১.২ কামারপুকুর ও পিতৃপরিচয়

প্রথম খণ্ড – দ্বিতীয় অধ্যায়: কামারপুকুর ও পিতৃপরিচয়

দরিদ্রগৃহে ঈশ্বরের অবতীর্ণ হইবার কারণ

ঈশ্বরাবতার বলিয়া যে-সকল মহাপুরুষ জগতে অদ্যাপি পূজিত হইতেছেন, শ্রীভগবান রামচন্দ্র ও শাক্যসিংহের কথা ছাড়িয়া দিলে, তাঁহাদিগের সকলেরই পার্থিব জীবন দুঃখ-দারিদ্র্য, সংসারের অসচ্ছলতা এবং এমনকি কঠোরতার ভিতর আরম্ভ হইয়াছে, দেখিতে পাওয়া যায়। যথা – ক্ষত্রিয়রাজকুল অলঙ্কৃত করিলেও শ্রীভগবান শ্রীকৃষ্ণের কারাগৃহে জন্ম ও আত্মীয়-স্বজন হইতে দূরে, নীচ গোপকুলমধ্যে বাল্যজীবন অতিবাহিত হইয়াছিল; শ্রীভগবান ঈশা পান্থশালায় পশুরক্ষাগৃহে দরিদ্র পিতামাতার ক্রোড় উজ্জ্বল করিয়াছিলেন; শ্রীভগবান শঙ্কর দরিদ্র বিধবার পুত্ররূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন; শ্রীভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নগণ্য সাধারণ ব্যক্তির গৃহে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছিলেন; ইস্লামধর্ম-প্রবর্তক শ্রীমৎ মহম্মদের জীবনেও ঐ কথার পরিচয় পাওয়া যায়। ঐরূপ হইলেও কিন্তু যে দুঃখ-দারিদ্র্যের ভিতর সন্তোষের সরসতা নাই, যে অসচ্ছল সংসারে নিঃস্বার্থতা ও প্রেম নাই, যে দরিদ্র পিতামাতার হৃদয়ে ত্যাগ, পবিত্রতা ও কঠোর মনুষ্যত্বের সহিত কোমল দয়াদাক্ষিণ্যাদি ভাবসমূহের মধুর সামঞ্জস্য নাই, সেস্থলে তাঁহারা কখনও জন্মগ্রহণ করেন নাই।

ভাবিয়া দেখিলে, পূর্বোক্ত বিধানের সহিত তাঁহাদিগের ভাবী জীবনের একটা গূঢ় সম্বন্ধ লক্ষিত হয়। কারণ, যৌবনে ও প্রৌঢ়ে যাঁহাদিগকে সমাজের দুঃখী, দরিদ্র এবং অত্যাচারিতদিগের নয়নাশ্রু মুছাইয়া হৃদয়ে শান্তিপ্রদান করিতে হইবে, তাঁহারা ঐসকল ব্যক্তির অবস্থার সহিত পূর্ব হইতে পরিচিত ও সহানুভূতিসম্পন্ন না হইলে ঐ কার্যসাধন করিবেন কিরূপে? শুধু তাহাই নহে। আমরা ইতিপূর্বে দেখিয়াছি সংসারে ধর্মগ্লানি-নিবারণের জন্যই অবতারপুরুষসকলের অভ্যুদয় হয়। ঐ কার্য সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত তাঁহাদিগকে পূর্বপ্রচারিত ধর্মবিধানসকলের যথাযথ অবস্থার সহিত প্রথমেই পরিচিত হইতে হয় এবং ঐ সকল প্রাচীন বিধানের বর্তমান গ্লানির কারণ আলোচনাপূর্বক তাহাদিগের পূর্ণতা ও সাফল্যস্বরূপ দেশকালোপযোগী নূতন বিধান আবিষ্কার করিতে হয়। ঐ পরিচয়লাভের বিশেষ সুযোগ দরিদ্রের কুটির ভিন্ন ধনীর প্রাসাদ কখনও প্রদান করে না। কারণ, সংসারের সুখভোগে বঞ্চিত দরিদ্র ব্যক্তিই ঈশ্বর এবং তাঁহার বিধানকে জীবনের প্রধান অবলম্বনরূপে সর্বদা দৃঢ়ালিঙ্গন করিয়া থাকে। অতএব সর্বত্র ধর্মগ্লানি উপস্থিত হইলেও পূর্ব পূর্ব বিধানের যথাযথ কিঞ্চিদাভাস দরিদ্রের কুটিরকে তখনও উজ্জ্বল করিয়া রাখে; এবং ঐজন্যই বোধ হয়, জগদ্গুরু মহাপুরুষসকল জন্মপরিগ্রহকালে দরিদ্র পরিবারেই আকৃষ্ট হইয়া থাকেন।

যে মহাপুরুষের কথা আমরা বলিতে বসিয়াছি, তাঁহার জীবনারম্ভও পূর্বোক্ত নিয়ম অতিক্রম করে নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মভূমি কামারপুকুর

হুগলি জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশ যেখানে বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলাদ্বয়ের সহিত মিলিত হইয়াছে, সেই সন্ধিস্থলের অনতিদূরে তিনখানি গ্রাম ত্রিকোণমণ্ডলে পরস্পরের সন্নিকট অবস্থিত আছে। গ্রামবাসীদিগের নিকটে ঐ গ্রামত্রয় শ্রীপুর, কামারপুকুর ও মুকুন্দপুররূপে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত থাকিলেও উহারা পরস্পর এত ঘন সন্নিবেশে অবস্থিত যে, পথিকের নিকটে একই গ্রামের বিভিন্ন পল্লী বলিয়া প্রতীত হইয়া থাকে। সেজন্য চতুষ্পার্শ্বস্থ গ্রামসকলে উহারা একমাত্র কামারপুকুর নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। স্থানীয় জমিদারদিগের বহুকাল ঐ গ্রামে বাস থাকাতেই বোধ হয় কামারপুকুরের পূর্বোক্ত সৌভাগ্যের উদয় হইয়াছিল। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেইকালে কামারপুকুর শ্রীযুক্ত বর্ধমান মহারাজের গুরুবংশীয়দিগের লাখরাজ জমিদারিভুক্ত ছিল এবং তাঁহাদিগের বংশধর শ্রীযুক্ত গোপীলাল, সুখলাল প্রভৃতি গোস্বামিগণ1 ঐ গ্রামে বাস করিতেছিলেন।

কামারপুকুর হইতে বর্ধমান শহর প্রায় বত্রিশ মাইল উত্তরে অবস্থিত। উক্ত শহর হইতে আসিবার বরাবর পাকা রাস্তা আছে। কামারপুকুরে আসিয়াই ঐ রাস্তার শেষ হয় নাই; ঐ গ্রামকে অর্ধবেষ্টন করিয়া উহা দক্ষিণ-পশ্চিমাভিমুখে ৺পুরীধাম পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে। পাদচারী দরিদ্র যাত্রী এবং বৈরাগ্যবান সাধুসকলের অনেকে ঐ পথ দিয়া শ্রীশ্রীজগন্নাথদর্শনে গমনাগমন করেন।

কামারপুকুরের প্রায় ৯।১০ ক্রোশ পূর্বে ৺তারকেশ্বর মহাদেবের প্রসিদ্ধ মন্দির অবস্থিত। ঐ স্থান হইতে দ্বারকেশ্বর নদের তীরবর্তী জাহানাবাদ বা আরামবাগের মধ্য দিয়া কামারপুকুরে আসিবার একটি পথ আছে। তদ্ভিন্ন উক্ত গ্রামের প্রায় নয় ক্রোশ দক্ষিণে অবস্থিত ঘাটাল হইতে এবং প্রায় তের ক্রোশ পশ্চিমে অবস্থিত বন-বিষ্ণুপুর হইতেও এখানে আসিবার প্রশস্ত পথ আছে।


1. ৺হৃদয়রাম মুখোপাধ্যায় আমাদিগকে সুখলালের স্থলে অনুপ গোস্বামীর নাম বলিয়াছিলেন; কিন্তু বোধ হয়, উহা সমীচীন নহে। গ্রামের বর্তমান জমিদার লাহাবাবুদের নিকটে শুনিয়াছি, উক্ত গোস্বামীজীর নাম সুখলাল ছিল এবং ইঁহার পুত্র কৃষ্ণলাল গোস্বামীর নিকট হইতেই তাঁহারা প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে কামারপুকুরের অধিকাংশ জমি ক্রয় করিয়া লইয়াছিলেন। আবার গ্রামে প্রবাদ আছে, ৺গোপেশ্বর নামক বৃহৎ শিবলিঙ্গ গোপীলাল গোস্বামী প্রতিষ্ঠিত করেন। অতএব উক্ত গোপীলাল গোস্বামী সুখলালের কোন পূর্বতন পুরুষ ছিলেন বলিয়া অনুমিত হয়। অথবা এমনও হইতে পারে, সুখলালের অন্য নাম গোপীলাল ছিল।

কামারপুকুর অঞ্চলের পূর্ব সমৃদ্ধি ও বর্তমান অবস্থা

১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দে ম্যালেরিয়াপ্রসূত মহামারীর আবির্ভাবের পূর্বে কৃষিপ্রধান বঙ্গের পল্লীগ্রামসকলে কি অপূর্ব শান্তির ছায়া অবস্থান করিত, তাহা বলিবার নহে। বিশেষতঃ, হুগলি জেলার এই গ্রামাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ধান্যপ্রান্তরসকলের মধ্যগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামগুলি বিশাল হরিৎসাগরে ভাসমান দ্বীপপুঞ্জের ন্যায় প্রতীত হইত। জমির উর্বরতায় খাদ্যদ্রব্যের অভাব না থাকায় এবং নির্মল বায়ুতে নিত্য পরিশ্রমের ফলে গ্রামবাসীদিগের দেহে স্বাস্থ্য ও সবলতা এবং মনে প্রীতি ও সন্তোষ সর্বদা পরিলক্ষিত হইত। বহুজনাকীর্ণ গ্রামসকলে আবার কৃষি ভিন্ন ছোটখাট নানাপ্রকার শিল্পব্যবসায়েও লোকে নিযুক্ত থাকিত। ঐরূপে উৎকৃষ্ট জিলাপি, মিঠাই ও নবাত প্রস্তুত করিবার জন্য কামারপুকুর এই অঞ্চলে চিরপ্রসিদ্ধ এবং আবলুস কাষ্ঠনির্মিত হুঁকার নল নির্মাণপূর্বক ঐ গ্রাম কলিকাতার সহিত কারবারে এখনও বেশ দু’পয়সা অর্জন করিয়া থাকে। সূতা, গামছা ও কাপড় প্রস্তুত করিবার জন্য এবং অন্য নানা শিল্পকার্যেও কামারপুকুর এককালে প্রসিদ্ধ ছিল। বিষ্ণু চাপড়ি প্রমুখ কয়েকজন বিখ্যাত বস্ত্রব্যবসায়ী এই গ্রামে বাস করিয়া তখন কলিকাতার সহিত অনেক টাকার কারবার করিতেন। প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে গ্রামে এখনও হাট বসিয়া থাকে। তারাহাট, বদনগঞ্জ, সিহড়, দেশড়া প্রভৃতি চতুষ্পার্শ্বস্থ গ্রামসকল হইতে লোকে সূতা, বস্ত্র, গামছা, হাঁড়ি, কলসী, কুলা, চেঙ্গারি, মাদুর, চেটাই প্রভৃতি সংসারের নিত্যব্যবহার্য পণ্য ও ক্ষেত্রজ দ্রব্যসকল হাটবারে কামারপুকুরে আনয়নপূর্বক পরস্পরে ক্রয়বিক্রয় করিয়া থাকে। গ্রামে আনন্দোৎসবের অভাব এখনও লক্ষিত হয় না। চৈত্রমাসে মনসাপূজা ও শিবের গাজনে এবং বৈশাখ বা জ্যৈষ্ঠে চব্বিশপ্রহরীয় হরিবাসরে কামারপুকুর মুখরিত হইয়া উঠে। তদ্ভিন্ন জমিদারবাটীতে বারমাস সকলপ্রকার পালপার্বণ এবং প্রতিষ্ঠিত দেবালয়সকলে নিত্যপূজা ও পার্বণাদি অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। অবশ্য দারিদ্র্যজনিত অভাব বর্তমানে ঐ সকলের অনেকাংশে লোপসাধন করিয়াছে।

ঐ অঞ্চলে ৺ধর্মঠাকুরের পূজা

৺ধর্মঠাকুরের পূজায়ও এখানে এককালে বিশেষ আড়ম্বর ছিল। কিন্তু এখন আর সেই কাল নাই; বৌদ্ধ ত্রিরত্নের অন্যতম শ্রীধর্ম এখন কুর্মমূর্তিতে পরিণত হইয়া এখানে এবং চতুষ্পার্শ্বস্থ গ্রামসকলে সামান্য পূজামাত্রই পাইয়া থাকেন। ব্রাহ্মণগণকেও সময়ে সময়ে ঐ মূর্তির পূজা করিতে দেখা গিয়া থাকে। উক্ত ধর্মঠাকুরের ভিন্ন ভিন্ন নাম বিভিন্ন গ্রামে শুনিতে পাওয়া যায়। যথা, কামারপুকুরের ধর্মঠাকুরের নাম – ‘রাজাধিরাজ ধর্ম’; শ্রীপুরে প্রতিষ্ঠিত উক্ত ঠাকুরের নাম – ‘যাত্রাসিদ্ধিরায় ধর্ম’ এবং মুকুন্দপুরের সন্নিকটে মধুবাটী নামক গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ধর্মের নাম – ‘সন্ন্যাসীরায় ধর্ম’। কামারপুকুরের প্রতিষ্ঠিত ধর্মের রথযাত্রাও এককালে মহাসমারোহে সম্পন্ন হইত। নবচূড়াসমন্বিত সুদীর্ঘ রথখানি তখন তাঁহার মন্দিরপার্শ্বে নিত্য নয়নগোচর হইত। ভগ্ন হইবার পরে ঐ রথ আর নির্মিত হয় নাই। ধর্মমন্দিরটিও সংস্কারাভাবে ভূমিসাৎ হইতে বসিয়াছে দেখিয়া ধর্মপণ্ডিত যজ্ঞেশ্বর তাঁহার নিজ বাটীতে ঠাকুরকে এখন স্থানান্তরিত করিয়াছেন।

হালদারপুকুর, ভূতির খাল, আম্রকানন প্রভৃতির কথা

ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, তাঁতী, সদ্গোপ, কামার, কুমার, জেলে, ডোম প্রভৃতি উচ্চনীচ সকলপ্রকার জাতিরই কামারপুকুরে বসতি আছে। গ্রামে তিন-চারিটি বৃহৎ পুষ্করিণী আছে। তন্মধ্যে হালদারপুকুরই সর্বাপেক্ষা বড়। তদ্ভিন্ন ক্ষুদ্র পুষ্করিণী অনেক আছে। তাহাদিগের কোন কোনটি আবার শতদল কমল, কুমুদ ও কহ্লারশ্রেণী বক্ষে ধারণ করিয়া অপূর্ব শোভা বিস্তার করিয়া থাকে। গ্রামে ইষ্টকনির্মিত বাটীর ও সমাধির অসদ্ভাব নাই। পূর্বে উহার সংখ্যা অনেক অধিক ছিল। রামানন্দ শাঁখারীর ভগ্ন দেউল, ফকির দত্তের জীর্ণ রাসমঞ্চ, জঙ্গলাকীর্ণ ইষ্টকের স্তূপ এবং পরিত্যক্ত দেবালয়সমূহ নানাস্থানে বিদ্যমান থাকিয়া ঐ বিষয়ের এবং গ্রামের পূর্বসমৃদ্ধির পরিচয় প্রদান করিতেছে। গ্রামের ঈশান ও বায়ুকোণে ‘বুধুই মোড়ল’ ও ‘ভূতীর খাল’ নামক দুইটি শ্মশান বর্তমান। শেষোক্ত স্থানের পশ্চিমে গোচর-প্রান্তর, মানিকরাজা-প্রতিষ্ঠিত সর্বসাধারণের উপভোগ্য আম্রকানন এবং আমোদর নদ বিদ্যমান আছে। ভূতীর খাল দক্ষিণে প্রবাহিত হইয়া গ্রামের অনতিদূরে উক্ত নদের সহিত সম্মিলিত হইয়াছে।

ভূরসুবোর মানিকরাজা

কামারপুকুরের অর্ধক্রোশ উত্তরে ভূরসুবো নামক গ্রাম। শ্রীযুক্ত মানিকচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক বিশেষ ধনাঢ্য ব্যক্তির তথায় বাস ছিল। চতুষ্পার্শ্বস্থ গ্রামসকলে ইনি ‘মানিকরাজা’ নামে পরিচিত ছিলেন। পূর্বোক্ত আম্রকানন ভিন্ন ‘সুখসায়ের’, ‘হাতিসায়ের’ প্রভৃতি বৃহৎ দীর্ঘিকাসকল এখনও ইঁহার কীর্তি ঘোষণা করিতেছে। শুনা যায়, ইঁহার বাটীতে লক্ষ ব্রাহ্মণ অনেকবার নিমন্ত্রিত হইয়া ভোজন করিয়াছিলেন।

গড় মান্দারণ

কামারপুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব বা অগ্নিকোণে মান্দারণ গ্রাম। চতুষ্পার্শ্বস্থ গ্রামসকলকে শত্রুর আক্রমণ হইতে রক্ষা করিবার নিমিত্ত পূর্বে কোনকালে এখানে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ প্রতিষ্ঠিত ছিল। পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্রকায় আমোদর নদের গতি কৌশলে পরিবর্তিত করিয়া উক্ত গড়ের পরিখায় পরিণত করা হইয়াছিল।

উচালনের দীঘি ও মোগলমারির যুদ্ধক্ষেত্র

মান্দারণ দুর্গের ভগ্ন তোরণ, স্তূপ ও পরিখা এবং উহার অনতিদূরে শৈলেশ্বর মহাদেবের মন্দির এখনও বর্তমান থাকিয়া পাঠানদিগের রাজত্বকালে এইসকল স্থানের প্রসিদ্ধি সম্বন্ধে পরিচয় প্রদান করিতেছে। গড় মান্দারণের পার্শ্ব দিয়াই বর্ধমানে গমনাগমন করিবার পূর্বোক্ত পথ প্রসারিত রহিয়াছে। ঐ পথের দুইধারে অনেকগুলি বৃহৎ দীর্ঘিকা নয়নগোচর হয়। উক্ত গড় হইতে প্রায় নয় ক্রোশ উত্তরে অবস্থিত উচালন নামক স্থানের দীর্ঘিকাই তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। উক্ত পথের একস্থানে একটি ভগ্ন হস্তিশালাও লক্ষিত হইয়া থাকে। ঐসকল দর্শনে বুঝিতে পারা যায়, যুদ্ধবিগ্রহের সৌকর্যার্থেই এই পথ নির্মিত হইয়াছিল। মোগলমারির প্রসিদ্ধ যুদ্ধক্ষেত্র পথিমধ্যে বিদ্যমান থাকিয়া ঐ বিষয়ের সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে।

দেরে গ্রামের জমিদার রামানন্দ রায়ের কথা

কামারপুকুরের পশ্চিমে প্রায় একক্রোশ দূরে সাতবেড়ে, নারায়ণপুর ও দেরে নামক তিনখানি গ্রাম পাশাপাশি অবস্থিত আছে। এই গ্রামসকল এককালে সমৃদ্ধিসম্পন্ন ছিল। দেরের দীর্ঘিকা ও তৎপার্শ্ববর্তী দেবালয় এবং অন্যান্য নানা বিষয় দেখিয়া ঐ কথা অনুমিত হয়। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময়ে উক্ত গ্রামত্রয় ভিন্ন জমিদারিভুক্ত ছিল এবং উহার জমিদার রামানন্দ রায় সাতবেড়ে নামক গ্রামে বাস করিতেছিলেন। এই জমিদার বিশেষ ধনাঢ্য না হইলেও বিষম প্রজাপীড়ক ছিলেন। কোন কারণে কাহারও উপর কুপিত হইলে, ইনি ঐ প্রজাকে সর্বস্বান্ত করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইতেন না। ইঁহার পুত্রকন্যাদির মধ্যে কেহই জীবিত ছিল না। লোকে বলে, প্রজাপীড়ন-অপরাধেই ইনি নির্বংশ হইয়াছিলেন এবং মৃত্যুর পরে ইঁহার বিষয়-সম্পত্তি অপরের হস্তগত হইয়াছিল।

দেরে গ্রামের মানিকরাম চট্টোপাধ্যায়

প্রায় দেড়শত বৎসর পূর্বে মধ্যবিত্ত-অবস্থাসম্পন্ন ধর্মনিষ্ঠ এক ব্রাহ্মণপরিবারের দেরে গ্রামে বাস ছিল। ইঁহারা সদাচারী, কুলীন এবং শ্রীরামচন্দ্রের উপাসক ছিলেন। ইঁহাদিগের প্রতিষ্ঠিত শিবালয়সমন্বিত পুষ্করিণী এখনও ‘চাটুয্যে পুকুর’ নামে খ্যাত থাকিয়া ইঁহাদিগের পরিচয় প্রদান করিতেছে। উক্তবংশীয় শ্রীযুক্ত মানিকরাম চট্টোপাধ্যায়ের তিন পুত্র এবং এক কন্যা হইয়াছিল। তন্মধ্যে জ্যেষ্ঠ ক্ষুদিরাম সম্ভবতঃ সন ১১৮১ সালে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তৎপরে রামশীলা নাম্নী কন্যার এবং নিধিরাম ও কানাইরাম নামক পুত্রদ্বয়ের জন্ম হইয়াছিল।

তৎপুত্র ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের কথা

শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম বয়ঃপ্রাপ্তির সহিত অর্থকরী কোনরূপ বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন কি-না জানা যায় না। কিন্তু সত্যনিষ্ঠা, সন্তোষ, ক্ষমা, ত্যাগ প্রভৃতি যে গুণসমূহ সদ্ব্রাহ্মণের স্বভাবসিদ্ধ হওয়া কর্তব্য বলিয়া শাস্ত্রনির্দিষ্ট আছে, বিধাতা তাঁহাকে ঐ সকল গুণ প্রচুর পরিমাণে প্রদান করিয়াছিলেন। তিনি দীর্ঘ ও সবল ছিলেন, কিন্তু স্থূলকায় ছিলেন না; গৌরবর্ণ ও প্রিয়দর্শন ছিলেন। বংশানুগত শ্রীরামচন্দ্রে ভক্তি তাঁহাতে বিশেষ প্রকাশ ছিল এবং তিনি নিত্যকৃত্য সন্ধ্যাবন্দনাদি সমাপন করিয়া প্রতিদিন পুষ্পচয়নপূর্বক ৺রঘুবীরের পূজান্তে জলগ্রহণ করিতেন। শূদ্রের নিকট হইতে দানগ্রহণ দূরে থাকুক, শূদ্রযাজী ব্রাহ্মণের নিমন্ত্রণ তিনি কখনও গ্রহণ করেন নাই এবং যে-সকল ব্রাহ্মণ পণগ্রহণ করিয়া কন্যাসম্প্রদান করিত, তাহাদিগের হস্তে জলগ্রহণ পর্যন্ত করিতেন না। ঐরূপ নিষ্ঠা ও সদাচারের জন্য গ্রামবাসীরা তাঁহাকে বিশেষ ভক্তি ও সম্মানের চক্ষে দর্শন করিত।

ক্ষুদিরামগৃহিণী শ্রীমতী চন্দ্রাদেবী

পিতার মৃত্যুর পরে সংসার ও বিষয়সম্পত্তির তত্ত্বাবধান শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের স্কন্ধেই পতিত হইয়াছিল এবং ধর্মপথে অবিচলিত থাকিয়া তিনি ঐ সকল কার্য যথাসাধ্য সম্পন্ন করিতেছিলেন। ইতিপূর্বে বিবাহ করিয়া সংসারে প্রবেশ করিলেও তাঁহার পত্নী অল্প বয়সেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। সুতরাং আন্দাজ পঁচিশ বৎসর বয়ঃক্রমকালে তিনি পুনরায় দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেন। তাঁহার এই পত্নীর নাম শ্রীমতী চন্দ্রমণি ছিল; কিন্তু বাটিতে ইঁহাকে সকলে ‘চন্দ্রা’ বলিয়াই সম্বোধন করিত। শ্রীমতী চন্দ্রাদেবীর পিত্রালয় সরাটিমায়াপুর নামক গ্রামে অবস্থিত ছিল। তিনি সুরূপা, সরলা ও দেবদ্বিজপরায়ণা ছিলেন। কিন্তু হৃদয়ের অসীম শ্রদ্ধা, স্নেহ ও ভালবাসাই তাঁহার বিশেষ গুণ বলিয়া নির্দেশ করা যাইতে পারে এবং ঐ সকলের জন্যই তিনি সংসারে সকলের প্রিয় হইয়াছিলেন। সম্ভবতঃ সন ১১৯৭ সালে শ্রীমতী চন্দ্রমণি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। সুতরাং সন ১২০৫ সালে বিবাহের সময় তাঁহার বয়ঃক্রম আট বৎসর মাত্র ছিল। সম্ভবতঃ সন ১২১১ সালে তাঁহার প্রথম পুত্র রামকুমার জন্মগ্রহণ করে। উহার প্রায় পাঁচ বৎসর পরে শ্রীমতী কাত্যায়নী নাম্নী কন্যার এবং সন ১২৩২ সালে দ্বিতীয় পুত্র রামেশ্বরের মুখাবলোকন করিয়া তিনি আনন্দিতা হইয়াছিলেন।

জমিদারের সহিত বিবাদে ক্ষুদিরামের সর্বস্বান্ত হওয়া

ধর্মপথে থাকিয়া সংসারযাত্রানির্বাহ করা যে কতদূর কঠিন কার্য, তাহা শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের হৃদয়ঙ্গম হইতে বিলম্ব হয় নাই। সম্ভবতঃ তাঁহার কন্যা কাত্যায়নীর জন্মপরিগ্রহের কিঞ্চিৎকাল পরে তিনি বিষম পরীক্ষায় নিপতিত হইয়াছিলেন। গ্রামের জমিদার রামানন্দ রায়ের প্রজাপীড়নের কথা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করিয়াছি। দেরেপুরের কোন ব্যক্তির প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়া তিনি এখন মিথ্যাপবাদে আদালতে মকদ্দমা আনয়ন করিলেন এবং বিশ্বস্ত সাক্ষীর প্রয়োজন দেখিয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামকে তাঁহার পক্ষে সাক্ষ্যপ্রদান করিতে অনুরোধ করিলেন। ধর্মপরায়ণ ক্ষুদিরাম আইন-আদালতকে সর্বদা ভীতির চক্ষে দেখিতেন এবং ঘটনা সত্য হইলেও ইতিপূর্বে কখনও কাহারও বিরুদ্ধে উহাদিগের আশ্রয় লইতেন না। সুতরাং জমিদারের পূর্বোক্ত অনুরোধে আপনাকে বিশেষ বিপন্ন জ্ঞান করিলেন। কিন্তু মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রদান না করিলে জমিদারের বিষম কোপে পতিত হইতে হইবে, একথা স্থির জানিয়াও তিনি উহাতে কিছুতেই সম্মত হইতে পারিলেন না। অগত্যা এস্থলে যাহা হইয়া থাকে, তাহাই হইল; জমিদার তাঁহারও বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ প্রদানপূর্বক নালিশ রুজু করিলেন এবং মকদ্দমায় জয়ী হইয়া তাঁহার সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তি নিলাম করিয়া লইলেন। শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের দেরেপুরে থাকিবার বিন্দুমাত্র স্থান রহিল না। গ্রামবাসী সকলে তাঁহার দুঃখে যথার্থ কাতর হইলেও তাঁহাকে জমিদারের বিরুদ্ধে কোনই সহায়তা করিতে পারিল না। ঐরূপে প্রায় চল্লিশ বৎসর বয়ঃক্রমকালে শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম এককালে নিঃস্ব হইলেন।

ক্ষুদিরামের দেরে গ্রাম পরিত্যাগ

পিতৃপুরুষদিগের অধিকারিস্বত্বে ও নিজ উপার্জনের ফলে যে সম্পত্তি1 তিনি এতকাল ধরিয়া সঞ্চয় করিয়াছিলেন, বায়ুতাড়িত ছিন্নাভ্রের ন্যায় উহা এখন কোথায় এককালে বিলীন হইল! কিন্তু ঐ ঘটনা তাঁহাকে ধর্মপথ হইতে বিন্দুমাত্র বিচলিত করিতে সক্ষম হইল না। তিনি ৺রঘুবীরের শ্রীপাদপদ্মে একান্ত শরণ গ্রহণ করিলেন এবং স্থিরচিত্তে নিজ কর্তব্য অবধারণপূর্বক দুর্জনকে দূরে পরিহার করিবার নিমিত্ত পৈতৃক ভিটা ও গ্রাম হইতে চিরকালের নিমিত্ত বিদায়গ্রহণ করিলেন।


1. হৃদয়রাম মুখোপাধ্যায়ের নিকট শুনিয়াছি, দেরেপুরে শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের প্রায় দেড়শত বিঘা জমি ছিল।

সুখলাল গোস্বামীর আমন্ত্রণে ক্ষুদিরামের কামারপুকুরে আগমন ও বাস

কামারপুকুরের শ্রীযুক্ত সুখলাল গোস্বামীজীর কথা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করিয়াছি। সমস্বভাববিশিষ্ট ছিলেন বলিয়া শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরামের সহিত ইঁহার পূর্ব হইতে বিশেষ সৌহৃদ্য উপস্থিত হইয়াছিল। বন্ধুর ঐরূপ বিপদের কথা শুনিয়া তিনি বিশেষ বিচলিত হইলেন এবং নিজ বাটীর একাংশে কয়েকখানি চালাঘর চিরকালের জন্য ছাড়িয়া দিয়া তাঁহাকে কামারপুকুরে আসিয়া বাস করিবার জন্য অনুরোধ করিয়া পাঠাইলেন। শ্রীযুক্ত ক্ষুদিরাম উহাতে অকূলে কূল পাইলেন এবং শ্রীভগবানের অচিন্ত্য লীলাতেই পূর্বোক্ত অনুরোধ উপস্থিত হইয়াছে ভাবিয়া কৃতজ্ঞহৃদয়ে কামারপুকুরে আগমনপূর্বক তদবধি ঐ স্থানেই বাস করিতে লাগিলেন। বন্ধুপ্রাণ সুখলাল উহাতে বিশেষ আনন্দিত হইলেন এবং ধর্মপরায়ণ ক্ষুদিরামের সংসারযাত্রানির্বাহের জন্য এক বিঘা দশ ছটাক ধান্যজমি তাঁহাকে চিরকালের জন্য প্রদান করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *