৪.৭ ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ – ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের পুনর্যাত্রা ও গোপালের মার শেষকথা

চতুর্থ খণ্ড – সপ্তম অধ্যায়: ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ – ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের পুনর্যাত্রা ও গোপালের মার শেষকথা

বলরাম বসুর বাটীতে পুনর্যাত্রা উপলক্ষ্যে উৎসব

অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্॥
– শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৯।২২

‘কামারহাটির ব্রাহ্মণী’র গোপালরূপী শ্রীভগবানের দর্শনের কিছুকাল পরে রথের সময় ঠাকুর কলিকাতায় শুভাগমন করিয়াছেন – বাগবাজারের বলরাম বসুর বাটীতে ভক্তদের ভিড় লাগিয়াছে – বলরামবাবুও আনন্দে আটখানা হইয়া সকলকে সমুচিত আদর-অভ্যর্থনা করিতেছেন। বসুজ মহাশয় পুরুষানুক্রমে বনিয়াদি ভক্ত – এক পুরুষে নয়। ঠাকুরের কৃপাও তাঁহার ও তৎপরিবারবর্গের উপর অসীম।

ঠাকুরের শ্রীচৈতন্যদেবের সঙ্কীর্তন দেখিবার সাধ ও তদ্দর্শন। বলরাম বসুকে উহার ভিতর দর্শন করা

ঠাকুরের শ্রীমুখ হইতে শুনা – এক সময়ে ঠাকুরের শ্রীশ্রীচৈতন্যদেবের সঙ্কীর্তন করিতে করিতে নগর প্রদক্ষিণ করা দেখিবার সাধ হইলে ভাবাবস্থায় তদ্দর্শন হয়। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার – অসীম জনতা, হরিনামে উদ্দাম উন্মত্ততা! আর সেই উন্মাদ-তরঙ্গের ভিতর উন্মাদ শ্রীগৌরাঙ্গের উন্মাদনী আকর্ষণ! সেই অপার জনসঙ্ঘ ধীরে ধীরে দক্ষিণেশ্বরের উদ্যানের পঞ্চবটীর দিক হইতে ঠাকুরের ঘরের সম্মুখ দিয়া অগ্রে চলিয়া যাইতে লাগিল। ঠাকুর বলিতেন – উহারই ভিতর যে কয়েকখানি মুখ ঠাকুরের স্মৃতিতে চির-অঙ্কিত ছিল, বলরামবাবুর ভক্তি-জ্যোতিঃপূর্ণ স্নিগ্ধোজ্জ্বল মুখখানি তাহাদের অন্যতম। বলরামবাবু যেদিন প্রথম ঠাকুরকে দর্শন করিতে দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে উপস্থিত হন, সেদিন ঠাকুর তাঁহাকে দেখিবামাত্র চিনিয়াছিলেন – এ ব্যক্তি সেই লোক।

বলরামের নানাস্থানে ঠাকুর-সেবার ও শুদ্ধ অন্নের কথা

বসুজ মহাশয়ের কোঠারে (উড়িষ্যার অন্তর্গত) জমিদারি ও শ্যামচাঁদবিগ্রহের সেবা আছে, শ্রীবৃন্দাবনে কুঞ্জ ও শ্যামসুন্দরের সেবা আছে এবং কলিকাতার বাটীতেও ৺জগন্নাথদেবের বিগ্রহ1 ও সেবাদি আছে। ঠাকুর বলিতেন, “বলরামের শুদ্ধ অন্ন – ওদের পুরুষানুক্রমে ঠাকুর-সেবা ও অতিথি-ফকিরের সেবা – ওর বাপ সব ত্যাগ করে শ্রীবৃন্দাবনে বসে হরিনাম কচ্চে – ওর অন্ন আমি খুব খেতে পারি, মুখে দিলেই যেন আপনা হতে নেমে যায়।” বাস্তবিক ঠাকুরের এত ভক্তের ভিতর বলরামবাবুর অন্নই (ভাত) তাঁহাকে বিশেষ প্রীতির সহিত ভোজন করিতে দেখিয়াছি। কলিকাতায় ঠাকুর যেদিন প্রাতে আসিতেন, সেদিন মধ্যাহ্নভোজন বলরামের বাটীতেই হইত! ব্রাহ্মণ ভক্তদিগের বাটী ব্যতীত অপর কাহারও বাটীতে কোনদিন অন্নগ্রহণ করিয়াছেন কি না সন্দেহ – তবে অবশ্য নারায়ণ বা বিগ্রহাদির প্রসাদ হইলে অন্য কথা।


1. এই বিগ্রহ এখন কোঠারে আছেন।

ঠাকুরের চারিজন রসদ্দার ও বলরামবাবুর সেবাধিকার

অলোকসামান্য মহাপুরুষদিগের অতি সামান্য নিত্যনৈমিত্তিক চেষ্টাদিতেও কেমন একটু অলৌকিকত্ব, নূতনত্ব থাকে। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সহিত যাঁহারা একদিনও সঙ্গ করিয়াছেন, তাঁহারাই এ কথার মর্ম বিশেষরূপে বুঝিবেন। বলরামবাবুর অন্ন খাইতে পারা সম্বন্ধেও একটু তলাইয়া দেখিলেই উহাই উপলব্ধি হইবে। সাধনকালে ঠাকুর এক সময় জগদম্বার নিকট প্রার্থনা করিয়া বলেন, “মা, আমাকে শুকনো সাধু করিসনি – রসে বশে রাখিস”; জগদম্বাও তাঁহাকে দেখাইয়া দেন, তাঁহার রসদ (খাদ্যাদি) যোগাইবার নিমিত্ত চারিজন রসদ্দার প্রেরিত হইয়াছে। ঠাকুর বলিতেন – ঐ চারিজনের ভিতর রানী রাসমণির জামাতা মথুরানাথ প্রথম ও শম্ভু মল্লিক দ্বিতীয় ছিলেন। সিমলার সুরেন্দ্রনাথ মিত্রকে (যাহাকে ঠাকুর কখনও ‘সুরেন্দর’ ও কখনও ‘সুরেশ’ বলিয়া ডাকিতেন) ‘অর্ধেক রসদ্দার’ অর্থাৎ সুরেন্দ্র পুরা একজন রসদ্দার নয় – বলিতেন; মথুরানাথের ও শম্ভুবাবুর সেবা চক্ষে দেখা আমাদের ভাগ্যে হয় নাই – কারণ, আমরা তাঁহাদের পরলোকপ্রাপ্তির অনেক পরে ঠাকুরের নিকট উপস্থিত হই। তবে ঠাকুরের মুখে শুনিয়াছি, সে এক অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। বলরামবাবুকে ঠাকুর তাঁহার রসদ্দারদিগের অন্যতম বলিয়া কখনও নির্দিষ্ট করিয়াছেন এ কথা মনে হয় না; কিন্তু তাঁহার যেরূপ সেবাধিকার দেখিয়াছি তাহা আমাদের নিকট অদ্ভুত বলিয়া বোধ হয় এবং তাহা মথুরবাবু ভিন্ন অপর রসদ্দারদিগের সেবাধিকার অপেক্ষা কোন অংশে ন্যূন নহে। সেসব কথা অপর কোন সময়ে বলিবার চেষ্টা করিব। এখন এইটুকুই বলি যে, বলরামবাবু যেদিন হইতে দক্ষিণেশ্বরে গিয়াছেন, সেইদিন হইতে ঠাকুরের অদর্শন-দিন পর্যন্ত ঠাকুরের নিজের যাহা কিছু আহার্যের প্রয়োজন হইত, প্রায় সে সমস্তই যোগাইতেন – চাল, মিছরি, সুজি, সাগু, বার্লি, ভার্মিসেলি, টেপিওকা ইত্যাদি; এবং সুরেন্দ্র বা ‘সুরেশ মিত্তির’ দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে দর্শন করিবার অল্পকাল পর হইতেই ঠাকুরের সেবাদির নিমিত্ত যেসকল ভক্ত দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে রাত্রিযাপন করিতেন, তাঁহাদের নিমিত্ত লেপ, বালিশ ও ডাল-রুটির বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন।

কি গূঢ় সম্বন্ধে যে এইসকল ব্যক্তি ঠাকুরের সহিত সম্বদ্ধ ছিলেন তাহা কে বলিতে পারে? কোন্ কারণে ইঁহারা এই উচ্চাধিকার প্রাপ্ত হন, তাহাই বা কে বলিবে? আমরা এই পর্যন্তই বুঝিয়াছি যে, ইঁহারা মহাভাগ্যবান – জগদম্বার চিহ্নিত ব্যক্তি! নতুবা লোকোত্তরপুরুষ রামকৃষ্ণদেবের বর্তমান লীলায় ইঁহারা এইরূপে বিশেষ সহায়ক হইয়া জন্মাধিকার লাভ করিতেন না! নতুবা শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত মনে ইঁহাদের মুখের ছবি এরূপ ভাবে অঙ্কিত থাকিত না, যাহাতে তিনি দর্শনমাত্রেই তা বুঝিতে পারিয়া বলিয়াছিলেন, “ইহারা এখানকার, এই বিশেষ অধিকার লইয়া আসিয়াছে!”

ঠাকুর ‘আমি’ ‘আমার’ শব্দের পরিবর্তে সর্বদা ‘এখানে’ ‘এখানকার’ বলিতেন। উহার কারণ

‘ইহারা আমার’ না বলিয়া ঠাকুর ‘এখানকার’ বলিতেন, কারণ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অপাপবিদ্ধ মনে অহং-বুদ্ধি এতটুকুও স্থান পাইত না। তাই ‘আমি’, ‘আমার’ এই কথাগুলি প্রয়োগ করা তাঁহার পক্ষে বড়ই কঠিন ছিল! কঠিন ছিলই বা বলি কেন? তিনি ঐ দুই শব্দ আদৌ বলিতে পারিতেন না। যখন নিতান্তই বলিতে হইত, তখন ‘শ্রীশ্রীজগদম্বার দাস বা সন্তান আমি’ – এই অর্থে বলিতেন, এবং উহাও পূর্ব হইতে ঐ ভাব ঠিক ঠিক মনে আসিলে তবেই বলা চলিত, সেজন্য কথোপকথনকালে কোন স্থলে ‘আমার’ বলিতে হইলে ঠাকুর নিজ শরীর দেখাইয়া ‘এখানকার’ এই কথাটি প্রায়ই বলিতেন – ভক্তেরাও উহা হইতে বুঝিয়া লইতেন; যথা, ‘এখানকার লোক’, ‘এখানকার ভাব নয়’ ইত্যাদি বলিলেই আমরা বুঝিতাম, তিনি ‘তাঁহার লোক নয়’, ‘তাঁহার ভাব নয়’ বলিতেছেন।

রসদ্দারেরা কে কি ভাবে কতদিন ঠাকুরের সেবা করে

যাক এখন সে কথা – এখন আমরা রসদ্দারদের কথাই বলি – প্রথম রসদ্দার মথুরানাথ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দক্ষিণেশ্বরে প্রথম শুভাগমন হইতে সাধনাবস্থা শেষ হইয়া কিছুকাল পর্যন্ত চৌদ্দ বৎসর তাঁহার সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। দ্বিতীয় দেড়জনের ভিতর শম্ভুবাবু মথুরবাবুর শরীরত্যাগের কিছু পর হইতে কেশববাবু প্রমুখ কলিকাতার ভক্তসকলের ঠাকুরের নিকট যাইবার কিছু পূর্ব পর্যন্ত বাঁচিয়া থাকিয়া ঠাকুরের সেবা করিয়াছিলেন এবং অর্ধ-রসদ্দার সুরেশবাবু শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অদর্শনের ছয়-সাত বৎসর পূর্ব হইতে চারি-পাঁচ বৎসর পর পর্যন্ত জীবিত থাকিয়া তাঁহার ও তদীয় সন্ন্যাসী ভক্তদিগের সেবা ও তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত ছিলেন। ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের আশ্বিন মাসে বরাহনগরে মুন্সীবাবুদিগের পুরাতন ভগ্ন জীর্ণ বাটীতে প্রতিষ্ঠিত বরাহনগর মঠ – যাহা আজ বেলুড় মঠে পরিণত – এই সুরেশবাবুর আগ্রহে এবং ব্যয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়। হিসাবে বাকি আর দেড়জন রসদ্দার – কোথায় তাঁহারা? আমাদের প্রসঙ্গোক্ত বলরামবাবু ও যে আমেরিকা-নিবাসিনী মহিলা (মিসেস্ সারা সি বুল) শ্রীবিবেকানন্দ স্বামীজীকে বেলুড় মঠ স্থাপনে বিশেষ সহায়তা করেন – তাঁহারাই কি ঐ দেড়জন? শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও বিবেকানন্দ স্বামীজীর অদর্শনে এ কথা এখন আর কে মীমাংসা করিবে?

‘বলরামের পরিবার সব এক সুরে বাঁধা’

বলরামবাবু দক্ষিণেশ্বরে যাইয়া পর্যন্ত প্রতি বৎসর রথের সময় ঠাকুরকে বাটীতে লইয়া আসেন। বাগবাজার রামকান্ত বসু স্ট্রীটে তাঁহার বাটী অথবা তাঁহার ভ্রাতা কটকের প্রসিদ্ধ উকিল রায় হরিবল্লভ বসু বাহাদুরের বাটী। বলরামবাবু তাঁহার ভ্রাতার বাটীতেই থাকিতেন – বাটীর নম্বর ৫৭। এই ৫৭নং রামকান্ত বসু স্ট্রীট বাটীতে ঠাকুরের যে কতবার শুভাগমন হইয়াছে তাহা বলা যায় না। কত লোকই যে এখানে ঠাকুরকে দর্শন করিয়া ধন্য হইয়াছে, তাহার ইয়ত্তা কে করিবে? দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীকে ঠাকুর কখনও কখনও রহস্য করিয়া ‘মা কালীর কেল্লা’ বলিয়া নির্দেশ করিতেন, কলিকাতার বসুপাড়ার এই বাটীকে তাঁহার দ্বিতীয় কেল্লা বলিয়া নির্দেশ করিলে অত্যুক্তি হইবে না। ঠাকুর বলিতেন, “বলরামের পরিবার সব এক সুরে বাঁধা” – কর্তা গিন্নী হইতে বাটীর ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলি পর্যন্ত সকলেই ঠাকুরের ভক্ত; ভগবানের নাম না করিয়া জলগ্রহণ করে না এবং পূজা, পাঠ, সাধুসেবা, সদ্বিষয়ে দান প্রভৃতিতে সকলেরই সমান অনুরাগ। প্রায় অনেক পরিবারেই দেখা যায়, যদি একজন কি দুইজন ধার্মিক তো অপর সকলে আর একরূপ, বিজাতীয়; এ পরিবারে কিন্তু সেটি নাই। সকলেই একজাতীয় লোক! পৃথিবীতে নিঃস্বার্থ ধর্মানুরাগী পরিবার বোধ হয় অল্পই পাওয়া যায় – তাহার উপর আবার পরিবারস্থ সকলের এইরূপ এক বিষয়ে অনুরাগ থাকা এবং পরস্পর পরস্পরকে ঐ বিষয়ে সাহায্য করা, ইহা দেখিতে পাওয়া কদাচ কখনও হয়। কাজেই এই পরিবারবর্গই যে ঠাকুরের দ্বিতীয় কেল্লাস্বরূপ হইবে এবং এখানে আসিয়া যে ঠাকুর বিশেষ আনন্দ পাইবেন ইহা বিচিত্র নহে।

বলরামের বাটীতে রথোৎসব আড়ম্বরশূন্য ভক্তির ব্যাপার

পূর্বেই বলিয়াছি, এই বাটীতে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের সেবা ছিল, কাজেই রথের সময় রথটানাও হইত; কিন্তু সকলই ভক্তির ব্যাপার, বাহিরের আড়ম্বর কিছুই নাই। বাড়ি সাজানো, বাদ্যভাণ্ড, বাজে লোকের হুড়াহুড়ি, গোলমাল, দৌড়াদৌড়ি – এ সবের কিছুই নাই। ছোট একখানি রথ, বাহিরবাটীর দোতলার চকমিলান বারাণ্ডায় চারিদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া টানা হইত – একদল কীর্তনীয়া আসিত, তাহারা সঙ্গে সঙ্গে কীর্তন করিত, আর ঠাকুর ও তাঁহার ভক্তগণ ঐ কীর্তনে যোগদান করিতেন। কিন্তু সে আনন্দ, সে ভগবদ্ভক্তির ছড়াছড়ি, সে মাতোয়ারা ভাব, ঠাকুরের সে মধুর নৃত্য – সে আর অন্যত্র কোথা পাওয়া যাইবে? সাত্ত্বিক পরিবারের বিশুদ্ধ ভক্তিতে প্রসন্ন হইয়া সাক্ষাৎ ৺জগন্নাথদেব রথের বিগ্রহে এবং শ্রীরামকৃষ্ণশরীরে আবির্ভূত – সে অপূর্ব দর্শন আর কোথায় মিলিবে? সে বিশুদ্ধ প্রেমস্রোতে পড়িলে পাষণ্ডের হৃদয়ও দ্রবীভূত হইয়া নয়নাশ্রুরূপে বাহির হইত – ভক্তের আর কি কথা! এইরূপে কয়েক ঘণ্টা কীর্তনের পরে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের ভোগ দেওয়া হইত এবং ঠাকুরের সেবা হইলে ভক্তেরা সকলে প্রসাদ পাইতেন। তারপর অনেক রাত্রে এই আনন্দের হাট ভাঙিত এবং ভক্তেরা দুই-চারি জন ব্যতীত যে যাঁহার বাটীতে চলিয়া যাইতেন। লেখকের এই আনন্দ-সম্ভোগ জীবনে একবারমাত্রই হইয়াছিল – ঐ বারেই গোপালের মাকে এই বাটীতে ঠাকুরের কথায় আনিতে পাঠানো হয়। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের উলটা রথের কথাই আমরা এখানে বলিতেছি। ঠাকুর এই বৎসর ঐ দিন এখানে আসিয়া বলরামবাবুর বাটীতে দুই দিন দুই রাত থাকিয়া তৃতীয় দিনে বেলা আটটা-নয়টার সময় নৌকা করিয়া দক্ষিণেশ্বরে প্রত্যাগমন করেন।

স্ত্রী-ভক্তদিগের সহিত ঠাকুরের অপূর্ব সম্বন্ধ

আজ ঠাকুর প্রাতেই এ বাটীতে আসিয়াছেন। বাহিরে কিছুক্ষণ বসার পর তাঁহাকে অন্দরে জলযোগ করিবার জন্য লইয়া যাওয়া হইল। বাহিরে দু-চারটি করিয়া অনেকগুলি পুরুষ-ভক্তের সমাগম হইয়াছে, ভিতরেও নিকটবর্তী বাটীসকল হইতে ঠাকুরের যত স্ত্রী-ভক্ত সকলে আসিয়াছেন। ইঁহাদের অনেকেই বলরামবাবুর আত্মীয়া বা পরিচিতা এবং তাঁহার বাটীতে যখনই পরমহংসদেব উপস্থিত হইতেন বা তিনি নিজে যখনই শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দক্ষিণেশ্বরে দর্শন করিতে যাইতেন, তখনই ইঁহাদের সংবাদ দিয়া বাটীতে আনাইতেন বা আনাইয়া সঙ্গে লইয়া যাইতেন। ভাবিনী ঠাকরুন, অসীমের মা, গনুর মা ও তাঁর মা – এইরূপ এর মা, ওর পিসী, এর ননদ, ওর পড়শী প্রভৃতি অনেকগুলি ভক্তিমতী স্ত্রীলোকের আজ সমাগম হইয়াছে।

এইসকল সতী সাধ্বী ভক্তিমতী স্ত্রীলোকদিগের সহিত কামগন্ধহীন ঠাকুরের যে কি এক মধুর সম্বন্ধ ছিল তাহা বলিয়া বুঝাইবার নহে। ইঁহাদের অনেকেই ঠাকুরকে সাক্ষাৎ ইষ্টদেবতা বলিয়া তখনি জানেন। সকলেরই ঠাকুরের উপর এইরূপ বিশ্বাস। আবার কোন কোন ভাগ্যবতী উহা গোপালের মার ন্যায় দর্শনাদি দ্বারা সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। কাজেই ঠাকুরকে ইঁহারা আপনার হইতেও আপনার বলিয়া জানেন এবং তাঁহার নিকট কোনরূপ ভয়-ডর বা সঙ্কোচ অনুভব করেন না। ঘরে কোনরূপ ভাল খাবার-দাবার তৈয়ার করিলে তাহা পতিপুত্রদের আগে না দিয়া ইঁহারা ঠাকুরের জন্য আগে পাঠান বা স্বয়ং লইয়া যান। ঠাকুর থাকিতে এইসকল ভদ্রমহিলারা কতদিন যে পায়ে হাঁটিয়া দক্ষিণেশ্বর হইতে কলিকাতায় নিজেদের বাটীতে গতায়াত করিয়াছেন তাহা বলা যায় না। কোন দিন সন্ধ্যার পর, কোন দিন রাত দশটায়, আবার কোন দিন বা উৎসব-কীর্তনাদি সাঙ্গ হইতে ও দক্ষিণেশ্বর হইতে ফিরিতে রাত দুই প্রহরেরও অধিক হইয়া গিয়াছে! ইঁহাদের কাহাকেও ঠাকুর ছেলেমানুষের মতো কত আগ্রহের সহিত নিজের পেটের অসুখ প্রভৃতি রোগের ঔষধ জিজ্ঞাসা করিতেন; কেহ তাঁহাকে ঐরূপ জিজ্ঞাসা করিতে দেখিয়া হাসিলে বলিতেন, “তুই কি জানিস? ও কত বড় ডাক্তারের স্ত্রী – ও দু-চারটে ঔষধ জানেই জানে।” কাহারও ভাবপ্রেম দেখিয়া বলিতেন, “কৃপাসিদ্ধ গোপী”। কাহারও মধুর রান্না খাইয়া বলিতেন, “ও বৈকুণ্ঠের রাঁধুনী, সুক্তোয় সিদ্ধহস্ত” ইত্যাদি।

ঠাকুরের স্ত্রী-ভক্তদিগকে গোপালের মার দর্শনের কথা বলা ও তাঁহাকে আনিতে পাঠান

ঠাকুর জল খাইতে খাইতে আজ এইসকল স্ত্রীলোককে ‘গোপালের মা’র সৌভাগ্যের কথা বলিতে লাগিলেন। বলিলেন, “ওগো, সেই যে কামারহাটি থেকে বামনের মেয়েটি আসে, যার গোপালভাব – তার সব কত কি দর্শন হয়েছে; সে বলে, গোপাল তার কাছ থেকে হাত পেতে খেতে চায়। সেদিন ঐসব কত কি দেখে শুনে ভাবে প্রেমে উন্মাদ হয়ে উপস্থিত। খাওয়াতে-দাওয়াতে একটু ঠাণ্ডা হলো! থাকতে বললুম, কিন্তু থাকল না। যাবার সময়ও সেইরূপ উন্মাদ – গায়ের কাপড় খুলে ভূঁয়ে লুটিয়ে যাচ্চে, হুঁশ নেই। আমি আবার কাপড় তুলে দিয়ে বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে দি! খুব ভক্তি-বিশ্বাস – বেশ! তাকে এখানে আনতে পাঠাও না।”

বলরামবাবুর কানে ঐ কথা উঠিবামাত্র তিনি তৎক্ষণাৎ কামারহাটি হইতে ‘গোপালের মা’কে আনিতে লোক পাঠাইলেন – কারণ, আসিবার সময় যথেষ্ট আছে; ঠাকুর আজ কাল তো এখানেই থাকিবেন।

অপরাহ্ণে ঠাকুরের সহসা গোপাল-ভাবাবেশ ও পরক্ষণেই গোপালের মার আগমন

জলযোগ সাঙ্গ হইলে ঠাকুর বাহিরে আসিয়া বসিলেন ও ভক্তদের সহিত নানা কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন।

ক্রমে ঠাকুরের মধ্যাহ্নভোজন হইয়া গেল – ভক্তেরাও সকলে প্রসাদ পাইলেন। একটু বিশ্রামের পর ঠাকুর বাহিরে হলঘরে বসিয়া ভক্তদের সহিত নানা কথা কহিতে লাগিলেন। প্রায় সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় তাঁহার ভাবাবেশ হইল। আমরা সকলেই বালগোপালের ধাতুময়ী মূর্তি দেখিয়াছি – দুই জানু ও এক হাত ভূমিতে হামা দেওয়ার ভাবে রাখিয়া ও এক হাত তুলিয়া ঊর্ধ্বমুখে যেন কাহারও মুখপানে সাহ্লাদ-সতৃষ্ণ-নয়নে চাহিয়া রহিয়াছে ও কি চাহিতেছে! ভাবাবেশে ঠাকুরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদির ঠিক সেইরূপ সংস্থান হইয়া গেল, কেবল চক্ষু দুটি যেন বাহিরের কিছুই দেখিতেছে না, এইরূপ ভাবে অর্ধনিমীলিত অবস্থায় রহিল; ঠাকুরের এইরূপ ভাবাবস্থারম্ভ হইবার একটু পরেই গোপালের মারও গাড়ি আসিয়া বলরামবাবুর বাটীর দরজায় দাঁড়াইল। এবং গোপালের মাও উপরে আসিয়া ঠাকুরকে আপনার ইষ্টরূপে দর্শন করিলেন! উপস্থিত সকলে গোপালের মার ভক্তির জোরেই ঠাকুরের সহসা এইরূপ গোপাল-ভাবাবেশ হইয়াছে জানিয়া তাঁহাকে বহু ভাগ্যবতী জ্ঞানে সম্মান ও বন্দনা করিলেন। সকলে বলিতে লাগিলেন ‘কি ভক্তি, ভক্তির জোরে ঠাকুর সাক্ষাৎ গোপাল-রূপ ধারণ করিলেন’, ইত্যাদি। গোপালের মা বলিলেন, “আমি কিন্তু বাবু ভাবে অমন কাঠ হয়ে যাওয়া ভালবাসি না। আমার গোপাল হাসবে খেলবে বেড়াবে দৌড়ুবে – ও মা, ও কি! একেবারে যেন কাঠ! আমার অমন গোপাল দেখে কাজ নেই!” বাস্তবিকই ভাবসমাধিতে ঠাকুরের ঐরূপ বাহ্যজ্ঞান-হারানো প্রথম যেদিন তিনি দেখেন, সেদিন ভয়ে ডরে কাতরা হইয়া ঠাকুরের শ্রীঅঙ্গ ঠেলিতে ঠেলিতে বলিয়াছিলেন, “ও বাবা, তুমি অমন হলে কেন?” – সে কামারহাটিতে ঠাকুর যেদিন প্রথম গিয়াছিলেন।

ঠাকুর ভাবাবেশে যখন যাহা করিতেন তাহাই সুন্দর দেখাইত। উহার কারণ

আমরা যখন ঠাকুরের নিকট যাই, ঠাকুরের বয়স তখন ঊনপঞ্চাশের কাছাকাছি – বোধ হয় ঊনপঞ্চাশ হইতে পাঁচ ছয় মাস বাকি আছে; গোপালের মাও ঐ সময়েই যান। ঠাকুরের কাছে যাইবার পূর্বে মনে হইত ছোট ছেলে নাচে, অঙ্গভঙ্গি করে, তা লোকের বেশ লাগে, কিন্তু একটা বুড়ো মিন্সে, সাজোয়ান মরদ যদি ঐরূপ করে, তাহলে লোকের বিরক্তিকর বা হাস্যোদ্দীপকই হয়। ‘গণ্ডারের খেমটি নাচ কি কারো ভাল লাগে?’ – স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন। কিন্তু ঠাকুরের কাছে আসিয়া দেখি সব উলটো ব্যাপার। বয়সে প্রৌঢ় হলেও ঠাকুর নাচেন, গান করেন, কত হাবভাব দেখান – কিন্তু তাঁর সকলগুলিই কি মিষ্ট! বাস্তবিক ‘একটা বুড়ো মিনসেকে নাচিলে যে এত ভাল দেখায়, এ কথা আমরা কখনও স্বপ্নেও ভাবি নাই!’ – গিরিশবাবু এ কথাটি বলিতেন। আজ বলরামবাবুর বাড়িতে এই যে তাঁহার গোপাল-ভাবাবেশে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সংস্থান বালগোপালের ন্যায় হইল, তাহাই বা কত সুন্দর! কেন যে ঐরূপ সুন্দর বোধ হইত, তাহা তখন বুঝিতাম না – কেবল সুন্দর ইহাই অনুভব করিতাম। এখন বুঝি যে, যে ভাব যখন তাঁহার ভিতরে আসিত তাহা তখন পুরাপুরিই আসিত, তাঁহার ভিতর এতটুকু আর অন্য ভাব থাকিত না – এতটুকু ‘ভাবের ঘরে চুরি’ বা লোক-দেখানো ভাব থাকিত না। সে ভাবে তিনি তখন একেবারে অনুপ্রাণিত, তন্ময় বা (তিনি নিজে যেমন রহস্য করিয়া বলিতেন) ডাইলুট (dilute) হইয়া যাইতেন; কাজেই তখন তিনি বৃদ্ধ হইয়া বালকের অভিনয় করিতেছেন বা পুরুষ হইয়া স্ত্রীর অভিনয় করিতেছেন – এ কথা লোকের মনে আর উদয় হইতেই পাইত না! ভিতরের প্রবল ভাবতরঙ্গ শরীরের মধ্য দিয়া ফুটিয়া বাহির হইয়া শরীরটাকে যেন এককালে পরিবর্তিত বা রূপান্তরিত করিয়া ফেলিত!

পুনর্যাত্রাশেষে ঠাকুরের দক্ষিণেশ্বরে আগমন

ভক্তসঙ্গে আনন্দে দুই দিন দুই রাত ঠাকুরের বলরামবাবুর বাটীতে কাটিয়াছে। আজ তৃতীয় দিন দক্ষিণেশ্বরে ফিরিবেন। বেলা আন্দাজ ৮টা কি ৯টা হইবে – ঘাটে নৌকা প্রস্তুত। স্থির হইল, গোপালের মা ও অন্য একজন স্ত্রী-ভক্তও (গোলাপ-মাতা) ঐ নৌকায় ঠাকুরের সহিত দক্ষিণেশ্বরে যাইবেন; তদ্ভিন্ন দুই-একজন বালক-ভক্ত, যাঁহারা ঠাকুরের পরিচর্যার জন্য সঙ্গে আসিয়াছিলেন, তাঁহারাও যাইবেন। বোধ হয় শ্রীযুত কালী (স্বামী অভেদানন্দ) উঁহাদের অন্যতম।

ঠাকুর বাটীর ভিতরে যাইয়া জগন্নাথদেবকে প্রণাম করিয়া এবং ভক্ত-পরিবারের প্রণাম গ্রহণ করিয়া নৌকায় যাইয়া উঠিলেন। গোপালের মা প্রভৃতিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইয়া নৌকায় উঠিলেন। বলরামবাবুর পরিবারবর্গের অনেকে ভক্তি করিয়া গোপালের মাকে কাপড় ইত্যাদি এবং তাঁহার অভাব আছে জানিয়া রন্ধনের নিমিত্ত হাতা, বেড়ী প্রভৃতি অনেকগুলি দ্রব্য তাঁহাকে দিয়াছিলেন। সে পুঁটুলি বা মোটটি নৌকায় তুলিয়া দেওয়া হইল। নৌকা ছাড়িল।

নৌকায় যাইবার সময় ঠাকুরের গোপালের মার পুঁটুলি দেখিয়া বিরক্তি। ভক্তদের প্রতি ঠাকুরের যেমন ভালবাসা তেমনি কঠোর শাসনও ছিল

যাইতে যাইতে পুঁটুলি দেখিয়া ঠাকুর জিজ্ঞাসায় জানিলেন – উহা গোপালের মার; ভক্ত-পরিবারেরা তাঁহাকে যেসকল দ্রব্যাদি দিয়াছেন, তাহারই পুঁটুলি। শুনিয়াই ঠাকুরের মুখ গম্ভীরভাব ধারণ করিল। গোপালের মাকে কিছু না বলিয়া অপর স্ত্রী-ভক্ত গোলাপ-মাতাকে লক্ষ্য করিয়া ত্যাগের বিষয়ে নানা কথা কহিতে লাগিলেন। বলিলেন, “যে ত্যাগী সে-ই ভগবানকে পায়। যে লোকের বাড়িতে গিয়ে খেয়েদেয়ে শুধুহাতে চলে আসে, সে ভগবানের গায়ে ঠেস দিয়ে বসে।” – ইত্যাদি। সেদিন যাইতে যাইতে ঠাকুর গোপালের মার সহিত একটিও কথা কহিলেন না, আর বার বার ঐ পুঁটুলিটির দিকে দেখিতে লাগিলেন। ঠাকুরের ঐ ভাব দেখিয়া গোপালের মার মনে হইতে লাগিল, পুঁটুলিটা গঙ্গার জলে ফেলিয়া দি। একদিকে ঠাকুরের যেমন পঞ্চমবর্ষীয় বালকের ভাবে ভক্তদের সহিত হাসি তামাসা ঠাট্টা খেলাধুলা ছিল, অপর দিকে আবার তেমনি কঠোর শাসন। কাহারও এতটুকুও বেচাল দেখিতে পারিতেন না। ক্ষুদ্র হইতেও ক্ষুদ্র জিনিসের তত্ত্বাবধান ছিল, কাহারও অতি সামান্য ব্যবহার বে-ভাবের হইলে অমনি তাঁহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাহার উপর পড়িত ও যাহাতে উহার সংশোধন হয়, তাহার চেষ্টা আসিত। চেষ্টারও বড় একটা বেশি আড়ম্বর করিতে হইত না, একবার মুখ ভারী করিয়া তাহার সহিত কিছুক্ষণ কথা না কহিলেই সে ছটফট করিত ও স্বকৃত দোষের জন্য অনুতপ্ত হইত। তাহাতেও যে নিজের ভুল না শোধরাইত, ঠাকুরের শ্রীমুখ হইতে দুই-একটি সামান্য তিরস্কারই তাহার মতি স্থির করিতে যথেষ্ট হইত! অদ্ভুত ঠাকুরের প্রত্যেক ভক্তের সহিত অদৃষ্টপূর্ব ব্যবহার ও শিক্ষাদান এইরূপেই চলিত – প্রথম অমানুষী ভালবাসায় তাহার হৃদয় সম্পূর্ণরূপে অধিকার, তাহার পর যাহা কিছু বলিবার কহিবার – দুই চারি কথায় বলা বা বুঝানো।

ঠাকুরের বিরক্তি-প্রকাশে গোপালের মার কষ্ট ও শ্রীশ্রীমার তাঁহাকে সান্ত্বনা দেওয়া

দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছিয়াই গোপালের মা নহবতে শ্রীশ্রীমার নিকট ব্যাকুল হইয়া যাইয়া তাঁহাকে বলিলেন, “অ বৌমা, গোপাল এইসব জিনিসের পুঁটুলি দেখে রাগ করেছে; এখন উপায়? তা এ-সব আর নিয়ে যাব না, এইখানে বিলিয়ে দিয়ে যাই।”

শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীর অপার দয়া – বুড়িকে কাতর দেখিয়া সান্ত্বনা করিয়া বলিলেন, “উনি বলুনগে। তোমায় দেবার তো কেউ নেই, তা তুমি কি করবে মা – দরকার বলেই তো এনেচ?”

গোপালের মা তত্রাচ তাহার মধ্য হইতে একখানা কাপড় ও আরও কি কি দুই-একটি জিনিস বিলাইয়া দিলেন এবং ভয়ে ভয়ে দুই-একটি তরকারি স্বহস্তে রাঁধিয়া ঠাকুরকে ভাত খাওয়াইতে গেলেন। অন্তর্যামী ঠাকুর তাঁহাকে অনুতপ্তা দেখিয়া আর কিছুই বলিলেন না। আবার গোপালের মার সহিত হাসিয়া কথা কহিয়া পূর্ববৎ ব্যবহার করিতে লাগিলেন। গোপালের মাও আশ্বস্তা হইয়া ঠাকুরকে খাওয়াইয়া-দাওয়াইয়া বৈকালে কামারহাটি ফিরিলেন।

গোপালের মার ঠাকুরে ইষ্ট-বুদ্ধি দৃঢ় হইবার পর যেরূপ দর্শনাদি হইত

পূর্বে বলিয়াছি, গোপালের মার ভাবঘন গোপালমূর্তির প্রথম দর্শনের দুই মাস পরে সে দর্শন আর সদাসর্বক্ষণ হইত না। তাহাতে কেহ না মনে করিয়া বসেন যে, উহার পরে তাঁহার কালেভদ্রে কখনও গোপালমূর্তির দর্শন হইত। কারণ, প্রতি দিনই তিনি দিনের মধ্যে দুই-দশ বার গোপালের দর্শন পাইতেন। যখনই দেখিবার নিমিত্ত প্রাণ ব্যাকুল হইত তখনই পাইতেন, আবার যখনই কোন বিষয়ে তাঁহার শিক্ষার প্রয়োজন তখন গোপাল সম্মুখে সহসা আবির্ভূত হইয়া সঙ্কেতে, কথায় বা নিজে হাতেনাতে করিয়া দেখাইয়া তাঁহাকে ঐরূপ করিতে প্রবৃত্ত করিতেন। ঠাকুরের শ্রীঅঙ্গে বার বার মিশিয়া যাইয়া তাঁহাকে শিখাইয়াছিলেন তিনি ও শ্রীরামকৃষ্ণদেব অভিন্ন। খাইবার ও শুইবার জিনিস চাহিয়া-চিন্তিয়া লইয়া কিভাবে তাঁহার সেবা করা উচিত তাহা শিখাইয়াছিলেন। আবার কোন কোন বিশেষ বিশেষ শ্রীরামকৃষ্ণভক্তদিগের সহিত একত্র বিহার করিয়া বা তাঁহাদের সহিত অন্য কোনরূপ আচরণ করিয়া দেখাইয়া নিজ মাতাকে বুঝাইয়াছিলেন, ইঁহারা ও তিনি অভেদ – ভক্ত ও ভগবান এক। কাজেই তাঁহাদের ছোঁয়ান্যাপা বস্তুভোজনেও তাঁহার দ্বিধা ক্রমে ক্রমে দূর হইয়া যায়।

শ্রীরামকৃষ্ণদেবে ইষ্টদেব-বুদ্ধি দৃঢ় হইবার পর হইতে আর তাঁহার বড় একটা গোপালমূর্তির দর্শন হইত না। যখন তখন শ্রীরামকৃষ্ণদেবকেই দেখিতে পাইতেন, এবং ঐ মূর্তির ভিতর দিয়াই বালগোপালরূপী ভগবান তাঁহাকে যত কিছু শিক্ষা দিতেন। প্রথম প্রথম ইহাতে তাঁহার মনে বড়ই অশান্তি হয়। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নিকট উপস্থিত হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলেন, “গোপাল, তুমি আমায় কি করলে, আমার কি অপরাধ হলো, কেন আর আমি তোমায় আগেকার মতো (গোপালরূপে) দেখতে পাই না?” ইত্যাদি। তাহাতেই শ্রীরামকৃষ্ণদেব উত্তর দেন, “ওরূপ সদাসর্বক্ষণ দর্শন হলে কলিতে শরীর থাকে না; একুশ দিন মাত্র শরীরটা থেকে তারপর শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়ে যায়।” বাস্তবিক প্রথম দর্শনের পর দুই মাস গোপালের মা সর্বদাই একটা ভাবের ঘোরে থাকিতেন। রান্না-বাড়া, স্নান-আহার, জপ-ধ্যান প্রভৃতি যাহা কিছু করিতেন, সব যেন পূর্বের বহুকালের অভ্যাস ছিল ও করিতে হয় বলিয়া; তাঁহার শরীরটা অভ্যাসবশে আপনা-আপনি ঐসকল কোন রকমে সারিয়া লইত এই পর্যন্ত! কিন্তু তিনি নিজে সদাসর্বক্ষণ যেন একটা বিপরীত নেশার ঝোঁকে থাকিতেন, কাজেই এভাবে শরীর আর কয়দিন থাকে? দুই মাসও যে ছিল, ইহাই আশ্চর্য! দুই মাস পরে সে নেশার ঝোঁক অনেকটা কাটিয়া গেল। কিন্তু গোপালকে পূর্বের ন্যায় না দেখিতে পাওয়ায় আবার এক বিপরীত ব্যাকুলতা আসিল। বায়ুপ্রধান ধাত – বায়ু বাড়িয়া শরীরে বুকের ভিতর একটা দারুণ যন্ত্রণা অনুভূত হইতে লাগিল। শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে সেইজন্যই বলেন, “বাই বেড়ে বুক যেন আমার করাত দিয়ে চিরচে!” ঠাকুর তাহাতেই তাঁহাকে সান্ত্বনা দিয়া বলেন, “ও তোমার হরিবাই; ও গেলে কি নিয়ে থাকবে গো? ও থাকা ভাল; যখন বেশি কষ্ট হবে তখন কিছু খেয়ো।” এই কথা বলিয়া ঠাকুর তাঁহাকে নানারূপ ভাল ভাল জিনিস সেদিন খাওয়াইয়াছিলেন।

ঠাকুরের নিকটে মাড়োয়ারী ভক্তদের আসা-যাওয়া

কলিকাতা হইতে আমরা মেয়ে-পুরুষে অনেকে ঠাকুরকে যেমন দেখিতে যাইতাম অনেকগুলি মাড়োয়ারী মেয়ে-পুরুষও তেমনি সময়ে সময়ে দেখিতে আসিত। তাহারা সকলে অনেকগুলি গাড়িতে করিয়া দক্ষিণেশ্বরের বাগানে আসিত এবং গঙ্গাস্নান করিয়া পুষ্পচয়ন ও শিবপূজাদি সারিয়া পঞ্চবটীতে আড্ডা করিত। পরে ঐ গাছতলায় উনুন খুঁড়িয়া ডাল, লেট্টি, চুরমা প্রভৃতি প্রস্তুত করিয়া দেবতাকে নিবেদনপূর্বক আগে ঠাকুরকে সেইসব খাবার দিয়া যাইত এবং পরে আপনারা প্রসাদ পাইত। ইহাদের ভিতর আবার অনেকে ঠাকুরের নিমিত্ত বাদাম, কিসমিস, পেস্তা, ছোয়ারা, থালা-মিছরি, আঙুর, বেদানা, পেয়ারা, পান প্রভৃতি লইয়া আসিয়া তাঁহার সম্মুখে ধরিয়া দিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিত। কারণ, তাহারা আমাদের অনেকের মতো ছিল না, রিক্তহস্তে সাধুর আশ্রমে বা দেবতার স্থানে যে যাইতে নাই এ কথা সকলেই জানিত, এবং সেজন্য কিছু না কিছু লইয়া আসিতই আসিত।

কামনা-করিয়া-দেওয়া জিনিস ঠাকুর গ্রহণ ও ভোজন করিতে পারিতেন না। ভক্তদেরও উহা খাইতে দিতেন না

শ্রীরামকৃষ্ণদেব কিন্তু তাহাদের দু-একজনের ছাড়া ঐসকল মাড়োয়ারীপ্রদত্ত জিনিসের কিছুই স্বয়ং গ্রহণ করিতেন না। বলিতেন, “ওরা যদি একখিলি পান দেয় তো তার সঙ্গে ষোলটা কামনা জুড়ে দেয় – ‘আমার মকদ্দমায় জয় হোক, আমার রোগ ভাল হোক, আমার ব্যবসায়ে লাভ হোক’ ইত্যাদি!” ঠাকুর নিজে তো ঐসকল জিনিস খাইতেনই না, আবার ভক্তদেরও ঐসকল খাবার খাইতে দিতেন না। তবে, ডাল রুটি ইত্যাদি রাঁধা খাবার, যাহা তাহারা ঠাকুর-দেবতাকে ভোগ দিয়া তাঁহাকে দিয়া যাইত, ‘প্রসাদ’ বলিয়া নিজেও তাহা কখনও একটু-আধটু গ্রহণ করিতেন এবং আমাদের সকলকেও খাইতে দিতেন। তাহাদের দেওয়া ঐসকল মিছরি, মেওয়া প্রভৃতি খাইবার অধিকারী ছিলেন একমাত্র নরেন্দ্রনাথ (স্বামী বিবেকানন্দজী)। ঠাকুর বলিতেন, “ওর (নরেন্দ্রের) কাছে জ্ঞান-অসি রয়েছে – খাপখোলা তরোয়াল, ওর ওসব খেলে কিছুই দোষ হবে না, বুদ্ধি মলিন হবে না।” তাই ঠাকুর ভক্তদের ভিতর যাহাকে পাইতেন তাহাকে দিয়া ঐসব খাবার নরেন্দ্রনাথের বাটীতে পাঠাইয়া দিতেন। যেদিন কাহাকেও পাইতেন না, সেদিন নিজের ভ্রাতুষ্পুত্র মা কালীর ঘরের পূজারী রামলালকে দিয়াই পাঠাইয়া দিতেন। আমরা রামলালদাদার নিকট শুনিয়াছি, নিত্য নিত্য ঐরূপ লইয়া যাইতে পাছে রামলাল বিরক্ত হয় তাই একদিন মধ্যাহ্নভোজনের পর রামলালকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “কিরে, তোর কলিকাতায় কোন দরকার নাই?”

রামলাল – আজ্ঞে, আমার কলিকাতায় আর কি দরকার! তবে আপনি বলেন তো যাই।

মাড়োয়ারীদের-দেওয়া খাদ্যদ্রব্য নরেন্দ্রনাথকে পাঠান

শ্রীরামকৃষ্ণ – না তাই বলছিলাম; বলি, অনেকদিন বেড়াতে-টেড়াতে যাসনি, তাই যদি বেড়িয়ে আসতে ইচ্ছা হয়ে থাকে। তা একবার যা না। যাস তো ঐ টিনের বাক্সয় পয়সা আছে, নিয়ে বরাহনগর থেকে শেয়ারের গাড়িতে করে যাস। তা না হলে রোদ লেগে অসুখ করবে। আর ঐ মিছরি, বাদামগুলো নরেন্দ্রকে দিয়ে আসবি ও তার খবরটা নিয়ে আসবি – সে অনেকদিন আসেনি; তার খবরের জন্য মনটা ‘আটু-পাটু’ কচ্চে।

রামলালদাদা বলেন, “আহা, সে কত সঙ্কোচ, পাছে আমি বিরক্ত হই!” বলা বাহুল্য, রামলালদাদাও ঐরূপ অবসরে কলিকাতায় শুভাগমন করিয়া ভক্তদের আনন্দবর্ধন করিতেন।

গোপালের মাকে ঠাকুরের মাড়োয়ারীদের প্রদত্ত মিছরি দেওয়া

আজ অনেকগুলি মাড়োয়ারী ভক্ত ঐরূপে দক্ষিণেশ্বরে আসিয়াছেন। পূর্বের ন্যায় ফল, মিছরি ইত্যাদি ঠাকুরের ঘরে অনেক জমিয়াছে। এমন সময় গোপালের মা ও কতকগুলি স্ত্রী-ভক্ত ঠাকুরকে দর্শন করিতে আসিয়া উপস্থিত। গোপালের মাকে দেখিয়া ঠাকুর কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়া তাঁহার মাথা হইতে পা পর্যন্ত সর্বাঙ্গে হাত বুলাইতে বুলাইতে ছেলে যেমন মাকে পাইয়া কত প্রকারে আদর করে, তেমনি করিতে লাগিলেন। গোপালের মার শরীরটা দেখাইয়া সকলকে বলিলেন, “এ খোলটার ভেতর কেবল হরিতে ভরা; হরিময় শরীর!” গোপালের মাও চুপটি করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। ঠাকুর ঐরূপে পায়ে হাত দিতেছেন বলিয়া একটুও সঙ্কুচিতা হইলেন না! পরে ঘরে যত কিছু ভাল ভাল জিনিস ছিল, সব আনিয়া ঠাকুর বৃদ্ধাকে খাওয়াইতে লাগিলেন। গোপালের মা দক্ষিণেশ্বরে যাইলে ঠাকুর ঐরূপ করিতেন ও খাওয়াইতেন! গোপালের মা তাঁহাকে একদিন বলেন, “গোপাল, তুমি আমায় অত খাওয়াতে ভালবাস কেন?”

শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি যে আমায় আগে কত খাইয়েছ।

গোপালের মা – আগে – কবে খাইয়েছি?

শ্রীরামকৃষ্ণ – জন্মান্তরে।

সমস্ত দিন দক্ষিণেশ্বরে থাকিয়া গোপালের মা যখন কামারহাটি ফিরিবেন বলিয়া বিদায় গ্রহণ করিতেছেন, তখন ঠাকুর মাড়োয়ারীদের দেওয়া যত মিছরি আনিয়া গোপালের মাকে দিলেন ও সঙ্গে লইয়া যাইতে বলিলেন। গোপালের মা বলিলেন, “অত মিছরি সব দিচ্ছ কেন?”

শ্রীরামকৃষ্ণ – (গোপালের মার চিবুক সাদরে ধরিয়া) ওগো, ছিলে গুড়, হলে চিনি, তারপর হলে মিছরি! এখন মিছরি হয়েছ – মিছরি খাও আনন্দ কর।

মাড়োয়ারীদের মিছরি ঐরূপে গোপালের মাকে ঠাকুর দেওয়াতে সকলে অবাক হইয়া রহিল – বুঝিল, ঠাকুরের কৃপায় এখন আর গোপালের মার মন কিছুতেই মলিন হইবার নয়। গোপালের মা আর কি করেন, অগত্যা ঐ মিছরিগুলি লইয়া গেলেন, নতুবা গোপাল (শ্রীরামকৃষ্ণদেব) ছাড়েন না; আর শরীর থাকিতে তো সকল জিনিসেরই প্রয়োজন – গোপালের মা যেমন কখনও কখনও আমাদের বলিতেন, “শরীর থাকতে সব চাই – জিরেটুকু মেথিটুকু পর্যন্ত, এমন দেখিনি!”

দর্শনের কথা অপরকে বলিতে নাই

গোপালের মা পূর্বাবধি জপ-ধ্যান করিতে করিতে যাহা কিছু দেখিতেন সব ঠাকুরকে আসিয়া বলিতেন; তাহাতে ঠাকুর বলিতেন, “দর্শনের কথা কাহাকেও বলতে নাই, তা হলে আর হয় না।” গোপালের মা তাহাতে এক দিবস বলেন, “কেন? সে সব তো তোমারি দর্শনের কথা, তোমায়ও বলতে নাই?” ঠাকুর তাহাতে বলেন, “এখানকার দর্শন হলেও আমাকে বলতে নাই।” গোপালের মা বলিলেন, ‘বটে?’ তদবধি তিনি আর দর্শনাদির কথা কাহারও নিকট বড় একটা বলিতেন না। সরল উদার গোপালের মার শ্রীরামকৃষ্ণদেব যাহা বলিতেন তাহাতেই একেবারে পাকা বিশ্বাস হইত। আর সংশয়াত্মা আমরা? আমাদের ঠাকুরের কথা যাচাই করিতে করিতেই জীবনটা কাটিয়া গেল – জীবনে পরিণত করিয়া ঐসকলের ফলভোগে আনন্দ করা আর ঘটিয়া উঠিল না!

স্বামী বিবেকানন্দের সহিত ঠাকুরের গোপালের মার পরিচয় করিয়া দেওয়া

এই সময় একদিন গোপালের মা ও শ্রীমান নরেন্দ্রনাথ (বিবেকানন্দ স্বামীজী) উভয়ে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত। নরেন্দ্রনাথের তখনও ব্রাহ্মসমাজের নিরাকারবাদে বেশ ঝোঁক। ঠাকুরদেবতা – পৌত্তলিকতায় বিশেষ বিদ্বেষ; তবে এটা ধারণা হইয়াছে যে, পুতুলমূর্তি-টূর্তি অবলম্বন করিয়াও লোক নিরাকার সর্বভূতস্থ ভগবানে কালে পৌঁছায়। ঠাকুরের রহস্যবোধটা খুব ছিল। একদিকে এই সর্বগুণান্বিত সুপণ্ডিত মেধাবী বিচারপ্রিয় ভগবদ্ভক্ত নরেন্দ্রনাথ এবং অপরদিকে গরিব কাঙালী নামমাত্রাবলম্বনে শ্রীভগবানের দর্শন ও কৃপাপ্রয়াসী সরলবিশ্বাসী গোপালের মা – যিনি কখনও লেখাপড়া জ্ঞানবিচারের ধার দিয়াও যান নাই – উভয়কে একত্রে পাইয়া এক মজা বাধাইয়া দিলেন। ব্রাহ্মণী যেরূপে বালগোপালরূপী ভগবানের দর্শন পান এবং তদবধি গোপাল যেভাবে তাঁহার সহিত লীলাবিলাস করিতেছেন, সে সমস্ত কথা শ্রীযুত নরেন্দ্রের নিকটে গোপালের মাকে বলিতে বলিলেন। গোপালের মা ঠাকুরের কথা শুনিয়া বলিলেন, “তাতে কিছু দোষ হবে না তো, গোপাল?” পরে ঐ বিষয়ে ঠাকুরের আশ্বাস পাইয়া অশ্রুজল ফেলিতে ফেলিতে গদ্গদস্বরে গোপালরূপী শ্রীভগবানের প্রথম দর্শনের পর হইতে দুই মাস কাল পর্যন্ত যত লীলাবিলাসের কথা আদ্যোপান্ত বলিতে লাগিলেন – কেমন করিয়া গোপাল তাঁহার কোলে উঠিয়া কাঁধে মাথা রাখিয়া কামারহাটি হইতে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত সারা পথ আসিয়াছিল, আর তাহার লাল টুকটুকে পা দুখানি তাঁহার বুকের উপর ঝুলিতেছিল তিনি স্পষ্ট দেখিতে পাইয়াছিলেন; ঠাকুরের অঙ্গে কেমন মাঝে মাঝে প্রবেশ করিয়া আবার নির্গত হইয়া পুনরায় তাঁহার নিকটে আসিয়াছিল; শুইবার সময় বালিশ না পাইয়া বারবার খুঁতখুঁত করিয়াছিল; রাঁধিবার কাঠ কুড়াইয়াছিল এবং খাইবার জন্য দৌরাত্ম্য করিয়াছিল – সকল কথা সবিস্তার বলিতে লাগিলেন। বলিতে বলিতে বুড়ি ভাবে বিভোর হইয়া গোপালরূপী শ্রীভগবানকে পুনরায় দর্শন করিতে লাগিলেন। নরেন্দ্রনাথের বাহিরে কঠোর জ্ঞানবিচারের আবরণ থাকিলেও ভিতরটা চিরকালই ভক্তিপ্রেমে ভরা ছিল – তিনি বুড়ির ঐরূপ ভাবাবস্থা ও দর্শনাদির কথা শুনিয়া অশ্রুজল সংবরণ করিতে পারিলেন না। আবার বলিতে বলিতে বুড়ি বারবার নরেন্দ্রনাথকে সরলভাবে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, “বাবা, তোমরা পণ্ডিত বুদ্ধিমান, আমি দুঃখী কাঙালী কিছুই জানি না, কিছুই বুঝি না – তোমরা বল, আমার এসব তো মিথ্যা নয়?” নরেন্দ্রনাথও বারবার বুড়িকে আশ্বাস দিয়া বুঝাইয়া বলিলেন, “না, মা, তুমি যা দেখেছ সে সব সত্য!” গোপালের মা যে ব্যাকুল হইয়া শ্রীযুত নরেন্দ্রনাথকে ঐরূপ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন তাহার কারণ, বোধ হয় তখন আর তিনি পূর্বের ন্যায় সর্বদা শ্রীগোপালের দর্শন পাইতেন না বলিয়া।

গোপালের মার নিমন্ত্রণে ঠাকুরের কামারহাটির বাগানে গমন ও তথায় প্রেতযোনিদর্শন

এই সময়ে ঠাকুর একদিন শ্রীযুত রাখালকে (ব্রহ্মানন্দ স্বামী) সঙ্গে লইয়া কামারহাটিতে গোপালের মার নিকট আসিয়া উপস্থিত – বেলা দশটা আন্দাজ হইবে। কারণ, গোপালের মার বিশেষ ইচ্ছা হইয়াছিল, নিজ হস্তে ভাল করিয়া রন্ধন করিয়া একদিন ঠাকুরকে খাওয়ান। বুড়ি তো ঠাকুরকে পাইয়া আহ্লাদে আটখানা। যাহা যোগাড় করিতে পারিয়াছিলেন তাহাই জলযোগের জন্য দিয়া জল খাওয়াইয়া বাবুদের বৈঠকখানার ঘরে ভাল করিয়া বিছানা পাতিয়া তাঁহাকে বসাইয়া নিজে কোমর বাঁধিয়া রাঁধিতে গেলেন। ভিক্ষা-সিক্ষা করিয়া নানা ভাল ভাল জিনিস যোগাড় করিয়াছিলেন। – নানা প্রকার রান্না করিয়া মধ্যাহ্নে ঠাকুরকে বেশ করিয়া খাওয়াইলেন এবং বিশ্রামের জন্য মেয়েমহলের দোতলার দক্ষিণদিকের ঘরখানিতে আপনার লেপখানি পাতিয়া, ধোপদোস্ত চাদর একখানি তাহার উপর বিছাইয়া ভাল করিয়া বিছানা করিয়া দিলেন! ঠাকুরও তাহাতে শয়ন করিয়া একটু বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। শ্রীযুত রাখালও ঠাকুরের পার্শ্বেই শয়ন করিলেন, কারণ রাখাল মহারাজ বা স্বামী ব্রহ্মানন্দকে ঠাকুর ঠিক ঠিক নিজের সন্তানের মতো দেখিতেন এবং তাঁহার সহিত সেইরূপ ব্যবহার সর্বদা করিতেন।

এই সময়ে ঐ স্থানে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঠাকুর দেখেন। তাঁহার নিজের মুখ হইতে শোনা বলিয়াই তাহা আমরা এখানে বলিতে সাহসী হইতেছি, নতুবা ঐ কথা চাপিয়া যাইব মনে করিয়াছিলাম। ঠাকুরের দিনে-রেতে নিদ্রা অল্পই হইত, কাজেই তিনি স্থির হইয়া শুইয়া আছেন; আর রাখাল মহারাজ তাঁহার পার্শ্বে ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। এমন সময় ঠাকুর বলেন, “একটা দুর্গন্ধ বেরুতে লাগল; তারপর দেখি ঘরের কোণে দুটো মূর্তি! বিটকেল চেহারা, পেট থেকে বেরিয়ে পড়ে নাড়ি-ভুঁড়িগুলো ঝুলচে; আর মুখ, হাত, পা মেডিকেল কলেজে যেমন একবার মানুষের হাড়গোড় সাজানো দেখেছিলাম (মানব-অস্থি-কঙ্কাল) ঠিক সেইরকম। তারা আমাকে অনুনয় করে বলচে, ‘আপনি এখানে কেন? আপনি এখান থেকে যান, আপনার দর্শনে আমাদের (নিজেদের অবস্থার কথা মনে পড়ে বোধ হয়!) বড় কষ্ট হচ্চে!’ এদিকে তারা ঐরূপ কাকুতি-মিনতি কচ্চে, ওদিকে রাখাল ঘুমুচ্চে। তাদের কষ্ট হচ্চে দেখে বেটুয়া ও গামছাখানা নিয়ে চলে আসবার জন্য উঠচি, এমন সময় রাখাল জেগে বলে উঠল, ‘ওগো, তুমি কোথায় যাও?’ আমি তাকে ‘পরে সব বলব’ বলে তার হাত ধরে নীচে নেমে এলাম ও বুড়িকে (তার তখন খাওয়া হয়েছে মাত্র) বলে নৌকায় গিয়ে উঠলাম। তখন রাখালকে সব বলি – এখানে দুটো ভূত আছে। বাগানের পাশেই কামারহাটির কল – ঐ কলের সাহেবরা খানা খেয়ে হাড়গোড়গুলো যা ফেলে দেয় তাই শোঁকে (কারণ ঘ্রাণ লওয়াই উহাদের ভোজন করা!) ও ঐ ঘরে থাকে! বুড়িকে ও কথার কিছু বললুম না – তাকে ঐ বাড়িতেই সদাসর্বক্ষণ একলা থাকতে হয় – ভয় পাবে।”

কাশীপুরের বাগানে ঠাকুরের গোপালের মাকে ক্ষীর খাওয়ান ও বলা – তাঁহার মুখ দিয়া গোপাল খাইয়া থাকেন

কলিকাতার যে রাস্তাটি বাগবাজার গঙ্গার ধার দিয়া পুল পার হইয়া উত্তরমুখো বরাবর বরাহনগর বাজার পর্যন্ত গিয়াছে, সেই রাস্তার উপরেই মতিঝিল বা কলিকাতার বিখ্যাত ধনী পরলোকগত মতিলাল শীলের উদ্যান-সম্মুখস্থ ঝিল। ঐ মতিঝিলের উত্তরাংশ যেখানে রাস্তায় মিলিয়াছে তাহার পূর্বে রাস্তার অপর পারেই রানী কাত্যায়নীর (লালাবাবুর পত্নী) জামাতা ৺কৃষ্ণগোপাল ঘোষের উদ্যানবাটী। ঐ বাগানেই শ্রীরামকৃষ্ণদেব আট মাস কাল বাস করিয়া (১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি হইতে ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত) ভক্তদিগের স্থূলনেত্রের সম্মুখ হইতে অন্তর্হিত হন। ঐ উদ্যানই তাঁহাদিগের নিকট ‘কাশীপুরের বাগান’ নামে অভিহিত হইয়া সকলের মনে কতই না হর্ষ-শোকের উদয় করিয়া দেয়! তোমরা বলিবে – ঠাকুর তো তখন রোগশয্যায়, তবে হর্ষ আবার কিসের? আপাতদৃষ্টিতে রোগশয্যা বটে, কিন্তু ঠাকুরের দেবশরীরে ঐ প্রকার রোগের বাহ্যিক বিকাশ তাঁহার ভক্তদিগকে বিভিন্ন শ্রেণীবদ্ধ ও একত্র সম্মিলিত করিয়া কি এক অদৃষ্টপূর্ব প্রণয়বন্ধনে যে গ্রথিত করিয়াছিল, তাহা বলিয়া বুঝাইবার নহে। অন্তরঙ্গ, বহিরঙ্গ, সন্ন্যাসী, গৃহী, জ্ঞানী, ভক্ত – এইসকল বিভিন্ন শ্রেণীর বিকাশ ভক্তদিগের ভিতর এখানেই স্পষ্টীকৃত হয়; আবার ইহারা সকলেই যে এক পরিবারের অন্তর্গত, এ ধারণার সুদৃঢ় ভিত্তি এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার কত লোকই যে এখানে আসিয়া ধর্মালোক অপরোক্ষানুভব করিয়া ধন্য হইয়া গিয়াছিল, তাহার ইয়ত্তা কে করিবে? এখানেই শ্রীমান নরেন্দ্রনাথের সাধনায় নির্বিকল্পসমাধি-অনুভব, এখানেই নরেন্দ্রপ্রমুখ দ্বাদশজন বালকভক্তের ঠাকুরের শ্রীহস্ত হইতে গৈরিকবসন-লাভ, আবার এখানেই ১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি অপরাহ্ণে (বেলা তিনটা হইতে চারটার ভিতর) উদ্যানপথে শেষদিন পরিভ্রমণ করিতে নামিয়া ভক্তবৃন্দের সকলকে দেখিয়া ঠাকুরের অপূর্ব ভাবান্তর উপস্থিত হয় এবং ‘আমি আর তোমাদের কি বলব, তোমাদের চৈতন্য হোক!’ বলিয়া সকলের বক্ষ শ্রীহস্ত দ্বারা স্পর্শ করিয়া তিনি তাহাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ ধর্মশক্তি সঞ্চারিত করেন! দক্ষিণেশ্বরে যেরূপ, এখানেও সেইরূপ স্ত্রী-পুরুষের নিত্য জনতা হইত! এখানেও শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী ঠাকুরের আহার্য প্রস্তুত করা ইত্যাদি সেবায় নিত্য নিযুক্তা থাকিতেন এবং গোপালের মা প্রমুখ ঠাকুরের সকল স্ত্রী-ভক্তেরা তাঁহার নিকট আসিয়া ঠাকুরের ও তদীয় ভক্তগণের সেবায় সহায়তা করিতেন – কেহ কেহ রাত্রিযাপনও করিয়া যাইতেন। অতএব কাশীপুর উদ্যানে ভক্তদিগের অপূর্ব মেলার কথা অনুধাবন করিয়া আমাদের মনে হয়, জগদম্বা এক অদৃষ্টপূর্ব মহদুদ্দেশ্য সংসাধিত করিবেন বলিয়াই ঠাকুরের দেবশরীরে ব্যাধির সঞ্চার করিয়াছিলেন। এখানে ঠাকুরের নিত্যনূতন লীলা ও নূতন নূতন ভক্তসকলের সমাগম দেখিয়া এবং ঠাকুরের সদানন্দমূর্তি ও নিত্য অদৃষ্টপূর্ব শক্তিপ্রকাশ দর্শন করিয়া অনেক পুরাতন ভক্তেরও মনে হইয়াছিল, ঠাকুর লোকহিতের নিমিত্ত একটা রোগের ভান করিয়া রহিয়াছেন মাত্র – ইচ্ছামাত্রেই ঐ রোগ দূরীভূত করিয়া পূর্বের ন্যায় সুস্থ হইবেন।

* * *

কাশীপুরের উদ্যান – ঠাকুরের বার্লি, ভার্মিসেলি, সুজি প্রভৃতি তরল পদার্থ আহারে দিন কাটিতেছে। একদিন তিনি পালোদেওয়া ক্ষীর – যেমন কলিকাতায় নিমন্ত্রণবাটীতে খাইতে পাওয়া যায় – খাইতে ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন – কেহই তাহাতে ওজর-আপত্তি করিল না, কারণ দুধে সিদ্ধ সুজি বা বার্লি যখন খাওয়া চলিতেছে, তখন পালোমিশ্রিত ক্ষীর একটু খাইলে আর অসুখ অধিক কি বাড়িবে? ডাক্তারেরাও অমত করিলেন না। অতএব স্থির হইল – শ্রীযুত যোগীন্দ্র (যোগানন্দ স্বামীজী) আগামীকাল ভোরে কলিকাতা গিয়া ঐরূপ ক্ষীর একখানা কিনিয়া আনিবেন!

যোগীন্দ্র বা যোগেন ঠিক সময়ে রওনা হইলেন। পথে যাইতে যাইতে ভাবিতে লাগিলেন, ‘বাজারের ক্ষীরে পালো ছাড়া আরো কত কি ভেজাল মিশানো থাকে – ঠাকুরের খেলে অসুখ বাড়বে না তো?’ ভক্তদের সকলেই ঠাকুরকে প্রাণের প্রাণস্বরূপে দেখিতেন, কাজেই সকলের মনেই ঠাকুরের অসুখ হওয়া অবধি ঐ এক চিন্তাই সর্বদা থাকিত। যোগেনের সেইজন্যই নিশ্চয় ঐরূপ চিন্তার উদয় হইল। আবার ভাবিলেন – কিন্তু ঠাকুরকে তো ঐ কথা জিজ্ঞাসা করিয়া আসেন নাই, অতএব কোন ভক্তের দ্বারা ঐরূপ ক্ষীর তৈয়ার করিয়া লইয়া যাইলে তিনি তো বিরক্ত হইবেন না? সাত-পাঁচ ভাবিতে ভাবিতে যোগানন্দ বাগবাজারে বলরামবাবুর বাটীতে পৌঁছিলেন এবং আসার কারণ জিজ্ঞাসায় সকল কথা বলিলেন। সেখানে ভক্তেরা সকলে বলিলেন, ‘বাজারের ক্ষীর কেন? আমরাই পালো দিয়ে ক্ষীর করে দিচ্ছি; কিন্তু এ-বেলা তো নিয়ে যাওয়া হবে না, কারণ করতে দেরি হবে। অতএব তুমি এ-বেলা এখানে খাওয়া-দাওয়া কর, ইতোমধ্যে ক্ষীর তৈয়ার হয়ে যাবে। বেলা তিনটার সময় নিয়ে যেও।’ যোগেনও ঐ কথায় সম্মত হইয়া ঐরূপ করিলেন এবং বেলা প্রায় চারিটার সময় ক্ষীর লইয়া কাশীপুরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

এদিকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব মধ্যাহ্নেই ক্ষীর খাইবেন বলিয়া অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়া শেষে যাহা খাইতেন তাহাই খাইলেন। পরে যোগেন আসিয়া পৌছিলে সকল কথা শুনিয়া বিশেষ বিরক্ত হইয়া যোগেনকে বলিলেন, “তোকে বাজার থেকে কিনে আনতে বলা হলো, বাজারের ক্ষীর খাবার ইচ্ছা, তুই কেন ভক্তদের বাড়ি গিয়ে তাদের কষ্ট দিয়ে এইরূপে ক্ষীর নিয়ে এলি? তারপর ও ক্ষীর ঘন, গুরুপাক, ও কি খাওয়া চলবে – ও আমি খাব না।” বাস্তবিকই তিনি তাহা স্পর্শও করিলেন না – শ্রীশ্রীমাকে উহা সমস্ত গোপালের মাকে খাওয়াইতে বলিয়া বলিলেন, “ভক্তের দেওয়া জিনিস, ওর ভেতর গোপাল আছে, ও খেলেই আমার খাওয়া হবে।”

গোপালের মার বিশ্বরূপ-দর্শন

ঠাকুরের অদর্শন হইলে গোপালের মার আর অশান্তির সীমা রহিল না। অনেকদিন আর কামারহাটি ছাড়িয়া কোথাও যান নাই। একলা নির্জনেই থাকিতেন। পরে পুনরায় পূর্বের ন্যায় ঠাকুরের দর্শনাদি পাইয়া সে ভাবটার শান্তি হইল। ঠাকুরের অদর্শনের পরেও গোপালের মার ঐরূপ দর্শনাদির কথা আমরা অনেক শুনিয়াছি। তন্মধ্যে একবার গঙ্গার অপর পারে মাহেশের রথযাত্রা দেখিতে যাইয়া সর্বভূতে শ্রীগোপালের দর্শন পাইয়া তাঁহার বিশেষ আনন্দ হয়। তিনি বলিতেন – তখন রথ, রথের উপর শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব, যাহারা রথ টানিতেছে, সেই অপার জনসঙ্ঘ সকলই দেখেন তাঁহার গোপাল! – ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করিয়া রহিয়াছেন মাত্র! এইরূপে শ্রীভগবানের বিশ্বরূপের দর্শনাভাস পাইয়া ভাবে প্রেমে উন্মত্ত হইয়া তাঁহার আর বাহ্যজ্ঞান ছিল না। জনৈকা স্ত্রী-বন্ধুর নিকট তিনি নিজে উহা বলিবার সময় বলিয়াছিলেন, “তখন আর আমাতে আমি ছিলাম না – নেচে হেসে কুরুক্ষেত্র করেছিলাম।”

বরাহনগর মঠে গোপালের মা

এখন হইতে প্রাণে কিছুমাত্র অশান্তি হইলেই তিনি বরাহনগর মঠে ঠাকুরের সন্ন্যাসী ভক্তদের নিকট আসিতেন এবং আসিলেই শান্তি পাইতেন। যেদিন তিনি মঠে আসিতেন সেদিন সন্ন্যাসী ভক্তেরা তাঁহাকেই ঠাকুরকে ভোগ দিয়া খাওয়াইতে অনুরোধ করিতেন। গোপালের মাও সানন্দে দুই-একখানা তরকারি নিজ হাতে রাঁধিয়া ঠাকুরকে খাওয়াইতেন। মঠ যখন আলমবাজারে ও পরে গঙ্গার অপর পারে নীলাম্বরবাবুর বাটীতে উঠাইয়া লইয়া যাওয়া হয়, তখনও গোপালের মা এইরূপে ঐ ঐ স্থানে উপস্থিত হইয়া সমস্ত দিন থাকিয়া কখনও কখনও আনন্দ করিতেন – কখনও এক-আধদিন রাত্রিযাপনও করিয়াছিলেন।

পাশ্চাত্য মহিলাগণ-সঙ্গে গোপালের মা

শ্রীবিবেকানন্দ স্বামীজীর বিলাত হইতে প্রত্যাগমনের পর সারা (Mrs. Sara C. Bull), জয়া1 (Miss J. MacLeod) ও নিবেদিতা যখন ভারতে আসেন তখন তাঁহারা একদিন গোপালের মাকে কামারহাটিতে দর্শন করিতে যান এবং তাঁহার কথায় ও আদরে বিশেষ আপ্যায়িতা হন! আমাদের মনে আছে, গোপালের মা সেদিন তাঁহার গোপালকে তাঁহাদের ভিতরেও অবস্থিত দেখিয়া তাঁহাদের দাড়ি ধরিয়া সস্নেহে চুম্বন করেন, আপনার বিছানায় সাদরে বসাইয়া মুড়ি, নারিকেল-লাড়ু প্রভৃতি যাহা ঘরে ছিল তাহা খাইতে দেন ও জিজ্ঞাসিতা হইয়া তাঁহার দর্শনাদির কথা তাঁহাদিগকে কিছু কিছু বলেন। তাঁহারাও উহা সানন্দে ভক্ষণ ও তাঁহার ঐসকল কথা শ্রবণ করিয়া মোহিত হন এবং ঐ মুড়ির কিছু আমেরিকায় লইয়া যাইবেন বলিয়া চাহিয়া লন।


1. পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী ইঁহাদের ঐ নামে ডাকিতেন এবং ইঁহাদের সরলতা, ভক্তি, বিশ্বাসাদি দেখিয়া বিশেষ প্রীতা হইয়াছিলেন।

সিস্টার নিবেদিতার ভবনে গোপালের মা

গোপালের মার অদ্ভুত জীবনকথা শুনিয়া সিস্টার নিবেদিতা এতই মোহিতা হন যে, ১৯০৪ খ্রীষ্টাব্দে যখন গোপালের মার শরীর অসুস্থ ও বিশেষ অপটু হওয়ায় তাঁহাকে বাগবাজারে বলরামবাবুর বাটীতে আনা হয়, তখন তাঁহাকে বাগবাজারস্থ নিজ ভবনে (১৭ নং বসুপাড়া) লইয়া রাখিবার জন্য বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। গোপালের মাও তাঁহার আগ্রহে স্বীকৃতা হইয়া তথায় গমন করেন; কারণ পূর্বেই বলিয়াছি তাঁহার ধীরে ধীরে সকল বিষয়েরই দ্বিধা শ্রীগোপালজী দূরীভূত করিয়া দেন। উহারই দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে আর একটি কথা মনে পড়িতেছে – দক্ষিণেশ্বরে শ্রীযুত নরেন্দ্রনাথ একদিন মা কালীর প্রসাদী পাঁঠা এক বাটি খাইয়া হস্ত ধৌত করিতে যাইলে ঠাকুর জনৈকা স্ত্রী-ভক্তকে ঐ স্থান পরিষ্কার করিতে বলেন। গোপালের মা তথায় দাঁড়াইয়াছিলেন। ঠাকুরের ঐ কথা শুনিবামাত্র তিনি (গোপালের মা) ঐসকল হাড়গোড়-উচ্ছিষ্টাদি তৎক্ষণাৎ নিজহস্তে সরাইয়া ঐ স্থান পরিষ্কার করেন! ঠাকুর উহা দেখিয়া আনন্দে পূর্বোক্ত স্ত্রী-ভক্তকে বলেন, “দেখ, দেখ, দিন দিন কি উদার হয়ে যাচ্ছে!”

গোপালের মার শরীরত্যাগ

সিস্টার নিবেদিতার ভবনে এখন হইতে গোপালের মা বাস করিতে লাগিলেন। স্বামীজীর মানস-কন্যা নিবেদিতাও মাতৃনির্বিশেষে তাঁহার সেবা করিতে লাগিলেন। তাঁহার আহারের বন্দোবস্ত নিকটবর্তী কোন ব্রাহ্মণ-পরিবারের মধ্যে করিয়া দেওয়া হইল। আহারের সময় গোপালের মা তথায় যাইয়া দুটি ভাত খাইয়া আসিতেন এবং রাত্রে লুচি ইত্যাদি ঐ ব্রাহ্মণ-পরিবারের কেহ স্বয়ং গোপালের মার ঘরে পৌঁছাইয়া দিতেন। এইরূপে প্রায় দুই বৎসর বাস করিয়া গোপালের মা গঙ্গাগর্ভে শরীরত্যাগ করেন। তাঁহাকে তীরস্থ করিবার সময় নিবেদিতা পুষ্প, চন্দন, মাল্যাদি দিয়া তাঁহার শয্যাদি স্বহস্তে সুন্দরভাবে ঢাকিয়া সাজাইয়া দেন, একদল কীর্তনীয়া আনয়ন করেন এবং স্বয়ং অনাবৃতপদে সাশ্রুনয়নে সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গাতীর পর্যন্ত গমন করিয়া যে দুই দিন গঙ্গাতীরে গোপালের মা জীবিতা ছিলেন, সেই দুই দিন তথায়ই রাত্রিযাপন করেন। ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের ৮ জুলাই অথবা সন ১৩১৩ সালের ২৪ আষাঢ় ব্রাহ্মমুহূর্তে উদীয়মান সূর্যের রক্তিমাভায় যখন পূর্বগগন রঞ্জিত হইয়া অপূর্ব শ্রী ধারণ করিতেছে এবং নীলাম্বরতলে দুই-চারিটি ক্ষীণপ্রভা তারকা ক্ষীণজ্যোতি চক্ষুর ন্যায় পৃথিবীপানে দৃষ্টিপাত করিয়া রহিয়াছে, যখন শৈলসুতা ভাগীরথী জোয়ারে পূর্ণা হইয়া ধবল তরঙ্গে দুই কূল প্লাবিত করিয়া মৃদুমধুর নাদে প্রবাহিতা, সেই সময়ে গোপালের মার শরীর সেই তরঙ্গে অর্ধনিমজ্জিতাবস্থায় স্থাপিত করা হইল এবং তাঁহার পূত প্রাণপঞ্চ শ্রীভগবানের অভয়পদে মিলিত হইল ও তিনি অভয়ধাম প্রাপ্তা হইলেন।

আত্মীয়েরা কেহ নিকটে না থাকায় বেলুড়মঠের জনৈক ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচারীই গোপালের মার মৃত শরীরের সৎকার করিয়া দ্বাদশ দিন নিয়মরক্ষা করিলেন।

গোপালের মার কথার উপসংহার

শোকসন্তপ্তহৃদয়া সিস্টার নিবেদিতা ঐ দ্বাদশ দিন গত হইলে গোপালের মা-র পরিচিতা পল্লীস্থ অনেকগুলি স্ত্রীলোককে নিজ স্কুলবাটীতে নিমন্ত্রণ করিয়া আনাইয়া কীর্তন ও উৎসবাদির বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন।

গোপালের মা শ্রীরামকৃষ্ণদেবের যে ছবিখানি এতদিন পূজা করিয়াছিলেন, তাহা বেলুড়মঠে ঠাকুরঘরে রাখিবার জন্য দিয়া যান এবং ঐ ঠাকুরসেবার জন্য দুইশত টাকাও ঐ সঙ্গে দিয়া গিয়াছিলেন।

শরীরত্যাগের দশ-বার বৎসর পূর্ব হইতে তিনি আপনাকে সন্ন্যাসিনী বলিয়া গণ্য করিতেন এবং সর্বদা গৈরিকবসনই ধারণ করিতেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *