2 of 3

চশমা

চশমা

এ কাহিনি জয়দেব ও মহিমাময়ের অল্প বয়েসের। তখনও তারা মদ্যপ হিসেবে এত বিখ্যাত হয়নি। সন্ধ্যাবেলা হাজরার মোড়ে আমাদের একটা আড্ডা ছিল, সেখানে প্রতি সন্ধ্যায় এদিক ওদিক থেকে মদ খেয়ে এসে ঝামেলা বাধাত। তখন তাদের নবীন যৌবন। তাদের দুজনেরই মাথায় ঢুকে গিয়েছিল যে, ছবি আঁকা ছবি এঁকে নাম করা সবচেয়ে সোজা এবং তার আনুষঙ্গিক হিসেবে প্রয়োজন রং, তুলি, ক্যানভাস এবং মদ্যপান।

মহিমা একটু বেশি, জয় একটু কম, কিন্তু দুজনেই অতিমাত্রায় আধুনিক। মহিমার যে-ছবিটি বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল, সেটি আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। বিরাট ক্যানভাসে হলুদ রং মাখানো, নীচে তিনটে কালো দাগ পাশাপাশি! লাহিড়ি অবশ্য বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, এগুলি হল পাপবোধ। জয় তর্ক করেছিল, তাহলে লাইনগুলো উত্তর-দক্ষিণে না হয়ে পুবে-পশ্চিমে হওয়া উচিত ছিল। এই তর্ক কোথায় শেষ হত বলা যায় না, যদি না মজুমদারসাহেব যথাসময়ে অংশগ্রহণ। করতেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা পিকাসোতে পৌঁছে গেলুম। দক্ষিণ ফ্রান্সের এক মাঝারি জেলায় পিকাসো নামের চার রকম বানান হয়। পিকাসোর পিসেমশায় কলকাতায় ফ্রেঞ্চ ব্যাঙ্কে দেড় বছর কাজ করেছিলেন, কিন্তু তার কলকাতার টিকটিকি দেখলে গা কেমন ঘুলিয়ে উঠত, বাধ্য হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে কলকাতা ছেড়ে যেতে হয়। দু-একবার মল্লিকমশায় কীসব প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মল্লিকমশায় দৈনিক আজ্ঞায় আসতে পারেন না, তাই বোধহয় কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে তাই চুপ করে রইলেন।

কিন্তু কথায় কথায় মহিমা আর জয় খুব চটে গেল, চটে গেল বললে কম বলা হয়, ভয়ংকর ক্ষেপে গেল বলা উচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, জয়ের একটা বাজে অভ্যাস আছে, মদ ছাড়াও সন্ধ্যাবেলায় একটু গাঁজা খায়, রাতের দিকে চোখ লাল থাকে, একটু ব্যোম-ব্যোম ভাব যাকে বলে। মহিমা ঠিক সেরকম নয় তবে সে কদাচিৎ স্নান করে। অনেকে বলে মাসে একদিন, মজুমদার সাহেবের মতে বছরে একদিন, সে-ও সেই দোল-পূর্ণিমার দিন গায়ের রং ভোলার জন্যে। মোট কথা, দুজনেই একটু তিরিক্ষি মেজাজের। বিশেষত সন্ধ্যার পরে।

ঝগড়াটা লেগেছিল মজুমদার সাহেবের সঙ্গে। গঞ্জিকাসেবী বা মদোমাতাল তিনি কাউকে ভয় পেয়ে তর্কে রেহাই দেবেন, এমন পাত্র নন। আমি আর মল্লিকমশায় মৃদু মৃদু হাসছিলাম।

ঘরের মেঝেতে জল যেমন গড়ায়, সেইরকম ঝগড়া গড়াতে লাগল। কখনও খুব দ্রুতগতিতে, তারপর কোথাও কিছু নেই একটু থমকে, কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ, তারপর দুদিকে কেটে ছড়িয়ে পড়ল। একটা দিক খুব চিকন হয়ে ফুরিয়ে গেল, মজুমদারসাহেব বনাম জয় হঠাৎ সেখান থেকে একটা ধারা বেরিয়ে আলের মূল ধারার সঙ্গে জুড়ে তরতর করে পাহাড়ি নদীর মতো ঝগড়া চলল জয় আর মহিমার মূল নায়কদের মধ্যে।

আধঘণ্টার মধ্যে জয় সম্বন্ধে আমরা এমন সব তথ্য শুনতে পেলাম মহিমার মুখে, আর মহিমা সম্বন্ধে জয়ের মুখে, যা ভাবাই যায় না। বহু গোপন তথ্য ফাস হয়ে গেল, দুজনের মধ্যেকার অনেক নিবিড় ষড়যন্ত্র। জয়ের যে গৃহপালিত কুকুর ছবিটার আমি খুব প্রশংসা করি আসলে সেটা নাকি আমাকে নিয়েই আঁকা। (এতদিন পরে মনে পড়ছে, কুকুরটাকে দেখে আমার কেমন মায়া হয়েছিল, কেমন যেন চেনা চেনা মনে হয়েছিল, কোথায় যেন অনেকবার দেখেছি, এখন কারণটা বোঝা গেল।)

অন্যদিকে জয়ের মুখে জানা গেল মহিমার পাপবোধ ছবিটা নাকি মল্লিকমশায়ের চরিত্র নিয়ে আঁকা। হলদে রং আর তিনটে কালো দাগের কী অর্থ তা এবার বেরুল। তিনটে কালো দাগ তিনটি মহিলাকে বোঝাচ্ছে, আর তারা প্রত্যেকেই আমাদের অতিপরিচিতা। তাদের সঙ্গে শান্তশিষ্ট, রসিকপ্রকৃতির মল্লিকমশায়ের এমন সরস সম্পর্ক থাকতে পারে আমরা কখনও ভাবতেই পারিনি।

জয় এবং মহিমা ক্রমশ গোপনতর তথ্য ফাসের দিকে উৎসাহ দেখাতে লাগল। জয় কেন প্রত্যেক দিন রাত্রি এগারোটায় বসুশ্রী সিনেমার উলটোদিকের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকে, তার মেজমামা কী এক কুখ্যাত মামলায় ছ বছর জেল খাটছে, তার ছোট বোন কেন প্রত্যেক সপ্তাহে বিরাটি যায়–সব। জানাজানি হয়ে গেল।

আর মহিমাই বা কী করে প্রাইজ পেয়েছিল, মহিমার পায়ে যে শৌখিন লেডিস চপ্পল রয়েছে, তার মালিকান যে কে, সেটাও আমাদের জানতে হল।

ইতিমধ্যে চৌমাথায় আমাদের চারদিকে ভিড় জমতে আরম্ভ করেছে। ঝগড়ার সুযোগে একটা ভিখিরি বেশ দু পয়সা কামানোর চেষ্টা করতে লাগল।

ঝগড়া করতে করতেই জয়দেব আর মহিমাময় মিনিট পনেরোর জন্যে হাজরা পার্কের পেছন দিকে চলে গেল। তখনও হাজরা পার্ক পাতাল রেলের গুদাম হয়নি। রাত আটটার পরে উত্তরের দিকটা একটা মুক্তবায়ু খাবারখানা হয়ে যেত। চেঁচামেচি করে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, একটু গলা। ভিজিয়ে তারা আবার ফিরে এল, ধীরে ধীরে রাত অনেক হয়ে গেল কিন্তু দুজনের মধ্যে হাজার চেষ্টা করেও ঝগড়া থামানো গেল না, আমরা তাদের পরিত্যাগ করতে বাধ্য হলুম। ততক্ষণে দর্শকদের ভিড় আবার বেশ বেড়ে গেছে। একটা অকর্মা গোছের ট্রাফিক-পুলিশ ভাঙা বাংলায় কয়েকবার ক্যায়া হোতা হ্যায়, রাত বারো বাজ গিয়া ইত্যাদি জানান দিয়ে দিয়ে অবশেষে উলটোদিকের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে রাস্তায় লাঠি ঠুকতে লাগল। আমি আর মল্লিকমশায় রাত বারোটায় ঝগড়া দেখবার জন্যে এত লোক কোথা থেকে জড়ো হয় এই বিষয়ে আলোচনা করতে করতে বাড়ির দিকে পা। বাড়ালাম।

শুধু মজুমদার সাহেব-ই রয়ে গেলেন। কোনওদিন কোনও কলহই তিনি অর্ধসমাপ্ত রেখে যাননি, আজও তার কোনও ব্যতিক্রম হল না। আমরা যেতে যেতে পিছন ফিরে দেখলাম মজুমদার সাহেব চৌমাথার পাশের রেলিং-এর ওপর বসে নির্বিকার সিগারেট টানছেন, নীচে ভিড়ের মধ্যে মহিমা আর জয়কে দেখা গেল না কিন্তু তাদের উচ্চ, অশ্রাব্য কণ্ঠস্বর বহুদূর পর্যন্ত আমাদের কর্ণগোচর হতে লাগল।

পরদিন নরমহাতের কড়ানাড়ায় ঘুম ভাঙল সাড়ে পাঁচটায়। একটু বিরক্ত হয়েই দরজা খুলেছিলাম। চার ঘণ্টাও ভাল করে ঘুমাইনি। খুলে দেখি মজুমদার-গৃহিণী, অসম্ভূত অলকদাম, নিশিজাগরণে লোহিতা-লোচনা, প্রায় বাড়ির পোশাকে বাইরে চলে এসেছেন, এই আমার বাড়ি পর্যন্ত। মজুমদার-গৃহিণী নিজের বাড়ি থেকে এগারো মাইল দূরের এক মেয়েকলেজের মর্নিং সেকশনে পড়ান, প্রতিদিন শেষরাত্রিতে গৃহত্যাগ করেন। সুতরাং এই ভোর সাড়ে পাঁচটা যে আমার মধ্যরাত্রি এতটা তিনি বোধহয় পূর্বে অনুমান করতে পারেননি।

সমস্ত বিরক্তি ঢেকে, আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, কী সৌভাগ্য, প্রভাতে উঠিয়া ও মুখ আসুন।ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি মজুমদার সাহেব কাল রাত্রে বাড়ি ফেরেননি।

কিঞ্চিৎ শঙ্কা, কিঞ্চিৎ লজ্জাও বোধহয় মৃদু হাসির সঙ্গে মিশিয়ে একটা মোটামুটি সুসেব্য মিস্টার তৈরি করলেন মজুমদার-গৃহিণী, আপনার বন্ধু কাল রাত্রে আপনার এখানে ছিলেন না?

আমি আমতা আমতা করে উত্তর দিতে যাচ্ছি, এমন সময় প্রায় উদভ্রান্তের মতো মজুমদার সাহেব ঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই কাল রাত্রের গৃহে অনুপস্থিতির জন্যে বিন্দুমাত্র লজ্জিত না হয়ে উলটে গৃহিণীকে ধরলেন, তুমি এই সাতসকালে বাড়িতে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছ, আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে! আমার কয়েক মাস আগের এক শীতের রাত্রির কথা মনে পড়ল। মজুমদার সাহেব যেদিন বাড়ির চাবি পকেটে করে আমার ঘরে রাত্রে থেকে গিয়েছিলেন, সেদিন মজুমদার-গৃহিণী কী করেছিলেন?

কিন্তু আজ একটা দাম্পত্য কলহ প্রায় আমার ঘরের মধ্যেই লেগে গেল। আমি মধ্যে পড়ে মজুমদার-গৃহিণীকে বিরত করতে চেষ্টা করলুম, চাকরটা আবার নিরুদ্দেশ, সকালবেলায় বাড়িতে অতিথি এসেছেন, একটু চা খান, কেটলি স্টোভ সবই তো কোথায় আছে জানেন, দয়া করে একটু করে নিন।

এইসব মুহূর্তে মজুমদার সাহেবের পত্নীপ্রেম দেখবার মতো, আমার স্ত্রী কেন আপনার বাড়িতে চা করবে? ভদ্রতা করতে হয় নিজে চা করে খাওয়ান!

আমি আজকাল আর এসব কথায় অপমানিত হই না। চুপ করে রইলাম।

মজুমদার-গৃহিণী উঠে পাশের ঘরে চা করতে গেলেন। আমি মজুমদার সাহেবকে গতরাত্রের ঘটনা জিজ্ঞাসা করলাম। কিছুক্ষণ ফোঁস ফোঁস করে, তারপরে তিনি মুখ খুললেন, বিস্তৃত বিবরণ দিলেন সমস্ত ঘটনার। মজুমদার সাহেবের কথা শুনতে শুনতে এতক্ষণে লক্ষ করে দেখলাম ওঁর শরীরের উপর দিয়ে গতকাল রাত্রে যেন দুর্দান্ত তাণ্ডব বয়ে গেছে। ধুতির কোঁচা শতচ্ছিন্ন, কানের নীচে রক্তবর্ণ আঘাতের চিহ্ন, বাঁহাতের দুটো আঙুলে রক্তমাখা ন্যাকড়ার ফালি জড়ানো।

রাত একটার পর জয় আর মহিমা দুজনেই যেন ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তখন আর মুখে মুখে নয়, হাতে হাতে। বিটের জমাদারের মুখ-চেনা ছিল মজুমদারের, তাই থানা পুলিশ হয়নি। দুবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে মজুমদার সাহেব আহত হয়েছেন। একবার মহিমা ধাক্কা দিয়ে পার্কের রেলিং-এ ফেলে দেয়, পরের বার রাস্তার এক পাগলা ভিখিরির গায়ে। সেই পাগলা ভিখিরিটাকে আমরা সবাই চিনি, নিরীহ ঠান্ডা মেজাজের। কিন্তু হঠাৎ আচমকা ঘুম ভেহে যাওয়ায় সে লাফিয়ে উঠে রাস্তা থেকে একটা ভাঙা বাঁশের টুকরো কুড়িয়ে তিনজনকেই বেধড়ক আক্রমণ করে। এতেই অবশ্য গোলমালের ফয়সালা হয়ে যায়। সেটা রাত তিনটের সময়। তারপর এতরাত্রে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না স্থির করে মজুমদার একা পায়ে হেঁটে আহত ক্লান্ত অবস্থায় বাড়ি পৌঁছে দেখেন দুয়ার বন্ধ।

কই, চা হতে এত দেরি হচ্ছে কেন? মজুমদার সাহেব চিৎকার করে স্ত্রীকে তাগাদা দিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ির নীচে শোনা গেল, দু কাপ বেশি। যেন কিছুই হয়নি এইরকম হাসিমুখে কালরাতের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ঘরে ঢুকলেন পরস্পরের কাঁধে হাত দিয়ে, যেন গলায় গলায় ভাব জয়দেব আর মহিমাময় এল। জয়ের পায়ের দিকে ধুতির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ অন্তর্হিত, কাঁধে জামার কলার বলতেও প্রায় কিছুই নেই, কলারের নীচে পিঠের দিকে আধাআধিভাবে ছেঁড়া, একটা ফালি তেকোনা নিশানের মতো উড়ছে। মহিমার তেমন মারাত্মক নয়, তার হাওয়াই শার্টের একটা হাতাই যা শুধু নেই আর খালি পা। তা ছাড়া দুজনেই ক্রমাগত চোখ পিটপিট করছে, দুজনেই চশমাধারী, কিন্তু আজ কারওর চোখেই চশমা নেই, উভয়েই উদ্ভান্ত-দর্শন।

কাল রাত্রির ঘটনায় দুজনেই যথেষ্ট লজ্জিত। ব্যাপারটা একেবারেই যে ছেলেমানুষি হয়ে গেছে এটা প্রায় আমরা একমত হলুম, মজুমদারসাহেব বাদে। মজুমদারসাহেব ওই ঘটনার মধ্যে শুভ্রচৈতন্য এবং মহৎ আত্মাভিমান বোধের আদর্শ আবিষ্কার করেছিলেন। সমস্ত বিষয়ে অনুধাবন করতে শ্রীমতী মজুমদারের বোধহয় একটু সময় লাগল। চা খেতে খেতে প্রথম কয়েক মিনিট তিনি স্থির হয়ে স্বীয় স্বামী এবং জয় ও মহিমাকে পর্যবেক্ষণ করলেন এবং তারপর উদাসদৃষ্টিতে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলেন, মুখে কোথায় একটা অনির্দিষ্ট বঙ্কিম হাসি।

শেষে তোমাদের দুজনেরই চশমা হারাল? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

জয় বা মহিমা কিছু উত্তর দেওয়ার আগে মজুমদারসাহেব বললেন, কিন্তু জয়ের চোখে তো শেষ পর্যন্ত চশমা ছিল, মহিমারটাই তো হাজরা পার্কে হারাল।

জয় বলল, আমার তো ছিল চোখে যতদূর মনে পড়ে, তবে যা ব্যাপার, ভোরবেলা উঠে দেখছি না, বোধহয় সেইসময় কোথাও পড়ে গেছে। হাতে একটা পয়সা নেই, এখন চশমা তৈরি করি কী দিয়ে?

কী আর করা যেতে পারে!, মহিমা উদাসীন ভাবে জানাল, ওকাকু নামে সেই জার্মানসাহেব একটা ছবি নেবে বলেছিল, তা সে তো দিল্লি থেকে ফিরছে না, ততদিন অন্ধ হয়েই থাকতে হবে।

চোখে না দেখতে পেলে কি আপনাদের ছবি আঁকার খুব অসুবিধে হয়? হঠাৎ মজুমদারগৃহিণী প্রশ্ন করে বসলেন।

মজুমদারসাহেব ফোঁস করে উঠলেন, তুমি চুপ করো তো, এর মধ্যে তুমি আবার কথা বলছ কেন?

একটু পরে জয় উঠল। তার সঙ্গে মহিমাও উঠল। মিনিট দশেক পরে ফিরে এল একা মহিমা, এবার তার চোখে চশমা।

এ চশমা তুমি কোথায় পেলে? মজুমদারসাহেব লাফিয়ে উঠলেন।

মহিমা মৃদু হেসে বলল, আমার পকেটে ছিল, সিগারেট বের করতে গিয়ে দেখি রয়ে গেছে।

কিন্তু এ চশমা তো তোমার নয়। মজুমদারসাহেব বললেন।

মহিমা কেমন আমতা আমতা করতে লাগল, কিন্তু এটা তো আমারই বলে মনে হচ্ছে।

 অসম্ভব। মজুমদারসাহেবের সাফ জবাব, তোমার চশমা কালো মোটা লাইব্রেরি ফ্রেমের, আমার সঙ্গে গিয়ে কিনেছিলে। এটা জয়ের।

তোমাদের দুজনের কি একই পাওয়ার চশমার? কী করে তোমার চোখে জয়ের চশমা লাগছে? আমি প্রশ্ন করি।

মহিমা প্রথম প্রশ্ন এড়িয়ে গেল, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে যা বলল তার সারাংশ এইরকম: যখন চোখে চশমা থাকে তখন তো আর চশমা দেখতে পাই না, আর যখন থাকে না তখন তো চোখেই দেখতে পাই না। নিজের চশমা চেনা অসম্ভব।

এই যুক্তি অনস্বীকার্য, কিন্তু একই চশমা দুজনের হল কী করে?

মজুমদারসাহেব গৃহিণীকে বললেন, তুমি বাড়ি যাও, আমি আসছি। তারপর আমাকে বললেন, আপনি আসুন, মহিমাকে নিয়ে জয়ের ওখানে যাই, দেখি জয়ের চশমার কী হল?

ব্যাপারটা একটু বেশি গোলমেলে, কিন্তু আমাকেও উঠতে হল। জয়ের ওখানে গিয়ে দেখলুম সে খালিচোখেই পিটপিট করতে করতে ছবি আঁকছে।

এই চশমাটা কার? মহিমার চোখ থেকে চশমাটা খুলে জয়ের চোখের সামনে তুলে ধরলেন মজুমদারসাহেব।

কী করে বলি? যেন ঈশ্বর বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করা হয়েছে এই রকম নির্লিপ্তভাবে ছবি আঁকতে আঁকতে জয় উত্তর দিল।

আশ্চর্য! মজুমদারসাহেব ভীষণ বিরক্তির সঙ্গে হাতের চশমাটা জানলা দিয়ে তিনতলার বাইরের আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলেন।

তোমার খালি চোখে কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না, আর এর অন্যের চশমা চোখে দিয়েও কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না! যত সব বুজরুকি! এর পরে যদি কারওর চোখে চশমা দেখি চোখ গেলে দেব! মজুমদারসাহেব আমাকে সঙ্গে নিয়ে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে এলেন।

তারপর থেকে জয় আর মহিমা কারও চোখেই চশমা নেই। আর কী এক অজ্ঞাত কারণে দুজনেরই নতুন ছবিগুলি খুব সরল আর বোধ্য হয়ে উঠল এবং শেষ পর্যন্ত এতই সরল হয়ে গেল যে তারা ছবি আঁকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *