২. দ্বিতীয় লম্বক

দ্বিতীয় লম্বক

প্রথম তরঙ্গ

অতঃপর হে দৃশ্য ও বর্ণনা পিপাসু সুধী মণ্ডলী * দূর হু ই উ ই ধূমেল দিগন্তের দিকে বিশাল পথের অর্ধবৃত্তে খুর ও চাকার দাগ পড়ে * এ পথেরই পাশে কিংবা শাখাপথে কোনও একটি গায়ে মাত্র পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে সম্ভবতঃ অপঘাতে মৃত এই অচেনা লোকটির লাশ পৌঁছে দেবার শর্তে ওদের যাত্রা শুরু হল। ওরা চারজন দুই পইরাত ধরমরাজ এবং গাড়োয়ান।

ভোরে প্রৌঢ় হাঁপানী রুগীর একটু শ্বাস টান ছিল। রোদে বাতাসের জলকণা মরে এলে কষ্টের উপশম হয় * কথার শুরু শেষ কি মধ্যে হু হু কাশি নয় শ্বাসটান।

হু হু যাবো তোরে ধান কাটিবার এলায় চলেছি নাশ নিয়ে * হামাকের কপালে ভালমন্দ কি আছেন কবি কে? আর আকমল ছুমুন্দির পুত যেইনা দেখছং গাড়িত চইড়ে আরামসে সোহাগী বিল যেতে পারছেনা নুম্বা নুম্বা পা ফেইলে ভেইগে গিয়েছে * আর নাশ না পৌঁছালে হু হু ছোঁয়াব পাবু নাকিরে বাহের? অপঘাতে মরলি পরে না খোদার হু হু ফেরেশতা কান্দে * করম হলে চলে না ধরমও নাগেরে বাহের।

এখানে পথ খানিকটা ভাঙা। দ্রুত লাফিয়ে নামে বাহের গাড়োয়ান * ভাঙা পার হয় সাবধানে। পীরের সেবায়িতের ষড়গো আপনেরা নিজের ভালমন্দ নিজে বুঝে লিবেন * হামাকের যানি গুনা না হয় * লাশের ভেদ আপনেরা হামাকের চায়া বেশী সমঝেন গো। যুবক পইরাতের নাম শুকুর চান। তার হৃদয় কতনা জানা অজানা স্বপ্নে বসন্ত বাউরী * তার তো সেই বয়স যে বয়সে গভীর নিশীথে তশতরী ঠুনকি শরবতীদের কাঠবাদামের গাছের নীচে বাঁশী বাজাতে ভালো লাগে * যে বয়সে চাঁদের রাতে বাঁশী বাজাতে বাজাতে ভাবে কোন সে মোহিনী সাপিনী তার সুরের টানে আঁকাবাঁকা পথে তারই কাছে চলে আসবে * চাঁদের অপার্থিব প্রায় কিরণজালে ফণার কোন কোন অংশে তা হয়ে উঠবে ভয়ংকরী প্রতিফলন।

শুকুর চান বলে এট্টুখানি পায়ের পাতা দেখা যায়গো চাচা * কে জানে বয়স কত। কিন্তু সে ভয়ে বলে না এই মৃতের বয়স তারই কাছাকাছি। শুকুর চানের কাঁধে বড় পুটুলী পায়ের পাতায় এখানে ওখানে শেষ রাতের শুকনো বেলে কাদা * সে সহসা থুতনী উচ্চে তুলে ধরে নীল মহানীলে চোখে গেঁথে যায় ওর। আহা চাটাই মোড়া এই লোকটি কি ভালবাসতো কাউকে? সেই দূর গাঁয়ে যেতে যেতে রাত হবে * হয়ত সে তখন শোবার আগে চুল আঁচড়ে নিচ্ছে ঠোঁটে চুল বাঁধুনী সূতো কামড়ে * ভাঙা আয়নায় মুখ দেখেনা রাতে যদি প্রিয়জনের মৃত্যুর সময় কাছে থাকতে না পায়। পেতলের মাজাবাতি সামনে স্থির শিখা চালের দিকে উঠে যাচ্ছে কখনও কখনও দীর্ঘ নিঃশ্বাসের আঘাতে কাপে শিখা। চুলে সুগন্ধি তেল মাখে কাঁচের বাটিতে লালচে মত তেল * এমন সময় চীৎকার হবে তার চুলে আটকে যাবে চিরুনী।

কি হয়েছে গো চাচী

মা গো শফিকের লাশ এইসছে এলংজানি হাসপাতাল থিকে

হাতের প্রদীপ উঁচু করে ধরেছিল এবার পড়ে যায় * ঘরের ঘন অন্ধকারে কান্নার কেরোসীন ছড়িয়ে পড়ে। শুকুর চান বলে উঠে কম্পিত মেয়েটির দুঃখে

আহ্ হা

যুবকের সকল গল্পের শিকড় থাকে মনে * শুধু আহ হা এই শব্দের হুতাশের কলি মুখে শোনা যায় * সঙ্গীরা শুধু এই কথা বলতে শোনে আহা আহারে।

প্রৌঢ় হু হু করা লোকটি বলে কোন মাওএর জানি আদরের ছাওয়াল হে। এবয়সে কত মৃত্যু সে দেখেছে * সবাই মরে কবরে যায় তবে এক একজনের মৃত্যু দৃশ্য এক এক রকম * সবাই মরে কিন্তু কেউ কারো মত করে মরে না। তাদের গায়ের ছোভান গর্ত থেকে গোক্ষুর টেনে বের করতো * একবার এক শঙ্খিনী সাপের মাথা পায়ের নীচে রেখে টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিল। সেও অপঘাতে মরল গায়ের দক্ষিণের মধ্য মাঠে ঘাস তুলতে গিয়ে জ্যৈষ্ঠের এক আম ঝরানো ঝড়ের বিকেলে বজ্রপাতে। পরে রোদ উঠলো * তার ঝলসানো শরীরে বিশেষত মুখে গলায় ধানের কচি পাতার ছাপ পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল কিন্তু খেজুর পাতার চাটাই মোড়া লোকটির মৃত্যু তেমন নয়। তার শরীরের করাতকলের কাঠের গুড় * বড়ো বড়ো বরফের চাক * এরকম অদ্ভুত ঘটনা সে দেখেছে কেবল খাঁচি ভরা ইলিশ মাছের ক্ষেত্রে। সেখানে অবশ্য কাঠের গুড়ো থাকতোনা।

আইচ্ছে রে বাহের

হুঁ

কিবে কইরে মরল ডাক্তার কিছু কয় নাই তুকে?

না।

তুই পুছলি না?

কিসের ঠেকা পড়েছে হামার? খেপের মাল ফেলে দিয়ে চলে যামো।

বাহের এমনভাবে বলে যেন সে জনম ভর এক নিস্পৃহ ভঙ্গীতে এভাবে লাশ আনা নেয়া করেছে। তখনও সে বুঝতে পারে না যে ভোর ষাড়ের ঘুণ্টি ধরমরাজের নাচ ডাক্তারের শ্বেতী কালি চামড়া লাশ এবং মসজিদ খচিত নোট যে যার আপন আপন দিকে তাকে টেনে নিয়ে গেছে। বোধশক্তিরহিত বাহের গাড়োয়ান উঁচু দীর্ঘ খয়ের গাছের মিহি ছায়া পেরুতে পেরুতে শীতল হয়। কপালের ঘাম মুছে সে হঠাৎ ষড়দ্বয়ের তলপেটে পায়ের আঙ্গুলের টোকা দেয় হ হ হ * বুঝতে পারে আজ ভোরে যা ঘটে গেছে তাকে এবং আশপাশে যা ঘটবে কিছুই ফেরানো যাবে না। তখন মনে হয় আপন চটের আসনে সেঁটে গেছে সে * ইচ্ছে করলেই এখন আর গাড়ি থামানো যায় না খ্যাপের লাশটি ফেলে রেখে যাওয়া যায় না * গলা ছেড়ে চিলমারী বন্দরের সেই গানও গাওয়া যায় না।

ধরম রাজ ইচ্ছে মতন রাস্তায় কখনও রাস্তা থেকে হাঁটা পথে নীচে নেমে হাত দুটো পাখীর ডানা বানিয়ে বৃত্তাকার ঘুরতে থাকে।

উড়তিছি গো * হামাকের হাত ধরম ঠাকুরের আশীর্বাদে ডানা হয়েছে * পালক উঠেছে শরীর ভর * গরুড় বিহঙ্গম হয়ে গেছি গো * এবার পোড়া মাটির ধরম ঠাকুরকে পিঠে নিয়ে চলে যায়মা শাল দাহালার দ্যাশে * হায় গো সাঁওতালের দ্যাশে সেই কবে থিকে রজঃস্বলা নারীগণের বন্ধ্যাভাব ছাওয়াল পাওয়ালের জনম বন্ধ। যখন শালের বনে শাদা শাদা গরুর মুখির ফেনাফুলে বন ছেয়ে যায় তখন সেই দেশে নারীগণ বাধক বেদনায় কঁকায় * এই ধরম ঠাকুরের শরীল ধোয়া পানি খেলে সব সেইরে যাবে হামাকের মাবুনদের।

কি কয় পাগলাটা?

তাকর দ্যাশের কথা কয়

শণবনে জাল দিয়ে এক কুড়ি খরগোশ ধরে বধ কুরে দেমো ঠাকুর রক্তে রঞ্জন কুরে দেমো তোমার থান সাত্ততালের দ্যাশের ভুমন জুড়ে জনম ভইরা দেও

এই প্রথম বাহের গাড়োয়ান একটু বাঁকা হয়ে নাক সোজা পথ দিয়ে বহু দূর দিগন্তে তাকায়। সে বোকা পেটুক নিদ্রাকাতর * খুশী এলে মনে মূল ব্যাপারটির চারপাশে থেকে অবিরল কথা বীজ বোনে কিন্তু কিছুতেই বোঝাতে পারে না কিংবা ভুলে যায় বোঝাতে আজ দুদিন পর রান্নাঘর থেকে ইলিশ মাছের ঝোলের গন্ধ পাচ্ছে সে * মাটির হাঁড়িতে লাল ঝালের সঙ্গে দু ফোঁটা সর্ষের তেলে ঝোলের টগবগানি * তার দুঃখও তদ্রুপ। কবে কোন বছর তার একমাত্র মেয়েটি মরে গিয়েছিল পানিতে ডুবে মনে উঠলে সে কথাটি আর কাউকে কিছুতেই বলে না ঘর দোর বাসন আবহাওয়া সব কিছুর ভেতর দিয়ে দুঃখের গন্ধ নিয়ে আসে * বলেনা হামাকের মা জননী ঝুমকীর কথা মনে এসে মন খারাপ নাগতিছে।

দিগন্তে তাকিয়ে গাড়োয়ান ঘটে যাওয়া সব ঘটনা পাশাপাশি সাজাতে চেষ্টা করে * দিল সোহাগীর বিলে জলিধান বহন করে কিছু বাড়তি আয়ের জন্য এই গাড়ি নিয়ে যাওয়া * এক গাড়ি এক আঁটি ধান * ধানকাটার অতিরিক্ত আয়। হঠাৎ সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে বঁড় দুটোকে লক্ষ্য করে বলে তখনই হামাকের বুঝ লওন উচিত ছেলে আপনেরা সাথে থাকলি পরে কত যে কেরামতি ঘটতি পারে আগে জানমো কেমুন কইরে? মাত্র এইটুকু ভক্তি ব্যাঙ্গ বিশ্বাসে মিশে * তবে দিন মজুর গাড়োয়ান খেটে খাওয়া যারা সকল কষ্ট হতাশা এক লহমায় অগ্নি স্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়।

আমি একখান বেজন্মার বাচ্চা * আমাকের কি ঠেকা ছেলো ওই ডোমের বাচ্চার কথায় রাজী হওনের।

হঠাৎ গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামে * র র র

অই ধরমরাজ নরির বাড়িতে চাম উঠায়ে নেমু তর টেকা ফিরত দিচ্ছি গিয়া তর চিতা পড়া ডাক্তাররে বুইলে দে বাহের তার ধানের গাড়িতে লাশ নিবেক না

হে ভাই কি বুলতেছ গো? এনা পোড়া মাটির ধরম ঠাকুর * বলে সে হাঁটু পেতে সংযুক্ত অঞ্জলি উচ্চে তুলে ধরে। যথাস্থলে লিয়ে চল বাবু বুইলতেছি তুমাকে না লাশ নিমো না।

ধরমরাজ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে * লাশ নিমোনা হোহ তোমাকের ঘাড়ে নিবো লাশ * সরকারী লাশ করার কইরেছ * ভুগমান তুমার নাম ঠিকানা নেইখে রেখেছে * পুলিশ এইসে বান্ধিনে যাবো হুঁ হুঁ

যুবক ও প্রৌঢ় বাহের গাড়োয়ানকে সমঝায় * গাড়িতে তুলেছে যখন উপায় নাই * সরকারী লাশ

না নিমো না।

এমুন করিস না বাপ * হাজার ফিরিশতানা এই লাশের পাশে * যাকের কান আছে শুনতি পায় চোখ আছে দেখতি পায়। সহসা বাহের একপাক ঘুরে নেয় বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে লাশটিকে। হাজার ফেরেশতা?

 ধরম লাফিয়ে উঠে গাড়িতে দেও কান্ধে তুলে দেও একাই নিমো লাশ * একাই নিমো। যুবক ও প্রৌঢ় বাধা দেয়।

খবদ্দার ছুঁবে না বুইলতেছি

ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু হয় * বাহের সহসা কোমরে গামছা পেঁচিয়ে তার আসনের নীচে চটের ঝোলানো থলে থেকে ঝকেঝকে দা বের করে আনে।

আয় আয় দেখি নাপাকেরা বাচ্চা মদ খেয়ে নাশ ছুঁবি?

ধরমরাজ দৌড়ে পালায়। প্রৌঢ় হু হু দা কেড়ে নেয় * চল চল মাতাল কিন্তু মানুষটা ভাললারে।

নিঃশব্দে যাত্রা শুরু হয় * আপন ভাগ্যের কথা ভেবে ক্রোধবিষ উপরে খানিক শান্ত হয় গাড়োয়ান * এক শূন্য দৃষ্টিতে তাকায় পথে * গাড়িতে গতির সঙ্গে পথে পথে চন্দ্রবোড়া সাপের কুঞ্চণ দেখতে পায় * চন্দ্ৰবোড়ার শীতল ও পরিকল্পিত নৃশংসতার কথা চাল চরিত্র উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা ভালো জানে।

তবে করে কি সে সাপ?

 বলি শোন।

চন্দ্ৰবোড়ার চরিত্র এই যে সে কেউটে প্রভৃতির মত শিকার ছোবল প্রদান মাত্র কামড়ে ধরে না * প্রাণী দেহে প্রথমে সে তার ফ্যাং ঢুকিয়ে দেয় বিদ্যুৎ বেগে * প্রবল ঝাঁকিতে থলের ঈষদ হরিদ্রাভ বিষ ঢুকে যায় * শিকার ছোবল খাওয়ামাত্র মুক্ত ভেবে যাক বাঁচা গেল ভেবে দৌড়ে পালায় * শিকার যদি ইঁদুর হয় তবে বহুদূর পর্যন্ত চলে যায় * কিন্তু ক্রমে চন্দ্রহীন কি চন্দ্রালোকিত রাতে তার শরীরের রক্তস্রোত জমাট ও কালো হয়ে আসে ক্রমে ঢলে পড়ে। চন্দ্রবোড়া শ্লথ গতিতে প্রায় ত্রিকোণ মস্তকে তাপ আঘ্রাণ করতে করতে শিকারকে পায় গিলে খায়।

গাড়োয়ান বুঝতে পারে পথের শুরুতে যে দংশন করেছে গন্তব্যে পৌঁছালে সেই তাকে গিলবে। সমস্ত পথ রৌদ্রে শ্যামে শঙ্কায় ভরা * পেছেনের বহু দূরে অঙ্কিত চাকার রেখা সামনে শাদা বাঁকা পথ যেখানে দেখতে পাওয়া ফুরায় সেখানে মিশে। আজ উজ্জ্বল আলোকিত ভুবনের সকল দৃশ্য খসে গিয়ে সূর্যের পথপরিক্রমার নীচে একটি যে দৃশ্য তৈরী হল তা সামনে দুই পৌরণিক ষণ্ড এবং একজন গাড়োয়ান মিলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কী এক রহস্যময় অথচ শাশ্বত ঠিকানায়। গাড়ির অনেক দূরে নিকষ রঙা ধরম * এদিকে গাঢ় নীলের নিচে গাড়োয়ানের হৃদয় ক্রমেই বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত হতে থাকে। সে বুঝতে পারে চলতে চলতে আকাশ আলো ষাড়ের কুঁদ ঘুণ্টি ধরমরাজের নৃত্য কচি ধানের বিশাল মাঠ সব কিছু মিলে একটি প্রবাহ তৈরী হচ্ছে। তাতে এই লাশ বহনের দৃশ্যটিকে আর অস্বাভাবিক মনে হয় না * বাহেরও ভেসে যেতে দেয় নিজেকে সেই হঠাৎ ধরমরাজ গরুড় পাখী উড়ে গাড়ির সামনে পিছে হটতে হটতে নাচে * এট্টা পুতুল নাচের গান করি? বলা মাত্র সে গান ধরে *

দেখ দেখ সহচরী
দেখলো নয়ন ভরি
খেলিছে তোমার হরি এসে যমুনায়।
 এমন চাঁদের ছবি
গগনে উদয় রবি
কাল মেঘ লুকে বেড়ায় এসে যমুনায়।

গান থামিয়ে সে বলে বৈশাখী পূর্ণিমায় ঠাকুরের পূজার থানে পুতুল নাচ দেখেছিলাম ছুটু বেলা।

এবং কি আশ্চর্য গরুর গলার ঘুণ্টি যেন গানের নাচের তালে বাজে। ধরমরাজ এবার চেঁচায় এই দেবতারে খুন কইরেছে কে। এই পোড়া মাটির পুতুলটারে ভেঙেছে কে? বলতে হবে বলতে হবে।

গাড়োয়ান হেসে ফেলে * কিন্তু ধরমরাজের পৌনঃপুনিক ভক্তিযোগ আচরণ দেখে সেও ক্রমে মৃতের মধ্যে অতিলৌকিক মহিমা খুঁজতে চায়।

আচ্ছা লোকটা মরল কিভাবে? কেউতো পরিস্কার করে কিছু বললনা। ডাক্তারখানা থেকে যে কাগজটা দিয়েছে তাতে কী নেখা আছে * সরকার এ মৃত্যুর বাদী * গলার কাছ থেকে পেট পর্যন্ত চিরে সব বের করে এনেছিল।

যুবক হঠাৎ সভয়ে লক্ষ্য করে লাশের শরীর থেকে রক্তমেশানো পানি চুঁইয়ে প্লাস্টিকের বিছানার এক কোণে খানিকটা জমা হয়েছে।

হে চাচাজান দেখ দেখি * আমার কেমন জানি মাথাটা গুলে উঠছে

এমন সময় ফাঁদ আর খাঁচা নিয়ে এক ঘুঘু শিকারী গাড়ি অতিক্রম করে* * শুকুর চানের অদম্য কৌতূহল

হে ভাই ঘুঘু আছে না?

আছে গণ্ডা দুই।

ধূমেইল ঘুঘু?

 একজোড়া

তিলা?

হরিয়াল?

ব্যস্ত লোকটি আর কোন কথা বলে না।

যুবক তবু চেঁচিয়ে বলে হামাকের সেদিকে কত বটগাছ কত টিয়ে কত হরিয়াল * টিয়ে হরিয়ালের ডাকে ভরে যায় যুবকের কান। লাল পশমী ফল * পাকা গাবে বাঁকা চঞ্চুতে ঠোকর * বড়শীতে মরিচ বেঁধে টিয়ের জন্য অপেক্ষা * আর এত জোড়া হরিয়াল মেরেছিল গেলবছর শীতে তার সবুজে হলুদ বুকের পালকগুলো কেমন উড়ে উড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিল উত্তরের হু হু বাতাসে।

গাড়োয়ান মঙ্গল অমঙ্গলের বোধে এসে উপস্থিত হয় একা একা বলে পইখ ধইরতে নাই মাইরতে নাই গুণা হয় * একজনরে জানি যেই বছর শীতে মানিক জোড়া মারে সে বছরই তার পুত্র মরে।

কিন্তু বিশ্ববিধানে রোদ নীলাকাশ হু হু বাতাস এমন কি আঁড় জোড়ার নিঃশ্বাস গ্রহণের ফলে নিসৃত ফেনা এ সবের সঙ্গে অপঘাতে এই যুবকের এভাবে মৃত্যুর কোন তুলনা হয় না।

চাকাদ্বয় বাঁকা পথে মোড় ঘুরতেই মিহি কান্নার কথকতা। প্রৌঢ় ভাবে যার স্বজন নাই পরিচয় নাই তার জন্যে কি জগতে এই অজানা অচেনা মানুষও অন্ততঃ এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলবে না? কিন্তু মুখে বলে চাকায় কান্দে শুকুর চান দেখ তাই চাকায় কান্দে।

যেতে যেতে পশ্চিমে গ্রাম বেতাগী থেকে রাস্তা পূবের দিগন্তে আবার উধাও হয়। রাস্তার পাশে ঘরবাড়ী যাদের লাশের গাড়ি দেখে কৌতূহল জাগে * বালক বালিকারা ভিড় করে। এ লাশ তাদের গায়ের নয় বলে স্বস্তি খোঁজে। যে কান্না এখানে কেউ কাদলো না সে কান্না দূরে অপেক্ষা করছে * করছে কারণ সেখানেই তার ঠিকানা ও পরিচয় * সেখানে লোকটির সকল শরীরের একটি পরিচিতি আছে * তার চোখ তারই মত ঠোঁট কান নাক এমনকি ডানদিগের চোখের নিচে ছোট্ট তিলও * সুতরাং তার মৃত্যু এখানে পরিচয়ের যবনিকা টানে না।

গাড়োয়ান আরো নতুন নতুন ভাবনার বাঁকে এসে দাঁড়ায়। সে ভুবনের বাতাসে তার বন ও গামছা ওড়ে * আচ্ছা যে মানুষটা কাকেশ্বরী স্বর্ণখালি নদীর ভুরুঙ্গা মাছ ধরে শস্য কর্তন করে শীতের নীলচে কুয়াশায় দিগন্ত মোড়ানো মাঠে মাঠে হলুদ সর্ষে ফুলের ঘোড়দৌড় লাগায় কেন তার পেট চেরাই করে নাড়িভুড়ি বের করে আনা হবে। যদি যুবক যুয়ান হয় তবে তো আরো তিরিশ বছর বাঁচতে পারতো।

এমন সময় শুকুর চান আকাশে চেয়ে চেঁচায় হুইগো বাহের চাচা কত বড় মৌমাছির ঝাঁক। ধরমরাজ চীৎকার করে বলে ছায়া দিতে দিতে যাবে গো হামার ধরম ঠাকুরের শালবনে ফুল ফুইটেছে তারই মধু খাওয়াবে গো।

খবরদার নড়া চড়া করিস না হুল ফুটায়ে যমঘরে পাঠিয়ে দিবে * প্রৌঢ়বলে।

মৃদু বাতাসে অযুত নিযুত মধুমাছিদের পথ পরিক্রমার গান। গাড়োয়ান ঠোঁটে ডান হাতের তর্জনী ঠেকিয়ে হা করে চেয়ে থাকে * চৈত্রের ভোরে লিচু বনে মঞ্জরীতে এ গান শুনেছে কত * কিন্তু এখন নীল আকাশ ক্রমেই বাড়ে সূর্যতাপ * শস্যটানা গাড়িতে অপরিচিত লাশ ঠিক তার উপর দিয়ে মৌমাছিদের ডানার মিহি ছায়া * কেন? হে খোদা কেন?

এক আশ্চর্য মানুষ আছে ইখানে * হুজুর বুইলেছিল মুসা নবী যখন মেছর থিকে এস্রাইলে যায় পথে পানি কষ্ট খাদ্যখানা নাই তখন আকাশ আন্ধার কইরে মান্না সালওয়া ফলপানি বরিষ হয়েছিল।

৩১

ডিম ফেইটে পিলচু হড়ম আর পিলচু বুড়ীর জনম হলো প্যাক প্যাক প্যাক প্যাক হাঁস দুটু হড় হোপেনের সামনে নাচে আর গায়

হায়ে হায়ে জলপুরী রে
হায়ে হায়ে লুকীন মানেবা।
হায়ে হায়ে বুসাঁর আকাঁকীন
হায়ে হায়ে নুকীন মানেবা।
হায়ে হায়ে তুকারে দুহুকীন
হায়ে হায়ে দুসে লাইয়ে চেন।
 হায়ে হায়ে মারাং ঠাকুর জিয়ো
হায়ে হায়ে বুসাঁর আঁকাকীন
হায়ে হায়ে নুকীন মানেবা
হায়ে হায়ে তুকারে দুহুকীন।

.

দ্বিতীয় তরঙ্গ

যাত্রা শুরু হলো। সূর্য তাদের পেছনে এক সময় লাল হয়ে উঠে * আকাশে খণ্ড মেঘ ছোটে দক্ষিণ পশ্চিম থেকে উত্তর পূর্বে * মেঘের এ রকম গতি হলে বৃষ্টির আশা বৃথা। লাশের বরফ গলে কালো রক্তের ফোঁটা ঝরে * কুত্তিটি একটু ঘাস দেখে পেছনটা নীচু করে মুতে * পিছিয়ে পড়ে কিন্তু পিছন ছাড়ে না। গাঁয়ের শেষে গাঁও পেরিয়ে পানামজা এক বিলের পথে ঘুরে এই একক ও নিঃসঙ্গ গাড়িটি যখন উত্তরমুখো চলতে থাকে পশ্চিম আকাশ থেকে এক অদ্ভুত লাল আভা বিশ্ব সংসারে এসে পড়ে।

হে চাচা এনা মায়ে বুইলতো কারবালার ইমাম হোসেনের রক্ত ফিনিক দিয়ে আকাশে উইঠে গিয়েছিল

এ আলো যখন পড়ে মেঘের মিহি আস্তর থাকে অর্ধ আকাশ জুড়ে * স আস্তরের আভা পাকাপুঁইবীজ কচলালে হয়ত বা হাতের চেটোতে রঙ থাকবে নেগে।

তুমি যে শাস্ত্র বুল এই ঘাউয়া কুত্তিটা কি সিখানে থিকে বেরিয়ে পড়েছে?

সবাই তাকায় কুত্তিটাকে আর অচেনা লাগছে না * তার চাউনী যেন এমন ঠিক বুইলেছে তোমাদের সকলকে চেনা হামার।

মাইল দশেক এলাম না বাহের

 হয় হবি

লণ্ঠন জ্বালাতি হবি না চাঁদ আছে

আলো থাকলি পরে ডর কমে। নয় মড়ার গা ভার ভার করে * বলে হু হু হু প্রৌঢ়। সন্ধ্যার অন্ধকারে সকল ভুবনের ঝিঁঝি ও তারা বেরিয়ে আসে * পূর্বে গগনে চাঁদ হয়ে উঠে রাতের রাজা * পথ আলো অন্ধকারের সমান মিশেলে শঙ্কাময়।

হু হু বাতাসে কেঁদে চলে কেরায়া শেষে একসার শূন্য গরুর গাড়ি * চাঁদের আলোয় অধিক উজ্জ্বল শাদা ষাঁড় দুটোতে চোখ পড়ে সকলের।

কোটে যাছুন গো

নয়ানপুর।

নয়ানপুর না নবীনপুর?

নয়ানপুর সিখান থিকে দিল সোহাগীর বিল * ফসল ফলেছে কেমুন গো?

শিষের ভারে পাকাধানের কোমর গেছে ভেইঙে

হা হা হা নবীনপুর থেকে দিল সোহগী পথটা ঘুরতি গো

গাড়িত লাশ আছে একটা * পৌঁছে দেমো

লাশ?

 হ লাশ

অ মরলো কিবে কইরে?

হামরা জানি না ভাড়া লিয়ে যাচ্ছি।

তারপর সারবাঁধা গাড়ির শব্দ মিলায় দূরে। ঝিঁঝির ডাক চাঁদের আলো ষাঁড় ও কুকুরের লোমে অঙ্কুরিত হয়।

এ বাহের এট্টু এট্টু গন্ধ করে কেমুন যেন গাড়ির পিছনে পিছনে হাটতি গেলে তবে পাশ দিয়ে হাটছুইন না কেন?

ধরমরাজ চেঁচায় * চন্দ্রদেব তুকারে দুহুকিন মুস্কার হো চন্দ্রদেব রূপার থালায় খরগোশের মাংস খামো শালি ধানের ভাত দিয়ে।

বাঁকা পথে গড় গড়িয়ে নামে গাড়ি * সে দিকে নয়ানপুর * কিন্তু নামতে গিয়ে গাড়ি নীচু জলাভূমিতে চলে যেতে থাকে। খবদ্দার গেল গেল

হোই চাচা গাড়ি গেল? ধর ধর।

গাড়োয়ান লাফ দিয়ে নেমে প্রচণ্ড শক্তিতে চাকা টেনে ধরে। শুকুর চান জোয়ালের দিকে যায় * প্রৌঢ় গাড়ির চালা ধরে টানে। গরু দুটো নিশ্চিন্ত মনে পানি খায় * বাহের গাড়োয়ান তীব্র শ্বাস এবং ঘাম ফলাতে ফলাতে জুত থেকে খুলে দেয় গরু। একি বাহেরের ভুল নাকি ষাঁড়েদের বিপুল তৃষ্ণা * পানা ভরা পাগাড় পানি পানে শোসানির শব্দ উঠে ষাঁড়েদের ঠোঁটে ঠোঁটে।

প্রৌঢ় হু হু করে ধরম রাজ কোই?

 শালা ভুতের বাচ্চা।

বহু দূরে হো হো শব্দ শোনা যায় * ধরম ধারে কাছে কোথাও নেই।

বাঁচি গেলুরে বাহের লাশনা জখম হতো * গাড়ি গরু কিছু না একটা অসুবিধে হতো যুবক হাত পা ধুয়ে একটা বিড়ি ধরায় * মুখোমুখি চাঁদের দিকে তাকায় * বিশাল অস্পষ্ট প্রান্তর থেকে হু হু বাতাস তার কানের ঘেরে ওঁ ওঁ ধ্বনি তুলে। বাহের চেঁচায় * চাচা গো তানেদের পা ঠিক আছেন * আল্লার রহম পীরের দোয়া।

আবার চলতে শুরু করে। গাড়োয়ান গজরায় * এই পঞ্চাশ টেকার একখান লুটের লিগে মুই জান দিবার চইলছং * সরকারী লাশ * নাথি মারি সরকারের কপালে।

নিঃশব্দে কখনও কখনও চাকার কান্নাসহ ওদের পথ চলা শুরু হয়। সঙ্গে অজ্ঞাত অনামা মৃত। গাড়োয়ান বলে * এইতো সামনের গাও নয়ানপুর এইতো আপনে নেমে যাবেন * ধরমরাজ ঠাকুর মেনেছে হামরাও মানি * মানিক পীরের ষাড় আছে না অন্তরের খবর জানে*এই তো তুমার শরীর ঘিরে মাটি থপড়ে থাপড়ে কানবু স্বজন পরিজন * তুমার মনের মানুষ চুল ছড়ায়ে দিয়ে কানবু * মরা বুলেই কি মরা? বেবাক তো জানেনা বুঝ দেখ*

চান্দের আলো দেখে মরা মানুষ

দেখে?

শুকুর চান বোকার মত প্রশ্ন করে

শুনে?

ক্যান শুনবোনা। গাড়োয়ান জবার দেয় * হঠাৎ প্রৌঢ় প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে।

এই শুকুর চান লাশ পৌঁছে দিলে তারা কি কেবলই কানবু? হামাকের দুলা ভাত খাতি বুইলবে না? আহা গরম গরম ভাতের নগে যুদি এট্টু বাইগণ ভত্তা দেয়।

বাহের আবার এক নতুন উপলদ্ধির বাঁকে এসে দাঁড়ায়। ঝকঝকে আকাশে চাঁদ * চাঁদের ভোর * তারা দেখা যায় গোল দিগন্তে এখানে সেখানে * বিশাল আকাশ দিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠে পূর্বাভিমুখী শকট শুভ্র কিন্তু অর্থবহ। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে শোকের ঘরে কে রান্ধে ভাত সালুন।

যখন নয়ানপুরের ছায়া ঢাকা ঘন জঙ্গলে ছাওয়া মসজিদ মকতবের সামনে এসে দাঁড়ায় চৌদ্দ দিনের চাঁদ মধ্যগগন ছুঁই ছুঁই। ওরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে চাঁদ ও অন্ধকারের সমান মিশেলে জোনাকের স্রোত * আষাঢ়ী পূর্ণিমার মুখ দেখা গেলে বাতাসে নদীর স্রোতের কথা মনে পড়ে * মাটির স্তর থেকে একটু উপরে বনের কালো অংশে বাতাসের প্রবাহে আলোর কণাবাহী তরঙ্গ। মসজিদের গম্বুজে বসানো চীনে মাটির বাসন ভাঙা তার একটা ফাঁকা অংশে আলো প্রতিফলিত হয়। গ্রাম জুড়ে এ বাড়ী ও বাড়ী থেকে হাসি হল্লা কথা শোনা যায় * এমনকি সাংসারিক চুলোচুলির খবরও রটে যায় ধাবমান বাতাসে বাতাসে।

ভারী অপ্রস্তুত লাগে * কিভাবে এই চাঁদ ও জোনাকী জড়ানো গাঁয়ে তাদেরই এক স্বজন কি পরিজনের লাশ আসার সংবাদ দেয়া যায় * তবে তার কি করার আছে। তাদের গায়ের আলী হরকরার মতই তার কাজ দুঃখ বেদনা লাভালাভের উর্ধ্বে যে দূর প্রবাস থেকে একবাড়ীর জন্য মনিঅর্ডারের টাকা অন্য বাড়ির জন্য দুঃসংবাদ একই নিষ্কম্প হাতে বিতরণে করে। তাতে তার কতটুকু খুশী বা কষ্ট লাগতো * মনিঅর্ডারের টাকাও তার নয় মৃত্য ব্যক্তিও তার আত্মীয় নয়। এ প্রাকৃতের কর্মযোগ * এরকম যুক্তি উজ্জ্বল হলে ভার কমে যায় মনের * তখন সে চাঁদ জোনাকী ও নৈশ বায়ুর প্রবাহে নিজেকে স্থাপন করতে সক্ষম হয়।

ধরমরাজ হঠাৎ চুপ কেন? ক্লান্তি? প্রৌঢ় ও যুবক বাড়ি বাড়ি খবর দিতে যায়। আহা সবুজ কচি লাউ সবার মন সেখানে বঁটির ধার বিধে যাবে। সহসা অজস্র বাতি আর দূর সম্ভাষণের রোল উঠে গাও ভর। অজস্র বাতি দুলে দুলে উঠে এ বাড়ী ও বাড়ী বৃত্তাকারে কাছে দূরে বহু দূরে মাঠ পেরিয়ে। দূরে বলে মানুষের আকার আকৃতি দেখা যায় না আললাগুলোকে স্বয়ম্ভু বলে মনে হয় সুতরাং * বাহের গাড়োয়ান তখন বুকের ভেতর এক দারুণ মোচড় অনুভব করে। বেশতো গোলাপী নোট রোজগার গন্তব্য দায়িত্ব এখন সবশেষ * গাড়িটা ভালো করে ধুয়ে রাতটা ঘুমিয়ে বা শাস্ত্র শুনে কাটাবে। যে আলো উজিয়ে আসে তার জন্য নয় * প্রায় সবুজ শুকানো খেজুর চাটাই মোড়া বরফ দিয়ে যার অন্যায় মৃত্যুকে শাদা ও খয়েরী কাঠের গুড়ার মধ্যে ঢেকে রাখা হয়েছে সে এখন উদ্ভাসিত হবে এসব লণ্ঠনের আলোয়। এ গাঁয়ের সকল আলো মৃতের মুখের দিকেই উজিয়ে আসছে।

এক বৃদ্ধ ৬০ একমাত্র পুত্র সোনাফর ২২ তার বোগরায় কাজ করে। সে চিলের ক্রেঙ্কার তুলে ডানায় বেগনী শাড়ি জড়িয়ে উড়ে আসতে চায় * অতিদ্রতচারিতার ফলে লণ্ঠন নিভে গেলে সে অদৃশ্য হয় * উচ্চকণ্ঠ রোদনের পিছে পড়ে থাকে সে * অথচ তার সাধ রোদনের ধাবমান কণ্ঠের আগে চলে যায়। যেন দেখতে পায় সবার আগে হিমসাগর আমের মুখটি। গম্ভীর পদক্ষেপে নয়ানপুন হাইস্কুলের হেড মাস্টার আসেন। হাতে নিকেল ওঠা টর্চ আলো ঘোলাটে * তিনদিন আগে স্কুলের কেরানী গিয়েছিলেন রাজশাহী বোর্ডে * গতকালই ফেরার কথা * তাঁর হাতে টর্চের আলো ঘোলাটে কিন্তু তা কাপে না।

নয়ানপুর কলেজের ছাত্রী রেহানা ১৯ যে ছেলেটাকে ভালবাসে গোপন একটি রাজনৈতিক দলের সাথে কাজ করে * রেহানার থুতনি মাঝখানে ঢেউ খেলানো ওপরের ঠোঁটের সংগে মিল যেন সাঁওতাল পল্লীর ধনুকের ছাদে গড়া ঠোঁট * রঙ কালো * দুদিন আগে দলের কোন্দলে যশোর এলাকায় তারিফের এক বন্ধু মারা যায়। তারিফ এখন দিনাজপুরে * ওই কদবেল গাছের নিচে তারিফের সংগে শেষ দেখা। রেহানা এ সময়ে অধ্যাপক গার্ণার প্রদত্ত রাষ্ট্রের সংজ্ঞা মুখস্থ করছিল * সংজ্ঞার দাড়ি যতি বিহীন একটানা হবার প্রবণতা ওকে পীড়া দেয়। সব সংজ্ঞার ক্ষেত্রে এই উদ্ভট প্রয়াস দেখা যায় যে এক প্যারাতেই পৃথিবীর তাবৎ সূর্যচন্দ্র বেঁধে ফেলা। শ্রবণমাত্র ওর ছোট বুকটা যে কেমন করে * ধুক ধুক বন্ধ হয়ে মুঠি পিঠা হয় * সে কাজের ছেলেটাকে নিয়ে লণ্ঠন হাতে আসতে থাকে। তার গোলাপী প্রিন্টের শাড়ি আঁচল টানতে টানতে পা ফেলে * সে তার আচরণে একথা কাউকে প্রকাশ করে না যে তারিফের মৃত্যুর আশঙ্কা ওর বুকে।

তারপর আসে শরবতী * ধলুর বৌ। ধলু গেছে নারায়ণগঞ্জের পাটকলে * শুক্রবার থেকে সন্ধ্যেবেলা হুই পথের বাঁকে তাকিয়ে থাকে। চোখের কাজল বিকেল থেকে ঘামতে ঘামতে কপোল পর্যন্ত মিশে যায় * ওর কপালের সাধারণ সীমা থেকে অন্তত এক ইঞ্চি দূরে চুল চওড়া কপালিনী বটে * ভাত জোটে না। বুক টন টন করে * পাটকলে দলাদলি গেলবার দুজন মরল কার যেন তলপেটে চাকু সেঁধিয়েছিল।

মুই যামো না চাচী।

জব্বারের বাপ ৫২ 11 ছেলে থাকে ঈশ্বরগঞ্জ * তার মুখের একাংশ। অবশ। কাঁপা হাতের লণ্ঠন বারংবার ডান হাতে নেয় তখন লাঠিটি অর্থহীন বোঝা হয়ে দাঁড়ায় * ছেলে ম্যাট্রিক পাশ দারোয়ান। সে নিশ্চেত যে আরও দুর্ঘটনা তার জন্যে অপেক্ষা করছে।

হেডমাস্টার মসজিদের চন্দ্রালোকিত গম্বুজের দিকে একপলক তাকিয়ে বলেন।

চাটাই খোল মুখটা দেখমো।

হে খুইলতেছি। বুকটা ফাড়া গো পুরা খুললে ভয় পাবু সোগাই

চাটাই খানিকটা খোলা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সবাই। হেডমাস্টারও ধাক্কাধাক্কিতে বিপর্যস্ত হন * টর্চ জ্বালিয়ে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেন। দু চোখের কোটরে গুড়ো * নাকে তুলো * শাদা উজ্জ্বল কপাল * ঠোঁট দুটো পাতলা কিন্তু কঠিন ও কালো দুটো দাঁত একটু আভাস দেয়। দাড়ি মোচ খোঁচাখোঁচা * দেখামাত্র হেডমাস্টার বলেন

ইন্নালিল্লাহে দূরে দাঁড়ানো নারীগণ চীৎকার করে উঠে * আল্লা গো বৃদ্ধা ছুটে এসে বলে * আল্লার কছম মোর ছাওয়াল মোক দেখবার দেও। সে গাড়ির পাটাতনে মাথা কুটে টুক টুক। হায় নিত্য দিন দূরবাসী পুত্রের জন্য তার শঙ্কা ব্যর্থ হবার নয় * ঝাঁপসা চোখে সে মুখ পুরো দেখে না বলে মৃতের মুখ হাতড়ায় হা সোনা হা সোনা এমান ঠাণ্ডা ক্যা তোরশরীল।

দূরে সমবেত নারীগণ আরও দ্বিগুণ স্বরে শোক উদগীরণ করে।

কিন্তু ততক্ষণে হেডমাস্টার গম্ভীর কণ্ঠে বলেন * না এ তোর ছেলে না সোনাফরের মা।

বৃদ্ধা চীৎকার করে হামাকে মিছা কথা দিয়ে ভুলাতে চাস * এইতো সোনাফর আ হা হা। হেডমাস্টার আরও উচ্চকণ্ঠে বলেন * বুইলেছিত এ তোর ছাওয়াল না এই নয়ানপুরের এরে দেখিনিক কুনোদিন

উপস্থিত লণ্ঠনগুলো যেন হাতে আটকে যায় সকলের * কথাটা আবার শোনার জন্য কানপাতে।

সকল মরা মানুষেরই নাককান চোখ আল্লায় যদি রাখে তবে থাকে * তার মানি এই না যে তা থাকলেই তোমাকের ছাওয়াল পাওয়াল ভাই বাপ। এই লাশটা কোখিকে এসেছে? ঠিকানা দেখি?

দুটো কাশি দেন সকল পঞ্চাশোর্ধ হেডমাস্টারের মতই নিকফ এবং গম্ভীর। ধরম রাজ স্তব্ধ হয়ে যায় * ঝোলা থেকে খুঁজে পেতে ঠিকানা বের করে * অন্ধকারে শাদা কাগজে কলমভাঙা রায় পড়বেন জজ সাহেব। ভীতিকর শাদা কাগজে টর্চের আলো পড়ে * খান দশেক হ্যারিকেন উচ্চে উঠে যায়।

নয়ানপুর নবায়পুর হানিফালি কী হোসেনালি পিং মোংআজাফর এভাবে নাম ঠিকানা সরকারী লেখার গুণে দ্বিধান্বিত হয়ে উঠে।

একজন গম্ভীর কণ্ঠে বলে এই গাঁয়ে এই বয়সের একজন হোসেনালি আছে ঘোড়ামারা কাজ করে * কাল ফিরেছে।

কিন্তু তার বাপ মোঃ মালেকা মৃত * গুটি বসন্তে বছর আট আগে মরেছিল।

জীবিত হোসেনালিকে খুঁজে পেতে কারো বিলম্ব হয় না। তার দিকে তাকিয়ে আসন্ন শোক তরঙ্গের গর্জনভীত ভীড় নিশ্চল হয়ে যায় * তারা। বিস্ময়ের সাথে দেখেতে থাকে জীবিত হোসেনালিকে। ভাগ্য ভালো সে আমবাগানে প্রহরীর কাজ করে * কাল ফিরেছে * কাল যদি না ফিরতে তবে ওই হোসেনালির স্থলে কি এই হোসেনালি থাকতোনা। আর এই হোসেনালি যদি মরে তবে মৃত হোসেনালির বাপের নামও বদলে যেত। জীবিত হোসেনালি ভীত হয়ে উঠে * যেন মৃত্যুর কালো তরঙ্গ পথ গ্রাম নাম সব অতিক্রম করে তার পিতার নামের কাছে এসে ফিরে গেছে * ফিরে গেছে বলে জীবিত হোসেনালির চোখের জ্বতে কালোফেনা যে নেই স্পর্শ না করে বলা যাবে না!!

এখানে একজন হোসেনালি চাটাই মোড়া মৃত হোসেনালিকে গভীর আগ্রহে লণ্ঠন উঁচু করে দেখে। চোখে সরাবার পরও করাত কলের ঝুর ঝুরে ধাতব শিস * ঠোঁট শক্ত কালো ঠাণ্ডা * গুলি কিংবা ছুরি অথবা বজ্রপাতে জীবনের শেষ শূন্য মুহূর্তে যে ভয়ের কুঞ্চন একবার ঝলসে উঠেছিল তার চিহ্ন ধীরে ধীরে মুখপেশীর নীচে আশ্রয় নিয়েছে। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে কী ঘুম কী প্রশান্তি * কিন্তু আর দশটি স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এমন মানুষের মুখের অন্তিম রেখাগুলোর সঙ্গে এর ভেদটা একটু ভালো করে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেই বোঝা যাবে। জীবিত হোসেনালির খুটিয়ে দেখা যেন আর থামে না * ক্রমে ধীরে ধীরে মৃতের মুখের আদল তার সজীব মুখে নানান রেখা আঁকতে থাকে। ভয়ে নিজের মুখে একবার হাত বুলিয়ে মৃতের মুখের ছাপ লাগা ছায়া মোছার চেষ্টা করে * পরে সে বোকার মত সবার দিকে তাকায়। সে ভাবে যে হয়তবা তারই মরার কথা ছিল * ওই হোসেনালি মরে গিয়ে এই হোসেনালিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সবাই ঘিরে ধরে তাকে * বিশেষতঃ নারীগণ * নারীগণ তাকে বেষ্টন করে উচ্চস্বরে কাঁদে। মুহূর্তেই হোসেনালি হয়ে যায় কোন মৃত্যুঞ্জয়ী বীর * তার চারপাশে নানান ভঙিতে লাল কালো নীল পৌরাণিক নারীগণ বিস্ফারিত চোখ * পটচিত্র। হেডমাস্টার এবার বিরক্তের সাথে আদেশ করেন *

যাও ভুল ঠিকানায় এসেছ * তবে দু মাইল দূরে নবীনপুর বলে এক গেরাম আছে এই পথে সোজা * হয়ত সেখানে এই লোকটার ঠিকানা মিলতে পারে। সেটা জুয়াড়ী গরুর দালাল আর সিধেল চোরদের গ্রাম *

সে গ্রামে সবচেয়ে বেশী অপঘাতে লোক মরে * এখানে ইস্কুল আছে কলেজ আছে মাদ্রাসা আছে * বুঝেছো। এইতো গেল মাসে উপমন্ত্রী এসেছে এ গ্রামে বলে অনাবশ্যক অনেকটা পেশাগত গাম্ভীর্যে গলা খাকারী দেন। গাড়োয়ান নিথর মেরে বসে থাকে। এখন তিনজন ক্ষুধার্ত ও মৃত একজন কোথায় যাবে? ভিড়ের মধ্যে কেউ বলে * আপনাকের কুননা দোষ নাইগো * ডাকের চিঠি কত দেখেছি এ গাওরটা ওই গাঁয়ে যায়। গাড়োয়ান চেঁচিয়ে উঠে হয়েছে থামেন * মুই সরকারের ডাক হরকরা না * মুই খেইটে খাই গতর বেইচে খাই

কিন্তু এত কিছুর পরও বুড়ী চীৎকার করে * ও হামাকের পেটের ছাওয়াল গো * তোমরা সবে মিলে যুক্তি করেছ * অরে রেখে দেও * অ সোনাফর। বাপজান।

সবাই টেনে ধরে বুড়ীকে * কিন্তু তার আছাড়ি পিছাড়ি ও রোদন থামে * চুপ যা চুপ যা।

চাকায় চাকায় রোদনের দীর্ঘ রেখা আঁকতে খাটুনী বেচা অভুক্ত ক্লান্ত চারজন মানুষ ও একজন ভুল ঠিকানায় আসা মৃত যাত্রা শুরু করে। মসজিদের গম্বুজ তেমনি কালো বৃক্ষছায়ার আড়ালে শাদা দ্যুতি ছড়ায় * আবার বনজ অন্ধকারের খাতে জোনাকীর প্রবাহ শুরু হয়। চাকার শব্দ এই গ্রামের ওই মোড়ে এসে দূর হতে হতে মিলায় দূরে।

কিন্তু যারা নবীনপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে চাঁদ মাথার ঠিক ওপরে বলে ছায়াটুকুও শুষে নেয় * ছায়া তৈরী করে না এমন আলোয় মানুষ নিজের কাছে নিজেই ভারী ভীতিকর ও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠে। বাহের গাড়োয়ান একা একা কথা বলে * তবে তুকে নিয়ে যামো কোঠে? কেবা তোমার মাতা কহ কেবা তুমাকের পিতা গো। আহা ভদ্র লোকের গায়ে হামাকের এট্টু পুছ করল না এ ভাই ক্ষিদা পায় নাই তোমাকের? এখন মোর সন্দ হয় তুমি ওই বুড়িটারই ছাওয়াল * এখন মোর সন্দ হয় সবাই যুক্তি কইরে বুলেছে না না এ তুর ছাওয়াল না হয়।

কিন্তু কেন সে জানে না * আবার প্রৌঢ় হু হু করতে করতে বলে * এট্টু থামায়ে নিয়ে খানিক ছাতু পানি খামো। হঠাৎ যুবক বমি ঠেকাতে আপন কণ্ঠনালী চেপে ধরে। ধরম কোন কথা বলে নি এতক্ষণ এবার শূন্যে চিবুক তুলে বলে * একি নীলে হল তুর হো জিয়ো।

আম বাগানে পাতকুয়ার পাশে গাড়ি থামে * সেই কুত্তিটা এতক্ষণ কোথাও দেখেনি কেউ এখন আবার কোথা থেকে এসে ধরমরাজের পাশে বসে * ইঁদারার কাছে যায়। মাটিতে জমে থাকা পানি খায় লক লক করে। ইদারা থেকে পানি তুলে সবাই আঁজলা ভরে পান করে হাত মুখ ধোয় * যুবকটি হাঁড়িতে ছাতু মাখে * মনুয়া কলার ফানা বের করে আনে প্রৌঢ়।

দূরে ধরমরাজ গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে তারপর চেঁচিয়ে বলে * হেই বাবুরা দু মুঠা গরম ভাত দেও ধরম ঠাকুরের ভোগ দেও * মদ খেয়ে খেয়ে ইষ্টমাকে ঘা করে ফেলেছি।

সহসা বাহের গাড়োয়ান কুদ্ধ কণ্ঠে গর্জন করে উঠে * শুওরের বাচ্চা ল এই তোর চিপড়া ভুগমানের পঞ্চাশ টাকা * যা লাশ হটা। তার চোখ জ্বল জ্বল করে * উঠে গিয়ে ধরমরাজের সামনে দাঁড়ায়।

হামাকেরে ভুল ঠিকানায় আনলু ক্যা? ওঠ খাড়া কথার জবাব দে ঠিক মত।

আগে খেতে দেও পরে মার

শুওরের বাচ্চা * ভুল ঠিকানার লাশ এনেছো। লাফিয়ে পড়ে গাড়োয়ান টুটি চেপে ধরে * যুবকও প্রৌঢ় ছাড়াবার চেষ্টা করে।

অর দোষটা কি? ঠিকানা দিয়েছে ডাক্তার

গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতেই ধরমরাজ পালায় * এবং তাকে আর দেখা যায় না পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত।

তখন যুবক যেন নিজেকে নিজে বলে লাশটা রাইত অন্ধারে চাপা দিয়ে যাওনই ভালা।

বাহের অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়।

তর কথা শুনে ফের খুন চাপে মাথায় * সেই সকাল থিকে যার নিগে এত কষ্ট এতপথ তারে ধূলায় চাপা দিয়ে যামো? মরা বলে কেউ না সে?

এক চূড়ান্ত ঘোষণার মত শোনা যায় কথাটা। কথাটা অনিবার্য সময়ে উচ্চারিত হল একটু আগে বা পরে নয় * কেননা আগে উচ্চারিত হলে তা অসংলগ্ন মনে হত পরে হলে তা হত প্রয়োজনের চেয়ে বেশী পরে। কথাটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না * লাশটি তাদের সে অর্থে কেউ নয় বটে কিন্তু সঙ্গে থাকতে থাকতে সঙ্গী হয়ে উঠেছে। শস্যের চেয়ে শূন্য উদরের চেয়ে মৃতের আহ্বান প্রবল হয়ে উঠে মধ্যরাতে।

মরা বুলেই কি সে দেখেনা বুঝে না শুনে না * নতুন কবরের কাছে গোরু বান্ধিস দেখবু কেমন ছটফট করে।

সহসা খুব কাছে থেকে প্রথমে একটা শেয়ালের এবং পরে আরো একটির রূপালী চীৎকার * রূপালী কেননা সে চীৎকারে মৃতের মাংস আঘ্রাণের লালা ভরা। ওদের দোষ দেয়া যায় না। পৃথিবীর সকল পচন্ত মাংসেই তাদের অধিকার আছে। কুত্তিটি এগিয়ে গিয়ে এভাবে খেউ খেউ খেউ কিন্তু পাল্টা উচ্চারণ শুনে ভয়ে গাড়োয়ানের পায়ের কাছে এসে লেজ পাকিয়ে কুঁই কুঁই করে। শেয়াল জুটেছে বাহের নিদ যাওয়া যাবু না * তা হলে লাশ আস্ত থাকবু না তারচে চল নবীনপুর উদ্দিশ করি * বাহের খেতে খেতে কাশে।

না এখন উঠতি পারমো না * এলা খানিক জিরয়ে নেমে * তুমি করবলার পুথিটা ধর ছোয়াব হবু।

এই নাশ রেখে * গুণা হুবু না

ক্যা গুণা হবু ক্যা * ইমাম সাবের কিসসা জগতে কার না কান্দন ভরে চক্ষে }

তবে কুনখান থিকে বুইলবো একটু কেশে নিয়ে শুরু করে

খঞ্জর নিকলি সীমার
কহে দুষ্ট মার মার
ছের কাটিলে পামো
এক লক্ষ টাকা।
 যখন মারিল ছোরা
জহর মাখিয়া ত্বরা
ফিরুজা আসমান যেন
মেঘে পড়ে ঢাকা।
লইয়া নবীর নাম
কহিলেন যে ইমাম
না পড়িবে কাটা ছের
কাট দিনসাতে।
তবেত সীমার কহে
বুঝিতে না পারি অহে
কাটে না জহর ছোরা
মেরা দুই হাতে।

বৃদ্ধের ক্লান্ত গলায় মধ্যরাতে কান্না পেয়ে যায় যেন। আম বাগানের চিত্রিত আলো * বাগান থেকে দূরে দক্ষিণ পশ্চিমে খোলা প্রান্তর ঘুরে শেয়ালের দল আরো দূরে চলে যায়। এখানে এই তিন জনের মনে মনে খেজুর পাতার চাটাই মোড়া লাশটি ইমাম হোসেনের মতই কবন্ধ হয়ে উঠে * আমবাগানের ছায়া নেই কারবালার প্রান্তরে * বিশ্বনিখিল ধূসর বালুময় * জলের অভাবে মরলেন নবীর দৌহিত্র। ঠিকানাও কি আজ এই মৃতের জন্য জলের মতই অনিবার্য ও প্রয়োজনীয় নয় * যদিও ফোরাতের জল আর লাশের প্রকৃত ঠিকানা তুল্য নয়। তারপর প্রৌঢ় গান ধরে কিভাবে বিবি সখিনার হাতের মেহেদী কাশেমের মৃত্যুতে স্লান হল * কিভাবে আহাজারী উঠলো ইমামের তাবুতে * আকাশে টুকরো টুকরো ছেঁড়া মেঘ দক্ষিণ পশ্চিম থেকে উড়ে উড়ে পূর্বে যায় * শাদা মেঘের ছিন্ন পাড়ের ভেতর কালোর আভাস।

এজিদ দেখতি কেমুন ছিল? বাহের আকাশে তাকায় এ কথায় * কে। জানে কেমন ছিল।

.

তৃতীয় তরঙ্গ

আবার নতুন উদ্যম ও বিশ্বাসে নতুন ঠিকানায় যাত্রা শুরু হয় * নবীনপুর * হালটের মধ্য দিয়ে পথ তারপর সরকারী রাস্তা। গাড়োয়ানের পায়ে স্বস্তি আছে আসনে বসা বলে * বাকি দুজন হাঁটতে হাঁটতে দুলতে দুলতে যায় * পা ভাঙতে ভাঙতে চলে। ষড়দ্বয়ের মুখে ফেনা নিঃসণের ধ্বনি দু এক দলা ফেনা ঝরে। চাঁদ মধ্যরাত ঠেলে উজাতে থাকে * শুকুর চানের ডান উরুর সন্ধিতে বাগীর মত ফুলে উঠেছে ব্যথা। সহসা গাড়োয়ান মধ্য মাঠে চীকার করে।

হো ও ও খোদা হামাকের মুক্তি নাই * মোরা নেতিয়ে পড়মো উপুড় হমো পথের ধূলায় তবু মুক্তি নাই * এই পীরের থানের গরুর মুক্তি নাই।

 চাঁদ লাল হয়ে আসে মধ্যরাতের পর। প্রতিধ্বনি আসে দূর গাঁও থেকে মুক্তি নাই * রাতের বাদুড় ও মুক্তি নাই কথাটা পাশাপাশি উড়ে যায়।

পাগলা হলু বাহের * এমুন কইরে বিলেপ করিস ক্যানে

তবু বাহের বেদনায় ক্রোধে চীৎকার করে

তুমার মুক্তি নাই শুকুর চানের যে হাঁটতি কষ্ট হয় মুক্তি নাই

যুবক ভয় পায় * বিশাল হা করা মাঠ প্রতিধ্বনি বাদুড়ের ওড়া চাঁদের লালচে ভাব জিয়ো ধর্মঠাকুর কারবালার হত্যাকাণ্ড। মুক্তি নাই কথাটাকে তার শরীর বলে মনে হয় * মনে হয় মধ্যমাঠে এক লৌকিক গল্পের জ্বীন মুক্তি নাই * দু পা ফাঁক করে মুক্তি নাই দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল তার শরীর পশ্চিমের চাঁদ ছুঁই ছুঁই করে তার মাথার বাঁকা শিঙ * শিঙে শিঙে ভৌতিক আলো জামা ভরা তারার আলো।

চলে শাদা ষড়দ্বয়। ওরা নিশ্ৰুপ * হঠাৎ তিনজনের মধ্যে একজন কথা বলে

কি?

কই

কিছু কি পুছ কইরেছিলে?

আরে না তবে কথা বুইললো কে?

গাড়োয়ান ছাড়া বাকী দুজনের গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। প্রৌঢ় বলে * বরফ গলে লাশে পচন ধইরেছে পিছে হাটলে বয় করে।

তবে দৌড়ে যাও নয় নাকের ফুটোয় মাটির চাক ভইরে দেও * চীৎকার করে * নয় ফিরে যাও আপন আপন দেশে ফিরে যাও * বুলবে কিয়ামত শেষ হাশর শেষ তও শাপ কাটে নাই বাহের গাড়োয়ানের * লাশের গাড়ির সঙ্গে তার পাছা সেহঁটে গেছে * সে ঘুরবে তামাম পৃথিমী মুক্তি নাই।

বাহের এমুন কইরে কথা বুইলছিস ক্যানে।… আমরা এট্টু বিড়ি খেয়ে জিরয়ে নি তুই মাঠ শেষে রাস্তার মোড়ে বসবি এট্টু কাম কাজও সারতি হবু পেটটা ভাল যাচ্ছে না

বাহের নিরুওর * গাড়ি চলতে থাকে।

হঠাৎ লাশটি যেন উঠে বসে খেজুর চাটইর বাঁধন ছিঁড়ে * অস্পষ্ট কালো মূর্তি চাঁদের বিপরীতে বলে।

তুমার মন খারাপ নাকি গো?

তারও চে বেশী

আমার শরীলটা গোরে ছেপে না দিলে শান্তি পাই না * পচন ধইরেছে গো

হামাকের সঙ্গীগণের বমি আসে তোমাকের পচা গন্ধে

মোর পচাগন্ধে মোরই বমি আসতেছে।

তবে বমি কর ধুয়ে মুছে দেমো

কিন্তুক মোর পেট শূন্য নাড়ি ভুড়ি ফুসফুস গুদা পেট ফেইড়ে তার মিঝে সান্ধায়ে দেছে গো 

গাড়োয়ান হঠাৎ টের পায় সে মৃত যুবকের সঙ্গে একাই কথা বলছে * সহসা সে বিড় বিড় করে।

পাগল হয়া যামো মুই পাগল হয়া যামো * চাঁদ পশ্চিমে হেলে কতরাজ্যের পার তুকে লিয়ে আমি কতদূর যামো।

বহু দূর থেকে শুকুর চান হাঁকে হো ও। গাড়োয়ান এবার মৃতকে লক্ষ্য করে বলে * আইচ্ছা ঠিকানা ভুল হলে কি মরা মানুষের দায়িত্বটা কুনোজন নিবু না? যে মরা তারতো নিজের কিছু করণের ক্ষমতা নাই * সে না পারে চলতে না পারে নিজের কুনো উপকার করতে * ঠিকানা যুদি না পাও তবে আমরা দায় নিলাম লাশের নয়ানপুরের মানুষ এট্টু যদি বুইলতো এ ভাই কত না কষ্ট করেছ তুমরা।

তারপরে এ ভাই লাশ ভাই

তুমারে লিয়ে মুই কেবলি চলমো গলতে গলতে পচতে পচতে হাড় থাকবুকখান তারপর জৈষ্টি আষাঢ় শাওন ভাদ্রে ধুয়ে যাবে পচাগলা * শাদা হাড় কখান গাঁওতে গাঁওতে ফিরি করমো হামি * কমু দেখ এই হাড় মাথা তোমাকের কারু কিনা হা হা হা * মানুষই চেনে না তবে মানুষের হাড়।

তখন মিহি ঠাণ্ডা নেমেছে। গাড়ি থামে * বাহের গোরু দুটোকে জোয়াল থেকে ছাড়িয়ে দেয় খানিকক্ষণের জন্য। দূরে ক্ষীণ শব্দ * মাইকের ভেতরে গান * হলুদ বাটো মেন্দিবাটো বাটো ফুলের মৌ * বিয়ের গান * একেবারে উল্টো গান * তবে বিবাহের যেমন বিশেষ পোশাক মৃতের জন্য তেমনি। ষাড় দুটো ঘাস খায় * বাহের অপেক্ষা করে * এর মধ্যে একটি ষাড় গাড়ির পাটাতনের কাছে আসে * খেজুর পাতার মোড়ানী শুকে ফোঁস ফোঁস করে * সরে এসে খুরে মাটি ছাঁটে। তারপর হঠাৎ লাফিয়ে ছুটতে থাকে * লাফিয়ে ছুটে প্রান্তরময়।

শুকুর চান নড়ি হাতে গরুর পেছনে ঊর্ধ্বেশ্বাসে দৌড়ায় * কুত্তিটাও পেছনে ছুটে। শাদা চাঁদের আলো কালচে সবুজ কচি ধান এখানে ওখানে পতিত জমির ধূলা ওড়াওড়ি খেউ খেউ খেউ।

এই দুঃসময়ে বঁড় কেন এমন করে। একি ওই মর্গের অন্ধকার থেকে আসা যুবকের অন্যায় মৃত্যুর বিরুদ্ধে ষাড়ের ক্রোধ? কিংবা আদতেই নবীনপুরের কেউ হবে এই যুবকটি * তার জীবিত কালের গন্ধ পেয়েছে ষড়? আহা এখানে কি এই পথের পাশে একা বাঁশী বাজাত ফালগুনে চৈত্রে কিংবা বোশেখে?

কিন্তু ততক্ষণে সঙ্গীদ্বয় এবং বাহের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। মালকোচা মারা তিনজন দিনমজুরকে কালো এবং নগ্ন মনে হয় * আদি কালে বন থেকে তাড়িয়ে যে ষাঁড়টিকে গৃহ প্রাঙ্গনে লালন ও প্রজননের আশায় আদি মানুষ ধরতে চেয়েছিল সে এই। আজ রাতে পৃথিবীর প্রথম ষাঁড় ধরা হবে * এ দৃশ্য নিশ্চিতই প্রাচীন কালের * তিন শিকারী মূর্তি ও মুদ্রায় অরণ্যের ছাপ * অবশেষে ষাঁড় আত্মসমর্পন করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *