কে মারা যাচ্ছে?

কে মারা যাচ্ছে?

আজ চব্বিশ এপ্রিল।

আর হাতে তিন দিন রয়েছে, মাত্র তিন দিন। এই বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে যদি জগৎহরি মারা না যান তবে কেলেঙ্কারি হবে।

এই গল্পের নায়ক জগহরি, শ্রীযুক্ত জগৎহরি মুখোপাধ্যায় এই কয়েকদিন আগেও মৃত্যুমুখী ছিলেন। চৈত্রমাসের প্রথমে সেই এক শনিবার বিকেলে বাড়ির কাছে পার্কে বেড়াতে যাওয়ার পথে হঠাৎ অকাল বর্ষণে প্রচণ্ড ভিজে গিয়েছিলেন জগৎহরি।

সেই ঠান্ডা লেগে বুকে জল জমা, শ্বাস কষ্ট। বুড়ো বয়েসে এসব অসুখ মারাত্মক।

তা ছাড়া জগৎহরিবাবুর বয়েস তো আর কিছু কম হয়নি। তিরাশি পূর্ণ হয়ে চুরাশিতে পা দিয়েছেন গত বৌষ মাসে। সে তুলনায় শরীর-স্বাস্থ্য ভালই ছিল, কিন্তু এ বয়েসে আচমকা অসুখ খুব বিপজ্জনক।

জগৎহরিবাবু মৃত্যুর মুখে চলে গিয়েছিলেন। ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছিল। গত সোমবার তো মনে হয়েছিল আজকের রাত্রিটা কাটে কি না কাটে।

সুখের কথা শুধু সেই সোমবারের রাত্রি নয় তারও পরে আরও পাঁচ-পাঁচটা রাত্রি বহাল তবিয়তে কাটিয়ে দিয়েছেন শ্রীযুক্ত জগৎহরি, নামের পূর্বে শ্রীর বদলে চন্দ্রবিন্দু বসানোয়, স্বর্গীয় জগৎহরি হওয়ায়, তার তেমন বিশেষ কোনও উৎসাহ দেখা যায়নি।

ওইখানেই হয়েছে বিপদ।

শ্রীযুক্ত জগৎহরি মুখোপাধ্যায় কোনও সামান্য লোক নন। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার প্রবাদসিদ্ধ এক মুখুজ্যে বংশের তিনি মুখোজ্জ্বলকারী উত্তরপুরুষ। পিতৃপুরুষদের বিশাল পারিবারিক ব্যবসা ছিল চেতলা হাটে। মশারি আর মাছ মারার জালের পাইকারি কারবার। সেই ব্যবসা ধীরেসুস্থে অনেকটা গুটিয়ে নিয়ে তিনি চলচ্চিত্রে প্রযোজনায় মনোনিবেশ করেন।

জগৎহরি বিশ-পঁচিশ বছর আগে চিত্রজগতে রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত নোক ছিলেন। নীতিশ মুখার্জির ভাইপোর বিয়েতে তিনি বরযাত্রী হয়েছিলেন, মলিনা দেবী তাঁকে ভাইফোঁটা দিতেন, এমনকী স্বয়ং উত্তমকুমার তাকে জগদা বলতেন। বাড়িতে কড়া করে ইলিশ মাছ ভেজে, বিমানযাত্রী পেলে, জগৎবাবু গীতা দত্তকে বোম্বাইতে পাঠাতেন। কলকাতায় কালেভদ্রে রাজকাপুর এলে তিনি ঘি-গরমমশলা দেওয়া পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া পাঁঠার মাংসের ঝোল রাজকাপুরকে হোটেলে পাঠাতেন। রাজকাপুর যাওয়ার সময়ে তাঁর কলকাতার এজেন্টকে বলে যেতেন। তাঁর হোটেলের ঘরে কয়েক বোতল স্কচ হুইস্কির বোতলে সব সময়েই যথেষ্ট অবশিষ্টাংশ পড়ে থাকত, কারণ তিনি নতুন বোতল না খুলে খেতেন না এবং প্রচুরই খেতেন, সেই বোতলগুলো জগত্তরিকে এজেন্ট সাহেব পাঠিয়ে দিতেন। এবং সেই প্রসাদ পেয়ে জগৎহরিবাবু ধন্য বোধ করতেন। লোকজনকে ডেকে ডেকে খাওয়াতেন, বলতেন, এটা রাজকাপুরের স্কচ।

জগৎহরি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেছিলেন শরৎচন্দ্রের গল্পের সিনেমা করে। গল্পটা শরৎচন্দ্রের। কিন্তু একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রচনা করে, কপিরাইট না কিনে অন্য নামে চলচ্চিত্রায়ণ করতেন, যেমন গৃহদাহ তার সুবাদে হয়েছিল মনের আগুন, চরিত্রহীন হয়েছিল পথে বিপথে। চিত্রনাট্যকারের নাম থাকত না, তাকে এজন্যে কিছু বেশি পয়সা দেয়া হত। বইয়ের টাইটেলে লেখা থাকত কাহিনি ও চিত্রনাট্য ছদ্মবেশী।

এসব বই দুর্বল অশ্রুগ্রন্থি বাঙালি মধ্যবিত্ত দর্শক লুফে নিয়েছিল। তারাই তখনকার সিনেমার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। কান্নাহাসির দোল-দোলানো পৌষফাল্গুনের পালা চিরদিনই বাঙালি দর্শকের অতি প্রিয়।

যথেষ্ট পয়সা করেছিলেন জগহরিবাবু, মশারির ব্যবসায় এর চেয়ে বেশি উপার্জন হওয়া সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া চেতলার মশারির দোকানটা ছোট করে ভালই চলছিল, দোকানটা থেকে সংসার খরচা মোটামুটি চলে যেত। সিনেমার লাইনে যেমন হয় জগৎহরিবাবুর কিন্তু চরিত্রদোষ ছিল না, সে বড় খরচার ব্যাপার।

ফলে সিনেমা করে যেটুকু লাভ হয়েছিল প্রায় পুরো টাকাটাই জগৎহরি নানাভাবে বিনিয়োগ করেছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পারিবারিক বিষয়বুদ্ধি এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছিল।

যোধপুর পার্কে পাঁচ কাঠা জমি কিনেছিলেন, ক্যামাক স্ট্রিটে একটা বড়সড় ফ্ল্যাট। শান্তিনিকেতনে বাড়ি করলেন এক বিঘে জমির ওপরে। এ ছাড়া পোস্টাফিসে ক্যাশ সার্টিফিকেট কিনলেন প্রায় দু লাখ টাকার মতো, যা ডবল হয়ে হয়ে এখন আটলাখে দাঁড়িয়েছে।

তবে জগৎহরি ব্যবসায়ের পথ সবটাই যে কুসুমাস্তীর্ণ ছিল তা নয়। একবার খ্যাতির লোভে আর্ট ফিল্ম করে বেশ কয়েক লাখ টাকা গচ্চা দিয়েছিলেন, তবে এই সুযোগে একবার লাক্সেমবার্গে ঘুরে এসেছিলেন। সেখানে তার প্রযোজিত বই ঘাম ও রক্ততৃতীয় বিশ্বের চিত্রমেলায় প্রদর্শিত হয়েছিল। ব্যস ওই পর্যন্তই, তার পরে আর এ ব্যাপারে কোনও খবর পাওয়া যায়নি। প্রদর্শনের সময় আন্ডারগ্রাউন্ড ঘুপচি হলে দেড়শো সিটের মধ্যে মাত্র বারোটি সিট পূর্ণ ছিল, তার মধ্যে তিনটেতে ছিলেন তিনি, তার পরিচালক কাবুল মল্লিক এবং শ্রীমতী কাবুল।

শ্ৰীমতী ও শ্রীমান কাবুল মল্লিক অত্যন্ত তুখোড় দম্পতি। ঘাম ও রক্ত ছিল জোতদার বর্গাদার সম্পর্ক নিয়ে একটি আর্থ-সামাজিক প্রতিবেদন। বইটি এক পয়সাও ফেরত দেয়নি, কলকাতায় একদিনও চলেনি। তবে বড় বড় কাগজে, বৈদ্যুতিক প্রচার মাধ্যমে প্রচুর বাহবা পেয়েছিল। তবে সেসবের পিছনেও ছিল পাঁচতারা হোটেলে পার্টি, অবশ্য জগৎহরির পয়সায়।

সেই জগৎহরি এখন মরতে বসেছেন। কিংবা সঠিক করে বলা উচিত আগে মরতে বসেছিলেন, এখন বাঁচতে বসেছেন।

কিন্তু তার বোধহয় বাঁচা হবে না। তার বোধহয় আর বাঁচা হবে না, অন্ততপক্ষে বাঁচা উচিত হবে না।

এভাবে বলা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু কী ভাবেই বা বলা যায়? ব্যাপারটা গোলমেলে।

জগৎহরিবাবুর কোনও মেয়ে নেই, পর পর চার ছেলে। ছেলেরা এখন লায়েক হয়েছে, সিনেমা প্রযোজকের ছেলেদের যতটা বখে যাওয়া সম্ভব, তার চেয়ে কিছু কম বখে যায়নি তারা।

তাই বলে তারা যে কেউ পিতৃভক্ত নয়, তা নয়। জগৎহরির মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তারা একেকজন নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেয়।

বড় ছেলেটি প্রশান্ত, বাবার টাকায় যাত্রাদল করেছে, যাত্রা-উর্বশী আইভরি দাশের সঙ্গে আগামী দুসপ্তাহ তার উত্তরবঙ্গ সফরের প্রোগ্রাম ছিল। বাবার জন্যে সেটা ক্যানসেল করেছে।

দ্বিতীয়টি অশান্ত। চিটফান্ড কোম্পানি করেছে। এক বছরে টাকা ডবল করে দেয়। তার বাবা, জগহরি, তাকে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বাড়িতেই বছর বছর টাকা ডবল হওয়ার সুবিধে আছে জেনেও পোস্টাপিসে টাকা জমিয়েছিলেন ছয় বছরের মেয়াদে।

 তৃতীয়টি সুশান্ত। সে পারিবারিক ব্যবসা চেতলার হাটে মশারির ব্যবসাটা দেখে। সে বেশ সব্যবস্থ। দোকানের আয় থেকে সংসার খরচের জন্য দৈনিকই দুশো-আড়াইশো টাকা তার মা নিরুপমার হাতে দেয়। লোক-লৌকিকতা, পুজো, নববর্ষ ইত্যাদির মোটা টাকার দায়ও সে বহন করে।

এই তিনজনই বিবাহিত। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, শ্বশুরবাড়ি ইত্যাদি আছে। চতুর্থটির বিয়ে হয়নি, সে বোবা। সঙ্গত কারণেই তার নাম শান্ত। তার বিশেষ কোনও দোষ বা গুণ নেই। শুধু সন্ধ্যাবেলা কালীঘাট বাজারে গিয়ে দু পাইট দুনম্বর বাংলা মদ না খেলে তার রাতে ঘুম আসে না।

ভালই চলছিল সব। গোল বাধিয়েছেন জগৎহরিবাবু নিজে। তিনি কিছুতেই মারা যাচ্ছেন না।

সব রকম বিধি বন্দোবস্ত করা আছে। গঙ্গাজল, তামা, তুলসী। দৈনিক চেতলা বাজার থেকে এক টাকায় আস্ত তুলসীগাছ কিনে আনা হচ্ছে। বড়বাজার থেকে এক কেজি খাঁটি তিল এনে পুজোর ঘরে রাখা হয়েছে। এক বালতি খুচরো পয়সা জমানো হয়েছে, সেইসঙ্গে এক টিন খই। শবযাত্রার সময়ে ছিটোতে হবে।

ডাক্তাররা তো দিনক্ষণ বলেই দিয়েছিলেন। কিন্তু জগহরি ডাক্তারি নির্দেশ অমান্য করে বেঁচে রয়েছেন।

সবচেয়ে সমস্যা দাঁড়িয়েছে হরিমোহিনী দেবীকে নিয়ে। আগাম ১০ হাজার টাকা দিয়ে তাঁকে শ্রাদ্ধবাসরে কীর্তন গাওয়ার জন্যে বুক করা হয়েছে। জগৎহরিবাবুর মতো কৃতবিদ্য ব্যক্তির শ্রাদ্ধবাসরে যেখানে চিত্রজগতের দিকপালেরা, নট-নটিরা অবশ্যই আসবেন সেখানে হরিমোহিনী দেবী ছাড়া আর কাউকে দিয়ে কীর্তন গাওয়ানো একেবারেই ঠিক হবে না। মোটেই সম্মানজনক হবে না জগৎহরিবাবুর পুত্রদের পক্ষে।

এদিকে, হরিমোহিনী দেবী স্টেটসে চলে যাচ্ছেন সাতই মে। নিউ জার্সিতে, বস্টনে, লস এঞ্জেলসে তাঁর কীর্তন গানের চুক্তি। টিকিট, প্রোগ্রাম সব ফাঁইনাল। শ্রাদ্ধ হবে মৃত্যুর পরে এগারো দিনে, বড় জোর সাতই মে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব।

অবশেষে সমস্ত সমস্যা হৃদয়ঙ্গম করে এক শুভানুধ্যায়ী একটি সুপরামর্শ দিলেন। জগৎহরিবাবুকে উইল করতে বলুন। অনেক সময় দেখা যায় মুমুর্ষ ব্যক্তি উইল করার পরেই মারা যান। উইল করার সঙ্গে সঙ্গে বাঁচবার ইচ্ছে সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়। সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা মনোমতো ভাবে করে তিনি শান্তিতে দ্রুত পরলোকে গমন করেন। পরামর্শটা পেয়েছিল বড় ভাই প্রশান্ত। সে এসে অশান্ত এবং সুশান্তকে বলে। হাবেভাবে শান্তকেও ব্যাপারটা যথাসাধ্য বোঝানো হয়। তার পরে চার ভাই দল বেঁধে মা নিরুপমাকে বোঝাতে গিয়ে দেখল তারও কোনও আপত্তি নেই। তিনি আগে থেকে মন শক্ত করে বসে আছেন। তা ছাড়া তিনি হরিমোহিনী দেবীর কীর্তনের অত্যন্ত ভক্ত। হরিমোহিনী দেবীর কীর্তনই যদি না হল তা হলে তাঁর বিধবা হয়ে লাভ কী?

যথাসময়ে আলিপুর আদালতে পারিবারিক উকিল রামতনু ঘোষকে খবর দেওয়া হয়েছিল। আজ ২৪ এপ্রিল রবিবার সকালে তিনি উইল করতে এসেছেন।

জগহরিবাবু আগে থেকে কিছু জানেন না। তিনি রামতনুবাবুকে দেখে ভেবেছেন, পুরনো পরিচিত লোক, হয়তো তার শারীরিক অবস্থার কথা শুনে দেখতে এসেছেন।

সুতরাং যখন রামতনুবাবু বললেন যে, তিনি তাঁর উইল করতে এসেছেন। জগৎহরিবাবু একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। উইল? আমি কেন উইল করতে যাব? জগৎহরিবাবু আইন কিছু কম জানেন না, তিনি বললেন, আমি মারা গেলে আমার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর বিষয়সম্পত্তি আমার স্ত্রী আর চার ছেলে সমান ভাগে পাবে। এর জন্যে আবার উইল করতে যাব কেন? রামতনুবাবু পুরনো, ঝানু উকিল। তিনি বললেন, উইল করা ভাল। তা হলে পরে আর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে গোলমাল হয় না। কিছুটা কথাবার্তার পর জগহরিবাবু উইল করতে নিমরাজি হলেন। ততক্ষণে চার ছেলে এবং বিরাট ঘোমটা টেনে নিরুপমাদেবীও জগৎহরিবাবুর শয্যার পাশে এসে গেছেন।

জগৎহরিবাবুর খাটের সামনে একটা নিচু তক্তাপোশ রয়েছে, সেটায় বাড়ির সবাই বসলেন। পাশে একটা কাঠের চেয়ারে রামতনুবাবু। রামতনুবাবুর মুহুরিও সঙ্গে এসেছে, সে মেঝেতে কাগজ কলম নিয়ে বসল। তার নাম সহদেব।

সজ্ঞানে, সুস্থ শরীরে ইত্যাদি প্রথা ও আইন মাফিক বয়ান শেষ হওয়ার পরে জগহরিবাবু বললেন, যোধপুর পার্কে আমার পাঁচ কাঠা জমি রয়েছে, সেই জমি আমি আমার সতীসাধ্বী স্ত্রী। শ্রীযুক্তা নিরুপমা দেবীকে দিলাম।

সঙ্গে সঙ্গে নিরুপমা দেবী ঘোমটার আড়াল থেকে কাংস্য কণ্ঠে প্রতিবাদ করলেন, দ্যাখো কাণ্ড! আমি বুড়ি মানুষ, বিধবা হতে যাচ্ছি, খালি জমি দিয়ে আমি কী করব?

নিরুপমা দেবীর প্রতিবাদ শুনে একটু থমকিয়ে গেলেন জগৎহরি। মুখে বললেন, ঠিক আছে ওটা পরে দেখছি। সহদেব মুহুরিও চতুর লোক, যোধপুর পার্কের জমির লাইনটা যেটা সে এইমাত্র লিখেছিল সেটার গায়ে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন লাগিয়ে দিল।

এবার জগহরিবাবু বললেন, আমার ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটটা আমার বড় ছেলে প্রশান্তকে দেব।

সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিলেন নিরুপমা দেবী, না। না। ও ফ্ল্যাটটা অশান্তকে দাও। ও একটু সাহেবি মেজাজের। তা ছাড়া ওর যা কাজ করবার সেটা বাঙালিপাড়ায় নিরাপদ নয়।

ঢোক গিললেন জগৎহরিবাবু, রামতনুবাবু। মেঝেতে সহদেব মুহুরিও সদ্য সমাপ্ত পংক্তিটির পাশে আবার একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিল।

কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে জগৎহরি বললেন, আমার চেতলা বাজারে মশারির ব্যবসাটা তৃতীয় ছেলে সুশান্ত দেখাশোনা করে ওটা তাকেই দিয়ে যাব।

বাক্য শেষ হওয়ার আগেই আবার নিরুপমার আপত্তি, এই তোমার বুদ্ধি? তুমি মরে গেলে মশারির ব্যবসা করবে নাকি কেউও? ওটা প্রশান্তকে দাও। চেতলা বাজারে অত ভাল জায়গা, ওখানে প্রশান্ত যাত্রা কোম্পানির অফিস করবে।

আবার কিঞ্চিৎ নীরবতা এবং সহদেব মুহুরির প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হচ্ছিলেন জগৎহরি, তিনি এবারে অনেকদিন পরে খাটের ওপরে উঠে বসলেন, বললেন, আমি যদি শান্তিনিকেতনের নিরিবিলি বাড়িটা এই বোবা কালা ছেলে শান্তকে দিই, ওর মতো ও শান্তিতে থাকতে পারবে, তাতে নিশ্চয় তোমাদের কোনও আপত্তির কারণ নেই।

নিরুপমা বললেন, নিশ্চয় আপত্তি করব। তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। শান্তিনিকেতনে শান্তকে দেখবে কে। সেটা হল গানবাজনার জায়গা। কালাবোবার সেখানে কোনও ঠাই নেই।

আর সহ্য করতে পারলেন না জগৎহরি। যাঁর চিত হয়ে খাটে শুয়ে শ্মশানে যাওয়ার কথা, তিনি তড়াক করে খাট থেকে মেঝের ওপর নেমে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। সহদেব মুহুরি আর একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিতে যাচ্ছিল, জগৎহরিবাবুর ডান পাটা তার ডান হাতের ওপর পড়ায় সে একটু কোঁক করে উঠল।

ঘোমটা টানা নিরুপমার মুখপানে তাকিয়ে জগহরি গর্জে উঠলেন, বলি উইলটা কার? আমার, না তোমার? বলি মারা যাচ্ছে কে? আমি, না তুমি?

বলা বাহুল্য এ গল্প এখানেই শেষ। পুরনো দিনের পাঠকেরা যারা গল্পের শেষে একটা পরিণতি প্রত্যাশা করেন, তাঁদের অবগতির জন্যে তিনটি ঘটনা জানাচ্ছি। এক, জগহরিবাবু উইল করেননি। দুই, জগৎহরিবাবু এখনও মারা যাননি। তিন, জগৎহরিবাবু একটা নতুন সিনেমা প্রযোজনায় হাত দিয়েছেন, কাহিনির নাম, যতক্ষণ শ্বাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *