৫.০২ পূর্ব-পরিদৃষ্ট ভক্তগণের ঠাকুরের নিকটে আগমনারম্ভ

পঞ্চম খণ্ড – দ্বিতীয় অধ্যায়: পূর্ব-পরিদৃষ্ট ভক্তগণের ঠাকুরের নিকটে আগমনারম্ভ

ব্রাহ্মসমাজের নিকট হইতে ঠাকুরও কিছু শিখিয়াছিলেন

ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের প্রধান আচার্য কেশবচন্দ্র হইতে আরম্ভ করিয়া বিজয়কৃষ্ণ, প্রতাপচন্দ্র, শিবনাথ, চিরঞ্জীব, অমৃতলাল, গৌরগোবিন্দ প্রভৃতি নেতাসকল ঠাকুরের পুণ্যদর্শন ও সঙ্গলাভে স্বধর্মনিষ্ঠা ও ঈশ্বরার্থে সর্বস্বত্যাগরূপ আদর্শের মহত্ত্ব বিশেষভাবে হৃদয়ঙ্গম করিয়া কতদূর উপকৃত হইয়াছিলেন, তাহা আমরা পাঠককে ইতঃপূর্বে অনেকটা বলিয়াছি। এখন প্রশ্ন হইতেছে, কেশবপ্রমুখ ব্রাহ্মগণের সংসর্গে আসিয়া অপরোক্ষ-বিজ্ঞানসম্পন্ন, ভাবমুখে অবস্থিত ঠাকুর কি কিছু শিক্ষা করিয়াছিলেন? শ্রীরামকৃষ্ণভক্তবৃন্দের অনেকে ঐ কথায় ‘না’ শব্দ উচ্চারণ করিতে কিছুমাত্র ইতস্ততঃ করিবেন না। কিন্তু দেখিতে পাওয়া যায়, সংসারে সর্বত্র আদানপ্রদানের নিয়ম চির-বর্তমান। একান্ত অনভিজ্ঞ তরলমতি বালককে শিক্ষা প্রদান করিতে অগ্রসর হইয়া কোন্ ভাবে উপদেশ দিলে তাহার বুদ্ধিবৃত্তি উপদিষ্ট বিষয় শীঘ্র ধারণা করিতে পারিবে, তাহার পূর্বসংস্কারসমূহ ঐ বিষয় হৃদয়ঙ্গম করিবার পথে কতদূর সহায় বা অন্তরায় হইয়া দণ্ডায়মান, এবং তৎসমুদয়ের অপনোদনই বা কিরূপে হওয়া সম্ভব ইত্যাদি নানা বিষয় আমরা শিক্ষা করিয়া থাকি। অতএব পাশ্চাত্যভাব ও শিক্ষারূপ ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শে আসিয়া ঠাকুর যে কিছুই শিক্ষা করেন নাই, এ কথা বলা নিঃসংশয় যুক্তিসঙ্গত নহে। আমাদিগের ধারণা সেজন্য সম্পূর্ণ অন্যরূপ। আমরা বলি, ব্রাহ্মসমাজ ও সঙ্ঘকে নিজ অলৌকিক সাধনলব্ধ ভাব ও আধ্যাত্মিক প্রত্যক্ষসমূহ প্রদান করিতে যাইয়া ঠাকুর অনেক কথা স্বয়ং শিক্ষা করিয়াছিলেন। অতএব উহার ফলে তিনি কোন্ কোন্ বিষয় শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন, তদ্বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা এখানে কর্তব্য।

পাশ্চাত্য ভাবসহায়ে ভারতবাসীর জীবন কতদূর পরিবর্তিত হইতেছে তাহার পরিচয়প্রাপ্তি

আমরা ইতিপূর্বে দেখিয়াছি, কেশবপ্রমুখ ব্রাহ্মদিগের সংসর্গে আসিবার পূর্বে ঠাকুর পাশ্চাত্য ভাব ও শিক্ষার প্রভাব হইতে বহু দূরে নিজ জীবন যাপন করিতেছেন। পুণ্যবতী রানী রাসমণির জামাতা মথুরানাথের কথা ছাড়িয়া দিলে তাঁহার নিকটে এ পর্যন্ত যত লোক উপস্থিত হইয়াছিল, তাহাদিগের প্রত্যেককেই তিনি সকাম প্রবৃত্তিমার্গে অথবা ভারতের সনাতন ‘ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ’-রূপ আদর্শ অবলম্বনে জীবন পরিচালিত করিতে যথাসাধ্য সচেষ্ট দেখিয়াছিলেন। পাশ্চাত্য ভাবে শিক্ষিত মথুরানাথকে কিঞ্চিৎ বিভিন্নপ্রকৃতিসম্পন্ন দেখিতে পাইলেও উক্ত ভাবে শিক্ষিত প্রত্যেক ভারতবাসীর জীবনই যে ঐরূপ বিপরীত বর্ণে রঞ্জিত হইয়াছে, এ কথা ধারণা করিবার তাঁহার অবসর হয় নাই। কারণ, তাঁহার পুণ্য-সঙ্গলাভে মথুরানাথের প্রকৃতি স্বল্পকালেই পরিবর্তিত হওয়ায় ঐ বিষয়ে চিন্তা করিবার তাঁহার আবশ্যকতাই হয় নাই। অতএব ব্রাহ্মদিগের সংসর্গে আসিয়া, এবং ধর্মলাভে সচেষ্ট হইলেও, ভারতের প্রাচীন ত্যাগাদর্শ হইতে তাঁহাদিগকে বিচ্যুত দেখিয়াই তাঁহার মন উহার কারণ অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিল, এবং পাশ্চাত্যের শিক্ষা-দীক্ষা বর্তমান ভারতবাসীর জীবনে কিরূপ বিপরীত ভাবরাশি আনয়ন করিতেছে, তদ্বিষয়ে পরিচয় প্রথম প্রাপ্ত হইয়াছিল।

পাশ্চাত্য মনীষিগণের শিক্ষার সহিত না মিলাইয়া ইহারা ভারতের ঋষিদিগের প্রত্যক্ষসকল গ্রহণ করিবে না

ঠাকুর বোধ হয় প্রথমে ভাবিয়াছিলেন, তাঁহার জীবন্ত ও সাক্ষাৎ-উপলব্ধ ধর্মভাবসকলের পরিচয় পাইয়া কেশবপ্রমুখ ব্রাহ্মগণ স্বল্পকালেই ঐসকল সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করিবেন। কিন্তু দিনের পর যতই দিন যাইতে লাগিল এবং তাঁহার সহিত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে সম্বদ্ধ হইয়াও যখন তাঁহারা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব ছাড়াইয়া তাঁহার আধ্যাত্মিক প্রত্যক্ষসকলে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী হইতে পারিলেন না, তখন তাঁহার হৃদয়ঙ্গম হইল, উক্ত প্রভাব তাঁহাদিগের মনে কতদূর বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে। তখনই তিনি বুঝিতে পারিলেন, পাশ্চাত্যের চিন্তাশীল মনীষিগণ ইঁহাদের অন্তরে গুরুর স্থান চিরকালের নিমিত্ত অধিকার করিয়া বসিয়াছেন এবং তাঁহাদিগের ভাব ও কথার সহিত না মিলাইয়া ইঁহারা ভারতের আপ্তকাম ঋষিদিগের প্রত্যক্ষসকল কখনও গ্রহণ করিতে পারিবেন না। তজ্জন্যই ঠাকুর ইঁহাদিগকে উপদেশ দিবার পরেই বলিতেন, “আমি যাহা হয় বলিয়া যাইলাম, তোমরা উহার ল্যাজা-মুড়ো বাদ দিয়ে গ্রহণ কর।” ইঁহাদিগের ভাবের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান না হইয়া তিনি ইঁহাদিগকে ঐরূপে স্বাধীনতাপ্রদান করাতেই ইঁহারা তাঁহার ভাব ও প্রত্যক্ষসকল যথাসম্ভব গ্রহণ করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, এ কথা বলা বাহুল্য।

জগদম্বার ইচ্ছায় ঐরূপ হইয়াছে জানিয়া ঠাকুরের নিশ্চিন্ত ভাব

ভারতের ঋষিদিগের সমষ্টীভূত ভাবঘনমূর্তি ঠাকুর কিন্তু পূর্বোক্ত ঘটনায় কিছুমাত্র বিচলিত হয়েন নাই। কারণ, শ্রীশ্রীজগদম্বার ইচ্ছাকেই যিনি জগতের সর্ববিধ ঘটনার হেতু বলিয়া প্রাণে প্রাণে অনুভব করিয়াছেন এবং সকল বিষয়ে তাঁহার আদেশ গ্রহণপূর্বক যিনি আপনাকে সর্বাবস্থায় পরিচালিত করিতে অভ্যস্ত হইয়াছেন, সংসারের কোন ঘটনা তাঁহাকে কখনও বিচলিত করিতে সক্ষম হয় না। অঘটন-ঘটন-পটীয়সী ঐশী শক্তি মায়া নিজ স্বরূপ দেখাইয়া-বুঝাইয়া চিরকালের নিমিত্ত তাঁহাকে অচল অটল শান্তির অধিকারী করিয়াছেন। অতএব শ্রীশ্রীজগদম্বার ইচ্ছাতেই ভারতে পাশ্চাত্য ভাব প্রবেশ এবং তাঁহার ইচ্ছাতেই ব্রাহ্মপ্রমুখ শিক্ষিত সম্প্রদায়ের পাশ্চাত্যভাবের হস্তে ক্রীড়া-পুত্তলীস্বরূপ হওয়ার কথা সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিয়া ঠাকুর তাঁহাদিগের ঐরূপ দুর্বলতায় বিরক্তিপ্রকাশ অথবা তাঁহাদিগকে নিজ অপার স্নেহ-ভালবাসা হইতে বঞ্চিত করিবেন কিরূপে? সুতরাং ঋষিদিগের প্রত্যক্ষ-বিজ্ঞানের ইঁহারা যতটা পারেন লউন, কালে শ্রীশ্রীজগদম্বা এমন লোক আনয়ন করিবেন – যিনি উক্ত বিজ্ঞান সম্পূর্ণ গ্রহণ করিবেন, এ কথা ভাবিয়া তিনি নিশ্চিন্ত মনে অবস্থান করিয়াছিলেন।

ব্রহ্মবিজ্ঞানের সমগ্র গ্রহণে ব্রাহ্মগণ অশক্ত বুঝিয়া ঠাকুর কি করিয়াছিলেন

আবার, ব্রাহ্মগণ তাঁহার সকল কথা গ্রহণ করিতে পারিতেছেন না দেখিয়া তিনি তাঁহাদিগকে নিজ আধ্যাত্মিক প্রত্যক্ষসকলের অংশমাত্র বলিয়াই নিরস্ত হয়েন নাই। কিন্তু, ঈশ্বরার্থে সর্বস্ব ত্যাগ না করিলে তাঁহার পুণ্যদর্শন কখনই লাভ হইবে না – যত মত তত পথ – প্রত্যেক পথের চরমেই উপাস্যের সহিত উপাসকের অভেদত্বপ্রাপ্তি – মন মুখ এক করাই সাধন – এবং ঈশ্বরের প্রতি একান্ত বিশ্বাস ও নির্ভর করিয়া সদসৎ বিচারপূর্বক সর্বথা ফলকামনারহিত হইয়া সংসারে কর্তব্যকর্মসকলের অনুষ্ঠান করাই তাঁহার দিকে অগ্রসর হইবার পথ, ইত্যাদি আধ্যাত্মিক জগতের সকল গূঢ় তত্ত্বই তিনি তাঁহাদিগের নিকটে সর্বদা নিঃসঙ্কোচে প্রকাশ করিতেন। কায়মনোবাক্যে ব্রহ্মচর্যপালন না করিলে দেহের প্রতি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হওয়া এবং আধ্যাত্মিক রাজ্যের উচ্চ উপলব্ধিসকল প্রত্যক্ষ করা কখনও সম্ভবে না, এ কথা কেশবপ্রমুখ কাহাকেও কাহাকেও বুঝাইয়া তিনি তাঁহাদিগকে তৎকরণে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ঐরূপে সকল কথা বারংবার বলিবার বুঝাইবার পরেও অনেকের ঐসকল ধারণা হইতেছে না দেখিয়া তিনি বুঝিয়াছিলেন, সংস্কার বদ্ধমূল হইয়া যাইলে হৃদয়ে নূতন ভাব গ্রহণ করা একপ্রকার অসম্ভব – “কাঁটি উঠিবার পরে পাখিকে ‘রাধাকৃষ্ণ’ নাম শিখাইতে প্রয়াস করিলে প্রায়ই উহা ব্যর্থ হয়” এবং পাশ্চাত্যের ইহকালসর্বস্ব জড়বাদের প্রভাবেই হউক অথবা অন্য কোন কারণেই হউক, রূপরসাদিভোগের ভাব যাহাদিগের মনে একবার বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে, ভারতের সনাতন ত্যাগাদর্শ গ্রহণপূর্বক তাহারা কখনও উহা জীবনে সম্যক পরিণত করিতে পারিবে না। সেইজন্যই তাঁহার প্রাণে এখন ব্যাকুল প্রার্থনার উদয় হইয়াছিল, ‘মা, তোর ত্যাগী ভক্তদিগকে আনিয়া দে, যাহাদিগের সহিত প্রাণ খুলিয়া তোর কথা বলিয়া আনন্দ করিতে পারি!’ অতএব দৃঢ়সংস্কারবিহীন বালকদিগের মনই তাঁহার ভাব ও কথা সম্পূর্ণ গ্রহণপূর্বক উহাদিগের সত্যতা উপলব্ধি করিতে নিঃসঙ্কোচে অগ্রসর হইবে, এ কথা ঠাকুর এখন হইতে বিশেষভাবে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন বলিলে যুক্তিবিরুদ্ধ হইবে না।

ব্রাহ্মগণের দ্বারা কলিকাতাবাসীর মন ঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া; রাম ও মনোমোহনের আগমন ও আশ্রয়লাভ

সে যাহা হউক, কেশবপ্রমুখ ব্রাহ্মনেতৃগণ ঠাকুরের অভিনব আধ্যাত্মিক ভাব যতদূর গ্রহণ করিতে পারিয়াছিলেন এবং উহার ফলে তাঁহাদিগের ভিতর যে পরিবর্তন উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা লক্ষ্য করিতে কলিকাতার জনসাধারণের বিলম্ব হয় নাই। আবার, কেশবপ্রমুখ ব্যক্তিগণ যখন ব্রাহ্মমণ্ডলী-পরিচালিত সংবাদপত্র-সকলে ঠাকুরের আধ্যাত্মিক মতের অলৌকিকত্ব এবং তাঁহার অমৃতময়ী বাণীসকলের কিছু কিছু প্রকাশ করিতে লাগিলেন, তখন কলিকাতার জনসাধারণ তাঁহার প্রতি সমধিক আকৃষ্ট হইয়া তাঁহার পুণ্য-দর্শনলাভের জন্য দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইতে লাগিল। ঠাকুরের চিহ্নিত ভক্তসকল ঐরূপেই দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে ক্রমে ক্রমে উপস্থিত হইয়াছিলেন। আমরা শুনিয়াছি, শ্রীযুত কেশবের সহিত ঠাকুরের প্রথম সাক্ষাতের প্রায় চারি বৎসর পরে সন ১২৮৫ সালের, ইংরাজী ১৮৭৯ খ্রীষ্টাব্দের শেষ ভাগে শ্রীযুত রামচন্দ্র দত্ত ও শ্রীযুত মনোমোহন মিত্র নামক ঠাকুরের গৃহস্থ ভক্তদ্বয় কেশব-পরিচালিত সংবাদপত্রে তাঁহার কথা পাঠ করিয়া তাঁহার সমীপে আগমন করিয়াছিলেন। ঠাকুরের পুণ্যদর্শনলাভে ইঁহাদিগের জীবনে কিরূপ যুগান্তর ধীরে ধীরে উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা শ্রীযুত রামচন্দ্র তৎকৃত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবনবৃত্তান্ত’-শীর্ষক পুস্তকে স্বয়ং প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন। অতএব তাহার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। এখানে সংক্ষেপে এ কথা বলিলেই চলিবে যে, ঈশ্বরার্থে কাম-কাঞ্চন-ত্যাগরূপ ঠাকুরের জীবনাদর্শ সম্যক গ্রহণ করিতে না পারিলেও ইঁহারা তাঁহার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধাপ্রভাবে ত্যাগের পথে অনেক দূর অগ্রসর হইয়া কৃতার্থ হইয়াছিলেন। সৎকর্মের অনুষ্ঠানে দুঃখোপার্জিত অর্থের অকাতর ব্যয় দেখিয়াই গৃহী ব্যক্তির ভক্তি-বিশ্বাসের তারতম্য অনেকাংশে নিরূপণ করিতে পারা যায়। প্রথমে গুরু এবং পরে ইষ্টস্থানে ঠাকুরকে বসাইয়া শ্রীযুত রামচন্দ্র তাঁহাকে ও তদ্ভক্তসকলকে কলিকাতার সিমলা নামক পল্লীস্থ নিজ ভবনে পুনঃপুনঃ আনয়নপূর্বক উৎসবাদিতে যেরূপ অকাতরে ব্যয় করিতেন, তাহা হইতে বুঝা যাইত, তাঁহার বিশ্বাস-ভক্তি ক্রমে কত গভীর ভাব প্রাপ্ত হইয়াছিল। ঠাকুর তাঁহার সম্বন্ধে কখনও কখনও বলিতেন, “রামকে এখন এত মুক্তহস্ত দেখিতেছ, যখন প্রথম আসিয়াছিল তখন এমন কৃপণ ছিল যে, বলিবার নহে; এলাচ আনিতে বলিয়াছিলাম, তাহাতে একদিন এক পয়সার শুকনো এলাচ আনিয়া সম্মুখে রাখিয়া প্রণাম করিয়াছিল! রামের স্বভাবের কতদূর পরিবর্তন হইয়াছে, তাহা ইহা হইতে বুঝ।”

ঠাকুরের অদ্ভুত দর্শন ও রাখালচন্দ্রের আগমন

ঠাকুর যখন আপনার জ্ঞানে রাম ও মনোমোহনকে নিজ অভয় আশ্রয়ে চিরকালের নিমিত্ত গ্রহণ করিয়াছিলেন, তখন তাঁহার অহৈতুকী করুণার অধিকারী হইয়া তাঁহারা আপনাদিগকে কতদূর কৃতার্থম্মন্য জ্ঞান করিয়াছিলেন, তাহা বলিবার নহে। সংসারে ঐরূপ আশ্রয় যে কখনও পাওয়া সম্ভব, এ কথা তাঁহাদিগের স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। সুতরাং তাঁহারা যে এখন নিজ আত্মীয়-কুটুম্ব, বন্ধু-বান্ধব সকলকে উক্ত আশ্রয় গ্রহণ করাইতে প্রয়াসী হইবেন, ইহাতে আশ্চর্য কি? দেখিতেও পাওয়া যায়, ঠাকুরের সহিত প্রথম সাক্ষাতের বৎসরকালমধ্যেই তাঁহারা নিজ নিজ আত্মীয়-পরিজনবর্গকে ক্রমে ক্রমে দক্ষিণেশ্বরে তাঁহার শ্রীপদপ্রান্তে আনিয়া উপস্থিত করিয়াছেন। ঐরূপে সন ১২৮৮ সালের শেষ ভাগ ইংরাজী ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ঠাকুরের লীলাসহচর ত্যাগী ভক্তবৃন্দ একে একে তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইয়াছিলেন। আমরা শুনিয়াছি, শ্রীরামকৃষ্ণসঙ্ঘে সুপরিচিত স্বামী ব্রহ্মানন্দই ঠাকুরের নিকটে প্রথম উপস্থিত হইয়াছিলেন।1 পূর্বজীবনে ইঁহার নাম শ্রীরাখালচন্দ্র ছিল, শ্রীযুত মনোমোহনের ভগ্নীর সহিত ইনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইয়াছিলেন এবং উক্ত বিবাহের স্বল্পকাল পরেই ঠাকুরের নাম শুনিয়া তাঁহার নিকটে আগমন করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলিতেন, “রাখাল আসিবার কয়েকদিন পূর্বে দেখিতেছি, মা (শ্রীশ্রীজগদম্বা) একটি বালককে আনিয়া সহসা আমার ক্রোড়ে বসাইয়া দিয়া বলিতেছেন, ‘এইটি তোমার পুত্র!’ – শুনিয়া আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিয়া বলিলাম, ‘সে কি? – আমার আবার ছেলে কি?’ তিনি তাহাতে হাসিয়া বুঝাইয়া দিলেন ‘সাধারণ সংসারিভাবে ছেলে নহে, ত্যাগী মানসপুত্র।’ তখন আশ্বস্ত হই। ঐ দর্শনের পরই রাখাল আসিয়া উপস্থিত হইল এবং বুঝিলাম এই সেই বালক!”


1. ত্যাগী ভক্তদের কেহ কেহ পূর্বেও আসিয়াছিলেন – ‘কথামৃত’, ১ম ভাগ, ৬ পৃঃ; ‘লীলাপ্রসঙ্গ – সাধকভাব’, পরিশিষ্ট, ২২ পৃঃ; ‘ঐ গুরুভাব, পূর্বার্ধ’, ২৯ পৃঃ; ‘ভক্ত মনোমোহন’, ৩২ পৃঃ; স্বামী তুরীয়ানন্দের ১৯।৯।১৭ তাঃ-এর পত্র দ্রষ্টব্য। – প্রঃ

রাখালের বালকভাব

শ্রীযুত রাখালের সম্বন্ধে অন্য এক সময়ে ঠাকুর আমাদিগকে বলিয়াছিলেন, “তখন তখন রাখালের এমন ভাব ছিল – ঠিক যেন তিন-চারি বৎসরের ছেলে! আমাকে ঠিক মাতার ন্যায় দেখিত। থাকিত, থাকিত, সহসা দৌড়িয়া আসিয়া ক্রোড়ে বসিয়া পড়িত এবং মনের আনন্দে নিঃসঙ্কোচে স্তনপান করিত! বাড়ি তো দূরের কথা, এখান হইতে কোথাও এক পা নড়িতে চাহিত না। তাহার বাপ পাছে এখানে না আসিতে দেয়, সেজন্য কত বলিয়া বুঝাইয়া এক-একবার বাড়িতে পাঠাইতাম। বাপ জমিদার, অগাধ পয়সা, কিন্তু বড় কৃপণ ছিল; প্রথম প্রথম নানারূপে চেষ্টা করিয়াছিল – যাহাতে ছেলে এখানে আর না আসে; পরে যখন দেখিল, এখানে ধনী, বিদ্বান লোক সব আসে, তখন আর ছেলের আসায় আপত্তি করিত না। ছেলের জন্য কখনও কখনও এখানে আসিয়াও উপস্থিত হইয়াছিল। তখন রাখালের জন্য তাহাকে বিশেষ আদর-যত্ন করিয়া সন্তুষ্ট করিয়া দিয়াছিলাম।”

রাখালের পত্নী

“শ্বশুরবাড়ির তরফ হইতে কিন্তু রাখালের এখানে আসা সম্বন্ধে কখনও আপত্তি উঠে নাই। কারণ, মনোমোহনের মা, স্ত্রী, ভগ্নীরা, সকলের এখানে আসা-যাওয়া ছিল। রাখাল আসিবার কিছুকাল পরে যেদিন মনোমোহনের মাতা রাখালের বালিকা বধূকে সঙ্গে লইয়া এখানে আসিল, সেদিন মনে হইল বধূর সংসর্গে আমার রাখালের ঈশ্বরভক্তির হানি হইবে না তো? – ভাবিয়া, তাহাকে কাছে আনাইয়া পা হইতে মাথার কেশ পর্যন্ত শারীরিক গঠনভঙ্গী তন্ন তন্ন করিয়া দেখিলাম এবং বুঝিলাম ভয়ের কারণ নাই, দেবীশক্তি, স্বামীর ধর্মপথের অন্তরায় কখনও হইবে না। তখন সন্তুষ্ট হইয়া নহবতে (শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীকে) বলিয়া পাঠাইলাম, টাকা দিয়া যেন পুত্রবধূর মুখ দেখে।”

রাখালের বালকভাবের হানি

“আমাকে পাইলে আত্মহারা হইয়া রাখালের ভিতর যে কিরূপ বালকভাবের আবেশ হইত, তাহা বলিয়া বুঝাইবার নহে। তখন যে-ই তাহাকে ঐরূপ দেখিত, সে-ই অবাক হইয়া যাইত! আমিও ভাবাবিষ্ট হইয়া তাহাকে ক্ষীর-ননী খাওয়াইতাম, খেলা দিতাম। কত সময় কাঁধেও উঠাইয়াছি! – তাহাতেও তাহার মনে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচের ভাব আসিত না! তখনি কিন্তু বলিয়াছিলাম বড় হইয়া স্ত্রীর সহিত একত্র বাস করিলে তাহার এই বালকের ন্যায় ভাবটি আর থাকিবে না।”

রাখালকে শাসন

“অন্যায় করিলে তাহাকে শাসনও করিতাম। একদিন কালীঘর হইতে প্রসাদী মাখন আনিলে সে ক্ষুধিত হইয়া আপনিই উহা লইয়া খাইয়াছিল! তাহাতে বলিয়াছিলাম, ‘তুই তো ভারি লোভী, এখানে আসিয়া কোথায় লোভত্যাগে যত্ন করিবি, তাহা না হইয়া আপনিই মাখন লইয়া খাইলি?’ সে ভয়েই জড়সড় হইয়া গিয়াছিল ও আর কখনও ঐরূপ করে নাই।”

রাখালের মনে হিংসা ও ঠাকুরের ভয়

“রাখালের মনে তখন বালকের ন্যায় হিংসাও ছিল। তাহাকে ভিন্ন আর কাহাকেও আমি ভালবাসিলে সে সহ্য করিতে পারিত না। অভিমানে তাহার মন পূর্ণ হইয়া উঠিত। তাহাতে আমার কখনও কখনও তাহার নিমিত্ত ভয় হইত। কারণ, মা (শ্রীশ্রীজগদম্বা) যাহাদের এখানে আনিতেছেন, তাহাদের উপর হিংসা করিয়া পাছে তাহার অকল্যাণ হয়।”

রাখালের শ্রীবৃন্দাবন গমন

“এখানে আসিবার প্রায় তিন বৎসর পরে রাখালের শরীর অসুস্থ হওয়ায় সে বলরামের সহিত শ্রীবৃন্দাবনে গিয়াছিল। উহার কিছু পূর্বে দেখিয়াছিলাম, মা যেন তাহাকে এখান হইতে সরাইয়া দিতেছেন। তখন ব্যাকুল হইয়া প্রার্থনা করিয়াছিলাম, ‘মা, ও (রাখাল) ছেলেমানুষ, বুঝে না, তাই কখনও কখনও অভিমান করে, যদি তোর কাজের জন্য ওকে এখান হইতে কিছুদিনের জন্য সরাইয়া দিস, তাহা হইলে ভাল জায়গায় মনের আনন্দে রাখিস।’ উহার অল্পকাল পরেই তাহার বৃন্দাবনে যাওয়া হয়।”

রাখালের অসুস্থতায় ঠাকুরের ভয়

“বৃন্দাবনে থাকিবার কালে রাখালের অসুখ হইয়াছে শুনিয়া কত ভাবনা হইয়াছিল, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, ইতঃপূর্বে মা দেখাইয়াছিলেন, রাখাল সত্য সত্যই ব্রজের রাখাল! যেখান হইতে যে আসিয়া শরীর ধারণ করিয়াছে, সেখানে যাইলে প্রায়ই তাহার পূর্বকথা স্মরণ হইয়া সে শরীরত্যাগ করে। সেইজন্য ভয় হইয়াছিল, পাছে শ্রীবৃন্দাবনে রাখালের শরীর যায়। তখন মা-র নিকট কাতর হইয়া কত প্রার্থনা করি এবং মা অভয়দানে আশ্বস্ত করেন। ঐরূপে রাখালের সম্বন্ধে মা কত কি দেখাইয়াছেন। তাহার অনেক কথা বলিতে নিষেধ আছে।”1


1. শ্রীযুত রাখালের সম্বন্ধে পূর্বোক্ত কথাসকল ঠাকুর একই সময়ে আমাদিগের নিকট না বলিলেও পাঠকবর্গের সুবিধার জন্য আমরা ঐসকল এখানে ধারাবাহিকভাবে সাজাইয়া দিলাম।

রাখালের ভবিষ্যৎ জীবন

ঐরূপে ঠাকুর তাঁহার প্রথমলব্ধ বালকভক্ত-সম্বন্ধে কত সময় কত বলিয়াছেন, তাহার ইয়ত্তা নাই। মা তাঁহাকে তাহার সম্বন্ধে যাহা দেখাইয়াছিলেন তাহা বর্ণে বর্ণে সফল হইয়াছিল। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বালক ধীর গম্ভীর সাধক-শ্রেণীভুক্ত হইয়া ক্রমে ঈশ্বরার্থে সংসারের সর্বস্ব ত্যাগপূর্বক শ্রীরামকৃষ্ণসঙ্ঘের শীর্ষস্থান অধিকার করিয়া বসিয়াছিল।

নরেন্দ্রনাথের আগমন

শ্রীমদ ব্রহ্মানন্দ স্বামীর দক্ষিণেশ্বরে প্রথমাগমনের তিন-চারি মাস পরেই পূজ্যপাদ স্বামী বিবেকানন্দ ঠাকুরের নিকটে আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহার কথাই এখন আমরা পাঠককে বলিতে প্রবৃত্ত হইব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *