৪. কথাপুচ্ছ

কথাপুচ্ছ

১৯৮৬-৮৭ সালের গণঅভ্যুত্থান আকস্মিকভাবে স্তব্ধ হলে অন্য সবার সঙ্গে আমিও সমান বিচলিত হই। রাজনৈতিক দলের বাদানুবাদের আবর্তে শহীদদের শব নাম পরিচয়হীন দিগন্তের দিকে ভেসে যায়–এ রকম বেদনা এই চাকা নাটকের মূলে আছে। গল্পের সার সংক্ষেপ নাসির উদ্দীন ইউসুফের কাছে প্রেরিত হলে প্রথমে তিনি খুব একটা উৎসাহী হননা। তবুও পরে খ্রিষ্টীয় নব্বই সালের বসন্তকালের অন্ত্যে বৈশাখে মাত্র পাঁচ দিনে প্রবল স্বেদকম্পনে নাটকটি লেখা হয়ে যায়।

রাজনৈতিক অভিপ্রায় নাটকের শরীরে নেই-শিরায় হয়ত আছে। আমি ঠিক নিশ্চিত নই-সমাজমনস্ক রাজনীতিপিপাসু পাঠক নাড়ী ধরে পাবেন কিনা তেমন উদ্বেলিত স্পন্দন তাদের নিজ নিজ ঘড়ি মিলিয়ে। না পেলে আমার অস্বস্তি নেই এই জন্য যে সমকালীন রাজনৈতিক আবেগ তাতে তড়িৎ ক্রিয়া করে না–আমি যদুর জানি আমার কবি স্বভাব। আর স্বভাব বিরুদ্ধ শিল্পকর্ম অন্য যাদের সন্তুষ্ট করুক নিজেকে বাঁচায় না। সেদিক থেকে বলতে পারি চাকা নাটকের একটি নিজস্ব ও নৈসর্গিক অর্থ আছে। দর্শক শ্রোতা তাতেই তৃপ্ত হবেন। এবং লেখার পর আমারও মনে হয়েছে। সমকালের বেদনা এ রচনায় বহুদূরে নানা বাঁক ঘুরে ভিন্ন শিল্প ভাষায় এসেছে। ধরা যাক আমি বাস্তবেই একটি গল্প বলতে চেয়েছি-সে গল্পের শববাহী চাকার সঙ্গে সঙ্গে চলে যাচ্ছি মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে। এ কাহিনীর * ক্ষেতমজুরদের হাতে কবর খনন হলে অনামা মৃতের গতি হল। কেউ যে চিনতে পারল না তার কষ্ট নিবারিত হল জানাযা ও কবরের পরে। সে আনন্দ ও শোকের যদি কোন মানবিক তাৎপর্য থাকে তবে তাতেই আমি খুশী হব।

এক মধ্যরাতে নাসির উদ্দীন ইউসুফ পুরো গল্পটি আমার কাছ থেকে পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেন। তিনি চাকাতে মানবিক সম্পর্কের দিকটাকে খুব বড় করে দেখেছেন। আমিও একমত। কিন্তু তার প্রক্রিয়া বিচিত্র পথে চলেছে। নীল আকাশ-নদী-উজ্জ্বল সূর্যকিরণ–মৌমাছির ঝক-দিগন্ত রেখা-জোৎস্নার কুহক নিশ্চাপ সঁড়ের শরীরে রক্তপাত প্রভৃতির মধ্য দিয়ে শব চলে গেছে ক্ষেত মজুরদের হাতে কাটা গোরে। অন্যদিকে মৃতের প্রতি সহানুভূতির কথাটা নাটকে আছে। কিন্তু তা কর্তব্যও বটে–এ কথাটা সত্য।

চাকা রূপক সাংকেতিক নাটক নয়–নিরবলম্ব বাস্তবতাও যে এর লক্ষ ছিল তা বলা যায় না। গল্পটি যেভাবে বলতে ভাল লেগেছে সেভাবেই বলা। আমার অন্যসব নাটকের মত এ নাটকেও পুরাণ আছে। অথচ নিশ্চিন্ত যে অনামা মৃত্যুকে আমি পৌরানিকতার ছলে ব্যাখ্যা করেছি। চাকার গল্পটা গল্পই। নাটকটি কেউ যদি ঘটে গেছে এমন একটা ঘটনার ব্যাখ্যা বলেও মনে করেন আপত্তি করব না।

বলতে বলতে নাটক–সেজন্যই কথানাট্য। একে কথকতাও বলা যায়। কিন্তু কথকতা অভিনয়রীতির নাম- নাট্যরীতির নাম নয়। উপরন্তু কথকতা বললে কথানাট্যের দাবী পূরণ হয় না। রামায়ণও কথকতা কিন্তু আসরে লোকগল্প বলার রীতিটাকে আমরা কেউ কথকতা বলি না। কারণ–যারা পুরাণ কিংবা লোককথাগুলো পরিবেশন করেন তারা একে শাস্ত্র গান বা হাস্ত র বলে থাকেন।

গ্রাম থিয়েটারের কর্মী–বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাসাহিত্য কিংবা নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদানকালে শীত বসন্ত-রাখালের পিঠা গাছ কিংবা কাজলরেখা শ্রেণীর লোককথাকে বলতাম কিসসাকথন। আবার পরিবেশনার স্থান বিবেচনায় এর অন্য একটি নামও দিয়েছি। গৃহাঙ্গন থিয়েটার। ঢাকা ও মানিকগঞ্জ জেলার গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের গল্পকথাকে বলা হয় শাস্ত্রগান বা হাস্তর। শাস্ত্র কথাটি যে কেবল শাস্ত্র নয় সে জেনে অবাক হয়েছি। সে হিসেবে একে যদি কেউ শাস্ত্ৰনাটক বলেন বিবাদ করব। কিন্তু তাতে ধর্ম ন্যায় অর্থ বিদ্যায় ব্যবহৃত শাস্ত্র কথাটা নিয়ে বিবাদ বেধে যায়। হয়ত অতীতে এই কিসসা বা লোককথার ভেতরে ছিল গল্পচ্ছলে ন্যায় ও ধর্মের কথা। রুমীর মসনভীর গল্প তো সুফীতন্ত্রের শাস্ত্র জামীর হপ্তপয়করের গল্পগুলোতে আধ্যাত্মিক ইঙ্গিত উপচে পড়ে। রাজা রাহরাম গোর সপ্তবর্ণের প্রাসাদে সাত দেশের সাত রাজকন্যের মুখে যে সব কালো হলুদ সবুজ লাল নীল চন্দনবর্ণ গল্প শোনেন সেগুলো নাটকীয় ঘটনা ও সংঘাতে শেষাবধি দয়িত দায়িতার জীবনে এক শুভ সংকেত বয়ে আনে। কিন্তু শাস্ত্র যদি বলি তবে বলা যায় সামজিক ন্যায় ধর্মকথা শুভ অশুভের শিক্ষাটা শাস্ত্র গানের একার সম্পদ নয় তা রামায়নে আছে মঙ্গলনাট কিংবা গাজীর গানেও আছে। তবে শাস্ত্র গানে একটা সাধারণ লক্ষণ দেখেছি তা হচ্ছে দুঃখভোগের ভেতর দিয়ে জীবনের অভিষ্ট জয় করে নেয়া। কিসসা কথা-শাস্ত্র বা কথানাট্যে বিয়োগান্ত পরিসমাপ্তি দেখিনি। হয়ত আমাদের জনপদে প্রাচীনকাল থেকে কিসসা কথকতা বা শাস্ত্র কথকতা এভাবেই শুভ বিচারবুদ্ধি দিয়ে এসেছে।

কিন্তু প্রাচীন বা মধ্যযুগের শিল্প পরিভাষাকে আধুনিক থিয়েটারে ব্যবহার করা সহজ নয় হয়ত বা সম্ভব নয়। উপরন্তু বাংলা নাটকে দেশজ নাট্য পরিভাষার সীমাবদ্ধতা আছে। উত্তরাধিকার সূত্রে এখনও যে শব্দগুলো নৈয়ায়িক এবং যেগুলো সঙ্গবদ্ধ করা সম্ভব তার চেষ্টা চালাচ্ছি মাত্র। শিঘ্রী এ বিষয়ে সবার এগিয়ে আসা উচিত।

আমি কথার শাসনে নাটক রচনা করেছি তাই এর নাম দিয়েছি কথানাট্য। গৃহাঙ্গনে কথক যে কিসসা বলেন দোহারদের সঙ্গে এ নাটকের আঙ্গিক পরিকল্পনায় সে রীতির শিক্ষাটা সক্রিয় ছিল। গ্রাম থিয়েটারের কাজে এ দেশের নানান অঞ্চলে যাই বলে দেশের শিল্প শস্যক্ষেতের নানান সুগন্ধি ধানের ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাই। পূর্ব পুরুষের সমৃদ্ধ ক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কষকের সাহস বাড়ে। নইলে একজন গায়েন আমার হাতের লেখায় সত্তর বাহাত্তর পৃষ্ঠার নাটক গাইবেন এ ধারণা ইউরোপীয় ধাঁচের নাটক থেকে পাবার কথা নয়।

প্রিয় বন্ধু শাঁওলী মিত্রের কাজের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগও এই কথ্যনাট্যের মূলে কাজ করেছে। শত্তলীর উজ্জ্বল অভিনয় কথকতা রীতিরই আধুনিক উত্তরাধিকার। কিন্তু তার অন্বিষ্ট এবং আমার বিষয় এক নয় বলা বাহুল্য। কথানাট্যের পুরাণ বহিভূর্ত বা লোককথা বহির্ভূত নাট্যবস্তু নির্বাচনের ইচ্ছা আমার বহু দিনের। পুতুল নাচের নাটক রচনার ক্ষেত্রেই প্রথম এই পুরাণশূন্য বিষয় অবলম্বন করি। আমার কাজ সম্পর্কে খুব ঘনিষ্ঠভাবে যারা জানেন হয়ত পড়েছেন বিশুকুমারের পুতুল নাচ শীর্ষক একটি মুদ্রিত রচনা। সেখানে কুমারদের সঙ্গে আধুনিক কালের শিল্পায়ণের দ্বন্দ্ব ও লোকজ মটিভের শৈল্পিক উত্থান প্রসঙ্গ আছে।

চাকাকে কেউ যদি কাব্য বলেন আপত্তি করব না–গল্প বললে অখুশী হব না। আমি সব সময় চেয়েছি আমার লেখা নাটকগুলো নাটকের বন্ধন ভেঙে অন্য সব শিল্পতীর্থগামী হোক। কারণ শিল্পে আমি দৈতাদ্বৈতবাদী। তবুও সংস্কৃত কথাসরিৎসাগর এর রীতিটাকে ধ্রুপদী জ্ঞানে এর গল্পাবিভাজনরীতি মেনে চলেছি। কথাসরিৎসাগরের কথামুখ বা কথাপিঠ এবং লম্বক ও তরঙ্গ বিভাগ চাকাতে মেনে চলেছি। এর লক্ষ্য আধুনিক কথানাট্যের একটি নৈয়ায়িক ভিত্তি গড়ে তোলা। আমাদের কালের অন্যতম মঞ্চ অভিনেত্রী বন্ধুপত্মী শিমূল ইউসুফকে এ নাটক উৎসর্গ করছি এ কথা মনে রেখে যে-ঐতিহ্যবাহী নাট্যাভিনয়ের ধমনীতে সঙ্গীতের যে তরঙ্গ-আমাদের কালে শিমুল এবং তার মত দু-একজন মাত্র তাকে মঞ্চাভিনয়ে বহন করে চলেছেন। এই নাটকের মধ্যে একটি গীতিসুর আছে। প্রথম রাত্রির নাটক পঠনকালে সে সুর তাঁর কানে বেজেছিল বলে বিশ্বাস করি।

ইতোমধ্যে ঢাকা থিয়েটারের জামিল আহমেদ ইংরেজিতে চাকার অনুবাদ করেছেন এবং এর অনুবাদের ইংরেজি রূপান্তর করেছেন স্টিভ ফ্রিডম্যান। অক্টোবর ৯০ এর ২৬ ২৭ ও ২৮ তারিখে Antioch Theater এর প্রযোজনায় যুক্তরাষ্ট্রে নাটকটি অভিনীত হয়। এর নির্দেশনায় ছিলেন জামিল আহমেদ এবং ডেনী প্যারটিজ। জামিল আহমেদকে ঢাকা থিয়েটার ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের পক্ষ থেকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। বাংলা নাট্যরীতির অন্যতম শাখা কথানাট্য বহির্বিশ্বে তার প্রয়াসেই পরিচিত হলো। একদিন হয়ত বিশ্ব নাটকের পাশে আমাদের নাট্যরীতি শাঘ্য এক করণে দাঁড়াবে নিজের পায়ে।

চাকায় গদ্যপদ্যের দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন ব্যবহারের সর্বজন স্বীকৃত রীতি পরিত্যাক্ত হল এই বিশ্বাসে যে বাক্যের নিজস্ব পরিধিতেই এর অর্থজ্ঞাপকতা বিদ্যামান। তাই দাঁড়ি কমার ব্যবহার ছাড়াই একটি বাক্যের সুনিশ্চিত অর্থ জ্ঞাপন সম্ভব। উপরন্তু আমি চাই আমার দেয়া চিহ্ন শাসনের পরিবর্তে নির্দেশক কিংবা অভিনেতা নিজেরাই নিজেদের সুবিধামত বাক্যের চলনটা ঠিক করে নেবেন।

ঢাকা থিয়েটার ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার এর অন্যতম কর্মী হুমায়ুন কবীর হিমুর আর্থিক আনুকূল্যে চাকা প্রকাশিত হলো। আমাদের স্নেহভাজন মিলাত পাণ্ডুলিপি তৈরির ক্লান্তিকর কাজটি করেছে। তাকেও জানাচ্ছি আন্ত রিক কৃতজ্ঞতা।

আমার নাটকের আদি জিউস যিনি বরাবর হিফাস্টাসের কামারশালায় নানান মূর্তি রচনার সাহস যোগান সেই বন্ধুবর নাসির উদ্দীন ইউসুফকে পুনরায় স্মরণ করি। ঢাকা থিয়েটারের প্রাণপ্রিয় কর্মীদের আহবান করি বর্ণনাত্মক বাংলা নাটক ও অভিনয়রীতির দিকে।

আমাদের শিকড় সন্ধান সফল হোক।

গ্রাম থিয়েটার আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক।

ইতি
১২.১.৯১ ইং
সেলিম আল দীন

নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সাভার, ঢাকা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *