২৫. উমাইয়া ইব্‌ন আবুস সালত ছাকাফী

উমাইয়া ইব্‌ন আবুস সালত ছাকাফী

হাফিজ ইব্‌ন আসাকির বলেন, উমাইয়া ইব্‌ন আবুস সালত-এর বংশ লতিকা নিম্নরূপঃ উমাইয়া ইব্‌ন আবুস সালত আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আবী রবীয়া ইব্‌ন আওফ ইব্‌ন আকদ ইব্‌ন আযযা ইব্‌ন আওফ ইব্‌ন ছাকীফ ইব্‌ন মুনাব্বিহ ইব্‌ন বাকর ইব্‌ন হাওয়াযিন আবু উছমান, তাকে আবুল হাকাম ছাকাকী বলা হত। তিনি জাহিলিয়তের যুগের একজন কবি। ইসলামের পূর্বে তিনি দামেশকে আগমন করেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি সরল পথের অনুসারী এবং জীবনের শুরু থেকেই ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। পরবর্তীতে তার ঈমান-বিচূতি ঘটে। পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা তার কথাটি উল্লেখ করেছেন। আয়াতটি হল :

তাদেরকে ঐ ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শোনাও, যাকে আমি দিয়েছিলাম নিদর্শন, তারপর সে তা বর্জন করে ও শয়তান তার পেছনে লাগে, আর সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। (৭ আরাফ : ১৭৫)

যুবাইর ইব্‌নে বাক্কার বলেন,- এর কন্যা হচ্ছে রুকাইয়া আবদ শামস ইব্‌ন আবদ মানাফ কবি উমাইয়া ইব্‌ন আবুস সালত -এর মা। আবুস সালত- এর মূল নাম রবীয়া ইব্‌ন ওহব ইব্‌ন আল্লাজ ইব্‌ন আবু সালামা ইব্‌নে ছাকীফ।

অন্যরা বলেন, উমাইয়ার পিতা ছিলেন তায়েফের বিখ্যাত কবিদের একজন। উমাইয়া ছিল এদের মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতিমান।

আব্দুর রাযযাক ছাওৱী সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আমর (রা) উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এই আয়াতে উমাইয়া ইব্‌নে আবুস সালতের প্রতিই ইঙ্গিত করা

হয়েছে।

আবু বকর ইব্‌নে মরদুইয়া নাফে ইব্‌নে আসিম ইব্‌নে মাসউদ হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি একদিন এমন একটি মজলিসে উপস্থিত ছিলাম, যেখানে আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আমরও ছিলেন। সেই মজলিসে এক ব্যক্তি সূরা আরাফের পূর্বোক্ত আয়াত পাঠ করলে আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আমর (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি জান, লোকটি কে? উত্তরে কেউ

ব্যক্তি। আব্দুল্লাহ ইব্‌নে আমর (রা) বললেন, না। প্রশ্ন করা হল, তবে লোকটি কে? তিনি বললেন, লোকটি হচ্ছে উমাইয়া ইব্‌ন আবুস সালত। আবু সালেহ, কালবী ও কাতাদা প্রমুখ অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

তাবারানী বর্ণনা করেন যে, আবু সুফিয়ান বলেন, আমি এবং উমাইয়া ইব্‌ন আবুস সালত। ছাকাফী একবার বাণিজ্য উপলক্ষ্যে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। পথে কোথাও যাত্রা বিরতি দিলে উমাইয়া আমাকে একটি লিপিকা পাঠ করে শুনাতো। এইভাবে আমরা খৃষ্টানদের একটি গ্রামে গিয়ে পৌছি। তখন গ্রামের খৃষ্টানরা এসে উমাইয়াকে স্বাগত জানায় এবং উমাইয়া তাদের সাথে তাদের বাড়ীতে যায়। দুপুরে ফিরে এসে সে পরনের পোষাক খুলে ফেলে দুটি কালো কাপড় পরে নেয় এবং পরে আমাকে বলল, আবু সুফিয়ান! এই অঞ্চলে একজন বিজ্ঞ খৃষ্টান আলেম আছেন, আপনি ইচ্ছা করলে তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমি বললাম, না, আমার কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহর শপথ! যদি সে আমাকে আমার মনঃপূত কোন কথা বলে, তাতে আমি তার প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পারব না। আর যদি সে আমার দৃষ্টিতে অগ্ৰীতিকর কোন কথা বলে, তা হলে আমি অবশ্যই তার প্রতি ক্ষুব্ধ হবো।

আবু সুফিয়ান বলেন, এর পর উমাইয়া চলে যায় এবং জনৈক প্রবীণ খৃষ্টানের সাথে কথা বলে। আবার আমার নিকট ফিরে আসে। এসে বলল, আচ্ছা এই প্ৰবীণ লোকটির নিকট যেতে আপনার বাধা কোথায়? আমি বললাম, আমি তো তার ধর্মের অনুসারী নই! উমাইয়া বলল, তা সত্ত্বেও তা থেকে কিছু বিস্ময়কর কথা তো শুনতে পারবেন এবং তাকে দেখতে পারবেন।

তারপর সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছ। আপনি কী ছাকীফ বংশীয়? আমি বললাম, না। বরং আমি কুরাইশী। উমাইয়া বলল, তবে লোকটির কাছে যেতে আপনার অসুবিধাটা কোথায়? আল্লাহর শপথ! অবশ্যই তিনি আপনাদেরকে ভালোবাসেন ও আপনাদের মঙ্গল কামনা করেন।

আবু সুফিয়ান বলেন, এ কথা বলে উমাইয়া আমার নিকট থেকে চলে গিয়ে তাদের নিকট রয়ে যায়। পরে রাতের কিছু অংশ অতিবাহিত হওয়ার পর এসে কাপড় ছেড়ে সে সটান বিছানায় শুয়ে পড়ে। আল্লাহর শপথ! সারাটা রাত সে ঘুমায় নি বা উঠেও যায়নি। ভোরে তাকে ক্লান্ত- শ্ৰান্ত ও চিন্তিত অবস্থায় দেখা যায়। সারাদিন সে আমাদের সাথে কোন কথাও বলেনি,

আমরাও তার সাথে কোন কথা বললাম না।

অতঃপর সে বলল, এবার কি আমরা রওয়ানা হতে পারি? আমি বললাম, তোমার নিকট বাহন আছে কি? সে বলল, হ্যাঁ আছে। আমরা রওয়ানা হলাম। টানা দুই রাত পথ চললাম। তৃতীয় রাতে উমাইয়া আমাকে বলল, আবু সুফিয়ান! কথা বলছেন না যে! আমি বললাম, তুমিই তো কথাবার্তা ছেড়ে দিয়েছ। আল্লাহর শপথ! আমি বললাম, তোমার আবার প্রত্যাবর্তন স্থল আছে নাকি হে? সেদিন তুমি তোমার বন্ধুর নিকট থেকে আসা অবধি আমি তোমাকে যেমন দেখছি, তেমনটি তোমাকে আমি কখনো দেখিনি। উমাইয়া বলল, ব্যাপারটির হেতু আপনি নন। আমি আমার প্রত্যাবর্তন স্থল সম্পর্কে ভীত। আল্লাহর শপথ! আমি একদিন মৃত্যুবরণ করব। তারপর আমাকে জীবিত করা হবে। আমি বললাম, তুমি কি আমার আমানত গ্ৰহণ করতে পার? উমাইয়া বলল, কোন শর্তে আমি আপনার আমানত গ্রহণ করব? আমি বললাম, এই শর্তে যে, পুনরায় উত্থিত করা হবে না এবং তোমার কোন হিসাব-নিকাশও নেওয়া হবে না। এ কথা শুনে উমাইয়া হেসে দিল এবং বলল, আবু সুফিয়ান!! আমরা অবশ্যই পুনরুখিত হবো। তারপর আমাদের হিসাব-নিকাশ নেওয়া হবে। পরিশেষে একদল জান্নাতে প্ৰবেশ করবে। আর এক দল জাহান্নামে যাবে। আমি বললাম, তা তুমি এই দুটার কোনটায় যাবে বলে তোমার বন্ধুটি তোমাকে জানালো? উমাইয়া বলল, আমার বন্ধুর এ ব্যাপারে আন্দীে কোন জ্ঞান নেই। আমার ব্যাপারে তো নয়ই, তার নিজের ব্যাপারেও নয়।

আবু সুফিয়ান বলেন, এভাবে আমরা আরও দুই রাত কাটালাম। সে আমাকে আজব-আজব কথা শোনায় আর আমি হেসে খুন হই। এক সময়ে আমরা দামেশকের গোতা অঞ্চলে এসে পৌঁছি। এখানে আমরা আমাদের পণ্য সম্ভার বিক্রয় করি এবং দুই মাস অবস্থান করি। তারপর রওয়ানা হয়ে আমরা একটি খৃষ্টান পল্লীতে গিয়ে উপনীত হই। সেখানকার লোকেরা উমাইয়াকে দেখে এগিয়ে আসে এবং তাকে উপটৌকনাদি দেয়। উমাইয়া তাদের সাথে তাদের গীর্জায় যায় এবং দুপুরের পরে ফিরে এসে কাপড় পাল্টিয়ে আবার চলে যায়। এইবার সন্ধ্যা রাতের পর ফিরে এসে কাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। আল্লাহর শপথ! সারাটা রােত্র সে একদণ্ড ঘুমাল না। চিন্তিত ও ভারাক্রান্ত মনে এপাশ-ওপাশ করে কাটাল। সে-ও আমাদের সাথে কোন কথা বলল না, আমরাও তার সাথে কথা বললাম না।

অতঃপর সে বলল, এবার আমরা রওয়ানা হই। আমি বললাম, ইচ্ছা হলে চল! আমরা রওয়ানা হলাম। কয়েক রাত কেটে গেল। উমাইয়া তেমনি-ই দুঃখ ভারাক্রান্ত রয়ে গেল। তার পর সে বলল, আবু সুফিয়ান! আসুন, আমরা দ্রুত অগ্রসর হয়ে সংগীদের আগে চলে যাই। আমি বললাম, কেন? কোন প্রয়োজন আছে নাকি? সে বললো, আছে বৈ কি! তখন আমরা দুইজন সংগীদের পেছনে ফেলে খানিকটা সামনে এগিয়ে গেলাম। এবার উমাইয়া বললো, আচ্ছা, উতবা ইব্‌নে রবীয়া সম্পর্কে বলুন তো, তিনি কি অন্যায়-অবিচার এবং বৈধ-অবৈধ বিবেচনা করে চলেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ! উমাইয়া বলল, তিনি কি আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং বজায় রাখতে আদেশ করেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ! উমাইয়া বলল, পিতা-মাতা উভয় দিক থেকেই কি তিনি কুলীন-সমাজে শ্রদ্বেয় ব্যক্তি? আমি বললাম, হ্যাঁ।

উমাইয়া বলল, আচ্ছা, আপনার জানা মতে কুরাইশ বংশে তার চাইতে সন্ত্রান্ত ব্যক্তি আর কেউ আছেন কি?

আমি বললাম, না, আল্লাহর শপথ! তার চাইতে সন্ত্রান্ত আর কেউ আছে বলে আমি জানি না।

উমাইয়া বলল, তিনি কি দরিদ্র? আমি বললাম, না। বরং তিনি প্রচুর সম্পদের অধিকারী।

আমি বললাম, একশ পেরিয়ে গেছে। উমাইয়া বলল, আচ্ছা বংশ-মর্যাদা, সম্পদ এবং বয়স কি তাকে বিপথগামী করেছে?

আমি বললাম, না, কেন এ সব তাঁকে বিপথগামী করবে? বরং এ সব তাঁর কল্যাণ আরো বৃদ্ধি করেছে। উমাইয়া বলল, তা-ই বটে! এখন কি ঘুমাবে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তারপর আমি শয়ন করলাম। আর উমাইয়া তার সামান- পত্রের নিকট চলে গেল। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে এক স্থানে অবতরণ করে রাত কাটালাম। তারপর আবার রওয়ানা হলাম। আমরা দুইটি খোরাসানী উটনীতে সওয়ার হয়ে চলতে লাগলাম। আমরা একটি খোলা ময়দানে গিয়ে পীেছলাম। তখন উমাইয়া বলল, উতবা ইব্‌নে রবীয়া সম্পর্কে বলুন, তিনি কি অবৈধ কাজ ও জুলুম-অত্যাচার পরিহার করে চলেন? তিনি কি আত্মীয়তা বজায় রাখেন এবং তা বজায় রাখার জন্য আদেশ করেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ! তিনি তা করেন। উমাইয়া বলল, তিনি কি সম্পদশালী। উমাইয়া বলল, কুরাইশ গোত্রে তার চেয়ে সম্ভান্ত আর কেউ আছে বলে আপনি জানেন কি? আমি বললাম, না।

উমাইয়া বলল, তার বয়স কত হবে? আমি বললাম, একশর উপরে। উমাইয়া বলল, বয়স, বংশ-মর্যাদা এবং সম্পদ তাকে বিপথগামী করেছে কি? আমি বললাম, না, আল্লাহর শপথ! এইসব তাকে বিপথগামী করেনি।

আমি বললাম, তুমি যা বলতে চাচ্ছি, তা বলে ফেল!

উমাইয়া বলল, আমি যা বলছি তুমি তা কারো কাছে তা প্ৰকাশ করবে না। উতবা ইব্‌ন রবীয়ার ব্যাপারে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। তারপর সে বলল, আমি এ খৃষ্টান পণ্ডিতকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তার একটি ছিল এই যে, এই প্ৰতীক্ষিত নবী সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? বললেন, তিনি তো আরবের লোক হবেন। আমি বললাম, তিনি যে, আরবের লোক হবেন তা তো আমি জানি। আমার প্রশ্ন হল, তিনি আরবের কোন গোত্রের লোক হবেন? ঐ খ্ৰীষ্টান পণ্ডিত বললেন, তিনি আরবের হজ্জ তত্ত্বাবধানকারী পরিবারের লোক হবেন। আমি বললাম, হ্যাঁ, আমাদের এমন একটি ঘর আছে, যাকে কেন্দ্র করে আরবরা হজ্জ করে থাকে। এবার পণ্ডিত বললেন, তিনি হবেন কুরায়শ বংশের লোক। এ কথাটি শোনার পর আমি এমন ব্যথিত হয়ে পড়লাম, যেমনটি এর আগে কখনো হইনি। যেন দুনিয়া ও আখিরাতের তাবৎ সাফল্য হাতছাড়া হয়ে গেল। আমি আশা করতাম যে, সেই প্ৰতীক্ষিত নবী আমিই হবো।

তারপর আমি বললাম, আমাকে লোকটির আরো কিছু বিবরণ দাও! জবাবে সে বললো : যৌবন অতিক্রম করে যখন তিনি প্রৌঢ়ত্বে পদাপর্ণ করবেন, তখন তাঁর প্রথম কাজ হবে এই যে, তিনি অন্যায়-অবিচার এবং হারাম কাজ থেকে বিরত থাকবেন। নিজে আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখবেন এবং অন্যদেরকেও তা বজায় রাখতে আদেশ করবেন। তিনি হবেন পিতা-মাতা উভয় কুল থেকে সন্ত্রান্ত, বিত্তহীন, সমাজে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর বাহিনীর অধিকাংশ হবেন ফেরেশতা।

আমি বললাম, তার লক্ষণ কি? তিনি বললেন, ঈসা ইব্‌ন মারিয়াম (আ)-এর দুনিয়া ত্যাগের পর থেকে সিরিয়ায় এ পর্যন্ত আশিটি ভূমিকম্প ঘটেছে। তার প্রতিটিতে একটি করে বিপদ ছিল। এখনো এমন একটি ব্যাপক ভূমিকম্প অবশিষ্ট আছে, যাতে একাধিক বিপদ থাকবে।

আবু সুফিয়ান বলেন, এই কথা শুনে আমি বললাম, আল্লাহর শপথ! এটা মিথ্যা কথা। আল্লাহ। যদি একান্তই রাসূল পাঠান তাহলে বয়স্ক ও সন্ত্রান্ত লোক ছাড়া কাউকেও রাসূল করে পাঠাবেন না। জবাবে উমাইয়া বলল, তুমি যার নামে শপথ করেছ, আমিও তাঁরই নামে শপথ করে বলছি যে, ঘটনাটি এরূপই হবে, হে আবু সুফিয়ান!! খৃষ্টান পণ্ডিতের কথা নিঃসন্দেহে সত্য।

এই আলোচনার পর আমরা শুয়ে রাত কাটালাম। অতঃপর তল্লি- তল্পা নিয়ে আবার যাত্ৰা শুরু করলাম। অগ্রসর হতে হতে যখন আমাদের এবং মক্কার মাঝে মাত্র দুই দিনের পথ বাকী থাকলো, ঠিক এমন সময় পেছন থেকে এক আরোহী এসে আমাদের সঙ্গে মিলিত হল। পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই সে বলতে শুরু করল যে, আপনাদের চলে আসার পরীক্ষণেই সিরিয়ায় এক ভূমিকম্প হয়ে সব তছনছ করে ফেলেছে, ফলে তার অধিবাসীদের উপর নানা রকম মহা বিপদ নেমে এসেছে।

আবু সুফিয়ান বলেন, এ কথা শুনে উমাইয়া আমার কাছে এসে বলল, আবু সুফিয়ান!! খৃষ্টান পণ্ডিতের কথাটা তোমার এখন কেমন মনে হচ্ছে?

আমি বললাম, এখন তো আমার মনে হচ্ছে যে, তোমার সংগী তোমাকে যা বলেছিল, সত্যই বলেছে।

আবু সুফিয়ান বলেন, তারপর আমি মক্কা এসে কয়েকদিন সেখানে অবস্থান করে আবার বাণিজ্য উপলক্ষে ইয়ামানে চলে যাই। সেখানে আমি পাঁচ মাস অবস্থান করি। অতঃপর মক্কায় ফিরে আসি। মক্কায় আসার পর লোকেরা আমার ঘরে এসে প্ৰত্যেকে নিজ নিজ পণ্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে শুরু করল। মুহাম্মদ ইব্‌ন আব্দুল্লাহও আসলেন। হিন্দ তখন আমার অদূরে বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধূলা করছিল। মুহাম্মদ এসে আমাকে সালাম দিলেন কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন, এবং আমার সফরের খোঁজখবর নিলেন। কিন্তু তার পণ্যসম্ভার সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। তারপর উঠে চলে গেলেন।

আমি তখন হিন্দকে লক্ষ্য করে বললাম, আল্লাহর শপথ! বিষয়টা আমার নিকট অদ্ভূত ঠেকছে। কুরায়শের যত লোকের আমার কাছে পণ্য আছে, তারা একে একে প্রত্যেকে নিজ নিজ পণ্যের খোঁজখবর নিল। কিন্তু মুহাম্মদ নিজের পণ্য সম্পর্কে একটি কথাও জিজ্ঞেস করলেন না। জবাবে হিন্দ আমাকে বলল, আপনি কি তার ঘটনা জানেন না? আমি আতঙ্কগ্ৰস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী ঘটনা? জবাবে হিন্দ বলল, সে দাবি করে যে, সে নাকি আল্লাহর রাসূল! সঙ্গে সঙ্গে আমার খৃষ্টান পণ্ডিতের কথাটা মনে পড়ে গেল এবং আমার সমস্ত শরীর শিউরে উঠলো। অবস্থা দেখে হিন্দ আমাকে বলল, তোমার আবার কী হলো? আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম এবং বললাম, তুমি যা বললে। সব মিথ্যা কথা। মুহাম্মদ এত নির্বোধি নয় যে, এ রকম কথা বলবে। হিন্দ বলল, আল্লাহর শপথ, অবশ্যই মুহাম্মদ তা বলছে এবং একথা রীতিমত সুপচার করে বেড়াচ্ছে! এতদিনে তো এই মতের পক্ষে তার বেশ কজন সঙ্গী-সাখী ও জুটে গিয়েছে। আমি বললাম, এইসব বাজে কথা।

আবু সুফিয়ান বলেন, অতঃপর আমি ঘর থেকে বের হয়ে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করতে শুরু করলাম। হঠাৎ মুহাম্মদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমি বললাম, তোমার পণ্য তো এত দামে বিক্রয় হয়েছে। তুমি বেশ লাভবান হয়েছ। লোক পাঠিয়ে টাকাগুলো নিয়ে নাও। তবে অন্যদের থেকে যে হারে আমি লভ্যাংশ নিয়েছি, তোমার নিকট থেকে তা নেব না। কিন্তু তিনি তাতে রাজী হলেন না এবং বললেন, তাহলে আমি আমার অংশ গ্রহণই করব না। আমি বললাম, ঠিক আছে, আপনি লোক পাঠিয়ে দিন। আমি অন্যদের নিকট থেকে যে হারে লাভ নিয়েছি, আপনার থেকেও সে হারেই নেবো। এরপর মুহাম্মদ লোক পাঠিয়ে তার টাকা নিয়ে নেন। এবং আমিও তার নিকট থেকে সেই হারে লাভ গ্রহণ করি, যে হারে অন্যদের নিকট থেকে নিয়েছি।

আবু সুফিয়ান বলেন, এই ঘটনার অল্প পরেই আমি ইয়ামানে যাই। তারপর তায়েফ গিয়ে উমাইয়া ইব্‌নে আবুস সালত-এর নিকট যাই। উমাইয়া বলল, হে আবু সুফিয়ান। খৃষ্টান পণ্ডিতের কথাটা কি তোর মনে পড়ে? আমি বললাম, মনে পড়ে বৈ কি? সে ব্যাপারটি তো বাস্তবায়িত হয়ে গিয়েছে। উমাইয়া জিজ্ঞেস করল, কে সেই লোক? আমি বললাম, আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ। উমাইয়া বলল, আবদুল মুত্তালিব-এর ছেলে আবদুল্লাহর পুত্র? আমি বললাম, হ্যাঁ, তা-ই। এই বলে আমি হিন্দের মুখে শ্রুত ঘটনাটি বিস্তারিত বিবৃত করলাম। শুনে উমাইয়া ঘর্মাসিক্ত হয়ে গেল এবং বলল, আল্লাহই ভালো জানেন। তারপর সে বলল, হে আবু সুফিয়ান খৃষ্টান পন্ডিত যে বিবরণ দিয়েছিলেন, যতদূর মনে হয় মুহাম্মদের মধ্যে তার সবই বিদ্যমান। আমার জীবদ্দশায় যদি মুহাম্মদ তাঁর দাবিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান তাহলে তার সাহায্য না করার জন্য আমি আল্লাহর নিকট ওযরখাহী করব।

আবু সুফিয়ান বলেন, অতঃপর আমি পুনরায় ইয়ামান চলে গেলাম। ইয়ামান পৌঁছামাত্র জানতে পারলাম যে, মুহাম্মদের সংবাদ এখানেও পৌছে গেছে। পুনরায় তায়েফ গিয়ে উমাইয়াকে বললাম, আবু উছমান। মুহাম্মদের সংবাদ তো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এবার তুমি কী করবে, সিদ্ধান্ত নাও। উমাইয়া বলল, আল্লাহর শপথ! আমি ছাকীষণ গোত্র ব্যতীত অন্য গোত্রের নবীর প্রতি কিছুতেই ঈমান আনিব না।

আবু সুফিয়ান বলেন, অতঃপর আমি মক্কায় চলে আসি! এসে দেখতে পেলাম যে, জনতার হাতে মুহাম্মদের সংগীরা প্রহৃত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে। তা দেখে আমি মনে মনে বলতে লাগলাম, তার ফেরেশতা বাহিনী এখন কোথায় গেল? আমি মনে মনে গর্ব বোধ করলাম।

অপেক্ষাকৃত সংক্ষেপে বর্ণনাটি বায়হাকীর কিতাবুদ দালাইলেও বর্ণিত হয়েছে, তাবারানীর অন্য এক বর্ণনায় আবু সুফিয়ান ও উমাইয়া ইব্‌নে আবুসসালত-এর কথোপকথনে অতিরিক্ত আছে :

উমাইয়া বলল, আমি আমার কাছে রক্ষিত বিভিন্ন কিতাবে পড়েছি যে, আমাদের এ কঙ্করময় অঞ্চল থেকে একজন নবী প্রেরিত হবেন। ফলে আমি ধারণা করতাম, বরং আমার দৃঢ় বিশ্বাসই ছিল যে, আমিই হবো সেই ব্যক্তি। কিন্তু পরে বিভিন্ন পণ্ডিতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে জানতে পারলাম যে, তিনি হবেন আবদে মানাফের বংশের লোক। চিন্তা-ভাবনা করে আমি আবদে মানাফের বংশে উতবা ইব্‌নে রবীয়া ছাড়া আর কাউকে এর উপযুক্ত বলে খুঁজে পেলাম না। কিন্তু আপনার মুখে তাঁর বয়সের কথা শুনে বুঝতে পারলাম যে, তিনিও সেই ব্যক্তি নন। কারণ, তিনি অনেক আগেই চল্লিশ পেরিয়ে গেছেন, অথচ তার প্রতি ওহী নাযিল হয়নি।

আবু সুফিয়ান বলেন, এর কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়। আমি কুরাইশের এক বণিক কাফেলার সঙ্গে ইয়ামানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পথে উমাইয়ার সাথে দেখা হলে উপহাস করে তাকে বললাম, উমাইয়া! তুমি যে নবীর কথা বলতে, তার আবির্ভাব তো ঘটে গেছে। উমাইয়া বলল, তিনি অবশ্যই সত্য নবী, তুমি তার অনুসারী হয়ে যাও! আমি বললাম, তার অনুগামী হতে তোমাকে কে বাধা দেয়? উমাইয়া বলল, আমাকে শুধু ছাকীফ গোত্রের নারীদের লজা দেওয়ার ভয়ই বাধা দিচ্ছে। তাদের কাছে আমি বলে বেড়াতাম যে, আমিই হবো সেই ব্যক্তি। এখন যদি তারা আমাকে আবদে মানাফের গোত্রের এক নবীর অনুসরণ করতে দেখে তবে তারা আমাকে লজ্জা দিবে। উমাইয়া বলল : আমি যেন দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, হে আবু সুফিয়ান! তুমি তার বিরোধিতা করছে। তারপর ছাগল ছানার মত রজ্জ্ববিদ্ধ অবস্থায় তুমি তার নিকট নীত হচ্ছে। আর তিনি তোমার ব্যাপারে তার ইচ্ছামত ফয়সালা দিচ্ছেন।

আবদুর রাযযাক কালবী থেকে বর্ণনা করেন যে, কালবী বলেন, উমাইয়া একদিন শুয়ে ছিল। সঙ্গে তার নিজের দুই কন্যা। হঠাৎ তাদের একজন ভয়ে চীৎকার করে উঠল। চীৎকার শুনে উমাইয়া জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, তোমার কি হয়েছে? কন্যাটি বলল, আমি দেখলাম, দুটি শকুন ঘরের ছাদ ফাঁক করে ফেলল এবং একটি শকুন আপনার কাছে এসে আপনার পেট চিরে ফেলল। অপরটি ঘরের চালের ওপর দাড়িয়ে ছিল। চালের উপরের শকুনটি নিচেরটিকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, সে কি স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন? অপরটি বলল, হ্যাঁ। প্রথমটি আবার জিজ্ঞেস করল, সে কি তীক্ষধী? অপরটি বলল, না। এ ঘটনা শুনে উমাইয়া বলল, তোমাদের পিতার কল্যাণই কামনা করা হয়েছে।

ইসহাক ইব্‌নে বিশর সাঈদ ইব্‌ন মুসায়্যাব থেকেও বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। সাঈদ ইব্‌নে মুস্যায়াব (র) বলেন, মক্কা বিজয়ের পর উমাইয়া ইব্‌ন আবুস সালত এর বোন ফারিআ একদিন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করে। ফারিআ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও সুন্দরী। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে খুব পছন্দ করতেন। একদিন তিনি তাকে বললেন, ফারিআ! তোমার ভাইয়ের কোনো কবিতা কি তোমার স্মরণ আছে? ফারিআ বললেন, জী হ্যাঁ, আছে বৈকি। তবে আমার দেখা একটি ঘটনা তার চেয়েও বিস্ময়কর। ঘটনাটি হলো এই যে, আমার ভাই একবার সফরে গিয়েছিলেন। সফর থেকে ফিরে এসে আমার কাছে আসেন এবং আমার খাটে শয়ন করেন। আমি তখন একটি চামড়ার পশম খসাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম যে, সাদা রঙের দুটি পাখি অথবা পাখির দুটি প্রাণী এগিয়ে আসে এবং দুটির একটি জানালার ওপর বসল। আর অপরটি আমার ভাইয়ের গায়ে এসে পড়লো। এবং তার বুক থেকে নাভির নিচ পর্যন্ত চিরে ফেলল। তারপর তার পেটে হাত ঢুকিয়ে তার হৃৎপিণ্ড বের করে হাতে নিয়ে তার ঘাণ নিল। তখন অপরটি জিজ্ঞেস করল, ওকি স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন? জবাবে দ্বিতীয়টি বলল, হ্যাঁ। আবার জিজ্ঞেস করল, ওকি তীক্ষুধী? বলল, না। তারপর হৃৎপিণ্ডটি যথাস্থানে রেখে দিল। পরীক্ষণে পলকের মধ্যে জখম শুকিয়ে গেল। প্ৰাণী দুটি চলে যাওয়ার পর আমি আমার ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাকে নাড়া দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি ব্যথা অনুভব করছেন? তিনি বললেন, না। কেবল শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে। অথচ ঘটনা দেখেই আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তখন ভাই বললেন, কি ব্যাপার, তুমি কাঁপছে কেন? ফারিআ বলেন, তখন আমি তাকে ঘটনাটি বিবৃত করলাম। শুনে ভাই বললেন, আমার কল্যাণই কামনা করা হয়েছে। তারপর তিনি আমার নিকট থেকে চলে গেলেন এবং নিম্নোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করেন।

–দুশ্চিন্তা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আমি আমার চক্ষুকে সংবরণ করতে চেষ্টা করি ঠিক, কিন্তু অশ্রু তার আগেই ঝরে পড়ে। কারণ, আমার নিকট মৃত্যুর পরোয়ানা এসে গেছে। অথচ, আমাকে এমন কোন মুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়নি, যা ভাষ্যকার বর্ণনা করে  শোনাবে।

আমি অবগত নই যে, আমি কি ঐ ব্যক্তির মত হব, যার ওপর অগ্নি প্রজুলিত করা হবে এবং আগুন তাকে বেষ্টন করে রাখবে।

নাকি আমি সেই জান্নাতে স্থান পাব, যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সৎকর্মশীলদেরকে, যার বালিশগুলো সাজানো থাকবে সারি সারি করে।

ঐ আবাস দুটো সমান নয়, এক নয় কর্মের ধারাও। তারা দল হবে দুটি। একটি প্রবেশ করবে জান্নাতে, যা বেষ্টিত থাকবে বাগ-বাগিচা দ্বারা। অপর দলকে প্রবেশ করানো হবে জাহান্নামে। তার সব সামগ্ৰী হবে তাদের জন্য অকল্যাণকর।

এই হৃদয়গুলো যেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে যে, যখনই এগুলো কোন কল্যাণের সংকল্প করবে, বিপদাপদ তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। আর দুর্ভাগ্যবশত জান্নাতের অনুসন্ধান থেকে বিরত রাখবে সে দুনিয়া, যাকে আল্লাহ নিশ্চিহ্ন করে দেবেন।

এক ব্যক্তি নিজেকে ভৎসনা করেছে। কারণ, সে জানে যে, সর্বদ্ৰষ্টা (আল্লাহ) তাকে অবলোকন করছেন। সে নিজেকে আজীবন বেঁচে থাকার প্রতি উৎসাহিত করেনি। অল্প কদিন বেঁচে থাকলেও একদিন তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতেই হবে।

যে ব্যক্তি মৃত্যু থেকে পলায়ন করবে, হঠাৎ একদিন মৃত্যু তার সামনে এসে দাঁড়াবেই।

যৌবনে মৃত্যু না হলে বার্ধক্যে হবে অবশ্যই। মৃত্যু একটি পেয়ালা। মানুষ তার স্বাদ আস্বাদনকারী। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর উমাইয়া নিজ অঞ্চলে ফিরে যায়।

ংবাদ পেয়ে আমি তার নিকট গিয়ে দেখলাম, সে মৃত্যুশয্যায় শায়িত। সমস্ত শরীর কাপড় দিয়ে ঢাকা। আমি তার কাছে গিয়ে বসলাম। আমাকে দেখে সে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে এবং আমি হাজির, আমি তোমাদের সামনে হাজির ৷ এমন কোন বিত্তবান নেই, যে পণ দিয়ে আমাকে মুক্ত করবে, আমার আপনজন কেউ নেই, যে আমাকে রক্ষা করবে!

—তারপর সে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে আবার ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। অবস্থা দেখে আমি বললাম, লোকটি তো শেষ হয়ে গেল। তারপর সে আবার বিস্ফারিত নয়নে ওপর দিকে তাকিয়ে উচ্চঃস্বরে বলল :

—হাজির, আমি তোমাদের সামনে হাজির। ক্ষমা করার কেউ নেই যে, আমি তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব, এমন কোন আত্মীয়-স্বজন নেই, যার সাহায্যে আমি আত্মরক্ষা করতে পারি?

এই বলে আবার সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে বিস্ফারিত নয়নে ওপর দিকে দৃষ্টিপাত করে আবার বললঃ

হাজির আমি, তোমাদের সামনে হাজির। বিত্ত-বৈভব থাকলে মানুষ সেবা পায়। আর পাপের পরিণতিতে ধ্বংস হয়।

এরপর আবার সে বেহুশ হয়ে পড়ে। ইশ ফিরে পেয়ে বলল :

হাজির আমি, তোমাদের সামনে হাজির! ক্ষমাই যদি কর আল্লাহ! অপরাধই ক্ষমা করে

দাও। তোমার কোন বান্দাই তো অপরাধমুক্ত নয়! এই বলে আবার সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে এলে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলল;

সকল আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস তা যতই দীর্ঘস্থায়ী হোক, একদিন না একদিন তা নিঃশেষ হবেই।

হায়, আমার এই শোচনীয় অবস্থা সৃষ্টির আগে যদি আমি পাহাড় চূড়ায় গিয়ে ছাগল চর্যাতম! ফারিআ বলেন, এরপর আমার ভাই মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ

—ফারিআ! তোমার ভাইয়ের দৃষ্টান্ত সেই ব্যক্তির ন্যায়, যাকে আল্লাহ তার নিদর্শন দিয়ে দিয়েছেন; কিন্তু সেসব দেশে সে তা বর্জন করে। খাত্তাবী এই বর্ণনাটিকে গরীব পর্যায়ের বলে উল্লেখ করেছেন।

হাফিজ ইব্‌নে আসাকির যুহরী থেকে বর্ণনা করেন যে, যুহরী বলেন, উমাইয়া ইব্‌নে আবুসসালত একবার বলেছিল :

— আমাদেরই মধ্য হতে আমাদের এমন একজন রাসূল আছেন, যিনি আমাদেরকে সবকিছুর আনুপূর্বিক সংবাদ প্রদান করেন।

তারপর উমাইয়া বাহরাইন চলে যায়। এ সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওত প্রাপ্ত হন। উমাইয়া বাহরাইনে আট বছর অবস্থান করে, তারপর সে তায়েফা চলে আসে। এসে তায়েফবাসীদেরকে জিজ্ঞেস করে যে, আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ কী বলে? লোকেরা বলল, মুহাম্মদ দাবী করছে যে, সেই নাকি সেই, যা হওয়ার কামনা তুমি করতে।

যুহরী বলেন, এ কথা শুনে উমাইয়া মক্কায় চলে আসে এবং নবী করীম (সা)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলে, হে আবদুল মুত্তালিবের পৌত্র! এসব তুমি কী বলছি? নবী করীম (সা) বললেন, আমি বলছি যে, আমি আল্লাহর রাসূল আর আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। উমাইয়া বলল, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই, আগামী দিন সময় দাও! জবাবে তিনি বললেন, ঠিক আছে, আগামীকালই কথা হবে। উমাইয়া বলল, হয়ত আমিও একা আসব, তুমিও একা আসবে। অথবা আমি আমার দলবল নিয়ে আসব, তুমিও তোমার দলবল নিয়ে আসবে; কোনটা তোমার পছন্দ? নবী করীম (সা) বললেন, তোমার যেমন খুশী। উমাইয়া বলল, ঠিক আছে, আমি আমার দলবল নিয়েই আসব, তুমিও তোমার দলবল নিয়ে এসো!

পরদিন উমাইয়া কুরায়শ বংশীয় একদল লোক নিয়ে এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-ও কতিপয় সাহাবা সঙ্গে নিয়ে সমবেত হন এবং সকলে কাবার ছায়ায় বসেন।

বর্ণনাকারী বলেন, প্রথমে উমাইয়া তার বক্তব্য পেশ করে এবং স্বরচিত কবিতা শুনায়। আবৃত্তি শেষ করে সে বলল, হে আবদুল মুত্তালিবের পৌত্র। এবার তুমি আমার জবাব দাও! রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন :

তাঁর তিলাওয়াত শেষ হলে উমাইয়া তার দুপা টেনে টেনে ছুটে পালাতে শুরু করল। তার সঙ্গী কুরাইশরাও তার অনুসরণ করল। তারা জানতে চাইল, উমাইয়া! তোমার মতামত কী? উমাইয়া বলল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সঙ্গীরা জিজ্ঞাসা করল, তবে কি তুমি তার অনুসারী হয়ে যাবে? উমাইয়া বলল, আমি একটু চিন্তা-ভাবনা করে দেখি!

বর্ণনাকারী বলেন, তারপর উমাইয়া সিরিয়ায় চলে যায় এবং রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় হিজরত করেন। বদর যুদ্ধের পর উমাইয়া সিরিয়া থেকে ফিরে এসে বদর প্রান্তরে অবতরণ করে। পরে রাসূল (সা)-এর নিকট যেতে উদ্যত হলে একজন তাকে লক্ষ্য করে বলল, আবুস সালাত! তুমি কি করতে যাচ্ছে? উমাইয়া বলল, যাচ্ছি মুহাম্মদের সঙ্গে দেখা করতে। লোকটি জিজ্ঞাসা করল, মুহাম্মদের কাছে তুমি কি করবে? উমাইয়া বলল, তার প্রতি আমি ঈমান আনব এবং সব ক্ষমতা তার হাতে ছেড়ে দিব। লোকটি বলল, তুমি কি জানো, বন্দরের এই কূপে যারা আছে, তারা কারা? উমাইয়া বলল, না, তা তো বলতে পারি না। লোকটি বলল, তোমার দুই মামটিতো ভাই উতবা ইব্‌নে রবীয়া ও শায়াবা ইব্‌নে রবীয়া। আর তাদের মা রবীয়া বিনতে আবদে শামস।

বর্ণনাকারী বলেন, এ সংবাদ শোনামাত্র উমাইয়া তার উল্পীর উভয় কান ও লেজ কেটে ফেলল। তারপর কুপের পাড়ে দাঁড়িয়ে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করল। সঙ্গে সঙ্গে সে মক্কা হয়ে তায়েফা চলে গেল এবং ইসলাম গ্রহণের পরিকল্পনা ত্যাগ করল। সে কবিতাটির প্রথম १र्शद्धप्रैि छिल?

গোটা কবিতাটির বদর যুদ্ধের বর্ণনায় উল্লেখিত হবে। ইমাম যুহরী অতঃপর দুই পাখির ঘটনা, এবং উমাইয়ার মৃত্যুর কাহিনী বর্ণনা করেন, যা ইতিপূর্বেই বিবৃত হয়েছে। মৃত্যুকালে উমাইয়া যে কবিতাগুলি আবৃত্তি করেছিল, তা-ও তিনি উল্লেখ করেছেন। তাহলো :

সব আরাম-আয়েশ-যতই তা দীর্ঘস্থায়ী হোক, একদিন না একদিন নিঃশেষ হবেই। হায়, আমার এই দশা সৃষ্টি হওয়ার আগেই যদি আমি পর্বত চূড়ায় গিয়ে ছাগল চরােতাম! অতঃএব মৃত্যুই হোক তোমার দুচোখের লক্ষ্য। আর যুগের করাল গ্রাস থেকে তুমি নিজেকে রক্ষা করে চল। মনে রেখ, সিংহই হোক বা ষাড়ই হোক, পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থানকারী পাখিটি হোক কিংবা হরিণই হোক, অথবা উটপাখীর শাবকটি হোক, ছােট বড় কোনো কিছুই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায় না। ছােটকে ছােট বলে এবং বড়কে বড় বলেও মৃত্যু রেহাই দেয় না। খাত্তাবী এই বর্ণনাকে গরীব পর্যায়ের বলে উল্লেখ করেছেন।

সুহায়লী তার আত- তারীফ ওয়াল ইলাম গ্রন্থে লিখেছেন যে, উমাইয়া ইব্‌নে আবুস্ সালত-ই প্রথম ব্যক্তি, যে (41 11 এL.L.) বলেছিল।

এ প্রসংগে তিনি একটি আশ্চর্য কাহিনী বর্ণনা করেন। কাহিনীটি হলো, কুরাইশের একদল লোকসহ উমাইয়া একবার সফরে বের হয়। আবু সুফিয়ানের পিতা হারব ইব্‌ন উমাইয়াও তাদের সঙ্গে ছিল। পথে এক জায়গায় একটি সাপ দেখতে পেয়ে সাপটিকে তারা মেরে ফেলে। যখন সন্ধ্যা হলো, তখন একটি মহিলা জিন এসে সাপ হত্যা করার কার%ে, তাদেরকে ভৎসনা করে। তার হাতে ছিল একটি লাঠি। লাঠিটি দ্বারা সে সজোরে মাটিতে একটি আঘাত করে। ফলে, কাফেলার উটগুলো এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করে। জিনটি চলে যায়। কাফেলার লোকেরা চতুর্দিক খোঁজাখোজি করে কোথাও মহিলাটিকে পেল না। কিন্তু খানিক পরে আবারো মহিলাটি এসে পুনরায় লাঠি দ্বারা মাটিতে আঘাত করে সঙ্গে সঙ্গে উধাও হয়ে যায়। উটগুলো এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে শুরু করে। এবার মহিলাকে খোেজাখোজি করে ক্লান্ত হয়ে লোকেরা উমাইয়াকে জিজ্ঞাসা করে যে, এ বিপদ থেকে রেহাই পাওয়ার মত কোন বুদ্ধি কি আপনার আছে? উমাইয়া বলল, আমি তো কোন বুদ্ধি দেখছি না। তবে চিন্তা করে দেখি, কী করা যায়।

অতঃপর তারা সে মহল্লায় ঘুরে-ফিরে দেখল যে, এমন কাউকে পাওয়া যায় কি না যার কাছে। এ ব্যাপারে পরামর্শ নেওয়া যায়। হঠাৎ তারা বেশ দূরে আগুন দেখতে পায়। কাছে গিয়ে দেখল, একটি তাবুর দরজায় এক বৃদ্ধ লোক আগুন জ্বলিয়ে রেখেছে। আরো কাছে গিয়ে দেখতে পেল, আসলে সে ভয়ঙ্কর আকৃতির এক জিন। তারা তাকে সালাম করে তাদের সমস্যার কথা জানালো। জবাবে সে বলল, মহিলা জিনটি তোমাদের কাছে আবার আসলে বলবে, (-1 এL.L.) দেখবে সে পালিয়ে কুল পাবে না। এরপর লোকেরা আবার একত্রিত হলো। মহিলা জিনটি তৃতীয়বার মতান্তরে চতুর্থবারের মত আবারো তাদের কাছে আসল। সঙ্গে সঙ্গে উমাইয়া ইব্‌নে আবুস সালত তার মুখের উপর বলে ফেলল, (411 এL.L.) মহিলা জিনটি তখন সত্যি সত্যি ছুটে পালালো। একটুও দাঁড়ালো না। তবে জিনেরা সাপ হত্যার দায়ে হারব ইব্‌নে উমাইয়ার উপর চড়াও হয়ে তাকে হত্যা করে ফেলে, তার সঙ্গীরা জনমানবহীন সে অঞ্চলেই তাকে কবর দিয়ে আসে। এ প্রসঙ্গই জিনরা বলে বেড়ােত :

—হারবের সমাধি জনমানবহীন এক মরুভূমিতে অবস্থিত। হারাবের কবরের কাছে আর কোন কবর নেই।

কেউ কেউ বলেন, উমাইয়া ইব্‌নে আবুস সালত মাঝে-মধ্যে পশু-পাখিদের ভাষা নিয়ে গবেষণা করত। চলার পথে কোন পাখির ডাক শুনতে পেলে সাখীদেরকে বলত, দেখ এই পাখিটি এই এই বলছে। সাখীরা বলত, হতে পারে; তবে আমরা এর সত্যাসত্য কিছুই বুঝতে পারছি না। একদিন সে একটি বকরীর পালের নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিল। পালের একটি বকরী বাচ্চাসহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সেই বকরীটি তার বাচ্চার দিকে তাকিয়ে ভ্যা ভ্যা শব্দ করল, যেন বকরীটি দ্রুত পালের সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য বাচ্চাকে উদ্ধৃদ্ধ করছে। শুনে উমাইয়া সাখীদেরকে বলল, তোমরা কি বুঝতে পারছি যে, বকরীটি কী বলছে? তারা বলল, না, আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। উমাইয়া বলল, বাকীটি তার বাচ্চাকে বলছে, তুমি আমাদের সঙ্গে দ্রুত দৌড়াও। অন্যথায় নেকড়ে এসে নিৰ্ঘাত তোমাকে খেয়ে ফেলবে, যেমনটি গত বছর তোমার ভাইকে খেয়ে ফেলেছিল।

উমাইয়ার এ ব্যাখ্যা শুনে কাফেলার লোকেরা রাখালের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, গত বছর কি কোন নেকড়ে অমুক জায়গায় তোমার কোন ছাগল ছানাকে খেয়েছিল? রাখাল বলল, হ্যাঁ।

বর্ণনাকারী বলেন, আরেকদিন উমাইয়া একটি উট দেখতে পেল। উটের পিঠে সওয়ার ছিল এক মহিলা। উটটি মহিলার দিকে মাথা তুলে শব্দ করছিল। শুনে উমাইয়া বলল, উটটি মহিলাকে বলছে যে, তুমি তো আমার পিঠে সওয়ার হয়েছ, কিন্তু তোমার হাওদায় একটি সুই আছে। ফলে উমাইয়ার সঙ্গীরা মহিলাকে উটের পিঠ থেকে নামিয়ে হাওদা খুলে দেখতে পেল, ঠিকই একটি সুই পড়ে আছে।

ইবনুস সাকীত বলেন, উমাইয়া ইব্‌নে আবুস সালত একদিন পানি পান করছিল। ঠিক এ সময়ে একটি কাক এসে কা কা করে ডেকে উঠে। শুনে উমাইয়া বলল, তোর মুখে মাটি পড়ুক কথাটি সে দুবার বলল। জিজ্ঞাসা করা হল, কেন, কাকটি কী বলছে? উমাইয়া বলল, কাকটি বলছে, তুমি তোমার হাতের পেয়ালার পানিটুকু পান করা মাত্ৰই মারা যাবে। অতঃপর কাকটি আবারো কী কী করে উঠল। উমাইয়া বলল, কাকটি বলছে যে, এর প্রমাণ হলো, আমি এই আবর্জনা স্তুপে নেমে সেখান থেকে কিছু খাব, আর গলায় হাডিড আটকে যাবে। ফলে আমি মারা যাব। এই বলে কাকটি আবর্জনা স্তুপে নেমে কিছু একটা খেল এবং গলায় হাডিড আটকে সত্যি সত্যি সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল। ঘটনা দেখে উমাইয়া বলল, কাকটি নিজের বেলায় যা বলেছে, তা তো সত্য বলে প্রমাণিত হলো। এইবার দেখি, আমার ব্যাপারে যা বলেছে, তা সত্য কিনা। এই বলে সে হাতের পেয়ালার পানিটুকু খেয়ে ফেলে হেলান দিয়ে বসল। আর সত্যি সত্যি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।

বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন :

কবিদের উক্তিসমূহের মধ্যে লাবীদের একটি উক্তিই সর্বাধিক সঠিক। লাবীদ বলেছিল, আল্লাহ ছাড়া যা কিছু আছে সবই মিথ্যা। আর উমাইয়া ইব্‌নে আবুস সালত মুসলমান হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

ইমাম আহমদ (র) বর্ণনা করেন যে, শারীদ বলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পেছনে সওয়ার ছিলাম। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি উমাইয়া ইব্‌নে আবুস সালতের কোন কবিতা জানা আছে? আমি বললাম, ফ্ল্যা, আছে। নবী করীম (সা) বললেন, তা হলে তা আবৃত্তি কর। আমি একে একে অন্ততঃ একশটি পংক্তি তাঁকে আবৃত্তি করে শুনালাম। অবশেষে তিনি আর কিছু বললেন না, আমিও থেমে গেলাম। ইমাম মুসলিমেরও অনুরূপ একটি বর্ণনা রয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, উমাইয়ার কবিতা শুনে নবী করীম (সা) বলতেন, আসলে তো সে ইসলাম গ্রহণের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।

ইয়াহয়া ইব্‌নে মুহাম্মদ বর্ণনা করেন যে, শারীদ হামদানী যার মাতুলগণ ছাকীফ গোত্রীয় তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে আমরা বিদায় হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমি হেঁটে অগ্রসর হচ্ছি। হঠাৎ পেছনে উটের শব্দ শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখি রাসূলুল্লাহ (সা) আসছেন। তিনি বললেন, কে, শারীদ? আমি বললাম, জী হ্যাঁ, আমি শারীদ। নবী করীম (সা) বললেন, আমি কি তোমাকে আমার উটের পিঠে তুলে নেব? আমি বললাম, জী হ্যাঁ, তবে ক্লান্তির দরুন নয়, বরং রাসূলুল্লাহর সহ-আরোহী হওয়ার সৌভাগ্য লাভের উদ্দেশ্যে। তখন নবী করীম (সা) উট থামিয়ে আমাকে তুলে নিলেন। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর তিনি

জানা আছে? আমি বললাম, জী হ্যাঁ, আছে। তিনি বললেন, তা হলে আবৃত্তি কর। শারদ বলেন, মনে হয় যেন আমি একশর মতো পংক্তি আবৃত্তি করে শোনালাম। শুনে তিনি বললেন, উমাইয়া ইব্‌নে আবুস সালত-এর বিষয়টা আল্লাহ-ই ভালো জানেন। রাবী বলেন, এই হাদীছটি গরীব। পর্যায়ের। আর যে বলা হয়ে থাকে- রাসূলুল্লাহ্ (সা) উমাইয়া সম্পর্কে বলেছিলেন, তার কবিতা ঈমানদার কিন্তু অন্তর কাফির— এ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই। আল্লাহই ভালো জানেন।

ইমাম আহমদ (র) ইব্‌নে আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) উমাইয়ার কয়েকটি পংক্তির বক্তব্য যথাৰ্থ বলে অভিহিত করেছেন। সেগুলো হলো :

তার ডান পায়ের নীচে আছে শনি গ্রহ ও বৃষরাশি আর অপর পায়ের নীচে আছে একটি ঈগল ও ওঁত পেতে থাকা সিংহ।

প্রতি রাতে সূৰ্য রক্তিম বর্ণ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ক্রমশ লাল হতে থাকে রং। সূর্য উদিত হতে অস্বীকৃতি জানায়। তাকে বাধ্য করে উদিত করাতে হয়। উমাইয়ার এই পংক্তি কটি শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছিলেন, উমাইয়া যথার্থই বলেছে। আবু বকর হুযালীর বর্ণনায় ইব্‌নে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, ইব্‌নে আব্বাস (রা) বলেছেন : সত্তর হাজার ফেরেশতা উদ্ধৃদ্ধ না করা পর্যন্ত সূৰ্য উদিত হয় না। ফেরেশতারা সূর্যকে বলেন, উদিত হও, উদিত হও! সূর্য বলে, এমন জাতির জন্য আমি উদিত হব না, যারা আল্লাহকে ছেড়ে আমার ইবাদত করে। অবশেষে উদয় হওয়ার উপক্রম হলে শয়তান এসে সূর্যকে উদয় হওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু সূর্য শয়তানের শিং দ্বয়ের মধ্য দিয়ে উদিত হয়ে যায় এবং শয়তানকে পুড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যার সময় যখন সূর্যের অন্ত যাওয়ার সময় হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অস্ত যেতে তা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়, শয়তান আবার এসে সূর্যকে সিজদা দান হতে বিরত রাখার চেষ্টা করে। ফলে সূর্য শয়তানের শিং দ্বয়ের মধ্যখােন দিয়ে অন্ত যায় এবং শয়তানকে পুড়িয়ে দেয়। ইব্‌ন আসাকির এর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের সম্পর্কে উমাইয়া ইব্‌নে আবুস সালতের দুটি পংক্তি নিম্নরূপ :

তাঁরা আল্লাহর আরাশের খুঁটি ধারণ করে আছেন। সৃষ্টির কোন মাবুদ না থাকলে তাঁরা ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়তেন। আরাশের নীচে তারা ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। ভীতির আতিশয্যে তাদের পার্শ্বদেশ ও কাঁধের মধ্যস্থল থারথার করে কাপে। এটি ইব্‌ন আসাকিরের বর্ণনা। আসমায়ী সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি উমাইয়ার নিম্নোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করতেন :

আল্লাহর মাহাত্ম্য বর্ণনা কর, তিনিই তো সাহায্যের অধিকারী। সুউচ্চ আকাশে মহান আমাদের প্রভু, মানুষের বহু উর্ধে আকাশে তাঁর আসনে রয়েছেন। চোখে দৃশ্যমান তাঁর আরাশ নতশিরে যা ফেরেশতারা বহন করছেন।

আব্দুল্লাহ ইব্‌নে জাদআন তায়মীর প্রশংসামূলক উমাইয়া ইব্‌নে আবুস সালত-এর কয়েকটি পংক্তি :

আমি কি আমার প্রয়োজনের কথা উত্থাপন করব, নাকি আপনার নাজুকতাই আমার জন্য যথেষ্ট? নিশ্চয় নাজুকতাই আপনার বৈশিষ্ট্য।

সকলের অধিকার সম্পর্কে আপনি সম্যক অবহিত। আপনি সন্ত্রান্ত, কুলীন, ভদ্র ও সৌন্দর্যের আধার।

আপনি এমন-ই সন্ত্রান্ত যে, সকাল বা সন্ধ্যৗস্যার সুন্দর চরিত্রের মাঝে কোন পরিবর্তন সাধন করতে পারে না।

আপনি এমন এক ব্যক্তি, যে উদারতা ও বদ্যান্যতায় তখনো বাতাসের সাথে প্রতিযোগিতা করেন, যখন শৈত্য প্রবাহ কুকুরকে পর্যন্ত ঘরে আবদ্ধ করে রাখে। আপনার বাসভূমি হল দানশীলতার ভূমি, যা প্রতিষ্ঠা করেছে বনু তায়ীম। আপনি হলেন তার আকাশ। আপনি কারো

ংসার মুখাপেক্ষী নন। আপনি স্বনাম ধন্য।

আব্দুল্লাহ ইব্‌ন জাদ আনি তায়মীর প্রশংসামূলক উমাইয়া ইব্‌নে আবুস সালত-এর আরো কতগুলো কবিতা আছে। এই আব্দুল্লাহ ইব্‌নে জাদ আন একজন সন্ত্রান্ত ও দানশীল ব্যক্তিরূপে বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর একটি ডেগ ছিল, যা সব সময় মধু ও ঘি মাখা রুটিতে পরিপূর্ণ থাকত। তা। সকলের জন্য ছিল উন্মুক্ত। যে কোন আরোহী বাহনের উপর থেকেই তা থেকে আহার করতে পারত। তিনি গোলাম আযাদ করতেন। বিপদগ্ৰস্ত মানুষের সহায়তা করতেন। হযরত আয়েশা (রা) একদিন নবী করীম (সা)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, আব্দুল্লাহ ইব্‌নে জাদ আনের এসব মহৎ কর্ম কি তার কোন উপকারে আসবে? জবাবে নবী করীম (সা) বললেন, জীবনে একদিনও সে একথা বলেনি যে, হে আল্লাহ! কিয়ামতের দিন তুমি আমার পাপসমূহ ক্ষমা করে দিও।

পাদী বাহীরা

যে মনীষী পূর্বাহ্নেই রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মধ্যে নবী হওয়ার লক্ষণ ধরতে পেরেছিলেন, তিনি হচ্ছেন পাদ্রী বাহীরা। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন মক্কার বনিক কাফেলাসহ চাচা আবু তালিবের সঙ্গে সিরিয়া যাচ্ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বয়স তখন বার বছর। বাহীরা একটি মেঘখণ্ডকে সকলের মধ্যে শুধু তাকেই ছায়া দিতে লক্ষ্য করেন। তখন তিনি তাদের জন্য আহার্য প্ৰস্তৃত করে কাফেলার সকলকে দাওয়াত করেন। সীরাত অধ্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা আসছে। ইমাম তিরমিয়ী এ বিষয়ে একটি হাদীছ বৰ্ণনা করেছেন। যথাস্থানে আমরা তার উপর বিশদ আলোচনা করেছি। হাফিজ ইব্‌নে আসাকির বাহীরার জীবনী আলোচনা প্রসঙ্গে উক্ত হাদীসের সমর্থনে

বেশ কটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইমাম তিরমিয়ী বর্ণিত হাদীছটি উদ্ধৃত করেননি; এটি আশ্বর্যজনক ব্যাপার বৈকি?

ইব্‌নে আসাকির লিখেছেন যে, বাহীরা কুফুর নামে পরিচিত একটি গ্রামে বাস করতেন। সে গ্রাম থেকে বুসরার দূরত্ব ছিল ছয় মাইল। এটাই বাহীরার গীর্জা (1 – – – – ১) নামে বিখ্যাত। কারো কারো মতে, বাহীরা যে গ্রামে বাস করতেন তার নাম মানফাআ। যায়রার অপর দিকে বালকা নামক স্থানে এটি অবস্থিত। আল্লাহই সম্যক অবগত।

কাস ইব্‌নে সাঈদা আল-ইয়াদী

হাফিজ আবু বকর মুহাম্মদ ইব্‌নে জাফর ইব্‌নে সাহল খারায়েতী তাঁর হাওয়াতিফুল জান গ্রন্থে উবাদা ইব্‌নে সামিত (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, ইয়াদের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করলে তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, কাস ইব্‌নে সাঈদ ইয়াদীর খবর কি? তারা বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা)! তিনি তো মারা গেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, উকাজের মেলায় একদিন আমি তাকে দেখেছিলাম। একটি লাল উটের পিঠে বসে তখন তিনি কিছু চমৎকার কথা বলছিলেন, এখন আমার তা স্মরণ নেই। এমন সময় ঐ দলের পেছন থেকে জনৈক বেদুঈন দাঁড়িয়ে বলল, আমার তা মনে আছে, হে আল্লাহর রাসূল! বৰ্ণনাকারী বলেন, এ কথা শুনে নবী করীম (সা) আনন্দিত হন। বেদুঈনটি বলছিলেন :

হে লোক সকল! তোমরা সমবেত হও। শুনে রেখ, যারা গত হওয়ার তারা গত হয়ে গেছে। যা আগমন করার, তা অবশ্যই আসবে। অন্ধকার রাত, কক্ষবিশিষ্ট আকাশ, বিক্ষুব্ধ সমুদ্র, উজ্জ্বল তারকারাজি, সুদৃঢ় পর্বত ও প্রবহমান নদ-নদী। আকাশে সংবাদ আছে, আর পৃথিবীতে আছে উপদেশ গ্রহণের উপকরণ। ব্যাপার কি, মানুষ কেবল চলেই যাচ্ছে, ফিরে তো আর আসছে না। ওখানে রয়ে যাওয়াই কি তাদের পছন্দ, নাকি তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। কাস আল্লাহর নামে শপথ করে বলছে যে, আল্লাহর দেওয়া একটি দীন আছে, যা তোমাদের দীন আপেক্ষা অধিকতর পছন্দনীয়। তারপর তিনি কবিতা আবৃত্তি করলেন?

যারা আমাদের আগে অতীত হয়েছেন, তাদের মধ্যে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। কারণ আমি দেখালাম যে, মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কারোরই কোন উপায় নেই।

আরো দেখলাম যে, আমার সম্প্রদায়েরও গত হয়ে যাচ্ছে-ছােট-বড় সকলে।

যারা গত হয়ে গেছে, তারা তোমার নিকট ফিরে আসার নয়। আর যারা বেঁচে আছে। তারাও আজীবন বেঁচে থাকবার নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আরো দশজন লোকের ন্যায় আমিও একদিন চলে যাব। বর্ণনাটির সনদ গরীব। পর্যায়ের।

তাবারানী তাঁর মুজামে কবীর গ্রন্থে ইব্‌ন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, আব্দুল কায়স গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করলে রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তোমাদের কেউ কি কাস ইব্‌নে সায়িদ আল-ইয়াদীকে চেনে? তারা বলল, আমরা তো সকলেই তাঁকে চিনি, হে আল্লাহর রাসূল! নবী করীম (সা) বললেন, তাঁর খবর কী? তারা বলল, তিনি তো মারা গেছেন। নবী করীম (সা) বললেন, আমার মনে আছে যে, এক মুহাররম মাসে উকাজের মেলায় একটি লাল উটের পিঠে বসে তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন :

লোক সকল! তোমরা সমবেত হও, কান দিয়ে শ্রবণ কর ও স্মরণ রাখা। যে জীবন লাভ করেছে, সে মরবেই। যে মরবে। সে গত হয়ে যাবে। যা কিছু আগমন করার, তা অবশ্য আসবে। আকাশে গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে, যমীনে আছে শিক্ষা গ্রহণের উপকরণ। শয্যা প্ৰস্তুত, ছাদ সুউচ্চ, নক্ষত্ররাজি আবর্তনশীল, সমুদ্রের পাখি সম্ভার অফুরন্ত। কাস সত্য-সত্য শপথ করে বলছে, এখন যাতে সন্তোষ আছে, পরে অবশ্যই তাতে অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। আল্লাহর এমন একটি দীন আছে, যা তার নিকট তোমাদের দীন অপেক্ষা অধিকতর প্রিয়। ব্যাপার কি, আমি দেখতে পাচ্ছি যে, মানুষ চলেই যাচ্ছে, আর ফিরে আসছে না! তবে কি তারা ওখানে রয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করেছে? নাকি তারা ঘুমিয়ে পড়েছে?

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে তাঁর কবিতা উদ্ধৃত করতে পারবে? জবাবে একজন পূর্বোক্ত পংক্তি আবৃত্তি করে :

অতীতে গত হওয়া লোকদের মধ্যে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। আমি দেখতে পেলাম যে, মৃত্যুর মুখে একবার যে পতিত হয়, তার আর সেখান থেকে ফিরে আসার উপায় থাকে না। আরো দেখলাম যে, আমার সম্প্রদায়ের ছােট-বড় সকলেই মৃত্যুর পানে ধাবিত হচ্ছে। যারা অতীত হয়ে গেছে, আমার কাছে তারা আর ফিরে আসবে না হাফিজ বায়হাকী তাঁর কিতাব দালাইলু নুবুওত গ্রন্থে মুহাম্মদ ইব্‌ন হাস্সান সুলামী থেকে বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন।

আলী ইব্‌নে হুসাইন. ইব্‌নে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, বকর ইব্‌নে ওয়ায়েল গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করলে রাসূলুল্লাহ (সা) তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মিত্র কাসা ইব্‌নে সায়িদা আল-আইয়াদীর খবর কি? এভাবে ইব্‌নে আব্বাস (রা) ঘটনাটি আনুপুর্বিক বর্ণনা করেন।

আহমদ ইব্‌নে আবু তালিব হাসান ইব্‌নে আবুল হাসান বসরী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হাসান ইব্‌নে আবুল হাসান বলেন, জারূদ ইব্‌নে মুআল্লা ইব্‌নে হানাশ ইব্‌নে মুআল্লা আল-আব্দী নামক একজন খৃষ্টান ব্যক্তি ছিলেন। আসমানী কিতাব সমূহের ব্যাখ্যায় তিনি পারদশী ছিলেন। তিনি দর্শন, চিকিৎসা ও আরবী সাহিত্যে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। সর্বোপরি তিনি ছিলেন সুদর্শন ও বিত্তবান। একদিন তিনি আব্দুল কায়সের বিচক্ষণ ও বাকপটু কয়েকজন লোক নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আগমন করেন। এসে নবীজির সামনে বাস নবীজিকে উদ্দেশ করে আবৃত্তি শুরু করেন :

হে হিদায়াতের নবী! আপনার নিকট কিছু লোক বিজন মরু প্ৰান্তর ও গোত্রের পর গোত্র অতিক্রম করে এসেছে। তারা বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি অতিক্রম করে এসেছে আপনার সাক্ষাতের আশায়। এতে তারা ক্লান্তিকে ক্লান্তি মনে করেনি।

প্ৰাণীকুল যে বিজন মরু ভুমি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আমাদের উষ্ট্রগুলো সেসব অতিক্রম করে এসেছে। শক্তিশালী দুঃসাহসী অশ্বগুলো আরোহীদের নিয়ে উজ্জ্বল তারকার ন্যায় সে সব অতিক্রম করে এসেছে।

এমন ভয়াবহ ও কঠিন দিনের শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রত্যাশায় যেদিন আতঙ্ক হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। সকল সৃষ্টিকে সমবেত করার দিনের পাথেয় প্রত্যাশায় আর ঐ ব্যক্তির

ভয়ে, যে গোমরাহীর মাঝে ঘুরপাক খেয়েছে। আমরা এসেছি আল্লাহর নূরের দিকে, প্রমাণ, পুণ্য ও নিয়ামতের দিকে, তা অর্জন করার আশায়।

হে আমেনার সন্তান! আল্লাহ। আপনাকে এমন কল্যাণ দান করেছেন, যা আপনার নিকট একের পর এক আসতে থাকবে। হে আল্লাহর নিদর্শন! আপনার দ্বারা আল্লাহ আমাদেরকে উপকৃত করুন,ঐ ব্যক্তিদের ন্যায় নয়, যারা পশ্চাতে রয়ে গেছে।

শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে নিজের কাছে এনে বসালেন এবং বললেন : হে জারূদ! তুমি এবং তোমার সম্প্রদায় আমার নিকট আসতে বিলম্ব করে ফেলেছ। জারূদ বললেন, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোন! আপনার পথ ধরতে যে বিলম্ব করবে, সে হবে দুর্ভাগা। তার পরিণামও হবে মর্মন্তদ! যারা আপনাকে দেখে, আপনার কথা শুনে আপনাকে ত্যাগ করে অন্য পথ ধরেছে, আমি তাদের দলে নই। আমি এতকাল যে ধর্মের অনুসরণ করতাম, তা ত্যাগ করে আপনার ধর্ম গ্ৰহণ করতে যাচ্ছি। এতে কি আমার পূর্বের যাবতীয় পাপ মোচন হবে না? এতে কি আল্লাহ আমার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমার সে সব দায়-দায়িত্ব আমার, তুমি এক্ষুণি এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন এবং খৃষ্টধর্ম ত্যাগ কর। জারূদ বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। তিনি এক, অদ্বিতীয়। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।

বর্ণনাকারী বলেন, এই বলে জারূদ মুসলমান হয়ে যান এবং তাঁর সঙ্গে তাঁর সম্প্রদায়ের বেশ কিছু লোকও ইসলাম গ্ৰহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এতে বেশ আনন্দিত হন এবং তাদেরকে সম্বর্ধিত করেন যাতে তারা যারপর নেই। আনন্দিত হন।

তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে কাস ইব্‌নে সায়িদা আল ইয়াদিকে চিনে; জারূদ বললেন, আমার বাপ-মা আপনার জন্য কুরবান হোন!! আমরা প্রত্যেকেই তাঁকে চিনি। অ্যামি তো তাঁকে বেশ ভালো করেই জানি। তিনি আরবেরই একটি গোত্রের লোক ছিলেন। ছয়শত বছর আয়ু পেয়েছিলেন। এর মধ্যে পাঁচ প্রজন্মের আয়ুষ্কাল পর্যন্ত ঈসা (আ)-এর ন্যায় বনে-জঙ্গলে অতিবাহিত করেন। এ সময় নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করতেন না এবং তার দ্বারা কেউ উপকৃতও হতে পারত না। ময়লা কাপড় পরিধান করতেন। বৈরাগ্য অবলম্বনে তিনি কোন অশান্তি অনুভব করতেন না। বন্য প্রাণীদের সঙ্গে একত্রে বসবাস করতেন। অন্ধকারে অবস্থান করা পছন্দ করতেন! গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি। এ কারণে তিনি এক অনন্য ব্যক্তি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। তার প্রজ্ঞা দ্বারা মানুষ উপমা পেশ করত এবং তার উসিলায় বিপদাপদ দূর হত।

তিনিই আরবের প্রথম ব্যক্তি, যিনি এক আল্লাহয় বিশ্বাস স্থাপন করেন। ঈমান আনেন, পুনরুত্থান ও হিসাব-কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন, জনগণকে অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং মৃত্যুর আগে আমল করে যাওয়ার আদেশ দেন। মৃত্যু সম্পর্কে উপদেশ দেন। এবং তাকদীরের প্রতি আত্মসমর্পণ করেন। কবর যিয়ারত করেন, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হওয়ার কথা প্রচার করেন। কবিতা আবৃত্তি করেন, তাকদীর সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেন এবং আকাশের সংবাদ সম্পকে অবহিত হন। তিনিই সর্বপ্রথম সমুদ্র ও পানির বিশদ বিবরণ দেন, আরোহী অবস্থায় বক্তৃতা দেন, নসীহত করেন, বিপদাপদ ও আযাব-গজব থেকে সতর্ক করেন। * কুফারী ত্যাগ করে সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য উৎসাহ প্ৰদান করেন এবং এক আল্লাহর

প্ৰতি আহবান করেন। উকাজের বাজারে একদিন তিনি বললেন ৪

পূর্ব ও পশ্চিম, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী, শান্তি ও যুদ্ধ, শুষ্ক ও আর্দ্র, লোনা ও মিষ্ট, সূর্য ও চন্দ্ৰ, বায়ু ও বৃষ্টি, রাত ও দিন, নারী ও পুরুষ, স্থল ও সমুদ্র, বীজ ও শস্য, পিতা ও মাতা, সমবেত ও বিক্ষিপ্ত, নিদর্শনের পর নিদর্শন, আলো ও অন্ধকার, স্বচ্ছতা ও সংকট, রব ও দেবতা, নিশ্চয় মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে গেছে।

নবজাতকের দৈহিক বৃদ্ধি, হারিয়ে যাওয়া, গোপন বস্তু, গরীব ও ধনী, সৎ ও অসৎ অলসতায় বিভোর লোকদের জন্য ধ্বংস ৷ আমলকারীরা অবশ্যই তাদের আমল ঠিক করে নিবে। আমল না করেই যারা বুকে আশা নিয়ে বসে আছে, তারা অবশ্যই নিরাশ হবে। মানুষ যা বিশ্বাস করে বসে আছে, ঘটনা আসলে তা নয় -বরং আল্লাহ এক ও একক। তিনি কারো সন্তান নন, পিতাও নন। তিনি চিরঞ্জাব। মৃত্যু ও জীবন দান করেন। নর ও নারী তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তিনি পরজগত ও ইহজগতের রব। শোন হে ইয়াদের সম্প্রদায়!

ছামুদ ও আদি জাতি এখন কোথায়? কোথায় তোমাদের পূর্ব পুরুষগণ? কোথায় রোগী ও রোগী পরিদর্শনকারীরা? প্রত্যেকেই একদিন পুনরায় জীবিত হবে। কাস মানুষের রবের শপথ করে বলছে যে, এক একজন করে তোমরা প্ৰত্যেকে একদিন পুনরুজ্জিবিত হবে। ডাকাডাকি করার দিন, যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে ও পৃথিবী আলোকোজ্জ্বল হবে। সুতরাং ধ্বংস সেই ব্যক্তির, যে সুস্পষ্ট সত্য ও ঝলমলে আলোক হতে বিমুখ হয়েছে। মীমাংসার দিনে, ন্যায় বিচারের দিনে যখন মহা ক্ষমতাধর বিচার করবেন ও সতর্ককারীরা সাক্ষ্য প্ৰদান করবেন, সাহায্যকারীরা দূরে সরে যাবে ও পরস্পর সম্পর্কহীনতা প্ৰকাশ পাবে। অবশেষে একদল জান্নাতে আর একদল জাহান্নামে স্থান পাবে। তারপর তিনি কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করেন।

বর্ণনাকারী বলেন, শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমারও মনে আছে যে, একদিন তিনি উকাজ বাজারে একটি লাল উটের পিঠের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিল। বলছিলেন :

হে লোক সকল! তোমরা সমবেত হও, শ্রবণ করা। শুনে কথাগুলো মনে রেখ। পরে সেই অনুযায়ী কাজ করে নিজের উপকার সাধন করবে। আর সত্য কথা বলবে। যে লোক জীবন লাত করল, সে মৃত্যুবরণ করবে। যে লোক জীবন লাভ করল, সে শেষ হয়ে গেল। যা আসবার তা এসে গেছে।

বৃষ্টি ও শস্য, জীবিত ও মৃত, অন্ধকার রাত, কক্ষবিশিষ্ট আকাশ, উজ্জ্বল নক্ষত্র, বিক্ষুব্ধ সমুদ্র, আলো ও অন্ধকার, রাত ও দিন, পুণ্য ও পাপ; নিশ্চয় আকাশে সংবাদ আছে। যমীনে আছে শিক্ষার উপকরণ। পাতানো বিছানা, উচু ছাদ, দীপ্ত নক্ষত্র, ঠাণ্ড সমুদ্র ও পাল্লার ওজন। কাস আল্লাহর নামে সত্য কসম করে বলছে, যাতে মিথ্যার লেশ মাত্র নেই; সংসারে যদি সন্তুষ্টি বলতে কিছু থেকে থাকে তা হলে অসন্তষ্টিও আছে নিশ্চয়ই।

অতঃপর তিনি বললেন, লোক সকল! নিশ্চয় আল্লাহর দেয়া এমন একটি দীন আছে, যা তার নিকট তোমাদের এই দীন, ধর্ম অপেক্ষা প্রিয়। সেই দীন আগমন করার সময় ঘনিয়ে এসেছে।

অতঃপর তিনি বলিলেন ব্যাপার কি, আমি দেখতে পাচ্ছি যে, মানুষ কেবল চলেই যাচ্ছে ফিরে কেউ আসছে না। ওরা কি ওখানে থেকে যাওয়াই মেনে নিয়েছে, নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) উপস্থিত সাহাবীদের প্রতি মুখ করে বললেন, তোমাদের কে আমাকে কাস-এর কবিতা বর্ণনা করতে পারবে? আবু বকর (রা) বললেন, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোন, সেইদিন আমি ঘটনা স্থলে উপস্থিত ছিলাম। কাস তখন বলছিলেন :

— যারা অতীত হয়ে গেছে তাদের মধ্যে আমাদের শিক্ষা গ্ৰহণের অনেক উপকরণ আছে। কারণ, আমি দেখতে পেয়েছি যে, একবার যে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, সেখান থেকে আর সে ফিরে আসে না। আর আমার সম্প্রদায়কেও দেখেছি যে, ছোট বড় নির্বিশেষে এক এক করে তারাও চলে যাচ্ছে। তাতে আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে, অন্য দশজনের মত আমিও একদিন চলে যাব।

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর আব্দুল কায়স সম্প্রদায়ের বড় মাথাওয়ালা দীর্ঘকায় এক প্ৰবীণ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে এসে বললেন, আমার বাবা-মা আপনার জন্য উৎসৰ্গিত হোন! আমি কাস্ এর একটি বিস্ময়কর ঘটনা দেখেছি। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, কী দেখেছি হে বনু আব্দুল কায়স-এর ভাই? সে বলল, যৌবন কালে আমি বসন্তের চারণভূমি থেকে আমার এক অবাধ্য উটের সন্ধানে তার পিছু পিছু ছুটছিলাম, যা কাঁটাগুলা ও ছোট ছোট টিলায় ও মনোরম উদ্ভিদে পরিপূর্ণ। সেখানে অসংখ্য উটপাখি ও সাদা বনগরু নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ছুটতে ছুটিতে আমি একটি উচু ও সমতল ভূমিতে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে সবুজ-শ্যামল পিলু গাছের ছড়াছড়ি। সেগুলোর ডাল-পালা নুয়ে আছে। সেগুলোর ফল যেন গোলমরিচ। হঠাৎ সেখানে আমি পানি পড়া অবস্থায় একটি ঝর্ণা ও একটি সবুজ বাগান দেখতে পেলাম।

হঠাৎ দেখতে পেলাম, কাস ইব্‌নে সায়িদা একটি গাছের নীচে বসে আছেন। তার হাতে একটি লাঠি। আমি তার কাছে গেলাম এবং বললাম, আপনার কল্যাণ হোক! তিনি বললেন, আপনারও কল্যাণ হোক! তাঁর সাথে আরো একজন লোক। পার্শ্বে একটি কুয়া। বিপুল সংখ্যক হিংস্ৰ জন্তু সেই কুয়া থেকে পানি পান করছে এবং চলে যাচ্ছে। এগুলোর কোনটি যদি কুয়া থেকে অন্যাটিকে ডিঙ্গিয়ে পানি পান করতে চাইল। কাস তাকে এই বলে হাতের লাঠি দ্বারা আঘাত করতেন যে, থাম, তোমার আগেরটি আগে পানি পান করে নিক, তুমি পরে পান করবে। এ দৃশ্য দেখে আমি অত্যন্ত ভীত হলাম। আমার প্রতি তাকিয়ে তিনি বললেন, তোমার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। হঠাৎ দুইটি কবর দেখতে পেলাম। কবর দুইটির মাঝে একটি মসজিদ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলো কাদের কবর? বললেন, দুই ভাইয়ের। এই জায়গায় তারা আল্লাহর ইবাদত করত। আমি তাদের সাথে মিলিত হওয়া পর্যন্ত এখানে অবস্থান করে আল্লাহর ইবাদত করব। আমি বললাম, কেন নিজ সম্প্রদায়ের নিকট গিয়ে তাদের সৎকর্মে সহযোগিতা এবং অন্যায় কাজে বাধা দান করবেন না? তিনি বললেন, তোমার মায়ের অকল্যাণ হোক, তুমি কি জানো না যে, ইসমাঈলীদের বংশধর তাদের পিতার দীন- ধর্ম পরিত্যাগ করে

ংখ্য দেব-দেবীর পূজা শুরু করেছে? এই বলে তিনি কবর দুটোর কাছে গিয়ে কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করেন :

— ওগো বন্ধুদ্বয়! তোমাদের নিদ্ৰা তো অনেক দীর্ঘ হলো। মনে হচ্ছে, তোমাদের এই নিদ্রা কখনো শেষ হবে না। তোমাদের চামড়া ও হাডিডর মাঝের নিদ্ৰা দেখে আমার মনে হচ্ছে, খেজুর বীথিতে পানি সিঞ্চনকারীই তোমাদেরও পিপাসা নিবারণ করেছেন। দীর্ঘ নিদ্রার কারণেই কি তোমরা কোনো আহবানকারীর ডাকে সাড়া দিচ্ছ না? তোমরা কি জান না যে, নাজরানে আমি একা তোমরা দুজন ব্যতীত আমার কোন বন্ধু নেই? তোমাদের কবরের পাশ্বেই এখন আমার অবস্থান। এখান থেকে সরবার আমার ইচ্ছা নেই। আমি কি জীবন ভরই তোমাদের জন্য ক্ৰন্দন করব? কেউ যদি কারো জন্য উৎসৰ্গিত হতে পারে, তা হলে আমি আমাকে তোমাদের

জন্য উৎসর্গ করছি। আমার আত্মা যেন তোমাদের কবরে, তোমাদের কাছে চলেই গিয়েছে। মৃত্যু যেন আমার অতি নিকটে।

বর্ণনাকারী বলেন, শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আল্লাহ কাসকে রহম করুন। কিয়ামতের দিন একাই সে একটি উম্মতরূপে উত্থিত হবে।

বর্ণনাটি একান্তই গরীব পর্যায়ের এবং এটি মুরসালও বটে, যদি না হাসান তা স্বয়ং জারূদ থেকে শুনে থাকেন। বায়হাকী এবং ইব্‌নে আসাকিরও ভিন্ন এক সূত্রে বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। তাতে এও আছে যে, যে লোকটির উট হারিয়ে গিয়েছিল, উটটি খুঁজতে খুঁজতে এক বিপদ ংকুল উপত্যকায় তার রাত হয়ে যায়। রাত গভীর হলো, চতুর্দিক গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেল। লোকটি বলেন, ঠিক এমন সময় আমি শুনতে পেলাম, কে যেন বলছে :

ওহে আঁধার রাতে ঘুমন্ত ব্যক্তি! পবিত্র মক্কায় আল্লাহ মহান হাশেমী বংশ থেকে একজন নবী প্রেরণ করেছেন, যার উসিলায় দূর হয়ে যাচ্ছে সব বিকট অন্ধকার।

লোকটি বলেন, শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকিয়ে আমি কিছুই দেখতে পেলাম না এবং আর কোন সাড়া-শব্দও পেলাম না। ফলে আমি নিজেই আবৃত্তি করতে শুরু করলাম :

ওহে সেই ব্যক্তি, যে ঘোর আঁধারে কথা বলছি, তোমায় স্বাগতম। আল্লাহ তোমাকে হিদায়াত দিন। তুমি পরিষ্কার করে বল, যার প্রতি তুমি আহবান করছি। তা জানালে সাদরে গৃহীত হবে।

লোকটি বলেন, কিছুক্ষণ পর আমি শুনতে পেলাম, কে যেন বলছে, আলো উদ্ভাসিতw) হয়েছে, মিথ্যার অবসান ঘটেছে, আল্লাহ মুহাম্মদকে প্রজ্ঞা সহ প্রেরণ করেছেন; যিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান, মুকুট ও শিরস্ত্ৰাণধারী, উজ্জ্বল মুখমণ্ডল, সুদৰ্শন ভ্ৰীযুগল ও আয়ত নেত্রের অধিকারী, লা-ইলাহা ইল্লাহল্লাহ যার সাক্ষ্য। তিনি হলেন মুহাম্মদ, সাদা-কালো, শহর প্রত্যন্ত এলাকার সকলের নিকট র্যাকে প্রেরণ করা হয়েছে।

অতঃপর সে কবিতা আবৃত্তি করল :

সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি বিশ্বজগত অযথা সৃষ্টি করেননি। যিনি ঈসা (আ)-এর পরে এক দিনের জন্যও আমাদেরকে এমনি ছেড়ে দেননি। আমাদের মাঝে তিনি আহমাদকে প্রেরণ করেছেন, যিনি সকলের সেরা নবী। আল্লাহ তার প্রতি রহমত বর্ষণ করুক, যতদিন পর্যন্ত লোকজন তাঁর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে এবং অনুপ্রেরণা লাভ করবে।

এ প্রসঙ্গে কাস ইব্‌নে সায়িদা নিম্নোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করেন –

—হে মৃত্যুর ঘোষণাকারী! সমাধিস্থ ব্যক্তি তো সমাধিতে বিদ্যমান। তাদের বিরুদ্ধে বর্ণিত অবশিষ্ট কথাগুলো সব মিথ্যা।

তাদের কথা ছেড়ে দাও। কারণ, একদিন তাদের জাগ্রত হওয়ার জন্য আহবান করা হবে। তখন তারা তাদের নিদ্রা থেকে জাগ্রত হলে তাদের ঘুম উড়ে যাবে।

তখন তারা অন্য অবস্থায় ফিরে যাবে। যেমনিভাবে তাদের পূর্বে সৃষ্টি করা হয়েছিল, তেমনিভাবে তাদেরকে নতুন করে সৃষ্টি করা হবে।

তাদের কেউ হবে বিবস্ত্ৰ। কেউ থাকবে বস্ত্রাবৃত। কিছু বস্ত্র হবে নতুন আর কিছু হবে পুরাতন ও জীর্ণ।

বাযহাকী ইব্‌নে আব্বাস (রা) সূত্রে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন এবং তাতে উক্ত পংক্তির কথাও উল্লেখ করেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, লোকেরা তার শিয়রে একটি লিপি পেয়েছিল। তাতে ঈষৎ শাব্দিক পরিবর্তনসহ উক্ত পংক্তিগুলোই লিখিত ছিল।

শুনে রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, সেই সত্তার শপথ, যিনি আমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, কাস অবশ্যই পুনরুত্থানে বিশ্বাসী ছিলেন। বর্ণনার মূল বক্তব্য প্রসিদ্ধ। তবে সনদগুলো দুর্বল হলেও মূল ঘটনা প্রমাণে সহায়ক।

বায়হাকী (র) বর্ণনা করেন যে, হযরত আনাস ইব্‌ন মালিক (রা) বলেন, ইয়াদের একটি প্রতিনিধিদল নবী করীম (সা)-এর নিকট আগমন করলে রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞাসা করলেন, কাস ইব্‌নে সায়িদার খবর কী? তারা বলল, সে তো মারা গিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তার মুখ নিঃসৃত কয়েকটি কথা শুনেছিলাম, যা এ মুহুর্তে আমি মনে করতে পারছি না। শুনে উপস্থিত এক ব্যক্তি বলে উঠল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার মনে আছে। নবী করীম (সা) বললেন, তা হলে তা শুনাও তো! লোকটি বলল, আমি উকাজের বাজারে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময়ে কাস ইব্‌ন সায়িদা বলল, ওহে লোক সকল! কান পেতে শোন ও মনে রাখ, যে জীবন লাভ করে, সে অবশ্যই মৃত্যুবরণ করবে। আর যে মৃত্যুবরণ করেছে, সে শেষ হয়ে গেছে। যা কিছু আমবার, তা এসে গেছে। অাঁধার রাত। কক্ষ বিশিষ্ট আকাশ। উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিক্ষুব্ধ সমুদ্র } সুদৃঢ় পর্বত। প্রবহমান নদী। নিশ্চয় আকাশে খবর আছে। পৃথিবীতে আছে শিক্ষা গ্রহণের উপকরণ। আমি দেখছি যে, মানুষ মরে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে না। তাহলে কি মানুষ

ওখানেই থেকে যাওয়া মেনে নিয়েছে, নাকি সব ত্যাগ করে ঘুমিয়ে পড়েছে? কাস আল্লাহর শপথ করে বলছে, সত্য শপথ, নিশ্চয় আল্লাহর একটি দীন আছে যা তোমাদের রীতি-নীতির চেয়ে বহু উত্তম। অতঃপর সে কবিতা আবৃত্তি করল :

বিগত লেকাদের মধ্যে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে? আমাকে একদিন চলে যেতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *