৪.৩ গুরুভাবে তীর্থভ্রমণ ও সাধুসঙ্গ

চতুর্থ খণ্ড – তৃতীয় অধ্যায়: গুরুভাবে তীর্থভ্রমণ ও সাধুসঙ্গ

অপরাপর আচার্য পুরুষদিগের সহিত তুলনায় ঠাকুরের জীবনের অদ্ভুত নূতনত্ব

যদ্ যদ্ বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা।
তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোঽংশসম্ভবম্॥
– গীতা, ১০।৪১

গুরুভাবের প্রেরণায় ভাবমুখে অবস্থিত ঠাকুর কত স্থানে কত লোকের সহিত কত প্রকারে যে লীলা করিয়াছিলেন তাহার সমুদয় লিপিবদ্ধ করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। উহার কিছু কিছু ইতঃপূর্বেই আমরা পাঠককে উপহার দিয়াছি। ঠাকুরের তীর্থভ্রমণও ঐ ভাবেই হইয়াছিল। এখন আমরা পাঠককে উহাই বলিবার চেষ্টা করিব।

আমরা যতদূর দেখিয়াছি ঠাকুরের কোন কার্যটিই উদ্দেশ্যবিহীন বা নিরর্থক ছিল না। তাঁহার জীবনের অতি সামান্য সামান্য দৈনিক ব্যবহারগুলির পর্যালোচনা করিলেও গভীর ভাবপূর্ণ বলিয়া দেখিতে পাওয়া যায় – বিশেষ ঘটনাগুলির তো কথাই নাই। আবার এমন অঘটন-ঘটনাবলী-পরিপূর্ণ জীবন বর্তমান যুগে আধ্যাত্মিক জগতে আর একটিও দেখা যায় নাই। আজীবন তপস্যা ও চেষ্টার দ্বারা ঈশ্বরের অনন্তভাবের কোন একটির সম্যক উপলব্ধিই মানুষ করিয়া উঠিতে পারে না, তা নানাভাবে তাঁহার উপলব্ধি ও দর্শন করা – সকল প্রকার ধর্মমত সাধনসহায়ে সত্য বলিয়া প্রত্যক্ষ করা এবং সকল মতের সাধকদিগকেই নিজ নিজ গন্তব্যপথে অগ্রসর হইতে সহায়তা করা! আধ্যাত্মিক জগতে এরূপ দৃষ্টান্ত দেখা দূরে থাকুক, কখনও কি আর শুনা গিয়াছে? প্রাচীন যুগের ঋষি আচার্য বা অবতার মহাপুরুষেরা এক একটি বিশেষ বিশেষ ভাবরূপ পথাবলম্বনে স্বয়ং ঈশ্বরোপলব্ধি করিয়া তত্তৎ ভাবকেই ঈশ্বরদর্শনের একমাত্র পথ বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিলেন; অপরাপর নানা ভাবাবলম্বনেও যে ঈশ্বরের উপলব্ধি করা যাইতে পারে, এ কথা উপলব্ধি করিবার অবসর পান নাই। অথবা নিজেরা ঐ সত্যের অল্পবিস্তর প্রত্যক্ষ করিতে সমর্থ হইলেও তৎপ্রচারে জনসাধারণের ইষ্টনিষ্ঠার দৃঢ়তা কমিয়া যাইয়া তাহাদের ধর্মোপলব্ধির অনিষ্ট সাধিত হইবে – এই ভাবিয়া সর্বসমক্ষে ঐ বিষয়টির ঘোষণা করেন নাই। কিন্তু যাহা ভাবিয়াই তাঁহারা ঐরূপ করিয়া থাকুন, তাঁহারা যে তাঁহাদের গুরুভাব-সহায়ে একদেশী ধর্মমতসমূহই প্রচার করিয়াছিলেন এবং কালে উহাই যে মানবমনে ঈর্ষাদ্বেষাদির বিপুল প্রসার আনয়ন করিয়া অনন্ত বিবাদ এবং অনেক সময়ে রক্তপাতেরও হেতু হইয়াছিল, ইতিহাস এ বিষয়ে নিঃসংশয় সাক্ষ্য দিতেছে।

ঠাকুর নিজ জীবনে কি সপ্রমাণ করিয়াছেন এবং তাঁহার উদার মত ভবিষ্যতে কতদূর প্রসারিত হইবে

শুধু তাহাই নহে, ঐরূপ একঘেয়ে একদেশী ধর্মভাব-প্রচারে পরস্পরবিরোধী নানা মতের উৎপত্তি হইয়া ঈশ্বরলাভের পথকে এতই জটিল করিয়া তুলিয়াছিল যে, সে জটিলতা ভেদ করিয়া সত্যস্বরূপ ঈশ্বরের দর্শনলাভ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব বলিয়াই সাধারণ বুদ্ধির প্রতীত হইতেছিল! ইহকালাবসায়ী ভোগৈকসর্বস্ব পাশ্চাত্যের জড়বাদ আবার সময় বুঝিয়াই যেন দুর্দমনীয় বেগে শিক্ষার ভিতর দিয়া ঠাকুরের আবির্ভাবের কিছুকাল পূর্ব হইতে ভারতে প্রবিষ্ট হইয়া তরলমতি বালক ও যুবকদিগের মন কলুষিত করিয়া নাস্তিকতা, ভোগানুরাগ প্রভৃতি নানা বৈদেশিক ভাবে দেশ প্লাবিত করিতেছিল। পবিত্রতা, ত্যাগ ও ঈশ্বরানুরাগের জ্বলন্ত নিদর্শনস্বরূপ এ অলৌকিক ঠাকুরের আবির্ভাবে ধর্ম পুনরায় প্রতিষ্ঠিত না হইলে দুর্দশা কতদূর গড়াইত তাহা কে বলিতে পারে? ঠাকুর স্বয়ং অনুষ্ঠান করিয়া দেখাইলেন যে, ভারত এবং ভারতেতর দেশে প্রাচীন যুগে যত ঋষি, আচার্য, অবতার মহাপুরুষেরা জন্মগ্রহণ করিয়া যত প্রকার ভাবে ঈশ্বরোপলব্ধি করিয়াছেন এবং ধর্মজগতের ঈশ্বরলাভের যত প্রকার মত প্রচার করিয়া গিয়াছেন তাহার কোনটিই মিথ্যা নহে – প্রত্যেকটিই সম্পূর্ণ সত্য; বিশ্বাসী সাধক ঐ ঐ পথাবলম্বনে অগ্রসর হইয়া এখনও তাঁহাদের ন্যায় ঈশ্বরদর্শন করিয়া ধন্য হইতে পারেন। – দেখাইলেন যে, পরস্পরবিরুদ্ধ সামাজিক আচার, রীতিনীতি প্রভৃতি লইয়া ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানের ভিতর পর্বত-সদৃশ ব্যবধান বিদ্যমান থাকিলেও উভয়ের ধর্মই সত্য; উভয়েই এক ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন ভাবের উপাসনা করিয়া, বিভিন্ন পথ দিয়া অগ্রসর হইয়া, কালে সেই প্রেমস্বরূপের সহিত প্রেমে এক হইয়া যায়। দেখাইলেন যে, ঐ সত্যের ভিত্তির উপর দণ্ডায়মান হইয়াই উহারা উভয়েই উভয়কে কালে সপ্রেম আলিঙ্গনে বদ্ধ করিবে এবং বহু কালের বিবাদ ভুলিয়া শান্তিলাভ করিবে। – এবং দেখাইলেন যে, কালে ভোগলোলুপ পাশ্চাত্যও ‘ত্যাগেই শান্তি’ এ কথা হৃদয়ঙ্গম করিয়া ঈশা-প্রচারিত ধর্মমতের সহিত ভারত এবং অন্যান্য প্রদেশের ঋষি এবং অবতারকুল-প্রচারিত ধর্মমতসমূহের সত্যতা উপলব্ধি করিয়া নিজ কর্মজীবনের সহিত ধর্মজীবনের সম্বন্ধ আনয়ন করিয়া ধন্য হইবে! এ অদ্ভুত ঠাকুরের জীবনালোচনায় আমরা যতই অগ্রসর হইব ততই দেখিতে পাইব, ইনি দেশবিশেষ, জাতিবিশেষ, সম্প্রদায়বিশেষ বা ধর্মবিশেষের সম্পত্তি নহেন। পৃথিবীর সমস্ত জাতিকেই একদিন শান্তিলাভের জন্য ইঁহার উদারমতের আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইবে। ভাবমুখে অবস্থিত ঠাকুর ভাবরূপে তাহাদের ভিতর প্রবিষ্ট হইয়া সমুদয় সঙ্কীর্ণতার গণ্ডি ভাঙিয়া চুরিয়া তাঁহার নবীন ছাঁচে ফেলিয়া তাহাদিগকে এক অপূর্ব একতাবন্ধনে আবদ্ধ করিবেন।

এ বিষয়ে প্রমাণ

ভারতের পরস্পর-বিরোধী চিরবিবদমান যাবতীয় প্রধান প্রধান সম্প্রদায়ের সাধককুল ঠাকুরের নিকট আগমন করিয়া যে তাঁহাতে নিজ নিজ ভাবের পূর্ণাদর্শ দেখিতে পাইয়াছিলেন, এবং তাঁহাকে নিজ নিজ গন্তব্য পথেরই পথিক বলিয়া স্থির ধারণা করিয়াছিলেন, ইহাতে পূর্বোক্ত ভাবই সূচিত হইতেছে। ঠাকুরের গুরুভাবের যে কার্য এইরূপে ভারতে প্রথম প্রারব্ধ হইয়া ভারতীয় ধর্মসম্প্রদায়সমূহের ভিতর একতা আনিয়া দিবার সূত্রপাত করিয়া গিয়াছে, সে কার্য যে শুধু ভারতের ধর্মবিবাদ ঘুচাইয়া নিরস্ত হইবে তাহা নহে – এশিয়ার ধর্মবিবাদ, ইউরোপের ধর্মহীনতা ও ধর্মবিদ্বেষ সমস্তই ধীর স্থির পদসঞ্চারে শনৈঃ শনৈঃ তিরোহিত করিয়া সমগ্র পৃথিবী ব্যাপিয়া এক অদৃষ্টপূর্ব শান্তির রাজ্য স্থাপন করিবে। দেখিতেছ না, ঠাকুরের অন্তর্ধানের পর হইতে ঐ কার্য কত দ্রুতপদসঞ্চারে অগ্রসর হইতেছে? দেখিতেছ না, কিরূপে গুরুগতপ্রাণ পূজ্যপাদ স্বামী বিবেকানন্দের ভিতর দিয়া আমেরিকা ও ইউরোপে ঠাকুরের ভাব প্রবেশলাভ করিয়া এই স্বল্পকালের মধ্যেই চিন্তাজগতে কি যুগান্তর আনিয়া উপস্থিত করিয়াছে? দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর যতই চলিয়া যাইবে ততই এ অমোঘ ভাবরাশি সকল জাতির ভিতর, সকল ধর্মের ভিতর, সকল সমাজের ভিতর আপন প্রভাব বিস্তার করিয়া অদ্ভুত যুগান্তর আনিয়া উপস্থিত করিবে। কাহার সাধ্য ইহার গতি রোধ করে? অদৃষ্টপূর্ব তপস্যা ও পবিত্রতার সাত্ত্বিক তেজোদ্দীপ্ত এ ভাবরাশির সীমা কে উল্লঙ্ঘন করিবে? যে সকল যন্ত্রসহায়ে উহা বর্তমানে প্রসারিত হইতেছে, সে সকল ভগ্ন হইবে, কোথা হইতে ইহা প্রথম উত্থিত হইল তাহাও হয়তো বহুকাল পরে অনেকে ধরিতে বুঝিতে পারিবে না, কিন্তু এ অনন্তমহিমোজ্জ্বল ভাবময় ঠাকুরের স্নিগ্ধোদ্দীপ্ত ভাবরাশি হৃদয়ে যত্নে পোষণ করিয়া তাঁহারই ছাঁচে জীবন গঠিত করিয়া পৃথিবীর সকলকেই একদিন ধন্য হইতে হইবে নিশ্চয়।

ঠাকুরের ভাবপ্রসার কিরূপে বুঝিতে হইবে

অতএব ভারতের বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত সাধককুলের ঠাকুরের নিকট আগমন ও যথার্থ ধর্মলাভ করিয়া ধন্য হইবার যে সকল কথা আমরা তোমাকে উপহার দিতেছি, হে পাঠক, কেবলমাত্র ভাসাভাসা ভাবে গল্পের মতো ঐ সকল পাঠ করিয়াই নিরস্ত থাকিও না। ভাবমুখে অবস্থিত এ অলৌকিক ঠাকুরের দিব্য ভাবরাশি প্রথম যথাসম্ভব ধরিবার বুঝিবার চেষ্টা কর; পরে ঐ সকল কথার ভিতর তলাইয়া দেখিতে থাক কিরূপে ঐ ভাবরাশির প্রসার আরম্ভ হইল, কিরূপেই বা উহা পরিপুষ্ট হইয়া প্রথম পুরাতন, পরে নবীন ভাবে শিক্ষিত জনসমূহের ভিতর আপন প্রভাব বিস্তার করিতে থাকিল এবং কিরূপেই বা পরে উহা ভারত হইতে ভারতেতর দেশে উপস্থিত হইয়া পৃথিবীর ভাবজগতে যুগান্তর আনিয়া উপস্থিত করিতেছে।

ঠাকুরের ভাবের প্রথম প্রচার হয় দক্ষিণেশ্বরাগত এবং তীর্থে দৃষ্ট সকল সম্প্রদায়ের সাধুদের ভিতরে

ভারতীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত সাধককুলকে লইয়াই ঠাকুরের ভাবরাশির প্রথম বিস্তার। আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, ঠাকুর যখন যে যে ভাবে সিদ্ধ হইয়াছিলেন তখন সেই সেই ভাবের ভাবুক সাধককুল তাঁহার নিকট স্বতঃপ্রেরিত হইয়া আগমনপূর্বক তত্তৎ ভাবের পূর্ণাদর্শ তাঁহাতে অবলোকন ও তাঁহার সহায়তা লাভ করিয়া অন্যত্র চলিয়া গিয়াছিলেন। তদ্ভিন্ন মথুরবাবু ও তৎপত্নী পরম ভক্তিমতী জগদম্বা দাসীর অনুরোধে ঠাকুর শ্রীবৃন্দাবন পর্যন্ত তীর্থপর্যটনে গমন করিয়াছিলেন। কাশী বৃন্দাবনাদি তীর্থে সাধুভক্তের অভাব নাই। অতএব তত্তৎস্থানেও যে বিশিষ্ট বিশিষ্ট সাধকেরা ঠাকুরের সহিত মিলিত হইয়া তাঁহার গুরুভাবসহায়ে ধন্য হইয়াছিলেন এ কথা শুধু যে আমরা অনুমান করিতে পারি তাহাই নহে, কিন্তু উহার কিছু কিছু আভাস তাঁহার শ্রীমুখেও শুনিতে পাইয়াছি। তাহারও কিছু কিছু এখানে লিপিবদ্ধ করা আবশ্যক।

জীবনে উচ্চাবচ নানা অদ্ভুত অবস্থায় পড়িয়া নানা শিক্ষা পাইয়াই ঠাকুরের ভিতর অপূর্ব আচার্যত্ব ফুটিয়া উঠে

ঠাকুর বলিতেন, “ঘুঁটি সব ঘর ঘুরে তবে চিকে ওঠে; মেথর থেকে রাজা অবধি সংসারে যত রকম অবস্থা আছে সে সমুদয় দেখে শুনে, ভোগ করে, তুচ্ছ বলে ঠিক ঠিক ধারণা হলে তবে পরমহংস অবস্থা হয়, যথার্থ জ্ঞানী হয়!” এ তো গেল সাধকের নিজের চরমজ্ঞানে উপনীত হইবার কথা। আবার লোকশিক্ষা বা জনসাধারণের যথার্থ শিক্ষক হইতে হইলে কিরূপ হওয়া আবশ্যক তৎসম্বন্ধে বলিতেন, “আত্মহত্যা একটা নরুন দিয়ে করা যায়; কিন্তু পরকে মারতে হলে (শত্রুজয়ের জন্য) ঢাল খাঁড়ার দরকার হয়।” ঠিক ঠিক আচার্য হইতে গেলে তাঁহাকে সব রকম সংস্কারের ভিতর দিয়া নানাপ্রকারে শিক্ষালাভ করিয়া অপর সাধারণাপেক্ষা সমধিক শক্তিসম্পন্ন হইতে হয়। “অবতার, সিদ্ধপুরুষ এবং জীবে শক্তি লইয়াই প্রভেদ” – ঠাকুর এ কথা বারংবার আমাদের বলিয়াছেন। দেখ না, ব্যবহারিক রাজনৈতিকাদি জগতে বিসমার্ক, গ্লাডস্টোন প্রভৃতি প্রতিভাশালী ব্যক্তিদিগকে দেশের প্রাচীন ও বর্তমান সমস্ত ইতিহাস ও ঘটনাদির প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া ইতরসাধারণাপেক্ষা কতদূর শক্তিসম্পন্ন হইতে হয়; ঐরূপে শক্তিসম্পন্ন হওয়াতেই তো তাঁহারা পঞ্চাশ বা ততোধিক বৎসর পরে বর্তমানকালে প্রচলিত কোন্ ভাবটি কিরূপ আকার ধারণ করিয়া দেশের জনসাধারণের অহিত করিবে তাহা ধরিতে বুঝিতে পারেন এবং সেজন্য এখন হইতে তদ্বিপরীত ভাবে এমন সকল কার্যের সূচনা করিয়া যান যাহাতে দীর্ঘকাল পরে ঐ ভাব প্রবল হইয়া দেশে ঐরূপ অমঙ্গল আর আনিতে পারে না! আধ্যাত্মিক জগতেও ঠিক তদ্রূপ বুঝিতে হইবে। অবতার বা যথার্থ আচার্যপুরুষদিগকে প্রাচীন যুগের ঋষিরা পূর্ব পূর্ব যুগে কি কি আধ্যাত্মিক ভাবের প্রবর্তনা করিয়া গিয়াছিলেন, এতদিন পরে ঐ সকল ভাব কিরূপ আকার ধারণ করিয়া জনসাধারণের কতটা ইষ্ট করিয়াছে ও করিতেছে এবং বিকৃত হইয়া কতটা অনিষ্টই বা করিতেছে ও করিবে, ঐ সকল ভাবের ঐরূপে বিকৃত হইবার কারণই বা কি, বর্তমানে দেশে যে সকল আধ্যাত্মিক ভাব প্রবর্তিত হইয়াছে সে সকলও কালে বিকৃত হইতে হইতে দুই-এক শতাব্দী পরে কিরূপ আকার ধারণ করিয়া কিভাবে জনসাধারণের অধিকতর অহিতকর হইবে – এ সমস্ত কথা ঠিক ঠিক করিয়া বুঝিয়া নবীন ভাবের কার্য প্রবর্তন করিয়া যাইতে হয়। কারণ, ঐ সকল বিষয় যথার্থভাবে ধরিতে বুঝিতে না পারিলে সকলের বর্তমান অবস্থা ধরিবেন বুঝিবেন কিরূপে, এবং রোগ ঠিক ঠিক ধরিতে না পারিলে তাহার ঔষধ প্রয়োগই বা কিরূপে করিবেন? সেজন্য তীব্র তপস্যাদি করিয়া পূর্বোক্ত ঔষধদানে আপনাকে শক্তিসম্পন্ন করা ভিন্ন আচার্যদিগকে সংসারে নানা অবস্থায় পড়িয়া যতটা শিক্ষালাভ করিতে হয় – ইতরসাধারণ সাধককে ততটা করিতে হয় না। দেখ না, ঠাকুরকে কত প্রকার অবস্থার সহিত পরিচিত হইতে হইয়াছিল। দরিদ্রের কুটিরে জন্মগ্রহণ করিয়া বাল্যে কঠোর দারিদ্র্যের সহিত, কালীবাটীর পূজকের পদগ্রহণে স্বীকৃত হইয়া যৌবনে পরের দাসত্ব করা-রূপ হীনাবস্থার সহিত, সাধকাবস্থায় ভগবানের জন্য আত্মহারা হইয়া আত্মীয়-কুটুম্বদিগের তীব্র তিরস্কার লাঞ্ছনা অথবা গভীর মনস্তাপ এবং সাংসারিক অপর সাধারণের পাগল বলিয়া নিতান্ত উপেক্ষা বা করুণার সহিত, মথুরবাবুর তাঁহার উপর ভক্তি-শ্রদ্ধার উদয়ে রাজতুল্য ভোগ ও সম্মানের সহিত, নানা সাধককুলের ঈশ্বরাবতার বলিয়া তাঁহার পাদপদ্মে হৃদয়ের ভক্তি-প্রীতি ঢালিয়া দেওয়ায় দেবতুল্য পরম ঐশ্বর্যের সহিত – এইরূপ কতই না অবস্থার সহিত পরিচিত হইয়া ঐ সকল অবস্থাতে সর্বতোভাবে অবিচলিত থাকারূপ বিষম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে হইয়াছিল! অনন্য অনুরাগ একদিকে যেমন তাঁহাকে ঈশ্বরলাভের জন্য অদৃষ্টপূর্ব তীব্র তপস্যায় লাগাইয়া তাঁহার যোগপ্রসূত অতীন্দ্রিয় সূক্ষ্মদৃষ্টি সম্পূর্ণ খুলিয়া দিয়াছিল, সংসারের এই সকল নানা অবস্থার সহিত পরিচয়ও আবার তেমনি অপর দিকে তাঁহাকে বাহ্য বর্তমান জগতের সকল প্রকার অবস্থাপন্ন লোকের ভিতরের ভাব ঠিক ঠিক ধরিয়া বুঝিয়া তাহাদের সহিত ব্যবহারে কুশলী এবং তাহাদের সকল প্রকার সুখ-দুঃখের সহিত সহানুভূতিসম্পন্ন করিয়া তুলিয়াছিল। কারণ, ভিতরের ও বাহিরের ঐ সকল অবস্থার ভিতর দিয়াই ঠাকুরের গুরুভাব বা আচার্যভাব দিন দিন অধিকতর বিকশিত ও পরিস্ফুট হইতে দেখা গিয়াছিল।

তীর্থ-ভ্রমণে ঠাকুর কি শিখিয়াছিলেন; ঠাকুরের ভিতর দেব ও মানব উভয় ভাব ছিল

তীর্থ-ভ্রমণও যে ঠাকুরের জীবনে ঐরূপ ফল উপস্থিত করিয়াছিল তাহার আর সন্দেহ নাই। যুগাচার্য ঠাকুরের দেশের ইতরসাধারণের আধ্যাত্মিক অবস্থার বিষয় জ্ঞাত হওয়ার আবশ্যক ছিল। মথুরের সহিত তীর্থ-ভ্রমণে যাইয়া উহা যে অনেকটা সংসিদ্ধ হইয়াছিল এ বিষয় নিঃসন্দেহ। কারণ, অন্তর্জগতে ঠাকুরের যে প্রজ্ঞাচক্ষু মায়ার সমগ্র আবরণ ভেদ করিয়া সকলের অন্তর্নিহিত ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ অখণ্ড সচ্চিদানন্দের দর্শন স্পর্শন সর্বদা করিতে সমর্থ হইত, বহির্জগতে লৌকিক ব্যবহারের সম্পর্কে আসিয়া উহাই আবার এখন এক কথায় লোকের ভিতরের ভাব ধরিতে এবং দুই-চারিটি ঘটনা দেখিয়াই সমাজের ও দেশের অবস্থা বুঝিতে বিশেষ পটু হইয়াছিল। অবশ্য বুঝিতে হইবে, ঠাকুরের সাধারণ অবস্থা লক্ষ্য করিয়াই আমরা এ কথা বলিতেছি, নতুবা যোগবলে উচ্চ ভূমিতে উঠিয়া যখন তিনি দিব্যদৃষ্টি-সহায়ে ব্যক্তিগত, সমাজগত বা প্রদেশগত অবস্থার দর্শন ও উপলব্ধি করিতেন এবং কোন্ উপায় অবলম্বনে তাহাদের বর্তমান দুর্দশার অবসান হইবে তাহা সম্যক নির্ধারণ করিতেন, তখন ইতরসাধারণের ন্যায় বাহ্যদৃষ্টিতে দেখিয়া শুনিয়া তুলনায় আলোচনা করিয়া কোন বিষয় জানিবার পারে তিনি চলিয়া যাইতেন এবং ঐরূপে ঐ বিষয়ের তত্ত্বনিরূপণের তাঁহার আর প্রয়োজনই হইত না! দেব-মানব ঠাকুরকে আমরা সাধারণ বাহ্যদৃষ্টি এবং অসাধারণ যোগদৃষ্টি – উভয় দৃষ্টি সহায়েই সকল বিষয়ের তত্ত্বনিরূপণ করিতে দেখিয়াছি! সেজন্য দেবভাব ও মনুষ্যভাব উভয়বিধ ভাবের সম্যক বিকাশের পরিচয় পাঠককে না দিতে পারিলে এ অলৌকিক চরিত্রের একদেশী ছবিমাত্রই পাঠকের মনে অঙ্কিত হইবে। তজ্জন্য ঐ উভয়বিধ ভাবেই এই দেব-মানবের জীবনালোচনা করিতে আমাদের প্রয়াস।

ঠাকুরের ন্যায় দিব্যপুরুষদিগের তীর্থপর্যটনের কারণ সম্বন্ধে শাস্ত্র কি বলেন

শাস্ত্রদৃষ্টিতে ঠাকুরের তীর্থ-ভ্রমণের আর একটি কারণও পাওয়া যায়। শাস্ত্র বলেন, ঈশ্বরের দর্শনলাভে সিদ্ধকাম পুরুষেরা তীর্থে যাইয়া ঐ সকল স্থানের তীর্থত্ব সম্পাদন করিয়া থাকেন। তাঁহারা ঐ সকল স্থানে ঈশ্বরের বিশেষ দর্শনলাভের জন্য ব্যাকুল অন্তরে আগমন ও অবস্থান করেন বলিয়াই সেখানে ঈশ্বরের বিশেষ প্রকাশ আসিয়া উপস্থিত হয়, অথবা ঐ ভাবের পূর্বপ্রকাশ সমধিক বর্ধিত হইয়া উঠে এবং মানবসাধারণ সেখানে উপস্থিত হইলে অতি সহজেই ঈশ্বরের ঐ ভাবের কিছু না কিছু উপলব্ধি করে। সিদ্ধ পুরুষদের সম্বন্ধেই যখন শাস্ত্র এ কথা বলিয়াছেন তখন তদপেক্ষা সমধিক শক্তিমান ঠাকুরের ন্যায় অবতারপুরুষদিগের তো কথাই নাই! তীর্থ সম্বন্ধে পূর্বোক্ত কথাটি ঠাকুর অনেক সময় আমাদিগকে তাঁহার সরল ভাষায় বুঝাইয়া বলিতেন। বলিতেন – “ওরে, যেখানে অনেক লোকে অনেক দিন ধরে ঈশ্বরকে দর্শন করবে বলে তপ, জপ, ধ্যান, ধারণা, প্রার্থনা, উপাসনা করেছে সেখানে তাঁর প্রকাশ নিশ্চয় আছে, জানবি। তাঁদের ভক্তিতে সেখানে ঈশ্বরীয় ভাবের একটা জমাট বেঁধে গেছে; তাই সেখানে সহজেই ঈশ্বরীয় ভাবের উদ্দীপন ও তাঁর দর্শন হয়। যুগযুগান্তর থেকে কত সাধু, ভক্ত, সিদ্ধপুরুষেরা এই সব তীর্থে ঈশ্বরকে দেখবে বলে এসেছে, অন্য সব বাসনা ছেড়ে তাঁকে প্রাণ ঢেলে ডেকেছে, সেজন্য ঈশ্বর সব জায়গায় সমানভাবে থাকলেও এই সব স্থানে তাঁর বিশেষ প্রকাশ! যেমন মাটি খুঁড়লে সব জায়গাতেই জল পাওয়া যায়, কিন্তু যেখানে পাতকো, ডোবা, পুকুর বা হ্রদ আছে সেখানে আর জলের জন্য খুঁড়তে হয় না – যখন ইচ্ছা জল পাওয়া যায়, সেই রকম।”

তীর্থ ও দেবস্থান দেখিয়া ‘জাবর কাটিবার’ উপদেশ

আবার ঈশ্বরের বিশেষ প্রকাশযুক্ত ঐ সকল স্থান দর্শনাদির পর ঠাকুর আমাদিগকে ‘জাবর কাটিতে’ শিক্ষা দিতেন। বলিতেন – “গরু যেমন পেট ভরে জাব খেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে এক জায়গায় বসে সেই সব খাবার উগ্রে ভাল করে চিবাতে বা জাবর কাটতে থাকে, সেই রকম দেবস্থান, তীর্থস্থান দেখবার পর সেখানে যে সব পবিত্র ঈশ্বরীয় ভাব মনে জেগে ওঠে সেই সব নিয়ে একান্তে বসে ভাবতে হয় ও তাইতে ডুবে যেতে হয়; দেখে এসেই সে সব মন থেকে তাড়িয়ে বিষয়ে, রূপ-রসে মন দিতে নাই; তাহলে ঐ ঈশ্বরীয় ভাবগুলি মনে স্থায়ী ফল আনে না।”

কালীঘাটে শ্রীশ্রীজগদম্বাকে দর্শন করিতে ঠাকুরের সঙ্গে একবার আমাদের কেহ কেহ গমন করিয়াছিলেন। পীঠস্থানের বিশেষ প্রকাশ এবং ঠাকুরের শরীর-মনে শ্রীশ্রীজগন্মাতার জীবন্ত প্রকাশ উভয় মিলিত হইয়া ভক্তদিগের প্রাণে যে এক অপূর্ব উল্লাস আনয়ন করিল, তাহা আর বলিতে হইবে না। দর্শনাদি করিয়া প্রত্যাগমনকালে পথিমধ্যে ভক্তদিগের একজনকে বিশেষ অনুরুদ্ধ হইয়া তাঁহার শ্বশুরালয়ে গমন এবং সে রাত্রি তথায় যাপন করিতে হইল। পরদিন তিনি যখন পুনরায় ঠাকুরের নিকট আগমন করিলেন তখন ঠাকুর তাঁহাকে পূর্বরাত্রি কোথায় ছিলেন জিজ্ঞাসা করিলেন এবং তাঁহার পূর্বোক্তরূপে শ্বশুরালয়ে থাকিবার কথা শুনিয়া বলিলেন, “সে কিরে? মাকে দর্শন করে এলি, কোথায় তাঁর দর্শন, তাঁর ভাব নিয়ে জাবর কাটবি, তা না করে রাতটা কিনা বিষয়ীর মতো শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে এলি? দেবস্থান তীর্থস্থান দর্শনাদি করে এসে সেই সব ভাব নিয়ে থাকতে হয়, জাবর কাটতে হয়, তা নইলে ওসব ঈশ্বরীয় ভাব প্রাণে দাঁড়াবে কেন?”

ভক্তিভাব পূর্বে হৃদয়ে আনিয়া তবে তীর্থে যাইতে হয়

আবার ঈশ্বরীয় ভাব ভক্তিভরে হৃদয়ে পূর্ব হইতে পোষণ না করিয়া তীর্থাদিতে যাইলে যে বিশেষ ফল পাওয়া যায় না, সে সম্বন্ধেও ঠাকুর অনেকবার আমাদের বলিয়াছেন। তাঁহার বর্তমানকালে আমাদের অনেকে অনেক সময়ে তীর্থাদিভ্রমণে যাইবার বাসনা প্রকাশ করিতেন। তাহাতে তিনি অনেক সময় আমাদের বলিয়াছেন, “ওরে যার হেথায় আছে, তার সেথায় আছে; যার হেথায় নাই, তার সেথায়ও নাই।”1 আবার বলিতেন – “যার প্রাণে ভক্তিভাব আছে, তীর্থে উদ্দীপনা হয়ে তার সেই ভাব আরও বেড়ে যায়; আর যার প্রাণে ঐ ভাব নেই, তার বিশেষ আর কি হবে? অনেক সময়ে শোনা যায়, অমুকের ছেলে কাশীতে বা অন্য কোথায় পালিয়ে গিয়েছে; তারপর আবার শুনতে পাওয়া যায়, সে সেখানে চেষ্টা-বেষ্টা করে একটা চাকরি যোগাড় করে নিয়ে বাড়িতে চিঠি লিখেছে ও টাকা পাঠিয়েছে! তীর্থে বাস করতে গিয়ে কত লোকে সেখানে আবার দোকান-পাট-ব্যবসা ফেঁদে বসে। মথুরের সঙ্গে পশ্চিমে গিয়ে দেখি, এখানেও যা সেখানেও তাই; এখানকার আমগাছ তেঁতুলগাছ বাঁশঝাড়টি যেমন, সেখানকার সেগুলিও তেমনি। তাই দেখে হৃদুকে বলেছিলাম, ‘ওরে হৃদু, এখানে আর তবে কি দেখতে এলুম রে! সেখানেও যা এখানেও তাই! কেবল, মাঠে-ঘাটের বিষ্ঠাগুলো দেখে মনে হয় এখানকার লোকের হজমশক্তিটা ওদেশের লোকের চেয়ে অধিক’!”2


1. অবতারপুরুষেরা অনেক সময় একইভাবে শিক্ষা দিয়া থাকেন। মহামহিম ঈশা এক সময়ে তাঁহার শিষ্যবর্গকে বলিয়াছিলেন – “To him who hath more, more shall be given and from him who hath little, that little shall be taken away.” অর্থাৎ যাহার অধিক ভক্তি-বিশ্বাস আছে তাহাকে আরও ঐ ভাব দেওয়া হইবে। আর যাহার ভক্তি-বিশ্বাস অল্প তাহার নিকট হইতে সেই অল্পটুকুও কাড়িয়া লওয়া হইবে।
2. ঠাকুর এ কথাগুলি অন্যভাবে বলিয়াছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের বুদ্ধগয়াগমনে তথায় গমনোৎসুক জনৈক ভক্তকে ঠাকুর যাহা বলেন

পূর্বে একস্থানে বলিয়াছি, গলরোগের চিকিৎসার জন্য ভক্তেরা ঠাকুরকে প্রথম কলিকাতায় শ্যামপুকুর নামক পল্লীস্থ একটি ভাড়াটিয়া বাটীতে এবং পরে কলিকাতার কিছু উত্তরে অবস্থিত কাশীপুর নামক স্থানে একটি বাগানবাটীতে আনিয়া রাখিয়াছিলেন। কাশীপুরের বাগানে আসিবার কয়েকদিন পরেই স্বামী বিবেকানন্দ একদিন কাহাকেও কিছু না বলিয়া কহিয়া অপর দুইটি ভ্রাতার সহিত বুদ্ধগয়ায় গমন করেন। সে সময় আমাদের ভিতর ভগবান বুদ্ধদেবের অদ্ভুত জীবন এবং সংসারবৈরাগ্য, ত্যাগ ও তপস্যার আলোচনা দিবারাত্র চলিতেছিল। বাগানবাটীর নিম্নতলের দক্ষিণ দিককার যে ছোট ঘরটিতে আমরা সর্বদা উঠাবসা করিতাম, তাহার দেওয়ালের গায়ে – যতদিন সত্যলাভ না হয় ততদিন একাসনে বসিয়া ধ্যান-ধারণাদি করিব, ইহাতে শরীর যায় যাক – বুদ্ধদেবের এইরূপ দৃঢ়প্রতিজ্ঞাব্যঞ্জক ‘ললিতবিস্তর’-এর একটি শ্লোক লিখিয়া রাখা হইয়াছিল। দিবারাত্র ঐ কথাগুলি চক্ষের সামনে থাকিয়া সর্বদা আমাদের স্মরণ করাইয়া দিত, আমাদেরও সত্যস্বরূপ ঈশ্বরকে লাভের জন্য ঐরূপে প্রাণপাত করিতে হইবে। আমাদেরও –

ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু।
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুৰ্লভাং নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে॥1

– করিতে হইবে। দিবারাত্র ঐরূপ বৈরাগ্যালোচনা করিতে করিতে স্বামীজী সহসা বুদ্ধগয়ায় চলিয়া যাইলেন। কিন্তু কোথায় যাইবেন, কবে ফিরিবেন সে কথা কাহাকেও জানাইলেন না। কাজেই আমাদের কাহারও কাহারও মনে হইল তিনি বুঝি আর সংসারে ফিরিবেন না, আর বুঝি তাঁহাকে আমরা দেখিতে পাইব না! পরে সংবাদ পাওয়া গেল, তিনি গৈরিক ধারণ করিয়া বুদ্ধগয়ায় গিয়াছেন। আমাদের সকলের মন তখন হইতে স্বামীজীর প্রতি এমন বিশেষ আকৃষ্ট যে একদণ্ড তাঁহাকে ছাড়িয়া থাকা বিষম যন্ত্রণাদায়ক, কাজেই মন চঞ্চল হইয়া অনেকের অনুক্ষণ পশ্চিমে স্বামীজীর নিকট যাইবার ইচ্ছা হইতে লাগিল। ক্রমে ঠাকুরের কানেও সে কথা উঠিল। স্বামী ব্রহ্মানন্দ একদিন একজনের ঐ বিষয়ে সঙ্কল্প জানিতে পারিয়া ঠাকুরকে তাহার কথা বলিয়াই দিলেন। ঠাকুর তাহাতে তাহাকে বলিলেন – “কেন ভাবছিস? কোথায় যাবে সে (স্বামীজী)? কদিন বাহিরে থাকতে পারবে? দেখ না এল বলে।” তারপর হাসিতে হাসিতে বলিলেন – “চার খুঁট ঘুরে আয়, দেখবি কোথাও কিছু (যথার্থ ধর্ম) নেই; যা কিছু আছে সব (নিজের শরীর দেখাইয়া) এইখানে!” ‘এইখানে’ – কথাটি ঠাকুর বোধ হয় দুই ভাবে ব্যবহার করিয়াছিলেন, যথা – তাঁহার নিজের ভিতরে ধর্মভাবের, ঈশ্বরীয় ভাবের বর্তমানে যেরূপ বিশেষ প্রকাশ রহিয়াছে সেরূপ আর কোথাও নাই; অথবা প্রত্যেকের নিজের ভিতরেই ঈশ্বর রহিয়াছেন; নিজের ভিতর তাঁহার প্রতি ভক্তি ভালবাসা প্রভৃতি ভাব উদ্দীপিত না করিতে পারিলে বাহিরে নানাস্থানে ঘুরিয়াও কিছুই লাভ হয় না। ঠাকুরের অনেক কথারই এইরূপ দুই বা ততোধিক ভাবের অর্থ পাওয়া যায়। শুধু ঠাকুরের কেন? জগতে যত অবতারপুরুষ যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের সকলের কথাতেই ঐরূপ বহু ভাব পাওয়া যায় এবং মানবসাধারণ যাহার যেরূপ অভিরুচি, যাহার যেরূপ সংস্কার ঐ সকল কথার সেইরূপ অর্থই গ্রহণ করিয়া থাকে। যাঁহাকে সম্বোধন করিয়া ঠাকুর পূর্বোক্ত কথাগুলি বলিলেন, তিনি কিন্তু এক্ষেত্রে ঐগুলির প্রথম অর্থই বুঝিলেন এবং ঠাকুরের ভিতরে ঈশ্বরীয় ভাবের যেরূপ প্রকাশ, এমন আর কুত্রাপি নাই এ কথা দৃঢ় ধারণা করিয়া নিশ্চিত মনে তাঁহার নিকট অবস্থান করিতে লাগিলেন। স্বামী বিবেকানন্দও বাস্তবিক কয়েকদিন পরেই পুনরায় কাশীপুরে ফিরিয়া আসিলেন।


1. ললিতবিস্তর ৯।৫৭।

‘যার হেথায় আছে, তার সেথায় আছে’

পরম ভক্তিমতী জনৈকা স্ত্রী-ভক্তও এক সময়ে ঠাকুরের শরীর রক্ষা করিবার কিছুকাল পূর্বে তাঁহার নিকটে শ্রীবৃন্দাবনে গমন করিয়া কিছুকাল তপস্যাদি করিবার বাসনা প্রকাশ করেন। ঠাকুর সে সময় তাঁহাকে হাত নাড়িয়া বলিয়াছিলেন, “কেন যাবি গো? কি করতে যাবি? যার হেথায় আছে, তার সেথায় আছে – যার হেথায় নাই, তার সেথায়ও নাই।” স্ত্রী-ভক্তটি মনের অনুরাগে তখন ঠাকুরের সে কথা গ্রহণ করিতে না পারিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। কিন্তু সেবার তীর্থে যাইয়া তিনি কোন বিশেষ ফল যে লাভ করিতে পারেন নাই এ কথা আমরা তাঁহার নিকট শ্রবণ করিয়াছি। অধিকন্তু ঠাকুরের সহিতও তাঁহার আর সাক্ষাৎ হইল না, কারণ উহার অল্পকাল পরেই ঠাকুর শরীর-রক্ষা করিলেন।

ঠাকুরের সরল মন তীর্থে যাইয়া কি দেখিবে ভাবিয়াছিল

ভাবময় ঠাকুরের তীর্থে গমন বিশেষ ভাব লইয়া যে হইয়াছিল, এ কথা আমরা তাঁহার নিকট বহুবার শুনিয়াছি। তিনি বলিতেন, “ভেবেছিলাম, কাশীতে সকলে চব্বিশ ঘণ্টা শিবের ধ্যানে সমাধিতে আছে দেখতে পাব; বৃন্দাবনে সকলে গোবিন্দকে নিয়ে ভাবে প্রেমে বিহ্বল হয়ে রয়েছে দেখব। গিয়ে দেখি সবই বিপরীত!” ঠাকুরের অদৃষ্টপূর্ব সরল মন সকল কথা পঞ্চমবর্ষীয় বালকের ন্যায় সরলভাবে গ্রহণ ও বিশ্বাস করিত। আমরা সকল বস্তু ও ব্যক্তিকে সন্দেহের চক্ষে দেখিতেই বাল্যাবধি সংসারে শিক্ষালাভ করিয়াছি; আমাদের ক্রূর মনে সেরূপ বিশ্বাসের উদয় কিরূপে হইবে? কোন কথা সরলভাবে কাহাকেও বিশ্বাস করিতে দেখিলে আমরা তাহাকে বোকা নির্বোধ বলিয়াই ধারণা করিয়া থাকি। ঠাকুরের নিকটেই প্রথমে শুনিলাম, “ওরে, অনেক তপস্যা, অনেক সাধনার ফলে লোকে সরল উদার হয়, সরল না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না; সরল বিশ্বাসীর কাছেই তিনি আপনার স্বরূপ প্রকাশ করেন।” আবার সরল বিশ্বাসী হইতে হইবে শুনিয়া কেহ পাছে বোকা বাঁদর হইতে হইবে ভাবিয়া বসে, এজন্য ঠাকুর বলিতেন, “ভক্ত হবি, তা বলে বোকা হবি কেন?” আবার বলিতেন, “সর্বদা মনে মনে বিচার করবি – কোনটা সৎ কোনটা অসৎ, কোনটা নিত্য কোনটা অনিত্য, আর অনিত্য জিনিসগুলো ত্যাগ করে নিত্য পদার্থে মন রাখবি।”

‘ভক্ত হবি, তা ব’লে বোকা হবি কেন?’ ঠাকুরের যোগানন্দ স্বামীকে ঐ বিষয়ে উপদেশ

ঐ দুই প্রকার কথার সামঞ্জস্য করিতে না পারিয়া আমাদের অনেকে অনেক সময় তাঁহার নিকট তিরস্কৃতও হইয়াছে। স্বামী যোগানন্দ তখন গৃহত্যাগ করেন নাই। বাটীতে একখানি কড়ার আবশ্যক থাকায় বড়বাজারে একদিন একখানি কড়া কিনিয়া আনিতে যাইলেন। দোকানীকে ধর্মভয় দেখাইয়া বলিলেন, “দেখ বাপু, ঠিক ঠিক দাম নিয়ে ভাল জিনিস দিও, ফাটা ফুটো না হয়।” দোকানীও ‘আজ্ঞা মশায় তা দেব বই কি’, ইত্যাদি নানা কথা কহিয়া বাছিয়া বাছিয়া তাঁহাকে একখানি কড়া দিল; তিনি দোকানীর কথায় বিশ্বাস করিয়া উহা আর পরীক্ষা না করিয়াই লইয়া আসিলেন; কিন্তু দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া দেখিলেন, কড়াখানি ফাটা। ঠাকুর সে কথা শুনিয়াই বলিলেন, “সে কি রে? জিনিসটা আনলি, তা দেখে আনলি নি? দোকানী ব্যবসা করতে বসেছে – সে তো আর ধর্ম করতে বসে নি? তার কথায় বিশ্বাস করে ঠকে এলি? ভক্ত হবি, তা বলে বোকা হবি? লোকে তোকে ঠকিয়ে নেবে? ঠিক ঠিক জিনিস দিলে কি না দেখে তবে দাম দিবি; ওজনে কম দিলে কি না তা দেখে নিবি; আবার যে সব জিনিসের ফাউ পাওয়া যায় সে সব জিনিস কিনতে গিয়ে ফাউটি পর্যন্ত ছেড়ে আসবি নি।” ঐরূপ আরও অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে, কিন্তু ইহা তাহার স্থান নহে। এখানে আমরা ঠাকুরের অদৃষ্টপূর্ব সরলতার সহিত অদ্ভুত বিচারশীলতার কথাটির উল্লেখমাত্র করিয়াই পূর্বানুসরণ করি।

কাশীবাসীদিগের বিষয়ানুরাগদর্শনে ঠাকুর – ‘মা, তুই আমাকে এখানে কেন আনলি?’

ঠাকুরের নিকট শুনিয়াছি এই তীর্থভ্রমণোপলক্ষে মথুর লক্ষ মুদ্রারও অধিক ব্যয় করিয়াছিলেন। মথুর কাশীতে আসিয়াই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণকে প্রথমে মাধুকরী দেন; পরে একদিন তাঁহাদিগকে সপরিবারে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়া পরিতোষপূর্বক ভোজন, প্রত্যেককে এক একখানি বস্ত্র ও এক এক টাকা দক্ষিণা দেন; আবার শ্রীবৃন্দাবন দর্শন করিয়া এখানে পুনরাগমন করিয়া ঠাকুরের আজ্ঞায় একদিন ‘কল্পতরু’ হইয়া তৈজস, বস্ত্র, কম্বল, পাদুকা প্রভৃতি নিত্য আবশ্যকীয় ব্যবহার্য পদার্থসকলের মধ্যে যে যাহা চাহিয়াছিল তাহাকে তাহাই দান করেন। মাধুকরী দিবার দিনেই ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদিগের মধ্যে বিবাদ গণ্ডগোল, এমন কি পরস্পরে মারামারি পর্যন্ত হইয়া যাইতে দেখিয়া ঠাকুরের মনে বিষম বিরাগ উপস্থিত হয় এবং বারাণসীতেও ইতরসাধারণকে অপর সকল স্থানের ন্যায় এইরূপে কামকাঞ্চনে রত থাকিতে দেখিয়া তাঁহার মনে একপ্রকার হতাশ ভাব আসিয়াছিল। তিনি সজলনয়নে শ্রীশ্রীজগদম্বাকে বলিয়াছিলেন, “মা, তুই আমাকে এখানে কেন আনলি? এর চেয়ে দক্ষিণেশ্বরে যে আমি ছিলাম ভাল।”

ঠাকুরের ‘স্বর্ণময়ী কাশী’-দর্শন

এইরূপে সাধারণের ভিতর বিষয়ানুরাগ প্রবল দেখিয়া ব্যথিত হইলেও এখানে অদ্ভুত দর্শনাদি হইয়া ঠাকুরের শিব-মহিমা এবং কাশীর মাহাত্ম্য সম্বন্ধে দৃঢ় ধারণা হইয়াছিল। নৌকাযোগে বারাণসী প্রবেশকাল হইতেই ঠাকুর ভাব-নয়নে দেখিতে থাকেন শিবপুরী বাস্তবিকই সুবর্ণে নির্মিত – বাস্তবিকই ইহাতে মৃত্তিকা প্রস্তরাদির একান্ত অভাব – বাস্তবিকই যুগ-যুগান্তর ধরিয়া সাধু-ভক্তগণের কাঞ্চনতুল্য সমুজ্জ্বল, অমূল্য হৃদয়ের ভাবরাশি স্তরে স্তরে পুঞ্জীকৃত ও ঘনীভূত হইয়া ইহার বর্তমান আকারে প্রকাশ। সেই জ্যোতির্ময় ভাবঘন মূর্তিই ইহার নিত্য সত্য রূপ – আর বাহিরে যাহা দেখা যায় সেটা তাহারই ছায়ামাত্র।

কাশীকে ‘সুবর্ণ-নির্মিত’ কেন বলে?

স্থূল দৃষ্টিসহায়েও ‘সুবর্ণ-নির্মিত বারাণসী’ কথাটির একটা মোটামুটি অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে বিশেষ চেষ্টার আবশ্যক হয় না। কাশীর অসংখ্য মন্দির ও সৌধাবলী, কাশীর প্রস্তর-বাঁধানো ক্রোশাধিকব্যাপী গঙ্গাতট ও বিস্তীর্ণ-সোপানাবলী-সমন্বিত অগণিত স্নানের ঘাট, কাশীর প্রস্তর-মণ্ডিত তোরণ-ভূষিত অসংখ্য পথ, পয়ঃ-প্রণালী, বাপী, তড়াগ, কূপ, মঠ ও উদ্যানবাটিকা এবং সর্বোপরি কাশীর ব্রাহ্মণ, বিদ্যার্থী, সাধু ও দরিদ্রগণের পোষণার্থ অসংখ্য অন্নসত্রসকল দেখিয়া কে না বলিবে বহু প্রাচীনকাল হইতে ভারতের সর্বপ্রদেশ মিলিত হইয়া অজস্র সুবর্ণ-বর্ষণেই এ বিচিত্র শিবপুরী নির্মাণ করিয়াছে? ভারতের প্রায় ত্রিশ কোটি হৃদয়ের ভক্তিভাব এতকাল ধরিয়া এইরূপে এই নগরীতে যে সমভাবে মিলিত থাকিয়া ইহার এইরূপ বহিঃপ্রকাশ আনয়ন করিতেছে, এ কথা ভাবিয়া কাহার মন না স্তম্ভিত হইবে? কে না বিপুল ভাবপ্রবাহের অদম্য বেগ দেখিয়া মোহিত এবং উহার উৎপত্তিনির্ণয় করিতে যাইয়া আত্মহারা হইবে? কে না বিস্মিত হইয়া ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে অবনত মস্তকে বলিবে – এ সৃষ্টি বাস্তবিকই অতুলনীয়, বাস্তবিকই ইহা মনুষ্যকৃত নহে, বাস্তবিকই অসহায় জীবের প্রতি দীনশরণ আর্তৈকত্রাণ শ্রীবিশ্বনাথের অপার করুণাই ইহার জন্ম দিয়াছে এবং তাঁহার সাক্ষাৎ শক্তিই শ্রীঅন্নপূর্ণারূপে এখানে চিরাধিষ্ঠিতা থাকিয়া অন্নবিতরণে জীবের অন্নময় ও প্রাণময় এবং আধ্যাত্মিক ভাববিতরণে তাহার মনোময়, বিজ্ঞানময় ও আনন্দময় শরীরের পূর্ণ পুষ্টিবিধান করিতেছেন এবং দ্রুতপদে তাহাকে মুক্তি বা শ্রীবিশ্বনাথের সহিত ঐকাত্ম্যবোধে আনয়ন করিতেছেন! ভাবমুখে অবস্থিত ঠাকুর এখানে আগমনমাত্রেই যে ঐ দিব্য হেমময় ভাবপ্রবাহ শিবপুরীর সর্বত্র ওতপ্রোতভাবে পরিব্যাপ্ত দেখিতে পাইবেন এবং উহারই জমাট প্রকাশ-রূপে এ নগরীকে সুবর্ণময় বলিয়া উপলব্ধি করিবেন, ইহাতে আর বিচিত্র কি?

স্বর্ণময় কাশী দেখিয়া ঠাকুরের ঐ স্থান অপবিত্র করিতে ভয়

প্রকাশশীল পদার্থমাত্রই হিন্দুর নয়নে সত্ত্বগুণ-প্রসূত ও পবিত্র। আলোক হইতে পদার্থসকলের প্রকাশ, সেজন্য আলোক বা উজ্জ্বলতা আমাদের নিকট পবিত্র; দেবতার নিকট জ্যোৎপ্রদীপ1 রাখা, দেবদেবীর সম্মুখে দীপ নির্বাণ না করা, এই সকল শাস্ত্র-নিয়ম হইতেই আমরা এ কথা বুঝিতে পারি। এজন্যই বোধ হয় আবার উজ্জ্বলপ্রকাশযুক্ত সুবর্ণাদি পদার্থসকলকে পবিত্র বলিয়া দেখিবার, শরীরের অধোভাগে সুবর্ণালঙ্কার-ধারণ না করিবার বিধিসমূহের উৎপত্তি। বারাণসী সর্বদা সুবর্ণময় দেখিতে পাইয়া শৌচাদি করিয়া সুবর্ণকে অপবিত্র করিতে হইবে বলিয়া বালকস্বভাব ঠাকুর প্রথম প্রথম ভাবিয়া আকুল হইয়াছিলেন। তাঁহার শ্রীমুখে শুনিয়াছি, এজন্য তিনি মথুরকে বলিয়া পালকির বন্দোবস্ত করিয়া কয়েকদিন অসীর পারে গমন ও তথায় (বারাণসীর বাহিরে) শৌচাদি সারিয়া আসিতেন। পরে ঐ ভাবের বিরামে আর ঐরূপ করিতে হইত না।


1. জাগ প্রদীপ।

কাশীতে মরিলেই জীবের মুক্তি হওয়া সম্বন্ধে ঠাকুরের মণিকর্ণিকায় দর্শন

কাশীতে আর একটি বিশেষ দর্শনের কথা আমরা ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছিলাম। বারাণসীর মণিকর্ণিকাদি পঞ্চতীর্থ দর্শন করিতে অনেকেই গঙ্গাবক্ষে নৌকাযোগে যাইয়া থাকেন। মথুরও ঠাকুরকে সঙ্গে লইয়া তদ্রূপে গমন করিয়াছিলেন। মণিকর্ণিকার পাশেই কাশীর প্রধান শ্মশানভূমি। মথুরের নৌকা যখন মণিকর্ণিকা ঘাটের সম্মুখে আসিল তখন দেখা গেল শ্মশান চিতাধূমে ব্যাপ্ত – শবদেহসকল সেখানে দাহ হইতেছে। ভাবময় ঠাকুর সহসা সেদিকে দেখিয়াই একেবারে আনন্দে উৎফুল্ল ও রোমাঞ্চিতকলেবর হইয়া নৌকার বাহিরে ছুটিয়া আসিলেন এবং একেবারে নৌকার কিনারায় দাঁড়াইয়া সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন। মথুরের পাণ্ডা ও নৌকার মাঝি-মাল্লারা লোকটি জলে পড়িয়া স্রোতে ভাসিয়া যাইবে ভাবিয়া ঠাকুরকে ধরিতে ছুটিল। কিন্তু কাহাকেও আর ধরিতে হইল না; দেখা গেল ঠাকুর ধীর স্থির নিশ্চেষ্টভাবে দণ্ডায়মান আছেন এবং এক অদ্ভুত জ্যোতিঃ ও হাস্যে তাঁহার মুখমণ্ডল সমুদ্ভাসিত হইয়া যেন সে স্থানটিকে শুদ্ধ জ্যোতির্ময় করিয়া তুলিয়াছে। মথুর ও ঠাকুরের ভাগিনেয় হৃদয় সাবধানে ঠাকুরের নিকট দাঁড়াইয়া রহিলেন, মাঝি-মাল্লারাও বিস্ময়পূর্ণনয়নে ঠাকুরের অদ্ভুত ভাব দূরে দাঁড়াইয়া নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। কতক্ষণ পরে ঠাকুরের সে দিব্য ভাবের বিরাম হইলে সকলে মণিকর্ণিকায় নামিয়া স্নানদানাদি যাহা করিবার করিয়া পুনরায় নৌকাযোগে অন্যত্র গমন করিলেন।

তখন ঠাকুর তাঁহার সেই অদ্ভুত দর্শনের কথা মথুর প্রভৃতিকে বলিতে লাগিলেন। বলিলেন, “দেখিলাম পিঙ্গলবর্ণ জটাধারী দীর্ঘাকার এক শ্বেতকায় পুরুষ গম্ভীর পাদবিক্ষেপে শ্মশানে প্রত্যেক চিতার পার্শ্বে আগমন করিতেছেন এবং প্রত্যেক দেহীকে সযত্নে উত্তোলন করিয়া তাহার কর্ণে তারক-ব্রহ্মমন্ত্র প্রদান করিতেছেন! – সর্বশক্তিময়ী শ্রীশ্রীজগদম্বাও স্বয়ং মহাকালীরূপে জীবের অপর পার্শ্বে সেই চিতার উপর বসিয়া তাহার স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ প্রভৃতি সকল প্রকার সংস্কার-বন্ধন খুলিয়া দিতেছেন এবং নির্বাণের দ্বার উন্মুক্ত করিয়া স্বহস্তে তাহাকে অখণ্ডের ঘরে প্রেরণ করিতেছেন। এইরূপ বহুকল্পের যোগ-তপস্যায় যে অদ্বৈতানুভবের ভূমানন্দ জীবের আসিয়া উপস্থিত হয় তাহা তাহাকে শ্রীবিশ্বনাথ সদ্য সদ্য প্রদান করিয়া কৃতার্থ করিতেছেন।”

মথুরের সঙ্গে যে সকল শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন তাঁহারা ঠাকুরের পূর্বোক্ত দর্শনের কথা শুনিয়া বলিয়াছিলেন – “কাশীখণ্ডে মোটামুটিভাবে লেখা আছে, এখানে মৃত্যু হইলে ৺বিশ্বনাথ জীবকে নির্বাণপদবী দিয়া থাকেন; কিন্তু কি ভাবে যে উহা দেন তাহা সবিস্তার লেখা নাই। আপনার দর্শনেই স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে উহা কিরূপে সম্পাদিত হয়। আপনার দর্শনাদি শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ কথারও পারে চলিয়া যায়।”

ঠাকুরের ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে দর্শন

কাশীতে অবস্থানকালে ঠাকুর এখানকার খ্যাতনামা সাধুদেরও দর্শন করিতে যান। তন্মধ্যে ত্রৈলঙ্গ স্বামীজীকে দেখিয়াই তাঁহার বিশেষ প্রীতি হইয়াছিল। স্বামীজীর অনেক কথা ঠাকুর অনেক সময় আমাদিগকে বলিতেন। বলিতেন, “দেখিলাম সাক্ষাৎ বিশ্বনাথ তাঁহার শরীরটা আশ্রয় করে প্রকাশিত হয়ে রয়েছেন! তাঁর থাকায় কাশী উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে! উঁচু জ্ঞানের অবস্থা! শরীরের কোন হুঁশই নেই; রোদে বালি এমনি তেতেছে যে পা দেয় কার সাধ্য – সেই বালির ওপরেই সুখে শুয়ে আছেন! পায়েস রেঁধে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দিয়েছিলাম। তখন কথা কন না – মৌনী। ইশারায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘ঈশ্বর এক না অনেক?’ তাতে ইশারা করে বুঝিয়ে দিলেন – ‘সমাধিস্থ হয়ে দেখ তো এক; নইলে যতক্ষণ আমি, তুমি, জীব, জগৎ ইত্যাদি নানা জ্ঞান রয়েছে ততক্ষণ অনেক।’ তাঁকে দেখিয়ে হৃদেকে বলেছিলাম, ‘একেই ঠিক ঠিক পরমহংস অবস্থা বলে’।”

শ্রীবৃন্দাবনে ‘বাঁকাবিহারী’-মূর্তি ও ব্রজ-দর্শনে ঠাকুরের ভাব

কাশীতে কিছুকাল থাকিয়া ঠাকুর মথুরবাবুর সহিত বৃন্দাবনে গমন করেন। শুনিয়াছি বাঁকাবিহারী মূর্তি দর্শন করিয়া তথায় তাঁহার অদ্ভুত ভাবাবেশ হইয়াছিল – আত্মহারা হইয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন করিতে ছুটিয়া গিয়াছিলেন! আবার সন্ধ্যাকালে রাখাল বালকগণ গরুর পাল লইয়া যমুনা পার হইয়া গোষ্ঠ হইতে ফিরিতেছে দেখিতে দেখিতে তাহাদের ভিতর শিখিপুচ্ছধারী নবনীরদশ্যাম গোপালকৃষ্ণের দর্শনলাভ করিয়া তিনি প্রেমে বিভোর হইয়াছিলেন। ঠাকুর এখানে নিধুবন, গোবর্ধন প্রভৃতি ব্রজের কয়েকটি স্থানও দর্শন করিতে যান। ব্রজের এই সকল স্থান তাঁহার বৃন্দাবন অপেক্ষা অধিক ভাল লাগিয়াছিল এবং ব্রজেশ্বরী শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণকে নানাভাবে দর্শন করিয়া এই সকল স্থানেই তাঁহার বিশেষ প্রেমের উদয় হইয়াছিল। শুনিয়াছি গোবর্ধনাদি দর্শন করিতে যাইবার কালে মথুর তাঁহাকে পালকিতে পাঠাইয়া দেন এবং দেবস্থানে ও দরিদ্রদিগকে দান করিতে করিতে যাইবেন বলিয়া পালকির এক পার্শ্বে একখানি বস্ত্র বিছাইয়া তাহার উপর টাকা আধুলি সিকি দু-আনি ইত্যাদি কাঁড়ি করিয়া ঢালিয়া দিয়াছিলেন; কিন্তু ঐ সকল স্থানে যাইতে যাইতেই ঠাকুর ভাবে প্রেমে এতদূর বিহ্বল হইয়া পড়েন যে ঐ সকল আর হাতে করিয়া তুলিয়া দান করিতে পারেন নাই! অগত্যা ঐ বস্ত্রের এক কোণ ধরিয়া টানিয়া ঐ সকল স্থানে স্থানে দরিদ্রদিগের ভিতর ছড়াইতে ছড়াইতে গিয়াছিলেন।

ব্রজে ঠাকুরের বিশেষ প্রীতি

ব্রজের এই সকল স্থানে ঠাকুর সংসারবিরাগী অনেক সাধককে কুপের1 ভিতর পশ্চাৎ ফিরিয়া বসিয়া বাহিরের সকল বিষয় হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া জপ-ধ্যানে নিমগ্ন থাকিতে দেখিয়াছিলেন। ব্রজের প্রাকৃতিক শোভা, ফল-ফুলে শোভিত ক্ষুদ্র গিরি-গোবর্ধন, মৃগ ও শিখিকুলের বনমধ্যে যথা তথা নিঃশঙ্ক বিচরণ, সাধু-তপস্বীদের নিরন্তর ঈশ্বরের চিন্তায় দিনযাপন এবং সরল ব্রজবাসীদের কপটতাশূন্য সশ্রদ্ধ ব্যবহার ঠাকুরের চিত্ত বিশেষভাবে আকৃষ্ট করিয়াছিল; তাহার উপর নিধুবনে সিদ্ধপ্রেমিকা বর্ষীয়সী তপস্বিনী গঙ্গামাতার দর্শন ও মধুর সঙ্গ লাভ করিয়া ঠাকুর এতই মোহিত হইয়াছিলেন যে, তাঁহার মনে হইয়াছিল ব্রজ ছাড়িয়া তিনি আর কোথাও যাইবেন না; এখানেই জীবনের অবশিষ্ট কাল কাটাইয়া দিবেন।


1. বাঁশ-খড়ে তৈয়ারি একজন মাত্র লোকের বাসোপযোগী ঘরকে এখানে কুপ বলে। একটি মোচার অগ্রভাগ কাটিয়া জমির উপর বসাইয়া রাখিলে যেরূপ দেখিতে হয় কুপও দেখিতে তদ্রূপ।

নিধুবনের গঙ্গামাতা; ঠাকুরের ঐ স্থানে থাকিবার ইচ্ছা; পরে বুড়ো মার সেবা কে করিবে ভাবিয়া কলিকাতায় ফিরা

গঙ্গামাতার তখন প্রায় ষষ্টি বর্ষ বয়ঃক্রম হইবে। বহুকাল ধরিয়া ব্রজেশ্বরী শ্রীমতী রাধা ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাঁহার প্রেমবিহ্বল ব্যবহার দেখিয়া এখানকার লোকে তাঁহাকে শ্রীরাধার প্রধানা সঙ্গিনী ললিতা সখী কোন কারণবশতঃ স্বয়ং দেহ ধারণ করিয়া জীবকে প্রেমশিক্ষা দিবার নিমিত্ত অবতীর্ণা বলিয়া মনে করিত। ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছি ইনি দর্শনমাত্রেই ধরিতে পারিয়াছিলেন, ঠাকুরের শরীরে শ্রীমতী রাধিকার ন্যায় মহাভাবের প্রকাশ, এবং সেজন্য ইনি ঠাকুরকে শ্রীমতী রাধিকাই স্বয়ং অবতীর্ণা ভাবিয়া ‘দুলালী’ বলিয়া সম্বোধন করিয়াছিলেন। ‘দুলালী’র এইরূপ অযত্ন-লভ্য দর্শন পাইয়া গঙ্গামাতা আপনাকে ধন্য জ্ঞান করিয়াছিলেন এবং ভাবিয়াছিলেন তাঁহার এতকালের হৃদয়ের সেবা ও ভালবাসা আজ সফল হইল! ঠাকুরও তাঁহাকে পাইয়া চিরপরিচিতের ন্যায় তাঁহারই আশ্রমে সকল কথা ভুলিয়া কিছুকাল অবস্থান করিয়াছিলেন। শুনিয়াছি ইঁহারা উভয়ে পরস্পরের প্রেমে এতই মোহিত হইয়াছিলেন যে, মথুর প্রভৃতির মনে ভয় হইয়াছিল ঠাকুর বুঝি আর তাঁহাদের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে ফিরিবেন না! পরম অনুগত মথুরের মন এ ভাবনায় যে কিরূপ আকুল হইয়াছিল তাহা আমরা বেশ অনুমান করিতে পারি। যাহা হউক, ঠাকুরের মাতৃভক্তিই পরিশেষে জয়লাভ করিল এবং তাঁহার ব্রজে থাকিবার সঙ্কল্প পরিবর্তন করিয়া দিল। ঠাকুর এ সম্বন্ধে আমাদের বলিয়াছিলেন, “ব্রজে গিয়ে সব ভুল হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল আর ফিরব না। কিন্তু কিছুদিন বাদে মার কথা মনে পড়ল, মনে হলো তাঁর কত কষ্ট হবে, কে তাঁকে বুড়ো বয়সে দেখবে, সেবা করবে। ঐ কথা মনে উঠায় আর সেখানে থাকতে পারলুম না।”

ঠাকুরের জীবনে পরস্পরবিরুদ্ধ ভাব ও গুণসকলের অপূর্ব সম্মিলন; সন্ন্যাসী হইয়াও ঠাকুরের মাতৃসেবা

বাস্তবিক যতই ভাবিয়া দেখা যায়, এ অলৌকিক পুরুষের সকল কথা ও চেষ্টা ততই অদ্ভুত বলিয়া প্রতীত হয়, ততই আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর বিরুদ্ধ গুণসকলের ইঁহাতে অপূর্বভাবে সম্মিলন দেখিয়া মুগ্ধ হইতে হয়। দেখ না, শ্রীশ্রীজগদম্বার পাদপদ্মে শরীর-মন সর্বস্ব অর্পণ করিলেও ঠাকুর সত্যটি তাঁহাকে দিতে পারিলেন না, জগতের সকল ব্যক্তির সহিত লৌকিক সম্বন্ধ ত্যাগ করিয়াও নিজ জননীর প্রতি ভালবাসা ও কর্তব্যটি ভুলিতে পারিলেন না, পত্নীর সহিত শারীরিক সম্বন্ধের নামগন্ধ কোনকালে না রাখিলেও গুরুভাবে তাঁহার সহিত সর্বকালে সপ্রেম সম্বন্ধ রাখিতে বিস্মৃত হইলেন না; ঠাকুরের এইরূপ অলৌকিক চেষ্টার কতই না দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে! পূর্ব পূর্ব যুগের কোন্ আচার্য বা অবতারপুরুষের জীবনে এইরূপ অদ্ভুত বিপরীত চেষ্টার একত্র সমাবেশ ও সামঞ্জস্য দেখিতে পাওয়া যায়? কে না বলিবে এরূপ আর কখনও কোথায়ও দেখা যায় নাই? ঈশ্বরাবতার বলিয়া ইঁহাকে ধারণা করুক আর নাই করুক, কে না স্বীকার করিবে এরূপ দৃষ্টান্ত আধ্যাত্মিক জগতে আর একটিও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না? ঠাকুরের বর্ষীয়সী মাতাঠাকুরানী জীবনের শেষ কয়েক বৎসর দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটেই বাস করিতেন এবং তাঁহার সকল প্রকার সেবা-শুশ্রূষা ঠাকুর নিজ হস্তে নিত্য সম্পাদন করিয়া আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করিতেন – এ কথা আমরা ঠাকুরের শ্রীমুখে বহুবার শ্রবণ করিয়াছি। আবার সেই আরাধ্যা মাতার যখন দেহান্ত হইল তখন ঠাকুরকে শোকসন্তপ্ত হইয়া এতই কাতর ও অজস্র অশ্রুবর্ষণ করিতে দেখা গিয়াছিল যে, সংসারে বিরল কাহাকেও কাহাকেও ঐরূপ করিতে দেখা যায়! মাতৃবিয়োগে ঐরূপ কাতর হইলেও কিন্তু তিনি যে সন্ন্যাসী, এ কথা ঠাকুর এক ক্ষণের জন্যও বিস্মৃত হন নাই। সন্ন্যাসী হওয়ায় মাতার ঔর্ধ্বদেহিক ও শ্রাদ্ধাদি করিবার নিজের অধিকার নাই বলিয়া ভ্রাতুষ্পুত্র রামলালের দ্বারা উহা সম্পাদিত করাইয়াছিলেন এবং স্বয়ং বিজনে বসিয়া মাতার নিমিত্ত রোদন করিয়াই মাতৃঋণের যথাসম্ভব পরিশোধ করিয়াছিলেন। ঐ সম্বন্ধে ঠাকুর আমাদের কতদিন বলিয়াছিলেন, “ওরে, সংসারে বাপ মা পরম গুরু; যতদিন বেঁচে আছেন যথাশক্তি উঁহাদের সেবা করতে হয়, আর মরে গেলে যথাসাধ্য শ্রাদ্ধ করতে হয়; যে দরিদ্র, কিছু নেই, শ্রাদ্ধ করবার ক্ষমতা নেই, তাকেও বনে গিয়ে তাঁদের স্মরণ করে কাঁদতে হয়; তবে তাঁদের ঋণশোধ হয়! কেবলমাত্র ঈশ্বরের জন্য বাপ মার আজ্ঞা লঙ্ঘন করা চলে, তাতে দোষ হয় না; যেমন প্রহ্লাদ বাপ বললেও কৃষ্ণনাম নিতে ছাড়েনি; এমনকি, ধ্রুব মা বারণ করলেও তপস্যা করতে বনে গিয়েছিলেন; তাতে তাঁদের দোষ হয়নি।” এইরূপে ঠাকুরের মাতৃভক্তির ভিতর দিয়াও গুরুভাবের অদ্ভুত বিকাশ ও লোকশিক্ষা দেখিয়া আমরা ধন্য হইয়াছি।

সমাধিস্থ হইয়া শরীরত্যাগ হইবে ভাবিয়া ঠাকুরের গয়াধামে যাইতে অস্বীকার; ঐরূপ ভাবের কারণ কি?

গঙ্গামাতার নিকট হইতে কষ্টে বিদায়গ্রহণ করিয়া ঠাকুর মথুরের সহিত পুনরায় কাশীতে প্রত্যাগমন করেন। আমরা শুনিয়াছি কয়েকদিন সেখানে থাকিবার পরে দীপান্বিতা অমাবস্যার দিনে শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণা দেবীর সুবর্ণপ্রতিমা দর্শন করিয়া ঠাকুর ভাবে প্রেমে মোহিত হইয়াছিলেন। কাশী হইতে গয়াধামে যাইবার মথুরের ইচ্ছা হইয়াছিল। কিন্তু ঠাকুর সেখানে যাইতে অমত করায় মথুর সে সঙ্কল্প পরিত্যাগ করেন। ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছি ঠাকুরের পিতা গয়াধামে আগমন করিয়াই ঠাকুর যে তাঁহার গৃহে জন্মগ্রহণ করিবেন একথা স্বপ্নে জানিতে পারিয়াছিলেন এবং এইজন্যই জন্মিবার পর তাঁহার নাম গদাধর রাখিয়াছিলেন। গয়াধামে গদাধরের পাদপদ্মদর্শনে প্রেমে বিহ্বল হইয়া তাঁহা হইতে পৃথকভাবে নিজ শরীরধারণের কথা পাছে একেবারে ভুলিয়া যান এবং তাঁহার সহিত চিরকালের নিমিত্ত পুনরায় সম্মিলিত হন – এই ভয়েই ঠাকুর যে এখন মথুরের সহিত গয়ায় যাইতে অমত করিয়াছিলেন, এ কথাও তিনি কখনও কখনও আমাদিগকে বলিয়াছেন। ঠাকুরের ধ্রুব ধারণা ছিল, যিনিই পূর্ব পূর্ব যুগে শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীগৌরাঙ্গ প্রভৃতি রূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, তিনিই এখন তাঁহার শরীর আশ্রয় করিয়া ধরায় আগমন করিয়াছেন। সেজন্য, পূর্বোক্ত পিতৃস্বপ্নে পরিজ্ঞাত নিজ বর্তমান শরীরমনের উৎপত্তিস্থল গয়াধাম, এবং যে যে স্থলে অন্য অবতারপুরুষেরা লীলাসংবরণ করিয়াছিলেন সেই সেই স্থান দর্শন করিতে যাইবার কথায় তাঁহার মনে কেমন একটা অব্যক্ত ভাবের সঞ্চার হইতে দেখিয়াছি। ঠাকুর বলিতেন, ঐ সকল স্থানে যাইলে তাঁহার শরীর থাকিবে না, এমন গভীর সমাধিস্থ হইবেন যে তাহা হইতে তাঁহার মন আর নিম্নে মনুষ্যলোকে ফিরিয়া আসিবে না! কারণ শ্রীগৌরাঙ্গদেবের লীলাসংবরণ-স্থল নীলাচল বা ৺পুরীধামে যাইবার কথাতেও ঠাকুর ঐরূপ ভাব অন্য সময়ে প্রকাশ করিয়াছিলেন। শুধু তাঁহার নিজের সম্বন্ধে কেন, ভক্তদের কাহাকেও যদি তিনি ভাব-নয়নে কোন দেববিশেষের অংশ বা বিকাশ বলিয়া বুঝিতে পারিতেন তবে ঐ দেবতার বিশেষ লীলাস্থলে যাইবার বিষয়ে তাঁহার সম্বন্ধেও ঐরূপ ভাব প্রকাশ করিয়া তাহাকে তথায় যাইতে নিষেধ করিতেন। ঠাকুরের ঐ ভাবটি পাঠককে বুঝানো দুরূহ। উহাকে ‘ভয়’ বলিয়া নির্দেশ করাটা যুক্তিসঙ্গত নহে; কারণ সামান্য সমাধিমান পুরুষেরাই যখন দেহী কিরূপে মৃত্যুকালে শরীরটা ছাড়িয়া যায় জীবৎকালেই তাহার অনুভব করিয়া মৃত্যুকে কৌমার যৌবনাদি দেহের পরিবর্তন-সকলের ন্যায় একটা পরিবর্তনবিশেষ বলিয়া দেখিতে পাইয়া নির্ভয় হইয়া থাকেন, তখন ইচ্ছামাত্রেই গভীরসমাধিমান অবতারপুরুষেরা যে একেবারে অভীঃ মৃত্যুঞ্জয় হইয়া থাকেন ইহাতে আর বিচিত্র কি? উহাকে ইতরসাধারণের ন্যায় শরীরটা রক্ষা করিবার বা বাঁচিবার আগ্রহও বলিতে পারি না। কারণ, ইতরসাধারণে যে ঐরূপ আগ্রহ প্রকাশ করে সেটা স্বার্থসুখ বা ভোগের জন্য। কিন্তু যাঁহাদের মন হইতে স্বার্থপরতা চিরকালের মতো ধুইয়া পুঁছিয়া গিয়াছে তাঁহাদের সম্বন্ধে আর ও কথা খাটে না। তবে ঠাকুরের মনের পূর্বোক্ত ভাব আমরা কেমন করিয়া বুঝাইব? আমাদের অভিধানে, আমাদের মনে যে সকল ভাব উঠে তাহাই বুঝাইবার, প্রকাশ করিবার উপযোগী শব্দসমূহ পাওয়া যায়। ঠাকুরের ন্যায় মহাপুরুষদিগের মনের অত্যুচ্চ দিব্য ভাবসকল প্রকাশ করিবার সে সকল শব্দের সামর্থ্য কোথায়? অতএব হে পাঠক, এখানে তর্কবুদ্ধি ছাড়িয়া দিয়া ঠাকুর ঐ সকল বিষয় যে ভাবে বলিয়া যাইতেন তাহা বিশ্বাসের সহিত শুনিয়া যাওয়া এবং কল্পনাসহায়ে ঐ উচ্চ ভাবের যথাসম্ভব ছবি মনে অঙ্কিত করিবার চেষ্টা করা ভিন্ন আমাদের আর গত্যন্তর নাই।

কার্য-পদার্থের কারণ-পদার্থে লয় হওয়াই নিয়ম

ঠাকুর বলিতেন এবং শাস্ত্রেও ইহার নানা দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যে, যে প্রকাশ যেখান হইতে বা যে বস্তু বা ব্যক্তি হইতে উৎপন্ন হয়, সেই প্রকাশ পুনরায় সেই স্থলে বা সেই বস্তু বা ব্যক্তির বিশেষ সমীপাগত হইলে তাহাতেই লয় হইয়া যায়। ব্রহ্ম হইতে জীবের উৎপত্তি বা প্রকাশ; সেই জীব আবার জ্ঞানলাভ দ্বারা তাঁহার সমীপাগত হইলেই তাঁহাতে লীন হইয়া যায়! অনন্ত মন হইতে তোমার আমার ও সকলের ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত মনের উৎপত্তি বা প্রকাশ; আমাদের ভিতর কাহারও সেই ক্ষুদ্র মন নির্লিপ্ততা, করুণা, পবিত্রতা প্রভৃতি সদ্গুণসমূহের বৃদ্ধি করিতে করিতে সেই অনন্ত মনের সমীপাগত বা সদৃশ হইলেই তাহাতে লীন হইয়া যায়। স্থূল জগতেও ইহাই নিয়ম। সূর্য হইতে পৃথিবীর বিকাশ; সেই পৃথিবী আবার কোনরূপে সূর্যের সমীপাগত হইলেই তাহাতে লীন হইয়া যাইবে। অতএব বুঝিতে হইবে ঠাকুরের ঐরূপ ধারণার নিম্নে আমাদের অজ্ঞাত কি একটা ভাববিশেষ আছে এবং বাস্তবিক যদি ৺গদাধর বলিয়া কোন বস্তু বা ব্যক্তিবিশেষ থাকেন এবং ঠাকুরের শরীর-মনটার উৎপত্তি ও বিকাশ তাঁহা হইতে কোন কারণে হইয়া থাকে, তবে ঐ উভয় পদার্থ পুনরায় সমীপাগত হইলে যে পরস্পরের প্রতি প্রেমে আকৃষ্ট হইয়া একত্র মিলিত হইবে, এ কথায় যুক্তিবিরুদ্ধই বা কি আছে?

অবতারপুরুষদিগের জীবন-রহস্যের মীমাংসা করিতে কর্মবাদ সক্ষম নহে; উহার কারণ

অবতারপুরুষেরা যে ইতরসাধারণ জীবের ন্যায় নহেন, এ কথা আর যুক্তিতর্ক দ্বারা বুঝাইতে হয় না। তাঁহাদের ভিতর অচিন্ত্য কল্পনাতীত শক্তিপ্রকাশ দেখিয়াই জীব অবনত মস্তকে তাঁহাদিগকে হৃদয়ের পূজাদান ও তাঁহাদের শরণ গ্রহণ করিয়া থাকে। মহর্ষি কপিলাদি ভারতের তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন দার্শনিকগণ ঐরূপ অদৃষ্টপূর্ব শক্তিমান পুরুষদিগের জীবনরহস্য ভেদ করিবার অশেষ চেষ্টা করিয়াছেন। কি কারণে তাঁহাদের ভিতর দিয়া ইতরসাধারণাপেক্ষা সমধিক শক্তিপ্রকাশ হয়, এ বিষয়ে নির্ণয় করিতে যাইয়া তাঁহারা প্রথমেই দেখিলেন সাধারণ কর্মবাদ ইহার মীমাংসায় সম্পূর্ণ অক্ষম। কারণ, ইতরসাধারণ পুরুষের অনুষ্ঠিত শুভাশুভ কর্ম স্বার্থসুখান্বেষণেই হইয়া থাকে। কিন্তু ইঁহাদের কৃত কার্যের আলোচনায় দেখা যায়, সে উদ্দেশ্যের একান্তাভাব। পরের দুঃখমোচনের বাসনাই ইঁহাদের ভিতর অদম্য উৎসাহ আনয়ন করিয়া ইঁহাদিগকে কার্যে প্রেরণ করিয়া থাকে এবং সে বাসনার সম্মুখে ইঁহারা নিজের সমস্ত ভোগসুখ এককালে বলি প্রদান করিয়া থাকেন। আবার পার্থিব মানযশলাভ যে ঐ বাসনার মূলে বর্তমান তাহাও দেখা যায় না। কারণ লোকৈষণা, পার্থিব মানযশ ইঁহারা কাকবিষ্ঠার ন্যায় সর্বথা পরিত্যাগ করিয়া থাকেন। দেখ না, নর ও নারায়ণ ঋষিদ্বয় বহুকাল বদরিকাশ্রমে তপস্যায় কাটাইলেন, জগতের কল্যাণোপায়-নির্ধারণের জন্য। শ্রীরামচন্দ্র প্রাণের প্রতিমা সীতাকে পর্যন্ত ত্যাগ করিলেন প্রজাদিগের কল্যাণের জন্য। শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যেক কার্যানুষ্ঠান করিলেন সত্য ও ধর্মের প্রতিষ্ঠার জন্য। বুদ্ধদেব রাজ্যসম্পদ ত্যাগ করিলেন জন্ম-জরা-মরণাদি দুঃখের হস্ত হইতে জীবকে উদ্ধার করিবেন বলিয়া। ঈশা প্রাণপাত করিলেন দুঃখশোকাকুল পৃথিবীতে প্রেম-স্বরূপ পরমপিতার প্রেমের রাজ্যস্থাপনার জন্য। মহম্মদ অধর্মের বিরুদ্ধেই তরবারি ধারণ করিলেন। শঙ্কর, অদ্বৈতানুভবেই যথার্থ শান্তি, জীবকে এ কথা বুঝাইতেই আপন শক্তি নিয়োগ করিলেন এবং শ্রীচৈতন্য, একমাত্র শ্রীহরির নামেই জীবের কল্যাণকারী সমস্ত শক্তি নিহিত রহিয়াছে জানিয়া সংসারের ভোগসুখে জলাঞ্জলি দিয়া উদ্দাম তাণ্ডবে হরিনাম-প্রচারেই জীবনোৎসর্গ করিলেন। কোন্ স্বার্থ ইঁহাদিগকে ঐ সকল কার্যে প্রেরণ করিয়াছিল? কোন্ আত্মসুখ-লাভের জন্য ইঁহারা জীবনে এত কষ্ট স্বীকার করিয়া গিয়াছেন?

মুক্তাত্মার শাস্ত্রনির্দিষ্ট লক্ষণসকল অবতারপুরুষে বাল্যকালাবধি প্রকাশ দেখিয়া দার্শনিকগণের মীমাংসা; সাংখ্য-মতে তাঁহারা ‘প্রকৃতি-লীন’-শ্রেণীভুক্ত

দার্শনিকগণ আরও দেখিলেন, অসাধারণ মানসিক অনুভবে মুক্তপুরুষদিগের শরীরে যে সমস্ত লক্ষণ আসিয়া উপস্থিত হয় বলিয়া তাঁহারা শাস্ত্র-দৃষ্টে স্বীকার করিয়া থাকেন, সে সমস্তও ইঁহাদের জীবনে বিশেষভাবে বিকশিত। কাজেই ঐ সকল পুরুষদিগকে বাধ্য হইয়াই এক নূতন শ্রেণীর অন্তর্গত করিতে হইল। সাংখ্যকার কপিল বলিলেন, ইঁহাদের ভিতর এক প্রকার মহদুদার লোকৈষণা বা লোককল্যাণ-বাসনা থাকে। সেজন্য ইঁহারা পূর্ব পূর্ব জন্মের তপস্যাপ্রভাবে মুক্ত হইয়াও নির্বাণপদবীতে অবস্থান করেন না – প্রকৃতিতে লীন হইয়া থাকেন, বা প্রকৃতিগত সমস্ত শক্তিই তাঁহাদের শক্তি, এই প্রকার বোধে এক কল্পকাল অবস্থান করিয়া থাকেন; এবং এজন্যই ইঁহাদের মধ্যে যিনি যে কল্পে ঐরূপ শক্তিসম্পন্ন বলিয়া আপনাকে অনুভব করেন তিনিই সে কল্পে অপর সাধারণ মানবের নিকট ঈশ্বর বলিয়া প্রতীত হন। কারণ প্রকৃতির ভিতর যত কিছু শক্তি আছে সে সমস্তই আমার বলিয়া যাঁহার বোধ হইবে তিনি সে সমস্ত শক্তিই ইচ্ছামতো প্রয়োগ ও সংহার করিতে পারিবেন। আমাদের প্রত্যেকের ক্ষুদ্র শরীর-মনে প্রকৃতির যে সকল শক্তি রহিয়াছে সে সকলকে আমার বলিয়া বোধ করিতেছি বলিয়াই আমরা যেমন উহাদের ব্যবহার করিতে পারিতেছি, তাঁহারাও তদ্রূপ প্রকৃতির সমস্ত শক্তিসমূহ তাঁহাদের আপনার বলিয়া বোধ করায় সে সমস্তই ইচ্ছামতো ব্যবহার করিতে পারিবেন। সাংখ্যকার কপিল এইরূপে সর্বকালব্যাপী এক নিত্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করিলেও এককল্পব্যাপী সর্বশক্তিমান পুরুষসকলের অস্তিত্ব স্বীকার করিয়া তাঁহাদিগকে ‘প্রকৃতিলীন’ আখ্যা প্রদান করিয়াছেন।

বেদান্ত বলেন, তাঁহারা ‘আধিকারিক’ এবং ঐ শ্রেণীর পুরুষদিগের ঈশ্বরাবতার ও নিত্যমুক্ত ঈশ্বরকোটীরূপ দুই বিভাগ আছে

বেদান্তকার আবার একমাত্র ঈশ্বরপুরুষের নিত্য অস্তিত্ব স্বীকার করিয়া এবং তিনিই জীব ও জগৎরূপে প্রকাশিত রহিয়াছেন বলিয়া ঐ সকল বিশেষ শক্তিমান পুরুষদিগকে নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-স্বভাব ঈশ্বরের বিশেষ অংশসম্ভূত বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। শুধু তাহাই নহে, এইরূপ পুরুষেরা লোককল্যাণকর এক একটি বিশেষ কার্যের জন্যই আবশ্যকমত জন্মগ্রহণ করেন এবং তদুপযোগী শক্তিসম্পন্নও হইয়া আসেন দেখিয়া ইঁহাদিগকে ‘আধিকারিক’ নাম প্রদান করিয়াছেন। ‘আধিকারিক’ অর্থাৎ কোন একটি কার্যবিশেষের অধিকার বা সেই কার্যটি সম্পন্ন করিবার ভার ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত। এইরূপ পুরুষসকলেও আবার উচ্চাবচ শক্তির প্রকাশ দেখিয়া এবং ইঁহাদের কাহারও কার্য সমগ্র পৃথিবীর সকল লোকের সর্বকাল কল্যাণের জন্য অনুষ্ঠিত ও কাহারও কার্য একটি প্রদেশের বা তদন্তর্গত একটি দেশের লোকসমূহের কল্যাণের জন্য অনুষ্ঠিত দেখিয়া বেদান্তকার আবার এই সকল পুরুষের ভিতর কতকগুলিকে ঈশ্বরাবতার এবং কতকগুলিকে সামান্য-অধিকারপ্রাপ্ত নিত্যমুক্ত ঈশ্বরকোটি পুরুষশ্রেণীর বলিয়া স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। বেদান্তকারের ঐ মতকে ভিত্তিরূপে অবলম্বন করিয়াই পুরাণকারেরা পরে কল্পনাসহায়ে অবতার-পুরুষদিগের প্রত্যেকে কে কতটা ঈশ্বরের অংশসম্ভূত ইহা নির্ধারণ করিতে অগ্রসর হইয়া ঐ চেষ্টার একটু বাড়াবাড়ি করিয়া বসিয়াছেন এবং ভাগবতকার –

এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম্। – ১।৩।২৮

ইত্যাদি বচন প্রয়োগ করিয়াছেন।

আমরা ইতঃপূর্বে পাঠককে একস্থলে বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছি যে গুরুভাবটি স্বয়ং ঈশ্বরেরই ভাব। অজ্ঞানমোহে পতিত জীবকে উহার পারে স্বয়ং যাইতে অক্ষম দেখিয়া তিনিই অপার করুণায় তাহাকে উহা হইতে উদ্ধার করিতে আগ্রহবান হন। ঈশ্বরের সেই করুণাপূর্ণ আগ্রহ এবং তদ্ভাবাপন্ন হইয়া চেষ্টাদিই শ্রীগুরু ও গুরুভাব। ইতরসাধারণ মানবের ধরিবার বুঝিবার সুবিধার জন্য সেই গুরুভাব কখনও কখনও বিশেষ বিশেষ নরাকারে আমাদের নিকট আবহমানকাল হইতে প্রকাশিত হইয়া আসিতেছে। সেই সকল পুরুষকেই জগৎ অবতার বলিয়া পূজা করিতেছে। অতএব বুঝা যাইতেছে, অবতারপুরুষেরাই মানবসাধারণের যথার্থ গুরু।

আধিকারিক পুরুষদিগের শরীর-মন সাধারণ মানবাপেক্ষা ভিন্ন উপাদানে গঠিত; সেজন্য তাঁহাদের সঙ্কল্প ও কার্য সাধারণাপেক্ষা বিভিন্ন ও বিচিত্র

আধিকারিক পুরুষদিগের শরীর-মন সেজন্য এমন উপাদানে গঠিত দেখা যায় যে, তাহাতে ঐশ্বরিক ভাব-প্রেম ও উচ্চাঙ্গের শক্তিপ্রকাশ ধারণ ও হজম করিবার সামর্থ থাকে। জীব এতটুকু আধ্যাত্মিক শক্তি ও লোকমান্য পাইলেই অহঙ্কৃত ও আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠে; আধিকারিক পুরুষেরা ঐ সকল শক্তি তদপেক্ষা সহস্র সহস্র গুণে অধিক পরিমাণে পাইলেও কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ বা বুদ্ধিভ্রষ্ট ও অহঙ্কৃত হন না। জীব সকল প্রকার বন্ধন হইতে বিমুক্ত হইয়া সমাধিতে আত্মানুভবের পরম আনন্দ একবার কোনরূপে পাইলে আর সংসারে কোন কারণেই ফিরিতে চাহে না, আধিকারিক পুরুষদিগের জীবনে সে আনন্দ যেমনি অনুভব হয়, অমনি মনে হয় অপর সকলকে কি উপায়ে এ আনন্দের ভাগী করিতে পারি। জীবের ঈশ্বর-দর্শনের পরে আর কোন কার্যই থাকে না। আধিকারিক পুরুষদিগের সেই দর্শনলাভের পরেই, যে বিশেষ কার্য করিবার জন্য তাঁহারা আসিয়াছেন তাহা ধরিতে বুঝিতে পারেন এবং সেই কার্য করিতে আরম্ভ করেন। সেজন্য আধিকারিক পুরুষদিগের সম্বন্ধে নিয়মই এই যে, যতদিন না তাঁহারা যে কার্যবিশেষ করিতে আসিয়াছেন তাহা সমাপ্ত করেন, ততদিন পর্যন্ত তাঁহাদের মনে সাধারণ মুক্তপুরুষদিগের মতো ‘শরীরটা এখনি যায় যাক, ক্ষতি নাই’, এরূপ ভাবের উদয় কখনো হয় না – মনুষ্যলোকে বাঁচিয়া থাকিবার আগ্রহই দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁহাদের ঐ আগ্রহে ও জীবের বাঁচিয়া থাকিবার আগ্রহে আকাশ-পাতাল প্রভেদ বর্তমান দেখিতে পাওয়া যায়। আবার কার্য শেষ হইলেই আধিকারিক পুরুষ উহা তৎক্ষণাৎ বুঝিতে পারেন এবং আর তিলার্ধও সংসারে না থাকিয়া পরম আনন্দে সমাধিতে দেহত্যাগ করেন। জীবের ইচ্ছামাত্রেই সমাধিতে শরীরত্যাগ তো দূরের কথা – জীবনের কার্য যে শেষ হইয়াছে এইরূপ উপলব্ধিই হয় না, এ জীবনে অনেক বাসনা পূর্ণ হইল না এইরূপ উপলব্ধিই হইয়া থাকে। অন্য সকল বিষয়েও তদ্রূপ প্রভেদ থাকে। সেইজন্যই আমাদের মাপকাঠিতে অবতার বা আধিকারিক পুরুষদিগের জীবন ও কার্যের উদ্দেশ্য মাপিতে যাইয়া আমাদিগকে বিষম ভ্রমে পতিত হইতে হয়।

‘গয়ায় যাইলে শরীর থাকিবে না’, ‘জগন্নাথে যাইলে চিরসমাধিস্থ হইবেন’ – ঠাকুরের এই সকল কথাগুলির ভাব কিঞ্চিন্মাত্রও হৃদয়ঙ্গম করিতে হইলে শাস্ত্রের পূর্বোক্ত কথাগুলি পাঠকের কিছু কিছু জানা আবশ্যক। এজন্যই আমরা যত সহজে পারি সংক্ষেপে উহার আলোচনা এখানে করিলাম। ঠাকুরের কোন ভাবটিই যে শাস্ত্রবিরুদ্ধ নহে, পূর্বোক্ত আলোচনায় পাঠক ইহাও বুঝিতে পারিবেন।

পূর্বেই বলিয়াছি ঠাকুর মথুরের সহিত ৺গয়াধামে যাইতে অস্বীকার করেন। কাজেই সে যাত্রায় কাহারও আর গয়াদর্শন হইল না। বৈদ্যনাথ হইয়া কলিকাতায় সকলে প্রত্যাগমন করিলেন। বৈদ্যনাথের নিকটবর্তী কোন গ্রামের লোকসকলের দারিদ্র্য দেখিয়াই ঠাকুরের হৃদয় করুণাপূর্ণ হয় এবং মথুরকে বলিয়া তাহাদের পরিতোষপূর্বক একদিন খাওয়াইয়া প্রত্যেককে এক একখানি বস্ত্র প্রদান করেন। এ কথার বিস্তারিত উল্লেখ আমরা লীলাপ্রসঙ্গে পূর্বেই একস্থলে করিয়াছি।1


1. গুরুভাব – পূর্বার্ধ, সপ্তম অধ্যায়ের শেষভাগ দেখ।

ঠাকুরের নবদ্বীপ-দর্শন

কাশী বৃন্দাবনাদি তীর্থ ভিন্ন ঠাকুর একবার মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের জন্মস্থল নবদ্বীপ দর্শন করিতেও গমন করিয়াছিলেন; সেবারেও মথুরবাবু তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া যান। শ্রীগৌরাঙ্গদেবের সম্বন্ধে ঠাকুর আমাদের এক সময়ে যাহা বলিয়াছিলেন তাহা হইতেই বেশ বুঝা যায় যে, অবতারপুরুষদিগের মনের সম্মুখেও সকল সময় সকল সত্য প্রকাশিত থাকে না। তবে আধ্যাত্মিক জগতের যে বিষয়ের তত্ত্ব তাঁহারা জানিতে বুঝিতে ইচ্ছা করেন, অতি সহজেই তাহা তাঁহাদের মন-বুদ্ধির গোচর হইয়া থাকে।

ঠাকুরের চৈতন্য মহাপ্রভু সম্বন্ধে পূর্বমত এবং নবদ্বীপে দর্শনলাভে ঐ মতের পরিবর্তন

শ্রীগৌরাঙ্গের অবতারত্ব সম্বন্ধে আমাদের ভিতর অনেকেই তখন সন্দিহান ছিলেন, এমনকি ‘বৈষ্ণব’ অর্থে ‘ছোটলোক’ এই কথাই বুঝিতেন এবং সন্দেহ-নিরসনের নিমিত্ত ঠাকুরকে অনেক সময় ঐ বিষয় জিজ্ঞাসাও করিয়াছিলেন। ঠাকুর তদুত্তরে একদিন আমাদের বলিয়াছিলেন, “আমারও তখন তখন ঐ রকম মনে হতো রে, ভাবতুম পুরাণ ভাগবত কোথাও কোন নামগন্ধ নেই – চৈতন্য আবার অবতার! ন্যাড়া-নেড়ীরা টেনে বুনে একটা বানিয়েছে আর কি! – কিছুতেই ও কথা বিশ্বাস হতো না। মথুরের সঙ্গে নবদ্বীপ গেলুম। ভাবলুম, যদি অবতারই হয় তো সেখানে কিছু না কিছু প্রকাশ থাকবে, দেখলে বুঝতে পারব। একটু প্রকাশ (দেবভাবের) দেখবার জন্য এখানে ওখানে বড় গোসাঁইয়ের বাড়ি, ছোট গোসাঁইয়ের বাড়ি, ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখে বেড়ালুম – কোথাও কিছু দেখতে পেলুম না! – সব জায়গাতেই এক এক কাঠের মুরদ হাত তুলে খাড়া হয়ে রয়েছে দেখলুম! দেখে প্রাণটা খারাপ হয়ে গেল; ভাবলুম, কেনই বা এখানে এলুম। তারপর ফিরে আসব বলে নৌকায় উঠছি এমন সময়ে দেখতে পেলুম অদ্ভুত দর্শন! দুটি সুন্দর ছেলে – এমন রূপ কখনো দেখিনি, তপ্ত কাঞ্চনের মতো রং, কিশোর বয়স, মাথায় একটা করে জ্যোতির মণ্ডল, হাত তুলে আমার দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে আকাশপথ দিয়ে ছুটে আসচে! অমনি ‘ঐ এলোরে, এলোরে’ বলে চেঁচিয়ে উঠলুম। ঐ কথাগুলি বলতে না বলতে তারা নিকটে এসে (নিজের শরীর দেখাইয়া) এর ভেতর ঢুকে গেল, আর বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলুম! জলেই পড়তুম, হৃদে নিকটে ছিল, ধরে ফেললে। এই রকম এই রকম ঢের সব দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলে – বাস্তবিকই অবতার, ঐশ্বরিক শক্তির বিকাশ!” ঠাকুর ‘ঢের সব দেখিয়ে’ কথাগুলি এখানে ব্যবহার করিলেন, কারণ পূর্বেই একদিন শ্রীগৌরাঙ্গদেবের নগর-সঙ্কীর্তন-দর্শনের কথা আমাদের নিকট গল্প করিয়াছিলেন। সে দর্শনের কথা আমরা লীলাপ্রসঙ্গে অন্যত্র উল্লেখ করিয়াছি বলিয়া এখানে আর করিলাম না।1


1. সপ্তম অধ্যায়ের পূর্বভাগ দেখ।

ঠাকুরের কালনায় গমন

পূর্বোক্ত তীর্থসকল ভিন্ন ঠাকুর আর একবার মথুরবাবুর সহিত কালনা গমন করিয়াছিলেন। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের পাদস্পর্শে বাংলার গঙ্গাতীরবর্তী অনেকগুলি গ্রাম যে তীর্থবিশেষ হইয়া উঠিয়াছে, তাহা আর বলিতে হইবে না। কালনা তাহাদেরই ভিতর অন্যতম। আবার বর্ধমান রাজবংশের অষ্টাধিকশত শিব-মন্দির প্রভৃতি নানা কীর্তি এখানে বর্তমান থাকিয়া কালনাকে একটি বেশ জম-জমাট স্থান যে করিয়া তুলিয়াছে এ কথা দর্শনকারীমাত্রেই অনুভব করিয়াছেন। ঠাকুরের কিন্তু এবার কালনা দর্শন করিতে যাওয়ার ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। এখানকার খ্যাতনামা সাধু ভগবানদাস বাবাজীকে দর্শন করাই তাঁহার মনোগত অভিপ্রায় ছিল।

ভগবানদাস বাবাজীর ত্যাগ, ভক্তি ও প্রতিপত্তি

ভগবানদাস বাবাজীর তখন অশীতি বৎসরেরও অধিক বয়ঃক্রম হইবে। তিনি কোন্ কুল পবিত্র করিয়াছিলেন তাহা আমাদের জানা নাই। কিন্তু তাঁহার জ্বলন্ত ত্যাগ, বৈরাগ্য ও ভগবদ্ভক্তির কথা বাংলার আবালবৃদ্ধ অনেকেরই তখন শ্রুতিগোচর হইয়াছিল। শুনিয়াছি একস্থানে একভাবে বসিয়া দিবারাত্র জপ-তপ-ধ্যান-ধারণাদি করায় শেষদশায় তাঁহার পদদ্বয় অসাড় ও অবশ হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু অশীতিবর্ষেরও অধিকবয়স্ক হইয়া শরীর অপটু ও প্রায় উত্থান-শক্তিরহিত হইলেও বৃদ্ধ বাবাজীর হরিনামে উদ্দাম উৎসাহ, ভগবৎপ্রেমে অজস্র অশ্রুবর্ষণ ও আনন্দ কিছুমাত্র না কমিয়া বরং দিন দিন বর্ধিতই হইয়াছিল। এখানকার বৈষ্ণবসমাজ তাঁহাকে পাইয়া তখন বিশেষ সজীব হইয়া উঠিয়াছিল এবং ত্যাগী বৈষ্ণব-সাধুগণের অনেকে তাঁহার উজ্জ্বল আদর্শ ও উপদেশে নিজ নিজ জীবন গঠিত করিয়া ধন্য হইবার অবসর পাইয়াছিলেন। শুনিয়াছি বাবাজীর দর্শনে যিনিই তখন যাইতেন, তিনিই তাঁহার বহুকালানুষ্ঠিত ত্যাগ, তপস্যা, পবিত্রতা ও ভক্তির সঞ্চিত প্রভাব প্রাণে প্রাণে অনুভব করিয়া এক অপূর্ব আনন্দের উপলব্ধি করিয়া আসিতেন। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের প্রেমধর্মসম্বন্ধীয় কোন বিষয়ে বাবাজী যে মতামত প্রকাশ করিতেন তাহাই তখন লোকে অভ্রান্ত সত্য বলিয়া ধারণা করিয়া তদনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইত। কাজেই সিদ্ধ বাবাজী তখন কেবল নিজের সাধনাতেই ব্যস্ত থাকিতেন না কিন্তু বৈষ্ণবসমাজের কিসে কল্যাণ হইবে, কিসে ত্যাগী বৈষ্ণবগণ ঠিক ঠিক ত্যাগের অনুষ্ঠানে ধন্য হইবে, কিসে ইতরসাধারণ সংসারী জীব শ্রীচৈতন্য-প্রদর্শিত প্রেমধর্মের আশ্রয়ে আসিয়া শান্তিলাভ করিবে – এ সকলের আলোচনা ও অনুষ্ঠানে অনেককাল কাটাইতেন। বৈষ্ণবসমাজের কোথায় কি হইতেছে, কোথায় কোন্ সাধু ভাল বা মন্দ আচরণ করিতেছে – সকল কথাই লোকে বাবাজীর নিকট আনিয়া উপস্থিত করিত এবং তিনিও সে সকল শুনিয়া বুঝিয়া তত্তৎ বিষয়ে যাহা করা উচিত তাহার উপদেশ করিতেন। ত্যাগ, তপস্যা ও প্রেমের জগতে চিরকালই কি যে এক অদৃশ্য সুদৃঢ় বন্ধন! লোকে বাবাজীর উপদেশ শিরোধার্য করিয়া তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পাদন করিতে স্বতঃপ্রেরিত হইয়া ছুটিত। এইরূপে গুপ্তচরাদি সহায় না থাকিলেও সিদ্ধ বাবাজীর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি বৈষ্ণবসমাজের সর্বত্রানুষ্ঠিত কার্যেই পতিত হইত এবং ঐ সমাজগত প্রত্যেক ব্যক্তিই তাঁহার প্রভাব অনুভব করিত। আর, সে দৃষ্টি ও প্রভাবের সম্মুখে সরল বিশ্বাসীর উৎসাহ যেমন দিন দিন বর্ধিত হইয়া উঠিত, কপটাচারী আবার তেমনি ভীত কুণ্ঠিত হইয়া আপন স্বভাব-পরিবর্তনের চেষ্টা পাইত।

ঠাকুরের তপস্যাকালে ভারতে ধর্মান্দোলন

অনুরাগের তীব্র প্রেরণায় ঠাকুর যখন ঈশ্বরলাভের জন্য দ্বাদশ বর্ষব্যাপী কঠোর তপস্যায় লাগিয়াছিলেন এবং তাহাতে গুরুভাবের অদৃষ্টপূর্ব বিকাশ হইতেছিল, তখন উত্তর ভারতবর্ষের অনেক স্থলেই ধর্মের একটা বিশেষ আন্দোলন যে চলিয়াছিল এ কথার উল্লেখ আমরা লীলাপ্রসঙ্গের অন্য স্থলে করিয়াছি।1 কলিকাতা ও তন্নিকটবর্তী নানাস্থানের হরিসভাসকল এবং ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন, উত্তর-পশ্চিম ও পঞ্জাব অঞ্চলে শ্রীযুত দয়ানন্দ স্বামীজীর বেদধর্মের আন্দোলন – যাহা এখন আর্যসমাজে পরিণত হইয়াছে, বাংলায় বিশুদ্ধ বৈদান্তিক ভাবের, কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ও রাধাস্বামী মতের, গুজরাতে নারায়ণ স্বামী মতের2 – এইরূপে নানা স্থলে নানা ধর্মমতের উৎপত্তি ও আন্দোলন এই সময়েরই কিছু অগ্র-পশ্চাৎ উপস্থিত হইয়াছিল। ঐ আন্দোলনের সবিস্তার আলোচনা এখানে আমাদের উদ্দেশ্য নয়; কেবল কলিকাতার কলুটোলা নামক পল্লীতে প্রতিষ্ঠিত ঐরূপ একটি হরিসভায় ঠাকুরকে লইয়া যে ঘটনা হইয়াছিল তাহাই এখানে আমরা পাঠককে বলিব।


1. পঞ্চম অধ্যায় দেখ।
2. বর্তমানে “স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়” নামে পরিচিত। অপর নাম “উদ্ধব সম্প্রদায়”। ইঁহাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ “শিক্ষাপত্রী”, “স্বামিনি বাতোঁ” ও “বচনামৃত”। প্রধান কেন্দ্র গুজরাতের আহমেদাবাদ ও বড়তাল নগরীদ্বয়। ইঁহারা শ্রীরামানুজাচার্য-প্রবর্তিত বিশিষ্টাদ্বৈতমতের সন্ন্যাসী ও শ্রীরামানুজাচার্য-আশীর্বাদধন্য। – ২১ অক্টোবর ২০১৮, সঙ্কলক।

ঠাকুরের কলুটোলার হরিসভায় গমন

ঠাকুর নিমন্ত্রিত হইয়া একদিন ঐ হরিসভায় উপস্থিত হইয়াছিলেন; ভাগিনেয় হৃদয় তাঁহার সঙ্গে গিয়াছিল। কেহ কেহ বলেন, পণ্ডিত বৈষ্ণবচরণ – যাঁহার কথা আমরা পূর্বে পাঠককে বলিয়াছি – সেদিন সেখানে শ্রীমদ্ভাগবতপাঠে ব্রতী ছিলেন এবং তাঁহার মুখ হইতে ভাগবত শুনিবার জন্যই ঠাকুর তথায় গমন করিয়াছিলেন; এ কথা কিন্তু আমরা ঠাকুরের শ্রীমুখ হইতে শুনিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। সে যাহাই হউক, ঠাকুর যখন সেখানে উপস্থিত হইলেন তখন ভাগবতপাঠ হইতেছিল এবং উপস্থিত সকলে তন্ময় হইয়া সেই পাঠ শ্রবণ করিতেছিল। ঠাকুরও তদ্দর্শনে শ্রোতৃমণ্ডলীর ভিতর একস্থানে উপবিষ্ট হইয়া পাঠ শুনিতে লাগিলেন।

ঐ সভায় ভাগবত পাঠ

কলুটোলার হরিসভার সভ্যগণ আপনাদিগকে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের একান্ত পদাশ্রিত মনে করিতেন এবং ঐ কথাটি অনুক্ষণ স্মরণ রাখিবার জন্য তাঁহারা একখানি আসন বিস্তৃত রাখিয়া উহাতে মহাপ্রভুর আবির্ভাব কল্পনা করিয়া পূজা, পাঠ প্রভৃতি সভার সমুদয় অনুষ্ঠান ঐ আসনের সম্মুখেই করিতেন। ঐ আসন ‘শ্রীচৈতন্যের আসন’ বলিয়া নির্দিষ্ট হইত। সকলে ভক্তিভরে উহার সম্মুখে প্রণাম করিতেন এবং উহাতে কাহাকেও কখনও বসিতে দিতেন না। অন্য সকল দিবসের ন্যায় আজও পুষ্পমাল্যাদি-ভূষিত ঐ আসনের সম্মুখেই ভাগবতপাঠ হইতেছিল। পাঠক শ্রীশ্রীমহাপ্রভুকেই হরিকথা শুনাইতেছেন ভাবিয়া ভক্তিভরে পাঠ করিতেছিলেন এবং শ্রোতৃবৃন্দও তাঁহারই দিব্যাবিৰ্ভাবের সম্মুখে বসিয়া হরিকথামৃত পান করিয়া ধন্য হইতেছি ভাবিয়া উল্লসিত হইতেছিলেন। ঠাকুরের আগমনে শ্রোতা ও পাঠকের সে উল্লাস ও ভক্তিভাব যে শতগুণে সজীব হইয়া উঠিল, ইহা আর বলিতে হইবে না।

ঠাকুরের ‘চৈতন্যাসন’-গ্রহণ

ভাগবতের অমৃতোপম কথা শুনিতে শুনিতে ঠাকুর আত্মহারা হইয়া পড়িলেন এবং ‘শ্রীচৈতন্যাসন’-এর অভিমুখে সহসা ছুটিয়া যাইয়া তাহার উপর দাঁড়াইয়া এমন গভীর সমাধিমগ্ন হইলেন যে তাঁহাতে আর কিছুমাত্র প্রাণসঞ্চার লক্ষিত হইল না! কিন্তু তাঁহার জ্যোতির্ময় মুখের সেই অদৃষ্টপূর্ব প্রেমপূর্ণ হাসি এবং শ্রীচৈতন্যদেবের মূর্তিসকলে যেমন দেখিতে পাওয়া যায় সেইপ্রকার ঊর্ধ্বোত্তোলিত হস্তে অঙ্গুলিনির্দেশ দেখিয়া বিশিষ্ট ভক্তেরা প্রাণে প্রাণে বুঝিলেন ঠাকুর ভাবমুখে শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর সহিত একেবারে তন্ময় হইয়া গিয়াছেন! তাঁহার শরীর-মন এবং ভগবান শ্রীশ্রীচৈতন্যের শরীর-মনের মধ্যে স্থূলদৃষ্টে দেশকাল এবং অন্য নানা বিষয়ের বিস্তর ব্যবধান যে রহিয়াছে, ভাবমুখে ঊর্ধ্বে উঠিয়া সে বিষয়ের কিছুমাত্র প্রত্যক্ষই তিনি আর তখন করিতেছেন না। পাঠক পাঠ ভুলিয়া ঠাকুরের দিকে চাহিয়া স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন; শ্রোতারাও ঠাকুরের ঐরূপ ভাবাবেশ ধরিতে বুঝিতে না পারিলেও একটা অব্যক্ত দিব্য ভয়-বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া মুগ্ধ শান্ত হইয়া রহিলেন, ভাল-মন্দ কোন কথাই সে সময়ে কেহ আর বলিতে সমর্থ হইলেন না। ঠাকুরের প্রবল ভাবপ্রবাহে সকলেই তৎকালের নিমিত্ত অবশ হইয়া অনির্দেশ্য কোন এক প্রদেশে যেন ভাসিয়া চলিয়াছেন – এইরূপ একটা অনির্বচনীয় আনন্দের উপলব্ধি করিয়া প্রথম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া রহিলেন, পরে ঐ অব্যক্তভাব-প্রেরিত হইয়া সকলে মিলিয়া উচ্চরবে হরিধ্বনি করিয়া নামসঙ্কীর্তন আরম্ভ করিলেন। সমাধিতত্ত্বের আলোচনার1 পূর্বে একস্থলে আমরা বলিয়াছি যে, ঈশ্বরের যে নামবিশেষের ভিতর অনন্ত দিব্য ভাবরাশির উপলব্ধি করিয়া মন সমাধিলীন হয়, সেই নামাবলম্বনেই আবার সে নিম্নে নামিয়া বহির্জগতের উপলব্ধি করিয়া থাকে – ঠাকুরের দিব্য সঙ্গে আমরা প্রত্যহ বারংবার ইহা বিশেষভাবে দেখিয়াছি। এখনও তাহাই হইল; সঙ্কীর্তনে হরিনাম শ্রবণ করিতে করিতে ঠাকুরের নিজশরীরের কতকটা হুঁশ আসিল এবং ভাবে প্রেমে বিভোর অবস্থায় কীর্তনসম্প্রদায়ের সহিত মিলিত হইয়া তিনি কখনও উদ্দাম মধুর নৃত্য করিতে লাগিলেন, আবার কখনও বা ভাবের আতিশয্যে সমাধিমগ্ন হইয়া স্থির নিশ্চেষ্টভাবে অবস্থান করিতে লাগিলেন। ঠাকুরের ঐরূপ চেষ্টায় উপস্থিত সাধারণের ভিতর উৎসাহ শতগুণে বাড়িয়া উঠিয়া সকলেই কীর্তনে উন্মত্ত হইয়া উঠিল। তখন ‘শ্রীচৈতন্যের আসন’ ঠাকুরের ঐরূপে অধিকার করাটা ন্যায়সঙ্গত বা অন্যায় হইয়াছে, এ কথার বিচার আর করে কে? এইরূপে উদ্দাম তাণ্ডবে বহুক্ষণ শ্রীহরির ও শ্রীমহাপ্রভুর গুণাবলীকীর্তনের পর সকলে জয়ধ্বনি উচ্চারণ করিয়া সেদিনকার সে দিব্য অভিনয় সাঙ্গ করিলেন এবং ঠাকুরও অল্পক্ষণ পরেই সেখান হইতে দক্ষিণেশ্বরে প্রত্যাগমন করিলেন।


1. গুরুভাব – পূর্বার্ধ, সপ্তম অধ্যায় দেখ।

ঐরূপ করায় বৈষ্ণবসমাজে আন্দোলন

ঠাকুরের দিব্যপ্রভাবে হরিনামতাণ্ডবে উচ্চভাবপ্রবাহে উঠিয়া কিছুক্ষণের জন্য মানবের দোষদৃষ্টি স্তব্ধীভূত হইয়া থাকিলেও তাঁহার সেখান হইতে চলিয়া আসিবার পর আবার সকলে পূর্বের ন্যায় ‘পুনর্মূষিক’ভাব প্রাপ্ত হইল। বাস্তবিক, জ্ঞানকে উপেক্ষা করিয়া কেবলমাত্র ভক্তিসহায়ে ঈশ্বরপথে অগ্রসর হইতে যে সকল ধর্ম শিক্ষা দেয়, তাহাদের উহাই দোষ। ঐ সকল ধর্মপথের পথিকগণ শ্রীহরির নামসঙ্কীর্তনাদি-সহায়ে কিছুক্ষণের জন্য আধ্যাত্মিকভাবের উচ্চ আনন্দাবস্থায় অতি সহজে উঠিলেও পরক্ষণেই আবার তেমনি নিম্নে নামিয়া পড়েন। উহাতে তাঁহাদের বিশেষ দোষ নাই; কারণ উত্তেজনার পর অবসাদ আসাটা প্রকৃতির অন্তর্গত শরীর ও মনের ধর্ম। তরঙ্গের পরেই ‘গোড়’, উত্তেজনার পরেই অবসাদ আসাটাই প্রকৃতির নিয়ম। হরিসভার সভ্যগণও উচ্চ ভাবপ্রবাহের অবসাদে এখন নিজ নিজ পূর্বপ্রকৃতি ও সংস্কারের বশবর্তী হইয়া ঠাকুরের ক্রিয়াকলাপের সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইলেন! এক দল ঠাকুরের ভাবমুখে ‘শ্রীচৈতন্যাসন’ ঐরূপে গ্রহণ করার পক্ষ সমর্থন করিতে এবং অন্য দল ঐ কার্যের তীব্র প্রতিবাদে নিযুক্ত হইলেন। উভয় দলে ঘোরতর দ্বন্দ্ব ও বাকবিতণ্ডা উপস্থিত হইল, কিন্তু কিছুই মীমাংসা হইল না।

চৈতন্যাসন-গ্রহণের কথা শুনিয়া ভগবানদাসের বিরক্তি

ক্রমে ঐ কথা লোকমুখে বৈষ্ণবসমাজের সর্বত্র প্রচারিত হইল। ভগবানদাস বাবাজীও উহা শুনিতে পাইলেন। শুধু শুনাই নহে, ভবিষ্যতে আবার ঐরূপ হইতে পারে – ভগবদ্ভাবের ভান করিয়া নামযশঃপ্রার্থী ধূর্ত ভণ্ডেরাও ঐ আসন স্বার্থসিদ্ধির জন্য ঐরূপে অধিকার করিয়া বসিতে পারে ভাবিয়া হরিসভার সভ্যগণের কেহ কেহ তাঁহার নিকটে ঐ আসন ভবিষ্যতে কিভাবে রক্ষা করা কর্তব্য সে বিষয়ে মীমাংসা করিয়া লইবার জন্য উপস্থিত হইলেন।

শ্রীচৈতন্যপদাশ্রিত সিদ্ধ বাবাজী নিজ ইষ্টদেবতার আসন অজ্ঞাতনামা শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দ্বারা অধিকৃত হইয়াছে শুনা অবধি বিশেষ বিরক্ত হইয়াছিলেন। এমনকি, ক্রোধান্ধ হইয়া তাঁহার উদ্দেশে কটুকাটব্য বলিতে এবং তাঁহাকে ভণ্ড বলিয়া নির্দেশ করিতেও কুণ্ঠিত হন নাই। হরিসভার সভ্যগণের দর্শনে বাবাজীর সেই বিরক্তি ও ক্রোধ যে এখন দ্বিগুণ বাড়িয়া উঠিল এবং ঐরূপ বিসদৃশ কার্য সম্মুখে অনুষ্ঠিত হইতে দেওয়ায় তাঁহাদিগকেও যে বাবাজী অপরাধী সাব্যস্ত করিয়া বিশেষ ভর্ৎসনা করিলেন, এ কথা আমরা বেশ বুঝিতে পারি। পরে ক্রোধশান্তি হইলে ভবিষ্যতে আর যাহাতে কেহ ঐরূপ আচরণ না করিতে পারে, বাবাজী সে বিষয়ে সকল বন্দোবস্ত নির্দেশ করিয়া দিলেন। কিন্তু যাঁহাকে লইয়া হরিসভার এত গণ্ডগোল উপস্থিত হইল তিনি ঐসকল কথার বিশেষ কিছু জানিতে পারিলেন না।

ঠাকুরের ভগবানদাসের আশ্রমে গমন

ঐ ঘটনার কয়েক দিন পরেই শ্রীরামকৃষ্ণদেব স্বতঃপ্রেরিত হইয়া ভাগিনেয় হৃদয় ও মথুরবাবুকে সঙ্গে লইয়া কালনায় উপস্থিত হইলেন। প্রত্যূষে নৌকা ঘাটে আসিয়া লাগিলে মথুর থাকিবার স্থান প্রভৃতির বন্দোবস্তে ব্যস্ত হইলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব ইত্যবসরে হৃদয়কে সঙ্গে লইয়া শহর দেখিতে বহির্গত হইলেন এবং লোকমুখে ঠিকানা জানিয়া ক্রমে ভগবানদাস বাবাজীর আশ্রমসন্নিধানে উপস্থিত হইলেন।

হৃদয়ের বাবাজীকে ঠাকুরের কথা বলা

বালকস্বভাব ঠাকুর পূর্বাপরিচিত কোন ব্যক্তির সম্মুখীন হইতে হইলে সকল সময়েই একটা অব্যক্ত ভয়লজ্জাদিভাবে প্রথম অভিভূত হইয়া পড়িতেন। ঠাকুরের এ ভাবটি আমরা অনেক সময়ে লক্ষ্য করিয়াছি। বাবাজীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইবার সময়ও ঠিক তদ্রূপ হইল। হৃদয়কে অগ্রে যাইতে বলিয়া আপনি প্রায় আপাদমস্তক বস্ত্রাবৃত হইয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আশ্রমে প্রবেশ করিলেন। হৃদয় ক্রমে বাবাজীর নিকটে উপস্থিত হইয়া প্রণাম করিয়া নিবেদন করিলেন, “আমার মামা ঈশ্বরের নামে কেমন বিহ্বল হইয়া পড়েন; অনেক দিন হইতেই ঐরূপ অবস্থা। আপনাকে দর্শন করিতে আসিয়াছেন।”

বাবাজীর জনৈক সাধুর কার্যে বিরক্তি-প্রকাশ

হৃদয় বলেন, বাবাজীর সাধনসম্ভূত একটি শক্তির পরিচয় নিকটে উপস্থিত হইবামাত্র তিনি পাইয়াছিলেন। কারণ, প্রণাম করিয়া উপরোক্ত কথাগুলি বলিবার পূর্বেই তিনি বাবাজীকে বলিতে শুনিয়াছিলেন, “আশ্রমে যেন কোন মহাপুরুষের আগমন হইয়াছে, বোধ হইতেছে।” কথাগুলি বলিয়া বাবাজী নাকি ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিয়াও দেখিয়াছিলেন; কিন্তু হৃদয় ভিন্ন অপর কাহাকেও সে সময়ে আগমন করিতে না দেখিয়া সম্মুখাবস্থিত ব্যক্তিসকলের সহিত উপস্থিত প্রসঙ্গেই মনোনিবেশ করিয়াছিলেন। জনৈক বৈষ্ণব সাধু কি অন্যায় কার্য করিয়াছিলেন, তাঁহার সম্বন্ধে কি করা কর্তব্য – এই প্রসঙ্গই তখন চলিতেছিল; এবং বাবাজী সাধুর ঐরূপ বিসদৃশ কার্যে বিষম বিরক্ত হইয়া – তাঁহার কণ্ঠী (মালা) কাড়িয়া লইয়া সম্প্রদায় হইতে তাড়াইয়া দিবেন, ইত্যাদি বলিয়া তাঁহাকে তিরস্কার করিতেছিলেন। এমন সময় শ্রীরামকৃষ্ণদেব তথায় উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে প্রণাম করিয়া উপস্থিত মণ্ডলীর এক পার্শ্বে দীনভাবে উপবিষ্ট হইলেন। সর্বাঙ্গ বস্ত্রাবৃত থাকায় তাঁহার মুখমণ্ডল ভাল করিয়া কাহারও নয়নগোচর হইল না। তিনি ঐরূপে আসিয়া বসিবামাত্র হৃদয় তাঁহার পরিচায়ক পূর্বোক্ত কথাগুলি বাবাজীকে নিবেদন করিলেন। হৃদয়ের কথায় বাবাজী উপস্থিত কথায় বিরত হইয়া ঠাকুরকে এবং তাঁহাকে প্রতিনমস্কার করিয়া কোথা হইতে তাঁহাদের আগমন হইল, ইত্যাদি প্রশ্ন করিতে লাগিলেন।

বাবাজীর লোকশিক্ষা দিবার অহঙ্কার

বাবাজী হৃদয়ের সহিত কথার অবসরে মালা ফিরাইতেছেন দেখিয়া হৃদয় বলিলেন, “আপনি এখনও মালা রাখিয়াছেন কেন? আপনি সিদ্ধ হইয়াছেন, আপনার উহা এখন আর রাখিবার প্রয়োজন তো নাই?” ঠাকুরের অভিপ্রায়ানুসারে হৃদয় বাবাজীকে ঐরূপ প্রশ্ন করেন বা স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া করেন, তাহা আমাদের জানা নাই। বোধ হয় শেষোক্ত ভাবেই ঐরূপ করিয়াছিলেন। কারণ, ঠাকুরের সেবায় সর্বদা নিযুক্ত থাকিয়া এবং তাঁহার সহিত সমাজের উচ্চাবচ নানা লোকের সঙ্গে মিশিয়া হৃদয়েরও তখন তখন উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা এবং যখন যেমন তখন তেমন কথা কহিবার ও প্রসঙ্গ উত্থাপিত করিবার ক্ষমতা বেশ পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিল। বাবাজী হৃদয়ের ঐরূপ প্রশ্নে প্রথম দীনতা প্রকাশ করিয়া পরে বলিলেন, “নিজের প্রয়োজন না থাকিলেও লোকশিক্ষার জন্য ও-সকল রাখা নিতান্ত প্রয়োজন; নতুবা আমার দেখাদেখি লোকে ঐরূপ করিয়া ভ্রষ্ট হইয়া যাইবে।”

বাবাজীর ঐরূপ বিরক্তি ও অহঙ্কার দেখিয়া ঠাকুরের ভাবাবেশে প্রতিবাদ

চিরকাল শ্রীশ্রীজগন্মাতার উপর সকল বিষয়ে বালকের ন্যায় সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া আসায় ঠাকুরের নির্ভরশীলতা এত সহজ, স্বাভাবিক ও মজ্জাগত হইয়া গিয়াছিল যে, নিজে অহঙ্কারের প্রেরণায় কোন কাজ করা দূরে থাকুক, অপর কেহ ঐরূপ করিতেছে বা করিব বলিতেছে দেখিলে বা শুনিলে তাঁহার মনে একটা বিষম যন্ত্রণা উপস্থিত হইত। সেইজন্যেই তিনি ঈশ্বরের দাসভাবে অতি বিরল সময়ে ‘আমি’ কথাটির প্রয়োগ করা ছাড়া অপর কোন ভাবে আমাদের ন্যায় ঐ শব্দের উচ্চারণ করিতে পারিতেন না। অল্প সময়ের জন্যও যে ঠাকুরকে দেখিয়াছে সেও তাঁহার ঐরূপ স্বভাব দেখিয়া বিস্মিত ও মুগ্ধ হইয়াছে, অথবা অন্য কেহ কোন কর্ম ‘আমি করিব’ বলায় তাঁহার বিষম বিরক্তিপ্রকাশ দেখিয়া অবাক হইয়া ভাবিয়াছে – ঐ লোকটা কি এমন কুকাজ করিয়াছে যাহাতে তিনি এতটা বিরক্ত হইতেছেন! ভগবানদাসের নিকটে আসিয়াই ঠাকুর প্রথম শুনিলেন তিনি কণ্ঠী ছিঁড়িয়া লইয়া একজনকে তাড়াইয়া দিব বলিতেছেন। আবার অল্পক্ষণ পরেই শুনিলেন তিনি লোকশিক্ষা দিবার জন্যই এখনও মালা-তিলকাদি-ব্যবহার ত্যাগ করেন নাই। বাবাজীর ঐরূপে বারংবার ‘আমি তাড়াইব, আমি লোকশিক্ষা দিব, আমি মালা-তিলকাদি ত্যাগ করি নাই’ ইত্যাদি বলায় সরলস্বভাব ঠাকুর আর মনের বিরক্তি আমাদের ন্যায় চাপিয়া সভ্যভব্য হইয়া উপবিষ্ট থাকিতে পারিলেন না। একেবারে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বাবাজীকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “কি? তুমি এখনও এত অহঙ্কার রাখ? তুমি লোকশিক্ষা দিবে? তুমি তাড়াইবে? তুমি ত্যাগ ও গ্রহণ করিবে? তুমি লোকশিক্ষা দিবার কে? যাঁহার জগৎ তিনি না শিখাইলে তুমি শিখাইবে?” – ঠাকুরের তখন সে অঙ্গাবরণ পড়িয়া গিয়াছে। কটিদেশ হইতে বস্ত্রও শিথিল হইয়া খসিয়া পড়িয়াছে এবং মুখমণ্ডল এক অপূর্ব দিব্য তেজে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে! তিনি তখন একেবারে আত্মহারা হইয়া পড়িয়াছেন, কাহাকে কি বলিতেছেন তাহার কিছুমাত্র যেন বোধ নাই! আবার ঐ কয়েকটি কথামাত্র বলিয়াই ভাবের আতিশয্যে তিনি একেবারে নিশ্চেষ্ট নিস্পন্দ হইয়া সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন।

বাবাজীর ঠাকুরের কথা মানিয়া লওয়া

সিদ্ধ বাবাজীকে এ পর্যন্ত সকলে মান্য-ভক্তিই করিয়া আসিয়াছে। তাঁহার বাক্যের প্রতিবাদ করিতে বা তাঁহার দোষ দেখাইয়া দিতে এ পর্যন্ত কাহারও সামর্থ্যে ও সাহসে কুলায় নাই। ঠাকুরের ঐরূপ চেষ্টা দেখিয়া তিনি প্রথম বিস্মিত হইলেন; কিন্তু ইতরসাধারণ মানব যেমন ঐরূপ অবস্থায় পড়িলে ক্রোধপরবশ হইয়া প্রতিহিংসা লইতেই প্রবৃত্ত হয়, বাবাজীর মনে সেরূপ ভাবের উদয় হইল না! তপস্যা-প্রসূত সরলতা তাঁহার সহায় হইয়া শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কথাগুলির যাথার্থ্য হৃদয়ঙ্গম করাইয়া দিল! তিনি বুঝিলেন, বাস্তবিকই এ জগতে ঈশ্বর ভিন্ন আর দ্বিতীয় কর্তা নাই। অহঙ্কৃত মানব যতই কেন ভাবুক না সে সকল কার্য করিতেছে, বাস্তবিক কিন্তু সে অবস্থার দাসমাত্র; যতটুকু অধিকার তাহাকে দেওয়া হইয়াছে ততটুকুমাত্রই সে বুঝিতে ও করিতে পারে। সংসারী মানব যাহা করে করুক, ভক্ত ও সাধকের তিলেকের জন্য ঐ কথা বিস্মৃত হইয়া থাকা উচিত নহে। উহাতে তাঁহার পথভ্রষ্ট হইয়া পতনের সম্ভাবনা। এইরূপে ঠাকুরের শক্তিপূর্ণ কথাগুলিতে বাবাজীর অন্তৰ্দৃষ্টি অধিকতর প্রস্ফুটিত হইয়া তাঁহাকে নিজের দোষ দেখাইয়া বিনীত ও নম্র করিল। আবার শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শরীরে অপূর্ব ভাববিকাশ দেখিয়া তাঁহার ধারণা হইল ইনি সামান্য পুরুষ নহেন।

ঠাকুর ও ভগবানদাসের প্রেমালাপ ও মথুরের আশ্রমস্থ সাধুদের সেবা

পরে ভগবৎপ্রসঙ্গে সেখানে যে এক অপূর্ব দিব্যানন্দের প্রবাহ ছুটিল এ কথা আমাদের সহজেই অনুমিত হয়। ঐ প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মুহুর্মুহুঃ ভাবাবেশ ও উদ্দাম আনন্দে বাবাজী মোহিত হইয়া দেখিলেন যে, যে মহাভাবের শাস্ত্রীয় আলোচনা ও ধারণায় তিনি এতকাল কাটাইয়াছেন তাহাই শ্রীরামকৃষ্ণ-শরীরে নিত্য প্রকাশিত! কাজেই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের উপর তাঁহার ভক্তি-শ্রদ্ধা গভীর হইয়া উঠিল। পরে যখন বাবাজী শুনিলেন ইনিই সেই দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস, যিনি কলুটোলার হরিসভায় ভাবাবেশে আত্মহারা হইয়া শ্রীচৈতন্যাসন অধিকার করিয়া বসিয়াছিলেন, তখন ইঁহাকেই আমি অযথা কটুকাটব্য বলিয়াছি – ভাবিয়া তাঁহার মনে ক্ষোভ ও পরিতাপের অবধি রহিল না। তিনি বিনীতভাবে শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে প্রণাম করিয়া তজ্জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করিলেন। এইরূপে ঠাকুর ও বাবাজীর সেদিনকার প্রেমাভিনয় সাঙ্গ হইল এবং শ্রীরামকৃষ্ণদেবও হৃদয়কে সঙ্গে লইয়া কিছুক্ষণ পরে মথুরের সন্নিধানে আগমন করিয়া ঐ ঘটনার আদ্যোপান্ত তাঁহাকে শুনাইয়া বাবাজীর উচ্চ আধ্যাত্মিক অবস্থার অনেক প্রশংসা করিলেন। মথুরবাবুও উহা শুনিয়া বাবাজীকে দর্শন করিতে যাইলেন এবং আশ্রমস্থ দেববিগ্রহের সেবা ও একদিন মহোৎসবাদির জন্য বিশেষ বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *