৪.১ বৈষ্ণবচরণ ও গৌরীর কথা

চতুর্থ খণ্ড – প্রথম অধ্যায়: বৈষ্ণবচরণ ও গৌরীর কথা

দক্ষিণেশ্বরাগত সাধু ও সাধকগণের সহিত ঠাকুরের গুরুভাবের সম্বন্ধ-বিষয়ে কলিকাতার লোকের অজ্ঞতা

যে মে মতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ।
শ্রদ্ধাবন্তোঽনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেঽপি কর্মভিঃ॥
– গীতা, ৩।৩১

কলিকাতার জনসাধারণের ধারণা, ঠাকুর কলিকাতার কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ কতকগুলি ইংরেজীশিক্ষিত, পাশ্চাত্যভাবে ভাবিত নব্য হিন্দুদলের লোকের ভিতরেই ধর্মভাব সঞ্চারিত করিয়াছিলেন বা তাঁহাদের ভিতরেই পূর্ব হইতে প্রদীপ্ত ধর্মভাবকে অধিকতর উজ্জ্বল করিয়াছিলেন। কিন্তু কলিকাতার লোকেরা ঠাকুরের দক্ষিণেশ্বরে অবস্থানের কথা জানিতে পারিবার বহু পূর্ব হইতেই যে ঠাকুরের নিকটে বাঙলা এবং উত্তর ভারতবর্ষের প্রায় সকল প্রদেশ হইতে সকল সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট বিশিষ্ট সাধু, সাধক এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতসকল আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন এবং ঠাকুরের জ্বলন্ত জীবন্ত ধর্মাদর্শ ও গুরুভাবসহায়ে আপন আপন নির্জীব ধর্মজীবনে প্রাণসঞ্চার লাভ করিয়া অন্যত্র অনেকানেক লোকের ভিতর সেই নব ভাব, নব শক্তি সঞ্চারিত করিতে গমন করিয়াছিলেন – এ কথা কলিকাতার ইতরসাধারণে অবগত নহেন।

“ফুল ফুটিলে ভ্রমর জুটে।” ধর্মদানের যোগ্যতা চাই, নতুবা প্রচার বৃথা

ঠাকুর বলিতেন – ‘ফুল ফুটিলেই ভ্রমর আপনি আসিয়া জুটে’, তাহাকে ডাকিয়া আনিতে হয় না। তোমার ভিতরে ঈশ্বরভক্তি ও প্রেম যথার্থই বিকশিত হইলে যাঁহারা ঈশ্বরতত্ত্বের অনুসন্ধানে, সত্যলাভের জন্য জীবনোৎসর্গ করিয়াছেন বা করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছেন, তাঁহারা সকলে কি একটা অনির্দিষ্ট আধ্যাত্মিক নিয়মের বশে তোমার নিকট আসিয়া জুটিবেনই জুটিবেন। ঠাকুরের মতই ছিল সেজন্য – অগ্রে ঈশ্বরবস্তু লাভ কর, তাঁহার দর্শন ও কৃপা লাভ করিয়া যথার্থ লোকহিতের জন্য কার্য করিবার ক্ষমতায় ভূষিত হও, ঐ বিষয়ে তাঁহার আদেশ বা ‘চাপরাস’ লাভ কর, তবে ধর্মপ্রচার বা বহুজনহিতায় কর্ম করিতে অগ্রসর হও; নতুবা, ঠাকুর বলিতেন, “তোমার কথা লইবে কে? তুমি যাহা করিতে বলিবে, দশে তা লইবে কেন, শুনিবে কেন?”

আধ্যাত্মিক বিষয়ে সকলেই সমান অন্ধ

বাস্তবিক এই জন্ম-জরা-মৃত্যু-সঙ্কুল দুঃখ-দারিদ্র্য-অজ্ঞানান্ধকারপূর্ণ জগতে আমরা অহঙ্কারে ফুলিয়া উঠিয়া যতই কেন আপনাদের অপরের অপেক্ষা বড় জ্ঞান করি না, অবস্থা আমাদের সকলেরই সমান। জড়বিজ্ঞানের উন্নতি করিয়া অঘটন-ঘটন-পটীয়সী জগজ্জননীর মায়ার রাজ্যে দুই-চারিটা দ্রব্যগুণ জানিয়া লইয়া যতই কেন আমরা কল-কারখানার বিস্তার করি না, দুর্দশা আমাদের চিরকাল সমান রহিয়াছে! সেই ইন্দ্রিয়-তাড়না, সেই লোভ-লালসা, সেই নিরন্তর মৃত্যুভয়, সেই কে আমি, কেনই বা এখানে, পরেই বা কোথায় যাইব – পঞ্চেন্দ্রিয় ও মনবুদ্ধি-সহায়ে সত্যলাভের প্রয়াসী হইলেও ঐসকলের দ্বারাই পদে পদে প্রতারিত ও বিপথগামী – আমার এ খেলার উদ্দেশ্য কি এবং ইহার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ কখনও হইবে কিনা – এ সকল বিষয়ে পূর্ণমাত্রায় অজ্ঞানতা নিরন্তরই বিদ্যমান! এ চির-অভাবগ্রস্ত সংসারে যথার্থ তত্ত্বজ্ঞান লইবার লোক তো সকলেই! কিন্তু তাহাদের উহা দেয় কে? বাস্তবিক কাহারও যদি কিছু দান করিবার থাকে তো সে কত দিবে দিক না। কিন্তু ভ্রান্ত – শত ভ্রান্ত মানব সে কথা বুঝে না। কিছু না থাকিলেও সে নাম-যশের বা অন্য কিছু স্বার্থের প্ররোচনায় অগ্রেই যাহা তাহার নাই অপরকে তাহা দিতে ছুটে বা সে যে তাহা দিতে পারে এইরূপ ভান করে এবং ‘অন্ধেনৈব নীয়মানা যথান্ধাঃ’ আপনিও হায় হায় করিয়া পশ্চাত্তাপ করে এবং অপরকেও সেইরূপ করায়!

ঠাকুর ধর্মপ্রচার কিভাবে করেন

সেইজন্য ঠাকুর সংসারে সকলে যে পথে চলিতেছে তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত পথ অবলম্বন করিয়া পূর্ণমাত্রায় ত্যাগ, বৈরাগ্য ও সংযমাদি অভ্যাসে আপনাকে শ্রীশ্রীজগদম্বার হস্তের ঠিক ঠিক যন্ত্রস্বরূপ করিয়া ফেলিলেন এবং সত্যবস্তু লাভ করিয়া স্থির নিশ্চিন্ত হইয়া একই স্থানে বসিয়া জীবন কাটাইয়া যথার্থ কার্যানুষ্ঠানের এক নূতন ধারা দেখাইয়া গেলেন। দেখাইলেন যে, বস্তুলাভ করিয়া অপরকে দিবার যথার্থ কিছু সংগ্রহ করিয়া যেমন তিনি উহা বিতরণের নিমিত্ত তাঁহার জ্ঞানভাণ্ডার খুলিয়া দিলেন, অমনি অনাহূত হইলেও কোথা হইতে পিপাসু লোকসকল আসিয়া জুটিতে লাগিল এবং তাঁহার দিব্যদৃষ্টি ও স্পর্শে পূত হইয়া নিজেরাই যে কেবল ধন্য হইয়া গেল তাহা নহে, কিন্তু সেই নব ভাব তাহারা যেখানেই যাইতে লাগিল সেখানেই প্রসারিত করিয়া অপর সাধারণকে ধন্য করিতে লাগিল। কারণ ভিতরে যে ভাবরাশি থাকে তাহাই আমরা বাহিরে প্রকাশ করিয়া থাকি – তা আমরা যেখানেই থাকি না কেন। ঠাকুর তাঁহার সরল গ্রাম্য ভাষায় যেমন বলিতেন, “যে যা খায় তার ঢেকুরে (উদ্গারে) সেই গন্ধই পাওয়া যায় – শশা খাও, শশার গন্ধ বেরুবে; মুলো খাও, মুলোর গন্ধ বেরুবে – এইরূপই হয়।”

ব্রাহ্মণীর সহিত মিলনকালে ঠাকুরের অবস্থা

ভৈরবী ব্রাহ্মণীর সহিত সম্মিলন ঠাকুরের জীবনে একটি বিশেষ ঘটনা। দেখিতে পাই, ঐ সময় হইতেই তিনি শাস্ত্রমর্যাদা রক্ষা করিয়া তৎপ্রদর্শিত সাধনমার্গে যেমন দৃঢ় ও দ্রুতপদে অগ্রসর, তেমনি আবার তাঁহাতে গুরুভাবের বিশেষ প্রকাশ হইতে আরম্ভ। কিন্তু ঐ কালের পূর্বে তাঁহাতে যে ঐ ভাব আদৌ ছিল না, তাহা বলিতে পারি না। কারণ পূর্ব পূর্ব প্রবন্ধে আমরা দেখিয়াছি যে, ঠাকুরের জীবনে গুরুভাবের বিকাশ বাল্যাবধি সকল সময়েই স্বল্পাধিক পরিমাণে বর্তমান এবং এমনকি, তাঁহার নিজ দীক্ষাগুরুগণও ঐ গুরুভাবের সহায়ে নিজ নিজ ধর্ম-জীবনের অভাব, ত্রুটি ও অবসাদ দূরীভূত করিয়া পূর্ণতাপ্রাপ্তির অবসর পাইয়াছিলেন।

ঠাকুরের উচ্চাবস্থা-সম্বন্ধে অপরে কি বুঝিত

ব্রাহ্মণী আসিবার পূর্বে ঠাকুরের অদৃষ্টপূর্ব ঈশ্বরানুরাগ ও ব্যাকুলতা উন্মত্ততা ও শারীরিক ব্যাধি বলিয়াই অনেকটা গণ্য হইয়া আসিতেছিল এবং উহার উপশমের জন্য চিকিৎসাও হইতেছিল। ৺গঙ্গাপ্রসাদ সেনের বাটীতে পূর্ববঙ্গীয় জনৈক সাধক কবিরাজী চিকিৎসার জন্য আগত ঠাকুরকে দেখিয়া ঐসকল শারীরিক লক্ষণসমূহকে ‘যোগজ বিকার’ বা যোগাভ্যাস করিতে করিতে শরীরে যে-সকল অসাধারণ পরিবর্তন আসিয়া উপস্থিত হয় তাহাই বলিয়া নির্দেশ করিলেও সে কথায় তখন কেহ একটা বড় আস্থা স্থাপন করেন নাই। মথুর প্রমুখ সকলেই স্থির করিতেছিলেন, উহা ঈশ্বরানুরাগের সহিত বায়ুরোগের সম্মিলনে উপস্থিত হইয়াছে। ভক্তিশাস্ত্রজ্ঞা বিদুষী ব্রাহ্মণীই ঐসকল শারীরিক বিকারকে প্রথম অসাধারণ ঈশ্বরভক্তি-প্রসূত দেববাঞ্ছিত মানসিক পরিবর্তনের অনুরূপ দিব্য শারীরিক পরিবর্তন বলিয়া সকলের সমক্ষে নির্দেশ করিলেন। শুধু নির্দেশ করিয়াই ক্ষান্ত রহিলেন না, কিন্তু সাক্ষাৎ প্রেম-ভক্তিরূপিণী ব্রজেশ্বরী শ্রীমতী রাধা হইতে মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য পর্যন্ত পূর্ব পূর্ব সমস্ত যোগী আচার্যগণের জীবনেই যে অপূর্ব মানসিক অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ঐরূপ অনুভূতিসমূহ সময়ে সময়ে উপস্থিত হইয়াছিল এবং সে কথা যে ভক্তিগ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রহিয়াছে, তাহাও তিনি শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করিয়া দেখাইয়া এবং ঠাকুরের শারীরিক লক্ষণের সহিত ঐসকল মিলাইয়া নিজ বাক্য প্রমাণিত করিতে লাগিলেন। তাঁহার সে কথায় জননীর আশ্বাসে বালক যেমন সাহস ও বল পাইয়া আনন্দ প্রকাশ করিতে থাকে, ঠাকুর তো তদ্রূপ করিতে লাগিলেনই আবার মথুর প্রমুখ কালীবাটীর সকলেও বড় অল্প আশ্চর্যান্বিত হইলেন না। তাহার উপর যখন ব্রাহ্মণী মথুরকে বলিলেন, “শাস্ত্রজ্ঞ সুপণ্ডিত সকলকে আন, আমি তাঁহাদের নিকট আমার এ কথা প্রমাণিত করিতে প্রস্তুত”, তখন আর তাঁহাদের আশ্চর্যের পরিসীমা রহিল না।

ঠাকুরের অবস্থা বুঝিয়া ব্রাহ্মণী শাস্ত্রজ্ঞদের আনিতে বলায় মথুরের সিদ্ধান্ত

কিন্তু আশ্চর্য হইলে কি হইবে? ভিক্ষাব্রতাবলম্বিনী নগণ্যা একটা অপরিচিতা স্ত্রীলোকের কথায় ও পাণ্ডিত্যে সহসা কে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারে? কাজেই পূর্ববঙ্গীয় কবিরাজের কথার ন্যায় ভৈরবী ব্রাহ্মণীর কথাও মথুরানাথ প্রভৃতির হৃদয়ে এক কান দিয়া প্রবেশলাভ করিয়া অপর কান দিয়া বাহির হইয়া যাইত নিশ্চয়, তবে ঠাকুরের আগ্রহ ও অনুরোধে ব্যাপারটা অন্যরূপ দাঁড়াইয়া গেল। বালকবৎ ঠাকুর মথুরবাবুকে ধরিয়া বসিলেন, ‘ভাল ভাল পণ্ডিত আনাইয়া ব্রাহ্মণী যাহা বলিতেছে, তাহা যাচাইতে হইবে।’ ধনী মথুরও ভাবিলেন – ছোট ভট্চাযের জন্য ঔষধে ও ডাক্তার-খরচায় তো এত টাকা ব্যয় হইতেছে, তা ঐরূপ করিতে দোষ কি? পণ্ডিতেরা আসিয়া শাস্ত্রপ্রমাণে ব্রাহ্মণীর কথা কাটিয়া দিলে – এবং দিবেও নিশ্চিত – অন্ততঃ একটা লাভও হইবে। পণ্ডিতদের কথায় বিশ্বাস করিয়া ছোট ভট্চাযের সরল বিশ্বাসী হৃদয়ে অন্ততঃ এ ধারণাটা হইবে যে, তাঁহার রোগবিশেষ হইয়াছে – তাহাতে তাঁহার নিজের মনের উপর একটা বাঁধ দিতেও ইচ্ছা হইতে পারে। পাগল তো লোকে এইরূপেই হয় – নিজে যাহা করিতেছি, বুঝিতেছি, তাহাই ঠিক আর অপর দশজনে যাহা বুঝিতেছে, করিতে বলিতেছে, তাহা ভুল – এইটি নিশ্চয় করিয়া নিজের মনের উপর, চিন্তার উপর বাঁধ না দিয়া মনকে নিজের বশীভূত রাখিবার চেষ্টা না করিয়াই তো লোক পাগল হয়! আর পণ্ডিতদের না ডাকিয়া ভট্চাযকে ব্রাহ্মণীর কথায় অবাধে বিশ্বাস করিতে দিলে তাঁহার মানসিক বিকার আরও বাড়িয়া শারীরিক রোগও যে বাড়িবে, তাহাতে আর সন্দেহ কি। এইরূপে কতক কৌতূহলে, কতক ঠাকুরের প্রতি ভালবাসায় – ঐরূপ কিছু একটা ভাবিয়াই যে মথুর ঠাকুরের অনুরোধে পণ্ডিতদিগকে আনাইতে সম্মত হইয়াছিলেন, ইহা আমরা বেশ বুঝিতে পারি।

বৈষ্ণবচরণ ও ‘ইঁদেশে’র গৌরীকে আহ্বান

কলিকাতার পণ্ডিতমহলে তখন বৈষ্ণবচরণের বেশ প্রতিপত্তি। আবার অনেক স্থলে সকলের সমক্ষে তিনি শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থ সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করিয়া পাঠ করিয়া ইতরসাধারণের নিকটেও তাঁহার খুব নামযশ। সেজন্য ঠাকুর, মথুরবাবু ও ব্রাহ্মণী সকলেই তাঁহার কথা ইতঃপূর্বেই শুনিয়াছিলেন। মথুর তাঁহাকে আনাইতে মনোনীত করিলেন এবং বাঁকুড়া অঞ্চলের ইঁদেশের গৌরী পণ্ডিতের অসাধারণ ক্ষমতা ও পাণ্ডিত্যের কথা শুনিয়া তাঁহাকেও আনাইবার মানস করিলেন। এইরূপেই বৈষ্ণবচরণ ও ইঁদেশের গৌরীর দক্ষিণেশ্বরে আগমন হয়। ঠাকুরের নিকট আমরা ইঁহাদের অনেক কথা অনেক সময় শুনিয়াছি। তাহাই এখন পাঠককে উপহার দিলে মন্দ হইবে না।

বৈষ্ণবচরণের তখন কতদূর খ্যাতি

বৈষ্ণবচরণ কেবল যে পণ্ডিত ছিলেন তাহা নহে, কিন্তু একজন ভক্ত সাধক বলিয়াও সাধারণে পরিচিত ছিলেন। তাঁহার ঈশ্বরভক্তি এবং দর্শনাদি শাস্ত্রে বিশেষতঃ ভক্তিশাস্ত্রে সূক্ষ্ম দৃষ্টি তাঁহাকে তাত্কালিক বৈষ্ণবসমাজের একজন নেতা করিয়া তুলিয়াছিল বলা যাইতে পারে। বিদায়-আদায় নিমন্ত্রণাদিতে বৈষ্ণবসমাজ তাঁহাকে অগ্রেই সাদর আহ্বান করিতেন। ধর্মবিষয়ক কোনরূপ মীমাংসায় উপনীত হইতে হইলে সমাজ অনেক সময় তাঁহাকেই জিজ্ঞাসা করিতেন ও তাঁহার মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতেন। আবার সাধনপথের ঠিক ঠিক নির্দেশ পাইবার জন্য অনেক ভক্ত সাধকও তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহারই পরামর্শে গন্তব্যপথে অগ্রসর হইতেন। কাজেই ভক্তির আতিশয্যে ঠাকুরের ঐরূপ ভাবাদি হইতেছে কিংবা কোনরূপ শারীরিক ব্যাধিগ্রস্ত হওয়াতে ঐরূপ হইতেছে, তাহা নির্ণয় করিতে যে বৈষ্ণবচরণকে মথুর আনিতে সঙ্কল্প করিবেন, ইহাতে আর বৈচিত্র্য কি?

ঠাকুরের গাত্রদাহ-নিবারণে ব্রাহ্মণীর ব্যবস্থা

ভৈরবী ব্রাহ্মণী আবার ইতোমধ্যে ঠাকুরের অবস্থা সম্বন্ধে তাঁহার ধারণা যে সত্য তদ্বিষয়ে এক বিশিষ্ট প্রমাণ পাইয়া নিজেও উল্লসিতা হইয়াছিলেন এবং অপরেরও বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছিলেন। তাহা এই – ব্রাহ্মণীর আগমনকালের কিছু পূর্ব হইতে ঠাকুর গাত্রদাহে বিষম কষ্ট পাইতেছিলেন। সে জ্বালা নিবারণের অনেক চেষ্টা হইয়াছিল, কিন্তু কিছুমাত্র ফলোদয় হয় নাই। ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছি, সূর্যোদয় হইতে যত বেলা হইত ততই সে জ্বালা অধিকতর বৃদ্ধি পাইত। দুই প্রহরে এত অসহ্য হইয়া উঠিত যে, গঙ্গার জলে শরীর ডুবাইয়া মাথায় একখানি ভিজা গামছা চাপা দিয়া দুই-তিন ঘণ্টা কাল বসিয়া থাকিতে হইত। আবার অত অধিকক্ষণ জলে পড়িয়া থাকিলে পাছে বিপরীত ঠাণ্ডা লাগিয়া অনুরূপ অসুস্থতা উপস্থিত হয়, এজন্য ইচ্ছা না হইলেও জল হইতে উঠিয়া আসিয়া বাবুদের কুঠির ঘরের মর্মর-প্রস্তর-বাঁধানো মেঝে ভিজা কাপড় দিয়া মুছিয়া ঘরের সমস্ত দ্বার বন্ধ করিয়া সেই মেঝেতে গড়াগড়ি দিতে হইত।

ব্রাহ্মণী ঠাকুরের ঐরূপ অবস্থার কথা শুনিয়াই অন্যরূপ ধারণা করিলেন। বলিলেন, উহা ব্যাধি নয়; উহাও ঠাকুরের মনের প্রবল আধ্যাত্মিকতা বা ঈশ্বরানুরাগের ফলেই উপস্থিত হইয়াছে। বলিলেন, ঈশ্বরদর্শনের অত্যুগ্র ব্যাকুলতায় শরীরে এইরূপ বিকার-লক্ষণসকল শ্রীমতী রাধারানী ও শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনে অনেক সময় উপস্থিত হইত। এ রোগের ঔষধও অপূর্ব – সুগন্ধি পুষ্পের মাল্যধারণ এবং সর্বাঙ্গে সুবাসিত চন্দনলেপন।

বলা বাহুল্য, ব্রাহ্মণীর ঐ প্রকার রোগনির্দেশে বিশ্বাস করা দূরে থাকুক, মথুর প্রমুখ সকলে হাস্য সংবরণ করিতেও পারেন নাই। ভাবিয়াছিলেন, কত ঔষধসেবন, মধ্যমনারায়ণ বিষ্ণুতৈলাদি কত তৈলমর্দন করিয়া যাহার কিছু উপশম হইল না, তাহা কিনা বলে ‘রোগ নয়’। তবে ব্রাহ্মণী যে সহজ ঔষধের ব্যবস্থা করিতেছে তাহার ব্যবহারে কাহারও কোনও আপত্তিই হইতে পারে না। দুই-এক দিন লাগাইয়া কোনও ফল না পাইলে রোগী আপনিই উহা ত্যাগ করিবে। অতএব ব্রাহ্মণীর কথামতো ঠাকুরের শরীর চন্দনলেপ ও পুষ্পমাল্যে ভূষিত হইল। কিন্তু তিন দিন ঐরূপ অনুষ্ঠানের পর দেখা গেল, ঠাকুরের সে গাত্রদাহ একেবারে তিরোহিত হইয়াছে। সকলে আশ্চর্য হইলেন। কিন্তু অবিশ্বাসী মন কি সহজে ছাড়ে? বলিল – ওটা কাকতালীয়ের ন্যায় হইয়াছে আর কি! ভট্টাচার্য মহাশয়কে শেষে ঐ যে বিষ্ণুতৈলটা ব্যবহার করিতে দেওয়া হইয়াছিল, ওটা একেবারে খাঁটি তেল ছিল; কবিরাজের কথার ভাবেই সেটা বুঝা গিয়াছিল – সেই তৈলটাতেই উপকার হইয়া আসিতেছিল; আর দুই-এক দিন ব্যবহার করিলেই সব জ্বালাটুকু দূর হইত, এমন সময় ভৈরবী চন্দন মাখাইবার ব্যবস্থাটা করিয়াছে, তাই ঐ প্রকার হইয়াছে। ব্রাহ্মণী যাহাই বলুক আর ব্যবস্থা করুক না কেন, ও তৈলটা কিন্তু বরাবর মাখানো উচিত।

ঠাকুরের বিপরীত ক্ষুধা-নিবারণে ব্রাহ্মণীর ব্যবস্থা

কিছুদিন পরে ঠাকুরের আবার এক উপসর্গ আসিয়া উপস্থিত হয়। ব্রাহ্মণীর সহজ ব্যবস্থায় উহাও তিন দিনে নিবারিত হইয়াছিল এ কথাও আমরা ঠাকুরের মুখে শুনিয়াছি। ঠাকুর বলিতেন, “এ সময় একটা বিপরীত ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছিল। যতই কেন খাই না, পেট কিছুতেই যেন ভরত না। এই খেয়ে উঠলুম, আবার তখনি যেন কিছু খাই খাই – সমান খাবার ইচ্ছা! দিন-রাত্তির কেবলই ‘খাই-খাই’ ইচ্ছা – তার আর বিরাম নেই। ভাবলুম, এ আবার কি ব্যারাম হল? বামনীকে বল্লুম, সে বল্লে – ‘বাবা, ভয় নেই, ঈশ্বরপথের পথিকদের ওরকম অবস্থা কখন কখন হয়ে থাকে, শাস্ত্রে এ কথা আছে; আমি তোমার ওটা ভাল করে দিচ্ছি।’ এই ব’লে, মথুরকে ব’লে ঘরের ভেতর চিঁড়ে মুড়কি থেকে সন্দেশ, রসগোল্লা, লুচি অবধি যত রকম খাবার আছে, সব থরে থরে সাজিয়ে রাখলে আর বল্লে, ‘বাবা, তুমি এই ঘরে দিন-রাত্তির থাক আর যখন যা ইচ্ছে হবে তখনই তা খাও।’ সেই ঘরে থাকি, বেড়াই; সেই সব খাবার দেখি, নাড়ি-চাড়ি; কখনও এটা থেকে কিছু খাই, কখনও ওটা থেকে কিছু খাই – এই রকমে তিন দিন কেটে যাবার পর সে বিপরীত ক্ষুধা ও খাইবার ইচ্ছাটা চলে গেল, তবে বাঁচি।”

যোগসাধনার ফলে ঐসকল অবস্থার উদয়, ঠাকুরের ঐরূপ ক্ষুধা-সম্বন্ধে আমরা যাহা দেখিয়াছি

যোগ বা ঈশ্বরে মনের তন্ময়ভাবে অবস্থানে অবস্থাটা সহজ হইয়া আসিবার পূর্বে এবং কখনও কখনও পরেও এইরূপ বিপরীত ক্ষুধাদির উদ্রেকের কথা সাধকদিগের জীবনে শুনিয়াছি এবং ঠাকুরের জীবনেও অনেকবার পরিচয় পাইয়া অবাক হইয়াছি। তবে ঠাকুরের সম্বন্ধে আমরা যাহা দেখিয়াছি, সেটা একটু অন্য প্রকারের অবস্থা। উপরোক্ত সময়ের মতো তখন ঠাকুর নিরন্তর ঐরূপ ক্ষুধায় পীড়িত থাকিতেন না। কিন্তু সহজাবস্থায় সচরাচর তাঁহার যেরূপ আহার ছিল তাহার চতুর্গুণ বা ততোধিক পরিমাণ খাদ্য ভাবাবস্থায় উদরস্থ করিলেন, অথচ তজ্জন্য কোনই শারীরিক অসুস্থতা হইল না – এইরূপ হইতেই দেখিয়াছি। ঐরূপ দু-একটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করিলে পাঠক উহা সহজেই বুঝিতে পারিবেন।

১ম দৃষ্টান্ত – বড় একখানি সর খাওয়া

ইতঃপূর্বে ঐ বিষয়ের আভাস আমরা পাঠককে দিয়াছি।1 পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে, স্ত্রীভক্তদিগের সহিত ঠাকুরের লীলাপ্রসঙ্গে আমরা পূর্বে একস্থলে বাগবাজারের কয়েকটি ভদ্রমহিলার ভোলা ময়রার দোকান হইতে একখানি বড় সর লইয়া দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরকে দর্শন করিতে গমনের কথা এবং তথায় তাঁহার দর্শন না পাইয়া কোনও প্রকারে শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত বা ‘মাস্টার’ মহাশয়ের বাটীতে আসিয়া ঠাকুরের দর্শনলাভ, শ্রীযুক্ত প্রাণকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের – ঠাকুর যাঁহাকে ‘মোটা বামুন’ বলিয়া নির্দেশ করিতেন – সহসা তথায় আগমন ও ঐসকল মহিলাদের ঠাকুর যে তক্তাপোষের উপর বসিয়াছিলেন তাহারই তলে লুকাইয়া থাকা প্রভৃতি কথা লিপিবদ্ধ করিয়াছি; সে রাত্রে ঠাকুর আহারাদির পর দক্ষিণেশ্বরে আগমন করিয়া পুনরায় কিরূপে ক্ষুধায় কাতর হইয়া স্ত্রীভক্তদিগের আনীত বড় সরখানির প্রায় সমস্ত খাইয়া ফেলেন, সেকথাও আমরা পাঠককে বলিয়াছি। এখন ঐরূপ আরও কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ আমরা এখানে করিব। কয়েকটি ঘটনার কথাই বলিব, কারণ ঠাকুরের জীবনে ঐরূপ ঘটনা নিত্যই ঘটিত। অতএব তদ্বিষয়ে সকল ঘটনা লিপিবদ্ধ করা অসম্ভব।


1. পূর্বার্ধ, প্রথম অধ্যায় দেখ।

২য় দৃষ্টান্ত – কামারপুকুরে এক সের মিষ্টান্ন ও মুড়ি খাওয়া

ম্যালেরিয়ার প্রথমাগমন ও প্রকোপে ‘সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা’ বঙ্গের অধিকাংশ প্রদেশ, বিশেষতঃ রাঢ়ভূমি বিধ্বস্ত ও জনশূন্য হইবার পূর্বাবধি হুগলী, বর্ধমান প্রভৃতি জেলাসকলের স্বাস্থ্য যে ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশসকলের অপেক্ষা কোন অংশে ন্যূন ছিল না, এ কথা এখনও প্রাচীনদিগের মুখে শুনিতে পাওয়া যায়। তাঁহারা বলেন, লোকে তখন বর্ধমান প্রভৃতি স্থানে বায়ুপরিবর্তনে যাইত। কামারপুকুর বর্ধমান হইতে বার-তের ক্রোশ দূরে অবস্থিত। ঐ স্থানের জলবায়ুও তখন বিশেষ স্বাস্থ্যকর ছিল। দ্বাদশ বৎসর অদৃষ্টপূর্ব কঠোর তপস্যায় এবং পরেও নিরন্তর শরীরের দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া ‘ভাবমুখ’-এ থাকায় ঠাকুরের বজ্রসম দৃঢ় শরীরও যে ক্রমে ক্রমে শারীরিক পরিশ্রমে অপটু এবং কখনও কখনও প্রবল-রোগাক্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিল, এ কথা আমরা পূর্বেই বলিয়াছি। সেজন্য ঠাকুর সাধনকালের অন্তে প্রতি বৎসর চাতুর্মাস্যের সময়টা জন্মভূমি কামারপুকুর অঞ্চলেই কাটাইয়া আসিতেন। পরম অনুগত সেবক ভাগিনেয় হৃদয় তাঁহার সঙ্গে যাইত এবং মথুরবাবু, যাওয়া-আসার সমস্ত খরচ ছাড়া পল্লীগ্রামে তাঁহার কোন বিষয়ের পাছে অভাব হয়, এজন্য সংসারের আবশ্যকীয় যত কিছু পদার্থ তাঁহার সঙ্গে পাঠাইয়া দিতেন। শুনিয়াছি লোকে নিজ কন্যাকে প্রথম শ্বশুরালয়ে পাঠাইবার কালে যেমন প্রদীপের সলতেটি এবং আহারান্তে ব্যবহার্য খড়কে-কাঠিটি পর্যন্ত সঙ্গে দিয়া থাকে, মথুরবাবু ও তাঁহার পরম ভক্তিমতী গৃহিণী শ্রীমতী জগদম্বা দাসী ঠাকুরকে কামারপুকুরে পাঠাইবার কালে অনেক সময় সেইরূপভাবে ‘ঘর বসত’ সঙ্গে দিয়া পাঠাইয়া দিতেন। কারণ এ কথা তাঁহাদের অবিদিত ছিল না যে, কামারপুকুরে ঠাকুরের সংসার যেন শিবের সংসার। সঞ্চয়ের নামগন্ধ ঠাকুরের পিতৃ-পিতামহের কাল হইতেই ছিল না। সৎপথে থাকিয়া যাহা জোটে তাহাই খাওয়া এবং ৺রঘুবীরের নামে প্রদত্ত দেড় বিঘা মাত্র জমিতে যে ধান্য হয় তাহাতেই সমস্ত বৎসর সংসার চালানো ঐ পরিবারের রীতি ছিল! পল্লীর মুদির দোকানই এ পবিত্র দেব-সংসারের ভাণ্ডার-স্বরূপ। যদি বিদায়-আদায়ে কিছু পয়সা-কড়ি পাওয়া গেল তবেই সে ভাণ্ডার হইতে সংসারের ব্যবহার্য তরি-তরকারি তৈল-লবণাদি সেদিনকার মতো বাহির হইল, নতুবা পুষ্করিণীর পাড়ের অযত্নলভ্য শাকান্নে আনন্দে জীবনধারণ। আর সর্বসময়ে সকল বিষয়ে যা করেন জীবন্ত জাগ্রত কুলদেবতা ৺রঘুবীর। ঐসকল কথা জানা ছিল বলিয়াই মথুরবাবুর কয়েক বিঘা ধান্যজমি শ্রীশ্রীরঘুবীরের নামে ক্রয় করিয়া দিবার আগ্রহ এবং ঠাকুরকে দেশে পাঠাইবার কালে সংসারের আবশ্যকীয় সকল পদার্থ ঠাকুরের সঙ্গে পাঠানো।

পূর্বেই বলিয়াছি, ঠাকুর চাতুর্মাস্যের সময় তখন কামারপুকুরে আসিতেন। প্রায় প্রতি বৎসরই আসিতেন। ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের সময় এইরূপে এক বৎসর আসিয়া জ্বররোগে বিশেষ কষ্ট পান – তদবধি আর দেশে যাইবেন না সঙ্কল্প করেন এবং আর তথায় গমনও করেন নাই। ঠাকুরের তিরোভাবের আট-দশ বৎসর পূর্বে তিনি ঐরূপ সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। যাহা হউক, এ বৎসর তিনি পূর্ব পূর্ব বারের ন্যায় কামারপুকুরে আসিয়া অবস্থান করিতেছেন। তাঁহাকে দেখিবার ও তাঁহার ধর্মালাপ শুনিবার জন্য বাটীতে প্রতিবেশী স্ত্রীপুরুষের ভিড় লাগিয়াই আছে। আনন্দের হাট-বাজার বসিয়াছে। বাটীর স্ত্রীলোকেরা তাঁহাকে পাইয়া মনের আনন্দে তাঁহার এবং তাঁহাকে দেখিতে সমাগত সকলের সেবা-পরিচর্যায় নিযুক্ত আছেন। দিনের পর দিন, সুখের দিন কোথা দিয়া যে কাটিয়া যাইতেছে তাহা কাহারও অনুভব হইতেছে না। বাটীতে তখন ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীযুক্ত রামলালদাদার পূজনীয়া মাতাঠাকুরানীই গৃহিণীস্বরূপে ছিলেন এবং তাঁহার কন্যা শ্রীমতী লক্ষ্মীদিদি ও পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী বাস করিতেছিলেন।

রাত্রি প্রায় এক প্রহর হইয়াছে। প্রতিবেশী স্ত্রীপুরুষেরা রাত্রের মতো বিদায় গ্রহণ করিয়া নিজ নিজ বাটীতে প্রস্থান করিয়াছেন। ঠাকুরের কয়েক দিন হইতে অগ্নিমান্দ্য ও পেটের অসুখ হইয়াছে, সেজন্য রাত্রে সাগু-বার্লি ভিন্ন অন্য কিছুই খান না। আজও রাত্রে দুধ-বার্লি খাইয়া শয়ন করিলেন। বাটীর স্ত্রীলোকেরা তাঁহার আহার ও শয়নের পর নিজেরা আহারাদি করিলেন এবং রাত্রিতে করণীয় সংসারের কাজ-কর্ম সারিয়া এইবার শয়নের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।

সহসা ঠাকুর তাঁহার শয়নগৃহের দ্বার খুলিয়া ভাবাবেশে টলমল করিতে করিতে বাহিরে আসিলেন এবং রামলালদাদার মাতা প্রভৃতিকে আহ্বান করিয়া বলিতে লাগিলেন – “তোমরা সব শুলে যে? আমাকে কিছু খেতে না দিয়ে শুলে যে?”

রামলালের মাতা – ওমা, সে কি গো? তুমি যে এই খেলে?

ঠাকুর – কৈ খেলুম? আমি তো এই দক্ষিণেশ্বর থেকে আসচি – কৈ খাওয়ালে?

স্ত্রীলোকেরা সকলে অবাক হইয়া পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলেন। বুঝিলেন, ঠাকুর ভাবাবেশে ঐরূপ বলিতেছেন। কিন্তু উপায়? ঘরে এখন আর এমন কোনরূপ খাদ্যদ্রব্যই নাই যাহা ঠাকুরকে খাইতে দিতে পারেন! এখন উপায়? কাজেই রামলালদাদার মাতাকে ভয়ে ভয়ে বলিতে হইল – “ঘরে এখন তো আর কিছু খাবার নেই, কেবল মুড়ি আছে। তা মুড়ি খাবে? দুটি খাও না। তাতে পেটের অসুখ করবে না।” এই বলিয়া থালে করিয়া মুড়ি আনিয়া ঠাকুরের সম্মুখে রাখিলেন। ঠাকুর তাহা দেখিয়া বালকের ন্যায় রাগ করিয়া পশ্চাৎ ফিরিয়া বসিলেন ও বলিতে লাগিলেন – “শুধু মুড়ি আমি খাব না।” অনেক বুঝানো হইল – “তোমার পেটের অসুখ, অপর কিছু তো খাওয়া চলবে না; আর দোকান-পসারও এ রাত্রে সব বন্ধ – সাগু-বার্লি যে কিনে এনে করে দেব তারও জো নেই। আজ এই দুটি খেয়ে থাক, কাল সকালে উঠেই ঝোল-ভাত রেঁধে দেব” ইত্যাদি; কিন্তু সে কথা শুনে কে? অভিমানী আবদেরে বালকের ন্যায় ঠাকুরের সেই একই কথা – “ও আমি খাব না।”

কাজেই রামলালদাদা তখন বাহিরে যাইয়া ডাকাডাকি করিয়া দোকানির ঘুম ভাঙাইলেন এবং এক সের মিঠাই কিনিয়া আনিলেন। সেই এক সের মিষ্টান্ন এবং সহজ লোকে যত খাইতে পারে তদপেক্ষা অধিক মুড়ি থালে ঢালিয়া দেওয়া হইলে তবে ঠাকুর আনন্দ করিয়া খাইতে বসিলেন এবং উহার সকলই নিঃশেষে খাইয়া ফেলিলেন। তখন বাটীর সকলের ভয় – ‘এই পেট-রোগা মানুষ, মাসের মধ্যে অর্ধেক দিন সাগু-বার্লি খেয়ে থাকা, আর এই রাত্রে এই সব খাওয়া! কাল একটা কাণ্ড হবে আর কি!’ কিন্তু কি আশ্চর্য, দেখা গেল পরদিন ঠাকুরের শরীর বেশ আছে, রাত্রে খাইবার জন্য কোনরূপ অসুস্থতাই নাই।

৩য় দৃষ্টান্ত – জয়রামবাটীতে একটি মৌরলা মাছ সহায়ে এক রেক চালের পান্তাভাত খাওয়া

আর একবার ঐরূপে কামারপুকুর অঞ্চলে বাস করিবার কালে ঠাকুরকে তাঁহার শ্বশুরালয়ে জয়রামবাটী গ্রামে লইয়া যাওয়া হয়। রাত্রের আহারাদির পর শয়ন করিবার কিছুক্ষণ পরে ঠাকুর উঠিয়া বলিলেন – “বড় ক্ষুধা পেয়েছে।” বাটীর মেয়েরা ভাবিয়া আকুল – কি খাইতে দিবে, ঘরে কিছুই নাই। কারণ সে দিন বাটীতে পূর্বপুরুষদিগের কাহারও বাৎসরিক শ্রাদ্ধ বা ঐরূপ একটা কিছু ক্রিয়াকর্ম হইয়াছিল এবং সেজন্য বাটীতে অনেক লোকের আগমন হওয়ায় সকল প্রকার খাদ্যাদিই নিঃশেষে উঠিয়া গিয়াছিল। কেবল হাঁড়িতে কতকগুলা পান্তাভাত ছিল। শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী ঠাকুরকে ভয়ে ভয়ে ঐ কথা জানাইলে ঠাকুর বলিলেন, “তাই নিয়ে এস।” তিনি বলিলেন – “কিন্তু তরকারি তো নাই।”

ঠাকুর – দেখ না খুঁজে-পেতে; তোমরা ‘মাছ চাটুই’ (ঝাল-হলুদে মাছ) করেছিলে তো? দেখ না, তার একটু আছে কি না।

শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী অনুসন্ধানে দেখিলেন, ঐ পাত্রে একটি ক্ষুদ্র মৌরলা মাছ ও একটু কাই কাই রস লাগিয়া আছে। অগত্যা তাহাই আনিলেন। দেখিয়া ঠাকুরের আনন্দ! সেই রাত্রে সেই পান্তাভাত খাইতে বসিলেন এবং ঐ একটি ক্ষুদ্র মৎস্যের সহায়ে এক রেক চালের ভাত খাইয়া শান্ত হইলেন।

৪র্থ দৃষ্টান্ত – দক্ষিণেশ্বরে রাত্রি দু-প্রহরে এক সের হালুয়া খাওয়া

দক্ষিণেশ্বরে অবস্থানকালেও মধ্যে মধ্যে ঐরূপ হইত। একদিন ঐরূপে প্রায় রাত্রি দুই প্রহরের সময় উঠিয়া ঠাকুর রামলালদাদাকে ডাকিয়া বলিলেন, “ওরে ভারি ক্ষুধা পেয়েছে, কি হবে?”

ঘরে অন্যদিন কত মিষ্টান্নাদি মজুত থাকে, সেদিন খুঁজিয়া দেখা গেল, কিছুই নাই! অগত্যা রামলালদাদা নহবতখানার নিকটে যাইয়া শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানী ও তাঁহার সহিত যে সকল স্ত্রী-ভক্ত ছিলেন, তাঁহাদের সেই সংবাদ দিলেন। তাঁহারা শশব্যস্তে উঠিয়া খড়কুটো দিয়া উনুন জ্বালিয়া একটি বড় পাথরবাটির পুরাপুরি এক বাটি, প্রায় এক সের আন্দাজ হালুয়া তৈয়ার করিয়া ঠাকুরের ঘরে পাঠাইয়া দিলেন। জনৈকা স্ত্রী-ভক্তই উহা লইয়া আসিলেন। স্ত্রী-ভক্তটি ঘরে প্রবেশ করিয়াই চমকিত হইয়া দেখিলেন ঘরের কোণে মিটমিট করিয়া প্রদীপ জ্বলিতেছে, ঠাকুর ঘরের ভিতর ভাবাবিষ্ট হইয়া পায়চারি করিতেছেন এবং ভ্রাতুষ্পুত্র রামলাল নিকটে বসিয়া আছে। সেই ধীর স্থির নীরব নিশীথে ঠাকুরের গম্ভীর ভাবোজ্জ্বল বদন, সেই উন্মাদবৎ মাতোয়ারা নগ্ন বেশ ও বিশাল নয়নে স্থির অন্তর্মুখী দৃষ্টি – যাহার সমক্ষে সমগ্র বিশ্বসংসার ইচ্ছামাত্রেই সমাধিতে লুপ্ত হইয়া আবার ইচ্ছামাত্রেই প্রকাশিত হইত – সেই অনন্যমনে গুরুগম্ভীর পাদবিক্ষেপ ও উদ্দেশ্যবিহীন সানন্দ বিচরণ দেখিয়াই স্ত্রী-ভক্তটির হৃদয় কি এক অপূর্ব ভাবে পূর্ণ হইল! তাঁহার মনে হইতে লাগিল, ঠাকুরের শরীর যেন দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বাড়িয়া কত বড় হইয়াছে। তিনি যেন এ পৃথিবীর লোক নহেন! যেন ত্রিদিবের কোন দেবতা নরশরীর পরিগ্রহ করিয়া দুঃখ-হাহাকার-পূর্ণ নরলোকে রাত্রির তিমিরাবরণে গুপ্ত লুক্কায়িত ভাবে নির্ভীক পদসঞ্চারে বিচরণ করিতেছেন এবং কেমন করিয়া এ শ্মশানভূমিকে দেবভূমিতে পরিণত করিবেন, করুণাপূর্ণ হৃদয়ে তদুপায়-নির্ধারণে অনন্যমনা হইয়া রহিয়াছেন! যে ঠাকুরকে সর্বদা দেখেন ইনি সেই ঠাকুর নহেন। তাঁহার শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল এবং নিকটে যাইতে একটা অব্যক্ত ভয় হইতে লাগিল।

ঠাকুরের বসিবার জন্য রামলাল পূর্ব হইতেই আসন পাতিয়া রাখিয়াছিলেন। স্ত্রী-ভক্তটি কোনরূপে যাইয়া সেই আসনের সম্মুখে হালুয়ার বাটিটা রাখিলেন। ঠাকুর খাইতে বসিলেন এবং ক্রমে ক্রমে ভাবের ঘোরে সে সমস্ত হালুয়াই খাইয়া ফেলিলেন। ঠাকুর কি স্ত্রী-ভক্তের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়াছিলেন? কে জানে! কিন্তু খাইতে খাইতে স্ত্রী-ভক্তটি নির্বাক হইয়া তাঁহাকে দেখিতেছেন দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন – “বল দেখি, কে খাচ্চে? আমি খাচ্চি, না আর কেউ খাচ্চে?”

স্ত্রী-ভক্ত – আমার মনে হচ্চে, আপনার ভিতরে যেন আর একজন কে রয়েছেন, তিনিই খাচ্চেন।

ঠাকুর ‘ঠিক বলেছ’ বলিয়া হাস্য করিতে লাগিলেন।

প্রবল মনোভাবে ঠাকুরের শরীর পরিবর্তিত হওয়া

এইরূপ অনেক ঘটনার উল্লেখ করা যাইতে পারে। দেখা যায়, প্রবল মানসিক ভাবতরঙ্গে ঐসকল সময়ে ঠাকুরের শরীরে এতদূর পরিবর্তন আসিয়া উপস্থিত হইত যে, তাঁহাকে তখন যেন আর এক ব্যক্তি বলিয়া বোধ হইত এবং তাঁহার চাল-চলন, আহার-বিহার, ব্যবহার প্রভৃতি সকল বিষয়ই যেন অন্য প্রকারের হইয়া যাইত। অথচ ঐরূপ বিপরীত আচরণে ভাবভঙ্গের পরেও শরীরে কোনরূপ বিকার লক্ষিত হইত না। ভিতরে অবস্থিত মনই যে আমাদের স্থূল শরীরটাকে সর্বক্ষণ ভাঙিতেছে, গড়িতেছে, নূতন করিয়া নির্মাণ করিতেছে – এ বিষয়টি আমরা জানিয়াও জানি না, শুনিয়াও বিশ্বাস করি না। কিন্তু বাস্তবিকই যে ঐরূপ হইতেছে তাহার প্রমাণ আমরা এ অদ্ভুত ঠাকুরের জীবনের এই সামান্য ঘটনাসমূহের আলোচনা হইতেও বেশ বুঝিতে পারি। কিন্তু থাক এখন ও কথা, আমরা পূর্ব কথারই অনুসরণ করি।

বৈষ্ণবচরণের আগমনে দক্ষিণেশ্বরে পণ্ডিতসভা

কেহ কেহ বলেন, ভৈরবী ব্রাহ্মণীর মুখেই বৈষ্ণবচরণের কথা মথুরবাবু প্রথম জানিতে পারেন এবং তাঁহাকে আনাইয়া ঠাকুরের আধ্যাত্মিক অবস্থাসকল শারীরিক ব্যাধিবিশেষের সহিত যে সম্মিলিত নহে, তাহা পরীক্ষা করিবার মানস করেন। যাহাই হউক, কিছুদিন পরে বৈষ্ণবচরণ নিমন্ত্রিত হইয়া দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইলেন। ঐ দিন যে একটি ছোটখাট পণ্ডিতসভার আয়োজন হইয়াছিল, তাহা আমরা অনুমান করিতে পারি। বৈষ্ণবচরণের সঙ্গে কতকগুলি ভক্ত সাধক ও পণ্ডিত নিশ্চয়ই দক্ষিণেশ্বরে আসিয়াছিলেন; তাহার উপর বিদুষী ব্রাহ্মণী ও মথুরবাবুর দলবল, সকলে ঠাকুরের জন্য একত্র সম্মিলিত; সেইজন্যই সভা বলিতেছি।

ঠাকুরের অবস্থা-সম্বন্ধে ঐ সভায় আলোচনা

এইবার ঠাকুরের অবস্থা সম্বন্ধে আলোচনা চলিল। ব্রাহ্মণী ঠাকুরের অবস্থা সম্বন্ধে যাহা লোকমুখে শুনিয়াছেন এবং যাহা স্বয়ং চক্ষে দেখিয়াছেন, সেই সমস্তের উল্লেখ করিয়া ভক্তিপথের পূর্ব পূর্ব প্রসিদ্ধ আচার্যসকলের জীবনে যে-সকল অনুভব আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ ঐসকল কথার সহিত ঠাকুরের বর্তমান অবস্থা মিলাইয়া উহা একজাতীয় অবস্থা বলিয়া নিজমত প্রকাশ করিলেন। বৈষ্ণবচরণকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “আপনি যদি এ বিষয়ে অন্যরূপ বিবেচনা করেন, তাহা হইলে ঐরূপ কেন করিতেছেন, তাহা আমাকে বুঝাইয়া দিন।” মাতা যেমন নিজ সন্তানকে রক্ষা করিতে বীরদর্পে দণ্ডায়মানা হন, ব্রাহ্মণীও যেন আজ সেইরূপ কোন দৈববলে বলশালিনী হইয়া ঠাকুরের পক্ষ সমর্থনে অগ্রসর। আর ঠাকুর – যাঁহার জন্য এত কাণ্ড হইতেছে? আমরা যেন চক্ষুর সম্মুখে দেখিতেছি, ঠাকুর বাদানুবাদে নিবিষ্ট ঐসকল লোকের ভিতর আলুথালু ভাবে বসিয়া ‘আপনাতে আপনি’ আনন্দানুভব ও হাস্য করিতেছেন, আবার কখনও বা নিকটস্থ বেটুয়াটি হইতে দুটি মৌরি বা কাবাবচিনি মুখে দিয়া তাঁহাদের কথাবার্তা এমনভাবে শুনিতেছেন, যেন ঐসকল কথা অপর কাহারও সম্বন্ধে হইতেছে! আবার কখনও বা নিজের অবস্থার বিষয়ে কোন কথা “ওগো, এই রকমটা হয়” বলিয়া বৈষ্ণবচরণের অঙ্গ স্পর্শ করিয়া তাঁহাকে বলিতেছেন।

ঠাকুরের অবস্থা-সম্বন্ধে বৈষ্ণবচরণের সিদ্ধান্ত

কেহ কেহ বলেন, বৈষ্ণবচরণ সাধনপ্রসূত সূক্ষ্মদৃষ্টিসহায়ে ঠাকুরকে দেখিবামাত্রই মহাপুরুষ বলিয়া চিনিতে পারিয়াছিলেন। কিন্তু পারুন আর নাই পারুন, এ ক্ষেত্রে সকল কথা শুনিয়া ঠাকুরের সম্বন্ধে তিনি ব্রাহ্মণীর সকল কথাই হৃদয়ের সহিত যে অনুমোদন করেন, এ কথা আমরা ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছি। শুধু তাহাই নহে – বলিয়াছিলেন যে, যে প্রধান প্রধান ঊনবিংশ প্রকার ভাব বা অবস্থার সম্মিলনকে ভক্তিশাস্ত্র ‘মহাভাব’ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন এবং যাহা কেবল একমাত্র ভাবময়ী শ্রীরাধিকা ও ভগবান শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনেই এ পর্যন্ত লক্ষিত হইয়াছে, কি আশ্চর্য, তাহার সকল লক্ষণগুলিই (ঠাকুরকে দেখাইয়া) ইঁহাতে প্রকাশিত বোধ হইতেছে! জীবের ভাগ্যক্রমে যদি কখনও জীবনে মহাভাবের আভাস উপস্থিত হয়, তবে ঐ উনিশ প্রকারের অবস্থার ভিতর বড় জোর দুই-পাঁচটা অবস্থাই প্রকাশ পায়। জীবের শরীর ঐ উনিশ প্রকার ভাবের উদ্দাম বেগ কখনই ধারণ করিতে সমর্থ হয় নাই এবং শাস্ত্র বলেন, পরেও ধারণে কখনও সমর্থ হইবে না। মথুর প্রভৃতি উপস্থিত সকলে বৈষ্ণবচরণের কথা শুনিয়া একেবারে অবাক! ঠাকুরও স্বয়ং বালকের ন্যায় বিস্ময় ও আনন্দে মথুরকে বলিলেন, “ওগো, বলে কি? যা হোক, বাপু, রোগ নয় শুনে মনটায় আনন্দ হচ্ছে।”

কর্তাভজাদি সম্প্রদায়-সম্বন্ধে ঠাকুরের মত

ঠাকুরের অবস্থা সম্বন্ধে ঐরূপ মতপ্রকাশ বৈষ্ণবচরণ যে একটা কথার কথামাত্র ভাবে করেন নাই, তাহার প্রমাণ আমরা তাঁহার অদ্য হইতে ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার আধিক্য হইতেই পাইয়া থাকি। এখন হইতে তিনি ঠাকুরের দিব্য সঙ্গসুখের জন্য প্রায়ই মধ্যে মধ্যে দক্ষিণেশ্বরে আসিতে থাকেন, নিজের গোপনীয় রহস্যসাধনসমূহের কথা ঠাকুরকে বলিয়া তাঁহার মতামত গ্রহণ করেন এবং কখনও কখনও নিজ সাধনপথের সহচর ভক্ত-সাধক সকলেও যাহাতে ঠাকুরের সহিত পরিচিত হইয়া তাঁহার ন্যায় কৃতার্থ হইতে পারেন, তজ্জন্য তাঁহাদের নিকটেও তাঁহাকে বেড়াইতে লইয়া যান। পবিত্রতার ঘনীভূত প্রতিমা-সদৃশ দেবস্বভাব ঠাকুর ইঁহাদের সহিত মিলিত হইয়া এবং ইঁহাদের জীবন ও গুপ্ত সাধনপ্রণালীসমূহ অবগত হইয়াই সাধারণ দৃষ্টিতে দূষণীয় এবং নিন্দার্হ অনুষ্ঠানসকলও যদি কেহ ‘ভগবান-লাভের জন্য করিতেছি’, ঠিক ঠিক এই ভাব হৃদয়ে ধারণ করিয়া সাধন বলিয়া অনুষ্ঠান করে, তবে ঐসকল হইতেও অধঃপাতে না গিয়া কালে ক্রমশঃ ত্যাগ ও সংযমের অধিকারী হইয়া ধর্মপথে অগ্রসর হয় ও ভগবদ্ভক্তি লাভ করে – এ বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করিবার অবসর পাইয়াছিলেন। তবে প্রথম প্রথম ঐসকল অনুষ্ঠানের কথা শুনিয়া এবং কিছু কিছু স্বচক্ষে দর্শন করিয়া ঠাকুরের মনে ‘ইঁহারা সব বড় বড় কথা বলে অথচ এমন সব হীন অনুষ্ঠান করে কেন?’ – এরূপ ভাবেরও উদয় হইয়াছিল, এ কথা আমরা তাঁহার শ্রীমুখ হইতে অনেক সময় শুনিয়াছি। কিন্তু পরিশেষে ইঁহাদের ভিতরে যাঁহারা যথার্থ সরল-বিশ্বাসী ছিলেন, তাঁহাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হইতে দেখিয়া ঠাকুরের মত-পরিবর্তনের কথাও আমরা তাঁহারই নিকট শুনিয়াছি। ঐসকল সাধনপথাবলম্বীদিগের উপর আমাদের বিদ্বেষবুদ্ধি দূর করিবার জন্য ঠাকুর তাঁহার ঐ বিষয়ক ধারণা আমাদের নিকট কখনও কখনও এইভাবে প্রকাশ করিতেন – “ওরে দ্বেষবুদ্ধি করবি কেন? জানবি ওটাও একটা পথ, তবে অশুদ্ধ পথ। বাড়িতে ঢোকবার যেমন নানা দরজা থাকে – সদর ফটক থাকে, খিড়কির দরজা থাকে, আবার বাড়ির ময়লা সাফ করবার জন্য বাড়ির ভেতর মেথর ঢোকবারও একটা দরজা থাকে – এও জানবি তেমনি একটা পথ। যে যেদিক দিয়েই ঢুকুক না কেন, বাড়ির ভিতরে ঢুকলে সকলে এক স্থানে পৌঁছায়। তা বলে কি তোদের ঐরূপ করতে হবে? না – ওদের সঙ্গে মিশতে হবে? তবে দ্বেষ করবি না।”

প্রবৃত্তিপূর্ণ মানব কিরূপ ধর্ম চায়

প্রবৃত্তিপূর্ণ মানবমন কি সহজে নিবৃত্তিপথে উপস্থিত হয়? সহজে কি সে শুদ্ধ সরলভাবে ঈশ্বরকে ডাকিতে ও তাঁহার শ্রীপাদপদ্ম লাভ করিতে অগ্রসর হয়? শুদ্ধতার ভিতরে সে কিছু কিছু অশুদ্ধতা স্বেচ্ছায় ধরিয়া রাখিতে চায়; কামকাঞ্চন ত্যাগ করিয়াও উহার একটু আধটু গন্ধ প্রিয় বোধ করে; অশেষ কষ্ট স্বীকার করিয়া শুদ্ধভাবে জগদম্বার পূজা করিতে হইবে এ কথা লিপিবদ্ধ করিবার পরেই তাঁহার সন্তোষাৰ্থ বিপরীত কামভাবসূচক সঙ্গীত গাহিবার বিধান পূজাপদ্ধতির ভিতর ঢুকাইয়া রাখে! ইহাতে বিস্মিত হইবার বা নিন্দা করিবার কিছুই নাই। তবে ইহাই বুঝা যায় যে, অনন্তকোটিব্রহ্মাণ্ড-নায়িকা মহামায়ার প্রবল প্রতাপে দুর্বল মানব কামকাঞ্চনের কি বজ্র-বন্ধনেই আবদ্ধ রহিয়াছে! বুঝা যায় যে, তিনি এ বন্ধন কৃপা করিয়া না ঘুচাইলে জীবের মুক্তিলাভ একান্ত অসাধ্য। বুঝা যায় যে, তিনি কাহাকে কোন্ পথ দিয়া মুক্তিপথে অগ্রসর করিয়া দিতেছেন তাহা মানববুদ্ধির অগম্য। আর স্পষ্ট বুঝা যায় যে, আপনার অন্তরের কথা তন্ন তন্ন করিয়া জানিয়া ধরিয়া এ অদ্ভুত ঠাকুরের জীবনরহস্য তুলনায় পাঠ করিতে বসিলে ইনি এক অপূর্ব, অমানব, পুরুষোত্তম পুরুষ স্বেচ্ছায় লীলায় বা আমাদের প্রতি করুণায় আমাদের এ হীন সংসারে কিছু কালের জন্য – বহির্দৃষ্টে দীনের দীনভাবে হইলেও জ্ঞানদৃষ্টে – রাজরাজেশ্বরের মতো বাস করিয়া গিয়াছেন।

তন্ত্রোৎপত্তির ইতিহাস ও তন্ত্রের নূতনত্ব

বৈদিক যুগের যাগযজ্ঞাদিপূর্ণ কর্মকাণ্ডে যোগের সহিত ভোগের মিলন ছিল; রূপরসাদি সকল বিষয়ের নিয়মিত ভোগ দেবতার উপাসনা করিয়া লাভ করাই মানবজীবনের উদ্দেশ্য বলিয়া নির্দিষ্ট ছিল। ঐসকলের অনুষ্ঠান করিতে করিতে মানবমন যখন অনেকটা বাসনাবর্জিত হইয়া আসিত তখনই সে উপনিষদুক্ত শুদ্ধা ভক্তির সহিত ঈশ্বরের উপাসনা করিয়া কৃতার্থ হইত। কিন্তু বৌদ্ধযুগে চেষ্টা হইল অন্য প্রকারের। অরণ্যবাসী বাসনাশূন্য সাধকদিগের শুদ্ধভাবে উপাসনা ভোগবাসনাপূর্ণ সংসারী মানবকে নির্বিশেষে শিক্ষা দিবার বন্দোবস্ত হইল। তাত্কালিক রাজ্যশাসনও বৌদ্ধ যতিদিগের ঐ চেষ্টায় সহায়তা করিতে লাগিল। ফলে দাঁড়াইল, বৈদিক যাগযজ্ঞাদির – যাহা প্রবৃত্তিমার্গে স্থিত মানবমনকে নিয়মিত ভোগাদি প্রদান করিতে করিতে ধীরে ধীরে যোগের নিবৃত্তিমার্গে উপনীত করিতেছিল, তাহার – বাহিরে উচ্ছেদ, কিন্তু ভিতরে ভিতরে নীরব নিশীথে জনশূন্য বিভীষিকাপূর্ণ শ্মশানাদি চত্বরে অনুষ্ঠেয় তন্ত্রোক্ত গুপ্ত সাধনপ্রণালীরূপে প্রকাশ। তন্ত্রে প্রকাশ, মহাযোগী মহেশ্বর বৈদিক অনুষ্ঠানসকল নির্জীব হইয়া গিয়াছে দেখিয়া উহাদিগকে পুনরায় সজীব করিয়া ভিন্নাকারে তন্ত্ররূপে প্রকাশিত করিলেন। এই প্রবাদে বাস্তবিকই মহা সত্য নিহিত রহিয়াছে। কারণ, তন্ত্রে বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের ন্যায় যোগের সহিত ভোগের সম্মিলন তো লক্ষিত হইয়াই থাকে, তদ্ভিন্ন বৈদিক কর্মকাণ্ডসমূহ যেমন উপনিষদের জ্ঞানকাণ্ড হইতে সুদূরে পৃথকভাবে অবস্থান করিতেছিল, তান্ত্রিক অনুষ্ঠানসকল তেমনভাবে না থাকিয়া প্রতি ক্রিয়াটিই অদ্বৈত জ্ঞানের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত রহিয়াছে – ইহাও পরিলক্ষিত হয়। দেখ না – তুমি কোন দেবতার পূজা করিতে বসিলে অগ্রেই কুলকুণ্ডলিনীকে মস্তকস্থ সহস্রারে উঠাইয়া ঈশ্বরের সহিত অদ্বৈতভাবে অবস্থানের চিন্তা তোমায় করিতে হইবে; পরে পুনরায় তুমি তাঁহা হইতে ভিন্ন হইয়া জীবভাব ধারণ করিলে এবং ঈশ্বরজ্যোতিঃ ঘনীভূত হইয়া তোমার পূজ্য দেবতারূপে প্রকাশিত হইলেন, এবং তুমি তাঁহাকে তোমার ভিতর হইতে বাহিরে আনিয়া পূজা করিতে বসিলে – ইহাই চিন্তা করিতে হইবে। মানবজীবনের যথার্থ উদ্দেশ্য – প্রেমে ঈশ্বরের সহিত একাকার হইয়া যাইবার কি সুন্দর চেষ্টাই না ঐ ক্রিয়ায় লক্ষিত হইয়া থাকে! অবশ্য সহস্রের ভিতর হয়তো একজন উন্নত উপাসক ঐ ক্রিয়াটি ঠিক ঠিক করিতে পারেন; কিন্তু সকলেই ঐরূপ করিবার অল্পবিস্তর চেষ্টাও তো করে, তাহাতেই যে বিশেষ লাভ – কারণ, ঐরূপ করিতে করিতেই যে তাহারা ধীরে ধীরে উন্নত হইবে। তন্ত্রের প্রতি ক্রিয়ার সহিতই এইরূপে অদ্বৈত জ্ঞানের ভাব সম্মিলিত থাকিয়া সাধককে চরম লক্ষ্যের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। ইহাই তন্ত্রোক্ত সাধনপ্রণালীর বৈদিক ক্রিয়াকলাপ হইতে নূতনত্ব এবং এইজন্যই তন্ত্রোক্ত সাধনপ্রণালীর ভারতের জনসাধারণের মনে এতদূর প্রভুত্ব-বিস্তার।

তন্ত্রে বীরাচারের প্রবেশেতিহাস

তন্ত্রের আর এক নূতনত্ব – জগৎকারণ মহামায়ার মাতৃত্বভাবের প্রচার এবং সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় স্ত্রী-মূর্তির উপর একটা শুদ্ধ পবিত্র ভাব আনয়ন। বেদ পুরাণ ঘাঁটিয়া দেখ, এ ভাবটি আর কোথাও নাই। উহা তন্ত্রের একেবারে নিজস্ব। বেদের সংহিতাভাগে স্ত্রী-শরীরের উপাসনার একটু আধটু বীজমাত্রই দেখিতে পাওয়া যায়। যথা, বিবাহকালে কন্যার ইন্দ্রিয়কে ‘প্রজাপতের্দ্বিতীয়ং মুখং’ বা সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি করিবার দ্বিতীয় মুখ বলিয়া নির্দেশ করিয়া উহা যাহাতে সুন্দর তেজস্বী গর্ভ ধারণ করে এজন্য ‘গর্ভং ধেহি সিনীবালি’ ইত্যাদি মন্ত্রে উহাতে দেবতাসকলের উপাসনার এবং ঐ ইন্দ্রিয়কে পবিত্রভাবে দেখিবার বিশেষ বিধান আছে। কিন্তু তাহা বলিয়া কেহ যেন না মনে করেন, বৈদিক সময় হইতেই যোনিলিঙ্গের উপাসনা ভারতে প্রচলিত ছিল। বাবিল-নিবাসী সুমের জাতি এবং তচ্ছাখা দ্রাবিড় জাতির মধ্যেই স্থূলভাবে ঐ উপাসনা যে প্রথম প্রচলিত ছিল, ইতিহাস তাহা প্রমাণিত করিয়াছে। ভারতীয় তন্ত্র বেদের কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ডের ভাব যেমন আপন শরীরে প্রত্যেক অনুষ্ঠানের সহিত একত্র সম্মিলিত করিয়াছিল, তেমনি আবার অধিকারী-বিশেষের আধ্যাত্মিক উন্নতি ঐ উপাসনার ভিতর দিয়াই সহজে হইবে দেখিয়া দ্রাবিড় জাতির ভিতরে নিবদ্ধ স্ত্রী-শরীরে উপাসনাটির স্থূলভাব অনেকটা উল্টাইয়া দিয়া উহার সহিত পূর্বোক্ত বৈদিক যুগের উপাসনার উচ্চ আধ্যাত্মিক ভাবটি সম্মিলিত করিয়া পূর্ণ বিকশিত করিল; এবং ঐরূপে উহাও নিজাঙ্গে মিলিত করিয়া লইল। তন্ত্রে বীরাচারের উৎপত্তি এইভাবেই হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয়। তন্ত্রকার কুলাচার্যগণ ঠিকই বুঝিয়াছিলেন প্রবৃত্তিপূর্ণ মানব স্থূল রূপরসাদির অল্পবিস্তর ভোগ করিবেই করিবে; কিন্তু যদি কোনরূপে তাহার প্রিয় ভোগ্যবস্তুর উপর ঠিক ঠিক আন্তরিক শ্রদ্ধার উদয় করিয়া দিতে পারেন, তবে সে কত ভোগ করিবে করুক না – ঐ তীব্র শ্রদ্ধাবলে স্বল্পকালেই সংযমাদি আধ্যাত্মিক ভাবের অধিকারী হইয়া দাঁড়াইবে, নিশ্চয়। সেজন্যই তাঁহারা প্রচার করিলেন – নারীশরীর পবিত্র তীর্থস্বরূপ, নারীতে মনুষ্যবুদ্ধি ত্যাগ করিয়া দেবীবুদ্ধি সর্বদা রাখিবে এবং জগদম্বার বিশেষ শক্তিপ্রকাশ ভাবনা করিয়া সর্বদা স্ত্রী-মূর্তিতে ভক্তি-শ্রদ্ধা করিবে; নারীর পাদোদক ভক্তিপরায়ণ হইয়া পান করিবে এবং ভ্রমেও কখনও নারীর নিন্দা বা নারীকে প্রহার করিবে না। যথা –

যস্যাঃ অঙ্গে মহেশানি সর্বতীর্থানি সন্তি বৈ।
– পুরশ্চরণোল্লাসতন্ত্র, ১৪ পটল

শক্তৌ মনুষ্যবুদ্ধিস্তু যঃ করোতি বরাননে।
ন তস্য মন্ত্রসিদ্ধিঃ স্যাদ্বিপরীতং ফলং লভেৎ॥
– উত্তরতন্ত্র, ২য় পটল

শক্ত্যা পাদোদকং যস্তু পিবেদ্ভক্তিপরায়ণঃ।
উচ্ছিষ্টং বাপি ভুঞ্জীত তস্য সিদ্ধিরখণ্ডিতা॥
– নিগমকল্পদ্রুম

স্ত্রিয়ো দেবাঃ স্ত্রিয়ঃ পুণ্যাঃ স্ত্রিয় এব বিভূষণম্।
স্ত্রীদ্বেষো নৈব কর্তব্যস্তাসু নিন্দাং প্রহারকম্॥
– মুণ্ডমালাতন্ত্র, ৫ম পটল

প্রত্যেক তন্ত্রে উত্তম ও অধম দুই বিভাগ আছে

কিন্তু হইলে কি হইবে? কালে তান্ত্রিক সাধকদিগের ভিতরেও এমন একটা যুগ আসিয়াছিল যখন ঈশ্বরীয় জ্ঞানলাভ ছাড়িয়া তাঁহারা সামান্য সামান্য মানসিক শক্তি বা সিদ্ধাইসকল-লাভেই মনোনিবেশ করিয়াছিলেন। ঐ সময়েই নানা প্রকার অস্বাভাবিক সাধনপ্রণালী ও ভূতপ্রেতাদির উপাসনা তন্ত্রশরীরে প্রবিষ্ট হইয়া উহাকে বর্তমান আকার ধারণ করাইয়াছিল। প্রতি তন্ত্রের ভিতরেই সেজন্য উত্তম ও অধম, উচ্চ ও হীন – এই দুই স্তরের বিদ্যমানতা দেখিতে পাওয়া যায়। এবং উচ্চাঙ্গের ঈশ্বরোপাসনার সহিত হীনাঙ্গের সাধনসকলও সন্নিবেশিত দেখা যায়। আর যাহার যেমন প্রকৃতি, সে এখন উহার ভিতর হইতে সেই মতটি বাছিয়া লয়।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব-সম্প্রদায়-প্রবর্তিত নূতন পূজা-প্রণালী

মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের প্রাদুর্ভাবে আবার একটি নূতন পরিবর্তন তন্ত্রোক্ত সাধনপ্রণালীতে আসিয়া উপস্থিত হয়। তিনি ও তৎপরবর্তী বৈষ্ণবাচার্যগণ সাধারণের দ্বৈতভাবের বিস্তারেই মঙ্গল ধারণা করিয়া তান্ত্রিক সাধনপ্রণালীর ভিতর হইতে অদ্বৈতভাবের ক্রিয়াগুলি অনেকাংশে বাদ দিয়া কেবল তন্ত্রোক্ত মন্ত্রশাস্ত্র ও বাহ্যিক উপাসনাটি জনসাধারণে প্রচলিত করিলেন। ঐ উপাসনা ও পূজাদিতেও তাঁহারা নবীন ভাব প্রকাশ করাইয়া আত্মবৎ দেবতার সেবা করিবার উপদেশ দিলেন। তান্ত্রিক দেবতাকুল নিবেদিত ফলমূল আহার্যাদি দৃষ্টিমাত্রেই সাধকের নিমিত্ত পূত করিয়া দেন এবং উহা গ্রহণে সাধকের কামক্রোধাদি পশুভাবের বৃদ্ধি না হইয়া আধ্যাত্মিক ভাবই বৃদ্ধি পাইয়া থাকে – ইহাই সাধারণ বিশ্বাস। বৈষ্ণবাচার্যগণের নব-প্রবর্তিত প্রণালীতে দেবতাগণ ঐসকল আহার্যের সূক্ষ্মাংশ এবং সাধকের ভক্তির আতিশয্য ও আগ্রহনির্বন্ধে কখনও কখনও স্থূলাংশও গ্রহণ করিয়া থাকেন – এইরূপ বিশ্বাস প্রচলিত হইল। উপাসনা-প্রণালীতে এইরূপে আরও অনেক পরিবর্তন বৈষ্ণবাচার্যগণ কর্তৃক সংসাধিত হয়, তন্মধ্যে প্রধান এইটিই বলিয়া বোধ হয় যে, তাঁহারা যতদূর সম্ভব তন্ত্রোক্ত পশুভাবেরই প্রাধান্য স্থাপন করিয়া বাহ্যিক শৌচাচারের পক্ষপাতী হইয়াছিলেন এবং আহারে শৌচ, বিহারে শৌচ, সকল বিষয়ে শুচিশুদ্ধ থাকিয়া ‘জপাৎ সিদ্ধির্জপাৎ সিদ্ধির্জপাৎ সিদ্ধির্নসংশয়ঃ’ – নামই ব্রহ্ম এই জ্ঞানে কেবলমাত্র শ্রীভগবানের নাম-জপ দ্বারাই জীব সিদ্ধকাম হইবে, এই মত সাধারণে প্রচার করিয়াছিলেন।

ঐ প্রণালী হইতে কালে কর্তাভজাদি মতের উৎপত্তি ও সে সকলের সার কথা

কিন্তু তাঁহারা ঐরূপ করিলে কি হইবে? তাঁহাদের তিরোভাবের স্বল্পকাল পরেই প্রবৃত্তিপূর্ণ মানবমন তাঁহাদের প্রবর্তিত শুদ্ধমার্গেও কলুষিত ভাবসকল প্রবেশ করাইয়া ফেলিল। সূক্ষ্ম ভাবটুকু ছাড়িয়া স্থূল বিষয় গ্রহণ করিয়া বসিল – পরকীয়া নায়িকার উপপতির প্রতি আন্তরিক টানটুকু গ্রহণ করিয়া ঈশ্বরে উহার আরোপ না করিয়া পরকীয়া স্ত্রীই গ্রহণ করিয়া বসিল এবং এইরূপে তাঁহাদের প্রবর্তিত শুদ্ধযোগমার্গের ভিতরেও কিছু কিছু ভোগ প্রবেশ করাইয়া উহাকে কতকটা নিজের প্রবৃত্তির মতো করিয়া লইল। ঐরূপ না করিয়াই বা সে করে কি? সে যে অত শুদ্ধভাবে চলিতে অক্ষম। সে যে যোগ ও ভোগের মিশ্রিত ভাবই গ্রহণ করিতে পারে। সে যে ধর্মলাভ চায়; কিন্তু তৎসঙ্গে একটু আধটু রূপরসাদি-ভোগেরও লালসা রাখে। সেইজন্যই বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ভিতর কর্তাভজা, আউল, বাউল, দরবেশ, সাঁই প্রভৃতি মতের উপাসনা ও গুপ্ত সাধনপ্রণালীসকলের উৎপত্তি। অতএব ঐসকলের মূলে দেখিতে পাওয়া যায় সেই বহু প্রাচীন বৈদিক কর্মকাণ্ডের প্রবাহ, সেই যোগ ও ভোগের সম্মিলন; আর দেখিতে পাওয়া যায় সেই তান্ত্রিক কুলাচার্যগণের প্রবর্তিত অদ্বৈতজ্ঞানের সহিত প্রতি ক্রিয়ার সম্মিলনের কিছু কিছু ভাব।

কর্তাভজাদি মতে সাধ্য ও সাধনবিধি-সম্বন্ধে উপদেশ

কর্তাভজা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের ঈশ্বর, মুক্তি, সংযম, ত্যাগ, প্রেম প্রভৃতি বিষয়ক কয়েকটি কথার এখানে উল্লেখ করিলেই পাঠক আমাদের পূর্বোক্ত কথা সহজে বুঝিতে পারিবেন। ঠাকুর ঐসকল সম্প্রদায়ের কথা বলিতে বলিতে অনেক সময় এগুলি আমাদের বলিতেন। সরল ভাষায় ও ছন্দোবদ্ধে লিপিবদ্ধ হইয়া উহারা অশিক্ষিত জনসাধারণের ঐসকল বিষয় বুঝিবার কতদূর সহায়তা করে, তাহা পাঠক ঐসকল শ্রবণ করিলেই বুঝিতে পারিবেন। ঐসকল সম্প্রদায়ের লোকে ঈশ্বরকে ‘আলেকলতা’ বলিয়া নির্দেশ করেন। বলা বাহুল্য, সংস্কৃত ‘অলক্ষ্য’ কথাটি হইতেই ‘আলেক্’ কথাটির উৎপত্তি। ঐ ‘আলেক্’ শুদ্ধসত্ত্ব মানবমনে প্রবিষ্ট বা তদবলম্বনে প্রকাশিত হইয়া ‘কর্তা’ বা ‘গুরু’রূপে আবির্ভূত হন। ঐরূপ মানবকে ইঁহারা ‘সহজ’ উপাধি দিয়া থাকেন। যথার্থ গুরুভাবে ভাবিত মানবই এ সম্প্রদায়ের উপাস্য বলিয়া নির্দিষ্ট হওয়ায় উহার নাম ‘কর্তাভজা’ হইয়াছে। ‘আলেকলতার’ স্বরূপ ও বিশুদ্ধ মানবে আবেশ সম্বন্ধে ইঁহারা এইরূপ বলেন –

আলেকে আসে, আলেকে যায়,
আলেকের দেখা কেউ না পায়।
আলেককে চিনিছে যেই,
তিন লোকের ঠাকুর সেই।

‘সহজ’ মানুষের লক্ষণ – তিনি ‘অটুট’ হইয়া থাকেন অর্থাৎ রমণীর সঙ্গে সর্বদা থাকিলেও তাঁহার কখনো কামভাবে ধৈর্যচ্যুতি হয় না।

এই সম্বন্ধে ইঁহারা বলেন –

রমণীর সঙ্গে থাকে, না করে রমণ।

সংসারে কামকাঞ্চনের ভিতর অনাসক্তভাবে না থাকিলে সাধক আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করিতে পারে না, সেজন্য সাধকদিগের প্রতি উপদেশ –

রাঁধুনি হইবি, ব্যঞ্জন বাঁটিবি, হাঁড়ি না ছুঁইবি তায়।
সাপের মুখেতে ভেকেরে নাচাবি, সাপ না গিলিবে তায়।
অমিয়-সাগরে সিনান করিবি, কেশ না ভিজিবে তায়।

তন্ত্রের ভিতর সাধকদিগের যেমন পশু, বীর ও দিব্যভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা আছে, ইঁহাদের ভিতরেও তেমনি সাধকদিগের উচ্চাবচ শ্রেণীর কথা আছে –

‘আউল, বাউল, দরবেশ, সাঁই –
সাঁইয়ের পর আর নাই।’

অর্থাৎ সিদ্ধ হইলে তবে মানব সাঁই হইয়া থাকে।

ঠাকুর বলিতেন, “ইঁহারা সকলে ঈশ্বরের ‘অরূপ রূপ’-এর ভজন করেন” এবং ঐ সম্প্রদায়ের কয়েকটি গানও আমাদের নিকট অনেক সময় গাহিতেন। যথা –

বাউলের সুর।
ডুব্ ডুব্ ডুব্ রূপসাগরে আমার মন।
তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবিরে প্রেমরত্নধন॥
(ওরে) খোঁজ্ খোঁজ্ খোঁজ্ খুঁজলে পাবি, হৃদয়মাঝে বৃন্দাবন।
(আবার) দীপ্ দীপ্ দীপ্ জ্ঞানের বাতি হৃদে জ্বলবে অনুক্ষণ॥
ড্যাং ড্যাং ড্যাং ডাঙ্গায় ডিঙ্গি, চালায় আবার সে কোন্ জন?
কুবীর বলে শোন্ শোন্ শোন্ ভাব গুরুর শ্রীচরণ॥

এইরূপে গুরুর উপাসনা ও সকলে একত্রিত হইয়া ভজনাদিতে নিবিষ্ট থাকা – ইহাই তাঁহাদের প্রধান সাধন। ইঁহারা দেবদেবীর মূর্ত্যাদি অস্বীকার না করিলেও উপাসনা বড় একটা করেন না। ভারতে গুরু বা আচার্যের উপাসনা অতীব প্রাচীন; উপনিষদের কাল হইতেই প্রবর্তিত বলিয়া বোধ হয়। কারণ উপনিষদেই রহিয়াছে “আচার্যদেবো ভব”। তখন দেবদেবীর উপাসনা আদৌ প্রচলিত হয় নাই বলিয়াই বোধ হয়। সেই আচার্যোপাসনা কালে ভারতে কতরূপ মূর্তি ধারণ করিয়াছে দেখিয়া আশ্চর্য হইতে হয়।

এতদ্ভিন্ন শুচি-অশুচি, ভাল-মন্দ প্রভৃতি ভেদজ্ঞান মন হইতে ত্যাগ করিবার জন্য নানা প্রকারের অনুষ্ঠানও সাধককে করিতে হয়। ঠাকুর বলিতেন, সেসকল সাধকেরা গুরুপরম্পরায় অবগত হইয়া থাকেন। ঠাকুর তাহারও কিছু কিছু কখনও কখনও উল্লেখ করিতেন।

বৈষ্ণবচরণের ঠাকুরকে কাছিবাগানের আখড়ায় লইয়া যাওয়া ও পরীক্ষা

ঠাকুরকে অনেক সময় বলিতে শুনা যাইত, ‘বেদ পুরাণ কানে শুনতে হয়; আর তন্ত্রের সাধনসকল কাজে করতে হয়, হাতে হাতে করতে হয়।’ দেখিতেও পাওয়া যায়, ভারতের প্রায় সর্বত্রই স্মৃতির অনুগামী সকলে কোন না কোনরূপ তান্ত্রিকী সাধনপ্রণালীর অনুসরণ করিয়া থাকেন। দেখিতে পাওয়া যায়, বড় বড় ন্যায়-বেদান্তের পণ্ডিতসকল অনুষ্ঠানে তান্ত্রিক। বৈষ্ণবসম্প্রদায়-সকলের ভিতরেও সেইরূপ অনেক স্থলে দেখিতে পাওয়া যায়, বড় বড় ভাগবতাদি ভক্তিশাস্ত্রের পণ্ডিতগণ কর্তাভজাদি সম্প্রদায়সকলের গুপ্ত সাধনপ্রণালী অনুসরণ করিতেছেন। পণ্ডিত বৈষ্ণবচরণও এই দলভুক্ত ছিলেন। কলিকাতার কয়েক মাইল উত্তরে কাছিবাগানে ঐ সম্প্রদায়ের আখড়ার সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। ঐ সম্প্রদায়ভুক্ত অনেকগুলি স্ত্রীপুরুষ ঐ স্থলে থাকিয়া তাঁহার উপদেশমত সাধনাদিতে রত থাকিতেন। ঠাকুরকে বৈষ্ণবচরণ এখানে কয়েকবার লইয়া গিয়াছিলেন। শুনিয়াছি, এখানকার কতকগুলি স্ত্রীলোক ঠাকুরকে সদাসর্বক্ষণ সম্পূর্ণ নির্বিকার থাকিতে দেখিয়া এবং ভগবৎ-প্রেমে তাঁহার অদৃষ্টপূর্ব ভাবাদি হইতে দেখিয়া তিনি সম্পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়জয়ে সমর্থ হইয়াছেন কিনা জানিবার জন্য পরীক্ষা করিতে অগ্রসর হইয়াছিলেন এবং তাঁহাকে ‘অটুট সহজ’ বলিয়া সম্মান প্রদর্শন করিয়াছিলেন। অবশ্য বালকস্বভাব ঠাকুর বৈষ্ণবচরণের সঙ্গে ও অনুরোধে তথায় সরলভাবেই বেড়াইতে গিয়াছিলেন। উহারা যে তাঁহাকে ঐরূপে পরীক্ষা করিবে, তিনি তাহার কিছুই জানিতেন না। যাহাই হউক, তদবধি তিনি আর ঐ স্থানে গমন করেন নাই।

বৈষ্ণবচরণের ঠাকুরকে ঈশ্বরাবতার-জ্ঞান

ঠাকুরের অদ্ভুত চরিত্রবল, পবিত্রতা ও ভাবসমাধি দেখিয়া তাঁহার উপর বৈষ্ণবচরণের ভক্তিবিশ্বাস দিন দিন এতদূর বাড়িয়া গিয়াছিল যে, পরিশেষে তিনি ঠাকুরকে সকলের সমক্ষে ঈশ্বরাবতার বলিয়া স্বীকার করিতেও কুণ্ঠিত হইতেন না।

তান্ত্রিক গৌরী পণ্ডিতের সিদ্ধাই

বৈষ্ণবচরণ ঠাকুরের নিকট কিছুদিন যাতায়াত করিতে না করিতেই ইঁদেশের গৌরী পণ্ডিত দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গৌরী পণ্ডিত একজন বিশিষ্ট তান্ত্রিক সাধক ছিলেন। দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে তিনি পৌঁছিবামাত্র তাঁহাকে লইয়া একটি মজার ঘটনা ঘটে। ঠাকুরের নিকটেই আমরা উহা শুনিয়াছি। ঠাকুর বলিতেন, গৌরীর একটি সিদ্ধাই বা তপস্যালব্ধ ক্ষমতা ছিল। শাস্ত্রীয় তর্কবিচারে আহূত হইয়া যেখানে তিনি যাইতেন, সেই বাটীতে প্রবেশকালে এবং যেখানে বিচার হইবে সেই সভাস্থলে প্রবেশকালে তিনি উচ্চরবে কয়েকবার ‘হা রে রে রে, নিরালম্বো লম্বোদরজননী কং যামি শরণম্’ – এই কথাগুলি উচ্চারণ করিয়া তবে সে বাটীতে ও সভাস্থলে প্রবেশ করিতেন। ঠাকুর বলিতেন, জলদগম্ভীরস্বরে বীরভাবদ্যোতক ‘হা রে রে রে’ শব্দ এবং আচার্যকৃত দেবীস্তোত্রের ঐ এক পাদ তাঁহার মুখ হইতে শুনিলে সকলের হৃদয় কি একটা অব্যক্ত ত্রাসে চমকিত হইয়া উঠিত! উহাতে দুইটি কার্য সিদ্ধ হইত। প্রথম, ঐ শব্দে গৌরীর ভিতরের শক্তি সম্যক জাগরিতা হইয়া উঠিত; এবং দ্বিতীয়, তিনি উহার দ্বারা শত্রুপক্ষকে চমকিত ও মুগ্ধ করিয়া তাহাদের বলহরণ করিতেন। ঐরূপ শব্দ করিয়া এবং কুস্তিগীর পালোয়ানেরা যেরূপে বাহুতে তাল ঠোকে সেইরূপ তাল ঠুকিতে ঠুকিতে গৌরী সভামধ্যে প্রবেশ করিতেন ও বাদশাহী দরবারে সভ্যেরা যেভাবে উপবেশন করিত, পদদ্বয় মুড়িয়া তাহার উপর সেইভাবে সভাস্থলে বসিয়া তিনি তর্কসংগ্রামে প্রবৃত্ত হইতেন। ঠাকুর বলিতেন, তখন গৌরীকে পরাজয় করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত হইত না।

গৌরীর ঐ সিদ্ধাইয়ের কথা ঠাকুর জানিতেন না। কিন্তু দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে পদার্পণ করিয়া যেমন গৌরী উচ্চরবে ‘হা রে রে রে’ শব্দ করিলেন, অমনি ঠাকুরের ভিতরে কে যেন ঠেলিয়া উঠিয়া তাঁহাকে গৌরীর অপেক্ষা উচ্চরবে ঐ শব্দ করাইতে লাগিল। ঠাকুরের মুখনিঃসৃত ঐ শব্দে গৌরী উচ্চতর রবে ঐ শব্দ করিতে লাগিলেন। ঠাকুর তাহাতে উত্তেজিত হইয়া তদপেক্ষা অধিকতর উচ্চরবে ‘হা রে রে রে’ করিয়া উঠিলেন। ঠাকুর হাসিতে হাসিতে বলিতেন, বারংবার সেই দুই পক্ষের ‘হা রে রে রে’ রবে যেন ডাকাত-পড়ার মতো এক ভীষণ আওয়াজ উঠিল। কালীবাটীর দারোয়ানেরা যে যেখানে ছিল শশব্যস্তে লাঠি-সোটা লইয়া তদভিমুখে ছুটিল। অন্য সকলে ভয়ে অস্থির। যাহা হউক, গৌরী এক্ষেত্রে ঠাকুরের অপেক্ষা উচ্চতর রবে আর ঐ সকল কথা উচ্চারণ করিতে না পারিয়া শান্ত হইলেন এবং একটু যেন বিষণ্ণভাবে ধীরে ধীরে কালীবাটীতে প্রবেশ করিলেন। অপর সকলেও ঠাকুর এবং নবাগত পণ্ডিতজীই ঐরূপ করিতেছিলেন জানিতে পারিয়া হাসিতে হাসিতে যে যাহার স্থানে চলিয়া গেল। ঠাকুর বলিতেন, “তারপর মা জানিয়ে দিলেন, গৌরী যে শক্তি বা সিদ্ধাইয়ে লোকের বলহরণ করে নিজে অজেয় থাকত, সেই শক্তির এখানে ঐরূপে পরাজয় হওয়াতে তার ঐ সিদ্ধাই থাকল না! মা তার কল্যাণের জন্য তার শক্তিটা (নিজেকে দেখাইয়া) এর ভিতর টেনে নিলেন।” বাস্তবিক দেখা গিয়াছিল, গৌরী দিন দিন ঠাকুরের ভাবে মোহিত হইয়া তাঁহার সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন।

গৌরীর আপন পত্নীকে দেবীবুদ্ধিতে পূজা

পূর্বেই বলিয়াছি, গৌরী পণ্ডিত তান্ত্রিক সাধক ছিলেন। ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছি, গৌরী প্রতি বৎসর ৺দুর্গাপূজার সময় জগদম্বার পূজার যথাযথ সমস্ত আয়োজন করিতেন এবং বসনালঙ্কারে ভূষিতা করিয়া আলপনা দেওয়া পীঠে বসাইয়া নিজের গৃহিণীকেই শ্রীশ্রীজগদম্বা জ্ঞানে তিন দিন ভক্তিভাবে পূজা করিতেন। তন্ত্রের শিক্ষা – যত স্ত্রী-মূর্তি, সকলই সাক্ষাৎ জগদম্বার মূর্তি – সকলের মধ্যেই জগন্মাতার জগৎপালিনী ও আনন্দদায়িনী শক্তির বিশেষ প্রকাশ। সেইজন্য স্ত্রী-মূর্তিমাত্রকেই মানবের পবিত্রভাবে পূজা করা উচিত। স্ত্রী-মূর্তির অন্তরালে শ্রীশ্রীজগন্মাতা স্বয়ং রহিয়াছেন, একথা স্মরণ না রাখিয়া ভোগ্যবস্তুমাত্র বলিয়া সকামভাবে স্ত্রী-শরীর দেখিলে উহাতে শ্রীশ্রীজগন্মাতারই অবমাননা করা হয় এবং উহাতে মানবের অশেষ অকল্যাণ আসিয়া উপস্থিত হয়। চণ্ডীতে দেবতাগণ দেবীকে স্তব করিতে করিতে ঐ কথা বলিতেছেন –

বিদ্যাঃ সমস্তাস্তব দেবি ভেদাঃ,
স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু।
ত্বয়ৈকয়া পূরিতমম্বয়ৈতৎ
কা তে স্তুতিঃ স্তব্যপরাপরোক্তিঃ॥

– হে দেবি! তুমিই জ্ঞানরূপিণী; জগতে উচ্চাবচ যত প্রকার বিদ্যা আছে – যাহা হইতে লোকের অশেষ প্রকার জ্ঞানের উদয় হইতেছে – সে সকল তুমিই, তত্তদ্রূপে প্রকাশিতা। তুমিই স্বয়ং জগতের যাবতীয় স্ত্রী-মূর্তিরূপে বিদ্যমানা। তুমিই একাকিনী সমগ্র জগৎ পূর্ণ করিয়া উহার সর্বত্র বর্তমান। তুমি অতুলনীয়া, বাক্যাতীতা – স্তব করিয়া তোমার অনন্ত গুণের উল্লেখ করিতে কে কবে পারিয়াছে বা পারিবে!

ভারতের সর্বত্র আমরা নিত্যই ঐ স্তব অনেকে পাঠ করিয়া থাকি। কিন্তু হায়! কয়জন কতক্ষণ দেবীবুদ্ধিতে স্ত্রী-শরীর অবলোকন করিয়া ঐরূপ যথাযথ সম্মান দিয়া বিশুদ্ধ আনন্দ হৃদয়ে অনুভব করিয়া কৃতার্থ হইতে উদ্যম করিয়া থাকি? শ্রীশ্রীজগন্মাতার বিশেষ-প্রকাশের আধারস্বরূপিণী স্ত্রী-মূর্তিকে হীন বুদ্ধিতে কলুষিত নয়নে দেখিয়া কে না দিনের ভিতর শতবার সহস্রবার তাঁহার অবমাননা করিয়া থাকে? হায় ভারত, ঐরূপ পশুবুদ্ধিতে স্ত্রী-শরীরের অবমাননা করিয়াই এবং শিবজ্ঞানে জীবসেবা করিতে ভুলিয়াই তোমার বর্তমান দুর্দশা। কবে জগদম্বা আবার কৃপা করিয়া তোমার এ পশুবুদ্ধি দূর করিবেন, তাহা তিনিই জানেন!

গৌরীর অদ্ভুত হোমপ্রণালী

গৌরী পণ্ডিতের আর একটি অদ্ভুত শক্তির কথা আমরা ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছিলাম। বিশিষ্ট তান্ত্রিক সাধকেরা জগন্মাতার নিত্যপূজান্তে হোম করিয়া থাকেন। গৌরীও সকল দিন না হউক, অনেক সময় হোম করিতেন। কিন্তু তাঁহার হোমের প্রণালী অতি অদ্ভুত ছিল। অপর সাধারণে যেমন জমির উপর মৃত্তিকা বা বালুকা দ্বারা বেদি রচনা করিয়া তদুপরি কাষ্ঠ সাজাইয়া অগ্নি প্রজ্বলিত করেন এবং আহুতি দিয়া থাকেন, তিনি সেরূপ করিতেন না। তিনি স্বীয় বামহস্ত শূন্যে প্রসারিত করিয়া হস্তের উপরেই এককালে এক মন কাঠ সাজাইতেন এবং অগ্নি প্রজ্বলিত করিয়া ঐ অগ্নিতে দক্ষিণ হস্ত দ্বারা আহুতি প্রদান করিতেন! হোম করিতে কিছু অল্প সময় লাগে না, ততক্ষণ হস্ত শূন্যে প্রসারিত রাখিয়া ঐ এক মন কাষ্ঠের গুরুভার ধারণ করিয়া থাকা এবং তদুপরি হস্তে অগ্নির উত্তাপ সহ্য করিয়া মন স্থির রাখা ও যথাযথভাবে ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে আহুতি প্রদান করা – আমাদের নিকটে একেবারে অসম্ভব বলিয়াই বোধ হয়। সেজন্য আমাদের অনেকে ঠাকুরের মুখে শুনিয়াও ঐ কথা সহসা বিশ্বাস করিতে পারিতেন না। ঠাকুর তাহাতে তাঁহাদের মনোভাব বুঝিয়া বলিতেন, “আমি নিজের চক্ষে তাকে ঐরূপ করতে দেখেছি রে! ওটাই তার একটা সিদ্ধাই ছিল।”

বৈষ্ণবচরণ ও গৌরীকে লইয়া দক্ষিণেশ্বরে সভা; ভাবাবেশে ঠাকুরের বৈষ্ণবচরণের স্কন্ধারোহণ ও তাঁহার স্তব

গৌরীর দক্ষিণেশ্বরে আগমনের কয়েকদিন পরেই মথুরবাবু বৈষ্ণবচরণ প্রমুখ কয়েকজন সাধক পণ্ডিতদের আহ্বান করিয়া একটি সভার অধিবেশন করিলেন। উদ্দেশ্য, পূর্বের ন্যায় ঠাকুরের আধ্যাত্মিক অবস্থার বিষয় শাস্ত্রীয় প্রমাণ প্রয়োগে নবাগত পণ্ডিতজীর সহিত আলোচনা ও নির্ধারণ করা। প্রাতেই সভা আহূত হয়। স্থান – শ্রীশ্রীকালীমাতার মন্দিরের সম্মুখে নাটমন্দির। বৈষ্ণবচরণের কলিকাতা হইতে আসিতে বিলম্ব হইতেছে দেখিয়া ঠাকুর গৌরীকে সঙ্গে করিয়া অগ্রেই সভাস্থলে চলিলেন, এবং সভাপ্রবেশের পূর্বেই শ্রীশ্রীজগন্মাতা কালিকার মন্দিরে প্রবেশ করিয়া ভক্তিভরে তাঁহার শ্রীমূর্তিদর্শন ও শ্রীচরণবন্দনাদি করিয়া ভাবে টলমল করিতে করিতে যেমন মন্দিরের বাহিরে আসিলেন, অমনি দেখিলেন সম্মুখে বৈষ্ণবচরণ তাঁহার পদপ্রান্তে প্রণত হইতেছেন। দেখিয়াই ঠাকুর ভাবে প্রেমে সমাধিস্থ হইয়া বৈষ্ণবচরণের স্কন্ধদেশে বসিয়া পড়িলেন এবং বৈষ্ণবচরণ উহাতে আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করিয়া আনন্দে উল্লসিত হইয়া তদ্দণ্ডেই রচনা করিয়া সংস্কৃত ভাষায় ঠাকুরের স্তব করিতে লাগিলেন। ঠাকুরের সেই সমাধিস্থ প্রসন্নোজ্জ্বল মূর্তি এবং বৈষ্ণবচরণের তদ্রূপে আনন্দোচ্ছ্বসিত হৃদয়ে সুললিত স্তবপাঠ দেখিয়া শুনিয়া মথুরপ্রমুখ উপস্থিত সকলে স্থিরনেত্রে ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে চতুষ্পার্শ্বে দণ্ডায়মান হইয়া স্তম্ভিতভাবে অবস্থান করিতে লাগিলেন। কতক্ষণ পরে ঠাকুরের সমাধিভঙ্গ হইল, তখন ধীরে ধীরে সকলে তাঁহার সহিত সভাস্থলে যাইয়া উপবিষ্ট হইলেন।

এইবার সভার কার্য আরম্ভ হইল। কিন্তু গৌরী প্রথমেই বলিয়া উঠিলেন – (ঠাকুরকে দেখাইয়া) “উনি যখন পণ্ডিতজীকে এরূপ কৃপা করিলেন, তখন আজ আর আমি উহার (বৈষ্ণবচরণের) সহিত বাদে প্রবৃত্ত হইব না; হইলেও আমাকে নিশ্চয় পরাজিত হইতে হইবে, কারণ উনি (বৈষ্ণবচরণ) আজ দৈববলে বলীয়ান! বিশেষতঃ উনি (বৈষ্ণবচরণ) তো দেখিতেছি আমারই মতের লোক – ঠাকুর সম্বন্ধে উহারও যাহা ধারণা, আমারও তাহাই; অতএব এস্থলে তর্ক নিষ্প্রয়োজন।” অতঃপর শাস্ত্রীয় অন্যান্য কথাবার্তায় কিছুক্ষণ কাটাইয়া সভা ভঙ্গ হইল।

ঠাকুরের সম্বন্ধে গৌরীর ধারণা

গৌরী যে বৈষ্ণবচরণের পাণ্ডিত্যে ভয় পাইয়া তাঁহার সহিত অদ্য তর্কযুদ্ধে নিরস্ত হইলেন, তাহা নহে। ঠাকুরের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার ও অন্যান্য লক্ষণাদি দেখিয়া এই অল্পদিনেই তিনি তপস্যা-প্রসূত তীক্ষ্ণদৃষ্টিসহায়ে প্রাণে প্রাণে অনুভব করিয়াছিলেন – ইনি সামান্য নহেন, ইনি মহাপুরুষ! কারণ, ইহার কিছুদিন পরেই ঠাকুর একদিন গৌরীর মন পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করেন – “আচ্ছা, বৈষ্ণবচরণ (নিজের শরীর দেখাইয়া) একে অবতার বলে; এটা কি হতে পারে? তোমার কি বোধ হয়, বল দেখি?”

গৌরী তাহাতে গম্ভীরভাবে উত্তর করিলেন – “বৈষ্ণবচরণ আপনাকে অবতার বলে? তবে তো ছোট কথা বলে। আমার ধারণা, যাঁহার অংশ হইতে যুগে যুগে অবতারেরা লোক-কল্যাণসাধনে জগতে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন, যাঁহার শক্তিতে তাঁহারা ঐ কার্য সাধন করেন, আপনি তিনিই!” ঠাকুর শুনিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন – “ও বাবা! তুমি যে আবার তাকেও (বৈষ্ণবচরণকেও) ছাড়িয়ে যাও! কেন বল দেখি? আমাতে কি দেখেছ, বল দেখি?” গৌরী বলিলেন, “শাস্ত্রপ্রমাণে এবং নিজের প্রাণের অনুভব হইতেই বলিতেছি। এ বিষয়ে যদি কেহ বিরুদ্ধ পক্ষাবলম্বনে আমার সহিত বাদে প্রবৃত্ত হয়, তাহা হইলে আমি আমার ধারণা প্রমাণ করিতেও প্রস্তুত আছি।”

ঠাকুর বালকের ন্যায় বলিলেন, “তোমরা সব এত কথা বল, কিন্তু কে জানে বাবু, আমি তো কিছু জানি না!”

গৌরী বলিলেন, “ঠিক কথা। শাস্ত্রও ঐ কথা বলেন – আপনিও আপনাকে জানেন না। অতএব অন্যে আর কি করে আপনাকে জানবে বলুন? যদি কাহাকেও কৃপা করে জানান তবেই সে জানতে পারে।”

ঠাকুরের সংসর্গে গৌরীর বৈরাগ্য ও সংসার ত্যাগ করিয়া তপস্যায় গমন

পণ্ডিতজীর বিশ্বাসের কথা শুনিয়া ঠাকুর হাসিতে লাগিলেন। দিন দিন গৌরী ঠাকুরের প্রতি অধিকতর আকৃষ্ট হইতে লাগিলেন। তাঁহার শাস্ত্রজ্ঞান ও সাধনের ফল এতদিনে ঠাকুরের দিব্যসঙ্গে পূর্ণ পরিণতি লাভ করিয়া সংসারে তীব্র বৈরাগ্যরূপে প্রকাশ পাইতে লাগিল। দিন দিন তাঁহার মন পাণ্ডিত্য, লোকমান্য, সিদ্ধাই প্রভৃতি সকল বস্তুর প্রতি বীতরাগ হইয়া ঈশ্বরের শ্রীপাদপদ্মে গুটাইয়া আসিতে লাগিল। এখন আর গৌরীর সে পাণ্ডিত্যের অহঙ্কার নাই, সে দাম্ভিকতা কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে, সে তর্কপ্রিয়তা এককালে নীরব হইয়াছে। তিনি এখন বুঝিয়াছেন, ঈশ্বরপাদপদ্ম-লাভের একান্ত চেষ্টা না করিয়া এতদিন বৃথা কাল কাটাইয়াছেন – আর ওরূপে কালক্ষেপ উচিত নহে। তাঁহার মনে এখন সঙ্কল্প স্থির – সর্বস্ব ত্যাগ করিয়া ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিপূর্ণ চিত্তে সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া ব্যাকুল অন্তরে তাঁহাকে ডাকিয়া দিন কয়টা কাটাইয়া দিবেন; এইরূপে যদি তাঁর কৃপা ও দর্শনলাভ করিতে পারেন!

এইরূপে ঠাকুরের সঙ্গসুখে ও ঈশ্বরচিন্তায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটিয়া যাইতে লাগিল। অনেক দিন বাটী হইতে অন্তরে আছেন বলিয়া ফিরিবার জন্য পণ্ডিতজীর স্ত্রী-পুত্র-পরিবারবর্গ বারংবার পত্র লিখিতে লাগিল। কারণ, তাহারা লোকমুখে আভাস পাইতেছিল, দক্ষিণেশ্বরের কোন এক উন্মত্ত সাধুর সহিত মিলিত হইয়া পণ্ডিতজীর মনের অবস্থা কেমন এক রকম হইয়া গিয়াছে।

পাছে তাহারা দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া তাঁহাকে টানাটানি করিয়া সংসারে পুনরায় লিপ্ত করে, তাহাদের চিঠির আভাসে পণ্ডিতজীর মনে ঐ ভাবনাও ক্রমশঃ প্রবল হইতে লাগিল। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া গৌরী উপায় উদ্ভাবন করিলেন এবং শুভ মুহূর্তের উদয় জানিয়া ঠাকুরের শ্রীপদে প্রণাম করিয়া সজলনয়নে বিদায় প্রার্থনা করিলেন। ঠাকুর বলিলেন, “সে কি গৌরী, সহসা বিদায় কেন? কোথায় যাবে?”

গৌরী করজোড়ে উত্তর করিলেন, “আশীর্বাদ করুন যেন অভীষ্ট সিদ্ধ হয়। ঈশ্বরবস্তু লাভ না করিয়া আর সংসারে ফিরিব না।” তদবধি সংসারে আর কখনও কেহ বহু অনুসন্ধানেও গৌরী পণ্ডিতের দেখা পাইলেন না।

বৈষ্ণবচরণ ও গৌরীর কথা উল্লেখ করিয়া ঠাকুরের উপদেশ – নরলীলায় বিশ্বাস

এইরূপে ঠাকুর বৈষ্ণবচরণ এবং গৌরীর জীবনের নানা কথা আমাদিগের নিকট অনেক সময় উল্লেখ করিতেন। আবার কখনও বা কোন বিষয়ের কথাপ্রসঙ্গে তাঁহাদিগকে ঐ বিষয়ে কি মতামত প্রকাশ করিতে শুনিয়াছিলেন, সে বিষয়েরও উল্লেখ করিতেন। আমাদের মনে আছে, একদিন জনৈক ভক্ত সাধককে উপদেশ দিতে দিতে ঠাকুর তাঁহাকে বলিতেছেন, “মানুষে ইষ্টবুদ্ধি ঠিক ঠিক হলে তবে ভগবানলাভ হয়। বৈষ্ণবচরণ বলত – নরলীলায় বিশ্বাস হলে তবে পূর্ণ জ্ঞান হয়।”

কালী ও কৃষ্ণে অভেদ-বুদ্ধি-সম্বন্ধে গৌরী

কখনও বা কোন ভক্তের ‘কালী’ ও ‘কৃষ্ণ’-এ বিশেষ ভেদবুদ্ধি দেখিয়া তাহাকে বলিতেন, “ও কি হীন বুদ্ধি তোর? জানবি যে তোর ইষ্টই কালী, কৃষ্ণ, গৌর, সব হয়েছেন। তা বলে কি নিজের ইষ্ট ছেড়ে তোকে গৌর ভজতে বলছি, তা নয়। তবে দ্বেষবুদ্ধিটা ত্যাগ করবি। তোর ইষ্টই কৃষ্ণ হয়েছেন, গৌর হয়েছেন – এই জ্ঞানটা ভিতরে ঠিক রাখবি। দেখ্ না, গেরস্তের বৌ শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শ্বশুর, শাশুড়ী, ননদ, দেওর, ভাসুর সকলকে যথাযোগ্য মান্য ভক্তি ও সেবা করে – কিন্তু মনের সকল কথা খুলে বলা, আর শোয়া কেবল এক স্বামীর সঙ্গেই করে। সে জানে যে, স্বামীর জন্যই শ্বশুর শাশুড়ী প্রভৃতি তার আপনার। সেই রকম নিজের ইষ্টকে ঐ স্বামীর মতন জানবি। আর তাঁর সঙ্গে সম্বন্ধ হতেই তাঁর অন্য সকল রূপের সহিত সম্বন্ধ, তাঁদের সব শ্রদ্ধা ভক্তি করা – এইটে জানবি। ঐরূপ জেনে দ্বেষবুদ্ধিটা তাড়িয়ে দিবি। গৌরী বলত – ‘কালী আর গৌরাঙ্গ এক বোধ হলে তবে বুঝব যে ঠিক জ্ঞান হলো’।”

ভালবাসার পাত্রকে ভগবানের মূর্তি বলিয়া ভাবা সম্বন্ধে বৈষ্ণবচরণ

আবার কখনও বা ঠাকুর কোন ভক্তের মন সংসারে কাহারও প্রতি অত্যন্ত আসক্ত থাকায় স্থির হইতেছে না দেখিয়া তাহাকে তাহার ভালবাসার পাত্রকেই ভগবানের মূর্তিজ্ঞানে সেবা করিতে ও ভালবাসিতে বলিতেন। লীলাপ্রসঙ্গে পূর্বে এক স্থলে আমরা পাঠককে বলিয়াছি, কেমন করিয়া ঠাকুর জনৈকা স্ত্রী-ভক্তের মন তাঁহার অল্পবয়স্ক ভ্রাতুষ্পুত্রের উপর অত্যন্ত আসক্ত দেখিয়া তাঁহাকে ঐ বালককেই গোপাল বা বালকৃষ্ণ-জ্ঞানে সেবা করিতে ও ভালবাসিতে বলিতেছেন এবং ঐরূপ অনুষ্ঠানের ফলে ঐ স্ত্রী-ভক্তের স্বল্পকালেই ভাবসমাধি-উদয়ের কথারও উল্লেখ করিয়াছি।1 ভালবাসার পাত্রকে ঈশ্বরজ্ঞানে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করার কথা বলিতে বলিতে কখনও কখনও ঠাকুর বৈষ্ণবচরণের ঐ বিষয়ক মতের উল্লেখ করিয়া বলিতেন, “বৈষ্ণবচরণ বলত, যে যাকে ভালবাসে তাকে ইষ্ট বলে জানলে ভগবানে শীঘ্র মন যায়।” বলিয়াই আবার বুঝাইয়া দিতেন, “সে ঐ কথা তাদের সম্প্রদায়ের মেয়েদের করতে বলত, তজ্জন্য দূষ্য হতো না – তাদের সব পরকীয়া নায়িকার ভাব কি না! পরকীয়া নায়িকার উপপতির উপর মনের যেমন টান, সেই টানটা ঈশ্বরে আরোপ করতেই তারা চাইত।” ওটা কিন্তু সাধারণে শিক্ষা দিবার যে কথা নহে, তাহাও ঠাকুর বলিতেন। বলিতেন, তাতে ব্যভিচার বাড়বে। তবে নিজের পতি পুত্র বা অন্য কোন আত্মীয়কে ঈশ্বরের মূর্তি-জ্ঞানে সেবা করিতে, ভালবাসিতে ঠাকুরের অমত ছিল না এবং তাঁহার পদাশ্রিত অনেক ভক্তকে যে তিনি ঐরূপ করিতে শিক্ষাও দিতেন, তাহা আমাদের জানা আছে।


1. পূর্বার্ধ, প্রথম অধ্যায়।

ঐ উপদেশ শাস্ত্রসম্মত – উপনিষদের যাজ্ঞবল্ক্য-মৈত্রেয়ী-সংবাদ

ভাবিয়া দেখিলে বাস্তবিক উহা যে অশাস্ত্রীয় নবীন মত নহে তাহাও বেশ বুঝিতে পারা যায়। উপনিষদ্কার ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য-মৈত্রেয়ী-সংবাদে1 শিক্ষা দিতেছেন – পতির ভিতর আত্মস্বরূপ শ্রীভগবান রহিয়াছেন বলিয়াই স্ত্রীর পতিকে প্রিয় বোধ হয়। স্ত্রীর ভিতর তিনি থাকাতেই পতির মন স্ত্রীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়া থাকে। এইরূপে ব্রাহ্মণের ভিতর, ক্ষত্রিয়ের ভিতর, ধনের ভিতর, পৃথিবীর যে সমস্ত বস্তু অন্তরে প্রিয়বুদ্ধির উদয় করিয়া মানবমন আকর্ষণ করে, সে সমস্তের ভিতরেই প্রিয়স্বরূপ, আনন্দস্বরূপ, ঐশ্বরিক অংশের বিদ্যমানতা দেখিয়া ভালবাসিবার উপদেশ ভারতের উপনিষদ্কার ঋষিগণ বহু প্রাচীন যুগ হইতেই আমাদের শিক্ষা দিতেছেন। দেবর্ষি নারদাদি ভক্তিসূত্রের আচার্যগণও জীবকে ঈশ্বরের দিকে কামক্রোধাদি রিপুসকলের বেগ ফিরাইয়া দিতে বলিয়া এবং সখ্য-বাৎসল্য-মধুররসাদি আশ্রয় করিয়া ঈশ্বরকে ডাকিবার উপদেশ করিয়া উপনিষদ্কার ঋষিদিগেরই যে পদানুসরণ করিয়াছেন, ইহা স্পষ্ট বুঝা যায়। অতএব ঠাকুরের ঐ বিষয়ক মত যে শাস্ত্রানুগত, তাহা বেশ বুঝা যাইতেছে।


1. বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ – ৫ম ব্রাহ্মণ।

অবতারপুরুষেরা সর্বদা শাস্ত্রমর্যাদা রক্ষা করেন; সকল ধর্মমতকে সম্মান করা সম্বন্ধে ঠাকুরের শিক্ষা

ঈশ্বরাবতার মহাপুরুষেরা পূর্ব পূর্ব শাস্ত্রসকলের মর্যাদা সম্যক রক্ষা করিয়া তাঁহাদের প্রবর্তিত বিধানের অবিরোধী কোন নূতন পথের সংবাদই যে ধর্মজগতে আনিয়া দেন, এ কথা আর বলিয়া বুঝাইতে হইবে না। যে-কোন অবতার-পুরুষের জীবনালোচনা করিলেই উহা বুঝিতে পারা যায়। বর্তমান যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনেও যে ঐ বিষয়ের অক্ষুণ্ণ পরিচয় আমরা সর্বদা সকল বিষয়ে পাইয়াছি, এ কথাই আমরা পাঠককে ‘লীলাপ্রসঙ্গ’-এ বুঝাইতে প্রয়াসী। যদি না পারি, তবে পাঠক যেন বুঝেন উহা আমাদের একদেশী বুদ্ধির দোষেই হইতেছে – যে ঠাকুর ‘যত মত তত পথ’-রূপ অদৃষ্টপূর্ব সত্য আধ্যাত্মিক জগতে প্রথম প্রকাশ করিয়া জনসাধারণকে মুগ্ধ করিয়াছেন, তাঁহার ত্রুটি বা দোষে নহে। পাশ্চাত্য নীতি – যাহার প্রয়োগ সুচতুর দুনিয়াদার পাশ্চাত্য কেবল অপর ব্যক্তি ও জাতির কার্যাকার্য-বিচারণের সময়েই বিশেষভাবে করিয়া থাকেন, নিজের কার্যকলাপ বিচার করিতে যাইয়া প্রায়ই পাল্টাইয়া দেন, সেই পাশ্চাত্য নীতির অনুসরণ করিয়া আমরা যাহাকে ‘জঘন্য কর্তাভজাদি মত’ বলিয়া নাসিকা কুঞ্চিত করি, ঐ কর্তাভজাদি মত হইতে শুদ্ধাদ্বৈত বেদান্তমত পর্যন্ত সকল মতই এ দেবমানব ঠাকুরের নিকট সসম্মানে ঈশ্বরলাভের পথ বলিয়া স্থানপ্রাপ্ত হইত এবং অধিকারী-বিশেষে অনুষ্ঠেয় বলিয়া নির্দিষ্টও হইত। আমরা অনেকে দ্বেষবুদ্ধিপ্রণোদিত হইয়া ঠাকুরকে অনেক সময় জিজ্ঞাসা করিয়াছি – ‘মহাশয়, অত বড় উচ্চদরের সাধিকা ব্রাহ্মণী পঞ্চ-মকার লইয়া সাধন করিতেন, এটা কিরূপ? অথবা অত বড় উচ্চদরের ভক্ত সুপণ্ডিত বৈষ্ণবচরণ পরকীয়া-গ্রহণে বিরত হন নাই – এ তো বড় খারাপ?’

ঠাকুরও তাহাতে বারংবার আমাদের বলিয়াছেন, “ওতে ওদের দোষ নেই রে! ওরা ষোল আনা মন দিয়ে বিশ্বাস করত, ঐটেই ঈশ্বরলাভের পথ। ঈশ্বরলাভ হবে বলে যে যেটা সরলভাবে প্রাণের সহিত বিশ্বাস করে অনুষ্ঠান করে, সেটাকে খারাপ বলতে নেই, নিন্দা করতে নেই। কারও ভাব নষ্ট করতে নেই। কেন-না যে-কোন একটা ভাব ঠিক ঠিক ধরলে তা থেকেই ভাবময় ভগবানকে পাওয়া যায়। যে যার ভাব ধরে তাঁকে (ঈশ্বরকে) ডেকে যা। আর, কারো ভাবের নিন্দা করিসনি, বা অপরের ভাবটা নিজের বলে ধরতে যাসনি।” এই বলিয়াই সদানন্দময় ঠাকুর অনেক সময় গাহিতেন –

আপনাতে আপনি থেকো, যেও না মন কারু ঘরে।
যা চাবি তাই বসে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে॥
পরম ধন সে পরশমণি, যা চাবি তাই দিতে পারে,
(ও মন) কত মণি পড়ে আছে, সে চিন্তামণির নাচদুয়ারে॥
তীর্থগমন দুঃখভ্রমণ, মন উচাটন হয়ো না রে,
(তুমি) আনন্দে ত্রিবেণী-স্নানে শীতল হও না মূলাধারে॥
কি দেখ কমলাকান্ত, মিছে বাজি এ সংসারে,
(তুমি) বাজিকরে চিনলে নাকো, যে এই ঘটের ভিতর বিরাজ করে॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *