২.১৬ বেদান্তসাধনের শেষ কথা ও ইসলামধর্মসাধন

দ্বিতীয় খণ্ডষোড়শ অধ্যায়: বেদান্তসাধনের শেষ কথা ইসলামধর্মসাধন

ঠাকুরের কঠিন ব্যাধি কালে তাঁহার মনের অপূর্ব আচরণ

জগদম্বা দাসীর সাংঘাতিক পীড়া পূর্বোক্ত প্রকারে আরোগ্য করিয়া হউক, অথবা অদ্বৈত-ভাবভূমিতে নিরন্তর অবস্থানের জন্য ঠাকুর দীর্ঘ ছয়মাস কাল পর্যন্ত যে অমানুষী চেষ্টা করিয়াছিলেন তাহার ফলেই হউক, তাঁহার দৃঢ় শরীর ভগ্ন হইয়া এখন কয়েক মাস রোগগ্রস্ত হইয়াছিল। তাঁহার নিকটে শুনিয়াছি, ঐ সময়ে তিনি আমাশয় পীড়ায় কঠিনভাবে আক্রান্ত হইয়াছিলেন। ভাগিনেয় হৃদয় নিরন্তর তাঁহার সেবায় নিযুক্ত ছিল এবং শ্রীযুক্ত মথুর তাঁহাকে সুস্থ ও রোগমুক্ত করিবার জন্য প্রসিদ্ধ কবিরাজ গঙ্গাপ্রসাদ সেনের চিকিৎসা ও পথ্যাদির বিশেষ বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু শরীর ঐরূপে ব্যাধিগ্রস্ত হইলেও ঠাকুরের দেহবোধবিবর্জিত মন এখন যে অপূর্ব শান্তি ও নিরবচ্ছিন্ন আনন্দে অবস্থান করিত, তাহা বলিবার নহে। বিন্দুমাত্র উত্তেজনায়1 উহা শরীর, ব্যাধি এবং সংসারের সকল বিষয় হইতে পৃথক হইয়া দূরে নির্বিকল্পভূমিতে এককালে উপনীত হইত এবং ব্রহ্ম, আত্মা বা ঈশ্বরের স্মরণমাত্রেই অন্য সকল কথা ভুলিয়া তন্ময় হইয়া কিছুকালের জন্য আপনার পৃথগস্তিত্ববোধ সম্পূর্ণরূপে হারাইয়া ফেলিত। সুতরাং ব্যাধির প্রকোপে শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা উপস্থিত হইলেও তিনি যে উহার সামান্যমাত্রই উপলব্ধি করিতেন, একথা বুঝিতে পারা যায়। তবে ঐ ব্যাধির যন্ত্রণা সময়ে সময়ে তাঁহার মনকে উচ্চভাবভূমি হইতে নামাইয়া শরীরে যে নিবিষ্ট করিত, একথাও আমরা তাঁহার শ্রীমুখে শুনিয়াছি। ঠাকুর বলিতেন, এইকালে তাঁহার নিকটে বেদান্তমার্গবিচরণশীল সাধকাগ্রণী পরমহংসসকলের আগমন হইয়াছিল এবং ‘নেতি নেতি’, ‘অস্তি-ভাতি-প্রিয়’, ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ প্রভৃতি বেদান্তপ্রসিদ্ধ তত্ত্বসমূহের বিচারধ্বনিতে তাঁহার বাসগৃহ নিরন্তর মুখরিত হইয়া থাকিত।2 ঐসকল উচ্চতত্ত্বের বিচারকালে তাঁহারা যখন কোন বিষয়ে সুমীমাংসায় উপনীত হইতে পারিতেন না, ঠাকুরকেই তখন মধ্যস্থ হইয়া উহার মীমাংসা করিয়া দিতে হইত। বলা বাহুল্য, ইতরসাধারণের ন্যায় ব্যাধির প্রকোপে নিরন্তর মুহ্যমান হইয়া থাকিলে কঠোর দার্শনিক বিচারে ঐরূপে প্রতিনিয়ত যোগদান করা তাঁহার পক্ষে কখনই সম্ভবপর হইত না।


1. গুরুভাবপূর্বার্ধ, ২য় অধ্যায়।
2. গুরুভাবউত্তরার্ধ, ২য় অধ্যায়।

অদ্বৈতভাবে প্রতিষ্ঠিত হইবার পরে ঠাকুরের দর্শন দর্শনের ফলে তাঁহার উপলব্ধিসমূহ

আমরা অন্যত্র বলিয়াছি, নির্বিকল্প ভূমিতে নিরন্তর অবস্থানকালের শেষভাগে ঠাকুরের এক বিচিত্র দর্শন বা উপলব্ধি উপস্থিত হইয়াছিল। ভাবমুখে অবস্থান করিবার জন্য তিনি তৃতীয়বার আদিষ্ট হইয়াছিলেন।1 ‘দর্শন’ বলিয়া ঐ বিষয়ের উল্লেখ করিলেও উহা যে তাঁহার প্রাণে প্রাণে উপলব্ধির কথা, উহা পাঠক বুঝিয়া লইবেন। কারণ পূর্ব দুইবারের ন্যায় ঠাকুর এইকালে কোন দৃষ্ট মূর্তির মুখে ঐকথা শ্রবণ করেন নাই। কিন্তু তুরীয় অদ্বৈততত্ত্বে একেবারে একীভূত হইয়া অবস্থান না করিয়া যখনই তাঁহার মন ঐ তত্ত্ব হইতে কথঞ্চিৎ পৃথক হইয়া আপনাকে সগুণ বিরাট ব্রহ্মের বা শ্রীশ্রীজগদম্বার অংশ বলিয়া প্রত্যক্ষ করিতেছিল, তখন উহা ঐ বিরাট ব্রহ্মের বিরাট মনে ঐরূপ ভাব বা ইচ্ছার বিদ্যমানতা সাক্ষাৎ উপলব্ধি করিয়াছিল।2 ঐ উপলব্ধি হইতে তাঁহার মনে নিজ জীবনের ভবিষ্যৎ প্রয়োজনীয়তা সম্যক প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিয়াছিল। কারণ শরীররক্ষা করিবার নিমিত্ত বিন্দুমাত্র বাসনা অন্তরে না থাকিলেও শ্রীশ্রীজগদম্বার বিচিত্র ইচ্ছায় বারংবার ভাবমুখে অবস্থান করিতে আদিষ্ট হইয়া ঠাকুর বুঝিয়াছিলেন, নিজ প্রয়োজন না থাকিলেও ভগবল্লীলাপ্রয়োজনের জন্য তাঁহাকে দেহরক্ষা করিতে হইবে এবং নিত্যকাল ব্রহ্মে অবস্থান করিলে শরীর থাকা সম্ভবপর নহে বলিয়াই তিনি এখন ঐরূপ করিতে আদিষ্ট হইয়াছেন। জাতিস্মরত্বসহায়ে ঠাকুর এইকালেই সম্যক বুঝিয়াছিলেন, তিনি নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-স্বভাববান আধিকারিক অবতারপুরুষ, বর্তমান যুগের ধর্মগ্লানি দূর করিয়া লোককল্যাণসাধনের জন্যই তাঁহাকে দেহধারণ ও তপস্যাদি করিতে হইয়াছে। একথাও তাঁহার এই সময়ে হৃদয়ঙ্গম হইয়াছিল যে, শ্রীশ্রীজগন্মাতা উদ্দেশ্য-বিশেষ সাধনের জন্যই এবার তাঁহাকে বাহ্যৈশ্বর্যের আড়ম্বরপরিশূন্য ও নিরক্ষর করিয়া দরিদ্র ব্রাহ্মণকুলে আনয়ন করিয়াছেন এবং ঐ লীলারহস্য তাঁহার জীবৎকালে স্বল্পলোকে বুঝিতে সমর্থ হইলেও, যে প্রবল আধ্যাত্মিক তরঙ্গ তাঁহার শরীরমনের দ্বারা জগতে উদিত হইবে, তাহা সর্বতোভাবে অমোঘ থাকিয়া অনন্তকাল জনসাধারণের কল্যাণসাধন করিতে থাকিবে।


1. এই গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায় দেখ। 
2. গুরুভাবপূর্বার্ধ, ৩য় অধ্যায়।

ব্রহ্মজ্ঞানলাভের পূর্বে সাধকের জাতিস্মরত্বলাভসম্বন্ধে শাস্ত্রীয় কথা

ঐরূপ অসাধারণ উপলব্ধিসকল ঠাকুরের কিরূপে উপস্থিত হইয়াছিল বুঝিতে হইলে শাস্ত্রের কয়েকটি কথা আমাদিগকে স্মরণ করিতে হইবে। শাস্ত্র বলেন, অদ্বৈতভাবসহায়ে জ্ঞানস্বরূপে পূর্ণরূপে অবস্থান করিবার পূর্বে সাধক জাতিস্মরত্ব লাভ করিয়া থাকেন।1 অথবা ঐ ভাবের পরিপাকে তাঁহার স্মৃতি তখন এতদূর পরিণত অবস্থায় উপস্থিত হয় যে, ইতঃপূর্বে তিনি যেভাবে যথায় যতবার শরীর পরিগ্রহপূর্বক যাহা কিছু সুকৃত-দুষ্কৃতের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, সে সকল কথা তাঁহার স্মরণপথে উদিত হইয়া থাকে। ফলে সংসারের সকল বিষয়ের নশ্বরতা ও রূপরসাদি ভোগসুখের পশ্চাৎ ধাবিত হইয়া বারংবার একইভাবে জন্মপরিগ্রহের নিষ্ফলতা সম্যক প্রত্যক্ষীভূত হইয়া তাঁহার মনে তীব্র বৈরাগ্য উপস্থিত হয় এবং ঐ বৈরাগ্যসহায়ে তাঁহার প্রাণ সর্ববিধ বাসনা হইতে এককালে পৃথক হইয়া দণ্ডায়মান হয়।


1. সংস্কারসাক্ষাৎকরণাৎ পূর্বজাতিজ্ঞানং।পাতঞ্জল সূত্র, বিভূতিপাদ, ১৮শ সূত্র।

ব্রহ্মজ্ঞানলাভে সাধকের সর্বপ্রকার যোগবিভূতি সিদ্ধসঙ্কল্পত্বলাভ সম্বন্ধে শাস্ত্রীয় কথা

উপনিষদ্ বলেন,1 ঐরূপ পুরুষ সিদ্ধসঙ্কল্প হয়েন এবং দেব, পিতৃ প্রভৃতি যখন যে লোক প্রত্যক্ষ করিতে তাঁহার ইচ্ছা হয়, তখনই তাঁহার মন সমাধি-বলে ঐসকল লোক সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করিতে সমর্থ হয়। মহামুনি পতঞ্জলি তৎকৃত যোগশাস্ত্রে ঐ বিষয়ের উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন যে, ঐরূপ পুরুষের সর্ববিধ বিভূতি বা যোগৈশ্বর্যের স্বতঃ উদয় হইয়া থাকে। পঞ্চদশীকার সায়ন-মাধব ঐরূপ পুরুষের বাসনারাহিত্য এবং যোগৈশ্বর্যলাভ – উভয় কথার সামঞ্জস্য করিয়া বলিয়াছেন যে, ঐরূপ বিচিত্র ঐশ্বর্যসকল লাভ করিলেও অন্তরে বিন্দুমাত্র বাসনা না থাকায় তাঁহারা ঐসকল শক্তি কখনও প্রয়োগ করেন না। পুরুষ সংসারে যে অবস্থায় থাকিতে থাকিতে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে, জ্ঞানলাভের পরে তদবস্থাতে কালাতিপাত করে। কারণ চিত্ত সর্বপ্রকারে বাসনাশূন্য হওয়ায়, সমর্থ হইলেও ঐ অবস্থার পরিবর্তন করিবার আবশ্যকতা সে কিছুমাত্র অনুভব করে না। আধিকারিক পুরুষেরাই2 কেবল সর্বতোভাবে ঈশ্বরেচ্ছাধীন থাকিয়া বহুজনহিতায় ঐ শক্তিসকলের প্রয়োগ সময়ে সময়ে করিয়া থাকেন।


1. ছান্দোগ্যোপনিষদ্, ৮ম প্রপাঠক, ২য় খণ্ড।
2. লোককল্যাণসাধনের জন্য যাঁহারা বিশেষ অধিকার বা শক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করেন।

পূর্বোক্ত শাস্ত্রকথা অনুসারে ঠাকুরের জীবনালোচনায় তাঁহার অপূর্ব উপলব্ধিসকলের কারণ বুঝা যায়

পূর্বোক্ত শাস্ত্রীয় কথাসকল স্মরণ রাখিয়া ঠাকুরের বর্তমান জীবনের অনুশীলনে তাঁহার এইকালের বিচিত্র অনুভূতিসকল সম্যক না হইলেও অনেকাংশে বুঝিতে পারা যায়। বুঝা যায় যে তিনি ভগবৎপাদপদ্মে অন্তরের সহিত সর্বস্ব সমর্পণ করিয়া সর্বপ্রকারে বাসনাপরিশূন্য হইয়াছিলেন বলিয়াই, অত স্বল্পকালে ব্রহ্মজ্ঞানের নির্বিকল্প ভূমিতে উঠিতে এবং দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হইতে সমর্থ হইয়াছিলেন। বুঝা যায়, জাতিস্মরত্বলাভ করিয়াই তিনি এইকালে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন যে পূর্ব পূর্ব যুগে যিনি ‘শ্রীরাম’ এবং ‘শ্রীকৃষ্ণ’-রূপে আবির্ভূত হইয়া লোককল্যাণসাধন করিয়াছিলেন, তিনিই বর্তমানকালে পুনরায় শরীর পরিগ্রহপূর্বক ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’-রূপে আবির্ভূত হইয়াছেন। বুঝা যায়, লোককল্যাণসাধনের জন্য পরজীবনে তাঁহাতে বিচিত্র বিভূতিসকলের প্রকাশ নিত্য দেখিতে পাইলেও কেন আমরা তাঁহাকে নিজ শরীরমনের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ঐসকল দিব্যশক্তির প্রয়োগ করিতে কখনও দেখিতে পাই না। বুঝা যায়, কেন তিনি সঙ্কল্পমাত্রেই আধ্যাত্মিক তত্ত্বসমূহ প্রত্যক্ষ করিবার শক্তি অপরের মধ্যে জাগরিত করিতে সমর্থ হইতেন এবং কেনই বা তাঁহার দিব্যপ্রভাব দিন দিন পৃথিবীর সকল দেশে অপূর্ব আধিপত্য লাভ করিতেছে।

পূর্বোক্ত উপলব্ধিসকল ঠাকুরের যুগপৎ উপস্থিত না হইবার কারণ

অদ্বৈতভাবে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হইয়া ভাবরাজ্যে অবরোহণ করিবার কালে ঠাকুর ঐরূপে নিজ জীবনের ভূতভবিষ্যৎ সম্যক উপলব্ধি করিয়াছিলেন। কিন্তু ঐ উপলব্ধিসকল তাঁহাতে যে সহসা একদিন উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা বোধ হয় না। আমাদিগের অনুমান, ভাব-ভূমিতে অবরোহণের পরে বৎসরকালের মধ্যে তিনি ঐসকল কথা সম্যক বুঝিতে পারিয়াছিলেন। শ্রীশ্রীজগন্মাতা ঐকালে তাঁহার চক্ষুর সম্মুখ হইতে আবরণের পর আবরণ উঠাইয়া দিন দিন তাঁহাকে ঐসকল কথা স্পষ্ট বুঝাইয়া দিয়াছিলেন। পূর্বোক্ত উপলব্ধিসকল তাঁহার মনে যুগপৎ কেন উপস্থিত হয় নাই, তদ্বিষয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করিলে আমাদিগকে বলিতে হয় – অদ্বৈতভাবে অবস্থানপূর্বক গভীর ব্রহ্মানন্দসম্ভোগে তিনি এই কালে নিরন্তর ব্যাপৃত ছিলেন। সুতরাং যতদিন না তাঁহার মন পুনরায় বহির্মুখী বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছিল, ততদিন ঐসকল বিষয় উপলব্ধি করিবার তাঁহার অবসর এবং প্রবৃত্তি হয় নাই। ঐরূপে সাধনকালের প্রারম্ভে ঠাকুর শ্রীশ্রীজগন্মাতার নিকটে যে প্রার্থনা করিয়াছিলেন, ‘মা, আমি কি করিব, তাহা কিছুই জানি না, তুই স্বয়ং আমাকে যাহা শিখাইবি তাহাই শিখিব’ – তাহাই এই কালে পূর্ণ হইয়াছিল।

অদ্বৈতভাবলাভ করাই সকল সাধনের উদ্দেশ্য বলিয়া ঠাকুরের উপলব্ধি

অদ্বৈতভাবভূমিতে আরূঢ় হইয়া ঠাকুরের এইকালে আর একটি বিষয়েরও উপলব্ধি হইয়াছিল। তিনি হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন যে, অদ্বৈতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়াই সর্ববিধ সাধনভজনের চরম উদ্দেশ্য। কারণ ভারতের প্রচলিত প্রধান প্রধান সকল ধর্মসম্প্রদায়ের মতাবলম্বনে সাধন করিয়া তিনি ইতঃপূর্বে প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন, উহারা প্রত্যেকেই সাধককে উক্ত ভূমির দিকে অগ্রসর করে। অদ্বৈতভাবের কথা জিজ্ঞাসা করিলে তিনি সেইজন্য আমাদিগকে বারংবার বলিতেন, “উহা শেষ কথা রে, শেষ কথা; ঈশ্বর-প্রেমের চরম পরিণতিতে সর্বশেষে উহা সাধকজীবনে স্বতঃ আসিয়া উপস্থিত হয়; জানিবি সকল মতেরই উহা শেষ কথা এবং যত মত তত পথ।”

পূর্বোক্ত উপলব্ধি তাঁহার পূর্বে অন্য কেহ পূর্ণভাবে করে নাই

ঐরূপে অদ্বৈতভাব উপলব্ধি করিয়া ঠাকুরের মন অসীম উদারতা লাভ করিয়াছিল। ঈশ্বরলাভকে যাহারা মানবজীবনের উদ্দেশ্য বলিয়া শিক্ষাপ্রদান করে ঐরূপ সকল সম্প্রদায়ের প্রতি উহা এখন অপূর্ব সহানুভূতিসম্পন্ন হইয়াছিল। কিন্তু ঐরূপ উদারতা ও সহানুভূতি যে তাঁহার সম্পূর্ণ নিজস্ব সম্পত্তি এবং পূর্বযুগের কোন সাধকাগ্রণী যে উহা তাঁহার ন্যায় পূর্ণভাবে লাভ করিতে সমর্থ হন নাই, একথা প্রথমে তাঁহার হৃদয়ঙ্গম হয় নাই। দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে এবং প্রসিদ্ধ তীর্থসকলে নানা সম্প্রদায়ের প্রবীণ সাধকসকলের সহিত মিলিত হইয়া ক্রমে তাঁহার ঐ কথার উপলব্ধি হইয়াছিল। কিন্তু এখন হইতে তিনি ধর্মের একদেশী ভাব অপরে অবলোকন করিলেই প্রাণে বিষম আঘাত প্রাপ্ত হইয়া ঐরূপ হীনবুদ্ধি দূর করিতে সর্বতোভাবে সচেষ্ট হইতেন।

অদ্বৈতবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত ঠাকুরের মনের উদারতা সম্বন্ধে দৃষ্টান্ততাঁহার ইসলাম ধর্মসাধন

অদ্বৈতবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হইয়া ঠাকুরের মন এখন কিরূপ উদারভাবসম্পন্ন হইয়াছিল, তাহা আমরা এই কালের একটি ঘটনায় স্পষ্ট বুঝিতে পারি। আমরা দেখিয়াছি, ঐ ভাবসাধনে সিদ্ধ হইবার পরে ঠাকুরের শরীর কয়েক মাসের জন্য রোগাক্রান্ত হইয়াছিল। সেই ব্যাধির হস্ত হইতে মুক্ত হইবার পরে উল্লিখিত ঘটনা উপস্থিত হইয়াছিল।

গোবিন্দ রায় নামক এক ব্যক্তি এই সময়ের কিছুকাল পূর্ব হইতে ধর্মান্বেষণে প্রবৃত্ত হন। হৃদয় বলিত, ইনি জাতিতে ক্ষত্রিয় ছিলেন। সম্ভবতঃ পারসী ও আরবী ভাষায় ইঁহার ব্যুৎপত্তি ছিল। ধর্মসম্বন্ধীয় নানা মতামত আলোচনা করিয়া এবং নানা সম্প্রদায়ের সহিত মিলিত হইয়া ইনি পরিশেষে ইসলামধর্মের উদার মতে আকৃষ্ট হইয়া যথারীতি দীক্ষাগ্রহণ করেন। ধর্মপিপাসু গোবিন্দ ইসলামধর্মমত গ্রহণ করিলেও উহার সামাজিক নিয়মপদ্ধতি কতদূর অনুসরণ করিতেন, বলিতে পারি না। কিন্তু দীক্ষাগ্রহণ করিয়া অবধি তিনি যে কোরানপাঠ এবং তদুক্ত প্রণালীতে সাধনভজনে মহোৎসাহে নিযুক্ত ছিলেন, একথা আমরা শ্রবণ করিয়াছি। গোবিন্দ প্রেমিক ছিলেন। বোধ হয়, ইসলামের সুফী সম্প্রদায়ের প্রচলিত শিক্ষা এবং ভাবসহায়ে ঈশ্বরের উপাসনা করিবার পদ্ধতি তাঁহার হৃদয় অধিকার করিয়াছিল। কারণ ঐ সম্প্রদায়ের দরবেশদিগের মতো তিনি এখন ভাবসাধনে অহোরাত্র নিযুক্ত থাকিতেন।

সুফি গোবিন্দ রায়ের আগমন

যেরূপেই হউক, গোবিন্দ এখন দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীতে উপস্থিত হয়েন এবং সাধনানুকূল স্থান বুঝিয়া পঞ্চবটীর শান্তিপ্রদ ছায়ায় আসন বিস্তীর্ণ করিয়া কিছুকাল কাটাইতে থাকেন। রানী রাসমণির কালীবাটীতে তখন হিন্দু সংসারত্যাগীদের ন্যায় মুসলমান ফকিরগণেরও সমাদর ছিল এবং জাতিধর্মনির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের ত্যাগী ব্যক্তিদিগের প্রতি এখানে সমভাবে আতিথ্য প্রদর্শন করা হইত। অতএব এখানে থাকিবার কালে গোবিন্দের অন্যত্র ভিক্ষাটনাদি করিতে হইত না এবং ইষ্টচিন্তায় নিযুক্ত হইয়া তিনি সানন্দে দিনযাপন করিতেন।

গোবিন্দের সহিত আলাপ করিয়া ঠাকুরের সঙ্কল্প

প্রেমিক গোবিন্দকে দেখিয়া ঠাকুর তৎপ্রতি আকৃষ্ট হয়েন এবং তাঁহার সহিত আলাপে প্রবৃত্ত হইয়া তাঁহার সরল বিশ্বাস ও প্রেমে মুগ্ধ হয়েন। ঐরূপে ঠাকুরের মন এখন ইসলামধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তিনি ভাবিতে থাকেন, ‘ইহাও তো ঈশ্বরলাভের এক পথ, অনন্ত-লীলাময়ী মা এপথ দিয়াও তো কত লোককে তাঁহার শ্রীপাদপদ্মলাভে ধন্য করিতেছেন; কিরূপে তিনি এই পথ দিয়া তাঁহার আশ্রিতদিগকে কৃতার্থ করেন, তাহা দেখিতে হইবে; গোবিন্দের নিকট দীক্ষিত হইয়া এ ভাবসাধনে নিযুক্ত হইব।’

গোবিন্দের নিকট হইতে দীক্ষাগ্রহণ করিয়া সাধনে ঠাকুরের সিদ্ধিলাভ

যে চিন্তা, সেই কাজ। ঠাকুর গোবিন্দকে নিজ অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন এবং দীক্ষাগ্রহণ করিয়া যথাবিধি ইসলামধর্মসাধনে প্রবৃত্ত হইলেন। ঠাকুর বলিতেন, “ঐ সময়ে ‘আল্লা’-মন্ত্র জপ করিতাম, মুসলমানদিগের ন্যায় কাছা খুলিয়া কাপড় পরিতাম; ত্রিসন্ধ্যা নমাজ পড়িতাম এবং হিন্দুভাব মন হইতে এককালে লুপ্ত হওয়ায় হিন্দু দেবদেবীকে প্রণাম দূরে থাকুক, দর্শন পর্যন্ত করিতে প্রবৃত্তি হইত না। ঐভাবে তিন দিবস অতিবাহিত হইবার পরে ঐ মতের সাধনফল সম্যক হস্তগত হইয়াছিল।” ইসলামধর্মসাধনকালে ঠাকুর প্রথমে এক দীর্ঘশ্মশ্রুবিশিষ্ট, সুগম্ভীর, জ্যোতির্ময় পুরুষপ্রবরের দিব্যদর্শন লাভ করিয়াছিলেন। পরে সগুণ বিরাট ব্রহ্মের উপলব্ধিপূর্বক তুরীয় নির্গুণ ব্রহ্মে তাঁহার মন লীন হইয়া গিয়াছিল।

মুসলমানধর্মসাধনকালে ঠাকুরের আচরণ

হৃদয় বলিত, মুসলমানধর্মসাধনের সময় ঠাকুর মুসলমানদিগের প্রিয় খাদ্যসকল, এমন কি গো-মাংস পর্যন্ত গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক হইয়াছিলেন। মথুরামোহনের সানুনয় অনুরোধই তখন তাঁহাকে ঐ কর্ম হইতে নিরস্ত করিয়াছিল। বালকস্বভাব ঠাকুরের ঐরূপ ইচ্ছা অন্ততঃ আংশিক পূর্ণ না হইলে তিনি কখনও নিরস্ত হইবেন না ভাবিয়া মথুর ঐ সময়ে এক মুসলমান পাচক আনাইয়া তাহার নির্দেশে এক ব্রাহ্মণের দ্বারা মুসলমানদিগের প্রণালীতে খাদ্যসকল রন্ধন করাইয়া ঠাকুরকে খাইতে দিয়াছিলেন। মুসলমানধর্মসাধনের সময় ঠাকুর কালীবাটীর অভ্যন্তরে একবারও পদার্পণ করেন নাই। উহার বাহিরে অবস্থিত মথুরামোহনের কুঠিতেই বাস করিয়াছিলেন।

ভারতে হিন্দু মুসলমান জাতি কালে ভ্রাতৃভাবে মিলিত হইবে, ঠাকুরের ইসলামমতসাধনে বিষয় বুঝা যায়

বেদান্তসাধনে সিদ্ধ হইয়া ঠাকুরের মন অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি কিরূপ সহানুভূতিসম্পন্ন হইয়াছিল, তাহা পূর্বোক্ত ঘটনায় বুঝিতে পারা যায় এবং একমাত্র বেদান্তবিজ্ঞানে বিশ্বাসী হইয়াই যে ভারতের হিন্দু ও মুসলমানকুল পরস্পর সহানুভূতিসম্পন্ন এবং ভ্রাতৃভাবে নিবদ্ধ হইতে পারে, একথাও হৃদয়ঙ্গম হয়। নতুবা ঠাকুর যেমন বলিতেন, “হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যেন একটা পর্বত-ব্যবধান রহিয়াছে – পরস্পরের চিন্তাপ্রণালী, ধর্মবিশ্বাস ও কার্যকলাপ এতকাল একত্রবাসেও পরস্পরের নিকট সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য হইয়া রহিয়াছে।” ঐ পাহাড় যে একদিন অন্তর্হিত হইবে এবং উভয়ে প্রেমে পরস্পরকে আলিঙ্গন করিবে, যুগাবতার ঠাকুরের মুসলমানধর্মসাধন কি তাহারই সূচনা করিয়া যাইল?

পরবর্তী কালে ঠাকুরের মনে অদ্বৈতস্মৃতি কতদূর প্রবল ছিল

নির্বিকল্প ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হইবার ফলে ঠাকুরের এখন দ্বৈত ভূমির সীমান্তরালে অবস্থিত বিষয় ও ব্যক্তিসকলকে দেখিয়া অদ্বৈতস্মৃতি অনেক সময় সহসা প্রবুদ্ধ হইয়া উঠিত এবং তাঁহাকে তুরীয়ভাবে লীন করিত। সঙ্কল্প না করিলেও সামান্যমাত্র উদ্দীপনায় আমরা তাঁহার ঐরূপ অবস্থা উপস্থিত হইতে দেখিয়াছি। অতএব, এখন হইতে তিনি সঙ্কল্প করিবামাত্র যে ঐ ভূমিতে আরোহণে সমর্থ ছিলেন, একথা বলা বাহুল্য। অদ্বৈতভাব যে তাঁহার কতদূর অন্তরের পদার্থ ছিল, তাহা উহা হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। ঐরূপ কয়েকটি ঘটনার এখানে উল্লেখ করিলেই পাঠক বুঝিতে পারিবেন, ঐ ভাব তাঁহার হৃদয়ে যেমন দুরবগাহ তেমনই দূরপ্রসারী ছিল।

বিষয়ক কয়েকটি দৃষ্টান্ত – () বৃদ্ধ ঘেষেড়া

দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীর প্রশস্ত উদ্যান বর্ষাকালে তৃণাচ্ছন্ন হওয়ায় মালীদিগের তরিতরকারি বপনের বিশেষ অসুবিধা হইয়া থাকে। তজ্জন্য ঘেসেড়াদিগকে ঐ সময়ে ঘাস কাটিয়া লইবার অনুমতি প্রদান করা হয়। একজন বৃদ্ধ ঘেসেড়া একদিন ঐরূপে বিনামূল্যে ঘাস লইবার অনুমতিলাভে সানন্দে সারাদিন ঐ কর্মে নিযুক্ত থাকিয়া অপরাহ্ণে মোট বাঁধিয়া বাজারে বিক্রয় করিতে যাইবার উপক্রম করিতেছিল। ঠাকুর দেখিতে পাইলেন, লোভে পড়িয়া সে এত ঘাস কাটিয়াছে যে, ঐ ঘাসের বোঝা লইয়া যাওয়া বৃদ্ধের শক্তিতে সম্ভবে না। দরিদ্র ঘেসেড়া কিন্তু ঐ বিষয় কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া বৃহৎ বোঝাটি মাথায় তুলিয়া লইবার জন্য নানারূপে পুনঃপুনঃ চেষ্টা করিয়াও উহা উঠাইতে পারিতেছিল না। ঐ বিষয় দেখিতে দেখিতে ঠাকুরের ভাবাবেশ হইল। ভাবিলেন, অন্তরে পূর্ণজ্ঞানস্বরূপ আত্মা বিদ্যমান এবং বাহিরে এত নির্বুদ্ধিতা, এত অজ্ঞান। ‘হে রাম, তোমার বিচিত্র লীলা!’ – বলিতে বলিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন।

() আহত পতঙ্গ

একদিন ঠাকুর দেখিলেন, একটি পতঙ্গ (ফড়িং) উড়িয়া আসিতেছে এবং উহার গুহ্যদেশে একটি লম্বা কাটি বিদ্ধ রহিয়াছে। কোন দুষ্ট বালক ঐরূপ করিয়াছে ভাবিয়া তিনি প্রথমে ব্যথিত হইলেন। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবাবিষ্ট হইয়া ‘হে রাম, তুমি আপনার দুর্দশা আপনি করিয়াছ’ বলিয়া হাস্যের রোল উঠাইলেন।

() পদদলিত নবীন দূর্বাদল

কালীবাটীর উদ্যানের স্থানবিশেষ নবীন দূর্বাদলে সমাচ্ছন্ন হইয়া এক সময়ে রমণীয় দর্শন হইয়াছিল। ঠাকুর উহা দেখিতে দেখিতে ভাবাবিষ্ট হইয়া এতদূর তন্ময় হইয়া গিয়াছিলেন যে, ঐ স্থানকে সর্বতোভাবে নিজ অঙ্গ বলিয়া অনুভব করিতেছিলেন। সহসা এক ব্যক্তি ঐ সময়ে ঐ স্থানের উপর দিয়া অন্যত্র গমন করিতে লাগিল। তিনি উহাতে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করিয়া এককালে অস্থির হইয়া পড়িলেন। ঐ ঘটনার উল্লেখ করিয়া তিনি আমাদিগকে বলিয়াছিলেন, “বুকের উপর দিয়া কেহ চলিয়া যাইলে যেমন যন্ত্রণা অনুভব হয়, ঐকালে ঠিক সেইরূপ যন্ত্রণা অনুভব করিয়াছিলাম। ঐরূপ ভাবাবস্থা বড়ই যন্ত্রণাদায়ক, আমার উহা ছয় ঘণ্টাকালমাত্র ছিল, তাহাতেই অস্থির হইয়া পড়িয়াছিলাম।”

() নৌকায় মাঝিদ্বয়ের পরস্পর কলহে ঠাকুরের নিজ শরীরে আঘাতানুভব

কালীবাটীর চাঁদনি-সমাযুক্ত বৃহৎ ঘাটে দণ্ডায়মান হইয়া ঠাকুর একদিন ভাবাবেশে গঙ্গা দর্শন করিতেছিলেন। ঘাটে তখন দুইখানি নৌকা লাগিয়াছিল এবং মাঝিরা কোন বিষয় লইয়া পরস্পর কলহ করিতেছিল। কলহ ক্রমে বাড়িয়া উঠিয়া সবল ব্যক্তি দুর্বলের পৃষ্ঠদেশে বিষম চপেটাঘাত করিল। ঠাকুর উহাতে চিৎকার করিয়া ক্রন্দন করিয়া উঠিলেন। তাঁহার ঐরূপ কাতর ক্রন্দন কালীঘরে হৃদয়ের কর্ণে সহসা প্রবেশ করায় সে দ্রুতপদে তথায় আগমনপূর্বক দেখিল, তাঁহার পৃষ্ঠদেশ আরক্তিম হইয়াছে এবং ফুলিয়া উঠিয়াছে। ক্রোধে অধীর হইয়া হৃদয় বারংবার বলিতে লাগিল, “মামা, কে তোমায় মারিয়াছে দেখাইয়া দাও, আমি তার মাথাটা ছিঁড়িয়া লই।” পরে ঠাকুর কথঞ্চিৎ শান্ত হইলে মাঝিদিগের বিবাদ হইতে তাঁহার পৃষ্ঠে আঘাতজনিত বেদনাচিহ্ন উপস্থিত হইয়াছে শুনিয়া হৃদয় স্তম্ভিত হইয়া ভাবিতে লাগিল, ইহাও কি কখনও সম্ভবপর! ঘটনাটি শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয় ঠাকুরের শ্রীমুখে শ্রবণ করিয়া আমাদিগকে বলিয়াছিলেন। ঠাকুরের সম্বন্ধে ঐরূপ অনেক ঘটনার1 উল্লেখ করা যাইতে পারে।


1. গুরুভাবপূর্বার্ধ, ২য় অধ্যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *