১. ওয়ালীদ ইব্‌ন ইয়াযীদ ইব্‌ন আবদুল মালিকের খিলাফতকাল

ঐতিহাসিক ওয়াকিদী বলেন যে, ওয়ালীদের চাচা হিশাম ইবন আবদুল মালিকের যেদিন মৃত্যু হয়েছে সেদিনই ওয়ালীদের খলীফারূপে বায়আত অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার খিলাফতের পক্ষে গণ-আস্থা ও স্বীকৃতি গ্রহণ করা হয়েছে। ওই দিনটি ছিল ১২৫ হিজরী সনের রবিউসসানী মাসের সাত তারিখ বুধবার।

হিশাম ইবন কালবী বলেন, রবিউসসানী মাসের এক শনিবারে তার পক্ষে বায়আত অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন ওয়ালীদের বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। তার খিলাফত লাভের পটভূমিকা হলো, তার পিতা শায়খ ইয়ায়ীদ ইবন আবদুল মালিক এটি নির্ধারিত করে দিয়েছিলেন যে, তার মৃত্যুর পর তার ভাই হিসাম ইবন আবদুল মালিক খলীফা হবে আর হিশামের পর খলীফ হবে আলোচ্য ওয়ালীদ ইবন আবদুল মালিক।

হিশাম খলীফা হবার পর সে তার ভাতিজা ওয়ালীদকে ভাল নজরে দেখছিলেন। কিন্তু ওয়ালীদ নষ্ট হতে হতে এমন পর্যায়ে নেমে গেল যে, প্রকাশ্যে মদ্য পান, মন্দ লোকদের সাহচর্য এবং আমোদ-প্রমোদে ডুবে গেল। পরিণতিতে হিশাম চাইলেন ওয়ালীদকে খিলাফতের সংস্পৰ্শ থেকে সরিয়ে দিতে । তিনি ১১৬ হিজরী সনে ওয়ালীদকে আমীর-ই-হজ করে মক্কা শরীফ প্রেরণ করলেন। কিন্তু হজ্জের সফরে সে লুকিয়ে তার শিকারী কুকুরগুলো সাথে নিয়ে যায়। কথিত আছে যে, সিন্দুকের ভেতরে কুকুরগুলোকে ঢুকিয়ে সে যাত্রা করে। হঠাৎ একটি সিন্দুক সওয়ারীর পিঠ থেকে পড়ে যায়। ওই সিন্দুকে কুকুর ছিল। পড়ে গিয়ে কুকুরটি চীৎকার জুড়ে দেয়। তাতে উটগুলো ভয় পেয়ে অস্থির হয়ে উঠে। এজন্যে সে উটগুলোকে প্রহার করেন।

ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, ওই যাত্রায় ওয়ালীদ কা’বা শরীফের সমান মাপে একটি গম্বুজ বানিয়ে নেয়। তার ইচ্ছা ছিল কা’বা গৃহের ছাদে সেটি স্থাপন করে বন্ধু-বান্ধবসহ সে সেটির ভিতরে বসবে। আর সাথে নিয়ে যাওয়া মদ-সুরা পান করবে, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি বাজাবে। কিন্তু মক্কা শরীফ পৌঁছার পর তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সে ভয় পেয়ে যায়। কা’বা গৃহের ছাদে উঠলে জনগণ তাকে বাঁধা দিবে, প্রতিবাদ করবে। এই আশংকায় সে আর ওই পথে অগ্রসর হয়নি।

তার মদ্যপান ও নানা পাপচারিতার কথা অবগত হয়ে তার চাচা হিশাম ইবন আবদুল মালিক তাকে বহুবার বারণ করেন, বাধা দেন। কিন্তু সে বাধা মানেনি, বিরত থাকেনি। বরং অবলীলায় সে তার পাপকাৰ্য চালিয়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত চাচা হিশাম, তাকে খিলাফতের দাবী থেকে বহিষ্কার করে আপনি ছেলে মাসলামা ইবন হিশামকে খিলাফতের উত্তরাধিকার বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ করার পর তার মাতুল গোত্র পবিত্র মদীনাবাসী এবং অন্যান্য লোকজনসহ বহু সেনাপতি তার সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানায়। আহ যদি ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হত ! কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সব দিক কুলিয়ে উঠতে পারেননি। হিশাম, একদিন ওয়ালীদকে বললেন, ধুতুরী! তুই কি মুসলমান আছিস না মুসলমান নেই, আমি বুঝতে পারছি না। কারণ, যত প্রকারের মন্দ ও নোংরা কাজ তার সবগুলো তো তুই বিনা দ্বিধায়-নিঃসংকোচে ও নিৰ্ভয়ে প্রকাশ্যে করে যাচ্ছিস ।

উত্তরে ওয়ালীদ লিখেছিল হিশামের নিকট :

يا أيها السائل عن دیننا + دینی علی دین آبی شاکر

“হে ঐ ব্যক্তি যে, আমার দীন সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেছ। তুমি জেনে নাও যে, আমি আবু শাকিরের দীনে অধিষ্ঠিত আছি।”

که به س ع س る〜 ・ “、・・・ so که ه به ه ما . که ع g) سمه نشربها صرفا و ممزوجة — بالسخن احيانا وبالفاتر

“আমরা খাটি মন্দ পান করেই থাকি। কখনো ওই মদে গরম পানি মিশিয়ে খাই আর কখনো ঠাণ্ডা পানিতে মিশ্রিত করে পান করি।”

এই কবিতা পাঠ করে হিশাম, তার ছেলে মাসলমার প্রতি ক্রোধান্বিত হয়ে উঠেন। মাসলামার উপনাম ছিল আবু শাকির। হিশাম, তাকে বললেন, তুই তো ওয়ালীদের মত হয়ে যাচ্ছিস অথচ আমি চেয়েছিলাম তোকে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে। ১১৯ হিজরী সনে তিনি মাসলামাকে আমীর-ই-হজ বানিয়ে মক্কা শরীফ পাঠিয়ে দেন। তিনি সেখানে অত্যন্ত গাম্ভীর্য ও বিচক্ষণতার সাথে ওই দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফে অনেক মালপত্র দান করেন। এই প্রেক্ষিতে পবিত্র মদীনার এক ক্রীতদাস নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করেছিল :

يا أيها السائل عن ديننا + نحن على دين أبى شاكر

“ওহে প্ৰশ্নকর্তা ! যে আমাদের ধর্ম সম্পর্কে জানতে চাও, তুমি জেনে নাও যে, আমার আবৃ শাকিরের ধর্মে অধিষ্ঠিত আছি।”

ألواهب الجرد بأرسانها + أليس بزنديق ولاً كافر

“তিনি তার সকল মালপত্ৰ দান করে দেন এমনকি রশিসহ থলি দান করে দেন । তিনি ধর্মত্যাগীও নন, কাফিরও নন।”

ওয়ালীদ বেপরোয়াভাবে মন্দ কর্মে ডুবে থাকার কারণে তার মাঝেও হিশামের মাঝে ভীষণভাবে দ্বন্দু সৃষ্টি হয়। তার অপকর্মগুলো ঘৃণ্য চােখে দেখতে থাকেন খলীফা হিশাম। এ কারণে তিনি ওয়ালীদকে খিলাফতের উত্তরাধিকারিত্ব থেকে অপসারণ করে নিজের ছেলে মাসলামাকে পরবর্তী খলীফা ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই পর্যায়ে ওয়ালীদ রাজ দরবার ত্যাগ । করে গ্রাম্য জনপদে পালিয়ে যায়। ইতিমধ্যে উভয়ের মাঝে চরমপত্র আদান-প্ৰদান হয়। হিশামর শাসাতে থাকেন ওয়ালীদকে। তাকে ধমক দিতে থাকেন। এই পরিস্থিতিতে একদিন হিশাম মারা যান। ওয়ালীদ তখন গ্রাম্য এলাকায় অবস্থান করছিল, সেদিন ভোরে ওয়ালীদের নিকট খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের সংবাদ এল তার পূর্ব রাতে ওয়ালীদ ভীষণ অস্থিরতা ও অশান্তি অনুভব করে। সে তার জনৈক সঙ্গীকে বলে যে, এই রাতে আমি ভীষণ অস্বস্তিবােধ করেছি। চল আমরা একটু হাঁটাহাঁটি করি তাতে যদি একটু শান্তি পাই।

তারা দু’জনে হাঁটতে শুরু করে এবং হিশামের দেওয়া চরমপত্র হুমকি-ধামকি ইত্যাদি বিষয়ে তারা আলাপ করছিল। প্রায় দুই মাইল পথ অতিক্রম করার পর তারা প্ৰচণ্ড হৈ-চৈ শুনতে পেল এবং সম্মুখে ধুলি উড়তে দেখল। অল্পক্ষিণ পরে তাদের নিকট পরিষ্কার হল যে, ওরা সংবাদ বাহক। খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের সংবাদ নিয়ে তারা তারই নিকট আসছে।

ওয়ালীদ তার সাথীকে বলল, ধুত্তুরী ! এরাতাে হিশামের পাঠানাে লোকজন। হে আল্লাহ! আপনি আমার কল্যাণ করুন। সংবাদ বাহক কাফেলা যখন ওয়ালীদের কাছাকাছি এসে পৌছল। এবং ওরা চিনতে পারল যে, এই ব্যক্তিই ওয়ালীদ, তখন তারা বাহন থেকে নেমে পায়ে হেঁটে তার সম্মুখে আসে এবং খলীফা জ্ঞানে তাকে সালাম জানায়। এমন সালাম শুনে সে তো হতভম্ব হয়ে পড়ে। সে বলল, ধুতুরী ! খলীফা হিশাম কি মারা গিয়েছেন ? ওরা বলল, হ্যা, তিনি মারা গিয়েছেন ।

সে বলল, তোমাদেরকে কে পাঠিয়েছে? তারা বলল, ডাকমন্ত্রী সালিম ইবন আবদুর রহমান পাঠিয়েছেন। তারা মন্ত্রীর চিঠি তাকে হস্তান্তর করে। সে চিঠি পড়েছে এবং জনসাধারণের অবস্থা জানতে চায়। তার চাচা হিশাম, কেমন করে মারা গেলেন এই সব খবরা-খবর সে ওদের থেকে সংগ্রহ করে। ওরা তাকে সবকিছু জানায়। সে তখনই জরুরী নির্দেশ পাঠায় যেন পূর্ণ সতর্কতার সাথে হিশামের ধন-সম্পদ ও রুসাফা অঞ্চলে তার বিত্ত-বৈভব সংরক্ষণ করা হয়। এ প্রসংগে সে বলেছিল :

لیت هشاما عاش حتی یری + مگیالهٔ الا و فرقد طبیعا “আহ ! হিশাম যদি জীবিত থাকত আর এটা দেখত যে, তার পরিপূর্ণ মালামাল এখন সীল মোহর করে দেওয়া হয়েছে।”

كلناة بالصناع الذى كالة + وما ظلمناة به اصبعا “আমরা এইগুলো মেপেছি। সেই ছা” দিয়ে যে পরিমাপ পাত্র দিয়ে, যেটি দিয়ে সে নিজে মেপে নিত। আমরা এক অঙ্গুলী পরিমাণও তার প্রতি যুলুম করিনি।”

و ما آتینا ذال عن بداعة + آحلهٔ الفرقان لی آجمعا “কোন মনগড়া ও খাম-খেয়ালী পূর্ণ পথে আমরা এটা করিনি। বরং কুরআন মজীদ এটি আমাদের জন্যে হালাল ও বৈধ করে দিয়েছে।”

যুহরী (র) খলীফা হিশামকে উৎসাহিত করতেন ওয়ালীদকে খিলাফতের অধিকার থেকে সরিয়ে দেবার জন্যে, কিন্তু জন-সাধারণের আপত্তির আশংকায় এবং সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিবাদের ভয়ে খলীফা হিশাম, তা থেকে বিরত থাকতেন। যুহরীর এই ষড়যন্ত্র ওয়ালীদের জানা ছিল। এজন্যে সে যুহরীকে ঘূণা করত এবং তাকে হুমকি-ধমকি দিত। উত্তরে যুহরী বলত যে, হে পাপিষ্ঠ ! আমাকে ধমক দিয়ে লাভ নেই মহান আল্লাহ্ কখনাে তােমাকে আমার উপর কতৃত্ব ও ক্ষমতা চালাতে দিবেন না। ওয়ালীদ খলীফা পদে অধিষ্ঠিত হবার পূর্বে ইমাম যুহরী (র) ইনতিকাল করেন ।

বস্তৃত। চাচা হিশামের নাগালের বাহিরে গিয়ে ওয়ালীদ গ্ৰাম্য জনপদে বসবাস করছিল। চাচা খলীফা হিশামের মৃত্যু পর্যন্ত সে গ্রামেই ছিল। হিশামের মৃত্যুর পর তার ধনসম্পদ সংরক্ষণের নির্দেশ দিল ওয়ালীদ। তারপর দ্রুত গতিতে সে গ্রাম ছেড়ে দামেস্কের উদ্দেশ্যে যাত্ৰা করে। রাজধানীতে এসে ওয়ালীদ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মচারীদেরকে নিয়োগ দেয়। দেশের সকল অঞ্চল থেকে তার প্রতি আনুগত্য আসতে থাকে। অভিনন্দন জানানোর জন্য বিভিন্ন প্রতিনিধিদল আসতে থাকে ওয়ালীদের দরবারে ।

এদিকে মারওয়ান ইবন মুহাম্মদ ছিল তৎকালীন আর্মেনিয়া রাজ্যের গভর্নর, সে ওয়ালীদকে লিখেছিল আল্লাহর বান্দাদের উপর মহান আল্লাহর খিলাফতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়ালীদের প্রতি মহান আল্লাহ বরকত নাযিল করুন। আপন রাজ্যে মহান আল্লাহ তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করে দিন । হিশামের মৃত্যু এবং ওয়ালীদের খিলাফত লাভে মারওয়ান ওয়ালীদকে অভিনন্দন জানায় এবং তার মালামাল রক্ষায় তার অবদানের কথা উল্লেখ করেন। মারওয়ান আরো জানায় যে, তার অধীনস্থ রাজ্যে সে নতুনভাবে ওয়ালীদের জন্যে বায়আত গ্রহণ করেছে এবং তাতে ওই রাজ্যের জনসাধারণ আনন্দিত ও সন্তুষ্ট হয়েছে। বিদ্রোহ কিংবা বিশৃংখলার আশংকা না থাকলে কাউকে স্থলাভিষিক্ত করে মারওয়ান সশরীরে রাজধানীতে এসে খলীফার সাথে দেখা করত বলে এবং সে খলীফাকে জানায় ।

খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ওয়ালীদ প্রজা-সাধারণের প্রতি সদাচরণ ও ভাল ব্যবহার করতে শুরু করে। সে খোড়া, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠ রোগী এবং সকল অন্ধ লোকের জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে একজন করে খাদিম ও তত্ত্বাবধায়ক বরাদ্দ করেছিল এবং মুসলমানদের পোষ্যদের জন্যে বায়তুল মাল হতে প্রচুর হাদিয়া-তুহফা ও উপহার সরবরাহ করল। জনসাধারণের রাষ্ট্রীয় ভাতা বৃদ্ধি করেছিল। বিশেষত সিরিয়াবাসী ও রাষ্ট্ৰীয় মেহমানদেরকে সে প্রচুর উপহার-উপঢৌকন প্ৰদান করেছিল। খলীফা ওয়ালীদ একজন দানশীল, সম্মানিত ও প্রশংসাযোগ্য শাসক ছিল। সে নিজে কবি ছিল। তার নিকট কিছু চাওয়া হলে সে কোন দিন তা দিতে “না” করেনি। নিজের প্রশংসা করে সে নিম্নের কবিতা বলেছিল :

“আমি তোমাদেরকে গ্যারান্টি দিচ্ছি, আমি তোমাদের যিম্মাদারী নিচ্ছি যে, কেউ যদি আমার বিরোধিতা না করে তাহলে দুঃখ-বেদনার আকাশ তোমাদের উপর থেকে সরে যাবে।”

سيوشك الحاق معاً وزيادة + وأعطيةً مئى اليكم تبرع

“অবিলম্বে আমি তােমাদের ভাতা ও অনুদান বৃদ্ধি করে দিব। সেটি ক্রমান্বয়ে বেশী হতে বেশীতে উন্নীত হবে। এগুলো মানবতা ও লৌকিকতা হিসেবে আমি তোমাদেরকে দিব ।”

محرمكم ديوانكم وعطاؤكم + به يكتب الكتاب شهرا وتطبع

“তোমাদের পাওনা নষ্ট করা আমার জন্যে নিষিদ্ধ। তোমাদের পাওনা বিষয়ে মাসে মাসে দফতর প্রস্তুত করা হবে এবং ওগুলো ছাপিয়ে দেওয়া হবে।”

এই হিজরী সনে খিলাফতে তার উত্তরাধিকারীর নাম ঘোষণা করে। তার মৃত্যুর পর প্রথমে তার ছেলে হাকাম এবং তারপর উছমান খলীফা নিযুক্ত হবে বলে সে সিদ্ধান্ত নেয়। এ বিষয়ে বায়আতি বা অঙ্গীকার দানের জন্যে সে ইরাক ও খুরাসানের গভর্নর ইউসুফ ইবন উমরের নিকট বার্তা পাঠায়। সে এই বার্তা প্রেরণ করে খুরাসানের উপ-প্ৰশাসক নাসর ইবন সাইয়ারের নিকট । তারপর এই প্রস্তাবের সমর্থনে নাসর ইবন সাইয়ার একটি আবেদনধর্ম ও আবেগপূর্ণ দীর্ঘ বক্তৃতা প্রদান করে। ইবন জারীর এই বক্তব্য পরিপূর্ণভাবে উদ্ধৃত করেছেন। নাসর ইবন সাইয়ার পূর্বে-পশ্চিমে সর্বত্র ওয়ালীদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি মজবুত করে দেয় এবং সর্বত্র তার দুই ছেলের পরবতী খলীফা হবার পক্ষে বায়আত গ্রহণ করে। পুরস্কারস্বরূপ খলীফা ওয়ালীদ নাসর ইবন সাইয়ারকে খুরাসানের স্থায়ী গভর্নর ঘোষণা করে চিঠি প্রেরণ করে।

এরপর ইউসুফ ইবন উমর খলীফা ওয়ালীদের সাথে সাক্ষাত করে। সে খুরাসানের শাসনভার তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানায়। ওয়ালীদ তাই করে। খলীফা হিশামের শাসনামলে যেমনটি ছিল ওয়ালীদ তাই পুনর্বহাল করল। নাসর ইবুন সাইয়ার পূর্বের ন্যায় ইউসুফের অধীনে উপ-প্ৰশাসকের দায়িত্ব পালন করবে। এ পর্যায়ে শাসনকর্তা ইউসুফ ইবন উমর নাসর ইবন সাইয়ারকে এই মর্মে চিঠি লিখল যে, অতি সত্বর প্রচুর হাদিয়া-তুহফা এবং উপহার নিয়ে সে যেন পরিবার-পরিজনসহ খলীফার দরবারে উপস্থিত হয়। নাসর ইবন সাইয়্যার ১০০০ ক্রীতদাস ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে ১০০০ তরুণী, প্রচুর স্বর্ণ ও রূপার পাত্রসহ হাদিয়া-তুহফার বিশাল বহর নিয়ে রাজদরবারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে ৷ খলীফা ওয়ালীদ তাকে খুব তাড়াতাড়ি উপস্থিত হবার এবং সাথে তানপুরা, দোতারা-সেতারা, তবলা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সাথে নিয়ে আসতে নির্দেশ দিল । ওয়ালীদের এই পদক্ষেপ মানুষের নিকট পসন্দ হয়নি। তারা ওয়ালীদকে ঘূণা ও অপসন্দ করতে লাগল ।

জ্যোতিষিগণ নাসর ইবন সাইয়ারকে বলল যে, অবিলম্বে সিরিয়া অঞ্চলে ফিতনা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। ফলে নাসর ইবন সাইয়ার রাজদরবারে যাচ্ছিল বিলম্ব করে। পথিমধ্যে তার নিকট খলীফা ওয়ালীদের মৃত্যু সংবাদ পৌছে। বাহক তাকে জানায় যে, খলীফা ওয়ালীদ নিহত হয়েছে এবং সিরিয়াতে প্রচণ্ড সংঘর্ষ ও বিশৃংখলা চলছে। নাসর তার সাথী-সঙ্গী ও আসবাবপত্র নিয়ে পার্শ্ববতী এক শহরে ঢুকে যায় এবং সেখানে অবস্থান করতে থাকে। তার নিকট সংবাদ পেঁৗছে যে, ইউসুফ ইবন উমর ইরাক ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে এবং সেখানেও বিশৃংখলা চলছে। এই সংঘর্ষ ও বিশৃংখলা শুরু হল খলীফার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। এই বিষয়টি আমরা আলোচনা করব। মহান আল্লাহই সাহায্যকারী।

এই হিজরী সনে খলীফা ওয়ালীদ ইউসুফ ইবন মুহাম্মদ ইবন ইউসুফ ছাকাফীকে পবিত্র মক্কা, মদীনা ও তায়িফের প্রশাসক নিযুক্ত করে এবং তাকে নির্দেশ দেয় যেন ইবরাহীম ইবন হিশাম এবং মুহাম্মদ ইবন হিশাম, ইবন ইসমাঈল মাখিযুমীকে পবিত্র মদীনায় হেয়াপ্রতিপন্ন ও লাঞ্ছিত করে রাখে। কারণ, তারা দুইজন হল পূর্ববতী খলীফা হিশামের মামা। এরপর যেন তাদেরকে ইরাকের প্রশাসক ইউসুফ ইবন উমরের নিকট প্রেরণ করে। যেন তাদের দুইজনকে ইউসুফের নিকট পাঠায়। যে পদের দুইজনের উপর চরম নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে তারা দুইজন মারা যায়। সে তাদের থেকে প্রচুর ধন-সম্পদও আদায় করে।

এই হিজরী সনে খলীফা ওয়ালীদ ইউসুফ ইবন মুহাম্মদ ইবন ইয়াহইয়াকে পবিত্র মদীনার কাষী নিয়ােগ করে। এই হিজরী সনে ওয়ালীদ ইবন ইয়াখীদ তার আপন ভাইয়ের নেতৃত্বে একদল সৈনিক পাঠায় কাবরাস-অধিবাসীদের বিরুদ্ধে এবং তাকে এই নির্দেশ দেয় যে, সে যেন ওদেরকে সিরিয়া কিংবা রোমান অঞ্চলে যাবার ইখতিয়ার দেয়। ফলে ওদের কেউ সিরিয়া গিয়ে মুসলমানদের প্রতিবেশ্বিত্ব গ্রহণ করে আর কেউ কেউ রোমান অঞ্চলে চলে যায়।

ইবন জারীর বলেন, এই হিজরী সনে সুলায়মান ইবন কাহীর, মালিক ইবন হায়ছাম, লাহিয ইবন কুরায়য, কাহতাবা ইবন শাবীব প্রমুখ আগমন করে এবং তারা মুহাম্মদ ইবন আলীর সাথে সাক্ষাত করে। তারা আবু মুসলিমের তৎপরতা সম্পর্কে তাকে অবহিত করে। তিনি বললেন, সে কি স্বাধীন মানুষ নাকি ক্রীতদাস ? তারা বলল যে, সে নিজেকে স্বাধীন বলে দাবী করে, কিন্তু তার মালিক তাকে ক্রীতদাসরূপে গণ্য করে। এরপর তারা আবু মুসলিমকে ক্রয় করতঃ তাকে মুক্ত ও স্বাধীন করে দেয়। তারা মুহাম্মদ আলীকে ২ লক্ষ দিরহাম এবং ৩০ হাজার দিরহামের জামা-কাপড় প্রদান করে। মুহাম্মদ ইবন আলী তাদেরকে বললেন যে, সম্ভবত এই বছরের পর তোমরা আমার সাক্ষাত পাবে না। আমি যদি মারা যাই। তবে তোমরা স্মরণ রেখো যে, তোমাদের সাথী ইবরাহীম ইবন মুহাম্মদ সে আমারই ছেলে। তার প্রতি সদাচরণ করার জন্যে আমি তোমাদেরকে ওসীয়ত করলাম। বস্তৃত এই বৎসর যুল-কাদাহ মাসের শুরুতে মুহাম্মদ ইবন আলী ইনতিকাল করেন। তাঁর পিতার মৃত্যুর সাত বছর পর তিনি মারা গেলেন। এই হিজরী সনে ইয়াহইয়া ইবন যায়দ ইবন আলী খুরাসান অঞ্চলে নিহত হয়। এই হিজরী সনে আমীর-ই-হজ্জ হিসেবে পবিত্র মক্কা, মদীনা ও তায়েফের প্রশাসক ইউসুফ ইবন মুহাম্মদ ছাকার্যক্ষী লোকজন নিয়ে হজ্জ সম্পন্ন করেন। এই সময়ে গভর্নর হিসেবে ইরাকে ছিলেন ইউসুফ ইবন উমর, খুরাসানে ছিলেন নাসর ইবন সাইয়ার।

এক পর্যায়ে নাসর ইবন সাইয়ার প্রচুর হাদিয়া-তুহফা ও উপহার সামগ্ৰী নিয়ে লোকজনের বিশাল দল সহকারে খলীফা ওয়ালীদ ইবন ইয়ায়ীদের নিকট যাত্রা করেন। কিন্তু তারা ওয়ালীদের সাথে সাক্ষাত করার পূর্বে সে নিহত হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *