রাসের মেলা

রাসের মেলা

আজ রাস পূর্ণিমা। রাসের মেলা বসেছে শহরতলির খালধারের এই রাস্তা আর দু-পাশে যেখানে যেটুকু ফাঁকা ঠাঁই আছে তাই জুড়ে। নামকরা মস্ত মেলা, প্রতিবছর হয়। দোকানপাট বসে অনেক, দূর থেকে বহু লোক আসে কেনাবেচা করতে, অনেকে সারা বছরের দরকারি মাদুর পাটি বঁটি-দা হাতা খুন্তি ঝুড়ি ধামা কুলো ঝাঁটা গেলাস বাটি থালা কেনে এই মেলাতে। মনোহারি কাজের জিনিস ও শখের জিনিস, জামাকাপড়, খেলনা পুতুল, খাবারদাবার এসব যতই কেনাবেচা হোক আসলে গেঁয়ো কারিগরের তৈরি গেরস্তের ওইসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের কেনাবেচাটাই মেলার বৈশিষ্ট্য। পাশে ফাঁপতে পারে না, রাস্তা চওড়া কম, একপাশে নর্দমার খাতটা আরো সংকীর্ণ করেছে রাস্তাটাকে মেলা তাই লম্বায় বড় হয়। হরদম লরিগাড়ির চলনে এবড়োখেবড়ো বড় রাস্তাটা খাল ডিঙিয়েছে কংক্রিটের পুলে উঠে। পুলের খানিক এদিকে ডাইনে গেছে মেলার রাস্তা খালের সঙ্গে সমান্তরালভাবে আধমাইল দূরে রেললাইনের তল দিয়ে উত্তরমুখে সোজা। মেলা বসে রাস্তার এ-মাথা থেকে রেলের পুল ছাড়িয়ে আরো প্রায় পোয়া মাইল দূর তক। মেলা সবচেয়ে জমাট হয় মাঝামাঝি স্থানে, সেখানে ওদিকে আছে রাস্তা থেকে খাল পর্যন্ত অনেকটা ফাঁকা জায়গা, আর এদিকে আছে পাশের রাস্তাটার ফাপালো মোড়। ফাঁকা জায়গায় থাকে নাগরদোলা, পুতুলনাচ আর সার্কাস, মজার খেলা ও নাচগানের তাঁবু! লোক গিজগিজ করে এখানে।

রাস্তা আর খালের মধ্যে টিন-ছাওয়া ছোটবড় গোলা ও আড়ত, মাঝে মাঝে দু-একটি জরাজীর্ণ পুরনো দালান। এখানে যে লাখ লাখ টাকার কারবার চলে, ভাটার সময় খালের কাদা ঠেলে সালতি ছাড়া ছোট নৌকা চলতে না পারলেও এও। বন্দরতুল্য, দেখে তা মনে হয় না–ঠাকুরদাদার জীবদ্দশার শৈথিল্য যেন শুধু মরচে পড়ে মরছে এখানে, আর কিছু নয়! এ পাশের দোকান ও বাড়িঘরগুলো অনেক উন্নত, যেহেতু আধুনিক।

লড়াইয়ের আঁধার বছরগুলোতে মেলা জমেনি। আলো না জ্বালাতে পারলে কি মেলা জমে, দিনে দিনে পাততাড়ি গুটোতে হলে। এ বছর শুধু ওই সাঁঝের বাতি না জ্বালাবার হুকুমটা বাতিল হতেই মেলা জীবন্ত হয়েছে আশ্চর্যরকম। সবাই যেন হা করে অপেক্ষা করছিল লড়াই শেষ হবার জন্য যতটা নয়, লড়াই শেষ হলে সাঁঝবাতি জ্বালিয়ে জাঁকজমকের সঙ্গে মেলা করার জন্য। গায়ে গায়ে ঘেঁসে দোকান বসেছে। তিন পো মাইল রাস্তার যেখানে ঠাঁই মিলিছে সেখানে, ভদ্রলোকের বাড়ির সামনের এক হাত চওড়া রোয়াকটুকু পর্যন্ত ভাড়া নিয়ে। চৌকি পেতে, কাঠের তক্তায় কিংবা স্রেফ বাঁশ দিয়ে মঞ্চ বেঁধে, চাচের বেড়া ও হোগলার চালা তুলে হয়েছে কোনো। দোকান, কারো ছাউনি একখানি কুড়িয়ে আনার মতো মরচে-পড়া ঢেউটিনের, কারো দুখানা রিজেক্ট পিপে, কেটেকুটে হাতুড়ি পিটে সোজা-করা ছাদ, কারো ভোলা। আকাশের নিচে ড্যাম রোদবিষ্টি ড্যাম ফ্যাশনের দোকান–যেন পটারি কারখানার নলভাঙা কেটলি, চটলা-ওঠা হাতলহীন কাপ ইত্যাদির দোকান-দোকানটাই যেন ঘোষণা যে বড়লোক বাবুদের জিনিস, একটু খুঁতওলা জিনিস, তাতে আর কী হয়েছে, এখানে কিনতে পাবে এমন সস্তায় তোমার পয়সায় কুলোয়, এ সুযোগ ছেড়ো না, টিনের মগে চা না খেয়ে বাবুরা যে কাপে খান সেই কাপে, শুধু একটু চটলা-ওঠা হাতলহীন কাপে, চা খাও! আর সত্যি কথা, কাপ-কেটলির দোকানে কী ভিড় মেয়েপুরুষের, চা খাওয়া যাদের নমাসে মাসে সর্দিকাশির ওষুধ হিসেবে, বিয়োনি মেয়ের ব্যথার জোর বাড়িয়ে তাকে রেহাই দেবার টোটকা হিসাবে।

.

খাদু বলে, মেলা নাকি? মেলা? মেলায় তো যামু তবে আইজ!

দত্তগিন্নির গা জ্বলে যায় শুনে,প্রায় দেড় বছর কাজ করছে যে মনমরা খাটুনে ভালো ঝিটা হঠাৎ মেলার নাম শুনেই তাকে আহ্বাদে উল্লাসে ডগমগিয়ে উঠতে দেখে।

মুখ ভার করে বলে, খাদু, কী করে মেলায় যাবি আজ? আমার শরীর ভালো না। উনি আজ একটায় আসবেন, খেয়েদেয়ে উঠে আমায় একটু না পেলে, খোকা। গোলমাল করলে–

দত্তগিনি হেসে ফেলে, বুঝছিস তো খাদু? হপ্তায় একটা দিন দুপুরের ছুটি, তা-ও আধখানা। খোকা কাদাকাটা করলে বড় রাগেন। উনি বিকেলে বেরোবার আগে তো মেলায় তোর যাওয়া হয় না।

অ মা! খাদু বলে অবাক হয়ে, তা ক্যান যামু? বেলা না পড়লেনি কেউ মেলায় যায়!

মেলায় যাবার নামেই যেন বদলে গেছে খাদু। দুর্ভিক্ষের বন্যায় কুটোর মতো ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকেছে এই শহরে বাবুদের বাড়ি ঝিগিরিতে। কোথায় দেশ গা আপনজন, জানাচেনা অবস্থায় অভ্যাসের ধাচে দিন কাটানোর সুখ আর কোথায় এই বিদেশে খাপছাড়া না-বনা মানুষের ঘরে দাসীপনা, এই দুঃখে সে একেবারে মিইয়ে ছিল। আজ যেন ডাক দিয়েছে আগের জীবন, ছেলেমানুষি ফুর্তি আর। উত্তেজনা জেগেছে। চুলে ভালো করে তেল মেখে স্নান করে খাদু। দত্তগিন্নির সাবানটা একফাঁকে মুখে হাতে ঘষে নেয় একটু। টিনের ছোট তোরঙ্গে তোলা সাফ। থানটি বার করে রাখে। শেমিজটা বড় ময়লা হয়েছিল, স্নানের আগেই সাবান দিয়ে সাফ করে রেখেছে।

একটা কথা ভেবে খাদু একটু দমে যায়। এই ঘটির দেশের মেলা না জানি কেমন হবে! খোকাকে কোলে নিয়ে গিন্নিমার পিছু পিছু একজিবিশনে ঘুরে এসেছে সেদিন, সাজানো গোছানো আলোয় ঝলমলে চোখ ঝলসানো কাণ্ড বটে সেটা, থ বানিয়ে দেয় মানুষকে, কিন্তু মেলার মজা নেই একফোঁটা, প্রাণ ভরে না ঘুরে ঘুরে। ওমনি একজিবিশনকে এদেশে মেলা বলে কি না কে জানে!

বাবু বেরিয়ে যেতে না যেতে শেমিজ কাপড় পরে খাদু বলে, যাই মা?

দত্তগিন্নি মুখ ভার করে বলে, যাবার জন্য তড়পাচ্ছিস দেখি! যা, কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরবি, দেরি করিসনে।

কংক্রিটের পুলটার নিচে মেলার এ মাথায় পৌঁছে খুশিতে হাসি ফোটে খাদুর পুরু ঠোঁটের ফাঁকে মিশিঘষা কালো মজবুত দাঁতে। এ মেলা মেলাই। গরিব গেঁয়ো। মেয়ে-পুরুষের ভিড়, রঙিন কাগজের ঘূর্ণি, ফুল, বাঁশের বাঁশির ফেরিওলা, মাটির ডুগডুগি বেহালা, পুতুল, কাঠের খেলনা, তেলেভাজার দোকান, হোগলার নিচে মাটিতেই যা-কিছু হোক বিছিয়ে পসরা সাজানো–সব আছে! পুলকে কেমন করে ওঠে মনটা খাদুর। হায় গো, কেউ যদি একজন সাথী থাকত তার।

পায়ে পায়ে এগোয় খাদু এদিক-ওদিক চেয়ে চেয়ে থেমে থেমে ঘুরে ঘুরে পিছু ফিরে এপাশ-ওপাশ গিয়ে গিয়ে। কিনবার জন্য, যা-কিছু হোক কিনবার জন্য, মনটা তার নিশপিশ করে। পিঠে সে অনুভব করে আঁচলে-বাঁধা একটা টাকা আর খুচরো এগার আনার চাপ। কোমরের আঁচলের কোণেও বাধা আছে এক টাকার চারটে নোট। জীবনে আর কখনো কোনো মেলায় খাদু এত টাকা-পয়সা নিয়ে যায়নি, তাও আবার সব তার নিজের রোজগারের টাকা-পয়সা। বাপভায়ের কাছে চেয়েচিন্তে, একরকম ভিক্ষে করে কয়েক গণ্ডা পয়সা নিয়ে সে মেলায় যেত, আজ এসেছে নিজের কামানো পাঁচ টাকা এগার আনা নিয়ে! টাকা থাকার মজাটা যেন খেয়ালও করেনি খাদু এতদিন, আজ যেন তার প্রথম মনে পড়ে যে দত্তগিন্নির কাছে তার দেড়-দুবছরের মাইনের অনেক টাকা জমা আছে, দু-এক টাকার বেশি কোনো মাসেই সে নেয়নি। সে কত টাকা হবে কে জানে! টাকার জোরে বুকের জোর যেন বেড়ে যায় খাদুর, আজ মেলায় এসে নিজের পয়সা যেমন খুশি খরচ করতে পারবে খেয়াল হওয়ায়।

সেইসঙ্গে এতদিন পরে একটা ভয় ঢোকে খাদুর মনে। এতকালের মাইনের টাকাগুলো জমা রেখেছে দত্তগিন্নির কাছে, হিসেবও জানে না সে কত টাকা হবে, দত্তগিন্নি যদি তাকে ফাঁকি দেয়, যদি একেবারে না-ই দেয় টাকা? বোকার মতো কাজ করেছে, খাদু ভাবে মাসে মাসে মাইনে চুকিয়ে নিয়ে নিজের কাছে টিনের তোরঙ্গে রাখেনি বলে আফসোস করে খাদু। হায় গো, টাকাগুলো যদি মারা যায় তার।

কী কিনবে ভাবতে ভাবতে সোনার একটা আংটি কিনে বসে খাদু বার আনা দিয়ে। খাঁটি সোনার নয় কিন্তু ঠিক যেন সোনা, কী সুন্দর যে মানিয়েছে তার বা হাতের সেজো আঙুলে। বিয়েতে একটা আসল সোনার আংটি পেয়েছিল খাদু, বছর না ঘুরতে সে আংটি কেড়ে নিয়েছিল বরটা তার, ফিরে দেবে বলেছিল বটে কিন্তু। আরো যে বছরখানেক বেঁচেছিল তার মধ্যে দেয়নি। ও মিছে কথা, বেঁচে থাকলেও দিত না, খাদু জানে। তারপর কতকাল আংটি পরার শখটা খাদু চেপে রেখেছিল, এতদিনে মিটল। কিন্তু না গো, মিটেও যেন মিটল না, প্রথম বয়সের সাধ কি আর মেটে মাঝ বয়সে, নিজে নিজের সাধ মেটালে, কেউ আদর করে কিনে না দিলে।

বজ্জাতেরা তাকায়, গায়ে গা ঘসে যায় ছলে কৌশলে, খানিক আগে থেকেই পিছু নিয়েছে ওই বাবুসাজা লোকটা। ফিনফিনে পাঞ্জাবির নিচে গেঞ্জিটা যেমন স্পষ্ট ওর মতলবও স্পষ্ট তেমনি। খাদু ওসব গায়ে মাখে না, রাগ করে না, বিচলিত হয় না। মেলাতে এ রকম হয়, কতকগুলো লোক এই করতেই আসে মেলায়, মেয়েলোকের গায়ে একটু গা ঠেকিয়ে মজা পেতে, পুরুষ হয়ে চোরের মতো এইটুকু নিয়ে বর্তে যায়– কী ঘেন্না মাগো! আসল বজ্জাত ওই লোকটা যে পিছু নিয়েছে একলা মেয়েলোক দেখে, গুণ্ডা না হলে কেউ কখনো গাড়োয়ানের চেহারা নিয়ে বাবু সাজে। নিক পিছু, ঘুরুক সাথে সাথে। বোকা-হাবা মেয়ে ভেবেছে খাদুকে, টের পাবে ভাব করতে এলে, এই ভিড়ের মাঝে খাদু যখন গলা ছেড়ে শুরু করবে গাল দিয়ে ওর চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে।

পড়ন্ত রোদের মতো তেজ কমে কমে আসে খাদুর আনন্দ ও উত্তেজনার, নিভে যেতে থাকে উন্মাদনা। একা আর কতক্ষণ ভালো লাগে মেলা, কথা কওয়ার কেউ একজন সাথে নেই।

খিদে পায়। এত লোকের মাঝে খেতে লজ্জা করে খাদুর। ভাজা পাঁপড় কিনে আঁচলের তলে লুকিয়ে ফেলে বা হাতে, ডান হাতে এক-এক টুকরো ভেঙে নিয়ে এমনভাবে মুখ দিয়ে চিবোয় যে কেউ টেরও পাবে না পানসুপুরি মুখ দিয়ে চিবোচ্ছে কিছু খাচ্ছে। এমন সময় কাণ্ড দেখ কপালের, খাদু সোজাসুজি সামনে পড়ে যায় দত্তবাবুর।

তাকিয়ে দেখতে দেখতে দত্তবাবু উদাসীনের মতো এগিয়ে যায় পাশ কাটিয়ে, আস্তে আস্তে থামে, ফিরে কাছে গিয়ে বলে, মেলা দেখতে এয়েছিস?

যেন মেলাতে মেলা দেখতে আসেনি খাদু, এসেছে ঘাস কাটতে। তিরিশের ওপরে বয়স হবে দত্তবাবুর, বিয়ের চার বছর পরে জন্মেছে খোকাটি, খোকার তিনবারের জন্মদিন বলে কমাস আগে খাওয়াদাওয়া হল বাড়িতে। টুকটুকে ফরসা রঙের না-মোটা না-রোগা সুন্দর চেহারা দত্তবাবুর, মুখখানা ফ্যাকাশে, চুপসানো। দেখে এমন মায়া হয় খাদুর। গিন্নিমা শুষে শুষে শেষ করে দিয়েছে বাবুকে, টাকার জন্য আপিসে খাঁটিয়ে আর বাড়িতে নিজের রাক্ষুসী হিড়িম্বার খিদে মিটিয়ে। আড়ি পেতে সব শুনেছে, সব জেনেছে খাদু। বৌ-বর খেল দেল শুতে গেল মিলল মিশল ঘুমাল, এই তো নিয়ম জানে খাদু, গিন্নিমা যেন মাগী-মাকড়সার মতো তাতে খুশি নয়, রাত বারটায় শ্রান্তিতে ক্লান্তিতে অবসাদে মর-মর বরটাকে যে করে তোক জাগিয়ে তুলে খাবেই খাবে, বেশি যদি নেতিয়ে পড়ে তো ঝাঁঝিয়ে ঝাঁঝিয়ে বলবে, মেয়েবন্ধু তো গাদা গাদা, কার সাথে কারবার করে এলে আজ যে বিয়ে-করা বৌকে এত অবহেলা?

আড়ি পেতে বাবুর কাতরতা দেখতে দেখতে যেন একশ বিছে কামড়েছে খাদুকে, চিৎকার করে বলতে সাধ গেছে, লাথি মেরে রাক্ষুসীকে বার করে দিয়ে ঘুমো না, কেমন ধারা পুরুষ তুই!

এই ক-আনা পয়সা নে, কিছু কিনিস, দত্তবাবু বলে খানিকটা কাঁচুমাচু ভাবে, আর শোন খাদু, বাড়িতে যেন বলিস না আমায় মেলায় দেখেছিস।

পয়সা পেয়ে খাদু মুচকে হেসে মাথা নাড়ে। দত্তবাবু এগিয়ে গেলে পিছু থেকে জিভের ডগাটুকু বার করে তাকে অবজ্ঞার ভেংচি কাটে। এমনও পুরুষ হয়, বৌয়ের ভয়ে মনখুশিতে মেলায় আসতে ডরায়!

.

মেলার মাঝখানে জমজমাট অংশে আটকে যায় খাদ, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। এইখানেই। মোড়ের মাথায় মন্দিরের বদলে একটা চেপ্টা ঘরের মধ্যে সিঁদুরলেপা দাঁত-খিচানো ভীষণাকৃতি দানবরূপী প্রকাণ্ড দেবতা, খাদু ভক্তিভরে প্রণাম করে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ পুতুলনাচ দেখে, রামায়ণ মহাভারতের রাজা-রানীদের চেয়ে দেখে, তার মজা লাগে শণের দাড়িওলা মুনিগুলো আর হনুমানকে। নুলো খঞ্জ অন্ধ ভিখারিদের দিকে না তাকিয়ে সে দুটি পয়সা দেয় জোয়ানমর্দ ভিখারিকে, কেঁদে কেঁদে ভগবান ভালো করবেন বলার বদলে সে হেঁড়ে গলায় সবাইকে শাসিয়ে ভিক্ষা চাইছে, তাকে না দিলে তুমি মরবে, তোমার সর্বনাশ হবে। অনেক কিছু কেনার এত সাধ নিয়েও ওই আংটি আর একটি আরশি ছাড়া আর কিছুই কেনা হয়নি খাদুর। কিছু কিনতে গেলেই মনে হয়েছে, কার জন্য কিনবে, তার কে আছে, কী কাজে লাগবে তার জিনিসটা। তার ঘর নেই, সংসার নেই, সাজাগোজা নেই, আরামবিরাম নেই। কী করতে সে মেলায় এল, কী সুখটা তার হল মেলায় এসে। আপন মনে এমনভাবে ঘুরে বেড়াতে কি ভালো লাগে মেলায়। এত লোকের হাসি আনন্দ উৎসবের মধ্যে থেকে খোঁচা দিয়ে দিয়ে মনটাতে ব্যস্ততা এনে শুধু খা-খা করানো।

মেয়েছেলেরাও উঠেছে নাগরদোলায়, দুজন চারজনে একসঙ্গে নয়তো পুরুষ সাথীর সঙ্গে, লজ্জাশরম ভুলে আওয়াজ ছাড়ছে অদ্ভুত, দিশেহারা হয়ে আঁকড়ে ধরেছে সাথীকে, খিলখিলিয়ে হাসছে যেন ভূতে-পাওয়ার হাসি। একসঙ্গে ওই ভয় আর ফুর্তি, ওপরে উঠে নিচে নেমে দোল খাওয়ার ওই বিষম মজা আর তীব্র সুখের শিহরণ যে কেমন খাদু কি আর জানে না। সাথী কেউ থাকলে সেও একটু নাগরদোলায় চাপত, অনেকদিন পরে আবার একটু চেখে দেখত কেমন লাগে নিজের ভেতরে ওই শিরশির করা।

কী ভাবো?

মাঝখানে কোথায় সরে গিয়েছিল, আবার পিছু নিয়েছিল লোকটা পুতুলনাচ দেখবার সময়, এখন পাশে এসে দাঁড়িয়ে কথা কয়েছে। বেঁজে উঠত খাদু সন্দেহ নেই, সে করে উঠে এক নিমিষে টের পাইয়ে দিত বাড়াবাড়ি করতে গেলেই বিষদাঁতে সে ছোবল দেবে। কিন্তু কথা হল কী, লোকটার কথায় তার দেশি টান। দেশগাঁয়ের চেনাজানা কেউ যেন ছদ্মবেশে তাকে এতক্ষণ ঠকিয়ে এবার নিজেকে জানান দিল কথা কয়ে। তাই শুধু মুখটা গোমড়া করে বলতে হয় খাদুকে, কী ভাবুম?

দেইখাই চিনছি দেশের মানুষ তুমি।

চিনছ তো চিনছ।

পাতলা পাঞ্জাবির নিচে শুধু গেঞ্জি নয়, গেঞ্জি-আঁটা চওড়া মোটা শক্ত বুক আর কাঁধ আছে, ঘনকালো কিছু লোম দেখা যায় গেঞ্জির ওপরে। জবরদস্ত গর্দান লোকটার। মুখের চামড়া ক্ষেতমজুরের মতো পুরু আর কর্কশ। দু-এক নজরে দেখে খাদু আবার ভাবে আফসোসের সঙ্গে, চাষাভুষোর এমনধারা বেমানান বাবু সাজা কেন?

দোলায় চাপবা?

না।

ডর নাই, আমারে কোনো ডর নাই তোমার। লোকটা বলে হঠাৎ আবেগের সঙ্গে, পুবের আকাশের যেখানে আড়াল থেকেই পূর্ণিমার চাঁদ ফ্যাকাশে করে রেখেছে। সন্ধ্যাকে সেই দিকে মুখ তুলে চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে একটা বিড়ি ধরায়। সিগারেটের প্যাকেটটা বার করেও আবার পকেটে রেখে বিড়িটা বার করে।

তোমারে ভাবছিলাম বাবুগো মাইয়া বুঝি, কথা কইবার চাইয়া ডরাইছি। তবু মনডা কইল কী, না, বাবুগো ঘরের মাইয়ালোক সাহস পাইব কই যে একা আসব মেলায়? কথা কমু ভাবি, ডরাই। শ্যাষে অখনে কইলাম। ডর নাই, আমারে ডর নাই।

ডরে তো মরি। লোকটার কথা শুনে বিষম খটকা লাগে খাদুর মনে। সেও কি তবে বেমানান সাজ করেছে লোকটার মতো খাপছাড়া আর হাস্যকর, চাষাভুষো ঘরের মেয়ে হয়ে বাবুর ব্লাড়ীর বেশ ধরে? ছোট একটা তাঁবুতে পরীর নাচ আর ম্যাজিক দেখাচ্ছে। নাচের নমুনা ধরা হয়েছে সবার সামনে। রোগা-ক্যাংটা কালো কুৎসিত তিনটি মেয়ে মুখ গলা হাতে পুরু করে রং লেপে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে তাবুর সামনে ছোট বাঁশের মঞ্চে ভঙ্গি করছে নাচের, গলা ছেড়ে পাঁচমেশালি সুরে গান ধরেছে ভাঙা হারমোনিয়ামের সঙ্গে–একজন ওদের মধ্যে হিজড়ে। মাঝে মাঝে তাবুর সামনের পরদা সরিয়ে দেখানো হচ্ছে যে শুধু এরা নয় আরো অঙ্গরা আছেন ভেতরে, দু আনা-চার আনায় ওই পরীদের মজাদার নাচ দেখার সুযোগ ছেড়ো না, তার সঙ্গে ম্যাজিক, ভাড়ামি। চলা আও, চলা আও–দো দো আনা, চার চার আনা।

আমার পয়সা আমি দিমু কইলাম। গায়ে-পড়া ঝগড়ার সুরে খাদু বলে দু আনা পয়সা বাড়িয়ে দিয়ে। নাচ দেখতে ভেতরে যাবার তাদের মধ্যে কথাও হয়নি তখন পর্যন্ত, তার হয়ে লোকটির টিকিটের পয়সা দেবার কথা দূরে থাক।

দিও, তুমিই পয়সা দিও। লোকটি বলে আমোদ পেয়ে, কিন্তু অ্যানে কী দেখবা? খালি ফাঁকিবাজি, ঠকাইয়া পয়সা নেওনের ফিকির। দেখবা যদি, চীনাগো সার্কাস দেখি গা চলো। খাসা দেখায়, পয়সা দিয়া খুশি হইবা।

দেখি না কী আছে।

সব দেখবে খাদু এবার, ভালোমন্দ যা কিছু দেখার আছে; এত মানুষ ঠকছে সাধ করে, সেও নয় ঠকবে, বিশ্বাসী সাথী যখন পেয়েছে একজন। বিশ্বাস রাখবে কি না শেষ পর্যন্ত ভগবান জানে, কী বিপদ আজ তার অদৃষ্টে আছে তাও জানে ওই পোড়ারমুখো ভগবান, তবে মেলায় কোনোরকম নষ্টামি গুণ্ডামি যে করবে না লোকটা এটুকু খাদু জানে। বুঝদার বিশ্বাসী সাথীর মতোই সে সাথে থাকবে, মনখোলা আলাপী কথায় হাসি-তামাশায় খুশি থাকবে দুজনেই, ভালো লাগবে মেলা দেখা। মতলব যা আছে তা মনেই থাকবে ওর চাপা-পড়া।

ঘেন্না জন্মে যায় সস্তা নাচ, বাজে ম্যাজিক, বগলে লাঠি খুঁচিয়ে কাতুকুতু দেওয়ার মতো ভাড়ামি দেখে। তবু শেষ পর্যন্ত থাকে খাদু, উপভোগও করে। এও মেলারই অঙ্গ জেনে শুনে কত বাজে জিনিস কেনে পয়সা দিয়ে, অন্য সময় যেভাবে পয়সা নষ্ট করার কথা ভাবলেও গা জ্বালা করত, নইলে আর মেলার উন্মাদনা কিসের। নিজের ভিতর উথলাচ্ছে আনন্দ আর উত্তেজনা, তাই দিয়ে ফাঁকিকেও সার্থকতা দেওয়া যায়। মেলায় না হলে একটা পয়সা দিয়েও কি কেউ দেখতে চাইত এসব!

বয়সের পাকামি আছে, সে যাবার নয়, তবে ছেলেবয়সের আবেগপুলকের বন্যাও থইথই করছে মনে। ফাঁকি যাচাই করতে করতেও উৎসুক লোভী মন নিয়ে খুশি। হয়েই খাদু দেখে হিমালয় পারের অজগর সাপ, এক ছেলের দুই মাথা, জন্ম থেকে। জোড়া-লাগা দুই মেয়ে।

অচেনা মানুষের সঙ্গে কথা কয় খাদু, ছেলে কাখে বৌটির সঙ্গে, কুলো আর পাখা হাতে বিধবাটির সঙ্গে একপাল বৌ ছেলে নাতিনাতনি নিয়ে বেসামাল সধবা গিন্নিটির সঙ্গে। দেখা হয় চেনা মানুষের সঙ্গে। সুবলের মা পাড়ার তিন বাড়িতে ঠিকে কাজ করে। চুপি চুপি শুধোয় সুবলের মা, সাথে কে?

দ্যাশের মানুষ, কুটুম। খাদু বলে নির্ভয় নিশ্চিন্তভাবে।

চাঁদ উঠেছে আকাশে, নিচে অসংখ্য আলো জ্বলছে মেলার। একজিবিশনের চোখ ঝলসানো বাড়াবাড়ি আলো নয়, কাছে তেল মোম গ্যাসের শিখা, কোনোটা কাঁচের মধ্যে কোনোটা খোলা, তফাতে জোছনারাতের তারার মতো।

আরো দেখবা?

দেখুম না; চীনা সার্কাস? তুমিই তো কইলা।

চীনা সার্কাসের তাঁবুটা অনেক বড়। চার আনা টিকিটের দাম। লোক টানবার জন্য সামনে খেলার নমুনা দেখানো হচ্ছে এখানেও, ভিন্ন রকম নমুনা। মেয়ে আছে তিনটি, দুজন হলদে রঙের চীনা, একজন কালো রঙের বাঙালি। কালো হলেও ছিরি ছাদ আছে মেয়েটির, রং মেখে ভূতও সাজেনি, সস্তা ঢঙের ভঙ্গিও নেই। চীনা মেয়ে দুটিকে বড়-ছোট বোন মনে হয় খাদুর। পিছু বেঁকে পায়ের গোড়ালি ছুঁয়ে, হাতের ভরে শূন্যে পা তুলে দাঁড়িয়ে, ছোট লোহার চাকার ভেতর দিয়ে কৌশলে গলে গিয়ে ওরা খেলার নমুনা দেখাচ্ছে! আঁটোসাঁটো জোয়ান-বয়সী চীনাটি দুহাতের দুটি ছড়ির ডগায় বসানো প্লেট দুটিকে বন-বন করে ঘোরাচ্ছে। আরেকজন, তাকে ওর ভাই মনে হয় খাদুর, পাঁচ ছটা লোহার শিকের আস্ত চাকা নিয়ে চাকার সঙ্গে চাকা আটকে আবার খুলে ফেলেছে, কী করে কে জানে! ভেতরে গিয়ে খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় খাদু। পাঁচ-ছ বছরের একটা ছেলে, সে দৌড়ে এসে লাফ দিয়ে মাটি না ছুঁয়ে শূন্যে পাক খেয়ে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াচ্ছে, বড় একজনের মাথায় হাতের ভর দিয়ে শূন্যে পা তুলে দিচ্ছে, এসব দেখে রোমাঞ্চ হয় খাদুর। টেবিলে কাঠের গোলায় বসানো তক্তার দুপাশে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে তক্তা গড়িয়ে গড়িয়ে একটি মেয়ের দোল খাওয়া দেখে সে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে, মেজো চীনা মেয়েটিকে শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে টেবিল ডিঙোতে দেখে, আগুনের চাকার মাঝখান দিয়ে গলে যেতে দেখে সে অভিভূত হয়ে যায়, ভাবে, কত কাল ধরে কী ধৈর্যের সঙ্গে তপস্যা করে না জানি এসব কসরত আর কায়দা ওরা আয়ত্ত করেছে।

খাদু সবচেয়ে অভিভূত হয় ভেবে যে এক সংসারের বাপ ছেলে মেয়ে পুরুষ সবাই মিলে এমন চমৎকার সার্কাস দেখাচ্ছে। ভেতরে ঢুকে দলের সবাইকে দেখার পর এতে আর তার সন্দেহের লেশটুকু নেই। চেহারার মিল নয় না-ই ধরতে পারল সে ওদের, বয়স কখনো সবার খাপ খায় এমনভাবে এক পরিবারের না হলে-বুড়ো একজন বাপ, মাঝবয়সী, জোয়ান, কিশোর আর ছেলেবয়সী এই চার ছেলে; তিন-চার বছর বয়সের ফারাকের দুটি জোয়ান আর ন-দশ বছরের একটি, এই তিন মেয়ে। মা বুঝি নেই ওদের। বৌ মরেছে বুড়ো বেচারার। আহা।

জোয়ান মেয়ে দুটির দুজনেই মেয়ে, না একজন ছেলের বৌ আর একজন মেয়ে কিংবা দুজনেই ছেলের বৌ, এই একটু খটকা থাকে খাদুর। সিঁদুরও দেয় না যে আন্দাজ করে নেবে। কালো মেয়েটা এদের সঙ্গে কেন, সেও আরেক ধাঁধা খাদুর।

আমাগো মাইয়াটা কী করে চীনাগো লগে? সে শুধোয় সঙ্গীকে।

ভাড়া করছে।

এরা নাকি সাধারণত অল্প বয়সে চুরি-করা অথবা অনাথা মেয়ে, সংসারে যাদের দেখবার শুনবার কেউ নেই। বড় হলে কাউকে দিয়ে করানো হয় দেহের ব্যবসা, কেউ শেখে চুরিচামারির কায়দা, কেউ শেখে কসরত। এ মেয়েটা হয়তো ভাড়াও খাটছে, নতুন খেলাও শিখছে চীনাদের কাছে, পরে আরো দাম বাড়বে। অবাক হয়ে শোনে খাদু। বিরাট এ জগৎ সংসার, অদ্ভুত কাণ্ডকারখানার সীমা নেই তাতে। কোথাকার এই বিদেশি পরিবার সার্কাস দেখিয়ে পয়সা রোজগার করছে, কোথায় কার ঘরে জন্মে আজ ওদের সঙ্গে খেলা দেখাচ্ছে এই কালো মেয়েটা। এক দুর্বোধ্য বিস্ময়কর অনুভূতিতে বুকটা তার কেমন করে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে ভাবে, মানুষ কী যে করে সংসারে আর কী যে করে না!

নাগরদোলায় বুক-শিরশির-করা সুখটা তিন-চার পাকের বেশি সয় না খাদুর, কাতর হয়ে বলে, নামুম। থামান যায় না?

যায় না?

জোরে হাঁক দিয়ে নাগরদোলা থামাতে বলে লোকটি, যেন হুকুম দেয়। আর এমন আশ্চর্য, তার হুকুমে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে থামতে আরম্ভ করে দোলা। পাশ থেকে উঠে লোকটি আগে নামতে গেলে খাদুর খেয়াল হয়, লজ্জাশরম ভুলে দুহাতে কীভাবে ওকে সে আঁকড়ে ধরেছে।

ডর করে নাকি?

না। খাদু জোর দিয়ে বলে, গা গুলায়।

মেলায় মানুষ কমতে শুরু করেছে। বিকালে মানুষের জোয়ার এসেছিল, তাতে ধরেছে ভাটার টান। মেলা আর ভালো লাগে না, শ্রান্তি বোধ করে খাদু। মেলায় ছড়ানো নিজেকে এবার গুটিয়ে নিয়ে বিশ্রাম করতে ইচ্ছা হয়। ফিরে গেলে ঘ্যানঘ্যান। করবে দত্তগিন্নি, কৈফিয়ত চাইবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তারপর দত্তবাবুর বুড়ি মায়ের ঘুপচি ঘরটির মেঝেতে বিছানা বিছিয়ে শোয়া। সারারাত বুড়ি কাশবে, বার বার উঠবে। ভাবলেও মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায় খাদুর।

কিন্তু বাড়ি সে যে যাবে, বিশ্রাম সে যে করবে, সে তো এতক্ষণের সাথীটি রেহাই দিলে তবেই? এবার সময় হল ওর মতলব হাসিলের। বেশ ভালো করেই জড়িয়ে জড়িয়ে ফাঁদে ফেলেছে তাকে। এতক্ষণ ভুলিয়ে ভালিয়ে বাগিয়েছে, এবার কোন। ভয়ংকর স্থানে নিয়ে যাবে কে জানে, যা খুশি করবে তাকে নিয়ে, হয়তো ছেড়ে দেবে দলের খুনে গুণ্ডাদের হাতে, হয়তো শেষরাতে গলাটা কেটে ফাঁক করে ভাসিয়ে দেবে খালে। বুকটা ঢিপঢিপ করে খাদুর। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে লোকটা কিছুক্ষণ থেকে, বার বার চোখ বুলাচ্ছে তার পা থেকে মাথা অবধি। গায়ে কাঁটা দেয় খাদুর।

যাইগা অখন রাইত হইছে। সে বলে ভয়ে ভয়ে।

যাইবা? রাইত হয় নাই বেশি। ক্ষুব্ধ চিন্তিতভাবে লোকটা খাদুর নতুন ভাবসাব লক্ষ্য করে, চলো যাই, দিয়া আসি তোমারে। কলাপাড়া নন্দ লেন কইলা না?

আমি যাইতে পারুম। ক্ষীণস্বরে খাদু বলে। পারবা না ক্যান?

বাড়িটা চিনা আসুম, বুঝলা না?

বোঝে না? সব বোঝে খাদু। চলুক সাথে, বড় রাস্তা ধরে সে যাবে, রাস্তায় এখন গাড়ি ঘোড়া লোকজনের ভিড়। পাড়ায় গিয়ে নির্জন গলিতে ঢুকবে, কিন্তু পাড়ার মধ্যে তার ভয়টা কী, লোকজন জেগেই আছে সব বাড়িতে এখন।

কী কিনা দিমু কও।

তিণ্যটি না।

তোমার খালি না আর না। লোকটা বলে বেজার হয়ে।

কংক্রিটের পুলের গোড়ায় বড় রাস্তার পাড়ে লোকটা রিকশা ডেকে বসে একটা, খাদুকে চমকে আর ভড়কে দিয়ে।

না, না, রিকশা লাগব না।

লাগব। ধমকে দিয়ে বলে এবার লোকটা, সব কথায় না না কর ক্যান? উইঠা বসো রিকশায়, কও তো হাইটা যামুনে আমি লগে।

খাদু কিছু বলে না, কী আর বলবে। লোকটা তার পাশে উঠে বসে। আংটিপরা হাতে একবার হাত বুলিয়ে দেয়, ধমক দেবার দোষ কাটিয়ে সান্ত্বনা দিতে। ঘেমে জল হয়ে গেছে খাদুর গা তখন, হাত-পা যেন অবশ হয়ে এসেছে।

রিকশা চলে ঘণ্টা বাজিয়ে, চলতে চলতে লোকটা হঠাৎ বলে রিকশাওয়ালাকে, ডাইনে যাও।

না, না, বড় রাস্তায় চলুক।

এইটা রাস্তা না?

রিকশা ঢোকে ডাইনের রাস্তায়। এটা সোজা পথ কলাপাড়া যাবার খাদু জানে, কিন্তু বড় রাস্তা ছেড়ে রিকশা যখন ঢুকেছে এই গলিতে তখনি খাদু জেনেছে কলাপাড়ায় নন্দ লেনে দত্তবাড়িতে আর সে পৌঁছবে কি না সন্দেহ। দু-পাশে ঘিঞ্জি বস্তি, টিন আর খোলার চালে জোছনা, সরু সরু গলিতে অন্ধকার। ওর মধ্যে কোথায় যেন জোরালো হল্লা চলেছে, মেয়েমানুষ গানও গাচ্ছে হারমোনিয়ামের সঙ্গে! এর মধ্যে নিয়ে যাবে কি নোকটা তাকে? এ অঞ্চল পেরিয়ে রিকশা রাস্তায় বাঁক ঘুরলে খাদু একটু স্বস্তি পায়। এ অঞ্চলটা শান্ত, দু-পাশে কাঁচাপাকা বাড়িতে গেরস্ত, আধা-গেরস্তের বাস।

কিন্তু খানিক এগিয়েই লোকটা থামতে বলে রিকশাওয়ালাকে। ঘনিষ্ঠ সুরে বলে, আমার ঘরখানা চিনাইয়া দেই তোমারে, কী কও?

পুরনো একটা পাকা গ্যারেজ ঘর, দরজা এখন তালাবন্ধ। এখানে সে থাকে, রাধে বাড়ে খায়, ঘুমোয়। পাশে গায়ে-গায়ে লাগানো টিনের চাল ও টিনের বেড়ার একটা ঘর, সামনে দোকানের মতো মস্ত দু-পাট কপাট, ওপরে-নিচে দুটো তালা সাঁটা। ওপরে একটা তেরাবাঁকা সাইনবোর্ড, দু-পাশে সাইকেলের দুটো পুরনো টায়ার ঝুলছে। এটা তার সাইকেল মেরামতি দোকানদামোদর সাইকেল ওয়ার্কস।

নাম কই নাই তোমারে? আমার নাম দামোদর।

রিকশার জোয়াল নামিয়ে রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে তাদের নামবার অপেক্ষায়। শক্ত করে পাশটা চেপে ধরে ঝোঁক ঠেকিয়ে খাদু কাঠ হয়ে বসে থাকে।

নামবা না?

না। তুমি নামো।

চাঁদের আলোয় পথের আলোয় বেশ দেখা যায় মুখে যেন তপ্ত রাগের ছাকা লেগেছে দামোদরের। একহাতে সে খাদুর আংটিপরা হাতের কব্জি চেপে ধরে, এত জোরে ধরে যেন খেয়াল নেই ওটা মেয়েছেলের নরম হাত, হাড় ভেঙে যেতে পারে মট করে, আরেক হাতে সে মুঠো করে ধরে খাদুর বুকের কাপড় শেমিজ।

মারো। আমারে মাইরা ফেলাও। খাদু কেঁদে ফেলে হুস করে, জোরে নয়, চেপেচুপে, কহাত দূরে রিকশাওয়ালাও টের পায় কি না পায়! আগে থেকে সে যেন তৈরি হয়েই ছিল এমনিভাবে কাঁদবার জন্য।

দামোদর ভড়কে গিয়ে বুকের কাপড় হাতের কব্জি ছেড়ে দেয় তৎক্ষণাৎ। থবনে গিয়ে গুম হয়ে থাকে কয়েক লহমা। তারপর রিকশাওয়ালাকে চলতে বলে কলাপাড়ার দিকে।

রিকশাওয়ালা চলতে আরম্ভ করলে খাদুকে বলে, ব্যারাম স্যারাম নি আছে মাথার?

সে রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় পড়ে রিকশা, আবার ইটের রাস্তায় বাঁক নেয় শহরতলির শান্ত নিঝুম উঠতি দ্রপাড়ার এলাকায়। মাঠ, পুকুর বাগানের ফাঁকে ফাঁকে ছড়ানো নতুন বাড়ি, ছোট সীমানায় ঠাসা গরিবের পুরনো বস্তি। শরীর-জুড়ানো হাওয়া বইছে, অবাধে, শোনা যাচ্ছে ঝিঁঝির ডাক, কোনো বাড়ির ছাদ থেকে ভেসে আসা বাঁশির বাবুয়ানি মিহি সুর।

আকাশে মুখ তুলে চাঁদ দেখতে হয় না, চারদিকে চাঁদের আলো চোখের সামনে ছড়ানো।

নন্দ লেনের মোড়ে ঘন তেঁতুলগাছের ছায়া। খাদু দাঁড়াতে বলে রিকশাওয়ালাকে। তোমার লগে দেখলে বাড়ির লোক কী কইব? আমি নামি।

নামো।

খাদু রিকশায় বসে থেকেই হাত বাড়িয়ে দত্তবাবুর বাড়ির হদিস তাকে বাৎলে দেয়, বলে, ডাইনা দিকে তিনখান বাড়ির পরের বাড়িখান, দোতলা বাড়ি। দেইখাই চিনবা।

বাড়ি চিনতে হাঙ্গামা কী। দামোদর বলে উদাস গলায়, নন্দ লেনে দত্তবাবুর বাড়ি খুঁইজা নিতে পারতাম না?

ফুরফুরে হাওয়ায় তেঁতুলগাছের ছায়া ঘেঁষে জোছনায় দাঁড়িয়ে খাদু যেন চোখের সামনে দেখতে পায় দত্তবাড়ির অন্তঃপুর, খোকার কান্নায় স্বামীর পাশে শুতে দেরি হচ্ছে বলে রেগে গজর গজর করে শাপছে তাকে, মাছের মতো মরা চোখে চেয়ে দেখছে ঘুমকাতুরে গাল-চুপসানো দত্তবাবু, নিজের ঘরে চৌকিতে কাথার বিছানায় বসে দত্তবাবুর বুড়ি মা কেশে চলেছে খক খক করে আর মেঝেতে শুয়ে খাদু ঝি এপাশ ওপাশ করছে অজানা কষ্টে। আজ রাতে কব্জিটা টন টন করবে।

হাতটা মুচরাইয়া দিছ একেবারে, ব্যথা জানায়। আহত কব্জি তুলে ধরে খাদু তাতে অন্য হাতের তালু ঘষে আস্তে আস্তে।

ষাইট, সোনা ষাইট। দামোদর বলে ব্যঙ্গ করে, কবিরাজি ত্যাল আইনা লাগাইও, মাথায়ও মাইখো ঘইষা ঘইষা।

লোক আসতে দেখে খাদু তেঁতুলগাছের ছায়ায় পিছিয়ে যায়। রিকশা আর গাছের ছায়ায় তার আবছা মূর্তির দিকে চাইতে চাইতে মানুষটা চলে গেলে এগিয়ে আসে। রিকশাওয়ালা তখন জোয়াল তুলে ধরেছে রিকশার।

আসি গো ঠাইরান। বলে খাদুর কাছে বিদায় নিয়ে দামোদর রিকশাকে বলে, যাও জোরসে চলো। বকশিশ দিমু।

খাদু বলে শোনো, শুনছ? একটা কথা ভাবতেছিলাম।

রিকশা থেকে ঝুঁকে মুখ বাড়িয়ে দেয় দামোদর।

খাদু বলে, তুমি তো বাড়ি চিনা গেলা আমার। কই দিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া আনলা আমারে, তোমার ঘর চিনা নিতে পারুম কি না ভাবি।

কী করবা তবে? দামোদর জিজ্ঞাসা করে ভয়ে উৎকণ্ঠায় গলা কাঁপিয়ে।

গিয়া দেইখা চিনা আসুম? খাদু বলে প্রায় অস্ফুট স্বরে। দামোদর স্পষ্ট শুনতে পায় প্রত্যেকটি কথা। রাসপূর্ণিমার বিদ্রি রাত্রি হলেও সেখানে তাদের আশপাশে আর তো কোনো শব্দ ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *