মানুষ

মানুষ
৯/৩/৪৭ ইং

.

চরিত্র

আব্বা
আম্মা
ফরিদ
জুলেখা
শিশু
লোকটা
এবং লোকজন

বড় শোবার ঘর। ডান দিকে একটা খাট একটু কোণাকোণি করে রাখা। মশারী ওঠান। বামে মাঝারি রকমের টেবিল, তাতে শেড দেয়া ল্যাম্প, পাশে টেলিফোন। দু-একটা অতিরিক্ত বসবার জায়গা। একদিকে গোসলখানার দরজা, অন্য পাশে গরাদহীন কাঁচের বড় জানালা.

পর্দা ওঠার সংগে সংগে শোনা যাবে, দূরে বহু কণ্ঠের মিলিত ধ্বনি বন্দেমাতরম। এবং একটু কাছে প্রচন্ড আল্লাহু আকবর রব! এই দুই চিৎকারের সংগে সামঞ্জস্য রেখে মাঝে মাঝে দেখা দেবে, বন্ধ জানালার কাঁচের মধ্যদিয়ে, দূরে, লকলকে আগুনের শিখা, নীল আকাশকে রক্তিমাভ করে কাঁপছে।

ঘরের মধ্যে চারজন লোক ও একজন অসুস্থ শিশু। খাটের ওপর বর্ষীয়সী আম্মাজান আধশোয়া অবস্থায় শিশুকে আস্তে আস্তে বাতাস করছেন। আবছা আলোতে আম্মাজানের ক্লান্ত উদ্বিগ্ন মুখ এক অদ্ভুত বিষাদভরা গাম্ভীর্যে স্তব্ধ। শিশুর অন্য পাশে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে কিশোরী জুলেখা। মাথায় ওড়নার এক অংশ ঝুলে মাটিতে পড়ে গেছে, লক্ষ্য নেই। ঘামে কপালের গুঁড়ো চুল গালে গলায় লেপটে আছে। অসহনীয় আতংকে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে ভয়ার্ত অর্থহীন চাহনি। টেবিলের সামনে খাটের দিক পেছন ফিরে, কোমরের পেছনে দু’হাত মুঠ করে দাঁড়িয়ে আছেন আব্বাজান। নিশ্চল নীরব। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন টেবিলের ল্যাম্পের সহস্র আলোকরশ্মির কেন্দ্রস্থলে। যেন ভেতরের কোনো অশান্তি বিক্ষুদ্ধ হিংস্র অন্তর্দ্বন্দ্বকে নিষ্পেষিত করে তবে তিনি সুস্থরূপে ধারণ করবেন। টেবিল ল্যাম্পের সংকীর্ণ। আলোপরিসীমার মধ্যে ফাঁপানো সাদা দাঁড়ী আর কপালের গভীর রেখা জ্বলজ্বল করছে। দ্বিতীয় ছেলে ফরিদ নিশাচর কোনো পশুর মতো সন্তর্পণে সামনে পায়চারী করছে। থমকে দাঁড়াচ্ছে। চোখেমুখে প্রতিহিংসার ছায়াবাজি।

দূরে ধ্বনি উঠল বন্দেমাতরম, তিনবার। হাজার কণ্ঠের আকাশ কাঁপানো হুংকার। তারপরই, তীব্র অন্ধকার ছিন্নভিন্ন করে পাল্টা আহ্বান, আল্লাহু আকবর।

কিছুক্ষণ সব স্তব্ধ।

.

আব্বা : আল্লাহু আকবর! আল্লাহু আকবর! আল্লাহু আকবর!

জুলেখা : আব্বাজান! আব্বাজান!

আব্বা : কি! ভয় পেয়েছিস, না! ভীরু কোথাকার! ইমানের ডাক শুনে আঁৎকে উঠেছিস? চুপ। কাঁদিস না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে শোন আবার। আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর। বল, ভয় লাগে এখনো।

জুলেখা : না।

আব্বা : ভেবেছিলি আমি পাগল হয়ে গেছি, না! কেন? জীবনে অনেক লোককে মরতে দেখেছি, চোখের সামনে। শ্বাস বন্ধ হয়ে, চোখ উল্টে দিয়ে, জিব বার করে, গলগল করে রক্ত বমি করে কত সুস্থ মানুষকে মরতে দেখেছি। কৈ কোনোদিন তো উন্মাদ হয়ে যাই নি।

আম্মা : (ফরিদকে) হাসপাতালে আরেকবার ফোন করে দেখবি?

ফরিদ : লাভ নেই। ওরা মোর্শেদ ভাইয়ের বর্ণনা টুকে রেখেছে। কোনো সংবাদ পেলে আমাদের ফোন করে জানাবে বলেছে।

 জুলেখা : মোর্শেদ ভাই আমার জন্য বই কিনতে বেরিয়েছিল। মোর্শেদ ভাইকে আমি কেন যেতে বললাম।

 আব্বা : চুপ, চুপ নালায়েক মেয়ে। আদরের দেমাক করিস না অত। তুই, তুই কে? মোর্শেদকে বাইরে পাঠাবার না পাঠাবার তুই কে? যিনি পাঠাবার তিনিই পাঠিয়েছেন। মালাউনের ছুরির খোঁচায় মরণ, ওর তকদিরে লেখা ছিল এমনি মওত। আজ রায়ওট হবে জানলেই যেন তুই সব রাখতে পারতি।

ফরিদ : আব্বা।

আব্বা : কি তোমারও ভয় হচ্ছে আমি উন্মাদ হয়ে গেছি! আমি ভুলে গেছি বাপ হয়ে মেয়ের সংগে কি করে কথা বলতে হয়!

 ফরিদ : হাসপাতাল থেকে ওরা এখনও কোনো খবর দেয়নি, আপনি মিছেমিছি ওসব কথা কেন ভাবছেন?

আব্বা : হাসপাতাল! ওরা তোমার ভাইকে ছুরি মেরে কোলে তুলে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে গেছে, না? ওগো, শুনেছ তোমার ছেলের কথা? আমি জানি মোর্শেদকে এতক্ষণে ওরা কি করেছে। আমি জানি।

 ফরিদ : আব্বাজান, আপনি তার কথা বলবেন না। চুপ করে শুয়ে পড়ুন।

আব্বা : চুপ করে শুয়ে থাকব? কেন? ওরা আমার ছেলেকে কেটে, আমি পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি, শরীর থেকে গলা কেটে মাথাটা আলাদা করে ফেলেছে। মোর্শেদের কালো কোঁকড়া চুল চাক বাধা রক্তের দলার সংগে লেপটে ওর গাঢ় মরা চোখ ঢেকে রেখেছে।

জুলেখা : ভাইয়া, আব্বাকে চুপ করতে বল।

আব্বা : কে, কে আমায় চুপ করাবে? তোরা মরে গেছিস। তোরা চুপ করে থাক। তোরা ওর ভাই নস্, বোন নস্। তোরা ওর কেউ নস্। তাই তোরা চুপ করে আছিস। আমি ওর বাপ

 আম্মা : জুলেখা!

জুলেখা : আম্মা!

আব্বা : আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, ওরা ওর কাটা মন্ডুকে কাঁসার থালায় সাজিয়ে ফেরি করে বেড়াচ্ছে, ওরা সবাই তাই দেখে বাহবা দিচ্ছে, -ফুর্তির খাতিরে মুঠো মুঠো টাকা পয়সা ছড়িয়ে দিচ্ছে আমার ছেলের নরম সাদা গলাকাটা লাশের—

আম্মা : খো দা আ!

আব্বা : কে, কে খোদাকে ডাকল?

ফরিদ : আম্মা, আম্মা কথা বলছ না কেন? খোকার দিকে আংগুল দিয়ে কি দেখাচ্ছ?

জুলেখা : ভাইয়া, খোকা যেন কেমন হয়ে গেছে। নড়ছে না। মুখের শিরাগুলো কি রকম নীল হয়ে ফুটে উঠেছে।

আব্বা : দেখি, দেখি। আমায় দেখতে দাও। জুলি অমন ঝুঁকে পড়ে রইলি কেন! পানি, একটু পানি নিয়ে আয়।

 (জুলি গ্লাস থেকে চামচে পানি ঢালে)

ফরিদ, তুমি একবার হাসপাতালে, ডাক্তার, যে কোনো ডাক্তারকে একবার খবর দাও। যত টাকা লাগে দেবো, সে যেন দেরী না করে সোজা এখানে চলে আসে।

 ফরিদ : তাতে কোনো ফল হবে না আব্বা। আরও দু’বার ফোন করেছি, এই দাংগার ভেতর জীবন বিপন্ন করে কোনো ডাক্তার আসতে রাজি নয়।

আব্বা : কেউ আসবে না? কেউ নয়? সবার জীবনের মূল্য আছে, শুধু আমার ছেলেটার নেই?

জুলেখা : আব্বা, খোকা পানি খাচ্ছে না। ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে সব গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে।

ফরিদ : আব্বা আমি যাই।

আব্বা : কোথায়?

ফরিদ : ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসি।

আব্বা : না না। তুই যেতে পারবি না। তুই আমার চোখের সামনে থাকবি। কোথথাও যাবি না। আমি বুঝেছি, ওরা আমার সবকিছু ছিনিয়ে নিতে চায়। আমার পাঁজরের হাড় একটা একটা করে খুলে নিয়ে আমাকে যন্ত্রণায় উন্মাদ করে মেরে ফেলতে চায়। আমি দেবো না। আমি তোমাদের কাউকে হারাব না। বুনো চিতার মত ওরা নিঃশব্দে ওত পেতে ছিল। আমার মোর্শেদ, অসহায়, নির্দোষ, শক্তিহীন

(নিচের দরজায় ঘা পড়ে)

কে, কে? দরজায় কে ধাক্কা দিচ্ছে? তাহলে মোর্শেদকে ওরা মেরে ফেলতে পারে নি। মোর্শেদ ফিরে এসেছে, আমার মোর্শেদ বেঁচে আছে, সে আমায় ডাকছে, তোমরা কেউ ওকে, মোর্শেদ মোর্শেদ

(দরজায় আরো জোর আঘাত)

ফরিদ : আপনি অত উত্তেজিত হবেন না। স্থির হয়ে বসুন। আমি দরজা খুলে দেখছি কে এসেছে। জুলেখা তুই আব্বার কাছে এসে বোস। আমি এক্ষুণি দেখে আসছি।

(প্রস্থান)

আব্বা : জানিস জুলি, খোদার রহমত আছে আমারই ওপর। এখনি দেখবি মোর্শেদ ছুটে ওপরে আসবে। ওর হাসির শব্দে এ ঘর কলকল করে উঠবে। খোকার অসুখ ভাল হয়ে যাবে, সমস্ত পৃথিবী শান্ত সুন্দর হয়ে চারদিক আলোকিত করে রাখবে।

(ফরিদের প্রবেশ)

ওকি, তুই একলা কেন? মোর্শেদ, মোর্শেদ কোথায়?

ফরিদ : মোর্শেদ ভাই নয়, পাড়ারই একটি লোক এসেছিল খবর দেয়ার জন্য। আমাদের এলাকায় একটা হিন্দু গুণ্ডা নাকি ঢুকছে, সাবধানে থাকতে বলল। একটু আগে বশির উকিলের ছাদে কে ওকে দেখেছে। অন্ধকারে ছাদ টপকে কোথায় পালাল কেউ ঠিক ঠাহর করতে পারল না।

আব্বা : বশির উকিলের বাড়ির ছাদে?

ফরিদ : হ্যাঁ। আমি বাইরে যাচ্ছি। দলবল নিয়ে সবাই খুঁজতে বার হবে। আমিও যাচ্ছি।

আব্বা : তুই যাবি?

ফরিদ : চুপ করে বসে থাকব? আমি যাচ্ছি। (ড্রয়ারে হাত দেয়) পিস্তলটা রইল। হাতের কাছে রাখবেন। আমি এই ছোরাটা সংগে নিয়ে গেলাম।

 জুলেখা : ভাইয়া, তুমি যেও না।

আব্বা : ছোরা? ছোরা কেন? ছোরা দিয়ে তুই কি করবি?

ফরিদ : আমার ভাইয়ের কাটা মাথা যারা ফেরী করে বেড়াতে পারে তাদের বিরুদ্ধে ছোরা তুলতে আপনি আমায় নিষেধ করেন আব্বাজান? দুধের কচি শিশুকে যারা হত্যা করতে হাতিয়ার তুলে ধরেছে, সে সমাজের সংগে লড়াই করতে ছোরা হাতে নিয়েছি বলে আপনি শিউরে উঠলেন? আপনার সম্ভ্রান্ত বনেদী রুচিকে কদমবুছি। আমি যাই, দোয়া করবেন।

(প্রস্থান)

(আব্বাজান নিশ্চল। জুলেখা আব্বাজানকে আঁকড়ে ধরে থাকে। আম্মা খোকাকে বাতাস করছেন। হঠাৎ যন্ত্রণাকাতর শিশুর কণ্ঠরুদ্ধ আর্তনাদ)

জুলেখা : আম্মা, আম্মা, খোকা অমন ছটফট করছে কেন? খোকার কি হয়েছে আম্মাজান?

আব্বা : আমি অনেক গুণাহ্ করেছি খোদা, আমায় শাস্তি দাও, শাস্তি দাও। যত খুশি যন্ত্রণা আমায় দাও, আমি কোনো নালিশ জানাবো না। মোর্শেদ যদি তোমার কাছে কোনো দোষ করে থাকে, তাকে শাস্তি দাও, আমি মাথা পেতে নেবো, একটুও প্রতিবাদ জানাবো না। কিন্তু ঐ কচি শিশু, নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক, মায়ের কোল থেকে এখনও পৃথিবীতে নামে নি, ওত কোনো অপরাধ করে নি, তুমি কোন্ ইনসাফে ওকে শ্বাস বন্ধ করে মারতে চাও। ওকে মুক্তি দাও, শান্তি দাও, রেহাই দাও- বাঁচাও বাঁচাও, ওকে তুমি বাঁচাও খোদা।

(দু’হাতে মুখ গুঁজে টেবিলে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে। আম্মাজান নিশ্চল। জুলেখা ফুঁফিয়ে কাঁদে)

হঠাৎ পেছনের কাঁচের জানালার ওপর, বার থেকে, কোনো ভারি জিনিসের কয়েকটা আঘাত পড়ে। একটা কাঁচ ঝনঝন শব্দে ভেংগে পড়ল।

আব্বা : কে? (হাত দিয়ে পিস্তল চেপে ধরেন)

ভাংগা কাঁচের ভেতর দিয়ে হাত গলিয়ে ক্ষিপ্রহস্তে ছিটকিনি খুলে, জানালা টপকে ঘরে প্রবেশ করে এক যুবক। শেড দেয়া টেবিল ল্যাম্পের স্বল্পালোকে দেখা গেল লোকটার হাতে একটা কালো চামড়ার ব্যাগ, গায়ে ঢোলা পাঞ্জাবী, পরণে ধূতি।

আব্বা : (কাঁপা হাতে পিস্তল তুলে) কে, কে তুমি?

 লোকটা: আমি-মানুষ।

 আব্বা : মানুষ?

লোকটা : মানুষ, হিন্দু।

আব্বা : বশির উকিলের বাড়ির ছাদে ওরা, তাহলে তোমাকেই দেখেছিল?

লোকটা: হয়ত। হঠাৎ দাংগা শুরু হয়ে যাবে ভাবিনি। বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম প্রয়োজনে। গিয়ে আর বেরুতে পারিনি।

আব্বা : এখন বেরুলে কোন সাহসে।

লোকটা : আপনি আমায় বিশ্বাস করতে পারছেন না। বেরিয়েছি বাধ্য হয়ে। বন্ধুর সাহসে কুলালো না আমায় জায়গা দেয়। বন্ধুকে ছেড়ে তাই ছাদ টপকে বেরিয়ে পড়লাম, নিরাপদ জায়গার খোঁজে।

আব্বা : বন্ধুর বাড়ির চেয়ে এটা বেশি নিরাপদ এ আশ্বাস তোমায় কে দিয়েছে।

 লোকটা : আমি আশ্রয় দাবি করছি না, প্রার্থনা করছি। অন্য উপায় নেই।

আব্বা : বাইরে দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ কান পেতে শুনলে, এ ভুল তুমি করতে না।

জুলেখা : আব্বা, আব্বা, তোমার হাত কাঁপছে। গুলি ছুটে যেতে পারে।

আব্বা : (একটু একটু করে এগুতে থাকে) যখন তুমি হয়ত জানালা ভেংগে প্রাণ বাঁচাতে আমার ঘরে ঢুকছো, ঠিক তখনই হয়ত তোমার কোনো পরম আত্মীয় আমার বড় আদরের ছেলে মোর্শেদকে ছুরির মাথায় গেঁথে নাচাচ্ছে, বিলাসী বেড়াল যেমন অসহায় ইঁদুরকে নখের আঁচড়ে একটু একটু করে কুরে কুরে মারে। আর আমার খোকা—

(খোকা ও মায়ের আর্তনাদ। বেদনাযুক্ত, ভয়ার্ত)

লোকটা: ওকি? উনি ওরকম করে বিছানায় ওপর লুটিয়ে পড়লেন কেন?

 জুলেখা : আব্বা, আব্বা, খোকা জানি কেমন করছে?

লোকটা : খোকার কি হয়েছে? অসুখ?

আব্বা : হাঁ, অসুখ। মরণ-অসুখ। গত আধঘন্টা থেকে ছটফট করছিল, এখন হয়ত শান্তি লাভ করল।

 লোকটা : কি করছিলেন আপনি? দেখি, জায়গা ছাড়ন, পিস্তলটা সরিয়ে একটু পথ দিন। আমি দেখছি।

আব্বা : তুমি, তুমি? তুমি কি দেখবে? ওহ্ বুঝেছি, তোমাদের এখন আশা মেটে নি। আমার খোকাকে বুঝি নিজ হাতে নিয়ে যেতে ওরা তোমাকে পাঠিয়েছে?

লোকটা : আপনি অপ্রকৃতিস্থ। সরে দাঁড়ান।

(সকলে স্তম্ভিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে নীরবে এগিয়ে গিয়ে লোকটা খোকার পাশে বসে। হাতের কালো ব্যাগটা খুলে ডাক্তারী সরঞ্জাম বার করে পরীক্ষা করতে থাকে।)।

ভয়ের কোন কারণ নেই মা। খুব সময়মত এসে পড়েছি। কণ্ঠনালীর উদ্ধৃত্ত মাংসপিণ্ড হঠাৎ ফুলে গিয়ে মাঝে মাঝে শ্বাস বন্ধ করে দিতে চাইছে। আমি একটা উত্তেজক ওষুধ দিচ্ছি। আর একটা ইনজেকশন দেব। সব এক্ষুণি ভাল হয়ে যাবে। কিছু ভাববেন না।

আব্বা : ইজেকশন?

(লোকটা চামচ দিয়ে ঔষধ খাওয়াবে। স্পিরিট দিয়ে তুলো ভিজিয়ে উঁচ সেঁকে নেয়। সংলাপ চলতে থাকে, কখনও জুলেখা, কখনও আব্বা, কখনও আম্মা লোকটাকে টুকটাক সাহায্য করে।)

লোকটা : এই যন্ত্রগুলো দেখে অন্ততঃ আমায় বিশ্বেস করতে পারেন। আমি এখনও পুরোদস্তুর পেশাদার ডাক্তার হইনি। সবেমাত্র পাশ করেছি। বন্ধুর বাড়ি এসেছিলাম, রোগী দেখতে। আশা করিনি এক রাতের মধ্যেই দু’ দু’জন রোগীর চিকিৎসা করতে হবে। (ইনজেকশন ঠিক করে নেয়) এখন আর কোনো ভয় নেই মা। দেখবেন ভাইটু আমার এখনই খলখল করে হেসে উঠবে!

আব্বা : বাঁচবে, না? কোনো ভয় নেই, না? খোদা, অপরিসীম তোমার করুণা, তুমি এ গুনাহ্গারের ডাক শুনেছ! অবুঝ শিশুর ওপর কি আর তুমি ইনসাফ না করে পার? তোমার শোকর গুজারী করি!

লোকটা : আমায় একটু হাতধোয়ার সাবান জল দিতে হবে।

 আব্বা : এস, আমার সংগে এস। এই দিকে, বাথরুমে চল।

(আব্বা ও লোকটার প্রস্থান। সঙ্গে সঙ্গে বাইরের দরজায় দ্রুত করাঘাত ও ফরিদের চিৎকার। জুলেখা, জুলেখা!)।

 জুলেখা : আসছি ভাইয়া।

ফরিদ : (নেপথ্যে) শিগগির, দরজা খোল, শিগিগির।

জুলেখা : আম্মা, ভাইয়া যদি

আম্মা : কোন ভয় নেই। তুই দরজা খুলে দে।

(জুলেখা বেরিয়ে যায় ও একটু পরেই উত্তেজিত ফরিদকে নিয়ে প্রবেশ করে)।

ফরিদ : আম্মা, আব্বাজান কোথায় গেলেন?

আম্মা : গোসল খানায়। কেন কি হয়েছে?

ফরিদ : এ সে হিঁদুটাকে নাকি, আমাদের বাড়ির ছাদের খুব কাছেই কোথাও একবার দেখা গিয়েছিল। সবাই সন্দেহ করছে, ও নিশ্চয়ই আমাদের বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে আছে।

 আম্মা : বলে দাও, নেই।

ফরিদ : ওরা বিশ্বাস করতে চায় না। একেবারে ক্ষেপে উঠেছে। আমার হাতের ছুরি ওদের দেখিয়েছি- কসম কেটে বলেছি, আমি মোর্শেদ ভাইয়ের ছোট ভাই। তার রক্তক্ষরণের জবাব দিতে আমি কসুর করব না।

আম্মা : আমার ঘরের জিনিস লণ্ডভণ্ড করে বাইরের লোককে এখানে খানাতল্লাশী চালাতে আমি কখনও অনুমতি দেবো না। বলে দাও, আমরা পাহারা দিচ্ছি, এ বাড়িতে কেউ ঢোকে নি।

ফরিদ : ওরা নিজেরা না দেখে কিছুতেই সন্তুষ্ট হবে না। ভদ্রলোকের কথায় ওরা বিশ্বাস করতে রাজি নয়। ওদের বাড়ি তল্লাসী করতে না দিলে ওরা গোলমাল বাধাবে। বিপদ ঘটবে। সব বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।

আম্মা : বেশ! ওদের ডেকে নিয়ে এসো। খুঁজে দেখে যাক কাউকে বার করতে পারে কি না।

ফরিদ : আপনি তাহলে একবার অন্য ঘরে

আম্মা : না, পর্দা করার জন্য আমি অন্য ঘরে যেতে পারব না। এখানেই থাকব। মশারীটা ফেলে দাও, আমি ভেতরে থাকব। আমি ছোট খোকার কাছে থাকব।

ফরিদ : (গোসলখানার পথে পা বাড়িয়ে) আমি তাহলে আব্বাকে ডেকে নিয়ে আসি।

আম্মা : না, না। তুমি বাইরে যাও। একটু পর ওদের ভেতরে নিয়ে আসবে। আমরা ততক্ষণে ঘরটা গুছিয়ে নিচ্ছি। যত খুশী এসে দেখে যাক, হিন্দু খুঁজে পায় কি না। জুলেখা তোমার আব্বাকে ডেকে দেবে। তুমি বাইরে যাও। (বলতে বলতে আম্মা নিরুদ্বেগ্ন চিত্তে মশারী ফেলছেন। গোসলখানার দরজা দিয়ে, লোকটার হাত ধরে, উত্তেজিত ভয়ার্ত আব্বাজানের প্রবেশ।)

আব্বা : আমরা সব শুনেছি। এ তুমি কি করলে? কেটে কুচিকুচি করে ফেলবে। এঁকে আমি এখন কোথায় লুকিয়ে রাখি। কিন্তু, কিন্তু একে আমি রক্ষা করবই। এঁকে আমি মরতে দেবো না। এঁকে বাঁচাব। বাঁচাব হাঁ এই ধরো আমার পিস্তল মুঠ করে ধরো। যে তোমাকে মারতে চাইবে তাকে মারবার অধিকার তোমারও আছে। না লড়ে মরবে কেন?

আম্মা : (ভাল করে চারপাশে মশারী গুঁজে দেয়।) অত উত্তেজিত হয়ো না তুমি। আমি যা করেছি, ঠিকই করেছি। (হাত দিয়ে নেড়ে টেবিল ল্যাম্পটার শেডটা ঠিক করে নেয়)। ডাক্তার, তুমি আমার সংগে এস! এই মশারীর মধ্যে তুমি আমার সংগে থাকবে। শেড দেয়া টেবিল ল্যাম্পের এই আলোর। জন্য বাইরে থেকে মশারীর ভেতরের কিছুই স্পষ্টই দেখা যাবে না। ঘরের বড় আলোটা নিবিয়ে দাও। তোমার কোন ভয় নেই। শরীফ খান্দানের পর্দানশীল মহিলা আমি, মশারীর ভেতর থেকে একবার কথা বললেই যথেষ্ট। কেউ মশারী তুলে উঁকি দিয়ে দেখার প্রস্তাব করতে সাহস করবে না।

লোকটা : মা!

আম্মা : দেরী কোরো না। ওদের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। উঠে এস শিগগির।

(প্রথমে আম্মাজান, পরে লোকটা, মশারীর ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাবে। আব্বা ও জুলেখা বাকহীন। ঘরে প্রবেশ করল ফরিদ, অনুসরণ করে আরো। কয়েকজন লোক। ঘরে ঢুকেই তারা বিনা ভূমিকায় এদকি ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। এ দরজা দিয়ে যায়, ও দরজা দিয়ে আসে। হঠাৎ টেলিফোন বেজে ওঠে। কিন্তু সেই শব্দ এই অদ্ভুত পরিস্থিতির মানুষগুলোকে যেন একটু সচকিত করে তুলছে না।)

আম্মা : (মশারীর ভেতর থেকে) তোমরা কেউ ফোনটা ধরছ না কেন? দেখ কে ডাকছে? কি বলছে? তোমরা কেউ ফোনটা ধর, হয়ত কেউ মোর্শেদের কোনো খবর জানাতে চাইছে। আব্বা : ধরছি, আমি ধরছি! হ্যালো, ইয়েস, বলুন। হ্যাঁ, আমি মোর্শেদের বাবা।

(কি যেন শুনলেন। চোখমুখ হঠাৎ শিটিয়ে পাথরের মূর্তির মতো নিথর হয়ে গেল। ফোনটা নামিয়ে রেখে তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন। ততক্ষণে পাড়ার লোকেরা গৃহতল্লাস শেষ করে একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে। যাবার সময়-)।

একজন : সব ঠিক আছে। কেউ নেই। সালাম সাহেব।

(সকলের প্রস্থান)

জুলেখা : আব্বা! তুমি অমন করে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? আব্বা, কিছু বল। অমন করে চেয়ে থেকো না, আমার ভয় করছে। আব্বাজান, ফোনে কে ডেকেছিল? কি বলল?

আব্বা : হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিল।

ফরিদ : জুলি, আমার কাছে আয়। ভয় পাস নে, আব্বাজানকে অমনি থাকতে দে।

(আম্মাজান বেরিয়ে আসেন। মশারী তুলতে থাকেন)

ফরিদ : আম্মা! এ কে?

লোকটা : আবার বলছ ভাই? আমি মানুষ। (আম্মাকে) ছোট খোকার আর কোনো ভয়। নেই মা। দেখুন খেলতে শুরু করেছে। খোকাকে আমি দেখছি। আপনি (আব্বার দিকে ইংগিত করে) ওঁকে দেখুন।

(জুলেখা তখন ফরিদের বুকে মাথা রেখে ডুকরে কাঁদছে। আব্বাজান তেমনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন, চোখে উন্মাদের দৃষ্টি! আম্মাজানের শান্ত কালো চোখ আব্বার মুখের ওপর ন্যস্ত, একটু একটু করে তা পানিতে ভরে উঠছে। লোকটা ছোটখোকার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে ওর কপালে হাত রাখে। মঞ্চ আস্তে আস্তে অন্ধকার হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে পর্দা নেমে আসে)

য ব নি কা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *