2 of 2

৬০. ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ

ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ

সে দিন ছিল মীমাংসার দিন যে দিন দু’দল পরস্পরের মুখোমুখি হয়। (৮ : :১)। আল্লাহর বাণী :

“এবং বদরের যুদ্ধে যখন তোমরা হীনবল ছিলে আল্লাহ তো তোমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।” (৩ : S३७)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন, :

“এটা এরূপ, যেমন তোমার প্রতিপালক তোমাকে ন্যায্যভাবে তোমার গৃহ হতে বের করেছিলেন, অথচ বিশ্বাসীদের এক দল এটা পসন্দ করেনি। সত্য স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হওয়ার পরও তারা তোমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়। মনে হচ্ছিল তারা যেন মৃত্যুর দিকে চালিত হচ্ছে আর তারা যেন এটা প্রত্যক্ষ করছে। স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, দু’-দলের একদল তোমাদের আয়ত্তাধীন হবে; অথচ তোমরা চাচ্ছিলে যে, নিরস্ত্র দলটি তোমাদের আয়ত্তাধীন হোক আর আল্লাহ চাচ্ছিলেন যে, তিনি সত্যকে তাঁর বাণী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেন এবং কাফিরদেরকে নিৰ্মল করেন। এটা এ জন্যে যে, তিনি সত্যকে সত্য ও অসত্যকে অসত্য প্রতিপন্ন করেন, যদিও অপরাধীরা এটা পসন্দ করে না। (৮ : ৫-৮)। এ ভাবে বদর যুদ্ধের বর্ণনা সূরা আনফালে যে পর্যন্ত করা হয়েছে তার বিস্তারিত আলােচনা আমরা তাফসীর গ্রন্থে যথাস্থানে করেছি। এখানে প্রয়ােজন অনুযায়ী তার পূনরাবৃত্তি করা হবে।

ইবন ইসহাক আবদুল্লাহ ইবন জাহাশের অভিযান সম্পর্কে আলোচনার পর লিখেন : এর কিছু দিন পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) জানতে পারলেন যে, আবু সুফিয়ান সাখার ইবন হারব কুরায়শদের বিশাল এক কাফেলা নিয়ে সিরিয়া থেকে রওনা হয়েছে। তার সাথে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার সম্পদ ও বাণিজ্য-সম্ভার। তিনি আরও জানলেন যে, এই কাফিলায় ত্ৰিশ অথবা চল্লিশ জন লোক রয়েছে, যাদের মধ্যে মাখরামা ইবন নাওফিল এবং আমর ইবন আসও আছে। মূসা ইবন উকবা ইমাম যুহরী থেকে বর্ণনা করেন যে, এটা ছিল ইবন হাযরামীর হত্যাকাণ্ডের দু’মাস পরের

বলবাে, তা আপনি গোপন রাখবেন। আব্বাস জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি স্বপ্ন দেখেছ? আতিকা বললেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম। একজন লোক উটে চড়ে মক্কার সংলগ্ন সমতল ভূমিতে এসে থামাল। তারপর সে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার দিয়ে ঘোষণা দিল, সাবধান ওহে বিশ্বাসঘাতকেরা! তিন দিনের মধ্যে ধ্বংসের জন্যে প্রস্তুত হয়ে যাও। এরপর দেখলাম, জনতা তার পাশে সমবেত হয়েছে। লোকটি পরে মসজিদে হারামে প্রবেশ করল, জনতাও তাকে অনুসরণ করল। এরপর উটনী তাকে নিয়ে কাবাঘরে গিয়ে উঠলো। সেখানেও সে অনুরূপ ঘোষণা দিল, “সাবধান হে বিশ্বাসঘাতকের দল (অর্থাৎ কুরায়শরা)। তিন দিনের মধ্যে তোমরা ধ্বংসের জন্যে প্ৰস্তুত হও।” এরপর উটনী সেখান থেকে তাকে নিয়ে আবু কুবায়স পাহাড়ের শীর্ষে আরোহণ করলো। সেখান থেকেও সে একই ঘোষণা দিল। এরপর সে পাহাড়ের উপর থেকে একটি পাথর গড়িয়ে দিল। পাথরটি গড়িয়ে পাহাড়ের পাদদেশে এসেই ভেঙ্গে টুকরো টুকরা হয়ে ছিটকে পড়লো। ফলে মাককার এমন কোন বাড়ি-ঘর অবশিষ্ট থাকলো না, যেখানে এর কোন টুকরো পৌঁছায়নি। তা শুনে আব্বাস বললেন, সত্যিই আল্লাহর কসম! সত্যিই এটা এক ভয়ানক স্বপ্ন। তবে তুমি এ স্বপ্নের কথা গোপন রাখবে, কাউকে বলবে না।

এরপর আব্বাস সেখান থেকে বেরিয়ে যান। পথে তার বন্ধু ওয়ালীদ ইবন উতবার সাথে সাক্ষাত হয়। আব্বাস তার নিকট স্বপ্নের বৃত্তান্ত খুলে বলেন এবং তা গোপন রাখার জন্যে অনুরোধ জানান। কিন্তু ওয়ালীদ তার পিতা উতবার কাছে তা বলে দেয়। এ ভাবে স্বপ্নের কথাটি ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং কুরায়শদের ঘরে ঘরে এর আলোচনা চলতে থাকে। আব্বাস বলেন, একদিন সকালে আমি বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতে বের হলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম, আবু জাহল কুরায়শদের কয়েকজন লোকের সাথে বসে আতিকার স্বপ্ন প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছে। আবু জাহল আমাকে দেখেই বললো, হে আবুল ফযল! তাওয়াফ শেষ করে আমাদের কাছে এসো। আমি তাওয়াফ শেষে তাদের পাশে গিয়ে বসলাম। আবু জাহল বললো, হে বনু আবদুল মুত্তালিব! তোমাদের মধ্যে এই মহিলা নবীর আবিভােব আবার কবে থেকে হল? আমি বললাম, সে আবার কি? আবু জাহল বললো, কেন, ঐ যে আতিকার স্বপ্ন!! আমি বললাম, সে আবার কী স্বপ্ন দেখেছে? আবু জাহল বললো হে বনু আবদুল মুত্তালিব! তোমরা কি তোমাদের পুরুষদের নবুওয়াতীতে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না যে, এখন তোমাদের মহিলারাও নবুওয়াতী দাবী করছে? আতিকা নাকি স্বপ্নের মাধ্যমে জেনে বলেছেন, তিন দিনের মধ্যে তোমরা প্ৰস্তুত হও। আমরা এখন তোমাদের জন্যে এই তিন দিন অপেক্ষা করবো। এর মধ্যে যদি তার কথা সত্য হয়, তা হলে যা হবার তাই হবে। আর যদি এই তিন দিনের মধ্যে কোন ঘটনা না ঘটে, তবে আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে লিখিত ঘোষণা জারী করবো যে, গোটা আরব জাহানে তোমরাই সবচেয়ে মিথ্যাবাদী গোষ্ঠী। আব্বাস বলেন, আল্লাহর কসম, আমি তাকে তেমন গুরুতর কিছুই বলিনি, শুধু তার বক্তব্যকে অস্বীকার করলাম এবং বললাম, আদতে আতিকা কোন স্বপ্নই দেখেনি।

এরপর আমরা সেখান থেকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। বিকেল বেলা বনু আবদুল মুত্তালিবের মহিলারা আমার কাছে এসে বললো, এই জঘন্য পাপিষ্ঠকে তোমরা স্বাধীন ভাবে

ছেড়ে দিয়েছ। সে তোমাদের পুরুষদের যা খুশী তাই বলেছে। এখন তোমাদের নারীদের সম্পর্কেও বিভিন্ন প্রকার কটুক্তি করছে। আর তুমি সব শুনে চুপ করে বসে রইছ। এতে তোমার আত্মমর্যাদায় মোটেও লাগছে না! আব্বাস বললেন, আল্লাহর কসম, আমার প্রতিক্রিয়া অবশ্যই আছে। তবে আমার পক্ষ থেকে বড় ধরনের কিছু দেখাইনি। আল্লাহর কসম, এবার আমি তার কঠোর প্রতিবাদ করবাে। সে যদি এর পুনরাবৃত্তি করে তবে আমি অবশ্যই তার সমুচিত জবাব দেব। আব্বাস বলেন, আতিকার স্বপ্ন দেখার তৃতীয় দিবসে আমি ক্ৰোধে অধীর হয়ে সকাল বেলা ঘর থেকে বের হলাম। ভাবলাম, তাকে ধরার একটা সুবর্ণ সুযোগ আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে। আবু জাহলকে মসজিদের মধ্যে পেয়ে গেলাম। আল্লাহর কসম, আমি তার দিকে অগ্রসর হলাম এবং প্রস্তুতি নিলাম যে, কোন কায়দায় সে যদি পূর্বের ন্যায় আচরণ করে, তবে তার উপর আক্রমণ করবো। আবু জাহল ছিল হালকা-পাতলা দেহ বিশিষ্ট। কিন্তু তার চেহারা ছিল রুক্ষ, ভাষা ছিল রূঢ় এবং দৃষ্টিশক্তি ছিল তীক্ষ। আব্বাস বলেন, হঠাৎ সে দ্রুত পায়ে মসজিদের দরজার দিকে বেরিয়ে আসছে। আমি মনে মনে ভাবলাম, ওর হলটা কী? আল্লাহ তার উপর অভিশাপ বর্ষণ করুন!; সে কি আমার গালমন্দের ভয়ে সরে যেতে চাচ্ছে? কিন্তু সহসাই বুঝতে পারলাম সে যম যম ইবন আমরা গিফারীর চিৎকার শুনতে পেয়েছে, যা আমি শুনতে পাইনি। গিফারী মক্কার উপকণ্ঠে বাতনে ওয়াদীতে এসে উটের নাক কেটে হাওদা উলটিয়ে এবং জামা ছিড়ে ফেলে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার দিয়ে বলছিল?

“হে কুরায়শ জনগণ! বিপদ! বিপদ! আবু সুফিয়ানসহ তোমাদের মালামাল লুট করার জন্যে মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীরা আক্রমণে বেরিয়েছেন। আমার মনে হয়, তোমরা আর তা রক্ষা করতে পারবে না। সাহায্যের জন্যে আগাও! সম্পদের জন্য আগাও! ছুটে যাও। আব্বাস বলেন, এ ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে আমিও তার দিকে মনোযোগী হতে পারলাম না; আর সেও আমার দিকে মনোযোগী হল না। যা হোক, লোকজন অতি দ্রুত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ফেললো। তারা বলাবলি করছিল যে, মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীরা কি আমাদের কাফেলাকে ইবন হাযরামীর কাফেলার মত মনে করছে? কখনো না, আল্লাহর কসম, তারা এবার ভিন্ন রকম দেখবে।

মূসা ইবন উকবা আতিকার স্বপ্নের বর্ণনা ইবন ইসহাকের মতই উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, যম যম ইবন আমরা যখন ঐ অবস্থায় এসে উপস্থিত হল, তখন কুরায়শরা আতিকার স্বপ্নের কথা স্মরণ করে ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে এবং ঘর থেকে উচ্চ ও নিম্নভূমিতে বেরিয়ে আসে।

ইবন ইসহাক বলেন, কুরায়শদের সকলেই এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। হয় নিজে সরাসরি গমন করে, না হয়। অন্য কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করে পাঠায়। নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে আবু লাহাব ইবন আবদুল মুত্তালিব ব্যতীত আর কেউ যুদ্ধে যাওয়া থেকে বিরত থাকেনি। সে তার পরিবর্তে আসী ইবন হিশাম, ইবন মুগীরাকে পাঠায়। আবু লাহাবের নিকট আসী চার হাজার দিরহামের ঋণী ছিল। দরিদ্রতার কারণে সে ঋণ পরিশোধ করতে পারছিল না। ঐ পাওনা

ইবন ইসহাক বলেন, আমার নিকট ইবন আবু নাজীহ বৰ্ণনা করেছেন যে, উমাইয়া ইবন খালফও যুদ্ধে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে ছিল অতিশয় বৃদ্ধ, মোটাসোটা ভারী দেহের অধিকারী। এ সংবাদ শুনে উকবা ইবন আবু মুআয়ত তার কাছে আসে। তখন উমাইয়া মসজিদে হারামে নিজের লোকজনসহ বসা ছিল। উকবার হাতে ছিল আগুন ও অঙ্গারভর্তি একটা পাত্র। সে পত্রিটি উমাইয়ার সম্মুখে রেখে দিয়ে বললো, হে আবু আলী লও তুমি আগুন পোহাও। কেননা, তুমি তো একজন নারী। উমাইয়া বললো, আল্লাহ তোমাকে ও যা তুমি নিয়ে এসেছ তাকে অমংগল করুন। রাবী বলেন, উমাইয়া তখন প্ৰস্তৃতি নিল ও অন্যদের সাথে যুদ্ধে গমন করল। ১

ইবন ইসহাক এ ঘটনা এ ভাবেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ইমাম বুখারী ঘটনাটির বর্ণনা অন্য ভাবে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমার কাছে আহমদ ইবন উছমান… সাআদ ইবন মুআয থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, তার ও উমাইয়া ইবন খালফের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। উমাইয়া মদীনায় এলে সাআদ ইবন মুআযের অতিথি হত এবং সাআদ মক্কায় গেলে উমাইয়ার বাড়িতে মেহমান হতেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনায় হিজরত করলে একদা সাআদ ইবন মুআয উমরা করার উদ্দেশ্যে মক্কায় যান ও উমাইয়ার বাড়িতে অবস্থান করেন। সাআদ উমাইয়াকে বললেন, আমার জন্যে একটা নিরিবিলি সময় বের কর, যে সময়ে আমি নির্বিঘ্নে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতে পারি। সে মতে একদা দুপুর বেলা উমাইয়া সাআদকে সাথে নিয়ে বের হল। তাদের সাথে আবু জাহলের সাক্ষাত হয়। আবু জাহল উমাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো, হে আবৃ সাফওয়ান! তোমার সাথে এ ব্যক্তিটি কে? সে উত্তরে বললো, এ হচ্ছে সাআদ। তখন আবু জােহল সাআদকে লক্ষ্য করে বললো : মক্কায় তোমাকে যে নিরাপদে-নির্বিঘ্নে তাওয়াফ করতে দেখছি। অথচ তোমরা ধর্মত্যাগীদের আশ্রয় দান করেছ এবং তাদেরকে সাহায্য ও সহযোগিতা করার ঘোষণা দিয়েছ? শুনে রেখো, আল্লাহর কসম, তুমি যদি এ সময় আবু সাফওয়ানের সাথে না হতে, তবে কিছুতেই তুমি তোমার পরিবারের কাছে অক্ষত ভাবে ফিরে যেতে পারতে না। সাআদ ততোধিক উচ্চকণ্ঠে বললেন, সাবধান! তুমি যদি আমাকে এ কাজ থেকে বাধা দাও, তবে আমি তোমাকে এমন এক বিষয়ে বাধা দেবো, যা তোমার জন্যে এর চাইতে গুরুতর হবে অনায় তা হচ্ছে, মদীনার উপর দিয়ে সিরিয়ার বাণিজ্য-পথ। তখন উমাইয়া তাকে বললো, হে সাআদ! আবুল হাকামের সাথে এতো উচ্চকণ্ঠে কথা বলো না। কেননা, তিনি হলেন এই তল্লাটের অধিবাসীদের নেতা। তখন সাআদ বললেন, উমাইয়া! তুমি চুপ থাক। কেননা, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি, তারাই তোমার হত্যাকারী। উমাইয়া জিজ্ঞেস করলো, কোথায়, মককয়? সাআদ বললেন, তা আমি জানি না। এ কথা শুনে উমাইয়া অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। এরপর বাড়ি ফিরে যেয়ে উমাইয়া তার স্ত্রীকে ডেকে বললো, হে উম্মে সাফওয়ান! শুনেছি, সাআদ আমাকে কী বলেছে? তার স্ত্রী বললো, সে তোমাকে কী বলেছে?

১. ওয়াকিদীর বর্ণনা মতে, উকবা ও আবু জাহল দু’জনেই উমাইয়ার কাছে যায়। উকবার কাছে ছিল আগুন ও

আগরবাতি, আর আবু জাহলের হাতে ছিল সুরমাদানী। উকবা বললো, আগর বাতির ঘাণ লও! কেননা, তুমি হলে নারী। আবু জাহল বললো, সুরমা লাগাও। কেননা, তুমি তো নারী।

জিজ্ঞেস করলাম, মক্কায়? সে বললো, জানি না। এরপর উমাইয়া বললো, আল্লাহর কসম, আমি আর মক্কা ছেড়ে কোথাও যাবো না। এরপর বদর যুদ্ধ সমাগত হলে আবু জাহল লোকজনকে যুদ্ধে যাওয়ার প্ররোচনা দিয়ে বললো, তোমরা তোমাদের কাফেলাকে রক্ষা করার জন্যে বেরিয়ে পড়। কিন্তু উমাইয়া মক্কা থেকে বের হতে অনীহা প্রকাশ করলো। তখন আবু জাহল এসে বললো, হে আবু সাফওয়ান! লোকে যখন দেখবে, তুমি এ উপত্যকার অন্যতম নেতা হয়েও যুদ্ধে না গিয়ে বাড়িতে বসে থাকছ, তখন তারাও তোমার সাথে বাড়িতে থেকে যাবে। আবু জাহল তাকে নেয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। অবশেষে উমাইয়া বললো, তুমি যখন ছাড়লেই না, তখন আল্লাহর কসম, আমি মক্কার মধ্যে সর্বাধিক উৎকৃষ্ট ও তেজী একটি উট ক্রয় করবো।*

এরপর সে স্ত্রীকে বললো, হে উম্মে সাফওয়ান!! আমার যুদ্ধে যাওয়ার ব্যবস্থা কর। স্ত্রী বললো, হে আবু সাফওয়ান! তোমার ইয়াছরিবী ভাই-এর কথা কি ভুলে গিয়েছ? সে বললো, না, ভুলি নাই। তবে আমি তাদের সাথে অল্প কিছু দূর পর্যন্ত যেতে চাই মাত্র। রওনা হয়ে যাওয়ার পর যে স্থানেই সে অবতরণ করেছে। সেখানেই সে (সম্মুখে অগ্রসর না হওয়ার জন্যে) উট বেঁধে রেখেছে। সারাটা পথেই সে এরূপ করতে থাকলো। অবশেষে আল্লাহর হুকুমে বদর রণাঙ্গনে সে নিহত হয়।

বুখারী অন্যত্র এ ঘটনা আবু ইসহাকের বরাতে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ ইসরাঈল সূত্রে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনায় আছে যে, উমাইয়াকে তার স্ত্রী বলেছিল, আল্লাহর কসম, মুহাম্মদ কখনও মিথ্যা কথা বলেন না।

ইবন ইসহাক বলেন, কুরায়শরা যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি সমাপন করলো এবং রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করলো, তখন বনু বকর ইবন আবদে মানাত ইবন কিনানার সাথে তাদের বিরোধের কথা মনে পড়লো এবং তারা আশংকা করলো যে, আমরা রওনা দিলে তারা পিছন থেকে আমাদের উপর হামলা করতে পারে। কুরায়শ ও বনু বকরের মধ্যে সুদীর্ঘ যুদ্ধের মূলে যে কারণ ছিল তা হলো, কুরায়শ পক্ষের বনু আমির ইবন লুআই গোত্রের সদস্য হাফস ইবন আখইয়াফের এক পুত্রের হত্যা। তাকে হত্যা করেছিল বনু বকরের এক ব্যক্তি এবং হত্যা করেছিল তাদের সর্দার আমির ইবন ইয়াখীদ ইবন আমির ইবন মালালুহ-এর ইঙ্গিতে। এরপর নিহতের ভাই মিকরা য ইবন হাফস-এর প্রতিশোধ স্বরূপ। আমিরকে হত্যা করে সে আমিরের পেটের মধ্যে তরবারি ঢুকিয়ে দেয়। এরপর ঐ রাত্রেই বাড়িতে ফিরে আসে এবং কাবাঘরের গিলাফের সাথে তরবারি বুলিয়ে রাখে। এ কারণে দু’-পক্ষের মধ্যে অবস্থার যে অবনতি ঘটে, তাতে কুরায়শদের মনে ঐ সময় বনু বকরের প্রতি আশংকা জাগে।

ইবন ইসহাক বলেন, ইয়ামীদ ইবন রূমান আমার নিকট উরওয়া ইবন যুবােয়র থেকে বর্ণনা করেছেন যে, কুরায়শরা যুদ্ধে রওনা হওয়ার প্রাককালে বনু বকরের সাথে তাদের বিরোধের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা ভাবতে থাকে। ঠিক ঐ মুহুর্তে ইবলীস সুরাকী ইবন মালিক

১. ওয়াকিদী বলেছেন, উমাইয়া কুশােয়র গোত্র থেকে তিনশ’ দিরহাম দিয়ে একটি উট ক্রয় করে। বদর যুদ্ধে

মুসলমানরা এটা গনীমত স্বরূপ পায় এবং খুবায়ব ইবন আসাফের ভাগে তা পড়ে।

br

ইবন জুশাম, মুদলাজির আকৃতি ধারণ করে তাদের সামনে হাযির হয়। সুরাকা ছিল বনু কিনানার অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা। সে কুরায়শদের বললো, বনু কিনানার লোকেরা যাতে পশ্চাৎ দিক থেকে তোমাদের উপর হামলা না করে আমি তার দায়িত্ব গ্রহণ করছি। এ প্রতিশ্রুতি পেয়ে কুরায়শরা দ্রুত যুদ্ধে রওনা হয়ে গেল। কুরআনে আল্লাহ এ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন :

ولا تكونوا كالذين ………………. و اللهٔ شدید العقاب.

অর্থাৎ, তোমরা তাদের ন্যায় হয়ে না, যারা দম্ভভরে ও লোক দেখাবার জন্যে নিজেদের বাড়ি থেকে বের হয়েছিল এবং লোককে আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে তারা যা করে আল্লাহ তা পরিবেষ্টন করে রয়েছেন। স্মরণ কর, শয়তান তাদের কার্যাবলী তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল এবং বলেছিল আজ মানুষের মধ্যে কেউই তোমাদের উপর বিজয়ী হবে না। আমি তোমাদের পাশেই থাকবো। এরপর দু’দল যখন পরস্পরের সম্মুখীন হল, তখন সে সরে পড়লো ও বললো, তোমাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক রইলো না, তোমায়া যা দেখতে পাও না। আমি তা দেখি। আমি আল্লাহকে ভয় করি। আর আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর। (৮ : :৭-৪৮)। অভিশপ্ত শয়তান কুরায়শদের ধোঁকা দিয়ে যুদ্ধ অভিযানে রওনা করিয়ে দিল এবং সেও তাদের সাথী হলো। একে একে মনযিল অতিক্রম করে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলো। এই বাহিনীর অনেকেই বলেছে, সুরাকার সাথে দলবল ও ঝাণ্ডা ছিল। এ ভাবে শয়তান তাদেরকে রণাঙ্গন পর্যন্ত পৌছিয়ে দিল। পরে যখন সে যুদ্ধের তীব্ৰতা লক্ষ্য করলো এবং মুসলমানদের সাহায্যার্থে ফেরেশতাদের অবতরণ করতে দেখলো ও জিবরাঈলকে প্রত্যক্ষ করলো, তখন সে এই কথা বলে পেছনে ধাবিত হলো যে, আমি যা দেখছি তোমরা তা দেখতে পোচ্ছ না। আমি আল্লাহকে ভয় করি।” এ ধরনের কথা আল্লাহ অন্যত্রও বলেছেন। যথা :

کمثل الشیطان اذ قال للانسان ا گفر فلما کفر قال انی بری، مذ ثانی

أخاف الله رب العلمين. “এদের তুলনা শয়তান— যে মানুষকে বলে ‘কুফরী কর’। এরপর যখন সে কুফরী করে

শয়তান তখন বলে তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।” (৫৯ : ১৬)।

আল্লাহ আরও বলেন, :

وقال جاء الحق وزهق الباطل ان الباطل كان زهو قاএবং বল, সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, মিথ্যা তো বিলুপ্ত হবারই (১৭ : ৮১) { তাই অভিশপ্ত ইবলীস ঐ দিন মুসলমানদের জন্যে সাহায্যকারী ফেরেশতাদের দেখতে পেয়ে পালিয়ে যায়। সে হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রথম পলায়নকারী। অথচ সেই ছিল তাদের সাহস

দানকারী তাদের সহযাত্রী। সে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয়, ওয়াদা দেয় ও উপকার করার কথা বলে। কিন্তু শয়তানের ওয়াদা প্রতারণা ব্যতীত আর কিছুই নয়।

ইউনুস (র) ইবন ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, কুরায়শরা ছোট-বড় মিলে মোট নয় শ’ পঞ্চাশজন যোদ্ধা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের সাথে ছিল দু’শ” ঘোড়া ১ এবং কয়েকজন গায়িকা ॥২ যারা দফা বাজিয়ে গান গাইত এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসামূলক কবিতা আবৃত্তি করতো। এই অভিযানে যে সব কুরায়শ এক এক দিন করে সকল সৈন্যের খাদ্য সরবরাহ করে, ইবন ইসহাক তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। উমাবী বলেন, মক্কা থেকে বের হওয়ার পর সর্বপ্রথম আবু জাহল (মিনায়) দশটি উটি যাবাহ করে। এরপর উসফান নামক স্থানে পৌঁছলে উমাইয়া ইবন খালফ সৈন্যদের জন্যে নয়টি উটি যাবাহ করে। কুদায়দে পৌঁছলে সুহায়ল ইবন আমরা তাদের জন্যে দশটি উটি যাবাহ করে। কুদায়দ থেকে তারা পথ পরিবর্তন করে লোহিত সাগরের দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে তারা একদিন অবস্থান করে। এ সময় শায়াবা ইবন রাবীআ নয়টি উটি যাবাহ করে সকলকে আপ্যায়িত করে। এরপর তারা জুহফায় পৌঁছে। সেখানে উতবা ইবন রাবীআ দশটি উটি যাবাহ করে। এরপর তারা আবওয়া পর্যন্ত পৌঁছে। সেখানে হাজাজের দুই পুত্ৰ নাবীহ ও মুনাববিহ দশটি উটি যাবাহ করে। আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবও যোদ্ধাদের দশটি উটি যাবাহ করে তাদেরকে আপ্যায়িত করেন। তাছাড়া হারিছ ইবন নাওফিল দশটি উটি যাবাহ করে। বদর কুয়োর সন্নিকটে আবুল বুখতারী দশটি উটি যাবাহ করে। এরপর থেকে তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ খরচে পানাহার করে। উমাবী বলেন, আমার নিকট আমার পিতা বর্ণনা করেন যে, আবু বকর হুযালী বলেছেন, বদর যুদ্ধে মুশরিকদের কাছে ছিল ষাটটি ঘোড়া ও ছয়শ’ বর্ম। অপরদিকে রাসূলুল্লাহর সাথে ছিল দুটি ঘোড়া ও ষাটটি বর্ম।

এতক্ষণ যাবত কুরায়শ বাহিনীর মক্কা ত্যাগ ও বদর যুদ্ধে গমন সম্পর্কে আলোচনা করা হল। অপরদিকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অভিযান সম্পর্কে ইবন ইসহাক বলেন, : রমযান মাসের কয়েক দিন অতিবহিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা) তার সাহাবাগণকে সাথে নিয়ে অভিযানে বের হন। ইবন উম্মে মাকতুমকে তিনি লোকদের নামায্যের ইমামতীর দায়িত্ব প্ৰদান করেন। এরপর রাওহা থেকে আবু লুবাবাকে মদীনার শাসক নিযুক্ত করে ফেরত পাঠান। মুসআব ইবন উমায়রের হাতে যুদ্ধের পতাকা অৰ্পণ করেন। এ পতাকা ছিল সাদা রঙের। রাসূলুল্লাহর সম্মুখে ছিল দু’টি কাল পতাকা। এর একটি ছিল আলী ইবন আবু তালিবের হাতে। এ পতাকার নাম ছিল উকাব (ঈগল)। আর অন্যটি ছিল জনৈক আনসার সাহাবীর হাতে। ইবন হিশাম বলেন,

পতাকা ছিল হুবাব ইবন মুনযিরের হাতে। ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর সেনাদলের পশ্চাৎ ভাগের দায়িত্ব বনু মাযিন। ইবন নাজ্জারের কায়স ইবন আবু সা’সাআকে প্রদান করেন। উমাবী বলেন, মুসলিম বাহিনীতে দু’টি মাত্র ঘোড়া ছিল। তার একটির আরোহী ছিলেন। মুসআব ইবন উমায়ার এবং অপরটিতে আরোহণ করেছিলেন যুবােয়র ইবন আওআম (রা)। সেনাবাহিনীর দক্ষিণ বাহুর (মায়মানা) নেতৃত্বে ছিলেন সাআদ ইবন খায়৷ছামা এবং বাম বাহুর (মায়সারা) নেতৃত্বে ছিলেন মিকদাদ ইবন আসওয়াদ (রা)।

১. ওয়াকিদীর মতে একশ’ অশ্ব। ২। ওয়াকিদী বলেন, গায়িকারা হলো সারা— আমর ইবন হাশিম ইবন মুত্তালিবের দাসী; উযযা— আসওয়াদ

ইবন মুত্তালিবের দাসী; তৃতীয় জন উমাইয়া ইবন খালফের দাসী।

ইমাম আহমদ আবু ইসহাক সূত্রে. আলী থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধে মিকদাদ ব্যতীত আমাদের মধ্যে আর কোন অশ্বারোহী ছিল না। বায়হাকী ইবন ওয়াহাবের সূত্ৰে….. ইবন আব্বাস থেকে বর্ণিত। হযরত আলী তাকে বলেছেন, বদর যুদ্ধে আমাদের বহিনীতে মাত্র দু’টি ঘোড়া ছিল। এর একটি ছিল যুবায়রের এবং অপরটি ছিল মিকদাদ ইবন। আসওয়াদের। উমাবী… তায়মী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বাহিনীতে দু’জন অশ্বারোহী ছিলেন। একজন হলেন যুবােয়র ইবন আওয়াম। তিনি ছিলেন দক্ষিণ বাহুতে। আর অপরজন মিকদাদ ইবন আসওয়াদ। তিনি ছিলেন বাম বাহুতে।

আরোহণ করতেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা), আলী ও মারছাদ ইবন আবুল মারছাদ পালাক্রমে একটি উটে আরোহণ করতেন। হামযা, যােয়দ ইবন হারিছা, আবু কাবশা ও আনাসা আর একটিতে পালাক্রমে আরোহণ করতেন। শেষোক্ত তিন জন ছিলেন রাসূলের মুক্তদাস। এ হচ্ছে ইবন ইসহাকের বর্ণনা। কিন্তু ইমাম আহমদ… ইবন মাসউদ থেকে ভিন্ন ভাবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন বদর যুদ্ধে আমরা প্রতি তিনজনে একটি করে উটে আরোহণ করি। আবু লুবাবা ও আলী ছিলেন, রাসূলের সহযাত্রী। যখন রাসূলের ভাগের উট টানার পালা আসলো, তখন তারা উভয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার পালা আমাদেরকে দিন— আমরা হেঁটে যাচ্ছি। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তোমরা দু’জন আমার থেকে অধিক শক্তিশালী নও এবং সওয়াব ও পুরস্কার লাভের আগ্রহ তোমাদের চেয়ে আমার কম নয়। L1 ১ ও ০–এ–ঐL, L_n ,,! —) با غنی عن الاجرا منکما)

ইমাম নাসাঈ এ হাদীছ… হাসান ইবন সালামা সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। লেখক বলেন, সম্ভবত আবু লুবাবাকে রাওহা থেকে ফেরত পাঠান পর্যন্ত তিনি রাসূলের সহ-আরোহী ছিলেন। আবু লুবাবা চলে যাওয়ার পর তাঁর সহ-আরোহী হন আলী এবং আবু লুবাবার পরিবর্তে মারছাদ। ইমাম আহমদ… আইশা থেকে বর্ণনা করেন, বদর অভিযানে আজরাসে পৌঁছে রাসূল (সা) উটের কাধের কিছু অংশ চিরে দিতে বলেন। বুখারী ও মুসলিমের শর্তে হাদীছটি বর্ণিত। নাসাঈ… কাতাদা থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেন। হাফিয মিযয়ী সাঈদ ইবন বিশার ও হিশাম। আবু হুরায়রা থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেন। ইমাম বুখারী বলেন, ইয়াহইয়া ইবন বুকায়ার… আবদুল্লাহ ইবন কাআব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি কাআব ইবন মালিককে বলতে শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) যে সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, সেগুলোর মধ্যে তাবৃক অভিযান ব্যতীত অন্য কোন যুদ্ধ থেকে আমি পিছিয়ে থাকিনি। তবে বদর যুদ্ধেও আমি অংশগ্রহণ করিনি। কিন্তু বদর যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেনি, তাদের কাউকেই আল্লাহ তিরস্কার করেননি। কারণ, প্রকৃত পক্ষে রাসূলুল্লাহ্ (সা) কুরায়শ কাফিলাকে ধরার উদ্দেশ্যেই কেবল বের হয়েছিলেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে আল্লাহ মুসলমানদেরকে তাদের শত্রুর মুকাবিলায় এনে দেন।

ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনা থেকে মক্কার পথে উঠে মদীনার বাইরের গিরিপথ দিয়ে অগ্রসর হতে লাগলেন এবং পর্যায়ক্রমে আকীক, যুল-হুলায়ফা, উলাতুল জায়শ, তুরবান, মালাল, গামীসুল-হুমাম, সাখীরাতুল-ইয়ামামা, সায়ালা হয়ে ফাজজুর রাওহাতে

পৌঁছেন। সেখান থেকে তিনি শানুকার সমতল পথ ধরে চলতে লাগলেন। তিনি যখন আরকুয যাবিয়া নামক স্থানে পৌঁছেন, তখন এক বেদুঈনের সাথে তার সাক্ষাত হয়। মুসলিম সৈন্যরা তার নিকট কুরায়শদের খোঁজখবর জিজ্ঞেস করে। কিন্তু তার থেকে তারা কোনই তথ্য জানতে পারলো না। রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সালাম করার জন্যে তারা বেদুঈনকে পরামর্শ দেয়। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের মাঝে কি আল্লাহর রাসূল (সা) উপস্থিত আছেন? তারা বললেন : হ্যা আছেন। এরপর সে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সালাম করে বললো, আপনি যদি রাসূল হয়ে থাকেন, তা হলে বলুন দেখি, আমার এই উটনীটির গর্ভে কী আছে? তখন সালামা ইবন সুলামা ইবন ওয়াককাশ তাকে বললেন, রাসূলুল্লাহর নিকট এই কথা জিজ্ঞেস করো না। আমার কাছে এসো, আমি তোমাকে এ ব্যাপারে বলে দেবো। তুমি এই উটনীর সাথে সংগম করেছ এবং তার ফলে এর গর্ভে এখন তোমার ঔরসের একটি উটের বাচ্চা আছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সালামাকে বললেন, চুপ থাক, এ লোকটিকে তুমি অশ্লীল কথা বলেছে। এই বলে তিনি সালামা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) রাওহার সাজাজ নামক কুপের কাছে গিয়ে অবতরণ করেন। এখানে কিছু সময় কাটাবার পর আবার যাত্রা শুরু করেন। একটা মোড়ের নিকট পৌছে মক্কার পথ বামে রেখে ডান দিকে নাযিয়ার উপর দিয়ে বদর অভিমুখে তারা চলতে থাকেন। মক্কার নিকটবতী এসে রাহকান নামক একটি উপত্যকা তিনি আড়াআড়িভাবে অতিক্রম করেন। এই উপত্যকাটি নাযিয়া ও সাফরা গিরিপথের মাঝখানে অবস্থিত। এরপর তিনি আরও একটি সংকটময় গিরিপথ অতিক্রম করে সাফরায় পীেছলেন। সেখান থেকে আবু সুফিয়ান সাখর ইবন হারব ও অন্যদের সংবাদ সংগ্রহের জন্যে বাস্বাস ইবন আমরা জুহানী (বনু সাইদার মিত্র) ও আদী ইবন আবুয-যাগবী (বনু নাজারের মিত্র)-কে বদর এলাকায় পাঠান। কিন্তু মূসা ইবন উকবা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) মদীনা থেকে যাত্রা করার পূর্বেই এ দু’জনকে পাঠিয়েছিলেন। তারা ফিরে এসে জানালেন যে, কুরায়শরা তাদের বাণিজ্য কাফেলাকে রক্ষা করার জন্যে মক্কা থেকে যাত্রা শুরু করেছে। মূসা ইবন উকবা এবং ইবন ইসহাক উভয়ের বর্ণনা যদি সঠিক হয় তবে ধরে নিতে হবে সে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদেরকে দু’বার পেরণ করেছিলেন।

ইবন ইসহাক বলেন, ঐ দু’জনকে পাঠিয়ে দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) রওনা হন। দু’টি পর্বতের মাঝখানে অবস্থিত সাফুরা নামক জনপদে উপনীত হয়ে তিনি ঐ দু’টি পাহাড়ের নাম জানতে চান। তাকে জানান হলো যে, একটির নাম মুসলিহ এবং অপরটির নাম মুখারী। এরপর তিনি পাহাড় দু’টির অধিবাসীদের পরিচয় জানতে চান। তাকে জানান হলো, এরা হচ্ছে গিফার গোত্রের দু’টি শাখা— বনু নারী ও বনু হারাক। এ নাম দু’টি শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং নাম দু’টিকে অশুভ মনে করে তার মাঝখান দিয়ে অতিক্রম করা শুভ মনে করলেন না। তাই তিনি ঐ দু’টি পাহাড় ও সাফরা জনপদ বামে রেখে ডান দিকে যাফরান নামক উপত্যকা আড়াআড়িভাবে পাড়ি দিয়ে যাত্রা বিরতি করেন। এখানে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (সা) সংবাদ পেলেন যে, কুরায়শরা তাদের বাণিজ্য কাফেলা রক্ষার্থে প্ৰস্তৃতি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। তিনি তার সাথিগণকে এ বিষয়ে অবহিত করেন এবং এখন কী করা উচিত সে সম্পর্কে তাদের থেকে পরামর্শ আহবান করেন। আবু বকর সিদীক (রা) উঠে চমৎকার ভাবে নিজের মতামত

ব্যক্ত করেন। এরপর উমর ইবন খাত্তাব (রা) দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠভাবে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন। এরপর মিকদাদ ইবন আমার দণ্ডায়মান হন। তিনি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আল্লাহ। আপনাকে যা করতে নির্দেশ দেন। আপনি তাই করুন, আমরা আপনার সংগে আছি। আল্লাহর কসম, আমরা আপনাকে সে কথা বলবো না, যে কথা বনী ইসরাঈলরা মূসা (আ:)-কে বলেছিল। তারা বলেছিল : আপনি ও আপনার প্রতিপালক যুদ্ধ করুন গে, আমরা এখানে বসে থাকলাম। কিন্তু আমরা বলছি : আপনি ও আপনার প্রতিপালক যুদ্ধে যান, আমরাও আপনাদের সাথে থেকে যুদ্ধ করবো। সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য দীন দিয়ে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদেরকে নিয়ে সুদূর বারকুল গিমাদেও যেতে চান, তবে আমরা আপনার সংগী হয়ে সেখান পর্যন্ত পৌঁছবো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) মিকদ্দাদের প্রশংসা করলেন এবং তার মংগলের জন্যে দু’আ

করলেন।

এরপর তিনি উপস্থিত লোকদের কাছ থেকে পুনরায় পরামর্শ আহবান করলেন। তিনি মনে মনে চাচ্ছিলেন যে, আনসারদের মধ্য হতে কেউ কিছু বলুক। এর কারণ হলো, আনসারদের বড় একটা সংখ্যা সেখানে উপস্থিত ছিল। কিন্তু আকাবা গিরিগুহায় যখন তাঁরা রাসূলের নিকট বায়আতি গ্রহণ করেছিলেন, তখন তারা বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাদের আবাসভূমিতে না পৌছা পর্যন্ত আমরা আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে না। যখন আপনি আমাদের মাঝে চলে আসবেন, তখন থেকে আপনি আমাদের দায়িত্বে থাকবেন। আমরা আপনাকে বিপদ-আপদ ও শত্রু থেকে সেইরূপ রক্ষা করবো। যেমনটি আমাদের সন্তানাদি ও পরিবার-পরিজনকে করে থাকি। এ জন্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আশংকা করছিলেন যে, আনসারগণ এ কথা ভাবতে পারেন যে, মদীনায় তিনি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে তখনই তাদের উপর তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব বর্তায়। কিন্তু তিনি মদীনার বাইরে কোন শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করলে সেই অভিযানে শরীক হওয়া তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তাই রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন পরামর্শ চান, তখন সাআদ ইবন মুআয উঠে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আপনি সম্ভবত আমাদের (আনসারদের) দিকে ইঙ্গিত করছেন। তিনি বললেন, হ্যা। সাআদ বললেন, “আমরা আপনার উপর ঈমান এনেছি। আপনার দাওয়াতকে সত্য বলে গ্রহণ করেছি। আপনি যে বিধি-বিধান নিয়ে এসেছেন তার সত্যতার উপর সাক্ষ্য দিয়েছি এবং এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে আপনার নিকট অংগীকার করেছি ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছি যে, আপনার কথা শানুবো ও আপনার আনুগত্য করবো। সুতরাং ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যা সংকল্প করেছেন তাই করুন!! আমরা আপনার ংগে আছি। সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদেরকে নিয়ে সমুদ্রে যান এবং তাতে ঝাপ দেন, তবে আমরাও তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একটি লোকও এ ব্যাপারে পিিছয়ে থাকবে না। আপনি যদি আমাদেরকে নিয়ে আগামীকাল শত্রুর মুকাবিলা করতে চান, তবে তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। যুদ্ধে আমরা ধৈর্যশীল এবং শত্রুর মুকাবিলায় অটল থাকবো। হতে পারে। আল্লাহ আমাদের দ্বারা এমন বীরত্ব দেখাবেন, যা দেখে আপনার চোখ জুড়াবে। সুতরাং আল্লাহর উপর ভরসা করে আপনি সামনে অগ্রসর হোন।” সাআদ-এর এ বক্তব্য শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং উৎসাহিত বোধ করলেন। এরপর সবাইকে নির্দেশ দিয়ে বললেন, “তোমরা সম্মুখে অগ্রসর

হও এবং সুসংবাদ গ্রহণ করা। কেননা, আল্লাহ আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, দু’দলের একদল আমাদের করায়ত্ত হবে।” আল্লাহর কসম, শক্ৰদের মধ্যে যারা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হবে, তাদের সেই স্থানগুলো যেন আমি এখনই দেখতে পাচ্ছি।

ইবন ইসহাকের এই বর্ণনার সমর্থনে আরও অনেকের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেগুলোর মধ্যে ইমাম বুখারী আবু নুআয়মের সূত্ৰে… ইবন মাসউদ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, : আমি মিকদাদ ইবন আসওয়াদের দ্বারা এমন একটি দৃশ্য সংঘটিত হতে দেখেছি, তা যদি আমার দ্বারা সংঘটিত হত, তবে দুনিয়ার সকল সম্পদের চাইতে ওটাই আমার কাছে অধিকতর প্রিয় হতো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে আহবান করেন, তখন মিকদাদ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর কাছে এসে বললেন, আমরা আপনাকে সে রকম কথা বলবো না, যে রকম মূসা (আ:)-এর সম্প্রদায় মূসা (আ:)-কে বলেছিল। তারা বলেছিল তুমি ও তোমার প্রতিপালক যেয়ে মুদ্ধ কর, আমরা এখানে বসে থাকলাম। বরং আমরা আপনার ডানে, বামে, সম্মুখে ও পশ্চাতে থেকে যুদ্ধ করবো। ইবন মাসউদ বলেন, আমি দেখলাম, মিকদ্দাদের এ কথায় রাসূলুল্লাহর চেহারা হাস্যোজুল হয়ে উঠেছে এবং তিনি অত্যন্ত খুশী হয়েছেন।

বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে এককভাবে কয়েক স্থানে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন, যা মুসলিমে নেই। ইমাম নাসাঈও এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তবে তার বর্ণনায় এই কথাটা বাড়তি আছে যে, বদর যুদ্ধে মিকদাদ ইবন আসওয়াদ ঘোড়ায় চড়ে আসেন এবং অনুরূপ ভাষণ দেন। ইমাম আহমদ উবায়দা… আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) বদর প্রান্তরে যাওয়া সম্পর্কে সাখী-সংগীদের থেকে পরামর্শ আহবান করেন। আবু বকর (রা) তাঁর পরামর্শ ব্যক্তি করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) পুনরায় পরামর্শ আহবান করেন। উমর (রা) উঠে তার পরামর্শ ব্যক্তি করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীগণের নিকট আবারও পরামর্শ চান। তখন একজন আনসার সাহাবী দাঁড়িয়ে বলেন, হে আনসার ভাইয়েরা! রাসূলুল্লাহ (সা) আপনাদের মতামত বিশেষ করে জানতে চাচ্ছেন। তখন জনৈক আনসার সাহাবী উঠে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনাকে সেরূপ কথা বলবো না যেরূপ বলেছিল বনী ইসরাঈল তাদের নবী মূসা (আ:)-কে। তারা বলেছিল, তুমি ও তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর, আমরা এখানে বসে থাকলাম। কিন্তু আমরা ঐ সত্তার কসম করে বলছি, যিনি আপনাকে সত্য বিধান দিয়ে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে দুৰ্গম বারকুল গিমাদে যেতে চান, তবে আমরা অবশ্যই আপনার সাথে থাকবো। এ হাদীছটি ছলাহী বা তিনজন রাবীর মাধ্যমে বর্ণিত এবং সহীহর শর্ত অনুযায়ী বিশুদ্ধ। ইমাম আহমদ আফফান সূত্রে আনাস ইবন মালিক থেকে আরও বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীদের নিকট থেকে পরামর্শ তখনই আহবান করেন যখন আবু সুফিয়ানের আগমনের সংবাদ তাঁর কাছে এসে পৌছে। তখন আবু বকর (রা) পরামর্শ দিলে তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন। এরপর উমর (রা) আলোচনা করলেন। কিন্তু এবারও তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এবার সাআদ ইবন উবাদা (আনসারী) উঠে বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের (আনসারদের)-ই মতামত জানতে চাচ্ছেন। সেই আল্লাহর কসম, যার হাতের মুঠোয় আমার জীবন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি যদি আমাদেরকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন, তবে

আমরা অবশ্যই তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বো। যদি আমাদেরকে বারকুল গিমাদের দিকে সওয়ারী হাঁকাতে আদেশ দেন, তবে আমরা নিদ্বিধায় তাই করবো। এ কথার পর রাসূলুল্লাহ (সা) লোকজনকে অভিযানে বেরিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। মুসলিম সেনারা তখন যাত্রা করে বদর প্ৰান্তরে উপনীত হয়।

মুসলিম বাহিনী যেখানে অবতরণ করেছিল। সেখানে কুরায়শদের কয়েকটি উট এসে হাযির হয়। এই উট পালের মধ্যে বনু হাজজজের এক কৃষ্ণকায় গোলামও ছিল। মুসলমানরা তাকে ধরে এনে আবু সুফিয়ান ও তার কাফেলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকেন। সে বারবার বলছিল যে, আবু সুফিয়ানের কোন সংবাদ আমি জানি না। তবে আৰু জাহল ইবন হিশাম, উতবা ইবন রাবীআ এবং উমাইয়া ইবন খালফ এই কাছেই আছে। গোলামটি এই কথা বললে মুসলমানরা তাকে প্রহার করলেন। মার খেয়ে সে বললো, হ্যা, আবু সৃফিয়ানের সংবাদ বলছি সে নিকটেই আছে। এরপর তাকে ছেড়ে দিয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে বললো, আবু সুফিয়ানের কোন সংবাদ আমার জানা নেই, তবে আবু জাহল, উত্তবা, শায়াবা ও উমাইয়া কাছেই অবস্থান করছে। সে যখন দ্বিতীয়বার এই কথা বললো, তখন সাহাবীগণ তাকে আবার প্রহার করা শুরু করলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) সালাত আদায় করছিলেন। তা লক্ষ্য করে তিনি সালাত শেষ করে বললেন, যে আল্লাহর হাতে আমার জীবন তার কসম, সে যখন সত্য কথা বলছিল তোমরা তখন তাকে প্রহার করছিলে। আর যখন সে মিথ্যা বললো, তখন ছেড়ে দিলে। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) মাটির উপর হাত রেখে চিহ্নিত করে দেখাচ্ছিলেন যে, কাফিরদের মধ্যে এখানে অমুক এখানে অমুক নিহত হবে। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চিহ্নিত স্থানগুলো তাদের মধ্যে কেউই অতিক্রম করেনি। (যার জন্যে যেই স্থান চিহ্নিত করেছিলেন, সে সেই স্থানেই নিহত হয়েছে।)

ইমাম মুসলিম আবু বকর সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইবন আবু হাতিম তার তাফসীর গ্রন্থে এবং ইবন মারদাবিয়াহ তার হাদীছ গ্রন্থে আবদুল্লাহ ইবন লুহায়য়া সূত্রে. আবু আইয়ুব আনসারী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমরা মদীনায় অবস্থান করছিলাম। একদা রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, : আমি সংবাদ পেয়েছি, আবু সুফিয়ান তাঁর বাণিজ্য কাফেলাসহ মাককা অভিমুখে রওনা হয়েছে, এখন তোমরা কি ভাল মনে কর না যে, আমরা ঐ বাণিজ্য কাফেলার উপর হামলা করি? হয়তো আল্লাহ এই কাফেলাকে আমাদেরকে গনীমত হিসেবে দান করবেন? আমরা বললাম, হ্যা, আমরা তা চাই। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বের হলেন, আমরাও বের হলাম। এক দিন বা দুই দিন পথ চলার পর তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, : তোমরা যে মদীনা থেকে বেরিয়ে এসেছ এ সংবাদ কুরায়শরা জেনে গেছে। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার বিষয়ে তোমাদের মত কি? আমরা বললাম, এ ব্যাপারে আমাদের মত নেতিবাচক। আল্লাহর কসম, ওদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সামর্থ আমাদের নেই। আমরা তো বাণিজ্য কাফেলার উদ্দেশ্যে এসেছি। তিনি পুনরায় বললেন, কুরায়শ সশস্ত্র বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার ব্যাপারে তোমাদের অভিমত কী? আমরা আগের মতই উত্তর দিলাম। এ সময় মিকদাদ ইবন আমার উঠে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনাকে সে কথা বলবাে না।

যেমনটি মূসা (আ:)-কে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা বলেছিল— আপনি ও আপনার প্রভু গিয়ে যুদ্ধ করুন, আমরা এখানে অবস্থান করি। রাবী বলেন, আমরা আনসাররা আফসোস করলাম যে, মিকদ্দাদের মত আমরাও যদি বলতে পারতাম, তা হলে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হওয়া অপেক্ষা নিজেকে বেশী। ধন্য মনে করতাম। এই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ নিম্নের আয়াতটি তার রাসূলের উপর নাযিল করেন :

كما أخرجك ربك من بيتك بالحق وان فريقا من المؤمنين لكارهون.

“যেমন তোমার প্রতিপালক তোমাকে যথার্থভাবে তোমার গৃহ হতে বের করেছিলেন। অথচ বিশ্বাসীদের একদল এটা পসন্দ করেনি।” এরপর তিনি পূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করেন। ইবন মারদাবিয়াহ মুহাম্মাদ ইবন আমর ইবন আলকামা ইবন ওয়াককাস আল-লায়হী সূত্রে তাঁর পিতা ও দাদার বরাতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বদরের দিকে যাত্রা করে রাওহা নামক স্থানে পৌছে সহযাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, : তোমরা কী মনে করা? আবু বকর (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা:)! শুনেছি তাদের সৈন্য ও অস্ত্র অনেক বেশী। রাসূলুল্লাহ (সা) পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মতামত কি? এবার উমর (রা) উঠে আবু বকর (রা)-এর অনুরূপ মত ব্যক্ত করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) আবারও একই কথা জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের পরামর্শ কী? এবার সাআদ ইবন মুআয (রা) দাঁড়িয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি সম্ভবত আমাদের আনসারদের মতামত জানতে চাচ্ছেন। আল্লাহর কসম, যিনি আপনাকে সম্মানিত করেছেন এবং আপনার উপর কুরআন নাযিল করেছেন, আমরা এ পথে কিছুতেই আসতাম না, এ সম্পর্কে আমাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। আপনি যদি সফর করতে করতে ইয়ামানের বারকুল গিমাদ পর্যন্ত যান, তবে আমরাও অবশ্যই আপনার সফর-সংগী হবো। আমরা তাদের মত হবো না। যারা মূসা (আ:)-কে বলেছিল, তুমি ও তোমার রব যাও ও যুদ্ধ করা। আমরা এখানে থাকলাম। বরং আমরা বরছি, আপনি ও আপনার রব যান ও যুদ্ধ করুন, আমরা আপনাদের সাথে আছি।

اذهب أنت وربك فقاتلا ………… آن معگم متبغون

আপনি হয়তো এক উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন; কিন্তু আল্লাহ অন্য পরিস্থিতির সম্মুখীন করে দিয়েছেন। সুতরাং আল্লাহ যে পরিস্থিতি এনে দিয়েছেন সেটিকে গ্ৰহণ করুন, সেই দিকে অগ্রসর হোন। আপনি যাকে চান তাকে সংযুক্ত রাখুন। যাকে চান বিযুক্ত করে দিন! আপনি যার সঙ্গে ইচ্ছা শক্রিতা করুন, যার সঙ্গে ইচ্ছা মিত্ৰতা করুন এবং আমাদের সম্পদ থেকে যে পরিমাণ ইচ্ছা! তা গ্রহণ করুন!” সাআদের বক্তব্যের পর কুরআনের এ আয়াত নাযিল হয় : “যেমন তোমার প্রতিপালক তোমাকে যথার্থভাবে তোমার গৃহ হতে বের করেছিলেন। অথচ বিশ্বাসীদের একদল এটা পসন্দ করেনি।” উমাবী তার মাগাষী গ্রন্থে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং এই কথাটা অতিরিক্ত উল্লেখ করেছেন যে, আপনি আমাদের সম্পদ থেকে যেটুকু ইচ্ছা গ্রহণ করুন, যেটুকু ইচ্ছা আমাদের জন্যে রেখে দিন! তবে যে অংশ গ্ৰহণ করবেন তা রেখে দেয়া অংশ থেকে

Ms N

আমাদের নিকট অধিকতর পসন্দনীয় হবে। আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন, সে বিষয়ে আমাদের হুকুম করুন, আমরা আপনার হুকুম মত চলবো। আল্লাহর কসম, আপনি যদি অগ্রসর হতে হতে বারকুল গিমাদ পর্যন্ত চলে যান, তবে আমরা অবশ্যই আপনার সাথে থাকবাে।”

ইবন ইসহাক বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) যাফিরান থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং আসাফির পাহাড়ের উচু পথ বেয়ে অগ্রসর হন। এরপর বিরাট পাহাড়ের মত উচু হান্নান নামক এক বালুর বিরাট ঢিবি ডানে রেখে পাহাড়ী পথ থেকে নেমে দিয়্যা (বা দাব্বিা) নামক এক জনপদে পৌছেন। সেখান থেকে বদরের কাছাকাছি এক স্থানে যাত্রা বিরতি করেন। এরপর তিনি জনৈক সাহাবীকে নিয়ে ইবন হিশামের মতে আবু বকর (রা)-কে নিয়ে উটে চড়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে বাইরে যান। কিছু দূর অগ্রসর হলে এক বৃদ্ধ বেদুঈনের সাথে তাঁর দেখা হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বৃদ্ধের নিকট জিজ্ঞেস করেন : তুমি কুরায়শ বাহিনী এবং মুহাম্মদ ও তাঁর সাহাবীদের অভিযান সম্পর্কে কোন সংবাদ জােন কি? বৃদ্ধটি বললো, তোমাদের পরিচয় না দেয়া পর্যন্ত আমি কোন সংবাদ জানাবো না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, : তুমি আগে সংবাদ জানালে আমাদের পরিচয়ও দেবাে। বৃদ্ধ বললো, তা হলে কি সংবাদের বিনিময়ে পরিচয়? তিনি বললেন, হ্যা। বৃদ্ধ বললো, আমি শুনেছি। মুহাম্মদ ও তাঁর সাহাবীরা অমুক দিন রওনা হয়েছেন। এ কথা যদি সত্য হয়, তবে আজ তারা অমুক জায়গায় থাকবেন। বৃদ্ধটি ঐ জায়গার নাম উল্লেখ করেন যে জায়গায় রাসূলুল্লাহর বাহিনী অবস্থান করছিল। বৃদ্ধটি বললো, আমি আরও শুনেছি যে, কুরায়শরা অমুক দিন যাত্রা শুরু করেছেন। আমার এ প্রাপ্ত সংবাদ যদি সত্য হয়, তবে আজ তারা অমুক স্থানে আছে। বৃদ্ধটি ঐ স্থানের প্রতি ইঙ্গিত করেন যে স্থানটিতে তখন কুরায়শরা অবস্থান করছিল। বৃদ্ধ তার কথা শেষ করে জিজ্ঞেস করলো। এবার বলুন, আপনারা দু’জন কোন গোত্র থেকে এসেছেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আমরা পানি থেকে এসেছি। এ কথা বলে তিনি সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। বৃদ্ধটি মনে মনে ভাবতে লাগলো কোন পানি থেকে? ইরাকের পানি থেকে নয়তো? ইবন হিশাম লিখেছেন, এই বৃদ্ধের নাম সুফিয়ান যিমাৱী।

ইবন ইসহাক বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর সাহাবীগণের নিকট ফিরে যান। সন্ধ্যার পর তিনি আলী ইবন আবু তালিব, যুবােয়র ইবন আওআম এবং সাআদ ইবন আবু ওয়াককাস (রা)-কে একদল সাহাবীসহ খবর সংগ্রহের জন্যে বদর কূপের দিকে পাঠিয়ে দেন। ইয়াষীদ ইবন রূমান (র) উরওয়া ইবন যুবােয়র থেকে এ কথা আমার নিকট বর্ণনা করেছেন। তারা সেখানে গিয়ে কুরায়শদের পানি সরবরাহকারী একটি উটের পাল দেখতে পান। ঐ পালের মধ্যে বনু হাজ্জাজের গোলাম আসলাম ও বনু আস ইবন সাআদ-এর গোলাম আরয আবু ইয়াসারও ছিল। তাঁরা লোক দু’জনকে শিবিরে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন সালাতে রত ছিলেন। সাহাবীগণের জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে তারা বললো, আমরা কুরায়শদের পানি সরবরাহের কাজে নিয়োজিত। এখান থেকে পানি নেয়ার জন্যে তারা

v–sv. w 1 * I–N A v VV WAY

আমাদেরকে পাঠিয়েছে। সাহাবীগণ তাদের এ পরিচয়ে সন্তুষ্ট হলেন না। তাদের ধারণা ছিল যে, এরা আবু সুফিয়ানের লোক হবে। তাই তারা তাদেরকে প্রহার করতে শুরু করলেন। তখন তারা বললো, আমরা আবু সুফিয়ানের লোক। এ কথা বলার পর মুসলমানরা তাদেরকে প্রহার করা বন্ধ করে দিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) রুক্‌-সােজদা করে ও সালাম ফিরিয়ে বললেন, : এরা যখন সত্য কথা বলছিল তোমরা তখন তাদেরকে প্রহার করছিলো। আর যখন তারা মিথ্যা কথা বললো, তখন তাদেরকে ছেড়ে দিলে। আল্লাহর কসম, ওরা কুরায়শদেরই লোক।

এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) ঐ দু’জনকে বললেন, কুরায়শদের অবস্থান সম্পর্কে আমাকে অবহিত কর। তারা বললো, আল্লাহর কসম, ঐ যে দূর প্রান্তে মাটির ঢিবি দেখা যায়, ওটার আড়ালেই কুরায়শদের অবস্থান। আর ঐ টিবির নাম হচ্ছে আজানকাল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, তাদের সংখ্যা কত হবে? তারা বললো, অনেক। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ওদের সমরপ্রস্তুতি কেমন? তারা বললো, জানি না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তারা দৈনিক কতটি উট যাবাহ করে? তারা বললো, কোন দিন নয়টি কোন দিন দশটি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তাদের সংখ্যা নয়শী’ থেকে হাযারের মধ্যে। তারপর তিনি জানতে চাইলেন, কুরায়শ নেতাদের মধ্যে কে কে রয়েছে? তারা জানাল, উতবা ইবন রাবীআ, শায়বা ইবন রাবী আ, আবুল বুখতারী ইবন হিশাম, হাকীম ইবন হিশাম, নাওফিল ইবন খুওয়ায়ালিদ, হারিছ ইবন আমির ইবন নাওফিল, তুআয়মা ইবন আদী ইবন নাওফিল, নযর ইবন হারিছ, যামআ ইবন আসওয়াদ, আবু

ইবন আমার এবং আমর ইবন আবদূন্দ। তা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীগণকে লক্ষ্য করে বললেনঃ মক্কা তার কলিজার টুকরাগুলো তোমাদের দিকে উগলে দিয়েছে।

ইবন ইসহাক বলেন, বাসবাস ইবন আমার ও আদী ইবন আবুয যাগবী ইতোপূর্বে টহল দিতে দিতে বদর পর্যন্ত চলে আসে। সেখানে তারা একটি পানির কুপের কাছে অবস্থিত টিলার নিকটে উট থামিয়ে নীচে অবতরণ করে এবং একটি মিশকে পানি ভর্তি করে নেয়। ঐ পানির কাছেই ছিল মাজদী ইবন আমরা জুহানী।

আদী ও বাস্বাস সেখানে দু’জন স্থানীয় দিন-মজুর মহিলার পারস্পরিক কথোপকথন শুনতে পায়। তাদের মধ্যে একজন অন্যজনের নিকট ঋণী ছিল। ঋণ গ্ৰহীতা মহিলা ঋণদাত্রী মহিলাকে বললো, আজ বা কালকের মধ্যেই কাফেলা এখানে চলে আসবে। তাদের কাজ করে দিয়ে আমি তোমার ঋণ পরিশোধ করবো। মাজদী বললো, তুমি ঠিক বলেছে। তারপরে সে উভয়ের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি করে দিল। এ কথা শুনেই আদী ও বাস্বাস উটের উপর চড়ে দ্রুত প্রস্থান করলো এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এসে যা তারা শুনেছিল তা জানিয়ে দিল। এ দিকে আবু সুফিয়ান সতর্কতা স্বরূপ কাফেলাকে পশ্চাতে রেখে নিজে আগে আগে আসতে থাকে। বদরের পানির কাছে এসে মাজদীকে জিজ্ঞেস করলো, কারও আনাগোনা লক্ষ্য করেছ কি? সে বললো, সন্দেহজনক কাউকে দেখিনি। তবে দু’জন আরোহীকে দেখলাম, এই টিলার কাছে উট থামিয়ে।

মশকে পানি ভরে নিয়ে চলে গেল। এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান বাসবাস ও আব্দীর উট বসাবার স্থানে গেল। তাদের উটের কিছু গোবর হাতে নিল। গোবর ভেঙ্গে দেখলো ভিতরে কতগুলো খেজুরের আঁটি আছে। তখন সে বললো, আল্লাহর কসম, এটা তো ইয়াছরিবের পশুর গোবর। এ কথা বলেই আবু সুফিয়ান দ্রুত কাফেলার কাছে ছুটে গেল এবং পথ পরিবর্তন করে বদর প্রান্তর বঁায়ে রেখে কাফেলাকে নিয়ে সাগর তীরের পথ ধরে দ্রুত চলে গেল। এদিকে কুরায়শ বাহিনী অগ্রসর হয়ে জুহফায় এসে যাত্রা বিরতি করলো। এখানে অবস্থানকালে জুহায়ম ইবন সালত ইবন মাখরামা ইবন মুত্তালিব ইবন আবদে মানাফ এক স্বপ্ন দেখে। সবাইকে লক্ষ্য করে সে বললো, আমি আধা-নিদ্ৰা আধা-জাগ্রত অবস্থায় স্বপ্নে দেখি। একজন অশ্বারোহী লোক এসে থামালো। তার সাথে একটা উটও আছে। এরপর সে বললো, উতবা ইবন রাবীআ, শায়াবা ইবন রাবীআ, আবুল হাকাম ইবন হিশাম, উমাইয়া ইবন খালফ এবং অমুক অমুক নিহত। এভাবে সে বদর যুদ্ধে যে সব কুরায়শ নেতা নিহত হয়, তাদের সকলের নাম একে একে উল্লেখ করল। এরপর দেখলাম, সে তার উটের ঘাড়ে তলোয়ারের দ্বারা আঘাত করে উটটিকে রক্তাক্ত করে দিল। তারপরে সে উটটিকে আমাদের সৈন্য শিবিরের দিকে হাঁকিয়ে দিল। এতে এমন কোন তাঁবু বাকি থাকেনি যা ঐ উটের রক্তে রঞ্জিত হয়নি। আবু জাহল এ কথা শুনে বললো, এতো দেখছি বনু মুত্তালিব গোত্রের আর এক নবী। আগামী কাল যদি যুদ্ধ হয়, তখনই সে দেখতে পাবে নিহত করা হয়েছে।

ইবন ইসহাক বলেন, আবু সুফিয়ান যখন নিশ্চিত হল যে, সে তার কাফেলাকে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে, তখন সে কুরায়শ বাহিনীর নিকট বলে পাঠােল যে, তোমরা বেরিয়েছিলে তোমাদের বাণিজ্যিক কাফেলা, লোকজন ও পণ্যদ্রব্য রক্ষা করার উদ্দেশ্যে। আল্লাহ সেগুলো রক্ষা করেছেন। সুতরাং এখন তোমরা ফিরে যাও! কিন্তু আবু জাহল ইবন হিশাম বললো : আল্লাহর কসম, আমরা বদর পর্যন্ত না গিয়ে ফিরছি না। আমরা সেখানে তিন দিন অবস্থান করবো। উট যাবাহ করে খাওয়াবো। মদ পান করবো। গায়িকারা আমাদেরকে গান গেয়ে শুনাবে। গোটা আরবে আমাদের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের অভিযান ও সমাবেশের কথা জানতে পারবে। চিরদিন তাদের মনে আমাদের ভীতি বদ্ধমূল হয়ে যাবে। অতএব তোমরা এগিয়ে চলো। উল্লেখ্য, বদর ছিল আরবের একটি অন্যতম মেলার স্থান। প্রতিবছর মেলা উপলক্ষে এখানে বিরাট বাজার বসতো। আখনাস ইবন শুরায়ক ইবন আমর ইবন ওয়াহব ছাকাকী ছিলেন বনু যুহরার মিত্র। জুহাফায় অবস্থানকালে তিনি বলেন, হে বনু যুহরার লোকজন! আল্লাহ তোমাদের মালামাল রক্ষা করেছেন এবং তোমাদের বন্ধু মাখরামা ইবন নাওফিলাকে সঙ্কটমুক্ত করেছেন। তোমরা তো মাখরামা ও তার সম্পদ রক্ষার্থে বের হয়েছিলে। সুতরাং তোমরা ফিরে যাও, আর কেউ কাপুরুষতার অপবাদ দিলে তা আমার উপর ছেড়ে দিও। যেখানে তোমাদের কোন ক্ষতিই হচ্ছে না, সেখানে যুদ্ধে গমন করার কোনই প্রয়োজন নেই। এই লোক (আবু জাহল) যা বলে তা তোমরা শুনবে না। এ কথা শুনার পর তারা সবাই ফিরে যায় এবং বনু যুহরার একজন লোকও যুদ্ধে উপস্থিত ছিল না। তারা আখনাসের কথা মেনে

নিল। আখনাস ছিল তাদের সকলের বরেণ্য ব্যক্তি। কুরায়শ গোত্রের যতগুলি শাখা ছিল প্রত্যেক শাখা থেকেই কিছু না কিছু লোক এ অভিযানে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু বনু আদী শাখার কোন লোকই এতে অংশ নেয়নি। আর বনু যুহরার লোকজন বের হলেও মািখরামার নেতৃত্বে পথ থেকে ফিরে আসে। সুতরাং বদর যুদ্ধে এ দু’ গোত্রের কেউই যোগদান করেনি।” কুরায়শদের এ অভিযানে তালিব ইবন আবু তালিবও অংশগ্রহণ করে ২ পথে তালিব ও জনৈক কুরায়শের মধ্যে বাদানুবাদ হয়। তখন কুরায়শ গোত্রের অন্যান্য লোকেরা তালিবকে বললো, ওহে বনু হাশিম, আমরা তোমাদের সম্যক চিনি। যদিও বাহ্যিকভাবে আমাদের সাথে বের হয়েছ। কিন্তু তোমাদের অন্তর রয়েছে মুহাম্মদের সাথে বাধা। এ কথা শুনার পর অন্যদের সাথে তালিবও মক্কায় ফিরে যান। এ প্রসঙ্গে তিনি নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন :

এখানে আরবী কবিতা দিতে হবে।

“হে আল্লাহ! তালিব যদি এমন এক বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করে, যারা মূলত তালিবের বিরোধী ও শত্রু। যে বাহিনীতে আছে কয়েকশ’ অশ্ব। সে বাহিনী যেন লুষ্ঠিত হয়—লুণ্ঠনকারী না হয়। সে বাহিনী যেন বিজিত হয়— বিজয়ী না হয়।”

ইবন ইসহাক বলেন, কুরায়শ বাহিনী উপত্যকার দূর-প্রান্তে আকানকাল টিলার অপর পাশে গিয়ে শিবির স্থাপন করে। বদর ও আকানকালের মধ্যবতীর্ণ মরুময় উপত্যকাটি ছিল অসমতল—যার পশ্চাতে ছিল কুরায়শরা। উপত্যকার নাম ‘বাতুনে ইয়ালীল”। বদরের কূপের অবস্থান ছিল নিকট প্রান্তে। অর্থাৎ বাতনে ইয়ালীল থেকে মদীনার দিকে।

এ প্রসঙ্গে কুরআনের বর্ণনা নিম্নরূপ :

إذ أنتم بالعدوة الدّنيا وهم بالعدوة القصوى والركب أسفل منكم “স্মরণ করা, তোমরা ছিলে উপত্যকার নিকট প্রান্তে এবং তারা ছিল দূর-প্রান্তে আর উষ্ট্রারোহী দল ছিল তোমাদের অপেক্ষা নিম্নভূমিতে।” অর্থাৎ লোহিত সাগরের উপকূলে। আল্লাহর বাণী :

ولو تواعذتُمُ لأختلفتم فى الميغدر ولكن ليقضى اللّة أمرا كان مفعولاً.

যদি তোমরা পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত করতে চাইতে, তবে এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটতো; কিন্তু বস্তৃত যা ঘটবারই ছিল। আল্লাহ তা সম্পন্ন করবার জন্য উভয় দলকে যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত করলেন। (৮ : :২)। এ সময় আল্লাহ বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। উপত্যকার মাটি ছিল নরম। রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর সাহাবীগণের অবস্থান স্থলের বালু বৃষ্টির পানিতে জমাট হয়ে যায়। ফলে তাদের চলাফিরায় কোন অসুবিধা হয়নি। পক্ষান্তরে কুরায়শদের ওখানে বৃষ্টির পানিতে মাটি কর্দমাক্ত হয়ে যায়। ফলে তাদের চলাফিরায় দারুণ বিঘ্ন ঘটে।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী :

و ليربط على قلوبكم ويشيت به الأقدام. “এবং আকাশ হতে তোমাদের উপর বারি বর্ষণ করেন। তা দ্বারা তোমাদের পবিত্র করার জন্য তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা অপসারণের জন্য, তোমাদের হৃদয় দৃঢ় করার জন্য এবং তোমাদের পা স্থির রাখার জন্যে” (৮ : ১১)। এখানে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি তাদের ভিতর ও বাইর পবিত্র করেছেন তাদের অবস্থানকে মযবৃত করেছেন। তাদের অন্তরে সাহস যুগিয়েছেন এবং শয়তানের প্রতারণা, ভয়-ভীতি ও কুমন্ত্রণা থেকে মুক্ত রেখেছেন। ভিতর-বাইর সুদৃঢ় করার তাৎপর্য এটাই। এছাড়া তাদেরকে উপর থেকে সাহায্য প্রদান করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন :

إذ يوحى ربك إلى المستكة أتى معكم فثبتوا الذين أمنوا سألقى فى قلوب

الذين كفروا الرعب فاضربوا فوق الأعناقر واضربوا منهم كل بنان. স্মরণ করা, তোমাদের প্রতিপালক ফেরেশতাগণের প্রতি প্ৰত্যাদেশ করেন, আমি তোমাদের সাথে আছি। সুতরাং মুমিনগণকে অবিচলিত রোখ, যারা কুফরী করে আমি তাদের হৃদয়ে ভীতির

সঞ্চার করব, সুতরাং আঘাত কর তাদের স্কন্ধে (অর্থাৎ মাথায়) ও আঘাত কর তাদের সর্বাঙ্গে।” যাতে করে তারা হাতিয়ার উত্তোলনে সক্ষম না হয় (৮ : ১২)। মহান আল্লাহর বাণী :

ذلك بأنهم شاقُوا اللّه ورسوله ومن يشاقق اللّه ورسولة فان اللّه شديد

العقاب. ذلکم فذ و قوه و آن الکفرین عذاب النار. “এর হেতু এই যে, তারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে এবং কেউ আল্লাহ ও

তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করলে আল্লাহ তো শাস্তিদানে কঠোর। সুতরাং এর আস্বাদ গ্রহণ কর এবং কাফিরদের জন্যে অগ্নিশাস্তি রয়েছে” (৮ : ১৩-১৪)।

ইবন জারীর বলেন, আমার নিকট হারূন ইবন ইসহাক….. আলী ইবন আবু তালিব থেকে বর্ণনা করেন : যে দিন সকাল বেলা বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়, সে রাত্রে স্বল্প পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টি থেকে বীচার জন্যে আমরা বৃক্ষের নীচে ও চালের তলে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা) সালাত আদায় করছিলেন এবং যুদ্ধের জন্যে উদ্ধৃদ্ধ করছিলেন। ইমাম আহমদ

জুহফ : মক্কা থেকে চার মারহালা দূরে মদীনার পথে একটি বড় গ্রামের নাম (মুজামুল বুলদান ৩/৬২) ২. ওয়াকিদীর মতে এদের সংখ্যা ছিল একশ’। সঠিক মতে একশ’র কম। বনু আদী মাররাজ-জাহরান থেকে

ফিরে আসে কিংবা পথ থেকে। ৩. তাবারী ইবন কালবী থেকে বর্ণনা করেন যে, মুশরিকরা তালিবকে তাদের সাথে আসতে বাধ্য করেছিল। ইবন আৰ্ছীর বলেন, বন্দী, নিহত বা ফিরে আসা কোন দলের মধ্যেই তালিবের নাম পাওয়া যায় না।

বলেন, আমাদের নিকট আবদুর রহমান ইবন মাহদী… আলী থেকে বর্ণনা করেন : বদর যুদ্ধে আমাদের বাহিনীতে মিকদাদ ব্যতীত আর কোন অশ্বারোহী ছিল না। আমরা সবাই ঘুমিয়ে ছিলাম আর রাসূলুল্লাহ্ (সা) একটি বৃক্ষের নীচে রাতভর সালাত আদায় ও কান্নাকাটি করতে থাকেন। এ ভাবে করতে করতে ভোর হয়ে যায়। সামনে এ হাদীছ বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে। ইমাম নাসাঈ এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। মুজাহিদ বলেন, : বৃষ্টি বর্ষণের ফলে মুসলিম শিবির এলাকায় ধূলা-বালি উড়া বন্ধ হয়, বালুমাটি জমে যায়, মুসলমানদের মনে শান্তি নেমে আসে। এবং তাদের পা সুদৃঢ় হয়।

বদরের পূর্বরাত ছিল হিজরী ২য় বর্ষের রামাযান মাসের ১৭ তারিখ শুক্রবারের রাত। রাসূলুল্লাহ (সা) বদরে একটি বৃক্ষের কাছে ঐ রোত্রটি সালাতরত অবস্থায় কাটান। সিজদাবনত হয়ে তিনি বারবার এই দু’আটি পড়তে থাকেন : ১. এমএ (হে চিরঞ্জাব, হে চিরস্থায়ী।)

ইবন ইসহাক বলেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজের বাহিনীকে অগ্রসর করে বদরের কূপের কাছে নিয়ে যান। ইবন ইসহাক বলেন, বনু সালামার অনেক লোকের সাথে আমার আলাপ হয়েছে। তারা বলেছে, ঐ সময় হুবাব ইবন মুনয্যির ইবন জামূহ রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই যেই স্থানে আপনি অবস্থান নিয়েছেন এটা কি আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন যে, এর থেকে সামান্য আগে বা পিছনে আমরা যেতে পারব না? না এটা আপনার ব্যক্তিগত অভিমত এবং রণ-কৌশল হিসেবে এ জায়গাকে আপনি বেছে নিয়েছেন? তিনি বললেন, এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। রণ-কৌশল হিসেবে এ স্থানকে বেছে নেয়া হয়েছে; এটা আমার ব্যক্তিগত মত। হুবাব বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ স্থানটা যুদ্ধের জন্যে খুব সুবিধাজনক নয়। আপনি লোকজন নিয়ে শক্ৰদের কাছাকাছি পানির কুয়ার নিকট চলুন, সেখানে আমরা অবস্থান গ্ৰহণ করি। এরপর আশে-পাশের সব কৃপ আমরা নষ্ট করে দেবো। আমাদের অবস্থানের জায়গায় একটা জলাধার তৈরি করে তাতে পানি ভর্তি করে রাখবো। যুদ্ধের সময় আমরা পানি পান করবো। কিন্তু ওরা পানি পান করতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তুমি একটা ভাল পরামর্শ দিয়েছ। উমাবী ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) লোকজনকে সমবেত করছিলেন। জিবরোল তাঁর ডান পাশে ছিলেন। এমন সময় একজন ফেরেশতা এসে বললেন, হে মুহাম্মদ! আল্লাহ। আপনাকে সালাম জানিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তিনিই সালাম, তার থেকে সালাম আসে, তার কাছে সালাম প্রত্যাবর্তন করে।

(وهو السلام و منه السلام و اليه السلام)

ফেরেশতা বললেন, : আল্লাহ। আপনাকে জানাচ্ছেন যে, হুবাব ইবন মুনযির যে পরামর্শ দিয়েছে তা সঠিক, আপনি সেই মত কাজ করুন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিবরীলকে বললেন আপনি এই ফেরেশতাকে চিনেন? জিবরীল বললেন, : আসমানের সকল অধিবাসীকে আমি চিনি না। তবে ইনি ফেরেশতা, শয়তান নয়। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাখীদের নিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন এবং শক্ৰদের নিকটবতী কূপের নিকট অবস্থান গ্ৰহণ করেন। তাঁর নির্দেশে আশপাশের সকল কৃপ নষ্ট করে দেয়া হয় এবং যে কুপের কাছে তাঁরা অবতরণ করছিলেন তার পাশে একটা

জলাধার তৈরি করে তাতে পানি ভর্তি করে রেখে পানি উঠাবার পাত্র রেখে দেয়া হয়। কোন কোন লেখক ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, হুবাব ইবন মুনয্যির যখন রাসূলুল্লাহকে পরামর্শ দেন, তখন আসমান থেকে একজন ফেরেশতা আসেন। তখন জিবরাল (আ) রাসূলুল্লাহর পাশে ছিলেন। ফেরেশতা বললেন, : হে মুহাম্মদ। আল্লাহ। আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং হুবাব ইবন মুনযিরের পরামর্শ গ্রহণ করতে বলেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) জিবরীলের দিকে তাকালেন। জিবরীল বললেন, আমি সকল ফেরেশতাকে চিনি না। তবে ইনি ফেরেশতা— শয়তান না। উমাবী বলেন, মুসলমানরা যাত্ৰা করে মধ্যরাতের সময় মুশরিকদের নিকটবতী কুপের কাছে অবতরণ করে। এরপর ঐ কূপের পানি দ্বারা তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মিটান। তারপর জলাধার তৈরি করে তাতে পানি ভর্তি করে রাখলেন। ফলে মুশরিকদের জন্যে আর পানি অবশিষ্ট থাকলো না।

ইবন ইসহাক বলেন, : সাআদ ইবন মুআয ঐ সময় রাসূলুল্লাহকে সম্বোধন করে বলেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি অনুমতি দিন, আমরা আপনার জন্যে উচু স্থানে একটা ছাউনি স্থাপন করি। আপনি সেখানে থাকবেন। তার কাছেই আপনার সওয়ারী ঠিক করে রাখবো। তারপরে শত্রুর মুকাবিলায় আমরা যুদ্ধ করবো। যুদ্ধে যদি আল্লাহ আমাদের বিজয় দান করেন, তাহলে তো আমাদের আশা পূর্ণ হলো। আর যদি তা না হয়, তাহলে আপনি সওয়ারীতে আরোহণ করে আমাদের সেই সব লোকের কাছে চলে যাবেন, যারা যুদ্ধে আসেনি। কেননা, এই যুদ্ধে এমন অনেক লোক আসতে পারেনি। যাদের তুলনায় আমরা আপনার জন্যে অধিক শক্তিশালী নই। তারা যদি জানতো যে, আপনি কোন যুদ্ধে গমন করছেন, তাহলে কিছুতেই তারা পিছিয়ে থাকতো না। আল্লাহ তাদের দ্বারা আপনাকে হিফাযত করবেন। তারা আপনার কল্যাণকামী হবে। ও আপনার সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবে। সাআদের বক্তব্য শুনে রাসূলুল্লাহ তার প্রশংসা করেন ও তার জন্যে দুআ করেন। এরপর রাসূলুল্লাহর জন্যে উচু স্থানে একটি ছাউনি স্থাপন করা হয় এবং তিনি তাতে অবস্থান করেন।

ইবন ইসহাক বলেন, : কুরায়শ বাহিনী সকাল বেলা তাদের অবস্থান থেকে রণাংগানের দিকে বেরিয়ে এলো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন দেখলেন শক্রিরা আকানকাল টিলা থেকে নেমে উপত্যকার দিকে ছুটে আসছে, তখন তিনি আল্লাহর কাছে এই দুআ করলেন : হে আল্লাহ! এই সেই কুরায়শ— যারা অশ্ববাহিনী নিয়ে দর্পভরে এগিয়ে আসছে। এরা আপনার বিদ্রোহী এবং আপনার রাসূলকে অস্বীকারকারী। হে আল্লাহ! আমি আপনার সেই সাহায্যের প্রত্যাশী যার প্রতিশ্রুতি আমাকে দিয়েছেন। হে আল্লাহ! এই সকাল বেলায় আপনি তাদেরকে ধ্বংস করে দিন। কুরায়শ দলের মধ্যে উত্বা ইবন রাবী আকে একটি লাল উটে আরোহণরত দেখতে পেয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, : গোটা কুরায়শ বাহিনীর মধ্যে যদি কারও মধ্যে কিছু কল্যাণ থেকে থাকে, তবে এই লাল উট আরোহীর মধ্যে আছে। কুরায়শরা যদি তার কথা শোনে, তবে তারা বেঁচে যাবে। ইতোমধ্যে খুফাফ ইবন আয়মা ইবন রাহযা কিংবা তার পিতা আয়মা ইবন রাহযা গিফারী তার পুত্রের মাধ্যমে কয়েকটি উটি উপহার হিসেবে কুরায়শদের নিকট প্রেরণ করে এবং জানায় যে, তোমরা চাইলে আমি অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে প্ৰস্তৃত রয়েছি।

কুরায়শরা তার পুত্রের মাধ্যমে জবাব পাঠাল যে, তোমার এ সৌজন্য আত্মীয়তার নিদর্শন। তোমার দায়িত্ব তুমি পালন করেছ। আমার জীবনের কসম, আমাদের যুদ্ধ যদি কোন মানুষের সাথে হয়, তবে ওদের তুলনায় আমাদের শক্তি কম নয়। আর যদি আমাদের এ যুদ্ধ আল্লাহর সাথে হয়। যেমনটি মুহাম্মদ বলে থাকে, তা হলে আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করার শক্তি তো কারও নেই। কুরায়শরা ময়দানে অবতরণ করার পর তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন রাসূলের তৈরি করা জলাধার পানি পান করতে আসে। তাদের মধ্যে হাকীম ইবন হিযমও ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, ওদেরকে পানি পান করতে দাও। পরিশেষে দেখা গেল যে, তাদের যতগুলো লোক ঐ পানি পান করেছিল একমাত্ৰ হাকীম ইবন হিযাম ব্যতীত তাদের সকলেই যুদ্ধে নিহত হয়। পরবতীতে তিনি ইসলাম গ্ৰহণ করেন এবং নিষ্ঠাবান মুসলমান হন। এ কারণে হাকীম ইবন। হিযাম যখন শক্ত কসম করতে চাইতেন, তখন বলতেন, ঐ সত্তার কসম, যিনি আমাকে বদর যুদ্ধে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

বদর যুদ্ধে শরীক সাহাবীগণের সংখ্যা ছিল তিনশ’ তের জন্য। যুদ্ধের বর্ণনা শেষে আমরা তাদের নাম আদ্যাক্ষরের ক্রম অনুযায়ী উল্লেখ করবো ইনশা আল্লাহ।

সহীহ বুখারীতে বারা” ইবন আযিবা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা এই কথা বলাবলি করতাম যে, বদর যোদ্ধাদের সংখ্যা তিনশ’ দশের কিছু অধিক। এই একই সংখ্যা ছিল তালুত বাহিনীরও— যারা তালুতের সাথে নদী অতিক্রম করেছিলেন। আর তাঁর সাথে মু’মিন ব্যতীত অন্য কেউ নদী অতিক্রম করতে পারেনি। সহীহ বুখারীতে বারা” ইবন আযিবা থেকে বৰ্ণিত অপর এক হাদীছে আছে যে, তিনি বলেন, বদর যুদ্ধের সময় আমি ও ইবন উমর ছোট বলে বিবেচিত ছিলাম। সে যুদ্ধে মুহাজিরগণের সংখ্যা ছিল। ষাটের কিছু বেশী। আর আনসারগণের সংখ্যা ছিল দুইশ’ চল্লিশের কিছু বেশী। ইমাম আহমদ (র) ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধে মুসলিম সৈন্য সংখ্যা ছিল তিনশ’ তের জন। তাদের মধ্যে মুহাজিরগণের সংখ্যা ছিল ছিয়াত্তর। আর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সতের রামাযান শুক্রবার। আল্লাহর বাণী :

اذ يريكهم الله فی منا ملت قليلاً و لو آراکهم کثیرا لف شأ تم ولتنازعتم فی

الأمر ولكن اللّه سلّم“স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন যে, তারা সংখ্যায় অল্প; যদি তোমাকে দেখাতেন যে, তারা সংখ্যায় অধিক, তবে তোমরা সাহস হারাতে এবং যুদ্ধ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের রক্ষা করেছেন” (৮ : :৩)। যুদ্ধের রাত্রে রাসূলুল্লাহ্ (সা) এই স্বপ্ন দেখেন। বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর নির্ধারিত ছাপরায় নিদ্ৰা যান এবং সবাইকে নির্দেশ দেন যে, অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত কেউ যেন যুদ্ধে লিপ্ত না হয়। ইতোমধ্যে শত্রুদল মুসলমানদের কাছাকাছি চলে আসে। তখন আবু বকর সিন্দীক রাসূলুল্লাহ (সা)-কে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ওরা তো আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে। তখন তাঁর নিদ্ৰা ভংগ হয়। এই নিদ্ৰায় আল্লাহ তাকে স্বপ্নের মাধ্যমে দুশমনদের সংখ্যা

ہے۔ O

কম করে দেখান। এ ঘটনা উমাবী বর্ণনা করেছেন (এবং বায়হাকী তার দালাইল গ্রন্থে উদধূত

করেছেন)। বৰ্ণনাটি নিতান্তই গরীব পর্যায়ের। আল্লাহর বাণী :

W … و اذیریگمو هم اذر التقیثم فی أعینگم قلیلاً

দুটি দল যখন পরস্পরের সম্মুখীন হল, তখন আল্লাহ প্রত্যেক দলকে অপর দলের দৃষ্টিতে

কম করে দেখান। যাতে উভয় দলই একে অপরের উপর আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। এরূপ

করার পিছনে নিগুঢ় রহস্য রয়েছে, যা সুস্পষ্ট। এ আয়াতের বক্তব্যের সাথে সূরা আলেইমরানের নিম্নোক্ত আয়াতের সাথে কোন বিরোধ নেই।

قد كان لكمْ أية فى فئتين التقتا فئة نقاتل فى سبيل اللّه وأخرى كافرة

يرونهم مثليهم رأى العين واللّة يؤيد بنصره من يشاء“দুটি দলের পরস্পর সম্মুখীন হওয়ার মধ্যে তোমাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। একদল আল্লাহর পথে লড়াই করছিল, অন্যদল কাফির ছিল। ওরা তাদেরকে (অর্থাৎ কাফিররা মুসলমানদেরকে) চোখের দেখায় দ্বিগুণ দেখছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। (৩ : ১৩)। কেননা, প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ মতে সেদিন কাফির দল মু’মিনদের দলকে কাফির দলের দ্বিগুণ সংখ্যা দেখতে পাচ্ছিল। আর এ দেখাটা হয়েছিল তীব্র লড়াই ও প্রতিযোগিতার সময়। এর মাধ্যমে আল্লাহ কাফিরদের অন্তরে ভয়-ভীতির সঞ্চার করে দেন। এ ছিল আল্লাহর কৌশল। প্রথমে মুখোমুখি হওয়ার সময় কাফিরদের চোখে মুমিনদের সংখ্যা কম করে দেখান। এরপর যুদ্ধ বেধে গেলে কাফিরদের চোখে মুমিনদের সংখ্যা দ্বিগুণ করে দেখান। আল্লাহর এ সাহায্যে কাফির দল ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পরাজয় বরণ করে। তাই আল্লাহ বলেন, :

জন্যে শিক্ষা রয়েছে।”

ইসরাঈল… আবু উবায়দ ও আবদুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, বদর যুদ্ধে আমাদের চোখে কাফিরদের সংখ্যা খুবই কম দেখাচ্ছিল। এমন কি আমি আমার পাশের লোককে জিজ্ঞেস করলাম, ওদের সংখ্যা কি সত্তর জনের মত দেখাচ্ছে না? সে বললো, আমার মনে হয় ওরা শ’খানেক হবে।

ইবন ইসহাক বলেন, : আবু ইসহাক ও অন্যান্য আলিমগণ প্ৰবীণ আনসারগণের বরাতে আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, কুরায়শ বাহিনী যখন সবকিছু ঠিকঠাক করে তাদের যুদ্ধের স্থান নিশ্চিত করে নিল, তখন উমােয়র ইবন ওয়াহব জুমাহীকে এই দায়িত্ব দিয়ে পাঠাল যে, মুহাম্মদের বাহিনীতে লোকসংখ্যা কত তা নির্ণয় করে এসো। উমােয়র ঘোড়ায় চড়ে মুসলিম বাহিনীর চারদিকে এক চক্কর দিয়ে কুরায়শদের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, ওদের সংখ্যা তিনশ’র চেয়ে সামান্য বেশী বা সামান্য কম। তবে আমাকে আরেকবার অবকাশ দাও দেখে আসি তাদের কোন গুপ্ত ঘাঁটি— বা সাহায্যকারী দল আছে কি না। এবার সে উপত্যকার দূর প্রান্ত পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করলো। কিন্তু কিছুই পেলো না। কুরায়শদের কাছে ফিরে গিয়ে সে

বললো, “কোন কিছুরই সন্ধান পেলাম না। তবে হে কুরায়শরা! আমি মৃত্যু বহনকারী বিপদসমূহ দেখে এসেছি। দেখেছি। ইয়াছরিবের বাহিনী যেন নিশ্চিত মৃত্যু বহন করে এনেছে। ওদের কাছে আত্মরক্ষা ও আশ্রয়ের জন্যে একমাত্র তলোয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। আল্লাহর কসম, তাদের হাবভাব দেখে মনে হলো, তাদের একজন নিহত হলে তোমাদের একজন অবশ্যই নিহত হবে। এ ভাবে তাদের সম-পরিমাণ লোক যখন তোমাদের দল থেকে নিহত হবে, তখন আর বেঁচে থাকার মধ্যে কল্যাণ কোথায়? অতএব তোমরা পুনর্বিবেচনা করে দেখ। উমায়রের মুখে এ কথা শুনে হাকীম ইবন হিযাম কুরায়শ বাহিনীর মধ্যে খুঁজে উত্বা ইবন রাবীআকে বললো : হে আবুল ওয়ালীদ! আপনি কুরায়শ গোত্রের প্রবীণ নেতা, সবাই আপনাকে মান্য করে। আপনি কি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার মত একটা কাজ করবেন? উতবা বললো, সে কাজটি কী হাকীম? হাকীম বললো, আপনি কুরায়শ বাহিনীকে যুদ্ধ না করে ফিরিয়ে নিয়ে যান এবং আপনার মিত্র আমর ইবন হাযরামীর খুনের বিষয়টা নিজের দায়িত্বে নিয়ে নিন। উতবা বললো, তোমার কথা আমি মেনে নিলাম। এ ব্যাপারে তুমি সাক্ষী থাক। সে আমার মিত্র। তার রক্তপণ ও অর্থের ক্ষয়ক্ষতি বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমার উপর থাকলো। তুমি হানযালিয়ার পুত্রের অর্থাৎ আবু জাহলের নিকট যাও। কেননা, কুরায়শ বাহিনীকে বিনা যুদ্ধে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সে ছাড়া আর কেউ বিরোধিতা করবে বলে আমি আশংকা করি না। এরপর উতবা এক ভাষণে বলে : হে কুরায়শরা! মুহাম্মদ ও তাঁর সংগীদের সাথে যুদ্ধ করে তোমাদের তেমন কোন লাভ নেই। আল্লাহর কসম, আজ যদি তোমরা তাকে হত্যা করতে সক্ষমও হও, তবু তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সু-সম্পর্ক থাকবে না। একজন আর একজনকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখতে থাকবে। কেননা, সে হয় তার চাচাত ভাই কিংবা খালাত ভাই অথবা অন্য কোন আত্মীয়কে হত্যা করেছে। সুতরাং তোমরা যুদ্ধ না করে ফিরে যাও। আর মুহাম্মদের ব্যাপারটা গোটা আরববাসীর হাতে ছেড়ে দাও। তারা যদি তাকে হত্যা করে, তবে তো তোমাদের উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেল। আর যদি তা না হয়, তা হলে মুহাম্মদের সাথে তোমাদের সম্পর্ক ভাল থাকবে। তোমরা তার সাথে যুদ্ধ করতে যাবে না।

হাকীম ইবন হিযাম বলেন, এরপর আমি আবু জাহলের কাছে গেলাম। দেখলাম, সে থলে থেকে বর্ম বের করে প্রস্তুত করছে। আমি বললাম, হে আবুল হাকাম!! উত্বা আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছে এই সংবাদ দিয়ে। এরপর উতবা যা কিছু বলেছিল সবই তাকে জানালাম। * আবু জাহল বললো, আল্লাহর কসম, উত্বা যখন থেকে মুহাম্মদ ও তাঁর সাথীদেরকে দেখেছে, তখন থেকে সে জাদুগ্ৰস্ত হয়ে আছে। আল্লাহর কসম, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মদের মাঝে চূড়ান্ত ফায়সালা না করে দেবেন। ততক্ষণ, পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাবো না। আর উত্বা যা বলেছে। ওটা তার আসল কথা নয়। আসল ব্যাপার হলো, সে যখন মুহাম্মদ ও তার সংগীদের সংখ্যা কম দেখেছে, তাদের মধ্যে উতবার ছেলেও আছে, তখন সে তার ছেলের জীবন নাশের ভয় করছে। এরপর আবু জাহল আমির ইবন হাযরামীর কাছে লোক মারফত খবর পাঠাল যে, তোমার মিত্র উত্বা বিনা যুদ্ধে লোকজন ফিরিয়ে নিতে যাচ্ছে। অথচ তুমি দেখতে পোচ্ছ যুদ্ধের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন প্রায়। সুতরাং তুমি ওঠে এবং তোমার নিহত ভাই আমর ইবন হাযরামীর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে কুরায়শদের প্রতিশ্রুতি উল্লেখ করে

সবাইকে উত্তেজিত কর। আমির ইবন হাযরামী উঠে দাঁড়াল এবং তার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে চিৎকার করে বললো, “হায় আমর’ ‘হায় আমর”। সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। ফিরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। তারা যে যুদ্ধের জন্যে এসেছিল তার উপর তারা অটল হয়ে পড়লো। এ ভাবে উতবা যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল তা সহসাই বানচাল হয়ে গেল। উতবা যখন আবু জাহলের এ মন্তব্য শুনলো যে, “উস্তুবা জাদুগ্ৰস্ত হয়ে গেছে”, তখন সে বললো, অচিরেই সে বিবেকহীন জানতে পাবে, জাদুগ্ৰস্ত আমি, না সে। এরপর উত্বা মাথায় পরার জন্যে একটা লৌহ শিরস্ত্ৰাণ খুঁজলো। কিন্তু গোটা বাহিনীর মধ্যে তার মাথার মাপে কোন শিরস্ত্ৰাণ পাওয়া গেল না। কারণ, উতবার মাথা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বড়। অবশেষে সে তার মাথায় নিজের চাদর পেচিয়ে নিল।

থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমরা একদা মারওয়ান ইবন হাকামের কাছে অবস্থান করছিলাম। এমন সময় দ্বাররক্ষী ভিতরে প্রবেশ করে বললো, হাকীম ইবন হিযাম ভিতরে আসার অনুমতি চান। মারওয়ান বললো, তাকে আসতে দাও। হাকীম ভিতরে প্রবেশ করলে মারওয়ান ধন্যবাদ দিয়ে বললো, হে আবু খালিদ কাছে এসো। এরপর তিনি বৈঠকের মাঝখানে এসে মারওয়ানের সম্মুখে বসে পড়েন। মারওয়ান তাকে বদর যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করার অনুরোধ জানায়। হাকীম ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, আমরা যখন জুহফা নামক স্থানে পৌছি, তখন কুরায়শ গোত্রের একটি শাখার সকলেই ফিরে চলে যায়। ফলে ঐ শাখার একজন লোকও সে যুদ্ধে অংশ গ্ৰহণ করেনি। এরপর আমরা রণাংগানের একেবারে কাছে গিয়ে শিবির স্থাপন করি— যার কথা আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন। (উদওয়াতুন্দ দুনিয়া— নিকট প্রান্তে)। তখন আমি উত্বা ইবন রাবী আর কাছে এসে বললাম, হে আবুল ওয়ালীদ! আপনি কি আজকের দিনের গৌরব নিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতে চান? উত্যুবা বললো, তাই করবো। বলো সেটা কি? আমি বললাম, মুহাম্মদের কাছে তো আপনাদের একটাই দাবী। তা হলো, আমর ইবন হাযরামীর খুনের প্রতিশোধ গ্রহণ। আমর ইবন হাযরামী আপনার মিত্র। আপনি যদি তার ঋণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তা হলে কুরায়শরা আজ যুদ্ধ না করে ফিরে যেতে পারে। উত্বা বললো, আমি সে দায়িত্ব নিলাম। তুমি সাক্ষী থাক। তবে তুমি ইবন হানযালিয়া অর্থাৎ আবু জাহলের কাছে যাও এবং বলো, আপনি কি নিজের চাচাত ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ না করে লোকজন নিয়ে ফিরে যেতে রায়ী আছেন? আমি আবু জাহলের কাছে গেলাম। দেখলাম, সম্মুখে-পশ্চাতে অনেক লোকের মধ্যে সে বসে আছে। আর আমির ইবন হাযরামী তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে এবং বলছে, আবদে শামসের হাত থেকে আমার যে হার (অর্থাৎ মর্যাদা) খুয়া গেছে, সে হার আজ বনু মািখযুমের হাতে উদ্ধার হবে। আমি আবু জাহলকে উদ্দেশ্য করে

আছেন? আবু জাহল বললো, সে বুঝি। এ কাজের জন্যে তোমাকে ছাড়া আর কাউকে দূত পায়নি? আমি বললাম, না। তবে আমিও তার ছাড়া অন্য কারও দূত হতে রাষী নই। হাকীম বলেন, আমি দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে উতবার কাছে চলে গেলাম। যাতে কোন সংবাদ থেকে

১. আবু জাহলের মাতার নাম হানযালা, অপর নাম আসমা বিনত মাখরামা।

বঞ্চিত না হই। উত্যুবা তখন আয়মা ইবন রাহযা গিফারীর দেহের উপর হেলান দিয়ে বসে ছিল। আয়মা কুরায়শদের জন্যে উপহার স্বরূপ দশটি উটি নিয়ে এসেছিল ইত্যবসরে দুরাচার আবু জাহল সেখানে উপস্থিত হয়ে উত্বকে শাসিয়ে বললো, তুমি কি জাদুগ্ৰস্ত হয়েছো? উত্বা আবু জাহলকে বললো, একটু পরেই জানতে পারবে। এ কথা বলার সাথে সাথেই আবু জাহল তলোয়ার বের করে তার ঘোড়ার পিঠে আঘাত করলো। এ দেখে আয়মা ইবন রাহযা মন্তব্য করলো যে, এটা শুভ লক্ষণ নয়। তখন চারিদিকে যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে রাসূল (সা) তাঁর সাথীগণকে সারিবদ্ধ করেন এবং সুনিপুণভাবে বিন্যস্ত করেন ইমাম তিরমিয়ী আবদুর রহমান ইবন আওফ থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বদর যুদ্ধে আমাদেরকে রাত্ৰিবেলা সারিবদ্ধ করেন।

ইমাম আহমদ…. আবু আইয়ুব থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বদর যুদ্ধে আমাদেরকে সারিবদ্ধ করে দেন। আমাদের মধ্য থেকে কয়েকজন সারি ছেড়ে সম্মুখে এগিয়ে যায়। নবী করীম (সা) তাদেরকে দেখে বললেন, আমার সাথে এসো, আমার সাথে এসো। ইমাম আহমদ একাই এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন এবং এর সনদ হাসান বা উত্তম।

ইবন ইসহাক বলেন, : রাসূলুল্লাহ্ (সা) যুদ্ধের জন্যে তাঁর সৈন্যগণকে সারিবদ্ধভাবে দাড় করান। তিনি হাতে একটি তীর নিয়ে তা দ্বারা লাইন সোজা করেন। সৈন্যদের কাতার পর্যবেক্ষণ করার সময় দেখেন যে, সুওয়াদ ইবন গাযিয়া (বনু আদী ইবন নাজারের মিত্ৰ) লাইন থেকে আগে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি তীর দ্বারা তার পেটে গুতা মেরে বলেন, সুওয়াদ! লাইনে সোজা হয়ে দাড়াও। সুওয়াদ বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি আমাকে ব্যথা দিলেন। অথচ আল্লাহ। আপনাকে সত্য ও ইনসাফ দিয়ে পাঠিয়েছেন। সুতরাং আমাকে প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ দিন। রাসূলুল্লাহ (সা) পেটের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দিয়ে বললেন, প্রতিশোধ গ্রহণ কর। সুওয়াদ তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে জড়িয়ে ধরে পেটে চুম্বন করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, সুওয়াদ! তুমি এরূপ করতে গেলে কেন? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অবস্থার ভয়াবহতা আপনি দেখছেন। তাই আমি চাচ্ছিলাম জীবনের শেষ মুহুর্তে আপনার পবিত্র দেহের সাথে আমার দেহের একটু স্পর্শ লাণ্ডক। তার কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) তার কল্যাণের জন্যে দুআ করলেন ও সদুপদেশ দিলেন।

ইবন ইসহাক বলেন, আফরার পুত্র আওফ ইবন হারিছ রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বললো : ইয়া রাসূলাল্লাহ। আল্লাহ বান্দার উপর কিসে খুশী হন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, : বর্মহীন শরীরে দুশমনদের মধ্যে ঢুকে যুদ্ধ করলে আল্লাহ খুশী হন। এ কথা শুনে আওফ শরীর থেকে বর্ম খুলে ফেলে তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যান।

ইবন ইসহাক বলেন, : এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) সৈন্যদের লাইন বিন্যস্ত করে ফিরে যান ও ছাপরায় প্রবেশ করেন। তার সাথে আবু বকর (রা)-ও যান। ছাপরার মধ্যে রাসূলুল্লাহর সাথে আবু বকর ব্যতীত আর কেউ ছিল না। ইবন ইসহাক ও অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ বলেছেন :

প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। যাতে প্রয়ােজন হলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাতে আরোহণ করে মদীনায় চলে যেতে সক্ষম হন। যে দিকে সাআদ ইবন মুআয ইতোপূর্বে ইংগিত করেছিলেন।

বাযযার তার মুসনাদ গ্রন্থে মুহাম্মদ ইবন আকীল থেকে বর্ণনা করেন : একদা খলীফা আলী (রা) তাদেরকে সম্বোধন করে বলেন, তোমরা বলে তো, সবচেয়ে বড় বীর কে? সবাই বললোঃ হে আমীরুল মু’মিনীন! সবচেয়ে বড় বীর আপনি। আলী (রাঃ) বললেন, : যে কেউ আমার মুকাবিলায় এসেছে আমি তার বদলা নিয়েছি। কিন্তু আবু বকর (রা)-এর ব্যতিক্রম। আমরা বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্যে আলাদা ছাপড়া স্থাপন করি। মুশরিকদের কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে যাতে তাঁর কাছে আসতে না পারে সে জন্যে রাসূলুল্লাহর সাথে যে কোন একজনকে থাকার জন্যে আমরা নাম আহবান করলাম। আল্লাহর কসম, সে দিন আবু বকর (রা) ব্যতীত কেউ এগিয়ে এলো না। তিনি খোলা তলোয়ার উচু করে রাসূলুল্লাহর শিয়রে দণ্ডায়মান ছিলেন। মুশরিকদের কেউ এ দিকে অগ্রসর হলেই তিনি তাকে ধাওয়া করে তাড়িয়ে দিতেন। সুতরাং আবু বকরই সবচেয়ে বড় বীর। আলী (রা) বলেন, আমি দেখেছি কুরায়শরা রাসূলুল্লাহর সাথে বিরোধিতা করতো, আবু বকর তার জবাব দিতেন, মাঝখানে আড় হয়ে দাঁড়াতেন। কাফিররা অভিযোগ দিতো তুমি-ই তো আমাদের অনেক মা’বৃদের স্থলে একজন মা’বুদের কথা প্রচার করছে। আল্লাহর কসম, তখন আমাদের মধ্য হতে আবু বকর ব্যতীত আর কেউ এগিয়ে যেতো না। তিনিই তাদের সামনে বাধ সাধতেন, তর্ক করতেন ও লড়াই করতেন। তিনি বলতেন, তোমরা এমন একজন লোককে হত্যা করতে চাও, যিনি বলছেন, “আমার প্রতিপালক আল্লাহ”। এরপর হযরত আলী (রা) তাঁর গায়ের চাদর খুলে ফেললেন এবং এতো বেশী রোদন করলেন যে, তার দাড়ি ভিজে গেল। তারপর তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, বল দেখি ফিরআওন বংশের সেই মুমিন লোকটি উত্তম, না আবু বকর উত্তম? প্রশ্ন শুনে উপস্থিত সবাই নিরুত্তর হয়ে গেল। আলী (রা) বললেন, আল্লাহর কসম, ফিরআওন বংশের সেই মু’মিন লোকটির জীবনের সমুদয় পুণ্যের তুলনায় আবু বকরের এক ঘণ্টার পুণ্য অনেক বেশী। কেননা, সে তার ঈমানকে গোপন করে রেখেছিল। আর ইনি প্রকাশ্যে ঈমানের ঘোষণা দিয়েছেন। বাযযার বলেন, মুহাম্মদ ইবন আকীল ব্যতীত অন্য কোন সূত্রে বর্ণনাটি আমাদের কাছে পৌঁছেনি। সুতরাং হযরত আবু বকর (রা)-এর এটা একক বৈশিষ্ট্য যে, গারে ছাওরে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে যেমন তিনি একাই ছিলেন, তেমন বদরের ছাপরার মধ্যে তিনিই তাঁর একক সাখী ছিলেন। তাঁবুতে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আল্লাহর কাছে বিগলিত মনে অধিক পরিমাণ কান্নাকাটি করেন এবং এই দুআ করেন :

اللهم انك ان تهلك هذه العصابة لا تعبد بعدها فى الارض

“হে আল্লাহ্! আজ যদি আপনি এ দলকে ধ্বংস করে দেন, তবে পৃথিবীতে আপনার। ইবাদত করার মত আর কেউ থাকবে না।”

তিনি কায়মনোবাক্যে আল্লাহর নিকট আরও প্রার্থনা করেন :

اللهم انجزلی ما وعد تنی اللهم نصر لف

“হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা কাৰ্যকারী করেন। হে আল্লাহ! আমরা আপনার সাহায্য চাই।”

দুআ করার সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) আকাশের দিকে দু’হাত উত্তোলন করেন। ফলে কাঁধের উপরে রাখা চাদর নীচে পড়ে যায়। আবু বকর (রা) রাসূল (সা)-এর পশ্চাতে থেকে চাদর পুনরায় কাঁধে তুলে দেন। রাসূলুল্লাহর অধিক কান্নাকাটির জন্যে তিনি সদয় হয়ে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এখন শেষ করুন। আল্লাহ। আপনার দুআ কবুল করেছেন। শীঘ্রই তিনি প্রতিশ্রুত সাহায্য পাঠাবেন।

সুহায়লী কাসিম ইবন ছাবিতের বক্তব্যের উদধূতি দিয়ে বলেছেন যে, আবু বকর (রা)-এর এই “ক্ষান্ত হোন, আপনার দু’আ কবুল হয়েছে” বলে যে উক্তি, তা তিনি করেছেন সহানুভূতির দৃষ্টিতে। যখন তিনি দেখলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) একান্ত নিবিড় চিত্তে আল্লাহর কাছে দুআ করছেন ও কান্নাকাটি করছেন; এমনকি তার কাঁধ থেকে চাদর পড়ে যাচ্ছে, তখন তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! এখন ক্ষান্ত হোন অর্থাৎ নিজের জীবনকে আর কষ্ট দেবেন না। আল্লাহ, তো আপনাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আবু বকর ছিলেন কোমল হৃদয় ও রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর অত্যধিক অনুরাগী। সুহায়লী এ প্রসংগে তার উস্তাদ আবু বকর ইবন আরাবীর ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা) ছিলেন খওফ-এর মাকামে। আর আবু বকর সিদীক (রা) ছিলেন রাজা (আশা)-এর মাকামে। আর ঐ মুহুর্তটা ছিল প্ৰচণ্ড ভয়ের মুহুর্ত। কেননা, আল্লাহর তো এ ক্ষমতা রয়েছে যে তিনি যা ইচ্ছা করতে পারেন। সে জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মধ্যে এই ভীতি বিরাজ করে যে, এর পরে পৃথিবীতে হয়তো আর ইবাদত করার লোক থাকবে না। তাঁর এই ভীতিটাও ছিল ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। কোন কোন সূফী বলেছেন, এ দিনের অবস্থােটা ছিল গারে ছাওর-এর বিপরীত অবস্থা। কিন্তু এ উক্তি সম্পূর্ণ ভ্ৰান্ত ও এ মত অগ্রহণযোগ্য। কেননা, এ উক্তির মধ্যে যে কত বড় ভ্ৰান্তি নিহিত আছে–এ কথা মেনে নিলে এর সাথে আরও কি কি কথা মেনে নেয়া হয় এবং তাঁর পরিণতি কী দাঁড়ায় ঐ সূফীগণ তা ভেবে দেখেননি।

যুদ্ধ বাধার পূর্ব মুহুর্তের চিত্রটা ছিল এ রকম যে, তখন দু’টি বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি দু’টি দল একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রস্তুত। দয়াময় আল্লাহর সামনে দুটি বিবদমান পক্ষ উপস্থিত। এদিকে নবীকুলের সর্দার তাঁর প্রতিপালকের কাছে সাহায্য লাভের ফরিয়াদে রত। সাহাবাগণ বিভিন্ন প্রকার দু’আ-মুনাজাতের মাধ্যমে ফরিয়াদ জানাচ্ছেন সেই সত্তার কাছে, যিনি। ভূ-মণ্ডল-নভঃমণ্ডলের মালিক। মানুষের দুআ শ্রবণকারী ও বিপদ থেকে মুক্তিদানকারী। যুদ্ধে মুশরিকদের পক্ষে সর্বপ্রথম যে নিহত হয়, তার নাম আসওয়াদ ইবন আবদুল আসাদ মািখযুমী। ইবন ইসহাক বলেন, সে ছিল খুবই ঝগড়াটে ও জঘন্য চরিত্রের লোক। সে কসম করে বলেছিল যে, আমি মুসলমানদের তৈরি হাওয থেকে পানি পান করবই, না হলে অন্তত তা নষ্ট করে দেবাে। এ জন্যে যদি প্রাণ দিতে হয় দেবো। এ উদ্দেশ্যে সে দল থেকে বেরিয়ে এলো। হামযা ইবন আবদুল মুত্তালিব তার দিকে ধাবিত হলেন। দু’জনে মুখোমুখি হলে হামযা তরবারি দ্বারা আঘাত করলেন। এতে তার পায়ের গোছা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তার নিকটেই ছিল হাওয।

কর্তিত পা হাওয্যের গায়ে যেয়ে পড়লো। পায়ের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে তার সঙ্গীদের দিকে যেয়ে পড়তে লাগলো। ঐ অবস্থায় সে হামাগুড়ি দিয়ে হাওয্যের নিকটে গেল এবং হাওয্যের মধ্যে গড়িয়ে পড়লো। এ ভাবে সে তার কসম রক্ষা করার শেষ প্রচেষ্টা চালালো। হামযা তার পশ্চাদ্ধাবন করে হাওয্যের মধ্যেই তলোয়ারের আঘাতে তাকে হত্যা করেন। উমাবী বলেন : এ সময় উত্বা ইবন রাবীআ উত্তেজিত হয়ে রীরত্ব প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আপন সহোদর শায়বা ইবন রাবী’আ ও পুত্র ওয়ালীদ ইবন উতবাকে নিয়ে স্বীয় বৃহ থেকে বেরিয়ে আসে। উভয় দলের মাঝখানে এসে তারা মল্লযুদ্ধের জন্যে চ্যালেঞ্জ করে। তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে মুসলমানদের মধ্য থেকে তিনজন আনসার সাহাবী বেরিয়ে তাদের সম্মুখে যান। তাঁরা হলেন আওফ ও মুআয— এদের পিতার নাম হারিছ এবং মাতার নাম আফরা। তৃতীয়জন আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা ॥১

এদের দেখে কুরায়শীরা জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কারা? তারা জবাব দিলেনঃ আমরা আনসার। কুরায়শরা বললো : তোমাদের দিয়ে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। অন্য বর্ণনা মতে তারা বলেছিল? তোমরা আমাদের পর্যায়ের সম্মানিত লোক। কিন্তু আমাদের নিকট আমাদের বংশের লোকদের পাঠাও! তাদের একজন চিৎকার করে বললো : হে মুহাম্মদ। আমাদের বিরুদ্ধে আমাদের বংশের সমকক্ষ লোক পাঠাও। তখন নবী করীম (সা) কুরায়শের তিন জনের নাম উল্লেখ করে বললেন, ওঠে হে উবায়দা ইবন হারিছ! ওঠে হে হামযা! ওঠো হে আলী! (তোমরা তাদের মুকাবিলা কর)। উমাবীর মতে মল্লযুদ্ধের জন্যে যখন তিনজন আনসার বের হয়ে যান, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তা পসন্দ করেননি। কারণ, এটা ছিল শক্ৰদের সাথে রাসূলুল্লাহর প্রথম যুদ্ধ। তাই তিনি চাচ্ছিলেন প্রথম মুকাবিলাটা নিজ গোত্রের লোক দিয়েই হোক। সে জন্যে তিনি আনসার তিনজনকে ফিরিয়ে আনেন এবং কুরায়শ তিনজনকে পাঠিয়ে

(Met

ইবন ইসহাক বলেনঃ এ তিনজন তাদের সম্মুখে গেলে তারা জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কারা? এরূপ প্রশ্ন থেকে বুঝা যায় যে, তারা যুদ্ধের পোশাক দ্বারা দেহ এমন ভাবে আবৃত করেছিলেন যে, তাদেরকে চেনা যাচ্ছিল না। তাই প্ৰত্যেকেই নিজ নিজ পরিচয় দিলেন। তারা বললো, হ্যা— এবার ঠিক আছে— সমানে সমান হয়েছে। এরপর মুসলিম তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক উবায়দা উতবার সাথে, হামযা শায়বার সাথে এবং আলী ওয়ালীদের সাথে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হন। হামযা ও আলী প্রতিপক্ষকে পাল্টা আঘাতের সুযোগ না দিয়ে প্রথম আঘাতেই যথাক্রমে শায়বা ও ওয়ালীদকে হত্যা করলেন। কিন্তু উবায়দা ও উতবা প্রত্যেকেই প্রতিপক্ষকে আঘাত করে আহত করেন। এ অবস্থা দেখে হামযা ও আলী একযোগে উতবার উপর হামলা করে তাকে হত্যা করেন এবং উবায়দাকে উঠিয়ে মুসলিম শিবিরে নিয়ে যান ॥২

১. ওয়াকিদী বলেন, : বের হওয়া তিনজনই আফরার পুত্র। তাদের নাম মুআয’ মুআওয়ায্য ও আওফ।

২. ইবনুল আহীর তার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন : আবু উবায়দার পা কেটে যায়। নবী (সা)-এর কাছে জিজ্ঞেস

করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি কি শহীদ হবাে না? তিনি বললেন হ্যা।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। আবু মিজলায্য কায়স ইবন উবাদ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আবু যর (রা) কসম করে বলতেন :

هذان خصمان اختصموا فیر بهم

এরা দু’টি বিবদমান পক্ষ— তারা তাদের প্রতিপালক সম্বন্ধে বিতর্কে লিপ্ত (২২ : ১৯) { আয়াতটি বদর যুদ্ধে হামযা ও তাঁর সঙ্গী এবং উত্বা ও তার সঙ্গীদের দ্বন্দুযুদ্ধ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। (বুখারী তাফসীর অধ্যায়)। বুখারী মাগাষী অধ্যায়ে হাজাজ ইবন মিনহাল. কায়স ইবন উবাদের সূত্রে বর্ণিত। আলী ইবন আবু তালিব (রা) বলেন, : আমিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন রাহমান আল্লাহর সামনে বিবাদের মীমাংসার জন্যে হাঁটু গেড়ে বসবো। কায়স هذان خصمان اختص موافی ربه–8 ۹۹ م.)f{SII 6)}۱۹۶۹), ۶۲۹)>

“এরা দু’টি বিবাদমান পক্ষা” আয়াতটি নাযিল হয়। তিনি বলেন, তারা হলেন (মুসলিম পক্ষে) আলী, হামযা, উবায়দা এবং (মুশরিকদের পক্ষে) শায়াবা ইবন রাবীআ, উতবা ইবন রাবী’আ ও ওয়ালীদ ইবন উতবা। তাফসীর গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

উমাবী বলেন, মুআবিয়া ইবন আমর. আবদুল্লাহ আল বাহী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বন্দরে মল্লযুদ্ধের জন্যে উতবা, শায়বা ও ওয়ালীদ অগ্রসর হয়। তাদের মুকাবিলার জন্যে হামযা, উবায়দা ও আলী এগিয়ে যান। সামনে গেলে তারা বললো, তোমাদের পরিচয় দাও যাতে করে আমরা তোমাদেরকে চিনতে পারি। হামযা বললেন? আমি আল্লাহ ও তার রাসূলের সিংহ। আমার নাম হামযা ইবন আবদুল মুত্তালিব। উতবা বললো, খুব ভাল, উত্তম প্রতিপক্ষ হয়েছে। আলী বললেন, আমি আল্লাহর বান্দা। আমি রাসূলুল্লাহর ভাই। উবায়দা বললেন, আমি এ দু’জনেরই মিত্র। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। একজনের বিরুদ্ধে একজন মুকাবিলা করে। কুরায়শ পক্ষের তিনজনই আল্লাহর হুকুমে নিহত হয়। এ প্রসঙ্গে হিনদ বিনত উতবা নিম্নরূপ শোকগাথা আবৃত্তি করে :

آعینی جودی بد مع سرب–علی خیر خند ف لم ینقلاب تداعی لبه رهبطه غدوة–بنو هاشم و بنو المطلب يذيقونه حداً أسيافهم – يعاونه بعد ما قد عطب অর্থ : হে আমার চক্ষুদ্বয়। প্রবাহিত অশ্রু দ্বারা বদান্যতা দেখাও:–বনু খুনন্দুফের উত্তম ব্যক্তির (উতবা) উপর, যে আর ফিরে আসেনি।

উষাকালে তাকে আহবান করেছে তার গোত্রের বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব। তারা তাকে তরবারির স্বাদ আস্বাদন করিয়েছে এবং নিহত হবার পরও তার লাশের উপর উপযুপরি আঘাত হেনেছে।

এই কারণে হিনদা হযরত হামযার কলিজা চিবিয়ে খাওয়ার মানত করে।

উবায়দার পূর্ণ পরিচয় হলো উবায়দা ইবন হারিছ ইবন মুত্তালিব ইবন আবদে মানাফ। তাকে তার সাথীরা তুলে এনে রাসূলুল্লাহর তাবুর মধ্যে তার পাশে চিত করে শুইয়ে রাখেন।

–ܙܠ ܟܐ)

রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিজের পা মুবারক বিছিয়ে দেন। উবায়দা তাঁর পায়ের উপর গাল রেখে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আজি যদি আবু তালিব আমাকে এ অবস্থায় দেখতেন, তবে ভাল ভাবেই জানতে পারতেন যে, তার কথা সত্যে পরিণত করার আমিই অধিকতর হকদার। যাতে তিনি বলেছিলেন :

و نسلمهٔ حتی نصرع دونه–و نذهل عن ابناثنا و الحلائل (হে কুরায়শরা! তোমাদের এ ধাবণাও মিথ্যা যে,)। আমরা তাকে (মুহাম্মদকে)

তোমাদের হাতে সোপর্দ করে দেবো, যতক্ষণ না তার হিফাযতের জন্যে আমরা ধরাশায়ী হয়ে যাই এবং আমাদের স্ত্রী-পুত্রদেরকে ভুলে যাই।।১

এরপর হযরত উবায়দার মৃত্যু হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন— আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি। তুমি শহীদ। ইমাম শাফিঈ (রহ) এ কথা বর্ণনা করেছেন। বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীতে প্রথম শহীদ উমর ইবন খাত্তাবের আযাদকৃত গোলাম মাহজা’ (২ দূর থেকে নিক্ষিপ্ত এক তীরের আঘাতে তিনি শহীদ হন। ইবন ইসহাকের মতে, তিনি ছিলেন প্রথম শহীদ। এরপর আদী ইবন নাজাজার গোত্রের হারিছ। ইবন সুরাকা হাওয থেকে পানি পান করার সময় শক্ৰদের নিক্ষিপ্ত তীর তার বুকে লাগায় তিনিও নিহত হন। বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, আনাস (রা) বলেন, হারিছা! ইবন সুরাকা। বদর যুদ্ধে নিহত হন। তিনি যুদ্ধ পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। হঠাৎ এক তীর এসে তার দেহে বিদ্ধ হলে তিনি শহীদ হন। সংবাদ শুনে তার মা এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে হারিছার কথা বলুন। সে যদি জান্নাতবাসী হয়, তা হলে আমি ধৈর্য ধারণ করবো। আর যদি অন্য কিছু হয়, তা হলে আল্লাহ দেখবেন আমি কিরূপ কান্নাকাটি করি। উল্লেখ্য, তখন পর্যন্ত মৃতের জন্যে উচ্চৈঃস্বরে কান্নাকাটি করা নিষিদ্ধ হয়নি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে বললেন, : বলো কি, তুমি কি পাগল হয়েছো? জান্নাত তো আটটি। আর তোমার ছেলে তো এখন সবোচ্চ মর্যাদার জান্নাত ফিরদাউসে অবস্থান করছে।

ইবন ইসহাক বলেন, : এরপর উভয় বাহিনী পরস্পরের দিকে এগিয়ে গেলো এবং একে

অন্যের নিকটবতী হলো। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর লোকদের বললেন, আমার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তোমরা আক্রমণ করো না। যদি তারা তোমাদের ঘিরে ফেলে তা হলে তীর নিক্ষেপ করে

১. আবু তালিব এক নাতিদীর্ঘ কাসীদার মাধ্যমে আরববাসীকে জানিয়ে দেয় যে, আমি মুহাম্মদের ধর্ম গ্ৰহণ করিনি, তবে তাকে কখনও শত্রুর হাতে ছেড়ে দেবো না, জীবন দিয়ে রক্ষা করবো। উল্লিখিত পংক্তির পূর্বের পংক্তি এই :

کذبتم و بیت الله نخلی محمد–ولما نطاعن دونه وننا ظل অর্থ : বায়তুল্লাহর শপথ, তোমরা মিথ্যা বলছে যে, মুহাম্মদকে আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেয়া হবে। অথচ তাকে রক্ষার জন্যে আমরা এখনও পর্যন্ত তীর-বর্শা নিক্ষেপ করিনি (ওয়াকিদী)। ২. তাকে হত্যা করে আমির ইবন হাযরামী (ইবন সাআদ)। আনসারদের মধ্যে প্রথম শহীদ হারিছা— তাকে হত্যা করে হাব্বান আরকােতা। কারও মতে উমােয়র ইবন হুমাম। তার হত্যাকারী খালিদ ইবন আ’লাম উকায়লী। ইবন উকবা বলেন, বদরের প্রথম শহীদ উমােয়র (বায়হাকী ৩/১১৩; ইবন সাআদ ২/১১২. ইবন आशैख़ २/>२७)।

তাদেরকে সরিয়ে দিবে। বুখারী শরীফে আবু উসায়দ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধের দিনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের নির্দেশ দেন যে, মুশরিকরা যদি তোমাদের নিকটে এসে যায়, তবে তাদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করো এবং তীর বাঁচিয়ে রেখো। বায়হাকী বলেন : হাকিম. ইবন ইসহাকের সূত্রে আবদুল্লাহ ইবন যুবােয়র থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা) বিভিন্ন গোত্রের মুজাহিদদের পরিচয়ের জন্যে বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করেন। সুতরাং মুহাজিরদের আহবান করার জন্যে “ইয়া বনী আবদির রাহমান”, খাযরাজ গোত্রের কাউকে আহবান করার জন্যে “ইয়া বনী আবদিল্লাহ” শব্দ নির্ধারণ করে দেন। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজের ঘোড়ার নাম রাখেন “খায়লুল্লাহ”। ইবন হিশাম বলেন, : ঐ দিন মুজাহিদ সাহাবীদের সাধারণ সংকেতসূচক শব্দ ছিল “আহাদ আহাদ”।

ইবন ইসহাক বলেন, : রাসূলুল্লাহ (সা) উঁচু স্থানে ছাপরার মধ্যে অবস্থান করছিলেন। আবু বকর (রা) তার সাথে ছিলেন। এ সময় তিনি আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। যেমন আল্লাহ বলেন :

اذ تستغيثون ربكم فاستجاب لكم أنى ممدّكم بألف من الملئكة مردفين وما جعلة اللّة الأبشنزى والتطمئن به قلوبكم وما النّصر الأمن عند اللّه أن

অর্থ ও স্বরণ করা, তোমরা যখন তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে, তিনি তা কবুল করেছিলেন এবং বলেছিলেন, আমি তোমাদের সাহায্য করবো এক হাযার ফেরেশতা দ্বারা, যারা একের পর এক আসবে। আল্লাহ এটা করেন কেবল শুভ সংবাদ দেয়ার জন্যে এবং এ উদ্দেশ্যে যাতে তোমাদের চিত্ত প্রশান্তি লাভ করে এবং সাহায্য তো শুধু আল্লাহর নিকট হতেই আসে। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় (৮ : ৯-১০)।

ইমাম আহমদ বলেন, : আবু নূহ কারাদ….. উমর ইবন খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবাগণের প্রতি লক্ষ্য করেন। তাদের সংখ্যা ছিল তিনশ’র কিছু বেশী। এরপর তিনি মুশরিকদের প্রতি লক্ষ্য করেন। ওদের সংখ্যা ছিল এক হাযারেরও বেশী। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) চাদর মুড়ি দিয়ে কিবলামুখী হন এবং দু’আ পাঠ করেন : হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা পূরণ করুন। “হে আল্লাহ! আজি যদি ইসলামের এ দলটিকে আপনি ধ্বংস করেন তা হলে পৃথিবীর বুকে আর কখনও আপনার ইবাদত করা হবে না।”

রাসূলুল্লাহ্ (সা) অব্যাহত ভাবে আল্লাহর নিকট এরূপ ফরিয়াদ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তার কাঁধ থেকে চাদর পড়ে যায়। আবু বকর (রা) এসে চান্দরটি কাঁধে উঠিয়ে দেন এবং পশ্চাৎ

দিক থেকে রাসূলুল্লাহকে ধরে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যথেষ্ট হয়েছে! আপনি আপনার প্রতিপালকের নিকট আবেদন করেছেন। অচিরই তিনি তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেন। এ সময়

আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন, (১.৩,,,,,, …. …। “স্মরণ করা, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে। তিনি তা কবুল করেছিলেন এবং বলেছিলেন, আমি তোমাদের সাহায্য করবো এক হাস্যার ফেরেশতা দিয়ে—— যারা একের পর এক আসবে.)। ইমাম আহমদ হাদীছের পুরোটাই বর্ণনা করেছেন। আমরা সামনে তা উল্লেখ করবো। এ হাদীছ ইমাম মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিয়ী, ইবন জারীর ও অন্যান্য মুহাদিছগণ ইকরিমা ইবন আম্মার ইয়ামানী সূত্রে বর্ণনা করেছেন এবং আলী ইবন মাদানী ও তিরমিয়ী সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। সুদী, ইবন জারীর ও আরও কিছু বর্ণনাকারী ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন যে, এ আয়াত বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দু’আর পরিপ্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছিল। উমাবী ও অন্যরা বলেছেন যে, মুসলিম সৈন্যগণ ও সে দিন আল্লাহর নিকট আশ্রয় ও সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। আল্লাহর বাণী : ৩, :১১–v < 1.1 ৩,–JL –এক সহস্ৰ ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করবেন— যারা একের পর এক আসবে। এর অর্থ হলো, ফেরেশতাগণ তোমাদের পশ্চাতে থাকবে ও তোমাদের বাহিনীকে সাহায্য করবে। ইবন আব্বাস থেকে আওফী এ ব্যাখ্যাই বৰ্ণনা করেছেন। মুজাহিদ ইবন কাহীর এবং আবদুর রহমান ইবন যায়দ প্রমুখ ও এ অর্থ করেছেন। আবু কুদায়না (র) কাবুস থেকে, তিনি ইবন আব্বাস থেকে (৩১, :৩.৯ –একের পর এক)-এর অর্থ লিখেছেন— প্রতি একজন ফেরেশতার পিছনে একজন ফেরেশতা থাকবে। এই একই সনদে ইবন আব্বাস থেকে ৩, :৩.০–এর আর একটি অর্থ পাওয়া যায়। তা হলো, প্রত্যেক ফেরেশতা তার সামনের ফেরেশতাকে অনুসরণ করবেন। আবু যুবইয়ান দাহহাক ও কাতাদা। এ অর্থই গ্রহণ করেছেন। আলী ইবন আবু তালহা ওয়ালিবী (র) ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন : আল্লাহ তার নবী ও মু’মিনদেরকে এক হাযার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করেন। তাদের মধ্যে জিবরাঈলের নেতৃত্বে পাঁচশ’ ফেরেশতা ছিলেন এক পার্শ্বে এবং মীকাইলের নেতৃত্বে পাঁচশ’ ফেরেশতা ছিলেন অন্য পার্শ্বে। এটাই প্রসিদ্ধ কথা। কিন্তু ইবন জারীর— আলী (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, জিবরাঈল (আ) এক হাযার ফেরেশতা নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ডান পার্শ্বে অবতরণ করেন। উভয়ের মাঝখানে ছিলেন। হযরত আৰু বকর (রা) এবং মীকাঈল (আঃ) আর এক হাযার ফেরেশতা নিয়ে রাসূলুল্লাহর বাম পার্শ্বে অবতরণ করেন এবং আমি ছিলাম। বাম পার্শ্বে। এ হাদীছটি ইমাম বায়হাকী তাঁর ‘দালাইল” গ্রন্থে আলী (রা) থেকে কিছু অতিরিক্তসহ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ইসরাফীল (আ.) ও এক হাযার ফেরেশতাসহ অবতীর্ণ হন এবং তিনি বর্শা দ্বারা যুদ্ধ করেন। ফলে তার বগল রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। বায়হাকীর এ বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, বন্দরে মোট তিন হাযার ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু এটা অপ্ৰসিদ্ধ বর্ণনা এবং এর সনদ দুর্বল। আর সনদ যদি সহীহ হয়, তবে ইতোপূর্বে উল্লিখিত বর্ণনাগুলো এর দ্বারা সমর্থিত হবে। তা ছাড়া ৩,–১,–৩, ১১:১২, 1 < 1.1 –এর ৬, ৭১. শব্দে (১)-এর উপর যাবর দিয়ে পড়লে ঐ মতটি আরও শক্তিশালী হয়। একটি কিরাআত এই রকম আছে। বায়হাকী বলেন, হাকিম. আলী ইবন আবু তালিব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, : বদর যুদ্ধে আমি অল্পক্ষিণ যুদ্ধ চালিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) কী

করছেন তা দেখার জন্যে দ্রুত ছুটে যাই। গিয়ে দেখি তিনি সিজদাবনত হয়ে আছেন এবং বলছেন :–১, : L·–>L. — • • • • L”, “-L) (হে চিরঞ্জীব, হে চিরস্থায়ী) } এর চেয়ে বেশী কিছু বলছেন না। আমি আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে গেলাম। কিছুক্ষণ পর পুনরায় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট চলে আসলাম। দেখলাম, তিনি পূর্বের ন্যায় সিজদায় পড়ে আছেন ও সেই একই তাসবীহ অনবরত পড়ে যাচ্ছেন। আমি আবার যুদ্ধক্ষেত্রে গেলাম। তারপরে ফিরে এলাম। দেখলাম, তখনও তিনি সিজদায় আছেন এবং ঐ দু’আই পড়ছেন। অবশেষে এ অবস্থার মধ্যে আল্লাহ আমাদের বিজয় দান করলেন। ইমাম নাসাঈ বুনন্দার, উবায়দুল্লাহ ইবন আবদুল মজীদ আবু আলী হানাফীর বরাত দিয়ে এ ঘটনার উল্লেখ করে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) যুদ্ধের রাত্রে ও দিনে এ দু’আ করেছিলেন। আমাশ আবু ইসহাক থেকে, তিনি আবু উবায়দা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দুআ প্রসঙ্গে বলেছেন যে, বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্যে যেরূপ অনুনয়-বিনয় করেছিলেন. অন্য কোন প্রার্থনাকারীকে সেরূপ অনুনয়-বিনয় করতে আমি কখনও দেখিনি। তিনি বলছিলেন : “হে আল্লাহ! আমি আপনার দেয়া প্ৰতিশ্রুতি ও ওয়াদার বাস্তবায়ন কামনা করি। হে আল্লাহ! এ ক্ষুদ্র দলটি যদি আজ ধ্বংস হয়ে যায়, তা হলে আপনার ইবাদত করার কেউ থাকবে না৷ ” এরপর তিনি ফিরে তাকালেন। মনে হলো যেন তার চেহারায় পূর্ণিমার চাদ উদ্ভাসিত হয়েছে। তিনি বললেন, আমি যেন শক্ৰদের নিহত হয়ে পড়ে থাকার স্থানগুলো দেখতে পাচ্ছি। নাসাঈ এ ঘটনা আমাশের বরাতে বর্ণনা করেছেন। তাতে আছে, ইবন মাসউদ বলেন : আমরা যখন বন্দরে শত্রুর মুখোমুখি হই, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) দু’আয় মনােনিবেশ করেন। তিনি তাঁর প্রার্থিত লক্ষ্য অর্জনের জন্যে যে ভাবে আবেদন-নিবেদন করলেন, সেভাবে করতে আমি কাউকে দেখিনি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুশরিক নেতাদের নিহত হওয়ার স্থান সম্পর্কে বদর যুদ্ধের দিনে সাহাবাগণকে অবহিত করেছিলেন। এ বিষয়ে সহীহ মুসলিমে উদধূত আনাস ইবন মালিকের বর্ণনা ইতোপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি। মুসলিমে উমর ইবন খাত্তাবের বর্ণিত হাদীছটিও আমরা উল্লেখ করবো। ইবন মাসউদের বর্ণিত হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা) এ সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন বদর যুদ্ধের দিনে এটাই যথার্থ। পক্ষান্তরে আনাস ও উমর ইবন খাত্তাব বর্ণিত হাদীছদ্বয় হতে বুঝা যায় যে, তিনি ঐ দিনের একদিন পূর্বেই এ সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। তবে উক্ত দুই প্রকারের বক্তব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে কোন অসুবিধা নেই। কেননা, হতে পারে তিনি যুদ্ধের একদিন পূর্বে কিংবা তারও বেশী পূর্বে এ বিষয়ে অবহিত করেছিলেন এবং পুনরায় যুদ্ধের দিনে যুদ্ধ বাধার কিছুক্ষণ পূর্বে আর একবার অবহিত করেন।

ইমাম বুখারী একাধিক সূত্রে খালিদ আল-হাযযা’, ইকরিমার বরাতে ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সা) বদর যুদ্ধের দিন তাঁর নির্ধারিত ছাপরা থেকে এভাবে দু’আ করেন : হে আল্লাহ! আমি আপনার দেয়া প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার কার্যকরী করার জোর ফরিয়াদ জানাচ্ছি। হে আল্লাহ! আপনি যদি চান আজকের দিনের পরে আর কখনও আপনার ইবাদত করা হবে না…..। তখন আবু বকর (রা) তার হাত ধরে বসলেন এবং বললেন, : ইয়া

রাসূলাল্লাহ! যথেষ্ট হয়েছে। আপনি আপনার প্রভুর কাছে অনেক মিনতি করেছেন। এ সময় তিনি লৌহ বৰ্ম পরা অবস্থায় বেরিয়ে আসলেন এবং এ আয়াত পড়তে লাগলেন :

سینهزم الجمع و یولون الدبر بل الساعهٔ موعد هم والساعهٔ آذهی

آمر

এ দল তো শীঘ্রই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে। অধিকন্তু কিয়ামত তাদের শাস্তির নির্ধারিত কাল এবং কিয়ামত হবে কঠিনতর ও তিক্ততর (৫৪ : :৫-৪৬)। এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় মক্কায়, আর এর বাস্তবায়ন হয় বদরের দিনে। যেমন ইবন হাতিম… ইকরিম থেকে বর্ণনা করেন : যখন v।| 31, 2, …”।–54.. আয়াতটি নাযিল হয়, তখন উমর (রা) বলেছিলেন, কোন দল পরাজিত হবে? কোন দল জয়লাভ করবে? উমর (রা) বলেন, এরপর বদর যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন লৌহ বর্ম পরিধান করে এ আয়াত পড়তে লাগলেন?

سيهزم الجمع ويولون الدُبر بل الساعة موعدهم والساعة أذهى

امر তখন আমি এর সঠিক মর্ম উপলব্ধি করতে পারলাম। ইমাম বুখারী ইবন জুরায়জ। সূত্রে আইশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন :

بل الساعة موعدهم والساعة أذهى وأمر

ইবন ইসহাক বলেন, : রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর প্রভুর নিকট সেই সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকেন, যার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন। প্রার্থনায় তিনি বলেন, : হে আল্লাহ! আজি যদি আপনি এ ক্ষুদ্র দলটিকে শেষ করে দেন, তা হলে আপনার ইবাদত করার কেউ আর থাকবে না। আবু বকর (রা) বলছিলেন, হে আল্লাহর নবী! আপনার প্রভুর কাছে আপনার যথেষ্ট প্রার্থনা করা হয়েছে। তিনি আপনাকে দেয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি অবশ্যই পূরণ করবেন। এরপর নবী করীম (সা) ছাপরার মধ্যে সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। মুহুর্তের মধ্যে তন্দ্ৰা কেটে গেলে তিনি বললেন, হে আবু বকর! সু-সংবাদ গ্রহণ করা। তোমার কাছে আল্লাহ সাহায্য এসে গেছে। এই তো জিবরীল

ফেরেশতা তার ঘোড়ার লাগাম ধরে টানছেন। ঘোড়ার সামনের দাঁতগুলোতে ধুলাবালি লেগে 2

এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) ছাপরার মধ্য থেকে বের হয়ে লোকদের যুদ্ধে যেতে উদ্ধৃদ্ধ করেন। এ পর্যায়ে তিনি বলেন : ঐ সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মদের জীবন। আজ যে লোক ধৈর্যের সাথে সওয়ারে উদ্দেশ্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্ৰাণপণে লড়াই করবে, সম্মুখে অগ্রসর হবে, পশ্চাদপদ হবে না, আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন। বনু সালামা গোত্রের উমােয়র ইবন হুমাম তখন কয়েকটি খেজুর হাতে নিয়ে খাচ্ছিলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, বেশ তো আমার ও জান্নাতে

প্রবেশের মাঝে তাদের হাতে আমার নিহত হওয়া ছাড়া আর বাধা কি? রাবী বলেন, এরপর তিনি হাতের খেজুর ছুড়ে ফেলে তলোয়ার নিয়ে শক্রির মাঝে ঝাপিয়ে পড়লেন এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।

ইমাম আহমদ বলেন, হাশিম ইবন সুলায়মান (র) ছাবিত থেকে, তিনি আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ্ (সা) আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলার গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্যে বসবাসকে গোয়েন্দা হিসেবে প্রেরণ করেন। তারপর তিনি ফিরে এলেন। তখন ঘরের মধ্যে আমি ও নবী করীম (সা) ব্যতীত আর কেউ ছিল না। রাবী (ছাবিত) বলেন, আমার স্মরণ পড়ছে না, আনাস নবীর কোন সহধর্মিণীর ঘরে থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। কিনা। তারপর তিনি বিস্তারিত ভাবে হাদীছটি বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)। ঘর থেকে বেরিয়ে লোকজনের সাথে আলাপ করেন এবং ঘোষণা দেন যে, শক্রর সন্ধানে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। তাই যাদের বাহন মওজুদ আছে, তারা যেন তাদের বাহন নিয়ে আমাদের সাথী হয়। কিছু লোক মদীনার উচ্চ এলাকা থেকে তাদের বাহনজন্তু নিয়ে আসার জন্যে রাসূলুল্লাহর কাছে অনুমতি চাইলে তিনি বললেন, : না, যাদের বাহন। এখন প্রস্তুত আছে কেবল তারাই যাবে। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর সাহাবীগণ রওনা হন এবং মুশরিকদের পূর্বেই বন্দরে উপস্থিত হন। এরপরে মুশরিকরা সেখানে পৌছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) সাহাবীগণকে বললেন তোমরা কেউ কাজে নিজেরা অগ্রসর হবে না, যতক্ষণ না আমি সে কাজের সামনে থাকি। এরপর মুশরিকরা নিকটবতী হলো। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তোমরা জান্নাত লাভের জন্যে অগ্রসর হও— যার প্রশস্ততা আসমান-যমীনের সমান। আনাস বলেন, তখন উমায়ার ইবন হুমাম আনসারী বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! জান্নাতের প্রশস্ততা কি আসমান-যমীনের সমান? তিনি বললেন, হ্যা। উমােয়র বললেন, : বেশ বেশ! রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, উমােয়র! বেশ বেশ বলতে তোমাকে কিসে উদ্বুদ্ধ করলো? উমােয়র জানালেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অন্য কিছু নয়, আল্লাহর কসম, ঐ জান্নাতে যাওয়ার আশায়ই আমি এ রকম বলেছি। রাসূলুল্লাহ বললেন, অবশ্যই তুমি তার অধিবাসী হবে। এরপর তিনি তার থলে থেকে কিছু খুরমা বের করে খেতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আবার মর্ম বললেন, এই খুরমা খাওয়ার শেষ পর্যন্ত যদি আমি বেচে থাকি, তা হলে তো আমার জীবন অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। সুতরাং খুরমাগুলো তিনি দূরে নিক্ষেপ করে যুদ্ধে চলে গেলেন এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হলেন। ইমাম মুসলিম এ হাদীছ আবু বকর ইবন আবু শায়বা ও একাধিক রাবী থেকে এবং আবুন-নািযর হাশিম ইবন কাসিম, সুলায়মান ইবন মুগীরা থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবন জারীর বলেন, : উমােয়র যুদ্ধ করার সময় এই কবিতাটি আবৃত্তি করেন :

ر کامضا الی الله بغیر زاد + الا التقی و عملی العاد

والصبر فی الله علی الجهاد + و کلی زاد عرضة النفاد

غیر التقی و البر و الرشاد

অর্থ : “কোন রকম পাথেয় ছাড়াই আমি আল্লাহর পথে দৌড়ে চলে এসেছি। পাথেয় বলতে আছে শুধু আল্লাহর ভয় ও পরকালে মুক্তির চিন্তা। জিহাদে প্রয়োজন আল্লাহর জন্যে ধৈর্য ধরা। দুনিয়ার সব পাথেয়ই তো শেষ হয়ে যাবে। শেষ হবে না কেবল তাকওয়া, পুণ্য ও সঠিক “ן וtQ<‘

ইমাম আহমদ বলেন, : হাজ্জাহ, ইসরাঈল, আবু ইসহাক, হারিছা ইবন মুদরিব, আলী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা হিজরত করে মদীনায় আসলে সেখানকার ফলমূল খেয়ে আমাদের শরীরে জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু হয় এবং আমরা জুরে আক্রান্ত হই। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বদর সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। যখন আমরা জানলাম যে, মুশরিকরা রওনা হয়ে পড়েছে, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বদরের পথে যাত্রা শুরু করেন। বস্তুত বদর একটি কুয়োর নাম। মুশরিকদের আগেই আমরা তথায় পৌছে। যাই। সেখানে দু’জন লোককে দেখতে পাই। তাদের মধ্যে একজন কুরায়শী, অন্যজন উকবা ইবন আবু মুআয়তের আযাদকৃত গোলাম। কুরায়শাটি আমাদেরকে দেখে পালিয়ে যায়, কিন্তু গোলামটিকে আমরা ধরে ফেলি। তার কাছে আমরা জিজ্ঞেস করি, কুরায়শরা সংখ্যায় কত? সে উত্তরে বলে, আল্লাহর কসম, তাদের সংখ্যা অনেক, শক্তি প্রচুর। সে বারবার এরূপ উত্তর দেয়ায় মুসলমানরা তাকে প্রহার করেন এবং শেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট নিয়ে আসেন। তিনি গোলামটিকে জিজ্ঞেস করলেন, কুরায়শদের সংখ্যা কত? সে একই উত্তর দিল, আল্লাহর কসম, তাদের সংখ্যা অনেক।–শক্তি অধিক। রাসূলুল্লাহ (সা) তার থেকে কুরায়শদের সংখ্যা জানতে বারবার চেষ্টা করেন, কিন্তু সে এড়িয়ে যায়। এরপর নবী করীম (সা) জিজ্ঞেস করলেন, তারা প্রতিদিন কয়টি উটি যাবাহ করে? সে বললো, দশটা। নবী করীম (সা) বললেন, তাদের সংখ্যা এক হাযার। প্রতি একটা উট একশ’ জনে খায়। ঐ রাত্রে মুষলধারে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে আমরা বৃক্ষের নীচে ও ঢালের তলে আশ্রয় নিই। রাসূলুল্লাহ (সা) রাত্রে তাঁর প্রভুর নিকট প্রার্থনায় বলেন, : “আয় আল্লাহ আপনি যদি আজ এই ছোট্ট দলটিকে খতম করে দেন, তবে আপনার ইবাদত করার মত কেউ থাকবে না।” রাত শেষ হলো। ফজরের সালাত আদায় করার জন্যে তিনি “হে আল্লাহর বান্দাগণ”! বলে সবাইকে আহবান করেন। ডাকে সাড়া দিয়ে লোকজন বৃক্ষ ও ঢালের নীচ থেকে চলে আসে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করেন ও যুদ্ধের জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন। তারপর আমাদেরকে জানান— দেখ, কুরায়শ বাহিনী এই পাহাড়ের লাল টিলাটির – অপর পার্শ্বে অবস্থান করছে। কুরায়শরা যখন আমাদের নিকটবতী হলো এবং আমরাও যুদ্ধের জন্যে সারিবদ্ধ হলাম, তখন দেখা গেল, তাদের মধ্যে একটি লোক একটি লাল উটে সওয়ার হয়ে লোকজনের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) আলী-কে ডেকে বললেন, হামযা কোথায়? তাকে ডাকো। কারণ, ঐ লাল উটওয়ালার সাথে হামযার মুশরিকদের থেকেও বেশী ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ইত্যবসরে হামযা তথায় উপস্থিত হলেন এবং বললেন, ও তো উতবা ইবন রাবীআ। সে যুদ্ধ থামাবার চেষ্টা করছে এবং লোকজনকে বলছে, তোমরা সব দোষ আমার মাথায় চাপিয়ে দিও। আর এ কথা বলিও যে, উতবা ইবন রাবীআ কাপুরুষতা দেখিয়েছে {

বস্তুত তোমরা তো জান, আমি কাপুরুষ নই। আবু জাহল এ কথা শুনে উতবাকে বললো, এ কথা তুমি বলেছে? শুন, যদি তুমি না হয়ে অন্য কেউ এ কথা বলতো, তবে আমি তাকে চিবিয়ে খেতাম। আমি দেখছি, তোমার অন্তরে ভয় ঢুকেছে। উত্বা বললো : ওহে হলুদ বর্ণের পশ্চাৎদেশধারী!! আমারই উপর কলংক লেপন করছে? আজি সবাই দেখবে, কাপুরুষ কে? এরপর উতবা, তার ভাই শায়াবা ও পুত্র ওয়ালীদ বংশগরিমার অহমিকা নিয়ে মল্লযুদ্ধের জন্যে বৃহ থেকে বেরিয়ে এসে ঘোষণা দিল, কে আছে, যে আমাদের সাথে মল্লযুদ্ধ করবে? আনসারদের মধ্য হতে কয়েকজন যুবক তাদের সামনে এগিয়ে এলো { উতবা বললো, আমরা এদেরকে চাই না। আমরা আমাদের স্বগোত্রীয় আবদুল মুত্তালিবের বংশধরদের সাথে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে চাই। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, : ওঠে হে হামযা! ওঠে হে আলী! ওঠে হে উবায়দা ইবন হারিছ ইবন আবদুল মুত্তালিব! তোমরা ওদের মুকাবিলায় অগ্রসর হও! আল্লাহর ইচ্ছায় রাবী আর দুই পুত্র উত্বা ও শায়বা এবং উতবার পুত্র ওয়ালিদ নিহত হল। অবশ্য উবায়দা এতে আহত হন। আলী বলেন, যুদ্ধে আমরা সত্তর জনকে হত্যা করি এবং সত্তরজনেকে বন্দী করি। জনৈক আনসারী আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবকে বন্দী করে আনেন। আব্বাস বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কসম! এ লোক আমাকে বন্দী করেনি। আমাকে বন্দী করেছে এমন এক লোক, যার মাথার দুই পার্শ্বে টাকা ছিল। সুদৰ্শন চেহারা বিশিষ্ট। সে একটি সাদা-কালো রঙের অশ্বে আরোহী ছিল। আনসারী বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমিই তাকে বন্দী করেছি। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, চুপ কর, আল্লাহ তোমাকে একজন ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেছেন। আলী বলেন, : আবদুল মুত্তালিবের গোত্র থেকে আব্বাস, আকীল ও নাওফিল ইবন হারিছকে আমরা বন্দী করি। এ বর্ণনার সনদ অতি উত্তম। আরও বর্ণনা আছে, যা এর সমর্থন করে। সেগুলোর মধ্যে কিছু পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, কিছু পরে উল্লেখ করা হবে। ইমাম আহমদ এ ঘটনা বিস্তারিত এবং আবু দাউদ ইসরাঈল থেকে আংশিক উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) যখন ছাপরা থেকে নেমে এসে লোকদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেন, তখন সকলেই ছিলেন সারিবদ্ধ, আত্ম-প্রত্যয়ে অবিচল এবং আল্লাহর স্মরণে লিপ্ত। কেননা, আল্লাহর নির্দেশ এ রকমই আছে। যথা :

يأيها الذين أمنوا اذا لقيتم فئة فاثبتوا و اذكروا اللّه كثيرا. “হে মু’মিনগণ! তোমরা যখন কোন দলের সম্মুখীন হবে, তখন অবিচলিত থাকবে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে” (৮ : :৫)।

উমাবী বলেন, আমার নিকট মুআবিয়া ইবন আমর (র) আবু ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, আওযাঈ বলেছেন : লোকে বলে, খুব কম লোকই দীনের উপর টিকে থাকতে সক্ষম হয়। তবে ঐ সময় যে ব্যক্তি বসে পড়ে কিংবা চক্ষু অবনমিত করে এবং আল্লাহকে স্মরণ করে, আশা করি সে ব্যক্তি রিয়া থেকে নিরাপদ থাকবে। বদর যুদ্ধে উত্তবা ইবন রাবীআ তার দলীয় লোকদের উদ্দেশ্যে বলেছিল, তোমরা কি নবীর সঙ্গীদের প্রতি লক্ষ্য করছে না? তারা অতন্দ্ৰ প্রহরীর মত হাঁটু গেড়ে বসে আছে এবং মনে হচ্ছে সৰ্প বা অজগরের ন্যায় জিহবা বের করে ক্ৰোধে গরগর করছে।

2 ལ─ང་ཡ་

উমাবী তাঁর মাগায়ী গ্রন্থে লিখেছেন : নবী করীম (সা) যখন মুসলমানগণকে যুদ্ধের জন্যে উদ্ধৃদ্ধ করেন, তখন প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অবস্থার উপর কসম করান এবং বলেন, সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার জীবন, আজ যে কেউ কাফিরদের বিরুদ্ধে ধৈৰ্য সহকারে সওয়াবের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করবে এবং সামনে এগিয়ে যাবে, পিছিয়ে আসবে না, আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন। এরপর তিনি উমােয়র ইবন হুমামের ঘটনা বর্ণনা করেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং তীব্র লড়াই করেন। অনুরূপ আবু বকর সিদীকও প্রত্যক্ষ ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারা উভয়ে প্রথমে ছাপরার মধ্যে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ ও কান্নাকাটির মাধ্যমে জিহাদ করেন। এরপর দু’জনেই ছাপরা থেকে নেমে এসে অন্যদের যুদ্ধে উদ্ধৃদ্ধ করেন এবং নিজেরা সশরীরে যুদ্ধ করেন। এতে তাঁরা উভয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানের মর্যাদা লাভ করেন।

ইমাম আহমদ বলেন, ওয়াকী’ আলী (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বদরের দিন আমি আমাদের অবস্থা লক্ষ্য করলাম। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর আশ্রয়ে ছিলাম আমরা সবাই। আমাদের মধ্যে তিনিই দুশমনদের সর্বাধিক নিকটে ছিলেন। সে দিন সকলের চেয়ে তিনি অধিক কঠোরভাবে যুদ্ধ করেন। নাসাঈ এ হাদীছ আবু ইসহাক সূত্রে আলী (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমরা যখন যুদ্ধের সম্মুখীন হলাম এবং শক্ৰদের সাথে লড়াই করলাম, তখন রাসূল (সা)-কে হিফাযত করার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করি।

ইমাম আহমদ বলেনঃ আবু নুআয়ম. আলী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আলী ও আবু বকরকে বদরের দিন বলা হয়, তোমাদের একজনের সাথে ছিলেন জিবরাঈল, অন্যজনের সাথে ছিলেন মীকাঈল। অপরদিকে ইসরাফীল একজন মহান ফেরেশতা। তিনি যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন কিন্তু যুদ্ধ করেননি। কিংবা বলেছেন, তিনি সৈন্যদের কাতারে হাযির ছিলেন। এ বর্ণনাটি পূর্বে উল্লিখিত সেই বর্ণনারই মত, যাতে বলা হয়েছে, আবু বকর ছিলেন ডান পার্শ্বে এবং বদরের দিন ফেরেশতাগণ যখন একের পর এক অবতীর্ণ হচ্ছিলেন, তখন জিবরাঈল পাঁচশ’ ফেরেশতা নিয়ে ডাইনে আবু বকরের পার্শ্বে দাঁড়ালেন। অপরদিকে মীকাইল পাঁচশ’ ফেরেশতার আর একটি দল নিয়ে বাম পার্শ্বে অবস্থান নেন। হযরত আলী এখানে ছিলেন। এ সম্বন্ধে আরও একটি বর্ণনা আছে। যা আবু ইয়া’লা মুহাম্মদ ইবন জুবােয়র ইবন মুতুঙ্গম সূত্রে আলী থেকে বর্ণনা করেছেন। আলী (রা) বলেন : বদরের দিন আমি কুয়ার কাছে তাসবীহ পাঠ করছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড বেগে বাতাস বয়ে গেল। তারপরে আর একবার অনুরূপ বাতাস হল। কিছুক্ষণ পর আবার ঐ রকম বাতাস এলো। দেখা গেল, মীকাঈল এক হাযার ফেরেশতাসহ এসেছেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ডান পাশে দাঁড়িয়েছেন। এখানে ছিলেন আবু বকর। আর ইসরাফীল এক হাযার ফেরেশতাসহ নবীর বাম পাশে রয়েছেন। এখানে ছিলাম। আমি নিজে। জিবরাঈলও আর এক হাযার ফেরেশতা নিয়ে আসেন। আমি এই দিন অনেক ঘুরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আরবগণ যে কবিতা দ্বারা সর্বোচ্চ গৌরব প্রকাশ করতো, তা ছিল হাসসান ইবন ছবিতের নিম্নোক্ত কবিতা :

“আর বদর কুয়াের নিকট তারা যখন তাদের বাহন থামালো, তখন জিবরাঈল ও মুহাম্মদ ছিলেন। আমাদের পতাকাতলে।”

ইমাম বুখারী বলেন, ইসহাক ইবন ইবরাহীম. মুআয থেকে, তিনি তাঁর পিতা রিফাত্মাত ইবন রাফি’ থেকে বর্ণনা করেন। মুআয বলেন, তাঁর পিতা রিফাআত ছিলেন বদর যুদ্ধের অংশগ্রহণকারীরে অন্যতম। তিনি বলেছেন, একদা জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে বললেন, : আপনার বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মর্যাদা কিরূপ বলে মনে করেন? তিনি বললেন, তাদেরকে সবোত্তম মুসলমান গণ্য করা হয়। অথবা অনুরূপ কোন কথা তিনি বলেছিলেন। তখন জিবরাঈল (আঃ) বললেন, যে সব ফেরেশতা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, ফেরেশতাদের মধ্যে তাদের মর্যাদাও তদ্ররূপ। আল্লাহর বাণী :

اذ يوحى ربك الى الملائكة أتى معكم فثبتوا الذين أمنوا سألقى فى قلوب

الذين كفروا الرعب فاضربوا فوق الأعناق واضربوا منهم كل بنان.

“স্মরণ করা, তোমাদের প্রতিপালক ফেরেশতাগণের প্রতি প্ৰত্যাদেশ করেন, আমি তোমাদের সাথে আছি। সুতরাং মু’মিনদেরকে অবিচলিত রাখা। যারা কুফরী করে আমি তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করবো। সুতরাং তাদের স্কন্ধে ও সর্বাঙ্গে আঘাত কর” (৮ : ১২)। সহীহ মুসলিমে ইকরিমা ইবন আম্মার আবু যুমায়াল সূত্রে ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন : সে দিন জনৈক মুসলিম সৈনিক তার সম্মুখের একজন মুশরিকের পিছনে জোরে ধাওয়া করছিলেন। এ সময় তিনি তার উপর দিক থেকে বেত্ৰাঘাতের শব্দ ও অশ্বারোহীর আওয়াজ শুনতে পান। অশ্বারোহী বলছিলেন, হে হায়যুম! (ফেরেশতার ঘোড়ার নাম) সম্মুখে এগিয়ে যাও। তখন তিনি দেখতে পেলেন–তাঁর সম্মুখে ঐ মুশরিক চিৎ হয়ে পড়ে গিয়েছে। এরপর তিনি লক্ষ্য করে দেখলেন যে, তার নাক ফাটা ও মুখমণ্ডল ক্ষত-বিক্ষত! যেন কেউ তাকে বেত্ৰাঘাত করেছে। বেতের আঘাতে তার সমস্ত দেহ নীল হয়ে গেছে। এরপর ঐ আনসারী রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করলেন। সবকিছু শুনে তিনি বললেন, হ্যা, তুমি ঠিকই বলেছে। এই সাহায্য তৃতীয় আসমান থেকে এসেছে। সে দিন মুসলমানগণ সত্তর জন কাফিরকে হত্যা ও সত্তর জনকে বন্দী করেন।

ইবন ইসহাক বলেন, : আবদুল্লাহ ইবন আবু বকর ইবন হাযম…ইবন আব্বাস থেকে আমার কাছে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বনু-গিফারের এক ব্যক্তি আমাকে বলেছে যে, বন্দরের দিন আমি ও আমার এক চাচাত ভাই বদর প্রান্তরে যাই। তখনও আমরা ছিলাম মুশরিক। পার্শ্ববতী এক পাহাড়ে উঠে আমরা ঘটনার দৃশ্য দেখছিলাম এবং পরিণতি কোন দিকে গড়ায় তার অপেক্ষা করছিলাম। তখন দেখলাম, এক টুকরো মেঘ আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। মেঘের টুকরাটি যখন পাহাড়ের কাছে এলো, তখন আমরা সেই মেঘের ভিতর ঘোড়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আর এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলাম, ‘হায়যুম! সম্মুখে অগ্রসর হও।” এ সময়

আমার সাখীর হৃদয়যন্ত্র বন্ধ হয়ে সেখানেই সে মারা যায়। আমি মরতে মরতে কোন মতে বেঁচে যাই। ইবন ইসহাক বলেন, : আবদুল্লাহ ইবন আবু বকর বনূ-সাইদার জনৈক ব্যক্তির উদধূতি দিয়ে বলেন, আবু উসায়দ মালিক ইবন রাবীআ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে দৃষ্টিশক্তি চলে যাওয়ার পর একদিন তিনি বলেন, আজকের এই দিনে আমি যদি বন্দরে থাকতাম এবং আমার দৃষ্টিশক্তি বহাল থাকতো, তবে তোমাদেরকে সেই গিরিপথ দেখিয়ে দিতে পারতাম, যেখান দিয়ে ফেরেশতাগণ বেরিয়ে এসেছিলেন। এতে আমার বিন্দুমাত্ৰ সন্দেহ বা ভুল হতো না। ফেরেশতাগণ যখন অবতীর্ণ হলেন এবং ইবলীস তাদেরকে দেখতে পেলো–আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দিলেন? “আমি তোমাদের সাথে আছি। সুতরাং মু’মিনদের অবিচলিত রাখি।” ফেরেশতাগণ মু’মিনদেরকে অবিচলিত রাখতেন এভাবে যে, তারা একজন সৈন্যের কাছে তার কোন পরিচিত লোকের আকৃতি ধারণ করে গিয়ে বলতেন, সুসংবাদ গ্রহণ কর, ওরা কিছুই করতে পারবে না। আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন, তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ো।”

ওয়াকিদী ইকরিম সূত্রে ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন, বন্দরে ফেরেশতাগণ কোন পরিচিত ব্যক্তির আকৃতি ধারণ করে কারও সামনে হাযির হতেন এবং অবিচল থাকার সাহস যোগাতেন। ফেরেশতা বলতেন, আমি ওদের কাছে গিয়েছিলাম। শুনলাম–তারা বলাবলি করছে, মুসলমানরা যদি আক্রমণ করে, তা হলে আমরা টিকতে পারবো না। ওরা তোমাদের কিছুই করতে পারবে না। এ জাতীয় আরও উৎসাহব্যঞ্জক কথা তারা শুনাতেন। আল্লাহ এ দিকেই ইংগিত করে বলেছেন :

اذ يوحى ربك إلى الملائكة أتى معكم فثبتوا الذين أمنوا ………….. کل بنان. “স্মরণ কর, যখন তোমাদের প্রতিপালক ফেরেশতাদের প্রতি প্ৰত্যাদেশ করেন, আমি তোমাদের সংগে আছি, সুতরাং মু’মিনগণকে অবিচলিত রাখা। (৮ : ১২)।

এরপর ইবলীস যখন ফেরেশতাগণকে দেখতে পেলো, তখন সে কেটে পড়লো ও বললো, তোমাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক রইলো না। তোমরা যা দেখতে পাও না। আমি তা দেখি। এ সময় সে সুরাকা (ইবন মালিক ইবন জুছাম)-এর রূপ ধারণ করেছিল। আবু জাহল তখন নিজের বাহিনীকে যুদ্ধের জন্যে প্ররোচিত করে বলছিল, “খবরদার! সুরাকার পক্ষত্যাগ যেন তোমাদেরকে ধোকায় না ফেলে। কেননা, সে মুহাম্মদ ও তার সাথীদের সঙ্গেীকার প্রতিশ্রুতি মত কাজ করছে। তারপর সে লাতি-উযযার কসম করে ঘোষণা দিল—“আমরা মুহাম্মদ ও তার সংগীদের পাহাড়ের মধ্যে ছিন্নভিন্ন করে না দেয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত হবো না।”১ সুতরাং তাদেরকে হত্যা না করে শক্তভাবে বেঁধে নিও।

বায়হাকী সালামা সূত্রে আকীল ইবন শিহাব—আবু হাযিম— সােহল ইবন সাআদ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আবু উসায়দ অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর একদা আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাতিজা! আমি এবং তুমি যদি আজ বন্দরে থাকতাম, আর আল্লাহ আমার চোক খুলে দিতেন, তবে আমি তোমাকে সেই গিরিপথটি দেখিয়ে দিতাম যেই পথ দিয়ে ফেরেশতাগণ আমাদের

১. বায়হাকীতে আছে, মুহাম্মদ ও তার সংগীদের রশি দিয়ে না বাধা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না।

লোককে সাদা-কালো বর্ণের ঘোড়ার উপরে আসমান ও যমীনের মাঝখানে দেখেছি। তারা ছিলেন বিশেষ প্রতীক চিহ্নধারী। তারা শক্ৰদের হত্যা করছিলেন এবং বন্দীও করছিলেন। আবু উসায়দ অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বলেছিলেন, আমার যদি আজ চোখ থাকতো, আর তোমাদের সাথে বদরে থাকতাম, তবে অবশ্যই তোমাদেরকে সেই গিরিপথ দেখিয়ে দিতাম, যে পথ দিয়ে ফেরেশতাগণ বেরিয়ে আসছিলেন। এতে আমার কোন সংশয় বা সন্দেহ নেই।

ওয়াকিদী বলেন, : আমার নিকট খারিজা ইবন ইবরাহীম তাঁর পিতার বরাতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) জিবরাঈলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন–বদরের দিন কোন ফেরেশতা এ কথা বলেছিলেন যে, “হায়যুম! সামনে অগ্রসর হও”? উত্তরে জিবরাঈল বলেছিলেন, হে মুহাম্মদ (সা:)! আমি তো আকাশের সকল বাসিন্দাকে চিনি না। এই মুরসাল বর্ণনা। যারা বলেন, ‘হায়যুম’ জিবরাঈলের ঘোড়ার নাম, যেমন সুহায়লা বলেছেন। এই হাদীস ঐ বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক। ওয়াকিদী বলেন, : ইসহাক ইবন ইয়াহইয়া হামযা ইবন সুহায়ব সূত্রে সুহায়ব থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বদরের দিন কত যে কর্তিত হাত ও গভীর যখম দেখেছি, অথচ সে সব যখম ও ক্ষতস্থানে রক্তের কোন চিহ্ন ছিল না। ওয়াকিদী বলেন, : মুহাম্মদ ইবন ইয়াহইয়া আবু আকীল, রাফি’ ইবন খাদীজা সূত্রে আবু বুরদা ইবন নাইয়ার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধে আমি তিনটি ছিন্ন মস্তক এনে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্মুখে রেখে বললাম, এর দু’জনকে তো আমি হত্যা করেছি। কিন্তু তৃতীয় জনকে দেখলাম, একজন দীর্ঘকায় লোক একে আঘাত করেছে। ফলে আমার সামনে তার মস্তক পড়ে গেছে। ঐ মস্তক আমি উঠিয়ে আনি। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, সে হচ্ছে আমুক ফেরেশতা! ওয়াকিদী বলেন : মূসা ইবন মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম তাঁর পিতা সূত্রে আমার নিকট বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, সাইব ইবন আবু হুবায়শ উমর (রা) খিলাফত কালে বলতো, আল্লাহর কসম, আমাকে কোন মানুষ বন্দী করেনি। তাকে জিজ্ঞেস করা হতো, তা হলে কে তোমাকে বন্দী করেছিলো? সে বলতো, কুরায়শ বাহিনী যখন পরাজিত হয়ে পলায়ন করে, তখন আমিও তাদের সাথে পলায়ন করি। এ সময় সাদা ঘোড়ায় আরোহী লম্বা চুলধারী এক ব্যক্তি আমাকে ধরে বেঁধে ফেলে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে আবদুর রহমান ইবন আওফ আসেন। আমাকে বাধা অবস্থায় দেখে তিনি সৈন্য বাহিনীর মধ্যে ঘোষণা করেন, একে বন্দী করেছে কে? ঘোষণা দিতে দিতে তিনি আমাকে রাসূলুল্লাহর নিকট এনে হাযির করেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমাকে বন্দী করেছে? আমি বললাম, তাকে আমি চিনি না। তবে যাকে দেখেছি তার বর্ণনা দিতে চাই না। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তোমাকে বন্দী করেছেন জনৈক ফেরেশতা। এরপর আবদুর রহমান ইবন আওফকে বললেন, তোমার বন্দীকে নিয়ে যাও।

ওয়াকিদী বলেন, : হাকীম ইবন হিযাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদরের দিন আমি দেখলাম, আকাশ থেকে দিগন্তব্যাপী এক বিরাট চাদর নেমে আসছে। এরপর দেখলাম গোটা উপত্যকা ছেয়ে গেছে। তখন আমার মনে হল, এটা অবশ্যই আসমান থেকে আগত কিছু হবে, যা দ্বারা মুহাম্মদ (সা)-কে সাহায্য করা হচ্ছে। বস্তৃত এ ছিল ফেরেশতাদের আগমন— যার পরিণতিতে কাফিরদের পরাজয় ঘটে। ইসহাক ইবন রাহওয়ায়হ বলেন : জুবায়র ইবন মুতঙ্গম

থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কুরায়শদের পরাজয়ের পূর্বে দেখলাম, লোকজন যুদ্ধে লিপ্ত। এমন সময় আকাশ থেকে কাল পিপড়ার মত যেন একটা কাল চাদর নেমে আসছে। এ যে ফেরেশতাদের আগমন তাতে আমার কোন সন্দেহ রইল না। ফলে কুরায়শদের পরাজয় বরণ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। ফেরেশতাগণ সাহায্য করার জন্যে যখন অবতরণ করেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সামান্য তন্দ্রার পর তাদেরকে দেখেন, তখন আবু বকরকে সুসংবাদ দিয়ে বলেন, আবু বকর! সুসংবাদ গ্রহণ কর! এই তো জিবরাঈল তাঁর ঘোড়া টেনে নিয়ে আসছেন। যুদ্ধের কারণে ধুলাবালি তাঁর দীতে লেগে আছে। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বর্ম পরে ছাপরা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং মু’মিনদেরকে যুদ্ধের জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন, জান্নাতের সুসংবাদ দেন এবং ফেরেশতাগণের আগমনের সংবাদ শুনিয়ে তাদেরকে সাহস যোগান! মুসলিম বাহিনী তখন সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে আছে। এখনও শক্ৰদের উপর হামলা করেনি। তাদের অন্তরে প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তি নেমে আসে। তাঁরা ঐ অবস্থায় কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হন। এই তন্দ্ৰাই ছিল তাদের প্রশান্তি, দৃঢ়তা ও ঈমানের লক্ষণ। আল্লাহর বাণী :

اذ يغشيكم النعاس أمنة مينة

“স্মরণ কর, তিনি তার পক্ষ হতে স্বন্তির জন্যে তোমাদেরকে তন্দ্ৰায় আচ্ছন্ন করেন।” (৮ :

১১)। কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্য থেকে জানা যায়, উহুদ যুদ্ধেও তন্দ্ৰা আসার পর মুসলমানদের

এরূপ প্রশান্তি লাভ হয়েছিল। এ কারণে ইবন মাসউদ বলেছেন, যুদ্ধের ময়দানে সারিবদ্ধ সৈন্যদের তন্দ্ৰা ঈমানের লক্ষণ আর সালাতের মধ্যে তন্দ্ৰা মুনাফিকীর লক্ষণ।

মহান আল্লাহর বাণী :

ان تستفتحوا فقد جاءكم الفتح وان تنتهوا فهو خير” لكم وان تعودوا نعد ولن تُغنى عنكُمْ فنَنَّكُمْ شيئا ولو كثرت وأن اللّه مع المؤمنين. “তোমরা বিজয় চেয়েছিলে, তা তো তোমাদের নিকট এসেছে; যদি তোমরা বিরত হও, তবে তা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর, যদি তোমরা পুনরায় কর, তবে আমিও পুনরায় শাস্তি দেবো এবং তোমাদের দল সংখ্যায় অধিক হলেও তোমাদের কোন কাজে আসবে না, এবং আল্লাহ মু’মিনদের সাথে রয়েছেন” (৮ : ১৯)।

ইমাম আহমদ. আবদুল্লাহ ইবন ছা’লাবা থেকে বর্ণনা করেন, বন্দরে দু-পক্ষ মুখোমুখি হলে আবু জাহল এ ভাবে প্রার্থনা করেছিল, হে আল্লাহ! এরা আমাদের রক্ত-সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, এমন সব বিষয়ের প্রতি আহবান জানাচ্ছে, যা আমাদের বোধগম্য নয়। সুতরাং এই সকালে আপনি ওদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আবু জাহলই ছিল সাহায্য প্রার্থনাকারী।” ইবন ইসহাক তার সীরাত প্রন্থে এবং নাসাঈ সালিহ ইবন কায়সান সূত্রে যুহরী

১. আয়াতে উল্লিখিত “তোমরা যদি মীমাংসা বা সাহায্য কামনা কর”— এখানে তোমরা বলতে কাদের বুঝান হয়েছে? এ বিষয়ে ৩টি মত আছে। যথাঃ (১) কাফির : কেননা, আবু জাহল মীমাংসার জন্যে আল্লাহর

থেকে এরূপ বর্ণনা করেছেন। হাকিম ইমাম যুহরী থেকে শেষে বলেছেন, বুখারী-মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ। কিন্তু বুখারী-মুসলিমে এ বর্ণনা নেই।

উমাবী বলেন, : আসবাত ইবন মুহাম্মদ কুরাশী আতিয়্যা সূত্রে মুতাররাফ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “তোমরা যদি মীমাংসা চাও, তবে মীমাংসা তো তোমাদের নিকট এসে গেছে” এ আয়াতটি তখন নাযিল হয় যখন আবু জাহল এই বলে প্রার্থনা করে, হে আল্লাহ! দুই দলের মধ্যে যে দল শক্তিশালী, দুই গোত্রের মধ্যে যে গোত্র অধিক সম্মানিত এবং দুই পক্ষের মধ্যে যে পক্ষ সংখ্যায় বেশী তাদের প্রতি আপনি সাহায্য করুন! আলী ইবন আবু তালহা বলেন, “স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, দুই দলের একদল তোমাদের আয়ত্তাধীন হব৷” (৮ : १)

এ আয়াত প্রসংগে ইবন আব্বাস (রা) বলেন : মক্কার বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া থেকে ফিরে আসছে— এ সংবাদ পেয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নেতৃত্বে মদীনাবাসিগণ কাফেলাকে ধরার জন্যে বেরিয়ে আসেন। এ খবর তাৎক্ষণিক ভাবে মক্কা পৌছে যায়। মাককাবাসীরা দ্রুত কাফেলার দিকে এগিয়ে আসে, যাতে নবী করীম (সা) ও তার সাথীগণ কাফেলাকে কাবু করতে না পারে। কিন্তু কাফেলা পূর্বেই ঐ পথ অতিক্রম করে চলে যায়। এ দিকে আল্লাহ দুই দলের এক দলকে মুসলমানদের আয়ত্তাধীন করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মুসলমানদের কাম্য ছিল যে, বাণিজ্য কাফেলা তাদের করায়ত্ত হোক। রাসূলুল্লাহ (সা) মাককা থেকে আগত সশস্ত্র বাহিনীকে মুকাবিলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু মুসলিম বাহিনী মক্কাবাসীদের বিপুল রাণশক্তির কারণে তাদের মুকাবিলায় যেতে অনিচ্ছুক ছিলেন। অবশেষে নবী করীম (সা) ও মুসলমানগণ বদরে অবতরণ করেন। বন্দরের পানির কুয়ো ও মুসলিম শিবিরের মাঝখানের জায়গাটি ছিল বালুকারাশিতে পূর্ণ। দীর্ঘ সফরে মুসলমানরা ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েন। শয়তান তাদেরকে প্ররোচনা দেয়ার চেষ্টা করে। সে কুমন্ত্রণা দিয়ে বলে, মনে করেছ যে, তোমরা আল্লাহর বন্ধু এবং আল্লাহর রাসূল তোমাদের মধ্যে আছেন। অথচ পানির উপরে মুশরিকরা তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এ দিকে অমুক অমুক অসুবিধার দরুন পানির প্রয়োজন তোমাদের অত্যধিক ॥১ এরপর আল্লাহর হুকুমে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। মুসলমানগণ সে পানি পান করেন ও পবিত্রতা অর্জন

নিকট প্রার্থনা করেছিল। এ ছাড়া নযর ইবন হারিছ বলেছিল, হে আল্লাহ! মুহাম্মদের ধর্ম যদি সত্য হয়, তবে আমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ করুন। ফলে ঐ দিন সে নিহত হয়। কাষী ইয়ায বলেন, “ফাতাহ’ অর্থ যদি সিদ্ধান্ত বা মীমাংসা হয়, তবে এখানে কাফিরদেরকেই বুঝানো হয়েছে। (২) মু’মিন? অর্থাৎ তোমরা যদি সাহায্য চাও, তবে তোমাদের নিকট সাহায্য তো এসেছে এবং আল্লাহ তোমাদের বিজয় দিয়েছেন। কার্য’ ইয়ায্যের মতে এটাই উত্তম। কেননা, “সাহায্য তো তোমাদের নিকট পৌঁছে গেছে”— এ কথাটা মু’মিনদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য (৩) প্রথম সম্বোর্ধন মু’মিনদেরকে এবং পরে কাফিরদের। কেননা, আয়াতে বলা হয়েছে— “ তোমরা যদি পুনরাবৃত্তি কর, তবে আমিও পুনরাবৃত্তি ঘটাব।” এর অর্থ হলো, তোমরা যদি মুসলমানদের উপর বাড়াবাড়ি কর, তবে আমি বদরের ন্যায় পুনরাবৃত্তি করবাে। কুশায়রী, হাসান বসরী, মুজাহিদ এবং সুদী বলেছেন, কাফিরদের প্রতি সম্বোধন করার মতটিই বিশুদ্ধ। (তাফসীরে রায়ী)

১. কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, মুসলমানদের মধ্যে কারো কারো ফরয গোসলের প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল।

করেন। ফলে শয়তানের কুমন্ত্রণার প্রভাব তাদের অন্তর থেকে দূরীভূত হয়। বালু বৃষ্টির পানিতে সিক্ত হয়ে জমে শক্ত হয়ে যায়। মানুষ ও বাহনগুলো সহজেই তার উপর দিয়ে চলাচল করতে পারছিল। এরপর মুসলিম বাহিনী মুশরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তার নবী ও মুসলমানগণকে এক হাযার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করেন। জিবরাঈল পাঁচশ’ ফেরেশতা নিয়ে ডান পার্শ্বে এবং মীকাঈল পাঁচশ’ ফেরেশতা নিয়ে বাম পার্শ্বে অবস্থান গ্ৰহণ করেন। অপরদিকে ইবলীস একদল শয়তান ও তার চেলা-চামুণ্ডা নিয়ে হাযির হয়। তারা মুদলাজ গোত্রের পুরুষদের আকৃতি নিয়ে আসে এবং মূল শয়তান আসে সুরকা ইবন মালিক ইবন জু শাম-এর রূপ ধারণ করে। শয়তান মুশরিকদের বললো, তোমাদের উপর আজ কেউ বিজয়ী হতে পারবে না, আমি তোমাদের সাথে আছি। তারপর উভয় পক্ষ যখন যুদ্ধের জন্যে সারিবদ্ধ হয়, তখন আবু জাহল এই দু’আ করে, “হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে দল সত্যের উপর আছে, সে দলকে সাহায্য করুন। এ দিকে রাসূলুল্লাহ (সা) দু’হাত উঠিয়ে দু’আ করেন, “হে প্রতিপালক। আপনি যদি এ দলটিকে ধ্বংস করেন, তবে পৃথিবীতে আপনার ইবাদত করার মত আর কেউ থাকবে না।” এ সময় জিবরাঈল তাকে বলেন, এক মুঠো ধুলো হাতে নিন। রাসূলুল্লাহ এক মুঠো ধুলো হাতে নিয়ে শক্ৰদের দিকে নিক্ষেপ করেন। দেখা গেল, মুশরিকদের মধ্যে এমন একজন লোকও ছিল না। যার চোখে, নাকে ও মুখে ঐ নিক্ষিপ্ত ধুলো পৌঁছেনি। ফলে

তখন ইবলীসের হাত ছিল জনৈক মুশরিকের মুঠোর মধ্যে। সে জিবরাঈলকে দেখে হাতখানি ছুটিয়ে নিয়ে তাকে বিদায় জানিয়ে পলায়ন করে। মুশরিক লোকটি বললো, “হে সুরাকা! তুমি কি বলোনি যে, তুমি আমাদের সাথে থাকবে? ইবলীস জবাৰ দিল? “তোমরা যা দেখতে পাও না, আমি তা দেখতে পাচ্ছি। আমি আল্লাহকে ভয় করি, আর আল্লাহ শান্তি দানে কঠোর” (৮ : 8b )।

ফেরেশতাকে দেখতে পেয়েই সে এ কথাটি বলেছিল। বায়হাকী তাঁর ‘দালাইলা’ গ্রন্থে এ টি বর্ণনা করেছেন।

তাবারানী বলেন : মুসআদা ইবন সাআদ আল–আত্তার . রিফাআত ইবন রাফি’ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবলীস যখন মুশরিকদের বিরুদ্ধে ফেরেশতাদের কঠোর ভূমিকা প্রত্যক্ষ করে, তখন আশংকা করে যে, সেও ধরা পড়ে যাবে। হারিছ। ইবন হিশাম ইবলীসকে সুরাকা ইবন মালিক মনে করে জড়িয়ে ধরে। তখন ইবলী।াস হারিছের বুকে এক ঘুষি মেরে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সে সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়ে এবং দু’হাত উঠিয়ে প্রার্থনা করে “হে আল্লাহ! আপনি আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকার যে অবকাশ দিয়েছিলেন, সে অবকাশ আমি প্রার্থনা করছি। সে ভয় পাচ্ছিল যে, তাকে হত্যা না করা হয়। তখন আবু জাহল সবাইকে সম্বোধন করে বললো, হে কুরায়শ বাহিনী! সরাকা ইবন মালিকের কাপুরুষতা যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে। কেননা, সে ছিল মুহাম্মদের একজন গোয়েন্দা। আর শায়াবা, উতবা ও ওয়ালীদের নিহত হওয়ায় যেন তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা না আসে। কেননা, তারা খুব তাড়াহুড়া করে ফেলেছিল। লাত ও উষযার কসম, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা ওদেরকে বিচ্ছিন্ন করে পাহাড়ে-পর্বতে ছড়িয়ে

ـــ كما

পড়তে বাধ্য না করতে পারবো, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ফিরে যাবো না। তোমরা কোন শক্রকে ধরেই হত্যা করে ফেলো না, বরং তাদেরকে শক্তভাবে পাকড়াও করবে। তারপর আমাদের রক্ত সম্পর্ক নষ্ট করা ও লাতি-উযযা থেকে বিমুখ হওয়ার অপরাধের স্বীকৃতি আদায় করে পরে ওদেরকে হত্যা করবে। এসময় আবু জাহল নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করে :

لمشلی هذا ولد تنی امی অর্থ : “প্রচণ্ড গ্ৰীষ্মে সংঘটিত যুদ্ধও আমার থেকে বদলা নিতে সক্ষম হয় না। কেননা, আমি

দু’বছর বয়সের জওয়ান উটের ন্যায় শক্তিশালী। এ জাতীয় দুঃসাহসী কাজের জন্যেই আমার মা আমাকে প্রসব করেছে।”

ওয়াকিদী বলেন : মারওয়ান ইবন হাকম একদা হাকীম ইবন হিযামকে বদর যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করতে অনুরোধ জানায়। বৃদ্ধ হাকীম। এতে অনীহা প্রকাশ করেন। বারবার অনুরোধ জানালে তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন : আমরা উভয় পক্ষ পরস্পর মুখোমুখি হই এবং যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি। হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনতে পাই। যেন আকাশ থেকে পৃথিবীতে কিছু একটা পড়েছে। তামার পাত্রে পাথরের টুকরা পড়লে যেরূপ আওয়াজ হয়, ঐ আওয়াজটি ছিল অনেকটা সে রকম। এরপর নবী করীম (সা) এক মুঠো ধুলো হাতে নিয়ে আমাদের প্রতি নিক্ষেপ করেন। ফলে আমাদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ওয়াকিদী আবু ইসহাক সূত্রে … আবদুল্লাহ ইবন ছ’লাবা ইবন সুআয়র থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নাওফিল ইবন মুআবিয়া দায়লীকে বলতে শুনেছি— বদর যুদ্ধে আমরা পরাজিত হই। সে দিন আমাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে একটা শব্দ শুনি। শব্দটি ছিল তামার পাত্রে কংকর পড়ার শব্দের মত। এতে আমরা অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি।

উমাবী বলেন, : আবদুল্লাহ ইবন ছ’লাবা ইবন সুআয়র থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বন্দরে দু’দলের যুদ্ধ চলাকালে আবু জাহল এই প্রার্থনা করে : “হে আল্লাহ! সে আমাদের রক্ত-সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, এমন সংবাদ নিয়ে এসেছে যার সাথে আমরা পরিচিত নই, সুতরাং এই সকালে আপনি তাকে পরাভূত করে দিন৷” এভাবে আবু জাহলাই আল্লাহর সাহায্য কামনা করে। এ রকম অবস্থা তখন বিরাজ করছিল। এদিকে দুশমনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে আল্লাহ মুসলমানদের অন্তরে সাহস সঞ্চার করে দিয়েছিলেন। মুশরিকদের সংখ্যা মুসলমানদের চোখে কম করে দেখাচ্ছিলেন। ফলে যুদ্ধের জন্যে তারা উৎসােহবোধ করতে থাকে। অপর দিকে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ছাপরার মধ্যে সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়ার পর জাগ্রত হয়ে বললেন, আবু বকর! সুসংবাদ গ্রহণ করা, এই তো জিবরাঈল পাগড়ী মাথায় ঘোড়ার লাগাম ধরে টেনে নিয়ে আসছেন। ঘোড়ার মুখে ধুলাবালি লেগে আছে। আল্লাহর প্রতিশ্রুত সেই সাহায্য পৌঁছে গেছে। এরপর জিবরাঈলের কথামত রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক মুঠো কংকর হাতে নেন এবং ছাপরা থেকে বেরিয়ে শক্ৰদের সামনে যান। তারপর ১১ এ। এ. AL… ( ওদের চেহারা বিকৃত হোক) বলে শক্ৰদের দিকে নিক্ষেপ করেন। তিনি সাহাবাগণকে বললেন, এবার তোমরা আক্রমণ করা।

ওদের পরাজয় সুনিশ্চিত। অবশেষে আল্লাহর ফায়সালা অনুযায়ী মুশরিকদের অনেক নেতা যুদ্ধে নিহত হয় এবং অনেকে বন্দী হয়। এ ঘটনা সম্পর্কে ইবন ইসহাক থেকে যিয়াদের বর্ণনা নিম্নরূপ :

রাসূলুল্লাহ্ (সা) এক মুঠো কংকর হতে নিয়ে কুরায়শ দলের সামনে আসেন এবং এ-AL…. ১১। বলে তাদের দিকে ছুড়ে মারেন। তারপর সাহাবাগণকে বলেন, : আক্রমণ কর। ফলে কুরায়শরা পরাজিত হয়। আল্লাহর হুকুমত কুরায়শদের অনেক নেতা নিহত হয় ও অনেক সম্মানিত ব্যক্তি বন্দী হয়। সুদী আল-কাবীর বলেন, : বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা) আলীকে বলেছিলেন, আমাকে কিছু কংকর এনে দাও, আলী কিছু কংকর এনে দেন। কংকারগুলোতে ধুলাবালি লেগেছিল। তিনি সেগুলো শত্রুপক্ষের দিকে নিক্ষেপ করে দেন। দেখা গেল, এমন কোন মুশরিক ছিল না, যার দুই চোখে ঐ ধুলাবালি লাগেনি। এরপর মুসলমানরা পিছনে ধাওয়া করে তাদেরকে হত্যাও বন্দী করেন। এ প্রসংগে আল্লাহ নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন :

فلم تقتلوهم ولكن اللّه قتلهم وما ر میت اڈ رمیت و لکن الله رمی . “তোমরা তাদেরকে হত্যা করনি, আল্লাহই তাদেরকে হত্যা করেছেন এবং তুমি যখন ধুলো নিক্ষেপ করেছিলে তখন তুমি নিক্ষেপ করনি এবং আল্লাহই নিক্ষেপ করেছিলেন” (৮ : ১৭)।

উরওয়া, ইকরিমা, মুজাহিদ, মুহাম্মদ ইবন কাআব, মুহাম্মদ ইবন কায়স, কাতাদা ও ইবন যায়দ প্রমুখ মনীষিগণ এ কথাই বলেছেন যে, এ আয়াত বদর যুদ্ধের ঐ প্রসংগেই নাযিল হয়েছে। তবে হুনায়ন যুদ্ধেও রাসূলুল্লাহ (সা) এই একই কৌশল অবলম্বন করেন। যথাস্থানে আমরা এ সম্পর্কে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।

ইবন ইসহাক লিখেছেন : রাসূলুল্লাহ (সা) যখন সাহাবাগণকে যুদ্ধে উদ্ধৃদ্ধ করেন এবং মুশরিকদের প্রতি ধুলো নিক্ষেপ করেন, যার পরিণতিতে তারা পরাজিত হয়, তখন তিনি পুনরায় ছাপরায় প্রবেশ করেন। আবু বকর এ সময় রাসূলুল্লাহর সংগে ছিলেন। সাআদ ইবন মুআয ও কয়েকজন আনসার সাহাবী ছাপরার দরজার নিকট তলোয়ার হাতে পাহারায় নিয়োজিত ছিলেন। যাতে মুশরিকরা ঘুরে এসে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উপর আক্রমণ করতে না পারে। ইবন ইসহাক বলেন, কুরায়যা বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর মুসলিম মুজাহিদগণ তাদের বন্দী করতে থাকেন। এ অবস্থা দেখে সাআদ ইবন মুআয্যের চেহারায় অসন্তুষ্টির ভাব ফুটে উঠে। রাসূলুল্লাহ (সা) সাআদ-এর এ পরিবর্তন দেখে জিজ্ঞেস করেন, হে সাআদ! মনে হচ্ছে মুসলমানদের এ কাজে তুমি সন্তুষ্ট নও? সাআদ বললেন, হ্যা, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর কসম, আজ মুশরিকদের শেষ করার প্রথম সুযোগ আল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছেন। তাই ওদের পুরুষদের বন্দী করে জীবিত রাখার চেয়ে বেশী বেশী হত্যা করাই ছিল আমার কাছে পসন্দনীয়। ইবন ইসহাক বলেন : ইবন আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সা) তাঁর সাহাবাগণকে এ দিন বলেছিলেন, আমি জানি, বনু হাশিমসহ আরও কিছু লোককে কুরায়শরা জোরযাবর দস্তি করে যুদ্ধে এনেছে। আমাদের সাথে যুদ্ধ করার কোন প্রয়োজন তাদের ছিল না। সুতরাং বনু হাশিমের কেউ তোমাদের কারো সামনে পড়লে তাকে হত্যা করো না। আবুল বুখতারী ইবন হিশাম, ইবন হারিছ ইবন আসাদকে সামনে পেলে তাকে হত্যা করো না। রাসূলুল্লাহর চাচা আব্বাস ইবন

আবদুল মুত্তালিব কারও সামনে পড়লে তাকেও হত্যা করো না। কেননা, তাকে জোর করে যুদ্ধে আনা হয়েছে। এ কথা শুনে আবু হুযায়ফা উতবা ইবন রাবী আ বললেন, আমরা আমাদের বাপ, ভাই ও পুত্রদের হত্যা করবো। আর আব্বাসকে ছেড়ে দিবো, তা কী করে হয়? আল্লাহর কসম, সে যদি আমার সামনে পড়ে, তবে আমি তাকে তরবারি দ্বারা আঘাত করবোই। এ সংবাদ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট পৌঁছলে তিনি উমরকে ডেকে বলেন, : ওহে আবু হাফস!১ আল্লাহর রাসূলের চাচার চেহারায় কি তরবারি চালান যায়? উমর বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিন, আমি তলোয়ার দিয়ে তার গর্দান উড়িয়ে দেবো। আল্লাহর কসম, সে মুনাফিক হয়ে গেছে। পরবতীতে আবু হুযায়ফা বলতেন, ঐ দিন আমি যে কথাটি বলেছিলাম, তার জন্যে আমি নিজেকে নিরাপদ মনে করি না। একমাত্র শাহাদতের দ্বারা কাফফারা দেওয়া ছাড়া রক্ষা হবে না বলে আমি সর্বদা শংকিত থাকি। অবশেষে ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *