পিশাচকন্যা – তিনগোয়েন্দা
০১.
হঠাৎ করেই, প্রায় অলৌকিক ভাবে ক্ষমতাটা পেয়ে গেছি আমি, রিটা গোল্ডবার্গ বলল। কিভাবে পেয়েছি, জানতে চাও?
চাই, বলে মুসা আর জিনার দিকে তাকাল রবিন।
নীরবে মাথা ঝাঁকাল মুসা।
জিনা বলল, বলো।
একেবারে গোড়া থেকে?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল রবিন। আমরা অনেক চিন্তা-ভাবনা আলাপ-আলোচনা করে একমত হলাম, কিশোরের ব্যাপারে কেউ যদি কোন সূত্র দিতে পারে, সে তুমি। ওকে খুঁজে বের করতে হলে সূব তথ্য আমাদের জানা দরকার। কিছুই মিস করা চলবে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমার এই ক্ষমতা পাওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে কিশোরকে উদ্ধারের পথ।
ঠিক আছে, বসো তোমরা, বলে লিভিং-রূম থেকে উঠে চলে গেল রিটা। ফিরে এল কয়েক মিনিটের মধ্যে। বড় একটা বাঁধানো খাতা নিয়ে এসেছে হাতে করে। রবিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নিয়ে যাও এটা। আমার স্পেশাল ডায়েরী। পড়লে সব জানতে পারবে। আগে পড়ে নাও, তারপর কিভাবে তোমাদের সাহায্য করা যায়, আলোচনা করব। পড়ে তাড়াতাড়ি ফেরত দিও।
দেব, সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে ডায়েরীটা নিল রবিন।
তোমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ যেন ডায়েরীটা পড়তে না। পারে, সাবধান করে দিল রিটা।
চোখেও দেখবে না কেউ, রবিন বলল। বড় খাম আছে তোমার কাছে?
আছে।
রিটার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুসা আর জিনাকে নিয়ে বাড়ি চলে এল রবিন। মা-বাবা বাড়ি নেই, কাজে বেরিয়েছেন। নিরাপদে ডায়েরী পড়তে কোন অসুবিধে হবে না।
লিভিং-রুমে ঢুকেই মুসা বলল, মেরিআন্টির একটা খবর নেয়া দরকার।
ফোন করল সে। রাশেদ পাশা ধরলেন।
কয়েক মিনিট কথা বলে রিসিভার রেখে দিয়ে ফিরে তাকাল। মুসা, আন্টি এখনও বিছানায়। আঙ্কেলের মনমেজাজও ভাল না। ব্যবসা, কাজে-কর্মে মন নেই।
থাকার কথাও নয়, জিনা বলল। কিশোরের খোঁজ না পেলে কোনদিনই আর ভাল হবেন না আন্টি…
বাধা দিয়ে রবিন বলল, কথা আর না বাড়িয়ে কাজে লেগে পড়া যাক। ডায়েরীতে কি আছে পড়ছি আমি। তোমরা কাছে এসে বসো।
ডায়েরীটা খুলল রবিন। সুন্দর হাতের লেখা রিটার। গোটা গোটা অক্ষর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পড়তে কোন অসুবিধা হয় না।
জোরে জোরে পড়তে শুরু করল সে।
*
মহিলাটাকে স্রেফ একটা ডাইনী মনে হলো আমার। তবু সাহস করে সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকালাম। আমার চেয়ে বেশ খানিকটা লম্বা। তাতে কি?-মনকে বোঝালাম। আমার বয়েস কম। ক্ষিপ্রতা বেশি। লড়াই করার জন্যে প্রস্তুত হয়েই এসেছি আমি।
কাবু ওকে করব আমি, তবে হাতাহাতি লড়াইয়ে নয়, কথার মারপ্যাঁচে।
এতদিন ধরে যা শিখে এসেছি, তাতে একটা ব্যাপার আমার কাছে পরিষ্কার, কোন কিছুতে জিততে হলে কিংবা কোন জিনিস পেতে চাইলে একাগ্রভাবে সেটা চাইতে হবে; ইচ্ছে শক্তিটাই হলো আসল।
বাজার করাটা খুব কঠিন কাজ। অন্তত আমার কাছে। রীতিমত যুদ্ধ করা মনে হয়।
চুলের গোড়ায় আঙুল চালিয়ে সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করলাম। আমার সবচেয়ে সুন্দর হাসিটা তাকে উপহার দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বিক্রির জন্যে? আগামী সপ্তায় থাকবে তো?
ডাইনী মহিলাটা একজন সেলস লেডি। নাম ক্লডিয়া। বুকে ঝোলানো নেম-ট্যাগে সোনালি অক্ষরে লেখা রয়েছে নামটা।
আমার কথায় চোখের একটা পাপড়িও কপাল না। বরং তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মাথাটাকে পেছনে ঝটকা দিয়ে ছোট্ট একটা হাসি দিল।
এই একটা জিনিস একেবারেই সহ্য করতে পারি না আমি, তাচ্ছিল্য করা।
বিক্রি? উপহাসের সুরে বলল, এটা সাধারণ ব্লাউজ নয়, খুকী। তুমি চিনতে ভুল করেছ। প্যারিস, লন্ডন, মিলানের সামার কালেকশনে শো করা হয়েছিল। কিনতে হলে প্রচুর টাকা লাগবে। যদি না থাকে, আলোচনা করেও লাভ নেই। কিচ্ছা এখানেই খতম।
পিত্তি জ্বলে গেল আমার। মাঝে মাঝে ভেবে অবাক লাগে, এ ধরনের চাড়ালগুলোকে কোত্থেকে জোগাড় করে দোকান মালিকরা! দুনিয়ার আর কোথাও যেন জায়গা না পেয়ে খুঁজে খুঁজে রকি বীচে এসে হাজির হয় এরা। আজকে আমার জন্মদিন। আর আজই কিনা দেখা হলো এমন একটা জঘন্য চরিত্রের সঙ্গে।
অন্য কোনদিন হলে মহিলার এ কথা শোনার পর আর একটা সেকেন্ডও দাঁড়াতাম না। সোজা ঘুরে হাঁটা দিতাম। কিন্তু আজ আমি নিজের পয়সায় বাজার করতে আসিনি। তাতে সাহস বেড়ে গেছে।
টান দিয়ে পকেট থেকে বাবার আমেরিকান এক্সপ্রেস প্ল্যাটিনাম কার্ডটা বের করলাম। আমার প্রতি জন্মদিনে কেনাকাটা করতে পাঠানোর সময় হাতে তুলে দেয় এটা বাবা, যাতে ইচ্ছেমত খরচ করতে পারি। মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, কিনতে চাইলে নিশ্চয় পরা যাবে? গায়ে ফিট হলো কিনা বুঝব কি করে?
আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে মাথাটা সামান্য একটু নোয়াল মহিলা। ঝাঁকি দিতেও ইচ্ছে করছে না। যেন অতি তুচ্ছ একটা জীব আমি।
ওর সামনে থেকে সরার জন্যে বললাম, তাহলে চেঞ্জিং রামটা দেখিয়ে দিন, প্লীজ।
আমার হাতের প্লাস্টিকের কার্ডটা মনোযোগ দিয়ে দেখল ক্লডিয়া। তারপর কোন কথা না বলে ঘুরে রওনা হয়ে গেল দোকানের পেছন দিকে। কয়েক কদম গিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে বলল, এক সেকেন্ড। আসছি।
সাধারণত এ ধরনের বড় দোকানগুলোকে আমি এড়িয়েই চলি। কিন্তু ব্লাউজটার ওপর চোখ পড়ে গেছে আমার। সেই মে মাস থেকে উইনডোতে ঝোলানো দেখে আসছি। এটা জুন। এতদিনেও রাউজটা মাথা থেকে দূর করতে পরিনি আমি। কি করে পারব? আমার বয়েসী কোন মেয়েই পারবে না। এত সুন্দর জিনিস! কি তার রঙ: খাঁটি বিদ্যুৎ-নীল। হাতা কাটা। হাতে তৈরি লেস আর সিল্কের সুতোর অলঙ্করণ। একটা অদ্ভুত ব্যাপার-মনে হলো, আগে কোথাও দেখেছি ব্লাউজটা। ছোঁয়ার জন্যে, আপন করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলাম।
ক্লডিয়া বলে গেল এক সেকেন্ড, কিন্তু ফিরল পুরো পাঁচ মিনিট পর। মুখটাকে গম্ভীর করে রেখে জানাল, তোমার জন্যে একটা চেঞ্জিং রূম রেডি করতে দেরি হয়ে গেল। এসো।
রেডি করেছে মানে! অবাক হলাম। আমি তো জানতাম পোশাকের দোকানে চেঞ্জিং রূম রেডিই থাকে। ও কি আমাকে চোর ভেবেছে? গোপন ক্যামেরা চালু করে রেখে এসেছে?
*
থাবড়া মেরে দেয়া উচিত ছিল বদমাশ বেটিটার মুখে! বলে উঠল মুসা। ছেদ পড়ল রবিনের পড়ায়। ডায়েরী থেকে মুখ তুলে তাকাল।
যা-ই বলো, মাথা দুলিয়ে বলল জিনা, রিটা লেখে কিন্তু চমৎকার। ভাষা ভাল। একেবারে ছবি দেখিয়ে দেয়। প্র্যাকটিস রাখলে বড় লেখক হতে পারবে।
হুঁ মাথা ঝাঁকাল রবিন।
পড়ো, পড়ো, এরপর কি হয়েছে শোনা যাক।
আবার ডায়েরীর দিকে চোখ নামাল রবিন।
*
চেঞ্জিং রুমে ঢুকে আর একটা মুহূর্তও দেরি করলাম না। ক্যামেরার কথা মাথা থেকে উধাও করে দিয়ে পরে ফেললাম। ব্লাউজটা। এমন ভাবে ফিট করল, যেন আমার জন্যেই মাপ দিয়ে বানানো হয়েছে।
আয়নার দিকে তাকালাম। সত্যি, দারুণ মানিয়েছে আমাকে। তবে দামটা অতিরিক্ত। তিনশো ডলার। একটা ব্লাউজের দাম তিনশো, কল্পনা করা যায়! বাবার পকেট থেকে এতগুলো টাকা খসাতে মায়াই লাগল আমার। কিন্তু কোনমতেই লোভ ছাড়তে পারলাম না। আয়নার দিক থেকেও চোখ সরাতে পারলাম না।
একদৃষ্টিতে প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কি যেন কি ঘটে যেতে লাগল আমার ভেতরে। প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলাম। সাংঘাতিক ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে যেন আমার মধ্যে। ব্লাউজটা আগে কোথাও দেখেছি-বার বার মনে হচ্ছে এ কথাটা। কোথায়? অন্য কোনও দোকানে? কোনও ফ্যাশন শোতে?
উঁহু, দোকানে নয় বা কোন স্টলে নয়! ব্লাউজটা যেন আমারই ছিল, আমি নিজেই পরেছি কোন এক সময়। কিন্তু তা কি করে সম্ভব?
যতই মনে করার চেষ্টা করলাম, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতে লাগল স্মৃতি। ক্যামেরায় তোলা ছবির মত ভেসে উঠল মনের পর্দায়। চোখ বুজে মনের চোখে ছবিগুলো দেখার চেষ্টা করলাম।
জোরাল একটা গুঞ্জন কানে এল। মনে হলো ছাতের কাছ থেকে আসছে। অনেক বেড়ে গেল শব্দটা। মাথার ওপর ফ্লোরেসেন্ট লাইটগুলো মিটমিট করতে করতে নিভে গেল।
অন্ধকার!
হঠাৎ থেমে গেল গুঞ্জন। আলো জ্বলে উঠল আবার।
ভয় পেয়ে গেলাম। ছুটে বেরোলাম বদ্ধ ঘরটা থেকে। ক্লডিয়া যেখানে থাকার কথা, সেখানে নেই। তার জায়গায় অন্য এক মহিলা। চুলের ছাঁট থেকে শুরু করে মেকআপু, জুতো সবই সেকেলে। অনেক পুরানো ফ্যাশন। আরও ঘাবড়ে গেলাম। মগজের গোলমাল হয়নি তো আমার!
ক্লডিয়ার চেয়ে কোন দিক দিয়েই ভাল নয় এই মহিলাটিও। নেম-ট্যাগে নাম লেখা: গ্যারেট। শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, চেঞ্জিং রুমে কি করছিলে?
চেঞ্জিং রুমে কি করছিলাম মানে? আমি অবাক।
আমি জানতে চাইছি, কি পরছিলে?
নাহ, দোকানটার বদনাম না করে আর পারছি না। এখানকার সব কর্মচারীই দেখা যাচ্ছে ক্লডিয়ার মত। ভাল ব্যবহার শেখেইনি। কিছুটা রুক্ষস্বরেই জবাব দিলাম, গায়ে যে ব্লাউজটা দেখছেন, এটাই পরছিলাম।
চারপাশে তাকিয়ে অদ্ভুত সব পরিবর্তন লক্ষ করলাম। কোন কিছুই যেন স্বাভাবিক লাগছে না। ঘটছেটা কি এখানে! কয়েক মিনিট আগে যে ডেকোরেশন দেখে গিয়েছিলাম, সেটা বদলে গেছে। এত তাড়াতাড়ি কি করে বদলাল?
দেখো মেয়ে, ধমকের সুরে বলল গ্যারেট, আমার দোকানের মধ্যে কোন রকম গণ্ডগোল চাই না। যাও, বেরোও!
কিন্তু…আমি…
এক্ষুণি! আরও জোরে ধমকে উঠল গ্যারেট। কি সব পোশাক পরেছে দেখো! বিচ্ছিরি! আমার কাস্টোমাররা তোমাকে দেখে চমকে যাচ্ছে। যাও, যাও, বেরোও!
এতক্ষণে লক্ষ করলাম, দোকানের সব লোক তাকিয়ে আছে আমার দিকে। যেন আমি একটা চিড়িয়া। হাঁ করে দেখছে।
যাচ্ছি। তবে একটা কথা, ম্যাম, বলতে ছাড়লাম না, ওদের চমকে যদি কেউ দিয়েই থাকে, সেটা আমি না, আপনি।
কি বললে?
ঠিকই বলেছি। পাগলের চেয়ে ডাইনীকে অনেক বেশি ভয় করে লোকে।
জবাব আটকে যাওয়ায় মরা মাছের মত হাঁ হয়ে গেল। গ্যারেটের মুখ। প্রতিশোধ নিতে পেরে খুশিমনে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম আমি।
*
পথে বেরিয়ে হতবাক। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো শহরটাই কেমন পাল্টে গেছে। মানুষজন, জিনিসপত্র, সব কিছু এক লাফে যেন ফিরে গেছে তেরো বছর আগে। কি বিচ্ছিরি সব পোশাক পরেছে লোকে। প্যান্ট, জুতো! আহা, কি ছিরি! ওয়াক! বমি আসে দেখলে! আর একটা ব্যাপার, সবাই শীতের পোশাক পরেছে।
সন্দেহ হলো। একটা দোকানে ক্যালেন্ডার ঝোলানো দেখে সেদিকে এগোলাম। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ১৯৮৭-র শীতকাল। এক লাফে এক যুগের বেশি পেছনে চলে এসেছি। অবিশ্বাস্য! এ কি করে সম্ভব!
বোকার মত তাকিয়ে রইলাম রাস্তার লোকজনের দিকে। ওরাও তাকাতে লাগল আমার দিকে। যেন আমি একটা কি!-পাগলা গারদ থেকে এইমাত্র ছাড়া পেলাম। গরমকালের পোশাক পরে আছি আমি। প্রচণ্ড উত্তেজনায় শীতও টের পাচ্ছি না।
মনে হলো, সব রহস্যের জবাব রয়েছে ওই চেঞ্জিং রূমটায়। পায়ে পায়ে আবার মলের দিকে ফিরে চললাম।
মলে ঢুকে এলিভেটরের দিকে এগোনোর সময় দেখলাম, গরম কাপড় পরে ভালুক সেজে যাওয়া একটা ছেলে দোকানের বিজ্ঞাপন করছে। হাতে একগাদা কাগজ। আমার দিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিতে গিয়ে থমকে গেল। কুঁচকে গেল ভুরু। ভাবল বোধহয়, আমি তার প্রতিদ্বন্দ্বী। আজব পোশাক পরে তার জায়গা দখল করতে এসেছি।
ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করলাম না। তার হাত থেকে ছোঁ মেরে একটা কাগজ কেড়ে নিয়ে, একটা মুচকি হাসি উপহার দিয়ে সরে এলাম।
এলিভেটরে উঠলাম। আমি একা। দরজা বন্ধ হতে শুরু করল। ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, এখনও একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটা।
কাগজটার পেছনে পেন্সিলে লেখা রয়েছে কি যেন। দাগ পড়ে গেছে। উল্টে দেখলাম, একটা ফোন নম্বর। ছেলেটারই হবে হয়তো।
দরজাটা পুরো লেগে যাবার পর মাথার ওপরের গুঞ্জনটা কানে এল। আলো মিটমিট করতে লাগল এলিভেটরের। নিভে গেল।
বিদ্যুৎ চলে গেল নাকি! ঘাবড়ে গিয়ে অ্যালার্ম বেলের বোতামটা টিপতে যাব, ফিরে এল আলো। মুহূর্ত পরেই দরজা খুলে গেল। তিনতলার মেঝেতে পা রাখলাম আমি।
বেরিয়ে এসে চারপাশে তাকালাম।
আবার সেই পরিচিত দৃশ্য। আমার পরিচিত পরিবেশ।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
শিওর, আমি অতীতে চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসেছি বর্তমানে। সত্যি কি এসেছি? দোকানটাতে গেলেই বুঝতে পারব।
করিডর ধরে প্রায় দৌড়ে চললাম পোশাকের দোকানটার দিকে। ব্লাউজটা যেখানে ছিল। কিন্তু দুই কদমও এগোতে পারলাম না। সামনে এসে দাঁড়াল দুজন গার্ড।
এই মেয়েটাই, বলল একজন।
খপ করে আমার হাত চেপে ধরে টান দিল দ্বিতীয় গার্ড, এসো আমার সঙ্গে।
কোথায়? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
গেলেই টের পাবে, খুকী!
খুকী খুকী করছেন কেন আমাকে। রেগে উঠলাম। আমার বয়েস কি খুব কম মনে হচ্ছে?
কথার জবাব দিল না ওরা। একজন ওয়াকিটকি বের করে কারও উদ্দেশ্যে কথা বলল, পেয়েছি ওকে। ধরে নিয়ে আসছি…
*
রবিন এ পর্যন্ত আসতেই বাধা দিয়ে মুসা বলে উঠল, দেখো, ভাই, আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে! গলা শুকিয়ে গেছে! কোক টোক কিছু যদি থাকে, এনে দাও জলদি! খেলে হয়তো সহ্য করতে পারব।…বাপরে বাপ, কি কাণ্ড!
হ্যাঁ, অবাক হওয়ার মতই ঘটনা! বিড়বিড় করল জিনা।
আমি কিন্তু অবাক হচ্ছি না, ডায়েরীটা খোলা অবস্থায়ই সোফায় উপুড় করে রাখল রবিন। সেদিন লেকের পাড়ে ইউ এফ ওটা দেখার পর থেকে অবাক হওয়া ছেড়ে দিয়েছি। কোন কথাই আর অবিশ্বাস করব না। চোখের সামনেই তো তুলে নিয়ে গেল ওরা কিশোরকে।
উঠে রান্নাঘরে চলে গেল রবিন। আভন থেকে বের করা গরম বার্গার, আর ফ্রিজ থেকে কোক নিয়ে ফিরে এল। সামনের টেবিলে। রেখে মুসার দিকে তাকাল, খাও।
একটা বার্গার তুলে নিল জিনা। গেলাসে কোক ঢালল।
ডায়েরীতে কি লেখা আছে জানার জন্যে অস্থির হয়ে গেছে ওরা। তাড়াতাড়ি গপগপ করে গিলে নিয়ে খাওয়া শেষ করল।
ডায়েরীটা আবার তুলে নিল রবিন।
মুসার দিকে তাকাল জিনা। পড়ার সময় আর বাধা দেবে না, বুঝলে! তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করতে না পারলে রিটার সঙ্গে আলোচনায়ও বসা যাবে না। যত জলদি সম্ভব, খুঁজে বের করতে হবে কিশোরকে।
কিন্তু কোথায় আছে কিশোর? মুসার প্রশ্ন।
কাচু-পিকচুতে। জানা থাকলে, জবাব দিতে পারত জিনা।
.
০২.
ভারী লাগামটা খচ্চরের পিঠের ওপর দিয়ে টেনে এনে শপাং করে বাড়ি মারল কিশোর।
হাঁট, শয়তান কোথাকার! রাগে চিৎকার করে উঠল সে। লাঙলের হাতল ধরে ঠেলা দিল জোরে। মাথা ঘুরিয়ে খচ্চরটাকে চোখে চোখে তাকাতে দেখে রাগ আরও বেড়ে গেল।
হাঁট! টান দে! আরও জোরে খচ্চরের পিঠে বাড়ি মারল সে।
আস্তে এক পা বাড়াল জানোয়ারটা। তারপর আরেক পা।
পিছে পিছে হাঁটতে থাকল কিশোর। লাঙল ঠেলতে ঠেলতে ব্যথা হয়ে গেছে হাত। কাধ পোড়াচ্ছে চড়া রোদ। সকালটা অর্ধেক শেষ। সূর্যোদয় থেকে পরিশ্রম করে এতক্ষণে মাত্র দুটো ফালি চাষ দিতে পেরেছে।
এ ভাবে চললে খামারটা খোয়াতে হবে। ভাবনাটা শঙ্কা জাগাল মনে। এই খামারে জন্মায়নি সে। বাপ-দাদা চোদ্দ পুরুষে। কখনও হালচাষ করেনি। কিন্তু তাকে করতে হচ্ছে, পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে।
পিঠ বেয়ে দরদর করে নামছে ঘাম। শার্টের হাতা দিয়ে ভুরুর ঘাম মুছল। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি বা লেমোনেড পেলে খখসে। গলাটা ভেজানো যেত।
কিন্তু থামার সময় নেই। এগিয়ে যেতে হবে। খেতের শেষ প্রান্তের দিকে তাকাল। ভুলে থাকতে চাইল পানির কথা।
থেমে গেল আবার খচ্চরটা। টানতে চাইছে না আর। থুতনি। বুকের কাছে নেমে এল কিশোরের। জানোয়ারটাকে সামলাতে গিয়ে পরিশ্রম যা হচ্ছে, তার চেয়ে নিজে টানলেও বোধহয় কষ্ট কম হত।
মাথার দোমড়ানো বাদামী হ্যাটটা খুলে নিয়ে রাগ করে মাটিতে আছড়ে ফেলল সে। গরম বাতাসে উড়িয়ে এনে মুখের ওপর ফেলতে লাগল বহুদিনের না কাটা লম্বা, কোকড়া চুলগুলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুহাত পেছনে এনে কোমরে চাপ দিল। আগুনের মত পুড়িয়ে দিল যেন তীব্র ব্যথা। যতই দিন যাচ্ছে, পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে আরও। ফোঁস করে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল, মিস্টার হার্ট, খচ্চরটাকে একটু হটতে বলুন, প্লীজ!…আপনি বললেই ও হাঁটবে। আপনার কথা শোনে। আমাকে পাত্তাই দেয় না।
বাড়ির দিকে তাকাল কিশোর। বিশাল ওক গাছটার নিচের কবর ফলক দুটো এখান থেকেও দেখা যায়। রোদের মধ্যেও গায়ে। কাটা দিল তার। ইনডিয়ান দম্পতির মৃত্যুটা এখনও তার কাছে রহস্যময়।
নিজের অজান্তেই বুজে এল চোখের পাতা। সিসি আর হেনরিকে দেখতে পেল কল্পনায়। আবার চোখ মেলল। বিশাল বাড়িটাতে ওই দুটো ছেলেমেয়েকে নিয়ে একা থাকতে হয় তাকে।
কানে বাজতে লাগল লং জন হার্টের যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠ: ছেলেমেয়ে দুটোকে তুমি দেখো, কিশোর! তোমার হাতে তুলে দিয়ে গেলাম ওদের!
যে বিকেলে মারা গেছেন হার্ট আর তার স্ত্রী কোরিনা, সেই বিকেলটা এখনও জ্বলজ্বলে তার স্মৃতিতে। ধূসর মেঘ জমেছিল আকাশে। ঠাণ্ডা বাতাসে ভেসে আসছিল বৃষ্টির গন্ধ। কাঠের দোতলা বাড়িটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল সে। তাকিয়ে দেখছিল, স্ত্রীকে ওয়্যাগনে উঠতে সাহায্য করছেন হার্ট। দূরের এক আত্মীয় বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানে যাবেন।
ওয়্যাগনে বসে মাথার টুপিটার ফিতে বেঁধেছেন কোরিনা। ফিরে তাকিয়েছেন কিশোরের দিকে, বাবা, ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখো। পারবে না?
মাথা ঝাঁকিয়েছে কিশোর।
সিসি আর হেনরিকে বলেছেন কোরিনা, তোমাদের কিশোর ভাইয়ের কথা শুনবে তোমরা। কি, বুঝতে পেরেছ? নইলে কিন্তু আমরা ফিরে আসার পর কোন উপহার পাবে না।
মুখ গোমড়া করে সামান্য মাথা ঝাঁকিয়েছে সিসি। হেনরি কোন কথা বলেনি। কুটি করে আপনমনে ছেঁড়া একটা কাপড়ের তৈরি খেলনা ক্রমাগত ঘুরিয়েছে ছোট ছোট আঙুলে। গাল ফুলিয়ে আদুরে কণ্ঠে অনুরোধ করেছে, আমরাও তোমাদের সঙ্গে যাব, কোরিআন্টি।
হেনরি, তোমাকে সিসি আর কিশোরের সঙ্গে এখানেই থাকতে হবে, কঠোর হয়েছেন কোরিনা। লক্ষ্মী ছেলের মত থাকো। আসার সময় তোমাদের জন্যে অনেক কিছু নিয়ে আসব আমরা।
অনেক কিছু তো চাই না আমরা, হিসিয়ে উঠেছে সিসি। আমরা তোমাদের সঙ্গে যেতে চাই।
সিসি আর হেনরির কাঁধে হাত রেখেছে কিশোর। থাক, যাবার দরকার নেই। নিতে যখন চাইছেন না কোরিআন্টি, নিশ্চয় কোন কারণ আছে। এখানেই থাকো তোমরা, আমার সঙ্গে। আমাকে খারাপ লাগে?
জোরে জোরে মাথা নেড়েছে হেনরি আর সিসি।
না না, তোমাকে খুব ভাল লাগে আমাদের, কিশোরভাই, সিসি বলেছে। তোমাকে নিয়ে আমরা সবাই যদি আন্টিদের সঙ্গে যেতে পারতাম, আরও ভাল লাগত।
সকাল থেকেই কোরিনার পিছে লেগে থেকেছে দুই ভাই বোন। কতভাবে অনুরোধ করেছে সঙ্গে নেয়ার জন্যে। কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু আন্টি অটল। কোনমতেই রাজি হননি। কিশোর বুঝেছে, বাধা না থাকলে সিসি আর হেনরিকে সঙ্গে না নিয়ে যেতেন না। ওদের বাবা-মা নেই। কোথায় আছে-মারা গেছেন না। বেঁচে আছেন, সেটাও আরেক রহস্য। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেও কোন জবাব বের করতে পারেনি কিশোর। হার্টদের সঙ্গে সিসি বা হেনরির রক্তের সম্পর্ক নেই। কিন্তু বাবা-মায়ের অবর্তমানে বাবা মার মতই স্নেহ দিয়ে দুজনকে বড় করতে চেয়েছেন ওই ইনডিয়ান দম্পতি। সুতরাং নেননি যখন, বোঝাই গেছে-সঙ্গে নেয়ার উপায় ছিল না।
সিসির বয়েস তেরো। হেনরির ছয়। কিশোরের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এমন করে গিয়ে সিঁড়িতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিল দুজনে, মায়াই লাগছিল কিশোরের। দুজনেরই কালো চুল। দুজনেরই কান্নাভেজা সবুজ চোখের তারায় জ্বলছিল রাগের আগুন।
নিশ্চিন্তে চলে যান আপনারা, হেসে বলেছে কিশোর। সিসি আর হেনরি ঠিকমতই ঘরের কাজ করবে, সকাল সকাল ঘুমাতে যাবে…
তার দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে ভেঙচি কেটেছে সিসি, হেসেছে কিশোর।
ঘোড়ায় টানা ওয়্যাগনে সামনের বেঞ্চসীটে উঠে বসেছিলেন হার্ট। চাকার ব্রেক ছেড়ে কিশোরের দিকে ফিরে বলেছেন, শনিবার নাগাদ ফিরব।
ঘোড়া চালানোর জন্যে চাবুক মারার দরকার পড়ত না হার্টের। লাগাম তুলে সামান্য টান দিতেই কোন রকম প্রতিবাদ না করে চলতে শুরু করেছে চারটে ঘোড়া।
ওঁদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়েছে কিশোর। সিসি আর হেনরিকে নাড়তে বলেছে।
না, নাড়ব না! রাগ করে হাত দুটো কোলের কাছে গুটিয়ে নিয়েছে সিসি।
নাড়ব না! বোনের দেখাদেখি হেনরিও একই ভাবে হাত গুটিয়ে নিয়েছে।
আমি ওদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম, সিসি বলেছে, নিল! রাগ করে পা ঠুকল সিঁড়িতে।
নিল না! দেখাদেখি হেনরিও পা ঠুকেছে।
হঠাৎ, আকাশের বুক চিরে দিয়ে গেল বিদ্যুৎ-শিখা। শোনা গেল বজের চাপা গুড়গুড় শব্দ। কিশোরের মনে হচ্ছিল পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে। তীব্র গতিতে পিঠে ঝাঁপটা দিচ্ছিল বরফের মত শীতল ঝোড়ো হাওয়া।
ঘোড়াগুলোর আর্তচিৎকার কানে আসতে আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছে কিশোর। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে চারটে ঘোড়াই। খুর দিয়ে বাতাস খামচে ধরতে চাইছিল যেন। পরক্ষণেই মাটিতে পা নামিয়ে পাগলের মত লাফ মেরেছে সামনের দিকে।
মরিয়া হয়ে লাগাম টেনে ওগুলোকে সামলানোর চেষ্টা করেছেন হার্ট। চিৎকার করে ডেকে ডেকে শান্ত করতে চেয়েছেন।
লাফ দিয়ে বারান্দা থেকে ছুটে গেছে আতঙ্কিত কিশোর।
চিৎকার করে ঘোড়াগুলোকে থামতে বলেছে। কিন্তু বিফল হয়ে বাতাসে ভেসে গেছে তার ডাক। হার্টই যেখানে থামাতে পারেননি, সে থামাবে কি?
টানতে টানতে গভীর খাদের দিকে ওয়্যাগনটাকে নিয়ে গেছে। ঘোড়াগুলো পড়লে নিজেরাও যে মরবে সে-খেয়াল ছিল না। টান সামলাতে না পেরে, ঝাঁকুনি লেগে চিত হয়ে পেছনে উল্টে পড়ে গিয়েছিলেন হার্ট। ওয়্যাগনের ধার আঁকড়ে ধরেছিলেন কোরিনা। হ্যাচকা টানে মাথার টুপিটা উড়িয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল বাতাস, ফিতে বাঁধা থাকায় পারেনি, ফাঁসের মত গলায় টান দিচ্ছিল সেই ফিতে। বাতাসে উড়ছিল লম্বা চুল।
কোনমতেই থামানো যায়নি ঘোড়াগুলোকে। সোজা ধেয়ে গিয়েছিল খাদের দিকে। ডিগবাজি খেয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল পাড়ের ওপাশে।
অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে কিশোরকে। সাহায্য করার কোন সুযোগ ছিল না।
.
০৩.
দুর্ঘটনাটা নিয়ে অনেক ভেবেছে কিশোর। হাজার ভেবেও কোন কূলকিনারা পায়নি। কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করল ঘোড়াগুলো? বিদ্যুৎ চমকাতে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল? নাকি বজের শব্দে ভয় পেয়েছিল?
সূত্র খুঁজে বেড়িয়েছে কিশোর ভাঙা গাড়িটায়, খাদের ওপরে, খাদের নিচে। কিছুতেই বুঝতে পারেনি, ঘোড়াগুলোর ওভাবে হঠাৎ খেপে যাওয়ার কারণ। রহস্যটা এখনও অমীমাংসিত।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপারটা হলো, কোন প্রাণীর ওপর হার্টকে এ ভাবে নিয়ন্ত্রণ হারাতে আর দেখেনি সে। বরং উল্টোটাই দেখেছে। সব জানোয়ার তাঁর কথা শুনত। গৃহপালিত তো বটেই, বনের জানোয়ারও তার কথা অমান্য করত না। করত যে না, সেটা তো কিশোর নিজের চোখেই দেখেছে। জানোয়ারে কথা না শুনলে আজ সে এখানে থাকত না, কোনদিন ওদের খাবার হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যেত।
মনে পড়ল রকি বীচের সেই দিনটির কথা। ভুল তারিখে তার জন্মদিন করে ফেলেছিলেন মেরিচাচী। ভুলটা যে কি করে করলেন তিনি, সেটাও এক রহস্য। আর যারই হোক, কিশোরের জন্মদিনের তারিখ নিয়ে অন্তত মেরিচাচীর ভুল হওয়ার কথা ছিল না। রহস্যটা ভেদের সুযোগই পায়নি কিশোর।
জন্মদিনে নতুন ক্যামেরা উপহার পেয়েছিল সে। সেই ক্যামেরা নিয়ে লেকের পাড়ের বনে ইউ.এফ. ওর ছবি তুলতে গিয়েছিল। আকাশে বিচিত্র মেঘ দেখেছিল। দেখেছিল রঙিন ফানেল। তারপর অন্ধকার। অন্ধকার কেটে গেলে শুরু হলো দুঃস্বপ্ন…মস্ত এক কাঁচের পাইপে ভরে রাখা হয়েছে তাকে…পালাল সে ওটার ভেতর থেকে…বিশাল ল্যাবরেটরির মধ্যে দিয়ে ছুটল…বেরোতে পারল না, ধরে ফেলা হলো তাকে…আবার পালাল…আবার ধরা পড়া…আবার। পালানো…আবার ধরা…শেষে নেতা গোছের লোকটা মহাখাপ্পা হয়ে তার সহকারীদের বলল-ভয়ঙ্কর ছেলে; একে এখানে রাখা যাবে না। এমন কোথাও রেখে এসো, যেখানে মুক্তও থাকবে আবার বন্দিও থাকবে, আমাদের খপ্পর থেকে কোনমতেই বেরিয়ে যেতে পারবে না…লোকটার মুখে ডাক্তারদের মাস্ক ছিল, চেহারা বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু কণ্ঠস্বরটা চেনা চেনা-কোথায় শুনেছে ওই কণ্ঠ, স্বপ্নের মধ্যে মনে করতে পারেনি কিশোর…
তারপর আর কিছু মনে নেই। হুঁশ ফিরলে দেখল, একটা বনের মধ্যে পড়ে আছে সে। অন্ধকার হয়ে গেছে তখন। নানা রকম বুনো জানোয়ারের ডাক কানে আসতে লাগল। হঠাৎ দেখল, মাত্র কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে লাল চোখ মেলে তাকে দেখছে একটা বিশাল নেকড়ে। হাঁ করা মুখ থেকে ঝুলছে টকটকে লাল জিভ। অসংখ্য ধারাল দাঁত যেন তাকে ছিঁড়ে খেতে প্রস্তুত।
এটাও কি আরেক দুঃস্বপ্ন? নিজের বাহুতে চিমটি কেটেছে কিশোর। ব্যথা পায়নি। না, স্বপ্ন নয়, ভয়ঙ্কর বাস্তব।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। দৌড় দিতে গিয়ে লক্ষ করল, একটা নয়, একপাল নেকড়ে ঘিরে ফেলেছে তাকে। গাছে ওঠারও সময় পাবে না সে। ছুটে এসে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। নেকড়েরা।
তারমানে নিশ্চিত মৃত্যু। চোখ বুজে অপেক্ষা করতে লাগল। কিশোর, ধারাল দাঁতগুলো কখন তার গায়ে বেঁধে!
বিঁধল না। কানে এল মানুষের ফিসফিসে চাপা কণ্ঠ। চোখ মেলে দেখল অবিশ্বাস্য দৃশ্য। একজন মানুষ। ইনডিয়ান। পরনে শুধু প্যান্ট। গায়ে কিছু নেই। লম্বা লম্বা চুল। কথা বলছেন নেকড়েগুলোর সঙ্গে। পোষা কুকুরের মত তার পায়ের কাছে লুটোপুটি খেতে শুরু করেছে নেকড়েগুলো। এ যেন আরেক টারজান!
কিশোরকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে এলেন হার্ট। আরও চমক অপেক্ষা করছিল কিশোরের জন্যে। হতবাক হয়ে গেল, যখন জানতে পারল দক্ষিণ আমেরিকায় রয়েছে সে। অ্যান্ডিজের পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড় ঘেরা একটা অতি দুর্গম শহর-কাচু-পিকচুতে।
বোকা হয়ে গিয়েছিল। এখানে এল কি করে সে? ইউ এফ ও তো নিয়ে যায় ভিনগ্রহে। পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়ার কথা নয়!
তাকে পাগল ভাববে মনে করে হার্টকে সত্যি কথাটা বলল। বলল না, দুনিয়ায় তার কোন আত্মীয়-স্বজন নেই। ভাগ্যের সন্ধানে বেরিয়েছে। বানিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার একটা শহরের নাম বলে দিল।
সেই থেকেই এ বাড়িতে আছে কিশোর। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকবার গেছে সেই বনে, যেখানে নেকড়ের কবলে পড়ে মরতে বসেছিল। বহু খোঁজাখুঁজি করেছে, সূত্র খুঁজেছে। এক জায়গায় মাটিতে বসে যাওয়া ছয়টা ছোট ছোট বিচিত্র গর্ত ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি। মনে হয়েছে, ভারী কিছুর পায়ের চাপে তৈরি হয়েছে গর্তগুলো…
জানোয়ার বশ করার ক্ষমতাটা হার্টের কাছ থেকে রপ্ত করেছে সিসি। হাতে ধরে তাকে শিখিয়েছেন হার্ট। চেষ্টা করলে হয়তো কিশোরও শিখে নিতে পারত। কিন্তু কে জানত এমন বিপদে পড়বে! না শিখে এখন আফসোস হচ্ছে। বিদ্যেটা জানা থাকলে পাজি, কর্মবিমুখ, বেয়াড়া খচ্চরটাকে কাজ করাতে অসুবিধে হত না এখন। এটাকে দিয়েই তো দিব্যি হাল টানাতেন লং হার্ট, কোনই সমস্যা হত না। জানোয়ারটা কথা শুনত তার…
বাস্তবে ফিরে এল আবার কিশোরের মন। চারপাশে ছড়ানো জমিটার দিকে তাকিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল। সন্দেহ হচ্ছে, কোনদিনই হাল দিয়ে শেষ করতে পারবে না। ফসল বোনা তো দূরের কথা।
কি করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। খামারটা বাঁচানোর কোন উপায়ই মাথায় ঢুকছে না। নেকড়ের কবল থেকে বাঁচিয়ে এনে বাড়িতে জায়গা দেয়ায় হার্টের কাছে কৃতজ্ঞ সে। মৃত্যুকালে তাকে কথা দিয়েছে, সিসি আর হেনরিকে দেখবে। কথা যদি না-ও দিত, তাহলেও অসহায় ছেলেমেয়ে দুটোকে বাড়িতে একলা ফেলে চলে যেতে পারত না সে। যাওয়াটাও মুখের কথা নয়। যেখানে রয়েছে, সেখান থেকে বেরোতে হলে প্রচুর টাকা দরকার। তার কাছে আছে মোটে বিশ হাজার চিলিয়ান পেসো, আমেরিকান ডলারে এর মূল্যমান পঞ্চাশ ডলারেরও কম। বাড়ির আলমারিতে সামান্য যা ফেলে গিয়েছিলেন হার্ট, তার অবশিষ্ট। এত কম টাকা দিয়ে কোনমতেই বড় শহরে পৌঁছতে পারবে না তিনজনে। তারপর আরও ঝামেলা আছে। রকি বীচে ফিরতে হলে পাসপোর্ট দরকার। সে-সব জোগাড় করতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। কিভাবে এসেছে এখানে, বোঝাতে হবে কর্তৃপক্ষকে। সব কিছুর জন্যেই মোটা টাকা প্রয়োজন।
মিস্টার গ্যারিবাল্ডের কথা ভাবল। এখানকার ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। গতকাল এসেছিল দেখা করতে। বলা ভাল, ধমকাতে।
লোকটার কথা মনে হতেই ভয়, আর রাগ একসঙ্গে মাথাচাড়া দিল মনে। হুমকি দিয়ে গেছে, সময় মত কিস্তি শোধ করতে না পারলে বাড়িঘর সব দখল করে নেবে। ওই চামারটার কাছ থেকে জমিটা ইজারা নিয়েছিলেন হার্ট। বাড়িঘর হাতছাড়া হলে নিজের ব্যবস্থা নাহয় একটা করে নিতে পারবে কিশোর, কিন্তু পথে বসবে সিসি আর হেনরি। কি হবে ওদের?
মনকে শক্ত করল সে। এখন টাকা জোগাড়ের একটাই উপায়, ফসল ফলানো। খচ্চরের পিঠে আবার বাড়ি মারল, লাগাম দিয়ে। হাট, ব্যাটা, খচ্চরের বাচ্চা! তোর জন্যে সারাদিন খেতে পড়ে থাকব নাকি?
বাড়ি খেয়ে চিৎকার করে উঠল জানোয়ারটা। এক পা আগে বাড়াল।
হ্যাঁ, থামবি না, সাবধান করল কিশোর। লাঙলের হাতলে শক্ত হলো আঙুল। ফালের খোঁচায় কেটে দুদিকে উল্টে পড়তে শুরু করল আবার কালো মাটি।
দেহের প্রতিটি পেশি টানটান হয়ে ছিঁড়ে পড়তে চাইছে। কিন্তু পরোয়া করল না আর কিশোর।
ডাক শুনে ফিরে তাকাল সে। দৌড়ে আসতে দেখল সিসিকে। কাঁধে নাচছে কালো বেণী। পেছন পেছন আসছে হেনরি।
মোচড় দিয়ে উঠল কিশোরের পেট। দৌড়ানোর ভঙ্গিটা ভাল লাগল না তার। খারাপ কিছু ঘটল নাকি!
লাঙলের হাতল ছেড়ে দিয়ে ওদের দিকে দৌড় দিল সে। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে, সিসি? কি ব্যাপার?
দাঁড়িয়ে গেল সিসি। হাসল। না না, কিশোরভাই, ভয় পেয়ে না। খারাপ কিছু হয়নি।
দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। তাহলে ওরকম চিৎকার করছিলে কেন?
ঝিক করে উঠল সিসির সবুজ চোখের তারা। আমাদের শহরে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল না আজ তোমার, মনে নেই?
সরি, সিসি, আজ পারব না। অনেক কাজ পড়ে আছে, খেতের দিকে হাত তুলে দেখাল কিশোর।
কালো হয়ে গেল সিসির সবুজ চোখের তারা। উধাও হয়ে গেছে হাসি। মুখ নিচু করে বলল, কিন্তু তুমি আমাদের নিয়ে যাবে কথা দিয়েছিলে!
দিয়েছিলাম। কিন্তু…
প্যান্ট খামচে ধরে টান দিল হেনরি। মুখ তুলে তাকাল কিশোরের দিকে। চোখে টলমল করছে পানি। সবুজ দৃষ্টিতে কাতর অনুনয়।
তুমিও শহরে যেতে চাও?
নীরবে মাথা ঝাঁকাল হেনরি। হার্ট দম্পতি মারা যাওয়ার পর থেকে কোন কথা বলে না সে। প্রচণ্ড শ পেয়েছে বোধহয়। কথা বন্ধ হয়ে গেছে।
মাটিতে বসে পড়ল কিশোর। টোকা দিয়ে একটা লাল রঙের গুবরে পোকা ফেলল হেনরির পা থেকে। পরনের ওভারঅলটা অতিরিক্ত খাটো হয়ে গেছে ওর। সিসির দিকে তাকাল। বড় বড় ফুলওয়ালা নীল পোশাকটা মলিন, বিবর্ণ। ফসল ঘরে না ভোলা পর্যন্ত কাপড় কিনে দেয়ার উপায় নেই।
জানি, শহরে যাওয়ার বড় শখ তোমাদের, কিশোর বলল। কিন্তু জমি না চুষলে ফসল বোনা যাবে না। ফসল না হলে জায়গা-জমি বাড়ি-ঘর সব হারাতে হবে আমাদের।
কিন্তু, কিশোরভাই, পাশে বসে কিশোরের হাত খামচে ধরল সিসি। সবুজ চোখে উত্তেজনা। টাকার জন্যেই তো যেতে চাইছি আমি। ভাবছি, ঘোড়দৌড়ে আমিও অংশ নেব। প্রথম পুরস্কার এক লাখ পেসো আমিই পাব, দেখো। আমি জানি, আমি জিতব!
এক লাখ! প্রতিধ্বনি করল যেন কিশোর। টাকাটা পেলে ফসল ওঠা পর্যন্ত কোনমতে চালিয়ে নিতে পারবে সংসার।
সত্যি কি জিততে পারবে সিসি?
পারবে না। এত এত প্রতিযোগী রয়েছে। তাদের সঙ্গে সিসির জেতা, টাকা পাওয়া, সংসার চালানো…দূর! ছেলেমানুষী চিন্তা।
দেখো, সিসি, বোঝাতে গেল সে, আমি জানি, তুমি ঘোড়ায়। চড়ার ওস্তাদ। কিন্তু অন্য ওস্তাদেরাও আসবে। তাদের সঙ্গে পারবে না।
ঝটকা দিয়ে হাতটা সরিয়ে নিল সিসি। জ্বলন্ত চোখে তাকাল। আমি জিতব! আমি জিতব! আমি জিতব! তুমি যদি আমাকে নিয়ে যেতে না চাও, আমি একলাই যাব।
এতদিনে এই দৃষ্টির অর্থ জানা হয়ে গেছে কিশোরের। একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সিসি, কোনভাবেই আর ঠেকাতে পারবে না তাকে। এ ধরনের গোয়ার্তুমি কিশোরের। নিজের মধ্যেও আছে। আরেকজনকে বুঝিয়ে লাভ নেই। উঠে দাঁড়াল সে। দাঁড়াও, হ্যাটটা নিয়ে আসি।
.
০৪.
হেনরিকে কাঁধে বসিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে চলল কিশোর। পাশে পাশে হাঁটছে সিসি। টানতে টানতে নিয়ে চলেছে তার প্রিয় ঘোড়াটাকে। ঘোড়াটা কালো। নাম গোস্ট। পিঠে চড়েই যেতে পারত সিসি, কিন্তু দৌড়ের আগে গোউকে ক্লান্ত করতে চায় না।
সিসির জেতার সামান্যতম সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আর কিছু বলল না কিশোর। শহরে গেলে সিসি নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। জেতার কল্পনাটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।
শহরের কাছাকাছি হতে লোকের হট্টগোল আর ব্যান্ডের বাজনার শব্দ কানে এল। চৌরাস্তায় এসে মেইন রোডে উঠল ওরা। প্রধান সড়কটাও কাঁচা। রাস্তার ওপরে উঁচুতে আড়াআড়ি ভাবে ব্যানার টানানো হয়েছে। লোকে-লোকারণ্য। কাঠের তৈরি সারি সারি দোকান। দরজায় বড় করে লেখা নোটিশ ঝুলছে: ঘোড়দৌড়ের জন্যে দোকান বন্ধ।
রাস্তার পাশে টানানো সাইনবোর্ড পড়ে জানা গেল ঘোড়দৌড় হবে মেইন রোডে। বেলা ১টায়। ঘড়ি নেই কিশোরের হাতে। কোথায় হারিয়েছে, তা-ও মনে করতে পারল না; জন্মদিনে পাওয়া ক্যামেরাটার মত। জোর করে মন থেকে দূর করল রকি বীচের ভাবনা। ভাবলে ভীষণ কষ্ট হয়। সূর্য দেখে অনুমান করল একটা বাজতে আর বেশি দেরি নেই।
দারুণ, তাই না? উত্তেজনায় গলা কাঁপছে সিসির। মনে হচ্ছে আশপাশের অঞ্চলের আর কেউ নেই ঘরে, সব ঝেঁটিয়ে চলে এসেছে রেস দেখতে।
পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে টাউন হলের দিকে তাকাল সে। বারান্দা আর সিঁড়িতে দাঁড়ানো কিছু লোক। হাসাহাসি করছে, কথা বলছে। পিপার ওপর দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। দুহাতে মাথার ওপর তুলে রেখেছে একটা বোর্ড। তাতে লেখা: ঘোড়দৌড়ে আগ্রহীরা এখানে এসে নাম লেখান।
নামটা লিখিয়ে আসি, সিসি বলল।
সিসির হাত থেকে লাগামটা নিয়ে নিল কিশোর। তুমি যাও। আমি গোস্টকে নিয়ে এগোচ্ছি। এক কাধ থেকে অন্য কাঁধে সরাল হেনরিকে। সিসির পিছে পিছে চলল।
বারান্দায় দাঁড়ানো লোকটাকে বলল সিসি, আমি নাম লেখাতে চাই।
মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল বারান্দার হট্টগোল। সবার চোখ সিসির দিকে। যেন আরেকটা মাথা গজিয়েছে ওর।
চওড়া কাঁধওয়ালা লম্বা এক যুবক এগিয়ে এল সামনে। মেয়েমানুষ। তুমি রেস খেলবে কি?
নিজের নাকের ডগা টিপে ঘাম মুছল সিসি। কোথায় লেখা আছে সে-কথা, জন ফ্রেঞ্চ?
গাঢ় লাল চুলে আঙুল চালাল যুবক। লেখা নেই, কিন্তু নিয়ম কানুন সব মুখস্থ আমাদের। মেয়েমানুষ নেয়া হবে না।
অ, তাই নাকি। জানো যে, আমি খেললে জিততে পারবে। ভয়ে নিতে চাইছ না।
চোখের পাতা সরু হয়ে গেল জনের। তোমাকে ভয় পাব কেন! ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে কেউ পারে না।
এগিয়ে গেল কিশোর। সে জানে, শহরের সবাই ফ্রেঞ্চদের ভয় পায়। এলাকার সবচেয়ে ধনী পরিবার। টাকা আর ক্ষমতার জোরে যে কাউকে ঘাড় ধরে বের করে দিতে পারে এ শহর থেকে। এখানকার স্থানীয় নয় ওরা। সেই সতেরোশো সালে উত্তর আমেরিকা থেকে এসেছিল ওদের পূর্বপুরুষ। ওদের দেখতে পারে না কিশোর, বিশেষ করে দুই ভাই জন ফ্রেঞ্চ আর মার্ক ফ্রেঞ্চকে। কেউ যদি না-ই পারে, নিতে এত ভয় পাচ্ছেন কেন?
আরে নিয়ে নাও, বলে উঠল আরেকটা ভারী কণ্ঠ।
সবগুলো চোখ ঘুরে গেল সেদিকে। দুটো সোনালি রঙের ঘোড়ার লাগাম ধরে টাউন হলের দিকে এগিয়ে আসছে মার্ক ফ্রেঞ্চ। হাঁটার তালে তালে ঢেউ খেলছে ঘোড়াগুলোর শক্তিশালী। পেশিতে।
দাও ওকে একটা সুযোগ, সিসিকে দেখাল মার্ক। খেলুক না। বুঝুক কেমন মজা।
দমে গেল কিশোর! ঘোড়া দুটো দেখেই বুঝে গেছে, ওগুলোর সঙ্গে পারতে হলে অলৌকিক ক্ষমতা লাগবে সিসির।
খুশিতে চিৎকার করে উঠল সিসি। থ্যাংকস, মার্ক। যাও কথা দিলাম, তোমাকে বেশি পেছনে ফেলব না আমি।
সিসির আত্মবিশ্বাস অবাক করল কিশোরকে। ভাবল, বড় বেশি ছেলেমানুষ।
বারান্দায় দাঁড়ানো একজন লোক হাত নেড়ে ডাকল সিসিকে। বড় একটা চকবোর্ড দেখাল। রেসে অংশগ্রহণকারীদের নাম লেখা রয়েছে বোর্ডটায়।
নাও, নিচে তোমার নাম লিখে দাও, চক বাড়িয়ে দিল সে।
পরিষ্কার অক্ষরে দ্রুত নিজের নামটা লিখে দিল সিসি।
মার্ক আর জনকে পরস্পরের দিকে তাকাতে দেখল কিশোর। মুচকি হাসি ওদের ঠোঁটের কোণে। শঙ্কিত হলো সে। আল্লাহই জানে, কি ফন্দি করেছে ওরা!
চকের গুঁড়ো কাপড়ে মুছে কিশোরের হাত থেকে লাগামটা নিয়ে নিল সিসি।
কিছুটা সরে এসে কানে কানে সিসিকে বলল কিশোর, ওদের ব্যাপারে সাবধান। ভাবভঙ্গি আমার ভাল লাগছে না।
চোখের তারায় ছায়া পড়ল সিসির। ভঙ্গিই দেখায় ওরকম। ওদের আমি ভয় করি না।
রেসের আগে বেশি কিছু বলে সিসিকে ঘাবড়ে দিতে চাইল না কিশোর। লাগামটা ফিরিয়ে দিল। হেনরিকে বলল, চলো, এমন কোথাও গিয়ে দাঁড়াই, ভালমত যাতে দেখতে পাই।
চিৎকার করে উৎসাহ দিও আমাকে, সিসি বলল।
দেব।
হেনরিকে কাঁধে নিয়ে কোলাহল মুখর জনতাকে ঠেলে পথ করে এগোল কিপোর। কাঁধে কাধ লাগিয়ে রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে দর্শকরা। রাস্তার শেষ মাথার দিকে তাকাল সে। প্রতিযোগীরা তৈরি হচ্ছে। মেইন রোড ধরে সোজা ছুটে যাবে শহরের শেষ মাথায়, সেখানে রাখা একটা পিপা ঘুরে আবার ফিরে যেতে হবে যেখান থেকে শুরু করেছিল সেখানে। রাস্তার মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়ানোই ভাল, দৌড়ের সবটাই তাহলে দেখা যাবে।
দর্শকদের মাঝে এক ভদ্রলোকের ওপর চোখ পড়ল কিশোরের। গুড ডে, মিস্টার রনসন।
ঘুরে দাঁড়ালেন মিস্টার রনসন। তিনিও বিদেশী। এখানকার জেনারেল স্টোরের মালিক। এখানকার বাকি দোকানদারের মত আজকের দিনে তিনিও দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন, কিন্তু গা থেকে সাদা অ্যাপ্রনটা খোলেননি। আরি, কিশোর। আজকাল তো। তোমাকে দেখাই যায় না।
জোর করে মুখে হাসি ফোঁটাল কিশোর, কি করব, এত কাজ।
ভাগ্যিস তোমাকে খুঁজে পেয়েছিল লং হার্ট, নইলে ছেলেমেয়েগুলোর যে কি দুর্দশা হতো ভাবাই যায় না।
অ্যাপ্রনের পকেট থেকে একটা স্যারসাপ্যারিলা স্টিক বের করে হেনরির দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
লোভে চকচক করে উঠল হেনরির চোখ। ছোঁ মেরে প্রায় কেড়ে নিল ক্যান্ডিটা।
হেসে উঠলেন মিস্টার রনসন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, মিস্টার রনসন। কাঁধের ওপর হেনরিকে সোজা করে বসাল আবার কিশোর। ওর আর কি দোষ। কতদিন যে মিষ্টি কিনে দিতে পারি না ওকে।
নিজের ভাইও এতটা করে না, কিশোর। সত্যি তুমি…
কথা শেষ করতে দিল না তাঁকে কিশোর। সিসি এসেছে রেসে অংশ নিতে।
ও জিতলে টাকার সমস্যাটা তোমাদের কমবে, তাই না?
হ্যাঁ। সেজন্যেই আসা। রাস্তার শেষ মাথার দিকে তাকাল আবার কিশোর। ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছে প্রতিযোগীরা। সিসিকে দেখতে পেল। গলায় হাত বুলিয়ে আদর করছে গোস্টকে। হাত তুলে দেখাল কিশোর, হেনরি, ওই যে দেখো, সিসি।
হাততালি দিল হেনরি। বোনের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল।
হেসে সিসিও হাত নেড়ে জবাব দিল।
হার্ট প্রায়ই আমাকে বলত, কিশোরকে বললেন মিস্টার রনসন, জন্তু-জানোয়ারকে বশ করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে সিসির মধ্যে।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। এখানেই দাঁড়াই, কি বলো, হেনরি?
সরে জায়গা করে দিলেন মিস্টার রনসন। হ্যাঁ হ্যাঁ, দাঁড়াও। এসো, ঢুকে পড়ো।…তবে যতই ক্ষমতা থাক, ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে জেতা মুখের কথা নয়। সিসি পারবে না। একেবারেই ছেলেমানুষ সে, ঘোড়াটাও তেমন কিছু না। আমার কি মনে হয়, জানো? যদি পারেও, না জেতাই ভাল হবে সিসির জন্যে। জিততে না পারলে পাগলা কুত্তা হয়ে যাবে দুই ভাই।
.
০৫.
প্রতিযোগীদের ঘোড়াগুলোর সামনে টানটান করে একটা রশি ধরে রেখেছে দুটো ছেলে।
ঘোড়ায় চড়োয় চিৎকার করে উঠল গ্যারিবাল্ড। রেস পরিচালনার দায়িত্ব পড়েছে তার ওপর। শুধু ব্যাংকের মালিকই। নয়, শহরের ভালমন্দ দেখার ভারও তার…
ভালমন্দ! মনটা তেতো হয়ে গেল কিশোরের। ভালটা কখনোই চোখে পড়ে না গ্যারিবান্ডের, কেবল মন্দটাই দেখে-এই যেমন একটা অসহায় পরিবারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার জন্যে। উঠে-পড়ে লেগেছে। গতকাল এসে হুমকি দিয়ে গেছে কিশোরকে। অথচ এখন গোল ভূঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে এমন হাসি হাসছে যেন ঈশ্বরের পাঠানো দেবদূত। গাল দুটোও কুৎসিত রকমের ফোলা লোকটার। ঘেন্না লাগে! থুতু ফেলতে গিয়েও আশেপাশে লোক থাকায় ফেলল না কিশোর।
রশির কাছে এসে দাঁড়াল ডজনখানেক ঘোড়া। লাগাম ধরে তৈরি হয়ে আছে সওয়ারিরা।
ওদের মধ্যে সিসিই একমাত্র মেয়ে। দূর থেকেও ওর রক্তিম গাল দেখে মনের উত্তেজনা আঁচ করতে পারল কিশোর।
উত্তেজনার চেয়ে শঙ্কা বেশি কিশোরের মনে। সিসির দুই পাশে দাঁড়িয়েছে দুই ভাই-জন আর মার্ক। দুদিক থেকে চেপে এসে গোস্টকে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে রশির কাছ থেকে। জুনের বাহুতে ধাক্কা মারল সিসি। হেসে উঠল জন। নিজের ঘোড়া দিয়ে চাপ দিতে লাগল গোস্টের পেটে।
ওদের উদ্দেশ্য বুঝে ভয় পেয়ে গেল কিশোর। রেসে জেতার চেয়ে সিসিকে আহত করার দিকেই যেন ওদের খেয়াল বেশি। ওদের মাঝখানে বড়ই ক্ষুদ্র আর ভঙ্গুর লাগছে বেচারি সিসিকে।
হাত উঁচু করল গ্যারিবাল্ড। হাতে পিস্তল। আকাশের দিকে তাক করে গুলি করল একবার। হাত থেকে রশির দুই মাথা ছেড়ে দিল ছেলে দুটো।
রশিটা মাটিতে পড়ে যেতেই চিৎকার করে উঠল অশ্বারোহীরা। লাগামে টান দিয়ে চাপড় মারল ঘোড়ার গলায়। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল ঘোড়াগুলো। ধুলোর ঝড় উঠল ওগুলোর ছুটন্ত খুরের আঘাতে।
নাকেমুখে ধুলো ঢুকে যেতে কেশে উঠল কিশোর। চোখ বন্ধ করে ফেলল। কানের কাছে চিৎকার করছে উত্তেজিত দর্শকেরা: জোরে, জন! মার্ক, আরও জোরে! রেসে যেন কেবল ওই দুজনই প্রতিযোগিতা করছে।
লোকে ভয় পায় ওদের। মনে মনে অন্য কাউকে সমর্থন করলেও প্রকাশ্যে সেটা জানানোর সাহস নেই। সিসির মত দুর্বল একটা মেয়ের পক্ষ নিলে নিজের বিপদ ডেকে আনা ছাড়া আর কিছু পাবে না।
জোরে জোরে হাততালি দিচ্ছে হেনরি। পা ছুঁড়ছে। ওর খুদে পায়ের লাথি লাগছে কিশোরের বুকে। কাঁধের ওপর তাকে সোজা করে বসাল কিশোর। দর্শকদের ঠেলে এগিয়ে গেল ভালমত দেখার জন্যে।
প্রাণপণে ছুটছে সিসি। দুই পাশে মার্ক আর জন। শুরু থেকেই গোস্টের প্রায় গা ঘেঁষে রয়েছে ঘোড়া দুটো। গোস্টের গায়ে ধাক্কা লাগছে। আগে বাড়ার পথ পাচ্ছে না সিসি।
হঠাৎ, হাত বাড়িয়ে গোস্টের লাগাম ধরে হ্যাচকা টান মারল মার্ক।
এলোমেলো পা ফেলতে শুরু করল গোস্ট। চিৎকার করে জোরে লাগাম টেনে ধরল সিসি।
সিসি! ধরে রাখো! ছেড়ো না! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল কিশোর। পেটের ভেতরে খামচি দিয়ে ধরেছে তার। ঘোড়াটাকে নিয়ে এখন সিসি পড়ে গেলে, দুজনেই মরবে, অন্য ঘোড়াগুলোর পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে।
নিষ্ঠুর, কুৎসিত হাসি দেখতে পেল দুই ভাইয়ের মুখে।
সামলে নিয়েছে গোস্ট। তাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে সিসি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। প্রায় সবগুলো ঘোড়াই এখন গোস্টকে পার হয়ে চলে গেছে। আগে বাড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সিসি। ঘোড়ার কাধ ডলে, পেটে পায়ের গুঁতো মেরে জোরে ছোটার ইঙ্গিত করছে।
গতি বাড়তে লাগল ঘোড়াটার। বাতাসে উড়ছে সিসির বেণী। দেখতে দেখতে ধরে ফেলল সামনের ঘোড়াটাকে। দ্রুত পাশ কাটাল ওটার। তারপর আরেকটার। আরও একটার। সামনে নুয়ে পড়ল সিসি। গোস্টের ঘামে ভেজা চকচকে কাঁধের ওপর নেমে এসেছে থুতনি।
কি করছে ও? অবাক হলো কিশোর। সিসির ঠোঁট যে নড়ছে কোন সন্দেহ নেই তাতে। যেন ফিসফিস করে কথা বলছে ঘোড়াটার সঙ্গে।
স্তব্ধ হয়ে গেছে কিশোর। একটার পর একটা ঘোড়াকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে সিসি। তীব্র গতিতে পিপাটার চারপাশে ঘুরে আসার সময় ঘোড়ার গায়ের ধাক্কা লাগল পিপাটাতে। দুলে উঠল ওটা।
দম আটকে ফেলল কিশোর। পিপাটা উল্টে পড়ে গেলে ডিসকোয়ালিফাই হবে সিসি। কিন্তু ভাগ্য ভাল, পড়ল না।
পিপা ঘুরে এসে বাকি ঘোড়াগুলোকে পেছনে ফেলতে শুরু করল গোস্ট। কোনদিকে নজর নেই আর। লক্ষ্য যেন একটাই-শুধুই এগিয়ে যাওয়া; ধুলো-ধূসরিত পথের মাঝে, ধুলোর মেঘের পেছনে ফেলে আসা বাকি ঘোড়াগুলোকে।
অবিশ্বাস্য দৃশ্য! জন আর মার্কের দুটো ঘোড়া বাদে বাকি সবগুলো ঘোড়ার আগে চলে গেছে গোস্ট।
হেনরি, দেখো দেখো! আনন্দে গলা চিরে চিৎকার বেরিয়ে এল কিশোরের। জিতে যাচ্ছে সিসি!
ওর মাথাটাকেই যেন তবলা বাজিয়ে চাটি মারতে আরম্ভ করল হেনরি।
সামনের ঘোড়া দুটোকে হারাতে পারলেই জিতে যাবে সিসি! চাটির পরোয়া না করে আবার চিষ্কার করে উঠল কিশোর।
জনের কয়েক ফুট পেছনে রয়েছে সিসি। হালকা ছিপছিপে শরীর নিয়ে যেন উড়ছে গোস্ট। ধরে ফেলছে বিশালদেহী সোনালি ঘোড়াটাকে।
ফিরে তাকাল মার্ক। হাসতে শুরু করল সিসির দিকে তাকিয়ে।
ওর উদ্দেশ্য বুঝে আতঙ্কিত হয়ে গেল কিশোর। আবার যদি লাগাম ধরে টান মারে, এই গতিতে থেকে কোনমতেই সামলাতে পারবে না গোস্ট। ডিগবাজি খেয়ে পড়বে। ঘোড়া আর তার সওয়ারি, দুজনেরই ঘাড় ভাঙবে।
চিৎকার করে সাবধান করতে গেল কিশোর। স্বর বেরোল না।
হাত বাড়াল মার্ক।
চাটি বাজানো থেমে গেছে হেনরির। কিশোরের চুল আঁকড়ে ধরেছে সে। শক্ত হয়ে গেছে শরীর। ফোপাতে শুরু করল। চিৎকার করে কেঁদে উঠবে মনে হচ্ছে।
ভয়ঙ্কর ওই দৃশ্য হেনরিকে দেখতে দিতে চাইল না কিশোর। টেনে তাকে কাধ থেকে নামানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সেঁটে বসে। আছে হেনরি। কোনমতেই তাকে নামানো গেল না।
কোন রকম আগাম সঙ্কেত না দিয়ে আচমকা পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল মার্কের ঘোড়াটা। মার্কের একটা হাত বাড়ানোই আছে গোস্টের দিকে। ভয়াবহ হাঁক ছেড়ে, নাকের মাংস কুঁচকে ওপরে তুলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জনের ঘোড়াটার ওপর। কামড় বসাল ঘাড়ে! ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ছিটকে পড়ল দুই ভাইয়ের ওপর। মার্কের আর্তনাদ কানে এল কিশোরের। ঘোড়ার পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে সে। মরিয়া হয়ে জিন ধরে ঝুলে থাকার চেষ্টা করল। কিন্তু থাকতে দিচ্ছে না তাকে খেপা ঘোড়াটা।
জনের ভয়ার্ত চিৎকারও কানে আসছে। কামড় খেয়ে উন্মাদ হয়ে যাওয়া ঘোড়ার পিঠে বসে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। মাটির কাছে মুখ নামিয়ে দিল ঘোড়াটা। পেছনের দুই পা উঁচু করে ছুঁড়ে দিল শূন্যে। এই উন্মাদ ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারল না। জন। শেষ রক্ষা করতে পারল না। লাগাম থেকে ছুটে গেল হাত। দুই হাত দুদিকে বাড়িয়ে থাবা মেরে বাতাস ধরার চেষ্টা করল, যেন। উল্টে পড়ে গেল জিনের ওপর থেকে। মাঠিতে পড়ার শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেল কিশোর। জনের একটা হাঁত মাটিতে লম্বা হয়ে পড়ল। সামনের দুই খুর সবেগে সেই হাতের ওপর নামিয়ে আনল মার্কের ঘোড়াটা।
চোখ বুজে ফেলল কিশোর। জনের যন্ত্রণাকাতর ভয়ানক আর্তচিৎকার কানে এল তার। চোখ মেলল আবার। দেখল, মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে জন। তার ঘোড়াটা তীরবেগে ছুটে চলে যাচ্ছে। খুরের আঘাতে হাড় ভেঙে গিয়ে চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে চোখা মাথা। মাটি ভেজাচ্ছে গাঢ় লাল রক্ত।
চিৎকার-চেঁচামেচি হই-চই করছে লোকে। হাত তুলে দেখাচ্ছে। জনের দিকে চোখ ফেরাল কিলোর। সিসির ঘোড়াটা চলে গেছে রশির কাছে।
জিতে গেছি! জিতে গেছি! হেনরি, জিতে গেছি আমরা! কাঁধে বোঝা নিয়েই নাচতে শুরু করল কিশোর। হেনরির মুখ দেখতে পাচ্ছে না। তবে বুঝতে পারছে, নীরব হাসিতে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে ওর।
ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে ওদের দিকে ছুটে এল সিসি। কিশোরভাই! হেনরি! আমি জিতে গেছি! জিতে গেছি!
কাছে এসে কিশোরের হাত জড়িয়ে ধরল সে। কি, বলেছিলাম না, আমিই জিতব! তুমি তো বিশ্বাস করোনি!
হ্যাঁ, দেখলাম তো! সিসির কাঁধ চাপড়ে দিল কিশোর।
এতক্ষণে কিশোরের কাঁধ থেকে নামল হেনরি। গাছ থেকে নামার মত করে পিছলে নেমে গিয়ে বোনের কোমর জড়িয়ে ধরল। মুখ চেপে ধরল পেটে।
আদর করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল সিসি। তোকে অনেক ক্যান্ডি কিনে দেব, হেনরি। অনেক টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
আনন্দে খিলখিল করে হেসে উঠল সিসি।
তার হাসির শব্দ মিলাতে না মিলাতেই শীতল শিহরণ বয়ে গেল কিশোরের মেরুদণ্ড বেয়ে। লোকে ঘিরে ফেলেছে ওদের তিনজনকে।
জোরে কথা বলছে না কেউ। ফিসফাস করছে সবাই। সে-সব ছাপিয়ে বার বার কানে আসছে জনের যন্ত্রণাকাতর গোঙানি। যে ভঙ্গিতে সিসির দিকে তাকাচ্ছে লোকে, দেখে গায়ে কাঁটা দিল কিশোরের।
খবরদার, ওর বেশি কাছে যেয়ো না! চিৎকার করে উঠল। একজন। মেয়েটা মানুষ না, পিশাচ!
শয়তানের পূজারী! বলল আরেকজন। জন্তু-জানোয়ারেও ওর কথা শোনে! দেখলে না কেমন করে নিজের ঘোড়াটার কানে কানে কথা বলল? খেপিয়ে তুলল ফ্রেঞ্চদের ঘোড়াগুলোকে! ওই ডাইনীটাই দুটো ঘোড়ার লড়াই লাগিয়েছে!
বেশির ভাগ লোক তার কথা সমর্থন করল। গুঞ্জন উঠল তাদের মাঝে। ভুরু কুঁচকে সিসির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে সন্দেহ।
ও ডাইনী। চিৎকার করে উঠল আরেকজন।
ঠিক ঠিক, ঠিক বলেছ! বলে উঠল অন্য আরেকজন। সুর করে বলতে শুরু করল, ডাইনী! ডাইনী! ডাইনী!
তার কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাল আরও অনেকে।
ওদের ভাবভঙ্গি দেখে শিউরে উঠল কিশোর। মনে পড়ে গেল মধ্যযুগের ডাইনী পোড়ানোর কথা।
Leave a Reply