৩০. শ্বেত মুষিক জাতক

৩০. শ্বেত মুষিক জাতক

“আমি তোমার এ গৃহ হতে” এ ধর্মদেশনা ভগবান বুদ্ধ কপিলবস্তু নিগ্রোধারামে বাস করবার সময় পূর্বকালে শীল রক্ষার জন্য জীবন পরিত্যাগের বিষয় সম্পর্কে বলেছিলেন।

এক দিবস ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় উপবেশন করে পরস্পর এরূপ আলোচনা করতে লাগলেন–“অহো বন্ধুগণ, আমাদের শাস্তা বুদ্ধ যথাকালেই দেব মনুষ্যের নাথ হয়েছেন। এরূপে শাস্তার গুণ বর্ণনা করতে করতে ভিক্ষুগণ ধর্ম সভায় উপবিষ্ট আছেন, তৎকালে বুদ্ধ স্বীয় বাসস্থান থেকে দিব্যকর্ণে ভিক্ষুগণের ঐ আলোচনা শোনলেন। তখন তিনি বাসস্থান হতে বের হয়ে ধর্মসভায় এসে প্রজ্ঞাপ্ত শ্রেষ্ঠ বুদ্ধাসনে উপবেশন করলেন এবং তথায় উপস্থিত ভিক্ষুগণকে বললেন–“তোমরা বর্তমান কি বিষয়ের আলোচনা নিয়ে এখানে উপবিষ্ট আছ? তখন ভিক্ষুগণ বিনীত ভাবে তাদের আলোচ্য বিষয় বুদ্ধের নিকট ব্যক্ত করলেন। বুদ্ধ তাদেরকে বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, তথাগত শুধু এখন যে দেব-মনুষ্যের নাথ, তা নয়। পূর্বেও আমি বোধিসত্ত্বাবস্থায় শীল রক্ষা করে নিজের জীবনের প্রতি লক্ষ্য না করে অর্থাৎ জীবনের প্রতি আসক্ত না হয়ে পরকে নিজের দেহ দান দিয়েছিলাম। এ বলে ভগবান নীরব হলেন। তখন তথায় উপবিষ্ট ভিক্ষুগণের প্রার্থনায় সে অতীত কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন–

অতীতকালে বারাণসীতে ব্রহ্মদত্ত নামক রাজা রাজত্ব করবার কালে বোধিসত্ত্ব শ্বেত মূষিক রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তখন তার বর্ণ হয়েছিল অত্যন্ত পরিশুদ্ধ শ্বেত শঙ্খের ন্যায় শ্বেতবর্ণ। তাই তার নাম দিল শ্বেত মূষিক। এ শ্বেত মূষিক সর্বদা পঞ্চশীল রক্ষা করতেন। তখন ‘সুধর্ম পালক’ নামক এক ব্যক্তি সে মূষিক পোষণ করতেন। তাই সারা দেশে সে বোধিসত্ত্ব শ্বেত মুষিকের নাম প্রকট হয়েছিল। “সুধর্ম শ্বেত।” একদা বারাণসীবাসী এক মহা শ্ৰেষ্ঠী প্রাতঃকালে ব্রহ্মদত্ত রাজার নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন, তাঁর আদেশ নির্দেশ পালন করে সন্তোষ বিধানের জন্য। তিনি তথায় যথাযোগ্য কার্য সম্পাদনান্তর মধ্যাহ্ন কালে যে কোন। একটা প্রয়োজনে ঐ সুধর্ম পালকের গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তথায় শীলবান বোধিসত্ত্ব সুধর্ম শ্বেতকে দেখে চিন্তা করলেন–এ মূষিক সর্বদা শীল রক্ষা করে। তবে আমার নিকট কোন শীল নেই। এখন হতে আমি শীল রক্ষা করব।” এচিন্তা করে “সুধর্ম শ্বেত” পালক ব্যক্তিকে আহ্বান করে নিন্মোক্ত গাথাযোগে বললেন–

১। “আমি তোমার গৃহ হতে এ মূষিক নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখি। তুমি আমার নিকট হতে ধন ও ভোগ সম্পত্তি গ্রহণ করে তৎ-বিনিময়ে তোমার এশ্বেত মূষিকটি আমাকে দাও।”

সে সময় বারাণসীবাসী এক ব্রাহ্মণ রাজার সন্তোষ বিধানের জন্য মধ্যাহ্নকালে বারাণসী রাজের নিকট উপস্থিত হলেন। তথায় তিনি স্বীয় কার্য সম্পাদন করে কোন কার্যবশত উক্ত ‘সুধর্ম শ্বেত’ পালকের বাড়ীতে উপস্থিত হলেন। তিনিও তথায় ঐ শীলবান শ্বেত মূষিকটি দেখে সুধর্ম পালককে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–

২। “ভদ্র, তুমি আমার নিকট হতে বহু ধন-ধান্য ও ভোগসম্পদ গ্রহণ করে এমন কি সর্বপ্রকার ধনও গ্রহণ করে তৎবিনিময়ে তোমার শ্বেত মূষিকটি আমাকে দাও।” সুধর্ম পালক এ দু’জনের যাঞ্চা বাক্য শুনে তাদের নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–

৩। “আমার এ শ্বেত মূষিক আপনাদিগকে দেবনা। যে হেতু এ শীলবান মূষিক আমার গৃহেই বর্ধিত হয়েছে।” এবলে এদের বিদায় করলেন। এর পর হতে মূষিকটি সযত্নে সুক্ষ্ম বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদন করে অন্তঃপুরেই পোষণ করতে লাগলেন। তকালে বোধিসত্ত্ব চিন্তা করলেন–“এখন আমি শীল রক্ষা করছি। কেহ যদি আমাকে নিয়া ক্রীড়া করে, তার মহা পাপ হবে। যে হেতু–আমার শীল অতি শ্রেষ্ঠ বিধায়। সে যদি অতি দৃঢ়ভাবে আমাকে ধরে তত্বারাও আমার দুঃখ বেদনা উৎপন্ন হবে। কেহ যদি আমাকে ধরে আকাশে উৎক্ষেপণ করবে, তাতেও আমি অতি দুঃখ বেদনাগ্রস্ত হব। কেহ আমার মুখে ও দেহে থুথু, সিকনি ইত্যাদি যে কোন ঘৃণ্য বস্তু নিক্ষেপ করবে, কেহ আমাকে দৃঢ়ভাবে বন্ধন করলে এতেও আমি অতিশয় দুঃখ বেদনা পাব। আমার দুঃখ বেদনাদায়ক লোকেরা অপায়ে গমন করবে।” বোধিসত্ত্ব এরূপ চিন্তা করে সুধর্ম পালককে ডেকে নিতাক্ত তিনটি গাথা যোগে বললেন–

৪-৬। “যে আমাকে বন্ধনাদি দ্বারা নিপীড়ন করবে, সে সর্বদা ইহপরকালের জন্য স্বীয় দুঃখ উৎপাদন করবে। আপনি আমাকে সর্বদা অন্ন পানীয় ও ধান্যের দ্বারা রক্ষা করে আসছেন। তাই আপনি দেব নরলোকে সুখী হবেন। আমি আপনাকে কি প্রকারে শীল সম্পদে সমৃদ্ধ করতে পারব?”।

তখন বোধিসত্নের শীল তেজে সুধর্ম পালক সর্ববিধ পরিভোগ সম্পদে, দাস দাসী সম্পদেও মহা যশঃ কীর্তি সম্পদে সমৃদ্ধ হলেন। জনগণ তা দেখে ঐ ব্রাহ্মণকে বললেন–‘ভবৎ মহা ব্রাহ্মণ, এখন সে সুধর্ম পালক শ্বেত মূষিক পোষণের ফলে সর্ববিধ ধন ও পরিভোগ সম্পদে সমৃদ্ধ এবং দাস-দাসী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে মহা যশস্বী ও মহা পরিবারশালী হয়েছেন।” ব্রাহ্মণ জনগণ মুখে একথা শুনে পরশ্রীকাতরতায়। মত্ত হয়ে ক্রোধভরে নিজের কর্মচারী বৃন্দকে নিন্মোক্ত দুটি গাথা যোগে আদেশ করলেন

৭-৮। “ওহে তোমরা শীগগির গিয়ে শ্বেত মূষিকটা নিয়ে আস। তৎবিনিময়ে আমি তোমাদিগকে বহু ধন ও পরিভোগ্য বস্তু দেব। সুতরাং তোমরা মূষিক সুষ্ঠরূপে ধরে এনে আমাকে দিয়ে বহু ধন সম্পদ লাভ করবে। সে শ্বেত মূষিক সর্বদা আমার নিকট সুখে বাস করবে।”

ব্রাহ্মণের এ নির্দেশ শুনে কর্মচারীরা চিন্তা করলেন–‘সে শ্বেত মূষিক সর্বদাই পঞ্চশীল রক্ষা করে। তার শীল তেজেই সে মূষিক পালক মহা ভোগ সম্পদ শালী, মহা ধনী ও মহাযশঃস্বী। যদি আমি ব্রাহ্মণের আদেশে সে মূষিক ধরে নিয়ে আসি, তাহলে আমার উৎপাত হবে বলে মনে হয়। এমনকি জীবনও সংশয় হতে পারে। যদি তা ধরে নিয়ে ব্রাহ্মণকে না দিই, তাহলে আমার চিত্ত সর্বদা আতংকগ্রস্থ থাকবে। কারণ ব্রাহ্মণ হয়তঃ আমার অনর্থও করতে পারে। এখন কিইবা করব? এরূপ চিন্তা করে সে অগত্যা সুধর্ম পালকের গৃহে উপস্থিত হলেন। তথায় সে শ্বেত মূষিক দেখা মাত্রই তা ধরে বেগে দৌড়ে গিয়ে ব্রাহ্মণকে এনে দিল। গৃহে ঢুকে জোরপূর্বক মূষিক নিয়ে যাবার সময় সুধর্ম পালকের গৃহে মহা কোলাহলের সৃষ্টি হল। বহু লোক কোলাহল সহকারে ঐ ব্রাহ্মণ চাকুরের পিছু পিছু দৌড়াতে লাগল। বারাণসী মহা শ্ৰেষ্ঠী এসব কোলাহলময় জনস্রোত দেখে ভীত ত্রাসিত হল। এবং দেহ। হতে ঘর্ম নির্গত হতে লাগল। তখন মহাশ্রেষ্ঠী স্বীয় দেহরক্ষী খড়গ খানা নিয়ে প্রাঙ্গণ দ্বারে দাঁড়িয়ে ঐ কোলাহল বিষয় জানবার জন্য এক চাকর পাঠিয়ে দিলেন। চাকর ত্বরিৎ গতিতে ঐ ব্রাহ্মণের গৃহে গিয়ে দেখলেন–শ্বেত মূষিক সম্পর্কেই এ বিরাট কোলাহল। সে চাকরটিও সুযোগ লাভ করে তখনই শ্বেত মূষিকটি মহা শ্রেষ্ঠীর গৃহে নিয়ে গেল। সুধর্ম পালকের গৃহ হতে ঐ শ্বেত মূষিক অপহৃত হওয়ার পর হতে ক্রমান্বয়ে সুধর্ম পালকের ধন ও ভোগ সম্পদ পরিক্ষীণ হতে লাগল। দাস-দাসী পুত্র-দার বিভিন্ন স্থানে চলে গেল। ক্রমে তিনি দীন-হীন কাংগাল হয়ে গেল। গায়ে পরণে মাত্র দুটি জীর্ণ-শীর্ণ বসন ধারণ করে প্রত্যহ লোকের নিকট অন্ন ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন তখন বোধিসত্ত্ব মহা শ্ৰেষ্ঠীর গৃহে অবস্থানকালীন চিন্তা করলেন–“আমার প্রভু সুধর্ম পালক এখন কিভাবে আছেন তা আমি জানতে পারছি না আর আমি যে এখানে আছি, তাও তিনি জানেন না। এ চিন্তা করে একদা। তিনি গোপনে শ্রেষ্ঠী গৃহ হতে বের হয়ে হিমালয়ে প্রবেশ করলেন। তথায় তিনি প্রমোদিত চিত্তে শীল রক্ষা করে এক বৎসরকাল বাস করলেন। তারপর হঠাৎ একদিন সুধর্ম পালকের গৃহ দেখবার জন্য তার প্রবল ইচ্ছা উৎপন্ন হল। তাই তিনি হিমালয় হতে বের হয়ে ক্রমান্বয়ে একরাত্রে এ সুধর্ম পালকের গৃহে এসে প্রবেশ করলেন। তিনি সে গৃহের নানাস্থানে গিয়ে দেখলেন, পূর্বের সে ধন-ধান্য, পুত্র-দার, দাস-দাসী ও পরিভোগ্য বস্তু প্রভৃতি কিছুই দেখলেন না। গৃহে অন্য এক, নিস্থানে এসে দেখলেন একখানা জীর্ণ শীর্ণ রথ, এক স্থানে একটি ভগ্ন পাত্রে কতেক দুর্গন্ধ ভাত। তার পাশে শুয়ে আছেন সুধর্ম পালক। তার গায়ে পরণে আছে মাত্র দুটি জীর্ণ শীর্ণ বসন। বোধিসত্ত্ব ইহা দেখে কম্পিত দেহে ও অশ্রু বিগলিত নেত্রে সুধর্ম পালকের কর্ণ সমীপে এসে রোদন করতে করতে বললেন–হে প্রভু, এখন উঠে আমাকে দেখুন ইহা শুনে সুধর্ম পালক বললেন–“তুমি কে আমার সাথে কথা বলছ?” বোধিসত্ত্ব বললেন–“প্রভো, আমি আপনার নিকট এসেছি।” তখন সুধর্ম পালক শয়ন থেকে উঠে বোধিসত্ত্বকে দেখে জানতে পারলেন পূর্বের সে শ্বেত মূষিক। ইহা জ্ঞাত হয়ে তিনি অত্যন্ত প্রীতিফুল্ল হলেন এবং নিজের রত্নমুকুট নিজের মস্তকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে রত্ন দর্শনকারী চক্রবর্তী রাজার ন্যায় চিত্তে প্রীতি উৎপাদন পূর্বক পূর্বকালের স্বীয় সম্পত্তি বিষয় অনুসরণ করে বোধিসত্ত্বের নিকট রোদন করতে লাগলেন। তখন মূষিক তাকে আশ্বাস প্রদান করে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে বললেন–

৯-১০। “প্রভো, আমি আপনাকে সমস্ত অভাব-দুঃখ হতে মুক্ত করে দেব। আমি এখন আপনার হারানো সমস্ত বস্তু যথাস্থানে প্রতিষ্ঠা করতে এসেছি। আপনি অনুশোচনা করবেন না। প্রভো, এ হতে আপনি সর্বদা সুখী হবেন। পূর্বের ন্যায় পুত্র দার দাস-দাসী সম্পন্ন হবেন।”

এ বলে মহাসত্ত্ব তাঁর স্ত্রী-পুত্র, দাস-দাসী এবং পোয্য জনগণ কাউকে না দেখে সুধর্ম পালককে জিজ্ঞাসা করলেন–“প্রভো, পূর্বে আপনার এ গৃহে বাসকারী জনগণ এখন কোথায়?” সুধর্ম পালক তা শুনে কেঁদে কেঁদে বললেন–“তাত, তুমি এ গৃহ হতে বের হওয়ার সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে আমি দরিদ্র হয়ে পড়ি। তাই সবাইকে বিক্রি ও বন্ধনাদি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি। এখন নিরুপায় হয়ে অন্ন ভিক্ষা করে কোন প্রকারে বেঁচে আছি মাত্র। এ নিদারুণ করুণ কাহিনী শুনে বোধিসত্ত্ব তাকে বার বার বললেন–“বাবা, তাহলে আপনি আমাকে নিয়ে রাজার নিকট বিক্রি করুন।” ইহা শুনে রাত্রি শেষ হওয়ার পর সুধর্ম পালক প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে ওন করে অগত্যা শ্বেত মুষিকটি লয়ে রাজবাড়ীর দিকে যাত্রা করলেন।। তিনি ক্রমে রাজবাড়ীর বৰ্হিদ্বার রক্ষা করে বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। দ্বার রক্ষক শ্বেত মূষিকটি দেখে বলল–“এ মূষিকটি আমাকে দিন। আপনি যা মূল্য চান, তা দেব। ইহা শুনে সুধর্ম পালক তাকে মূষিক না দেওয়ার ইচ্ছায় বললেন–“দ্র দৌবারিক, আমার এ মূষিক কোটি টাকায়ও তোমাকে দেব না।” দৌবারিক বল্ল–“তবে আপনার এ মূষিকের মূল্য কি পরিমাণ হবে?” তিনি বললেন–“তা যখন তোমাকে দেব না, তবে মূল্যের প্রমাণ জানাটা নিষ্প্রয়োজন।” এ বলে তিনি বোধিসত্ত্বকে সূক্ষ বস্ত্রে পোটলী বেঁধে সে স্থান ত্যাগ করলেন। বারাণসী বাসী মহাশ্রেষ্ঠী তাঁকে দেখে আহ্বান করে বললেন–“ভবৎ, তুমি আমার গৃহে এসে ক্ষণেক বিশ্রাম করে যাও!” শ্ৰেষ্ঠী ভার হস্তে ঐ শ্বেত মূষিক দেখে বহুধন দ্বারা সে মূষিকের বিশেষ ভাবে পূজা সৎকার করলেন। ঐ সূক্ষ্ম বস্ত্রে দু’খানা লোম পতিত হয়েছে দেখে শ্ৰেষ্ঠী সুধর্ম পালকের নিকট হতে তা যাঞ্চা করলেন। তখন সুধর্ম পালক শ্ৰেষ্ঠীকে একখানা মাত্র লোম দিয়ে অন্যখানা সৌভাগ্য শ্রী দায়ক মনে করে নিজেই রেখে মহাশ্রেষ্ঠীকে নিন্মোক্ত গাথাত্ৰয়ে বললেন–

১১-১৩। “মহাশ্রেষ্ঠীন, অদ্য শীঘ্রই আমাকে রাজার নিকট নিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করায়ে দিন। আমার এ আশা পূর্ণ করুন।” তাত, রাজা আমাকে সর্বদা ধন দান দ্বারা বর্ধন করবার জন্য আমি এ মূষিকের কথানুসারে একে রাজার নিকট বিক্রি করব। এ শ্বেত মূষিক রাজার নিকট বাস করবার জন্য এবং আমার ধন লাভের জন্য আমাকে রাজার নিকট নিয়ে চলুন।” ইহা শুনে মহাশ্রেষ্ঠী তাঁকে সাথে করে ব্রহ্মদত্ত রাজার অনতিদূরে পরিষদের মধ্যভাগে গিয়ে বসলেন। তখন রাজা সুধর্ম পালকের হস্তে শ্বেত মূষিক দেখে শ্ৰেষ্ঠীকে নিন্মোক্ত গাথা যোগে জিজ্ঞাসা করলেন–

১৪। “হে মহাশ্রেষ্ঠীন, আপনার সাথে যে লোকটি শ্বেত মূষিক নিয়ে এখানে এসেছে, তার এখানে আসার কারণ কি? তার সমস্ত বিষয় আমাকে বলুন। আমি এ বিষয় আপনার নিকট জানতে চাই।” তা শুনে মহাশ্রেষ্ঠী রাজাকে এর সমস্ত বিষয় ব্যক্ত করলেন। তখন ব্রহ্মদত্ত রাজা সুধর্ম পালককে নিন্মোক্ত গাথা যোগে জিজ্ঞাসা করলেন–

১৫। “হে সজ্জন, তুমি এ মূষিক লয়ে শ্রেষ্ঠী সঙ্গে আমার নিকট কোথা হতে এসেছ? এ শ্বেত মূষিকের মূল্য তোমায় কত দিতে হবে।” রাজার কথা শুনে সুধর্ম পালক কৃতাঞ্জলি হয়ে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–

১৬। “মহারাজ, আমি আপনার এ নগরেই বাস করি। আমি স্বীয় গৃহ হতেই আপনাকে উপহারটি দেওয়ার জন্য এখানে এসেছি। আমার সারাজীবন জীবিকা নির্বাহোপযোগী ভোগ-সম্পদ দিয়ে এ মঙ্গলদায়ক মূষিকটি সানন্দে গ্রহণ করুন। এবং ইহাকে নিরাপদে ও সুখে রক্ষা করুন। রাজা ইহা শুনে অতিশয় তুষ্ট চিত্তে তাঁকে বহুধন দেওয়ার জন্য কোষাধ্যক্ষকে গাথা যোগে বললেন–

১৭। “হে অর্থ সচিব, তুমি এ ব্যক্তিকে দাস, দাসী গাড়ী ও বৃষ প্রত্যেকটি এক এক শত করে দাও। শ্রেষ্ঠ একখানা গ্রাম ও বহু ধন ধান্য সংগ্রহ করে দাও।”

তখন সে অর্থ সচিব রাজার নির্দেশ মতে সমস্ত বস্তু এক স্থানে সাজিয়ে সুধর্ম পালককে প্রদান করলেন। তিনি এ ধন সম্পদ পেয়ে বন্ধক দেওয়া স্ত্রী-পুত্র, দাস-দাসী প্রভৃতি পরিজনবর্গকে টাকার বিনিময়ে পুনরায় এনে পূর্বের ন্যায় পুনঃ পরিবার সম্পন্ন ধন-ধান্যে সমৃদ্ধ, যশ-কীর্তিতে মহীয়ান ও সর্ববিষয়ে মহাসম্পদ লাভী হলেন। তিনি এরূপে মহা সুখসম্পদের মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্য জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন। তারপর তিনি পরমায়ুর অবসানে মৃত্যুর পর যথাকৰ্মানুগতি লাভ করলেন। এদিকে মহাসত্ত্বও ব্রহ্মদত্ত রাজার নিকট বাস করে সর্বদা তাঁকে নিন্মোক্ত ছয়টি গাথায় ধর্মদেশনা করতেন

১৮-২৩। “মহারাজ, আপনি সর্বদা পিতা, মাতা, স্ত্রী, পুত্র, মিত্র, অমাত্য সৈন্য-সামন্ত ও বাহকাদির প্রতি যথা ধর্ম আচরণ করবেন। এ ধর্মাচরণের ফলে স্বর্গেই গতি লাভ করবেন। সর্বদা গ্রামে, নগরে, রাজ্যে, জনপদে, শান্ত শীলবান শ্ৰমণদের প্রতি ধর্মাচরণ করুন। এত দ্বারা নিশ্চয়ই আপনার স্বর্গবাস হবে। হে রথার্ষভ, সর্বদা বৃদ্ধ, শ্ৰমণ-ব্রাহ্মণ, সিংহব্যাঘ্রাদি মৃগ ও হংসাদি পক্ষীসমূহের প্রতি যথাধর্ম আচরণ করুন। এতদ্বারা ত্রিদিবালয়ে গমন করবেন। মহারাজ, আপনি এরূপে ধর্মাচরণ করুন। ধর্মাচরণ দ্বারা অনন্ত সুখ লাভ হয়। ধর্মাচরণ কারীরা কখনো দুর্গতিতে যায় না। ধর্মাচরণের ইহাই ফল। ইন্দ্রাদি সমস্ত দেবগণ এবং অন্যান্য জনগণও দিবারাত্র ধর্মাচরণ করেই। দীর্ঘদিন যাবৎ স্বর্গে অবস্থান করেন। মহারাজ, আপনি সর্বদা পুণ্য কৰ্ম্মে অপ্রমত্ত থাকবেন। এরূপে ধৰ্ম্মাচরণ করে স্বর্গলোকে গমন করুন।”

ব্ৰহ্মদত্ত রাজ বোধিসত্ত্বের এরূপ ধৰ্ম্মদেশনা শুনে অতিশয় সন্তুষ্ঠ চিত্তে বহু ধন দ্বারা মহাসত্ত্বের পূজা করার পর স্বীয় পুত্র ব্রহ্মদত্ত রাজ কুমারকে সমস্ত রাজ-সম্পত্তি প্রদান পূর্বক অভিষিক্ত করলেন। তৎপর পরমায়ুর অবসানে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। তখন বোধিসত্ত্ব ব্রহ্মদত্ত রাজকুমার প্রমুখ মহাজনগণকে সর্বদা নিন্মোক্ত গাথায় উপদেশ দিতেন–

২৪। “সর্বদা শান্ত ও পণ্ডিতদের সঙ্গ ও সেবা করবে। কদাচ অশান্তের সঙ্গ ও ভজনা করবে না। অশান্তেরা অপায়ে নিয়ে যায়। শান্ত ব্যক্তিরা দেবলোক প্রাপ্তির পথ নির্দেশ করে। তদ্ধেতু পণ্ডিত গণেরই সঙ্গ ও সেবা করবে।”

এ বলে মহাসত্ত্ব রাজা প্রমুখ মহাজনগণকে অনুশাসন করে পুনঃ বললেন–ভবৎগণ, এ হতে আপনারা সবাই দানাদি পুণ্য কর্মে অপ্রমত্ত হয়ে যথাশক্তি পুণ্যকর্ম করুন। এ বলে বোধিসত্ত্ব রাজবাড়ী হতে বের হয়ে অনুক্রমে হিমালয়ে গিয়ে কোন একটা নিরাপদ স্থানে বাস করতে লাগলেন। তথায় তিনি একাকী বাস করে “আমি সর্বদা পঞ্চশীল রক্ষা করব। অমাবস্যা, পূর্ণিমা ও অষ্টমী তিথিতে অষ্টাঙ্গ উপোসথ শীল এবং কোন কোন সময় দশশীলও রক্ষা করব।” এরূপ চিন্তা করে তথায় শীল পালনে নিরত হয়ে বাস করতে লাগলেন। তৎকালে বোধিসত্ত্বের শীল তেজে দেবরাজ ইন্দ্রের বাসভবন উত্তপ্ত হল, দেবরাজ তা অনুভব করে নিন্মোক্ত গাথা যোগে বললেন–

২৫। “বোধ হয় কোন মনুষ্য বা দেবতা আমার আসন হতে আমাকে চ্যুত করবার জন্য পঞ্চশীল, দান ও ব্রহ্মচর্য ধর্ম সম্যকরূপে পূর্ণ করছেন।” তখন দেবরাজ এর সম্যক কারণ চিন্তা করে জ্ঞাত হলেন যে–“এ উষ্ণতা বোধিসত্ত্বেরই শীল তেজানুভাব” তা সম্যক রূপে জ্ঞাত হয়ে অতি সন্তুষ্ট চিত্তে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় ধ্বনিত করলেন

২৬-২৭। “সে অনাথ সুখে বাস করুক। তার শীল প্রভাবে নিরয় শূন্য হবে, দেব লোক পরিপূর্ণ হবে। শীল পালনে রত্ন অত্র শ্বেত মূষিক বুদ্ধাঙ্কুর শীল পারমী পূর্ণ করে অনাগতে বুদ্ধ হবেন।

দেবরাজ সম্যকরূপে অবগত হলেন–এখন এ বোধিসত্ত্ব শীল রক্ষা করে ইন্দ্ৰত্ব, ব্রহ্মত্ব, পচেক বুদ্ধত্ব অথবা শ্রাবকত্ব প্রার্থনা করছেন না। অপিচ তিনি এ শীলগুণে অনাগতে সম্যক সম্বুদ্ধত্বই প্রার্থনা করছেন।” ইহা জ্ঞাত হয়ে তিনি সংকল্প করলেন–“আমি এখন তথায় গিয়ে তাঁর শীল পরমার্থ পারমীর যেন পূর্ণতা লাভ হয় তাই করব।” এ চিন্তা করে ব্রাহ্মণ বেশে তাঁর নিকট উপস্থিত হলেন। তিনি ব্রাহ্মণকে দেখে অতিশয় সন্তোষ সহকারে নিন্মোক্ত গাথাযোগে তার আগমন কারণ জিজ্ঞেস করলেন–

২৮। “হে মহা ব্রাহ্মণ, আপনি কোন প্রয়োজনে এ মহা বনে এসেছেন? তা আমাকে বলুন।” তা শুনে ব্রাহ্মণ তাঁকে সম্বোধন করে তিনটি গাথায় বললেন–

২৯-৩১। “হে শ্বেত অদ্য পূর্ণ উপোসথ দিনে আমি কিছুই ভক্ষণ করিনি। এখন আমি মাংসের ক্ষুধার্ত। মাংস খাইবার ইচ্ছায়ই আমি এখানে এসেছি। হে শ্বেত মূষিক, অদ্য আমি কিছু মাত্রও মাংস পাইনি; ক্ষুধায় আমার প্রাণ বায়ু বের হয়ে যাবে। শিল্পির আমাকে মাংস দাও। একান্তই যদি তোমার নিকট আমাকে দেওয়ার মত কোন মাংস না থাকে, তবে তোমার দেহ-মাংস যাঞ্চা করছি। আমাকে খেতে দাও।” বোধিসত্ত্ব ব্রাহ্মণের এ যাঞ্চা শুনে আগামী কল্যই যেন তাঁর সর্বজ্ঞতা লাভ হবে, এরূপ অনুভব করে প্রীতিফুল্ল চিত্তে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–

৩২-৩৪। “হে ব্রাহ্মণ, আপনি আমার নিকট যে মাংস প্রার্থনা করলেন, তা আপনাকে দেব। অনাগতে বোধি লাভের জন্য দানে আমার মন অতি রমিত হয়। আমার নিকট অদ্য কোন মাংস নেই। আপনি মাংস খেতে ইচ্ছুক হলে, আমাকেই ভক্ষণ করুন। আপনি কাষ্ঠ আহরণ করে অগ্নি উৎপাদন করতঃ প্রজ্বরিত অঙ্গার স্তুপ তৈরী করুন। আমি সে অঙ্গার স্তুপে পতিত হব। সেখান হতে আমার অগ্নি পক্ক মাংস গ্রহণ করবেন। অনাগতে বোধি লাভের জন্যই আপনাকে এরূপে আমার মাংস দান দিচ্ছি।” ব্রাহ্মণ বোধিসত্নের এরূপ বাক্য শুনে শুধু কাষ্ঠাদি সংগ্রহ করে তাতে অগ্নি সংযোগ করলেন। প্রজ্জ্বলিত অঙ্গার রাশি প্রস্তুত হলে বোধিসত্ত্বকে বললেন–, তখন তিনি নিজের দেহদান দেবগণের অনুমোদনের জন্য নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–

৩৫-৩৭। “ভবৎ দেবগণ, আপনারা সবাই আমার দেহ দান অনুমোদন করুন। বোধি লাভের জন্যই আমার এ উত্তম দান। এ প্রিয় জীবন ব্রাহ্মণকে দান করছি। অনাগতে বোধি লাভেরই জন্য আমার এদান আপনারা অনুমোদন করুন। এদেহ আমার বড়ই প্রিয়। কিন্তু সৰ্ব্বজ্ঞতা জ্ঞান ইহার চেয়েও আমার অতি প্রিয়। তাই আমি জীবন দান করছি। আপনারা তা। সর্বান্তঃকরণে অনুমোদন করুন।”

এবলে মহাসত্ত্ব আগামী কল্যই বুদ্ধত্ব লাভ করার ন্যায় মনে করে নির্ভয়ে অত্যন্ত প্রতিফুল্ল মনে বললেন–“মহা ব্রাহ্মণ, আমার দেহ মাংস এ অঙ্গারে পরিপক্ক হওয়ার পর আপনি নিজেই গ্রহণ করে যথেচ্ছা ভক্ষণ করবেন।” এবলে সেই প্রজ্বলিত অঙ্গার রাশিতে লাফিয়ে পড়লেন। অখণ্ড শীল পালন ও অনুদান তেজানুভাবে তখনই সপ্তরত্নে বিচিত্রিত রথচক্র প্রমাণ এক স্বর্ণপদ্ম অঙ্গাররাশি ভেদ করে উঠে উর্ধে মহাসড়কে বক্ষে ধারণ করল। এ কারণেই বোধিসত্নের দেহে সামান্য উষ্ণভাবও অনুভূত হল না। তখন পৃথিবী কম্পনাদি বহু আশ্চর্য ব্যাপার প্রাদুর্ভূত হল। সে বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিতাক্ত ছয়টি গাথা ভাষণ করলেন–

৩৮-৪৩। “তখন ঐ শীল রক্ষা ও দানরত শ্বেত মূষিক বোধিলাভের জন্য দেবরাজকে দেহ দান করেছিলেন। বোধিসত্ত্বের দেহ দান কালে ভীষণ ললামহর্ষণকর ভাবে মহাপৃথিবী কম্পিত হয়েছিল। তখন সমগ্র বনলী ভীষণ রোমাঞ্চকর ভাবে সংক্ষোভিত হয়েছিল। দেবরাজকে দানোত্তম দেহ দানের সময় সমগ্র বন বিপুলভাবে প্রধ্বনিত হয়েছিল। এ দান তেজে তখন সাগর জল উচ্ছ্বসিত হয়েছিল, সবল অলঙ্কৃত সুমেরু পর্বতরাজ মস্তক অবনমিত হয়েছিল। পৃথিবী আলোকময় সমুজ্জ্বল হয়েছিল। সাধুবাদ শব্দে দিক্‌বিদিক মুখরিত হয়েছিল এবং মহাশব্দ সমগ্র হিমালয়ে ও তার চারদিকে ব্যাপ্ত হল।” অতঃপর দেবরাজ ইন্দ্র মহাসক্তের শ্রেষ্ঠ অভিপ্রায় জ্ঞাত হয়ে তাঁর বহুবিধ স্তুতি করলেন তা প্রকাশ মানসে শাস্তা নিতাক্ত পাঁচটি গাথা বললেন–

৪৪-৪৮। “তাঁর সঙ্কল্প জ্ঞাত হয়ে দেবরাজ তাঁকে এরূপ বললেন–“দেব-মানবের মধ্যে আপনারই জয়। পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ভৈরব শব্দে নিনাদিত হয়েছিল। সমগ্র আকাশে বিদ্যোলহরীর প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। হিমালয় পৰ্ব্বত ও সুমেরু পৰ্বত বাসী দেবগণ নিজের বিমান দ্বারে স্থিত হয়ে সানন্দে সে দান অনুমোদন করেছিল। ইন্দ্র ব্রহ্মা প্রজাপতি, সোম, যাম, বৈশ্রবন প্রভৃতি দেবগণ দুষ্কর কার্য এরূপ অনুমোদন করেছিলেন।” আপনি যে উত্তম দেহ দান করছেন, এতে মনোজ্ঞ শ্রেষ্ঠ দান দ্বারা স্বর্গে গিয়ে সুখী হবেন।”

এবলে দোজ ইন্দ্র চিন্তা করলেন–“এ শ্বেত মূষিক সর্বজ্ঞতা জ্ঞানই প্রার্থনা করছেন। তিনি বুদ্ধাঙ্কুর হয়েই এ শীল পালন দ্বারা শীল পারমী ও জীবন দান দ্বারা দান পরমার্থ পারমী পূর্ণ করে অনাগতে নিশ্চয়ই সর্বজ্ঞ বুদ্ধত্ব লাভ করবেন। এখন আমি এ শ্বেত মূষিককে দেবলোকে নিয়ে যাব সমস্ত দেবগণকে দেখাবার জন্য।” এ চিন্তা করে দেবরাজ শ্বেত মূষিক স্বীয় হস্ততলে বসায়ে তাবতিংস দেবলোকে নিয়ে গেলেন। তথায়। সমস্ত দেবগণকে দেখায়ে বললেন–“হে দেবগণ, আপনারা সবাই এ শ্বেত মূষিককে দেখ। এ মূষিক বুদ্ধাঙ্কুর। ইনি অনাগতে সম্যক সম্বুদ্ধ হয়ে জগতবাসীকে মুক্ত করবেন।” এবলে দেবরাজ বোধিসত্ত্বকে নিজের পাণ্ডুকম্বল শীলাসনে বসালেন। তখন সমস্ত দেবগণ বোধিসত্ত্বকে ইন্দ্রাসনে উপবিষ্ট দেখে অত্যন্ত সন্তোষ হলেন। বোধিসত্ত্বও সে আসনে বসে দেবরাজ ইন্দ্র প্রমুখ সমাগত দেবগণকে নিন্মোক্ত সাতটি গাথা যোগে ধর্মদেশনা করলেন

৪৯-৫৫। “যে দেবগণ স্বর্গে উৎপন্ন হয়েছেন, তাঁরা পঞ্চশীল রক্ষা করলে দীর্ঘকাল যাবৎ তথায় দেবতাদের সাথে। রমিত হতে পারবেন। সর্বদা শীলাচরণ দ্বারা ইন্দ্র প্রমুখ সমস্ত দেবতা দীর্ঘদিন যাবৎ দেবলোকে রমিত হয়েছিলেন। ইহলোকে যে নরগণ সর্বদা সগৌরবে শীল রক্ষা করে, তারা পরলোকে সুখে যাপন করেন। যারা মনুষ্য জন্ম লাভ করে, দান, ব্রহ্মচর্য, সম-দম এবং সংযমাদি বহু কুশল কর্ম করে, তারা সর্বদা ধন, ভোগ সম্পদ, যশঃ, দীর্ঘায়ু, মহা সৌভাগ্যবান, বিশারদ এবং ধর্মাচরণকারী হন। যারা পঞ্চশীল রক্ষা করেন, তারা দুঃখ হতে মুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন সুখে অবস্থান করেন। তদ্ধেতু পূর্বে আপনার। দ্বারা পুণ্যকৃত হয়েছে। সুখের জন্য যে পুণ্য করেছেন, সে পুণ্য অনুমোদন করছি। সর্বদাই আপনি সুখী হবেন, পরে আপনি অনুতপ্ত হবেন না।”

দেবগণ বোধিসত্ত্বের ধর্ম দেশনা শুনে আকাশ বাতাস মুখরিত করে সাধুবাদ প্রদান করলেন এবং দিব্য বস্ত্র, অলংকারাদি ও দিব্য সুগন্ধি পুস্পাদি দ্বারা বোধিসত্ত্বকে পূজা সষ্কার করলেন। তৎপর তিনি ও দেবগণ পরিবৃত হয়ে নিতাক্ত গাথাযোগে দেবরাজকে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা জ্ঞাপন করলেন

৫৬। “হে দেবরাজ, আমি মনুষ্যলোকে প্রত্যাবর্তন করতে ইচ্ছা করি। আমি সৰ্ব্বদা শীলাদি পুণ্যকর্ম করতে ইচ্ছুক। আমার সে কৃত পুণ্যের দ্বারা মৃত্যুর পর আপনাদের এখানে উৎপন্ন হব।”

তা শুনে দেবরাজ স্বীয় হস্ত তলে বোধিসত্ত্বকে বসিয়ে হিমালয়ের এক স্থানে নিয়ে গেলেন। তথায় মধুর ফলের বাগান এবং পঞ্চবিধ পদ্ম সমাচ্ছন্ন পুষ্করিণী সম্পন্ন এক মনোরম স্থান নির্মাণ করে দিলেন। তৎপর দেবরাজ বোধিসত্ত্ব হতে বিদায় নিয়ে দেবলোকে প্রত্যাবর্তন করলেন। শাস্তা সে বিষয় নিন্মোক্ত গাথাদ্বয়ে প্রকাশ করলেন–

৫৭-৫৮। “দেবরাজ দেবলোক হতে শ্বেত মূষিক প্রমোদিত চিত্তে স্বহস্তে লয়ে পুনঃ মনুষ্যলোকে এনে দিলেন। তিনি সে মূষিকের জন্য হিমালয়ের এক রমণীয় মনোরম স্থানে বাসস্থান তৈরী করে দেবলোকে চলে গেলেন।” সে হতে বোধিসত্ত্ব হিমালয়ের এই রমণীয় প্রদেশে পতিত বৃক্ষ ফলাদি ভক্ষণ করে নিরাপদে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন। তথায় তিনি যথাস্কাল জীবিত থেকে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। ভগবান বুদ্ধ এ ধর্ম দেশনা করে জাতক সমাপন মানসে পুনঃ নিন্মোক্ত ছয়টি সমাপ্তি গাথা ভাষণ করলেন–

৫৯-৬৪। “তখনকার ব্রহ্মদত্ত রাজা বর্তমান মহা প্রজ্ঞাবান সারিপুত্র। বারাণসী শ্ৰেষ্ঠী বর্তমান মহা ঋদ্ধিবান মোগ্নল্লায়ন। বারাণসী ব্রাহ্মণ, ধুতাঙ্গধারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মহা কশ্যপ। দৌবারিক হল এখন অম্বথেরো। সুধর্মপালক এখন জীন সেবক আনন্দ। দেবরাজ ইন্দ্র এখন অনুরুদ্ধ। তখনকার আমার প্রতি গৌরবকারী সমস্ত দেব-নর এখন আমার শ্রাবকগণ সহ চতুর্বিধ পরিষদ মণ্ডলী। সংযত, শীলবান সুধর্ম শ্বেত মূষিক এখন আমি লোকনাথ তথাগত সম্বুদ্ধ। ত্রিবিধ সুখ প্রার্থনাকারী তোমরা সর্বদাই অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।।

(শ্বেত মূষিক জাতক সমাপ্ত।)।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *