১৬. গোপাল শালা জাতক
“আমার এশালা একান্তই শোভা পাচ্ছে” এ দেশনাটি শাস্তা জেতবনে অবস্থান করবার সময়ে জনৈক গোপালকের তৈরী শালা উপলক্ষ করে বলেছিলেন–
তখন এক রাখাল বালক কুশ, তৃণ, নল ও কাঠ সংযোগে একস্থানে একখানা বিশ্রাম-শালা তৈরী করে ছিল। একদা সারীপুত্র ও আনন্দকে সঙ্গে করে বুদ্ধ অন্যত্র যেতেছিলেন। রাস্তার পাশে উক্ত বালকের তৈরী বিশ্রাম শালাটি দেখে বুদ্ধ স্বগতঃ বললেন–“অহো, ক্ষুদ্র পুণ্য কর্মের ফলও বড় বিস্ময়কর হয়। এ পুণ্য কৰ্ম প্রভাবে দেবলোকে দশ সহস্র দেবকন্যা সেবিত সপ্ত রত্ন প্রতিমণ্ডিত, বিবিধ দিব্য সম্পত্তি পরিপূর্ণ এক কনক বিমান (প্রাসাদ) উৎপন্ন হয়েছে।” এবলে বুদ্ধ জেতবন বিহারে উপস্থিত হলেন। বুদ্ধের পচ্ছাদগামী সারিপুত্র ও আনন্দ বুদ্ধের এসব কথা শুনে তারা পরস্পর সে কথা আলোচনায় রত হয়ে জেতবন বিহারে উপনীত হলেন। স্থবিরদ্বয় ভগবানকে বন্দনা করে বিনীত বাক্যে জিজ্ঞেস করলেন–“ভন্তে, ঐ যে রাখাল বালক পথ পার্শ্বে একখানা বিশ্রাম শালা তৈরী করেছে, এতে সে কিরূপ ফল লাভ করবে।” প্রত্যুত্তরে বুদ্ধ বললেন–“রাখাল বালক শালা তৈরীর পুণ্য-ফলে মৃত্যুর পর তাবতিংশ দেবলোকে দেব-পুত্র হয়ে উৎপন্ন হবে। ওর সেবিকা হবে সহস্র দেবকন্যা, দিব্য প্রাসাদ হবে সপ্ত রত্ন প্রতিমণ্ডিত কনকময়। তার কর্মের সুখময় বিপাক দেখেই উক্ত স্বগতঃ বাক্য উচ্চারণ করেছিলাম। অতীতেও পণ্ডিত জন পান্থশালা তৈরী করে সশরীরেই দেবলোকে উপনীত হয়েছিল। এবলে বুদ্ধ মৌনভাব অবলম্বন করলেন। তখন তাঁদের প্রার্থনায় বুদ্ধ সেই অতীত কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন–
অতীতে জম্বুদ্বীপের অন্তর্গত কোনও এক নগরে ধর্মরাজ নামক এক ধর্মপরায়ণ রাজা রাজত্ব করতেন। তখন বোধিসত্ত্ব তার অগ্রমহিষীর জঠরে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করে যথাসময় নিরাপদে ভূমিষ্ঠ হলেন। রাজপুত্রের নামকরণ করা হল ধর্মরাজ কুমার। ষোড়শ বর্ষ বয়ক্রম কালে বিদ্যা শিক্ষার্থ তিনি তক্ষশীলায় উপনীত হলেন। যথাকালে তিনি সর্ববিধ শিল্প বিদ্যায় নৈপুণ্যতা লাভ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনিই রাজ্যভিষিক্ত হলেন এবং যথাধর্মমতে রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। তাঁর ভার্যার নাম ছিল বিমলা দেবী। তিনি ষোড়শ সহস্র রাণীর সর্বজ্যেষ্ঠা। তাই তিনিই অগ্রমহিষীর স্থান লাভ করেছিলেন। এবিমলা দেবী স্বামীর অতি প্রিয়মনোজ্ঞা ছিলেন। একদিবস বোধিসত্ত্ব স্বীয় শয়ন কক্ষে শ্রী শয্যায়। উপবিষ্টাবস্থায় পালঙ্কোপরি শ্বেতছত্র দেখে তাঁর চিত্তে এরূপ চিন্তার উদ্রেক হল “আমার এ রাজ সম্পদ কে দিয়েছে?” ইহা বিচার করে জ্ঞাত হলেন। “পূর্বজন্মে দান দিয়ে ও শীল রক্ষা করে এ শ্ৰেষ্ঠ রাজ-সম্পদ লাভ করেছেন।” এ চিন্তা করে তখনই ধর্মরাজ কুমার আসন ত্যাগ করে প্রাসাদ হতে অবতরণ করলেন। তখন তিনি রাজাঙ্গনে গিয়ে চারটি সৈন্ধব ঘোটক যোজিত রথ সর্বালঙ্কারে সুসজ্জিত করে রথে আরোহণ পূর্বক জনগণ সহ অরণ্যে প্রবেশ করলেন। সেখান হতে সারবান বৃক্ষ ছেদন করে রথ পরিপূর্ণ করতঃ নগর-দ্বারে এনে রাখলেন। কাঠমিস্ত্রী আহ্বান করে নগরের বহিদ্বারে চারখানা দান শালা তৈরী করার জন্য আদেশ দিলেন। কাঠ-মিস্ত্রী কিয়দ্দিনের মধ্যে তা সম্পন্ন করলেন। সে শালা চতুষ্টয় দেবসভার ন্যায় শোভমান হয়েছিল। জনগণ সে শালাগুলি দেখে তার সৌন্দর্য ও গুণ বর্ণনা করে ধর্মরাজ কুমারকে শালা চতুষ্টয়ের তৈরীর খবর জ্ঞাপন করলেন। রাজা তা শুনে শালা চতুষ্টয় দর্শন করে সন্তোষ চিত্তে দানশালার সৌন্দর্য বর্ণনা প্রসঙ্গে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
১। “আমার শালা অতিশয় শোভমান হয়েছে। দেবগণ যেন ইহা অলঙ্কৃত করেছে। এ শালা যেন দেবসভার ন্যায় রূপ ধারণ করেছে। প্রত্যেক কাজই হয়েছে অতি শোভমান।” এ। বলে মহাসত্ত্ব প্রত্যহ চার হাজার সুবর্ণ মুদ্রা ব্যয় করে দান দিতে লাগলেন। সে সময় পৃথিবী কম্পনাদি বহুবিধ অলৌকিক ব্যাপার প্রাদুর্ভূত হয়েছিল। সে বিষয় প্রকাশ করবার মানসে শাস্তা নিন্মোক্ত চারটি গাথা ভাষণ করলেন–
২-৫। “তখন ধর্মরাজ দান শালায় মহাদান প্রবর্তন করে যাচকদের উদার চিত্তে দান দিতে লাগলেন। সে হতে ধর্মরাজ স্বীয় দানশালায় সর্বদা প্রীতি ও সৌমণস্য চিত্তে যাচকদিগকে দান দিতেন। সে মহাদান দেওয়ার কালে এ মহাপৃথিবী ভীষণভাবে ও লোমহর্ষকভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল। তখন এরূপ ভীষণ ও লোমহর্ষণকর ব্যাপার হলেও রাজা অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে দান দিয়েছিলেন।”
অতঃপর মহাসত্ত্ব সে দানশালা চতুষ্টয়ে মহাদান দিয়ে চিত্তে প্রীতি উৎপাদন করে বললেন–“আমার দান সুপ্রদত্ত হয়েছে। এ দান আমার সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভের প্রত্যয় হোক।” এবলে তথায় দাঁড়িয়ে দানশালার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সে ক্ষণেই দেবরাজ ইন্দ্রের ভবন উত্তপ্ত হল। দেবরাজ দিব্যদৃষ্টিতে এর কারণ জ্ঞাত হয়ে চিন্তা করলেন–“অহো, এখন ধর্মরাজ বুদ্ধাঙ্গুর চার দানশালায় মহাদান দিচ্ছেন এবং সে দান প্রভাবে বুদ্ধত্ব প্রার্থনা করছেন। এখন আমি মনুষ্যলোকে গিয়ে তাঁকে নিমন্ত্রণ করে এ দেবলোক দর্শনার্থ নিয়ে আসব।” এ চিন্তা করে দেবরাজ দেবলোক হতে কুসুম বিমান যোগে রাজার দান শালার সম্মুখে এসে সমুজ্জল দিব্যদেহে দর্শন দিয়ে তরুণ সূর্যের ন্যায় আকাশে স্থিত হলেন। তখন মহাসত্ব সে দিব্য জ্যোতিঃ দর্শনে চমকৃত হয়ে আসন হতে উঠে দানশালার দ্বারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে অবলোকন করলেন। তখন উক্ত পুষ্প বিমান দেখে ইহা কার বিমান?” এবলে নিন্মোক্ত গাথাটি বললেন–
৬। “আপনি কি দেবতা, না গন্ধর্ব, না পুরন্দর শক্র, অথবা ঋদ্ধিবান মনুষ্য, তা আমি কি করে জানব?” ইহা শুনে দেবরাজ নিন্মোক্ত গাথাত্ৰয়ে বললেন–
৭-৯। “আমি দেবতা, গন্ধর্ব অথবা কোন ঋদ্ধিবান মনুষ্য নহি। আমি দেবরাজ ইন্দ্র, আপনার নিকট এসেছি। হে রাজন, আমি আপনাকে নিমন্ত্রণ করছি। শীঘ্রই স্বপত্নী আপনি এরথে আরোহণ করুন। আপনাদের স্বর্গে নিয়ে যাব। স্বর্গলোক দেখাবার ইচ্ছায় আপনাকে নেওয়ার জন্য এসেছি। হে পুণ্যবান। ক্ষত্রিয় আপনি তা জ্ঞাত হউন।” তা শুনে মহাসত্ত্ব বললেন–”হাঁ দেবরাজ, আমরা দেবলোকে যাব।” এবলে জনগণকে বললেন–“ভবৎগণ, তোমরা দানাদি পুণ্যক্রিয়া করে অপ্রমত্তভাবে থাক।” ইত্যাদি উপদেশ দিয়ে সস্ত্রীক ধর্মরাজ সেই কুসুম বিমানে আরোহণ করে সেক্ষণেই দেবলোকে উপনীত হলেন। তখন সমস্ত দেবতা উভয় ক্ষত্রিয়কে দেখে তাদের সাথে সন্তোষ জনক আলাপ করার পর পূজাসকার করলেন। একরাত্রি মাত্র উভয় ক্ষত্রিয় দেবলোকে দেবতাদের সাথে প্রীতিজনক আলাপ প্রত্যালাপ করে তথায় দিব্যসুখ পরিভোগ করলেন। তখন বোধিসত্ত্ব বললেন–“আমার একান্তই সুলব্ধ হয়েছে। মনুষ্যত্ব ও সুলব্ধ। অদ্য আমি এখানে এসেছি নিজের পুণ্য কর্মের প্রভাবে। পুণ্য ফলেই আমার দেবলোক দর্শন। আমি মনুষ্যলোকে গিয়ে এ হতে দানাদি পুণ্যক্রিয়া করব।” এরূপ চিন্তা করে নিন্মোক্ত উদান গাথা ভাষণ করলেন–
১০-১১। আমার এখানে একান্তই সুআগমন হয়েছে। যেহেতু আমি দেবতাদের দর্শন পেয়েছি। তাঁদের সহিত আলাপ করেছি। আমি সর্বদা কুশল কর্মে রত থাকব। দান, ধর্ম চর্যা, সংগম ও ক্ষান্তি আচরণ দ্বারা আমি এখানে দিব্য সুখ ভোগ করবার জন্য আসব।” পরদিবস প্রাতেই বোধিসত্ত্ব মনুষ্যলোকে গমন করতে ইচ্ছুক হয়ে দেবরাজ ইন্দ্রকে মনোভাব জ্ঞাপন। করলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র উভয় ক্ষত্রিয়কে বিমান যোগে মনুষ্যলোকে এনে বললেন–“মহারাজ এ হতে আপনারা অপ্রমত্তভাবে দানাদি পুণ্য সম্পাদন করুন।” এরূপ উপদেশ দিয়ে তাবতিংশ দেবলোকে প্রত্যাবর্তন করলেন। এ বিষয় প্রকাশের জন্য শাস্তা নিন্মোক্ত পাঁচটি গাথা ভাষণ করলেন–
১২-১৬। “সহস্র নেত্র দেবরাজ ইন্দ্র, ধর্মরাজকে নিমন্ত্রণ করে আকাশ পথে দেবলোকে নিয়ে গেলেন। পরে পুনঃ তাকে আকাশ পথে মনুষ্যলোকে নিয়ে আসলেন। ধর্মরাজ দেবলোক হতে অবতরণ করে অমাত্যদের সাথে প্রীত্যালাপে পরম সুখ অনুভব করলেন। তদ্ধেতু স্বীয় সুখকামী পণ্ডিতগণ ভিক্ষুবাসের নিমিত্ত বিহার তৈরী করে দান করে। বনে ও নির্জন স্থানে বিহার তৈরী করে এবং দুরাবরোহ স্থানে সিড়ি ও সেতু তৈরী করে দেন। অন্ন, পানীয়, খাদ্য, ভোজ্য, বস্ত্র, যানাদি ও প্রার্থীদের সর্বদা প্রসন্ন চিত্তে দান দিয়ে থাকেন।”
মহাসত্ব স্বীয় নগরে উপনীত হয়ে দেবলোকে দৃষ্ট বিষয়াদি জনগণের নিকট প্রকাশ করলেন–। তা শুনে সকলেই দেবলোকে উৎপন্ন হবার কামনায় সোৎসাহ চিত্তে দানাদি পুণ্য কর্ম করেছিল। ধর্মরাজ রাণীসহ বিপুলভাবে স্ত্রী সৌভাগ্য পরিভোগে রত হয়ে দান-শীলাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করতে লাগলেন। সারা জীবন এভাবে কুশল কর্ম সম্পাদন করে যথাকালে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন। সমস্ত অমাত্য ও জনগণ বোধিসত্ত্বের উপদেশ অনুসারে দান-শীলাদি পুণ্য কর্ম সম্পাদন করে যথাকালে মৃত্যুর পর দেবলোকে উৎপন্ন হলেন।” এবলে বুদ্ধ স্থবিরদ্বয়কে বিহার দানের পুণ্যফল বর্ণনা প্রসঙ্গে নিন্মোক্ত গাথাগুলি ভাষণ করলেন–
১৭-২৯। “স্বীয় সুখকামী জ্ঞানী ব্যক্তিগণ বিহার তৈরী করে সংঘকে দান দেন, তারা সর্ববস্তু দানকে পরাজিত করেন। সে ধীর ব্যক্তি বিহার দান ও অন্ন পানীয় শয়নাসনাদি দান দিয়ে দেবমনুষ্যলোকে সর্বদা সুখানুভব করে। দেবতা হোক বা মনুষ্য হোক্, সর্বদা সুখ লাভ করে। সে কখনো অপায়ে যায় না। ইহা বিহার দানের ফল। যে ব্যক্তি বিহার দান শ্রদ্ধার সহিত অনুমোদন করে, সে এক কল্পাবধি সুখ ভোগ করে। ইহা বিহার দান অনুমোদনের ফল। যে ব্যক্তি শ্রদ্ধায় বিহার নির্মাণের জন্য ছোট বড় যে কোন আসবার ক্রয়ের জন্য ধন দান করে, সে অষ্ট কল্পাবধি সর্বদা সুখ ভোগ করে। ইহা বিহার নির্মাণার্থ ধন দানের ফল। যে ব্যক্তি শ্রদ্ধায় নিজব্যয়ে বিহার দান করে, সে এক কল্পাবধি উক্ত দান-পুণ্য-প্রভাবে বিপুল সুখ ভোগ করে। ইহা বিহার দানের ফল। বিহার তেরী করবার কালে পরিশুদ্ধ চিত্তে যারা কায়িক, বাচনিক ও মানসিক সাহায্য করে তারা সর্বদা সুখ লাভ করে। পরিশুদ্ধ চিত্তে যে বিহার তৈরী করে দান দেয়, সে সর্বদা সুখ লাভ করে। যেহেতু বিহার দানকে সর্ববস্তু দান বলে আমার দ্বারা উক্ত হয়েছে। তদ্ধেতু তা সর্বদান হতেও উত্তম বলে আমি বলছি। তদ্ধেতু স্বীয় সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ইচ্ছাকারী পণ্ডিতগণ বিহার নির্মাণ করে প্রসন্ন চিত্তে দান দিবে। যাতে সেই বিহারে নিরাপদে বিহারবাসী ভিক্ষু বাস করতে পারে, তারও যথাযথ ব্যবস্থা করা উচিৎ।” এরূপে শাস্তা স্থবিরদ্বয়কে বিহার দানের ফল সম্বন্ধে বর্ণনা করার পর বললেন–“হে ভিক্ষুগণ পূর্বেও এরূপ শালা দান করা হয়েছিল।” এবলে জাতক কাহিনী সমাপ্ত করে জাতকের অবসান গাথা বললেন–
৩০-৩৪। তখনকার মহারাজ ধর্মরাজের পিতা এখন আমার পিতা রাজা শুদ্ধোদন। মহাদেবী রাজমাতা আমার মাতা মহামায়া। বিমলা এখন যশোধরা। দেবরাজ ইন্দ্র এখন। অনুরুদ্ধ অবশিষ্ট মহাজনগণ বর্তমান আমার পরিষদ মণ্ডলী। ধার্মিক জন নায়ক নরাভ ধর্মরাজ এখন আমি লোক নাথ তথাগত সম্যক্ সম্বুদ্ধ। তোমরা উভয়েই আমার শাসনে স্থিত আছ। অতি গৌরব চিত্তে এজাতক ধারণ কর।
(গোপালক জাতক সমাপ্ত।)
Leave a Reply