চতুরঙ্গ
2 of 3

চতুরঙ্গ

চতুরঙ্গ

আমার জীবনে ভীষণ সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমি একটা লোকের হাত কিছুতেই এড়াতে পারছি না।

অথচ লোকটা আমার কেউ নয়। আত্মীয় নয়, বন্ধু নয়, কখনও কিছু ছিল না। এই লোকটার কাছে আমার কোনও ধারদেনা নেই, লোকটারও নেই আমার কাছে। ধারের কথায় বলি, একবার এক কাবুলি ভদ্রলোকের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়েছিলাম কিন্তু তিনিও আমার পিছনে এমন করে লাগেননি।

উত্তমর্ণ ছাড়া এমনভাবে পিছনে লেগে থাকতে পারে ইন্সিওরেন্সের দালাল, বিয়ের ঘটক কিংবা পুলিশের ফেউ।

কিন্তু এই লোকটা আমার সম্মুখে একেক সময় একেক ছদ্মবেশে দেখা দিচ্ছে। আজ পর্যন্ত কোনও ইনসিওরেন্সের দালাল ছদ্মবেশে আক্রমণ করেছে শুনিনি। অনেকে আত্মীয় কিংবা বন্ধুর বেশে আসে বটে। একেবারে ছদ্মবেশী দালাল, যতদূর মনে হয় অসম্ভব।

বিয়ের ঘটক? কিন্তু বিয়ের ঘটক আমার কী করবে? গৃহে আমার নবীনা স্ত্রী, দুর্দান্ত পুত্র। হিন্দু কোড বিল পাশ হওয়ার পরে কি আর বিয়ের ঘটকেরা বিবাহিত ব্যক্তির অনুসরণ করে?

তা হলে বাকি থাকে পুলিশের স্পাই। পুলিশ কী জন্যে? আমি অতি নিরীহ সাদাসিধে মানুষ। সজনের ডাটা চুষে, বউয়ের শাড়ি ইস্ত্রি করে, সস্তা সিগারেট খেয়ে, গলা ব্যথা হলে নুন জল দিয়ে গার্গল করে নেহাত গোবেচারার মতো বেঁচে আছি। কোনও বেআইনি কিছু করি এমন সাহস নেই। একবার একটা অন্ধ ভিখিরির থালায় একটা অচল সিকি দিয়ে বিশ পয়সা তুলে নিয়েছিলাম, জ্ঞানত এই হল সবচেয়ে বড় পাপ কাজ। কিন্তু সেই জন্যে পুলিশ আমাকে ওয়াচ করতে যাবে কেন?

কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এ বড়ই বিপদ হয়েছে আমার।

লোকটাকে প্রথম দেখি হাজরা পার্কের সামনে।

 একটু আগে বলেছি আমার একটি পুত্রসন্তান আছে। সে সদ্য কথা বলতে শিখছে। প্রথমেই যে পাঁচ-সাতটি শব্দ সে উচ্চারণ করতে শেখে তার মধ্যে একটি হল বাবা এবং অন্য একটি ট্যাক্সি। এই শব্দ দুটি সে অধিকাংশ সময়েই একত্রে উচ্চারণ করে।

বাবা, ট্যাক্সি, তার এই শব্দ দুটির একত্রে মানে হল, বাবা, ট্যাক্সি ডেকে এনে চড়াও, অথবা বাবা, ট্যাক্সি হও।

আমি গরিব মানুষ, সদাসর্বদা ছেলেকে ট্যাক্সি চড়াতে পারি না, তাই নিজেকেই ট্যাক্সি হতে হয়। ট্যাক্সি হওয়া মানে ছেলেকে কাঁধে নিয়ে রোদ হোক, বৃষ্টি হোক, দিন-দুপুর বা মধ্যরজনী হোক, মাইল দেড়েক ঘুরে আসা। কোলে বা কাখে নিলে চলবে না, কুরুক্ষেত্র কাণ্ড হবে।

সেদিন বাড়ি থেকে ট্যাক্সি হয়ে বেরিয়ে ছেলেকে কাঁধে নিয়ে মাইল খানেক হেঁটে হাজরা পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। আমার পাশেই লোকটা চানাচুরের প্যাকেট নিয়ে একটা ঝুড়িতে করে বেচছে। তারস্বরে চেঁচিয়ে খদ্দের আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে, চানাচুর, এ বাবু চানাচুর, চানামোহনকা চানাচুর।

চানাচুরওয়ালার নাম চানামোহন। নাম শুনে একটু ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম লোকটাকে। নিতান্ত সাধারণ হিন্দুস্থানি চেহারা, গলায় মাদুলি, কাঁধে গামছা, গোয়ালাদের মতো গোঁফ।

খাব মনে করে এক প্যাকেট চানাচুরও কিনে ফেললাম। কিন্তু ছেলেটা খেতে দিল না, কখন কাঁধের উপর থেকে চিলের মতো ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে নিজেই কুড়মুড় করে খেতে লাগল।

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরছি, মোড়ের মাথায় বাস থেকে নামতেই নামল তুমুল বৃষ্টি। তাড়াতাড়ি একটা গাড়িবারান্দার নীচে ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিলাম।

বৃষ্টির জন্যে গাড়িবারান্দাটার নীচে খুব ভিড় হয়ে গেল। একটু পরে দেখি সেই ভিড়ের মধ্যে হাজরা পার্কের সামনের সেই চানামোহন ঘুগনি বেচছে। দুদিন আগে এই লোকটা চানাচুর বেচছিল, এখন ঘুগনি বেচছে। সে যা হোক, আমিও দশ পয়সার ঘুগনি কিনে খেলাম।

এই পর্যন্ত ভালই ছিল। চানাচুরওয়ালার ঘুগনিওয়ালা হতে আপত্তি নেই। যদিও আমার মনে খটকা লেগেছিল ব্যাপারটায়। কেননা এমন তো খুব বেশি দেখি না।

পরের দিনই রবিবার। সকালবেলায় বাসায় বসে আছি।

আমার স্ত্রী এসে বললেন, রাস্তা দিয়ে রং-মিস্ত্রি যাচ্ছে। ডাকব?

বাড়িতে কয়েকটা জানলা দরজা বহুদিন হল ফেটে, চটে আছে, রং করানো দরকার, বললাম, ডাকো।

রং-মিস্ত্রি আসতে দেখি চানামোহন। সেই গোঁফ, সেই মাদুলি, সেই কাঁধে গামছা। তাকে দেখে অবাক হলাম। কিন্তু সে আমাকে চিনতে পারল কিনা কে জানে?

সন্দেহ নিরসন করার জন্যে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলাম, কী নাম তোমার? লোকটা গোঁফের ফাঁকে মৃদু হেসে বলল, ফাগুলাল।

এ যে চানামোহন সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু এখন বলছে ফাগুলাল। তার উপরে প্রথমে চানাচুরওয়ালা, তারপরে ঘুগনিওয়ালা এবং একেবারে রং-মিস্ত্রি–পুরো ব্যাপারটাই সন্দেহজনক।

তবু যতই সন্দেহ বা দুশ্চিন্তা হোকা কেন, রং-মিস্ত্রিকে সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে এত কথা। ভাববার অবসর নেই। সুতরাং দাম-দর ঠিক করে ফাগুলালকে জানলা রং করতে বলা হল।

রং লাগানোর জন্যে ফাগুলাল পুরানো কাপড় চাইল। আমার স্ত্রী একটা পুরানো ধুতি থেকে প্রায় অর্ধেক ছিঁড়ে তাকে দিল। রং লাগাতে লাগল ফাগুলাল। একটা টিনের ছোট থালায় করে রং নিয়ে এসেছে, একেবারে তৈরি রং, সেই রং ঘেঁড়া ধুতির টুকরো দিয়ে ঘষে ঘষে জানলায় লাগল। আমি এক মুহূর্তও তাকে চোখের আড়াল করলাম না, ঠায় সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। কেননা এর কী মতলব, কিছুই যে বোঝা যাচ্ছে না।

ভালই রং করল কিন্তু ফাগুলাল। রং করে টাকা পয়সা নিয়ে সেলাম করে চলে গেল।

 এরও কয়েকদিন পরে।

 আবার একদিন ট্যাক্সি হয়ে বেরিয়েছি, কাঁধে পুত্র, তবে সঙ্গে সেদিন স্ত্রীও আছেন।

যেতে যেতে হঠাৎ আমার স্ত্রী থমকে দাঁড়ালেন, এই দ্যাখো আমাদের সেই রং-মিস্ত্রি এখানে কী সুন্দর বাটিকের ব্লাউজ পিস বেচছে!

সত্যিই সেই লোকটা। গলায় মাদুলি, কাঁধে গামছা, গোয়ালাদের মতো গোঁফ, সহাস্য বদনে কয়েকটা বাটিকের ছাপা ব্লাউজ পিস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

লোকটার গোঁফের ফাঁকের ওই হাসি আমার আরও রহস্যময় মনে হল। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে যেন একটা বিরাট চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র বা ওই জাতীয় কিছুর আভাস রয়েছে।

আমার পক্ষে আর নিজেকে দমন করা সম্ভব হল না। আমি স্পষ্টই লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমিই এই দুদিন আগে আমাদের বাড়িতে জানলা রং করতে গিয়েছিলে না?

লোকটা নির্বিকার ভাবে বলল, তা হবে।

 আমি আরও উত্তেজিত হয়ে বললাম, তোমার নাম কী?

লোকটা এবারও নির্বিকার ভাবে জানাল, বেনারসীপ্রসাদ।

সর্বনাশ, ফাগুলাল থেকে আবার বেনারসীপ্রসাদ হয়ে গেল! এই রহস্যের সমাধান আমাকে করতেই হবে। আমার কেমন যেন রোখ চেপে গেল।

ইতিমধ্যে লোকটার হাতে যে দু-তিনটি বাটিকের ব্লাউজ ছিল, একটি বাদে সবই বিক্রি হয়ে গেছে। শেষ ব্লাউজ পিসটিকে আমার স্ত্রী ছাড়লেন না, নিজেই কিনে নিলেন।

এইবার লোকটা ফাঁকা। আমি সুযোগ ছাড়লাম না। ছেলে কাঁধে নিয়ে লোকটার পিছে পিছে। হাঁটতে লাগলাম। একটু পরে হাঁটা থামিয়ে লোকটা একটু বিব্রত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার, বাবু?

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এখন তো বাটিকের ব্লাউজ পিস বেচলে, এরপর কী করবে?

লোকটা বলল, আর নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। আবার যদি করতে হয় তবে চানাচুর থেকে আরম্ভ করতে হবে।

মানে? আমার ভ্রুকুঞ্চনের জটিলতা দেখে লোকটা একটু প্রাঞ্জল হল।

আমাকে আর কষ্ট করে প্রশ্ন করতে হল না। লোকটাই বুঝিয়ে বলল, প্রথমে চানাচুর বেচছিলাম, এমন সময়ে জোর বৃষ্টি এসে সব ভিজিয়ে দিল। তখন কী আর করব, সব ঘুগনি হিসেবে বেচে দিলাম।

আমি রুদ্ধ নিশ্বাসে শুনছিলাম, বললাম, তারপর!

 তারপর আর কী, লোকটা বলে চলল, ঘুগনি বেচবার পর যেটুকু লেগে রইল থালায়, ওই তেল, মশলা, ডালের গুঁড়ো মতো কাদা কাদা, সেটা আর নষ্ট করে লাভ কী, একটা কৌটায় ভরে পরের দিন ওইগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রং-মিস্ত্রি হয়ে। আপনার বাড়িতেই তো রং করে দিয়ে এলাম।

অ্যা বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল আমার চোখ। কিন্তু বেশি বিস্মিত হবার আর সময় নেই। কাঁধের উপর ছেলে এতক্ষণে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। তদুপরি স্ত্রী-কেও কাছাকাছি দেখছি না। তিনি যে ইতিমধ্যে কোথায় গেলেন?

যাই হোক, আমার আর একটি প্রশ্নই বাকি ছিল। এইবার জিজ্ঞাসা করলাম, ওই বাটিকের ছাপা কাপড় কোথায় পেলে?

লোকটা হাসল, কোথায় আর পাব? আপনারাই তো দিলেন। সেই যে ছেঁড়া ধুতি দিলেন জানলায় রং লাগানোর জন্য।

ছেঁড়া ধুতি? আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।

হ্যাঁ, সেটাই রং লাগানো হয়ে গেলে রোদে শুকিয়ে তিন টুকরো করে বেচে দিলাম।তাড়াতাড়ি জবাব শেষ করে লোকটা আবার হাঁটা শুরু করল।

আমাকেও ফিরতে হবে। কিন্তু কী একটা খটকা যেন রয়ে গেল কোথায়? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ইতস্তত করতে লাগলাম।

এমন সময় লোকটা নিজেই কেন যেন ফিরে এল। এসে আমাকে বলল, দেখুন বাবু, আমার নাম বেনারসীপ্রসাদ নয়, আসলে আমার নাম ভজুয়া।

এই স্বীকারোক্তিতে আমি অবাক হলাম, বললাম, তাহলে বেনারসীপ্রসাদ বললে কেন?

 লোকটা হেসে বলল, তখন কাপড় বেচছিলাম কিনা।

এইবার সব আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। যখন কাপড় বেচে তখন বেনারসীপ্রসাদ, যখন রং লাগায় তখন ফাগুলাল, যখন চানাচুর বেচে তখন চানামোহন, যখন ঘুগনি বেচে তখন? কী জানি?

না জানলাম। আমার আর জানবার প্রয়োজন নেই।

দূরে ভজুয়া হেঁটে যাচ্ছে। ভজুয়া মানে বেনারসীপ্রসাদ, মানে ফাগুলাল, মানে চানামোহন।

আমি আবিষ্টের মতো, অভিভূতের মতো তার চলার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *