২৫. বিরিয় পণ্ডিত জাতক

২৫. বিরিয় পণ্ডিত জাতক

“আমার সহায় পঞ্চাল রাজা” ইহা ভগবান বুদ্ধ জেতবনে বাস করবার সময় নিজের পূর্বকৃত দান পারমী সম্পর্কে বলেছিলেন।

এক দিবস ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় উপবিষ্ট হয়ে নিন্মোক্ত বিষয় উত্থাপন করলেন–“অহো বন্ধুগণ, আমাদের শাস্তা দান প্রদানে অতৃপ্ত। তিনি অপরকে বিমুক্তি দান দ্বারা মহা করুণা বিকাশ করেছেন।” তখন ভগবান বুদ্ধ গন্ধকুঠি থেকে ভিক্ষুদের ঐ সর্ব আলোচনা দিব্য কর্ণে শুনে ধর্ম সভায় উপস্থিত হয়ে প্রজ্ঞাপ্ত সুসজ্জিত শ্রেষ্ঠ বুদ্ধাসনে বসে ভিক্ষুগণকে বললেন–“তোমরা। এখন কি বিষয়ের আলোচনা করছ?” তখন ভিক্ষুগণ তাদের আলোচ্যমান বিষয় বুদ্ধ সন্নিধানে ব্যক্ত করলেন। তখন ভগবান বুদ্ধ বললেন–“হে ভিক্ষুগণ, আমি যে এখন বুদ্ধভাবে পরকে বিমুক্তি সুখ দান করছি বলে তোমরা আশ্চৰ্য্যন্বিত হচ্ছ, তা নয়; আমি পূর্বে বোধিসত্ত্বকালেও পুখুৰ্জনাবস্থায় নিজের স্ত্রী, পুত্র বিক্রয় করে পরিশেষে স্বীয় দেহ মাংস পর্যন্ত বিক্রয় করে, তলব্ধ মূল্যে সুবর্ণ পাট ক্রয় করে সশ্রদ্ধায় দান করেছি। এ বলে ভগবান বুদ্ধ নীরবতা অবলম্বন করলেন। তখন সে সভাস্থ ভিক্ষুগণ বুদ্ধের সেই অতীত কাহিনী প্রকাশ করবার জন্য কাতর প্রার্থনা জ্ঞাপন করলে বুদ্ধ তা বলতে আরম্ভ করলেন–

সুদুর অতীতকালে “সবিধি” নামক এক রাজ্য ছিল। সে রাজ্যের রাজা ছিলেন “মহারথ” নামক এক রাজা। তিনি ছিলেন সম্যক দৃষ্টি ও বুদ্ধ-ভক্ত। তখন পঞ্চাল রাজ্যে “পঞ্চাল” নামক এক রাজা রাজত্ব করতেন। তিনি ছিলেন মিথ্যাদৃষ্টিক। মহারথ রাজার সাথে তার পত্রাদির মাধ্যমে ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। কিন্তু কোনদিন তাদের পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ ঘটেনি। এক সময় পঞ্চাল রাজা মহার্ঘ এক রক্ত কম্বল স্বীয় দূত দ্বারা মহারথ রাজার নিকট উপহার পাঠালেন। তিনি তা পেয়ে অতি আনন্দিত হলেন। তাই তিনি স্বীয় প্রিয় এক অমাত্যকে আহ্বান করে বললেন–

১। “আমার বন্ধু পঞ্চাল রাজা আমার জন্য একখানা মহামুল্যবান রক্ত কম্বল পাঠিয়েছেন। আমিও অদ্য আমার প্রিয় বন্ধুর জন্য মহার্ঘ রত্ন পাঠাব।” এবলে পুনঃ কহিলেন“জগতে বুদ্ধ রত্বের ন্যায় অন্য কোন রত্ন নেই। তাই আমি মদীয় বন্ধুর জন্য “বন্ধু-মুৰ্ত্তি” রত্নই পাঠাব।” এরূপ বলে এক সুবর্ণকার দ্বারা অষ্টাদশ হস্ত উঁচু এক বিরাট স্বর্ণপাত তৈরী করালেন। তাতে জাতি হিঙ্গুল রস দ্বারা অষ্টাদশ হস্ত উচ্চ এক মনোরম বুদ্ধ মুর্তি অংকন করালেন। তৎপর অনির্বচনীয় উৎসবের মাধ্যমে নানাবিধ পুষ্প সুগন্ধাদি পূজোপচার দ্বারা পূজা বন্দনা করে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–

২। “ভন্তে ভগবন, বুদ্ধ-প্রতিমূর্তি, আপনি এখন লোকনাথ, সর্বদাই সত্ত্বদের অনুকম্পাকারী। ভন্তে, এখন বুদ্ধ বেশ ধারণ করুন।” রাজা এরূপ বলে পুনঃ তিনটি গাথা কহিলেন–

৩-৫। “ভন্তে, জগতের হিতার্থ মহামুনি যেখানে গিয়েছেন, তথায় সর্বদা সকলের হিত-সুখ উৎপাদনের উপায় করেছেন ভন্তে পূর্বে যেমন সম্যক সম্বুদ্ধগণ জনগণের হিত সাধন করেছেন, সেরূপ আপনিও আমার হিতসাধন করুন। ভন্তে, পঞ্চাল নামক রাজা আমার বন্ধু। তিনি শ্রদ্ধাহীন ও মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন। আপনি তথায় গিয়ে ঋদ্ধি প্রদর্শনে তাঁকে মিথ্যাদৃষ্টি হতে প্রমুক্ত করুন।”

মহারথ রাজা এরূপ বলে নৌকায় প্রকাণ্ড এক মনোরম প্রাসাদ সজ্জিত করালেন। সে অস্থায়ী প্রাসাদে বুদ্ধ মুর্তি প্রতিষ্ঠা করে পঞ্চাল রাজার দূত সহ সমুদ্র পথে পঞ্চাল রাজার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন। তিনি গলা প্রমাণ সমুদ্র জলে নেমে সানন্দে বুদ্ধরত্ন উপহার পাঠালেন। এতে তিনি বিমল আনন্দ লাভ করলেন। তৎক্ষণে সমুদ্রের জলরাশি সুবর্ণ বর্ণ ধারণ করল। সমুদ্রের জল-তলগত নানাবিধ মনোহর মণি, মাণিক্য, মুক্তা ও সুচারু দ্রব্যাদি জলের উপর ভেসে ভেসে বুদ্ধমুর্তিকে পূজা করতে লাগল। সারা সমুদ্রতল সপ্ত-রত্নে বিচিত্র মোহর সুবর্ণ থালার ন্যায় সৌন্দর্য বিকাশ করতে লাগল। মধ্যে মধ্যে পঞ্চবর্ণ মহাপদ্ম উত্থিত হয়ে বুদ্ধ-মুর্তি পূজার নিরত হল। নাগলোকে নাগরাজগণ স্বীয় স্বীয় মহা পরিবারে পরিবৃত হয়ে নানাবিধ রত্ন। সম্ভার ও পুষ্পদি পূজোপচারে বুদ্ধ প্রতিমুর্তিকে পূজা করার জন্য জলের উপর এসে পরিবেষ্টন করল এবং মধুর স্বরে দিব্য বাদ্য-গীতে ও নৃত্য সহকারে পূজা করতে লাগলেন। দেবগণ আকাশ থেকে দিব্য পুষ্প বিকীর্ণ করতে লাগল। দিব্য তুর্যধ্বনিতে আকাশ মুখরিত করল। নানাবিধ সুবর্ণ ধ্বজা পতাকা উড়তে লাগল। দিব্য সুচারু ছত্র বুদ্ধমুর্তির চার পাশে ও মস্তকোপরি আকাশে ঝুলতে লাগল। বুদ্ধমুর্তির অনুভাব দেবমনুষ্যের অচিন্তনীয় বিষয় ও অপ্রমেয়। এ বুদ্ধমুর্তির এরূপ আশ্চর্য অদ্ভুত প্রভাব বিকাশ হয়েছিল, যেমন জীবন্ত সম্যক সমুদ্ধ।

পঞ্চাল রাজদূত সমুদ্র পথে বুদ্ধমুর্তির এরূপ নানা আশ্চর্য অদ্ভুত ব্যাপার দর্শনে নিরত হয়ে পঞ্চাল নগরে পৌছলেন। তখন রাজদূত নৌকা হতে অবতরণ করে রাজ সমীপে গেলেন এবং তাঁকে বন্দনা করে ঐ বুদ্ধ মুর্তির আশ্চর্য ঋদ্ধি বিষয় সব প্রকাশ করলেন–। পঞ্চাল রাজ তা শুনে অত্যন্ত প্রীত চিত্তে চিন্তা করলেন–“আমার বন্ধু মহারথ রাজা মহাপূজা সৎকার সহযোগে বুদ্ধপ্রতিমুর্তি পাঠিয়েছেন আমার জন্য। আমিও তার দ্বিগুণ পূজোৎসব সহকারে এখানে আনতে হবে। পঞ্চাল রাজা এমনে করে মহাধুমধামের সাথে চতুরঙ্গিনী সেনা সহ ঐ নৌকাঘাটে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং সে বুদ্ধ মুর্তিকে পঞ্চাঙ্গলুটিয়ে বন্দনা করলেন, সুগন্ধি-ধূপ-দীপ দ্বারা পূজা করলেন, ধ্বজা, পতাকা, ছত্র উখােলন করলেন, সৰ্ববিধ বাদ্যশব্দে পূজা সকার পরায়ণ হয়ে তথায় স্থিত হলেন। তকালে রাজা বহু শ্রদ্ধাবান অমাত্যগণ দ্বারা পরিবৃত হয়ে এ বুদ্ধমুর্তি দর্শন করে পরম প্রীত সহকারে বললেন–“আমি অদ্য হতে যাবজ্জীবন এ বুদ্ধ প্রতিমুর্তির শরণ গ্রহণ করলাম।” তৎক্ষণে সে বুদ্ধমুর্তি পঞ্চাল রাজার শ্রদ্ধাবেগে নানাবিধ অলৌকিক ঋদ্ধি করে আকাশে উখিত হলেন এবং পদ্মাসনে উপবেশন করলেন। তারপর দেহ হতে লাল, নীল, পীত, মঞ্জিষ্ঠা, শুভ্র ও প্রভাস্বর প্রভৃতি ষড়বর্ণ রশ্মি নিঃসৃত করে দশদিক প্রভাসিত করলেন। সে রশ্মিসমূহ সর্বদিকে তরঙ্গায়িত হয়ে সারা পৃথিবী-তল পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। তখন নীলবর্ণ রশ্মি দ্বারা সারা পৃথিবী অঞ্জনবর্ণ পুষ্পের ন্যায় নীলবর্ণ হল। তা পরিবর্তন হয়ে পুনঃ পৃথিবী বর্ণ পীত রশ্মির দ্বারা পীত বর্ণ পুষ্পের বর্ণ ধারণ করল। পুনঃ তা পরিবর্তন হয়ে শুভ্র রশ্মি প্রভাবে সারা পৃথিবী স্বচ্ছ রৌপ্য বর্ণের ন্যায় শুভ্র বর্ণ হল। ইহাও পরিবর্তন হয়ে পুনঃ লোহিত রশ্মির দ্বারা সারা জগত রক্ত পটলের ন্যায় বর্ণ হয়ে গেল। ইহা পরিবর্তন হয়ে মঞ্জিষ্ঠা রশ্মির প্রভাবে পুনঃ অনোজ পুষ্প বর্ণের ন্যায় সারা জগত মঞ্জিষ্ঠা বর্ণ ধারণ করল। তখনি ইহা পরিবর্তন হয়ে প্রভাস্বর রশ্মির প্রভাবে সমগ্র পৃথিবী শুকতারকা বর্ণের ন্যায় প্রভাস্বর বর্ণ ধারণ করল। বুদ্ধের সে রশ্মি সমুদ্রের অপর তীরে গিয়ে পৌছল। তৎকালে সারা সমুদ্রের জল নীল পীতাদি ষড়বর্ণে অপূর্ব বিচিত্রবর্ণ ধারণ করল। সমুদ্র-বক্ষ হতে বিচিত্র রশ্মি ছয়কামাবচর দেবলোক, ষোড়শ ব্রহ্মলোক ও অনন্ত লোকধাতুতে বিস্তৃত হল। এত সময়ের মধ্যে চন্দ্র-সূর্যের প্রভা বিলুপ্ত ছিল। এমন কি দেবব্রহ্মের দেহ-প্রভাবও বিলুপ্ত হয়ে গেল। সহস্র লোকধাতুর যে সূর্য-প্রভা ছিল, তাও জোনাকি পোকার আভার ন্যায় নিষ্প্রভ হল। তখন দেবরাজ ইন্দ্র বহু দেববৃন্দ সহ এসে দিব্য মাল্য গন্ধে সে বুদ্ধমুর্তিকে পূজায় নিরত হয়ে করযোড়ে বন্দনা অবস্থায় আকাশে স্থিত হলেন। এ বুদ্ধ বিম্বও আকাশে নানাবিধ অলৌকিক ঋদ্ধি প্রকাশে নিরত রইলেন। তখন দেবতা মানুষকে এবং মনুষ্য দেবতাকে দর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তক্ষণে কী যে একটা চমৎকার দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল, তা ভাষায় বর্ণনাতীত। ভগবান বুদ্ধ তা কিঞ্চিৎ প্রকাশ মানসে নিন্মোক্ত গাথা চতুষ্টয় ভাষণ করলেন–

৬-৯। “দেবতাগণ মনুষ্যকে এবং মনুষ্যগণ দেবতাগণকে স্বচক্ষে দর্শন করেছিলেন। তারা সবাই অঞ্জলীবদ্ধ হয়ে সে বুদ্ধবিম্বাভিমুখী হয়েছিল। ইন্দ্র প্রভৃতি সমস্ত দেবতা তুষ্ট চিত্তে প্রমোদিত হয়ে কৃতাঞ্জলী পুটে নমস্কার করতে করতে বুদ্ধ বিম্বের অভিমুখী হয়েছিল। তখন সমস্ত যক্ষ, গন্ধর্ব, সুপর্ণ ও নাগরাজা দিব্য পুস্পাদি নিয়ে এ বুদ্ধরূপকে উত্তম পূজা করেছিল। তারা সবাই প্রমোদিত ও প্রসন্ন চিত্তে সমস্বরে সাধুবাদ শব্দে লোকধাতু প্রকম্পিত করেছিল। অতঃপর পঞ্চাল রাজা সে বুদ্ধরূপের এরূপ অপূর্ব প্রতিহার্য সন্দর্শনে পরমপ্রীতি হয়ে বুদ্ধপ্রতিমুর্তিকে কাতর প্রার্থনায় নিন্মোক্ত গাথাযোগে নিমন্ত্রণ করলেন–

১০। “ভন্তে, আপনি আকাশ হতে অবতরণ করে নিত্য আমাদের পুণ্য উৎপাদনার্থ এ সুবর্ণ শিবিকায় উপবেশন করুন।” এ প্রার্থনার পরক্ষণেই সে বুদ্ধবিম্ব আকাশ হতে নেমে ঐ সুবর্ণ শিবিকায় সমাসীন হলেন। এ বিষয় প্রকাশ মানসে বুদ্ধ নিন্মোক্ত সাতটি গাথা ভাষণ করলেন–

১১-১৭। “আকাশে বিচরণকারী বুদ্ধবিম্ব আকাশ হতে নেমে শিবিকায় উপবেশন করলেন। তখন সসৈন্য পঞ্চাল রাজ শিবিকারূঢ় বুদ্ধবিম্ব রাজপ্রসাদে প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন তিনি গন্ধ, পুষ্প, দীপাদী দ্বারা পূজা করলেন এবং বুদ্ধগুণ মনন করে প্রীতিতে চিত্ত পরিপুর্ণ করলেন। তিনি প্রীত চিত্ত, সাদর সুমন সম্পন্ন হয়ে বুদ্ধের স্তুতি পরায়ণ হয়ে বলেন–ভন্তে, আপনি অপরিমাণকল্পে অপরিমাণ পুণ্য সম্ভার অর্জন করেছেন এবং ইহলোকে সর্বসত্নের হিতসাধন করে নির্বাণ লাভ করেছেন। ভন্তে, এখন আপনাকে পূজা করে আমার জীবন ধন্য ও সফল হল। যদি আমি অদ্যই মৃত্যুমুখে পতিত হই, আমার এসব কৃতপুণ্য আমার মহাহিত সাধন করবে। আমি সর্বদা আপনাকে বন্দনা করছি। আপনিই আমার নাথ ও প্রতিশণ, আপনিই আমার প্রতিষ্ঠা ও গতি। হে বুদ্ধ, আমি সর্বদা আপনাকে নমস্কার করছি।

পঞ্চাল রাজা একথা বলে প্রীতিপূর্ণ মনে এরূপ চিন্তা করলেন–“এখন আমার বন্ধু মহারথ রাজা এরূপ মহানুভব সম্পন্ন বুদ্ধপ্রতিমুর্তি আমার জন্য পাঠিয়েছেন। সুতরাং আমিও তাঁর জন্য এর দ্বিগুণ মুল্যের ও দ্বিগুণ বড় এক বুদ্ধমুর্তি তৈরী করে পাঠাব।” এ চিন্তা করে বিরাট এক মহার্ঘ চন্দনসার যোগাড় করে এক দক্ষ শিল্পীকে ডেকে বললেন–“অদ্য হতে তুমি এ মহার্ঘ চন্দন সার দ্বারা প্রকাণ্ড এক বুদ্ধমুর্তি তৈরী করে দাও।” শিল্পী রাজাদেশে স্বীকৃতি দিয়ে তখনি বুদ্ধমুর্তি নির্মাণের কাজে নেমে গেলেন। অল্পদিনের মধ্যেই ঐ চন্দনসার দ্বারা বিরাটকায় মনোহর লক্ষণ সম্পন্ন বুদ্ধমুর্তি নির্মাণ করে রাজাকে দিলেন। তখন রাজা সে মুর্তিটি চিত্রিত করার জন্য এক ধর্মশালায় রেখে তা রক্ষার জন্য প্রহরী নিযুক্ত করলেন।

তখন পঞ্চাল রাজা স্বীয় রাজ্যে ঘোষণা করালেন–যাদের নিকট সুবর্ণ আছে, তারা ইচ্ছা করলে রাজার সাথে বুদ্ধমুর্তিতে সুবর্ণাপাত লাগাতে পারেন।” সে দেশবাসী “বিরিয় পণ্ডিত” নামক জনৈক ব্যক্তি রাজার এ ঘোষণা শুনে চিন্তা করলেন–“রাজার সাথে কুশল কর্ম করা একান্তই উচিত। সুতরাং আমি অতি দরিদ্র, স্বর্ণ কোথায় পাব? পরের কাজ কর্ম করে যাই টাকা পাব, তাতে অল্প মাত্র স্বর্ণ পাব। ইহাতে তেমন কাজ হবেনা। যদি নিজকে বিক্রয় করতে পারি, তাহলে প্রচুর টাকা পাব। ইহাতে আমার ইচ্ছিত কাজ কিছুটা সম্পন্ন হতে পারে।” এ। চিন্তা করে স্বীয় গৃহে সুখাসনে বসে স্ত্রী পুত্রকে ডেকে নিতাক্ত গাথায় বললেন–

১৮। “হে আমার প্রিয় স্ত্রী সুজাতা ও প্রিয় পুত্র রেবত, তোমরা উভয়ে আমার অভাবে কোন অনুশোচনা করবে না।” ইহা শুনে সুজাতা মহাসত্ত্বকে গাথাযযাগে জিজ্ঞাসা করলেন–

১৯। “স্বামিন, আপনার নিকট কি হয়েছে? আপনি আমাদের কীই বা প্রকাশ করছেন? আমাদের ত্যাগ করে আপনি যাবেন কোথায়? তখন বোধিসত্ত্ব নিজের গমন বিষয় প্রকাশচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–

২০-২১। “অদ্য এনগরে রাজার কুশল কর্মের ঘোষণা শুনেছি। এখন আমি রাজার সাথে কুশল কর্ম করতে যাব। ভদ্রে আমি নিজেকে বিক্রিকরবার জন্য নগরে বিচরণ করব। নিজকে বিক্রি করে রাজার সাথে পুণ্যকর্ম করব।” সুজাতা একথা শুনে ক্রন্দন পরায়ণা হয়ে নিজে গাথাদ্বয়ে বললেন–

২২-২৩। “আমি আপনার দাসী। আপনি আমার স্বামী। রেবতও আপনার দাস, আপনাকে বিক্রয় না করে আমরা দুজনকে বিক্রি করুন। সুবর্ণ রৌপ্যাদির মধ্যে যা আপনার প্রিয়, তা অভিপ্রায়ানুযায়ী যোগাড় করুন।”

বোধিসত্ত্ব একথা শুনে বারক্রয় পত্নীকে নিষেধ করলেন। পত্নী তা শুনলেন না। তখন স্ত্রী-পুত্রকে বললেন–“তোমরা উভয়েই আমার কল্যাণ মিত্র। তোমরা উভয়েই আমার পারমী পূর্ণ কর।” এবলে উভয়কে সাথে করে নগরে প্রবেশ করলেন। তথায় কোন সমৃদ্ধ কুলে স্ত্রী পুত্রকে বিক্রি করে তম্মুল্যে স্বর্ণকার হতে স্বর্ণ ক্রয় করলেন। সে স্বর্ণ দ্বারা পাত তৈরী করে বুদ্ধমুর্তি রক্ষিত ঐ ধর্মশালার দ্বারে উপস্থিত হলেন। তথায় দ্বার রক্ষককে নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–

২৪। “ভদ্র মহোদয়, আমি এ নগরবাসী। রাজার ঘোষণা শুনে বুদ্ধবিম্বকে স্বর্ণপাত দ্বারা সজ্জিত করবার জন্য এখানে এসেছি।” ইহা শুনে দ্বারপাল নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–

২৫। “হে শ্রদ্ধাবান ভদ্রমহোদয়, আমাদের রাজা অমুক নক্ষত্রে এ বুদ্ধবিম্ব স্বর্ণপাত দ্বারা সজ্জিত করবেন। আপনিও তাঁর সাথে তখনই যোগদান করবেন। রাজার পূর্বে তা করতে অনুমতি দেবনা।” বোধিসত্ত্ব একথা শুনে সংবিগ্ন হৃদয়ে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–

২৬। “অহো! আমার আশা পূর্ণ হল না। আমি স্ত্রী পুত্র বিক্রি করে এসেছি। আপনারা আমাকে অনুমতি দিন। কিছুমাত্র হলেও স্বর্ণপাত বুদ্ধমুর্তিতে সংযোজন করি।” মহাসত্ত্ব এবলে তাদের বাধা না মেনে মহাশ্রদ্ধাচিত্তে সে শালায় প্রবেশ করলেন। তখন শালা প্রহরিগণ তাকে জোরপূর্বক শালা হতে বের করে দিল। এমন সময় রাজপুরুষগণ নিন্মোক্ত গাথায় তাঁকে কহিল

২৭। “হে পণ্ডিত মশাই, অদ্যই যদি বুদ্ধপ্রতিমুর্তিতে সুবর্ণ পাত সংযোজনের ইচ্ছা করেন, তা হলে তা রাজার নিকট গিয়ে প্রকাশ করুন। রাজা যদি অনুমতি দেন, তাতে আমাদের কোনই আপত্তি নেই।” বোধিসত্ত্ব একথা শুনে “সাধু সাধু” বলে স্বর্ণপাত সহ পঞ্চাল রাজার নিকট গিয়ে বন্দনা করে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–

২৮। “মহারাজ, অদ্যই আমি আপনার বুদ্ধবিম্বে আপনার সাথে স্বর্ণপিত লাগাতে ইচ্ছা করি। সুতরাং এবিষয়ে আমায় অনুমতি দান করুন।” রাজা ইহা শুনে বোধিসত্ত্বকে প্রতারণা করার মানসে নিতাক্ত গাথায় বললেন–

২৯। “হে দ্ৰ বিরিয় পণ্ডিত, সে বুদ্ধমুর্তির শ্রীমুখে যদি তুমি আমার সাথে স্বর্ণপাত লাগানোর অনুমতি পাও, তাহলে লাগাতে পার।” ইহা শুনে মহাসত্ত্ব প্রসন্ন চিত্তে স্বর্ণপাতগুলো লয়ে শালায় প্রবেশ করলেন। বুদ্ধমুর্তির পাদমূলে পাতগুলো। রেখে পৃথিবীতে জানুপেতে বসে বারম্বার বন্দনা পূর্বক করযোড়ে বুদ্ধমুর্তিকে নিন্মোক্ত গাথায় প্রার্থনাচ্ছলে বললেন–

৩০-৩২। “ভন্তে, আমি আপনার নিকট যাঞ্চা করছি যে আপনি আমার সাথে কথা বলুন। আমি আপনার দেহে স্বর্ণপাত লাগাব। ভন্তে, আপনি অনুকম্পা করে আমার সাথে কথা বলুন। অনাগতে আমার বোধি লাভের জন্য। আপনিই আমার শরণ-হে মহাবীর, আপনার শ্রীমুখ বিবৃত করে আমার সাথে কথা বলুন।

তক্ষণেই বুদ্ধবিম্ব রক্ষক দেবতা বিরিয় পণ্ডিতের কথা শুনে ও তাঁর শ্রদ্ধার তেজে বুদ্ধবিম্বের দেহে প্রবিষ্ট হলেন। তৎপর সে বুদ্ধমুর্তি জীবিত বুদ্ধের ন্যায় আসন চালনা করতে করতে ষড়বর্ণ রশ্মি বিচ্ছুরিত করে বোধিসত্ত্বকে বললেন–“সাধু সাধু” বিরিয় পণ্ডিত, তোমার অতিপ্রায়ানুযায়ীই কর।” তৎক্ষণেই বুদ্ধ মুর্তির সে মধুর শব্দ সারা পঞ্চাল রাজ্যে পরিব্যাপ্ত হল। তখন পঞ্চাল রাজাও তক্ষণে মহাজন সংঘ সহ সাধুবাদ প্রদান করে সে বুদ্ধমুর্তির মহাপূজা সৎকার করলেন। তখন বোধিসত্ত্ব প্রমোদিত চিত্তে পঞ্চাল লুটায়ে বন্দনা করে বুদ্ধমুর্তির দেহে স্বর্ণপাত লাগাতে আরম্ভ করলেন–। স্বর্ণপাত নিঃশেষ হল, বাকী রইল মাত্র হস্ত পদের অঙ্গুলিগুলি। তখন বোধিসত্ত্ব চিন্তা করলেন–“এখন আমার পুত্র-দার বিক্রি করে, তমূল্যে প্রাপ্ত এ স্বর্ণপাত দ্বারা এ বুদ্ধরূপ এতদূর বেষ্টন করা হল। এখন বাকীস্থান বেষ্টনের জন্য সুবর্ণ পাত কোথা পাব? যদি অদ্যই কেহ আমার মাংসের পরিবর্তে অবশিষ্ট স্বর্ণপাত দেয়, আমি তাকে আমার এ দেহ-মাংস প্রদান করব।” বোধিসত্ত্ব এরূপ চিন্তা করা মাত্রই চারি অযুত দুহাজার শত সহস্র যোজন দল বিশিষ্ট এ পৃথিবী কম্পিত হল। এ বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা ভগবান বুদ্ধ নিন্মোক্ত গাথায় বললেন–

৩৩-৩৫। “বোধিসত্নের এরূপ চিন্তার প্রভাবে তখনই ভীষণ ও লোমহর্ষণকভাবে এ মেদেনী প্রকম্পিত হল। মহাসত্ত্বের এরূপ চিন্তার প্রভাবে চলমান ইক্ষুযন্ত্রের ন্যায় শব্দায়মান হয়ে এ মহাপৃথিবী কম্পিত হয়েছিল। তখন। মহাসমুদ্র সংক্ষুব্ধ হয়েছিল। সুমেরু পর্বত-রাজ সপরিবারে অবনমিত হয়ে স্তুতি শব্দ প্রবর্তিত হয়েছিল।”

সেক্ষণে বোধিসত্ত্বের দান পারমী পরিপূর্ণের অনুভাববলে দেবরাজ ইন্দ্রের ভবন উত্তপ্ত হয়ে উঠল। তখন দেবরাজ ইন্দ্র দিব্য দৃষ্টিতে এসব ঘটনা দেখে তখনি দেবলোক হতে নেমে স্বর্ণকার বেশে বিরিয় পণ্ডিতের সামনে উপস্থিত হলেন। বোধিসত্ত্ব তাঁকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন–“বন্ধু, আপনি কে? দেবরাজ বললেন–“ভবৎ আমি একজন স্বর্ণকার। বোধিসত্ত্ব বললেন–মহাশয়, তবে আপনি মনুষ্য মাংসদ্বারা স্বর্ণপাত তৈরী করতে পারবেন কি?” দেবরাজ বললেন–মহাশয়, আপনি যদি বেতন দিতে পারেন, তবে আমি মনুষ্য মাংসের দ্বারা স্বর্ণপাত তৈরী করে দিতে পারি। ইহা শুনে বোধিসত্ত্ব প্রীতচিত্তে নিন্মোক্ত গাথা দ্বারা তাঁর সাথে আলাপ করতে লাগলেন

৩৬। “বন্ধু, আপনার বাক্য যদি সত্য হয়, তবে বুদ্ধমুর্তিতে বাকী স্বর্ণপাত লাগানের জন্য আমার দেহ-মাংস ছেদন করে দেব। আমাকে সুবর্ণপাত তৈরী করে দিন।” ইহা শুনে দেবরাজ ইন্দ্র গাথা যোগে বললেন–

৩৭। “আমি সর্ব শিল্পে দক্ষ। অদ্যই আপনার মাংসের দ্বারা সুবর্ণপাত তৈরী করব। এখন আপনার মাংস ছেদন করে দিন।” বোধিসত্ত্ব ইহা শুনে চিন্তা করলেন–“আমার মাংস ছেদনার্থ শস্ত্র পাব কোথায়? এ বলে আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে নিন্মোক্ত গাথাদ্বয় বললেন–

৩৮-৩৯। “হে দেবগণ, আমার বাক্য শ্রবণ করুন। যদি আমার ভবিষ্যতে বুদ্ধ হবার হেতু থাকে, তবে আমার জন্য এখানে শস্ত্ৰ পৰ্তিত করুন। সে শস্ত্রের দ্বারাই আমার মাংস ছেদন করব। সহসা আমাকে শস্ত্র প্রদান করুন। ভবিষ্যতে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য।”

বোধিসত্ত্বের এবাক্য সমাপ্তির পরক্ষণেই তীক্ষ্ণধার ছুরিকা একখানা তার সম্মুখে পতিত হল। বোধিসত্ত্ব তা নিয়ে স্বীয় দেহের মাংস ছেদনে উদ্যত হয়ে দেবগণকে তা জ্ঞাপন মানসে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–

৪০। “ভবৎ দেবগণ, আপনারা আমার বাক্য শ্রবণ করুন। এ মাংস দানের দ্বারা বুদ্ধমুর্তির দেহে স্বর্ণপিত লাগানের বাকী কাজ সম্পন্ন করব। এ পুণ্যে আমি অনাগতে বুদ্ধ হব।”

এরূপ বলে মহাসত্ত্ব তখনই মুত্যু না হওয়ার জন্য অধিষ্ঠান। করে ঐ দিব্য শস্ত্র দ্বারা স্বীয় দেহ মাংস ছেদন করে স্বর্ণকারের হস্তে প্রদান করলেন। স্বর্ণকার বেশধারী দেবরাজ তা নিমিষে স্বর্ণে পরিণত করে বিরিয় পণ্ডিতকে দিলেন। তিনি প্রমোদিত চিত্তে তা গ্রহণ করে বুদ্ধমুর্তির অবশিষ্ট কাজ পরিপূর্ণ করলেন। তার দ্বারাই বুদ্ধমুর্তির অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন হল।” এবলে চিত্তে প্রীতিভাব এনে বুদ্ধমুর্তিকে একাগ্রচিত্তে দেখলেন। তৎপর তিনি সে বুদ্ধমুর্তির পাদমুলে গিয়ে বন্দনা করে সংজ্ঞাহীন হলেন এবং ভূমিতে লুটিয়ে পড়লেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র এ অবস্থা দেখে তাঁর সর্বদেহে দিব্য ঔষধ মালিশ করে অমৃতোদক সিঞ্চন করলেন। ইহাতে মহাসত্ত্ব দেবরাজ ইন্দ্রের দিব্য প্রভাবে পুনঃসুন্দর দিব্য দেহ লাভ করলেন। তার পুণ্য তেজে সর্ব দেহ স্বর্ণ বর্ণ ও মনোহর হল। তখন দেবরাজ বোধিসত্ত্বের গুণ প্রকাশচ্ছলে নিন্মোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন–।

৪১। “হে মহাপুরুষ, আপনি অত্যন্ত দুষ্কর কার্য করেছেন। এ পুণ্যকর্মের দ্বারা আপনি নিশ্চয়ই বুদ্ধত্ব লাভ করবেন।” ইহা শুনে মহাসত্ত্ব গাথায় বললেন–

৪২। আপনি কি দেবতা, না গন্ধর্ব, না দেবরাজ পুরন্দর, কে বা কার পুত্র? তা আমাকে বলুন।” বোধিসত্ত্বের এ বাক্য শুনে দেবাজ স্বীয় দিব্য বেশ-ভূষায় জ্যোতির্ময় তরুণ সূর্যের ন্যায় আকাশেই স্থিত হয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। তৎবিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত চারটি গাথা ভাষণ করলেন–

৪৩-৪৬। “তৎপর দেবলোকের ঈশ্বর দেবরাজ ইন্দ্র বোধিসত্ত্বের সংকল্প জ্ঞাত হয়ে এরূপ বললেন–“আপনার পারমী পূরণের সুযোগ করে দেওয়ার মানসে আমি আপনার নিকট এসেছি, ভবিষ্যতে আপনি বুদ্ধ হওয়ার জন্য। হে তাত বীর, অনাগতে আপনি সর্বজ্ঞতা লাভ করে ধর্মচক্র প্রবর্তন করবেন এবং জনগণকে ত্রাণ করবেন। দেবরাজ ইন্দ্র তরুণ সূর্যের ন্যায় আকাশে স্থিত হয়ে বিরিয় পণ্ডিতের স্তুতি করে দেবলোকে চলে গেলেন।

তখন পঞ্চালরাজা প্রমুখ পঞ্চাল নগরবাসী সবাই বোধিসত্ত্বের মহাপূজা করেছিল। তৎপর পঞ্চাল রাজা বোধিসত্ত্বকে সুবর্ণ শিবিকা যোগে রাজাঙ্গণে এনে তথায় তাকে মহাসঙ্কার সহকারে মহাভোগ সম্পত্তি উপহার দিলেন। পর দিবস রাজা তাঁকে সেনাপতি পদে বরণ করে তার বিক্রিত স্ত্রী। পুত্র পুনঃ ক্রয় করে এনে বোধিসত্ত্বের হস্তে সমর্পণ করলেন। তখন হতে বোধিসত্ত্ব ভূমিবাসী ও আকাশবাসী দেবতাদের দ্বারা সর্বদা রক্ষিত, নীরোগতা ও সর্ববিধ সম্পদে সমৃদ্ধি লাভ করে নিরাপদে বাস করতে লাগলেন। সে বিষয় প্রকাশ মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত গাথাগুলি ভাষণ করলেন–

৪৭-৫৯। “ধর্মাচরণকারীকে নিশ্চয়ই ধর্মে রক্ষা করে। ধর্মাচরণ দ্বারা সুখ উৎপন্ন হয়। তারা কখনো দুর্গতিতে গমন করেনা। ইহাই ধর্মাচরণের ফল। তদ্ধেতু পণ্ডিতগণ নিজের পারলৌকিক সুখ দর্শন করে সর্বদা ছোট বা বড় বুদ্ধমুর্তি প্রতিষ্ঠা কর। সে বুদ্ধমুর্তি পাষাণ কাষ্ঠ, সুজাত মৃত্তিকা, চন্দনসার, সুবর্ণ, রৌপ্য, মণি ও লৌহ ইত্যাদি দ্বারা নির্মাণ করলেন। এ সুখ সম্পত্তি দায়ক ব্যক্তিগণ দেব নরলোকে সর্বদা সুখে বিচরণ করেন। নর-নারী নির্বিশেষে যারা সুখ ইচ্ছা করেন, তাঁরা সর্বদা যথাশক্তি অনুসারে ছোট হোক আর বড় হোক শ্রদ্ধার সহিত প্রসন্ন অন্তরে বুদ্ধমুর্তি দান করবেন। বুদ্ধমুর্তি দায়ক দেবমনুষ্য লোকে জন্মগ্রহণ করলে, তাঁরা তথায়। দীর্ঘায়ু, সুখী, নির্ভীক চিত্ত ও মহাতেজশালী হয়। তারা সর্বদা শক্তিশালী ও ক্ষমতাশালী হয় এবং জ্ঞাতি গোত্র দ্বারা উপদ্রুত হয় না। মহাধনী, মহাভোগ সম্পত্তি শালী এবং মহাযশস্বী হয়ে থাকেন। যারা আদর চিত্তে বুদ্ধমুর্তি প্রতিষ্ঠা করেন বা করায় এবং তা পূজা করেন, তাঁরা জন্মজন্মান্তরে সর্বদাই সুখী হবেন। যারা শ্রদ্ধা চিত্তে বুদ্ধমুর্তিতে রং করাবেন, তারা সর্বদা দেবমনুষ্যলোকে শ্রেষ্ঠ সুখলাভ করবেন। সে পুণ্যবান ব্যক্তি মনুষ্য লোকে মনুষ্য সুখ এবং দেবলোকে দিব্য সুখ প্রাপ্ত হন। সে বুদ্ধমুর্তি দায়ক মনোহর রূপবান, দর্শনীয়, যশস্বী, মহাধনশালী ও মহামর্যাদাসম্পন্ন হন। বুদ্ধবিম্ব দায়ক-দায়িকা পুনঃ মনুষ্যলোকে উৎপন্ন হলে তারা ঋদ্ধিবান ও বীতরাগ অরহত হয়ে নির্বাণ লাভ করেন।”

তখন বিরিয় পণ্ডিত বোধিসত্ত্ব যথায়ুষ্কালে নানাবিধ পুণ্যকর্মাদি সম্পাদন করে মৃত্যুর পর তুষিত দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। তাঁর বিমান স্বর্ণময় বহু দেববালক বালিকায় পরিপূর্ণ দীর্ঘপ্রস্থে দ্বাদশ যোজন বিস্তৃত বিমান।

ভগবান বুদ্ধ এবলে জাতক সমাপণ করে নিন্মোক্ত অবসান গাথাগুলি ভাষণ করলেন–

৬০-৬৪। “তখন স্বর্ণকার বেশধারী দেবরাজ ইন্দ্র ছিলেন দিব্যচক্ষুষ্মণ আমার শ্রাবক অনিরুদ্ধ। বিরিয় পণ্ডিতের পিতামাতা ছিলেন বর্তমানকালের মহারাজ শুদ্ধোদন ও মহামায়াদেবী। বর্তমানের যশোধরা ছিল তাঁর সুজাতা নামী স্ত্রী। রেবত কুমার ছিল তখন আমার অজ রাহুল কুমার। আর অবশিষ্ট সবাই ছিল বুদ্ধ পরিষদ। পুরুষোত্তম বিরিয় পন্ডিতই এখন আমি অরহত সম্যক সম্বুদ্ধ তথাগত লোকনাথ। সর্বদাই স্বীয় শ্রেষ্ঠ সুখ প্রার্থনাকারী তোমরা সবাই অতি গৌরব চিত্তে এ জাতক ধারণ কর।

(বিরিয় পণ্ডিত জাতক সমাপ্ত।)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *