৪.৪ গুরুভাব-সম্বন্ধে শেষ কথা

চতুর্থ খণ্ড – চতুর্থ অধ্যায়: গুরুভাব-সম্বন্ধে শেষ কথা

বেদে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষকে সর্বজ্ঞ বলায় আমাদের না বুঝিয়া বাদানুবাদ

অজোঽপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোঽপি সন্।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া॥
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥
– গীতা, ৪।৬-৮

বেদপ্রমুখ শাস্ত্র বলেন, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ সর্বজ্ঞ হন। সাধারণ মানবের ন্যায় তাঁহার মনে কোনরূপ মিথ্যা সঙ্কল্পের কখনও উদয় হয় না। তাঁহারা যখনই যে বিষয় জানিতে বুঝিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহাদের অন্তর্দৃষ্টির সম্মুখে সে বিষয় তখনই প্রকাশিত হয়, অথবা তদ্বিষয়ের তত্ত্ব তাঁহারা বুঝিতে পারেন। কথাগুলি শুনিয়া ভাব বুঝিতে না পারিয়া আমরা পূর্বে শাস্ত্রের বিরুদ্ধ পক্ষ অবলম্বন করিয়া কতই না মিথ্যা তর্কের অবতারণা করিয়াছি! বলিয়াছি, ঐ কথা যদি সত্য হয় তবে ভারতের পূর্ব পূর্ব যুগের ব্রহ্মজ্ঞেরা জড়বিজ্ঞান সম্বন্ধে এত অজ্ঞ ছিলেন কেন? হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন একত্র মিলিত হইয়া যে জল হয়, এ কথা ভারতের কোন্ ব্রহ্মজ্ঞ বলিয়া গিয়াছেন? তড়িৎশক্তির সহায়ে চার-পাঁচ ঘণ্টার ভিতরেই যে ছয় মাসের পথ আমেরিকাপ্রদেশের সংবাদ আমরা এখানে বসিয়া পাইতে পারি এ কথা তাঁহারা বলিয়া যান নাই কেন? অথবা যন্ত্রসাহায্যে মানুষ যে বিহঙ্গমের ন্যায় আকাশচারী হইতে পারে, এ কথাই বা জানিতে পারেন নাই কেন?

ঠাকুর উহা কি ভাবে সত্য বলিয়া বুঝাইতেন; “ভাতের হাঁড়ির একটি ভাত টিপে বুঝা, সিদ্ধ হয়েছে কি না”

ঠাকুরের নিকট আসিয়াই শুনিলাম, শাস্ত্রের ঐ কথা ঐভাবে বুঝিতে যাইলে তাহার কোন অর্থই পাওয়া যাইবে না; অথচ শাস্ত্র যেভাবে ঐ কথা বলিয়াছেন, সেভাবে দেখিলে উহা সত্য বলিয়া নিশ্চয় প্রতীতি হইবে। এজন্য ঠাকুর শাস্ত্রের ঐ কথা দুই-একটি গ্রাম্য দৃষ্টান্তসহায়ে বুঝাইয়া বলিতেন, “হাঁড়িতে ভাত ফুটছে; চালগুলি সুসিদ্ধ হয়েছে কি না জান্তে তুই তার ভেতর থেকে একটা ভাত তুলে টিপে দেখলি যে হয়েছে – আর অমনি বুঝতে পারলি যে, সব চালগুলি সিদ্ধ হয়েছে। কেন? তুই তো ভাতগুলির সব এক একটি করে টিপে টিপে দেখলি না – তবে কি করে বুঝলি? ঐ কথা যেমন বোঝা যায়, তেমনি জগৎসংসারটা নিত্য কি অনিত্য, সৎ কি অসৎ – এ কথাও সংসারের দুটো-চারটে জিনিস পরখ (পরীক্ষা) করে দেখেই বোঝা যায়। মানুষটা জন্মাল, কিছুদিন বেঁচে রইল, তারপর মলো, গরুটাও – তাই; গাছটাও – তাই; এইরূপে দেখে দেখে বুঝলি যে, যে জিনিসেরই নাম আছে, রূপ আছে, সেগুলোরই এই ধারা। পৃথিবী, সূর্যলোক, চন্দ্রলোক, সকলের নাম রূপ আছে, অতএব তাদেরও এই ধারা। এইরূপে জানতে পারলি, সমস্ত জগৎ-সংসারটারই এই স্বভাব। তখন জগতের ভিতরের সব জিনিসেরই স্বভাবটা জানলি – কি না? এইরূপে যখনি সংসারটাকে ঠিক ঠিক অনিত্য, অসৎ বলে বুঝবি, অমনি সেটাকে আর ভালবাসতে পারবি না – মন থেকে ত্যাগ করে নির্বাসনা হবি। আর যখনি ত্যাগ করবি, তখনি জগৎকারণ ঈশ্বরের দেখা পাবি। ঐরূপে যার ঈশ্বরদর্শন হলো, সে সর্বজ্ঞ হলো না তো কি হলো তা বল!”

কোন বিষয়ের উৎপত্তির কারণ হইতে লয় অবধি জানাই তদ্বিষয়ের সর্বজ্ঞতা; ঈশ্বর-লাভে জগৎ-সম্বন্ধেও তদ্রূপ হয়

ঠাকুরের এত কথার পরে আমরা বুঝিতে পারিলাম – ঠিক কথাই তো, একভাবে সর্বজ্ঞই তো সে হইল বটে! কোন একটা পদার্থের আদি মধ্য ও অন্ত দেখিতে পাওয়া এবং ঐ পদার্থটার উৎপত্তি যাহা হইতে হইয়াছে তাহা দেখিতে বা জানিতে পারাকেই তো আমরা সেই পদার্থের জ্ঞান বলিয়া থাকি। তবে পূর্বোক্তভাবে জগৎসংসারটাকে জানা বা বুঝাকেও জ্ঞান বলিতে হইবে। আবার ঐ জ্ঞান জগদন্তর্গত সকল পদার্থ সম্বন্ধেই সমভাবে সত্য। কাজেই উহাকে জগদন্তর্গত সব পদার্থের জ্ঞান বলিতে হয় এবং যাঁহার ঐরূপ জ্ঞান হয়, তাঁহাকে সর্বজ্ঞ তো বাস্তবিকই বলা যায়। শাস্ত্র তো তবে ঠিকই বলিয়াছে।

ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ সিদ্ধসঙ্কল্প হন, একথাও সত্য। ঐকথার অর্থ। ঠাকুরের জীবন দেখিয়া ঐ সম্বন্ধে কি বুঝা যায়। “হাড়মাসের খাঁচায় মন আনতে পারলুম না!”

ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ সত্যসঙ্কল্প হন, সিদ্ধসঙ্কল্প হন, শাস্ত্রীয় ঐ বচনেরও তখন একটা মোটামুটি অর্থ খুঁজিয়া পাইলাম। বুঝিতে পারিলাম যে, এক একটা বিষয়ে মনের সমগ্র চিন্তাশক্তি একত্রিত করিয়া অনুসন্ধানেই আমাদের তত্তদ্বিষয়ে জ্ঞান আসিয়া উপস্থিত হয়, ইহা নিত্য-প্রত্যক্ষ। তবে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ, যিনি আপন মনকে সম্পূর্ণরূপে বশীভূত এবং আয়ত্ত করিয়াছেন, তিনি যখনই যে কোন বিষয় জানিবার জন্য মনের সর্বশক্তি একত্রিত করিয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবেন, তখনই অতি সহজে যে তিনি ঐ বিষয়ের জ্ঞানলাভ করিতে পারিবেন, এ কথা তো বিচিত্র নহে। তবে উহার ভিতর একটা কথা আছে – যিনি সমগ্র জগৎসংসারটাকে অনিত্য বলিয়া ধ্রুব ধারণা করিয়াছেন এবং সর্বশক্তির আকরস্বরূপ জগৎকারণ ঈশ্বরকে প্রেমে সাক্ষাৎসম্বন্ধেও ধরিতে পারিয়াছেন, তাঁহার রেলগাড়ি চালাইতে, মানুষমারা কলকারখানা নির্মাণ করিতে সঙ্কল্প বা প্রবৃত্তি হইবে কি না। যদি ঐরূপ সঙ্কল্প তাঁহাদের মনে উদিত হওয়া অসম্ভব হয়, তাহা হইলেই তো আর ঐরূপ কলকারখানা নির্মিত হইল না। ঠাকুরের দিব্যসঙ্গলাভে দেখিলাম, বাস্তবিকই ঐরূপ হয়। বাস্তবিকই তাঁহাদের ভিতর ঐরূপ প্রবৃত্তির উদয় হওয়া অসম্ভব হইয়া উঠে। ঠাকুর কাশীপুরে দারুণ ব্যাধিতে ভুগিতেছেন, এমন সময়ে স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ আমরা, আমাদের কল্যাণের নিমিত্ত মনঃশক্তি-প্রয়োগে রোগমুক্ত হইতে সজল-নয়নে তাঁহাকে অনুরোধ করিলেও তিনি ঐরূপ চেষ্টা বা সঙ্কল্প করিতে পারিলেন না! বলিলেন, ঐরূপ করিতে যাইয়া সঙ্কল্পের একটা দৃঢ়তা বা আঁট কিছুতেই মনে আনিতে পারিলেন না! বলিলেন, “এ হাড়-মাসের খাঁচাটার উপর মনকে সচ্চিদানন্দ হতে ফিরিয়ে কিছুতেই আনতে পারলুম না! সর্বদা শরীরটাকে তুচ্ছ হেয় জ্ঞান করে যে মনটা জগদম্বার পাদপদ্মে চিরকালের জন্য দিয়েছি, সেটাকে এখন তা থেকে ফিরিয়ে শরীরটাতে আনতে পারি কি রে?”

ঐ বিষয় বুঝিতে ঠাকুরের জীবন হইতে আর একটি ঘটনার উল্লেখ। “মন উঁচু বিষয়ে রয়েচে, নীচে নামাতে পারলুম না”

আর একটা ঘটনার উল্লেখ এখানে করিলে পাঠকের ঐ বিষয়টি বুঝা সহজ হইবে। বাগবাজারের শ্রীযুক্ত বলরাম বসু মহাশয়ের বাটীতে ঠাকুর একদিন আসিয়াছেন। বেলা তখন দশটা হইবে। ঠাকুরের এখানে সে দিন আসাটা পূর্ব হইতে স্থির ছিল। কাজেই শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রনাথ প্রমুখ অনেকগুলি যুবক ভক্ত তাঁহার দর্শনলাভের জন্য সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং কখনও ঠাকুরের সহিত এবং কখনও তাঁহাদের পরস্পরের ভিতরে নানা প্রসঙ্গ চলিতে লাগিল। সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়াতীত বিষয় দেখার কথায় ক্রমে অণুবীক্ষণ-যন্ত্রের কথা আসিয়া পড়িল। স্থূল চক্ষে যাহা দেখা যায় না, ঐরূপ সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পদার্থও উহার সহায়ে দেখিতে পাওয়া যায়, একগাছি অতি ক্ষুদ্র রোমকে ঐ যন্ত্রের ভিতর দিয়া দেখিলে একগাছি লাঠির মতো দেখায় এবং দেহের প্রত্যেক রোমগাছটি পেঁপের ডালের মতো ফাঁপা ইহাও দেখিতে পাওয়া যায়, ইত্যাদি নানা কথা শুনিয়া ঠাকুর ঐ যন্ত্রসহায়ে দুই-একটি পদার্থ দেখিতে বালকের ন্যায় আগ্রহ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। কাজেই ভক্তগণ স্থির করিলেন, সেদিন অপরাহ্ণেই কাহারও নিকট হইতে ঐ যন্ত্র চাহিয়া আনিয়া ঠাকুরকে দেখাইবেন।

তখন অনুসন্ধানে জানা গেল, শ্রীযুক্ত প্রেমানন্দ স্বামীজীর ভ্রাতা, আমাদের শ্রদ্ধাস্পদ বন্ধু ডাক্তার বিপিনবিহারী ঘোষ – তিনি অল্প দিন মাত্রই ডাক্তারী পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন – ঐরূপ একটি যন্ত্র মেডিকেল কলেজ হইতে পুরস্কারস্বরূপে প্রাপ্ত হইয়াছেন। ঐ যন্ত্রটি আনয়ন করিয়া ঠাকুরকে দেখাইবার জন্য তাঁহার নিকট লোক প্রেরিত হইল। তিনিও সংবাদ পাইয়া কয়েক ঘণ্টা পরে বেলা চারিটা আন্দাজ যন্ত্রটি লইয়া আসিলেন এবং উহা ঠিকঠাক করিয়া খাটাইয়া ঠাকুরকে তন্মধ্য দিয়া দেখিবার জন্য আহ্বান করিলেন।

ঠাকুর উঠিলেন, দেখিতে যাইলেন, কিন্তু না দেখিয়াই আবার ফিরিয়া আসিলেন! সকলে কারণ জিজ্ঞাসা করিলে বলিলেন, “মন এখন এত উঁচুতে উঠে রয়েছে যে, কিছুতেই এখন তাকে নামিয়ে নিচের দিকে দেখতে পারছি না।” আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিলাম – ঠাকুরের মন যদি নামিয়া আসে তজ্জন্য। কিন্তু কিছুতেই সেদিন আর ঠাকুরের মন ঐ উচ্চ ভাবভূমি হইতে নামিল না – কাজেই তাঁহার আর সেদিন অণুবীক্ষণসহায়ে কোন পদার্থই দেখা হইল না। বিপিনবাবু আমাদের কয়েকজনকে ঐ সকল দেখাইয়া অগত্যা যন্ত্রটি ফিরাইয়া লইয়া যাইলেন।

ঠাকুরের দুই দিক দিয়া দুই প্রকারের সকল বস্তু ও বিষয় দেখা

দেহাদি-ভাব ছাড়াইয়া ঠাকুরের মন যখন যত উচ্চ উচ্চতর ভাবভূমিতে বিচরণ করিত, তখন তাঁহার তত্তৎ ভূমি হইতে লব্ধ তত অসাধারণ দিব্যদর্শনসমূহ আসিয়া উপস্থিত হইত এবং দেহ হইতে সম্পূর্ণ বিযুক্ত হইয়া যখন তিনি সর্বোচ্চ অদ্বৈতভাবভূমিতে বিচরণ করিতেন, তখন তাঁহার হৃদয়ের স্পন্দনাদি দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয়ব্যাপার কিছুকালের জন্য রুদ্ধ হইয়া দেহটা মৃতবৎ পড়িয়া থাকিত এবং মনের চিন্তাকল্পনাদি সমস্ত ব্যাপারও সম্পূর্ণরূপে স্থির হইয়া যাইয়া তিনি অখণ্ডসচ্চিদানন্দের সহিত এককালে অপৃথকভাবে অবস্থান করিতেন।

অদ্বৈত ভাবভূমি ও সাধারণ ভাবভূমি – ১মটি হইতে ইন্দ্রিয়াতীত দর্শন; ২য়টি হইতে ইন্দ্রিয় দ্বারা দর্শন

আবার ঐ সর্বোচ্চ ভাবভূমি হইতে নিম্নে নিম্নতর ভূমিতে ক্রমে ক্রমে নামিতে নামিতে যখন ঠাকুরের মানবসাধারণের ন্যায় ‘এই দেহটা আমার’ – পুনরায় এইরূপ ভাবের উদয় হইত, তখন তিনি আবার আমাদের ন্যায় চক্ষুদ্বারা দর্শন, কর্ণদ্বারা শ্রবণ, ত্বকদ্বারা স্পর্শ এবং মনের দ্বারা চিন্তা-সঙ্কল্পাদি করিতেন।

সাধারণ মানব ২য় প্রকারেই সকল বিষয় দেখে

পাশ্চাত্যের একজন প্রধান দার্শনিক1 মানব মনের সমাধিভূমিতে ঐপ্রকারের আরোহণ-অবরোহণের কিঞ্চিৎ আভাস পাইয়াই সাধারণ মানবের দেহান্তর্গত চৈতন্যও যে সকল সময় একাবস্থায় থাকে না, এইপ্রকার মত প্রকাশ করিয়াছেন। ঐ মতই যে যুক্তিযুক্ত এবং ভারতের পূর্ব পূর্ব সকল ঋষিগণের অনুমোদিত, এ কথা আর বলিতে হইবে না। তবে সাধারণ মানব ঐ উচ্চতম অদ্বৈত-ভাবভূমিতে বহুকাল আরোহণ না করিয়া উহার কথা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছে এবং ইন্দ্রিয়াদি-সহায়েই কেবলমাত্র জ্ঞানলাভ করা যায়, এই কথাটায় একেবারে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করিয়া সংসারে একপ্রকার নোঙর ফেলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া আছে। নিজ জীবনে তদ্বিপরীত করিয়া দেখাইয়া তাহার ঐ ভ্রম দূর করিতেই যে ঠাকুরের ন্যায় অবতারপ্রথিত জগদ্গুরু আধিকারিক পুরুষসকলের কালে কালে উদয় – এ কথাই বেদপ্রমুখ শাস্ত্র আমাদের শিক্ষা দিতেছেন।


1. Ralph Waldo Emerson – “Consciousness ever moves along a graded plane.”

ঠাকুরের দুই প্রকার দৃষ্টির দৃষ্টান্ত

সে যাহাই হউক, এখন বুঝা যাইতেছে যে, ঠাকুর সংসারের সকল বস্তু ও ব্যক্তিকে আমাদের মতো কেবল একভাবেই দেখিতেন না। উচ্চ উচ্চতর ভাবভূমিসকলে আরোহণ করিয়া ঐসকল বস্তু ও ব্যক্তিকে যেমন দেখায়, তাহাও সর্বদা দেখিতে পাইতেন। তজ্জন্যই তাঁহার সংসারের কোন বিষয়েই আমাদের ন্যায় একদেশী মত ও ভাবাবলম্বী হওয়া অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছিল; এবং সেজন্যই তিনি আমাদের কথা ও ভাব ধরিতে বুঝিতে পারিলেও আমরা তাঁহার কথা ও ভাব বুঝিতে পারিতাম না। আমরা মানুষটাকে মানুষ বলিয়া, গরুটাকে গরু বলিয়া, পাহাড়টাকে পাহাড় বলিয়াই কেবল জানি। তিনি দেখিতেন মানুষটা, গরুটা, পাহাড়টা – মানুষ, গরু ও পাহাড় বটে; অধিকন্তু আবার দেখিতেন, সেই মানুষ, গরু ও পাহাড়ের ভিতর হইতে সেই জগৎকারণ অখণ্ডসচ্চিদানন্দ উঁকি মারিতেছেন! মানুষ, গরু ও পাহাড়রূপ আবরণে আবৃত হওয়ায় কোথাও তাঁহার অঙ্গ (প্রকাশ) অধিক দেখা যাইতেছে এবং কোথাও বা কম দেখা যাইতেছে এইমাত্র প্রভেদ। সেজন্যই ঠাকুরকে বলিতে শুনিয়াছি –

ঐ সম্বন্ধে ঠাকুরের নিজের কথা ও দর্শন – “ভিন্ন ভিন্ন খোলগুলোর ভেতর থেকে মা উঁকি মারচে! রমণী বেশ্যাও মা হয়েছে!”

“দেখি কি – যেন গাছপালা, মানুষ, গরু, ঘাস, জল সব ভিন্ন ভিন্ন রকমের খোলগুলো! বালিশের খোল যেমন হয়, দেখিসনি? – কোনটা খেরোর, কোনটা ছিটের, কোনটা বা অন্য কাপড়ের, কোনটা চারকোণা, কোনটা গোল – সেই রকম। আর বালিশের ঐ সব রকম খোলের ভেতরে যেমন একই জিনিস তুলো ভরা থাকে – সেই রকম ঐ মানুষ, গরু, ঘাস, জল, পাহাড়, পর্বত সব খোলগুলোর ভেতরেই সেই এক অখণ্ডসচ্চিদানন্দ রয়েছেন। ঠিক ঠিক দেখতে পাই রে, মা যেন নানা রকমের চাদর মুড়ি দিয়ে নানা রকম সেজে ভেতর থেকে উঁকি মারচেন! একটা অবস্থা হয়েছিল, যখন সদা-সর্বক্ষণ ঐ রকম দেখতুম। ঐ রকম অবস্থা দেখে বুঝতে না পেরে সকলে বোঝাতে, শান্ত করতে এল। রামলালের মা-টা সব কত কি বলে কাঁদতে লাগল; তাদের দিকে চেয়ে দেখছি কি যে, (কালীমন্দির দেখাইয়া) ঐ মা-ই নানা রকমে সেজে এসে ঐ রকম করচে! ঢং দেখে হেসে গড়াগড়ি দিতে লাগলুম আর বলতে লাগলুম, ‘বেশ সেজেচ!’ একদিন কালীঘরে আসনে বসে মাকে চিন্তা করচি; কিছুতেই মার মূর্তি মনে আনতে পারলুম না। তারপর দেখি কি – রমণী বলে একটা বেশ্যা ঘাটে চান করতে আসত, তার মতো হয়ে পূজার ঘটের পাশ থেকে উঁকি মারচে! দেখে হাসি আর বলি, ‘ওমা, আজ তোর রমণী হতে ইচ্ছে হয়েছে – তা বেশ, ঐরূপেই আজ পূজো নে!’ ঐ রকম করে বুঝিয়ে দিলে – ‘বেশ্যাও আমি – আমি ছাড়া কিছু নেই!’ আর একদিন গাড়ি করে মেছোবাজারের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দেখি কি – সেজে গুজে, খোঁপা বেঁধে, টিপ পরে বারাণ্ডায় দাঁড়িয়ে বাঁধা হুঁকোয় তামাক খাচ্চে, আর মোহিনী হয়ে লোকের মন ভুলুচ্চে! দেখে অবাক হয়ে বললুম, ‘মা! তুই এখানে এইভাবে রয়েছিস?’ – বলে প্রণাম করলুম!” উচ্চ ভাবভূমিতে উঠিয়া ঐরূপে সকল বস্তু ও ব্যক্তিকে দেখিতে আমরা ভুলিয়াই গিয়াছি। অতএব ঠাকুরের ঐসকল উপলব্ধির কথা বুঝিব কিরূপে?

ঠাকুরের ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির সাধারণাপেক্ষা তীক্ষ্ণতা। উহার কারণ – ভোগসুখে অনাসক্তি। আসক্ত ও অনাসক্ত মনের কার্যতুলনা

আবার দেহাদি-ভাব লইয়া ঠাকুর যখন আমাদের ন্যায় সাধারণ ভাবভূমিতে থাকিতেন, তখনও স্বার্থ-ভোগসুখ-স্পৃহার বিন্দুমাত্রও মনেতে না থাকায় ঠাকুরের বুদ্ধি ও দৃষ্টি আমাদিগের অপেক্ষা কত বিষয় অধিক ধরিতে এবং তলাইয়া বুঝিতেই না সক্ষম হইত! যে ভোগসুখটা লাভ করিবার প্রবল কামনা আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে রহিয়াছে, খাইতে শুইতে দেখিতে শুনিতে বেড়াইতে ঘুমাইতে বা অপরের সহিত আলাপাদি করিতে – সকল সময়ে উহারই অনুকূল বিষয়সমূহ আমাদের নয়নে উজ্জ্বল বর্ণে প্রতিভাসিত হয় এবং তজ্জন্য আমাদের মন উহার প্রতিকূল বস্তু ও ব্যক্তিসকলকে উপেক্ষা করিয়া পূর্বোক্ত বিষয়সকলের দিকেই অধিকতর আকৃষ্ট হইয়া থাকে। ঐরূপে উপেক্ষিত প্রতিকূল ব্যক্তি ও বিষয়সকলের স্বভাব জানিবার আর আমাদের অবসর হইয়া উঠে না। এইরূপে কতকগুলি বস্তু ও ব্যক্তিকেই আপনার করিয়া লইয়া বা নিজস্ব করিয়া লইবার চেষ্টাতেই আমরা জীবনটা কাটাইয়া দিয়া থাকি। এইজন্যই ইতরসাধারণ মানবের ভিতর জ্ঞানলাভ করিবার ক্ষমতার এত তারতম্য দেখা যায়। আমাদের সকলেরই চক্ষুকর্ণাদি ইন্দ্রিয় থাকিলেও ঐসকলের সমভাবে সকল বিষয়ে চালনা করিয়া জ্ঞানোপার্জন করিতে আমরা সকলে পারি কই? এইজন্যই আমাদের ভিতরে যাহাদের স্বার্থপরতা এবং ভোগস্পৃহা অল্প, তাহারাই অন্য সকলের অপেক্ষা সহজে সকল বিষয়ে জ্ঞানলাভে সক্ষম হয়।

ঠাকুরের মনের তীক্ষ্ণতার দৃষ্টান্ত

সাধারণ ভাবভূমিতে অবস্থানকালেও ঠাকুরের দৃষ্টি যে কি তীক্ষ্ণ ছিল, তাহার দুই-একটি দৃষ্টান্ত এখানে দিলে মন্দ হইবে না। আধ্যাত্মিক জটিল তত্ত্বসকল বুঝাইতে ঠাকুর সাধারণতঃ যে সকল দৃষ্টান্ত ও রূপকাদি ব্যবহার করিতেন, তাহাতে ঐ তীক্ষ্ণদৃষ্টিমত্তার কতদূর পরিচয় যে পাওয়া যাইত, তাহা বলিবার নহে। উহার প্রত্যেকটির সহায়ে ঠাকুর যেন এক একটি জ্বলন্ত চিত্র দেখাইয়া ঐ জটিল বিষয় যে সম্ভবপর এ কথা শ্রোতার হৃদয়ে একেবারে প্রবিষ্ট করাইয়া দিতেন!

সাংখ্য-দর্শন সহজে বুঝান – “বে-বাড়ির কর্তা-গিন্নী”

ধর, জটিল সাংখ্যদর্শনের কথা চলিয়াছে। ঠাকুর আমাদিগকে পুরুষ ও প্রকৃতি হইতে জগতের উৎপত্তির কথা বলিতে বলিতে বলিলেন, “ওতে বলে – পুরুষ অকর্তা, কিছু করেন না। প্রকৃতিই সকল কাজ করেন; পুরুষ প্রকৃতির ঐসকল কাজ সাক্ষিস্বরূপ হয়ে দেখেন, প্রকৃতিও আবার পুরুষকে ছেড়ে আপনি কোন কাজ করতে পারেন না।” শ্রোতারা তো সকলেই পণ্ডিত – অফিসের চাকুরে বাবু বা মুচ্ছুদ্দী, না হয় বড় জোর ডাক্তার, উকিল বা ডেপুটি, আর স্কুল-কলেজের ছোঁড়া; কাজেই ঠাকুরের কথাগুলি শুনিয়া সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করিতেছে। ভাবগতিক দেখিয়া ঠাকুর বলিলেন, “ওই যে গো দেখনি, বে-বাড়িতে? কর্তা হুকুম দিয়ে নিজে বসে বসে আলবোলায় তামাক টানছে। গিন্নি কিন্তু কাপড়ে হলুদ মেখে একবার এখানে, একবার ওখানে বাড়িময় ছুটাছুটি করে এ কাজটা হলো কি না, ও কাজটা করলে কি না সব দেখচেন, শুনচেন, বাড়িতে যত মেয়েছেলে আসছে তাদের আদর অভ্যর্থনা করচেন আর মাঝে মাঝে কর্তার কাছে এসে হাতমুখ নেড়ে শুনিয়ে যাচ্চেন – ‘এটা এইরকম করা হলো, ওটা এইরকম হলো, এটা করতে হবে, ওটা করা হবে না’ ইত্যাদি। কর্তা তামাক টানতে টানতে সব শুনচেন আর ‘হুঁ’ ‘হুঁ’ করে ঘাড় নেড়ে সব কথায় সায় দিচ্চেন! সেইরকম আর কি।” ঠাকুরের কথা শুনিয়া সকলে হাসিতে লাগিল এবং সাংখ্য-দর্শনের কথাও বুঝিতে পারিল!

ব্রহ্ম ও মায়া এক বুঝান – “সাপ চলছে ও সাপ স্থির”

পরে আবার হয়তো কথা উঠিল – “বেদান্তে বলে, ব্রহ্ম ও ব্রহ্মশক্তি, পুরুষ ও প্রকৃতি অভেদ অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতি দুইটি পৃথক পদার্থ নহে; একই পদার্থ, কখনও পুরুষভাবে এবং কখনও বা প্রকৃতিভাবে থাকে।” আমরা বুঝিতে পারিতেছি না দেখিয়া ঠাকুর বলিলেন, “সেটা কিরকম জানিস? যেমন সাপটা কখনো চলচে, আবার কখনো বা স্থির হয়ে পড়ে আছে। যখন স্থির হয়ে আছে তখন হলো পুরুষভাব – প্রকৃতি তখন পুরুষের সঙ্গে মিশে এক হয়ে আছে। আর যখন সাপটা চলচে, তখন যেন প্রকৃতি পুরুষ থেকে আলাদা হয়ে কাজ করছে!” ঐ চিত্রটি হইতে কথাটি বুঝিয়া সকলে ভাবিতে লাগিল, এত সোজা কথাটা বুঝিতে পারি নাই।

ঈশ্বর মায়াবদ্ধ নন – “সাপের মুখে বিষ থাকে, কিন্তু সাপ মরে না”

আবার হয়তো পরে কথা উঠিল, মায়া ঈশ্বরেরই শক্তি, ঈশ্বরেতেই রহিয়াছেন, তবে কি ঈশ্বরও আমাদের ন্যায় মায়াবদ্ধ? ঠাকুর শুনিয়া বলিলেন, “না রে, ঈশ্বরের মায়া হলেও এবং মায়া ঈশ্বরে সর্বদা থাকলেও ঈশ্বর কখনও মায়াবদ্ধ হন না। এই দেখ না – সাপ যাকে কামড়ায় সেই মরে; সাপের মুখে বিষ সর্বদা রয়েছে, সাপ সর্বদা সেই মুখ দিয়ে খাচ্চে, ঢোক গিলচে, কিন্তু সাপ নিজে তো মরে না – সেই রকম!” সকলে বুঝিল, উহা সম্ভবপর বটে।

ঠাকুরের প্রকৃতিগত অসাধারণ পরিবর্তনসকল দেখিতে পাইয়া ধারণা – ঈশ্বর আইন বা নিয়ম বদলাইয়া থাকেন

ঐসকল দৃষ্টান্ত হইতেই বেশ বুঝা যায়, সাধারণ ভাবভূমিতে ঠাকুর যখন থাকিতেন তখন তাঁহার তীক্ষ্ণদৃষ্টির সম্মুখে কোনও পদার্থের কোনপ্রকার ভাবই লুক্কায়িত থাকিতে পারিত না। মানব-প্রকৃতির তো কথাই নাই, বাহ্য-প্রকৃতির অন্তর্গত যত কিছু পরিবর্তনও তাঁহার দৃষ্টিসম্মুখে আপন রূপ অপ্রকাশিত রাখিতে পারিত না। অবশ্য যন্ত্রাদিসহায়ে বাহ্য-প্রকৃতির যেসকল পরিবর্তন ধরা বুঝা যায়, আমরা সেসকলের কথা এখানে বলিতেছি না। আর এক আশ্চর্যের বিষয়, সাধারণ ভাবভূমিতে থাকিবার কালে বাহ্য-প্রকৃতির অন্তর্গত পদার্থনিচয়ের যেসকল অসাধারণ পরিবর্তন বা বিকাশ লোকনয়নে সচরাচর পতিত হয় না, সেইগুলিই যেন অগ্রে ঠাকুরের নয়নের গোচরীভূত হইত! ঈশ্বরেচ্ছাতেই সৃষ্ট্যন্তর্গত সকল পদার্থের সকলপ্রকার বিকাশ আসিয়া উপস্থিত হয়, অথবা তিনিই সাক্ষাৎ সম্বন্ধে জগদন্তর্গত বস্তু ও ব্যক্তিসকলের ভাগ্যচক্রের নিয়ামক – এই ভাবটি ঠাকুরের প্রাণে প্রাণে প্রবিষ্ট করাইয়া দিবার জন্যই যেন জগদম্বা ঠাকুরের সম্মুখে সাধারণ নিয়মের বহিৰ্ভূত ঐ অসাধারণ প্রাকৃতিক বিকাশগুলি (exceptions) যখন তখন আনিয়া ধরিতেন! “যাঁহার আইন (Law) অথবা যিনি আইন করিয়াছেন, তিনি ইচ্ছা করিলে যে আইন পালটাইয়া আবার অন্যরূপ আইন করিতে পারেন” – ঠাকুরের ঐ কথাগুলির অর্থ আমরা তাঁহার বাল্যাবধি ঐরূপ দর্শন হইতেই স্পষ্ট পাইয়া থাকি। দৃষ্টান্তস্বরূপ ঐ বিষয়ের কয়েকটি ঘটনা এখানে বলিলে মন্দ হইবে না।

বজ্রনিবারক দণ্ডের কথায় ঠাকুরের নিজ দর্শন বলা – ‘তেতলা বাড়ির কোলে কুঁড়েঘর, তাইতে বাজ পড়লো’

আমরা তখন কলেজে তড়িৎশক্তি সম্বন্ধে জড়বিজ্ঞানের বর্তমান যুগে আবিষ্কৃত বিষয়গুলির কিছু কিছু পড়িয়া মুগ্ধ হইতেছি। বালচপলতাবশে ঠাকুরের নিকটে একদিন ঐ প্রসঙ্গ উত্থাপিত করিয়া পরস্পর নানা কথা কহিতেছি। Electricity (তড়িৎ) কথাটির বারংবার উচ্চারণ লক্ষ্য করিয়া ঠাকুর বালকের ন্যায় ঔৎসুক্য প্রকাশ করিয়া আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাঁরে, তোরা ও-কি বলছিস? ইলেক্টিক্টিক্ মানে কি?” ইংরেজী কথাটির ঐরূপ বালকের ন্যায় উচ্চারণ ঠাকুরের মুখে শুনিয়া আমরা হাসিতে লাগিলাম। পরে তড়িৎশক্তি-সম্বন্ধীয় সাধারণ নিয়মগুলি তাঁহাকে বলিয়া বজ্রনিবারক দণ্ডের (Lightning Conductor) উপকারিতা, সর্বাপেক্ষা উচ্চ পদার্থের উপরেই বজ্রপতন হয়, এজন্য ঐ দণ্ডের উচ্চতা বাটীর উচ্চতাপেক্ষা কিঞ্চিৎ অধিক হওয়া উচিত – ইত্যাদি নানা কথা তাঁহাকে শুনাইতে লাগিলাম। ঠাকুর আমাদের সকল কথাগুলি মন দিয়া শুনিয়া বলিলেন, “কিন্তু আমি যে দেখেছি, তেতলা বাড়ির পাশে ছোট চালাঘর – শালার বাজ্ তেতলায় না পড়ে তাইতে এসে ঢুকল! তার কি করলি বল! ও সব কি একেবারে ঠিকঠাক বলা যায় রে! তাঁর (ঈশ্বরের বা জগদম্বার) ইচ্ছাতেই আইন, আবার তাঁর ইচ্ছাতেই উলটে পালটে যায়!” আমরাও সেবার মথুরবাবুর ন্যায় ঠাকুরকে প্রাকৃতিক নিয়ম (Natural Laws) বুঝাইতে যাইয়া ঠাকুরের ঐ প্রশ্নের উত্তরদানে অসমর্থ হইয়া কি বলিব কিছুই খুঁজিয়া পাইলাম না। বাজ্টা তেতলার দিকেই আকৃষ্ট হইয়াছিল, কি একটা অপরিজ্ঞাত কারণে সহসা তাহার গতি পরিবর্তিত হইয়া চালায় গিয়া পড়িয়াছে, অথবা ঐরূপ নিয়মের ব্যতিক্রম একটি আধটিই হইতে দেখা যায়, অন্যত্র সহস্র স্থলে আমরা যেরূপ বলিতেছি সেইভাবে উচ্চ পদার্থেই বজ্রপতন হইয়া থাকে – ইত্যাদি নানা কথা আমরা ঠাকুরকে বলিলেও ঠাকুর প্রাকৃতিক ঘটনাবলী যে অনুল্লঙ্ঘনীয় নিয়মবশে ঘটিয়া থাকে এ কথা কিছুতেই বুঝিলেন না। বলিলেন, “হাজার জায়গায় তোরা যেমন বলচিস তেমনি না হয় হলো, কিন্তু দু-চার জায়গায় ঐরকম না হওয়াতেই ঐ আইন যে পালটে যায় এটা বোঝা যাচ্চে!”

রক্তজবার গাছে শ্বেতজবা-দর্শন

উদ্ভিদ-প্রকৃতির আলোচকেরা সর্বদা শ্বেত বা রক্তবর্ণের পুষ্পপ্রসবকারী উদ্ভিদসমূহে কখনও কখনও তদ্ব্যতিক্রমও হইয়া থাকে বলিয়া গ্রন্থে লিখিয়া গিয়াছেন! কিন্তু ঐরূপ হওয়া এত অসাধারণ যে, সাধারণ মানব উহা কখনও দেখে নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। ঠাকুরের জীবনে ঘটনা দেখ – মথুরবাবুর সহিত, প্রাকৃতিক নিয়ম সব সময় ঠিক থাকে না, ঈশ্বরেচ্ছায় অন্যরূপ হইয়া থাকে – এই বিষয় লইয়া যখন ঠাকুরের বাদানুবাদ হইয়াছে সেই সময়েই ঐরূপ একটি দৃষ্টান্ত তাঁহার দৃষ্টিগোচর হওয়া এবং মথুরবাবুকে উহা দেখাইয়া দেওয়া।

প্রকৃতিগত অসাধারণ দৃষ্টান্তগুলি হইতেই ঠাকুরের ধারণা – জগৎ-সংসারটা জগদম্বার লীলাবিলাস

ঐরূপ জীবন্ত প্রস্তর দেখা, মনুষ্য-শরীরের মেরুদণ্ডের শেষ ভাগের অস্থি (Coccyx) পশুপুচ্ছের মতো অল্পস্বল্প বাড়িয়া পরে আবার উহা কমিয়া যাইতে দেখা, স্ত্রীভাবের প্রাবল্যে পুরুষশরীরকে স্ত্রীশরীরের ন্যায় যথাকালে সামান্যভাবে পুষ্পিত হইতে এবং পরে ঐ ভাবের প্রবলতা কমিয়া যাইলে উহা রহিত হইয়া যাইতে দেখা, প্রেতযোনি এবং দেবযোনিগত পুরুষসকলের সন্দর্শন করা প্রভৃতি ঠাকুরের জীবনে অনেক ঘটনা শুনিয়াছি। জগৎপ্রসূতি প্রকৃতিকে (Nature) আমরা পাশ্চাত্যের অনুকরণে একেবারে বুদ্ধিশক্তিরহিত জড় বলিয়া ধারণা করিয়াছি বলিয়াই ঐসকল অসাধারণ ঘটনাবলীকে প্রকৃতির অন্তর্গত কার্যকারণসম্বন্ধবিচ্যুত সহসোৎপন্ন ঘটনাবলী (Natural aberrations) নাম দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসি এবং মনে করি প্রকৃতি যেসকল নিয়মে পরিচালিত, তাহার সকলগুলিই বুঝিতে পারিয়াছি। ঠাকুরের অন্যরূপ ধারণা ছিল। তিনি দেখিতেন – সমগ্র বাহ্যান্তঃ-প্রকৃতি জীবন্ত প্রত্যক্ষ জগদম্বার লীলাবিলাস ভিন্ন আর কিছুই নহে। কাজেই ঐসকল অসাধারণ ঘটনাবলীকে তাঁহারই বিশেষ ইচ্ছাসম্ভূত বলিয়া মনে করিতেন। আর কিছু না হইলেও ঠাকুরের মনে যে ঐরূপ ধারণায় আমাদের অপেক্ষা শান্তি ও আনন্দ অনেক পরিমাণে অধিক থাকিত, এ কথা আর বুঝাইতে হইবে না। ঠাকুরের জীবনে ঐরূপ দৃষ্টান্তের কিছু কিছু উল্লেখ আমরা পূর্বে করিয়াছি এবং পরেও করিব। এখন যাহা করা হইল, তাহা হইতেই পাঠক আমাদের বক্তব্য বিষয় বুঝিতে পারিবেন। অতএব আমরা পূর্বানুসরণ করি।

ঠাকুরের উচ্চ ভাবভূমি হইতে স্থানবিশেষে প্রকাশিত ভাবের জমাটের পরিমাণ বুঝা

প্রত্যেক বস্তু এবং ব্যক্তিকে ঠাকুর পূর্বোক্ত প্রকারে দুই ভাবে দেখিয়া তবে তৎসম্বন্ধে একটা স্থির ধারণা করিতেন। আমাদের ন্যায় কেবলমাত্র সাধারণ ভাবভূমি (ordinary plane of consciousness) হইতে দেখিয়াই যাহা হয় একটা মতামত স্থির করিতেন না। অতএব তীর্থভ্রমণ এবং সাধুসন্দর্শনও যে ঠাকুরের ঐ প্রকারে দুই ভাবে হইয়াছিল এ কথা আর বলিতে হইবে না। উচ্চ ভাবভূমি (higher plane of consciousness or super-consciousness) হইতে দেখিয়াই ঠাকুর, কোন্ তীর্থে কতটা পরিমাণে উচ্চ ভাবের জমাট আছে, অথবা মানব মনকে উচ্চ ভাবে আরোহণ করাইবার শক্তি কোন্ তীর্থের কতটা পরিমাণে আছে, তদ্বিষয়ে অনুভব করিতেন। ঠাকুরের রূপরসাদি-বিষয়সম্পর্কশূন্য সর্বদা দেবতুল্য পবিত্র মন ঐ সূক্ষ্ম বিষয় স্থির করিবার একটি অপূর্ব পরিচায়ক ও পরিমাপক যন্ত্র (detector) স্বরূপ ছিল। তীর্থে বা দেবস্থানে গমন করিলেই উহা উচ্চ ভাবভূমিতে উঠিয়া সেইসকল স্থানের দিব্য প্রকাশ ঠাকুরের সম্মুখে প্রকাশিত করিত। উচ্চ ভাবভূমি হইতেই ঠাকুর কাশী স্বর্ণময় দেখিয়াছিলেন, কাশীতে মৃত্যু হইলে কি প্রকারে জীব সর্ববন্ধনবিমুক্ত হয় – তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন, শ্রীবৃন্দাবনে দিব্যভাবের বিশেষ প্রকাশ অনুভব করিয়াছিলেন এবং নবদ্বীপে যে আজ পর্যন্ত শ্রীগৌরাঙ্গের সূক্ষ্মাবিৰ্ভাব বর্তমান তাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন।

চৈতন্যদেবের বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমিসকল আবিষ্কার করা বিষয়ের প্রসিদ্ধি

কথিত আছে, বৃন্দাবনের দিব্যভাবপ্রকাশ শ্রীচৈতন্যদেবই প্রথম অনুভব করেন। ব্রজের তীর্থাস্পদ স্থানসকল তাঁহার আবির্ভাবের পূর্বে লুপ্তপ্রায় হইয়া গিয়াছিল। ঐসকল স্থানে ভ্রমণকালে উচ্চ ভাবভূমিতে উঠিয়া তাঁহার মন যেখানে যেরূপ শ্রীকৃষ্ণের দিব্য প্রকাশসকল অনুভব বা প্রত্যক্ষ করিত, সেখানেই যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বহু পূর্ব যুগে বাস্তবিক সেইরূপ লীলা করিয়াছিলেন – এ কথায় রূপসনাতনাদি তাঁহার শিষ্যগণ প্রথম বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং পরে তাঁহাদিগের মুখ হইতে শুনিয়া সমগ্র ভারতবাসী উহাতে বিশ্বাসী হইয়াছে। শ্রীচৈতন্যদেবের পূর্বোক্ত ভাবে বৃন্দাবনাবিষ্কারের কথা আমরা কিছুই বুঝিতে পারিতাম না। ঐ প্রকার হওয়া যে সম্ভবপর, এ কথা একেবারেই মনে স্থান দিতাম না। উচ্চ ভাবভূমিতে উঠিয়া বস্তু বা ব্যক্তিসকলকে ঠাকুরের মনের ঐরূপে যথাযথ ধরিবার বুঝিবার ক্ষমতা দেখিয়াই এখন আমরা ঐ কথায় কিঞ্চিন্মাত্র বিশ্বাসী হইতে পারিয়াছি। ঠাকুরের জীবন হইতে ঐ বিষয়ের দুই-একটি দৃষ্টান্ত এখানে প্রদান করিলেই পাঠক আমাদের কথা বুঝিতে পারিবেন।

ঠাকুরের জীবনে ঐরূপ ঘটনা – বন-বিষ্ণুপুরে ৺মৃন্ময়ী দেবীর পূর্বমূর্তি ভাবে দর্শন

ঠাকুরের ভাগিনেয় হৃদয়ের বাটী কামারপুকুরের অনতিদূরে সিহড় গ্রামে ছিল। ঠাকুর যে তথায় মধ্যে মধ্যে গমন করিয়া সময়ে সময়ে কিছুকাল কাটাইয়া আসিতেন, এ কথা আমরা ইতঃপূর্বেই পাঠককে জানাইয়াছি। একবার ঐ স্থানে ঠাকুর রহিয়াছেন, এমন সময়ে হৃদয়ের কনিষ্ঠ ভ্রাতা রাজারামের সহিত গ্রামের এক ব্যক্তির বিষয়কর্ম লইয়া বচসা উপস্থিত হইল। বকাবকি ক্রমে হাতাহাতিতে পরিণত হইল এবং রাজারাম হাতের নিকটেই একটি হুঁকা পাইয়া তদ্দ্বারা ঐ ব্যক্তির মস্তকে আঘাত করিল। আহত ব্যক্তি ফৌজদারী মকদ্দমা রুজু করিল এবং ঠাকুরের সম্মুখেই ঐ ঘটনা হওয়ায় এবং তাঁহাকে সাধু সত্যবাদী বলিয়া পূর্ব হইতে জানা থাকায় সে ব্যক্তি ঠাকুরকেই ঐ বিষয়ে সাক্ষিস্বরূপে নির্বাচিত করিল। কাজেই সাক্ষ্য দিবার জন্য ঠাকুরকে বন-বিষ্ণুপুরে আসিতে হইল। পূর্ব হইতেই ঠাকুর রাজারামকে ঐরূপে ক্রোধান্ধ হইবার জন্য বিশেষরূপে ভর্ৎসনা করিতেছিলেন; এখানে আসিয়া আবার বলিলেন, “ওকে (বাদীকে) টাকাকড়ি দিয়ে যেমন করে পারিস মকদ্দমা মিটিয়ে নে; নয়তো তোর ভাল হবে না; আমি তো আর মিথ্যা বলতে পারব না। জিজ্ঞাসা করলেই যা জানি ও দেখেছি সব কথা বলে দেব।” কাজেই রাজারাম ভয় পাইয়া মামলা আপসে মিটাইয়া ফেলিতে লাগিল।

ঠাকুরও সেই অবসরে বন-বিষ্ণুপুর শহরটি দেখিতে বাহির হইলেন।

বিষ্ণুপুর শহরের অবস্থা

এককালে ঐ স্থান বিশেষ সমৃদ্ধিশালী ছিল। লাল-বাঁধ, কৃষ্ণ-বাঁধ প্রভৃতি বড় বড় দীঘি, অসংখ্য দেবমন্দির, যাতায়াতের সুবিধার জন্য পরিষ্কার প্রশস্ত বাঁধানো পথসকল, বহুসংখ্যক বিপণিপূর্ণ বাজার, অসংখ্য ভগ্নমন্দির-স্তূপ এবং বহুসংখ্যক লোকের বাস এবং ব্যবসায়াদি করিতে গমনাগমনেই ঐ কথা স্পষ্ট বুঝা যায়। বিষ্ণুপুরের রাজারা এককালে বেশ প্রতাপশালী ধর্মপরায়ণ এবং বিদ্যানুরাগী ছিলেন। বিষ্ণুপুর এককালে সঙ্গীতবিদ্যার চর্চাতেও প্রসিদ্ধ ছিল।

৺মদনমোহন

রূপসনাতনাদি শ্রীচৈতন্যদেবের প্রধান সাঙ্গোপাঙ্গগণের তিরোভাবের কিছুকাল পর হইতে রাজবংশীয়েরা বৈষ্ণবমতাবলম্বী হন। কলিকাতার বাগবাজার পল্লীতে প্রতিষ্ঠিত ৺মদনমোহন বিগ্রহ পূর্বে এখানকার রাজাদেরই ঠাকুর ছিলেন। ৺গোকুলচন্দ্র মিত্র এখানকার রাজাদের এক সময়ে অনেক টাকা ধার দিয়াছিলেন এবং ঠাকুরটি দেখিয়া মোহিত হইয়া ঋণ পরিশোধকালে টাকা না লইয়া ঠাকুরটি চাহিয়া লইয়াছিলেন, এইরূপ প্রসিদ্ধি।

৺মৃন্ময়ী

৺মদনমোহন ভিন্ন রাজাদের প্রতিষ্ঠিত ৺মৃন্ময়ী নাম্নী এক বহু প্রাচীন দেবীমূর্তিও ছিলেন। লোকে বলিত ৺মৃন্ময়ী দেবী বড় জাগ্রতা। রাজবংশীয়দের ভগ্নদশায় ঐ মূর্তি এক সময়ে এক পাগলিনী কর্তৃক ভগ্ন হয়। রাজবংশীয়েরা সেজন্য পূর্বমূর্তির মতো অন্য একটি নূতন মূর্তির পুনঃস্থাপনা করেন।

ঠাকুর এখানকার অপর দেবস্থানসকল দেখিয়া ৺মৃন্ময়ী দেবীকে দর্শন করিতে যাইতেছিলেন। পথিমধ্যে একস্থানে ভাবাবেশে ৺মৃন্ময়ীর মুখখানি দেখিতে পাইলেন। মন্দিরে যাইয়া নবপ্রতিষ্ঠিত মূর্তিটি দেখিবার কালে দেখিলেন, ঐ মূর্তিটি তাঁহার ভাবকালে দৃষ্ট মূর্তিটির সদৃশ নহে। এইরূপ হইবার কারণ কিছুই বুঝিলেন না। পরে অনুসন্ধানে জানা গেল, বাস্তবিকই নূতন মূর্তিটি পুরাতন মূর্তিটির মতো হয় নাই। নূতন মূর্তির কারিকর নিজ গুণপনা দেখাইবার জন্য উহার মুখখানি বাস্তবিক অন্য ভাবেই গড়িয়াছে এবং পুরাতন মূর্তিটির ভগ্ন মুখখানি এক ব্রাহ্মণ কর্তৃক সযত্নে নিজালয়ে রক্ষিত হইতেছে। ইহার কিছুকাল পরে ঐ ভক্তিনিষ্ঠাসম্পন্ন ব্রাহ্মণ ঐ মুখখানি সংযোজিত করিয়া অন্য একটি মূর্তি গড়াইয়া লাল-বাঁধ দীঘির পার্শ্বে এক রমণীয় প্রদেশে প্রতিষ্ঠিত করিলেন এবং উহার নিত্যপূজাদি করিতে লাগিলেন।

ঠাকুরের ঐরূপে ব্যক্তিগত ভাব ও উদ্দেশ্য ধরিবার ক্ষমতা – ১ম দৃষ্টান্ত

সমীপাগত ব্যক্তিগণের আগমনের উদ্দেশ্য ও ভাব ধরিবার ক্ষমতা সম্বন্ধে একটি দৃষ্টান্তেরও এখানে উল্লেখ করা ভাল। পূজনীয় স্বামী ব্রহ্মানন্দকে ঠাকুর নিজের পুত্রের মতো ভালবাসিতেন, এ কথার উল্লেখ আমরা পূর্বেই করিয়াছি। একদিন দক্ষিণেশ্বরে তিনি ঠাকুরের সহিত, ঠাকুরের ঘরের পূর্বদিকের লম্বা বারান্দার উত্তরাংশে দাঁড়াইয়া নানা কথা কহিতেছেন, এমন সময় দেখিতে পাইলেন, বাগানের ফটকের দিক হইতে একখানি জুড়িগাড়ি তাঁহাদের দিকে আসিতেছে। গাড়িখানি ফিটন; মধ্যে কয়েকটি বাবু বসিয়া আছেন। দেখিয়াই কলিকাতার জনৈক প্রসিদ্ধ ধনী ব্যক্তির গাড়ি বলিয়া তিনি বুঝিতে পারিলেন। ঠাকুরকে দর্শন করিতে সে সময় কলিকাতা হইতে অনেকে আসিয়া থাকেন। ইঁহারাও সেইজন্যই আসিয়াছেন ভাবিয়া তিনি বিস্মিত হইলেন না।

ঠাকুরের দৃষ্টি কিন্তু গাড়ির দিকে পড়িবামাত্র তিনি ভয়ে জড়সড় হইয়া শশব্যস্তে অন্তরালে আপন ঘরে যাইয়া বসিলেন। তাঁহার ঐ প্রকার ভাব দেখিয়া বিস্মিত হইয়া ব্রহ্মানন্দ স্বামীও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ঘরে ঢুকিলেন। ঠাকুর তাঁহাকে দেখিয়াই বলিলেন, “যা – যা, ওরা এখানে আসতে চাইলে বলিস, এখন দেখা হবে না।” ঠাকুরের ঐ কথা শুনিয়া তিনি পুনরায় বাহিরে আসিলেন। ইতোমধ্যে আগন্তুকেরাও নিকটে আসিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানে একজন সাধু থাকেন, না?” ব্রহ্মানন্দ স্বামী শুনিয়া ঠাকুরের নাম করিয়া বলিলেন, “হাঁ, তিনি এখানে থাকেন। আপনারা তাঁহার নিকট কি প্রয়োজনে আসিয়াছেন?” তাঁহাদের ভিতর এক ব্যক্তি বলিলেন, “আমাদের এক আত্মীয়ের বিষম পীড়া হইয়াছে; কিছুতেই সারিতেছে না। তাই ইনি (সাধু) যদি কোন ঔষধ দয়া করিয়া দেন, সেজন্য আসিয়াছি।” স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলিলেন, “আপনারা ভুল শুনিয়াছেন। ইনি তো কখনও কাহাকেও ঔষধ দেন না। বোধ হয় আপনারা দুর্গানন্দ ব্রহ্মচারীর কথা শুনিয়াছেন। তিনি ঔষধ দিয়া থাকেন বটে। তিনি ঐ পঞ্চবটীতে কুটিরে আছেন। যাইলেই দেখা হইবে।”

আগন্তুকেরা ঐ কথা শুনিয়া চলিয়া গেলে ঠাকুর ব্রহ্মানন্দ স্বামীকে বলিলেন, “ওদের ভেতর কি যে একটা তমোভাব দেখলুম! – দেখেই আর ওদের দিকে চাইতে পারলুম না; তা কথা কইব কি! ভয়ে পালিয়ে এলুম!”

এইরূপে উচ্চ ভাবভূমিতে উঠিয়া ঠাকুরকে প্রত্যেক স্থান, বস্তু বা ব্যক্তির অন্তর্গত উচ্চাবচ ভাবপ্রকাশ উপলব্ধি করিতে আমরা নিত্য প্রত্যক্ষ করিতাম। ঠাকুর যেরূপ দেখিতেন, ঐ সকলের ভিতরে বাস্তবিকই সেইরূপ ভাব যে বিদ্যমান, ইহা বারংবার অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াই আমরা তাঁহার কথায় বিশ্বাসী হইয়াছি। তন্মধ্যে আরও দুই-একটি এখানে উল্লেখ করিয়া সাধারণ ভাবভূমি হইতে তিনি তীর্থাদিতে কি অনুভব করিয়াছিলেন, তাহাই পাঠককে বলিতে আরম্ভ করিব।

ঐ বিষয়ে ২য় দৃষ্টান্ত – স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁহার দক্ষিণেশ্বরাগত সহপাঠিগণ

উদারচেতা স্বামী বিবেকানন্দের মন বাল্যকালাবধি পরদুঃখে কাতর হইত। সেজন্য তিনি যাহাতে বা যাঁহার সাহায্যে আপনাকে কোন বিষয়ে উপকৃত বোধ করিতেন, তাহা করিতে বা তাঁহার নিকটে ঐরূপ সাহায্য পাইবার জন্য গমন করিতে আপন আত্মীয় বন্ধুবান্ধব সকলকে সর্বদা উৎসাহিত করিতেন। লেখাপড়া ধর্মকর্ম সকল বিষয়েই স্বামীজীর মনের ঐ প্রকার রীতি ছিল। কলেজে পড়িবার সময় সহপাঠিদিগকে লইয়া নানা স্থানে নিয়মিত দিনে প্রার্থনা ও ধ্যানাদি-অনুষ্ঠানের জন্য সভা-সমিতি গঠন করা, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও ভক্তাচার্য কেশবের সহিত স্বয়ং পরিচিত হইবার পরেই সহপাঠিদিগের ভিতর অনেককে উঁহাদের দর্শনের জন্য লইয়া যাওয়া প্রভৃতি যৌবনে পদার্পণ করিয়াই স্বামীজীর জীবনে অনুষ্ঠিত কার্যগুলি দেখিয়া আমরা পূর্বোক্ত বিষয়ের পরিচয় পাইয়া থাকি।

ঠাকুরের পুণ্যদর্শন লাভ করিয়া তাঁহার অদৃষ্টপূর্ব ত্যাগ, বৈরাগ্য ও ঈশ্বরপ্রেমের পরিচয় পাওয়া অবধি নিজ সহপাঠী বন্ধুদিগকে তাঁহার নিকটে লইয়া যাইয়া তাঁহার সহিত পরিচিত করিয়া দেওয়া স্বামীজীর জীবনে একটা ব্রতবিশেষ হইয়া উঠিয়াছিল। আমরা এ কথা বলিতেছি বলিয়া কেহ যেন না ভাবিয়া বসেন যে, বুদ্ধিমান স্বামীজী একদিনের আলাপে কাহারও প্রতি আকৃষ্ট হইলেই তাহাকে ঠাকুরের নিকট লইয়া যাইতেন। অনেকদিন পরিচয়ের ফলে যাহাদিগকে সৎস্বভাববিশিষ্ট এবং ধর্মানুরাগী বলিয়া বুঝিতেন, তাহাদিগকেই সঙ্গে করিয়া দক্ষিণেশ্বরে লইয়া যাইতেন।

‘চেষ্টা করলেই যার যা ইচ্ছা হ’তে পারে না’

স্বামীজী ঐরূপে অনেকগুলি বন্ধুবান্ধবকেই তখন ঠাকুরের নিকট লইয়া গিয়াছিলেন; কিন্তু ঠাকুরের দিব্যদৃষ্টি যে তাহাদের অন্তর দেখিয়া অন্যরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিল, এ কথা আমরা ঠাকুর ও স্বামীজী উভয়েরই মুখে সময়ে সময়ে শুনিয়াছি। স্বামীজী বলিতেন, “ঠাকুর আমাকে গ্রহণ করিয়া ধর্মসম্বন্ধীয় শিক্ষাদিদানে আমার উপর যেরূপ কৃপা করিতেন, সেইরূপ কৃপা তাহাদিগকে না করায় আমি তাঁহাকে ঐরূপ করিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিয়া ধরিয়া বসিতাম। বালস্বভাববশতঃ অনেক সময় তাঁহার সহিত কোমর বাঁধিয়া তর্ক করিতেও উদ্যত হইতাম! বলিতাম, ‘কেন মহাশয়, ঈশ্বর তো আর পক্ষপাতী নন যে, একজনকে কৃপা করবেন এবং আর একজনকে কৃপা করবেন না? তবে কেন আপনি উহাদের আমার ন্যায় গ্রহণ করবেন না? ইচ্ছা ও চেষ্টা করলে সকলেই যেমন বিদ্বান পণ্ডিত হতে পারে, ধর্মলাভ ঈশ্বরলাভও যে তেমনি করতে পারে, এ কথা তো নিশ্চয়।’ তাহাতে ঠাকুর বলিতেন, ‘কি করব রে – আমাকে মা যে দেখিয়ে দিচ্চে, ওদের ভেতর ষাঁড়ের মতো পশুভাব রয়েছে, ওদের এ জন্মে ধর্মলাভ হবে না – তা আমি কি করব? তোর ও কি কথা? ইচ্ছা ও চেষ্টা করলেই কি লোকে এ জন্মে যা ইচ্ছা তাই হতে পারে?’ ঠাকুরের ও কথা তখন শোনে কে? আমি বলিতাম, ‘সে কি মশায়, ইচ্ছা ও চেষ্টা করলে যার যা ইচ্ছা তা হতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে। আমি আপনার ও কথায় বিশ্বাস করতে পারছি না।’ ঠাকুরের তাহাতেও ঐ কথা – ‘তুই বিশ্বাস করিস আর নাই করিস, মা যে আমায় দেখিয়ে দিচ্চে!’ আমিও তখন তাঁর কথা কিছুতেই স্বীকার করতুম না। তার পর যত দিন যেতে লাগল, দেখে-শুনে তত বুঝতে লাগলুম – ঠাকুর যা বলেছেন তাই সত্য, আমার ধারণাই মিথ্যা।”

৩য় দৃষ্টান্ত – পণ্ডিত শশধরকে দেখিতে যাইয়া ঠাকুরের জলপান করা

স্বামীজী বলিতেন – এইরূপে যাচাইয়া বাজাইয়া লইয়া তবে তিনি ঠাকুরের সকল কথায় ক্রমে ক্রমে বিশ্বাসী হইতে পারিয়াছিলেন। ঠাকুরের প্রত্যেক কথা ও ব্যবহার ঐরূপে পরীক্ষা করিয়া লওয়া সম্বন্ধে আর একটি ঘটনার কথা আমরা স্বামীজীর নিকট হইতে যেরূপ শুনিয়াছি, এখানে বলিলে মন্দ হইবে না। ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের রথযাত্রার দিনে ঠাকুর স্বামীজীর নিকট হইতে শুনিয়া পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণিকে দেখিতে গিয়াছিলেন।1 শ্রীশ্রীজগদম্বার নিকট হইতে সাক্ষাৎ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিই যথার্থ ধর্মপ্রচারে সক্ষম, অপরসকল প্রচারক-নামধারীর বাগাড়ম্বর বৃথা – পণ্ডিতজীকে ঐরূপ নানা উপদেশদানের পর ঠাকুর পান করিবার জন্য এক গেলাস জল চাহিলেন। ঠাকুর যথার্থ তৃষ্ণার্ত হইয়া ঐরূপে জল চাহিলেন অথবা তাঁহার অন্য উদ্দেশ্য ছিল তাহা আমরা ঠিক বলিতে পারি না। কারণ, ঠাকুর অন্য এক সময়ে আমাদের বলিয়াছিলেন যে, সাধু সন্ন্যাসী অতিথি ফকিরেরা কোন গৃহস্থের বাটীতে যাইয়া যাহা হয় কিছু খাইয়া না আসিলে তাহাতে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়; এবং সেজন্য তিনি যাহার বাটীতেই যান না কেন, তাহারা না বলিলে বা ভুলিয়া গেলেও স্বয়ং তাহার নিকট হইতে চাহিয়া লইয়া কিছু না কিছু খাইয়া আসেন।

সে যাহা হউক, এখানে জল চাহিবামাত্র তিলক কণ্ঠি প্রভৃতি ধর্মলিঙ্গধারী এক ব্যক্তি সসম্ভ্রমে ঠাকুরকে এক গেলাস জল আনিয়া দিলেন। ঠাকুর কিন্তু ঐ জল পান করিতে যাইয়া উহা পান করিতে পারিলেন না। নিকটস্থ অপর এক ব্যক্তি উহা দেখিয়া গেলাসের জলটি ফেলিয়া দিয়া আর এক গেলাস জল আনিয়া দিল এবং ঠাকুরও উহার কিঞ্চিৎ পান করিয়া পণ্ডিতজীর নিকট হইতে সেদিনকার মতো বিদায় গ্রহণ করিলেন। সকলে বুঝিল, পূর্বানীত জলে কিছু পড়িয়াছিল বলিয়াই ঠাকুর উহা পান করিলেন না।

স্বামীজী বলিতেন – তিনি তখন ঠাকুরের অতি নিকটেই বসিয়াছিলেন, সেজন্য বিশেষ করিয়া দেখিয়াছিলেন, গেলাসের জলে কুটোকাটা কিছুই পড়ে নাই, অথচ ঠাকুর উহা পান করিতে আপত্তি করিয়াছিলেন। ঐ বিষয়ের কারণানুসন্ধান করিতে যাইয়া স্বামীজী মনে মনে স্থির করিলেন, তবে বোধ হয় জল-গেলাসটি স্পর্শদোষদুষ্ট হইয়াছে! কারণ ইতঃপূর্বেই তিনি ঠাকুরকে বলিতে শুনিয়াছিলেন যে, যাহাদের ভিতর বিষয়-বুদ্ধি অত্যন্ত প্রবল, যাহারা জুয়াচুরি বাটপাড়ি এবং অপরের অনিষ্টসাধন করিয়া অসদুপায়ে উপার্জন করে এবং যাহারা কাম-কাঞ্চন-লাভের সহায় হইবে বলিয়া বাহিরে ধর্মের ভেক ধারণ করিয়া লোককে প্রতারিত করে, তাহারা কোনরূপ খাদ্যপানীয় আনিয়া দিলে তাঁহার হস্ত উহা গ্রহণ করিতে যাইলেও কিছুদূর যাইয়া আর অগ্রসর হয় না, পশ্চাতে গুটাইয়া আসে এবং তিনি উহা তৎক্ষণাৎ বুঝিতে পারেন!

স্বামীজী বলিতেন – ঐ কথা মনে উদিত হইবামাত্র তিনি ঐ বিষয়ের সত্যাসত্য-নির্ধারণের জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প করিলেন এবং ঠাকুর স্বয়ং তাঁহাকে সেদিন তাঁহার সহিত আসিতে অনুরোধ করিলেও ‘বিশেষ কোন আবশ্যক আছে, সেজন্য যাইতে পারিতেছি না’ বলিয়া বুঝাইয়া তাঁহাকে গাড়িতে উঠাইয়া দিলেন। ঠাকুর চলিয়া যাইলে স্বামীজী পূর্বোক্ত ধর্মলিঙ্গধারী ব্যক্তির কনিষ্ঠ ভ্রাতার সহিত পূর্ব হইতে পরিচয় থাকায় তাহাকে একান্তে ডাকিয়া তাহার অগ্রজের চরিত্র সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। ঐরূপে জিজ্ঞাসিত হইলে সে ব্যক্তি বিশেষ ইতস্ততঃ করিয়া অবশেষে বলিল, ‘জ্যেষ্ঠের দোষের কথা কেমন করিয়া বলি’ ইত্যাদি। স্বামীজী বলিতেন, “আমি তাহাতেই বুঝিয়া লইলাম। পরে ঐ বাটীর অপর একজন পরিচিত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিয়া সকল কথা জানিয়া ঐ বিষয়ে নিঃসংশয় হইলাম এবং অবাক হইয়া ভাবিতে লাগিলাম – ঠাকুর কেমন করিয়া লোকের অন্তরের কথা ঐরূপে জানিতে পারেন!”


1. পঞ্চম অধ্যায় দেখ।

ঠাকুরের মানসিক গঠন কি ভাবের ছিল এবং কোন্ বিষয়টির দ্বারা তিনি সকল বস্তু ও ব্যক্তিকে পরিমাপ করিয়া তাহাদের মূল্য বুঝিতেন

সাধারণ ভাবভূমিতে থাকিবার কালে ঠাকুর যেরূপে সকল পদার্থের অন্তর্নিহিত গুণাগুণ ধরিতেন ও বুঝিতেন, তাহার পরিচয় পাইতে হইলে আমাদিগকে প্রথমে তাঁহার মানসিক গঠন কি প্রকারের ছিল, তাহা বুঝিতে হইবে এবং পরে কোন্ পদার্থটিকে পরিমাপকস্বরূপে সর্বদা স্থির রাখিয়া তিনি অপর বস্তু ও বিষয়সকল পরিমাপ করিয়া তৎসম্বন্ধে একটা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতেন, তাহাও ধরিতে হইবে। লীলাপ্রসঙ্গে স্থানে স্থানে ঐ বিষয়ের কিছু কিছু আভাস আমরা পাঠককে ইতঃপূর্বেই দিয়াছি। অতএব এখন উহার সংক্ষেপ উল্লেখমাত্র করিলেই চলিবে। আমরা দেখিয়াছি, ঠাকুরের মন পার্থিব কোন পদার্থে আসক্ত না থাকায় তিনি যখনই যাহা গ্রহণ বা ত্যাগ করিবেন মনে করিয়াছেন, তখনই উহা ঐ বিষয়ে সম্যক যুক্ত বা উহা হইতে সম্যক পৃথক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। পৃথক হইবার পর আজীবন আর ঐ বিষয়ের প্রতি একবারও ফিরিয়া দেখেন নাই। আবার ঠাকুরের অদৃষ্টপূর্ব নিষ্ঠা, অদ্ভুত বিচারশীলতা এবং ঐকান্তিক একাগ্রতা তাঁহার মনের হস্ত সর্বদা ধারণ করিয়া উহাকে যাহাতে ইচ্ছা, যতদিন ইচ্ছা এবং যেখানে ইচ্ছা স্থিরভাবে রাখিয়াছে। একক্ষণের জন্যও উহাকে ঐ বিষয়ের বিপরীত চিন্তা বা কল্পনা করিতে দেয় নাই। কোন বিষয় ত্যাগ বা গ্রহণ করিতে যাইবামাত্র এ মনের একভাগ বলিয়া উঠিত, ‘কেন ঐরূপ করিতেছ তাহা বল।’ আর যদি ঐ প্রশ্নের যথাযথ যুক্তিসহ মীমাংসা পাইত তবেই বলিত, ‘বেশ কথা, ঐরূপ কর।’ আবার ঐরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইবামাত্র ঐ মনের অন্য একভাগ বলিয়া উঠিত, ‘তবে পাকা করিয়া উহা ধর; শয়নে, স্বপনে, ভোজনে, বিরামে কখনও উহার বিপরীত অনুষ্ঠান আর করিতে পারিবে না।’ তৎপরে তাঁহার সমগ্র মন এক তানে ঐ বিষয় গ্রহণ করিয়া তদনুকূল অনুষ্ঠান করিতে থাকিত এবং নিষ্ঠা প্রহরীস্বরূপে এরূপ সতর্কভাবে উহার ঐ বিষয়ক কার্যকলাপ সর্বদা দেখিত যে, সহসা ভুলিয়া ঠাকুর তদ্বিপরীতানুষ্ঠান করিতে যাইলে স্পষ্ট বোধ করিতেন ভিতর হইতে কে যেন তাঁহার ইন্দ্রিয়নিচয়কে বাঁধিয়া রাখিয়াছে – ঐরূপ অনুষ্ঠান করিতে দিতেছে না। ঠাকুরের আজীবন সকল বস্তু ও ব্যক্তির সহিত ব্যবহারের আলোচনা করিলেই আমাদের পূর্বোক্ত কথাগুলি হৃদয়ঙ্গম হইবে।

ঐ বিষয়ে দৃষ্টান্ত – “চাল-কলা-বাঁধা বিদ্যায় আমার কাজ নেই”

দেখ না – বালক গদাধর কয়েকদিন পাঠশালে যাইতে না যাইতে বলিয়া বসিলেন, “ও চাল-কলা-বাঁধা বিদ্যাতে আমার কাজ নাই, ও বিদ্যা আমি শিখব না!” ঠাকুরের অগ্রজ রামকুমার, ভ্রাতা উচ্ছৃঙ্খল হইয়া যাইতেছে ভাবিয়া, কিছুকাল পরে বুঝাইয়া সুঝাইয়া কলিকাতায় আপনার টোলে, নিজের তত্ত্বাবধানে রাখিয়া ঐ বিদ্যা শিখাইবার প্রয়াস পাইলেও ঠাকুরের অর্থকরী বিদ্যা সম্বন্ধে বাল্যকালের ঐ মত ঘুরাইতে পারিলেন না। শুধু তাহাই নহে, নিষ্ঠাচারী পণ্ডিত হইয়া টোল খুলিয়া যথাসাধ্য শিক্ষাদান করিয়াও পরিবারবর্গের অন্নবস্ত্রের অভাব মিটাইতে পারিলেন না বলিয়াই যে অনন্যোপায় অগ্রজের রানী রাসমণির দেবালয়ে পৌরোহিত্য-স্বীকার – এ কথাও ঠাকুরের নিকট লুক্কায়িত রহিল না এবং ধনীদিগের তোষামোদ করিয়া উপাৰ্জনাপেক্ষা অগ্রজের ঐরূপ করা অনেক ভাল বুঝিয়া উহাকে তিনি অনুমোদনও করিলেন।

২য় দৃষ্টান্ত – ধ্যান করিতে বসিবামাত্র শরীরের সন্ধিস্থলগুলিতে কাহারও যেন চাবি লাগাইয়া বন্ধ করিয়া দেওয়া – এই অনুভব ও শূলধারী এক ব্যক্তিকে দেখা

দেখ না – সাধনকালে ঠাকুর ধ্যান করিতে বসিবামাত্র তাঁহার অনুভব হইতে লাগিল, তাঁহার শরীরের প্রত্যেক সন্ধিস্থানগুলিতে খট্খট্ করিয়া আওয়াজ হইয়া বন্ধ হইয়া গেল। তিনি যে ভাবে আসন করিয়া বসিয়াছেন, সেই ভাবে অনেকক্ষণ তাঁহাকে বসাইয়া রাখিবার জন্য কে যেন ভিতর হইতে ঐসকল স্থানে চাবি লাগাইয়া দিল। যতক্ষণ না আবার সে খুলিয়া দিল, ততক্ষণ হাত পা গ্রীবা কোমর প্রভৃতি স্থানের সন্ধিগুলি তিনি আমাদের মতো ফিরাইতে, ঘুরাইতে, যথা ইচ্ছা ব্যবহার করিতে চেষ্টা করিলেও কিছুকাল আর করিতে পারিলেন না! অথবা দেখিলেন, শূলহস্তে এক ব্যক্তি নিকটে বসিয়া রহিয়াছে এবং বলিতেছে, ‘যদি ঈশ্বরচিন্তা ভিন্ন অপর চিন্তা করিবি তো এই শূল তোর বুকে বসাইয়া দিব!’

৩য় দৃষ্টান্ত – জগদম্বার পাদপদ্মে ফুল দিতে যাইয়া নিজের মাথায় দেওয়া ও পিতৃ তর্পণ করিতে যাইয়া উহা করিতে না পারা। নিরক্ষর ঠাকুরের আধ্যাত্মিক অনুভবসকলের দ্বারা বেদাদি শাস্ত্র সপ্রমাণ হয়

দেখ না – পূজা করিতে বসিয়া আপনাকে জগদম্বার সহিত অভেদজ্ঞান করিতে বলিবামাত্র মন তাহাই করিতে লাগিল; জগদম্বার পাদপদ্মে বিল্বজবা দিতে যাইলেও ঠাকুরের হাত তখন কে যেন ঘুরাইয়া নিজ মস্তকের দিকেই টানিয়া লইয়া চলিল!

অথবা দেখ – সন্ন্যাস-দীক্ষাগ্রহণ করিবামাত্র মন সর্বভূতে এক অদ্বৈত ব্রহ্মদর্শন করিতেই থাকিল। অভ্যাসবশতঃ ঠাকুর ঐ কালে পিতৃতর্পণ করিতে যাইলে হাত আড়ষ্ট হইয়া গেল, অঞ্জলিবদ্ধ করিয়া হাতে জল তুলিতেই পারিলেন না! অগত্যা বুঝিলেন, সন্ন্যাসগ্রহণে তাঁহার কর্ম উঠিয়া গিয়াছে! ঐরূপ ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে, যাহাতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, অনাসক্তি, বিচারশীলতা, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা এ মনের কত সহজ, কত স্বাভাবিক ছিল। আর বুঝা যায় যে, ঠাকুরের ঐরূপ দর্শনগুলি শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ কথার অনুরূপ হওয়ায় শাস্ত্র যাহা বলেন তাহা সত্য। পূজ্যপাদ স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন – এবার ঠাকুরের নিরক্ষর হইয়া আগমনের কারণ উহাই; হিন্দুর বেদবেদান্ত হইতে অপরাপর জাতির যাবতীয় ধর্মগ্রন্থে নিবদ্ধ আধ্যাত্মিক অবস্থাসকলের কথা যে সত্য এবং বাস্তবিকই যে মানুষ ঐসকল পথ দিয়া চলিয়া ঐরূপ অবস্থাসকল লাভ করিতে পারে, ইহাই প্রমাণিত করিবেন বলিয়া।

অদ্বৈতভাব লাভ করাই মানবজীবনের উদ্দেশ্য। ঐ ভাবে ‘সব শেয়ালের এক রা।’ শ্রীচৈতন্যের ভক্তি বাহিরের দাঁত ও অদ্বৈতজ্ঞান ভিতরের দাঁত ছিল। অদ্বৈতজ্ঞানের তারতম্য লইয়াই ঠাকুর ব্যক্তি ও সমাজে উচ্চাবচ অবস্থা স্থির করিতেন

ঠাকুরের মনের স্বভাব আলোচনা করিতে যাইয়া এ কথা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, নির্বিকল্প ভূমিতে উঠিয়া অদ্বৈতভাবে ঈশ্বরোপলব্ধিই মানবজীবনের চরমে আসিয়া উপস্থিত হয়। আবার ঐ ভূমিলব্ধ আধ্যাত্মিক দর্শন সম্বন্ধে ঠাকুর বলিতেন, ‘সব শেয়ালের এক রা’; অর্থাৎ সকল শিয়ালই যেমন একভাবে শব্দ করে, তেমনি নির্বিকল্প ভূমিতে যাঁহারাই উঠিতে সমর্থ হইয়াছেন, তাঁহারা প্রত্যেকেই ঐ ভূমি হইতে দর্শন করিয়া জগৎকারণ ঈশ্বর সম্বন্ধে এক কথাই বলিয়া গিয়াছেন। প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্যের সম্বন্ধেও ঠাকুর বলিতেন, “হাতির বাহিরের দাঁত যেমন শত্রুকে মারবার জন্য এবং ভিতরের দাঁত নিজের খাবার জন্য, সেই রকম মহাপ্রভুর দ্বৈতভাব বাহিরের ও অদ্বৈতভাব ভিতরের জিনিস ছিল।” অতএব সর্বদা একরূপ অদ্বৈতভাবই যে ঠাকুরের সকল বিষয়ের পরিমাপক-স্বরূপ ছিল, এ কথা আর বলিতে হইবে না। ব্যক্তি ও ব্যক্তির সমষ্টি সমাজকে যে ভাব ও অনুষ্ঠান ঐ ভূমির দিকে যত অগ্রসর করাইয়া দিত, ততই ঠাকুর ঐ ভাব ও অনুষ্ঠানকে অপর সকল ভাব ও অনুষ্ঠান হইতে উচ্চ বলিয়া সিদ্ধান্ত করিতেন।

স্বসংবেদ্য ও পরসংবেদ্য দর্শন

আবার ঠাকুরের আধ্যাত্মিকভাবপ্রসূত দর্শনগুলির আলোচনা করিলে দেখিতে পাওয়া যায়, উহাদের কতকগুলি স্বসংবেদ্য এবং কতকগুলি পরসংবেদ্য। অর্থাৎ উহাদের কতকগুলি ঠাকুরের নিজ শরীরাবদ্ধ মনের চিন্তাসকল, নিষ্ঠা ও অভ্যাসসহায়ে ঘনীভূত হইয়া মূর্তিধারণ করিয়া তাঁহার নিকট ঐরূপে প্রকাশিত হইত এবং ঠাকুর নিজেই দেখিতে পাইতেন; এবং কতকগুলি তিনি উচ্চ-উচ্চতর ভাবভূমিতে উঠিয়া নির্বিকল্প ভাবভূমির নিকটস্থ হইবার কালে বা ভাবমুখে অবস্থিত হইয়া দেখিয়া অপরের উহা অপরিজ্ঞাত হইলেও বর্তমানে বিদ্যমান বা ভবিষ্যতে ঘটিবে বলিয়া প্রকাশ করিতেন এবং অপরে ঐসকলকে কালে বাস্তবিকই ঘটিতে দেখিত! ঠাকুরের প্রথম শ্রেণীর দর্শনগুলি সত্য বলিয়া উপলব্ধি করিতে হইলে অপরকে তাঁহার ন্যায় বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠাদিসম্পন্ন হইতে বা ঠাকুর যে ভূমিতে উঠিয়া ঐরূপ দর্শন করিয়াছেন, সেই ভূমিতে উঠিতে হইত, এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর গুলিকে সত্য বলিয়া বুঝিতে হইলে লোকের বিশ্বাস বা অন্য কোনরূপ সাধনাদির আবশ্যক হইত না – ঐসকল যে সত্য, তাহা ফল দেখিয়া লোককে বিশ্বাস করিতেই হইত।

বস্তু ও ব্যক্তিসকলের অবস্থা সম্বন্ধে স্থির সিদ্ধান্তে না আসিয়া ঠাকুরের মন নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিত না

সে যাহা হউক, ঠাকুরের মানসিক প্রকৃতি সম্বন্ধে আমরা পূর্বে যাহা বলিয়াছি এবং এখন যেসকল কথা উপরে বলিয়া আসিলাম, তাহা হইতেই আমরা বুঝিতে পারি সাধারণ ভাবভূমিতে থাকিবার কালেও ঐরূপ মন নিশ্চিন্ত থাকিবার নহে। যেসকল বস্তু ও ব্যক্তির সম্পর্কে উহা একক্ষণের জন্যও উপস্থিত হইত, তৎসকলের স্বভাব রীতিনীতি সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া একটা বিশেষ সিদ্ধান্তে উপনীত না হইয়া উহা কখনও স্থির থাকিতে পারিত না। বাল্যকালে যেমন অর্থের জন্যই বর্তমান সময়ে পণ্ডিতদিগের শাস্ত্রালোচনা এ কথা ধরিয়া ‘চাল-কলা-বাঁধা’ বিদ্যা শিখিল না, ঠাকুরের বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নানা স্থানে নানা লোকের সম্পর্কে আসিয়া ঐ মন তাহাদের সম্বন্ধে যেসকল সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিল, অতঃপর তাহাই আমাদের আলোচনীয়।

সাধারণ ভাবভূমি হইতে ঠাকুর যাহা দেখিয়াছিলেন – শাক্ত ও বৈষ্ণবের বিদ্বেষ

শ্রীচৈতন্যের তিরোভাবের পর হইতে আরম্ভ হইয়া বঙ্গদেশে শাক্ত ও বৈষ্ণবগণের পরস্পর বিদ্বেষ যে সমভাবেই চলিয়া আসিতেছিল, এ কথা আর বলিতে হইবে না। শ্রীরামপ্রসাদাদি বিরল কতিপয় শক্তি-সাধকেরা নিজ নিজ সাধনসহায়ে কালী ও কৃষ্ণকে এক বলিয়া প্রত্যক্ষ করিয়া ঐ বিদ্বেষ ভ্রান্ত বলিয়া প্রচার করিলেও সর্বসাধারণে তাঁহাদের কথা বড় একটা গ্রহণ না করিয়া বিদ্বেষ-তরঙ্গেই যে গা ঢালিয়া রহিয়াছে, এ কথা উভয়পক্ষের পরস্পরের দেব-নিন্দাসূচক হাস্যকৌতুকাদিতেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। বাল্যাবধি ঠাকুর ঐ বিষয়ের সহিত যে পরিচিত ছিলেন, ইহা বলা বাহুল্য। আবার উভয়পক্ষের শাস্ত্র-নিবদ্ধ সাধনে প্রবৃত্ত হইয়া সিদ্ধিলাভ করিয়া ঠাকুর যখন উভয় পন্থাই সমান সত্য বলিয়া উপলব্ধি করিলেন, তখন শাক্ত-বৈষ্ণবের ঐ বিদ্বেষের কারণ যে ধর্মহীনতাপ্রসূত অভিমান বা অহঙ্কার, এ কথা বুঝিতে তাঁহার বাকি রহিল না।

নিজ পরিবারবর্গের ভিতর ঐ বিদ্বেষ দূর করিবার জন্য সকলকে শক্তিমন্ত্রে দীক্ষাগ্রহণ করান

ঠাকুরের পিতা শ্রীরামচন্দ্রের উপাসক ছিলেন, এবং শ্রীশ্রীরঘুবীরশিলাকে দৈবযোগে লাভ করিয়া বাটীতে প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। ঠাকুর ঐরূপে বৈষ্ণববংশে জন্মগ্রহণ করিলেও কিন্তু বাল্যকাল হইতে তাঁহার শিব ও বিষ্ণু উভয়ের উপর সমান অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যাইত। বাল্যকালে এক সময়ে শিব সাজিয়া তাঁহার ঐ ভাবে সমাধিস্থ হইয়া কয়েক ঘণ্টাকাল থাকার কথা প্রতিবেশিগণ এখনও বলিয়া ঐ স্থান দেখাইয়া দেয়। ঐ বিষয়ের পরিচায়কস্বরূপ আর একটি কথারও এখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে; ঠাকুর আপন পরিবারবর্গের প্রত্যেককে এক সময়ে বিষ্ণুমন্ত্র ও শক্তিমন্ত্র উভয় মন্ত্রেই দীক্ষাগ্রহণ করাইয়াছিলেন। তাঁহাদের মন হইতে বিদ্বেষভাব সম্যক দূরীভূত করিবার জন্যই ঠাকুরের ঐরূপ আচরণ, এ কথাই আমাদের অনুমিত হয়।

সাধুদের ঔষধ দেওয়ার প্রথার উৎপত্তি ও ক্রমে উহাতে সাধুদের আধ্যাত্মিক অবনতি

বহু প্রাচীন যুগে মহারাজ ধর্মাশোক মানব-সাধারণের কল্যাণের নিমিত্ত ধর্ম ও বিদ্যাবিস্তারে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন, এ কথা এখন সকলেই জানেন। মানব এবং গ্রাম্য পশুসকলের শারীরিক রোগনিবারণের জন্য তিনি হাসপাতাল, পিঁজরাপোলাদি ভারতের নানা স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন, ভেষজসকলের সংগ্রহ ও চাষ করিয়া সাধারণের সহজপ্রাপ্য করেন এবং বৌদ্ধ যতিদিগের সহায়ে ঔষধ ও ওষধিসকলের দেশ-দেশান্তরে প্রেরণ ও প্রচার করিয়াছিলেন। সাধুদিগের ঔষধ সংগ্রহ করিয়া রাখা বোধ হয় ঐ কাল হইতেই অনুষ্ঠিত হয়। আবার তন্ত্রযুগে ঐ প্রথা বিশেষ বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী যুগের সংহিতাকারেরা সাধুদের উহাতে আধ্যাত্মিক অবনতি দেখিয়া ঐ বিষয়ে বিশেষ প্রতিবাদ করিলেও রক্ষণশীল ভারতে ঐ প্রথার এখনও উচ্ছেদ হয় নাই। দক্ষিণেশ্বরে থাকিবার কালে এবং তীর্থভ্রমণ করিবার সময় ঠাকুর অনেক সাধু-সন্ন্যাসীকে ঐভাবে প্রতিষ্ঠালাভ করিয়া ভোগসুখে চিরকালের নিমিত্ত পতিত হইতে দেখিয়া সাধুদের ভিতরেও যে ধর্মহীনতা অনুভব করেন, ইহা আমাদের স্পষ্ট বোধ হয়। কারণ, ঠাকুর আমাদের অনেককে অনেক সময়ে বলিতেন, “যে সাধু ঔষধ দেয়, যে সাধু ঝাড়ফুঁক করে, যে সাধু টাকা নেয়, যে সাধু বিভূতি তিলকের বিশেষ আড়ম্বর করে খড়ম পায়ে দিয়ে যেন সাঁইবোট (signboard) মেরে নিজেকে বড় সাধু বলে অপরকে জানায়, তাদের কদাচ বিশ্বাস করবিনি।”

কেবলমাত্র ভেকধারী সাধুদের সম্বন্ধে ঠাকুরের মত

উপরোক্ত কথাটিতে কেহ যেন না ভাবিয়া বসেন, ঠাকুর ভণ্ড ও ভ্রষ্ট সাধুদিগকে দেখিয়া পাশ্চাত্যের জনসাধারণের মতো সাধুসম্প্রদায়সকল উঠাইয়া দেওয়াই উচিত বলিয়া মনে করিতেন। কারণ, ঠাকুরকে আমরা ঐ কথা-প্রসঙ্গে সময়ে সময়ে বলিতে শুনিয়াছি যে, একটা ভেকধারী সাধারণ পেট-বৈরাগী ও একজন চরিত্রবান গৃহীর ভিতর তুলনা করিলে পূর্বোক্তকেই বড় বলিতে হয়। কারণ, ও ব্যক্তি যোগ-যাগ কিছু না করিয়া কেবলমাত্র চরিত্রবান থাকিয়া যদি জন্মটা ভিক্ষা করিয়া কাটাইয়া যায়, তাহা হইলেও সাধারণ গৃহী ব্যক্তি অপেক্ষা এ জন্মে কত অধিক ত্যাগের পথে অগ্রসর হইয়া রহিল। ঈশ্বরের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করাই যে ঠাকুরের নিকট ব্যক্তিগত চরিত্রের ও অনুষ্ঠানের পরিমাপক ছিল, এ সম্বন্ধে ঠাকুরের উপরোক্ত কথাগুলিই অন্যতম দৃষ্টান্ত।

যথার্থ সাধুদের জীবন হইতেই শাস্ত্রসকল সজীব থাকে

যথার্থ নিষ্ঠাবান প্রেমিক বা জ্ঞানী সাধু যে সম্প্রদায়েরই হউন না কেন, ঠাকুরের নিকট যে বিশেষ সম্মান পাইতেন, তাহার দৃষ্টান্ত আমরা লীলাপ্রসঙ্গে ইতঃপূর্বে ভূরি ভূরি দিয়াছি। ভারতে সনাতন ধর্ম উঁহাদের উপলব্ধি-সহায়েই সজীব রহিয়াছে। উঁহাদের ভিতরে যাঁহারা ঈশ্বরদর্শনে সিদ্ধকাম হইয়া সর্বপ্রকার মায়াবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করেন, তাঁহাদের দ্বারাই বেদাদি শাস্ত্র সপ্রমাণ হইয়া থাকে। কারণ, আপ্তপুরুষেই যে বেদের প্রকাশ, এ কথা বৈশেষিকাদি ভারতের সকল দর্শনকারেরাই একবাক্যে বলিয়া গিয়াছেন। অতএব গভীর-অন্তৰ্দৃষ্টি-সম্পন্ন ঠাকুরের তাঁহাদের সম্বন্ধে ঐ কথা বুঝিয়া তাঁহাদের ঐরূপে সম্মান দেওয়াটা কিছু বিচিত্র ব্যাপার নহে।

যথার্থ সাধুদের ভিতরেও একদেশী ভাব দেখা

নিজ নিজ পথে নিষ্ঠা-ভক্তির সহিত অগ্রসর সাধুদিগকে ঠাকুর বিশেষ প্রীতির চক্ষে দেখিয়া তাঁহাদের সঙ্গে স্বয়ং সর্বদা বিশেষ আনন্দানুভব করিলেও এক বিষয়ের অভাব তিনি তাঁহাদের ভিতর সর্বদা দেখিতে পাইয়া সময়ে সময়ে নিতান্ত দুঃখিত হইতেন। দেখিতেন যে, তিনি সমান অনুরাগে সকল সম্প্রদায়ের সহিত সমভাবে যোগদান করিলেও তাঁহারা সেইরূপ পারিতেন না। ভক্তিমার্গের সাধকসকলের তো কথাই নাই, অদ্বৈতপন্থায় অগ্রসর সন্ন্যাসী সাধকদিগের ভিতরেও তিনি ঐরূপ একদেশী ভাব দেখিতে পাইতেন। অদ্বৈতভূমির উদার সমভাব লাভ করিবার বহু পূর্বেই তাঁহারা অন্যসকল পন্থার লোকদিগকে হীনাধিকারী বলিয়া সমভাবে ঘৃণা বা বড় জোর এক প্রকার অহঙ্কৃত করুণার চক্ষে দেখিতে শিখিতেন। উদারবুদ্ধি ঠাকুরের একই লক্ষ্যে অগ্রসর ঐসকল ব্যক্তিদিগের ঐ প্রকার পরস্পর-বিদ্বেষ দেখিয়া যে বিশেষ কষ্ট হইত, এ কথা আর বলিতে হইবে না, এবং ঐ একদেশিতা যে ধর্মহীনতা হইতে উৎপন্ন, এ কথা বুঝিতে বাকি থাকিত না।

তীর্থে ধর্মহীনতার পরিচয় পাওয়া। আমাদের দেখা-শুনায় ও ঠাকুরের দেখা-শুনায় কত প্রভেদ

দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে বসিয়া ঠাকুর যে ধর্মহীনতা ও একদেশিতার পরিচয় গৃহী ও সন্ন্যাসী সকলেরই ভিতর প্রতিদিন পাইতেছিলেন, তীর্থে দেবস্থানে গমন করিয়া উহার কিছুই কম না দেখিয়া বরং সমধিক প্রতাপই দেখিতে পাইলেন। মথুরের দানগ্রহণ করিবার সময় ব্রাহ্মণদিগের বিবাদ, কাশীস্থ কতকগুলি তান্ত্রিক সাধকের পূজানুষ্ঠান দেখিতে তাঁহাকে আহ্বান করিয়া জগদম্বার পূজা নামমাত্র সম্পন্ন করিয়া কেবল কারণ-পানে ঢলাঢলি, দণ্ডী স্বামীদের প্রতিষ্ঠা ও নামযশলাভের জন্য প্রাণপণ প্রয়াস, বৃন্দাবনে বৈষ্ণব বাবাজীদের সাধনার ভানে যোষিৎসঙ্গে কালযাপন প্রভৃতি সকল ঘটনাই ঠাকুরের তীক্ষ্ণদৃষ্টির সম্মুখে নিজ যথাযথ রূপ প্রকাশ করিয়া সমাজ এবং দেশের প্রকৃত অবস্থার কথা বুঝাইতে তাঁহাকে সহায়তা করিয়াছিল। অবশ্য নিজের ভিতর অতি গভীর নির্বিকল্প অদ্বৈততত্ত্বের উপলব্ধি না থাকিলে সুদ্ধ ঐসকল ঘটনা দেখাটা ঐ বিষয়ে বিশেষ সহায়তা করিতে পারিত না। ঐ ভাবোপলব্ধি ইতঃপূর্বে করাতেই ঠাকুরের মনে ব্যক্তিগত ও সমাজগত মনুষ্যজীবনের চরম লক্ষ্য সম্বন্ধে ধারণা স্থির ছিল এবং উহার সহিত তুলনায় সকল বিষয় ধরা বুঝা সহজসাধ্য হইয়াছিল। অতএব যথার্থ উন্নতি, সভ্যতা, ধর্ম, জ্ঞান, ভক্তি, নিষ্ঠা, যোগ, কর্ম প্রভৃতি প্রেরকভাবসমূহ কোন্ লক্ষ্যে মানবকে অগ্রসর করাইতেছে, অথবা উহাদের পরিসমাপ্তিতে মানব কোথায় যাইয়া কিরূপ অবস্থায় দাঁড়াইবে, তদ্বিষয় নিঃসংশয়রূপে জানাতেই ঠাকুরের সাধারণ ভাবভূমিতে থাকিবার কালে ব্যক্তিগত এবং সমাজগত জীবনের দৈনন্দিন ঘটনাবলীর ঐরূপে দেখা ও আলোচনা তাঁহাকে সকল বিষয়ে সত্যাসত্য-নির্ধারণে সহায়তা করিয়াছিল। বুঝ না – যথার্থ সাধুতার জ্ঞান না থাকিলে তিনি কোন্ সাধু কতদূর অগ্রসর তাহা ধরিতেন কিরূপে? তীর্থে ও দেবমূর্ত্যাদিতে বাস্তবিকই যে ধর্মভাব বহু লোকের চিন্তাশক্তি-সহায়ে ঘনীভূত হইয়া প্রকাশিত রহিয়াছে, এ কথা পূর্বে নিঃসংশয়রূপে না দেখিলে মহাসত্যনিষ্ঠ ঠাকুর জনসাধারণকে তীর্থাটন ও সাকারোপাসনায় অতি দৃঢ়তার সহিত প্রোৎসাহিত করিতেন কিরূপে? অথবা নানা ধর্মসকলের কোন্ দিকে গতি এবং কোথায় পরিসমাপ্তি তাহা জানা না থাকিলে ঐসকলের একদেশিতাটিই যে দূষণীয়, এ কথা ধরিতেন কিরূপে? আমরাও নিত্য সাধু, তীর্থ, দেবদেবীর মূর্তি প্রভৃতি দেখি, ধর্ম ও শাস্ত্রমতসকলের অনন্ত কোলাহল শুনিয়া বধির হই, বুদ্ধিকৌশল এবং বাক্বিতণ্ডায় কখনও এ মতটি, কখনও ও মতটি সত্য বলিয়া মনে করি, জীবনের দৈনন্দিন ঘটনাবলী পর্যালোচনা করিয়া মানবের লক্ষ্য কখনও এটা কখনও ওটা হওয়া উচিত বলিয়া মনে করি; অথচ কোন বিষয়েই একটা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে না পারিয়া নিরন্তর সন্দেহে দোলায়মান থাকি এবং কখনও কখনও নাস্তিক হইয়া ভোগসুখলাভটাই জীবনে সারকথা ভাবিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া থাকি! আমাদের ঐরূপ দেখাশুনায়, আমাদের ঐরূপ আজ এক প্রকার, কাল অন্য প্রকার সিদ্ধান্তে আমাদিগকে কি এমন বিশেষ সহায়তা করে? ঠাকুরের পূর্বোক্তরূপ অদ্ভুত গঠন ও স্বভাববিশিষ্ট মন ছিল বলিয়া তিনি যাহা একবারমাত্র দেখিয়া ধরিতে বুঝিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, আমাদের পশুভাবাপন্ন মন শত জন্মেও তাহা জগদ্গুরু মহাপুরুষদিগের সহায়তা ব্যতীত বুঝিতে পারিবে কি না, বলিতে পারি না। জাতিগত সৌসাদৃশ্য উভয়ে সামান্যভাবে লক্ষিত হইলেও ঠাকুরের মনে ও আমাদের মনে যে কত প্রভেদ, তাহা প্রতি কার্যকলাপেই বেশ অনুমিত হয়। ভক্তিশাস্ত্র ঐজন্যই অবতারপুরুষদিগের মন সাধারণাপেক্ষা ভিন্ন উপাদানে – রজস্তমোরহিত শুদ্ধ সত্ত্বগুণে গঠিত বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন।

ঠাকুরের নিজ উদার মতের অনুভব

এইরূপে দিব্য ও সাধারণ উভয় ভাবভূমি হইতে দর্শন করিয়াই দেশের বর্তমান ধর্মহীনতা, প্রচলিত ধর্মমতসকলের একদেশিতা, প্রত্যেক ধর্মমত সমভাবে সত্য হইলেও এবং বিভিন্ন প্রকৃতিবিশিষ্ট মানবকে ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়া চরমে একই লক্ষ্যে পৌঁছাইয়া দিলেও পূর্বপূর্বাচার্যগণের তদ্বিষয়ে অনভিজ্ঞতা বা দেশকাল-পাত্র-বিবেচনায় অপ্রচার ইত্যাদি – অভিনব মহাসত্যসকলের ধারণা ঠাকুর তীর্থাদি-দর্শন হইতেই বিশেষরূপে অনুভব করিয়াছিলেন। আর অনুভব করিয়াছিলেন যে, একদেশিত্বের গন্ধমাত্ররহিত বিদ্বেষসম্পর্কমাত্রশূন্য তাঁহার নিজভাব জগতের পক্ষে এক অদৃষ্টপূর্ব ব্যাপার! উহা তাঁহারই নিজস্ব সম্পত্তি! তাঁহাকেই উহা জগৎকে দান করিতে হইবে!

‘সর্ব ধর্ম সত্য – যত মত, তত পথ’, একথা জগতে তিনিই যে প্রথমে অনুভব করিয়াছেন, ইহা ঠাকুরের ধরিতে পারা

“সর্ব ধর্মমতই সত্য – যত মত তত পথ” – এই মহদুদার কথা জগৎ ঠাকুরের শ্রীমুখেই প্রথম শুনিয়া যে মোহিত হইয়াছে, এ কথা আমাদের অনেকে এখন জানিতে পারিয়াছেন। পূর্ব পূর্ব যুগের ঋষি ও ধর্মাচার্যগণের কাহারও কাহারও ভিতরে ঐরূপ উদার ভাবের অন্ততঃ আংশিক বিকাশ তো দেখা গিয়াছে বলিয়া কেহ কেহ আপত্তি উত্থাপিত করিতে পারেন কিন্তু একটু তলাইয়া দেখিলেই বুঝা যায়, ঐসকল আচার্য নিজ নিজ বুদ্ধিসহায়ে প্রত্যেক মতের কতক কতক কাটিয়া ছাঁটিয়া ঐসকলের ভিতর যতটুকু সারাংশ বলিয়া স্বয়ং বুঝিতেন তৎ-সকলের মধ্যেই একটা সমন্বয়ের ভাব টানাটানি করিয়া দেখিবার ও দেখাইবার প্রয়াস করিয়াছেন। ঠাকুর যেমন প্রত্যেক মতের কিছুমাত্র ত্যাগ না করিয়া সমান অনুরাগে নিজ জীবনে উহাদের প্রত্যেকের সাধনা করিয়া তত্তৎমত-নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছিয়া ঐ বিষয়ে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন, সে ভাবে পূর্বের কোন আচার্যই ঐ সত্য উপলব্ধি করেন নাই। সে যাহাই হউক, ঐ বিষয়ের বিস্তৃত আলোচনা এখানে করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা কেবল এই কথাই পাঠককে এখানে বলিতে চাহি যে, ঐ উদার ভাবের পরিচয় ঠাকুরের জীবনে আমরা বাল্যাবধিই পাইয়া থাকি। তবে তীর্থদর্শন করিয়া আসিবার পূর্ব পর্যন্ত ঠাকুর এ কথাটি নিশ্চয় করিয়া ধরিতে পারেন নাই যে, আধ্যাত্মিক রাজ্যে ঐরূপ উদারতা একমাত্র তিনি উপলব্ধি করিয়াছেন, এবং পূর্ব পূর্ব ঋষি আচার্য বা অবতারখ্যাত পুরুষসকলে এক একটি বিশেষ পথ দিয়া কেমন করিয়া লক্ষ্যস্থানে পৌঁছিতে হয়, তদ্বিষয় জনসমাজে প্রচার করিয়া যাইলেও ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়া যে একই লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, এ সংবাদ তাঁহাদের কেহই এ পর্যন্ত প্রচার করেন নাই। ঠাকুর বুঝিলেন সাধনকালে তিনি সর্বান্তঃকরণে সকল প্রকার বাসনা-কামনা শ্রীশ্রীজগন্মাতার পাদপদ্মে সমর্পণ করিয়া সংসারে, মায়ার রাজ্যে আর কখনও ফিরিবেন না বলিয়া দৃঢ়-সঙ্কল্প করিয়া অদ্বৈতভাব-ভূমিতে অবস্থান করিলেও যে জগদম্বা তাঁহাকে তখন তাহা করিতে দেন নাই, নানা অসম্ভাবিত উপায়ে তাঁহার শরীরটা এখনও রাখিয়া দিয়াছেন – তাহা এই কার্যের জন্য – যতদূর সম্ভব একদেশী ভাব জগৎ হইতে দূর করিবার জন্য, এবং জগৎও ঐ অশেষকল্যাণকর ভাব গ্রহণ করিবার জন্য তৃষ্ণার্ত হইয়া রহিয়াছে। পূর্বোক্ত সিদ্ধান্তে কিরূপে আমরা উপনীত হইয়াছি, তাহাই এখন পাঠককে বলিবার আমরা প্রয়াস পাইব।

জগৎকে ধর্মদান করিতে হইবে বলিয়াই জগদম্বা তাঁহাকে অদ্ভুতশক্তিসম্পন্ন করিয়াছেন, ঠাকুরের ইহা অনুভব করা

ধর্মবস্তুর উপলব্ধি যে বাক্যের বিষয় নহে – অনুষ্ঠানসাপেক্ষ, ঐ কথা ঠাকুরের বাল্যাবধিই ধারণা ছিল। আবার ঐ বস্তু যে বহুকালানুষ্ঠানে সঞ্চিত করিয়া অপরে সংক্রমিত করিতে বা অপরকে যথার্থই প্রদান করিতে পারা যায় ইহাও ঠাকুর সাধনকালে সময়ে সময়ে, এবং সিদ্ধিলাভ করিবার পরে অনেক সময় অনুভব করিতেছিলেন। ঐ কথার আমরা ইতঃপূর্বেই1 অনেক স্থলে আভাস দিয়া আসিয়াছি। জগদম্বা কৃপা করিয়া তাঁহাতে যে ঐ শক্তি বিশেষভাবে সঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছেন এবং মথুরপ্রমুখ বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদিগের প্রতি কৃপায় তাঁহাকে সময়ে সময়ে সম্পূর্ণ আত্মহারা করিয়া ঐ শক্তি ব্যবহার করিয়াছেন, তদ্বিষয়ে প্রমাণও ঠাকুর এ পর্যন্ত অনেক বার আপন জীবনে পাইয়াছিলেন। উহাতে তাঁহার ইতঃপূর্বে এই ধারণামাত্রই হইয়াছিল যে, শ্রীশ্রীজগন্মাতা তাঁহার শরীর ও মনকে যন্ত্রস্বরূপ করিয়া কতকগুলি ভাগ্যবানকেই কৃপা করিবেন – কি ভাবে বা কখন ঐ কৃপা করিবেন, তাহা তিনি বুঝিতে পারেন নাই এবং শিশুর ন্যায় মাতার উপর নিঃসঙ্কোচে নির্ভরশীল ঠাকুরের মন উহা বুঝিতে চেষ্টাও করে নাই। কিন্তু ভারতকে ধর্মদান করিতে হইবে, জগতে ধর্মবন্যা খরস্রোতে প্রবাহিত করিতে হইবে, এ কথা তাঁহার মনে স্বপ্নেও উদিত হয় নাই। এখন হইতে জগদম্বা তাঁহার শরীর-মনকে আশ্রয় করিয়া ঐ নূতন লীলার আরম্ভ যে করিতেছেন, ঠাকুর এ কথা প্রাণে প্রাণে অনুভব করিতে লাগিলেন। কিন্তু করিলেই বা উপায় কি? জগদম্বা কোন্ দিক দিয়া কি করাইয়া কোথায় লইয়া যাইতেছেন, তাহা না বুঝিতে দিলেই বা তিনি কি করিবেন? ‘মা আমার, আমি মার’ – এ কথা সত্যসত্যই সর্বকালের জন্য বলিয়া তিনি যে বাস্তবিকই জগদম্বার বালক হইয়া গিয়াছেন! মার ইচ্ছা ব্যতীত তাঁহার যে বাস্তবিকই অপর কোনরূপ ইচ্ছার উদয় নাই! এক ইচ্ছা যাহা সময়ে সময়ে উদিত হইত – মাকে নানা ভাবে নানা পথ দিয়া জানিবেন, তাহাও যে ঐ মা-ই নানা সময়ে তাঁহার মনে তুলিয়া দিয়াছিলেন, এ কথাও মা তাঁহাকে ইতঃপূর্বে বিলক্ষণরূপে বুঝাইয়া দিয়াছেন। অতএব এখনকার অভিনব অনুভবে জগদম্বার বালক সানন্দে মার মুখের প্রতিই চাহিয়া রহিল এবং জগন্মাতাই পূর্বের ন্যায় এখনও তাঁহাকে লইয়া খেলিতে লাগিলেন।


1. গুরুভাব – পূর্বার্ধের ৬ষ্ঠ ও ৭ম অধ্যায় দেখ।

আমাদের ন্যায় অহঙ্কারের বশবর্তী হইয়া ঠাকুর আচার্যপদবী গ্রহণ করেন নাই

তীর্থাদিদর্শনে পূর্বোক্ত সত্যসকলের অনুভবে ঠাকুর যে আমাদের ন্যায় অহঙ্কারের বশবর্তী হইয়া আচার্যপদবী লয়েন নাই এ কথা আমরা দিব্যপ্রেমিকা তপস্বিনী গঙ্গামাতার সহিত শ্রীবৃন্দাবনে তাঁহার জীবনের অবশিষ্ট কাল কাটাইয়া দিবার ইচ্ছাতেই বেশ বুঝিতে পারি। ‘মার কাজ মা করেন, আমি জগতের কাজ করিবার, লোকশিক্ষা দিবার কে?’ – এই ভাবটি ঠাকুরের মনে আজীবন যে কি বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল, তাহা আমরা কল্পনাসহায়েও এতটুকু বুঝিতে পারি না। কিন্তু ঐরূপ হওয়াতেই তাঁহার জগদম্বার কার্যের যথার্থ যন্ত্রস্বরূপ হওয়া, ঐরূপ হওয়াতেই তাঁহার ভাবমুখে নিরন্তর স্থিতি, ঐরূপ হওয়াতেই তাঁহাতে শ্রীগুরুভাবের প্রকাশ এবং ঐরূপ হওয়াতেই তাঁহার মনে ঐ গুরুভাব ঘনীভূত হইয়া এক অপূর্ব অভিনবাকার ধারণ করিয়া এখন পূর্বোক্তরূপে প্রকাশ পাওয়া! এতদিন গুরুভাবের আবেশকালে ঠাকুর আত্মহারা হইয়া পড়িয়া তাঁহার শরীর-মনাশ্রয়ে যে কার্য হইত তাহা নিষ্পন্ন হইয়া যাইবার পর তবে ধরিতে বুঝিতে পারিতেন – এখন তাঁহার শরীর-মন ঐ ভাবের নিরন্তর ধারণ ও প্রকাশে অভ্যস্ত হইয়া আসিয়া উহাই তাঁহার সহজ স্বাভাবিক অবস্থা হইয়া দাঁড়াইয়া, তিনি না চাহিলেও, তাঁহাকে যথার্থ আচার্যপদবীতে সর্বদা প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিল। পূর্বে দীন সাধক বা বালকভাবই ঠাকুরের মনের সহজাবস্থা ছিল; ঐ ভাবাবলম্বনেই তিনি অনেক কাল অবস্থিতি করিতেন; এবং গুরুভাবের প্রকাশ তাঁহাতে স্বল্পকালই হইত। এখন তদ্বিপরীত হইয়া গুরুভাবেরই অধিক কাল অবস্থিতি এবং দীন সাধক বা বালক-ভাবের তাঁহাতে অল্পকাল স্থিতি হইতে লাগিল।

ঐ বিষয়ে প্রমাণ – ভাবমুখে ঠাকুরের জগদম্বার সহিত কলহ

অহঙ্কৃত হইয়া আচার্যপদবীগ্রহণ যে ঠাকুরের মনের নিকট এককালে অসম্ভব ছিল তাহার পরিচয় আমরা অনেক দিন ঠাকুরের ভাবাবেশে জগদম্বার সহিত বালকের ন্যায় কলহে পাইয়াছি। ফুল্ল শতদলের সৌরভে মধুকরপঙক্তির ন্যায় ঠাকুরের আধ্যাত্মিক প্রকাশে আকৃষ্ট হইয়া দক্ষিণেশ্বরে যখন অশেষ জনতা হইতেছিল তখন একদিন আমরা যাইয়া দেখি ঠাকুর ভাবাবস্থায় মার সহিত কথা কহিতেছেন। বলিতেছেন, “কচ্ছিস কি? এত লোকের ভিড় কি আনতে হয়? (আমার) নাইবার খাবার সময় নেই! (ঠাকুরের তখন গলদেশে ব্যথা হইয়াছে। নিজের শরীর লক্ষ্য করিয়া) একটা তো ভাঙা ঢাক! এত করে বাজালে কোন দিন ফুটো হয়ে যাবে যে! তখন কি করবি?”

ঐ বিষয়ে ২য় দৃষ্টান্ত

আবার একদিন দক্ষিণেশ্বরে আমরা তাঁহার নিকট বসিয়া আছি। সেটা ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাস। ইহার কিছুদিন পূর্বে শ্রীযুক্ত প্রতাপ হাজরার মাতার পীড়ার সংবাদ আসায় ঠাকুর তাহাকে অনেক বুঝাইয়া সুঝাইয়া মাতার সেবা করিতে দেশে পাঠাইয়া দিয়াছেন – সেদিনও আমরা উপস্থিত ছিলাম। অদ্য সংবাদ আসিয়াছে প্রতাপচন্দ্র দেশে না যাইয়া বৈদ্যনাথ দেওঘরে চলিয়া গিয়াছে। ঠাকুর ঐ সংবাদে একটু বিরক্তও হইয়াছেন। এ কথা সে কথার পর ঠাকুর আমাদিগকে একটি সঙ্গীত গাহিতে বলিলেন এবং কিছুক্ষণ পরে ঠাকুরের ভাবাবেশ হইল। সেদিনও ঠাকুর ঐ ভাবাবেশে জগদম্বার সহিত বালকের ন্যায় বিবাদ আরম্ভ করিলেন। বলিলেন, “অমন সব আদাড়ে লোককে এখানে আনিস কেন? (একটু চুপ করিয়া) আমি অত পারব না। এক সের দুধে এক-আধপো জলই থাক্ – তা নয়, এক সের দুধে পাঁচ সের জল! জ্বাল ঠেলতে ঠেলতে ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে গেল! তোর ইচ্ছে হয় তুই দিগে যা। আমি অত জ্বাল ঠেলতে পারব না। অমন সব লোককে আর আনিসনি।” কাহাকে লক্ষ্য করিয়া ঠাকুর ঐ কথা মাকে বলিতেছেন, তাহার কি দুরদৃষ্ট – এ কথা ভাবিতে ভাবিতে আমরা ভয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিলাম! মার সহিত ঐরূপ বিবাদ ঠাকুরের নিত্য উপস্থিত হইত; তাহাতে দেখা যাইত যে, যে আচার্যপদবীর সম্মানের জন্য অন্য সকলে লালায়িত, ঠাকুর তাহা নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর জ্ঞানে মাকে নিত্য তাঁহার নিকট হইতে ফিরাইয়া লইতে বলিতেন।

ঠাকুরের অনুভব: “সরকারী লোক – আমাকে জগদম্বার জমিদারির যেখানে যখনই গোলমাল হইবে সেখানেই তখন গোল থামাইতে ছুটিতে হইবে”

এইরূপে ইচ্ছাময়ী জগদম্বা নিজ অচিন্ত্য লীলায় তাঁহাকে অদৃষ্টপূর্ব অদ্ভুত উপলব্ধিসকল আজীবন করাইয়া তাঁহার ভিতর যে মহদুদার আধ্যাত্মিক ভাবের অবতারণা করাইয়াছেন, তাহা ইতঃপূর্বে জগতে অন্য কোন আচার্য মহাপুরুষেই আর করেন নাই – এ কথাটি ঠাকুরকে বুঝাইবার সঙ্গে সঙ্গে, অপরকে কৃতার্থ করিবার জন্য ঠাকুরের ভিতরে ধর্মশক্তি তিনি যে কতদূর সঞ্চিত রাখিয়াছেন এবং ঐ শক্তি অপরে সংক্রমণের জন্য তাঁহাকে যে কি অদ্ভুত যন্ত্রস্বরূপ করিয়া নির্মাণ করিয়াছেন, তদ্বিষয়ও জগন্মাতা ঠাকুরকে এই সময়ে দেখাইয়া দেন! ঠাকুর সবিস্ময়ে দেখিলেন – বাহিরে চতুর্দিকে ধর্মাভাব, আর ভিতরে মার লীলায় ঐ অভাবপূরণের জন্য অদৃষ্টপূর্ব শক্তি-সঞ্চয়! দেখিয়া বুঝিতে বাকি রহিল না যে, আবার মা এ যুগে অজ্ঞান-মোহরূপ দুর্দান্ত-রক্তবীজ-বধে রণরঙ্গে অবতীর্ণা! আবার জগৎ মার অহৈতুকী করুণার খেলা দেখিয়া নয়ন সার্থক করিবে এবং অনন্তগুণময়ী কোটী-ব্রহ্মাণ্ড-নায়িকার জয়স্তুতি করিতে যাইয়া বাক্য খুঁজিয়া পাইবে না! উত্তাপের আতিশয্যে মেঘের উদয়, হ্রাসের শেষে স্ফীতির উদয়, দুর্দিনের অবসানে সুদিনের উদয় এবং বহুলোকের বহুকালসঞ্চিত প্রাণের অভাবে জগদম্বার অহৈতুকী করুণা ঘনীভূত হইয়া এইরূপেই গুরুভাবের জীবন্ত সচল বিগ্রহরূপে অবতীর্ণ হয়! জগদম্বা কৃপায় ঠাকুরকে ঐ কথা বুঝাইয়া আবার কৃপা করিয়া দেখাইলেন, ঠাকুরকে লইয়া তাঁহার ঐরূপ লীলা বহুযুগে বহুবার হইয়াছে! – পরেও আবার বহুবার হইবে! সাধারণ জীবের ন্যায় তাঁহার মুক্তি নাই। ‘সরকারি লোক – আমাকে জগদম্বার জমিদারীর যেখানে যখনই কোন গোলমাল উপস্থিত হইবে সেখানেই তখন গোল থামাইতে ছুটিতে হইবে।’ – ঠাকুরের ঐসকল কথার অনুভব এখন হইতেই যে হইয়াছিল এ বিষয় আমরা ঐরূপে বেশ বুঝিতে পারি।

নিজ ভক্তগণকে দেখিবার জন্য ঠাকুরের প্রাণ ব্যাকুল হওয়া

‘যত মত তত পথ’-রূপ উদার মতের উদয় জগদম্বাই ‘লোকহিতায়’ কৃপায় তাঁহাতে করিয়াছেন এ কথা বুঝিবার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের বিচারশীল মন আর একটি বিষয় অনুসন্ধানে যে এখন হইতে অগ্রসর হইয়াছিল এ কথা স্পষ্ট প্রতীত হয়। কোন্ ভাগ্যবানেরা তাঁহার শরীর-মনাশ্রয়ে অবস্থিত সাক্ষাৎ মার নিকট হইতে ঐ নবীনোদার ভাব গ্রহণ করিয়া নিজ নিজ জীবনগঠনে ধন্য হইবে, কাহারা মার নিকট হইতে শক্তি গ্রহণ করিয়া তাঁহার বর্তমান যুগের অভিনব লীলার সহায়ক হইয়া অপরকে ঐ ভাব গ্রহণ করাইয়া কৃতার্থ করিবে, কাহাদিগকে মা ঐ মহৎ কার্যানুষ্ঠানের জন্য চিহ্নিত করিয়া রাখিয়াছেন – এইসকল কথা বুঝিবার, জানিবার ইচ্ছায় তাঁহার মন এ সময় ব্যাকুল হইয়া উঠে। মথুরের সহিত ঠাকুরের প্রেমসম্বন্ধ-বিচারকালে ঠাকুরের নিজ ভক্তগণকে দর্শনের কথা পূর্বে আমরা বলিয়াছি।1 জগদম্বার অচিন্ত্য লীলায় পৃথিবীর সকল বিষয়ে এতকাল সম্পূর্ণ অনাসক্তভাবে অবস্থিত ঠাকুরের মনে তাহাদের পূর্বদৃষ্ট মুখগুলি এখন উজ্জ্বল জীবন্ত ভাব ধারণ করিল! তাহারা কতগুলি হইবে – কবে, কতদিনে মা তাহাদের এখানে আনয়ন করিবেন – তাহাদের কাহার দ্বারা মা কোন্ কাজ করাইয়া লইবেন, মা তাহাদিগকে তাঁহার ন্যায় ত্যাগী করিবেন অথবা গৃহধর্মে রাখিবেন – সংসারে এ পর্যন্ত দুই-চারি জনই তাঁহাকে লইয়া মার এই অপূর্ব লীলার কথা অল্প-স্বল্প মাত্র বুঝিয়াছে, আগত ব্যক্তিদিগের কেহও কি জগদম্বার ঐ লীলার কথা যথাযথ সম্যক বুঝিতে পারিবে অথবা আংশিক বুঝিয়াই চলিয়া যাইবে – এইরূপ নানা কথার তোলাপাড়া করিয়াই যে এ অদ্ভুত সন্ন্যাসী মনের এখন দিন কাটিতে লাগিল, এ কথা তিনি পরে অনেক সময়ে আমাদিগকে বলিয়াছিলেন। বলিতেন, “তোদের সব দেখবার জন্য প্রাণের ভিতরটা তখন এমন করে উঠত, এমনভাবে মোচড় দিত যে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়তুম! ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা হতো! লোকের সামনে, কি মনে করবে ভেবে, কাঁদতে পারতুম না; কোন রকমে সামলে-সুমলে থাকতুম! আর যখন দিন গিয়ে রাত আসত, মার ঘরে, বিষ্ণুঘরে আরতির বাজনা বেজে উঠত, তখন আরও একটা দিন গেল – তোরা এখনও এলিনি ভেবে আর সামলাতে পারতুম না; কুঠির উপরের ছাদে উঠে ‘তোরা সব কে কোথায় আছিস আয়রে’ বলে চেঁচিয়ে ডাকতুম ও ডাক ছেড়ে কাঁদতুম। মনে হতো পাগল হয়ে যাব! তারপর কিছুদিন বাদে তোরা সব একে একে আসতে আরম্ভ করলি – তখন ঠাণ্ডা হই! আর আগে দেখেছিলাম বলে তোরা যেমন যেমন আসতে লাগলি অমনি চিনতে পারলুম! তারপর পূর্ণ যখন এল, তখন মা বললে ‘ঐ পূর্ণতে তুই যারা সব আসবে বলে দেখেছিলি তাদের আসা পূর্ণ হলো। ঐ থাকের (শ্রেণীর) লোকের কেউ আসতে আর বাকি রইল না।’ মা দেখিয়ে বলে দিলে, ‘এরাই সব তোর অন্তরঙ্গ’।” অদ্ভুত দর্শন – অদ্ভুত তাহার সফলতা! আমরা ঠাকুরের ঐসকল কথার অর্থ কতদূর কি বুঝিতে পারি? ঠাকুরের এখনকার অবস্থা সম্বন্ধে আমাদের পূর্বোক্ত কথাসকল যে স্বকপোলকল্পিত নহে, পাঠককে উহা বুঝাইবার জন্যই ঠাকুরের ঐ কথাগুলির এখানে উল্লেখ করিলাম।


1. গুরুভাব – পূর্বার্ধের ৭ম অধ্যায় দেখ।

ঠাকুরের ধারণা – ‘যার শেষ জন্ম সেই এখানে আসবে; যে ঈশ্বরকে একবারও ঠিক ঠিক ডেকেছে, তাকে এখানে আসতে হবেই হবে’

এইরূপে নিজ উদার মতের অনুভব করিবার এবং গ্রহণের অধিকারী কাহারা, এ কথা নির্ণয় করিতে যাইয়া ঠাকুরের আর একটি কথারও ধারণা উপস্থিত হইয়াছিল। ঠাকুর উহা আমাদিগকে স্বয়ং অনেক সময় বলিতেন। বলিতেন, “যার শেষ জন্ম সে-ই এখানে আসবে – যে ঈশ্বরকে একবারও ঠিক ঠিক ডেকেছে তাকে এখানে আসতে হবেই হবে।” কথাগুলি শুনিয়া কত লোক কত কি যে ভাবিয়াছে তাহা বলিয়া উঠা দায়। কেহ উহা একেবারে অযুক্তিকর সিদ্ধান্ত করিয়াছে; কেহ ভাবিয়াছে, উহা ঠাকুরের ভক্তি-বিশ্বাস-প্রসূত অসম্বদ্ধ প্রলাপমাত্র; কেহ বা ঐসকলে ঠাকুরের মস্তিষ্কবিকৃতি অথবা অহঙ্কারের পরিচয় পাইয়াছে; কেহ বা – আমরা বুঝিতে না পারিলেও ঠাকুর যখন বলিয়াছেন, তখন উহা বাস্তবিকই সত্য, এইরূপ বুঝিয়া তৎসম্বন্ধে যুক্তিতর্কের অবতারণা করাটা বিশ্বাসের হানিকর ভাবিয়া চক্ষুকর্ণে অঙ্গুলিপ্রদান করিয়াছে; আবার কেহ বা – ঠাকুর যদি উহা কখনও বুঝান তো বুঝিব, ভাবিয়া উহাতে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কিছুই একটা পাকা না করিয়া উহার সপক্ষে বা বিপক্ষে যে যাহা বলিতেছে, তাহা অবিচলিত চিত্তে শুনিয়া যাইতেছে। কিন্তু অহঙ্কার-সম্পর্ক-মাত্রশূন্য স্বাভাবিক সহজ ভাবেই যে জগদম্বা ঠাকুরকে নিজ উদার মতের অনুভব ও যথার্থ আচার্য-পদবীতে আরূঢ় করাইয়াছিলেন, এ কথা যদি আমরা পাঠককে বুঝাইতে পারিয়া থাকি তাহা হইলে তাঁহার ঐ কথাগুলির অর্থ বুঝিতে বিলম্ব হইবে না। শুধু তাহাই নহে, একটু তলাইয়া দেখিলেই পাঠক বুঝিবেন যে ঐ কথাগুলিই ঠাকুরের সহজ স্বাভাবিক ভাবে বর্তমান উচ্চ আধ্যাত্মিক অবস্থালাভবিষয়ে বিশিষ্ট প্রমাণস্বরূপ।

জগদম্বার প্রতি একান্ত নির্ভরেই ঠাকুরের ঐরূপ ধারণা আসিয়া উপস্থিত হয়

জগদম্বার বালক ঠাকুর নিজ শরীর-মনের অন্তরে দৃষ্টিপাত করিয়া বর্তমানে যে অপূর্ব আধ্যাত্মিক শক্তি-সঞ্চয় ও শক্তি-সংক্রমণ-ক্ষমতার পরিচয় পাইয়াছিলেন, তাহা যে তাঁহার নিজ চেষ্টার ফলে, এ কথা তিলেকের জন্যও তাঁহার জননীগত-প্রাণ-মনে উদিত হয় নাই। উহাতে তিনি অচিন্ত্যলীলাময়ী জগজ্জননীর খেলাই দেখিয়াছিলেন এবং দেখিয়া স্তম্ভিত ও বিস্মিত হইয়াছিলেন। অঘটনঘটনপটীয়সী মা নিরক্ষর শরীর-মনটাকে আশ্রয় করিয়া এ কি বিপুল খেলার আয়োজন করিয়াছেন! – মূককে বাগ্মী করা, পঙ্গুর দ্বারা সুমেরু উল্লঙ্ঘন করানো প্রভৃতি মার যে-সকল লীলা দেখিয়া লোকে মোহিত হইয়া তাঁহার মহিমা কীর্তন করে, বর্তমান লীলা যে ঐসকলকে শতগুণে সহস্রগুণে অতিক্রম করিতেছে! মার এ লীলায় বেদ বাইবেল পুরাণ কোরানাদি যাবতীয় ধর্মশাস্ত্র প্রমাণিত, ধর্ম প্রতিষ্ঠিত এবং জগতের যে অভাব পূর্বে কোন যুগে কেহই দূর করিতে সমর্থ হয় নাই, তাহা চিরকালের মতো বাস্তবিক অন্তর্হিত! ধন্য মা, ধন্য লীলাময়ী ব্রহ্মশক্তি! এইরূপ ভাবনার উদয়ই ঠাকুরের ঐ দর্শনে উপস্থিত হইয়াছিল। মার কথায়, মার অনন্ত করুণায় ও অচিন্ত্য শক্তিতে একান্ত বিশ্বাসেই ঠাকুরের মন ঐ দর্শনকে ধ্রুবসত্য বলিয়া ধরিয়া ঐ লীলার প্রসার কতদূর, কাহারা উহার সহায়ক এবং শক্তিবীজ কিরূপ হৃদয়েই বা রোপিত হইবে – এইসকল প্রশ্ন পর পর জিজ্ঞাসা করিয়া উহার ফলস্বরূপ অন্তরঙ্গ ভক্তদিগকে দেখা এবং যাহার শেষ জন্ম, যে ঈশ্বরকে পাইবার জন্য একবারও মনে প্রাণে ডাকিয়াছে সেই ব্যক্তিই মার এই অপূর্বোদার নূতন ভাব-গ্রহণের অধিকারী, এই সিদ্ধান্তে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। অতএব দেখা যাইতেছে, উহা জগজ্জননীর উপর ঠাকুরের ঐকান্তিক বিশ্বাসের ফলেই আসিয়াছিল। মার উপর নির্ভরশীল বালকের ঐরূপ সিদ্ধান্ত করা ভিন্ন অন্যরূপ করিবার আর উপায়ই ছিল না এবং ঐরূপ করাতে ঠাকুরের অহঙ্কারের লেশমাত্রও মনে উদিত হয় নাই।

ঠাকুরের ঐ কথার অর্থ

অতএব ‘যার শেষ জন্ম সে-ই এখানে আসবে, ঈশ্বরকে যে একবারও ঠিক ঠিক ডেকেছে, তাকে এখানে আসতে হবেই হবে’ – ঠাকুরের এই কথাগুলির ভিতর ‘এখানে’ কথাটির অর্থ যদি আমরা ‘মার অভিনব উদার ভাবে’ এইরূপ করি, তাহা হইলে বোধ হয় অযুক্তিকর হইবে না এবং কাহারও আপত্তি হইবে না। কিন্তু ঐ অর্থ স্বীকার করিলেই আবার অন্য প্রশ্ন উঠিবে – তাহারা কি জগদম্বার ‘যত মত তত পথ’-রূপ উদার ভাবে আপনা হইতে উপস্থিত হইবে অথবা জগদম্বা যাঁহাকে যন্ত্রস্বরূপ করিয়া জগতে ঐ ভাব প্রথম প্রচার করিলেন, তাঁহার সহায়ে উপস্থিত হইবে? – এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের বোধে, প্রশ্নকর্তার নিজের প্রাণে বা অপর কাহারও প্রাণে ঐ ভাব ঠিক ঠিক অনুভূতি করিবার ফল দেখিয়াই করা উচিত এবং যতদিন না ঐ দর্শন আসিয়া উপস্থিত হয়, ততদিন চুপ করিয়া থাকাই ভাল। তবে পাঠক যদি আমাদের ধারণার কথা জিজ্ঞাসা করেন তো বলিতে হয়, ঠিক ঠিক ঐ ভাবানুভূতির সঙ্গে সঙ্গে জগদম্বা যাঁহাকে ঐ ভাবময় করিয়া জগতের জন্য সংসারে প্রথম আনয়ন করিয়াছেন, তাঁহার দর্শনও তোমার যুগপৎ লাভ হইবে এবং তাঁহার ‘নির্মাণমোহ’ মূর্তিতে প্রাণের ভক্তি-শ্রদ্ধা তুমি আপনা হইতেই ঢালিয়া দিবে। ঠাকুর উহা প্রার্থনা করিবেন না – অপরেও কেহ তোমায় ঐরূপ করিতে বলিবেন না, কিন্তু তুমি জগদম্বার প্রতি প্রেমে আপনিই উহা করিয়া ফেলিবে! এ বিষয়ে আর অধিক বলা নিষ্প্রয়োজন।

গুরুভাবের ঘনীভূতাবস্থাকেই তন্ত্র দিব্যভাব বলিয়াছে। দিব্যভাবে উপনীত গুরুগণ শিষ্যকে কিরূপে দীক্ষা দিয়া থাকেন

জগদম্বার ইচ্ছায় গুরুভাব কাহারও ভিতর কিঞ্চিন্মাত্রও সহজ বা ঘনীভূত হইলে ঐ পুরুষের কার্যকলাপ, বিহার, ব্যবহার এবং অপরের প্রতি অহৈতুকী করুণাপ্রকাশ সকলই মানববুদ্ধির অগম্য এক অদ্ভুতাকার যে ধারণ করে, ভারতের তন্ত্রকার এ কথা বারংবার বলিয়াছেন। ঐ ভাবের ঐরূপ বিকাশকে তন্ত্র দিব্যভাব আখ্যা প্রদান করেন এবং ঐ দিব্যভাবে ভাবিত পুরুষদিগের অপরকে শিক্ষাদীক্ষাদিদান শাস্ত্রবিধিবদ্ধ নিয়মসকলের বহির্ভূত অসম্ভাবিত উপায়ে হইয়া থাকে, এ কথাও বলেন। কাহারও প্রতি করুণায় তাঁহারা ইচ্ছা বা স্পর্শমাত্রেই ঐ ব্যক্তিতে ধর্মশক্তি সম্যক জাগ্রত করিয়া তদ্দণ্ডেই সমাধিস্থ করিতে পারেন; অথবা আংশিকভাবে ঐ শক্তিকে তাহাদের ভিতর জাগ্রত করিয়া এ জন্মেই যাহাতে উহা সম্যকভাবে জাগরিতা হয় ও সাধককে যথার্থ ধর্মলাভে কৃতার্থ করে, তাহাও করিয়া দিতে পারেন। তন্ত্র বলেন, গুরুভাবের ঈষৎ ঘনীভূতাবস্থায় আচার্য শিষ্যকে ‘শাক্তী’ দীক্ষাদানে এবং বিশেষ ঘনীভূতাবস্থায় ‘শাম্ভবী’ দীক্ষাদানে সমর্থ হইয়া থাকেন। আর, সাধারণ গুরুদেরই শিষ্যকে ‘মান্ত্রী’ বা ‘আণবী’ দীক্ষাদান তন্ত্রনির্দিষ্ট। ‘শাক্তী’ ও ‘শাম্ভবী’ দীক্ষা সম্বন্ধে রুদ্রযামল, ষড়ন্বয় মহারত্ন, বায়বীয় সংহিতা, সারদা, বিশ্বসার প্রভৃতি সমস্ত তন্ত্র এক কথাই বলিয়াছেন। আমরা এখানে বায়বীয় সংহিতার শ্লোকগুলি উদ্ধৃত করিলাম। যথা –

শাম্ভবী চৈব শাক্তী চ মান্ত্রী চৈব শিবাগমে।
দীক্ষোপদিশ্যতে ত্রেধা শিবেন পরমাত্মনা॥
গুরোরালোকমাত্রেণ স্পর্শাৎ সম্ভাষণাদপি।
সদ্যঃ সংজ্ঞা ভবেজ্জন্তোর্দীক্ষা সা শাম্ভবী মতা॥
শাক্তী জ্ঞানবতী দীক্ষা শিষ্যদেহং প্রবিশ্যতি।
গুরুণা জ্ঞানমার্গেন ক্রিয়তে জ্ঞানচক্ষুষা॥
মান্ত্রী ক্রিয়াবতী দীক্ষা কুম্ভমণ্ডলপূর্বিকা।
* * *

শ্রীগুরুর দর্শন, স্পর্শন ও সম্ভাষণমাত্রেই শিষ্যের জ্ঞানের উদয় হওয়াকে শাম্ভবী দীক্ষা বলে; এবং গুরুর শক্তি শিষ্য-শরীরে প্রবিষ্ট হইয়া তাহার ভিতর জ্ঞানের উদয় করিয়া দেওয়াকেই শাক্তী দীক্ষা কহে

অর্থাৎ – আগমশাস্ত্রে পরমাত্মা শিব তিন প্রকার দীক্ষার উপদেশ করিয়াছেন, যথা – শাম্ভবী, শাক্তী ও মান্ত্রী। শাম্ভবী দীক্ষায় শ্রীগুরু-দর্শন, স্পর্শন বা সম্ভাষণ (প্রণামাদি) মাত্রেই জীবের তদ্দণ্ডে জ্ঞানোদয় হয়। শাক্তী দীক্ষায় জ্ঞানচক্ষু গুরু দিব্যজ্ঞান-সহায়ে শিষ্যের ভিতর নিজ শক্তি প্রবিষ্ট করাইয়া তাহার প্রাণে ধর্মভাব জাগ্রত করাইয়া দেন। মান্ত্রী দীক্ষায় মণ্ডল-অঙ্কন, ঘটস্থাপন এবং দেবতার পূজাদিপূর্বক শিষ্যের কর্ণে মন্ত্রোচ্চারণ করিয়া দিতে হয়।

রুদ্রযামল বলেন – শাক্তী ও শাম্ভবী দীক্ষা সদ্যোমুক্তিবিধায়িনী! যথা –

শাক্তী চ শাম্ভবী চান্যা সদ্যোমুক্তিবিধায়িনী।
* * *
সিদ্ধৈঃ স্বশক্তিমালোক্য তয়া কেবলয়া শিশোঃ।
নিরুপায়ং কৃতা দীক্ষা শাক্তেয়ী পরিকীর্তিতা॥
অভিসন্ধিং বিনাচার্যশিষ্যয়োরুভয়োরপি।
দেশিকানুগ্রহেণৈব শিবতা-ব্যক্তিকারিণী॥

অর্থাৎ – সিদ্ধপুরুষেরা কোনরূপ বাহ্যিক উপায় অবলম্বন না করিয়া কেবলমাত্র নিজ আধ্যাত্মিক শক্তিসহায়ে শিষ্যের ভিতর যে দিব্যজ্ঞানের উদয় করেন, তাহাকেই শাক্তী দীক্ষা কহে। শাম্ভবী দীক্ষায় আচার্য ও শিষ্যের মনে দীক্ষা প্রদান ও গ্রহণ করিব, পূর্ব হইতে এরূপ কোন সঙ্কল্প থাকে না। পরস্পরের দর্শন-মাত্রেই আচার্যের হৃদয়ে সহসা করুণার উদয় হইয়া শিষ্যকে কৃপা করিতে ইচ্ছা হয় এবং উহাতেই শিষ্যের ভিতর অদ্বৈতবস্তুর জ্ঞানোদয় হইয়া সে শিষ্যত্ব স্বীকার করে।

ঐরূপ দীক্ষায় কালাকাল-বিচারের আবশ্যকতা নাই

পুরশ্চরণোল্লাস তন্ত্র বলেন, ঐ প্রকার দীক্ষায় শাস্ত্রনির্দিষ্ট কালাকাল বিচারেরও আবশ্যকতা নাই। যথা –

দীক্ষায়াং চঞ্চলাপাঙ্গি ন কালনিয়মঃ ক্বচিৎ।
সদ্গুরোর্দর্শনাদেব সূর্যপর্বে চ সর্বদা॥
শিষ্যমাহূয় গুরুণা কৃপয়া যদি দীয়তে।
তত্র লগ্নাদিকং কিঞ্চিৎ ন বিচার্যং কদাচন॥

অর্থাৎ – হে চঞ্চলনয়নি পার্বতি, বীর ও দিব্যভাবাপন্ন গুরুর নিকট হইতে দীক্ষাগ্রহণে কালবিচারের কোন আবশ্যকতা নাই। উত্তরায়ণকালে সদ্গুরুর দর্শনলাভ হইলে এবং তিনি কৃপা করিয়া শিষ্যকে দীক্ষা দিতে আহ্বান করিলে লগ্নাদিবিচার না করিয়াই উহা লইবে।

দিব্যভাবাপন্ন গুরুগণের মধ্যে ঠাকুর সর্বশ্রেষ্ঠ – উহার কারণ

সাধারণ দিব্যভাবাপন্ন গুরুর সম্বন্ধেই শাস্ত্র যখন ঐরূপ ব্যবস্থা নির্ণয় করিয়াছেন, তখন এ অলৌকিক ঠাকুরের জগদম্বার হস্তে সর্বদা যন্ত্রস্বরূপ থাকিয়া অহৈতুকী করুণায় অপরকে শিক্ষাদান ও ধর্মশক্তি-সঞ্চারের প্রকার আমরা কেমন করিয়া নির্ণয় করিতে পারিব! কারণ, জগন্মাতা কৃপা করিয়া ঠাকুরের শরীর-মনাশ্রয়ে এখন যে কেবল তন্ত্রোক্ত দিব্যভাবের খেলাই শুধু দেখাইতে লাগিলেন তাহা নহে, কিন্তু দিব্যভাবাপন্ন যাবতীয় গুরুগণ ‘যত মত তত পথ’-রূপ যে উদার ভাবের সাধন ও উপলব্ধি এ কাল পর্যন্ত কখনও করেন নাই, সেই মহদুদার ভাবের প্রকাশও তিনি এখন হইতে ঠাকুরের ভিতর দিয়া জগদ্ধিতায় করিতে লাগিলেন। তাই বলিতেছি, অতঃপর ঠাকুরের জীবনে এক নূতনাধ্যায় এখন হইতে আরম্ভ হইল।

অবতারমহাপুরুষগণের ভিতরে সকল সময় সকল শক্তি প্রকাশিত থাকে না। ঐ বিষয়ে প্রমাণ

ভক্তিমান শ্রোতা হয়তো আমাদের ঐ কথায় কুটিল কটাক্ষ করিয়া বলিবেন – তোমাদের ও-সকল কি প্রকার কথা? ঠাকুরকে যদি ঈশ্বরাবতার বলিয়াই নির্দেশ কর, তবে তাঁহার ঐ ভাব বা শক্তিপ্রকাশ যে কখনও ছিল না, এ কথা আর বলিতে পার না। ঐ কথার উত্তরে আমরা বলি – ভ্রাতঃ, ঠাকুরের কথা-প্রমাণেই আমরা ঐরূপ বলিতেছি। নরদেহ ধারণ করিয়া ঈশ্বরাবতারদিগেরও সকল প্রকার ঈশ্বরীয় ভাব ও শক্তিপ্রকাশ সর্বদা থাকে না; যখন যেটির আবশ্যক হয়, তখনই সেটি আসিয়া উপস্থিত হয়। কাশীপুরের বাগানে বহুকাল ব্যাধির সহিত সংগ্রামে ঠাকুরের শরীর যখন অস্থিচর্মসার হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, তখন তাঁহার অন্তরের ভাব ও শক্তির প্রকাশ লক্ষ্য করিয়া ঠাকুর একদিন আমাদিগকে বলিয়াছিলেন:

“মা দেখিয়ে দিচ্ছে কি যে, (নিজের শরীর দেখাইয়া) এর ভিতর এখন এমন একটা শক্তি এসেছে যে, এখন আর কাহাকেও ছুঁয়ে দিতেও হবে না; তোদের বলব ছুঁয়ে দিতে, তোরা দিবি, তাতেই অপরের চৈতন্য হয়ে যাবে! মা যদি এবার (শরীর দেখাইয়া) এটা আরাম করে দেন তো দরজায় লোকের ভিড় ঠেলে রাখতে পারবি না – এত সব লোক আসবে। এত খাটতে হবে যে, ঔষধ খেয়ে গায়ের ব্যথা সারাতে হবে!”

ঠাকুরের ঐ কথাগুলিতেই বুঝা যায়, ঠাকুর স্বয়ং বলিতেছেন যে, যে শক্তিপ্রকাশ তাঁহাতে পূর্বে কখনও অনুভব করেন নাই তাহাই তখন ভিতরে অনুভব করিতেছিলেন। এইরূপ আরও অনেক দৃষ্টান্ত এ বিষয়ে দেওয়া যাইতে পারে।

ঠাকুরের ভক্তপ্রবর কেশবচন্দ্রের সহিত মিলন এবং উহার পরেই তাঁহার নিজ ভক্তগণের আগমন

দিব্যভাবের আবেগে ঠাকুর এখন ভক্তদিগকে ব্যাকুলচিত্তে পূর্বোক্ত প্রকারে ডাকিয়াই নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন নাই। যেখানে সংবাদ পৌঁছিলে তাঁহার দক্ষিণেশ্বরে অবস্থানের কথা প্রায় সকল ভক্তগণ জানিতে পারিবে, জগদম্বা তাঁহাকে সে কথা প্রাণে প্রাণে বলিয়া বেলঘরিয়ার উদ্যানে লইয়া যাইয়া ভক্তপ্রবর শ্রীযুত কেশবচন্দ্র সেনের সহিত সাক্ষাৎ করাইয়া দিলেন। ঐ ঘটনার অল্পদিন পর হইতে ঠাকুরের কৃপাসম্পদের বিশেষভাবে অধিকারী, ভাবাবস্থায় পূর্বে দৃষ্ট স্বামী বিবেকানন্দ ও ব্রহ্মানন্দ প্রমুখ ভক্তসকলের একে একে আগমন হইতে থাকে। তাঁহাদের সহিত ঠাকুরের দিব্যভাবে লীলার কথা ঠাকুর বলাইলে আমরা অন্য সময় বলিবার চেষ্টা করিব। এখন ঐ অদৃষ্টপূর্ব দিব্যভাবাবেশে তিনি ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দের রথযাত্রার সময় নিজ ভক্তগণকে লইয়া যেরূপে কয়েকটি দিন কাটাইয়াছিলেন, দৃষ্টান্ত-স্বরূপে তাহারই ছবি পাঠকের নয়নগোচর করিয়া আমরা গুরুভাবপর্বের উপসংহার করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *