০২. হিযকীল (আ)-এর বিবরণ

হিযকীল (আ)-এর বিবরণ

তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা মৃত্যু-ভয়ে হাজারে-হাজারে তাদের আবাস ভূমি ত্যাগ করেছিল? তারপর আল্লাহ্ তাদেরকে বলেছিলেন, তোমাদের মৃত্যু হোক। তারপর আল্লাহ তাদেরকে জীবিত করেছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল; কিন্তু অধিকাংশ লোক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। (২ বাকার : ২৪৩)

মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক। ওহাব ইব্‌ন মুনব্বিহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন : ইউশার মৃত্যুর পর কালিব ইব্‌ন ইউফান্না বনী-ইসরাঈলের নেতা হন এবং তার ইন্তিকালের পর হিযকীল ইব্‌ন ইউষী বনী ইসরাঈলের পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই হিযকীল ইবনুল আজুয। তথা বৃদ্ধার পুত্ররূপে পরিচিত, যার দোয়ায় আল্লাহ সে সব মৃত লোকদেরকে জীবিত করে দিয়েছিলেন, যাদের ঘটনা পূর্বোক্ত আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে।

ইব্‌ন ইসহাক বলেন, এসব লোক মহামারীর ভয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং এক প্রান্তরে উপনীত হয়। আল্লাহ বললেন, তোমাদের মৃত্যু হোক। ফলে তারা সকলেই তথায় মারা যায়। অবশ্য তাদের লাশগুলো হিংস্র জন্তুর কবল থেকে রক্ষা করার জন্য বেষ্টনীর ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়। একদা হযরত হিযকীল তাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি থমকে দাঁড়ান ও চিন্তা করতে থাকেন। এ সময় একটি গায়েবী আওয়াজের মাধ্যমে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আল্লাহ এ মৃত লোকগুলোকে তোমার সম্মুখে জীবিত করে দেন তা কি তুমি চাও? হিযকীল বললেন, জী হ্যাঁ। এরপর তাঁকে বলা হল, তুমি হাড়গুলোকে আদেশ কর, যাতে সেগুলো গোশত দ্বারা আবৃত হয় এবং শিরাগুলো যেন পরস্পর সংযুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী হিযকীল হাড়গুলোকে সে আহবান করার সাথে সাথে লাশগুলো সবই জীবিত হয়ে গেল এবং সমস্বরে তাকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করল।

আসবাত ঐতিহাসিক সুদী থেকে বিভিন্ন সূত্রে ইব্‌ন আব্বাস, ইব্‌ন মাসউদ প্রমুখ সাহাবী লিখেছেন : ওয়াসিত এর নিকটে অবস্থিত একটি জনপদের নাম ছিল দাওয়ার-দান (৩/১১৩।৩)

এ জনপদে একবার ভয়াবহ মহামারী দেখা দেয়। এতে সেখানকার অধিকাংশ লোক ভয়ে পালিয়ে যায় এবং পার্শ্ববতী এক এলাকায় অবস্থান করে। জনপদে যারা থেকে গিয়েছিল তাদের কিছু সংখ্যক মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়; কিন্তু বেশির ভাগ লোকই বেঁচে যায়। মহামারী চলে যাওয়ার পর পালিয়ে যাওয়া লোকজন জনপদে ফিরে আসে। জনপদে থেকে যাওয়া লোকদের মধ্যে যারা বেঁচেছিল তারা পরস্পর বলাবলি করল যে, আমাদের যেসব ভায়েরা এলাকা ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল তারাই বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের মত যদি আমরাও চলে যেতাম তবে সবাই বেঁচে থাকতাম। পুনরায় যদি এ রকম মহামারী আসে। তবে আমরাও তাদের সাথে চলে যাব। পরবর্তী বছর আবার মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। এবার জনপদ শূন্য করে সবাই বেরিয়ে গেল এবং পূর্বের স্থানে গিয়ে অবস্থান নিল। সংখ্যায় এরা ছিল তেত্ৰিশ হাজার বা তার চাইতে কিছু বেশি। যে স্থানে তারা সমবেত হয়, সে স্থানটি ছিল একটি প্রশস্ত উপত্যকা। তখন একজন ফিরিশতা উপত্যকাটির নীচের দিক থেকে এবং আর একজন ফিরিশতা উপত্যকাটির উপর দিক থেকে আওয়াজ দিয়ে বললেন, তোমাদের মৃত্যু হোক। আগে যে সমস্ত লোক মারা গেল, তাদের মৃত দেহগুলো সেখানে পড়ে থাকল। একদা নবী হিযকীল ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ দৃশ্য দেখে তিনি বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে গেলেন, গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন এবং আপন মুখের চোয়াল ও হাতের আঙ্গুল মুচড়াতে থাকলেন। এ অবস্থায় আল্লাহ তাঁর নিকট ওহী পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হিযকীল! তুমি কি দেখতে চাও, আমি কিভাবে এদেরকে পুনরায় জীবিত করি? হিযকীল বললেন জী হাঁ, আমি তা দেখতে চাই। বস্তৃত তিনি এখানে দাঁড়িয়ে এই বিষয়েই চিন্তামগ্ন ছিলেন এবং আল্লাহর শক্তি প্রত্যক্ষ করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁকে বলা হল, তুমি আহবান কর। তিনি আহবান করলেন, হে অস্থিসমূহ! আল্লাহ তোমাদেরকে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। দেখা গেল, যার যার অস্থি উড়ে উড়ে পরস্পর সংযুক্ত হয়ে কংকালে পরিণত হয়েছে। তাকে পুনরায় বলা হল, আহবান কর। তিনি আহবান করলেন, হে অস্থিসমূহ! আল্লাহ তোমাদের কংকালগুলো গােশত ইত্যাদি দ্বারা আবৃত করার নির্দেশ দিয়েছেন। দেখা গেল, কংকালগুলো মাংস দ্বারা আবৃত হয়ে তাতে শিরা-উপশিরা চালু হয়ে গিয়েছে এবং যে কাপড় পরিহিত অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছিল, সে কাপড়গুলোই তাদের দেহে শোভা পাচ্ছে। এরপর হিযকীলকে বলা হল, আহবান কর। তিনি আহবান করলেন, হে দেহসমূহ! আল্লাহর হুকুমে দাঁড়িয়ে যাও! সাথে সাথে সবাই দাঁড়িয়ে গেল। আসবাত বলেন, মনসুর মুজাহিদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, লোকগুলো জীবিত হয়ে এ দোয়াটি পাঠ করে :

হে আল্লাহ! আপনি অতি পবিত্ৰ-মহান, যাবতীয় প্রশংসা আপনার, আপনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। এরপর তারা জনপদে আপন সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে যায়। জনপদের অধিবাসীরা দেখেই তাদেরকে চিনতে পারল যে, এরাই ঐসব লোক, যারা আকস্মিকভাবে মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছিল। তবে যে কাপড়ই তারা পরিধান করতেন, তাই পুরনো হয়ে যেতো। এরপর এ অবস্থায়ই নির্ধারিত সময়ে তাদের সকলের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। এদের সংখ্যা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, এদের সংখ্যাটি চার হাজার; অপর বর্ণনা মতে আট হাজার; আবু সালিহ্ এর মতে নয়। হাজার; ইব্‌ন আব্বাস (রা)-এর আপার এক বর্ণনা মতে চল্লিশ হাজার। সাঈদ ইব্‌ন আবদুল আষীয তাদের সম্বন্ধে বলেছেন,

তারা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী একটি জাতি। ইব্‌ন জুরায়জা আতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, শত সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও যে কেউ তাকদীর লিখন খণ্ডাতে পারে না, এটা তারই এক রূপক দৃষ্টান্ত। কিন্তু অধিকাংশ আলিমের মতে এটা ছিল একটি বাস্তব ঘটনা!

ইমাম আহমদ এবং বুখারী ও মুসলিম (র) … ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, একবার হযরত উমর ইব্‌ন খাত্তাব (রা) সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সারাগ (ঃ ….) নামক স্থানে পৌছলে আবু উবায়দা ইব্‌ন জাররাহ (রা) ও তাঁর সঙ্গী সেনাধ্যক্ষগণ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে জানান যে, সিরিয়ায় বর্তমানে মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এ সংবাদ শুনে সম্মুখে অগ্রসর হবেন কিনা- সে বিষয়ে পরামর্শের জন্যে তিনি মুহাজির ও আনসারদের সাথে বৈঠকে বসেন। আলোচনায় তাদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। এমন সময় আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফ (রা) এসে তথায় উপস্থিত হন। তার কোন এক প্রয়োজনে তিনি প্রথমে পরামর্শ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি বললেন, এ ব্যাপারে আমার একটা হাদীস জানা আছে। আমি রাসূলুল্লাহ (স)-কে বলতে শুনেছি : যদি কোন এলাকায় মহামারী দেখা দেয়, আর পূর্ব থেকেই তোমরা সেখানে অবস্থানরত থাক, তাহলে মহামারীর ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সে এলাকা ত্যাগ করো না। আর যদি কোন অঞ্চলে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার সংবাদ পাও এবং তোমরা সে অঞ্চলের বাইরে থােক, তবে সে দিকে অগ্রসর হয়ে না।

হাদীসটি শোনার পর হযরত উমর (রা) আল্লাহর শোেকর আদায় করেন এবং মদীনায় ফিরে আসেন। ইমাম আহমদ… আবদুল্লাহ ইব্‌ন আমির ইব্‌ন রাবীআ থেকে বর্ণনা করেন যে, আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফ (রা) সিরিয়ায় হযরত উমর (রা)-কে রাসূল (সা)-এর হাদীস শুনিয়ে বলেছিলেন : এই মহামারী দ্বারা পূৰ্ববতী যুগের উম্মতদেরকে শাস্তি দেয়া হত; সুতরাং কোন এলাকায় মহামারী বিস্তারের সংবাদ শুনতে পেলে সেখানে তোমরা প্রবেশ করবে না; কিন্তু কোন স্থানে তোমাদের অবস্থানকালে যদি মহামারী দেখা দেয় তাহলে ভয়ে সে স্থান ত্যাগ করবে: না। এ কথা শোনার পর হযরত উমর (রা) সিরিয়া থেকে ফিরে আসেন।

মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক বলেন, হিযকীল (আ) বনী-ইসরাঈলের মধ্যে কত কাল অবস্থান করেছিলেন, সে সম্বন্ধে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। যা হোক, কোন এক সময়ে আল্লাহ তাকে

কথা বে-মালুম ভুলে যায়। ফলে তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিদা আতের প্রসার ঘটে। তারা মূর্তি পূজা আরম্ভ করে। তাদের এক উপাস্য দেব-মূর্তির নাম ছিল বাআল (Ul-)। অবশেষে আল্লাহ তাদের প্রতি একজন নবী প্রেরণ করেন। তার নাম ছিল ইলিয়াস ইব্‌ন ইয়াসীন ইব্‌ন ফিনহাস ইব্‌ন ঈযার ইব্‌ন হারূন ইব্‌ন ইমরান। ইতিপূর্বে আমরা হযরত খিযির (আ)-এর আলোচনা প্রসঙ্গে হযরত ইলিয়াস (আ)-এর আলোচনা করে এসেছি। কেননা, বিভিন্ন স্থানে সাধারণত তাদের উল্লেখ প্রায় এক সাথে করা হয়ে থাকে। তাছাড়া সূরা সাফফাতে হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনা উল্লেখ করার পর ইলিয়াস (আ)-এর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে তাঁর সম্পর্কে আমরা পূর্বেই আলোচনা করে এসেছি। মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক। ওহাব ইব্‌ন মুনাব্বিহ (র) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত ইলিয়াসের পর তাঁরই উত্তরাধিকারী হযরত আল-য়াসা (c_-_JI) ইব্‌ন আখতুবা বনী ইসরাঈলের প্রতি নবীরূপে প্রেরিত হন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *