখবে, আমাকে মনে করো।

আজহার স্তিমিত হাসি হাসে।

দোয়া করো, বাবা। আল্লার দোয়া লাগতে কতক্ষণ।

অনেক সামগ্রী খলিল কোনোদিন গাঁয়ে দেখে নাই। সে বিস্মিত-চোখে চারদিকে তাকায়।

চাচা, একা লোক আমি। গোসল করতে গেলে দোকান বন্ধ করতে হয়। তুমি মাঝে মাঝে এসে বসো।

হ্যাঁ, বসব চাচা। বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। ওদু চাচা এবার নিয়ে যাবে বলেছে।

বেশ, বেশ।

 দাওয়ার একপাশে খলিল উপবেশন করিল।

পাশাপাশি সাজানো শিশি-বোতলের দিকে সে সাগ্রহে দৃষ্টিপাত করিতে থাকে।

আনমনা লজেঞ্চুসের বোতল হাতে তুলিয়া খলিল নাড়াচাড়া করে।

এতে কী আছে, চাচা?

লজেঞ্চুস।

খেতে কেমন লাগে?

খুব মিষ্টি। একটার দাম দুপয়সা।

আজহারের কথা শেষ হওয়ামাত্র খলিল বোতল শেফের কোণে রাখিয়া দিল। তার হাতে শতরাজ্যের আড়ষ্টতা।

আজহার তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল। দোকানদার সে। দোকান খুলিয়াছে। একটু ইতস্তত করিয়া সে বলে : একটা খাও না, চাচা।

লজ্জিত খলিল জবাব দিল : না।

আজহার আর বিলম্ব করে না। নিজেই দুটি মিষ্টান্ন বাহির করিয়া খলিলের হাতে দিল। আড়ষ্টতা কাটে না খলিলের : না চাচা, আমি মিষ্টি খাই না। আমার কাছে পয়সা নেই।

খাও। খেয়ে ফেলো ব্যাটা।

 তোমার দোকান চলবে কী করে?

 এতটুকু ছেলে, সংসারের মারপ্যাঁচ এত বোঝে। অবাক হইয়া যায় আজহার খাঁ।

হাসিমুখে মিষ্টি খায় খলিল।

 তুমি একটু বসো, আমি মাগরেবের নামাজ পড়ে আসি।

খলিল হঠাৎ কর্তা বনিয়া যায়। গম্ভীরমুখে সে বসিয়া থাকে। খরিদ্দারের সঙ্গে। আলাপ করে। খুব হাসি পায় তার। এমন একটা দোকান যদি দিতে পারত সে।

আজহার ফিরিয়া আসিলে সে সড়কের পথ ধরিল।

ছোট ডিপা জ্বলে দোকানের এককোণে। দেখা যায় খলিল পথ হাঁটিতেছে। পার্শ্ববর্তী গাছপালার ছায়ায় ঢাকা সড়ক।

এতটুকু ছেলে।

আমজাদ কি অভিমান করিয়া মহেশডাঙায় ফিরিয়া যাইতেছে?

.

১০.

শৈরমী পাড়ায় কলমিশাক বিক্রয় করিয়া দরিয়াবৌর সঙ্গে গল্প জুড়িয়াছিল। গণেশের শরীর ভালো নয়। কয়েকদিন পূর্বে দাওয়া হইতে পড়িয়া গিয়াছিল। পঙ্গু বামহাত একদম অচল হইয়া গিয়াছে। শৈরমীর সামান্য অবসর পর্যন্ত নাই।

দরিয়াবিবি দরদের সঙ্গেই এই বিধবার করুণ প্রাত্যহিকতার কাহিনী শুনিতেছিল। আজকাল বারবার তারও মনে দোলা লাগে, এই জীবনের পরিণতি কোথায় পৌঁছিবে, কে জানে। আমজাদ ও নঈমার মুখের দিকে চাহিয়া দরিয়াবৌর মুখ শুকাইয়া যায়। আজহার খাঁ কোনো খবর দেয় না, কয়েক মাস হইয়া গেল।

সাকেরের মা আসিয়া জুটিল এই সময়। দরিয়াবৌ একটি পিঁড়া আগাইয়া দিল।

বৌ যে আমাদের দিকে পা বাড়াও না, মা।

দরিয়াবিবি এক সপ্তাহ সাকেরের বাড়ি যায় নাই। লজ্জিত হয় সে।

কত কাজ, দেখছেন না, মা। ফুরসৎ নেই, মা।

বৌ নিয়ে হাঁড়-মাংস পুড়ে ছাই হতে বসেছে।

শৈরমী এই প্রসঙ্গে যোগদান করিল : কী হয়েছে?

দিন মাস পার হয়ে গেল, এখনও খালাস হওয়ার নাম নাই। কবরেজ ডাকব, বৌর তাতেও দশ অছিলা।

দরিয়াবৌ সন্দেহ প্রকাশ করে : দশ মাস হয়ে গেছে! না মা, তোমাদের হিসেবে ভুল আছে।

সাকেরের মা জোর দিয়া বলিল : না, দশমাসের বেশি হবে তো কম নয়।

শৈরমী জবাব দিল : ভাবী, অনেকের এগারো মাস লেগে যায়।

দরিয়াবিবি মুখে আঁচল চাপা দিয়া হাসিতে লাগিল।

এগার মাস কেন, আঠার মা লাগে।

সাকেরের মার মুখ কালো হইয়া যায়।–কি হাসছো বৌ, আমার পেটে ভাত সেঁধোয় না। ছেলেটা দিনদিন বিগড়ে যাচ্ছে। দাঙ্গা করতে কোথায় চলে যায়। ছেলের মুখ দেখলে হয়ত ঠাণ্ডা হোত।

ও ব্যাটাছেলেদের দস্তুর। তোমার ভাসুরপোর কোনো খোঁজ নেই। একদিন ঝুপ করে এসে পড়বে। কী আর উপায় আছে, বলো।

শৈরমী ভরসা দিল : ঘাবড়ে যেও না, সাকেরের মা। ভগবান সুফল দিয়েছে নিশ্চয়।

তোমার মুখে সুবন (সুবর্ণ) বষুক, শৈরমী। আমার ঘুম হয় না চিন্তায়।

দরিয়াবিবি শৈরমীর দেওয়া কলমিশাক বাছিতে বাছিতে কথা বলিয়া যায়।

হাসুবৌকে বিকেলে দেখে আসব।

এসো একবার!

আবার সাকেরের মা বলিল : বৌটার মনের হদিশ পাওয়া মুশকিল। ছেলে-ছেলে করে গেল। আজকাল আর আমাকে ছাড়া কোথাও শোয় না। ছেলেটা এইজন্যেই বুঝি আরো বিগড়েছে। আমিও ভাবি অয়লা-পয়লা বার এবার। পাছে কোনো কষ্ট না হয়। বৌটা গোসল পর্যন্ত করে না, পাছে জ্বর হয়।

হাসুবৌর উদরস্ফীতির আয়তন সম্পর্কে দরিয়াবিবি প্রশ্ন উত্থাপন করিল।

দশ-মেসে পোয়াতির মতো, বৌমা। সদাই হাইফাই করছে। হাসুবৌ বলে, তার পেটে খুব ব্যথা। তাই হাত পর্যন্ত দিতে দেয় না। একবার দাইকে ডেকে পাঠালাম। পেটে আঙুল পর্যন্ত ছোঁয়াতে দিলে না।

সুফল দিয়েছে, চাচি। তুমি দেখো। হয়-নয় শৈরমী বাদিনী বলেছিল। গণেশের মা মন্তব্য করে। বৃদ্ধা বিশেষ আশ্বস্ত হয় না। বরং দরিয়াবিবি যেন একবার পাড়া-ভ্রমণে বাহির হয়, তার অনুরোধ জানাইল সে।

আজ হাতে অনেক কাজ আছে, মা। কাল বিকেলে ঠিক গিয়ে তোমার বৌর রোগ ধরে আসব।

শৈরমী আফসোস করিতে লাগিল : কলিকাল, দরিয়াভাবী মানুষের খারাবির শেষ নেই।

দরিয়াবিবি মুখ নিচু করিয়া শাক বাছিতে লাগিল। সে নিজের চিন্তায় মশগুল ছিল।

সাকের ভাই এলে একবার পাঠিয়ে দিয়ে। তার ভাইয়ের খোঁজখবর নিয়ে দেখুক। মনে করি চুপচাপ বসে থাকব। আর ওসব নিয়ে মাথা ঘামাব না।

এমনও লোক হয় সংসারে! ছেলেপুলের মায়া পর্যন্ত নেই।

শৈরমী তোপড়া গালে হাত রাখিয়া দরিয়াবিবির দিকে চাহিয়া রহিল। এই সহানুভূতি ভালো লাগে না দরিয়াবিবির। মেজাজ তার রুক্ষ হইয়া উঠিতেছে হঠাৎ।

একবার এসো, বৌমা।

সাকেরের মা চলিয়া গেল। শৈরমী এইবার ফিসফিস কণ্ঠে বলে : ভাবী, আধখান পচা সুপুরি দেবে, আজকাল গা মাটি-মাটি লাগে, ভাত খেয়ে কিছু মুখে দিতে পাইনে।

দরিয়াবিবি ঘরের ভিতর হইতে শুধু সুপুরি নয়, তেলের বোতলও বাহির করিয়া আনিল।

শৈরমী দিদি, মাথায় একটু তেল দিয়ে যাও।

শৈরমী তার রেখাঙ্কিত করতালু প্রসারিত করিল।

মাথায় তেল ঘষিতে ঘষিতে সে বলিয়া যায় : ভাবী, এই পাড়ায় এলে একটু মন ঠাণ্ডা হয়। কোঠা-বাড়িওয়ালা বামুনদের ওখানে গিয়ে দূর-ছি ছাড়া অন্য কথা শুনিনে। কপাল ধরিয়ে এসেছিলাম ভগবানের কাছে। ছেলেটার সুদ্ধ ভগবান হাত-পা ভেঙে ফেলে রাখলে।

দরিয়াবিবি জবাব দিল : সব জেতে (জাতিতে) ঐ এক ব্যাপার। রহিম বখশ জমিদার বলে সেবার তোমার দাদাকে কত অপমান করে গেল শুনেছিলে তো? গরিব হিদু আর মুসলমান নিজের জেতের কাছেই হোক আর অপরের জেতের কাছেই হোক, একই রকম মান-মজ্জিদে পায়।

আচ্ছা ভাবী, আমার মাথার কিরে–দাদার কোনো খবর পাওনি? তবে চুপচাপ বসে আছ?

আর খবরের কোনো দরকার নেই।

 ক্ষুব্ধ কণ্ঠে দরিয়াবিবি জবাব দিতেছিল।

শৈরমী চুপ করিয়া গেল। আঁচলে আধখানা সুপুরি বাঁধিয়া উঠিয়া পড়িল।

জাওলা পাঁকাল মাছ পেলে নিয়ে এসো, শৈরমী দিদি, ছেলেটার পেট গরম রেখেছে।

 শৈরমী এইবার হাসিয়া উঠিল।

 আমাকে পাগলী ঠাওরালে, ভাবী!

দরিয়াবিবি লজ্জায় মুখ নিচু করে। ঘড়া প্রসঙ্গে তার মর্যাদা কোথায় যেন আহত হইয়াছে।

না। তবে এমনি বলে রাখা ভালো।

শৈরমী আড়াল হইলে দরিয়াবিবি ঝরঝর কাঁদিয়া ফেলিল। চোখের পানি স্বতই রোধ মানে না। প্রাঙ্গণের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া আবার তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া ফেলিল দরিয়াবিবি। আসেকজান পাড়ায় বাহির হইয়া গিয়াছে। কথাবলার কোনো লোক আর নাই। দরিয়াবিবি শাক বাছিতে লাগিল।

আমজাদের ডাক কানে না গেলে হয়তো দরিয়াবিবি সারাদিন শাক লইয়া বসিয়া থাকিত। আনমনা ঘোর তার কাটিয়া যায়।

মা, এই দ্যাখো, আব্বা চিঠি আর কুড়ি টাকা পাঠিয়েছে।

আনন্দে যেন নৃত্য করিতে পাইলে আমজাদ সন্তুষ্ট হইত। বগলে মতবের দপ্তর, একহাতে টাকা আর মনিঅর্ডারের কুপনের অংশ। দশদিন মাত্র আমজাদ চন্দ্র কোটালের সহযোগীরূপে কাজ করিয়াছিল। দরিয়াবিবির আদেশেই আমজাদ এখন মvতবের পড়ুয়া।

দরিয়াবিবির দুই চোখ বিস্ময়ে ভরিয়া যায়।

সত্যি টাকা পাঠিয়েছে, কে দিল তোকে টাকা?

পিয়ন এসেছিল। আমার নামে আব্ব টাকা পাঠিয়েছে। আমার টিপসই নিল পিয়ন।

দরিয়াবিবি উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল। নোট দুটি পুত্রের হাত হইতে লইয়া সে নাড়াচাড়া করে।

 ঠিকানা দিয়েছে?

হ্যাঁ গো মা, এই তো লেখা রয়েছে।

আমজাদ জননীকে কুপনের অংশ দেখাইল, যেন মার অক্ষরজ্ঞান কত গভীর। দরিয়াবিবি কুপন হাতে লইয়া চক্ষুর দৃষ্টি সহজ করিল। অক্ষর-পরিচয়ের মূল্য তার নিকট এই প্রথম কঠিন সত্যরূপে ধরা দিল।

নঈমা কখন চুপিসারে দুইজনের কথাবার্তা শুনিতেছিল, সে ফুট কাটিল, মা, টাকা দিয়েছে, চিঠি দিয়েছে।

দরিয়াবিবি নঈমাকে কোলে তুলিয়া চুম্বন করিতে লাগিল।

হ্যাঁ। তোমাকে ময়রার দোকান থেকে মিঠাই কিনে দেব।

আমজাদ মুরুব্বির মতো মন্তব্য করিল : এই তো কমাস পরে মোটে কুড়িটা টাকা। তার চেয়ে গায়ে থেকে জন খাটলে লাভ। জানো মা, আমাদের জমি ছাড়িয়ে নিতে পারে। আব্বা এসে চাষ না দিলে লোকে জমি রাখে?

পুত্রের সংসার-অভিজ্ঞ সিদ্ধান্ত দরিয়াবিবির কাছে ভালো লাগে না, যদিও সে মায়ের কথার প্রতিধ্বনি করিতেছিল।

তুমি আর অত ফফর-দালালি করো না। যা করার আমি দেখে নেব।

আমার মাইনে দু-মাসের বাকি আছে। গম্ভীর হইয়া আমজাদ জবাব দিল।

নূতন নোটের গন্ধ শুকিতে লাগিল দরিয়াবিবি। বাইরে দুপুরের সূর্য টলমল করিতেছিল। বাস্তুর নিচে তেঁতুলের বন অলস সমীরে উল্লসিত।

নোট আঁচলে বাধিয়া দুটি খুচরা পয়সা দরিয়াবিবি আমজাদের হাতে দিয়া বলিল, দোকান থেকে দুজনে বিস্কুট কিনে খা।

নঈমা মার কোল হইতে নামিয়া পড়িল।

আসেকজান পাড়া হইতে ফিরিয়া আসিল। চৌধুরীপাড়ার কার যেন ফাতেহা ছিল আজ। আসেকজান খালিহাতে ফিরিয়া আসে নাই, তার আঁচলের নিচে অবস্থিত পুঁটুলি দেখিয়া তা বোঝা যায়।

বৌমা, তোমাদের রান্নার আগেই এসেছি। ছেলেরা আমার সঙ্গে খাবে। অনেক গোস্ত আর ভাত আছে।

না, আমাদের রান্না হবে এখনি।

খামাখা চাল নষ্ট করবে, মা।

নঈমা তখন চিৎকার করে বুড়ির আঁচল ধরিয়া।

ও দাদি, বাবাজি টাকা পাঠিয়েছে।

বৃদ্ধার চোখ আনন্দে সজল হইয়া ওঠে।

সত্যি বৌমা, খবর পাওয়া গেছে ছেলের?

হ্যাঁ, খালা। টাকাও দিয়েছে।

আমজাদ বৃদ্ধাকে আশ্বাস দিয়া বলিল, ঠিকানা পাওয়া গেছে। আমি একদিন যাব বাপজির কাছে।

দরিয়াবিবি কথা-কাটাকাটি পছন্দ করে না, আসেকজান আনন্দবিহ্বলতায় বিস্মৃত হইয়াছিল।

বৌমা, ছেলেরা আমার সঙ্গে খাবে দুপুরে।

না। দোকানে যা আমজাদ। নঈমা, তুইও সঙ্গে যা।

বৃদ্ধা ক্ষুণ্ণমনে নিজের ঝুপড়ির দিকে অগ্রসর হইল। মনে মনে রাগিয়াছিল। আজ টাকার লোক, সাকার, খাবারে এত ঘৃণা, ইশ। বৌমার রোখৃ সে জানে। সহজেই নীরব হইয়া গেল বৃদ্ধা।

দরিয়াবিবি আসেকজানের গমনপথের দিকে চাহিয়া বারবার ভ্রকুটি নিক্ষেপ করিল।

.

কয়েক মাস পূর্বে নঈমার একটি ফালি কাপড় হারাইয়া গিয়াছিল। দরিয়াবিবি বেদম প্রহার করিয়াছিল সেদিন নঈমাকে।

সেদিন সন্ধ্যায় আবার সে একটি কাপড় হারাইয়া বাড়ি ফিরিল। দরিয়াবিবি আজ কিছুই উচ্চবাচ্য করিল না। একে সংসারে হাজার রকমের টানাটানি, তার উপর এইসব ঝামেলা পোহাইতে দরিয়াবিবি হিমসিম খাইয়া যায়। মাঝে মাঝে অগত্যা ললাটলিপির উপর সমস্ত ক্রোধ খারিজ করিতে হয়।

সাকেরের মার অনুরোধে পরদিন বিকালবেলা দরিয়াবিবি অবসরের ফাঁকে পাড়া বেড়াইতে গিয়াছিল। সাকের কয়েকদিন হইতে বাড়িতেই আছে। রোহিনী চৌধুরী বোধহয় প্রজা ঢিট করিয়া ক্ষান্ত হইয়াছেন।

পাড়ার প্রবেশপথেই তার সঙ্গে দরিয়াবিবির সাক্ষাৎ হইল।

এই যে ভাবী সাহেব, হঠাৎ।

সাকের গোঁয়ার ও চোয়াড় বলিয়া খ্যাত। দরিয়াবিবির সঙ্গে তার ব্যবহার ভারি মধুর। চোখাচোখি দরিয়াবিবির দিকে চাহিয়া সে কথা বলে না পর্যন্ত। কণ্ঠস্বর তার সম্মুখে নরম হইয়া আসে। অথচ বিনয় সাকেরের স্বভাববিরুদ্ধ বিশ্লেষণ।

দরিয়াবিবি মাথার শ্লথ ঘোমটা টানিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি সাকের ভাই। মাথাভাঙা কাজ নেই বুঝি এখন, তাই দেখা হয়ে গেল।

আপনিও লজ্জা দেন ভাবী! লাঠি যখন চালাই, মাথা ভাঙে বৈকি। কিছু করে খেতে হবে তো। চুপচাপ বসে থাকলে কেউ চালডাল যোগাবে?

তোমার বড়ভাই চুপচাপ বসে নেই! সফরে বেরিয়েছে, দেখি কত মালমাত্তা নিয়ে ফেরে।

সাকের বিস্মিত-উল্লাসে জিজ্ঞাসা করে, বড়ভাইয়ের খবর পাওয়া গেছে?

হ্যাঁ। কোথা জাহানপুর, সেখানে আছে।

মাশায়াল্লাহ। এমন লোক, ডুব দিয়ে এতদিন কাটিয়ে দিলে।

তার ঘরে চাল-ডাল যোগানো আছে, ভাই। সে প্যাকল মাছ সেজে বসে না থাকলে আর কে থাকবে।

সাকের হো হো শব্দে হাসিয়া উঠিল।

গুণধর ভাইয়ের কাণ্ড দেখে হাসি পায় সকলের।

দরিয়াবিবি ঠোঁট দাঁতে চাপিয়া জবাব দিল।

ভাবী সাহেব, চটে গেলেন। মরদ মানুষদের আপনারা ঐরকম ভাবেন। চাল-ডাল জোটাতে তারা কম চেষ্টা করে না। চাল-ডাল না থাকলে তো মুখ বেঁকে নদীর চড়া হয়ে যায়। তাই মাথা ভাঙি, না মাথা পেতে দিই— এসব দেখবার কি সময় আছে। বড়ভাইকে খামাখা দোষেন।

দরিয়াবিবি হাসি মুখে বলিয়া যায় : তুমি ভাই বেড়াতে বেড়িয়েছ। যাও। আমি মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসি। বড়ভাইয়ের হয়ে আর ওকালতির দরকার নেই।

জো হুকুম ভাবী সাহেব। কুর্নিশের ভঙ্গিতে সাকের কিছুক্ষণ পিছু হটিয়া অন্য পথে আড়াল হইয়া গেল।

দরিয়াবিবির হাস্যধ্বনি পাড়ার ঘুলি-পথে গুঞ্জরিত হয়। একটু দূরেই সাকেরের উঠান আর লাউ মাচাঙের প্রাঙ্গণ।

সাকেরের মা হাসির শব্দ শুনিয়া কৌতূহলবশত এইদিকে অগ্রসর হইয়াছিল।

দরিয়াবিবিকে দেখিয়া সে আনন্দিত হয়। তুমি, বৌমা! হঠাৎ রাস্তায় এমন হাসছ?

সাকের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। সে কোনো দোষ গায়ে মাখে না। বড়ভাইয়ের মতোই। আমাকে জবাব দিল, ঘাড় না ভাঙলে কেউ খেতে দেবে? সাধে কি আর লাঠি ধরি!

ওর কথা ছাড়ো, মা। কান ঝালাপালা হয়ে গেল ওই এক কথা শুনে-শুনে। এসো, মা।

হাসুবৌ শাশুড়ির গলা শুনিয়া মাচাঙের নিচে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। বড় শীর্ণ হইয়া গিয়াছে তার শরীর। মুখ পাংশু। চোখের কোণে রক্তিমতা আছে কিনা সন্দেহ। চোখদুটি সদ্য-আরোগ্য রোগীর মতো ভাসা ও বিষণ্ণতাক্লিষ্ট।

শাশুড়ী হাসুবৌকে দেখিয়া জ্বলিয়া উঠিল।

ওই যে অভাগীর বেটি, দাঁড়িয়ে আছে। ছেলে কি আর আল্লা দেবে। সাকের না। হলে আমাদের এত জ্বালাবে কেন?

হাসুবৌ কোনো জবাব দিল না। ক্লান্ত দুই চোখ মাটির সমতলে কী যেন খুঁজিতে লাগিল।

খামাখা রাগ করো কেন, চাচি। এমন কচি বয়স, ছেলেমানুষ। পোয়াতিকে এমন ফজিয়ৎ করলে রোগে পড়বে যে।

রোগটা নেই কোনখানে?

দরিয়াবিবি হাসুবৌর নিকট অগ্রসর হইবামাত্র আতঙ্কিত চোখে সে একটু সরিয়া দাঁড়াইল।

হাসু। দরিয়াবিবির ডাক।

জি, বড়বুবু।

তোমার শরীর ভালো তো আজকাল?

না। সংক্ষিপ্ত নম্র উত্তর।

কদিনে এমন হয়ে গেছ।

 দরিয়াবিবি পুনরায় প্রশ্ন করিল, তুমি দিনের হিসেব রেখেছিলে?

লজ্জায় হাসুবৌ চোখ নামাইল।

এগারো মাস হোয়ে গেল। পেটে ব্যথা করে খুব নাকি?

 জি।

 দেখি একবার।

জি না, থাক্।

দরিয়াবিবি সাকেরের মার দিকে ফিরিয়া প্রশ্ন করিল : চাচি, তুমি পেটে হাত দিয়ে দেখোনি ছেলে নড়ে কিনা? মরা ছেলে পেটে থাকলে, শেষে পোয়াতি নিয়ে ভারি টানাটানি হবে।

আমাকে ছুঁতে দেয় না, মা।

হাসুবৌ ঘরের দিকে চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল, কোথা যাস্ হাসু?

পিয়াস লেগেছে, বড়বুবু।

পানি খেয়ে শিগ্‌গির আয়। শাশুড়ি আদেশ দিল। দরিয়াবৌ বিজ্ঞের মতো সায় দিতে লাগিল সাকেরের মার মন্তব্যের উপর।

বুড়ো বয়সে সংসারের ঝনঝাট ভাল লাগে না, মা। কোথা নামাজের পাটিতে বসে আল্লা-আল্লা করব, ওদের জন্য দোওয়া মাঙব; না, তা আর হবে না। এইসব ঝামেলা এই বয়সে পোষায়?

দরিয়াবিবির সহানুভূতি প্রকাশ পায় অন্যরূপে।

তা কী করবে চাচি। এইটুকু হাবাগোবা মেয়ে, তুমি না দেখলে সংসার চলে?

হাসুবৌ ঘর হইতে আর বাহির হয় না। বাহিরে দুইজন অপেক্ষা করিতে লাগিল। অবশ্য তাহাদের সময় অন্য কথাবার্তায় কাটিতে থাকে।

তুমি একটু দেখে যাও, মা। সত্যি পেটে যদি মরা ছেলে থাকে, মুশকিল।

তোমার বৌকে ডাকো, চাচি।

শাশুড়ির ডাকে হাসুবৌ আবার মাচাঙের নিচে দাঁড়াইল।

অবেলার অন্ধকার আসন পাতিয়াছে লাউ-মাচার সরস মাটির উপর। কয়েকটি চড়ুই নীলপাতার বনে কিচিরমিচির করিতেছিল।

হাসুবৌ অবনত মুখে ফোঁপাইয়া ফোপাইয়া কাঁদিতেছিল।

দরিয়াবিবি তার শীর্ণ হাত নিজের করতালুর উপর রাখিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিতে লাগিল : হাসু, কান্না কিসের! আমিও মেয়েমানুষ, তোর দুঃখ বুঝি। স্বামী বাউণ্ডেলে হলে কোনো মেয়েই সুখী হয় না।

সাকেরের মা দরিয়াবিবির সান্ত্বনা গ্রহণ করিল না।

মা, বাঁজা মেয়ে, কবছর বিয়ে হল, একটা ছেলে হলে সাকেরের চালচলন বদলে যেত।

দরিয়াবিবি হাসুবৌর রক্তশূন্য আঙুলের দিকে চাহিয়া কহিল : আমারও দুটো ছেলে, চাচি। কৈ, তোমার ভাসুরপোর বাউণ্ডেলগিরি গেল? আর জোয়ান ছেলের এমন কচিবৌ করেছিলে কেন?

শাশুড়ি কোনো জবাব দিল না।

হাসু, তোমার পেটটা একটু দেখি। যদি কপাল তোর ভাঙে, ছেলেটা পেটেই মরে থাকে, তাকে বাঁচাতে হবে তো।

আরো জোর কান্নার সঙ্গেই জবাব দিল হাসুবৌ।–আমাকে মরতে দাও বুবু। আমি সকলের গলার কাঁটা। আমি গোরস্তানে গেলেই ভালো।

দরিয়াবিবি তার চিবুকে হাত দিয়া বলিল : মুখে যা-তা কথা আনিসূনে। দুসাঁঝ এক। দেখি তোর পেট।

তোমার পায়ে পড়ি, দরিয়া বুবু, তোমার পায়ে পড়ি।

তীব্র ক্রন্দনের উচ্ছ্বাসে হাসুবৌর গলা বুজিয়া আসিতেছিল। দুই হাত প্রসারিত করিয়া সে নিজের কক্ষপট আবৃত করিল, চিলের নখর হইতে যেন বিহঙ্গিনী শাবক রক্ষা করিতেছে।

একটুও লাগবে না। একবার দেখব।

হাসুবৌ আরো পিছাইয়া যাইতেছিল।

দরিয়াবৌ ক্ষিপ্রগতিতে তার জঠরের কাপড় তুলিয়া একটান দিল।

এ কী! একরাশ বস্ত্রখণ্ডের ঢিবি যেন ধসিয়া পড়িতেছে। একটু জোর টানের সঙ্গেই। একগাদা ফালি ছেঁড়া টুকরো কাপড় হাসুবৌর স্ফীত জঠরদেশ হইতে নামিয়া আসিল। নঈমার ফালি, লাল গামছা, আরো পাড়ার অপহৃত অনেক শিশুর কাপড় তার ভেতর।

এক নিমিষে মাচাঙের নিচে মূৰ্ছিত হইয়া হাসুবৌ পড়িয়া গেল। স্বাভাবিক তার জঠরদেশ–স্ফীতির কোনো চিহ্ন নাই সেখানে।

কাপড়ের স্তূপের সম্মুখে ফ্যালফ্যাল নেত্রে হতভম্বের মতো দাঁড়াইয়া রহিল সাকেরের মা ও দরিয়াবিবি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *