2 of 2

৭৮. মক্কা থেকে হযরত যয়নবের মদীনায় হিজরত

মক্কা থেকে হযরত যয়নবের মদীনায় হিজরত

নবী-দুহিতা যয়নব (রা)-এর ব্যাপারে তাঁর বন্দী স্বামী আবুল ‘আস রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট যে ওয়াদা করেছিলেন, সে অনুযায়ী বদর যুদ্ধের এক মাস পর যয়নব মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে আসেন। এ প্রসংগে ইবন ইসহাক বলেন, : আবুল আস বন্দী দশা হতে মুক্তি পাওয়ার পর মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) জনৈক আনসারীসহ যায়দ ইবন হারিছাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেন। তিনি তাদেরকে বলে দিলেন : তোমরা বাতনে ইয়াজিজ নামক স্থানে গিয়ে অপেক্ষা করবে। যয়নব যখন সেখানে এসে পৌঁছবে, তখন তোমরা তাকে নিয়ে আমার কাছে চলে আসবে। আদেশমত তারা বেরিয়ে পড়লেন। এ ঘটনাটি ছিল বদর যুদ্ধের এক মাস পরে বা তার কাছাকাছি সময়ে। আবুল ‘আস মক্কায় এসে যায়নবকে তার পিতার কাছে চলে যেতে বললেন। সুতরাং যয়নব যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি গ্ৰহণ করতে লাগলেন। ইবন ইসহাক বলেনঃ আবদুল্লাহ ইবন আবু বকর যয়নব বরাতে বর্ণনা করেছেন, যয়নব বলেন, আমি মদীনায় চলে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম। এমন সময় উতবার কন্যা হিন্দ এসে আমার সংগে সাক্ষাত করে বলল, হে মুহাম্মদ তনয়! শুনতে পেলাম, তুমি নাকি তোমার পিতার কাছে চলে যেতে চোচ্ছ? আমি বললাম, এমন কোন ইচ্ছে আমার নেই। সে বলল, হে আমার চাচাত বোন। এমনটি করো না। আর যদি যেতেই চাও, তবে পথের খরচ এবং তোমার পিতার কাছে পৌঁছতে প্ৰয়োজনীয় পাথেয় যা দরকার তা আমার নিকট থেকে চেয়ে নিও। আমি সব দেব। এ ব্যাপারে কোন লজ্জাবোধ করবে না। পুরুষদের মাঝে যা চলছে তা যেন আমাদের মহিলাদেরকে স্পর্শ না করে। যয়নব বলেন, আল্লাহর কসম। আমি জানি, সে যা বলছে তা সে অবশ্যই করবে; কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি তার ব্যাপারে সতর্ক থাকলাম এবং মদীনায় যাওয়ার ইচ্ছার কথা তার নিকট অস্বীকার করলাম। ইবন ইসহাক বলেন, মদীনায় যাত্রার জন্যে যয়নবের প্ৰস্তৃতি পর্ব সম্পন্ন হলে তাঁর স্বামীর ভাই কিনানা ইবন রবী” একটি উটি নিয়ে আসলো। যয়নব তাতে সওয়ার হলেন। কিনানা তীর-ধনুক সাথে নিয়ে দিনের বেলায় যায়নবিকে সংগে করে রওনা হলো। কিনানা উটের রশি ধরে টেনে চলছিল। আর যয়নব হাওদার মধ্যে অবস্থান করছিলেন। কুরায়শরা এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করল এবং তাকে ধরার জন্যে বেরিয়ে পড়ল। যু-তুয়া নামক স্থানে গিয়ে তারা তাকে ধরে ফেললো। সর্বপ্রথম তাঁর সামনে যেয়ে দাঁড়ায় হাজার ইবন আসওয়াদ ইবন মুত্তালিব ইবন আসাদ ইবন আবদুল উযযা আল-ফিহরী।

হাব্বার বর্শা দ্বারা যায়নবকে ভয় দেখাল। যয়নব হাওদার মধ্যেই অবস্থান করছিলেন। কথিত আছে, তিনি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। ফলে প্ৰচণ্ড ভয়ে তাঁর গর্ভপাত ঘটে যায়। তখন তার দেবর কিনানা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল এবং তৃণীর হতে তীর বের করে ধনুকে সংযোজন করে বললঃ আল্লাহর কসম! যে-ই আমার কাছে আসবে, তাকেই আমি তীরবিদ্ধ করব। এ পরিস্থিতি দেখে সবাই পিছিয়ে গেল। আবু সুফিয়ান কুরায়শদের একদল লোক সংগে নিয়ে তার সামনে এসে বলল, ওহে, আমাদের প্রতি তীর নিক্ষেপ থেকে তুমি বিরত থাক। আমরা তোমার সাথে কথা বলব। কিনানা তীর নিক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকল। আবু সুফিয়ান আরও সামনে এসে তার কাছে দাঁড়াল এবং বলল : তুমি এ কাজটি ভাল কর নাই। তুমি প্রকাশ্য দিবালোকে এ মহিলাকে নিয়ে সকলের সামনে দিয়ে বের হলে, অথচ তুমি জান, আমরা কত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও বিপর্যয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আর মুহাম্মদের কারণে আমাদের মধ্যে কী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে! তুমি যদি প্ৰকাশ্য ভাবে সকলের চোখের সামনে দিয়ে তাকে তার পিতার কাছে নিয়ে যাও, তাতে লোকে ভাববে, বন্দরে আমাদের পরাজয় ঘটেছে বলে তুমি আজ তাকে এভাবে নিয়ে যেতে পারছি। এটা আমাদের চরম দুর্বলতা ও কাপুরুষতার পরিচয় হবে। আমি কসম করে বলছি, তাকে এখানে আটকে রাখার কোন অভিপ্রায় আমাদের নেই এবং কোন প্রতিশোধস্পৃহাও আমাদের নেই। বরং মেয়েটিকে নিয়ে তুমি ফিরে যাও। এরপর যখন পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যাবে এবং লোকে বলবে যে, আমরা তাকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি, তখন তুমি গোপনে তাকে নিয়ে যেয়ো এবং তার পিতার কাছে পৌছে দিয়ো। অবশেষে কিনানা তাই করল। ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেন : যয়নবকে যারা ফিরিয়ে নিতে এসেছিল, তারা যখন মক্কায় ফিরে যায়, তখন উতবার কন্যা হিন্দ তাদেরকে তিরষ্কার করে বলেছিল :

এ সব লোক কি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে গাধার ন্যায় নির্দয় ও কঠোর? পক্ষান্তরে যুদ্ধের ময়দানে ঋতুমতী নারীর সমতুল্য?

কেউ কেউ বলেছেন যে, হিন্দ বিনতে উত্বা এই কবিতা বলেছিল তখন, যখন কুরায়শরা বদর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মক্কায় গিয়েছিল। ইবন ইসহাক বলেন, : এরপর যয়নব আরও কিছু দিন মক্কায় অবস্থান করেন। পরে যখন পরিস্থিতি শান্ত হল, তখন এক রাত্রে কিনানা তাকে নিয়ে বের হল এবং যায়দ ইবন হারিছা ও তাঁর সংগীর কাছে পৌছিয়ে দিল। তারা রাতের বেলা তাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। বায়হাকী তাঁর ‘দালাইল” গ্রন্থে উমর ইবন আবদুল্লাহ সূত্রে. আইশা থেকে বর্ণনা করেন। এ বর্ণনায় আইশা (রা) মক্কা হতে যয়নবের বেরিয়ে আসা, কুরায়শ কর্তৃক ফিরিয়ে নেয়া ও গর্ভপাতের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এরপর বলেছেন, যয়নবকে আনার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা) যায়দ ইবন হারিছাকে প্রেরণ করেন। যাওয়ার সময় হারিছার নিকট রাসূলুল্লাহ (সা) তার হাতের আংটি দিয়ে দেন। যােয়দ মক্কার এক রাখালের সাথে সু-সম্পর্ক সৃষ্টি কবে তাকে ঐ আংটিটি দিয়ে বললেন, এটা যয়নবকে দিয়ে

হে পথিক! যদি তুমি আবু সুফিয়ানের সাক্ষাত পাও, তবে তাকে এ কথাটি পৌছিয়ে দিও যে, তুমি যদি আত্মসমর্পণ করে ইসলাম গ্ৰহণ না কর,

তা হলে এই সুসংবাদ (?) গ্ৰহণ করা যে, ইহকালে তুমি হবে লাঞ্ছিত আর আলকাতরার পোশাক পরিধান করে হবে জাহান্নামের চিরস্থায়ী বাসিন্দা।”

ইবন ইসহাক বলেন, উপরের কবিতায় আবু সুফিয়ানের দাস বলে কবি যার প্রতি ইংগিত করেছেন তার নাম আমির ইবন হাযরামী। কিন্তু ইবন হিশাম, তার নাম বলেছেন, উকবা ইবন আবদুল হারিছ ইবন হাযরামী। তিনি বলেন, আমির ইবন হাযরামী বদর যুদ্ধে নিহত হয়। ইবন ইসহাক বলেন, আমার নিকট ইয়ায়ীদ ইবন আবু হাবীব….. আবু হুরায়রা থেকে বর্ণনা করেন। আবু হুরায়রা বলেন, : নবী করীম (সা) একবার এক অভিযান প্রেরণ করেন। আমিও তার অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। যাত্রাকালে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদেরকে বলে দেন যে, তোমরা যদি হাব্বার ইবন আসওয়াদ ও ঐ লোকটিকে ধরতে পার যে হুবারের সাথে যয়নবের সম্মুখে অগ্রসর হয়ে

জানালেন, আমি তোমাদেরকে বলেছিলাম— ঐ লোক দু’জনকে ধরতে পারলে আগুনে পুড়িয়ে দেবে; কিন্তু পরে আমি ভেবে দেখলাম যে, আগুনে পুড়িয়ে মারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও জন্যে শোভা পায় না। তাই এখন জানাচ্ছি, যদি তাদেরকে পাকড়াও করতে পোর, তবে হত্যা করে দিও। হাদীছটি এই সূত্রে ইবন ইসহাক একাই বৰ্ণনা করেছেন। এটি সুনানের শর্ত অনুযায়ী বর্ণিত। তবে সুনান সঙ্কলকগণ এ হাদীছ বর্ণনা করেননি। ইমাম বুখারী কুতায়বা….. আবু হুরায়রা সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

ইবন ইসহাক বলেন, আবুল আস ফিরে গিয়ে মক্কায় কুফৱী অবস্থায় জীবন যাপন করতে থাকেন। অন্যদিকে যায়নব মদীনায় পিতার কাছে অবস্থান করেন। মক্কা বিজয়ের কিছু দিন আগে আবুল ‘আস কুরায়শদের পক্ষে বাণিজ্য উপলক্ষে বের হন। বাণিজ্য শেষে সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনকালে তিনি একটি মুসলিম সেনাদলের সম্মুখীন হন। সেনাদলটি তাঁর মালপত্র আটক করেন। কিন্তু আবুল আসি আত্মরক্ষার্থে সেখান থেকে পালিয়ে রাত্রে নিজ স্ত্রী যয়নবের কাছে এসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। যয়নব তাকে আশ্রয় দেন। ভোর বেলা রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন লোকজন নিয়ে ফজরের সালাত আরম্ভ করেন, তখন যয়নব মহিলাদের সারি থেকে উচ্চৈঃস্বরে বললেন, : লোক সকল! শুনে রাখুন, আমি আবুল ‘আস ইবন রবীকে আশ্রয় দিয়েছি। সালাম ফিরাবার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুসল্লীদের দিকে মুখ করে বসলেন এবং বললেন, “সালাতের মধ্যে আমি যা শুনেছি তোমরাও কি তা শুনতে পেয়েছ?” সবাই বললেন, জী-হ্যা। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেনঃ সেই সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মদের জীবন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। এখনই শুনলাম, যা তোমরাও শুনেছ। যে কোন সাধারণ মুসলমানেরও কাউকে আশ্রয় দেয়ার অধিকার রয়েছে। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) যয়নবের কাছে গিয়ে বললেনঃ হে প্রিয় কন্যা! তুমি তাকে মর্যাদার সংগে থাকতে দাও! তবে সে একান্তে যেন তোমার নিকট না আসে। কেননা, এখন তুমি তার জন্যে হালাল নিও।

মালামাল তাকে ফেরত দেয়ার জন্যে উৎসাহিত করে নবী করীম (সা) বার্তা পাঠালেন। তারা

আবুল আসের সমস্ত মাল তাকে ফেরত দিলেন। নিজেদের কাছে কিছুই রাখলেন না। আবুল আস মাল নিয়ে মক্কায় ফিরে গেলেন এবং কুরায়শদের প্রত্যেককে যার যার মাল যথাযথভাবে ফেরত দিলেন। তারপর তিনি বললেন, : হে কুরায়শ সম্প্রদায়! আমার কাছে কি তোমাদের আর কোন পাওনা বাকী আছে? সবাই বলল, না। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন। তুমি আমাদের নিকট বিশ্বস্ত ও সন্ত্রান্ত। আবুল আস এ সময় কালেমা শাহাদত পড়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন

এরপর তিনি কুরায়শদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, : আমি মদীনায় রাসূলুল্লাহর নিকট থাকা অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করি নাই। এ কারণে যে, তোমরা হয়তো ধারণা করবে, আমি তোমাদের মালামাল আত্মসাত করবো। আল্লাহর ইচ্ছায় এখন যখন তোমাদের মাল যথাযথভাবে বুঝিয়ে দিয়েছি, তখন আর আমার ইসলাম গ্রহণ করতে কোন বাধা নেই। এরপর আবুল ‘আস মক্কা থেকে হিজরত করে রাসূলুল্লাহর নিকট চলে যান। ইবন ইসহাক বলেন : দাউদ ইবন হুসাইন ইবন আব্বাস সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যয়নবকে পূর্ব বিবাহের ভিত্তিতে আবুল আসের নিকট ফিরিয়ে দেন, পুনরায় বিবাহ পড়াননি। ইমাম আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিয়ী ও ইবন মাজা এ হাদীছ মুহাম্মদ ইবন ইসহাক সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিরমিয়ী বলেন, এ হাদীছের সনদে কোন আপত্তি নেই, তবে আমরা এর সূত্র সম্পর্কে অবহিত নই। সম্ভবত দাউদ ইবন হুসায়নের স্মৃতি থেকে বর্ণিত হয়েছে। সুহায়লী বলেন, আমার জানা মতে ফকীহদের মধ্যে এ মত কেউ-ই পোষণ করেন না। এক বর্ণনায় আছে, ছয় বছর পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) যয়নবকে তাঁর স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেন। আর এক বর্ণনায় আছে, দুই বছর পর পূর্বের বিবাহের উপর তাকে ফিরিয়ে দেন। ইবন জারীর এ বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন। অপর বর্ণনায় আছে, বিবাহ দোহরাননি। এ হাদীছটি অনেক আলিমকেই বে-কায়দায় ফেলে দিয়েছে। কেননা, তাদের নিকট স্বীকৃত মূলনীতি এই যে, কুফারী অবস্থায় বিবাহের পর নির্জনে মিলিত হওয়ার পূর্বেই যদি স্ত্রী ইসলাম গ্ৰহণ করে ফেলে আর স্বামী কাফির থাকে, তবে সাথে সাথেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কিন্তু নির্জনে মিলিত হওয়ার পর যদি ইসলাম গ্রহণ করে, তবে ইদ্দত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে স্বামী ইসলাম গ্রহণ করলে বিবাহ ঠিক থাকবে। আর ইদতের মধ্যে ইসলাম গ্ৰহণ না করলে বিবাহ ভেংগে যাবে। কিন্তু আলোচ্য ঘটনায় যায়নব ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর নবুওয়াত প্ৰাপ্তির সময়। আর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। বদর যুদ্ধের এক মাস পর। ওদিকে মুশরিক পুরুষদের সাথে মুসলিম নারীদের বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ হয় ষষ্ঠ হিজরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধির বছর এবং আবুল আস ইসলাম গ্রহণ করেন অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পূর্বে। এখন যারা বলছেন, ছয় বছর পর ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাদের উদ্দেশ্যে— হিজরতের সময় থেকে দুই বছর পর। এ হিসেবে তাদের কথা সঠিক। আবার যারা বলেছেন দু’বছর পর ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাদের উদ্দেশ্য— মুশরিক পুরুষদের উপর মুসলিম নারীদের বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ হওয়ার বিধান নাযিলের দু’বছর পর। সে হিসেবে এ মতও সঠিক। যা হোক, উভয় অবস্থাতেই একটা কথা স্পষ্ট যে, যয়নবের ইদ্দত এ সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল। কেননা, বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ হওয়ার বিধান আসার পর পূর্ণ দুই বছর বা প্রায় দুই বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। সুতরাং পূর্ব বিবাহের ভিত্তিতে তাকে কিভাবে আগের স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেয়া হল? একদল আলিম এ প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, “হতে পারে যায়নবের ইদ্দত তখনও পূর্ণ হয়নি।” কিন্তু এই সম্ভাবনা গ্রহণ করলে বিষয়টি যায়নবের উপরে গড়ায়। তাঁর স্বীকৃতির উপর নির্ভর করবে, ইদ্দত তখন শেষ হয়েছিল কি না? অন্য এক দল আলিম এই হাদীছের মুকাবিলায় প্রথমে উল্লিখিত হাদীছটি পেশ করেছেন, যে হাদীছ ইমাম আহমদ, তিরমিয়ী ও ইবন মাজা হাজ্জাজ ইবন আরতাত থেকে, তিনি আমর ইবন শুআয়ব থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর কন্যা (যয়নব)-কে নতুন ভাবে মহর নির্ধারণ করে ও নতুন করে বিবাহ পড়ায়ে আবুল ‘আস ইবন রবী’র নিকট ফিরিয়ে দেন। ইমাম আহমদ এ হাদীছকে দুর্বল ও অমূলক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, হাজ্জাজ এ হাদীছ আমর ইবন শুআয়ব থেকে শ্রবণ করেননি, বরং মুহাম্মদ ইবন উবায়দুল্লাহ আর যামীর কাছ থেকে শুনেছেন। আর আরব্যামীর বর্ণিত হাদীছ মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। সহীহ হাদীছ ঐটাই যা বর্ণনা করা হয়েছে যে, নবী করীম (সা) যয়নবের প্রথম বিবাহ ঠিক রাখেন। অনুরূপভাবে দারাকুতনী বলেছেন, এ বর্ণনাটি প্রামাণ্য নয়। ইবন আব্বাস প্রামাণ্য হাদীছে। বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যয়নবকে প্রথম বিবাহের উপরই আবুল আসের নিকট ফিরিয়ে দেন। তিরমিয়ী বলেন, এ হাদীছের সনদ সমালোচনার উর্ধে নয়। বিজ্ঞ আলিমদের মতে কার্যকর পন্থা হচ্ছে : কাফির স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি স্ত্রী প্রথমে ইসলাম গ্ৰহণ করে এবং ইদত পালনকালে স্বামীও মুসলমান হয়ে যায়, তবে ঐ স্বামীই এই স্ত্রীর অধিক দাবীদার। ইমাম মালিক, আওযাঈ, শাফিঈ, আহমদ ও ইসহাক এই মত পোষণ করেন। অন্যরা বলেন? যায়নবের ইদ্দত শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্ৰবল ৷ যিনি বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যয়নবের বিবাহ নতুন ভাবে পড়িয়েছিলেন, তাদের বর্ণনা খুবই দুর্বল। যয়নবের এ ঘটনা থেকে দলীল গ্রহণ করে বলা হয়েছে যে, স্ত্রী যদি ইসলাম গ্ৰহণ করে আর স্বামীর ইসলাম গ্ৰহণ করতে বিলম্ব হয় এবং এতে ইদতের সময় পার হয়ে যায়, তবে শুধু এ কারণেই বিবাহ ভেংগে যাবে না; বরং স্ত্রীর ইখতিয়ার থাকবে–ইচ্ছা করলে সে অন্য কাউকে বিবাহ করতে পারবে এবং ইচ্ছা করলে যতদিন পারে বিবাহ হতে বিরত থেকে স্বামীর ইসলাম গ্রহণের অপেক্ষায় থাকবে। যতদিন অন্য কাউকে বিবাহ না করবে, ততদিন সে ঐ স্বামীর-ই স্ত্রী হিসেবে গণ্য হবে। এ মতটি নিঃসন্দেহে যুক্তিসংগত, শক্তিশালী এবং ফিকহী দৃষ্টিতে মূল্যবান। উক্ত মতের দলীল হিসেবে বুখারী শরীফে “মুশরিক নারী মুসলমান হলে তার বিবাহ ও ইদ্দত” শিরোনামে উল্লিখিত একটি হাদীছ গ্ৰহণ করা যায়। ইমাম বুখারী বর্ণনা করেন, ইবরাহীম ইবন মূসা. ইবন আব্বাস থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) ও মু’মিনদের বিষয়ে মুশরিকদের দু’ধরনের অবস্থান ছিল। একদল ছিল হারবী মুশরিক। তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন এবং তারাও তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত। আর একদল ছিল চুক্তিবদ্ধ মুশরিক। তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন না এবং তারাও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত না। হারবী মুশরিকদের কোন মহিলা যদি (ঈমান এনে) হিজরত করে মদীনায় চলে আসত, তা হলে সে ঋতুমতী হয়ে পুনরায় পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তার কাছে বিবাহের প্রস্তাব দেয়া হত না। পবিত্র হওয়ার পর তার সাথে বিবাহ বৈধ হত। তবে যদি অন্যের সাথে বিবাহের পূর্বেই তার স্বামী হিজরত করে চলে আসত, তা হলে ঐ মহিলাকে তার কাছেই ফিরিয়ে দেয়া হত। আর যদি তাদের কোন দাস বা দাসী হিজরত করে।

চলে আসত, তবে তারা মুক্ত হয়ে যেত এবং মুহাজিরদের যে সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার ছিল, তারাও তা লাভ করত। এরপর বর্ণনাকারী (আতা) চুক্তিবদ্ধ মুশরিকদের প্রসংগে মুজাহিদের অনুরূপ হাদীছ বর্ণনা করেছেন— যা এখানে হুবহু বৰ্ণনা করা হল। “কোন হারবী মুশরিক মহিলা হিজরত করে আসলে ঋতুস্রাব হওয়া ও পুনরায় পাক না হওয়া পর্যন্ত তার কাছে বিবাহের প্রস্তাব দেয়া যাবে না।” এ কথার অনিবাৰ্য দাবী হল–একবারের ঋতুস্রাব দ্বারা তার জরায়ু পরিষ্কার হয়ে যাবে। তিনবার ঋতুস্রাব দ্বারা ইদত পালন করার প্রয়োজন নেই।” একদল আলিম এই মত গ্রহণ করেছেন। অনুরূপ “বিবাহের পূর্বেই যদি তার স্বামী হিজরত করে আসে, তবে তাকে ঐ স্বামীর কাছেই ফিরিয়ে দেয়া হবে”— এই বাক্যটির দাবীও এই যে, ইদ্দত ও জরায়ু পরিষ্কার হওয়ার সময় অতিবাহিত হওয়ার পর যতদিন পর্যন্ত অন্যত্র বিবাহ না হবে, ততদিনের মধ্যে স্বামী হিজরত করে আসলে তার কাছেই মহিলাকে ফেরত দেয়া যাবে। রাসূলুল্লাহর কন্যা যয়নবের ঘটনা থেকে এ কথারই প্রমাণ মিলে একদল আলিম এ মতই পোষণ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *