• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

উক্তি-সঞ্চয়ন—১

লাইব্রেরি » স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী » ১০ম খণ্ড » ০৪. উক্তি-সঞ্চয়ন » উক্তি-সঞ্চয়ন—১

১। মানুষের জন্ম প্রকৃতিকে জয় করিবার জন্যই, তাহাকে অনুসরণ করার জন্য নয়।

২। তুমি যখন নিজেকে দেহমাত্র বলিয়া ভাব, তখন তুমি বিশ্বজগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন; নিজেকে যখন জীব বলিয়া ভাব, তখন তুমি সেই শাশ্বত মহান্ জাতির একটি কণিকামাত্র; আর যখন নিজেকে আত্মা বলিয়া ভাব, তখন তুমিই সব কিছু।

৩। ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন নয়—ইহা কার্যকারণের গণ্ডীরই মধ্যস্থ ব্যাপারবিশেষ; কিন্তু এই ইচ্ছাশক্তির পিছনে এমন কিছু আছে, যাহা স্বাধীন।

৪। সততা এবং পবিত্রতাই শক্তির আকর।

৫। বিশ্বজগৎ ঈশ্বরেরই বহিঃপ্রকাশ।

৬। নিজের উপর বিশ্বাস না আসিলে ঈশ্বরে বিশ্বাস আসে না।

৭। ‘আমার দেহ’—এই ভ্রমই সকল অমঙ্গলের মূল। আদি পাপ বলিয়া যদি কিছু থাকে, ইহাই সেই পাপ।

৮। একদল বলেন, চিন্তা—জড় হইতে উৎপন্ন; আবার অপর দলের মতে চিন্তা হইতে জড়-জগতের উৎপত্তি। এই দুইটি মতবাদই ভুল। জড়বস্তু এবং চিন্তা পরস্পর-সহগামী। তৃতীয় এমন একটি বস্তু আছে, যাহা হইতে জড় এবং চিন্তা দুই-ই উদ্ভূত।

৯। আকাশের ভিত্তিতে যেমন সমস্ত জড়কণা একত্র হয়, তেমনি কালের ভিত্তিতে সমস্ত চিন্তাতরঙ্গ মিলিত হয়। সকল জড় পদার্থ যেমন আকাশে (দেশে) সীমাবদ্ধ, সকল চিন্তাও তেমনি কালে সীমাবদ্ধ।

১০। ঈশ্বরের সংজ্ঞা নির্ণয় করিতে যাওয়া মানে পিষ্টপেষণ করা, কারণ তিনিই একমাত্র সত্তা—যাহাকে আমরা জানি।

১১। ধর্ম এমন একটি ভাব, যাহা পশুকে মনুষ্যত্বে ও মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে।

১২। বহিঃপ্রকৃতি অন্তঃপ্রকৃতিরই স্থূল প্রকাশ মাত্র।

১৩। উদ্দেশ্য দ্বারাই কোন কাজের মূল্য নিরূপিত হয়। তুমি ঈশ্বর, নিম্নতম মানুষটিও ঈশ্বর—ইহা অপেক্ষা উচ্চতর উদ্দেশ্য আর কি থাকিতে পারে?

১৪। মনোজগতের ঘটনাবলী পরীক্ষা করিতে হইলে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে শিক্ষিত এবং খুব সবল হওয়া প্রয়োজন।

১৫। মনই সব কিছু, চিন্তাই সব কিছু—এরকম ভাবা একটি উন্নত ধরনের জড়বাদ মাত্র।

১৬। এই পৃথিবী একটি বিরাট ব্যায়ামাগার, এখানে আমরা আসি নিজেদের সবল করিয়া তুলিতে।

১৭। একটি চারাগাছকে বাড়ান তোমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব, একটি শিশুকে শিক্ষা দেওয়াও তোমার পক্ষে ততটুকু সম্ভব, তার বেশী নয়। তুমি যেটুকু করিতে পার, তাহার সবটাই ‘নেতি’র দিকে—তুমি শুধু তাহাকে সাহায্য করিতে পার। শিক্ষা ভিতর হইতে বিকাশ হয়। নিজের প্রকৃতিকে শিশু বিকশিত করিতে থাকে; তুমি কেবল বাধাগুলি অপসারিত করিতে পার।

১৮। সম্প্রদায়-গঠনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বপ্রেমের বিরোধিতা করা হয়। যাঁহাদের হৃদয়ে সত্যই বিশ্বপ্রেমের অনুভূতি জাগিয়াছে, তাঁহারা বেশী কথা বলেন না, কিন্তু তাহাদের কাজগুলিই উচ্চকণ্ঠে উহা ঘোষণা করে।

১৯। সত্যকে হাজার রকম বাক্যে প্রকাশ করা চলে, এবং প্রতিটি কথাই সত্য।

২০। তোমাকে ক্রমশঃ ভিতর হইতে বাহিরের দিকে বিকশিত হইতে হইবে; ইহা কেহই তোমাকে শিখাইতে পারে না, কেহ তোমাকে ভগবৎপরায়ণ করিয়া দিতে পারে না। তোমার নিজের অন্তরাত্মা ভিন্ন দ্বিতীয় কোন শিক্ষক নাই।

২১। একটি অন্তহীন শৃঙ্খলের কয়েকটি শিকলির সহিত পরিচয় ঘটিয়া থাকিলে একই উপায়ে অপর অংশগুলিরও পরিচয়-লাভ সহজ।

২২। কোন জড় পদার্থ যাঁহাকে চঞ্চল করিতে পারে না, তিনি অমৃতত্ব লাভ করিয়াছেন।

২৩। সত্যের জন্য সব কিছুকেই ত্যাগ করা চলে, কিন্তু কোন কিছুর জন্য সত্যকে বর্জন করা চলে না।

২৪। সত্যের অনুসন্ধান মানে শক্তির প্রকাশ—এটা দুর্বল বা অন্ধের মত হাতড়ান নয়।

২৫। ঈশ্বর মানুষ হইয়াছেন—মানুষ আবার ঈশ্বর হইবে।

২৬। মানুষ মরে এবং স্বর্গে যায়—ইহা তো ছেলেমানুষী কথা। আমরা কখনও আসি না। যাইও না। আমরা যেখানকার সেখানেই আছি। যত জীবাত্মা আজ পর্যন্ত হইয়াছে বা আছে এবং হইবে—সকলেই এক জ্যামিতিক বিন্দুতে অবস্থিত।

২৭। যাঁহার হৃদয়-বেদ খুলিয়া গিয়াছে, তাঁহার কোন গ্রন্থের প্রয়োজন হয় না। গ্রন্থের একমাত্র কাজ হইল অন্তরের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করা। গ্রন্থগুলি তো অন্যের অভিজ্ঞতা মাত্র।

২৮। সকল জীবের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হও। দুঃস্থদের প্রতি করুণা প্রকাশ কর। সমস্ত প্রাণীকে ভালবাস। কাহারও প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হইও না এবং অপরের দোষ দর্শন করিও না।

২৯। মানুষ কখনও মরে না বা কখনও জন্মায়ও না। মৃত্যু হয় দেহের; কিন্তু আত্মা কোনদিন মরে না।

৩০। কোন ধর্মমত লইয়া কেহ জন্মায় না; পরন্তু প্রত্যেকেই কোন না কোন ধর্মমতের জন্যই জন্মায়।

৩১। প্রকৃতপক্ষে চরাচর বিশ্বে এক আত্মাই আছেন; অন্য সব কিছু তাঁহারই বিকাশ মাত্র।

৩২। উপাসকের অধিকাংশই সাধারণ শ্রেণীর, বীর কেবল দু-একজন, উপাসকদিগকে শ্রেণীতে ভাগ করা চলে।

৩৩। যদি এইখানে—এবং এই মুহূর্তেই পূর্ণত্ব লাভ করা সম্ভব না হয়, তবে অন্য কোন জীবনে যে আমরা পূর্ণত্ব লাভ করিতে পারিব, তাহার কোন প্রমাণ নাই।

৩৪। একতাল মাটি সম্বন্ধে যদি আমার সম্পূর্ণ জ্ঞান হয়, তবে পৃথিবীতে যত মাটি আছে, সে সম্বন্ধেও আমি জানিতে পারি। ইহা হইল তথ্য-সম্বন্ধীয় জ্ঞান, কিন্তু ইহার ক্ষেত্রানুযায়ী রূপ বিভিন্ন হইতে পারে। যখন তুমি নিজেকে জানিতে পারিবে, তখন সবই জানা হইয়া যাইবে।

৩৫। বেদের যতখানি অংশ যুক্তিসিদ্ধ, আমি ব্যক্তিগত ভাবে ততটুকু গ্রহণ করি। বেদের কোন কোন অংশ আপাত-দৃষ্টিতে পরস্পর-বিরোধী। দিব্যপ্রেরণালব্ধ বাণী (Inspired) বলিতে পাশ্চাত্য ভাষায় যাহা বুঝায়, এগুলি ঠিক তাহা নয়, বরং এগুলিকে ঈশ্বরের জ্ঞানসমষ্টি বা সর্বজ্ঞতা বলা যাইতে পারে। কল্পারম্ভে এই জ্ঞানের স্ফূর্তি ও বিস্তার হয় এবং কল্পশেষে এগুলি আবার সূক্ষ্মাকার প্রাপ্ত হয়। আবার যখন কল্প আরম্ভ হয়, তখন ঐ সঙ্গে এই জ্ঞানেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই পর্যন্ত এই মতবাদটি ঠিকই আছে। কিন্তু বেদ নামে অভিহিত শুধু এই বইগুলিই ঈশ্বরের জ্ঞান, এ-কথা বলা বৃথা তর্ক মাত্র। মনু এক জায়গায় উল্লেখ করিয়াছেন, বেদের যে অংশ যুক্তিসম্মত, সেইটুকুই বেদ নামের যোগ্য, অন্য কিছু নয়। আমাদের দার্শনিকেরা অনেকেই এই মত গ্রহণ করিয়াছেন।

৩৬। জগতের সমস্ত ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে বেদই কেবল ঘোষণা করেন যে, বেদের অধ্যয়নও গৌণ। ‘যাহা দ্বারা আমরা সেই অক্ষর পুরুষকে জানিতে পারি’ তাহাই প্রকৃত বিদ্যা এবং এই বিদ্যা কেবল বেদপাঠ, বিশ্বাস বা বিচার—এগুলির কোনটিই হয়, উহা অতিচেতন অনুভূতি বা সমাধি।’

৩৭। আমরাও এক সময়ে নিম্নতর প্রাণী ছিলাম। আমরা ভাবি যে, তাহারা আমাদের হইতে ভিন্ন। পাশ্চাত্য দেশের লোকেদের বলিতে শুনি—আমাদের ভোগের জন্য জগৎ সৃষ্ট হইয়াছে। ব্যাঘ্রদের বই লিখিবার ক্ষমতা থাকিলে তাহারাও বলিত যে, তাহাদের ভোগের জন্যই মানুষের সৃষ্টি হইয়াছে এবং সব প্রাণীর মধ্যে মানুষই পাপিষ্ঠ, কেননা তাহারা সহজে বাঘের নিকট ধরা দিতে চায় না। যে কীট তোমার পায়ের তলায় আজ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, সেও একদিন ঈশ্বরত্ব লাভ করিবে।

৩৮। নিউ ইয়র্কে স্বামী বিবেকানন্দ বলিলেনঃ আমাদের দেশের মেয়েরা তোমাদের মত বিদ্যা বুদ্ধি অর্জন করুক, ইহা আমি খুবই চাই, কিন্তু পবিত্রতা বিসর্জন দিয়া যদি তাহা করিতে হয়, তবে নয়। তোমরা যাহা জান, তাহার জন্য তোমাদের আমি প্রশংসা করি, কিন্তু তোমরা যেভাবে মন্দকে ফুল দিয়া ঢাকিয়া ভাল বল, তাহা আমি পছন্দ করি না। বুদ্ধিচার্তুযই শ্রেষ্ঠ বস্তু নয়। নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিকতা লাভের জন্যই আমাদের সাধনা। আমাদের দেশের মেয়েরা তেমন শিক্ষিতা নয় বটে, কিন্তু তাহারা অনেক বেশী পবিত্র। নারীর কাছে নিজ স্বামী ছাড়া অন্য সব পুরুষই সন্তান, প্রত্যেক পুরুষের নিকট নিজ স্ত্রী ব্যতীত অপর সকল নারীই মাতৃসদৃশ মনে হওয়া উচিত। আমি যখন আশে-পাশে তাকাই, তখন তোমরা যাহাকে নারীজাতির প্রতি পুরুষসুলভ সৌজন্য (gallantry) বল, তাহা দেখিয়া আমার মন বিরক্তিতে ভরিয়া উঠে। স্ত্রী-পুরুষ ভেদ মন হইতে মুছিয়া ফেলিয়া যততিন না তোমরা মানবিকতার সাধারণ ভিত্তি-ভূমিতে পরস্পর মেলামেশা করিতে পারিতেছ, ততদিন তোমাদের নারী-সমাজের যথার্থ উন্নতি হইবে না। তাহারা ততদিন তোমাদের ক্রীড়া-পুত্তলিকা মাত্র হইয়া থাকিবে, তার বেশী নয়। এইগুলি হইল বিবাহ-বিচ্ছেদের কারণ। তোমাদের পুরুষেরা নত হইয়া মেয়েদের অভিবাদন করে এবং বসিতে চেয়ার আগাইয়া দেয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শুরু করে প্রশংসাবাদ। তাহারা বলিতে থাকে, ‘মহোদয়া, আপনার চোখ-দুটি কি সুন্দর!’ এইরূপ করিবার তাহাদের কি অধিকার আছে? পুরুষ কি করিয়া এতদূর সাহসী হইতে পারে এবং তোমরা মেয়েরাই বা কি করিয়া এসব অনুমোদন কর? এই ভাব-অবলম্বনে মানব-জীবনের অপেক্ষাকৃত নিম্ন দিকটাই প্রকাশিত হয়। এগুলির দ্বারা মহৎ আদর্শের দিকে যাওয়া যায় না। আমরা যেন না ভাবি যে, আমরা পুরুষ বা স্ত্রী, বরং আমরা যেন ভাবি আমরা মানুষমাত্র। জীবনকে সার্থক করার জন্য এবং পরস্পরকে সাহায্য করার জন্যই আমাদের জন্ম। কোন যুবক ও যুবতীকে একসঙ্গে ছাড়িয়া দাও, দেখিবে অমনি যুবকটি যুবতীর স্তুতিবাদ আরম্ভ করিয়া দিয়াছে, এবং একজন কাহাকেও বিবাহ করার আগে হয়তো দেখা যাইবে, সে দুই-শ জনের নিকট প্রণয় নিবেদন করিয়াছে। কি জ্বালা! আমি যদি বিবাহকারীদের দলে ভিড়িতাম, তবে অত না করিয়া একজন প্রেয়সী যোগাড় করিতে পারিতাম।

ভারতে থাকা-কালে যখন আমি দূর হইতে এই-সব লক্ষ্য করিতাম, তখন শুনিয়াছিলাম, এ-সব দোষের নয়; এগুলি একটু আমোদ-প্রমোদ মাত্র, আর আমি তাহা বিশ্বাসও করিয়াছিলাম, কিন্তু তারপর আমি অনেক ভ্রমণ করিয়াছি এবং বুঝিয়াছি, ইহা ঠিক নয়, এগুলি দূষণীয়; কেবল পাশ্চাত্যবাসী তোমরা চোখ বুজিয়া থাক আর বল এ সব ভাল। পাশ্চাত্য জাতিগুলির ত্রুটি এইখানে যে, তাহারা নূতন জাতি, নির্বোধ, অব্যবস্থিত-চিত্ত এবং ঐশ্বর্যশালী। এইগুলির যে-কোন একটিই কত না ক্ষতিকর হইতে পারে; আবার যখন এগুলির তিনটি বা চারিটি একত্র হয়, তখন সাবধান হওয়া উচিত।

স্বামীজী স্বভাবতঃ সকলেরই কঠোর আলোচনা করিলেও বষ্টনবাসীদের প্রতি কঠোরতম ভাষা ব্যবহার করিয়াছিলেনঃ বষ্টনই সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট। ওখানকার মেয়েরা হুজুকপ্রিয়, অব্যবস্থিত-চিত্ত; সব সময় কিছু অভিনব এবং অদ্ভুত জিনিষের পিছু পিছু ছুটিতে ব্যস্ত।

৩৯। তিনি আমেরিকায় বলিলেনঃ যে-দেশ সভ্যতার জন্য এত গর্বিত, সে-দেশের নিকট যেরূপ আধ্যাত্মিকতা আশা করা যায়, তাহা কোথায়?

৪০। ‘ইহলোক’ এবং ‘পরলোক’ এই-সব শব্দ শুধু শিশুদের ভয় দেখাইবার জন্য। সব কিছুই ‘এখানে’। ইহলোকে—এই দেহেই ভগবানকে অবলম্বন করিয়া ভাগবত জীবন যাপন করিতে হইবে, সেজন্য সমস্ত স্বার্থবুদ্ধি ত্যাগ করা প্রযোজন, সমস্ত কুসংস্কার বর্জন করিতে হইবে। ভারতে এরূপ পুরুষ আছেন; এদেশে সে-রকম মানুষ কোথায়? তোমাদের (আমেরিকার) ধর্মপ্রচারকেরা স্বপ্নবিলাসীদের নিন্দা করেন। কিন্তু এদেশে আরও বেশী স্বপ্নবিলাসী থাকিলে এদেশের মঙ্গল হইত। স্বপ্নবিলাস এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর এই দাম্ভিকতার মধ্যে তফাত অনেক। সমস্ত পৃথিবী ঈশ্বরভাবে পরিপূর্ণ, পাপে নয়। এস, আমরা একে অপরকে সাহায্য করি, আমরা পরস্পরকে ভালবাসি।
৪১। অর্থ নারী ও যশ উপেক্ষা করিয়া আমি যেন আমার শ্রীগুরুর মত প্রকৃত সন্ন্যাসীর মৃত্যু বরণ করিতে পারি। এগুলির মধ্যে যশের আকাঙ্ক্ষাই হইল সর্বাধিক শত্রু।
৪২। আমি কখনও প্রতিহিংসার কথা বলি না। আমি সব সময়ে শক্তির কথাই বলিয়াছি। সমুদ্রের এই একটু জলকণিকার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিহিংসাবৃত্তি জাগে কি? তবে হাঁ, একটা মশকের নিকট উহা খুবই মারাত্মক বটে।

৪৩। একবার আমেরিকায় স্বামীজী বলিলেনঃ এটি একটি মহান্ দেশ, কিন্তু আমি এখানে বাস করিতে চাই না। আমেরিকানরা বড় বেশী অর্থের কথা ভাবে। অন্য কোন বস্তু অপেক্ষা তাহারা অর্থের উপর বেশী গুরুত্ব দেয়। তোমাদের দেশের লোকেদের অনেক কিছু শিখিবার আছে। তোমাদের জাতি যখন আমাদের মত প্রাচীন হইবে, তখন তোমাদের জ্ঞান আরও পাকা হইবে।

৪৪। এমনও হইতে পারে যে, আমি হয়তো বুঝিব—এই দেহের বাহিরে চলিয়া যাওয়া, এই দেহকে জীর্ণ পোষাকের মত ফেলিয়া দেওয়াই আমার পক্ষে হিতকর। কিন্তু আমি কোনদিন কর্ম হইতে ক্ষান্ত হইব না। যতদিন না সমগ্র জগৎ ঈশ্বরের সঙ্গে একত্ব অনুভব করিতেছে, ততদিন আমি সর্বত্র মানুষের মনে প্রেরণা জাগাইতে থাকিব।

৪৫। আমি নিজে যাহা কিছু হইয়াছি, ভবিষ্যতে পৃথিবী যাহা হইবে, তাহার সব কিছুরই মূলে আছেন—আমার গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ। জগতে অবতীর্ণ হইয়া তিনি হিন্দু ইসলাম ও খ্রীষ্ট ধর্মের মধ্যে সেই সর্বানুস্যূত অতি আশ্চর্য এক একত্ব উপলব্ধি করিয়াছিলেন এবং উহা প্রচার করিয়াছিলেন।

৪৬। জিহ্বাকে যথেচ্ছ চলিতে দিলে অপর ইন্দ্রিয়গুলিও যথেচ্ছ চলিবে।

৪৭। জ্ঞান, ভক্তি, যোগ এবং কর্ম—মুক্তির এই চারিটি পথ। নিজ নিজ অধিকার অনুযায়ী প্রত্যেকে নিজের উপযুক্ত পথ অনুসরণ করিবে; তবে এই যুগে কর্মযোগের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা উচিত।

৪৮। ধর্ম কল্পনার জিনিষ নয়, অপরোক্ষ অনুভূতির বিষয়। যিনি কোন একটি ভাবকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তিনি বহুশাস্ত্রবিদ্ পণ্ডিত অপেক্ষা বড়।

৪৯। স্বামীজী একবার একজনের খুব প্রশংসা করিতেছিলেন, ইহাতে পার্শ্বস্থ একজন বলিয়া উঠিলেন, ‘তিনি কিন্তু আপনাকে মানেন না।’ এই কথা শুনিয়া স্বামীজী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, তিনি কি এমন কোন আইনে আবদ্ধ যে, আমাকে মানিতে হইবে। তিনি সৎ কাজ করিতেছেন, তাই তিনি প্রশংসার যোগ্য।’

৫০। প্রকৃত ধর্মের রাজ্যে পুঁথিগত বিদ্যার প্রবেশাধিকার নাই।

৫১। কোন ধর্ম-সম্প্রদায়ের ভিতর যেদিন হইতে ধনীদের তোষণ করা আরম্ভ হয়, সেই দিন হইতে ঐ সম্প্রদায়ের ধ্বংসও আরম্ভ হয়।

৫২। তোমার যদি কোন অন্যায় করিবার ইচ্ছা হয়, তবে তাহা তোমার গুরুজনদের চোখের সামনে কর।

৫৩। গুরুর কৃপায় কোন বই না পড়িয়াও শিষ্য পণ্ডিত হইতে পারে।

৫৪। পাপ বা পুণ্যের কোন অস্তিত্ব নাই, আসলে আছে অজ্ঞান। অদ্বৈত অনুভূতির দ্বারা এই অজ্ঞান দূরীভূত হয়।

৫৫। একাধিক ধর্মান্দোলন একসাথেই আসে; তাহাদের প্রত্যেকটি অপরগুলিকে অতিক্রম করিয়া ঊর্ধ্বে উঠিতে যায়, কিন্তু সাধারণতঃ তাহাদের একটিই প্রকৃতপক্ষে শক্তিশালী হইয়া উঠে এবং সমসাময়িক অপর আন্দোলনগুলিকে আত্মসাৎ করিয়া ফেলে।

৫৬। রামনাদে থাকাকালে কথোপকথন প্রসঙ্গে স্বামীজী বলিলেনঃ রাম পরমাত্মা, সীতা দেবী জীবাত্মা এবং প্রত্যেক নারী বা পুরুষের দেহই লঙ্কা। এই দেহরূপ লঙ্কায় বন্দী জীবাত্মা সব সময়েই পরমাত্মা বা শ্রীরামের সহিত মিলন কামনা করে, কিন্তু রাক্ষসেরা তাহা হইতে দেয় না। রাক্ষস মানে চারিত্রিক কতকগুলি বৈশিষ্ট্য। উদাহরণস্বরূপ বিভীষণ সত্ত্বগুণ, রাবণ রজোগুণ এবং কুম্ভকর্ণ তমোগুণের প্রতীক। সত্ত্বগুণের অর্থ সাধুতা; রজোগুণের অর্থ কাম ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতা; তমোগুণের অর্থ অজ্ঞান, জড়তা, লোভ, হিংসা ও অন্যান্য সহগামী দোষসমূহ—এই গুণগুলি দেহে আবদ্ধ জীবাত্মাকে বা লঙ্কার বন্দিনী সীতাকে পরমাত্মা বা শ্রীরামের সহিত মিলিত হইতে দেয় না। এইরূপে বন্দিনী সীতা যখন তাঁহার প্রভুর সঙ্গে মিলিবার জন্য ব্যাকুল, তখন তিনি হনুমান অর্থাৎ গুরু বা পরমার্থ-বস্তুর উপদেষ্টার সাক্ষাৎ পান। তিনি শ্রীরামচন্দ্রের অঙ্গুরীয়ক দেখান। এই অঙ্গুরীয়ক হইল ব্রহ্মজ্ঞান বা সর্বোত্তম অনুভূতি, যাহা সকল ভ্রান্তি নিরসন করে। এইরূপ সীতা শ্রীরামের সান্নিধ্যলাভের উপায় দেখিতে পান অর্থাৎ অন্য কথায় বলিতে গেলে পরমাত্মার সহিত জীবাত্মার একত্বানুভূতি হয়।

৫৭। যে প্রকৃত খ্রীষ্টান, সে প্রকৃত হিন্দুও বটে, আবার যে প্রকৃত হিন্দু, সে প্রকৃত খ্রীষ্টানও বটে।

৫৮। সমাজের ভিতরে যে আধ্যাত্মিক শক্তি ক্রিয়া করিতেছে, তাহার বিকাশের ফলেই সামাজিক শুভ পরিবর্তনগুলি সঙ্ঘটিত হইতেছে। এই শক্তিগুলি সুদৃঢ় এবং সুসংবদ্ধ হইলে সমাজও নিজেকে তদনুরূপ গড়িয়া তুলিবে। প্রত্যেককেই যেমন নিজের মুক্তির জন্য চেষ্টা করিতে হয় এবং তাছাড়া উপায় নাই, প্রত্যেক জাতি সম্বন্ধেও একই কথা। প্রত্যেক জাতির মধ্যে আবার যে-সব নিজস্ব ভাল বিধিব্যবস্থাদি আছে, ঐগুলিরই উপর ঐ-সব জাতির অস্তিত্ব নির্ভর করে এবং ঐগুলিকে অন্য জাতির ছাঁচে ঢালিয়া নূতন করিয়া গড়া চলে না। যতদিন না কোন উন্নততর বিধিব্যবস্থা উদ্ভাবিত হয়, ততদিন পুরাতনগুলিকে ভাঙিয়া ফেলার চেষ্টা করা মারাত্মক। উন্নতি সব সময় ক্রমশঃ ধীর গতিতে হইয়া থাকে। সব সামাজিক রীতিনীতি অল্পবিস্তর অসম্পূর্ণ বলিয়া ঐগুলির ত্রুটি দেখাইয়া দেওয়া খুবই সোজা। কিন্তু তিনিই মনুষ্য-জাতির যথার্থ কল্যাণকামী, যিনি মানুষ যে-কোন সমাজব্যবস্থার মধ্যেই জীবন যাপন করুক না কেন, তাহার অপূর্ণতা দূর করিয়া দিয়া তাহাকে উন্নতির পথে অগ্রসর করাইয়া দেন, ব্যক্তির উন্নতি হইলেই সমাজ ও জাতির উন্নতি হইবে।
ধার্মিক ব্যক্তিগণ সমাজের দোষ ত্রুটি ধরিতে যান না, কিন্তু তাঁহাদের প্রেম সহানুভূতি ও সততা তাঁহাদিগকে সমাজকল্যাণে নিয়োজিত করে। উহাই তাঁহাদের নিকট অলিখিত শাস্ত্র। যে-সকল জাতি বা সমাজ ক্ষুদ্র লিখিত শাস্ত্রীয় গণ্ডীর উপরে উঠিতে পারেন, তাঁহারাই যথার্থ সুখী। সৎলোকেরা এই শাস্ত্রীয় গণ্ডীর উপরে উঠেন ও তাঁহাদের প্রতিবেশিগণ যে-কোন অবস্থাতেই থাকুক না কেন তাহাদিগকে এইরূপ উঠিতে সাহায্য করেন। ভারতের মুক্তিও সেইজন্য ব্যক্তির শক্তি-বিকাশ ও তাহার অন্তর্নিহিত ব্রহ্ম-উপলব্ধির উপরই নির্ভর করে।

৫৯। জড়বাদ না গেলে আধ্যাত্মিক কখনও আসিতে পারে না।

৬০। গীতার প্রথম অধ্যায়টি রূপক হিসাবে গ্রহণ করা যাইতে পারে।

৬১। যথাসময়ে ষ্টীমার ধরিতে পারিবেন না ভাবিয়া উদ্বিগ্ন একজন মার্কিন ভক্ত মন্তব্য করিলেন, ‘স্বামীজী, আপনার কোন সময়-জ্ঞান নাই।’ স্বামীজী শান্তভাবে উত্তর দিলেন, ‘ঠিক কথা; তুমি আছ সময়ের ভিতর, আমি আছি অনন্তে।’ ৬২।আমরা সর্বদাই ভাবপ্রবণতাকে আমাদের কর্তব্যবুদ্ধির স্থান অধিকার করিতে দিই, অথচ আমরা এই মনে করিয়া আত্মতুষ্টি লাভ করি যে, আমরা প্রকৃত ভালবাসার প্রেরণাতেই কাজ করিতেছি।

৬৩। ত্যাগের শক্তি লাভ করিতে হইলে আমাদিগকে অবশ্যই ভাবপ্রবণতার বাহিরে যাইতে হইবে। ভাবপ্রবণতা পশুদের বৃত্তি। তাহারা পুরোপুরি ভাবাবেগেই চলে।

৬৪। নিজ নিজ সন্তান-সন্ততির জন্য ত্যাগকে উচ্চতর ত্যাগ বলা যায় না। পশুরাও ঐরকম করিয়া থাকে এবং যে-কোন মানব-মাতাই যতখানি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ত্যাগ করেন, তাহারাও ঠিক ততখানি করে। ঐরূপ করাটাই ভালবাসার প্রকৃত পরিচয় নয়; উহা তো শুধু অন্ধ ভাবপ্রবণতা।

৬৫। আমরা চিরকাল ধরিয়া চেষ্টা করিতেছি, আমাদের দুর্বলতাকে শক্তিরূপে দেখাইতে, ভাবপ্রবণতাকে ভালবাসা বলিয়া চালাইতে, কাপুরুষতাকে সাহসের রূপ দিতে, এবং এইরূপ আরও কত কি।

৬৬। দাম্ভিকতা, দুর্বলতা প্রভৃতি বিষয়ে তোমার অন্তরাত্মাকে বলঃ এগুলি তোমার সাজে না, এগুলি তোমার সাজে না।

৬৭। কোন স্বামী কখনও তাহার স্ত্রীকে ‘স্ত্রী’ বলিয়া ভালবাসে নাই বা স্ত্রীও তাহার স্বামীকে ‘স্বামী’ বলিয়াই ভালবাসে নাই। স্ত্রীর মধ্যে যে ঈশ্বর আছেন, তাঁহাকেই স্বামী ভালবাসে, এবং স্বামীর মধ্যে যে ঈশ্বর আছেন, তাঁহাকেই স্ত্রী ভালবাসে। প্রত্যেকের মধ্যে যে ঈশ্বর আছেন, তিনিই আমাদের হৃদয়ে ভালবাসার প্রেরণা জাগান। ঈশ্বর একমাত্র প্রেমস্বরূপ।

৬৮। আহা! যদি তোমরা তোমাদের নিজেদের জানিতে পারিতে তোমরা আত্মা, তোমরাই ঈশ্বর! যদি কখনও আমি তোমাদিগকে মানুষ বলিয়া ভাবি, তাহা হইলে আমি ঈশ্বরের নিন্দা করিতেছি, জানিও।

৬৯। প্রত্যেকের মধ্যেই সেই ঈশ্বর, পরমাত্মা আছেন। অন্য সব কিছুই স্বপ্ন, শুধু মায়া।

৭০। আধ্যাত্মিক জীবনের যদি আনন্দ না পাই, তবে কি ইন্দ্রিয়পরায়ণতার মধ্যে তৃপ্তির সন্ধান করিতে হইবে? অমৃত না পাইয়া কি নর্দমার জল পান করিতে হইবে? চাতক কেবল বৃষ্টির জল পান করে; উড়িতে উড়িতে সে শুধু ভাবে—ফটিক জল, ফটিক জল। কোন ঝড়-ঝঞ্ঝাও তাহার পাখার গতি থামাইতে পারে না বা জল পানের জন্য তাহাকে ধরাপৃষ্ঠে নামাইতে পারে না।

৭১। ঈশ্বর-উপলব্ধি সহায়ক যে-কোন সম্প্রদায়কেই স্বাগত জানাও। ঈশ্বরানুভূতিই ধর্ম।

৭২। নাস্তিক দয়াবান হইতে পারে, কিন্তু ধার্মিক হইতে পারে না। পরন্তু ধার্মিককে দয়াশীল হইতেই হইবে।

৭৩। গুরুর আসন গ্রহণ করিবার জন্যই জন্মিয়াছেন, এমন সব মহাত্মা ছাড়া আর সকলেই গুরুগিরি করিতে গিয়া ভরাডুবি করেন।

৭৪। পশুত্ব, মনুষ্যত্ব এবং ঈশ্বরত্ব—এই তিনের সমষ্টিতেই মানুষ।

৭৫। গরম বরফ, অন্ধকার, আলো বলিতে যাহা বুঝায়, ‘সামাজিক উন্নতি’ বলিতে অনেকটা তাহাই বুঝায়। শেষ পর্যন্ত ‘সামাজিক উন্নতি’ বলিতে কিছুই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।

৭৬। বাহিরের কিছুর উন্নতি হয় না, জগতের উন্নতি করিতে গিয়া আমরাই উন্নত হই।

৭৭। আমি যেন মানুষের সেবা করিতে পারি—ইহাই আমার একমাত্র কাম্য।

৭৮। নিউ ইয়র্কে একটি প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজী অতি মৃদুভাবে বলিলেনঃ না, আমি কোন অলৌকিক বিদ্যায় (Occultism) বিশ্বাস করি না। কোন জিনিষ যদি মিথ্যা হয়, তবে তাহা নাই; যাহা মিথ্যা, তাহার অস্তিত্ব থাকিতে পারে না। অদ্ভুত অলৌকিক ঘটনাগুলিও প্রাকৃতিক ব্যাপারেরই অন্তর্গত। আমি এগুলিকে বিজ্ঞানের বিষয় বলিয়াই মনে করি। সে-হিসাবে এগুলি আমার নিকট গুপ্তবিদ্যার বিষয় নয়। আমি কোন গুপ্তবিদ্যা-সঙ্ঘে আস্থা রাখি না। তাহারা ভাল কিছুই করে না, করিতে পারে না।

৭৯। যুক্তিবাদী, ভাবপ্রবণ, রহস্যবাদী এবং কর্মী—সাধারণতঃ এই চারি স্তরের লোক দেখা যায়। ইহাদের প্রত্যেক স্তরের জন্যই উপযুক্ত সাধন-পদ্ধতি থাকা প্রয়োজন। যুক্তিবাদী আসিয়া বলিলেন—আমি এ রকম সাধন-পদ্ধতি মানি না, আমাকে বিশ্লেষণমূলক যুক্তিসিদ্ধ কিছু বলুন; যাহাতে আমার মন সায় দিতে পারে। সুতরাং বিচারবাদীর জন্য দার্শনিক বিচারই হইল সাধন-মার্গ। তারপর কর্মী আসিয়া বলেন, আমি দার্শনিকের সাধন-পদ্ধতি মানি না। আমাকে মানুষের জন্য কিছু করিতে দিন। অতএব তাঁহার সাধনার জন্য কর্মই পথ-হিসাবে নির্দিষ্ট হইয়াছে। রহস্যবাদী (mystic) এবং ভাবপ্রবণ ব্যক্তিদের জন্যও তাঁহাদের উপযুক্ত উপাসনা-মার্গ নির্ধারিত হইয়াছে। এই-সব লোকেরই জন্য ধর্মের মধ্যে তাঁহাদের নিজ নিজ অবস্থানুযায়ী ব্যবস্থা রহিয়াছে।

৮০। আমি সত্যানুসন্ধিৎসু। সত্য কখনও মিথ্যার সহিত বন্ধুত্ব করিতে পারে না। এমন কি সমস্ত পৃথিবী আমার বিরুদ্ধে দাঁড়াইলেও অবশেষে সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।

৮১। যেখানেই দেখিবে মানবহিতৈষণার উদারভাবগুলি সাধারণ জনতার হাতে পড়িয়াছে, সেখানেই সর্বপ্রথমে তুমি লক্ষ্য করিবে, ঐগুলির অধোগতি ঘটিয়াছে। শিক্ষা এবং বুদ্ধি থাকিলেই কোন কিছুর সংরক্ষণের সম্ভাবনা থাকে। সমাজের কৃষ্টিসম্পন্ন সম্প্রদায়ই প্রকৃতপক্ষে ধর্ম ও দর্শনের বিশুদ্ধতম রূপটি রক্ষা করিতে পারে। আর উহা হইতেই ঐ জাতির সামাজিক এবং মানসিক গতি-প্রকৃতির নিদর্শন পাওয়া যায়।

৮২। স্বামীজী একবার আমেরিকায় বলিলেনঃ আমি নূতন ধর্মমতে তোমাদের দীক্ষিত করিবার জন্য এখানে আসি নাই। আমি চাই তোমাদের স্ব স্ব ধর্মবিশ্বাস অটুট থাকুক। আমি একজন মেথডিষ্টকে ভাল মেথডিষ্ট, প্রেসবিটেরিয়ানকে ভাল প্রেসবিটেরিয়ান, ইউনিটেরিয়ানকে ভাল ইউনিটেরিয়ান করিতে চাই। আমি তোমাদিগকে শিখাইতে চাই—কি করিয়া সত্যকে জীবনে রূপায়িত করিতে হয়, কি করিয়া তোমাদের অন্তর্নিহিত জ্যোতিকে বাহিরে প্রকাশ করিতে হয়।

৮৩। দুঃখের রাজমুকুট মাথায় পরিয়া সুখ মানুষের সামনে হাজির হয়। যে তাহাকে স্বাগত জানায়, সে দুঃখকেও স্বাগত জানাইতে বাধ্য।

৮৪। যিনি সংসারের প্রতি বিমুখ হইয়াছেন, যিনি সর্বস্ব ত্যাগ করিয়াছেন, যিনি ইন্দ্রিয় জয় করিয়াছেন এবং যিনি শান্তিকামী, এই পৃথিবীতে তিনিই মুক্ত—তিনিই মহৎ। রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা পাইয়াও কেহ যদি ইন্দ্রিয়পরতন্ত্র এবং বাসনার দাস হয়, তবে সে প্রকৃত মুক্তির বিশুদ্ধ আস্বাদ পাইতে পারে না।

৮৫। পরোপকারই ধর্ম, পরপীড়নই পাপ। শক্তি ও সাহসিকতাই ধর্ম। দুর্বলতা ও কাপুরুষতাই পাপ। স্বাধীনতাই ধর্ম, পরাধীনতাই পাপ। অপরকে ভালবাসাই ধর্ম, অপরকে ঘৃণা করাই পাপ। ঈশ্বর এবং নিজ আত্মাতে বিশ্বাসই ধর্ম, সন্দেহই পাপ। অভেদ-দর্শনই ধর্ম, ভেদ-দর্শনই পাপ। বিভিন্ন শাস্ত্র শুধু ধর্মলাভের উপায় নির্দেশ করে।

৮৬। বিচারের সহায়ে সত্য যখন বুদ্ধিগ্রাহ্য হয়, তখন উহা অনুভূতির উৎস হৃদয়েই অনুভূত হয়। এইরূপে হৃদয় ও মস্তিস্ক দুই-ই একক্ষণে আলোকিত হইয়া উঠে এবং তখনই উপনিষদের কথায় বলিতে গেলে—‘ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিঃ ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ’—হৃদয়গ্রন্থি খুলিয়া যায়, সমস্ত সংশয় ছিন্ন হয়।
প্রাচীনকালে এই জ্ঞান ও এই ভাব যখন যুগপৎ ঋষির অন্তঃকরণে বিকশিত হইয়াছিল, তখন শ্রেষ্ঠ সত্যগুলি কবিতার ভাষায় রূপায়িত হয় এবং তখনই বেদ এবং অন্যান্য শাস্ত্র রচিত হয়। এই কারণে এগুলি অধ্যয়ন করিলে দেখা যায় যে, জ্ঞান ও ভাবের দুইটি সমান্তরাল রেখা অবশেষে বেদের স্তরে আসিয়া মিলিত হইয়াছে এবং ওতপ্রোতভাবে মিশিয়া গিয়াছে।

৮৭। বিশ্বপ্রেম, স্বাধীনতা, সাহসিকতা এবং নিঃস্বার্থ পরোপকার প্রভৃতি আদর্শগুলি আয়ত্ত করিবার জন্য বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র বিভিন্ন পথের সন্ধান দিয়াছে। কোন‍্‍টা পাপ, কোন‍্‍টা পুণ্য—এই-বিষয়ে প্রত্যেক ধর্মসম্প্রদায় প্রায়ই অপর সম্প্রদায়ের সঙ্গে দ্বিমত এবং সিদ্ধির দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া এই পাপ ও পুণ্যের পথের বিষয়ে ঝগড়ায় মত্ত। প্রত্যেক পথই অল্পবিস্তর উন্নতির পথে সাহায্য করে। গীতা বলেন, ‘সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধূমেনাগ্নিরিবাবৃতা।’ আগুন যেমন ধূমে আবৃত থাকে, সমস্ত কর্মের সঙ্গেই তেমনি দোষ মিশ্রিত থাকে। অতএব পথগুলি অল্পবিস্তর অসম্পূর্ণ থাকিবেই, ইহা নিঃসন্দেহ। কিন্তু নিজ নিজ শাস্ত্রনির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করিয়া উচ্চতম ধর্মভাব লাভ করাই যখন আমাদের লক্ষ্য, তখন ঐগুলিকে অনুসরণ করার জন্যই আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিত। তাছাড়া ঐগুলিকে যুক্তি ও বিচার-সহায়ে গ্রহণ করিতে হইবে। অতএব আমরা যতই সিদ্ধির পথে অগ্রসর হইতে থাকিব, ততই পাপপুণ্য-সমস্যার সমাধান আপনা-আপনিই হইয়া যাইবে।

৮৮। আজকাল আমাদের দেশে এমন অনেক আছেন, যাঁহারা শাস্ত্রের অর্থ ঠিক ঠিক বুঝিতে পারেন না। তাঁহারা শুধু ব্রহ্ম, মায়া, প্রকৃতি প্রভৃতি শব্দ শিখিয়া ঐগুলির দ্বারা মাথার মধ্যে গোলমাল বাধাইয়া তুলিয়াছেন। শাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম এবং উদ্দেশ্যকে ছাড়িয়া তাঁহারা কেবল শব্দ লইয়া মারামারি করেন। শাস্ত্র যদি সমস্ত লোককে সকল অবস্থায় সকল সময়ে সাহায্য করিতে না পারে, তবে সে শাস্ত্রের কি প্রয়োজন? শাস্ত্র যদি কেবল সন্ন্যাসীর জীবনের পথপ্রদর্শক হয়, যদি গার্হস্থ্য জীবনের কোন কাজে না আসে, তবে এই একদেশদর্শী শাস্ত্রে গৃহস্থের কি প্রয়োজন? যাঁহারা সমস্ত কর্ম ত্যাগ করিয়া জঙ্গলে আশ্রয় লইয়াছেন, শাস্ত্র যদি কেবল তাঁহাদের জন্যই হয়, শাস্ত্র যদি কর্ম-চঞ্চল পৃথিবীতে দৈনিক শ্রম, রোগ, শোক, দারিদ্র্যের মধ্যে, অনুশোচনাময় হতাশ হৃদয়ে, নিপীড়িতের আত্মগ্লানিতে, যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতার মধ্যে, লোভে, ক্রোধে, সুখে, বিজয়ের আনন্দে, পরাজয়ের অন্ধকারে এবং অবশেষে মৃত্যুর ভয়াবহ মুহূর্তে মানুষকে আশার আলো জ্বালাইবার উপায় দেখাইতে না পারে, তবে দুর্বল মানুষের কাছে এই শাস্ত্রের কোন প্রয়োজন নাই। তাহা হইলে শাস্ত্রের শাস্ত্রত্বই নষ্ট হইয়া যাইবে।

৮৯। ভোগের মধ্য দিয়াই কালে যোগ আসিবে। কিন্তু হায়, আমাদের দেশবাসীর ভাগ্য এমনি যে, যোগ আয়ত্ত করার কথা দূরে থাকুক, তাহারা সামান্য ভোগও পায় না। সর্বপ্রকার অপমান সহ্য করিয়া অতি কষ্টে তাহারা জীবনের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন মাত্র মিটাইতে সমর্থ হয়; তাহাও আবার সকলে পারে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এমন দূরবস্থাও আমাদের নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাইয়া আমাদিগকে আশু কর্তব্যের প্রতি সচেতন করিতে পারে না।

৯০। তোমাদের অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধার জন্য তোমরা যতই আন্দোলন কর না কেন, স্মরণ রাখিও, যতদিন না তীব্র জাতীয় সম্মানবোধ জাগাইয়া আমরা সত্যসত্যই নিজেদের উন্নত করিতে পারিতেছি, ততদিন এই সুযোগ ও অধিকার লাভের আশা ‘আলনাস্কারের দিবাস্বপ্নে’র তুল্য।

৯১। যখন কোন বংশ কোন প্রতিভাবান্ বা বিশেষ বিভূতিমান্ ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন, তখন সেই বংশে যা কিছু শ্রেষ্ঠ এবং সমধিক সৃজনশীল প্রতিভা থাকে, তাহা যেন ঐ ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপুষ্টির জন্য নিঃশেষে তাঁহারই দিকে আকৃষ্ট হয়। এই কারণে আমরা দেখি, ঐ বংশে পরবর্তী কালে যাঁহারা জন্মগ্রহণ করেন, তাঁহারা হয় নির্বোধ অথবা অতি সাধারণ- বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্র এবং কালে ঐ বংশ বহুক্ষেত্রেই নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়।

৯২। এই জীবনে যদি মুক্তিলাভ না হয়, তবে পরবর্তী এক বা বহু জীবনে যে মুক্তিলাভ ঘটিবে, তাহার প্রমাণ কি?

৯৩। আগ্রার তাজমহল দেখিতে গিয়া তিনি মন্তব্য করিলেনঃ ইহার যে-কোন এক-টুকরা মার্বেলকে নিংড়াইলে ইহা হইতে বিন্দু বিন্দু রাজকীয় প্রেম ও দুঃখ ক্ষরিত হইবে। তিনি আরও বলিলেনঃ ইহার অন্তর্ভাগের এক বর্গ ইঞ্চি পরিমিত স্থানের সৌন্দর্য ঠিক ঠিক উপভোগ করিতেই ছয় মাস লাগিবে।

৯৪। ভারতের প্রকৃত ইতিহাস উদ‍্‍ঘাটিত হইলে প্রমাণিত হইবে যে, যেমন ধর্মের ক্ষেত্রে, তেমনি ললিতকলার ক্ষেত্রেও ভারত সমস্ত পৃথিবীর আদি গুরু।

৯৫। স্থাপত্য-সম্পর্কে আলোচনা-প্রসঙ্গে তিনি বলিলেনঃ লোকে বলে কলিকাতা প্রাসাদপুরী। কিন্তু বাড়ীগুলি দেখিলে মনে হয় যেন কতকগুলি বাক্সকে উপর উপর সাজাইয়া রাখা হইয়াছে। এগুলি কোন বিশেষ ভাবের দ্যোতক নয়। প্রকৃত হিন্দু স্থাপত্য রাজপুতানায় এখনও অনেক দেখা যায়। কোন ধর্মশালার দিকে তাকাইলে মনে হইবে, উহা যেন মুক্ত বাহু প্রসারিত করিয়া যাত্রীকে আহ্বান জানাইতেছে—তাহারা সেখানে আশ্রয় ও আতিথেয়তা লাভ করিতে পারে। উহার ভিতরে ও বাহিরে দেবতার সান্নিধ্য অনুভব করিবে। গ্রাম্য কুটীর দেখিলেও তৎক্ষণাৎ উহার বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবে এবং বুঝিতে পারিবে যে, সমস্ত কুটীরটিই মালিকের নিজস্ব আদর্শ এবং প্রকৃতির দ্যোতক। ইতালী ব্যতীত অন্য কোন দেশে আমি এই জাতীয় ভাবব্যঞ্জক স্থাপত্যশিল্প দেখি নাই।

Category: ০৪. উক্তি-সঞ্চয়ন
পরবর্তী:
উক্তি-সঞ্চয়ন—২ »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑