ডিম

ডিম

সাতদিন বা তিনদিনের নোটিশে, সম্পাদক মশায় যাই বলুন, জোরাজুরি করে যে হাসির রচনা হয় না, এই গল্পই তার প্রমাণ।

এই ডিম নামক গল্পটিকে কোনও সম্ভ্রান্ত পাঠক যদি আর্যভাষায় অশ্বডিম্ব বলে অভিহিত করেন তাহলেও বোধহয় আপত্তির কিছু থাকতে পারে না।

সে যা হোক, এই খারাপ গল্পের সূত্রে আর একটা বিপদের কথা জানিয়ে রাখি। 

তরল রচনায় কথিকার পাত্র-পাত্রীর নামকরণ খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার। চেনাজানা কোনও পুরুষ-মহিলার নামের সঙ্গে নাম মিলে গেলে সর্বনাশ। সঙ্গে সঙ্গে সে ধরে নেবে এ গল্প তাকে নিয়েই লেখা, আমি তাকে উপহাস করেছি, নিশ্চয়ই আমার মনে কোনও রাগ বা অভিসন্ধি আছে। অনেক পরিশ্রম করে মনোহর বা কেয়ামত আলি, জুলেখা বা শ্যামা নাম দিয়ে গল্প লিখে ভাবলাম যাক এবার বাঁচা গেছে, কেউ দাবিদার হয়ে গোলমাল বাধাবে না। তা কার্যত দেখা গেল এসব নামেও দু-চারজন করে আত্মীয়বন্ধু, পরিচিতজন আছেন, তারা কেউ দুঃখিত হয়েছেন, কেউ কোপাম্বিত হয়েছেন। ভাটপাড়া থেকে জুলেখা একটি চিঠি দিল অসহনীয় কুৎসিত ভাষায়, এদিকে খবর পাওয়া গেল বসিরহাটের উকিল কেয়ামত আলি–কবে আমার সঙ্গে কলেজে পড়েছে, এখন আমার গল্প পড়ে আমার নামে মানহানির মামলার কথা ভাবছে।

সুতরাং এবার আর কোনও ঝুঁকি নিচ্ছি না। তা ছাড়া এবারের ঘটনাটা এতই বাস্তব যে কোনও কারণে নামধাম মিলে গেলে আর রক্ষা পাব না।

হাসির গল্প লিখে নাজেহাল হওয়ার মতো বিড়ম্বনা সত্যিই আমার আর পোষাবে না। তাই অনেক রকম ভেবে চিন্তে এই গল্পের নায়ক-নায়িকার নাম দিলাম কথাসাহেব আর কথাবিবি।

আশাকরি, জগৎ সংসারে এরকম নামে কোথাও কেউ নেই। থাকলেও আমি প্রয়োজন হলে আদালতে পর্যন্ত হলফ করে বলতে পারি আমি তাদের মোটেই জানি না, চিনি না, তাদের কথা আমি কখনও শুনিনি।

বলাবাহুল্য, এটি একটি দাম্পত্য কাহিনি। এই কাহিনির নায়ক-নায়িকার নামকরণ দেখেই বুদ্ধিমতী পাঠিকা সেটা নিশ্চয়ই টের পেয়েছেন।

কথাসাহেব আর কথাবিবি স্বামী-স্ত্রী।

অবশ্য এই নারী-প্রগতির দিনে আজ কিছুদিন হল আমি স্বামী-স্ত্রী না লিখে স্ত্রী-স্বামী লিখছি, সেই সুবাদে বলা চলে কথাবিবি আর কথাসাহেব স্ত্রী-স্বামী।

ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই নগণ্য গল্পের গৌরচন্দ্রিকা বড় দীর্ঘ হয়ে গেল; ভণিতা ছেড়ে এবার আসল ঘটনায় যেতে হচ্ছে।

কথাসাহেব আর কথাবিবির মধ্যে বনিবনা মোটেই নেই।

বনিবনা থাকার কথাও নয়। কবে আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা থেকেছে। দাম্পত্যজীবন এক দীর্ঘস্থায়ী টাগ অফ ওয়ার, কাছি টানাটানি খেলা, দুই পক্ষ দুদিক থেকে টানছে; কেউ হারছে না, কেউ জিতছে না। হঠাৎ যদি দুজনের কেউ টানাটানি ছেড়ে দেয়, অন্যজন সঙ্গে সঙ্গে মুখ থুবড়িয়ে পড়ে যায়।

তবে এর মধ্যে টানাটানি করতে করতে পঁচিশ-তিরিশ বছর চলে গেলে একই দড়ির দুপাশে ক্রমাগত দুজনে মিলে টানতে টানতে দুজনের কথাবার্তা, আচার-আচরণ এমনকী চেহারা পর্যন্ত একরকম হয়ে যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রায় মায়ের পেটের ভাইবোনের মতো হয়ে যায়।

কথাবিবি এবং কথাসাহেবের সম্পর্ক অবশ্য এখন পর্যন্ত এই পর্যায়ে আসেনি। পঁচিশ-তিরিশ নয়, এমনকী পাঁচ-দশও নয়, তাদের মাত্র দেড় বছরের পুরনো বিয়ে। তবে এরই মধ্যে মোক্ষম দড়ি টানাটানি শুরু হয়ে গেছে।

কথাবিবি যদি বাঁয়ে যেতে চান, অবশ্যই কথাসাহেব যেতে চাইবেন ডাইনে।

ডাইনে মানে, ধর্মতলার মোড়ে যদি রাজভবনের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো যায় তাহলে কথাসাহেব যেতে চাইবেন শ্যামবাজার বা দমদমে, তার যৌবনের বারাণসীতে যেখানে হাল্পটি ডাল্পটি কিংবা থেটাবেটা ক্লাবে তার নিজের লোকেরা এখন তাস, পাশা কিংবা দাবা খেলছেন অথবা রাজা-উজির মারছেন।

আর কথাবিবি যেতে চাইবেন গড়িয়াহাটায় বা গোলপার্কে, সুদূর বাঁয়ে যেখানে অফুরন্ত শাড়ির দোকান, বেলোয়ারি, মনিহারি সামগ্রীর স্বর্গ।

বলে রাখা ভাল কথাবিবি-কথাসাহেবের বসবাস হাওড়ায়, আন্দুল রোডে, সেখান থেকে কোনও ছুটির দিন বিকেলে নবনির্মিত বিদ্যাসাগর সাঁকো পেরিয়ে তারা চৌরঙ্গি-ধর্মতলা অঞ্চলে বেড়াতে আসেন। চৌরঙ্গিতে আসা পর্যন্ত দুজনের কেউই কাউকে বলেন না কোথায় যেতে চান, কী উদ্দেশ্য, গোলমালটা লেগে যায় ধর্মতলায় পৌঁছানোর পরে।

বাদ-বিসম্বাদ, তর্ক-বিতর্ক, রীতিমতো উচ্চগ্রামের সে বিবাদ কোনও কোনও দিন এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে অনেক সময় অজ্ঞাত পরিচয় পথচারীরা পর্যন্ত তার মধ্যে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পান।

সেই যে প্রচলিত কথা রয়েছে না, বিয়ের পরে প্রথম ছয়মাস স্বামী কথা বলে যায়, স্ত্রী শুনে যায়, তারপরের ছয়মাস স্ত্রী কথা বলে যায় স্বামী শুনে যায়। তারপর থেকে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কথা বলে যায়, তারা কেউই কারও কথা শোনে না, পাড়া-প্রতিবেশীরা শুনে যায়।

চৌরঙ্গির মোড়ে অবশ্য পাড়া-প্রতিবেশীর ব্যাপার নেই, এখানে যা শোনার পথচারীরা শোনে। তবে পাড়ার লোকেরা কেউ কেউ কখনও সখনও ছুটির দিনের বিকেলে কাজে-অকাজে এসপ্ল্যানেড বা ওই চৌরঙ্গি-ধর্মতলা অঞ্চলে এলে এদের ঝগড়া করতে দেখেছে। পরে পাড়ায় গিয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছে, এরা রাস্তায় বেরিয়ে পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে গোলমাল করে।

এর মানে অবশ্য এই নয় যে কথাবিবি আর কথাসাহেবের মধ্যে ভালবাসাবাসি নেই। কথা-দম্পতির প্রণয়ও অতি প্রগাঢ়।

পাড়া-প্রতিবেশীরাও সেটা বিলক্ষণ জানেন।

আন্দুলপাড়ায় হরিধনবাবুর আড়িপাতার স্ববাব আছে। তার স্ট্র্যাটেজি চমৎকার। যেসব বাড়িতে সেদিন খুব দাম্পত্য কলহ হয়েছে, রাতের দিকে হরিধনবাবু সেই সব বাড়িতে আড়িপাতার চেষ্টা করেন।

সবসময়ে যে হরিধনবাবু সফল হন তা নয় তবে একদা একটা চমৎকার কথোপকথন শুনেছিলেন কথা-দম্পতির বাড়ির দরজায় কান পেতে:

কথাসাহেব: ওগো আমাকে তুমি ভালবাস?

কথাবিবি: হুঁ

কথাসাহেব: আমি মরে গেলে তুমি কাঁদবে?

কথাবিবি: হু। হু।

কথাসাহেব: কেমন করে কাঁদবে? একটু কেঁদে দেখাও না।

কথাবিবি: কেমন করে মরবে? একটু মরে দেখাও না।

অতঃপর আর কানপাতার কোনও মানে হয় না। হরিধনবাবু নিঃশব্দে সরে গিয়েছিলেন, তবে তার মনে একটা খটকা দেখা দিয়েছিল, এই যে অবিশ্বাস্য বাক্যালাপ তার কর্ণগোচর হল, এটা ভালবাসার ডায়ালগ না কলহের ডায়ালগ। সে সমস্যা অবশ্য আমাদেরও রয়েছে।

কিন্তু গল্প বলতে বসে তো আর দ্বিধায় থাকলে চলবে না। কাহিনি, তা সে যত তুচ্ছই হোক, একটা পরিণতির দিকে এগোতেই হবে।

দিন দিন কথাসাহেব কথাবিবির মনোমালিন্য বেড়েই যাচ্ছে। কথাবিবি হয়তো একটা নতুন শাড়ি কিনলেন নীল রঙের, কথাসাহেব সেটা দেখে বললেন, আবার নীল?

কথাবিবি তখন বললেন, আবার নীল আসছে কোথা থেকে? বিয়ের পরে এটাই আমার প্রথম নীল শাড়ি।

কথাসাহেব হয়তো দামি সেলুন থেকে অতি আধুনিক ছাঁট দিয়ে চুল কেটে এলেন, বাড়িতে আসা মাত্র কথাবিবি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি নিজের ইচ্ছায় সজ্ঞানে চুল কেটে এলে, নাকি লোকে জোর করে ধরে তোমার চুল কেটে দিয়েছে?

পুরো ব্যাপারটা অবশেষে হেঁসেল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।

রবিবার সকালে বাজার থেকে শখ করে বড় বোয়াল মাছ নিয়ে এলেন কথাসাহেব। বাসায় এসে কথাবিবিকে বললেন, বড় বড় টুকরো করে কাঁচালঙ্কা দিয়ে পরিষ্কার ঝাল হবে।

কথাবিবি কিন্তু সেই বোয়াল মাছ হেঁসেলে ঢুকতে দিলেন না, বললেন, আমাদের বংশে বোয়াল মাছ খাওয়া নেই।

কথাসাহেব বললেন, বিয়ের পরে তোমার বংশ তোমাদের বংশে আর নেই, সেটা আমাদের বংশ হয়ে গেছে। আমাদের বংশে কালীপুজোয় বোয়ালমাছের ঝোল দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়।

কথাবিবি ঠোঁট উলটিয়ে বললেন, তোমাদের আবার বংশ!

এই রকম সব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা। কথাবিবি উচ্ছে সুক্তো করলেন, কথাসাহেব বললেন, উচ্ছে সেদ্ধ করলে না কেন? সে অনেক পুষ্টিকর।

সব কিছু নিয়েই দুজনার দুই মত। রাতে ভাত হলে কথাসাহেব বলেন, রুটি করনি কেন? রুটি হলে বলেন, ধুত্তোরি। সারাদিন অফিস কাছারি করে এসে এই শুকনো রুটি চেবানো যায়?

কথাবিবির সবচেয়ে অসুবিধে হয়েছে ডিম নিয়ে।

সব সময়ে সব বিষয়ে ঝগড়া করা যায় না।

সম্প্রতি কথাবিবি চেষ্টা করছেন ঝগড়াটাকে মোটামুটি আয়ত্তের মধ্যে রাখতে।

এখানে বলে রাখা ভাল যে স্বামী-স্ত্রীর অন্তর্নিহিত গোলমাল কখনও মেটার নয়। ষাট সত্তর বছরের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের শেষে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে এখনও হামেশাই খুনসুটি করতে দেখা যায়। দাম্পত্যজীবনের সেটাই হল মূল মশলা।

সে যা হোক, এ গল্পের নাম ডিম। ডিমের প্রসঙ্গে গিয়েই কথাবিবি-কথাসাহেবের কাহিনি শেষ করতে হবে।

কথাসাহেব দৈনিক সকালে জলখাবারের সঙ্গে একটি করে ডিম খান। একেকদিন একেকরকম। কোনওদিন ডিমসেদ্ধ, কোনওদিন ওমলেট, কোনওদিন ডিমের পোচ।

কিন্তু অসুবিধে হয়েছে কথাবিবির। এরকম অসুবিধেয় অবশ্য অধিকাংশ স্ত্রীকেই পড়তে হয়।

কথাবিবি সেদিন সকালে ডিমের ওমলেট করলেন। খাওয়ার টেবিলে বসে ডিমের ওমলেট দেখেই নাক সিঁটকালেন কথাসাহেব, আবার ডিমের ওমলেট।

পরের দিন কথাবিবি ডিমসেদ্ধ করলেন। আজ আবার উলটো কথা, কথাসাহেব ডিমসেদ্ধ দেখে বলেন, আজ ডিমসেদ্ধ কেন, কাল ওমলেটটা বেশ ভাল হয়েছিল।

মহা বিপদ। ডিমের পোচ দিলে ওমলেট, ওমলেট দিলে ডিমসেদ্ধ, কথাসাহেব ঠিক যে কী চান কথাবিবি ধরে উঠতে পারেন না।

কিন্তু কথাবিবি স্বাভাবিক কারণেই সকালবেলায় জলখাবারের টেবিল থেকে গোলমালটা আরম্ভ করতে চান না। এরপরে সারাদিন আর দম থাকে না, বিকেলের দিকে ঝগড়াটা জুতসই হয়ে জমে না।

অনেক ভেবেচিন্তে কথাবিবি একটা মোক্ষম বুদ্ধি বার করলেন। কিছু অপব্যয় হবে বটে কিন্তু গোলমালটা এড়ানো যাবে।

কথাবিবি সেদিন সকালে একই সঙ্গে ডিমসেদ্ধ ডিমের পোচ আর ওমলেট তিনটেই করলেন। করে পাশাপাশি তিনটে প্লেটে সাজিয়ে স্বামীর সামনে ধরলেন।

কিন্তু কথাসাহেব তেমন সহজ লোক নন। ভুরু কুঁচকিয়ে তিনটি প্লেট অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে আঙুল দিয়ে ডিমসেদ্ধটাকে দেখিয়ে স্ত্রীকে বললেন, ওই ডিমটা ওমলেট করা উচিত ছিল, আর ওই ওমলেটের ডিমটাকে পোচ।

এর পরে আর এ কাহিনি বাড়িয়ে লাভ নেই। কথাবিবি আর কথাসাহেবের টাগ অফ ওয়ার চলুক, সারা জীবন ধরে চলুক। প্রজাপতি ঋষির কাছে নিবেদন, প্রভু নজর রাখবেন। দেখবেন দড়িটা যেন ছিঁড়ে না যায়।

পুনশ্চ:

গল্পটা যখন ডিম নিয়ে, ডিমের পুরনো গল্পটাও একটু ছোট করে লিখি।

বাজার থেকে একটা ডিম কিনে এনেছিলাম। বাসায় এসে দেখি সেটা পচা। দোকানে ফেরত দিতে নিয়ে গিয়ে দোকানদারের ওপর খুব রাগারাগি করলাম।

বুড়ো দোকানদার অনেকক্ষণ চুপ করে বসে গালাগাল খেয়ে তারপর হাত তুলে আমাকে থামিয়ে তার ডিমের ঝুড়ির দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে আমাকে করুণ কণ্ঠে বললেন, স্যার, আপনার মাত্র একটা পচা ডিম তাই এত রাগারাগি করছেন আর আমার ঝুড়ি ভর্তি পচা ডিম আমি কী করি বলুন তো?

আমার এই ডিমের গল্প পড়ে কারওর যদি মাথাগরম হয়, দয়া করে ওই বুড়ো দোকানদারের কথাটা স্মরণ রাখবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *