০২. বিবাহ – দ্বিতীয় অধ্যায়

বিবাহ দ্বিতীয় অধ্যায়

প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে আট প্রকার বিবাহের কথা লিখিত আছে, যথা ব্রাহ্ম, দৈব, প্রাজাপত্য, আর্য, আসুর, রাক্ষস, গান্ধৰ্ব্ব ও পৈশাচ। তন্মধ্যে এখন কেবলমাত্র ব্রাহ্ম ও আসুর বিবাহ প্রচলিত আছে, অপর গুলি সামাজিক আদর্শের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে লোপ পাইয়াছে।

বিদ্বান ও ধার্ম্মিক বরকে গৃহে আনিয়া তাহাকে সালঙ্কারা কন্যা দান করাকে ব্রাহ্ম বিবাহ বলে, এবং বর কর্তৃক মূল্য দিয়া কন্যাকে বিবাহ করাকে আসুর বিবাহ বলে। বঙ্গদেশে সাধারণতঃ ভদ্রসমাজে যে বিবাহ হয় তাহা প্রথমোক্ত প্রকারের; নিম্ন জাতির মধ্যে আসুর বিবাহ খুব বেশী প্রচলিত।

কোনও বিবাহ ব্রান্ধ কিংবা আম্বর মতে সম্পন্ন হইয়াছে তাহা কেবলমাত্র স্ত্রীধনের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে বিবেচনা করিবার প্রয়োজন হয়, অন্যত্র প্রয়োজন হয় না, ব্রাহ্ম বিবাহ হইলে স্ত্রীধন একপ্রকার উত্তরাধিকারীতে অর্শায়, আসুর বিবাহ হইলে অন্য প্রকার উত্তরাধিকারীতে যায়। ব্রাহ্ম বিবাহই শাস্ত্রসম্মত, এবং আসুর বিবাহ শাস্ত্রনিন্দিত; সেজন্য কোন বিবাহ হইলে আদালত প্রথমেই অনুমান করিয়া লন যে, ঐ বিবাহ ব্ৰাহ্ম বিধিতেই সম্পন্ন হইয়াছে; তবে অপর পক্ষ অবস্ত ঐ অনুমান খণ্ডন করিয়া প্রমাণ দ্বারা দেখাইতে পারেন যে বিবাহ আসুরমতে সম্পন্ধু হইয়াছে (জগন্নাথ,ব; রঞ্জিং, ২৫ কলিকাতা ৩৫৪)।

অন্যান্য আইনে বিবাহ একপ্রকার চুক্তি বলিয়া গণ্য; কিন্তু হিন্দু আইনে তাহা নহে; উহা একটী ধর্ম্মকাৰ্য্য বা সংস্কার। স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ ধৰ্ম্মসম্বন্ধ বলিয়া গণ্য, চুক্তি দ্বারা আবদ্ধ সম্বন্ধ নহে; এবং সেজন্য হিন্দু ধৰ্ম্মশাস্ত্র অনুসারে বিবাহবন্ধন কিছুতেই ছিন্ন হয় না।

কে বিবাহ করিতে পারেন

হিন্দু আইন অনুসারে কোনও ব্যক্তির বয়স ১৫ বৎসর পূর্ণ হইলেই সে সাবালক হয় এবং বিবাহ করিতে পারে। কিন্তু তাহা বলিয়া নাবালকের বিবাহ অসিদ্ধ নহে। তবে নাবালকের বিবাহে তাহার পিতা বা অন্য অভিভাবকের সম্মতি আবশ্যক, কিন্তু সম্মতি না থাকিলে যে বিবাহ অসিদ্ধ হইয়া যাইবে তাহা নহে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যগণের সম্বন্ধে আরও এই নিয়ম আছে যে তাহাদের উপনয়ন সম্পন্ন না হইলে বিবাহ হইতে পরিবে না।

যদি কেহ এরূপ উন্মাদগ্ৰস্ত বা বুদ্ধিহীন হয় যে, সে কি করিতেছে তাহা বুঝিবার ক্ষমতা তাহার নাই, তাহা হইলে তাহার বিবাহ অসিদ্ধ হইবে (মৌজিলাল বঃ চন্দ্রাবলী, ৩৮ কলিকাতা। ৭০০ প্রিভি কৌন্সিল)। কিন্তু অল্প মস্তিষ্কবিকৃতি থাকিলে (যাহাকে চলিত কথায় ‘পাগলের ছিট’ বলা যায়) বিবাহ অসিদ্ধ হয় না। পুরুষত্বহানি হইলে তাহার বিবাহ সিদ্ধ কি না এ বিষয়ে এখনও আদালতে কোন নিষ্পত্তি হয় নাই। কিন্তু বিষ্ণুপ্রণীত ধৰ্ম্মশাস্ত্রে লিখিত আছে যে, এরূপ ব্যক্তির বিবাহ নিষিদ্ধ।

জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বিবাহ না হইলে কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিবাহ করিতে পারে মা; কিন্তু যেস্থলে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বিবাহ করিতে অস্বীকার করেন, কিংবা বিদেশে বাস করেন, কিংবা উন্মাদবশতঃ বা অন্য কোন কারণে বিবাহ করিড়ে অক্ষম হন, য়ে স্থলে কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিবাহ করিতে পারে। কিন্তু ঐ সকল অবস্থা ব্যতীতও যদি জ্যেষ্ঠের পূৰ্ব্বে কনিষ্ঠের বিবাহ হইয়া যায় তাহা হইলেও উহা অসিদ্ধ হইবে না। কন্যার পক্ষেও এইরূপ নিয়ম আছে যে, জ্যেষ্ঠ ভগ্নী অবিবাহিত থাকিতে কনিষ্ঠার বিবাহ নিষিদ্ধ; কিন্তু এরূপ বিবাহ হইলেও অসিদ্ধ হইবে না। এক স্ত্রী বর্তমানে পুনরায় বিবাহ করিলেও, তাহা সিদ্ধ।

কাহাকে বিবাহ করিতে পারা যায়

স্বধৰ্ম্মী ও স্বজাতির মধ্যে বিবাহ করিতে হইবে। ব্রাহ্মণ কায়স্থকে বিবাহ করিলে তাহা অসিদ্ধ হইবে। কিন্তু কোনও কোনও স্থলে (যথা ত্রিপুর, চট্টগ্রাম) কায়স্থের সহিত বৈদ্যের বিবাহ স্থানীয় প্রথানুসারে সিদ্ধ (৭ কলিকাতা উইক্‌লি নোটস ৬১২)। কিন্তু একই জাতির বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিবাহ অসিদ্ধ নহে (১৫ কলিকাতা ৭০৮)। যথা, রাঢ়ী শ্রেণীয় ব্যক্তি যদি বীরেন্দ্র শ্রেণীয় কন্যাকে বিবাহ করেন তাহা সিদ্ধ হইবে।

সম্প্রতি একটী ফৌজদারী মোকদ্দমায় কলিকাতা হাইকোটের বিচারপতি প্যাণ্টন স্থির করিয়াছেন ষে, কায়স্থের সহিত ডোমের বিবাহ ষদি শাস্ত্রোক্ত বিধান মতে সম্পন্ন হয় তাহা হইলে উহা সিদ্ধ বলিয়া গণ্য হইবে; কারণ উভয়েই যখন শূদ্র, তখন তাহাদের মধ্যে বিবাহ অশাস্ত্রীয় নহে (ভোলানাথ বঃ ভারতেশ্বর, ৫১ কলিকাতা ৪৮৮)। এই নিষ্পত্তি একেবারেই ভ্ৰাস্ত, কারণ কায়স্থ ও ডোমের মধ্যে বিবাহ যে কিরূপে”শাস্ত্রোক্ত বিধানমতে অনুষ্ঠিত” হইতে পারে, ইহাই এক হাস্যকর কথা, কারণ হিন্দুশাস্ত্রই এইরূপ বিবাহের বিরোধী। উপরোক্ত মোকদ্দমার ইউরোপীয় বিচারপতি এদেশীয় শাস্ত্র ও রীতিনীতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, সুতরাং তিনি ঐ অদ্ভুত রায় দিয়াছেন; এদেশীয় বিচারপতি হইলে তাঁহার নিষ্পত্তি অন্যরূপ হইত, সন্দেহ নাই। ইহার পূৰ্ব্বে আরও একটী মোকদ্দমায় স্থির হইয়াছে যে, কায়স্থ ও তাঁতির মধ্যে বিবাহ অসিদ্ধ নহে (বিশ্বনাথ বঃ সরসীবালা, ৪৮ কলিকাতা ৯২৬)। ইহাতেও বিচারপতিগণ উপরোক্তরূপে ভ্ৰম করিয়াছেন এবং ইহাও দুইজন ইউরোপীয় বিচাপতির নিষ্পত্তি। শূদ্রের মধ্যে যে সকল জাতি আছে তাহাদের মধ্যেও বিবাহ হয় না; যথা ধোপার সহিত নাপিতের বিবাহ বা কলুর সহিত গোয়ালার বিবাহ হয় না; এ সকল বিষয় ইউরোপীয় বিচারপতিগণের মস্তিষ্কে প্রবেশ করিতে পারে না; তাহারা শুদ্র বলিতে সকল শূদ্ৰজাতিকেই এক পৰ্য্যায়ভুক্ত মনে করিয়া স্থির করিয়াছেন যে তাহদের পরস্পরের মধ্যে বিবাহ চলিতে পারে।

তাহার পর, বঙ্গদেশীয় কায়স্থগণকে শূদ্রমধ্যে পরিগণিত করিয়া ঐ দুইটী মোকদ্দমায় হাইকোর্ট যে গুরুতর ভ্রম কবিয়াছেন, এই ভ্রমটী ৪০ বৎসরের উৰ্দ্ধকাল হইতে বিচারালয়ে চলিয়া আসিতেছে। এদেশের কায়স্থগণ কর্তৃক বহু শতাব্দী হইতে উপনয়ন ত্যাগ ও ক্ষত্রিয়াচিত আচার পরিবর্জনহেতু রঘুনন্দন তাহাদিগকে শূদ্রমধ্যে গণ্য করিয়াছেন। পণ্ডিত শ্যামাচরণ সরকার তাহার”ব্যবস্তাদর্পণ” নামক গ্রন্থে লিপিয়ছেন যে—এ দেশীয় কায়স্থগণ বাস্তবিকই ক্ষত্রিয়, কিন্তু বহুকাল যাবৎ তাহারা উপনয়ন ত্যাগ করিয়াছেন এবং নামান্তে”বৰ্ম্মা’ শব্দ ব্যবহার না করিয়া”দাস’ শব্দ ব্যবহার করেন বলিয়া তাহারা শূদ্রত্বে পতিত হইয়াছেন। এই সকল বিষয় আলোচনা করিয়া কলিকাতা হাইকোর্ট ১৮৮৪ সালে রাজকুমার বঃ বিশ্বেশ্বর (১০ কলিকাতা ৬৮৮) নামক মোকদ্দমায় কায়স্থকে শূদ্র বলিয়া প্রতিপন্ন করিয়াছেন, এবং এই নজীর অনুসরণ করিয়া অসিতমোহন বঃ নীরদমোহন (২০ কলি: উইক্‌লি নোটস ৯০১) নামক মোকদ্দমায় সেই কথারই প্রতিধ্বনি করিয়াছেন। আর স্মাৰ্ত্ত রঘুনন্দন যাহা বাকী রাখিয়ছিলেন সম্প্রতি কলিকাতা হাইকোর্ট তাহা শেষ করিয়া দিয়াছেন; কায়স্থের সহিত ডোমের ও তাঁতির বিবাহ সমর্থন করিয়া এই সম্ভ্রান্ত জাতির ললাটে শূদ্রত্বের চরম কলঙ্ককালিমা লেপন করিলেন। এই অপবাদের জন্য কায়স্থগণ নিজেরাই দায়ী। তাঁহারা উপবীত গ্রহণ অনাবশ্যক বোধ করেন, শূদ্রের ন্যায় ৩০ দিন অশৌচ পালন করেন, এবং দাস শব্দ ব্যবহার করিতে অনেকেই গৌরব অনুভব করেন। শূদ্রত্বের এই সকল চিহ্ন যতদিন তাঁহারা স্বেচ্ছায় ধারণ করিবেন, ততদিন তাঁহাদের এই গ্লানি ঘুচিবে না। বেহার ও পশ্চিম প্রদেশের কায়স্থগণ দাসশব্দ ব্যবহার করেন না, এবং উপবীত ত্যাগ করেন নাই, সেজন্য তথাকার কায়স্থগণ হাইকোর্টের বিচারে ক্ষত্রিয় বলিয়া পরিগণিত হইয়াছেন (ঈশ্বরীপ্রসাদ বঃ হরিপ্রসাদ, ৬ পাটনা ৫-৬; তুলসী বঃ বেহারী, ১২ এলাহাবাদ ৩২৮)।

সগোত্রে বিবাহ করিলে তাহা অসিদ্ধ হইবে। কতকগুলি সম্পর্ক”নিষিদ্ধ সম্পর্ক” বলিয়া কথিত হইয়াছে; ঐ সকল সম্পৰ্কীয়া কন্যাকে বিবাহ করা আইনে নিষিদ্ধ। যথা, পিতৃকুলের সাত পুরুষের, এবং মাতৃকুলের পাঁচ পুরুষের মধ্যে কাহারও বংশীয়া কন্যাকে বিবাহ করা শাস্ত্রে নিষেধ আছে। নারদ বলিয়াছেন—“আসপ্তমাং পঞ্চমাচ্চ বন্ধুভ্যং পিতৃমাতৃতঃ। অবিবাহ্যা সগোত্রা চ সমানপ্রবরা তথা॥” মনু বলিয়াছেন—“অসপিণ্ডী চ যা মাতুরসগোত্রা চ য: পিতুঃ। সা প্রশস্ত। দ্বিজাতীনাং দারকর্ম্মণি মৈথুনে।” কিন্তু এই নিষেধ থাকিলেও সকলে সকল সময়ে মানিয়া চলে না; অতএব যদি উভয় পক্ষের আত্মীয় ও স্বজনগণের সম্মুখে এবং তাহাদের সম্মতিক্রমে পূৰ্ব্বোক্ত নিষিদ্ধ সম্পর্কের মধ্যেও বিবাহ হইয়া থাকে, তাহা হইলে উহা সিদ্ধ বলিয়াই গণ্য হইবে। কিন্তু অতি নিকট সম্পৰ্কীয়গণের মধ্যে বিবাহ হওয়া উচিত নহে, কারণ তাহা অসিদ্ধ সাব্যস্ত হইবার সম্ভাবনা বেশী।

আরও, বিমাতার ভগিনী, বিমাতার ভ্রাতুকন্যা, খুল্লতাতের স্ত্রীর ভগিনী, শ্যালীকন্যা প্রভৃতিকে বিবাহ করা নিষিদ্ধ আছে। কিন্তু এইরূপ বিবাহ করিলেও তাহা অসিদ্ধ নহে।

এতদ্ভিন্ন, গুরুকন্যা (অর্থাৎ ষে গুরু বেদপাঠ করান তাহার কন্যা), বরের মাতৃনামধারিণী কন্যা, কিংবা যে কন্যা বর অপেক্ষা অধিকবয়স্কা তাহাকে বিবাহ করাও শাস্ত্রনিষিদ্ধ। কিন্তু পূর্বের ন্যায় এক্ষেত্রেও ক্লিবাহ করিলে তাহা অসিদ্ধ হইবে না।

কন্যার বিবাহে অভিভাবক

বঙ্গদেশে রঘুনন্দনের নিয়ম প্রচলিত আছে, এবং তাহার মতে নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ কন্যার বিবাহে অভিভাবক হইতে পর পর ক্ষমতাপন্ন :—পিতা, পিতামহ, ভ্রাতা, সকুল্য (অর্থাৎ ৪র্থ হইতে ৭ম পুরুষ পৰ্য্যন্ত জ্ঞাতি) মাতামহ, মাতুল, মাতা।”পিতা পিতামহো ভ্ৰাতা সকুল্যে মাতামহো মাতা চেতি। কন্যাপ্রদঃ পূৰ্ব্বাভাবে প্রকৃতিস্থঃ পরঃ পরঃ। ।”—বিষ্ণু, ২৪। ৩৮-৩৯৷

এই নিয়মটী দেখিলেই মনে হয় যে, মাতার স্থান বড়ই শেষে দেওয়া হইয়াছে। সন্তানের শরীর বা সম্পত্তি রক্ষার জন্য হিন্দু আইনে পিতার পরই অভিভাবক রূপে মাতার স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে, কিন্তু কন্যার বিবাহে অভিভাবক হিসাবে তাহার স্থান অত্যন্ত নিয়ে। সম্ভবতঃ বিবাহের ন্যায় একটী সামাজিক কার্য্যে স্ত্রীলোক অপেক্ষা পুরুষেরই বিচারশক্তি অধিক, পাত্র সম্বন্ধে ভাল-মন্দ বিচার স্ত্রীলোক অপেক্ষা পুরুষই ভালরূপ করিতে পরিবে, এইজন্যই শাস্ত্রকারগণ মাতাকে সর্বশেষে স্থান দিয়াছেন।

কিন্তু তাহা বলিয়া কন্যার বিবাহে মাতা যে কোনও কথাই বলিতে পারিবেন না, এরূপ নহে। কন্যার ভবিষ্যৎ মঙ্গলের জন্য পিতার যেমন ভাবনা, মাতার ভাবনা তাহা অপেক্ষা কম নহে; সুতরাং যদিও তিনি কন্যার পাত্রনিৰ্ব্বাচন সম্বন্ধে অধিকারিণী নহেন বটে, তথাপি, যদি কন্যার পিতা কন্যাকে কোন অপাত্রে সম্প্রদান করিতে উদ্যত হন তাহা হইলে কন্যার মাতা তাহাকে ঐ কাৰ্য্য হইতে নিবৃত্ত করিতে পারেন (হরেন্দ্র বঃ বৃন্দারাণী, ২ কলিকাতা উইক্‌লি নোটস ৫২১)। আবার বিশেষ বিশেষ স্থলেও পিতা অপেক্ষা মাতাই অধিকতর বাঞ্ছনীয় অভিভাবক বলিয়া গণ্য হন। যদি একজন কুলীন ব্রাহ্মণের একশত পত্নী থাকে, তাহা হইলে কবে কোন পত্নীর গর্ভে কোথায় কোন কন্য জন্মিয়াছে তাহা হয়তো ঐ ব্রাহ্মণের স্মরণও না থাকিতে পারে; ঐ কন্যা তাহার মাতার নিকট মাতামহের গৃহে প্রতিপালিত হইতেছে, পিতাকে সে হয়তো কখনও দেখেও নাই। এরূপ অবস্থায় ঐ কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে পিতা অপেক্ষা মাতাই স্বাভাবিক অভিভাবক হইবেন (মধুসুদন বঃ যাদবচন্দ্র, ৩ উইক্‌লি রিপোর্টর ১৯৪)।

অভিভাবক হিসাবে পিতার স্থান খুবই উচ্চ; এমন কি, পিতা যদি কোনও অপরাধে অভিযুক্ত হইয়া দণ্ড প্রাপ্ত হন, তাহা হইলেও সে কারণে তিনি কন্যার বিবাহের অভিভাবক হইবার অযোগ্য হইবেন না (১২ বোম্বাই ১১০)।

বিমাতা কখনও অভিভাবক হইতে পারেনা।

কন্যার যদি কোনও অভিভাবক না থাকে, অথবা যদি কন্যা যৌবনস্থা হওয়ার পরও তাহার অভিভাবকগণ বিবাহ দিতে অবহেলা করেন, তাহা হইলে সে নিজে স্বামী নিৰ্ব্বাচন করিতে পারে।

কন্যার বিবাহে কে উপযুক্ত অভিভাবক হইবেন, এ সম্বন্ধে বিবাহের পূৰ্ব্বে কোন প্রশ্ন উঠিলে আদালত তাহার মীমাংসা করিতে পারেন, কিন্তু বিবাহের পরে প্রশ্ন উঠিলে আদালত প্রায় হস্তক্ষেপ করেন না। যদি কোন কন্যার পিতা একটি পাত্ৰ নিৰ্ব্বাচন করেন, এবং ভ্রাতাও একটী পাত্র নির্বাচন করেন, এবং পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভ্ৰাতা বিবাহ দিতে অগ্রসর হন, সে স্থলে আদালত হস্তক্ষেপ করিবেন, এবং ভ্রাতার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রচার করিবেন। কিন্তু এ সকল বিষয়েও আদালত প্রধানতঃ কন্যর ভবিষ্যৎ মঙ্গলের প্রতি দৃষ্টি রাখিবেন। যদি আদালত দেখেন যে, পিতা একটী অযোগ্য পাত্র নির্বাচন করিয়াছেন এবং ভ্রাতার নির্বাচিত পাত্র তাহা অপেক্ষা যোগ্যতর, তাহা হইলে আদালত কখনও ভ্রাতার নির্বাচন রহিত করিয়া পিতার নির্বাচন স্থির রাখিবেন না। আর একটী উদাহরণ পূৰ্ব্বেই দেওয়া হইয়াছে যে, পিতা অযোগ্য পাত্র নির্বাচন করিলে মাতা তাঁহাকে আদালতের নিষেধাজ্ঞা দ্বারা নিবৃত্ত করিতে পারেন (২ কলিকাতা উইক্‌লি নোটস ৫২১)।

কিন্তু বিবাহ সম্পন্ন হইয়া গেলে পর, তখন আর আদালত অভিভাবক সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন লইয়া হস্তক্ষেপ করিবেন না। তাহার কারণ এই যে, হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে বিবাহ একটী অবিচ্ছেদ্য ধৰ্ম্মসম্বন্ধ, সুতরাং বিবাহ হইয়া গেলে পর আদালত তাহাতে হস্তক্ষেপ করিলে এবং বিবাহ অসিদ্ধ সাব্যস্ত করিলে কন্যার সামাজিক অবস্থা বড়ই শোচনীয় হইয়া পড়ে, সমাজে তাহার দাড়াইবার স্থান থাকে না (২২ বোম্বাই ৮১২)। সুতরাং যদি কোনও কন্যার পিতা বৰ্ত্তমানে এবং পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও মাতা বিবাহ দেন, এবং ঐ বিবাহ-ক্রিয়া যদি শাস্ত্রমতে সম্পন্ন হইয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে আদালত তাহাতে আর হস্তক্ষেপ করিবেন না (১১ বোম্বাই ২৪৭)। এমন কি, যদি পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাতা বিবাহ দিতে উদ্যত হন, এবং মাতাকে নিবৃত্ত করিবার জন্য পিতা আদালত হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রচার করান এবং ঐ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মাতা বিবাহ দেন, তাহা হইলেও ঐ বিবাহ অসিদ্ধ সাব্যস্ত হইবে না (২২ বোম্বাই ৫০৯)।

বিবাহে কি কি ক্রিয়া আবশ্যক

আদান-প্রদান, হোম এবং সপ্তপদীগমন-বিবাহে এই তিনটা ক্রিয়া আবশ্যক। দত্তকগ্রহণের ন্যায় বিবাহেও সম্প্রদান ও গ্রহণ কাৰ্য্যতঃ সম্পন্ন হওয়া চাই। এই ক্রিয়াগুলির মধ্যে কোনটা ইচ্ছাপূৰ্ব্বক পরিহার করিলে বিবাহ অসিদ্ধ হইবে।

কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহ সম্বন্ধে কোনও বিশেষ প্রথা থাকিলে সেই প্রথানুসারে বিবাহ করিলে তাহা সিদ্ধ হইবে। যথা, বৈষ্ণবদিগের মধ্যে প্রথা আছে যে, কষ্ঠিবদল করিলেই বিবাহ সিদ্ধরূপে সম্পন্ন হইয়া যায়, তাহাদিগের আর কোনও অনুষ্ঠান আবশ্যক হয় না; এবং আইনের চক্ষে এরূপ বিবাহ অসিদ্ধ বলিয়া গণ্য হইবে না। (সৌরভমণির বিষয়, ২৪ কলিকাতা উইক্‌লি নোটস, ৯৫৮)।

স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য

বিবাহের পর স্বামীই স্ত্রীর আইনমত অভিভাবক হন, এবং স্ত্রী স্বামীর বাটীতে বাস করিতে বাধ্য। কিন্তু কোন কোন স্থলে এরূপ প্রথা আছে যে, দ্বিতীয় সংস্কার না হওয়া পৰ্য্যন্ত স্ত্রী পিতৃগৃহে বাস করিতে পারেন। বিবাহের পূর্বে যদি এইরূপ চুক্তি হয় যে, স্ত্রী কখনও স্বামীর গৃহে বাস করিবে না, কিংবা স্বামী পুনরায় বিবাহ করিলে স্ত্রী পিতৃগৃহে চলিয়া যাইবে, তাহা হইলে ঐ চুক্তি অসিদ্ধ হইবে (মনোমোহিনী বঃ বসন্তকুমার, ২৮ কলিকাতা ৭৫১)। সেইরূপ, বিবাহের পরও যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এইরূপ চুক্তি হয় যে, স্ত্রী স্বামীর নিকট হইতে পৃথকভাবে থাকিবে, এবং ভরণপোষণ পাইবে, তাহা হইলে ঐ চুক্তি অসিদ্ধ হইবে (রাজলক্ষ্মী বঃ ভূতনাথ, ৪ কলিকাতা উইক্‌লি নোটস ৪৮৮)।

ফলকথা এই যে, বিবাহের পর হইতেই স্ত্রী স্বামীর নিকট বাস করিতে বাধ্য। স্বামী যদি পুনরায় বিবাহ করেন (১ মাদ্রাজ ৩৭৫) বা অসচ্চরিত্র হন, তাহা হইলেও স্ত্রী স্বামীগৃহে বাস করিতে বাধ্য। কিন্তু যদি স্বামী স্ত্রীর প্রতি নির্দয় ব্যবহার (প্রহার) করেন (জুলার বঃ দ্বারক, ৩৪ কলিকাতা ৯৭১), কিংবা স্ত্রীকে মর্ম্মান্তিক কষ্ট দেন (যথা গৃহে উপপত্নী রাখা, ৩৪ কলিকা্তা ৯৭১) কিংবা গুরুতর সংক্রামক রোগে (যথা কুষ্ঠরোগ) আক্রান্ত হন, তাহা হইলে স্ত্রী স্বামীর নিকট হইতে পৃথক থাকিতে এবং ভরণপোষণ আদায় করিতে পারেন। স্বামী ধৰ্ম্মান্তর গ্রহণ করিলে, স্ত্রী স্বামী হইতে পৃথক থাকিতে পারেন (মুচু বঃ অর্জুন, ৫ উইক্‌লি রিপোর্টার ২৩৫)।

স্বামীর অনুমতি ব্যতীত স্ত্রীকে কেহ স্বামীগৃহ হইতে অন্যত্র লইয়া যাইতে পারেন না। এমন কি, স্বামীর বিনা অনুমতিতে স্ত্রীকে যদি তাহার পিতাও লইয়া চলিয়া যান, তাহা হইলে তিনিও অপরাধী হইবেন (ধরণীধর আসামী, ১৭ কলিকাতা ২৯৮)। কোন ব্যক্তি যদি স্বামীর বিনা অনুমতিতে স্ত্রীকে স্বামীগৃহ ত্যাগ করিতে সাহায্য করেন, কিংবা স্বামীর বিনা অনুমতিতে স্ত্রী গৃহত্যাগ করিয়া গেলে যদি কোন ব্যক্তি তাহাকে আশ্রয় দেন, তাহা হইলে ঐ ব্যক্তির নিকট হইতে স্বামী ক্ষতিপূরণ আদায় করিতে পারেন।

স্বামীর মৃত্যুর পরও স্বামীগৃহে বাস করা স্ত্রীর কৰ্ত্তব্য, কিন্তু তথাপি উপযুক্ত কারণ থাকিলে তিনি তথায় বাস না করিতে পারেন।

স্বামীগৃহে থাকা শুধু যে স্ত্রীর কৰ্ত্তব্য তাহা নহে, স্ত্রীর উহাতে অধিকারও আছে। স্বামী স্ত্রীকে নিজগৃহে উপযুক্ত স্থান দিতে এবং তাহাকে ভরণপোষণ করিতে বাধ্য। তিনি কিছুতেই স্ত্রীকে বিনাকারণে পরিত্যাগ করিতে পারেন না।

 

বিধবার পুনর্বিবাহ

প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে বিধবার পুনৰ্ব্বিবাহ একপ্রকার নিষেধই ছিল, এবং সেজন্য সমাজে উহা মোটেই প্রচলিত নাই। কেবলমাত্র ভারতবর্ষের কয়েকট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্থানে উহা কতকগুলি নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে স্থানীয় প্রথানুসারে সম্পন্ন হইয়া থাকে।

কিন্তু ১৮৫৬ সালে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় পরাশরের একটী গ্রন্থ অবলম্বন করিয়া বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত বলিয়া প্রতিপন্ন করেন, এবং তাহার চেষ্টায় হিন্দু বিধবাগণের পুনৰ্ব্বিবাহ বিষয়ক ১৮৫৬ সালের ১৫ আইন প্রবর্তিত হয়। কিন্তু ঐ আইনসত্বেও হিন্দু সমাজে বিধবাবিবাহ প্রচলিত নাই বলিলেও চলে। তবে পূৰ্ব্বে উহা একেবারে অসিদ্ধ ছিল, এখন উহা আইনানুসারে সিদ্ধ বলিয়া গণ্য হইবে।

যদি ঐ বিধবার পূর্বস্বামীর সহিত সহবাস না হইয়া থাকে, তাহা হইলে ঐ কন্যার বিবাহে নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ পর পর অভিভাবক হইবেন –পিতা, পিতামহ, মাতা, ভ্রাতা, অন্যান্য পুরুষ জ্ঞাতি। যদি পূৰ্ব্বস্বামীর সহিত ঐ কন্যার সহবাস হইয়া থাকে, কিংবা যদি ঐ কন্য সাবালিকা হয়, তাহা হইলে সে স্বেচ্ছাক্রমে স্বামী নিৰ্ব্বাচন করিতে পারিবে (উক্ত আইন, ৭ ধারা)।

হিন্দু-বিধবা বিবাহ করিলে তিনি আর তাহার প্রথম স্বামীর ঔরসজাত সন্তানগণের অভিভাবক হইতে পারিবেন না (৩ ধারা), তাহার সম্পত্তি হইতে ভরণপোষণ পাইতে পারিবেন না, এবং তাহার স্বামীর সম্পত্তি তিনি যদি পাইয়া থাকেন (স্বামীর উত্তরাধিকারিণী স্বরূপে বা পুত্রের উত্তরাধিকারিণী স্বরূপে হউক), তাহা হইলে ঐ সম্পত্তি আর তিনি অধিকার করিতে পারিবেন না (২ ধারা)। কিন্তু এস্থলে ইহা জানিয়া রাখা কৰ্ত্তব্য যে, যে সম্পত্তি তিনি পুনৰ্ব্বিবাহের সময়ে ভোগ করিতেছেন সেই সম্পত্তি হইতেই তিনি বঞ্চিত হইবেন, যদি ভবিষ্যতে তাঁহার প্রথম স্বামীর সম্পৰ্কীয় কোনও ব্যক্তির সম্পত্তি উাহাতে অশায়, সে সম্পত্তি হইতে তিনি বঞ্চিত হইবেন না। যদি তাহার পুনৰ্ব্বিবাহের পর তাহার প্রথম পক্ষের স্বামীর ঔরসে নিজ গর্ভজাত পুত্র অবিবাহিত অবস্থায় পরলোকগমন করে, তাহা হইলে তিনি ঐ সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হইতে পারিবেন (১১উইক্‌লি রিপোর্টার ৮২)।

অন্যান্য কথা

বিবাহে বরকর্ত্তা এবং কন্যাকর্ত্তা এই উভয়পক্ষের স্বাধীন সম্মতি থাকা চাই। সুতরাং যদি কোন বিবাহ বলপূৰ্ব্বক কিংবা প্রতারণাপূৰ্ব্বক সম্পন্ন হয়, এবং তাহাতে যদি ভবিষ্যতে কন্যার অমঙ্গল হইবার আশঙ্কা থাকে, তাহা হইলে আদালত এই বিবাহ রদ করিতে পারেন। কিন্তু যদি ঐ বিবাহে কন্যার কোন অমঙ্গলের আশঙ্কা না থাকে, তাহা হইলে আদালত উহা রদ করিবেন না। কারণ পূৰ্ব্বে লিখিত হইয়াছে যে, বিবাহ অসিদ্ধ সাব্যস্ত হইলে কন্যার সমাজিক অবস্থা বড়ই শোচনীয় হইয়া দাঁড়ায়; এবং সেজন্য বিবাহের পর আদালত প্রায়ই হস্তক্ষেপ

করেন না।

পূৰ্ব্বেই লিখিত হইয়াছে যে, হিন্দুবিবাহ কিছুতেই বিচ্ছিন্ন হয় না। স্বামী যদি স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন তাহা হইলেও বিবাহবন্ধন যেমন তেমনিই থাকে এবং স্বামী অপুত্রক অবস্থায় পরলোকগমন করিলে স্ত্রী তাঁহার সম্পত্তিতে উওরাধিকারিণী হইবেন।

স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে কোন পক্ষ যদি ধৰ্ম্মান্তর গ্রহণ করেন এবং তজন্য অপরপক্ষ তাহাকে পরিত্যাগ করেন, তাহা হইলে আদালত ১৮৬৬ সালের ২১ আইন অনুসারে ঐ বিবাহ বন্ধন ছিন্ন বলিয়া সাব্যস্ত করিতে পারেন। ইহাই হিন্দুবিবাহ বিচ্ছেদের একমাত্র উদাহরণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *