৪.৫ ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ – ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের নবযাত্রা

চতুর্থ খণ্ড – পঞ্চম অধ্যায়: ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ – ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের নবযাত্রা

ঠাকুরে দেব ও মানব উভয় ভাবের সম্মিলন

ক্ষিপ্রং ভবতি ধর্মাত্মা শশ্বচ্ছান্তিং নিগচ্ছতি।
কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি॥
– গীতা, ৯/৩১

দিব্যভাবমুখে অবস্থিত শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অদ্ভুত চরিত্র কিঞ্চিন্মাত্রও বুঝিতে হইলে ভক্তসঙ্গে তাঁহাকে দেখিতে হইবে। কিরূপে কতভাবে ঠাকুর তাঁহার নানা প্রকৃতির ভক্তবৃন্দের সহিত প্রতিদিন উঠা-বসা, কথাবার্তা, হাসি-তামাশা – ভাব ও সমাধিতে থাকিতেন, তাহা শুনিতে ও তলাইয়া বুঝিতে হইবে, তবেই তাঁহার ঐ ভাবের লীলা একটু-আধটু বুঝিতে পারা যাইবে। অতএব ভক্তগণকে লইয়া ঠাকুরের ঐরূপ কয়েকদিনের লীলাকথাই আমরা এখন পাঠককে উপহার দিব।

আমরা যতদূর দেখিয়াছি, এ অলোকসামান্য মহাপুরুষের অতি সামান্য চেষ্টাদিও উদ্দেশ্যবিহীন বা অর্থশূন্য ছিল না। এমন অপূর্ব দেব- ও মানব-ভাবের একত্র সম্মিলন আর কোথাও দেখা দুর্লভ – অন্ততঃ পৃথিবীর নানা স্থানে এই পঁচিশ বৎসর ধরিয়া ঘুরিয়া আমাদের চক্ষে আর একটিও পড়ে নাই! কথায় বলে – ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না।’ ঠাকুরের সম্বন্ধে আমাদের অনেকের ভাগ্যে তাহাই হইয়াছে। গলার অসুখের চিকিৎসা করাইবার জন্য ভক্তেরা যখন ঠাকুরকে কিছুদিন কলিকাতায় শ্যামপুকুরে আনিয়া রাখেন, তখন শ্রীযুত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী একদিন তাঁহাকে দর্শন করিতে আসিয়া আমাদিগকে নিম্নলিখিত কথাগুলি বলেন।

শ্রীযুত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর দর্শন

শ্রীযুত বিজয় ইহার কিছুদিন পূর্বে ঢাকায় অবস্থানকালে একদিন নিজের ঘরে খিল দিয়া বসিয়া চিন্তা করিতে করিতে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাক্ষাৎ দর্শন পান এবং উহা আপনার মাথার খেয়াল কি না জানিবার জন্য সম্মুখাবস্থিত দৃষ্ট মূর্তির শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি বহুক্ষণ ধরিয়া স্বহস্তে টিপিয়া টিপিয়া দেখিয়া যাচাইয়া লন – সে কথাও ঐদিন ঠাকুরের ও আমাদের সম্মুখে তিনি মুক্তকণ্ঠে বলেন।

শ্রীযুত বিজয় – দেশ-বিদেশ পাহাড়-পর্বত ঘুরে ফিরে অনেক সাধু-মহাত্মা দেখলাম, কিন্তু (ঠাকুরকে দেখাইয়া) এমনটি আর কোথাও দেখলাম না; এখানে যে ভাবের পূর্ণ প্রকাশ দেখছি, তারই কোথাও দু-আনা, কোথাও এক-আনা, কোথাও এক-পাই, কোথাও আধ-পাই মাত্র; চার-আনাও কোন জায়গায় দেখলাম না।

ঠাকুর – (মৃদু মৃদু হাসিতে হাসিতে আমাদিগকে) বলে কি!

শ্রীযুত বিজয় – (ঠাকুরকে) সেদিন ঢাকাতে যেরূপ দেখেছি, তাতে আপনি ‘না’ বললে আমি আর শুনি না, অতি সহজ হয়েই আপনি যত গোল করেছেন। কলকাতার পাশেই দক্ষিণেশ্বর; যখনি ইচ্ছা তখনি এসে আপনাকে দর্শন করতে পারি। আসতে কোন কষ্ট নাই – নৌকা, গাড়ি যথেষ্ট; ঘরের পাশে এরূপে এত সহজে আপনাকে পাওয়া যায় বলেই আমরা আপনাকে বুঝলাম না। যদি কোন পাহাড়ের চুড়োয় বসে থাকতেন, আর পথ হেঁটে অনাহারে গাছের শিকড় ধরে উঠে আপনার দর্শন পাওয়া যেত, তাহলে আমরা আপনার কদর করতাম; এখন মনে করি ঘরের পাশেই যখন এইরকম, তখন না জানি বাহিরে দূর-দূরান্তরে আরও কত ভাল ভাল সব আছে; তাই আপনাকে ফেলে ছুটোছুটি করে মরি, আর কি!

ঠাকুরের ভক্তদের সহিত অলৌকিক আচরণে তাহাদের মনে কি হইত

বাস্তবিকই ঐরূপ! করুণাময় ঠাকুর, তাঁহার নিকট যাহারা আসিত, তাহাদের প্রায় সকলকেই আপনার বলিয়া গ্রহণ করিতেন, একবার গ্রহণ করিলে তাহারা ছাড়াছাড়ি করিলেও আর ছাড়িতেন না এবং কখনও কোমল, কখনও কঠোর হস্তে তাহাদের জন্মজন্মার্জিত সংস্কার-রাশিকে শুষ্ক, দগ্ধ করিয়া নিজের নূতন নূতন ভাবে অদৃষ্টপূর্ব, অমৃতময় ছাঁচে নূতন করিয়া গঠন করিয়া তাহাদের চিরশান্তির অধিকারী করিতেন! ভক্তেরা আপন আপন জীবন-কথা খুলিয়া বলিলে, এ কথার আর সন্দেহ থাকিবে না। সেজন্য দেখিতে পাই, শ্রীযুত নরেন্দ্রনাথ স্বগৃহে অবস্থানকালে কোন সময়ে সাংসারিক দুঃখকষ্টে অভিভূত হইয়া এবং এতদিন ধরিয়া শ্রীভগবানের শরণাপন্ন থাকিয়াও তাঁহার সাক্ষাৎকার পাইলাম না, ঠাকুর কিছুই করিয়া দিলেন না – ভাবিয়া অভিমানে লুকাইয়া গৃহত্যাগে উদ্যত হইলে, ঠাকুর তখন তাঁহাকে তাহা করিতে দিতেছেন না। দৈবশক্তি-প্রভাবে তাঁহার উদ্দেশ্য জানিতে পারিয়া বিশেষ অনুরোধ করিয়া তাঁহাকে সেদিন দক্ষিণেশ্বরে সঙ্গে আনিয়াছেন এবং পরে তাঁহার অঙ্গ স্পর্শ করিয়া ভাবাবেশে গান ধরিয়াছেন – “কথা কহিতেও ডরাই, না কহিতেও ডরাই; আমার মনে সন্দ হয়, বুঝি তোমায় হারাই – হা, রাই!” এবং নানা প্রকারে বুঝাইয়া সুঝাইয়া তাঁহাকে নিজের কাছে রাখিতেছেন। আবার দেখি – ‘বকল্মা’-লাভে কৃতার্থ হইয়াও যখন শ্রীযুত গিরিশ পূর্বসংস্কারের প্রতাপ স্মরণ করিয়া নিশ্চিন্ত ও ভয়শূন্য হইতে পারিতেছেন না, তখন তাঁহাকে অভয় দিয়া বলিতেছেন, “এ কি ঢোঁড়া সাপে তোকে ধরেছে রে শালা? জাত সাপে ধরেছে – পালিয়ে বাসায় গেলেও মরে থাকতে হবে! দেখিস নে? ব্যাঙগুলোকে যখন ঢোঁড়া সাপে ধরে, তখন ক্যাঁ-ক্যাঁ-ক্যাঁ-ক্যাঁ করে হাজার ডাক ডেকে তবে ঠাণ্ডা হয় (মরে যায়), কোনটা বা ছাড়িয়ে পালিয়েও যায়; কিন্তু যখন কেউটে গোখরোতে ধরে তখন ক্যাঁ-ক্যাঁ-ক্যাঁ তিন ডাক ডেকেই আর ডাকতে হয় না, সব ঠাণ্ডা। যদি কোনটা দৈবাৎ পালিয়েও যায় তো গর্তে ঢুকে মরে থাকে। – এখানকার সেইরূপ জানবি!” কিন্তু কে তখন ঠাকুরের ঐসব কথা ও ব্যবহারের মর্ম বুঝে? সকলেই ভাবিত ঠাকুরের মতো পুরুষ বুঝি সর্বত্রই বর্তমান। ঠাকুর যেমন সকলের সকল আবদার সহিয়া বরাভয়হস্তে সকলের দ্বারে অযাচিত হইয়া ফিরিতেছেন, সর্বত্র বুঝি এইরূপ। করুণাময় ঠাকুরের স্নেহের অঞ্চলে আবৃত থাকিয়া ভক্তদের তখন জোর কত, আবদার কত, অভিমানই বা কত! প্রায় সকলেরই মনে হইত ধর্মকর্মটা অতি সোজা সহজ জিনিস। যখনি ধর্মরাজ্যের যে ভাব দর্শনাদি লাভ করিতে ইচ্ছা হইবে, তখনি তাহা পাইব – নিশ্চিত। ঠাকুরকে একটু ব্যাকুল হইয়া জোর করিয়া ধরিলেই হইল – ঠাকুর তখনি উহা অনায়াসে স্পর্শ, বাক্য বা কেবলমাত্র ইচ্ছা দ্বারাই লাভ করাইয়া দিবেন! ঐ বিষয়ে কতই বা দৃষ্টান্ত দিব! লেখাপড়ার ভিতর দিয়া কটাই বা বলা যায়!

স্বামী প্রেমানন্দের ভাবসমাধি-লাভের ইচ্ছায় ঠাকুরকে ধরায় তাঁহার ভাবনা ও দর্শন

শ্রীযুত বাবুরামের (স্বামী প্রেমানন্দের) ইচ্ছা হইল, তাঁহার ভাবসমাধি হউক। ঠাকুরকে যাইয়া কান্নাকাটি করিয়া বিশেষভাবে ধরিলেন – “আপনি করে দিন।” ঠাকুর তাঁহাকে শান্ত করিয়া বলিলেন, “আচ্ছা, মাকে বলব; আমার ইচ্ছাতে কি হয় রে?” – ইত্যাদি। কিন্তু ঠাকুরের সে কথা কে শোনে? বাবুরামের ঐ এক কথা – ‘আপনি করে দিন।’ এইরূপ আবদারের কয়েকদিন পরেই শ্রীযুত বাবুরামকে কার্যবশতঃ নিজেদের বাটী আঁটপুরে যাইতে হইল। সেটা ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে। এদিকে ঠাকুর তো ভাবিয়া আকুল – কি করিয়া বাবুরামের ভাবসমাধি হইবে! একে বলেন, ওকে বলেন, “বাবুরাম ঢের করে কাঁদাকাটা করে গেছে যেন তার ভাব হয় – কি হবে? যদি না হয়, তবে সে আর এখানকার (আমার) কথা মানবেনি।” তারপর মাকে (শ্রীশ্রীজগদম্বাকে) বলিলেন, “মা, বাবুরামের যাতে একটু ভাবটাব হয়, তাই করে দে।” মা বলিলেন, “ওর ভাব হবে না; ওর জ্ঞান হবে।” ঠাকুরের শ্রীশ্রীজগদম্বার ঐ বাণী শুনিয়া আবার ভাবনা। আমাদের কাহারও কাহারও কাছে বলিলেনও – “তাইতো বাবুরামের কথা মাকে বললুম, তা মা বললে, ‘ওর ভাব হবেনি, ওর জ্ঞান হবে’; তা যাই হোক, একটা কিছু হয়ে তার মনে শান্তি হলেই হলো; তার জন্যে মনটা কেমন করচে – অনেক কাঁদাকাটা করে গেছে” – ইত্যাদি। আহা, সে কতই ভাবনা, যাহাতে বাবুরামের কোনরূপে সাক্ষাৎ ধর্মোপলব্ধি হয়! আবার সেই ভাবনার কথা বলিবার সময় ঠাকুরের কেমন বলা – “এটা না হলে ও (বাবুরাম) আর মানবেনি।” – যেন তাহার মানা-না-মানার উপর ঠাকুরের সকলই নির্ভর করিতেছে!

ঠাকুরের ভক্তদের সম্বন্ধে এত ভাবনা কেন তাহা বুঝাইয়া দেওয়া। হাজরার ঠাকুরকে ভাবিতে বারণ করায় তাঁহার দর্শন ও উত্তর

আবার কখনও কখনও বলা হইত – “আচ্ছা, বল দেখি, এই সব এদের (বালক ভক্তদিগকে লক্ষ্য করিয়া) জন্যে এত ভাবি কেন? এর কি হলো, ওর কি হলো না, এত সব ভাবনা হয় কেন? এরা তো সব ইস্কুল বয় (School boy); কিছুই নেই – এক পয়সার বাতাসা দিয়ে যে আমার খবরটা নেবে, সে শক্তি নেই; তবু এদের জন্যে এত ভাবনা কেন? কেউ যদি দুদিন না এসেচে তো অমনি তার জন্যে প্রাণ আঁচোড়-পাঁচোড় করে, তার খবরটা জানতে ইচ্ছা হয় – এ কেন?” জিজ্ঞাসিত বালক হয়তো বলিল, “তা কি জানি মশাই কেন হয়। তবে তাদের মঙ্গলের জন্যই হয়।”

ঠাকুর – কি জানিস, এরা সব শুদ্ধসত্ত্ব; কাম-কাঞ্চন এদের এখনও স্পর্শ করেনি, এরা যদি ভগবানে মন দেয় তো তাঁকে লাভ করতে পারবে, এই জন্যে! এখানকার (আমার) যেন গাঁজাখোরের স্বভাব; গাঁজাখোরের যেমন একলা খেয়ে তৃপ্তি হয় না – এক টান টেনেই কলকেটা অপরের হাতে দেওয়া চাই, তবে নেশা জমে – সেই রকম। তবু আগে আগে নরেন্দরের জন্যে যেমনটা হতো, তার মতো এদের কারুর জন্য হয় না। দুদিন যদি (নরেন্দ্রনাথ) আসতে দেরি করেছে তো বুকের ভিতরটায় যেন গামছায় মোচড় দিত! লোকে কি বলবে বলে ঝাউতলায়1 গিয়ে ডাক ছেড়ে কাঁদতুম। হাজরা2 (এক সময়ে) বলেছিল, ‘ও কি তোমার স্বভাব? তোমার পরমহংস অবস্থা; তুমি সর্বদা তাঁতে (শ্রীভগবানে) মন দিয়ে সমাধি লাগিয়ে তাঁর সঙ্গে এক হয়ে থাকবে; তা না, নরেন্দ্র এল না কেন, ভবনাথের কি হবে – এ সব ভাব কেন?’ শুনে ভাবলুম – ঠিক বলেছে, আর অমনটা করা হবেনি; তারপর ঝাউতলা থেকে আসচি আর (শ্রীশ্রীজগদম্বা) দেখাচ্ছে কি, যেন কলকাতাটা সামনে, আর লোকগুলো সব কাম-কাঞ্চনে দিনরাত ডুবে রয়েছে ও যন্ত্রণা ভোগ কচ্চে। দেখে দয়া এল। মনে হলো, লক্ষগুণ কষ্ট পেয়েও যদি এদের মঙ্গল হয়, উদ্ধার হয় তো তা করব। তখন ফিরে এসে হাজরাকে বললুম – ‘বেশ করেছি, এদের জন্যে সব ভেবেছি, তোর কি রে শালা?’


1. রানী রাসমণির কালীবাটীর উত্তরাংশে অবস্থিত ঝাউবৃক্ষগুলি। উদ্যানের ঐ অংশ শৌচাদির জন্য নির্দিষ্ট থাকায় ঐ দিকে কেহ অন্য কোন কারণে যাইত না।
2. শ্রীযুত প্রতাপচন্দ্র হাজরা।

স্বামী বিবেকানন্দের ঠাকুরকে ঐ বিষয় বারণ করায় তাঁহার দর্শন ও উত্তর

“নরেন্দর একবার বলেছিল, ‘তুমি অত নরেন্দর নরেন্দর কর কেন? অত নরেন্দর নরেন্দর করলে তোমায় নরেন্দ্রের মতো হতে হবে। ভরত রাজা হরিণ ভাবতে ভাবতে হরিণ হয়েছিল।’ নরেন্দরের কথায় খুব বিশ্বাস কি না? শুনে ভয় হলো! মাকে বললুম। মা বললে, ‘ও ছেলেমানুষ; ওর কথা শুনিস কেন? ওর ভেতর নারায়ণকে দেখতে পাস, তাই ওর দিকে টান হয়!’ শুনে তখন বাঁচলুম! নরেন্দরকে এসে বললুম, ‘তোর কথা আমি মানি না; মা বলেছে তোর ভেতর নারায়ণকে দেখি বলেই তোর উপর টান হয়, যেদিন তা না দেখতে পাব, সেদিন থেকে তোর মুখও দেখব না রে শালা’।” এইরূপে অদ্ভুত ঠাকুরের অদ্ভুত ব্যবহারের প্রত্যেকটিরই অর্থ ছিল, আর আমরা তাহা না বুঝিয়া বিপরীত ভাবিলে পাছে আমাদের অকল্যাণ হয়, সেজন্য এইরূপে বুঝাইয়া দেওয়া ছিল।

ঠাকুরের গুণী ও মানী ব্যক্তিকে সম্মান করা – উহার কারণ

গুণীর গুণের কদর, মানীর মানরক্ষা ঠাকুরকে সর্বদাই করিতে দেখিয়াছি। বলিতেন, “ওরে, মানীকে মান না দিলে ভগবান রুষ্ট হন; তাঁর (শ্রীভগবানের) শক্তিতেই তো তারা বড় হয়েছে, তিনিই তো তাদের বড় করেছেন – তাদের অবজ্ঞা করলে তাঁকে (শ্রীভগবানকে) অবজ্ঞা করা হয়।” তাই দেখিতে পাই, যখনই ঠাকুর কোথাও কোন বিশেষ গুণী পুরুষের খবর পাইতেন, অমনি তাঁহাকে কোন-না-কোন উপায়ে দর্শন করিতে ব্যস্ত হইতেন। উক্ত পুরুষ যদি তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইতেন, তাহা হইলে তো কথাই নাই, নতুবা স্বয়ং তাঁহার নিকট অনাহূত হইয়াও গমন করিয়া তাঁহাকে দর্শন, প্রণাম ও আলাপ করিয়া আসিতেন। বর্ধমানরাজের সভাপণ্ডিত পদ্মলোচন, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কাশীধামের প্রসিদ্ধ বীণকার মহেশ, শ্রীবৃন্দাবনে সখীভাবে ভাবিতা গঙ্গামাতা, ভক্তপ্রবর কেশব সেন – ঐরূপ আরও কত লোকেরই নাম না উল্লেখ করা যাইতে পারে – ইঁহাদের প্রত্যেকের বিশেষ বিশেষ গুণের কথা শুনিয়া দর্শন করিবার জন্য অনুসন্ধান করিয়া ঠাকুর স্বয়ং উঁহাদের দ্বারে উপস্থিত হইয়াছিলেন।

ঠাকুর অভিমানরহিত হইবার জন্য কতদূর করিয়াছিলেন

অবশ্য ঠাকুরের ঐরূপে অযাচিত হইয়া কাহারও দ্বারে উপস্থিত হওয়াটা কিছু আশ্চর্যের বিষয় নহে, কারণ ‘আমি এত বড়লোক, আমি অপরের নিকট এইরূপে যাইলে খেলো হইতে হইবে, মর্যাদাহানি হইবে’ – এ সব ভাব তো ঠাকুরের মনে কখনও উদিত হইত না। অহঙ্কার অভিমানটাকে তিনি যে একেবারে ভস্ম করিয়া গঙ্গায় বিসর্জন দিয়াছিলেন! কালীবাটীতে কাঙালী-ভোজনের পর কাঙালীদের উচ্ছিষ্ট পাতাগুলি মাথায় করিয়া বহিয়া বাহিরে ফেলিয়া আসিয়া স্বহস্তে ঐ স্থান পরিষ্কার করিয়াছিলেন; সাক্ষাৎ নারায়ণজ্ঞানে কাঙালীদের উচ্ছিষ্ট পর্যন্ত কোন সময়ে গ্রহণ করিয়াছিলেন; কালীবাটীর চাকর-বাকরদিগের শৌচাদির জন্য যে স্থান নির্দিষ্ট ছিল, তাহাও এক সময়ে স্বহস্তে ধৌত করিয়া নিজ কেশ দ্বারা মুছিতে মুছিতে1 জগদম্বার নিকটে প্রার্থনা করিয়াছিলেন, ‘মা, উহাদের চাইতে বড় এ ভাব আমার যেন কখনও না হয়!’ তাই ঠাকুরের জীবনের অদ্ভুত নিরভিমানতা দেখিলেও আমাদের বিস্ময়ের উদয় হয় না, কিন্তু অপর সাধারণের যদি এতটুকু অভিমান কম দেখি তো ‘কি আশ্চর্য’ বলিয়া উঠি! কারণ, ঠাকুর তো আর আমাদের এ সংসারের লোক ছিলেন না!


1. ঠাকুরের সাধনকালে নিজের শরীরের দিকে আদৌ দৃষ্টি না থাকায় মাথায় বড় বড় চুল হইয়াছিল ও ধূলি লাগিয়া উহা আপনা-আপনি জটা পাকাইয়া গিয়াছিল।

ঠাকুরের অভিমানরাহিত্যের দৃষ্টান্ত: কৈলাস ডাক্তার ও ত্রৈলোক্যবাবু সম্বন্ধীয় ঘটনা

ঠাকুর কালীবাটীর বাগানে কোঁচার খুঁটটি গলায় দিয়া বেড়াইতেছেন, জনৈক বাবু তাঁহাকে সামান্য মালী-জ্ঞানে বলিলেন, “ওহে, আমাকে ঐ ফুলগুলি তুলিয়া দাও তো।” ঠাকুরও দ্বিরুক্তি না করিয়া তদ্রূপ করিয়া দিয়া সে স্থান হইতে সরিয়া গেলেন! মথুরবাবুর পুত্র পরলোকগত ত্রৈলোক্যবাবু এক সময়ে ঠাকুরের ভাগিনেয় হৃদুর (হৃদয়রাম মুখোপাধ্যায়) উপর বিরক্ত হইয়া হৃদয়কে অন্যত্র গমন করিতে হুকুম করেন। সে সময় নাকি ঠাকুরেরও আর কালীবাটীতে থাকিবার আবশ্যকতা নাই – রাগের মাথায় তিনি এইরূপ ভাব অপরের নিকট প্রকাশ করেন। ঠাকুরের কানে ঐ কথা উঠিবামাত্র তিনি হাসিতে হাসিতে গামছাখানি কাঁধে ফেলিয়া তৎক্ষণাৎ সেখান হইতে যাইতে উদ্যত হইলেন। প্রায় গেট পর্যন্ত গিয়াছেন, এমন সময় ত্রৈলোক্যবাবু আবার অমঙ্গল-আশঙ্কায় ভীত হইয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন এবং ‘আপনাকে তো আমি যাইতে বলি নাই, আপনি কেন যাইতেছেন’, ইত্যাদি বলিয়া ঠাকুরকে ফিরিতে অনুরোধ করিলেন। ঠাকুরও যেন কিছুই হয় নাই, এরূপভাবে পূর্বের ন্যায় হাসিতে হাসিতে আপনার কক্ষে আসিয়া উপবেশন করিলেন!

বিষয়ী লোকের বিপরীত ব্যবহার

এরূপ আরও কত ঘটনার উল্লেখ করা যাইতে পারে। ঐসকল ব্যবহারে আমরা যত আশ্চর্য না হই, সংসারের অপর কেহ যদি অতটাও না করিয়া এতটুকু ঐরূপ কাজ করে তো একেবারে ধন্য ধন্য করি! কেন না, আমরা মুখে বলি আর নাই বলি মনের ভিতরে ভিতরে একেবারে ঠিক দিয়া রাখিয়াছি যে, সংসারে থাকিতে গেলেই ‘নিজের কোলে ঝোল টানিতে হইবে’, দুর্বলকে সবল হস্তে সরাইয়া নিজের পথ পরিষ্কার করিয়া লইতে হইবে, আপনার কথা ষোল কাহন করিয়া ডঙ্কা বাজাইতে হইবে, নিজের দুর্বলতাগুলি অপরের চক্ষুর অন্তরালে যত পারি লুকাইয়া রাখিতে হইবে, আর সরলভাবে ভগবানের বা মানুষের উপর ষোল আনা বিশ্বাস করিলে একেবারে ‘কাজের বার’ হইয়া ‘বয়ে’ যাইতে হইবে! হায় রে সংসার, তোমার আন্তর্জাতিক নীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি ও ব্যক্তিগত ধর্মনীতি – সর্বত্রই এইরূপ। তোমার ‘দিল্লীকা লাড্ডু’ যে খাইয়াছে সে তো পশ্চাত্তাপ করিতেছেই – যে না খাইয়াছে সেও তদ্রূপ করিতেছে।

ঠাকুরের প্রকট হইবার সময় ধর্মান্দোলন ও উহার কারণ

১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ। ঐ সময়ে ঠাকুরের বিশেষ প্রকট ভাব। তাঁহার অদ্ভুত আকর্ষণে তখন নিত্য কত নূতন নূতন লোক দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া তাঁহাকে দর্শন করিয়া ধন্য হইতেছে। কলিকাতার ছোট বড় সকলে তখন ‘দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস’-এর নাম শুনিয়াছে এবং অনেকে তাঁহাকে দর্শনও করিয়াছে। আর কলিকাতার জনসাধারণের মন অধিকার করিয়া ভিতরে ভিতরে যেন একটা ধর্মস্রোত নিরন্তর বহিয়া চলিয়াছে।1 হেথায় হরিসভা, হোথায় ব্রাহ্মসমাজ, হেথায় নামসঙ্কীর্তন, হোথায় ধর্মব্যাখ্যা ইত্যাদিতে তখন কলিকাতা নগরী পূর্ণ। অপর সকলে ঐ বিষয়ের কারণ না বুঝিলেও ঠাকুর বিলক্ষণ বুঝিতেন এবং তাঁহার স্ত্রী-পুরুষ উভয়বিধ ভক্তের নিকটই ঐ কথা অনেকবার বলিয়াছিলেন, আমাদের তো কথাই নাই। জনৈক স্ত্রী-ভক্ত বলেন, ঠাকুর একদিন তাঁহাকে ঐ সম্বন্ধে বলিতেছেন – “ওগো, এই যে সব দেখছ, এত হরিসভা-টরিসভা এ সব জানবে (নিজ শরীর দেখাইয়া) এইটের জন্যে। এ সব কি ছিল? কেমন এক রকম সব হয়ে গিয়েছিল! (পুনরায় নিজ শরীর দেখাইয়া) এইটে আসার পর থেকে এ সব এত হয়েছে, ভিতরে ভিতরে একটা ধর্মের স্রোত বয়ে যাচ্ছে!” আবার এক সময়ে ঠাকুর আমাদের বলিয়াছিলেন, “এই যে দেখছ সব ইয়াং বেঙ্গল (Young Bengal) এরা কি ভক্তি-টক্তির ধার ধারত? মাথা নুইয়ে পেরণামটা (প্রণাম) করতেও জানত না! মাথা নুইয়ে আগে পেরণাম করতে করতে তবে এরা ক্রমে ক্রমে মাথা নোয়াতে শিখেছে। কেশবের বাড়িতে দেখা করতে গেলুম, দেখি চেয়ারে বসে লিখছে। মাথা নুইয়ে পেরণাম করলুম, তাতে অমনি ঘাড় নেড়ে একটু সায় দিলে! তারপর আসবার সময় একেবারে ভূঁয়ে মাথা ঠেকিয়ে পেরণাম করলুম। তাতে হাত জোড় করে একবার মাথায় ঠেকাল। তারপর যত যাওয়া-আসা হতে লাগল ও কথাবার্তা শুনতে লাগল, আর মাথা হেঁট করে পেরণাম করতে লাগলুম তত ক্রমে ক্রমে তার মাথা নীচু হয়ে আসতে লাগল। নইলে আগে আগে ওরা কি এ সব ভক্তি-টক্তি করা জানত, না মানত!”


1. চতুর্থ অধ্যায় দেখ।

পণ্ডিত শশধরের ঐ সময়ে কলিকাতায় আগমন ও ধর্মব্যাখ্যা

নববিধান ব্রাহ্মসমাজে ঠাকুরের সঙ্গলাভ করিয়া যখন খুব জমজমাট চলিয়াছে, সেই সময়েই পণ্ডিত শশধরের হিন্দুধর্ম ব্যাখ্যা করিতে কলিকাতায় আগমন ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের দিক দিয়া হিন্দুদিগের নিত্যকর্তব্য অনুষ্ঠানগুলি বুঝাইবার চেষ্টা। ‘নানা মুনির নানা মত’ কথাটি সর্ব বিষয়ে সকল সময়েই সত্য; পণ্ডিতজীর বৈজ্ঞানিক ধর্মব্যাখ্যা সম্বন্ধেও ঐ কথা মিথ্যা হয় নাই। কিন্তু তাই বলিয়া শ্রোতার হুড়াহুড়ির অভাব ছিল না। আফিসের ফেরতা বাবু-ভায়া ও স্কুল-কলেজের ছাত্রদিগের ভিড় লাগিয়া যাইত। আল্বার্ট হলে স্থানাভাবে ঠেসাঠেসি করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতে হইত। সকলেই স্থির, উদ্গ্রীব – কোনরূপে পণ্ডিতজীর অপূর্ব ধর্মব্যাখ্যা যদি কতকটাও শুনিতে পায়! আমাদের মনে আছে, আমরাও একদিন কিছুকাল ঐভাবে দাঁড়াইয়া দুই-পাঁচটা কথা শুনিতে পাইয়াছিলাম এবং ভিড়ের ভিতর মাথা গুঁজিয়া কোনরূপে প্রৌঢ়বয়স্ক পণ্ডিতজীর কৃষ্ণশ্মশ্রুরাজি-শোভিত সুন্দর মুখখানি এবং গৈরিকরুদ্রাক্ষশোভিত বক্ষঃস্থলের কিয়দংশের দর্শন পাইয়াছিলাম। কলিকাতার অনেক স্থলেই তখন ঐ এক আলোচনা – শশধর পণ্ডিতের ধর্মব্যাখ্যা!

ঠাকুরের শশধরকে দেখিবার ইচ্ছা

বলে ‘কথা কানে হাঁটে’, কাজেই দক্ষিণেশ্বরের মহাপুরুষের কথা পণ্ডিতজীর নিকটে এবং পণ্ডিতজীর গুণপনা ঠাকুরের নিকটে পৌঁছিতে বড় বিলম্ব হইল না! ভক্তদিগেরই কেহ কেহ আসিয়া ঠাকুরের নিকট গল্প করিতে লাগিলেন, “খুব পণ্ডিত, বলেনও বেশ! বত্রিশাক্ষরী হরিনামের সেদিন দেবীপক্ষে অর্থ করিলেন, শুনিয়া সকলে ‘বাহবা বাহবা’ করিতে লাগিল, ইত্যাদি।” ঠাকুরও ঐ কথা শুনিয়া বলিলেন, “বটে? ঐটি বাবু একবার শুনতে ইচ্ছা করে।” এই বলিয়া ঠাকুর পণ্ডিতকে দেখিবার ইচ্ছা ভক্তদিগের নিকট প্রকাশ করেন।

ঠাকুরের শুদ্ধ মনে উদিত বাসনাসমূহ সর্বদা সফল হইত

দেখা যাইত, ঠাকুরের শুদ্ধ মনে যখন যে বাসনার উদয় হইত, তাহা কোন না কোন উপায়ে পূর্ণ হইতই হইত। কে যেন ঐ বিষয়ের যত প্রতিবন্ধকগুলি ভিতরে ভিতরে সরাইয়া দিয়া উহার সফল হইবার পথ পরিষ্কার করিয়া রাখিত! পূর্বে শুনিয়াছিলাম বটে, কায়মনোবাক্যে সত্যপালন ও শুদ্ধ পবিত্র ভাব মনে নিরন্তর রাখিতে রাখিতে মানুষের এমন অবস্থা হয় যে, তখন সে আর কোন অবস্থায় কোন প্রকার মিথ্যা ভাব চেষ্টা করিয়াও মনে আনিতে পারে না – যাহা কিছু সঙ্কল্প তাহার মনে উঠে সে সকলই সত্য হয়। কিন্তু সেটা মানুষের শরীরে যে এতদূর হইতে পারে, তাহা কখনই বিশ্বাস করিতে পারি নাই। ঠাকুরের মনের সঙ্কল্পসকল অতর্কিতভাবে সিদ্ধ হইতে পুনঃ পুনঃ দেখিয়াই ঐ কথাটায় আমাদের ক্রমে ক্রমে বিশ্বাস জন্মে। তাই কি ঐ বিষয়ে পুরাপুরি বিশ্বাস আমাদের ঠাকুরের শরীর বিদ্যমানে জন্মিয়াছিল? তিনি বলিয়াছিলেন, “কেশব, বিজয়ের ভিতরে দেখলাম এক-একটি বাতির শিখার মতো (জ্ঞানের) শিখা জ্বলছে, আর নরেন্দরের ভিতর দেখি জ্ঞান-সূর্য রয়েছে! কেশব একটা শক্তিতে জগৎ মাতিয়েছে, নরেনের ভিতর অমন আঠারটা শক্তি রয়েছে।” – এ সব তাঁর নিজের সঙ্কল্পের কথা নয়, ভাবাবেশে দেখাশুনার কথা; কিন্তু ইহাতেই কি তখন বিশ্বাস ঠিক ঠিক দাঁড়াইত? কখনও ভাবিতাম – হবেও বা, ঠাকুর লোকের ভিতর দেখিতে পান; তিনি যখন বলিতেছেন, তখন ইহার ভিতর কিছু গূঢ় ব্যাপার আছে; আবার কখনও ভাবিতাম, জগদ্বিখ্যাত বাগ্মী ভক্ত কেশবচন্দ্র সেন কোথা, আর শ্রীযুত নরেন্দ্রের মতো একটা স্কুলের ছোঁড়া কোথা! ইহা কি কখনও হইতে পারে? ঠাকুরের দেখাশুনার কথার উপরেই যখন ঐরূপ সন্দেহ আসিত, তখন ‘এইটি ইচ্ছা হয়’ বলিয়া ঠাকুর যখন তাঁহার মনোগত সঙ্কল্পের কথা বলিতেন তখন উহা ঘটিবার পক্ষে যে সন্দেহ আসিত না, ইহা কেমন করিয়া বলি।

১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের নবযাত্রার সময় ঠাকুর যথায় যথায় গমন করেন

পণ্ডিত শশধরের সম্বন্ধে ঠাকুরের সহিত ঐরূপ কথাবার্তা হইবার কয়েকদিন পরেই রথযাত্রা উপস্থিত। নয় দিন ধরিয়া রথোৎসব নির্দিষ্ট থাকায় উহা ‘নবযাত্রা’ বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের নবযাত্রার সময় ঠাকুরের সম্বন্ধে অনেকগুলি কথা আমাদের মনে উদিত হইতেছে। এই বৎসরেরই সোজা-রথের দিন প্রাতে ঠাকুরের ঠনঠনিয়ায় শ্রীযুত ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাটীতে নিমন্ত্রণরক্ষায় গমন এবং সেখান হইতে অপরাহ্ণে পণ্ডিত শশধরকে দেখিতে যাওয়া, সন্ধ্যার পর ঠাকুরের বাগবাজারে শ্রীযুত বলরামবাবুর বাটীতে রথোৎসবে যোগদান এবং সে রাত্রি তথায় অবস্থান করিয়া পরদিন প্রাতে কয়েকটি ভক্তসঙ্গে নৌকায় করিয়া দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে পুনরাগমন। ইহার কয়েকদিন পরেই আবার পণ্ডিত শশধর আলমবাজার বা উত্তর বরাহনগরের একস্থলে ধর্ম-সম্বন্ধিনী বক্তৃতা করিতে আসিয়া সেখান হইতে ঠাকুরকে দর্শন করিতে দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে আগমন করেন। তৎপরে উলটা রথের দিন প্রাতে ঠাকুরের পুনরায় বাগবাজারে বলরামবাবুর বাটীতে আগমন এবং সেদিন রাত ও তৎপর দিন রাত তথায় ভক্তগণের সঙ্গে সানন্দে অবস্থান করিয়া তৃতীয় দিবস প্রাতে ‘গোপালের মা’ প্রভৃতি ভক্তগণের সঙ্গে নৌকায় করিয়া দক্ষিণেশ্বরে প্রত্যাবর্তন। উলটা রথের দিনে পণ্ডিত শশধরও ঠাকুরকে দর্শন করিতে বলরামবাবুর বাটীতে স্বয়ং আগমন করেন ও সজলনয়নে করজোড়ে ঠাকুরকে পুনরায় নিবেদন করেন, “দর্শন-চর্চা করিয়া আমার হৃদয় শুষ্ক হইয়া গিয়াছে; আমায় একবিন্দু ভক্তি দান করুন।” ঠাকুরও তাহাতে ভাবাবিষ্ট হইয়া পণ্ডিতজীর হৃদয় ঐ দিন স্পর্শ করিয়াছিলেন। ঐ সময়ের কথাগুলি পাঠককে এখানে সবিস্তারে বলিলে মন্দ হইবে না।

ঈশানবাবুর পরিচয়

পূর্বেই বলিয়াছি রথের দিন প্রাতে ঠাকুর কলিকাতায় ঠনঠনিয়ায় ঈশানবাবুর বাটীতে আগমন করেন, সঙ্গে শ্রীযুত যোগেন (স্বামী যোগানন্দ), হাজরা প্রভৃতি কয়েকটি ভক্ত। শ্রীযুত ঈশানের মতো দয়ালু, দানশীল ও ভগবদ্বিশ্বাসী ভক্তের দর্শন সংসারে দুর্লভ। তাঁহার আটটি পুত্র, সকলেই কৃতবিদ্য। তৃতীয় পুত্র সতীশ শ্রীযুত নরেন্দ্রের (স্বামী বিবেকানন্দের) সহপাঠী। শ্রীযুত সতীশের পাখোয়াজে অতি সুমিষ্ট হাত থাকায় শ্রীযুত নরেন্দ্রের সুকণ্ঠের তান অনেক সময় ঐ বাটীতে শুনিতে পাওয়া যাইত। ঈশানবাবুর দয়ার বিষয় উল্লেখ করিয়া স্বামী বিবেকানন্দ আমাদিগকে একদিন বলেন যে, উহা পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের অপেক্ষা কিছুতেই কম ছিল না। স্বামীজী স্বচক্ষে দেখিয়াছেন, ঈশানবাবু নিজের অন্নব্যঞ্জনাদি কতদিন (বাটীতে তখন কিছু আহার্য প্রস্তুত না থাকায়) অভুক্ত ভিখারীকে সমস্ত অর্পণ করিয়া যাহা-তাহা খাইয়া দিন কাটাইয়া দিলেন। আর অপরের দুঃখ-কষ্টের কথা শুনিয়া উহা দূর করা নিজের সাধ্যাতীত দেখিয়া কতদিন যে তিনি (স্বামীজী) অশ্রুজল বিসর্জন করিতে তাঁহাকে (ঈশানবাবুকে) দেখিয়াছেন, তাহাও বলিতেন। শ্রীযুত ঈশান যেমন দয়ালু, তেমনি জপ-পরায়ণও ছিলেন। তাঁহার দক্ষিণেশ্বরে নিয়মপূর্বক উদয়াস্ত জপ করার কথাও আমরা অনেকে জানিতাম। জাপক ঈশান ঠাকুরের বিশেষ প্রিয় ও অনুগ্রহপাত্র ছিলেন। আমাদের মনে আছে, জপ সমাধান করিয়া ঈশান যখন ঠাকুরের চরণে একদিন সন্ধ্যাকালে প্রণাম করিতে আসিলেন, তখন ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া তাঁহার শ্রীচরণ ঈশানের মস্তকে প্রদান করিলেন। পরে বাহ্যদশা প্রাপ্ত হইয়া জোর করিয়া ঈশানকে বলিতে লাগিলেন, “ওরে বামুন, ডুবে যা, ডুবে যা” (অর্থাৎ কেবল ভাসা ভাসা জপ না করিয়া শ্রীভগবানের নামে তন্ময় হইয়া যা)। ইদানীং প্রাতের পূজা ও জপেই শ্রীযুত ঈশানের প্রায় অপরাহ্ণ চারিটা হইয়া যাইত। পরে কিঞ্চিৎ লঘু আহার করিয়া অপরের সহিত কথাবার্তা বা ভজন-শ্রবণাদিতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটাইয়া পুনরায় সান্ধ্য জপে উপবেশন করিয়া কত ঘণ্টা কাল কাটাইতেন। আর বিষয়কর্ম দেখার ভার পুত্রেরাই লইয়াছিল। ঠাকুর ঈশানের বাটীতে মধ্যে মধ্যে শুভাগমন করিতেন এবং ঈশানও কলিকাতায় থাকিলে প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে তাঁহাকে দর্শন করিতে আগমন করিতেন। নতুবা, পবিত্র দেবস্থান ও তীর্থাদি-দর্শনে যাইয়া তপস্যায় কাল কাটাইতেন।

এ বৎসর (১৮৮৫ খ্রীঃ) রথের দিনে শ্রীযুত ঈশানের বাটীতে আগমন করিয়া ঠাকুরের ভাটপাড়ার কতকগুলি ভট্টাচার্যের সহিত ধর্মবিষয়ক নানা কথাবার্তা হয়। পরে স্বামী বিবেকানন্দের মুখে পণ্ডিতজীর কথা শুনিয়া এবং তাঁহার বাসা অতি নিকটে জানিতে পারিয়া ঠাকুর শশধরকে ঐ দিন দেখিতে গিয়াছিলেন। পণ্ডিতজীর কলিকাতাগমন-সংবাদ স্বামীজী প্রথম হইতেই জানিতে পারিয়াছিলেন। কারণ, যাঁহাদের সাদর নিমন্ত্রণে তিনি ধর্মবক্তৃতাদানে আগমন করেন তাঁহাদের সহিত স্বামীজীর পূর্ব হইতেই আলাপ-পরিচয় ছিল এবং কলেজ স্ট্রীটস্থ তাঁহাদের বাসভবনে স্বামীজীর গতায়াতও ছিল। আবার পণ্ডিতজীর আধ্যাত্মিক ধর্মব্যাখ্যাগুলি ভ্রমপ্রমাদপূর্ণ বলিয়া ধারণা হওয়ায় তর্কযুক্তি দ্বারা তাঁহাকে ঐ বিষয় বুঝাইয়া দিবার প্রয়াসেও স্বামীজীর ঐ বাটীতে গমনাগমন এই সময়ে কিছু অধিক হইয়া উঠিয়াছিল। স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলেন, এইরূপে স্বামীজীই পণ্ডিতজীর সম্বন্ধে অনেক কথা জ্ঞাত হইয়া ঠাকুরকে উহা বলেন এবং অনুরোধ করিয়া তাঁহাকে পণ্ডিতদর্শনে লইয়া যান। পণ্ডিত শশধরকে দেখিতে যাইয়া ঠাকুর সেদিন পণ্ডিতজীকে নানা অমূল্য উপদেশ প্রদান করেন। শ্রীশ্রীজগদম্বার নিকট হইতে ‘চাপরাস’ বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হইয়া ধর্মপ্রচার করিতে যাইলে উহা সম্পূর্ণ নিষ্ফল হয় এবং কখনও কখনও প্রচারকের অভিমান-অহঙ্কার বাড়াইয়া তুলিয়া তাহার সর্বনাশের পথ পরিষ্কার করিয়া দেয়, এ সকল কথা ঠাকুর পণ্ডিতজীকে এই প্রথম দর্শনকালেই বলিয়াছিলেন। এইসকল জ্বলন্ত শক্তিপূর্ণ মহাবাক্যের ফলেই যে পণ্ডিতজী কিছুকাল পরে প্রচারকার্য ছাড়িয়া ৺কামাখ্যাপীঠে তপস্যায় গমন করেন, ইহা আর বলিতে হইবে না।

যোগানন্দ স্বামীর আচার-নিষ্ঠা

পণ্ডিতজীর নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া ঠাকুর সেদিন শ্রীযুত যোগেনের সহিত সন্ধ্যাকালে বাগবাজারে বলরাম বসুর বাটীতে উপস্থিত হইলেন। যোগেন তখন আহারাদিতে বিশেষ ‘আচারী’, কাহারও বাটীতে জলগ্রহণ পর্যন্ত করেন না। কাজেই নিজ বাটীতে সামান্য জলযোগমাত্র করিয়াই ঠাকুরের সঙ্গে আসিয়াছিলেন। ঠাকুরও তাঁহাকে কোথাও খাইতে অনুরোধ করেন নাই; কারণ, যোগেনের নিষ্ঠাচারিতার বিষয় ঠাকুরের অজ্ঞাত ছিল না। কেবল বলরামবাবুর শ্রদ্ধাভক্তি ও ঠাকুরের উপরে বিশ্বাস প্রত্যক্ষ করিয়া তাঁহার বাটীতে ফলমূল-দুগ্ধ-মিষ্টান্নাদিগ্রহণ শ্রীযুত যোগেন পূর্বাবধি করিতেন – এ কথাও ঠাকুর জানিতেন। সেজন্য পৌঁছিবার কিছু পরেই ঠাকুর বলরাম প্রভৃতিকে বলিলেন, “ওগো, এর (যোগেনকে দেখাইয়া) আজ খাওয়া হয়নি, একে কিছু খেতে দাও।” বলরামবাবুও যোগেনকে সাদরে অন্দরে লইয়া যাইয়া জলযোগ করাইলেন। ভাবসমাধিতে আত্মহারা ঠাকুরের ভক্তদিগের শারীরিক ও মানসিক প্রত্যেক বিষয়ে কতদূর লক্ষ্য থাকিত, তাহারই অন্যতম দৃষ্টান্ত বলিয়া আমরা এ কথার এখানে উল্লেখ করিলাম।

বলরাম বসুর বাটীতে রথোৎসব

বলরামবাবুর বাটীতে রথে ঠাকুরকে লইয়া আনন্দের তুফান ছুটিত। অদ্য সন্ধ্যার পরেই শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহকে মাল্য-চন্দনাদি দ্বারা ভূষিত করিয়া অন্দরের ঠাকুরঘর হইতে বাহিরে আনা হইল। এবং বস্ত্রপতাকাদি দ্বারা ইতঃপূর্বেই সজ্জিত ছোট রথখানিতে বসাইয়া আবার পূজা করা হইল। বলরামবাবুর পুরোহিতবংশজ ঠাকুরের ভক্ত শ্রীযুত ফকীরই ঐ পূজা করিলেন।

শ্রীযুত ফকীর বলরামবাবুর আশ্রয়ে থাকিয়া বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও আশ্রয়দাতার একমাত্র শিশুপুত্র রামকৃষ্ণের পাঠাভ্যাসাদির তত্ত্বাবধান করিতেন। ইনি বিশেষ নিষ্ঠাপরায়ণ ও ভক্তিমান ছিলেন এবং ঠাকুরের প্রথম দর্শনাবধি তাঁহার প্রতি বিশেষ ভক্তিপরায়ণ হইয়াছিলেন। ঠাকুর কখনও কখনও ইঁহার মুখ হইতে স্তোত্রাদি শুনিতে ভালবাসিতেন এবং শ্রীমচ্ছঙ্করাচার্যকৃত কালীস্তোত্র কিরূপে ধীরে ধীরে প্রত্যেক কথাগুলি সম্পূর্ণ উচ্চারণ করিয়া আবৃত্তি করিতে হয়, তাহা একদিন ইঁহাকে শিখাইয়া দিয়াছিলেন। ঠাকুর ঐ দিন সন্ধ্যার সময় ফকীরকে নিজ কক্ষের উত্তর দিকের বারাণ্ডায় লইয়া গিয়া ভাবাবিষ্ট হইয়া স্পর্শও করেন এবং ধ্যান করিতে বলেন। ফকীরের উহাতে অদ্ভুত দর্শনাদি হইয়াছিল।

এইবার সঙ্কীর্তন করিতে করিতে রথের টান আরম্ভ হইল। ঠাকুর স্বয়ং রথের রশি ধরিয়া অল্পক্ষণ টানিলেন। পরে ভাবাবেশে তালে তালে সুন্দরভাবে নৃত্য করিতে লাগিলেন। সে ভাবমত্ত হুঙ্কার ও নৃত্যে মুগ্ধ হইয়া সকলেই তখন আত্মহারা – ভগবদ্ভক্তিতে উন্মাদ! বাহিরবাটীর দোতলার চকমিলান বারাণ্ডাটি ঘুরিয়া ঘুরিয়া অনেকক্ষণ অবধি এইরূপ নৃত্য, কীর্তন ও রথের টান হইলে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব, শ্রীগোবিন্দ ও শ্রীমতী রাধারানী, শ্রীমহাপ্রভু ও তাঁহার সাঙ্গোপাঙ্গ এবং পরিশেষে তদ্ভক্তবৃন্দ, সকলের পৃথক পৃথক নামোল্লেখ করিয়া জয়কার দিয়া প্রণামান্তে কীর্তন সাঙ্গ হইল। পরে রথ হইতে ৺জগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহকে অবরোহণ করাইয়া ত্রিতলে (চিলের ছাদের ঘরে) সাতদিনের মতো স্থানান্তরিত করিয়া স্থাপন করা হইল। ইহার অর্থ – রথে চড়িয়া ৺জগন্নাথদেব যেন অন্যত্র আসিয়াছেন; সাতদিন পরে পুনঃ এখান হইতে রথে চড়িয়া আপনার পূর্বস্থানে গমন করিবেন। ৺জগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহকে পূর্বোক্ত স্থানে রাখিয়া ভোগনিবেদন করিবার পর অগ্রে ঠাকুর ও পরে ভক্তেরা সকলে প্রসাদ গ্রহণ করিলেন। ঠাকুর ও তাঁহার সহিত আগত যোগেন সে রাত্রি বলরামবাবুর বাটীতেই রহিলেন। অন্যান্য ভক্তেরা অনেকেই যে যাঁহার স্থানে চলিয়া গেলেন।

স্ত্রী-ভক্তদিগের ঠাকুরের প্রতি অনুরাগ

পরদিন প্রাতে ৮টা বা ৯টার সময় নৌকা ডাকা হইল – ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে প্রত্যাগমন করিবেন। নৌকা আসিলে ঠাকুর অন্দরে যাইয়া ৺জগন্নাথদেবকে প্রণাম করিয়া এবং ভক্তপরিবারবর্গের প্রণাম স্বয়ং গ্রহণ করিয়া বাহিরবাটীর দিকে আসিতে লাগিলেন। স্ত্রী-ভক্তেরা সকলে পশ্চাৎ পশ্চাৎ ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে অন্দরের পূর্বদিকে রন্ধনশালার সম্মুখে ছাদের শেষ পর্যন্ত আসিয়া বিষণ্ণমনে ফিরিয়া যাইলেন; কারণ এ অদ্ভুত জীবন্ত ঠাকুরকে ছাড়িতে কাহার প্রাণ চায়? উক্ত ছাদ হইতে কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া তিন-চারিটি সিঁড়ি উঠিলেই একটি দ্বার এবং ঐ দরজাটি পার হইয়া বাহিরের দ্বিতলের চকমিলান বারাণ্ডা। সকল স্ত্রী-ভক্তেরা ঐ ছাদের শেষ পর্যন্ত আসিয়া ফিরিলেও একজন যেন আত্মহারা হইয়া ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে বাহিরের চকমিলান বারাণ্ডাবধি আসিলেন – যেন বাহিরে অপরিচিত পুরুষেরা সব আছে, সে বিষয়ে আদৌ হুঁশ নাই।

ঠাকুরের অন্যমনে চলা ও জনৈকা স্ত্রী-ভক্তের আত্মহারা হইয়া পশ্চাতে আসা

ঠাকুর স্ত্রী-ভক্তদিগের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণান্তে ভাবাবেশে এমন গোঁ-ভরে বরাবর চলিয়া আসিতেছিলেন যে, মেয়েরা যে তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ কতদূর আসিয়া ফিরিয়া গিয়াছেন এবং তাঁহাদের একজন যে এখনও ঐ ভাবে তাঁহার সঙ্গে আসিতেছেন, সে বিষয়ে তাঁহার আদৌ হুঁশ ছিল না। ঠাকুরের ঐরূপ গোঁ-ভরে চলা যাঁহারা চক্ষে দেখিয়াছেন, তাঁহারাই কেবল বুঝিতে পারিবেন; অপরকে উহা বুঝানো কঠিন। দ্বাদশবর্ষব্যাপী, কেবল দ্বাদশবর্ষই বা বলি কেন আজন্ম একাগ্রতা অভ্যাসের ফলে ঠাকুরের মন-বুদ্ধি এমন একনিষ্ঠ হইয়া গিয়াছিল যে, যখন যেখানে বা যে কার্যে রাখিতেন তাঁহার মন তখন ঠিক সেখানেই থাকিত – চারিপাশে উঁকিঝুঁকি একেবারেই মারিত না। আর শরীর ও ইন্দ্রিয়াদি এমন বশীভূত হইয়া গিয়াছিল যে, মনে যখন যে ভাবটি বর্তমান, উহারাও তখন কেবলমাত্র সেই ভাবটিই প্রকাশ করিত! একটুও এদিক ওদিক করিতে পারিত না। এ কথাটি বুঝানো বড় কঠিন। কারণ, আপন আপন মনের দিকে চাহিলেই আমরা দেখিতে পাই, নানা প্রকার পরস্পর-বিপরীত ভাবনা যেন এককালে রাজত্ব করিতেছে এবং উহাদের ভিতর যেটি অভ্যাসবশতঃ অপেক্ষাকৃত প্রবল, শরীর ও ইন্দ্রিয়াদি নিষেধ না মানিয়া তাহারই বশে ছুটিয়াছে। ঠাকুরের মনের গঠন আর আমাদের মনের গঠন এতই বিভিন্ন!

ঠাকুরের ঐরূপ অন্যমনে চলিবার আর কয়েকটি দৃষ্টান্ত; ঐরূপ হইবার কারণ

দৃষ্টান্তস্বরূপ আরও অনেক কথা এখানে বলা যাইতে পারে। দক্ষিণেশ্বরে আপনার ঘর হইতে ঠাকুর মা কালীকে দর্শন করিতে চলিলেন। ঘরের পূর্বের দালানে আসিয়া সিঁড়ি দিয়া ঠাকুর বাটীর উঠানে নামিয়া একেবারে সিধা মা কালীর মন্দিরের দিকে চলিলেন। ঠাকুরের থাকিবার ঘর হইতে মা কালীর মন্দিরে যাইতে অগ্রে শ্রীরাধাগোবিন্দজীর মন্দির পড়ে; যাইবার সময় ঠাকুর উক্ত মন্দিরে উঠিয়া শ্রীবিগ্রহকে প্রণাম করিয়া মা কালীর মন্দিরে যাইতে পারেন; কিন্তু তাহা কখনও করিতে পারিতেন না। একেবারে সরাসরি মা কালীর মন্দিরে যাইয়া প্রণামাদি করিয়া পরে ফিরিয়া আসিবার কালে ঐ মন্দিরে উঠিতেন। আমরা তখন তখন ভাবিতাম, ঠাকুর মা কালীকে অধিক ভালবাসেন বলিয়াই বুঝি ঐরূপ করেন। পরে একদিন ঠাকুর নিজেই বলিলেন, “আচ্ছা, এ কি বল্ দেখি? মা কালীকে দেখতে যাব মনে করেছি তো একেবারে সিধে মা কালীর মন্দিরে যেতে হবে। এদিক ওদিক ঘুরে বা রাধাগোবিন্দের মন্দিরে উঠে যে প্রণাম করে যাব, তা হবে না। কে যেন পা টেনে সিধে মা কালীর মন্দিরে নিয়ে যায় – একটু এদিক ওদিক বেঁকতে দেয় না! মা কালীকে দেখার পর, যেথা ইচ্ছা যেতে পারি – এ কেন বল্ দেখি?” আমরা মুখে বলিতাম, ‘কি জানি মশাই’; আবার মনে মনে ভাবিতাম, ‘এও কি হয়? ইচ্ছা করিলেই আগে রাধাগোবিন্দকে প্রণাম করে যেতে পারেন। মা কালীকে দেখবার ইচ্ছাটা বেশি হয় বলেই বোধ হয় অন্যরূপ ইচ্ছা হয় না’ ইত্যাদি; কিন্তু এ-সব কথা সহসা ভাঙিয়া বলিতেও পারিতাম না। ঠাকুরই আবার কখনও কখনও ঐ বিষয়ের উত্তরে বলিতেন, “কি জানিস? যখন যেটা মনে হয় করব, সেটা তখনই করতে হবে – এতটুকু দেরি সয় না।” কে জানে তখন, একনিষ্ঠ মনের এই প্রকার গতি ও চেষ্টাদি, এবং ঠাকুরের মনটার অন্তঃস্তর অবধি সমস্তটা বহুকাল ধরিয়া একনিষ্ঠ হইয়া একেবারে একভাবে তরঙ্গায়িত হইয়া উঠে – উহাতে অন্য ভাবকে আশ্রয় করিয়া বিপরীত তরঙ্গরাজি আর উঠেই না। আবার কখনও কখনও বলিতেন, “দেখ, নির্বিকল্প অবস্থায় উঠলে তখন তো আর আমি-তুমি, দেখা-শুনা, বলা-কহা কিছুই থাকে না; সেখান থেকে দুই-তিন ধাপ নেমে এসেও এতটা ঝোঁক থাকে যে, তখনও বহু লোকের সঙ্গে বা বহু জিনিস নিয়ে ব্যবহার চলে না। তখন যদি খেতে বসি আর পঞ্চাশ রকম তরকারি সাজিয়ে দেয়, তবু হাত সেসকলের দিকে যায় না, এক জায়গা থেকেই মুখে উঠবে। এমন সব অবস্থা হয়! তখন ভাত ডাল তরকারি পায়েস সব একত্রে মিশিয়ে নিয়ে খেতে হয়!” আমরা এই সমরস অবস্থার দুই-তিন ধাপ নীচের কথা শুনিয়াই অবাক হইয়া থাকিতাম। আবার বলিতেন, “এমন একটা অবস্থা হয়, তখন কাউকে ছুঁতে পারি না। (ভক্তদের সকলকে দেখাইয়া) এদের কেউ ছুঁলে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠি।” – আমাদের ভিতর কে-ই বা তখন এ কথার মর্ম বুঝে যে, শুদ্ধসত্ত্ব গুণটা তখন ঠাকুরের মনে এতটা বেশি হয় যে, এতটুকু অশুদ্ধতার স্পর্শ সহ্য করিতে পারেন না! পুনরায় বলিতেন, “ভাবে আবার একটা অবস্থা হয়, তখন খালি (শ্রীযুক্ত বাবুরাম মহারাজকে দেখাইয়া) ওকে ছুঁতে পারি; ও যদি তখন ধরে1 তো কষ্ট হয় না। ও খাইয়ে দিলে তবে খেতে পারি।” যাক্ এখন সেসব কথা। পূর্বকথার অনুসরণ করি।


1. ভাবাবেশ হইলে ঠাকুরের শরীর-জ্ঞান না থাকায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি (হাত, মুখ, গ্রীবা ইত্যাদি) বাঁকিয়া যাইত এবং কখনও বা সমস্ত শরীরটা হেলিয়া পড়িয়া যাইবার মতো হইত। তখন নিকটস্থ ভক্তেরা ঐসকল অঙ্গাদি ধরিয়া ধীরে ধীরে যথাযথভাবে সংস্থিত করিয়া দিতেন এবং পাছে ঠাকুর পড়িয়া গিয়া আঘাতপ্রাপ্ত হন, এজন্য তাঁহাকে ধরিয়া থাকিতেন। আর যে দেবদেবীর ভাবে ঠাকুরের ঐ অবস্থা, সেই দেবদেবীর নাম তখন তাঁহার কর্ণকুহরে শুনাইতে থাকিতেন, যথা – কালী কালী, রাম রাম, ওঁ ওঁ বা ওঁ তৎ সৎ ইত্যাদি। ঐরূপ শুনাইতে শুনাইতে তবে ধীরে ধীরে ঠাকুরের আবার বাহ্য চৈতন্য আসিত। যে ভাবে ঠাকুর যখন আবিষ্ট ও আত্মহারা হইতেন, সেই নাম ভিন্ন অপর নাম শুনাইলে তাঁহার বিষম যন্ত্রণাবোধ হইত।

স্ত্রী-ভক্তটিকে ঠাকুরের দক্ষিণেশ্বরে যাইতে আহ্বান

ঠাকুর গোঁ-ভরে চলিতে চলিতে বাহিরের বারাণ্ডায় (যেখানে পূর্বরাত্রে রথ টানা হইয়াছিল) আসিয়া হঠাৎ পশ্চাতে চাহিয়া দেখেন, সেই স্ত্রী-ভক্তটি ঐরূপে তাঁহার পিছনে পিছনে আসিতেছেন। দেখিয়াই দাঁড়াইলেন এবং ‘মা আনন্দময়ী, মা আনন্দময়ী’ বলিয়া বার বার প্রণাম করিতে লাগিলেন। ভক্তটিও ঠাকুরের শ্রীচরণে মাথা রাখিয়া প্রতিপ্রণাম করিয়া উঠিবামাত্র ঠাকুর তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘চ না গো মা, চ না!’ কথাগুলি এমনভাবে বলিলেন এবং ভক্তটিও এমন এক আকর্ষণ অনুভব করিলেন যে, আর দিক্বিদিক্ না দেখিয়া (উঁহার বয়স তখন ত্রিশ বৎসর হইবে এবং গাড়ি-পালকিতে ভিন্ন এক স্থান হইতে অপর স্থানে কখনও ইহার পূর্বে যাতায়াত করেন নাই) ঠাকুরের পশ্চাৎ পশ্চাৎ পদব্রজে দক্ষিণেশ্বরে চলিলেন। কেবল একবারমাত্র ছুটিয়া বাটীর ভিতর যাইয়া বলরামবাবুর গৃহিণীকে বলিয়া আসিলেন, “আমি ঠাকুরের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে চললুম।” পূর্বোক্ত ভক্তটি এইরূপে দক্ষিণেশ্বরে যাইতেছেন শুনিয়া আর একটি স্ত্রী-ভক্তও সকল কর্ম ছাড়িয়া তাঁহার সঙ্গে চলিলেন। এদিকে ঠাকুর ভাবাবেশে স্ত্রী-ভক্তটিকে ঐরূপে আসিতে বলিয়া আর পশ্চাতে না চাহিয়া শ্রীযুক্ত যোগেন, ছোট নরেন প্রভৃতি বালক ভক্তদিগকে সঙ্গে লইয়া সরাসরি নৌকায় যাইয়া বসিলেন। স্ত্রী-ভক্ত দুইটিও ছুটাছুটি করিয়া আসিয়া নৌকায় উঠিয়া বাহিরের পাটাতনের উপর বসিয়া পড়িলেন। নৌকা ছাড়িল।

নৌকায় যাইতে যাইতে স্ত্রী-ভক্তের প্রশ্নে ঠাকুরের উত্তর – “ঝড়ের আগে এঁটো পাতার মত হয়ে থাকবে”

যাইতে যাইতে স্ত্রী-ভক্তটি ঠাকুরকে বলিতে লাগিলেন, “ইচ্ছা হয় খুব তাঁকে ডাকি, তাঁতে ষোল আনা মন দি, কিন্তু মন কিছুতেই বাগ মানে না – কি করি?”

ঠাকুর – তাঁর উপর ভার দিয়ে থাক না গো! ঝড়ের এঁটো পাতা হয়ে থাকতে হয় – সেটা কি জান? পাতাখানা পড়ে আছে; য্যাম্নে হাওয়াতে নিয়ে যাচ্চে ত্যাম্নে উড়ে যাচ্চে, সেই রকম; এই রকম করে তাঁর উপর ভার দিয়ে পড়ে থাকতে হয় – চৈতন্যবায়ু য্যাম্নে মনকে ফেরাবে, ত্যাম্নে ফিরবে, এই আর কি।

এইরূপ প্রসঙ্গ চলিতে চলিতে নৌকা কালীবাটীর ঘাটে আসিয়া লাগিল। নৌকা হইতে নামিয়াই ঠাকুর কালীঘরে1 যাইলেন। স্ত্রী-ভক্তেরা কালীবাটীর উত্তরে অবস্থিত নহবতখানায়2 শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীর নিকটে যাইলেন এবং তাঁহাকে প্রণাম করিয়া মা কালীকে প্রণাম করিতে মন্দিরাভিমুখে চলিলেন।


1. মা কালীর মন্দিরকে ঠাকুর ‘কালীঘর’ ও রাধাগোবিন্দজীর মন্দিরকে ‘বিষ্ণুঘর’ বলিতেন।
2. এই নহবতখানার নিম্নের ঘরে শ্রীশ্রীমা শয়ন করিতেন এবং সকল প্রকার দ্রব্যাদি রাখিতেন। নিম্নের ঘরের সম্মুখের রকে রন্ধনাদি হইত। উপরের ঘরে দিনের বেলায় কখনও কখনও উঠিতেন এবং কলিকাতা হইতে আগতা স্ত্রী-ভক্তদিগের সংখ্যা অধিক হইলে শয়ন করিতে দিতেন।

দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছিয়া ঠাকুরের ভাবাবেশ ও ক্ষত শরীরে দেবতাস্পর্শনিষেধ-সম্বন্ধে ভক্তদের প্রমাণ পাওয়া

এদিকে ঠাকুর বালক ভক্তগণসঙ্গে মা কালীর মন্দিরে আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিয়া ভাবাবিষ্ট হইয়া নাটমন্দিরে আসিয়া বসিলেন এবং মধুর কণ্ঠে গাহিতে লাগিলেন –

ভুবন ভুলাইলি মা ভবমোহিনি।
মূলাধারে মহোৎপলে বীণাবাদ্য-বিনোদিনি॥
শরীরে শারীরি যন্ত্রে,        সুষুম্নাদি ত্রয় তন্ত্রে,
গুণভেদে মহামন্ত্রে তিনগ্রাম-সঞ্চারিণি॥
আধারে ভৈরবাকার,        ষড়দলে শ্রীরাগ আর
মণিপুরেতে মল্লার বসন্তে হৃদ্প্রকাশিনি॥
বিশুদ্ধে হিন্দোল সুরে,        কর্ণাটক আজ্ঞাপুরে
তান মান লয় সুরে ত্রিসপ্ত-সুরভেদিনি॥
শ্রীনন্দকুমারে কয়,        তত্ত্ব না নিশ্চয় হয়
তব তত্ত্ব গুণত্রয় কাকীমুখ-আচ্ছাদিনি॥

নাটমন্দিরের উত্তর প্রান্তে শ্রীশ্রীজগদম্বার সামনে বসিয়া ঠাকুর এইরূপে গাহিতেছেন, সঙ্গী ভক্তেরা কেহ বসিয়া কেহ দাঁড়াইয়া স্তম্ভিত হৃদয়ে উহা শুনিয়া মোহিত হইয়া রহিয়াছেন। গাহিতে গাহিতে ভাবাবিষ্ট হইয়া ঠাকুর সহসা দাঁড়াইয়া উঠিলেন, গান থামিয়া গেল, মুখের অদৃষ্টপূর্ব হাসি যেন সেই স্থানে আনন্দ ছড়াইয়া দিল – ভক্তেরা নিস্পন্দ হইয়া এখন ঠাকুরের শ্রীমূর্তিই দেখিতে লাগিলেন। তখন ঠাকুরের শরীর একটু হেলিয়াছে দেখিয়া পাছে পড়িয়া যান ভাবিয়া শ্রীযুত ছোট নরেন তাঁহাকে ধরিতে উদ্যত হইলেন। কিন্তু তিনি স্পর্শ করিবামাত্র ঠাকুর যন্ত্রণায় বিকট চিৎকার করিয়া উঠিলেন। ছোট নরেন তাঁহার স্পর্শ ঠাকুরের এখন অভিমত নয় বুঝিয়া সরিয়া দাঁড়াইলেন এবং ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীযুত রামলাল মন্দিরাভ্যন্তর হইতে ঠাকুরের পূর্বোক্ত অব্যক্ত কষ্টসূচক শব্দ শুনিতে পাইয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া ঠাকুরের শ্রীঅঙ্গ ধারণ করিলেন। কতক্ষণ এইভাবে থাকিয়া নাম শুনিতে শুনিতে ঠাকুরের ধীরে ধীরে বাহ্য চৈতন্য হইল; কিন্তু তখনও যেন বিপরীত নেশার ঝোঁকে সহজভাবে দাঁড়াইতে পারিতেছেন না। পা বেজায় টলিতেছে।

এই অবস্থায় কোন রকমে হামা দেওয়ার মতো করিয়া ঠাকুর নাটমন্দিরের উত্তরের সিঁড়িগুলি দিয়া মন্দিরের প্রাঙ্গণে নামিতে লাগিলেন ও ছোট শিশুর মতো বলিতে লাগিলেন, “মা, পড়ে যাব না – পড়ে যাব না?” বাস্তবিকই তখন ঠাকুরকে দেখিয়া মনে হইতে লাগিল, তিনি যেন একটি ছোট তিন-চারি বৎসরের ছেলে, মার দিকে চাহিয়া ঐ কথাগুলি বলিতেছেন, আর মার নয়নে নয়ন রাখিয়া ভরসান্বিত হইয়াই সিঁড়িগুলি নামিতে পারিতেছেন! অতি সামান্য বিষয়েও এমন অপরূপ নির্ভরের ভাব আর কি কোথাও দেখিতে পাইব?

ভাবাবেশে কুণ্ডলিনী-দর্শন ও ঠাকুরের কথা

প্রাঙ্গণ উত্তীর্ণ হইয়া ঠাকুর এইবার নিজ কক্ষে আসিয়া পশ্চিম দিকের গোল বারান্দায় যাইয়া বসিলেন – তখনও ভাবাবিষ্ট। সে ভাব আর ছাড়ে না – কখনও একটু কমে, আবার বাড়িয়া বাহ্যচৈতন্য লুপ্তপ্রায় হয়! এইরূপে কতক্ষণ থাকার পর ভাবাবস্থায় ঠাকুর সঙ্গী ভক্তগণকে বলিতে লাগিলেন, “তোমরা সাপ দেখেছ? সাপের জ্বালায় গেলুম!” আবার তখনি যেন ভক্তদের ভুলিয়া সর্পাকৃতি কুলকুণ্ডলিনীকেই (তাঁহাকেই যে ঠাকুর বর্তমান ভাবাবস্থায় দেখিতেছিলেন এ কথা আর বলিতে হইবে না) সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, “তুমি এখন যাও বাবু; ঠাক্রুণ, তুমি এখন সর; আমি তামাক খাব, মুখ ধোব, দাঁতন হয়নি” – ইত্যাদি। এইরূপে কখনও ভক্তদিগের সহিত এবং কখনও ভাবাবেশে দৃষ্ট মূর্তির সহিত কথা কহিতে কহিতে ঠাকুর ক্রমে সাধারণ মানবের মতো বাহ্যচৈতন্য প্রাপ্ত হইলেন।

ভাবভঙ্গে আগত ভক্তেরা সব কি খাইবে বলিয়া ঠাকুরের চিন্তা ও স্ত্রী-ভক্তদের বাজার করিতে পাঠান

সাধারণ মানবের ন্যায় যখন থাকিতেন, তখন ঠাকুরের ভক্তদিগের নিমিত্তই চিন্তা। শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীকে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইলেন ঘরে কিছু তরিতরকারি আছে কি না। শ্রীশ্রীমা তদুত্তরে ‘কিছুই নাই’ বলিয়া পাঠাইলে ঠাকুরের আবার ভাবনা হইল, ‘কে এখন বাজারে যায়’; কারণ, বাজার হইতে কিছু শাকসবজি কিনিয়া না আনিলে কলিকাতা হইতে আগত স্ত্রী-পুরুষ ভক্তেরা খাইবে কি দিয়া? ভাবিয়া চিন্তিয়া স্ত্রী-ভক্ত দুইটিকে বলিলেন, “বাজার করতে যেতে পারবে?” তাঁহারাও বলিলেন, ‘পারব’ এবং বাজারে যাইয়া দুটো বড় বেগুন, কিছু আলু ও শাক কিনিয়া আনিলেন; শ্রীশ্রীমা ঐসকল রন্ধন করিলেন। কালীবাড়ী হইতেও ঠাকুরের নিত্য বরাদ্দ এক থাল মা কালীর প্রসাদ আসিল। পরে ঠাকুরের ভোজন সাঙ্গ হইলে ভক্তেরা সকলে প্রসাদ গ্রহণ করিলেন।

তৎপরে ঠাকুরের ভাবাবস্থার সময় শ্রীযুত ছোট নরেন ধরিতে যাইলে ঠাকুরের ওরূপ কষ্ট কেন হইল, সে কথার অনুসন্ধানে কারণ জানিতে পারা গেল। ছোট নরেনের মস্তকের বাঁ দিককার রগে একটি ছোট আব্ হইয়াছিল ও ক্রমে সেটি বড় হইতেছিল। সেটা পরে যন্ত্রণাদায়ক হইবে বলিয়া ডাক্তারেরা ঔষধ দিয়া ঐ স্থানটিতে ঘা করিয়া দিয়াছিল। পূর্বে শুনিয়াছিলাম বটে, শরীরে ক্ষত থাকিলে দেবমূর্তি স্পর্শ করিতে নাই, কিন্তু কথাটার সত্যতা যে আমাদের চক্ষুর সম্মুখে এইরূপে প্রমাণিত হইবে, তাহা আর কে ভাবিয়াছিল! দেবভাবে তন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হইয়া বাহ্যজ্ঞান একেবারে লুপ্ত হইলেও ঠাকুর যে কি অন্তর্নিহিত দৈবশক্তিবলে ঐরূপ করিয়া উঠিলেন, তাহা বুঝা সাধ্যায়ত্ত না হইলেও তাঁহার যে বাস্তবিকই কষ্ট হইয়াছিল, এ কথা নিঃসন্দেহ। ছোট নরেনকে ঠাকুর কত শুদ্ধস্বভাব বলিতেন তাহা আমাদের জানা ছিল এবং সাধারণ অবস্থায় ঠাকুর অপরসকলের ন্যায় তাঁহাকে শরীরে ঐরূপ ক্ষতস্থান থাকিলেও ছুঁইতেছেন, পদস্পর্শ করিতে দিতেছেন ও তাঁহার সহিত একত্র বসা-দাঁড়ানো করিতেছেন। অতএব তিনিই বা কেমন করিয়া জানিবেন, ভাবের সময় ঠাকুর ঐরূপে তাঁহার স্পর্শ সহ্য করিতে পারিবেন না? যাহা হউক, তদবধি তিনি যত দিন না উক্ত ক্ষতটি আরাম হইল, তত দিন আর ভাবাবস্থার সময় ঠাকুরকে স্পর্শ করিতেন না।

ঠাকুরের সহিত নানা সৎপ্রসঙ্গে সমস্ত দিন কোথা দিয়া কাটিয়া গেল। পরে সন্ধ্যা আগতপ্রায় দেখিয়া ভক্তেরা যে যাঁহার বাটীর দিকে চলিলেন। স্ত্রী-লোক দুইটিও ঠাকুরের ও শ্রীশ্রীমার নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া পদব্রজে কলিকাতায় আসিলেন।

বালকস্বভাব ঠাকুরের বালকের ন্যায় ভয়

পূর্বোক্ত ঘটনাগুলির পরে দুই-তিন দিন গত হইয়াছে! আজ পণ্ডিত শশধর ঠাকুরকে দর্শন করিতে অপরাহ্ণে দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে আসিবেন। বালকস্বভাব ঠাকুরের অনেক সময় বালকের ন্যায় ভয়ও হইত। বিশেষ কোন খ্যাতনামা ব্যক্তি তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিবেন শুনিলেই ভয় পাইতেন। ভাবিতেন, তিনি তো লেখাপড়া কিছুই জানেন না, তাহার উপর কখন কিরূপ ভাবাবেশ হয় তাহার তো কিছুই ঠিক-ঠিকানা নাই, আবার তাহার উপর ভাবের সময় নিজের শরীরেরই হুঁশ থাকে না তো পরিধেয় বস্ত্রাদির! – এরূপ অবস্থায় আগন্তুক কি ভাবিবে ও বলিবে! আমাদের মনে হইত, আগন্তুক যাহাই কেন ভাবুক না, তাহাতে তাঁহার আসিয়া গেল কি? তিনি তো নিজেই বার বার কত লোককে শিক্ষা দিতেছেন, ‘লোক না পোক (কীট); লজ্জা ঘৃণা ভয় – তিন থাকতে নয়।’ তবে কি ইনি নামযশের কাঙালী? কিন্তু যাচাইয়া দেখিতে যাইলেই, দেখিতাম – বালক যেমন কোন অপরিচিত ব্যক্তিকে দেখিলে ভয়ে লজ্জায় জড়সড় হয়, আবার একটু পরিচয় হইলে সেই ব্যক্তিরই কাঁধে পিঠে চড়িয়া চুল টানিয়া নিঃশঙ্ক চিত্তে নানারূপ মিষ্ট অত্যাচার করে – ঠাকুরের এই ভাবটিও ঠিক তদ্রূপ। নতুবা মহারাজ যতীন্দ্রমোহন, সুবিখ্যাত কৃষ্ণদাস পাল প্রভৃতির সহিত তিনি যেরূপ স্বাধীনভাবে কথাবার্তা কহিয়াছিলেন, তাহাতে বেশ বুঝা যায় যে, নামযশের কিছুমাত্র ইচ্ছা ভিতরে থাকিলে তিনি তাঁহাদের সহিত কখনই ঐভাবে কথা কহিতে পারিতেন না।1

আবার কখনও কখনও দেখা গিয়াছে, ঠাকুর আগন্তুকের পাছে অকল্যাণ হয় ভাবিয়া ভয়ও পাইতেন। কারণ তাঁহার আচরণ ও ব্যবহার প্রভৃতি বুঝিতে পারুক বা নাই পারুক তাহাতে ঠাকুরের কিছু আসিয়া যাইত না সত্য; কিন্তু বুঝিতে না পারিয়া আগন্তুক যদি ঠাকুরের অযথা নিন্দাবাদ করিত, তাহাতে তাহারই অকল্যাণ নিশ্চিত জানিয়াই ঠাকুর ঐরূপ ভয় পাইতেন। তাই শ্রীযুত গিরিশ অভিমান-আবদারে কোন সময়ে ঠাকুরের সম্মুখে তাঁহার প্রতি নানা কটূক্তি প্রয়োগ করিলে ঠাকুর বলিয়াছিলেন, “ওরে, ও আমাকে যা বলে বলুকগে, আমার মাকে কিছু বলেনি তো?” যাক এখন সে কথা।


1. মহারাজ যতীন্দ্রমোহনকে প্রথমেই বলিয়াছিলেন, “তা বাবু, আমি কিন্তু তোমায় রাজা বলতে পারব না; মিথ্যা কথা বলব কিরূপে?” আবার মহারাজ যতীন্দ্রমোহন নিজের কথা বলিতে বলিতে যখন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সহিত আপনার তুলনা করেন, তখন ঠাকুর বিশেষ বিরক্তির সহিত তাঁহার ঐরূপ বুদ্ধির নিন্দা করিয়াছিলেন। শ্রীযুত কৃষ্ণদাস পালও যখন জগতের উপকার করা ছাড়া আর কোন ধর্মই নাই ইত্যাদি বলিয়া ঠাকুরের সহিত তর্ক উত্থাপন করেন, তখন ঠাকুর বিশেষ বিরক্তির সহিত তাঁহার বুদ্ধির দোষ দর্শাইয়া দেন।

শশধর পণ্ডিতের দ্বিতীয় দিবস ঠাকুরকে দর্শন

পণ্ডিত শশধর তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিবেন শুনিয়া ঠাকুরের আর ভয়ের সীমা-পরিসীমা নাই। শ্রীযুত যোগেন (স্বামী যোগানন্দ), শ্রীযুত ছোট নরেন ও আর আর অনেককে বলিলেন, “ওরে, তোরা তখন (পণ্ডিতজী যখন আসিবেন) থাকিস!” ভাবটা এই যে, তিনি মূর্খ মানুষ, পণ্ডিতের সহিত কথা কহিতে কি বলিতে কি বলিবেন, তাই আমরা সব উপস্থিত থাকিয়া পণ্ডিতজীর সহিত কথাবার্তা কহিব ও ঠাকুরকে সামলাইব! আহা, সে ছেলেমানুষের মতো ভয়ের কথা অপরকে বুঝানো দুষ্কর। কিন্তু পণ্ডিত শশধর যখন বাস্তবিক উপস্থিত হইলেন, তখন ঠাকুর যেন আর একজন! হাস্যপ্রস্ফুরিতাধরে স্থির দৃষ্টিতে তাঁহার দিকে দেখিতে দেখিতে তাঁহার অর্ধবাহ্যদশার মতো অবস্থা হইল এবং পণ্ডিত শশধরকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “ওগো, তুমি পণ্ডিত, তুমি কিছু বল।”

শশধর – মহাশয়, দর্শন-শাস্ত্র পড়িয়া আমার হৃদয় শুষ্ক হইয়া গিয়াছে; তাই আপনার নিকটে আসিয়াছি ভক্তিরস পাইব বলিয়া; অতএব আমি শুনি, আপনি কিছু বলুন।

ঠাকুর – আমি আর কি বলব, বাবু! সচ্চিদানন্দ যে কি (পদার্থ) তা কেউ বলতে পারে না! তাই তিনি প্রথম হলেন অর্ধনারীশ্বর। কেন? – না, দেখাবেন বলে যে পুরুষ প্রকৃতি দুই-ই আমি। তারপর তা থেকে আরও এক থাক নেবে আলাদা আলাদা পুরুষ ও আলাদা আলাদা প্রকৃতি হলেন।

ঐরূপে আরম্ভ করিয়া আধ্যাত্মিক নিগূঢ় কথাসকল বলিতে বলিতে উত্তেজিত হইয়া ঠাকুর দাঁড়াইয়া উঠিয়া পণ্ডিত শশধরকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন।

ঠাকুর – সচ্চিদানন্দে যতদিন মন না লয় হয় ততদিন তাঁকে ডাকা ও সংসারের কাজ করা দুই-ই থাকে। তারপর তাঁতে মন লয় হলে, আর কোন কাজ করবার প্রয়োজন থাকে না। যেমন ধর কীর্তন গাইছে – ‘নিতাই আমার মাতা (মত্ত) হাতি।’ যখন প্রথম গান ধরেছে তখন গানের কথা, সুর, তাল, মান, লয় – সকল দিকে মন রেখে ঠিক করে গাইছে। তারপর যেই গানের ভাবে মন একটু লয় হয়েছে তখন কেবল বলছে – ‘মাতা হাতি, মাতা হাতি।’ পরে যেই আরও মন ভাবে লয় হলো অমনি খালি বলছে – ‘হাতি, হাতি।’ আর, যেই মন আরও ভাবে লয় হলো অমনি ‘হাতি’ বলতে গিয়ে ‘হা -‘ (বলেই হাঁ করে রইল)!

ঠাকুর ঐরূপে ‘হা -‘ পর্যন্ত বলিয়াই ভাবাবেশে একেবারে নির্বাক নিস্পন্দ হইয়া গেলেন এবং ঐ প্রকার অবস্থায় প্রায় পনর মিনিট কাল প্রসন্নোজ্জ্বলবদনে বাহ্যজ্ঞান-শূন্য হইয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। ভাবাবসানে আবার শশধরকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন।

ঠাকুর – ওগো পণ্ডিত, তোমায় দেখলুম।1 তুমি বেশ লোক। গিন্নী যেমন রেঁধেবেড়ে সকলকে খাইয়ে-দাইয়ে গামছাখানা কাঁধে ফেলে পুকুরঘাটে গা ধুতে, কাপড় কাচতে যায়, আর হেঁশেল-ঘরে ফেরে না – তুমিও তেমনি সকলকে তাঁর কথা বলে কয়ে যে যাবে, আর ফিরবে না!

পণ্ডিত শশধর ঠাকুরের ঐ কথা শুনিয়া, ‘সে আপনাদের অনুগ্রহ’ – বলিয়া ঠাকুরের পদধূলি বারংবার গ্রহণ করিতে লাগিলেন এবং তাঁহার ঐসকল কথা শুনিতে শুনিতে স্তম্ভিত, ও আর্দ্র হৃদয়ে ভগবদ্বস্তু জীবনে লাভ হইল না ভাবিয়া অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন।


1. অর্থাৎ সমাধিসহায়ে উচ্চভূমিতে উঠিয়া তোমার অন্তরে কিরূপ পূর্বসংস্কারসকল আছে তাহা দেখিলাম।

ঠাকুর ঐ দিনের কথা জনৈক ভক্তকে নিজে যেমন বলিয়াছিলেন

আমাদের একজন পরম বন্ধু পণ্ডিত শশধরের দক্ষিণেশ্বরে আগমনের পরদিন ঠাকুরের নিকট উপস্থিত হইলে, ঠাকুর যেভাবে ঐ বিষয় তাঁহার নিকট বলিয়াছিলেন – তাহাই আমরা এখন এখানে বলিব।

ঠাকুর – ওগো, দেখছই তো এখানে ওসব (লেখাপড়া) কিছু নেই, মুখ্যু-শুখ্যু মানুষ, পণ্ডিত দেখা করতে আসবে শুনে বড় ভয় হলো। এই তো দেখছ, পরনের কাপড়েরই হুঁশ থাকে না, কি বলতে কি বলব ভেবে একেবারে জড়সড় হলুম! মাকে বললুম, ‘দেখিস, মা, আমি তো তোকে ছাড়া শাস্তর (শাস্ত্র) মাস্তর কিছুই জানি না, দেখিস।’ তারপর একে বলি ‘তুই তখন থাকিস’, ওকে বলি ‘তুই তখন আসিস – তোদের সব দেখলে তবু ভরসা হবে।’ পণ্ডিত যখন এসে বসল তখনও ভয় রয়েছে – চুপ করে বসে তার দিকেই দেখছি, তার কথাই শুনছি, এমন সময় দেখছি কি – যেন তার (পণ্ডিতের) ভেতরটা মা দেখিয়ে দিচ্ছে – শাস্তর (শাস্ত্র) মাস্তর পড়লে কি হবে, বিবেক বৈরাগ্য না হলে ওসব কিছুই নয়! তার পরেই সড় সড় করে (নিজ শরীর দেখাইয়া) একটা মাথার দিকে উঠে গেল আর ভয়-ডর সব কোথা চলে গেল! একেবারে বিভ্ভুল হয়ে গেলুম! মুখ উঁচু হয়ে গিয়ে তার ভিতর থেকে যেন একটা কথার ফোয়ারা বেরুতে লাগল – এমনটা বোধ হতে লাগল! যত বেরুচ্চে, তত ভেতর থেকে যেন কে ঠেলে ঠেলে যোগান দিচ্চে! ও দেশে (কামারপুকুরে) ধান মাপবার সময় যেমন একজন ‘রামে রাম, দুইয়ে দুই’ করে মাপে, আর একজন তার পেছনে বসে রাশ (ধানের রাশি) ঠেলে দেয়, সেইরূপ। কিন্তু কি যে সব বলেছি, তা কিছুই জানি না! যখন একটু হুঁশ হলো তখন দেখছি কি যে, সে (পণ্ডিত) কাঁদছে, একেবারে ভিজে গেছে! ঐ রকম একটা আবস্থা (অবস্থা) মাঝে মাঝে হয়। কেশব যেদিন খবর পাঠালে, জাহাজে করে গঙ্গায় বেড়াতে নিয়ে যাবে, একজন সাহেবকে (ভারতভ্রমণে আগত পাদ্রি কুক্) সঙ্গে করে নিয়ে আসচে, সেদিনও ভয়ে কেবলই ঝাউতলার দিকে (শৌচে) যাচ্চি! তারপর যখন তারা এল আর জাহাজে উঠলুম, তখন এই রকমটা হয়ে গিয়েছিল! আর কত কি বলেছিলুম! পরে এরা (আমাদের দেখাইয়া) সব বললে, ‘খুব উপদেশ দিয়েছিলেন।’ আমি কিন্তু বাবু কিছুই জানিনি!

ঠাকুরের অলৌকিক ব্যবহার দেখিয়া অন্যান্য অবতারের সম্বন্ধে প্রচলিত ঐরূপ কথাসকল সত্য বলিয়া বিশ্বাস হয়

অদ্ভুত ঠাকুরের এই প্রকার অদ্ভুত অবস্থার কথা কেমন করিয়া বুঝিব? আমরা অবাক হইয়া হাঁ করিয়া শুনিতাম মাত্র। কি এক অদৃষ্টপূর্ব শক্তি যে তাঁহার শরীর-মনটাকে আশ্রয় করিয়া এইসকল অপূর্ব লীলার বিস্তার করিত, অভূতপূর্ব আকর্ষণে যাহাকে ইচ্ছা টানিয়া আনিয়া দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত করিত ও ধর্মরাজ্যের উচ্চতর স্তরসমূহে আরোহণে সামর্থ্য প্রদান করিত, তাহা দেখিয়াও বুঝা যাইত না। তবে ফল দেখিয়া বুঝা যাইত, সত্যই ঐরূপ হইতেছে, এই পর্যন্ত। কতবারই না আমাদের চক্ষুর সম্মুখে দেখিয়াছি, অতি দ্বেষী ব্যক্তি দ্বেষ করিবার জন্য ঠাকুরের নিকট আসিয়াছে এবং ঠাকুরও ঐ শক্তিপ্রভাবে আত্মহারা হইয়া ভাবাবেশে তাহাকে স্পর্শ করিয়াছেন, আর সেই ক্ষণ হইতে তাহার ভিতরের স্বভাব আমূল পরিবর্তিত হইয়া সে নব জীবনলাভে ধন্য হইয়াছে। বেশ্যা মেরীকে স্পর্শমাত্রে ঈশা নূতন জীবন দান করিলেন, ভাবাবেশে শ্রীচৈতন্য কাহারও স্কন্ধে আরোহণ করিলেন ও তাহার ভিতরের সংশয়, অবিশ্বাস প্রভৃতি পাষণ্ড ভাবসকল দলিত হইয়া সে ভক্তিলাভ করিল। ভগবদবতারদিগের জীবনপাঠে ঐসকল ঘটনার বর্ণনা দেখিয়া পূর্বে পূর্বে ভাবিতাম, শিষ্য-প্রশিষ্যগণের গোঁড়ামি ও দলপুষ্টি করিবার হীন ইচ্ছা হইতেই ঐরূপ মিথ্যা কল্পনাসমূহ লিপিবদ্ধ হইয়া ধর্মরাজ্যের যথাযথ সত্যলাভের পথে বিষম অন্তরায়স্বরূপ হইয়া রহিয়াছে! আমাদের মনে আছে, হরিনামে শ্রীচৈতন্যের বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হইত, নববিধান সমাজ হইতে প্রকাশিত ‘ভক্তিচৈতন্যচন্দ্রিকা’-নামক গ্রন্থে এ কথাটি সত্য বলিয়া স্বীকৃত দেখিয়া আমরা তখন ভাবিয়াছিলাম, গ্রন্থকারের মস্তিষ্কের কিছু গোল হইয়াছে! কি কূপমণ্ডুকই না আমরা তখন ছিলাম এবং ঠাকুরের দর্শন না পাইলে কি দুর্দশাই না আমাদের হইত! ঠাকুরের দর্শন পাইয়া এখন ‘ছাইতে না জানি গোড় চিনি’ অন্ততঃ এ অবস্থাটাও হইয়াছে। এখন নিজের পাজি মন যে নানা সন্দেহ তুলিয়া বা অপরে যে নানা কথা কহিয়া একটা যাহা-তাহাকে ধর্ম বলিয়া বুঝাইয়া যাইবে, সেটার হাত হইতে অন্ততঃ নিষ্কৃতি পাইয়াছি; আর ভক্তিবিশ্বাসাদি অন্যান্য বস্তুর ন্যায় যে হাতে হাতে অপরকে সাক্ষাৎ দেওয়া যায়, এ কথাটিও এখন জানিতে পারিয়া ‘অহেতুক কৃপাসিন্ধু’ ঠাকুরের কৃপাকণালাভে অমৃতত্ব পাইব ধ্রুব, বুঝিয়া আশাপথ চাহিয়া পড়িয়া আছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *