৩৩. রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের রাতে সংঘটিত অলৌকিক ঘটনাবলী

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের রাতে সংঘটিত অলৌকিক ঘটনাবলী

রাসূলুল্লাহ (সা) যে রাতে ভূমিষ্ঠ হন, সে রাতে অসংখ্য মূর্তির উপুড় হয়ে পড়া ও স্থানচ্যুত হওয়া, হাবশা অধিপতি নাজাশীর দেখা ঘটনার বিবরণ, জন্মের সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে নূর বের হয়ে তাতে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে যাওয়া; রাসূল (সা)-এর মাতৃগর্ভ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে আকাশপানে মাথা তুলে বের দিয়ে আসা, ড়েগ ফেটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়া, রাসূলুল্লাহ (সা) যে ঘরে জন্মলাভ করেন, সে ঘরটি আলোকিত হয়ে যাওয়া এবং নক্ষত্রেরাজি মানুষের নিকটবতী হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনাব বিবরণ আমরা ইতিপূর্বে অজ্ঞাত স্থান থেকে জিনের কথা বলা অধ্যায়ে উল্লেখ করে এসেছি।

সুহায়লী বৰ্ণনা করেন যে, ইবলীস জীবনে চারবার বিলাপ করে : ১. অভিশপ্ত হওয়ার সময়। ২. জান্নাত থেকে বিতাড়িত হওয়ার সময়। ৩. রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের সময় এবং ৪. সূরা ফাতিহা নাযিল হওয়ার সময়।

মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, এক ইহুদী মক্কায় বাস করত। সে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। রাসূলুল্লাহ (সা) যে রাতে ভূমিষ্ঠ হন সে রাতে কুরাইশ এর এক মজলিসে সে বলল, আজ রাতে কি তোমাদের মধ্যে কারও কোনও সন্তানের জন্ম হয়েছে? জবাবে তারা বলল, আল্লাহর কসম!! আমরা এ রকম কিছুই জানি না। ইহুদীটি বলল, আল্লাহু আকবার! তোমাদের অজান্তে ঘটে থাকলে তো কোনও অসুবিধা নেই। তবে তোমরা খোজ করে দেখ এবং যা বলছি। স্মরণ রাখা। এ রাতে আখেরী নবী ভূমিষ্ঠ হয়েছেন। তাঁর দুই কাধের মধ্যবর্তী স্থানে একটি চিহ্ন আছে। তাতে ঘোড়ার কেশরের মত একগুচ্ছ চুল আছে। দুরাত তিনি দুধ পান করবেন না। কারণ একটি দুষ্ট জিন তাঁর মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলে তাঁকে দুধ পান থেকে নিবৃত্ত রাখা হয়েছে।

শুনে লোকজন মজলিস ছেড়ে উঠে। চতুর্দিক ছড়িয়ে পড়ে। ইহুদীর কথায় তারা হতভম্ভ স্তম্ভিত! ঘরে গিয়ে প্রত্যেকে তারা ঘরের লোকদেরকে এ খবরটি শুনায়। শুনে তারা বলে উঠে, হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ! আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিবের একটি পুত্ৰ সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তারা তার নাম রেখেছে মুহাম্মদ। এবার তারা ইহুদীর কথা ও এই নবজাতক সম্পর্কে কানাঘুষা করতে করতে ইহুদীর নিকট যায় এবং তাকে এ খবরটি জানায়। ইহুদীটি বলল, তোমরা আমাকে নিয়ে চল, আমি তাকে একটু দেখব। লোকেরা ইহুদীকে নিয়ে আমেনার ঘরে গিয়ে তাকে বলল, তোমার পুত্রটিকে একটু আমাদের কাছে দাও। আমেনা পুত্ৰকে তাদের কাছে দিলে তারা তার পিঠের কাপড় সরিয়ে ইহুদীর বর্ণিত নিদর্শনটি দেখতে পায়। সাথে সাথে ইহুদী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার জ্ঞান ফিরলে লোকেরা তাকে বলল, কী ব্যাপার, আপনার হয়েছে কি? ইহুদীটি বলল, আল্লাহর শপথ? নবুওত বনী ইসরাঈল থেকে বিদায় নিল! তোমরা এতে আনন্দিত হও, হে কুরাইশের দল!! আল্লাহর শপথ, তোমাদের সহায়তায় তিনি এমন বিজয় লাভ করবেন যে, প্রাচ্যে-প্রতীচ্যে তীর সুসমাচার ছড়িয়ে পড়বে। মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক বৰ্ণনা করেন যে, হাস্সান ইব্‌ন সাবিত (রা) বলেছেন, আমি তখন সাত কি আট বছরের বালক। যা শুনি বা দেখি, তা বুঝবার বয়স তখন আমার হয়েছে। হঠাৎ একদিন সকাল বেলা ইয়াসরিবে জনৈক ইহুদীকে চীৎকার করে বলতে শুনলাম, হে ইহুদী সমাজ! চীৎকার শুনে লোকজন তার নিকট এসে ভীড় জমায় এবং বলে, বল, কি হয়েছে তোমার? সে বলল আহমদ নামের যে লোকটির জন্ম হওয়ার কথা, এই রাতে তার তারকা উদিত হয়েছে।

হাফিজ আবু নুয়ায়ম দালায়িলুন্নবুওয়াহ কিতাবে বর্ণনা করেছেন যে, আবু মালিক ইব্‌ন সিনান বলেন, একদা আমি গল্পগুজব করার জন্য আবদুল আশাহাল গোত্রে যাই। তখন আমরা তাদের সঙ্গে সন্ধিবদ্ধ। সে সময়ে আমি শুনতে পেলাম যে, ইউশা নামক এক ইহুদী বলছে, আহমদ নবীর আগমনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি হেরেম থেকে বেরিয়ে আসবেন। এ কথা শুনে খলীফা ইব্‌ন ছালাবা আল-আশাহালী উপহাস করে জিজ্ঞাসা করল, তার পরিচয় কী হে? ইহুদী বলল, তিনি হবেন এমন এক ব্যক্তি যিনি না হবেন বেঁটে, না লম্বা। দুচোখে তার লালিমা থাকবে। তিনি হবেন কমলীওয়ালা। তিনিও গাধায় সওয়ার হবেন। তার কাধে তরবারী ঝুলানো থাকবে। এই নগরী হবে তার হিজরত স্থল। আবু মালিক ইব্‌ন সিনান বলেন, ইহুদীর কথায় অভিভূত হয়ে আমি আমার স্বগোত্ৰ বনু খাদরায় চলে এলাম। আমার নিকট থেকে ঘটনার বিবরণ শুনে এক ব্যক্তি বলে উঠল, এ কথা কি ইউশা একাই বলছে, নাকি ইয়াসরিবের সব ইহুদীর একই কথা! আবু মালিক বলেন, এই ঘটনার পর আমি বনু কুরায়যার নিকট যাই। সেখান গিয়ে দেখতে পেলাম, একদল মানুষ আখেরী নবী সম্পর্কেই আলাপ-আলোচনা করছে। কথা প্রসঙ্গে যুবোয়র ইব্‌ন বাতা বললেন, সেই লাল নক্ষত্রটি উদিত হয়ে গেছে, যা কখনও কোনও নবীর আগমন বা আবির্ভাবের উপলক্ষ ছাড়া কোনদিন উদিত হয় না। এখন তো আহমদ ছাড়া আর কোন নবীর আগমনের বাকী নেই। আর এই ইয়াসরি বই হবে তার হিজরত স্থল।

আবু সাঈদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনা আগমন করার পর আমার আব্বা তাকে এই ঘটনাটি শুনান। শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ যুবোয়র যদি মুসলমান হত, তাহলে নেতৃস্থানীয় অনেক ইহুদীও মুসলমান হয়ে যেত। কারণ ওরা এর অনুগত।

আবু নুয়ায়ম (র) বর্ণনা করেন যে, যায়দ ইব্‌ন সাবিত (রা) বলেন, বনু কুরায়যা ও বনু নষীর এর ইহুদী পণ্ডিতগণ নবী করীম (সা)-এর পরিচিতি সম্পর্কে আলোচনা করতেন। অবশেষে লাল নক্ষত্র উদিত হয়ে গেলে তারা ঘোষণা করে যে, ইনিই আখেরী নবী; এর পরে আর কোনও নবী আসবেন না। নাম তাঁর আহমদ এবং তার হিজরত স্থল হবে ইয়াসরিব। কিন্তু যখন নবী করীম (সা) হিজরত করে মদীনায় আসলেন আর তারা তাকে অগ্রাহ্য করে, হিংসা

Page 493 missing

ব্যক্তির সন্ধান দেব, যিনি এর জবাব দিতে সক্ষম হবেন। কিসারা তাকে ঘটনাটি খুলে বলেন। জবাবে আবদুল মাসীহ বলেন, আমার এক মামা এর জবাব দিতে পারবেন। তিনি সিরিয়ার সাতীহ নামক স্থানের উপকণ্ঠে বাস করেন। কিসারা বললেন, ঠিক আছে। তুমি তার কাছে গিয়ে দেখ, সে এর জবাব দিতে পারে। কিনা। আমি যা জানতে চাই তাকে তা জিজ্ঞেস করে তার ব্যাখ্যা জেনে এসো। আবদুল মাসীহ সঙ্গে সঙ্গে সিরিয়ায় রওয়ানা হয়ে মুমূর্ষ সাঁতীহ এর নিকট পীেছেন। তিনি তাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু সাতীহ সালামের কোন জবাবও দিলেন না বা কোন কথাও বললেন না। তখন আবদুল মাসীহ কবিতার কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করেন। তা শুনে এবার সাতীহ মাথা তুলে বলেন, আবদুল মাসীহ! উটের পিঠে চড়ে তুমি সাতীহ এর নিকট এসেছি। অথচ সে তখন মৃত্যুপথযাত্রী। আমি জানি, তোমাকে সাসান বংশের বাদশাহ প্রেরণ করেছেন। রাজপ্রাসাদ প্ৰকম্পিত হওয়ায়, অগ্নিকুণ্ড নিভে যাওয়ায় এবং মুবিন্যানের স্বপ্ন যাতে তিনি দেখতে পেয়েছেন যে, উটগুলো ঘোড়াগুলোকে তাড়া করছে এবং দজলা অতিক্রম করে জনপদসমূহে ছড়িয়ে পড়েছে। শোন হে আবদুল মাসীহ! যখন তিলাওয়াত বৃদ্ধি পাবে, মোটা ছড়িওয়ালা আত্মপ্রকাশ করবেন, সামাওয়া উপত্যকা প্লাবিত হবে, সাওয়া হ্রদ শুকিয়ে যাবে এবং পারস্যের অগ্নিকুণ্ড নিভে যাবে, তখন শাম আর সাতীহ এর জন্য শাম থাকবে। না। গম্বুজের সমসংখ্যক রাজা-রাণী তার কর্তৃত্ব কেড়ে নেবে, আর সেই সময়টি এসে পড়েছে। একথাটি উচ্চারণ করেই সাঁতীহ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

আবদুল মাসীহ তখনই বাহনে চড়ে কবিতা আবৃত্তি করতে করতে রওয়ানা হয়ে পড়েন। কিসরার নিকট এসে তিনি তাকে শুনান। সাতীহ যা বলেছেন, তার বিবরণ দেন। শুনে কিসরা বলে উঠেন, তার মানে দাঁড়াল, আমার পর চৌদ্দজন রাজা রাজত্ব করবে।

বাস্তবিক পরবর্তী চার বছরে দশজন রাজা পারস্যের সিংহাসনে বসেন। অবশিষ্টগণ রাজত্ব করেন। হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফত পর্যন্ত। বায়যাবীও অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। আমার মতে, পারস্যের সর্বশেষ রাজা যার নিকট থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নেয়া হয়-তিনি হলেন, ইয়াযদাগির্দ ইব্‌ন শাহরিয়ার ইব্‌ন পারভেজ ইব্‌ন হুরমুয। ইব্‌ন নওশিরওয়া। এই রাজার আমলেই রাজপ্রাসাদে ফাটল ধরে। তার আগে তার পূর্বসূরীরা তিন হাজার একশ চৌষট্টি বছর রাজত্ব করেছিলেন। এদের সর্বপ্রথম রাজা ছিলেন খিওমারত ইব্‌ন উমাইম ইব্‌ন লাওয ইব্‌ন সাম ইব্‌ন নূহ।

আলোচ্য সাতীহ এর পরিচয় প্রসঙ্গে ইব্‌ন আসাকির তার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন যে, এই BBDD DBDD D DDD D DDDB BBD DDD DDD DDD DD DDD DD DDBD DDD ইব্‌ন আল-আযদি। কেউ কেউ তাঁকে রবী ইব্‌ন মাসউদও বলেছেন। তার মা রিদ আ বিনতে সাদ ইবনুল হারিছ। আল-হাজুরী। তাঁর বংশ লতিকা ভিন্নভাবেও বর্ণিত হয়েছে। ইব্‌নে আসাকির-এর মতে তিনি জাবিয়ায় বাস করতেন। তিনি আবু হাতিম সাজিস্যতানী থেকে বর্ণনা করেন যে, তার কয়েকজন শায়খ বলেছেন, সাতীহ হচ্ছেন্ন লোকমান ইব্‌ন আদ-এর পরবর্তী যুগের মানুষ। মহাপ্লাবনের আমলে তার জন্ম। বাদশাহ মীনাওয়াসের আমল পৰ্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। অর্থাৎ প্ৰায় ত্রিশ প্রজন্মের আয়ু তিনি লাভ করেন। তীয় আৰাস ছিল তার বাহরাইন।

3G

আবদুল কায়স গোত্র দাবি করে যে, সাতীহ তাদের বংশের লোক, অপরদিকে আযদ গোত্রীয়দের দাবি হচ্ছে যে, তিনি তাদের বংশের। অধিকাংশ মুহাদিস সাতীহকে আযাদ বং বলে অভিমত প্রকাশ করেন। তবে আমি বুঝে উঠতে পারছি না যে, তাঁর প্রকৃত পরিচয় কী? তবে তার বংশধররা নিজেদেরকে আযদবংশীয় বলে দাবি করেন।

ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, সাতীহ-এর সঙ্গে আদম সন্তানের কারো কোনও মিল ছিল না। তাঁর দেহ ছিল গোশতের একটি টুকরা, যার মাথায় দুচোখে ও দুহাতে ছাড়া আর কোথাও অস্থি অথবা শিরা ছিল না। কাপড় যেভাবে ভাঁজ করা যায় তেমনি তাকেও দুপা থেকে ঘাড় পর্যন্ত ভাঁজ করা যেত। জিহবা ছাড়া আর দেহে নাড়বার মত কিছুই ছিল না। কেউ কেউ বলেন, সাতীহ রেগে গেলে তাঁর দেহ ফুলে যেত এবং তিনি বসে পড়তেন।

ইব্‌ন আব্বাস (রা) আরও বলেন, সাতীহ একবার মক্কায় এসেছিলেন। কুসাই এর দুই পুত্ৰ আবদে শামস ও আবদে মানাফ সহ মক্কার নেতৃস্থানীয় অনেকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসেন। তারা তাঁকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করেন। সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব তিনি দেন। শেষ যুগে কী ঘটবে, সে বিষয়েও তারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করে। জবাবে তিনি বলেন, আল্লাহ আমাকে যা ইলহাম করেছেন, তার আলোকে বলছি যে, হে আরব জাতি! তোমরা এখন চরম বার্ধক্যের যুগে উপনীত। তোমাদের আর অনারবদের বুদ্ধি-বিচক্ষণতা সমান। তোমাদের নিকট না আছে বিদ্যা, না আছে বুদ্ধি। তবে তোমাদের পরবর্তীদের মধ্যে এমন কিছু বিবেকবান লোকের আবির্ভাব ঘটবে যে, তারা নানা প্রকার বিদ্যা অন্বেষণ করবে। সেই বিদ্যার আলোকে তারা মূর্তি ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলবে, যোগ্য লোকের অনুসরণ করবে, অনারবদের হত্যা করবে এবং বকরীর পাল তালাশ করে বেড়াবে। অতঃপর এই নগরবাসীদের মধ্যে হতে এমন একজন সুপথপ্ৰাপ্ত নবীর আবির্ভাব ঘটবে, যিনি সত্য ও সঠিক পথের দিক-নির্দেশনা করবেন এবং বহু দেবতার উপাসনা পরিহার করে এক রব এর ইবাদত করবেন। অতঃপর আল্লাহ তাকে প্রশংসিত এক স্থানে তুলে নেবেন। তখন তিনি ইহজগত থেকে আড়ালে থাকবেন; কিন্তু আকাশে থাকবেন প্রকাশমান। তারপর এমন এক সিদ্দিক তথা মহাসত্যবাদী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন, যিনি বিচার করবেন। সঠিক এবং অধিকার প্রদানে হবেন অকুণ্ঠচিত্ত।

এরপর সরল-সঠিক পথের অনুসারী, অভিজ্ঞ ও সন্ত্রান্ত এক ব্যক্তি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন। আতিথেয়তা ও ন্যায় বিচারে তিনি হবেন সর্বজনবিদিত। অতঃপর সাতীহ হযরত উছমান (রা), তাঁর হত্যা এবং তৎপরবর্তী বনু উমাইয়া ও বনু আব্বাসের যুগে যা কিছু ঘটবে, সব উল্লেখ করেন। এরপর যত ফেতনা ও যুদ্ধ-বিগ্ৰহ সংঘটিত হবে, তাও তার বক্তব্য থেকে বাদ পড়েনি। ইব্‌ন আসাকির ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে এই বর্ণনাটি বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন।

উপরে আমরা উল্লেখ করে এসেছি যে, এক স্বপ্নের ব্যাখ্যায় সাতীহ ইয়ামানের বাদশাহ রবীয়া ইব্‌ন নাসরকে ইয়ামানে কী কী অরাজকতা দেখা দিবে এবং কিভাবে ক্ষমতার হাত বদল

হবে, সবকিছুর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এমনকি একথাও বলেছিলেন যে, এক পর্যায়ে

Page 496 missing

কেননা, উপরিউক্ত বর্ণনায় আমরা বলেছি যে, সাতীহ তার ভাগিনাকে বলেছিলেন, হে আবদুল মাসীহ! যখন তিলাওয়াত বৃদ্ধি পাবে, শক্ত ছড়িওয়ালা আত্মপ্রকাশ করবেন, সামাওয়ার উপত্যকা ফুসে উঠবে, সাওয়া হ্রদ শুকিয়ে যাবে ও পারস্যের অগ্নিকুণ্ড নিভে যাবে, সাতীহ-এর জন্য শাম আর শাম থাকবে না, গম্বুজের সংখ্যার সমান সংখ্যক রাজা-রাণী শামের রাজত্ব করবে। আর যা আসবার, তা আসবেই।

এরপর সাতীহর মৃত্যু হয়। ঘটনাটা ছিল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্মের একমাস কিংবা তার চাইতে কিছু কম পরে। তাঁর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ইরাকের সীমান্তবতী সিরিয়ার কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

ইব্‌ন তারারার আল হারীরি বলেন, সাতীহ সাতশ বছরের আয়ু পেয়েছিলেন। আবার কেউ বলেন, পাঁচশ বছর, কেউ বলেন, তিনশ বছর। ইব্‌ন আসাকির বর্ণনা করেন যে, এক বাদশাহ সাঁতীহকে একটি শিশুর বংশ পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, যার পিতৃপরিচয় সম্পর্কে মতভেদ ছিল। জবাবে সাতীহ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তার সমাধান দেন। এমনি এক জটিল সমস্যার সমাধান পেয়ে বাদশাহ তাকে বললেন, সাতীহ! তোমার এই বিদ্যার উৎস সম্পর্কে তুমি আমাকে বলবে কি? জবাবে সাতীহ বললেন, এই বিদ্যা আমার নিজস্ব নয়। আমি এই বিদ্যা লাভ করেছি, আমার সেই ভাইয়ের নিকট থেকে, যিনি সিনাই পৰ্বতে ওহী শ্রবণ করেছিলেন। বাদশাহ বললেন, এমন নয় তো যে, তোমার সেই জিন ভাইটি সর্বক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকে-কখনো তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না? না, এমন নয়- বরং আমি যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি, সেও আলাদা হয়ে যায়। তবে সে যা বলে, আমি তা ছাড়া অন্যকিছু বলি না।

উপরে বর্ণিত হয়েছে যে, সাতীহ এবং আরেকজন ভবিষ্যদ্বক্তা (ইব্‌ন মসআব ইব্‌ন ইযাশকুর ইব্‌ন রাহম ইব্‌ন বুসর ইব্‌ন উকবা) একই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জন্মের পর তাদেরকে তারীফা বিনতে হুসাইন আল হামীদিয়াহ নামী এক গণক ঠাকুরণীর নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। সে তাদের মুখে থুথু দেয়। ফলে তার থেকে তারা জ্যোতিষবিদ্যা লাভ করে। আর সেই গণক ঠাকুরণী সেদিনই মারা যায়। সাতীহ ছিলেন আধা মানুষ। কথিত আছে যে, খালিদ ইব্‌ন আবদুল্লাহ আল-কাঁসরী তাঁরই বংশের লোক। উল্লেখ্য যে, শিক সাতীহ-এর বেশ কিছুকাল আগে মারা যান।

অপরদিকে আবদুল মাসীহ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন কায়সা ইব্‌ন হায়্যান ইব্‌ন নুফায়লা আল-গাসসানী আন-নাসরানী ছিলেন একজন প্ৰবীণ ব্যক্তি। হাফিজ ইব্‌ন আসাকির তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে তাঁর জীবন-চরিত আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন, এই আবদুল মাসীহ-ই খালিদ ইব্‌ন ওলীদ (রা)-এর সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে ইব্‌ন আসাকির দীর্ঘ একটি কাহিনীও উল্লেখ করেছেন এবং এও লিখেছেন যে, খালিদ ইব্‌ন ওলীদ (রা) এক সময় তার হাত থেকে বিষ খেয়েছিলেন। কিন্তু তা তাঁর বিন্দুমাত্র অনিষ্ট করেনি। কেননা বিষের পাত্ৰ হাতে নিয়ে তিনি বলেছিলেন?

এই বলে তিনি পাত্ৰস্থ পদার্থগুলো খেয়ে ফেলেন। খালিদ ইব্‌নে ওলীদের জ্ঞান হারাবার উপক্রম হয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দুহাতে নিজের দুহাতে চাপড় মারেন এবং ঘর্মািক্ত হন। তিনি জ্ঞান ফিরে পান। তখন আবদুল মাসীহকে তিনি কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করে শুনান।

আবু নুআয়ম শুআয়ব এর দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, মারারুদ্য যাহরান নামক স্থানে একজন ধর্মযাজক বাস করতেন। তার নাম ছিল ঈসা। তিনি সিরিয়ার অধিবাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন আস ইব্‌ন ওয়ায়েল এর আশ্রিত। আল্লাহ তাকে প্রচুর জ্ঞান দান করেছিলেন এবং তাতে মক্কাবাসীদের জন্য বহু উপকার করেছিলেন। তাঁর একটি উপাসনালয় ছিল, তাতেই তিনি সর্বদা থাকতেন। বছরে কেবল একবার মক্কায় আসতেন এবং মক্কাবাসীদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতেন। তিনি তাদেরকে বলতেন, হে মক্কাবাসী! অচিরেই তোমাদের মাঝে এমন এক নবজাতকের আবির্ভাব হবে, সমগ্র আরব যার ধর্ম অবলম্বন করবে এবং আজম তথা আরবের বাইরেও তার রাজত্ব ছড়িয়ে পড়বে। এই সেই সময় : যে ব্যক্তি তাকে পাবে এবং তাঁর আনুগত্য করবে, সে কৃতকার্য হবে। আর যে ব্যক্তি তাঁকে পেয়েও তীর বিরুদ্ধাচরণ করবে, সে ব্যর্থকাম হবে। আল্লাহর শপথ! তাঁর অনুসন্ধান ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে মদ-রুটি ও শান্তির দেশ ত্যাগ করে আমি এই অভাব-অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতার দেশে আসিনি। মক্কায় কোন সন্তান ভূমিষ্ঠ হলেই তিনি তার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতেন এবং শুনে বলতেন, না, এখন তার আগমন ঘটেনি। তখন তাকে বলা হতো, তাহলে বলুন না, সেই শিশুটি কেমন হবে? তিনি বলতেন, না, বলা যাবে না। প্ৰতীক্ষিত সেই মহান শিশুটির পরিচয় তিনি তার নিরাপত্তার খাতিরেই গোপন রাখতেন। কারণ তিনি জানতেন যে, সেই শিশুটির স্বজাতি তার অনিষ্ট করার চেষ্টা করবে।

রাসূলুল্লাহ (সা) যে রাতে ভূমিষ্ঠ হন। সেদিন প্রত্যুষে আবদুল্লাহ ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিব এসে ঈসের উপাসনালয়ের প্রধান ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে তাকে ডাক দেন। ডাক শুনে তিনি আওয়াজ করে জিজ্ঞেস করেন, কে? তিনি বললেন, আমি আবদুল্লাহ। যাজক তার নিকটে এসে বললেন, তুমি তার পিতা হও। আমি সেই শিশুটির কথা তোমাদের বলতাম যে, তিনি সোমবার দিনে ভূমিষ্ঠ হবেন, সোমবারে নবুওত লাভ করবেন এবং সোমবারেই তার ইন্তিকাল হবে। সেই প্রতীক্ষিত শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়ে গেছেন। আবদুল্লাহ বললেন, আজ প্রত্যুষে আমার একটি সন্তান জন্মেছে। জিজ্ঞাসা করলেন, তার কি নাম রেখেছেন? আব্দুল্লাহ বললেন, নাম রেখেছি, মুহাম্মদ। পদী বললেন, হে কাবার সেবায়েতগণ! আমারও কামনা এই ছিল যে, সেই শিশুটি যেন আপনাদের মধ্য থেকেই আগমন করেন। তিনটি লক্ষণে আমি বুঝতে পেরেছি যে, আপনার পুত্ৰই সেই প্রতীক্ষিত শিশু। এক, গত রাতে তাঁর নক্ষত্র উদিত হয়েছে। দুই, আজ তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েছেন এবং তিন, তার নাম মুহাম্মদ। আপনি যান। আমি আপনাদেরকে যে শিশুটির কথা বলতাম, আপনার পুত্র তিনিই। আবদুল্লাহ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি করে বুঝলেন যে, আমার পুত্রই তিনি? আজকে তো অন্য শিশুরও জন্ম হয়ে থাকতে পারে? পাদ্রী বললেন, আপনার পুত্রের সঙ্গে তাঁর নাম মিলে গেছে। আর আল্লাহ আলিমদের জন্য তার ইলমকে সন্দেহজনক করেন না। কারণ, তা হলো অকাট্য প্রমাণ স্বরূপ।

তাছাড়া এর আরও একটি প্রমাণ হলো, আপনার পুত্ৰ এখন ব্যাথাগ্রস্ত। তাঁর এই ব্যথা তিনদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এতে তার ক্ষুধা প্রকাশ পাবে। অতঃপর তিনি সুস্থতা লাভ করবেন। আপনি আপনার জিহবাকে সংযত করে চলবেন। কেননা, তার প্রতি এত বেশি বিদ্বেষ পোষণ করা হবে, যা কখনো অন্য কারও বেলায় হয়নি এবং তার উপর এত বেশি অত্যাচার হবে, যা অন্য কারও উপর কোনদিন হয়নি। তার কথা বলার বয়স পর্যন্ত যদি আপনি বেঁচে থাকেন এবং তিনি তার দাওয়াতের কাজ শুরু করেন, তাহলে আপনার স্বজাতির পক্ষ থেকে আপনি এমন আচরণ দেখতে পাবেন, যা আপনি সহ্য করতে পারবেন না। তখন ধৈর্যধারণ আর লাঞ্ছনা ভোগ করা ব্যতীত কোন গতি থাকবে না। অতএব আপনি আপনার জিহবাকে সংযত রাখবেন এবং তাকে চোখে চোখে রাখবেন। আবদুল্লাহ জিজ্ঞাসা করলেন, শিশুটির আয়ু কত হবে? পাদ্রী বললেন, আয়ু তার বেশি হোক আর কম হোক সত্ত্বরে পৌছবে না। সত্ত্বরের নিচে ষাটের ওপরে যে কোন বেজোড় সংখ্যার বয়সে তাঁর মৃত্যু হবে। আর এই হবে তাঁর উম্মতের অধিকাংশের গড় আয়ু।

বর্ণনাকারী বলেন, মুহাররমের দশ তারিখে রাসূলুল্লাহ (সা) মায়ের গর্ভে আসেন এবং হস্তিবাহিনীর যুদ্ধের তেইশ দিন আগে রমযান মাসের বার তারিখে সোমবার ভূমিষ্ঠ হন।

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর লালন-পালনকারী ও দাই-ম্যাগণের বিবরণ

উন্মে আয়মান রাসূলুল্লাহ (সা)-কে লালন-পালন করতেন। তাঁর আসল নাম ছিল বারাকা— এই উম্মে আয়মানকে রাসূলুল্লাহ (সা) উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে নবী করীম (সা) তাঁকে আযাদ করে তাঁর আযাদকৃত গোলাম যায়েদ ইব্‌নে হারিছার সঙ্গে বিবাহ দেন। এই স্ত্রীর গর্ভেই যায়েদ ইব্‌নে হারিছার পুত্র উসামা ইব্‌নে যায়েদ (রা)-এর জন্ম হয়।

হালীমা সাদিয়ার আগে তাঁর মা আমিনা এবং আবু লাহাব-এর দাসী ছুওয়াইবা (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দুধপান করাতেন।

ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাঁদের সহীহদ্বয়ে বর্ণনা করেন যে, আবু সুফিয়ানের কন্যা উন্মে হাবীবা একদিন রাসূল (সা)-কে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমার বোন আযযাহ বিনত আবু সুফিয়ানকে বিয়ে করুন! উত্তরে রাসূল (সা) বললেন : এটি কি তুমি পছন্দ করা? আমি বললাম : জী হ্যাঁ। তবে আমিই তো আপনার একমাত্র স্ত্রী নই? কল্যাণ লাভে আমার বোনটি আমার সাথে শরীক হোক এটি আমার পছন্দনীয়। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : কিন্তু আমার জন্য হালাল হবে না। উন্মে হাবীবাহ বলেন, তখন আমি বললাম, আমরা কিন্তু বলাবলি করছি যে, আপনি আবু সালামার কন্যাকে বিয়ে করতে আগ্রহী। এক বর্ণনায় আবু সালামার কন্যা দুররার নামও উল্লেখ আছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন : তুমি কি উম্মে সালামার কন্যার কথা বলছ? আমি বললাম, জী হ্যাঁ। তিনি বললেন : উম্মে সালামার কন্যা যদি আমার স্ত্রীর সাথে আগত পালিত কন্যা নাও হত, তবুও সে আমার জন্য হালাল হত না। কারণ সে আমার দুধ ভাই এর কন্যা। ছুওয়াইবা আমি এবং আবু সালামা উভয়কেই দুধ পান করান। অতএব তোমরা আমার

○○○

কাছে তোমাদের কন্যা ও বোনদের কোন প্রস্তাব নিয়ে এস না। বুখারীর বর্ণনায় এও আছে যে, উরওয়া (র) বলেন, ছুওয়াইবা হচ্ছেন আবু লাহাবের আযাদকৃত দাসী। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দুধ পান করিয়ে ছিলেন। আবু লাহাব এর মৃত্যুর পর তারই পরিবারের কেউ একজন তাকে অত্যন্ত বিমর্ষ অবস্থায় স্বপ্নে দেখেন। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি এখন কি হালে আছেন? আবু লাহাব বলল, তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর এ পর্যন্ত আমি কোন কল্যাণ চোখে দেখিনি। তবে ছুওয়াইবাকে মুক্ত করে দেয়ার বদৌলতে আমি এই পর্যায়ে উপনীত হয়েছি। এই বলে সে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনীয় মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি ছিদ্রের প্রতি ইংগিত করে।

সুহায়লী প্রমুখ উল্লেখ করেছেন, আবু লাহাবকে যিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন, তিনি তারই ভাই আব্বাস (রা)। ঘটনাটি ঘটেছিল আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর, বদর যুদ্ধের পরে। সেই স্বপ্লের বিবরণে একথাও উল্লেখ আছে যে, আবু লাহাব আব্বাসকে বলেছিল যে, সোমবার দিবসে আমার শাস্তি লঘু করা হয়। অভিজ্ঞ মহল বলেন, তার কারণ এই ছিল যে, ছুওয়াইবা যখন আবু লাহাবকে তার ভাতিজা মুহাম্মদ ইব্‌ন আব্দুল্লাহর জন্যের সুসংবাদ প্ৰদান করে, তক্ষণাৎ সে ছুওয়াইবাকে আযাদ করে দিয়েছিল। এটা তারই পুরস্কার স্বরূপ।

হালীমার ঘরে রাসূলুল্লাহ (সা)

মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক বলেন; অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্য হালীমা বিনতে আবী যুওয়াইব-এর দুধপানের ব্যবস্থা করা হয়। হালীমার পিতা আবু যুওয়াইব-এর পুরো নাম আবদুল্লাহ ইব্‌ন হারিছ। তাঁর বংশলতিকা হচ্ছে এরূপ। আবদুল্লাহ ইব্‌ন শাজনাহ ইব্‌ন জাবির ইব্‌ন রিযাম ইব্‌ন নাসিরা ইব্‌ন সাদ ইব্‌ন বকর ইব্‌ন হাওয়াযিন। ইব্‌নে মনসুর ইব্‌ন ইকরিমা ইব্‌ন হাফসা ইব্‌ন কায়স আইলান ইব্‌ন মুযার। ইব্‌ন ইসহাক বলেন : আর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দুধ পিতা-তথা হালীমার স্বামীর নাম হারিছ ইব্‌ন আবদুল উদ্যযা ইব্‌ন রিফাআ ইব্‌ন মিলান ইব্‌ন নাসিরা ইব্‌ন সাদ ইব্‌ন বকর ইব্‌ন হাওয়াযিন। নবী করীম (সা)-এর দুধ ভাই বোনদের নাম যথাক্রমে আবদুল্লাহ ইব্‌ন হারিছ, আনীস বিনতে হারিছ ও হুযাফা বিনতে হারিছ। হুযাফার অপর নাম শায়মা। ঐতিহাসিকগণ বলেন, এই শায়মাই তার মায়ের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তাদের বাড়িতে তাঁর অবস্থানকালে লালন-পালন করতেন।

ইব্‌ন ইসহাক আবদুল্লাহ ইব্‌ন জাফর ইব্‌ন আবু তালিব সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি হালিমা বিনতে হারিছ সম্পর্কে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন : কোন এক দুর্ভিক্ষের বছর দুগ্ধপোষ্য শিশু সংগ্রহের জন্য বনু সাদের কয়েকজন মহিলার সঙ্গে আমি মক্কায় যাই। (ওয়াকোদী তার সনদে উল্লেখ করেছেন যে, দুগ্ধপোষ্য শিশু অন্বেষণকারী মহিলাদের সংখ্যা ছিল দশ)। দুর্বল একটি গাধীতে সওয়ার হয়ে আমি মক্কায় পৌছি। আমার সঙ্গে ছিল আমারই একটি শিশু সন্তান আর একটি বুড়ো উটনী। আল্লাহর শপথ! উটনীটি আমার এক ফোটা দুধও দিচ্ছিল না। আর শিশুটির যন্ত্রণায় আমরা সেই রাতে একবিন্দুও ঘুমাতে পারিনি। কারণ তাকে খাওয়াবার মত না পেয়েছি আমার স্তনে এক ফোটা দুধ, না পেয়েছি তাকে পান করাবার মত উটনীর সামান্য দুধ। তবে আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠে স্বচ্ছলতা লাভে আশাবাদী ছিলাম।

যা হোক, অতি দুর্বল গান্ধীটির পিঠে সওয়ার হয়ে আমরা মক্কা এসে পৌঁছলাম। দুর্বলতার কারণে গান্ধীটি আমাদেরকে যেন বহন করতে পারছিল না। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমাদের সব কজন মহিলার সম্মুখেই রাসুলুল্লাহ (সা)-কে পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু শিশুটি এতীম শুনে কেউই তাকে গ্ৰহণ করতে সম্মত হল না। আমরা বললাম, এই এতীম শিশুর মা আমাদের কি করতে পারবে? আমরা তো শিশুর পিতার নিকট থেকে সুযোগ-সুবিধা আশা করি। আর এই শিশুটির মা-সে তো আমাদের কিছুই করতে পারবে না।

যা হোক, আমি ছাড়া আমার সঙ্গী সব মহিলা একটি করে শিশু নিয়ে নেয়। আমরা যখন মুহাম্মদ ছাড়া আর কোন শিশুই পেলাম না এবং ফেরার জন্য প্রস্তুতি গ্ৰহণ করলাম; তখন আমার স্বামী হারিছকে বললাম, আল্লাহর শপথ, শিশু সন্তান না নিয়ে এইভাবে শূন্য হাতে ফিরে যেতে আমার খারাপ লাগছে। আমি ওই এতীম শিশুটিকে অবশ্যই নিয়ে যাব। স্বামী বললেন, ঠিক আছে, তাই কর! হতে পারে, আল্লাহ তার মধ্যে আমাদের জন্য বরকত রেখেছেন। আমি গিয়ে শিশুটিকে নিয়ে নিলাম। আল্লাহর শপথ, আমি তো তাকে গ্রহণ করেছিলাম অন্য শিশু না পেয়ে নিতান্ত নিরূপায় হয়ে। এতীম মুহাম্মদকে নিয়ে আমি আমার বাহনের কাছে গেলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, আমার স্তনদ্বয় পর্যাপ্ত দুধে পরিপূর্ণ। শিশু মুহাম্মদ তৃপ্তির সাথে তা পান করে এবং তার দুধ ভাইও সেই দুধ পান করে তৃপ্ত হয়। আমার স্বামী উটনীর নিকট গেলেন। তিনি দেখতে পান যে, তার স্তন দুধে পরিপূর্ণ। উটনী থেকে তিনি দুধ দোহন করলেন। নিজে পান করলেন, আমিও তৃপ্তি সহকারে পান করলাম। আমরা শান্তিতে রাত কাটালাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার স্বামী আমাকে বললেন, হালীমা! আল্লাহর শপথ, আমার মনে হচ্ছে, তুমি একটি বরকতময় শিশুই নিয়েছ। দেখলে না, ওকে আনার পর থেকে এই রাতে আমরা কত কল্যাণ ও বরকত লাভ করলাম! এরপর থেকে আল্লাহ আমাদের জন্য এই কল্যাণ আরও বৃদ্ধি করতে থাকেন।

এরপর আমরা সকলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। শপথ আল্লাহর! আমার গান্ধীটি আমাদের নিয়ে এত দ্রুতগতিতে ছুটে চলে যে, সঙ্গের একটি গাধাও তার নাগাল পাচ্ছিল না। তা দেখে আমার সঙ্গীরা বলতে শুরু করে যে, আবু যুআইব-এর কন্যা! ব্যাপারটা কী? এই কি তোমার সেই গান্ধী, যাতে করে তুমি আমাদের সঙ্গে এসেছিলে? আমি বললাম, হ্যাঁ, এটিই আমার সেই গান্ধী, যাতে চড়ে আমি তোমাদের সঙ্গে এসেছিলাম। তারা বলল, আল্লাহর শপথ! নিশ্চয় এর বিশেষ কোন রহস্য আছে!

এভাবে আমরা বনু সাদ-এর এলাকায় এসে পৌঁছলাম। তখন এই ভূখণ্ড অপেক্ষা আল্লাহর জমীনে অধিকতর অনুর্বর কোন ভূমি ছিল বলে আমার মনে হয় না। আমার বকরীর পাল সারাদিন চরে সন্ধ্যাবেলা তৃপ্ত পেটে স্তন ভর্তি দুধ নিয়ে ফিরে আসতে শুরু করে। আমরা ইচ্ছামত দুধ দোহন করতে লাগলাম। অথচ, আমাদের আশেপাশে তখন কারও বকরীই এক ফোটা দুধ দিচ্ছিল না। প্রতিবেশীর বকরীগুলো সারাদিন চরে সন্ধ্যাবেলা ক্ষুধার্তা পেটেই ফিরে আসতো। তারা তাদের রাখালদের বলে দেয় যে, আবু যুআইব-এর কন্যার বকরী পাল যেখানে চরে, আজ থেকে আমাদের বকরীগুলোও তোমরা সেখানেই চরাবে। ফলে, তারা তাদের বকরী আমার বকরী পালের সঙ্গে চরাতে শুরু করে। কিন্তু তার পরও তাদের বকরী সেই দুধাবিহীন ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফিরতো আর আমার বকর ফিরতো তৃপ্তপেটে স্তন ভর্তি দুধ নিয়েই। এইভাবে দুদুটি বছর পর্যন্ত আল্লাহ আমাদেরকে বরকত দান করতে থাকেন।

দুর্ভিক্ষের কারণে তখনকার পারিপার্শ্বিক অবস্থা এই ছিল যে, পরিণত বয়সের একটি যুবককে একটি কিশোরের সঙ্গে তুলনা করা মুশকিল ছিল। কিন্তু আল্লাহর শপথ, দুটি বছর অতিক্রান্ত হতে না হতে মুহাম্মদ একটি নাদুস-নুদুস বালকে পরিণত হন। আমরা তাকে তার মায়ের নিকট নিয়ে গেলাম। অথচ, তার বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকায় তাকে ফিরিয়ে দিতে আমাদের মন সরছিল না। যা হোক, তার মা তাকে দেখার পর আমি বললাম, আরও একটি বছরের জন্য আপনার পুত্ৰকে আমার নিকট দিয়ে দিন। আমি মক্কার মহামারীতে ছেলেটির আক্রান্ত হয়ে পড়ার আশংকা করছি। আল্লাহর শপথ, আমি কথাটা বারবার বলায় শেষ পর্যন্ত তিনি সম্মত হয়ে বললেন, ঠিক আছে নিয়ে যাও!

তাকে সঙ্গে করে আমরা বাড়ি চলে গেলাম। দুই কি তিন মাস কেটে গেল। একদিন তিনি তাঁর দুধ-শরীক এক ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের বাড়ির পেছনে বকর চরাতে যান। হঠাৎ তাঁর ভাইটি দৌড়ে এসে বলল, আমাদের ঐ কুরাইশী ভাইকে সাদা পোশাক পরা দুজন লোক এসে তাকে শুইয়ে তার পেট চিরে ফেলেছে! খবর শুনে আমি ও তাঁর দুধ পিতা দৌড়ে তার নিকট গিয়ে দেখতে পেলাম, বিবর্ণ অবস্থায় তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর দুধ পিতা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করেন, বাবা! তোমার কী হয়েছে? জবাবে তিনি বললেন, সাদা পোশাক পরা দুজন লোক এসে আমাকে শুইয়ে ফেলে এবং আমার পেট চিরে পেটের ভেতর থেকে কী যেন বের করে ফেলে দিল! তারপর আমার পেট আগে যেমন ছিল তেমনি করে দেয়। হালীমা বলেন, আমরা তাকে ঘরে নিয়ে গেলাম। তাঁর দুধ পিতা বললেন, হালীমা! আশংকা হয় যে, আমার এই সন্তানটিকে জিনে পেয়ে বসেছে। চল, আমরা যা আশঙ্কা করছি, কিছু একটা ঘটে যাওয়ার আগেই ভালোয় ভালোয় আমরা তাকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসি। তাকে নিয়ে আমরা তার মায়ের কাছে চলে গেলাম। দেখে তার মা জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কী, হে স্নেহশীলা ধাত্রী? আমার পুত্রের প্রতি তোমাদের দুজনের এত আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তোমরা একে ফিরিয়ে আনলে কেন? হালীমা ও তাঁর স্বামী বললেন, আল্লাহর শপথ!! আল্লাহর অনুগ্রহে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। এখন এর ব্যাপারে আমাদের মনে নানা আপদ-বিপদের আশংকা হচ্ছে। তাই আপনার পুত্ৰকে আপনার নিকট ফিরিয়ে দিতে আসলাম।

তখন তিনি বলেন, তোমরা কিসের আশংকা করছ? কী ঘটেছে সত্যি করে আমাকে খুলে বল! আমরা তাকে ঘটনার বৃত্তান্ত শোনালাম। শুনে তিনি বললেন, তোমরা কি এর ব্যাপারে দুষ্ট জিনের ভয় করছ? কখনো নয়, আল্লাহর শপথ! আমার এই পুত্রের উপর শয়তানের কোন হাত থাকতে পারে না। আল্লাহর শপথ! আমরা এই পুত্র ভবিষ্যতে বিরাট কিছু হবে। আমি কি তোমাদেরকে এর ঘটনা শোনোব? আমার বললাম, জী হ্যাঁ, শোনান। তিনি বললেন, ও যখন আমার গর্ভে, তখন একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম, যেন আমার ভেতর থেকে এক ঝলক আলো বের হয়ে তাতে সিরিয়ার সকল রাজপ্ৰাসাদ আলোকিত হয়ে গেছে। আবার আমি যখন তাকে প্রসব করি, তখন সে আকাশ পানে মাথা তুলে দুহাতে ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়। সুতরাং তোমরা এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না! এ বর্ণনাটি আরও একাধিক সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে। সীরাত ও মাগায়ী বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে এটি একটি প্রসিদ্ধ বর্ণনা।

ওয়াকিদী… ইব্‌ন আব্বাসের বরাতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, হালীমা একদিন নবী করীম (সা)-এর সন্ধানে বের হন। খুঁজে খুঁজে একস্থানে তাকে তার বোনের সঙ্গে পান। তখন তাদের পালের পশুগুলো শুয়ে রয়েছিল। দেখে হালীমা বললেন, তোমরা এই গরমের মধ্যে বসে। আছ? জবাবে শিশু নবীর বোন বললেন, আম্মা! আমার এ ভাইটির তো গরম পাচ্ছে না। দেখলাম, একখণ্ড মেঘ ওকে ছায়া দিচ্ছে। ও থামলে মেঘও থেমে যায়, ও চললে মেঘও ওর সাথে সাথে চলতে শুরু করে। এই অবস্থায়ই আমরা এই জায়গায় এসে পৌছেছি।

ইব্‌ন ইসহাক খালিদ ইব্‌ন মদান সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, কয়েকজন সাহাবী একদিন রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বললেন, আমাদেরকে আপনার নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন। নবী করীম (সা) বললেন, হ্যাঁ, বলছি; আমি আমার পিতা ইবরাহীমের দোয়া ও ঈসার সুসংবাদ। আর আমি গর্ভে থাকাবস্থায় আমার আম্মা স্বপ্নে দেখেন, তার ভেতর থেকে এক ঝলক নূর বেরিয়ে আসে, যার আলোকে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদসমূহ আলোকিত হয়ে উঠে। সাদ ইব্‌ন বকর গোত্রে আমি ললিত-পালিত হই। একদিন আমি আমাদের ছাগল-ভেড়া চারাচ্ছিলাম। এমন সময় সাদা পোশাক পরিহিত দুজন লোক আমার নিকট আসে। সঙ্গে তাদের বরফ ভর্তি একটি সোনার তশতরী। আমাকে তারা শুইয়ে ফেলে, আমার পেট চিরে ফেলে তারপর হৃৎপিণ্ড বের করে তা চিরে ভিতর থেকে কালো রংয়ের একটি রক্তপিণ্ড বের করে ফেলে দেয়। তারপর সাথে আনা বরফ দ্বারা আমার হৃৎপিণ্ড ও পেট ধুয়ে দিয়ে আমাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। তারপর তাদের একজন অপরজনকে বলে, একে তার দশজন উম্মতের সঙ্গে ওজন কর। অপরজন আমাকে আমার দশজন উম্মতের সঙ্গে ওজন করে। আমার পাল্লা ভারী হয়। তারপর বলে, এবার তাকে তার একশ উম্মতের সঙ্গে ওজন কর! সে আমাকে একশ জনের সঙ্গে ওজন করে। এবারও আমার পাল্লা ভারী হয়। আবার বলে, এবার তাকে তার উম্মতের এক হাজার জনের সঙ্গে ওজন কর। আমাকে এক হাজার জনের সঙ্গে ওজন করে। এবারও আমার পাল্লা ভারী হয়। এইবার লোকটি বলে, হয়েছে, আর প্রয়োজন নেই। একে তার সমস্ত উম্মতের সঙ্গেও যদি ওজন করা হয়, তবু তার পাল্লাই ভারী হবে। এ সনদটি উত্তম।

আবু নুআয়ম তাঁর দালায়িল গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, উতবা ইব্‌ন আবদুল্লাহ বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার প্রথম জীবনের অবস্থা কেমন ছিল? জবাবে নবী করীম (সা) বললেন, যে মহিলা আমাকে দুধ পান করাতেন, তিনি ছিলেন বনু সাদ গোত্রীয়। একদিন আমি আর তার এক পুত্র ভেড়া-বকরী চরানোর জন্য মাঠে যাই। যাওয়ার সময় সঙ্গে করে খাবার কিছু নিয়ে যাইনি। তাই আমি আমার দুধ ভাইকে বললাম, তুমি গিয়ে আম্মার নিকট থেকে খাবার নিয়ে এস। আমার ভাই চলে গেল। আর আমি পশুপালের নিকট রয়ে গেলাম। হঠাৎ দেখি, শকুনের মত দুটি সাদা রংয়ের পাখি আমার দিকে ধেয়ে আসছে। এসে একটি অপরটিকে বলে, এই কি সেই লোক? অপরটি বলল, হ্যাঁ। তারপর তারা দ্রুত আমার একেবারে নিকটে এসে আমাকে চিৎ করে শুইয়ে আমার পেট চিরে ফেলে। তারপর আমার হৃৎপিণ্ড বের করে তার মধ্য থেকে দুটি কালো রক্তপিণ্ড বের করে। তারপর বরফের পানি দিয়ে আমার পেট ধুয়ে নেয়। তারপর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে আমার হৃদপিণ্ড ধোয়। তারপর আমার হৃদয়ে প্রশান্তি ঢেলে দেয়। তারপর একজন অপরজনকে বলে, এবার সেলাই করে দাও। পেট সেলাই করে আমার ওপর নবুওতের মোহর অংকিত করে দেয়। তারপর একজন অপরজনকে বলে, একে দাড়ির এক পাল্লায় রেখে আর তার উন্মতের এক হাজার জনকে অপর পাল্লায় রেখে ওজন কর। সে মতে আমাকে ওজন করা হল। আমি দেখলাম, এক হাজার জনের পাল্লা উপরে ওঠে গেল। আমার ভয় হচ্ছিল, তাদের কেউ আমার পর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কিনা। তখন একজন বলল, যদি এর সকল উম্মতের সঙ্গেও একে ওজন করা হয়, তবু এর পাল্লা ভারী হবে।

তারপর তারা আমাকে ফেলে চলে যায়। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর মায়ের নিকট গিয়ে ঘটনা খুলে বললাম। শুনে তিনিও শংকিত হয়ে পড়েন: পাছে আমার কোন ক্ষতি হয়ে যায়। তাই তিনি বললেন, তোমার জন্য আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উটের পিঠে করে আমাকে আমার আম্মার নিকট নিয়ে গেলেন। বললেন, আমি আমার আমানত বুঝিয়ে দিলাম ও দায়িত্ব পালন করলাম। এই বলে তিনি আমার সব ঘটনা খুলে বললেন। কিন্তু সব শুনেও আমার আম্মা বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। তিনি বললেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমার ভেতর থেকে এক ঝলক নূর বের হয়, যার আলোকে সিরিয়ার রাজ-প্ৰাসাদগুলো আলোকিত হয়ে যায়। এই বর্ণনায় এমন একজন রাবী রয়েছেন যার জাল হাদীস রটনার দুর্নােম রয়েছে-যদরুন হাফিজ ইব্‌ন আসাকির বর্ণনা করেন যে, আবুযর গিফারী (রা) বলেছেন, একদিন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি করে জানলেন এবং কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে, আপনি নবী? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, শোন হে আবু যর! আমি মক্কার উপকণ্ঠে অবস্থান করছিলাম। এই সময়ে দুজন ফেরেশতা আমার নিকট আগমন করেন। একজন মাটিতে অবতরণ করেন। আর অপরজন আকাশ ও জমিনের মধ্যখানে অবস্থান করেন। এক পর্যায়ে তাদের একজন অপরজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনিই কি সেই লোক? অপরজন বললেন হ্যাঁ, ইনিই সেই লোক। তখন প্ৰথমজন বললেন : একে একজন মানুষের সঙ্গে ওজন কর। ফেরেশতা আমাকে একজন মানুষের সঙ্গে ওজন করে। ওজনে আমার পাল্লা ভারী হয়।

ইব্‌ন আসাকির সম্পূর্ণ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। এতে তিনি নবী করীম (সা)-এর বক্ষবিদারণ, বক্ষ সেলাই ও দুই কাঁধের মাঝে মোহরে নবুওত স্থাপনের কথাও উল্লেখ করেছেন। এ বর্ণনায় অতিরিক্ত আছে- এরপর তারা চলে যান। আমি যেন এখনো তা দিব্যি দেখতে পাচ্ছি।

সহীহ মুসলিমে আনাস ইব্‌ন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, একদিন শিশু নবীর নিকট জিবরাল (আঃ) আগমন করেন। নবী করীম (সা) তখন অন্য বালকদের সাথে খেলা করছিলেন। জিবরাল (আ) শিশু নবীকে ধরে মাটিতে শুইয়ে তাঁর পেট চিরে তাঁর হৃদপিণ্ড বের করে আনেন। তারপর হৃৎপিণ্ড থেকে একটি কালো রক্তপিণ্ড বের করেন এবং বলেন, এটি শয়তানের অংশ। তারপর সোনার একটি পাত্রে যমযমের পানি দ্বারা হৃদপিণ্ডটি ধুয়ে নেন। অতঃপর তা যথাস্থানে স্থাপন করে দেন।

ঘটনা দেখে বালকরা দৌড়ে নবীজির দুধ-মায়ের নিকট এসে বলে, মুহাম্মদকে খুন করা হয়েছে। শুনে সকলে তাঁর নিকট দৌড়ে আসে। তখন তার মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে। আনাস (রা:) বলেন, আমি তার বুকে সেই সেলাইয়ের দাগ দেখতে পেতাম।

ইব্‌ন আসাকির আনাস (রা) সূত্রে আরও বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, নামায মদীনায় ফরয হয়। দুইজন ফেরেশতা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এসে তাকে যমযমের কাছে নিয়ে যান। তারপর তার পেট চিরে নাড়িজুড়ি বের করে একটি সোনার পেয়ালায় নিয়ে যমযমের পানি দ্বারা তা ধুয়ে দেন। তারপর তার উদরকে প্রজ্ঞা ও ইলম দ্বারা ভরে দেন।

অন্য সূত্রে আনাস (রা) থেকে আরও বর্ণিত আছে। তিনি বলেছেন, পরপর তিন রাত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট কয়েকজন ফেরেশতা আগমন করেন। তাদের একজন অন্যদেরকে বলেন, মানুষের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং তাদের নেতাকে নিয়ে চল। ফেরেশতারা তাকে যমযমের নিকট নিয়ে যান এবং তার পেট বিদীর্ণ করেন। তারপর একটি সোনার পাত্র এনে শিশু নবীর পেটকে ধুয়ে তা প্রজ্ঞাও ঈমান দ্বারা ভরে দেন।

উল্লেখ্য যে, সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত মিরাজের হাদীসেও উক্ত রাতে নবীজির বক্ষবিদারণ এবং যমযমের পানি দ্বারা তা ধৌত করার ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। তবে এতে কোনও বৈপরীত্য নেই। কারণ, হতে পারে একই ঘটনা নবী করীম (সা)-এর জীবনে দুবার ঘটেছে। একবার তাঁর শৈশবে আর একবার মিরাজের রাতে, তাকে উধৰ্ব্বজগতে আরোহণ এবং আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার উপযোগীর জন্য প্রস্তুতি করার লক্ষ্যে।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীগণকে বলতেন, আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ আরবী, আমি কুরাইশী এবং দুধপান করেছি। আমি সাদ ইব্‌ন বকর গোত্রে।

ইব্‌ন ইসহাক আরো বলেন, দুধ ছাড়ানোর পর হালীমা শিশু নবীকে তার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দিতে যাওয়ার পথে একদিন তিনি নবীজিকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে নাসারাদের একটি কাফেলার সঙ্গে তাদের সাক্ষাত হয়। দেখে কাফেলার লোকেরা শিশু নবীর দিকে এগিয়ে এসে তাকে চুমো খায় এবং বলে, এই বালকটিকে অবশ্যই আমরা আমাদের রাজার নিকট নিয়ে যাব। কারণ, ছেলেটি ভবিষ্যতে বিরাট কিছু হবে। হালীমা বড় কষ্টে পুত্ৰকে তাদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনেন। ইব্‌ন ইসহাক বলেন, উক্ত কাফেলার হাত থেকে মুক্ত করে তাঁকে নিয়ে যখন হালীমা মক্কার নিকটে চলে আসেন, তখন হঠাৎ শিশু নবী (সা) হারিয়ে যান। অনেক খোঁজাখুঁজি করে হালীমা আর তাকে পেলেন না। সংবাদ পেয়ে দাদা আবদুল মুত্তালিব নিজে এবং আরও একদল লোক তাঁর সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। খুঁজতে খুঁজতে ওয়ারাকা। ইব্‌ন নওফল ও অপর এক ব্যক্তি তাঁর সন্ধান পান। পেয়ে তাঁকে তারা দাদা আবদুল মুত্তালিবের নিকট নিয়ে যান। আবদুল মুত্তালিব শিশু নবীজিকে কাঁধে তুলে নিয়ে বায়তুল্লাহয় চলে যান এবং তাওয়াফে শিশু নবীজির নিরাপত্তার জন্য দোয়া করেন। অতঃপর তাকে তাঁর মায়ের নিকট ফিরিয়ে দেন।

উমাবী বর্ণনা করেন যে, আবদুল মুত্তালিব পুত্র আবদুল্লাহকে আদেশ করেন, যেন তিনি শিশু নবীজিকে সঙ্গে করে নিয়ে আরবের বিভিন্ন গোত্রে ঘুরে তার জন্য একজন দাই-মা ঠিক করে নেন। আবদুল্লাহ শিশু নবীকে দুধ পান করানোর জন্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে হালীমাকে ঠিক করেন।

বর্ণিত আছে যে, শিশু নবী হালীমার নিকট ছয় বছর অবস্থান করেন। এই সময়ে তাঁর দাদা বছরে একবার তাকে দেখতে যেতেন। বাক্ষাবিদারণের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর হালীমা শিশু নবীকে তার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দিয়ে যান। তিনি যখন আট বছরের বালক, তখন মা আমিনা মৃত্যুবরণ করেন। এবার দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। তাঁর দশ বছর বয়সের সময় দাদা আবদুল মুত্তালিবও মারা যান। তখন নবীজির লালন-পালনের দায়িত্ব হাতে নেন, তার দুই আপনি চাচা যুবোয়র ও আবু তালিব। তের বছর বয়সে তিনি চাচা যুবায়র-এর সঙ্গে ইয়ামান গমন করেন। এই সফরে তাঁর কয়েকটি আলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পায়। তার একটি হলো, চলার পথে একটি উট তাকে দেখেই বসে পড়ে। এমনকি তার বুক মাটি স্পর্শ করে। নবীজি (সা) তাতে চড়ে বসেন। আরেকটি ঘটনা হলে, ইয়ামানের একস্থানে তখন বাঁধভাঙ্গা প্লাবন হচ্ছিল। নবীজির উসিলায় আল্লাহ তাআলা বন্যার পানি শুকিয়ে দেন। কাফেলার সকলে অনায়াসে পথ অতিক্রম করে। তারপর চাচা যুবোয়র নবীজির চৌদ্দ বছর বয়সে মারা যান। এইবার চাচা আবু তালিব একাই নবীজি (সা)-কে লালন-পালন করতে শুরু করেন। এ বর্ণনায় একজন দুর্বল রাবী রয়েছেন।

মোটকথা, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর শৈশবেই হালীমা সাদিয়া ও তাঁর পরিবার-পরিজনের ওপর তার বরকত প্ৰকাশ পায়। তারপর সেই বরকত হাওয়াযিন গোত্রের সকলের ওপর ছড়িয়ে পড়ে: পরবর্তীকালে যখন তাদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর নবী করীম (সা) তাদেরকে বন্দী করেন তখন তারা সেই দুধপানের দোহাই দিয়ে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। নবী করীম (সা) তাদেরকে মুক্তিদান করেন এবং তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্ৰদৰ্শন করেন। এটি মক্কা বিজয়ের একমাস পরের ঘটনা। পরে যথাস্থানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আসবে, ইনশাআল্লাহ।

হাওয়াযিন-এর ঘটনা সম্পর্কে ইব্‌ন ইসহাক বৰ্ণনা করেন যে, আমর ইব্‌নে শুয়াইব এর দাদা বলেছেন, হুনায়নে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি তাদের থেকে প্রাপ্ত গনীমতের মাল ও বন্দীদের নিয়ে রওয়ানা হলে হাওয়াযিন-এর একটি প্রতিনিধি দল জিয়িরারানা নামক স্থানে তার সঙ্গে সাক্ষাত করে। তারা তখন ইসলাম গ্ৰহণ করে ফেলেছে। এসে তারা বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার আপনজন ও আত্মীয়। আমরা যে বিপদে পড়েছি তা আপনার অজানা নয়। আপনি আমাদের প্রতি দয়া করুন, আল্লাহ। আপনার প্রতি দয়া করবেন। যুহায়র ইব্‌ন সরদ নামক তাদের একজন বক্তা দাঁড়িয়ে বলে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! বন্দী মহিলাদের মধ্যে আপনার ঐসব খালা আর বোনরাও আছে, যারা আপনাকে কোলে-কাঁধে নিয়ে লালন- পালন করেছিল। এখন যদি আমরা শিমর এর পুত্র কিংবা নুমান ইব্‌ন মুনয্যির এর পুত্রকে

(շo Գ

দুধপান করিয়ে থাকতাম এবং পরে যদি তাদের পক্ষ থেকেও আমাদের প্রতি সেইরূপ বিপদ আসতো, যেমন এসেছে, আপনার পক্ষ থেকে, তাহলে তো আমরা তাদের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করতাম। অথচ, আপনি হচ্ছেন শ্ৰেষ্ঠ অভিভাবক। এই বলে সে কবিতার কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করে :

–হে আল্লাহর রসূল! মহানুভবতা দ্বারা আপনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। আপনিই আমাদের প্রত্যাশিত ও নির্বাচিত ব্যক্তি।

আপনি এমন রমণীর প্রতি অনুগ্রহ করুন, ভাগ্য যাকে (তার স্বগোত্রের কাছে ফিরে যাওয়া থেকে) বিরত রেখেছে, যার জীবন বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে এবং তার জীবন ধারায় এসেছে পরিবর্তন।

যে আমাদের যুগকে বানিয়ে রেখেছে। দুঃখে আর্তনাদকারী। ঐ সকল লোক যাদের রয়েছে সীমাহীন মর্মবেদনা ও দুঃখের প্রচণ্ড চাপ।

যদি না আপনার পক্ষ থেকে সম্প্রসারিত বরকতময় হাত তার ক্ষতিপূরণ করে। হে শ্ৰেষ্ঠ সহনশীল মানব! যার সহনশীলতা প্ৰকাশ পায় যখন তাকে পরীক্ষা করা হয়।

আপনি সেই মহিলাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন, যাদের দুধ আপনি পান করেছেন। যখন আপনার সুখ তাদের দুধেপূর্ণ থাকতো। অনুগ্রহ করুন সেই সব মহিলাদের প্রতি তখন আপনার জন্য শোভনীয় হত, আপনি যা করতেন এবং যা করতেন না। সবই।

আপনি আমাদের ঐ ব্যক্তির ন্যায় করবেন না, যে মৃত্যুবরণ করেছে। আপনি আমাদেরকে বঁচিয়ে রাখুন। কেননা, আমরা একটি সমুজ্জ্বল সম্প্রদায়।

নিশ্চয় আমরা নিয়ামতের শোকর আদায় করে থাকি, যদিও অন্যত্র তার না-শোকরী করা হয়। আমাদের এ কৃতজ্ঞতা আজকের দিনের পরও বহাল থাকবে।

উল্লেখ্য যে, যুহায়র ইব্‌ন সরদ ছিলেন তার গোত্রের নেতা। তিনি বলেন, হুনায়নের দিন আমাদেরকে বন্দী করে রাসূলুল্লাহ (সা) যখন আমাদের নারী-পুরুষদের আলাদা করছিলেন, তখন হঠাৎ আমি তাঁর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাই এবং কবিতার ছন্দে তার হাওয়াযিন গোত্রে প্ৰতিপালিত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেই। অন্য বর্ণনায় এ পংক্তিগুলোতে ঈষৎ শাব্দিক পরিবর্তন সহ বর্ধিত আরো কয়েকটি চরণ আছে, যা নিম্নরূপ।

–হে আল্লাহর রাসূল! স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানের ক্ষেত্রে আপনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। আপনিই আমাদের কাজ্যিক্ষত ও প্রত্যাশিত ব্যক্তি।

সুতরাং আপনি আপনার যে মায়ের দুধ পান করতেন, তাকে আপনি ক্ষমার পোশাক পরিয়ে দিন। ক্ষমা খ্যাতি প্রসারের হেতু হয়ে থাকে।

আমরা আপনার নিকট ক্ষমার প্রত্যাশা করি, যা দ্বারা আপনি এই কয়েকটি প্রাণীকে আচ্ছাদিত করবেন।

অতএব, আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন! আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি থেকে কিয়ামতের দিন

আল্লাহ। আপনাকে রক্ষা করবেন। যখন আপনাকে সফলতা প্ৰদান করা হবে।

সবকিছু শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, এই গনীমত ও বন্দীদের মধ্যকার যারা আমার ও বনু আবদুল মুত্তালিবের ভাগে আসবে, তা আমি আল্লাহর ওয়াস্তে তোমাদেরকে দান করে দিলাম।

একথা শুনে আনসারগণ বললেন, তাহলে যা আমাদের ভাগে আসবে, আমরাও তা আল্লাহ ও তার রাসূলের খাতিরে দান করলাম।

এই সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা) নারী ও শিশুসহ ছয় হাজার লোককে মুক্তি দান করেছিলেন এবং তাদেরকে বিপুল সংখ্যক পশু ও দাস-দাসী প্রদান করেন। আবুল হুসায়ন ইব্‌ন ফারিস মন্তব্য করেন যে, সেই দিন নবী করীম (সা) যে সম্পদ ফিরিয়ে দেন এবং যেসব বন্দীদের মুক্ত করে দেন, তার মূল্য ছিল পঞ্চাশ কোটি দেরাহাম। আর এইসব ছিল তাদের জীবনে পাওয়া নবীজির নগদ বরকত। যারা দুনিয়ার জীবনে নবী করীম (সা)-এর অনুসরণ করবে, আখিরাতে তারা তাঁর যে কি পরিমাণ বরকত লাভ করবে তা সহজেই অনুমেয়।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, হালীমার ঘরে দুধপান পর্ব শেষে ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহর হেফাজতে মা আমিনা ও পরে দাদা অৰিনুলিম্বুিজলিব-এর সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন। আল্লাহ তাকে উত্তমরূপে লালন-পালন কল্পতে থাকেন। তাঁর বয়স ছয় বছরে উপনীত হলে মা বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স যখন ছয় বছর, তখন তার মা আমিনা মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী আবওয়া নামক স্থানে ইন্তিকাল করেন। নবীজিকে সঙ্গে করে তিনি তার মাতুলালয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তারা ছিলেন আব্দী ইব্‌ন নাজ্জার গোত্রভুক্ত। মক্কায় প্ৰত্যাবর্তনের পথে তার ইন্তিকাল হয়।

ওয়াকিদী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সঙ্গে করে মা মদীনায় তার মাতুলালয়ে যান। দাসী উম্মে আয়মানও সঙ্গে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স তখন ছয় বছর।

উন্মে আয়মান বলেন, এ সময়ে একদিন দুজন ইহুদী আমার নিকট এসে বলল, আহমদকে নিয়ে এস দেখি! আমরা তাকে দেখতে এসেছি। তারা তাকে দেখে ফিরিয়ে দিয়ে একজন অপরজনকে বলে, এ ছেলেই এই উম্মতের নবী। আর এটাই হল তার হিজরত স্থল। একে কেন্দ্র করে অনেক যুদ্ধবিগ্রহের ঘটনা ঘটবে। মা আমিনা এ সংবাদ শুনে ঘাবড়ে যান এবং তাকে নিয়ে ফেরত রওয়ানা হন। এই ফেরার পথেই আবওয়া নামক স্থানে তার ইন্তিকাল হয়।

ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, বুরায়দা (রা) বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে বের হই। ওয়াদান নামক স্থানে উপনীত হলে নবী করীম (সা) বললেন, তোমরা এখানে অবস্থান কর, আমি আসছি। এই বলে তিনি চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফিরে আসেন। এসে বললেন :

আমি আমার আম্মার কবরের কাছে গিয়ে আমার রব-এর নিকট তার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি চাই। কিন্তু তিনি আমাকে তা থেকে বারণ করলেন। আর আমি তোমাদেরকে ইতিপূর্বে যিয়ারত করতে বারণ করেছিলাম। এখন থেকে তোমরা কবর যিয়ারত করবে। তিনদিনের পর কুরবানীর পশুর গোশত খেতেও আমি তোমাদেরকে বারণ করেছিলাম। এখন থেকে যে কদিন ইচ্ছা তা খেতে পারবে এবং যতদিন ইচ্ছা ধরে রাখতে পারবে। তোমাদেরকে আমি মদের পাত্রে পানি পান করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন থেকে সেই নিষেধাজ্ঞাও তুলে নিলাম।

বায়হাকী বর্ণনা করেন যে, হযরত বুরায়দা (রা) বলেছেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) একটি কবরের নিকট গিয়ে বসে পড়েন। দেখাদেখি লোকেরাও তাঁর চতুষ্পার্শ্বে বসে পড়ে। বসে নবী করীম (সা) মাথা নাড়তে নাড়তে কাঁদতে লাগলেন। উমর (রা) তার নিকটে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কাঁদছেন কেন ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)? নবী করীম (সা) বললেন, এটি আমার আম্মা আমিনা বিনতে ওহব-এর কবর। আমার রব-এর নিকট আমি তার এই কবরটি যিয়ারত করার অনুমতি চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দেন, কিন্তু তার মাগফিরাতের আবেদন করার অনুমতি চাইলে তিনি তাতে সম্মতি দিলেন না। মায়ের কথা ভেবে আমি কাদছি। বর্ণনাকারী বলেন, সেইদিনের মত এত বেশি সময় ধরে কাদতে নবীজিকে কখনও দেখা যায়নি।

আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ (রা)-এর বরাতে বায়হাকী বর্ণনা করেন, ইব্‌ন মাসউদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এক দিন কবরস্থান যিয়ারত করতে বের হন। আমরাও তাঁর সঙ্গে বের হলাম। তাঁর আদেশে আমরা এক জায়গায় বসে পড়লাম। তিনি ঘুরে ঘুরে কবর দেখছেন। এক পর্যায়ে একটি কবরের নিকট গিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে যান। দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত নিম্নস্বরে কি যেন বলতে থাকেন। তারপর তিনি কেঁদে উঠেন। তার কান্না দেখে আমরাও কেঁদে ফেললাম। অবশেষে তিনি আমাদের কাছে ফিরে আসেন। উমর ইব্‌ন খাত্তাব (রা) এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! আপনি কাঁদছেন কেন? আপনার কান্না তো আমাদেরকেও কাঁদিয়েছে এবং ভয় পাইয়ে দিয়েছে! তিনি আমাদের নিকটে এসে বসলেন এবং বললেন, আমার কান্না বুঝি তোমাদেরকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে? আমরা বললাম, জী হ্যাঁ। তিনি বললেন, যে কবরটির সামনে আমাকে তোমরা কথা বলতে দেখেছ, সেটি আমিনা বিনতে ওহব-এর কবর। আমার রব-এর নিকট আমি তার যিয়ারত করার অনুমতি প্রার্থনা করেছিলাম। তিনি আমাকে অনুমতি প্ৰদান করেন। আবার তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার অনুমতিও চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার রব সেই অনুমতি দিলেন না এবং আমার প্রতি নাযিল করলেন :

আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মুমিনদের জন্য সংগত নয়। যখন একথা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, তারা জাহান্নামী। ইবরাহীম তার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, তাকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে। অতঃপর যখন তার নিকট এ কথা সুস্পষ্ট হলো যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইবরাহীম তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল। ইবরাহীম তো কোমল-হৃদয় ও সহনশীল। (তাওবা : ১১৩-১১৪)

ফলে মায়ের জন্য পুত্রের হৃদয় যেভাবে বিগলিত হয় আমার অবস্থাও ঠিক তাই হলো। এ কারণেই আমি কেঁদেছি। বর্ণনাটি গরীব পর্যায়ের। হাদীছের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবে তার উল্লেখ নেই। ইমাম মুসলিম হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একদিন তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করেন। তখন তিনি নিজেও কান্নাকাটি করেন এবং আশেপাশের লোকদেরও কাদান। তারপর তিনি বলেন, আমার রব-এর নিকট আমি আমার মায়ের কবর জিয়ারত করার অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি আমাকে অনুমতি দেন। কিন্তু মায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে আমার রব আমাকে সেই অনুমতি দেননি। এখন থেকে তোমরা কবর যিয়ারত করবে, কবর তোমাদেরকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিবে। ইমাম মুসলিম আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! বলুন তো আমার আব্বা কোথায়? নবী করীম (সা) বললেন, জাহান্নামে। একথা শুনে লোকটি ফিরে যেতে উদ্যত হলে তিনি তাকে ডেকে বললেন, আমার পিতা এবং তোমার পিতা উভয়েই জাহান্নামে।

বায়হাকী হযরত সাদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, এক বেদুঈন নবী করীম (সা)-এর নিকট এসে বলল, আমার আব্বা আত্মীয় বৎসল ছিলেন। তার অমুক অমুক গুণ ছিল। এখন তিনি কোথায় আছেন? জবাবে নবী করীম (সা) বললেন, জাহান্নামে। বর্ণনাকারী বলেন, একথা শুনে বেদুঈন অস্থির হয়ে পড়ে এবং বলে, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা:)! আপনার পিতা কোথায়? নবী করীম (সা) বললেন, যখনই তুমি কোন কাফিরের কবর অতিক্রম করবে, তাকে জাহান্নামের সংবাদ দেবে। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর লোকটি মুসলমান হয়ে যায়।

পরে সে বলে, রাসূলুল্লাহ (সা) আমার উপর একটি কষ্টকর কাজ দিলেন। এরপর থেকে আমি যখনই যে কাফিরের কবরের নিকট দিয়ে অতিক্রম করেছি। তাকেই জাহান্নামের সংবাদে দিয়েছি। এটাও গরীব পর্যায়ের বর্ণনা, বিশুদ্ধ হাদীসসমূহে অনুক্ত।

ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ ইব্‌ন আমর (রাঃ) বলেছেন, একদিন আমরা রাসূলুলাহ (সা)-এর সঙ্গে হাঁটছিলাম। হঠাৎ একজন মহিলা দেখা গেল। তাকে নবী করীম (সা) চিনেছেন বলে আমরা ধারণা করিনি। রাস্তার মধ্যখানে এসে নবী করীম (সা) দাড়িয়ে যান। মহিলাও নবীজির নিকটে এসে দাঁড়ান। তখন দেখা গেল, তিনি রাসূলুলাহ (সা)-এর কন্যা ফাতিমা। নবী করীম (সা) বলনে, ফাতিমা! কিসে তোমাকে তোমার ঘর থেকে বের করে আনলো? ফাতিমা (রা) বললেন, এই গৃহবাসীদের মৃতের আত্মার মাগফেরাত প্রার্থনা ও সমবেদনা প্রকাশের জন্য এখানে এসেছি। নবী করীম (সা) বললেন, বোধহয় তুমি তাদের সঙ্গে কবর পর্যন্ত গিয়েছিলে? জবাবে তিনি বললেনঃ লোকদের সঙ্গে মৃতের কবর পর্যন্ত যাওয়া থেকে আল্লাহ আমাকে রক্ষা করুন। আমি তো এ বিষয়ে আপনি যা বলে থাকেন তা শুনেছি। নবী করীম (সা) বললেন, যদি তুমি তাদের সঙ্গে কবর পর্যন্ত যেতে, তবে জান্নাত দেখতে পেতে না, যতক্ষণ না তোমার বাপের দাদা তা প্ৰত্যক্ষ করতেন। আহমদ আবু দাউদ, নাসায়ী ও বায়হাকী প্রমুখ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে এর একজন রাবীকে অনেকে বিতর্কিত বলেছেন। আবদুল মুত্তালিব জাহেলী দীনের অনুসারী রূপেই মারা যান। তবে তার এবং আবু তালিবের দীনের ব্যাপারে শিয়াদের ভিন্নমত রয়েছে। আবু তালিবের ওফাত অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হবে।

বায়হাকী তাঁর দালায়লুন নুবুওয়াহ গ্রন্থে এই হাদীসগুলো উল্লেখ করে মন্তব্য করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পিতা-মাতা ও দাদার অবস্থা আখিরাতে কেন এরূপ হবে না? তারা তো পৌত্তলিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন এবং ঈসা (আ)-এর দীনেরও তাঁরা অনুসরণ করতেন না। তবে তাদের এই কুফৱীতে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বংশ পরিচয়ে কোন কলংক আসে না। কারণ, কফিরে কফিরে বিবাহ শুদ্ধ। এ কারণেই স্বামী স্ত্রী একত্রে ইসলাম গ্রহণ করলে বিবাহ নবায়ন করতে হয় না বা তাতে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে হয় না। উল্লেখ্য যে, একাধিক সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে যে, দুই নবীর মধ্যবর্তী সময়কার মানুষ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু, পাগল এবং বধিরদেরকে কিয়ামতের চত্বরে পরীক্ষা করা হবে। তখন তাদের কেউ জবাব দিতে পারবে, কেউ পারবে না। আমার মতে এই হাদীসের বক্তব্য আয় নবী করীম (সা)-এর পিতা-মাতা ও দাদা সম্পর্কে জাহান্নামী হওয়ার সংবাদ প্রদানের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কেননা, সে সময় এরাও ঐ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবেন, যারা জবাব দানে অক্ষম হবে।

এই আয়াতের তাফসীরে আমি বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।

সুহায়লী কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীসে আছে যে, আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দোয়ায় আল্লাহ তাআলা তাঁর পিতা-মাতা দুজনকেই জীবিত করেছিলেন। জীবন পেয়ে তারা নবীর প্রতি ঈমান আনয়ন করেন। আল্লাহর কুদরতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে এমনটি সম্ভবপর

হলেও প্রকৃত পক্ষে এই বর্ণনাটি একান্তই মুনকার পর্যায়ের। সহীহ হাদীসে এর বিপরীত বক্তব্য রয়েছে। আল্লাহই সম্যক জ্ঞাত।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, মা আমিনা বিনতে ওহব-এর মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ (সা) দাদা আবদুল মুত্তালিব ইব্‌ন হাশিম-এর তত্ত্বাবধানে থাকেন। সে সময়ে কাবার ছায়ায় আবদুল মুত্তালিবের জন্য বিছানা পাতা হত। আবদুল মুত্তালিব তাতে বসতেন এবং তাঁর সন্তান-সন্ততিরা সেই বিছানার চারদিকে বসে পড়ত। তাঁর সম্মানার্থে কেউই বিছানার উপরে উঠে বসতি না। নাদুস-নুদুস বালক নবী (সা)-ও সেই মজলিসে আসতেন এবং আবদুল মুত্তালিবের বিছানার ওপর বসে পড়তেন। তা দেখে তার চাচারা তাকে ধরে সরিয়ে বসাবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব বলতেন, আমার এ নাতিটিকে তোমরা ছেড়ে দাও। আল্লাহর শপথ! ভবিষ্যতে ও বিরাট কিছু হবে। এই বলে আবদুল মুত্তালিব নবীজিকে নিজ হাতে ধরে নিজের বিছানায় বসিয়ে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন এবং তিনি যা করতে চাইতেন, তাতে সহযোগিতা করতেন।

ওয়াকিদী একাধিক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) মা আমিনার কাছে থাকতেন। মায়ের ইন্তিকাল হলে দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আবদুল মুত্তালিব তাকে নিজের ঔরসজাত সন্তানদের চাইতেও বেশি স্নেহ করতেন এবং সব সময় তাকে কাছে কাছে রাখতেন। শয়নে-স্বপনে সর্বাবস্থায় নবীজি দাদা আবদুল মুত্তালিবের একান্তে যেতে পারতেন। দাদার বিছানায় গিয়ে বসলে আবদুল মুত্তালিব বলতেন, একে তোমরা ছেড়ে দাও, আমার এই সন্তানটি কালে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে।

বনু মুদলাজ এর একদল লোক আবদুল মুত্তালিবকে বলল, এই ছেলের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখবেন। কারণ এর পায়ের আকৃতি মাকামে ইব্রাহীমের পায়ের আকৃতির সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ আর কোন পা আমরা দেখিনি। একথা শুনে আবদুল মুত্তালিব আবু তালিবকে বললেন, শোন, এরা কী বলছে! সেই তখন থেকে আবু তালিব নবী করীম (সা)-কে বিশেষ হেফাজতে রাখতে শুরু করেন। আবদুল মুত্তালিব উন্মে আয়মানকে—যিনি নবীজিকে কোলে-কাখে নিতেন-বলেছিলেন, বারাকাহ! আমার এই নাতির ব্যাপারে উদাসীন হয়ে না। আমি একে সিদরাতুল মুনতাহার নিকট বালকদের সঙ্গে দেখতে পেয়েছি। আর আহলে কিতাবদের ধারণা আমার এই সন্তানটি এই উম্মতের নবী হবে। উল্লেখ্য যে, আবদুল মুত্তালিব যখনই খানা খেতেন বলতেন, আমার নাতিকে নিয়ে এস। তখন নবীজিকে তার কাছে এনে দেয়া হত। মৃত্যুকালে আবদুল মুত্তালিব আবু তালিবকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দেখাশুনা করার জন্য অসিয়ত করে যান। এই অসিয়তের পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং হাজুন নামক স্থানে সমাধিস্থ হন।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আট বছরে উপনীত হলে তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর প্রাক্কালে তিনি তাঁর কন্যাদের ডেকে তাদের বিলাপ করার আদেশ দেন। সেই মেয়েরা হলো, আরওয়া, উমাইয়া, বাররা, সাফিয়া, আতিকা ও উন্মে হাকীম আল-বায়যা। তাদের পিতাকে শুনিয়ে তারা যে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন ইব্‌ন ইসহাক সেগুলি উদ্ধৃত করেন। এগুলো ছিল খুবই মর্মস্পশী বিলাপ। ইব্‌ন ইসহাক এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইব্‌ন হিশাম বলেন, এই কবিতাগুলো যে তাদেরই, তা যথাৰ্থ বলে কোন কাব্য বিশারদই স্বীকার করেন নি।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, আবদুল মুত্তালিব ইব্‌ন হাশিমের মৃত্যুর পর যমযম ও পানি পান। করানো (সিকায়া)-এর দায়িত্ব তাঁর পুত্র আব্বাসের ওপর অর্পিত হয়। আব্বাস (রা) বয়সে তার ভাইদের মধ্যে সকলের কনিষ্ঠ। ইসলামের প্রতিষ্ঠা লাভ করা পর্যন্ত এই দায়িত্ব তাঁরই হতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা)-ও এই দায়িত্ব তাঁরই হাতে বহাল রাখেন। দাদা আবদুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ (সা) আবদুল মুত্তালিবের ওসিয়ত অনুসারে চাচা আবু তালিব-এর তত্ত্বাবধানে থাকতে শুরু করেন। আবু তালিব ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পিতা আবদুল্লাহর সহোদর। তাঁদের দুজনেরই মা হলেন, ফাতিমা বিনতে আমর ইব্‌ন আয়িয ইব্‌ন ইমরান ইব্‌ন মািখযুম। রাসূলুল্লাহ (সা) চাচার সঙ্গে সঙ্গেই থাকতেন।

ওয়াকিদীর বর্ণনায় আরো আছে, আবু তালিবের সংসার ছিল অসচ্ছল। রাসূলুল্লাহ (সা)-কে তিনি এত বেশি আদর করতেন যে, নিজের ঔরসজাত সন্তানদেরকে তত আদর করতেন না। রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নিজের পার্শ্বে না নিয়ে তিনি ঘুমাতেন না। বাইরে কোথাও গেলে তাঁকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। তাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আহার করতেন। তাকে ছাড়া আহার করলে আবু তালিব এবং তাঁর পরিবারের কারও আহারে তৃপ্তি আসত না। সবাই খেতে বসলে আবু তালিব বলতেন, তোমরা একটু অপেক্ষা কর, আমার আদরের দুলালটি এসে যাক। রাসূলুল্লাহ (সা) এসে তাদের সঙ্গে আহার করলে তাদের আহার্য উদৃত্ত থাকতো। এ ব্যাপারে আবু তালিব বলতেন, তুমি বড় বরকতময়। সকালে ঘুম থেকে উঠলে সবাইকে যেখানে মলিন ও আলুথালু মনে হত, সেখানে রাসূলুল্লাহকে অনেক দীপ্তিময় ও লাবণ্যময় দেখাতো।

হাসান ইব্‌ন আরাফা (র) বর্ণনা করেন যে, ইব্‌ন আব্বাস (রা) সূত্রে বলেছেন, ভোর হলে আবু তালিব শিশুদের জন্য একপাত্রে খাওয়ার আয়োজন করতেন। শিশুরা বসে কাড়াকড়ি করে খেতে শুরু করত। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (স) সেই কাড়াকড়িতে যোগ দিতেন না। তিনি হাত সরিয়ে নিতেন। দেখে চাচা আবু তালিব তার জন্য আলাদা পাত্রের ব্যবস্থা করেন।

ইব্‌ন ইসহাক বৰ্ণনা করেন, লাহাব গোত্রের এক ব্যক্তি গণক ছিল। লোকটি মক্কায় আসলে কুরাইশের লোকেরা তাদের সন্তানদেরকে তার কাছে নিয়ে যেত। একবার রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ওপর গণকের চোখ পড়ে। এক পর্যায়ে সে বলে, ওই ছেলেটিকে আমার কাছে নিয়ে এসো। তার অতিরিক্ত আগ্রহ দেখে আবু তালিব তাকে সরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু গণক বলতে থাকে, আরে এইমাত্র আমি যে ছেলেটিকে দেখলাম, ওকে একটু আমার কাছে নিয়ে এস। আল্লাহর শপথ, ভবিষ্যতে ও বিরাট কিছু হবে। বর্ণনাকারী বলেন, কিন্তু আবু তালিব নবীজিকে নিয়ে সরে পড়েন।

1 Comment
Collapse Comments

রাসূলের জন্মের সময় কি তাঁর পিতা বেঁচে ছিলেন? তথ্যটি যাচাই বাছাই দেখবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *