১১. হযরত ঈসা (আ)-এর বিবরণ

হযরত ঈসা (আ)-এর বিবরণ

খৃষ্টান সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, আল্লাহর সন্তান আছে। তাদের এ ভ্রান্ত বিশ্বাসের খণ্ডনে আল্লাহ তাআলা সূরা আলে-ইমরানের প্রথম দিকে ধারাবাহিকভাবে তিরাশিটি আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। নাজরান থেকে খৃষ্টানদের একটি প্রতিনিধিদল রাসূলে করীম (সা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাদের ভ্রান্ত ধর্ম-বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করে বলে যে, তারা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী এবং তাদের ধারণা অনুসারে আল্লাহ হচ্ছেন তিন সত্তার এক সত্তা। তাদের মধ্যকার বিভিন্ন দল উপদলের মধ্যে এক দলের মতে সেই তিন সত্তা হল : আল্লাহ, ঈসা (আ) ও মারিয়াম। এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তাআলা সূরার প্রারম্ভে উক্ত বিষয়ে আয়াত নাযিল করেন। তাতে তিনি বলেন যে, ঈসা (আ) আল্লাহর বান্দাদের মধ্যকার একজন বান্দা। অন্যান্য সৃষ্টির ন্যায় আল্লাহ তাঁকেও সৃষ্টি করেছেন এবং মাতৃগর্ভে আকৃতি দান করেছেন। তবে, আল্লাহ তাঁকে পিতা ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন, যেমন আদমকে পিতা ও মাতা ছাড়া পয়দা করেছেন। তার ক্ষেত্রে তিনি কেবল বলেছেন কুন- (হয়ে যাও) তখনই তিনি সৃষ্ট হয়ে যান। এ সূরায় আল্লাহ ঈসার মাতা মারুয়ামের জন্মের বৃত্তান্ত এবং তাঁর বৈশিষ্ট্যাবলী এবং ঈসার গর্ভধারণ সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। সূরা মারুয়ামেও এ সম্পর্কে তিনি বিশদ বর্ণনা করেছেন। সে বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব। সূরা আলে-ইমরানে আল্লাহ তাআলা বলেন :

—নিশ্চয়ই আদমকে, নূহকে ও ইবরাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে আল্লাহ বিশ্বজগতে মনোনীত করেছেন। এরা একে অপরের বংশধর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। স্মরণ কর, যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! আমার গর্ভে যা আছে তা একান্ত তোমার জন্যে আমি উৎসর্গ করলাম। সুতরাং তুমি আমার নিকট হতে তা কবুল কর, তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। অতঃপর যখন সে তাকে প্রসব করল তখন সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি কন্যা প্রসব করেছি; সে যা প্রসব করেছে, আল্লাহ তা সম্যক অবগত। ছেলে তো এই মেয়ের মত নয়, আমি তার নাম মারিয়াম রেখেছি এবং অভিশপ্ত শয়তান হতে তার ও তার বংশধরদের জন্যে তোমার শরণ নিচ্ছি। তারপর তার প্রতিপালক তাকে সংগ্রহে কবুল করলেন এবং তাকে উত্তমরূপে লালন-পালন করলেন এবং তিনি তাকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। যখনই যাকারিয়া কক্ষে তার সাথে সাক্ষাত করতে যেত, তখনই তার নিকট খাদ্য-সামগ্ৰী দেখতে পেত। সে বলত, হে মারিয়াম! এ সব তুমি কোথায় পেলে? সে বলত, এটা আল্লাহর নিকট হতে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবনোপকরণ দান করেন। (৩ আলে-ইমরান : ৩৩-৩৭)

আল্লাহ এখানে আদম (আ)-কে এবং তাঁর সন্তানদের মধ্যে যারা তার আনুগত্য ও অনুসরণে অটল ও অবিচল রয়েছিলেন, তাদের কথা উল্লেখ করেছেন। তারপর বিশেষভাবে বলেছেন, ইবরাহীমের বংশধরদের কথা। এর মধ্যে উক্ত বংশের ইসমাঈলী শাখা ও ইসহাকের শাখা অন্তর্ভুক্ত। এরপর তিনি এই পূত-পবিত্র আলে-ইমরানের বা ইমরান পরিবারের ফয়ীলত বর্ণনা করেছেন। এখানে ইমরান বলতে মারিয়ামের পিতাকে বুঝানো হয়েছে। মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক ইমরানের নিসাবনাম উল্লেখ করেছেন এভাবে : ইমরান ইব্‌ন বাশিম ইব্‌ন আমূন ইব্‌ন মীশা

আহরীহ্ ইব্‌ন ইয়া যাম ইব্‌ন ইয়াহফাশাত ইব্‌ন ঈশা ইব্‌ন আয়ান ইব্‌ন রাহবিআমি ইব্‌ন সুলায়মান ইব্‌ন দাউদ (আ)। অপর দিকে ইব্‌ন আসাকিরের বর্ণনা মতে হযরত মারিয়ামের বংশধারা নিম্নরূপ : মারুয়াম বিনত ইমরান ইব্‌ন মাছান ইবনুল আযির ইবনুল ইয়াওদ ইব্‌ন আখনার ইব্‌ন সাদৃক ইব্‌ন আয়াযুয। ইব্‌ন আল-য়াফীম ইব্‌ন আয়বৃদ ইব্‌ন যারায়াবীল ইব্‌ন

মাওছাম ইব্‌ন আযারিয়া ইব্‌ন ঘুরাম ইব্‌ন যুশাফাত ইব্‌ন ঈশা ইব্‌ন ঈবা ইব্‌ন রাহরি।আমি ইব্‌ন সুলায়মান ইব্‌ন দাউদ (আ)। মুহাম্মাদ ইব্‌ন ইসহাকের বর্ণিত নসব-নামার সাথে এই নসব-নামার যথেষ্ট পার্থক্য আছে; তবে মারিয়াম যে দাউদ (আ)-এর বংশধর, এ ব্যাপারে কোন বিরোধ নেই। মারিয়ামের পিতা ইমরান ছিলেন সে যুগে বনী ইসরাঈলের ইমাম। তার মা হান্না বিনত ফাকৃদ ইব্‌ন কাবীল ছিলেন ইবাদতগুজার মহিলা। হযরত যাকারিয়া (আ) ছিলেন সে যুগের নবী।

অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে তিনি ছিলেন মারিয়ামের বোন আশইয়ার স্বামী। কিন্তু কারও কারও মতে মারয়ামের খালার নাম ছিল আশইয়া এবং যাকারিয়া ছিলেন এই আশইয়ার স্বামী।

মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক ও অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, মারিয়ামের মায়ের কোন সন্তান হতো না। এ অবস্থায় একদিন তিনি দেখেন যে, একটি পাখী তার ছানাকে আদর-সোহাগ করছে। এ দৃশ্য দেখে তাঁর অন্তরে সন্তান লাভের অদম্য আগ্রহ জাগে। তখনই তিনি মানত করলেন যে, তিনি যদি গৰ্ভবতী হন তবে তাঁর পুত্ৰ সন্তানকে আল্লাহর জন্যে উৎসর্গ করবেন। অর্থাৎ বায়তুল মুকাদাসের খাদিম বানাবেন। মানত করার সাথে সাথেই তাঁর মাসিক স্রাব আরম্ভ হয়ে যায়। পবিত্র হওয়ার পর তার স্বামী তার সাথে মিলিত হন এবং মারিয়াম তার গর্ভে আসেন। আল-কুরআনের ভাষ্য হচ্ছে অতঃপর সে যখন তাকে প্রসব করল, তখন সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি কন্যা প্রসব করেছি। অথচ সে যা প্রসব করেছিল আল্লাহ তা সম্যক অবগত। …>… এর অন্য কেরাত ঐ…>, অর্থাৎ আমি যা প্রসব করেছি। আর পুত্র সন্তান কন্যা সন্তানের মত হয় নায়। অর্থাৎ বায়তুল মুকাদাসের খেদমতের ব্যাপারে। সে যুগের লোক বায়তুল মুকাদাসের খেদমতের জন্যে নিজেদের সন্তান মানত করত। মারিয়ামের মায়ের উক্তি, আমি তার নাম রাখলাম মারিয়াম। এ আয়াত থেকে দলীল গ্ৰহণ করে কেউ কেউ জন্মের দিনেই সন্তানের নামকরণের কথা বলেছেন। বুখারী ও মুসলিমে হযরত আনাস (রা) থেকে হাদীছ বর্ণিত আছে যে, তিনি তার নবজাত ভাইকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট নিয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (সা) একটি খোরমা চিবিয়ে তার রস নব-জাতকের মুখে দেন এবং তার নামকরণ করেন আবদুল্লাহ। হযরত হাসান (র) ছামুরা (রা) সূত্রে মারফু হাদীস বর্ণিত আছে, প্রত্যেক পুত্ৰ-সন্তান তার আকীকার দ্বারা সুরক্ষিত। জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু জবাই করবে, তার নামকরণ করবে এবং মাথার চুল মুণ্ডন করবে। এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদসহ সকল সুনান গ্ৰন্থকার এবং তিরমিয়ী একে সহীহ বলে অভিহিত করেছেন। এ হাদীছের কোন কোন বর্ণনায় নামকরণে (০.০.১) -এর স্থলে রক্তপ্রবাহিত করণ (০-০১-) -এর উল্লেখ আছে। কেউ কেউ এ বর্ণনাকেও সহীহ বলেছেন।

তারপর মারিয়াম বললেন, আমি একে এবং এর ভবিষ্যৎ বংশধরকে বিতাড়িত শয়তান থেকে রক্ষা করার জন্যে তোমারই শরণ নিচ্ছি। মারিয়ামের মায়ের এই দোয়া তার মানতের মতই কবুল হয়েছিল। এ সম্পর্কে হাদীসেও উল্লেখ পাওয়া যায়। ইমাম আহমদ……. আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : যে কোন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় শয়তান তাকে স্পর্শ করে, তাই সে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, কেবল মারিয়াম ও তার পুত্র এর ব্যতিক্রম। আবু হুরায়রা (রা) বলেন, তোমরা ইচ্ছে করলে কুরআনের এ আয়াত

এ উভয় হাদীস আবদুর রাযযাক (র) সূত্রে বর্ণিত। ইব্‌ন জারীর ……. আবু হুরায়রা (রা) থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ ভিন্ন সূত্রে … আবু হুরায়রা (রা) থেকে এ হাদীসটি নিম্নরূপভাবে বর্ণনা করেছেন; নবী করীম (সা) বলেছেন : বনী-আদমের প্রতিটি নবজাত শিশুকে শয়তান আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে, কেবল মারয়াম বিনত ইমরান ও তাঁর পুত্র ঈসা এর ব্যতিক্রম। এ হাদীসটি কেবল এই একটি সূত্রেই বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিমও ভিন্ন সনদে আবু হুরায়রা (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ ভিন্ন সূত্রে আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, কোন মা যখন সন্তান প্রসব করে তখন মায়ের কোলেই শয়তান তাকে ঘুষি মারে, কেবল মারিয়াম ও তার পুত্র এর ব্যতিক্রম।

রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা দেখেছি কি, শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হয়, তখন চিৎকার করে কাদে? সাহাবাগণ বললেন, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা দেখেছি। রাসূলুল্লাহ (স) { বললেন, এ চিৎকার তখনই সে দেয়, যখন মায়ের কোলে শয়তান তাকে ঘুষি মারে। এ হাদীস মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী বর্ণিত। কায়স . আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেছেন, যে কোন শিশু ভূমিষ্ঠ হলে শয়তান তাকে একবার বা দুবার চাপ দেয়, কেবল ঈসা ইব্‌ন মারিয়াম ও মারিয়াম এ থেকে রক্ষা পেয়েছে। তারপর রাসূল (সা) এ আয়াত পাঠ করলেন। আমি অভিশপ্ত শয়তান থেকে তার ও তার বংশধরদের জন্যে তোমার শরণ নিচ্ছি।

মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক ও ইমাম আহমদ … আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেছেন : প্রতিটি আদম সন্তান, যখন সে ভূমিষ্ঠ হয় তখন শয়তান তার পার্শ্বদেশে খোচা মারে কেবল ঈসা ইব্‌ন মারয়াম এর ব্যতিক্রম। শয়তান ঈসাকে খোচা মারতে গিয়ে পর্দায় খোচা মেরে চলে যায়। এ হাদীস বুখারী ও মুসলিমের শর্তে বর্ণিত। আল্লাহর বাণী : অতঃপর তার প্রতিপালক তাকে ভালরূপে কবুল করলেন এবং তাকে উত্তমরূপে লালন-পালন

ভূমিষ্ঠ হলে তাঁর মা তাকে একটি কাপড়ে জড়িয়ে বায়তুল মুকাদ্দাস মুসজিদে চলে যান এবং সেখানকার ইবাদতকারী লোকদের নিকট সোপর্দ করেন। মারিয়াম ছিলেন তাদের নেতা ও সালাতের ইমামের কন্যা। তাই তার দেখাশুনার দায়িত্ব কে নেবে, এ নিয়ে তারা বাদানুবাদে লিপ্ত হয়। বলাবাহুল্য যে, মারয়ামের দুগ্ধ পানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেই তাকে বায়তুল মুকাদ্দাসে ইবাদতকারীদের দায়িত্বে সোপর্দ করা হয়েছিল। মারয়ামকে যখন তাদের কাছে সোপর্দ করা হয়, তখন তারা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়— কে তার দায়িত্ব গ্রহণ করবে।

হযরত যাকারিয়া (আ) ছিলেন সে যুগের নবী। তিনি চাচ্ছিলেন, নিজের দায়িত্বে রাখতে এবং এ ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় তারই হক ছিল সর্বাধিক। কেননা, তার স্ত্রী ছিলেন মারিয়ামের বোন, মতান্তরে খালা। কিন্তু অন্যরা এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল এবং লটারীর মাধ্যমে ফয়সালা করার দাবি জানোল। অতঃপর লটারী করা হল এবং তাতে যাকারিয়া (আ)-এর নাম উঠলো। প্রকৃতপক্ষে খালা তো মায়েরই তুল্য। আল্লাহর বাণী : আর তাকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। যেহেতু লটারীতে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার বাণী : এ হল গায়েবী সংবাদ, যা আমি তোমাকে ওহীর মাধ্যমে অবহিত করছি। মারিয়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাদের মধ্যে কে গ্রহণ করবে। এর মধ্যে যখন তারা তাদের কলম নিক্ষেপ করছিল তুমি তখন তাদের নিকট ছিলে না এবং তারা যখন বাদানুবাদ করছিল, তখনও তুমি তাদের নিকট ছিলে না। (৩:৪৪)

মুফাসসিরগণ লিখেছেন যে, কলমের মাধ্যমে লিটারী তিনবার হয়েছিল। প্রথমবার প্রত্যেকে নিজ নিজ কলমে চিহ্ন দিয়ে এক জায়গায় রেখে দেয়। অতঃপর একজন অপ্ৰাপ্ত বয়স্ক বালককে সেখান থেকে একটা কলম উঠিয়ে আনতে বলে। দেখা গেল, যাকারিয়ার কলমই উঠে এসেছে। তাদের দাবি অনুযায়ী দ্বিতীয়বার লটারী করা হয়। এবার লটারীর পদ্ধতি ঠিক করা হয় যে, প্রত্যেকের কলম নদীর মধ্যে ফেলে দেবে; তারপর যার কলম স্রোতের বিপরীত দিকে চলবে, সে জয়ী হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কলম নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। দেখা গেল, যাকারিয়ার কলম স্রোতের বিপরীতে চলছে এবং অন্য সবার কলম স্রোতের অনুকূলে প্রবাহিত হচ্ছে। তখন তারা তৃতীয় বার লটারী করার দাবি জানাল এবং বলল, এবার যার কলম স্রোতের অনুকূলে চলবে এবং অন্যদের কলম উজানের দিকে উঠে যাবে সেই জয়ী হবে। এবারের লটারীতেও যাকারিয়া (আ) জয়ী হলেন এবং মারিয়ামের তত্ত্বাবধানের অধিকার লাভ করলেন। শরীআতের বিচারেও লটারীতে জয়ী হওয়ায় তাঁর অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

আল্লাহর বাণী : যখনই যাকারিয়া মিহরাবের মধ্যে তার কাছে আসত, তখনই কিছু খাবার দেখতে পেত। জিজ্ঞেস করত, মারিয়াম! কোথা থেকে এসব তোমার কাছে এল? সে বলত, এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিফিক দান করেন।

মুফাসসিরগণ লিখেছেন, হযরত যাকারিয়া মারিয়ামের জন্যে বায়তুল মুকাদাস মসজিদে একটি উত্তম কক্ষ নির্ধারণ করে দেন। তিনি ছাড়া ঐ কক্ষে অন্য কেউ প্রবেশ করত না। মারিয়াম এই কক্ষে অবস্থান করে আল্লাহর ইবাদত করতেন। মসজিদের কোন খেদমতের সময় সুযোগ যখন আসত, তখন তিনি সে দায়িত্ব পালন করতেন। রাত-দিন সর্বদা সেখানে তিনি আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তিনি এত বেশী পরিমাণে আল্লাহর ইবাদত করতেন যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে তাঁর ইবাদতকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হত। তাঁর বহু কারামত ও বৈশিষ্ট্যের কথা ইসরাঈলী সমাজে প্রসিদ্ধি লাভ করে। হযরত যাকারিয়া (আঃ) যখনই মারিয়ামের কক্ষে প্রবেশ করতেন তখনই তার নিকট বে-মৌসুমের বিরল খাদ্য দ্রব্য দেখতে পেতেন- যেমন শীত মৌসুমে গ্ৰীষ্মের ফল এবং গ্ৰীষ্ম মৌসুমে শীত কালের ফল দেখতে পেয়ে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, মারিয়াম! এসব তুমি কোথায় পেলে? সে বলত, এসব আল্লাহর নিকট থেকে অর্থাৎ আল্লাহই এসব খাদ্য সামগ্ৰী আমার জন্যে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা! করেন অপরিমিত রিযক দান করেন। সেখানেই যাকারিয়ার মনে পুত্র-সন্তানের আকাঙ্ক্ষা জাগে এবং বয়স অনেক বেশী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর নিকট দোয়া করে বলেন, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে তুমি তোমার নিকট থেকে সৎ বংশধর দান কর। নিশ্চয়ই তুমি প্রার্থনা শ্রবণকারী। কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, হযরত যাকারিয়া (আ) প্রার্থনায় এ কথাও বলেছিলেন যে, হে মহান প্ৰভু! আপনি যেমন মারিয়ামকে অসময়ে ফল দান করেছেন, আমাকেও একটি সন্তান দান করুন, যদিও অসময় হয়ে গেছে। এর পরবর্তী ঘটনাবলী আমরা যথা স্থানে বর্ণনা করে এসেছি।

আল্লাহর বাণী :

-স্মরণ কর, যখন ফেরেশতাগণ বলেছিল, হে মারিয়াম!! আল্লাহ তোমাকে মনোনীত ও পবিত্র করেছেন এবং বিশ্বের নারীগণের মধ্যে তোমাকে মনোনীত করেছেন। হে মারিয়াম! তোমার প্রতিপালকের অনুগত হও ও সিজদা কর এবং যারা রুকূ করে তাদের সাথে রুকূ করা। এটা অদৃশ্য বিষয়ের সংবাদ, যা তোমাকে ওহী দ্বারা অবহিত করছি। মারিয়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাদের মধ্যে কে গ্রহণ করবে। এর জন্যে যখন তারা তাদের কলম নিক্ষেপ করছিল, তুমি তখন তাদের নিকট ছিলে না এবং তারা যখন বাদানুবাদ করছিল তখনও তুমি তাদের নিকট ছিলে না। স্মরণ কর, যখন ফেরেশতাগণ বলল, হে মারিয়াম!! আল্লাহ তোমাকে তার পক্ষ হতে একটি কলেমার সুসংবাদ দিচ্ছেন। তার নাম মসীহ—মারিয়াম তনয় ঈসা, সে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত এবং সান্নিধ্যপ্রাপ্তগণের অন্যতম হবে। সে দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে মানুষের সাথে কথা বলবে এবং সে হবে পুণ্যবানদের একজন। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি, আমার সন্তান হবে কীভাবে? তিনি বললেন, এ ভাবেই, আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কিছু স্থির করেন তখন বলেন, হও এবং তা হয়ে যায়। এবং তিনি তাকে শিক্ষা দিবেন। কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইনজীল এবং তাকে বনী ইসরাঈলের জন্যে রাসূল করবেন। সে বলবে, আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদের জন্যে কাদা দ্বারা একটি পাখীর মত আকৃতি গঠন করব; তারপর তাতে আমি ফুৎকার দিব; ফলে আল্লাহর হুকুমে তা পাখী হয়ে যাবে। আমি জন্মান্ধ ও কুণ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে নিরাময় করব এবং আল্লাহর হুকুমে মৃতকে জীবন্ত করব। তোমরা তোমাদের ঘরসমূহে যা আহার কর ও মাওজুদ কর, তা তোমাদেরকে বলে দেব। তোমরা যদি মুমিন হও তবে এতে তোমাদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। আর আমি এসেছি আমার সম্মুখে তাওরাতের যা রয়েছে তার সমর্থকরূপে ও তোমাদের জন্যে যা নিষিদ্ধ ছিল তার কতকগুলোকে বৈধ করতে এবং আমি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর আর আমাকে অনুসরণ করা। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। সুতরাং তোমরা তার ইবাদত করবে। এটাই সরল পথ। (৩ আলে ইমরান : ৪২-৫১)

উপরোক্ত আয়াত সমূহে আল্লাহ এ কথা উল্লেখ করছেন যে, ফেরেশতাগণ মারয়ামকে এ সুসংবাদ পৌঁছান যে, আল্লাহ তাকে সে যুগের সমস্ত নারীদের মধ্যে মনোনীত করেছেন। যেহেতু তিনি তার থেকে সৃষ্টি করবেন পিতা ছাড়া পুত্র-সন্তান এবং তাঁকে এ সুসংবাদও দেন যে, সে পুত্রটি হবেন মর্যাদাশীল নবী। সে মানুষের সাথে কথা বলবে দোলনায় থাকা অবস্থায়। অর্থাৎ শিশুকালেই তিনি মানুষকে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান করবেন। পরিণত বয়সেও তিনি মানুষকে ঐ একই আহবান জানাতে থাকবেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, মারিয়াম তনয় পরিণত বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন এবং মানুষকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান করবেন। এবং তাঁকে বেশী বেশী ইবাদত-বন্দেগী ও রুকু সিজদা করার নির্দেশ দেয়া হয়। যাতে করে তিনি এই মর্যাদার যোগ্য হয়ে উঠেন এবং তিনি এ অপার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পারেন। তিনি এ নির্দেশ পূর্ণভাবে পালন করার চেষ্টা করতেন। কথিত আছে যে, দীর্ঘক্ষণ সালাতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তাঁর দুপা ফেটে যেত। আল্লাহ তার উপর এবং তাঁর পিতা-মাতার উপর শান্তি বর্ষিত করুন।

আয়াতে রয়েছে, ফেরেশতাগণ বলেন, হে মারিয়াম!! আল্লাহ তোমাকে মনোনীত করেছেন। এবং তোমাকে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছেন। অর্থাৎ মন্দ চরিত্র থেকে তোমাকে পবিত্র রেখেছেন এবং উত্তম গুণাবলী দ্বারা বিভূষিত করেছেন। আর তোমাকে বিশ্বের নারীগণের মধ্যে মনোনীত করেছেন। বিশ্বের নারীদের দুটি অর্থ হতে পারে : এক, সে যুগে বিশ্বে যত নারী ছিল, তাদের উর্ধে। যেমন মূসা (আ)-কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেছেন, আমি তোমাকে মানব জাতির উপর মনোনীত করেছি। অনুরূপভাবে বনী ইসরাঈল সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন, আমি জেনে শুনেই তাদেরকে বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম। (৪৪ দুখান : ৩২) কিন্তু সবাই জানে যে, ইবরাহীম (আ) মূসা (আ)-এর চাইতে শ্রেষ্ঠ, এবং মুহাম্মদ (সা) উভয়ের চাইতে শ্রেষ্ঠ। অনুরূপ বিশ্বনবীর এ উম্মত অতীতের সমস্ত উম্মত থেকে শ্রেষ্ঠ এবং বনী ইসরাঈল ও অন্যান্যদের তুলনায় সংখ্যায় অধিক, ইলম ও জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ এবং আমলে ও ইখলাসে উন্নততর।

(২) তোমাকে বিশ্বের নারীদের মধ্যে মনোনীত করেছেন। এ কথাটি ব্যাপক অর্থেও হতে পারে। অর্থাৎ পূর্ববতী ও পরবর্তী বিশ্বের সমস্ত নারীকুলের মধ্যে মারয়ামই শ্রেষ্ঠ। কেননা, তিনি যদি নবী হয়ে থাকেন, যেমন ইব্‌ন হাযম প্ৰমুখের ধারণা যে, ঈসা নবীর মা মারিয়াম, ইসহাক নবীর মা সারা ও মূসা নবীর মা নবী ছিলেন। কেননা, এঁদের প্রত্যেকের সাথে ফেরেশতা কথা বলেছেন এবং মূসা নবীর মায়ের নিকট ওহী এসেছে। এমত অনুযায়ী মারিয়াম অন্যান্য নারীদের তুলনায় তো বটেই, এমনকি সারা এবং মূসা (আ)-এর মায়ের তুলনায়ও শ্রেষ্ঠতর। t আয়াতে নবী অ-নবী সমস্ত নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং এর সাথে সাংঘর্ষিক অন্য কোন আয়াত নেই। কিন্তু আবুল হাসান আশআরী ও অন্যান্য ধর্ম বিশারদগণ জামহুর উলামা তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অভিমত উদ্ধৃত করে বলেছেন, নবুওত পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নারীদের মধ্যে কাউকেই তা দান করা হয়নি। এমত অনুযায়ী উক্ত আয়াতের অর্থ হবে, মারিয়ামকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ অপর এক হয়েছে এবং তার মা সিদ্দীকা (সত্যনিষ্ঠ) ছিল। (মায়িদা : ৭৫)। এ মত হিসেবে পূর্বের ও পরের সিদীক মৰ্যাদাপ্রাপ্ত নারীদের মধ্যে মারিয়ামের শ্রেষ্ঠ হওয়ায় কোন বাধা নেই। হাদীসে মারিয়ামের নাম আসিয়া বিনত মুযাহিম খাদীজা বিনত খুওয়ায়লিদ এবং নবী তনয়া হযরত ফাতিমা (রা)-এর সাথে এক সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইমাম আহমদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিয়ী ও নাসাঈ (র) বিভিন্ন সূত্রে …… হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন : নারীদের মধ্যে সর্বোত্তম মারিয়াম বিনূত ইমরান এবং নারীদের মধ্যে সর্বোত্তম খাদীজা বিনত খুওয়ায়লিদ। ইমাম আহমদ ……. আনাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : বিশ্বজগতে নারীদের মধ্যে কেবল

খুওয়ায়লিদ ও ফাতিমা (রা) বিনত মুহাম্মদ (সা)। তিরমিয়ী আবদুর রাযযাকের সূত্রে উপরোক্ত সনদে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। ইব্‌ন মারদুওবেহ এবং ইব্‌ন আসাকির আনাস (রা) সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ . আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) বলেছেন : উটে আরোহিণীদের মধ্যে উত্তম মহিলা হলেন সতী-সাধ্বী কুরায়শী মহিলা। ছোট শিশুদেরকে তারা অধিক স্নেহ করে এবং স্বামীর সম্পদের পূর্ণ হেফাজত করে। আবু হুরায়রা (রা) বলেন, বিবি মারিয়াম কখনও উটে আরোহণ করেন নি। ইমাম মুসলিম ও ইমাম আহমদ ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

তারপর আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ্ (সা)-এর জানা ছিল যে, ইমরানের কন্যা (মারয়াম) উটে আরোহণ করেন নি। এ হাদীস সহীহর শর্ত অনুযায়ী আছে এবং আবু হুরায়রা (রা) থেকে ভিন্ন সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে।

আবু ইয়ালা … ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ (সা) একদা মাটির উপরে চারটি রেখা আঁকেন এবং সাহাবাগণের নিকট জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি বুঝতে পেরেছ এ রেখা কিসের? তাঁরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, জান্নাতবাসী মহিলাদের মধ্যে সর্বোত্তম মহিলা খুওয়ায়লিদের কন্যা খাদীজা, মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমা, ইমরানের কন্যা মারিয়াম এবং মুযাহিমের কন্যা অর্থাৎ ফিরআওনের স্ত্রী আসিয়া। ইমাম নাসাঈ (র)-ও অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। আবুল কাসিম বাগাবী (র)… আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ফাতিমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাসূলুল্লাহর অন্তিমকালে তুমি তার মুখের উপর বুকে পড়ে প্রথমে কেঁদে ফেললে এবং পরীক্ষণে আবার হেসে উঠলে, এর কারণ কি? ফাতিমা (রা) বললেন, আব্বা আমাকে প্রথমে জানালেন, এই রোগেই তার ইন্তিকাল হবে, তাই আমি কেঁদেছি। দ্বিতীয়বার যখন বুকলাম তখন তিনি বললেন, আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সাথে মিলিত হবে এবং তুমি হবে জান্নাতী মহিলাদের নেত্রী। অবশ্য, মারিয়াম বিনত ইমরান-এর ব্যতিক্রম-এ কথা শুনে আমি হেসেছি। এ হাদীসের মূল অংশ সহীহ গ্রন্থে আছে এবং উল্লেখিত সনদ মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী আছে। এ হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব উল্লেখিত চারজন মহিলার মধ্যে উক্ত দুজন শ্রেষ্ঠ। অনুরূপ আর একটি হাদীস ইমাম আহমদ . আবু সাঈদ (র) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, জান্নাতবাসী মহিলাদের নেত্রী হবে ফাতিমা, তবে মারিয়াম বিনত ইমরানের ব্যাপারটি ব্যতিক্রম। এ হাদীসের উপরোক্ত সনদকে ইমাম তিরমিয়ী হাসান ও সহীহ বলেছেন। অবশ্য হাদীসটি দুর্বল সনদে হযরত আলী (আঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে।

মোটকথা, উপরোক্ত হাদীস থেকে এটাই বুঝা যায় যে, চার জনের মধ্যে ফাতিমা ও মারিয়ামই শ্রেষ্ঠ। এরপর কথা থাকে যে, এ দুজনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে? এ বিষয়ে হাদীসের অর্থ দুরকম হতে পারে। একঃ মারিয়াম ফাতিমার চাইতে শ্রেষ্ঠ; দুইঃ মারিয়াম ও ফাতিমা উভয়ে সমমর্যাদা সম্পন্ন। এ সম্ভাবনার কারণ হল, হাফিজ ইব্‌ন আসাকির ইব্‌ন আব্বাসের এক হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাতে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : জান্নাতবাসী মহিলাদের মধ্যে সবার

ফিরআওনের স্ত্রী আসিয়া। এখানে শব্দ বিন্যাস থেকে তাঁদের, মর্যাদার ক্রমবিন্যাস বুঝা যায়। ইতিপূর্বে যে সব হাদীস বর্ণিত হয়েছে সেখানেও চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে; যার দ্বারা মর্যাদার বিন্যাসও বুঝায় না এবং বিন্যাসের পরিপন্থীও বুঝায় না। এ হাদীসটিই আবু হাতিম (র) ভিন্ন সূত্রে ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন – সেখানেও বর্ণনা থেকে মর্যাদার ক্রম বিন্যাস বুঝায় না।

ইব্‌ন মারদুইবেহ … কুরুরা থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, পুরুষদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক লোক পূর্ণতা (কামালিয়ত) লাভ করেছেন; কিন্তু মহিলাদের মধ্যে তিনজন ছাড়া আর কেউই পূর্ণতা অর্জন করেন নি। তাঁরা হচ্ছেন মারয়াম বিনত ইমরান, ফিরআওনের স্ত্রী আসিয়া ও খাদীজা বিনত খুওয়ায়ালিদ। আর নারীদের মধ্যে আয়েশার মর্যাদা সেই পরিমাণ, যেই পরিমাণ মর্যাদা সমস্ত খাদ্যের মধ্যে ছারীদের

১. গোশতের ঝোলে ভেজানো রুটি।

আবু দাউদ ব্যতীত অধিকাংশ সিহাহ সিত্তার অন্যান্য সংকলকগণ … আবু মূসা আশআরী (আ) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: পুরুষদের মধ্যে অনেকেই পূর্ণতা লাভ করেছেন; কিন্তু নারীদের মধ্যে কেবল ফিরআওনের স্ত্রী আসিয়া ও মারয়াম বিনত ইমরান ছাড়া আর কেউই পূর্ণতা অর্জন করতে পারেন নি। আর নারীদের উপর আয়েশার শ্রেষ্ঠত্ব তেমনি যেমন শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে সকল খাদ্যের উপর ছারীদের। এ হাদীছ সহীহ। বুখারী ও মুসলিম উভয়েই বর্ণনা করেছেন। হাদীছের শব্দ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, নারী জাতির মধ্যে পূর্ণতা কেবল দুজন নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং তারা হলেন মারিয়াম ও আসিয়া। কেননা, তারা উভয়েই দুজন শিশু নবীকে তত্ত্বাবধান করেছিলেন। বিবি আসিয়া করে ছিলেন মূসা কালীমুল্লাহকে এবং বিবি মারয়াম করেছিলেন ঈসা। রূহুল্লাহকে। তবে পূর্ণতা আসিয়া ও মারিয়ামের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়ার অর্থ হল তাদের স্বাস্ব যুগের নারীদের মধ্যে তারাই ছিলেন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী শেষ নবীর উম্মতের মধ্যে আরও নারীদের পূর্ণতা লাভে এ হাদীছের সাথে কোন বিরোধ থাকে না। যেমন খাদীজা ও ফাতিমা। খাদীজা (রা) রাসূলুল্লাহর খেদমত করেছেন নবুওতের পূর্বে পনের বছর এবং নবুওতের পরে প্রায় দশ বছর। তিনি নিজের জানমাল দিয়ে নিষ্ঠার সাথে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সেবা-সহযোগিতা করেছেন। আর রাসূল তনয়া ফাতিমা তাঁর অন্যান্য বোনদের তুলনায় অধিক ফয়ীলতের অধিকারিণী। কেননা, রাসুলুল্লাহ (স)-এর জন্যে তিনি কষ্ট-নিপীড়ন সহ্য করেছেন এবং পিতার ইনতিকালের শোক যাতনায় ধৈর্য ধারণ করেছেন। কিন্তু অন্যান্য বোনদের সবাই রাসূলুল্লাহর জীবদ্দশায়ই ইন্তিকাল করেন।

অন্যদিকে হযরত আয়েশা (রা) ছিলেন রাসুলুল্লাহর প্রিয়তমা সহধর্মিণী। আয়েশা (রা) ব্যতীত অন্য কোন কুমারীকে রাসূলুল্লাহ বিবাহ করেন নি। শেষ নবীর উম্মতের মধ্যে এমনকি পূর্ববতী নবীগণের উম্মতের মধ্যেও আয়েশার চাইতে অধিক জ্ঞানী গুণী আর কোন মহিলা ছিলেন বলে জানা যায় না। অপবাদকারীরা যখন হযরত আয়েশা (রা)-এর বিরুদ্ধে অপবাদ রটায়। তখন আল্লাহ তাআলা সপ্ত আসমানের উপর থেকে নিজে আয়েশার পবিত্ৰতা ঘোষণা করে আয়াত নাযিল করেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ইনতিকালের পর তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর জীবিত ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ব্যাপী তিনি কুরআন ও সুন্নাহর প্রচার-প্রসারে অসামান্য অবদান রাখেন, মুসলিম সমাজে উদ্ভূত সমস্যাবলীর সমাধান দেন এবং মুসলমানদের পারস্পারিক দ্বন্ধ। সহজেই মীমাংসার গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। হযরত আয়েশা (রা) ছিলেন সকল উন্মুল মুমিনীনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এমনকি প্রাচীন ও আধুনিক বহু সংখ্যক আলিমের মতে, হযরত খাদীজার চাইতেও আয়েশা (রা) শ্রেষ্ঠ। কিন্তু উত্তম পন্থা হল উভয়ের মর্যাদার তারতম্য করার ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করা। যারা তারতম্য করেছেন তারা সেই হাদীছের প্রতি লক্ষ্য রেখে করেছেন যে, নারীদের মধ্যে আয়েশার স্থান সে রকম, যে রকম খাদ্যের মধ্যে ছারীদের স্থান। কিন্তু এ হাদীছের ব্যাখ্যা দুরকম করা যেতে পারে। এক, তিনি উল্লেখিত ও অনুল্লেখিত সকল নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দুই, উল্লেখিত নারীগণ ব্যতীত অন্যান্য নারীদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ।

যাহোক, এখানে মূল আলোচনা ছিল হযরত মারিয়াম বিনত ইমরান প্রসংগে। কেননা আল্লাহ তাকে পবিত্র করেছেন এবং তার যুগের সমস্ত নারীদের মধ্যে কিংবা সকল যুগের সমস্ত নারীদের মধ্যে তাকে মনোনীত করেছেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ইতিমধ্যেই হয়েছে। হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত মারিয়াম বিনত ইমরান এবং আসিয়া বিনত মুযাহিম জন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হিস সালামের সহধর্মিণীগণের অন্তর্ভুক্ত হবেন। তাফসীর গ্রন্থে আমরা প্রাথমিক যুগের কোন কোন আলিমের ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছি, যেখানে, এ.U.,,,,t<1 (অর্থাৎ বিবাহিত স্ত্রী ও কুমারী স্ত্রী)-এর ব্যাখ্যায় বিবাহিত স্ত্রী বলতে আসিয়া এবং কুমারী বলতে মারয়ামকে বুঝানো হয়েছে। তাফসীর গ্রন্থে সূরা তাহরীমের শেষ দিকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

তাবারানী … সাদ ইব্‌ন জুনাদা আল আওফী থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, জান্নাতের মধ্যে আল্লাহ আমার সংগে ইমরানের কন্যা মারয়াম, ফিরআওনের স্ত্রী ও মূসা নবীর ভগ্নীকে বিবাহ দিবেন। আবু ইয়ালা … আবু উমামা থেকে বর্ণিত হাদীছে। মূসা (আ)-এর বোনের নাম কুলসুম বলে উল্লেখিত হয়েছে। আবু জাফর উকায়লী এ হাদীছ শেষের দিকে কিছু বৃদ্ধিসহ বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহর কথা শোনার পর আবু উমামা বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার জন্যে এটা খুবই আনন্দের বিষয়। অতঃপর উকায়লী মন্তব্য করেন যে, হাদীছের এ অংশটি নির্ভরযোগ্য নয়। যুবোয়র ইব্‌ন বাককার . ইব্‌ন আবু দাউদ থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সা) খাদীজার ঘরে প্রবেশ করেন। খাদীজা (রা) তখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত। রাসূলুল্লাহ বললেন, হে খাদীজা! তোমার অবস্থা আমার নিকট খুবই অগ্ৰীতিকর ঠেকছে। অবশ্য অগ্ৰীতিকর বিষয়ের মধ্যে আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখে থাকেন। জেনে রেখ, আল্লাহ জান্নাতের মধ্যে তোমার সাথে ইমরানের কন্যা মারিয়াম, মুসার বোন কুলছুম ও ফিরআওনের স্ত্রী আসিয়াকে আমার সংগে বিবাহ দিয়ে রেখেছেন। খাদীজা (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ। আপনার সাথে এরূপ করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। খাদীজা (রা) বললেন, বরকতময় হোক আপনাদের এ বিবাহ ও সন্তানাদি।

ইব্‌ন আসাকির … ইব্‌ন আব্বাস (র) থেকে বৰ্ণিত। হযরত খাদীজা (রা) যখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত তখন রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর নিকট গমন করেন এবং বলেন, হে খাদীজা! যখন তুমি তোমার সতীনদের সাথে মিলিত হবে তখন তাদেরকে আমার সালাম জানাবে। খাদীজা (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পূর্বে কি আপনি কাউকে বিবাহ করেছিলেন? রাসূলুল্লাহ বললেন, না, বিবাহ তো করিনি; কিন্তু আল্লাহ আমার সাথে মারিয়াম বিনত ইমরান, আসিয়া বিনত মুযাহিম এবং মূসার বোন কুলসুমকে বিবাহ দিয়েছেন। ইব্‌ন আসাকির … ইব্‌ন উমর থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা জিবরাঈল (আঃ) ওহী নিয়ে রাসূলুল্লাহর নিকট আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে বসে আলাপ করেন। এমন সময় খাদীজা ঐ স্থান দিয়ে গমন করছিলেন। জিবরাঈল (আঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে মুহাম্মদ! ইনি কে! রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ইনি হলেন সিন্দীকা আমার স্ত্রী। জিবরাঈল (আঃ) বললেন, তার নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার কাছে কিছু বার্তা আছে। আল্লাহ তাকে সালাম জানিয়েছেন এবং জান্নাতে তাঁর জন্যে নির্মিত মূল্যবান ঘরের সুসংবাদ দিয়েছেন, সেখানে নেই কোন দুঃখ, নেই কোন কোলাহল। খাদীজা (রা) বললেন, আল্লাহর নাম সালাম বা শান্তি। আর তার থেকে সালাম ও শান্তির আশা করা যায় এবং আপনাদের দুজনের উপর সালাম, রহমত ও বরকত বৰ্ষিত হোক এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত রাসূলুল্লাহর উপর অবতীর্ণ হোক। খাদীজা (রা) জিজ্ঞেস করলেন : কাসাব নির্মিত ঐ ঘরটি কি? তিনি বললেন, আয়তাকার মুক্তা নির্মিত একটি বৃহৎ কক্ষ। ঐ ঘরের অবস্থান হবে মারিয়াম বিনত ইমরানের ঘর ও আসিয়া বিনত মুযাহিমের ঘরের মধ্যবর্তী স্থানে। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, কিয়ামতের দিন ঐ দুজন হবে আমার স্ত্রীদের অন্তর্ভুক্ত। খাদীজার প্রতি সালাম ও কষ্ট-কোলাহল মুক্ত মুক্তার ঘরের সুসংবাদের কথা সহীহ গ্রন্থে আছে; কিন্তু এই অতিরিক্ত কথাটুকুর বর্ণনা একান্তই বিরল। আর এ হাদীসসমূহের প্রতিটির সনদই সন্দেহযুক্ত।

ইব্‌ন আসাকির … কাআব আহবার থেকে বর্ণিত। হযরত মুআবিয়া (রা) একবার তাকে বায়তুল মুকাদাসের শুভ্ৰ পাথর খণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, উক্ত পাথর খণ্ডটি একটি খেজুর গাছের উপর স্থাপিত। গাছটি জান্নাতের একটি নদীর উপর অবস্থিত। ঐ গাছের নীচে বসে মারিয়াম বিনত ইমরান ও আসিয়া বিনত মুযাহিম জান্নাতবাসীদের জন্যে মালা গাথছেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাঁরা এভাবে মালা গাঁথতে থাকবেন। এরপর ইব্‌ন আসাকির …ভিন্ন সনদে উবাদা ইবনুস সামিত (রা) থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। কিন্তু উক্ত সনদে এ হাদীস অগ্রহণযোগ্য বরং জাল। আবু যুরআ.ইব্‌ন আবিদ থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা মুআবিয়া (রা) কাব আহবারকে বায়তুল- মুকাদাসের পাথর খণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন এবং উত্তরে তিনি অনুরূপ কথা বলেছিলেন। ইব্‌ন আসাকির (র) বলেন, উপরোল্লিখিত কথাটি কাব আহবারের কথা হতে পারে এবং তিনি এটা ইসরাঈলী উপাখ্যান থেকে নিয়েছেন। আর ইসরাঈলী উপাখ্যানের অনেক কথাই বানোয়াট ও কল্পিত—যা তাদের মধ্যে ধর্মদ্রোহী মূখ্য লোকদের রচিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *