১. প্রথম লম্বক

চাকা – সেলিম আল দীন

উৎসর্গ
আমাদের কালের মঞ্চকুসুম
শিমূল ইউসুফ

.

হাওলাদার প্রকাশনী সংস্করণের ভূমিকা

চাকা সেলিম আল দীনের অন্যতম আলোচিত নাটক। তার অন্যান্য নাটকের তুলনায় চাকা নানাবিধ কারণে অগ্রগণ্য। কথা নাট্য শিরোনামে যে ধারায় সূত্রপাত করেন তার প্রথম নিদর্শন চাকা।

সেলিম আল দীনের একমাত্র বই যার ভূমিকা লিখেছিলেন অন্য আরেকজন লেখক সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।

চাকা মঞ্চস্থ হবার আগে বিদেশে মঞ্চস্থ হয়েছিল; যা বাংলাদেশে বিরল। নাটকটি আমেরিকার অফ অফ ব্রডওয়েতে সহস্রাধিকবার মঞ্চস্থ হয়েছে। নাটকটি দেশে তিনজন নির্দেশকের নির্দেশনায় তিন সময়ে তিন দল প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মঞ্চায়িত হয়। নির্দেশক তিনজন হলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ, আনন জামান ও সুদীপ চক্রবর্ত্তী আর দলগুলো হলো ঢাকা থিয়েটার, বুনন থিয়েটার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স ডিপার্টমেন্ট। মঞ্চয়নের পাশাপাশি একাধিক দেশে সে দেশের ভাষায় মঞ্চস্থ হয়।

চাকা নাটকের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে বিদেশে পরিচিতি লাভ করেন মোরশেদুল ইসলাম। যদিও চলচ্চিত্রটিতে লেখার গভীরতা মনস্তাত্ত্বিক একাত্মতা ও বিস্তারিত দৃশ্য বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় না। চাকা নাটকের টেক্সট নিয়ে অনেকে তাদের নিজস্ব বিচার বিশ্লেষণ করে লিখেছেন।

অনেকের মতে তরুণ লেখকদের জন্য অবশ্য পাঠ্য একটি বই চাকা।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সাহিত্যের ছাত্র-ছাত্রীরা চাকা নাটক পাঠ করতে আগ্রহী, সে জন্য সেলিম আল দীন রচনাবলী ও সেলিম আল দীন নাটক সমগ্রে অন্তর্ভুক্ত থাকা সত্বেও আলাদাভাবে চাকা মুদ্রণ করা হলো।

সেলিম আল দীনের মৃত্যুর পর প্রকাশিত সব বই বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হচ্ছিল। বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার প্রয়াণে সে ধারা কিছুটা হোঁচট খেয়েছিল। যা সামলে এ বই প্রকাশের মাধ্যমে আবার কার্যক্রম শুরু হলো।

মেহেরুন্নেসার জীবদ্দশায় সেলিম আল দীনের প্রকাশিত সকল বইয়ের স্বত্ব তাঁর ছিল। এখন থেকে সেলিম আল দীনের লেখার গ্রন্থস্থত্ত্ব সেলিম আল দীন বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা ট্রাস্টের নামে হবে।

মোঃ কামরুল হাসান খান
প্রকাশনা তত্ত্বাবধায়ক

.

প্রথম সংস্করণের ভূমিকা

এটি আমার জন্যে প্রথম একটি ঘটনা হয় যে–অনুজ ধরাপৃষ্ঠে, সৃষ্টিশীল, প্রতিষ্ঠিত এক লেখকের গ্রন্থমুখ আমাকে লিখতে হচ্ছে; কিন্তু এই রচনা, লেখক যার বর্ণনা দিয়েছেন কথানাট্য কোনো ভূমিকার অপেক্ষা করে না; কিংবা করে; হয়ত কেবল এই কারণে, যে, লেখকের হাতে বস্তুগত উপাদান কথা ভিন্ন আর কিছু থাকে না, এবং তারপরও বিশেষভাবে এই রচনাটি কেন কথানাট্য তার সংবাদ আমাদের প্রত্যাশার ভেতর দাঁড়িয়ে যায়।

সেলিম আল দীন, এই কথানাট্যের রচয়িতা, বাংলা নাটকের এক প্রধান পুরুষ; সেলিম অনবরত সন্ধান করে চলেন প্রকাশের নতুনতর মার্গ; নতুন, কিন্তু বাংলা ভাষার সৃষ্টি এবং হাজার বছরের ধারাবাহিকতার অন্তর্গত অবশ্যই। বাংলায় তিনি লেখেন কারণে বাংলার অস্তিত্ব এবং জগত-বোধ, যাপিত জীবনের স্বপ্ন ও যন্ত্রণা তার বিষয়-অপিচ তা বিশ্বের সকল মানুষেরই মানচিত্র হয়ে ওঠে বটে। মানুষ প্রসংগে আমাদের বিস্ময় যেমন অফুরান, মানুষের কথা বলবার মাধ্যমও তেমনি বিচিত্র ও সহস্র। বাংলার ধূলিতে ও কাদার পটে অনবরত দাগ কেটে যাওয়া চাকার প্রতাঁকে সেলিম আল দীন মানুষের জীবনের যে মৌল কথাটিকে দেখতে পান, সেই কথা প্রকাশের জন্য তাকে সন্ধান করতে হয় কথাবিন্যাসের নতুন একটি চেতনা–সংলাপ নির্ভর নাটক তার কাছে যথেষ্ট মনে হয় না, আবার কেবল দেহছন্দ-নাচ-অভিনয় সকল কিছু তাকে এঁটে উঠতে পারে না, উপন্যাসের ধারাবর্ণনাও তার নিকট বলে মনে হয় না, সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এবং ব্যক্তি সমাজ-সংগ্রাম তাকে অবিরাম দুলিয়ে দিতে থাকে ভূত-ভবিষ্যতে, এমত মুহূর্তে আমাদের এই নাট্যকার এক নতুন সাহিত্য মাধ্যম আবিষ্কার করে ফেলোন–কথানাট্য–যা নাটক, কবিতা, নাচ, গীত, উপন্যাস উপকথা ও কথকতার সমাহার।

চাকা আমার কাছে এক বিস্ময়কর সৃষ্টি বলে মনে হয়েছে; জীবনের ধারাবাহিকতা, জীবনের একই সংগে নশ্বরতা ও অমরতা সেলিম আল দীন তার এই কথানাট্যের শরীরে এক আশ্চর্য বেগ ও গভীর মমতায় উপস্থাপন করেছেন; এবং উপস্থাপন করেছেন বর্ণনাংশ এমন এক ভাষায় যা মহাকাব্য ভাঙা কথকতার এক প্রতিভারঞ্জিত প্রতিদ্বন্দি হয়ে ওঠে। সেলিম আল দীনের কথানাট্য একদিকে যেমন আমার অস্তিত্ব ভাবনার অতিনিকট বলে অনুভব করেছি, তেমনি এর স্পন্দনের ভেতরে স্মরণ করেছি আমার প্রিয় একজন, যিনি বর্তমানকে মুহূর্তেই উপকথায় পরিণত করতে পারেন, কমলকুমার মজুমদারকে; এ রচনা আমার শিল্প-অভিজ্ঞতার অন্তগর্ত হয়ে রইলো।

সৈয়দ হক। ৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯১। মঞ্জুবাড়ী, গুলশান, ঢাকা।

.

প্রথম লম্বক
প্রথম তরঙ্গ

কথামুখ যৌথ মঙ্গলাচরণ

বেদনা সহমর্মিতার যুগল মন্থনে দীর্ঘ পঞ্চদিবস রাত্রিতে এই ধবল রক্তিমাভ নাট্যকথামালা উদ্ভূত হল। সাঁওতাল দেবতা ধরম করম এর সাক্ষী * মানিকপীরের সুউচ্চ কুঁদাল এবং ধবল ষণ্ডদ্বয় এই উপকথার সাক্ষী * কথায় বর্ণিত শব এই ষণ্ডদ্বয় যোজন যোজন পথ বয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

সর্বমোট তিনটি লম্বকে এই নাট্য কথামালা বিবৃত হয়েছে * প্রতিলম্বকে আছে বিষয় ও বাকের তরঙ্গ * কিন্তু কখনও কোথাও গল্পে বর্ণিত পথের চাকার ধ্বনি মিলায় না * এমনকি এই ধবলরক্তিমাভ কথায় বিধৃত চাকা এর দর্শক ও শ্ৰোতৃমণ্ডলীর নিদ্রার ভেতরে রেখাপাত করে * শব্দপুঞ্জধূলি ওড়ে বাতাসে * ষণ্ডদ্বয়ের সকল খুরের পুণ্যচিহ্ন পড়ে।

এই নাট্যকথামালার রচয়িতা স্মরণ করে জামশা গ্রামের অমর অভিনেতা জান্নাতবাসী হাকিম আলী গায়েনকে * যমুনার শাখা নদী কালীগঙ্গার কূলে জন্ম বলে প্রবাহে প্রবাহে তিনি সে নদীর সমান বিশাল * এই নাট্যকথা তারই মৃত্যু উত্তর বিমূর্ত নৃত্যচ্ছন্দের অভিজ্ঞানস্বরূপ।

ইতি যৌথ মঙ্গলাচরণ প্রথম তরঙ্গ।

.

দ্বিতীয় তরঙ্গ

একদিন বৈশাখের কোন এক সকালে কাকেশ্বরী নাম গাঙের পাড়ে একটি গঞ্জ এলংজানি পূর্বদিকের সম্মুখে পশ্চিমে অবস্থান হেতু সূর্যালোকে স্থানে স্থানে ঝলমল করে।

কোথায় কোথায় ঝলমল করে?

তবে শোন ধান তিল সরিষা ও গুড়ের আড়তের চালে যেখানে যেখানে ঢেউটিনের নতুন বান * সূর্যের প্রতিফলনও এক ধরনের আলোকিত ফলন একথা মান কিনা?

আর কোথায়?

হাটবারের সারে সার চালাঘরে এখন শূন্য বটে ভাঙা চালে প্লাস্টিকের ছাউনীতে।

আর কোন কিছু?

না তেমন কিছু নয় কেবল ওই কাকেশ্বরীর ভাঙা তটে বটগাছটি ত্রিভঙ্গ দিয়ে মাথায় ঝরঝরে ফিকে শ্যামল আয়না পাতা। গাঙের পাড়ে পাড়ে কদুর গেলে চিতাস্থল ছোট ছোট দুটি চুন সুরকীর তৈরি স্মৃতি মন্দির * একটির তিরশূল নেই অন্যটির বাঁকা একটির শ্লেট পাথরে খোদাই নাম ওঁ হরেকৃষ্ণ এবং জন্ম মৃত্যুর বাংলা সন।

আর কি দেখা যায়?

ওই গাঙ্গের পাড়ে বাড়ি বাঁধার মাটি তোলা হলে দীর্ঘ বাঁশের ডগায় পতাকা দেখা যায়।

ডমরু সহযোগে কথক দ্রুত আবর্তিত হয়।

কাল সন্ধ্যায় কপিশবর্ণ মেঘ বান্দর নাচানীর ডম্বরু বাজিয়েছিল। ঈশানে ধুসর মেঘ ক্রমে কপিশ হল * তারপর হু হু বাতাস খানিক পড়ে এলে শিস ধূম বাস্পে ডুম ডুম ডুম। ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে পাক খেতে খেতে ডুম ডুম ডুম * মোচড়ে মোচড়ে ভেজা ছেঁড়া সবুজ পাতা শি শি শি টেলিগ্রাফের তারে তারে তানপুরার তাম্র তার টানে ঝোড়ো বাতাস।

কান সোনাপুরের বিল থেকে হাতীর শুড় উঠতে দেখেছিল ক্ষেতিগণ। নিড়ানী বগল দাবা করে দে ছুট দে ছুট পেছনে ঘাড়ের কাছে শুনতে পায় ডম্বরুর ধ্বনি ডুম ডুম ডুম। স্বল্প সময়ের জন্য নামলো ঘন বৃষ্টি।

গঞ্জের এদিকটা খোলামেলা গাঙের পাড়। কৃশতর প্রবাহের রেখায় রেখায় কাল রাতে যোগ হয়েছে খানিক নতুন পানি। গোরু মোষের গাড়ি তৈরির ঘর * ঝাঁঝরা জং লাগা টিনের নীচু চালের ফাঁকফুক দিয়ে লতিয়ে লতিয়ে ধোঁয়া উঠছে বাতাসের প্রবাহের মুহূর্তেই হাওয়া। মাত্র হাপর দেয়া হচ্ছে নতুন কাঠ কয়লায়। চাকার হালচেন বা বেড় পেটানো হচ্ছে ঠং ঠাই ঠং ঠাই। কিছু চাকা ভাঙা + আর কোনদিন সরানো হবে না এমন একটি চাকা উইতে ঢেকে যাচ্ছে বিষণ্ণ ম্লান ভগ্নাংশ চাকা * বোম ভাঙা গাড়ি একটা চাকাবিহীন * একটি নতুন চাকাকে কাঠের ফুল বলে মনে হয়।

হে বর্ণনা পিপাসু দর্শকমণ্ডলি * আজ বৃষ্টি মাজা ভোরের আকাশ মিহি নীল কার্খা। ভোর হল শিশু। সব কিছু সুন্দর আকাশ টকটকে নীল। হাতুড়ীর শব্দ বাতাস চারিয়ে দূর গাঁয়ে মোচ পাকাতে পাকাতে চলে যায় * শিব গাজনের ঢাকী নাকি? ঠং ঠাই ঠং ঠাই।

ভোরের বাতাস তবে বাতাসেরও ভোর হয় * তখন সে ন্যাংটো পিচ্চি ভোর * কোমরের কালো তাগায় দুটি তিনটি ঘুমুর। আলতো পায়ে ছুটে আলপথে লুকানো শামুক কুড়াতে টুং টুং।

নদীর ওই পারে আলুর পাইকার * গোল আলুর স্তূপ লোকজন হাঁকডাক * আলুর বস্তা বোঝাই গোরু মোষের গাড়ি এদিক ওদিক চলে যায়। স্তূপীকৃত আলুর ওপর ভোরের আলো অজস্র ডিমের স্তূপ * পৃথিবীর কৃষিকর্মের যাদু। ক্রেতা বিক্রেতার মুখে চিরকালের উদ্বেগ এখানেও আছে।

ঠিক এসময়ে কাকেশ্বরীর পাড় হয়ে ঘুরে দক্ষিণে বাঁক নেয়া গঞ্জের ভেতর দিয়ে ভাঙা ইটের রাস্তায় উঠে আসে একটি ঘর্ষণমুখর গোরুর গাড়ি। গাড়ির ছিলমায় বাঁধা দুই শাদা ষাঁড় * চলনে ঘোড়ার স্বাচ্ছন্দ্য * চোখ আটকে যায় একবার তাকালে। শাদা কুঁদের চূড়ায় আবছা সুরমা রং * সেখানে মাত্র ভোর হচ্ছে। কপালের মাঝখানটা প্রায় কালো। তরুণ বয়সী খাটো কিন্তু বাঁকা শিঙ। গলায় মাজা ঘুণ্টি পেতলের * রোদ পড়ে চোখে ধাঁধায় হঠাৎ হঠাৎ * ঘুণ্টিদ্বয় চতুষ্পদের চরণ তালে বাজে * ষাঁড় দুটোকে ধ্বনিময় করে তুলে।

গাড়োয়ান হৈ হৈ হট হট একজন প্রৌঢ় পইরাত ছাউনীবিহীন উদাম পাটাতনে ঘুমায় তখনও * গাড়োয়ানের সঙ্গী বাকী তিনজন গাড়ির পেছনে পেছনে আসে * ভাঙা ইটের রাস্তায় চাকার প্রবল ঘর্ষণে ঘুমন্তজনা লাফিয়ে উঠে * তার মুখের হা ঘুম থেকে জাগার পরও বন্ধ হয়না।

গাড়ি সোজা চালাঘরের দিকে আসতে থাকে * চলার ছন্দে আঁড়েদের কুঁদ ডানে বাঁয়ে ওঠে নামে * গলকম্বলে কী সুন্দর ভঁজ। গাড়োয়ানের অচল ভক্তি ওদের প্রতি। তাদের পাঁচানি গাঁয়ের মানিকপীরের সেবায়িত

হলাঙ্গা ফকিরের ষাড় * ভাড়া করা ষড়। ধান যা পাবে তিনের এক তা বলে ভক্তি ষোল আনাই দেয় গাড়োয়ান। এই যেমন এখন থামিয়ে কথা বলে চাকাটা এট্টু সারমো আপনেরা থামেক হ্যাঁ? ঘাড় কাত করে অনুমতি প্রার্থনা। গাড়োয়ান মাথার লাল গামছা খুলে কোমরে বাঁধে।

ষাড়দ্বয় শাদা আকাশ মহানীল * সূর্যের লাল রং তখনও মরেনি নদীর ক্ষীণ জলে বাতাস তাড়িত আলোর বিশ্ব বটগাছে এসে পড়ে * কে কার প্রতিভাস কে জানে? ষাঁড় দুটো কি ভোর জোয়ারের ফেনা?

ততক্ষণে কামার ঘরে কাজ ও কয়লা গনগনে হয়ে ওঠে * হাপরের নিশ্বাসে নিশ্বাসে ছাই ছড়ায় শাদা অকলঙ্কিত। চার পইরাত জটলা করে এদিক ওদিক ছড়িয়ে যায় * এদের মধ্যে যার নাম শুকুর চান সে তরুণ এবং সবার সঙ্গে সেও যাবে জলিধান কাটতে হু ই বিশাল বিশাল প্রান্তর পেরিয়ে অচিন ভুবনের কোথাও দিল সোহাগীর বিলে। গাঙের পাড়ে কাল রাতে বৃষ্টিতে ভেজা নরম বালুতে দাঁড়ায় সে দিগন্তে চোখ স্থির করে। এই প্রথম পইরাতের কাজে সেখানে যাওয়া * পেছনে পাঁচানি গ্রামে তার অভুক্ত পরিবার এবং আকাশ গাঢ় নীল শূন্য বিধায় তার দু চোখের কোটরে পাকা ধানের পোঝা গুচ্ছ গুচ্ছ।

কথক হাটু গেড়ে বসে মিস্ত্রীর সামনে

এ ভাই হামাকের চাকাটায় এট্টু ঝামেলা হয়েছে

 কি হয়েছে গো

না এই আরা টা ঢিলে হয়েছে

মিস্ত্রী চাকার পুঠি ঠিক করছিল বাটালি ঠুকে ঠুকে। কালো মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি * সবুজ চেকলুঙ্গি ভেদ করেছে হাঁটু কালো তেল চিকচিকে। বাকা মেরুদণ্ড তাই ঘাড়টা না তুলেই সামনে জোয়াল নামানো গাড়িটার চাকার দিকে তাকায় * বেড়ের চারপাশে বৃত্তাকারে চোখ ঘুরিয়ে এনে গাড়োয়ানের মুখে নির্বিকার তাকায় একবার। এট্টু কেশে নিয়ে কানের গোঁজে রাখা ছোট্ট কাঠ পেন্সিলটি একান থেকে ওকানে রাখে।

পুঠি থেকে আরা ঢিলে হয়েছে

 সংক্ষিপে সেইরে দেও

যাবু কুটি?

জলি ধানের বতুরে যামো হুই দিল সুহাগীর বিল * মথুর ডাঙা দিয়ে পূবে ভুগরাইল তা দক্ষিণে থুয়ে বামুণ শিকড় হয়ে কুমারপুর তারপরে ছিরিপুর দামকুড়্যা।

হামাকে সঙ্গে আরও চাইরজনা জুটেছে।

মিস্ত্রী কাজে মন দেয় * কিন্তু গাড়োয়ানকে অপ্রয়োজনীয় কথার নেশায় পায়।

ভুরটি দারুণ সুন্দর গো * তেমুন তেজ নাগেনি রোদে * বেলায় বেলায় চলে যামো মথুর ভাঙা + রেতে চাঁদ থাকবি হামাকের কপাল মুখো * চৌদ্দ দিনের চাঁদ * রাত ভুর মানিকপীরের ষাড় দুটু চলবে। একজন ভাল গেতে পারে হেহ্ হোকি গাড়িয়াল ভাই বুলে টান দিলে হেই রমপুরের চিল মারির বন্দর পৌঁছে যাবু।

দূরে ডাউস ঘুড্ডি উড়িয়েছে কোন রাখাল * বাতাসের স্রোতে স্রোতে শণ কাগজের ঘুড়ি নাচে মাথায় খেজুর পাতার ভমেরা * নীলে নিবদ্ধ চোখ ঘুরে আসে চাকায় * বালুকাদাঘষা লোহার বেড় শাদা রূপাতুল্য ঝিলিক দেয় * হঠাৎ বউটির কথা মনে হয়।

বউ আমার সতী নক্ষী গো * কয় এ বুধুর বাপ খেতে খেতে ধান পাকিছে ঘরে বসি উপুস কাপুস মরবু ক্যা গরু নাই গাড়ি আছে। হলাঙ্গা ফকিরের ষাড় দুটু ভাড়া দেয় যাও না। রাইতে ঝড় বাদল থামলে হামাকের পেডের বেদনা আর চাঁদ উঠলো * এর মিঝে চোখ গেল পইখটা এমুন ডাকলো উঠানের গুপালভুগ গাছটায় * ডাকে ডাকে পেটের বিষ উঠলো মাথায়।

গাঙের পাড় ঘেষে বসে ওরা।

শুকুরচান মুড়ি কিনে আনে চার আনার * পইরাতগণ পরস্পর কথা বলে * সোগার হাতে আল কাচি * একটি করে পুটুলী * তাতে চালভাজা ছাতু লুঙ্গী গেঞ্জি আরও সব টুকি টাকি * তাদের মুখে অবিরল কথার ফুটন্ত মুড়ি * হাটুর উপর পোটলা * গতকালের সেদ্ধ কাপড়ে এখনও সোডার মিহিগন্ধ।

সব কিছুতেই উজ্জ্বলতা। এমনকি গুড়ের আড়ত থেকে তামাকের চালা থেকে নেশা নেশা গন্ধ * গন্ধদেরও ভোর হোল। তথাপি কাঠচেরাই ভাইকে খাওয়াবো গুঝি গুঝি

পান গো

পানগো।

ঝড়ে তার কাঁধের কমলাবর্ণের জামা একবার এদিকে ওড়ায় এদিকে যায় আবার ওড়ায় সে যায় ওদিকে।

অহে নাচনা থামাও * একটি সরকারী লাশ এসিছে সদর থিকে ঠিকানা মাফিক পৌঁছে দাও হুশ সাবধান অহে ধরম করম।

পারমো নাই এ ঈশ্বর

আহা এট্টা গাড়ি ঠিক কর

ধরম রাজ শূন্যে এবার সূর্যকিরণ ও মহানীল খুটিয়ে দেখে রক্তবর্ণ রাতজাগা ঝাল ঝাল চোখে তীক্ষ্ম চোখে চোখের দু পাশের কুঁচকি কুঞ্চণ

নাই কুনো লাশ নাই ভগমান কোথাও কুন লাশ নাই।

তার চীৎকার শূন্যে মিলালেও গাঙের পাড়ের দিক থেকে প্রতিধ্বনি হয়।

ভগমান

অহে সদর থিকে লাশ এসেছে।

পারমো নাই ভগমান

 আহা কথা শোন

খাকী রঙের কুত্তাটা রক্ত পানি মেশানো ধারা পান করে আরও কিছু পাওয়ার আশায় দু ধাপ সিঁড়ির নিচে এসে আয়ার দিকে তাকায় * কুত্তার দৃষ্টিতে চঞ্চলতা লোভ ও চোখের মণির পেছনে লোভের তামাটে আগুণ চকচক করে।

আয়া ছেই ছেই করে দুলতে থাকে * সে ক্রমেই অস্থির হয়।

হে খুদা নাশটা মরতি মরতি কেনে এইসছে সদর থিকে * এই না শেষ রাত থিকে পওরা দিচ্ছি * হাসপাতালে চারকী করি বুইলে হামাকের জগত সুমসারে কি আর কুনো কাম নাই * চান সুজ্জি সামনে রেখে পিঠপিছন কেবল লাশই পওরা দিমো * খেনে খেনে মুনে হয়। এই খালা বুইলবে লাশটা।

ঠুনকির নিগে ছেইলে দেখতে যামো এলাহী বরফ কলে * কি মেইলে মাগো একমণ বরফের চাঙড় কাঁধে তুইলে ধাশ করে ফেলে দেয়। আমাক বুইলেছে এ খালা ঠুনকির লিগে মন কান্দে * ইনকির নগে হামাকের কাজ সেইধে দেও * দুই কুড়ি টেকা দিমো তুমাক।

সহসা তার মনে হয় পেছনে লাশ রেখে বিবাহের কথা চলে না * স্বর বদলে সে প্রবল ভাবে দোলে*

আমার মরণ সাধ নাইগো * হেই খুদা নবী রসুল এই ভুরে রুটির উপরে গুড়ের চাক রেইখে খামো না পিঠ পিছন লাশ পওরা দিমা।

অর্শরোগী ডাক্তার চেঁচিয়ে উঠে * হই হই ঠুনকির মা লাশটা কি তুর বাপ নাগে যে কান্দস * হাম্বলাম্বা বন্ধ কর জানটা খায়া ফালামো সদরে না কোথায় যেন গোলমাল হয়েছিল ডাকাত পড়েছিল রাস্তায়।

এমন সময় ধরম রাজ হাত ধরে টানতে টানতে যাকে আনে সে কেবল সোনালী খড় ও পাকাধানের ঝুমঝুমি চেনে। একটু আগে মাত্র তার চাকা সারানো হয়েছে * তার চোখ বোশেখের নীলাকাশের ঠোঁট ছোঁয়ানো দিল সোহাগীর বিল * সেই পথ সাদা ধূলিময় বাঁকে বাঁকে পথ স্রোত। তার চোখে দীঘল পথের গতি স্তব্ধ হয়ে আছে।

ধরমরাজ আঁকড়ে ধরে আছে গাছোঁয়ানকে * যেন কত কালের ইষ্টি কুটুম।

পঞ্চাশ টেকা দেবেন ভগমান ঈশ্বর * সঙ্গে আমিও যামো দাদা * নাম ঠিকানায় পৌঁছে দিলে হবে * পণ্যি ছোওয়াবে কপাল ভরে যাবে হে হে * ধরম রাজ সাধন জানে গো। এ লাশেরও নাম আছে। খেজুর চাটাই মোড়া চাকা বরফ আর করাত কলের কাঠের গুডোর ভেতরে যে ঘুমায় নাম থেকে কিছুটা দূরে সে * যদি তার নাম হোসেনালি হয় তবে সে এখন আর হোসেনালি নয় হোসেনালির লাশ। এমন সময় গোঁড়া এশীয় রাষ্ট্রের ম্যাপ সমেত ঈশ্বর আসেন ক্রুদ্ধ গম্ভীর।

অহে লাশ নিয়ে এত ক্যাচাল কিসের। সরকারী রিপোর্ট আছে পোস্ট মর্টেম হয়েছে * সরকার বাহাদুর স্বয়ং বাদী।

কল্যাণমূলক রাষ্ট্র মানেই লাশের গন্তব্যে লাশকে পৌঁছানো। যার লাশ তার শরীর আছে কান নেই * তার শয্যা গহবাস নয়। নারী অন সুখদ ছায়া চীনে মাটির বাসনের পাশে হরিদ্ৰবৰ্ণ শবরী কলার খোসা কিছুই রইবেনা আর * যার লাশ তার শরীর আছে তাপ নেই দৃষ্টি ও রসনা নেই। গাড়োয়ান মসজিদ খচিত পঞ্চাশ টাকার গোলাপী নোট দেখে যতটা না নোটে আঁকা মসজিদ দেখে শূন্যে তাকায় * কোন মৌলিভী স্রষ্টা প্রসঙ্গে মহিমা রহমত গজব ও আবাবিল পাখী প্রসঙ্গে আকাশে তাকান না। এই নোটে মসজিদ থাকাতে তার সরল হৃদয় ঈশ্বর মৃত্যু ও মৃতের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। লেনদেনের ফাঁকে ফাঁকে খিলান গম্বুজ মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে দেবার এও এক কৌশল বটে। কেননা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরল হৃদয়কে বাড়তি মূল্য দিতে হয় * তবে যখন চাহিদা ও পণ্যের সময় আসে তখন সংখ্যা ও রং এর ব্যাপারটি প্রধান। একজন গাড়োয়ানের ভুবনে একটি পঞ্চাশ টাকার নোট কতইনা আলো আশা বিকীরণ করে * রঙ এর ভেতরে লেখা রেখাও সে হয়ত খানিকটা বেশী খুটিয়ে দেখে।

হয় গাড়িতে * প্রধান ডাক্তার মনে মনে আয়াত পড়েন * গাড়িতে উঠে গাড়োয়ান লক্ষ্য করে তিনজন সঙ্গী পইরাতের একজন ধারে কাছে কোথাও নেই।

একজন কেটে পড়েছে লাশের সঙ্গে যেতে হবে শুনে। তাকে দোষ দেয়া যায় না। কারণ সে হয়ত হত্যা চেনেনা * ধানের নবাঙ্কুর থেকে জলি ধানের হাত নোয়ানা সোনার চুড়িপরা শীষ ও এ দুয়ের মধ্যবর্তী মেঘ রৌদ্র বর্ষার শুরুতে মাটির তল দেখা ঝকঝকে জলের আসা যাওয়া চেনে। বাকী দুজন যে থেকে গেল একজন হাঁপানী রুগী অন্যজন কেবল কৌতূহল বশতঃ * দেখা যাকনা লাশের সঙ্গে গেলে কেমন লাগে * সারা জীবন ধানের আটির সাথে থেকেছি শস্য ঝরা সোনালী খড়ের পোঝয় পালা রচনা করেছি। তবে দেখা যাকনা ইত্যাদি। কৌতূহল এক আজব কারবার * কৌতূহল মানুষকে বিষ পিঁপড়ের বাসা পর্যন্ত নিয়ে যায় বোলতার হুল নখে তুলে দেখতে বলে * বড় চন্দ্রবোড়ার মুখ হা করে ভেতরটা কেমন দেখে নিতে বাধ্য করে।

.

চতুর্থ তরঙ্গ

হে দর্শক শ্রোতৃমণ্ডলী।

কাকেশ্বরীর পারাপার সম্পর্কে বলি * আদি কাল থেকে এখন যাবত সকল নদীর পারাপারের কাজ কারবার প্রায় এক * এমনকি ধর্মগ্রন্থাদিতেও পারাপার নৌকা ও কড়ির প্রসঙ্গ আছে। কাকেশ্বরীর পারাপারের নিলাম গ্রহীতাকে দেখা যায় না * কিস্তু গাঙের পাড়ের চালাঘরে তার নিযুক্ত লোকটির কাছে গুদারার পারাপারের কড়ি দিয়ে ওপারে যেতে হয়। যাকে কড়ি দিতে হয় সে কেমন যদি জানতে চান তবে বলি

এলংজানি গঞ্জের ধারে গাঙ এর পাড়ে থাকে
যে সে সামনে কালো ক্যাশ বাক্স এক রাখে।
অকারণে দোলে যেমন সুরা কেরাত পড়ে
মৌলভী * তার দৃষ্টি সীমায় দিগন্ত মর্মরে।
পূর্ব দিকে পিঠ রেখে সে ভোরের খাবার খায়
পুঁটি মাছের ঝোলে মেখেছে করা ভাতের গায়।

ততক্ষণে নানা বরণের মানুষ এসে গাড়োয়ানের চারপাশে জমা হয় * কিন্তু টাক্সোঘরের লোকটির নিস্পৃহতার অভিজ্ঞতা একটি লাশ বা একবস্তা আলু পারাপারের নয় * গর্ভবতী নারী পার হলে সে মনে মনে দুজনের পারাপারের হিসেবেও কষে ফেলে। গাড়ির ওপর প্লাস্টিকের ছাউনি নোংরা স্থানে স্থানে চামড়া কাটা ছেঁড়া। তার ওপর খেজুর পাতার চাটাই মোড়া যার লাশ ধরা যাক নাম হোসেনালি হোসেন আলী এভাবেও হতে পারে * উৎসুক ভিড়ের চোখেরা এ মৃতের আচ্ছাদনের দিকে যেভাবে তাকায় আজ ভুবনের কোথাও আকাশ আলো মেঘ ও কাকেশ্বরীর দেবদূতেরা সে চোখে দেখছেন না?? দেখা ও বাক্যের মিশেলটা আফসোস ও দুঃখ প্রকাশের শ্বাসযুক্ত অক্ষরহীন ভাষায় এরকম।

আহ ওহ্ হুসস্ * হুম হু ইহ্।

এই খেজুর চাটাই মোড়া লাশকে ঘিরে যেসব গল্প ও কল্পনা তাৎক্ষণিকভাবে তৈরী হয় লোকপুরাণ ও বৈদিক কথকতা সকল ভুবনে ভুবনে প্রায় সে ভাবেই তৈরী হয়েছিল। উপস্থিত লোকেদের সকল কথাকে ধুয়ে সোনাকরের ছাই বোয়া যে স্বর্ণকণা পাই তা হলো

এক অতিকায় দৈত্য এই যুবক শ্রমজীবীর বুকে নখ ফুটিয়ে প্রথমে রক্ত ও পরে গিলা কলজে খেয়ে নিয়েছিল * সরকারী ডাক্তারখানায়ও সে রকমের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গেছে।

তারপর তা থেকে আর একজন কালাই মটর ডালের বস্তা টানা শ্রমিক সে রীতিমত গল্পই তৈরি করে মনে মনে।

মেঘ শো শো * এই যুবক পথ চলে * হোও হোও * মেঘের কপিশ বুক চিরে সহসা বেরিয়ে আসে দৈত্যরাজ * হোও হোও ঘুর ঘুরর এক পা ভেঙেছিলেন বটে হযরত আলী * কিন্তু দৈত্যের কালো হাতে দুধরাজ মনিরাজের লেজ * আকাঁবাকা করে সাপ * চিকুর চিকিমিকি সবুজ পাতা উড়ে ধাবমান মোষের শিঙে শিঙে তীব্র বাতাস শিশি করে

লোকটির মনে মনে মেঘের আকার পাল্টালে পরে দৈত্যের চেহারাটা দাঁড়ায় মহাজনের। সহসা ধরম রাজ লাফিয়ে গাড়িতে উঠে ফুচকি মেরে জিভে কামড় দিয়ে পুনরায় নামে। হেই ভগমান লাশটিততা ধরম ঠাকুরের। বিশ্বাস অবিশ্বাস নয় এক অপূর্ব উপজাতীয় দেহ নৃত্যের শৃঙ্খলা ভোরের সূর্যের বিপরীতে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয় চোখে * হেই জিয়ো ভগমান লাশটিততা পোড়ামাটির ধরম ঠাকুরের * উই উই দূরে তার থানে রাজবেশ পরা ঠাকুরের ভুগ নৃত্য হয়েছিল গো * এমুন সময় রজঃস্বলা নারী এসে ধরম ঠাকুরের প্রেমে পড়ল গো * হো ঠাকুর সোয়ামী এনে দে * তারপর ভূঁইকম্প হলো দুঃখে ধরম ঠাকুর ভেঙ্গে গেলেন * আমার পোড়ামাটির ধরম ঠাকুর এখন হু ই ওখানে যাবেন * সিখানে পূজা হবি * তবে আসো ভক্ত্যার লাচ হবে * ঝুড়ি ধরা কাটা বিছান পথে হামাকের গড়াগড়ি হবে।

অদ্ভুত কৌশলে ধরম গড়াগড়ি খায়

তারপর ফুলকারী খেলা হবেক জ্বলন্ত অঙ্গার হাতে হাতে ঘুরবেক পায়ের নীচে অঙ্গার জুলবেক * হে ভাইগণ ভক্ত্যার লাচ হবে আগুনের ফুলকারী হবেক সরে যাও সরে যাও।

ধরম নাচতে থাকে যেন অঙ্গার হাতে ওর।
 হো হো ধরম ঠাকুর
মো দেয়াসী তুর।
 ধরম ঠাকুর ঢাককুরাকুর
 ধরম ঠাকুর ঢাককুরাকুর।

গাড়োয়ান এতে বিরক্ত হয় * নাচানাচি করেন ক্যা? লাশে গুণা দিবু হ * জলদী গাঙ পাড়ি দিয়ে চলেন। গাড়োয়ান দেখতে পায় দূরে শ্বেতী বলে সহজেই আলো অন্ধকারে গা মিলিয়ে ঈশ্বর দাঁড়িয়ে আছেন। এমন সময় অর্শরোগী ডাক্তার দৌড়ে আসে।

শুওরের বাচ্চা ডোমের বংশ তর জান খেয়ে ফেলমো * ক্ষেণে ক্ষেণে বরফ গলে শেষে মাঝ পথে পচন ধরবু * হে গাড়োয়ান টান দেও টান দেও।

মানুষের ভিড় ক্রমেই বাড়ে এবং মৃত্যু এমন একটি সংবাদ যা দ্রুতচারী বৈশাখে এলংজানির বটতলার ষড় দৌড় খেলারও আগে ছোটে * ভিড়ের কোলাহল ক্রমেই কমে এসে কোন নতুন কবরের পাশে ভাবগম্ভীর নীরবতায় স্বস্তি পায়।

গুদারার ভাড়া আদায়কারী লোকটি বুঝতে পারে সরকারী খরচে লাশ যাচ্ছে গাঙ পেরিয়ে দূরে। সে জানে এ ক্ষেত্রে সরকারী পুণ্যে ঘাটপারের কড়ি লাগবে না * সুতরাং সে নিস্পৃহভাবে পাতের পাশে জমানো পুঁটি মাছের মাথা ও কাটা একত্র করে চিবুতে থাকে। অপেক্ষমান লাশের পেছনে আরও সব দৃশ্য এসে ভিড় করে * বর্ষায় গাঙের স্রোত দক্ষিণবাহী একের পেছনে আরেক কচুরীপানার দল? এক কুষ্ঠরোগী আগে ছিল দস্যু পায়ে ঘায়ের জন্য ন্যাকড়া জড়ানো। দস্যু হিসেবে সে তার মূল্য পরিশোধ করেছে বলতে হয় * ওর ঘা দেখানোটা কড়ির কাজ করে ভোরে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়ায় * দাঁত বের করে হাসে। গুদারার ভাড়া আদায়কারী লোকটি পতিত ছায়া দেখেই বুঝতে পারে * ডানহাত নয় বাম হাতেই ইশারা দেয় যা যা।

আর একবার এক মানবণ আটমাসের সম্ভবতঃ আষাঢ়ের উপচানো নদীতে কূলে এসে লেগেছিল। শূন্য নদীতে তাকিয়ে সে এখন দেখতে পায় মৃত ভাসা কুকুরের উপর পচা মাংস লোভী কাকদের দীর্ঘ গাঙ পাডি দেয়া। সে কাকগুলো নরকগামী ছিলো?

গরু দুটোকে আগে ভাগে পার করে নিয়ে যায় সঙ্গী পইরাতগণ। এরপর সঙ্কীর্ণ নদীর উপর দিয়ে খড়ে ও মাটিতে বাঁধানো পথে গাড়ি পার করা হয় * ওপারে গরু জুতে লাফিয়ে উঠে গাড়োয়ান * ধরম রাজ হোই হোই করে * কালো নিকষ হাত তর্জনী সূচিক মুদ্রা * শূন্য মধ্যগগণে নীল তিসি ফুলের পাপড়ী মেলা সেই টকটকে আকাশ।

হো হো ধরম ঠাকুর পুড়া মাটির ধরম ঠাকুর তোমারে ভাঙলো কে? পেটখান চিরলো কে? হো হো ঠাকুর ভুগমান।

তার কণ্ঠ দূর আকাশের আর্শিতে লেগে দূর দূরান্তের বিশ্ব পল্লীতে গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।

ভোরের আলোর বিপরীতে সাঁওতালী রঙ নিকষ হয়ে উঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *