১৬. যুল-কারনায়ন

যুল-কারনায়ন

এ প্রসংগে আল্লাহর বাণী :

ওরা তোমাকে যুল-কারনায়ন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। বল, আমি তোমাদের নিকট তার বিষয় বর্ণনা করব। আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দান করেছিলাম। অতঃপর সে এক পথ অবলম্বন করল। চলতে চলতে সে যখন সূর্যের অস্তগমন স্থানে পৌঁছল তখন সে সূর্যকে এক পংকিল জলাশয়ে অস্তগমন করতে

দেখল এবং সে সেখানে এক সম্প্রদায়কে দেখতে পেল। আমি বললাম, হে যুল-কারনায়ন!

তুমি এদেরকে শাস্তি দিতে পার অথবা এদের ব্যাপার সদয়ভাবে গ্ৰহণ করতে পোর। সে বলল, যে কেউ সীমালংঘন করবে, আমি তাকে শাস্তি দিব, অতঃপর সে তার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে এবং তিনি তাকে কঠিন শাস্তি দিবেন। তবে যে ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে তার জন্যে প্রতিদান স্বরূপ আছে কল্যাণ এবং তার প্রতি ব্যবহারে আমি নাম কথা বলব।

আবার সে এক পথ ধরল। চলতে চলতে যখন সে সূর্যোদয় স্থলে পৌঁছল, তখন সে দেখল তা এমন এক সম্প্রদায়ের উপর উদয় হচ্ছে যাদের জন্যে সূৰ্যতাপ হতে কোন অন্তরাল আমি সৃষ্টি করিনি। প্রকৃত ঘটনা এটাই, তার বৃত্তান্ত আমি সম্যক অবগত আছি। আবার সে এক পথ ধরল। চলতে চলতে সে যখন দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যবর্তী স্থলে পৌঁছল, তখন সেখানে সে এক সম্প্রদায়কে পেল যারা তার কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। তারা বলল, হে যুল-কারনায়ন! ইয়াজুজ ও মাজুজ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে; আমরা কি তোমাকে কর দিব এই শর্তে যে, তুমি আমাদের ও তাদের মধ্যে এক প্রাচীর গড়ে দিবে? সে বলল, আমার প্রতিপালক আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা-ই উৎকৃষ্ট; সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য কর, আমি তোমাদের ও তাদের মধ্যস্থলে এক মজবুত প্রাচীর গড়ে দিব। তোমরা আমার নিকট লৌহ পিণ্ডসমূহ আনয়ন শুকর, অতঃপর মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে যখন লৌহস্তুপ দুই পর্বতের সমান হল তখন সে বলল, তোমরা হাঁপরে দম দিতে থাক। যখন তা আগুনের মত উত্তপ্ত হল, তখন সে বলল, তোমরা গলিত তামা আনয়ন কর, আমি তা ঢেলে দিই এর উপর। এরপর তারা তা অতিক্রম করতে পারল না বা ভেদ করতেও পারল না। সে বলল, এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ। যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে তখন এটাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন এবং আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য। (১৮ কাহফ : brరి–సెbr)

আল্লাহ এখানে যুল-কারনায়নের বর্ণনা দিয়েছেন। তাকে তিনি ন্যায়-পরায়ণ বলে প্রশংসা করেছেন। প্ৰাচ্য ও প্রতীচ্যের শেষ প্ৰান্ত পর্যন্ত তিনি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। সমস্ত ভূ-খণ্ডের উপর তিনি বিজয় লাভ করেছিলেন। সকল দেশের অধিবাসীরা তার আনুগত্য স্বীকার করেছিল। তাদের মধ্যে তিনি পূর্ণ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বস্তৃত তিনি আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত এক সফল ও বিজয়ী বীর এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী বাদশাহ। তাঁর সম্পর্কে বিশুদ্ধ কথা হল, তিনি একজন ন্যায়-পরায়ণ বাদশাহ। অবশ্য কারো কারো মতে, তিনি নবী, কারো কারো মতে, রাসূল। তাঁর সম্পর্কে একটি বিরল মত হচ্ছে, তিনি ছিলেন ফেরেশতা। এই শেষোক্ত মতটি আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে শ্রুত হয়ে বর্ণিত হয়েছে। কেননা, হযরত উমর (রা) একদিন শুনতে পেলেন যে, এক ব্যক্তি অপর একজনকে বলছে, হে যুল-কারনায়ন! তখন তিনি বললেন, থাম, যে কোন একজন নবীর নামে নাম রাখাই যথেষ্ট, ফেরেশতার নামে নাম রাখার কী প্রয়োজন? সুহায়লী এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

ওকী . মুজাহিদের সূত্রে আবদুল্লাহ ইব্‌ন আমর (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, যুল-কারনায়ন নবী ছিলেন। হাফিজ ইব্‌ন আসাকির … আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : আমি জানি না, তুব্বা বাদশাহ অভিশপ্ত ছিল কি না; আমি এটাও জানি না যে, শরিয়ী শাস্তি দ্বারা দণ্ডপ্রাপ্তের গুনাহ মাফ হবে কি না; আমি জানি না, যুল-কারনায়ন নবী ছিলেন কি না! এ হাদীস উপরোক্ত সনদে গরীব।

ইসহাক ইব্‌ন বিশর …….. ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, যুল-কারনায়ন ছিলেন একজন ধাৰ্মিক বাদশাহ। আল্লাহ তার কাজ-কর্মে সন্তুষ্ট ছিলেন নিজ কিতাবে তিনি তাঁর

ংসা করেছেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর সাহায্যপ্ৰাপ্ত। হযরত খিযির (আ) ছিলেন তাঁর উষীর। তিনি আরও বলেছেন যে, খিযির (আ) থাকতেন তাঁর সেনাবাহিনীর অগ্রভাগে। বর্তমান কালে বাদশাহর নিকট উষীরের যেই স্থান, যুল-কারনায়নের নিকট হযরত খিযিরের ছিল ঠিক সেইরূপ উপদেষ্টার মর্যাদা। আযরাকী প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন যে যুল-কারনায়ন হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আ)-এর নিকট ইসলাম গ্ৰহণ করেন এবং হযরত ইবরাহীমের সাথে তিনি ও ইসমাঈল (আ) একত্রে কাবা তাওয়াফ করেন। উবায়দ ইব্‌ন উসােয়র তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ ও অন্যান্য বর্ণনাকারী বলেছেন যে, যুল-কারনায়ন পদব্রজে হজ্জ পালন করেন। ইবরাহীম (আ) তাঁর আগমনের সংবাদ পেয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন, তাকে দোয়া করেন ও তাঁর উপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। আল্লাহ মেঘপুঞ্জকে যুল-কারনায়নের অনুগত করে দিয়েছিলেন। যেখানে তিনি যেতে চাইতেন মেঘমালা তাকে সেখানে বহন করে নিয়ে যেত।

যুল-কারনায়ন নামকরণের ব্যাপারে ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। কারও মতে, তার মাথায় দুইটি শিং-এর মত ছিল এ কারণে তাঁকে যুল-কারনায়ন (দুই শিংওয়ালা) বলা হয়েছে। ওহাব ইব্‌ন মুনব্বিহ বলেন, তার মাথায় তামার দুইটি শিং ছিল। এটা দুর্বল মত। কোন কোন আহলি-কিতাব বলেছেন, যেহেতু তিনি রোম ও পারস্য এই উভয় সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন তাই তাঁকে এরূপ উপাধি দেয়া হয়েছে। কেউ বলেন, যেহেতু তিনি সূর্যের দুই প্রান্ত পূর্ব ও পশ্চিম এবং এর মধ্যবর্তী সমস্ত জায়গার একচ্ছত্র বাদশাহ ছিলেন, তাই তাকে এই নামে ভূষিত করা হয়েছে। এই ব্যাখ্যা ইমাম যুহরীর এবং অন্যান্য মতের তুলনায় এ মতটিই অধিক গ্রহণযোগ্য। হাসান বসরী বলেন, তার মাথার চুলের দুটি উঁচু ঝুকি ছিল যার কারণে তাকে এই নাম দেয়া হয়। ইসহাক ইব্‌ন বিশর . শুআয়বের পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি এক পরাক্রমশালী বাদশাহকে আল্লাহর দিকে আহবান করেন। এতে সে তার একটি শিং-এর উপর আঘাত করে ভেংগে চুরমার করে দেয়। এ ঘটনার পর থেকে তাকে যুল-কারনায়ন বলে আখ্যায়িত করা হয়। ইমাম ছাওরী . আলী ইব্‌ন আবি তালিব (রা) থেকে বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি হযরত আলী (রা)-কে যুল-কারনায়ন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যুল-কারনায়ন আল্লাহর এক সৎ বান্দা। আল্লাহ তাকে উপদেশ দেন। তিনি উপদেশ কাবুল করেন। তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহর দিকে আহবান করেন। তারা তার একটি শিং-এর উপর সজোরে আঘাত করে। ফলে তিনি মারা যান। আল্লাহ তাকে জীবিত করেন। আবারও তিনি তার সম্প্রদায়কে আল্লাহর দিকে আহবান করেন। তখন তারা তার অপর শিং এর উপর আঘাত করে। এ আঘাতেও তিনি মারা যান। এখান থেকে তাকে যুল-কারনায়ন বলা হয়ে থাকে। শুবা আল-কাসিমও.. হযরত আলী (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। আবুত তুফায়াল হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণনা করে বলেন, যুল-কারনায়ন নবী, রাসূল বা ফেরেশতা কোনটিই ছিলেন। না। তিনি ছিলেন একজন পুণ্যবান ব্যক্তি।

যুল-কারনায়নের আসল নাম কি ছিল সে ব্যাপারে বিভিন্ন রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। যুবোয়র ইব্‌ন বাককার ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, তাঁর নাম আবদুল্লাহ ইব্‌ন যাহাহাক ইব্‌ন মাআদ। কারও বর্ণনা মতে, মুসআব ইব্‌ন আবদুল্লাহ ইব্‌ন কিনান ইব্‌ন মানসূর ইব্‌ন আবদুল্লাহ ইব্‌ন আযাদ ইব্‌ন আওন ইব্‌ন নাবাত ইব্‌ন মালিক ইব্‌ন যায়দ ইব্‌ন কাহলান ইব্‌ন সাবা ইব্‌ন কাহতান।

একটি হাদীসের বর্ণনায় আছে যে, যুল-কারনায়ন হিমায়ার গোত্রভুক্ত ছিলেন। তার মা ছিলেন রোম দেশীয়। প্রখর জ্ঞানের অধিকারী হওয়ায় যুল-কাল্পনায়নকে ইবনুল ফায়লাসুফ বা মহাবিজ্ঞানী হলা হতো। হিময়ার গোত্রের জনৈক কবি তাদের পূর্ব-পুরুষ যুল-কারনায়নের প্ৰশংসায় নিম্নরূপ গৌরবগাথা লিখেন :

যুল-কারনায়ন ছিলেন আমার পিতামহ, মুসলমান ও এমন এক বাদশাহ। অন্যান্য রাজন্যবৰ্গ তার বশ্যতা স্বীকার করে ও তার নিকট আত্মসমপণ করেন। তিনি অভিযানের পর অভিযান পরিচালনা করে পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছেন এবং মহাজ্ঞানী পথপ্রদর্শক আল্লাহর প্রদত্ত উপায়-উপকরণ অনুসন্ধান করেন। পশ্চিমে সূর্যের অস্তাচলে গিয়ে সেখানে সূর্যকে এক কর্দমাক্ত কাল জলাশয়ে অস্ত যেতে দেখেন। তার পরে আসেন সমাজ্ঞী বিলকীস। তিনি ছিলেন আমার ফুফু। বিশাল রাজ্যের অধিকারী হন তিনি। সুলায়মানের হুদূহুদ পাখীর আগমন পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত প্ৰতাপের সাথে রাজ্য পরিচালনা করেন।

সুহায়লী লিখেছেন, কেউ কেউ তার নাম বলেছেন মারযুবান ইব্‌ন মারযুবা। ইব্‌ন হিশাম এ কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি অন্যত্র যুল-কারনায়নের নাম লিখেছেনঃ আস-সাব। ইব্‌ন ষী-মারাইদ। তুবাবা বংশের ইনিই প্রথম বাদশাহ। বীরুস্-সাবার ঘটনায় তিনি ইবরাহীমের পক্ষে ফয়সালা দিয়েছিলেন। কেউ বলেছেন, যুল-কারনায়নের নাম আফরীদূিন ইব্‌ন আসফিয়ান-যিনি যাহহাককে হত্যা করেছিলেন। আরবের বাগী পুরুষ কুস তাঁর এক ভাষণে বলেছিলেন : হে আয়াদ ইব্‌ন সাব যুল-কারনায়নের বংশধর। তোমাদের পূর্বপুরুষ যুল-কারনায়ন যিনি পূর্ব ও পশ্চিমের বাদশাহ, জিন ও ইনসানের উপর ক্ষমতা প্রয়োগকারী এবং দুহাজার বছর যার বয়স। এ সত্ত্বেও তা যেন ছিল এক লহমার মত। এ কথা উল্লেখ করার পর ইব্‌ন হিশাম কবি আশার নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেন :

والصعب ذو القرنين أصبح ثاويا – بالجنو فى جداث أشم مقيما অতঃপর সাব যুল-কারনায়ন মাটির নীচে কবরের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ীভাবে অবস্থান গ্ৰহণ করেন এবং সেখানে অবস্থানরত অবস্থায় তার সুবাস নিতে থাকেন।

ইমাম দারাকুতুনী ও ইব্‌ন মাকুলা বলেছেন, যুল-কারনায়নের নাম হুরমুস। তাকে বলা হত হারবীস ইব্‌ন কায়তুন ইব্‌ন রামী ইব্‌ন লানতী ইব্‌ন কাশলুখীন ইব্‌ন ইউনান ইব্‌ন ইয়াফিছ ইব্‌ন নূহ (আ)। ইসহাক ইব্‌ন বিশ্বর …….. কাতাদা (র) থেকে বর্ণনা করেন যে, বাদশাহ ইস্কান্দর (আলেকজাণ্ডার)-ই হলেন যুল-কারনায়ন। তাঁর পিতা ছিলেন প্রথম কায়সার (রোম সম্রাট)। ইনি সাম ইব্‌ন নূহ (আ)-এর বংশধর। আর দ্বিতীয় যুল-কারনায়ন হচ্ছেন ইস্কানদার ইব্‌ন ফিলিপস ইব্‌ন মুসরীম ইব্‌ন হুরমুস ইব্‌ন মোয়তুন ইব্‌ন রূমী ইব্‌ন লানতী ইব্‌ন ইউনান ইব্‌ন ইয়াফিছ ইব্‌ন য়ুন্নাহ ইব্‌ন শার-খুন ইব্‌ন রূমাহ ইব্‌ন শারফত ইব্‌ন তাওফােল ইব্‌ন রূমী ইব্‌ন আসফার ইব্‌ন ইয়াকিয, ইব্‌ন ঈসা ইব্‌ন ইসহাক ইব্‌ন ইবরাহীম আল-খালীল (আঃ) { হাফিজ ইব্‌ন আসাকির তার ইতিহাস গ্রন্থে এই ন্যসবনাম উল্লেখ করেছেন। যুল-কারনায়ন আল-মাকদুনী আল-ইউনানী আল মিসরী আলেকজান্দ্ৰিয়া নগরীর প্রতিষ্ঠাতা, যিনি স্বীয় শাসনামলে রোমের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। প্রথম যুল-কারনায়ন থেকে এই দ্বিতীয় যুল-কারনায়ন দীর্ঘকাল পরে হযরত ঈসা (আ)-এর তিনশ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। দার্শনিক এরিস্টটল ছিলেন তাঁর উষীর। তিনি দারার পুত্র দারাকে হত্যা করেন এবং পারস্য সাম্রাজ্যকে পদানত করেন। আমরা এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। এজন্যে যে, অনেকেই উভয় ইস্কান্দারকে অভিন্ন ব্যক্তি মনে করেন। ফলে তারা এ বিশ্বাস করেন যে, কুরআনে যে যুল-কারনায়নের কথা বলা হয়েছে তারই উষীর ছিলেন এরিস্টটল। এ বিশ্বাসের ফলে বিরাট ভুল ও জটিলতার সৃষ্টি হয়। কেননা প্রথম যুল-কারনায়ন ছিলেন মুমিন, সৎ, আল্লাহভক্ত ও ন্যায়-পরায়ণ বাদশাহ। হযরত খিযির (আ) তাঁর উষীর। অনেকের মতে, তিনি ছিলেন নবী।

পক্ষান্তরে দ্বিতীয় যুল-কারনায়ন ছিল মুশরিক। তার উষীর একজন দার্শনিক। তাছাড়া এ দুজনের মধ্যে দুহাজার বছরের চাইতেও অধিক সময়ের ব্যবধান। সুতরাং কোথায় এর অবস্থান, আর কোথায় তার অবস্থান। উভয়ের মধ্যে বিরাট ব্যবধান, কোনই সামঞ্জস্য নেই। অজ্ঞ ও নির্বোধি লোকেরাই দুজনকে এক বলে ভাবতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহর বাণী : ওরা তোমাকে যুল-কারনায়ন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছে। এর কারণ হচ্ছে : কতিপয় কুরায়শের কাফিরগণ ইহুদীদের কাছে গিয়ে বলে, তোমরা আমাদেরকে এমন কিছু কথা বলে দাও, যে বিষয়ে আমরা মুহাম্মদ (সা)-এর জ্ঞান পরীক্ষা করতে পারি। ইহুদীরা এদেরকে শিখিয়ে দিল যে, তোমরা তাকে এমন এক ব্যক্তির কথা জিজ্ঞেস কর, যে সমগ্ৰ ভু-খণ্ড বিচরণ করেছে। আর

গিয়েছিল, যাদের পরিণতি সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। কুরায়শরা ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এ প্রশ্ন করলে আল্লাহ তাআলা আসহাবে কাহফ ও যুল-কারনায়নের ঘটনা সম্বলিত আয়াতসমূহ নাযিল করেন।

আল্লাহ বলেন, বল, আমি শীঘই তোমাদেরকে এ বিষয়ে জানাব। অর্থাৎ এদের বর্ণনা ও অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাব। আয়াতে উল্লেখিত (<ও অর্থঃ তার পরিচয়ের জন্যে যেটুকু প্রয়োজন ও কল্যাণকর ততটুকু বলা হবে। অতঃপর আল্লাহ বলেন : আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম ও প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দান করেছিলাম। অর্থাৎ তাকে বিরাট রাজত্ব দিয়েছিলাম এবং রাষ্ট্রের এমন সব উপায়-উপকরণ তার করায়ত্ত করে দিয়েছিলাম যার সাহায্যে সে বিরাট বিরাট কাজ সমাধা করতে ও বড় বড় উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারতো। কুতায়বা ……. হাবীব। ইব্‌ন হাম্মাদ থেকে বর্ণনা করেন। হাবীব বলেন, আমি হযরত আলী ইব্‌ন আবি তালিবের কাছে বসা ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করল, যুল-কারনায়ন কী উপায়ে পৃথিবীর পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেন? হযরত আলী (রা) বললেন, মেঘমালাকে তার অনুগত করে দেয়া হয়েছিল, সকল উপকরণ তার হস্তগত করা হয়েছিল এবং তার জন্যে আলো বিছুরিত করা হয়েছিল। এ পর্যন্ত বলে জিজ্ঞেস করলেন, আরও বলা লাগবে না কি? শুনে লোকটি চুপে হয়ে গেল, আর হযরত আলী (রা)-ও থেমে গেলেন। আবু ইসহাক সাবীয়ী . মুআবিয়া (রা) থেকে বর্ণনা করেন, সমগ্ৰ পৃথিবীর বাদশাহী করেছেন চারজন : (১) সুলায়মান ইব্‌ন দাউদ (আ), (২) যুল-কারনায়ন (৩) হুলওয়ানের জনৈক অধিবাসী। (৪) অন্য একজন। জিজ্ঞেস করা হল, তিনি কি খিযির? বললেন, না।

যুবায়র ইব্‌ন বাককার…… সুফিয়ান ছাওরী (রা) থেকে বর্ণনা করেন, সমগ্ৰ পৃথিবীতে রাজত্ব করেছেন এমন বাদশাহ ছিলেন চারজন, দুইজন মুমিন (১) নবী সুলায়মান (২) যুল-কারনায়ন এবং দুইজন কাফির। (৩) নিমরুদ ও (৪) বুখত নসর। সাঈদ ইব্‌ন বশীরও এইরূপ বর্ণনা করেছেন। ইসহাক ইব্‌ন বিশার… হাসন বসরী (র) থেকে বর্ণনা করেন যে, নমরূদের পরে যুল-কারনায়ন বাদশাহ হন। তিনি একজন খাটি-নেককার মুসলমান ছিলেন। তিনি প্ৰাচ্য ও প্রতীচ্যে অভিযান চালান। আল্লাহ তার আয়ু বাড়িয়ে দেন ও তাকে সাহায্য করেন। ফলে সমস্ত জনপদ তিনি নিজের অধীনে আনেন, ধন-রত্ন করায়ত্ব করেন, দেশের পর দেশ জয় করেন এবং বহু কাফির নিধন করেন। তিনি বিভিন্ন জনপদ, শহর ও কিল্লা অতিক্রম করে চলতে চলতে পৃথিবীর পূর্ব সীমান্তে ও পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যান। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন : তারা তোমাকে যুল-কারনায়ন সম্পর্কে-জিজ্ঞেস করে। বল, আমি তোমাদের কাছে তার কিছু অবস্থা বর্ণনা করব। আমি তাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের কার্যোপকরণ দান করেছিলাম। অর্থাৎ উপায়-উপকরণ অন্বেষণের জ্ঞান দান করেছিলাম।

ঐতিহাসিক ইসহাক লিখেছেন, মুকাতিল বলেন যে, যুল-কারনায়ন দেশের পর দেশ জয় করেন, ধনরত্ন সংগ্রহ করেন এবং যারা তার দীন গ্ৰহণ করত ও তা অনুসরণ করত তাদেরকে ছেড়ে দিতেন, অন্যথায় হত্যা করতেন। (……….. Jর্থ ৬- ১LA, 15 –আর আমি তাকে প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দিয়েছিলাম। এ আয়াতে (,, . এর অর্থ ইব্‌ন আব্বাস, মুজাহিদ, সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র, ইকরিমা, উবায়দ ইব্‌ন ইয়ালা, সুদন্দী, কাতাদা ও যাহহাক-এর মতে ইলম বা জ্ঞান। কাতাদা ও মাতা আল-ওয়াররাকের মতে, ভূ-পৃষ্ঠের বিভিন্ন নিদর্শন, অবস্থান, অবস্থা ও প্রকৃতি। আবদুর রহমান ইব্‌ন যায়দ ইব্‌ন আসলামের মতে, বিভিন্ন ভাষার জ্ঞান। কেননা, যুল-কারনায়ন যে জাতির বিরুদ্ধেই লড়াই করতেন সেই জাতির ভাষায় তাদের সাথে কথা বলতেন। কিন্তু এর সঠিক অর্থ এই যে, এমন প্রতিটি উপকরণই এর অন্তর্ভুক্ত যার সাহায্যে তিনি রাষ্ট্রের মধ্যে ও বাইরে নিজ উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে ব্যবহার করতেন। কারণ, তিনি প্রতিটি বিজিত দেশ থেকে প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ, খাদ্য-সামগ্ৰী ও পাথেয় গ্ৰহণ করতেন-যা তার কাজে লাগত এবং অন্য দেশ জয়ের জন্যে সহায়ক হত।

কোন কোন আহলি কিতাব উল্লেখ করেছেন, যুল-কারনায়ন এক হাজার ছয় শ বছর আয়ু পেয়েছিলেন। তিনি গোটা বিশ্ব ভ্ৰমণ করেন এবং মানুষকে এক আল্লাহর দিকে আহবান জানাতে থাকেন। কিন্তু তাঁর বয়সকাল সম্পর্কে যে সব মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ আছে। আমি তাকে প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দিয়েছিলাম এ আয়াত সম্পর্কে বায়হাকী ও ইব্‌ন আসাকির এক দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছেন, কিন্তু সে হাদীসটি অত্যন্ত মুনকার পর্যায়ের। ঐ হাদীসের জনৈক রাবী মুহাম্মদ ইব্‌ন ইউনুসের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারিতার অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে আমরা এখানে সে হাদীস উল্লেখ করলাম না। আল্লাহর বাণী : অতঃপর সে এক পথ অবলম্বন করল। চলতে চলতে সে যখন সূর্যের অস্তগমন স্থলে পীেছল। অর্থাৎ চলতে চলতে পৃথিবীর পশ্চিম দিকে এমন এক স্থানে গিয়ে পেঁৗছলেন, যে স্থান অতিক্রম করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে এসে তিনি থেমে যান। এই স্থানটি হল পশ্চিম আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল। এর মধ্যে ছিল কতগুলো দ্বীপ। দ্বীপগুলোকে আরবীতে খালিদাত দ্বীপপুঞ্জ বলা হয়।

মানচিত্রবিদদের কারও কারও মতে, এই দ্বীপ থেকেই ভূ-ভাগ শুরু হয়েছে, কিন্তু অন্যদের মতে উক্ত সাগরের উপকূল থেকে ভূ-পৃষ্ঠের সূচনা যা পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে। যুল-কারনায়ন এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যের অস্তগমন প্রত্যক্ষ করেন। সে সূর্যকে এক পংকিল জলাশয়ে অস্তগমন করতে দেখল। পংকিল জলাশয় বলতে সাগরকে বুঝান হয়েছে। কেননা যে ব্যক্তি সাগর থেকে বা তার উপকূল থেকে প্রত্যক্ষ করে সে দেখতে পায় সূর্য যেন সমুদ্রের মধ্য থেকে উদিত হচ্ছে এবং সমুদ্রের মধ্যে অস্ত যাচ্ছে। এ কারণে আয়াতের মধ্যে Laws, শব্দ বলা হয়েছে, যার অর্থ সে দেখতে পেল। একথা বলা হয়নি যে, সূর্য পংকিল জলাশয়ে অস্ত গেল। কাব। আল আহবার বলেছেন বা ৭-১২ অর্থ কাল বর্ণের কাদা। ণ … … কে কেউ কেউ 4_au-র পড়েছেন। কারও মতে, উভয় শব্দের অর্থ একই অর্থাৎ পংকিল জলাশয়। আবার কেউ কেউ বলেন

1_e¥U« অর্থ উষ্ণ। কেননা সূর্যের কিরণ এখানে সোজাসুজি ও তীর্যকভাবে পতিত তয়, ফলে এখানকার পানি উষ্ণ থাকে। ইমাম আহমদ…আবদুল্লাহ ইব্‌ন উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একবার সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় সেদিকে তাকালেন এবং বললেন : এটা আল্লাহর সৃষ্ট এক উষ্ণ অগ্নিপিণ্ড (a__• L~)।। 41।। ৩L; )। আল্লাহর হুকুম দ্বারা যদি বাধা প্রদান না করা হত, তবে ভূ-পৃষ্ঠের সবকিছু জ্বলিয়ে-পুড়িয়ে দিত। এ হাদীস গরীব পর্যায়ের সনদে জনৈক অজ্ঞাত পরিচয় রাবী বলেছেন। হাদীসটি মারফু পর্যায়ের হওয়ার ব্যাপারেও সন্দেহ আছে। এটা আবদুল্লাহ-ইব্‌ন আমরের উক্তিও হতে পারে। কেননা, ইয়ারমুকের যুদ্ধে দুইটি প্রাচীন কিতাব তাঁর হস্তগত হয়। এই কিতাব থেকে তিনি অনেক কথা বর্ণনা করতেন।

কোন কোন কাহিনীকার বলেছেন যে, যুল-কারনায়ন সূর্যের অস্তগমন স্থান অতিক্রম করে সেনাদল সহ দীর্ঘদিন পর্যন্ত অন্ধকারের মধ্যে সম্মুখপানে অগ্রসর হয়েছিলেন। তাদের এ কথা ভুল এবং যুক্তি ও রেওয়ায়ত এর পরিপন্থী।

ইব্‌ন আসাকির ওকী (র) এর সূত্রে … যায়নুল আবেদীন থেকে এক দীর্ঘ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ঘটনার সারমর্ম এই যে, যুল-কারনায়নের সাথে একজন ফেরেশতা থাকতেন। তার নাম ছিল রানাকীল। একদিন যুল-কারনায়ন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, পৃথিবীতে একটি ঝর্ণা আছে নাকি, যার নাম আইনুল হায়াত বা সঞ্জীবনী ঝর্ণা? ফেরেশতা ঝর্ণাটির অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন। যুল-কারনায়ন তার সন্ধানে যাত্রা শুরু করলেন। হযরত খিযির (আ)-কে তিনি অগ্রবর্তী দলে রাখলেন। যেতে যেতে এক অন্ধকার উপত্যকায় গিয়ে ঝর্ণার সন্ধান পেলেন। খিযির ঝর্ণার কাছে গিয়ে সেখান থেকে পানি পান করলেন। কিন্তু যুল-কারনায়ন ঝর্ণার কাছে যেতে পারলেন না। তিনি সেখানে অবস্থিত একটি প্রাসাদে এক ফেরেশতার সাথে মিলিত হলেন। ফেরেশতা যুল-কারনায়নকে একটি পাথর দান করলেন। পরে তিনি সেনাবাহিনীর নিকট ফিরে এলে আলিমগণ পাথরটি সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি পাথটিকে ওজন করার জন্য এক পাল্লায় রাখলেন এবং অপর পাল্লায় অনুরূপ এক হাজার পাথর রাখলেন। কিন্তু ঐ পাথরটির পাল্লা ভারী হল। তখন হয়রত খিযির (আ)-ও পাথরটির রহস্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তখন তিনি তার বিপরীত পাল্লায় একটি পাথর উঠিয়ে তার উপর এক মুষ্টি মাটি ছেড়ে দিলেন। এবার পাল্লাটি ভারী হয়ে গেল। তখন তিনি বললেন, এটা ঠিক বনী আদমের উপমা যারা কবরের মাটি ছাড়া কোন কিছুতেই তৃপ্ত হয় না। এ দৃশ্য দেখে আলিমগণ ভক্তিভরে তার প্রতি নত হলেন।

এরপর আল্লাহ ঐ এলাকার অধিবাসীদের ব্যাপারে ফয়সালা দেন : আমি বললাম হে যুল-কারনায়ন! তুমি এদেরকে শাস্তি দিতে পার অথবা এদের ব্যাপার সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পার। সে বলল, যে কেউ সীমালংঘন করবে। আমি তাকে শাস্তি দিব, অতঃপর সে তার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন হবে এবং তিনি তাকে কঠিন শাস্তি দিবেন। সুতরাং তার উপর দুনিয়ার শাস্তি ও আখিরাতের শাস্তি উভয়টিই কার্যকর হবে। দুনিয়ার শাস্তির কথা আগে বলা হয়েছে। কেননা, কাফিরদের জন্যে এটা সাবধান ও সতর্কতাস্বরূপ। তবে যে ঈমান আনে। এবং সৎকর্ম করে তার জন্যে প্রতিদানস্বরূপ আছে কল্যাণ এবং তার প্রতি ব্যবহারে আমি নাম কথা বলব। এখানে অধিক মূল্যবান প্রতিদানের কথা প্ৰথমে বলা হয়েছে অর্থাৎ-আখিরাতের পুরস্কার, তারপরে বলা হয়েছে তাদের প্রতি তার অনুগ্রহের কথা, এই অনুগ্রহ হলো ন্যায়-নীতি, জ্ঞান ও ঈমান আবার সে এক পথ ধরল। অর্থাৎ তিনি পশ্চিম থেকে প্রত্যাবর্তন করে পূর্ব দিকে যাওয়ার পথ ধরলেন। কথিত আছে, পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্ব প্রান্তে ফিরে আসতে তাঁর বার বছর অতিবাহিত হয়। চলতে চলতে যখন সে সূর্যোদয়স্থলে পীেছল, তখন সে দেখল তা এমন এক সম্প্রদায়ের উপর উদিত হচ্ছে, যাদের জন্যে সূৰ্যতাপ থেকে কোন অন্তরাল আমি সৃষ্টি করি নি। অর্থাৎ তাদের কোন ঘর-বাড়ি ছিল না এবং সূর্যের তাপ থেকে বীচার কোন উপায় ছিল, না। তবে অনেক আলিম বলেছেন যে, তারা মাটিতে কবরের ন্যায় এক প্রকার সুড়ংগে প্রচণ্ড তাপের সময় আশ্রয় নিত। প্রকৃত ঘটনা এটাই তার বৃত্তান্ত আমি সম্যক অবগত আছি। অর্থাৎ যুল-কারনায়নের সকল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমি অবহিত। আমি তাকে হেফাজত করেছিলাম এবং পৃথিবীর পশ্চিম থেকে পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত সুদীর্ঘ যাত্রা পথে আমার প্রহরা তার উপর কার্যকর ছিল।

উবায়দ ইব্‌ন উমোয়র ও তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ প্রমুখ আলিমগণ বলেছেন যে, যুল-কারনায়ন পদব্রজে হজ্ব পালন করেন। হযরত ইবরাহীম খলীল (আঃ) যুল-কারনায়নের আগমনের সংবাদ পেয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। উভয়ে একত্রে মিলিত হলে ইবরাহীম খলীল (আঃ) তাঁর জন্যে দোয়া করেন এবং কতিপয় উপদেশ দেন। কথিত আছে, হযরত খলীল একটি ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যান এবং যুল-কারনায়নকে তাতে আরোহণ করতে বলেন। কিন্তু যুল-কারনায়ন অস্বীকার করে বলেন, যে শহরে আল্লাহর খলীল বিদ্যমান আছেন সেই শহরে আমি বাহনে আরোহণ করে প্রবেশ করব না। তখন আল্লাহ মেঘমালাকে তাঁর অনুগত করে দেন। এবং ইবরাহীম এ সুখবর তাকে জানিয়ে দেন। তিনি যেখানে যাওয়ার ইচ্ছে করতেন মেঘমালা তাকে সেখানে নিয়ে যেত। আল্লাহর বাণী : আবার সে এক পথ চলতে চলতে সে যখন দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যবর্তীস্থলে পীেছল, তখন সেখানে সে এক সম্প্রদায়কে পেল যারা তার কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। এ সম্প্রদায় সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এরা হল তুর্কী জাতিইয়াজুজ ও মাজুজের জ্ঞাতি ভাই।

এ সম্প্রদায়ের লোকজন যুল-কারনায়নের নিকট অভিযোগ করে যে, ইয়াজুজ ও মাজুজ গোত্রদ্বয় তাদের উপর অত্যাচার চালায়, লুট-তরাজ ও ধ্বংসাত্নক কার্যক্রমের দ্বারা শহরকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। তারা যুল-কারনায়নকে কর দিতে আগ্রহ প্ৰকাশ করল, যাতে তিনি তাদের ও ইয়াজুজ-মাজুজের মাঝে একটি প্রাচীর তৈরী করে দেন। যাতে করে তারা আর এদিকে উঠে আসতে না পারে। যুল-কারনায়ন তাদের থেকে কর নিতে অস্বীকার করেন এবং তাকে আল্লাহ যে সম্পদ ও ক্ষমতা দিয়েছেন তাতেই সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বললেন আমার প্রতিপালক আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা-ই উৎকৃষ্ট। তিনি তাদেরকে শ্রমিক ও উপকরণ সরবরাহ করতে বললেন এবং উক্ত দুই পর্বতের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান ভরাট করে বাঁধ নির্মাণ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আর এ দুপর্বতের মধ্যবর্তী স্থান ছাড়া ইয়াজুজ-মাজুজের আসার অন্য কোন পথ ছিল না। তাদের এক দিকে ছিল গভীর সমুদ্র অন্য দিকে সুউচ্চ পর্বতমালা। অতঃপর তিনি লোহা ও গলিত তামা, মতান্তরে সীসা দ্বারা উক্ত বাধ নির্মাণ করেন। কিন্তু প্রথমোক্ত মতই সঠিক। সে মতে এ বাঁধ নির্মাণে তিনি ইটের পরিবর্তে লোহা এবং সুরকির পরিবর্তে তামা ব্যবহার করেন। আল্লাহ বলেন এরপর তারা তা অতিক্রম করতে পারল না। অর্থাৎ সিঁড়ি কিংবা অন্য কিছুর সাহায্যে বাঁধ পার হয়ে আসতে পারল না। এবং ভেদ করতেও পারল না অর্থাৎ কুঠার বা শাবল দ্বারা ছিদ্র করতে পারল না। সহজের মুকাবিলায় সহজ ও কঠিনের মুকাবিলায় কঠিন নীতি অবলম্বন করা হল। সে বলল, এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ। অর্থাৎ এ বাঁধ নিমাণের ক্ষমতা আল্লাহ-ই দান করেছেন। এটা তারই অনুগ্রহ ও দয়া। কেননা, এর দ্বারা উক্ত সীমালংঘনকারী জাতির অত্যাচার থেকে তাদের প্রতিবেশী লোকদেরকে রক্ষা করতে পেরেছেন। যখন আমার প্রতিলকের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে অর্থাৎ শেষ যামানায় মানব জাতির উপর তাদের বের হয়ে আসার নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে। তখন তিনি একে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিবেন। অর্থাৎ মাটির সাথে মিশিয়ে. দিবেন। কেননা, তাদের বের হয়ে আসার জন্যে এ রকম হওয়া আবশ্যক। এ কারণে আল্লাহ বলেন এবং আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ইয়াজুজ-মাজুজকে যখন ছেড়ে দেয়া হবে তখন তারা ভূ-পৃষ্ঠের উচু স্থান দিয়ে দ্রুত অগ্রসর হতে থাকবে। আল্লাহর সত্য প্রতিশ্রুতি নিকটবর্তী। এজন্যে এখানেও আল্লাহ বলেছেন, সেদিন আমি তাদেরকে ছেড়ে দিব এ অবস্থায় যে, একদল আর এক দলের উপর তরংগের মত পতিত হবে। সেদিন বলতে বিশুদ্ধ মতে বাধ ভেংগে দেয়ার দিনকে বুঝান হয়েছে। এবং শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে। অতঃপর আমি তাদের সকলকেই একত্রিত করব। (১৮ কাহফ : ৯৯)। ইয়াজুজ ও মাজুজের বের হওয়া সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীস সমূহ আমরা তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছি। এই গ্রন্থের ফিতান ও মালাহিম অধ্যায়ে আমরা সেগুলো উল্লেখ করব।

আবু দাউদ আত্-তায়ালিসী (র) সুফিয়ান ছওৱী (রা)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, সর্বপ্রথম যিনি মুসাফাহার প্রবর্তন করল তিনি হলেন, যুল-কারনায়ন? কব আল-আহবার থেকে বর্ণিত। তিনি মুআবিয়া (রা)-কে বলেছেন : যুল-কারনায়নের মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে তিনি তাঁর মাকে ওসিয়ত করেন যে, আমার মৃত্যু হয়ে গেলে আপনি ভোজের ব্যবস্থা করবেন এবং নগরীতে সমস্ত মহিলাদেরকে ডাকবেন। তারা আসলে তাদেব সম্মুখে খানা রেখে সন্তান হারা মহিলারা ব্যতীত অন্যদেরকে আহার করতে বলবেন। যে সব মহিলা সন্তান হারিয়েছে তারা যেন উক্ত খাদ্য ভক্ষণ না করে। ওসিয়ত অনুযায়ী মা সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করে উক্তরূপে আহার গ্রহণের আহবান জানালেন। কিন্তু একজন মহিলাও খাবার স্পর্শ করল না। যুল-কারনায়নের মা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার তোমরা সকলেই কি সুন্তান হারা? তারা বলল, আল্লাহর কসম, আমরা প্রত্যেকেই সন্তান হারিয়েছি। তখন এ একই অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তিনি মনে সান্তুনা লাভ করলেন। ইসহাক ইব্‌ন বিশর আবদুল্লাহ ইব্‌ন যিনাদের মাধ্যমে জনৈক আহলি কিতাব থেকে বর্ণনা করেন যে, যুল-কারনায়নের ওসিয়ত ও তার মায়ের উপদেশ একটি সুদীর্ঘ মূল্যবান উপদেশ। বহু-জ্ঞানপূর্ণ ও কল্যাণকর কথা তাতে আছে। যুল-কারনায়ন যখন ইন্তিকাল করেন, তখন তার বয়স হয়েছিল। তিন হাজার বছর। এ বর্ণনাটি গরীব। পর্যায়ের।

ইব্‌ন আসাকির (র) অন্য এক সূত্রে বলেছেন, যুল-কারনায়ন ছত্রিশ বছর জীবিত ছিলেন। কারও মতে তিনি বত্ৰিশ বছর বেঁচে ছিলেন। হযরত দাউদ (আ)-এর সাতশ চল্লিশ বছর পর এবং আদম (আ)-এর পঁাচ হাজার একশ একাশি বছর পর তিনি দুনিয়ায় আগমন করেন এবং

প্রথম ইসকান্দারের ক্ষেত্রে নয়। তিনি দুই ইসকান্দারের মধ্যে প্রথম জন ও দ্বিতীয় জনের মধ্যে তালগােল পাকিয়ে ফেলেছেন। প্রকৃত পক্ষে ইসকান্দার দুইজন। আমরা বিভিন্ন বিজ্ঞজনের উদ্ধৃতি দিয়ে এ আলোচনার শুরুতে সে বিষয়ে উল্লেখ করে এসেছি। যারা দুই ইসকান্দরকে একজন ভেবেছেন তাদের মধ্যে সীরাত লেখক আবদুল মালিক ইব্‌ন হিশাম অন্যতম। হাফিজ আবুল কাসিম সুহায়লী এর জোর প্রতিবাদ করেছেন ও কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং উভয় ইসকান্দারের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য নির্ণয় করে দেখিয়েছেন। সুহায়লী বলেছেন, সম্ভবত প্রাচীন যুগের কতিপয় রাজা-বাদশাহ প্রথম ইসকান্দরের সাথে তুলনা করে দ্বিতীয় ইসকান্দরকেও যুল-কারনায়ন নামে আখ্যায়িত করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *