১১. অক্ষপাদ দর্শন

১১. অক্ষপাদ দর্শন

এই দর্শনপ্রণেতা মহর্ষির নশ্য অক্ষপাদ ও গৌতম, এজন্য ইহাকে অক্ষপদ ও গৌতম দর্শন কহে । ইহাতে ন্যায় ও তর্ক পদার্থ বিশেষরূপে নির্দিষ্ট হওয়াতে ইহার ন্যায়শাস্ত্র ও তর্কশাস্ত্র এই দুইটী নামও অম্বর্থ হইতেছে । এবং এই দর্শনে অনুমানের রীতি সবিশেষ নিরূপিত থাকায় ইহাকে আম্বীক্ষিকী শাস্ত্র বলিয়াও ব্যবহার করিয়া থাকে (১) । এই ন্যায় শাস্ত্রের সকল শাস্ত্রেই উপযোগিতা আছে, ষে হেতু ন্যায় শাস্ত্র ব্যতিরেকে কোন শাস্ত্রেরই যথার্থ তাৎপৰ্য্যগ্রহ হয় না । ভগবান বৃহস্পতিও কহিয়াছেন, “ যে ব্যক্তি তর্কশা প্রাতুসারে তাৎপৰ্য্যাথের অনুসন্ধান করে, সে ব্যক্তিই শাস্ত্রের মৰ্ম্ম অবগত হইয়৷ ধৰ্ম্ম নির্ণয়ে সমর্থ হয় । কেবল শাস্ত্র অবলম্বন করিয়া ধৰ্ম্ম বিচার করা অকৰ্ত্তব্য, যে হেতু ন্যায় স্বরূপ যুক্তি – বিহীন বিচারে ধৰ্ম্ম হানি হয় ৷ ” পক্ষিল স্বামী ক হয়ছেন “এই অম্বিীক্ষিকা বিদ্য সকল বিদ্যার প্রদীপ স্বরূপ, যাবতীয় কৰ্ম্মের উপায় এবং নিখিল ধৰ্ম্মের আশ্রয় ” । অার যখন মহাভারতীয় মোক্ষধৰ্ম্মে পায়ে স্বয়ং বেদব্যাসই লিখিয়াছেন “ হে বৎস পার্থিব ! আমি আম্বীক্ষি কী শাস্ত্র অবলোকন করিয়া উপনিষদের সার সংগ্রহ করিয়াছি ” । তখন নfায়মতানুসারী উপনিষদের অর্থই গ্রাহ ও শ্রদ্ধেয় ইহা স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে । এ স্থলে অন্যায় পথাবলম্বী কেহ কেহ আপত্ত্বি করিয়া থাকেন যে, ন্যায় মতানুসারে কি রূপে উপনিষদের অর্থগ্রহণ করা যাইতে পারে, যেহেতু “ একমেবাদ্বিতীয়মূ” ইত্যাদি অনেকানেক ন্যায়বিরুদ্ধ শ্রীতি আছে । কিন্তু অ!দ্যোপাত্ত বৌদ্ধধিকারবিবৃত্তি দর্শন করিলে ঐ আপত্তি কেবল অবোধবিলাসত বোধ হইবে, যেহেতু উক্ত গ্রন্থে মহামহোপধ্যায় রঘুনাথ শিরোমণি ভট্টাচার্য ঐ সকল শ্রুতির সমন্বয় করিয়াছেন । তাহা অবলোকন করিলে ন্যয়মতানুসারে গুরুভ্যর্থ সংগ্রহ করাই ন্যায্য বোধ হইবে ।

গৌতম প্রণীত এই ন্যায়শাস্ত্র পঞ্চাধ্যায়াত্মক । ঐ পাঁচটী অধ্যায়েই দুই দুইটী আহ্নিক আছে এবং সকল আছি কই প্রকরণাত্মক ! যদিও, কেন অাহিকে চারিটি, কোন আহ্নিকে আ টটী, আর কোন আহ্নিকে বা তদধিক প্রকরণ থাকয় প্রকরণের বিশেষ রূপ নিয়ম নাই বটে ; কিন্তু কোন আহ্নিকেই চারিটির স্থান আর সতরটির অধিক প্রকরণ নাই, এরূপ সামান্য নিয়ম আছে । প্রথমাধ্যায়ের প্রথমাহিকে প্রমাণাদি নয়টা পদার্থের লক্ষণ এবং দ্বিতীয়ছিকে বাদ হইতে নিগ্রহ স্থান পর্য্যন্ত সাতটা পদার্থের লক্ষণ প্রদর্শিত হইয়ছে । দ্বিতীয়ের প্রথমে সংশয় পরীক্ষা (২) এবং প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ চতুষ্টয়ের অপ্রামাণ্য শঙ্ক নিরাকরণ । দ্বিতীয়ে অর্থপত্তি প্রমাণ প্রভূতির অনুমানে অন্তর্ভব ; তৃতীয়ের প্রথমে আত্মপ্রভূতি অর্থপর্যন্ত চারিট প্রমেয় পদার্থের পরীক্ষা, দ্বিতীয়ে বুদ্ধি ও মনের পর ক্ষী, চতুর্থের প্রথমে প্রবৃত্তি অবধি অপবর্গ পর্য্যন্ত ছয়টা প্রমেয় পদার্থের পরীক্ষা, দ্বিতীয়ে তত্ত্বজ্ঞান পরীক্ষা ; পঞ্চমের প্রথমে জাতিপদার্থবিভাগ, দ্বিতীয়ে নিগ্রহ স্থান বিভাগ নিরূপিত হইয়াছে ।

এই মতে পদার্থ ষোল প্রকার ; প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, অক, নির্ণয়, বাদ, জপ, বিতণ্ডা হেত্বাভাস, ছল, জাতি ও নিগ্ৰহস্থান ।

যাহার দ্বারা যথার্থরূপে বস্তু সকলের নির্ণয় করা যায় তাহাকে প্রমাণ পদার্থ কহে । প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দভেদে প্রমাণ চারি প্রকার । ঐ চারিট প্রমাণদ্বারা যথাক্রমে প্রত্যক্ষ, অতুমিতি, উপমিতি আর শা দবোপ— এই চারিট প্রমিভি জন্মে । নয়ন দি ইন্দ্রিয় দ্বারা যথার্থরূপে বস্তু সকলের ষে জ্ঞান হয়, তাহাকে প্রত্যক্ষ পুমিতি কহে। প্রত্যক্ষ প্রমিতি ছয় প্রকার ; ভ্রণজ, রাসন, চা ফুষ, ত্বাচ, শ্রাবণ ও মানস । ঘ্ৰাণ, রসনা, চক্ষুঃ, স্বক, শ্রোত্র আর মনঃ—এই ছয়টি ইন্দ্রিয় দ্বারা যথাক্রমে উল্লিখিত ছয় প্রকার প্রত্যক্ষ জন্মে । গন্ধ, ও তদ্‌গত সুরভিত্ত্ব ও অসুরভিত্ত্বাদি জাতির ভ্রাণর প্রত্যক্ষ হয়। মধুরাদি রস ও তদগত মধুরত্বাদি জাতির রাসন, নীল পীতাদি রূপ, ঐ ঐ রূপবিশিষ্ট দ্রব্য নীলস্য, পতিত্ব পুস্তৃতি জাতি, ঐ ঐ রূপবিশিষ্ট দ্রব্যের ক্রিয় এবং যোগ্য বৃত্তি সমবায়াদির চাফুষ, উদ্ভূত শীত উষ্ণাদি স্পর্শ ও ভাদৃশ স্পর্শবিশিষ্ট দ্রব্যাদির (৩) দ্বাচ, শব্দ ও তদগত বর্ণস্তু, ধ্বনিত্বাদি জাতির শ্রাবণ, এবং সুখছুঃখাদি আত্মরক্তি গুণের, আত্মার ও মুখস্থাদি জাজির মানস প্রত্যক্ষ (৪) হয় ।

ব্যাপ্য পদার্থ দর্শন করিয়া ব্যাপক পদার্থের যে জ্ঞান হয় তাহকে অনুমিত্তি কহে । ষে পদার্থ থাকিলে যে পদার্থের অভাব না থাকে তাহাকে তাহার ব্যাপ্য, এবং যে পদার্থ না থাকিলে ষে পদার্থ না থাকে তাহকে তাহার ব্যাপক কহে ; যথা কোন স্থানেই বহ্নি ব্যতিরেকে शृम থাকে ন বলিয়া ধূন বহ্নির ব্যাপ্য, এবং যে স্থানে ধূম থাকে সে স্থানে বহির তা ভাব থাকে না বলিয়া বর্হিঃ ধূমের ব্যাপক । এইজন্য লোকে পৰ্ব্বতাদিতে পূম সদর্শন করিয়া বহ্নির অকুমান করিয়া থাকে। অনুমান ত্ৰিবিধ ; পূৰ্ব্ববৎ শেষবৎ ও সামান্যতোদূষ্ট । কারণ দর্শনে কার্ব্যের অমুমানকে পুৰ্ব্ববং অর্থাৎ “ কারণলিঙ্গক ” অনুমান কহে, যেমন মেঘের উন্নতি দর্শন করিয়া ব্লষ্টির অনুমান । কার্য্য দর্শন করিয়া কারণের অনুমানকে শেষবৎ অর্থাৎ “ কাৰ্য্যলিঙ্গক ? অনুমান কহে, যেমন নদীর অত্যন্ত ব্লদ্ধি দর্শন করিয়া বৃষ্টির অনুমান । কারণ ও কার্য্যভিন্ন কেবল ব্যাপ্য ষে বস্তু তাহাকে দর্শন করিয়া যে অনুমিতি হয় তা হাকে সামান্যতোদূষ্ট অচমান কহে, যথা গগনমণ্ডলে সম্পূর্ণ শশধর মন্দর্শনে শুক্ল-পক্ষের অনুমান ক্রিয়কে হেতু করিয়া গুণের অনুমান এবং পৃথিবীত্ব জাতিকে হেতু করিয়া দ্রব্যত্ব জাতির অনুমান ।

কোন কোন শব্দের কোন কোন অর্থে শক্তি পরিচ্ছেদকে উপমিতি কহে অথা, ষে ব্যক্তি পূৰ্ব্বে গবয় জন্তু সন্দর্শন করে নাই, কিন্তু শুনিয়ছে, গেীসদৃশ গবয় পদবাচ্য, অর্থাৎ মে বস্তুর আকৃতি অবিকল গোর আকৃত্তিতুল্য, গবয় শব্দে তাহাকে বুঝায়, সেই ব্যক্তি তৎকালে এই মাত্র জানে যে, যে জন্তু গেদিদৃশ হইবে গবয় শব্দে তাহাকেই বুঝাইবে, গবয়শব্দ দ্বারা গবয় জন্তু বুঝায় জানে না । কিন্তু যখন সেই ব্যক্তির নয়ন পথে গবয় জন্তু পতিত হয়, তখন সেই ব্যক্তি ঐ গবয়ের আকুতি গোর আকৃতিতুল্য দেখিয় এবং পুৰ্ব্বশ্ৰুত গোমদৃশ গবয় পদবাচ্য এই বাক্যের মরণ করিয়া বিবেচনা করে, যদি গোসদৃশ জন্তুকে গৱয় শব্দে বুঝায় তবে যখন এই জন্তুটী গোসদৃশ হইতেছে, তখন এই জন্তুই গবয় পদবাচ্য হইবে সন্দেহ নাই । এস্থলে “এই জন্তুই গবয় পদবাচ্য হুইবে ” এইরূপ গবয় শব্দের শক্তি পরিচ্ছেদকে উপমিতি কহে ।

শব্দ দ্বারা যে বোধ হয় তাহাকে শী দবোধ কহে । যেমন গুরুর উপদেশ বাক্য শ্রবণ করিয়া ছাত্রগণের উপদিষ্ট অর্থের শা দুবোধ জন্মে । শব্দ প্রমাণ দ্বিবিধ ; দৃষ্টার্থক ও অদৃষ্টার্থক । যে শব্দের অর্থ প্রত্যক্ষসিদ্ধ তাহকে দৃষ্টার্থক, আর যাহার অর্থ অদৃশ্য তাহাকে অদৃষ্টার্থক শঙ্ক কহে। ইহার উদাহরণ যথাক্রমে, তুমি গৌরবর্ণ, আমার পুস্তক অতি উত্তম, তুমি দেখ ইত্যাদি সিদ্ধার্থক বাক্য, আর যাগ করিলে স্বৰ্গ হয়, বিষ্ণুপ্তজ করিলে বিষ্ণুর সন্তোষ জন্মে ইত্যাদি বিধি বাক্য ।

প্রমেয় পদার্থ আত্মা, শরীর, ইন্দ্রিয়, অর্থ, বুদ্ধি, মন, প্রবৃত্তি, দোষ, প্রেত্যভাব, ফল, দুঃখ ও অপবৰ্গভেদে দ্বাদশ প্রকার । (৫) ইন্দ্রিয় দুই প্রকার ; বহিরিন্দ্রিয় আর অন্তরিন্দ্রিয় । ঘ্রাণ, রসনা, চক্ষুঃ, ত্বক ও শ্রোত্র ভেদে বহিরিন্দ্রিয় পাচ প্রকার । অন্তরিক্রিয় এক মাত্র মনঃ । গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ ও শব্দভেদে অর্থ পদার্থ পাচ প্রকার । দোষ পদার্থ রাগ, দ্বেষ ও মোহ ভেদে ত্ৰিবিধ । কাম, মৎসর, স্পৃহা, তৃষ্টা, লোভ, মায়া ও দম্ভাদি ভেদে রাগ পদার্থ নানাবিধ । রমণেচ্ছাকে কাম কহে । নিজ প্রয়োজন ব্যতিরেকেই পরের অভিমত বিষয়ের নিবারণেচ্ছাকে মৎসর কহে, যেমন জলপানার্থ রাজকীয় পুষ্করিণীর অভিমুখে গমনোদ্যত তৃষ্ণাৰ্ত্ত ব্যক্তিকে উদাসীন ব্যক্তির নিবারণেচ্ছ । পরগুণের নিবারণেচ্ছাকেও মৎসর কহে । যে বিষয়ে কোন ধৰ্ম্মের হানি না হয় এমত বিষয় প্রাপ্তির ইচ্ছাকে স্পৃহা, আর আমার সঞ্চিত বস্তুর ক্ষয় না হউক এতাদৃশ ইচ্ছাকে তৃষ্ণা কহে । কাপণ্য দিভেদে তৃষ্ণাও নানাবিধ । উচিত ব্যয় না করিয়া ধনরক্ষণেচ্ছাকে কাৰ্পণ্য কহে । যাহার দ্বারা পাপ হইতে পারে এমত বিষয়ের প্রাপ্তীচ্ছাকে লোভ কহে । পরবঞ্চনেচ্ছাকে মায়া কহে । ভুলক্রমে নিজের ধাৰ্ম্মিকত্ত্বাদি প্রকাশ করিয়া স্বকীয় উৎকৃষ্টত্ব ব্যবস্থাপনেচ্ছাকে দম্ভ কহে ।

ক্রোধ, ঈর্ষা, অস্থয়া, দ্রোহ, অমর্য ও অভিমানাদি ভেদে দ্বেষ ও নানাপ্রকার । নেত্রদির রক্ততাদি জনক দ্বেষকে ক্রোধ ও সাধারণ ধনাদি হইতে নিজা শগ্রাহী এক অংশীর প্রতি অপর অংশীর যে দ্বেষ হয় তাহাকে ঈর্ব কহে, মেমন দুরন্ত দায়ীদগণের পরস্পর দ্বেষ। পরগুণাদিতে ষে বিদ্বেষ তাহাকে অস্থয়া, প্রাণীবিনাশজনক দ্বেষকে দ্রোহ, দুৰ্দ্দান্ত অপকারীর প্রতি পুত্যপকারাসমর্য ব্যক্তির দ্বেষকে অমর্ব, এবং তাদৃশ অপকারীর অপকার করিতে না পারিয়া “ধিক্ আমার আর জীবন ধারণ করা বৃথা ! যেহেতু আমার অপকারীর অপকার করিবার ক্ষমতা নাই” এইরূপ আত্মাবমাননাকে অভিমান কহে ।

বিপৰ্যয়, সংশয়, তর্ক, মান, পুমাদ, ভয়, শোকাদিভেদে মোহও নানাপুকার । অযথার্থ নিশ্চয়কে বিপৰ্যায় কহে, যেমন রজুকে সৰ্প বলিয়া নিশ্চয় কর । যে যে গুণ বাস্তবিক নিজের নাই সেই সকল গুণ নিজে আরোপ করিয়া আপনাকে উৎকৃষ্ট বলিয়া জ্ঞান করাকে নান, এক বিষয়কে পূৰ্ব্বে কৰ্ত্তব্য বলিয়া স্থির করিয়৷ ক্ষণকাল পরেই পুনরায় তাহাকেই অকৰ্ত্তব্য বলিয়া নিশ্চয় করাকে অর্থাৎ (মতির অস্থিরতাকে) পুমাদ কহে। অনিষ্টজনক কোন ব্যাপার উপস্থিত হইলে তৎপুর্তীকারে নিজের অসামর্থ্যজ্ঞানকে ভয় আর ইষ্টবস্তুর বিয়োগ হইলে পুনরায় তাহার অপুপ্তিসন্তাবনাকে শোক কহে ।

বারংবার উৎপত্তিকে অর্থাৎ একবার মরণ অার একবার জন্মগ্রহণ এবং পুনরায় মরণ ও তদনন্তর জন্মগ্রহণরূপ জন্মগ্রহণের আবৃত্তিকে প্রেত্যভাব কহে। যত দিন না মুক্তি হয় তত দিন সকল জীবগণকেই এই প্রেত্যভাব দুঃখে দুঃখিত হইতে হয় ।

যাহার দ্বারা যাহা নিম্পন্ন হয় তাহার ফল তাহাকে কহে, যেমন রন্ধনের ফল অন্ন, শাস্ত্রাসুশীলনের ফল জ্ঞানেদয় । ফল পদার্থ মুখ্য ও গৌণভেদে দ্বিবিধ ৷ চরম ফলকে মুখ্যফল কহে, মুখ্য ফল সুখ ও দুঃখের ভোগ । এতদতিরিক্ত সকল ফলই গৌণ ফল। যেহেতু সকল কৰ্ম্মেরই চরমে সুখ বা দুঃখের ভোগ স্বরূপ ফল পর্যfবসন্ন হয় । দেখ, রন্ধন দ্বারা পরিশেষে তোজন জন্য তৃপ্তিরূপ সুখ ও শাস্ত্র আলোচন। করিয়া জ্ঞানোদয় হইলে অসীম বিদ্যানন্দরূপ মুখের ভোগ হয় ; আর চৌর্য্যাদি দোষে দৃষিত হইয় পরিশেষে পিঞ্চরস্থ পক্ষীর ন্যায় কারাবদ্ধ হইয়া অশেষ যন্ত্রণ স্বরূপ দুঃখের ভোগ হয় ; এই রূপে বিবেচনা করিলে স্পষ্টই প্রতিপন্ন হয় যে, সকল কৰ্ম্মেরই চরম ফল সুখ-ভোগ কিম্বা দুঃখ-ভোগ ।

অত্যন্ত দুঃখ নিৰুক্তিরূপ মুক্তিকে অপবর্গ কহে । যে বিষয়ের উদেশে যে ব্যক্তি যে বিষয়ে প্ৰৱক্ত হয়, সেই বিষয়কে সেই ব্যক্তির সে বিষয়ে প্রবৃত্তির প্রয়োজন কহে । যেমন বুভূফু ব্যত্ত্বির রন্ধন প্রয়োজন ভোজন এবং সুপকারের বেতন । এস্থলে এম ও আশঙ্কা করিও না যে, ঐ ঐ ব্যক্তিদিগের ভোজন ও বেতন গ্ৰহণাদি যেমন রন্ধনের প্রয়োজন হইতেছে সেরূপ রদ্ধনের ফল স্বরূপ ও হইতেছে, তবে প্রয়োজন পদার্থ ও ফল পদার্থ পৃথক নির্দেশ করিবার প্রয়োজন কি ? যেহেতু এস্থলে ঐ উভয় পদার্থের ঐক্য থাকিলেও কুপিত ফক্ষিণস্থ মণির আশয়ে ফায় হস্তক্ষেপাদির স্থলে ঐ উভয়ের বিভিন্নত আছে । ঐ স্থলে মণির অশ্বয়ে ফণাযু হস্ত নিক্ষেপ করিবার প্রয়োজন মণি, এবং ফল সৰ্পকৃত দংশন দ্বারা প্রাণ বিয়োগ । যেহেতু যে বিষয়ের আশয়ে প্রবৃত্তি জন্মে তাহ সিদ্ধ হউক বা না হউক তাহাকে প্রয়োজন, আর অভিপ্রেত হউক বা অনভিপ্রেতই হউক যে বিষয় যাহার দ্বারা নিষ্পন্ন হয় তাহাকে ডাহার ফল কহে ইহা পূৰ্ব্বে প্রায় উক্তই হইয়াছে।

পুয়োজন মুখ্য ও গৌশভেদে দ্বিবিধ । অভিলম্বীয় বিষয়াস্তরের সম্পাদক বলিয়। ষে বিষয় অভিলক্ষণীয় হয় তাহাকে গৌণ, আর তদতিরিক্ত কেবল অভিলষণীয় বিষয়কে মুখ্য প্রয়োজন কহে । মুখ্য প্রয়োজন মুখ ও দুঃখনিবৃত্তি । যে কোন ব্যক্তি যে কোন বিষয়ে প্রবৃত্ত হয় সকলেরই প্রধান উদেশ্য সুখ বা দুঃখনিবৃত্তি, ঐ সুখ ও দুঃখনিবৃত্তির সম্পাদক বলিয়াই অতি ক্লেশকর বিষয় ও প্রার্থনীয় হয় । দেখ যদি ধনাদি দ্বারা ঐহিক সুখ স্বচ্ছন্দত ও যজ্ঞাদির দ্বারা পারলৌকিক স্বৰ্গসুখ লাভ ন হইত, তবে কোন ব্যক্তিই শারীরিক ক্লেশাদি স্বীকার করিয়া ধনেপোষ্ট্রন ও যজ্ঞাদিতে প্রবৃত্ত হইত না । অতএব ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে, ঐ ঐ সুখ লাভের আশয়েই ঐ ঐ বিষয়ে লোকে প্র রক্ত হয় । এবং যদি ঔষধ সেবন করিলেও শারীরিক পীড়া নিরক্তি ন হইত অথবা যোগাভ্যাস করিলেও মুক্তি না হইত, তবে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি দৃষ্ট দুঃখজনক ঐ ঐ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইত ? কিন্তু যখন দেখা যাইতেছে যে, যে ব্যক্তি জানে ঔষধ পান করিলে পীড়া শান্তি হয় অথবা যোগাভ্যাস করিলে মুক্তি হয়, সেই ব্যক্তিই ঐ ঐ বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়, আর যে ব্যক্তি তাহা না জানে কিংবা তদ্বিষয়ে যাহার বিশ্বাস না জন্মে, সেই ব্যক্তি ঐ ঐ বিষয়ে কদাচ প্রবৃত্ত হয় না; (৬) তখন ঔষধ পান ও যোগাভ্যাসের প্রধান উদেশ্য যে অনুক্রমে পীড়া শান্তি রূপ শারীরিক দুঃখনিবৃত্তি ও মুক্তিস্বরূপ অভ্যস্ত দুঃখনিবৃত্তি তাহার আর সন্দেহ কি ! ফলতঃ সকল বিষয়েরই প্রধান উদেশ্য সুখ বা দুঃখনিবৃত্তি বলিয়া সুখ ও দুঃখনিবৃত্তিকে মুখ্য প্রয়োজন আর উহারদিগের সাধন বলিয়া ধনোপাৰ্জ্জনাদিকে গৌণ প্রয়োজন কহে ।

প্রকৃত বিষয়ের দৃঢ়ীকরণার্থ যে প্রসিদ্ধ স্থলের উপন্যাস করা যায়, সেই স্থলকে দৃষ্টান্ত কহে। যথা “এই পৰ্ব্বতে বহ্নি আছে, যেহেতু ধূম দেখা যাইতেছে, যে যে স্থলে ধুম থাকে সেই সেই স্থলেই বহি থাকে, যেমন রন্ধনশালা’ এস্থানে “যেমন রন্ধনশালা” এই অংশটিকে দৃষ্টান্ত কহে ।

অনিশ্চিত বিষয়ের শাস্ত্রানুসারে নির্ণয় করাকে সিদ্ধান্ত কহে ; যথা, কি হইলে মুক্তি হয় এই রূপ জিজ্ঞাসা উপস্থিত হইলে “তত্ত্ব জ্ঞানন্নিশ্রেয় সাধিগমঃ” ইত্যাদি শাস্ত্রদ্বারা তত্ত্ব জ্ঞান হইলে মুক্তি হয় এইরূপ নিশ্চয় করা । সিদ্ধান্ত চারি প্রকার ; সৰ্ব্বতন্ত্র, প্রতিতন্ত্র, অধিকরণ আর অভূপগম । যে বিষয় সকল শাস্ত্রেই স্বীকৃত হইয়াছে এম ত বিষয়ের স্বীকারকে সৰ্ব্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত কহে, যেমন পরধনাপহরণ, পরস্ত্রীসংসর্গ ও পরের দ্বেষ সৰ্ব্বতোভাবে অ কৰ্ত্তব্য আর দীনের প্রতি দয়া, পরগুণে সন্তোষ ও পরোপকার প্রভূতি সৎকৰ্ম্ম সৰ্ব্বদা করা কৰ্ত্তব্য ইত্যাদি স্বীকার করা । যে বিষয় শাস্ত্রান্তর সম্মত নহে এতদ্বিষয়ের স্বকীয় শাস্ত্রে স্বীকারকে প্রতিতন্ত্র সিদ্ধান্ত কহে ; যথা বৈশেষিক দর্শনকৰ্ত্তার বিশেষ পদার্থ স্বীকার । এক বিষয় স্বীকার করিলে যে, বিষয়ান্তরেরও স্বীকার করা হয় তাহাকে অধিকরণ সিদ্ধান্ত কহে ; যথা জগৎ ঈশ্বর নিৰ্ম্মিত বলিয়া স্বীকার করিলে, ঈশ্বরের ষে জগন্নিৰ্ম্মাণ ক্ষমতা আছে তাহাও স্বীকার কর। হয়, এবং এই কাষ্ঠখানি একশত লোকেও উত্তোলন করিতে পারে না ইহা অঙ্গীকার করিলে ইহাও অঙ্গীকার করা হয় ষে এই কাষ্ঠের অতিশয় গুরুতা আছে । কোন বিষয় স্পষ্টাক্ষরে উল্লেখ না করিয়া প্রকারান্তরে সে বিষয়ের স্বীকারকে অভূপগম সিদ্ধান্ত কহে ; যথা ঈশ্বর আছেন কি না তাহার কিছুমাত্র উল্লেখ না করিয়৷ এই জগৎ ঈশ্বর-নিৰ্ম্মিত ইত্যাদি কথন দ্বারা ঈশ্বরের সত্তা স্বীকার করা এবং এই ন্যায়সুত্রে মনের ইঞ্জিয়ভ ইন্দ্রিয়গণনাস্থলে উল্লিখিত হয় নাই, কিন্তু স্থলান্তরে মহর্ষি গোতমের মনের ইক্রিয়তা ভঙ্গিক্রমে স্বীকার করা হইয়াছে।

বিচারাঙ্গ বাক্য বিশেষকে অবয়ব কহে । অবয়ব পাঁচটা ; প্রতিজ্ঞ, হেতু, উদাহরণ, উপনয় ও নিগমন । যে বিষয়ের ব্যবস্থাপন করিতে হইবে তাহার উপন্যাসকে প্রতিজ্ঞা কহে । ষথা পৰ্ব্বতে বহির সাধনার্থ “ পৰ্ব্বতে। বহ্নিমান ” অর্থাৎ পৰ্ব্বতে অগ্নি আছে ইত্যাদি বাক্য । কি হেতু পৰ্ব্বত্তে বহ্নি আছে এই জিজ্ঞাসা নিরাসার্থ তদনুমাপক হেতুর যে উপন্যাস তাহাকে হেতু কহে ; যেমন ঐ স্থলেই “ ধূমাৎ ” অর্থাৎ ধূম হেতু এই ভাগের উপন্যাস । উদাহরণ দ্বিবিধ অন্বয়ী ও ব্যতিরে কী । পৰ্ব্বতে ধুম থাকিলে বহি থাকে কেন ? এই আশঙ্কা নিবারণার্থ “যে যে ধূমবান স স বহ্নিমান ” অর্থাৎ ষে ষে স্থানে ধূম থাকে সেই সেই স্থানেই বহ্নি থাকে, যথা রন্ধনশালা, ইত্যাদি বাক্য প্রয়োগকে অস্বয়ী উদাহরণ, জার পূৰ্ব্বোক্ত শঙ্কা নিরাকরণার্থ * যশ্লৈবং তস্নৈবং ” অর্থাৎ যে স্থানে বহ্নি না থাকে সে স্থানে ধূমও থাকে না যথা পুষ্করিণী ইত্যাদি বাক্য প্রয়োগকে ব্যতিয়ে কী উদাহরণ কহে । সকল স্থলে উদাহরণ দ্বয়ের উপন্যাস করার অবশ্যকতা নাই, যেহেতু একতরের উপন্যাস করিলেই পূৰ্ব্বোক্ত শঙ্ক। নিরীকরণ হইতে পারে । এই উদাহরণ বাক্য দ্বারা বহ্নিতে ধূমের নিয়ত সহচরিত্ৰ রূপ ব্যাপকভ ব্যবস্থাপন করিয়া পক্ষনামক প্রকৃত স্থলে প্রকৃত মধ্যসাধক হেতুর ব্যবস্থাপনকে উপনয় কহে, बशी ‘বহ্নিব্যাপাধূমবংশ্চায়ং” অর্থাৎ বহির ব্যাপ্য ধূম এই পৰ্ব্বতে আছে, এইরূপ বাক্য । অর গ্রকৃত পক্ষে প্রকৃত সাধ্যের উপসংহার বাক্যকে নিগমন কহে ; যেমত “তমাৎ বহ্নিমান” অর্থাৎ সেইহেতু এই পৰ্ব্বতে বহ্নি আছে ইত্যাদি বাক্য । যেমত হস্ত, পদ ও উদরাদির প্রত্যেককে শরীরের অবয়ব আর তৎ সমুদায়কে শরীর কহে, সেইরূপ প্রতিজ্ঞাদি ঐ পাঁচটা বাক্যের প্রত্যেককে ন্যায়াবয়ব আর তৎসমুদায়কে ন্যায় বাক্য কহে । সকল বিচারস্থলেই ন্যায় প্রয়োগ করিতে হয়, ন্যায় প্রয়োগ না করিলে কোন পদার্থ সিদ্ধ হয় না । গ্ৰতিজ্ঞাদি পঞ্চ বাক্য ন্যায়ের অবয়ব বলিয়াই উহাদিগকে অবয়ব কহে ।

আপত্তিবিশেষকে ভক কহে ; যথা “যদ্যয়ং মনুষ্যঃ স্যাৎ করচরণাদিনান স্যাৎ’ অর্থাৎ যদি ইহা মনুষ্য হইত, তবে অবশ্য ইহার হস্ত পদাদি থাকিত, ইত্যাদি আপত্তি। তর্ক পচি প্রকার ; আত্মপ্রিয়, অন্যোন্যাশ্রয়, চক্রক, অনবস্থা, ও প্রমাণবাধিতাৰ্থ প্রসঙ্গ (৭) ।

পরস্পর জিগাৰু না হইয়া কেবল প্রকৃত বিষয়ের তত্ত্বনির্ণয়াৰ্থ, বাদ প্রতিবাদীর বিচারকে বাদ কহে। ঐ বাদ বিচারে সকলে অধিকারী নহে । যাহার। প্রকৃত বিষয়ের তত্ত্বনির্ণয়েস্থ, যথার্থবাদী, বঞ্চকস্তাদি দোষ-শূন্য যথাকলে প্রকৃতোপযোগী কথনে সমর্থ সিদ্ধান্ত বিষয়ের অপলাপ করে না এবং যুক্তিসিদ্ধ বিষয় স্বীকার করিয়া থাকে, তাহারাই বাদবিচারে অধিকারী । প্রকৃত বিষয়ের তত্ত্ব নির্ণয়াংশে দৃষ্টিপাত না করিয়া কেবল জিগীষাক্রমে পরমত খণ্ডন ও স্বমত ব্যবস্থাপনার্থ যে বাদী প্রতিবাদীর

বাগাড়ম্বর, তাহাকে জপ কহে । স্বমত স্থাপন হউক বা না হউক কেবল পরমত থগুনার্থ যে বাগ জালার স্তু, তা হাকে বিতগু কহে । এই দুই বিচারের অধিকারী সকলেই হইতে পারেন । বিচারের রীতি এইরূপ—প্রথমতঃ বাদীকে স্বমস্ত সংস্থাপন করিয়া স্বমতে যে যে দোষ সম্ভবে তাহার নিরাকরণ করিতে হয়, পরে প্রতিবাদীকে বাদী কর্তৃক সংস্থাপিত বিষয়ে নিজ অবোধ নিরাসার্থ ঐ বিষয়ের অনুবাদ করিয়া তাহাতে দোষারোপণ পুৰ্ব্বক স্বমত ব্যবস্থাপন করিতে হয়, পুনৰ্ব্বার বাদীকে প্রতিবাদিকথিত বিষয়ে নিজ অবোধ নিরাসার্থ ঐ বিষয়ের অনুবাদ করিয়া স্বমতে প্রতিবাদদত্ত দেবের উদ্ধার পূর্বক প্রতিবাদি মতে দোষের উদ্ভাবন করিতে হয়, এবং পুনৰ্ব্বার প্রভিবাদীকেও এইরূপ করিতে হয়। এই রীতিক্রমে বিচার করিতে করিতে যিনি স্বমতে দোষোদ্ধারে বা পরমতে দোষ দানে অসমর্থ হয়ে ন তিনিই পরাজিত হয়েন । এবং এই রীতি উল্লঙ্ঘন করিয়া যিনি বিচারে প্ররক্ত হয়েন বা অযথাকলে আর্থাৎ দোষোক্তাবনাদির অসময়ে দোষ দান দিতে প্রবৃত্ত হয়েন র্তাহারও পরাজয় হয় । if

প্রকৃত বিষয়ের বাস্তবিক সাধক ন হইলেও আপাততঃ প্রকৃত বিষয়ের সাধক বলিয়া যাহাকে বোধ হয়, তাহাকে হেত্বাভাম কহে, যথা ‘পৰ্ব্বত্তে ধুমবান বহ্নেঃ” অর্থাৎ পৰ্ব্বভে ধুম আছে যেহেতু বহ্নি আছে, ইত্যাদি স্থলে বহ্নিরূপ হেতু । যেহেতু বহ্নি বাস্তবিক ধুমের সাধক নহে, কারণ যে পদার্থ যাহার ব্যাপ্য না হয় সে পদার্থ তাহার সাধক হয় না এই রূপ নিয়ম আছে ; বহ্নি ধুম ব্যভিরেকেও দগ্ধ লৌহ ও শুষ্ক তৃণদিতে থাকে বলিয়৷ ধুমের ব্যাপ্য নহে, সুতরাং কি প্রকারে ধূমের সাধক হইবেক (৮)। হেত্বাভাস পাচ প্রকার ; সব্যভিচার, বিরুদ্ধ, অসিদ্ধ, সৎপ্রতিপক্ষিত অণর বধিত ।

বক্তা যে অর্থভাৎপর্য্যে যে শব্দ প্রয়োগ করেন, সে শব্দের সে অর্থ গ্রহণ না করিয়৷ অদ্বিপরীত অর্থ কম্পন পুৰ্ব্বক মিথ্য যে দোষারোপ করা, তাহীকে ছল কহে ; যথা ‘‘হরিপ্রসাদমহং ভক্ষয়ামি” অর্থাৎ হরির প্রসাদ আমি ভক্ষণ করিতেছি ইত্যাদি স্থলে হরি শদের বিষ্ণুরূপ তাৎপর্যার্থ পরিত্যাগ করিয়া বানররূপ অর্থ কম্পন পূৰ্ব্বক, কি ! তুমি বানরের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ কর, ষাও তুমি বড় স্লেচ্ছ, তোমার সহিত আর আহার ব্যবহার করিব না, ইত্যাদি দোষারোপ করা। বাকছল সামান্য ছল ও উপচার ছল ভেদে ছল পদার্থ তিন প্রকার । জমছভরকে অর্থাৎ বাদিকর্তৃক সংস্থাপিত মত দূষণে অসমর্থ অথবা নিজমভের হানিজনক যে উত্তর তাহাকে জাতি কহে । জাতি পদার্থ চব্বিশ প্রকার ; সাধ খুঁ্যসম, বৈধৰ্ম্ম্যসম, উৎকৰ্ষসম, অপকৰ্মসম, বর্ণ্যসম, অবৰ্ণ সম, বিকল্পসম, সাধfসম, প্রাপ্তিমম, অপ্রাপ্তিসম, প্রসঙ্গসন, প্রতিদ্বষ্টান্তসম, অনুৎপত্তিসম, সংশয়সম, প্রকরণসম, অহেতুসম, অর্থপত্তিসম, অবিশেষসম, উপপত্তিসম, উপলব্ধিসম, অতুপলব্ধিষম, নিত্যসম, অনিত্যসম অার কার্য্যসম ।

প্রতিজ্ঞাত বিষয়ে প্রতিবাদী দোষ দান করিলে সেই দোষের উদ্ধারে অশক্ত হইয় প্রতিজ্ঞাত বিষয়ের পরিত্যগাদিরূপ পরাজয়ের যে কারণ তাহীকে নিগ্রহস্থান কহে । নিগ্ৰহস্থান বাইশ প্রকার ; প্রতিজ্ঞাহানি, প্রতিজ্ঞান্তর, প্রতিজ্ঞাবিরোধ, প্রতিজ্ঞাসন্ন্যাস, হেত্বস্তুর, অর্থাস্তর, নিরর্থক, অবিজ্ঞাতার্থ, অপার্থক, অপ্রাপ্তকাল, স্থান, অধিক, পুনরুক্ত, অনমুভাষণ, অজ্ঞান, অপ্রতিভা, বিক্ষেপ, মত্তামুজ্ঞ, পর্যমুষোজ্যোপেক্ষণ, নিরমুযোজ্যামুযোগ, অপসিদ্ধান্ত আর হেত্বাভাস ।

এই ষোড়শ পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান হইলে অর্থাৎ এই ষোলটা পদার্থ বিশেষ রূপে জানিতে পারিলে আত্মতত্ত্বজ্ঞাম জন্মে অর্থাৎ আত্ম যে শরীরাদি হইত্তে পৃথগ ভূত্ত তাহ স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, সুতরাং শরীরাদিতে আত্মত্ববুদ্ধি রূপ মিথ্যাজ্ঞান অণর জন্মে না । এইরূপে রাগ ও দ্বেষের কারণ স্বরূপ ঐ মিথ্যাজ্ঞান নিৰুত্ত হইলে রাগ ও দ্বেষের আর উৎপত্তি হয় না, যদি রাগ ও দ্বেষই নিৱৰ্ত্ত হইল, তবে উহারদিগের কার্য্য স্বরূপ ধৰ্ম্ম ও অধৰ্ম্মাত্মক প্রবৃত্তির পুনৰ্ব্বার উৎপত্তির সম্ভাবনা কি? আর যখন ধৰ্ম্ম ও অধৰ্ম্মই জন্মগ্রহণের মুলীভূত হইতেছে, তখন ধৰ্ম্মাধৰ্ম্ম নিৰ্বত্ত হইলে যে, জন্মাদিও নিৰ্বত্ত হইবে তাহ বলিবার অপেক্ষা কি। আর যেমন কেন আশ্রয় ব্যতীত অন্মদাদির গমনাগমনদি হয় না, সেরূপ সুখ ও দুঃখের আয়তন স্বরূপ শরীরাদির অভাবে তত্ত্বজ্ঞানীর মরণানন্তর আর মুখ বা দুঃখ কিছুই জন্মে না, সুখ ও দুঃখ এক কালেই নিবৃত্ত হইয়া যায় ; ঐ দুঃখনিবৃত্তিকেই মুক্তি কহে ।

জীবাত্মাতিরিক্ত এক জন যে পরমেশ্বর আছেন তদ্বিষয়ে প্রমাণ অনুমান ও শ্রী ত্যাদি । অমুমানপ্রণালী এইরূপ । যে যে বস্তু কার্য হয়, তা হার একজন কৰ্ত্ত থাকে, যেমন ঘট ও পটাদি কার্যের কৰ্ত্ত যথাক্রমে কুম্ভকার ও তন্ত্রবায়াদি । এইরূপ অগম্য অরণ্যস্থ ব্ৰক্ষাদি ও ক{স বটে, তাহারও এক জন কৰ্ত্তা আছে বলিতে হইবে ; কিন্তু তদ্বিষয়ে অন্নদাদির কর্তৃত্ব সম্ভবে না, যে হেতু তাদৃশ স্থান অন্মদাদির অগম্য, সুতরাং তৎস্থানস্থিত স্থাবর দির কৰ্ত্তা মে এক জন অসাধারণ শক্তি সম্পন্ন পরমেশ্বর আছেন তদ্বিষয়ে আর সন্দেহ কি (৯) । পরমেশ্বরের ভোগসাধন শরীর, সুখ, দুঃখ ও দ্বেষাদি কিছুই নাই, কেবল নিত্য জ্ঞান, ইচ্ছা ও যত্নাদি কএকটা গুণ আছে । জীবাত্মা নানা অর্থাৎ এক একটা শরীরের অধিষ্ঠাত স্বরূপ এক একটা জীবাত্মা আছে । যদি সকলেরই আত্মা এক হইত স্তবে একজনের সুখে বা দুঃখে জগৎ সুখী বা দুঃখী হইত; যে হেতু সুখ ও দুঃখ আত্মার ধৰ্ম্ম, এক ব্যক্তির অস্থাতে সুখ ও দুঃখাদির সঞ্চার হইলে সকল ব্যক্তির আত্মাতে সুখ বা দুঃখের অসদ্ভাব থাকিত না । কিন্তু এই দোষ নিবারণ করিতে নয়নাদি স্বরূপ ইন্দ্রিয়কে যে আত্মা বলা তাহাও ভ্রান্ত ব্যক্তির সিদ্ধান্ত , বলিতে হইবে ; কারণ যদি নয়নাদি স্বরূপই আত্মা হইত, তবে আমি চক্ষু ইত্যাদি ব্যবহার হইত, ও নয়নাদির বিনাশ হইলে আত্মারও বিনাশ হইত, এবং যেমন অন্য ব্যক্তির দৃষ্ট বস্তু অপর ব্যক্তি মরণ করিতে পারে না, সেইরূপ চক্ষু বিনষ্ট হইলে পুৰ্ব্ব দৃষ্ট পদার্থ সকলের মরণ হইত না ; যেহেতু ঐ পদার্থদ্রষ্ট। চক্ষুঃ বিনষ্ট হইয়াছে, সুতরাং চক্ষু কর্তৃক দৃষ্ট পদাৰ্থ আর কোন ব্যক্তি মরণ করবে ?

এবং “ আমি গেীর, আমি কৃষ্ণ, আমি স্থল ব। আমি কৃশ” ইত্যাদি ব্যবহার হইতেছে বলিয়। শরীরকে আত্ম। বলিয়। যে স্বীকার করা তাহাও স্থূলদর্শিতার কৰ্ম্ম বলিতে হইবে, কারণ যদি শরীরই আত্মা হইত তাহ হইলে কোন ব্যক্তিই ধৰ্ম্ম ও অধৰ্ম্মের ফলস্বরূপ স্বর্গ ও নরক ভোগ করিত না, যে হেতু শরীর বিনষ্ট হইলেই আত্মাও বিনষ্ট হইত সুতরাং আর কোন ব্যক্তি স্বৰ্গ বা নরকভোগ করিবে । স্বৰ্গ বা নরকাদিকে অলীক বলিয়াই বা কি প্রকারে স্বীকার করা যাইতে পারে, কারণ তাহ হইলে কোন ব্যক্তিই শারীরিক ক্লেশ ও অর্থব্যয় স্বীকার করিয়া যাগাদি করিত না এবং পরদার গমনাদিরূপ নিষিদ্ধ কৰ্ম্ম হইতে নিৰ্বত্ত হইত না, বরং ঐহিক সুখাভিলাষে প্রত্নত্ত হইবারই সম্পূর্ণ সম্ভাবনা।

আরও দেখ যদি শরীরই আত্মা হইত, তবে সদ্যঃপ্রস্থত বালকের হর্ষ, শোক ও ভয়াদি বা স্তনপানাদিতে প্রবৃত্তি হইত না, কারণ তৎকালে ঐ বালকের হর্যাদির কোন কারণ নাই এবং স্তন পান করিলে যে ক্ষুধা নিবৃত্তি হয় তাহাও জানে না, উপদিষ্ট ও হয় না ; কিন্তু ইহলোক ও পরলোকগামী সুখদুঃখাদিভোক্তা, নিত্য এক অতিরিক্ত আত্মপদার্থ স্বীকার করিলে আর এ দোষ স্বটে না, যে হেতু ঐ বালকের ভূৰ্মানুভূক্ত হর্ষাদির কারণের স্মৃতি হইয়াই হর্ষাদি হইয়া থাকে এবং পূৰ্ব্বানুভূত স্তনপানের সংস্কার বশতঃই তৎকালে স্তনপানে প্রবৃত্তি হয়, তবে আমি গৌর ইভ্যাদি যে শরীরাভেদ ব্যবহার হইয়া থাকে তাহা ভ্ৰমাধীন বলিতে হইবে ।

———————-
(১) অনু, শ্রবণাদনু,+ঈক্ষা (মননম্‌)=অম্বীক্ষা, তন্নির্ব্বাহিকা আম্বীক্ষিকী, অর্থাৎ আত্মতত্ত্বের শ্রবণানন্তর তাহার অনুমানরূপ মননের নির্ব্বাহক শাস্ত্র।

(২) কোন বিষর স্বীকার করিতে যে যুক্তি উপন্যাস করা যায় তাহাকে তাহার পরীক্ষা কহে । অতিরিক্ত সংশয় পদার্থ স্বীকার করিবার যুক্তিকে সংশয় পরীক্ষা কহে ।

(৩) বল্লভাচার্য্যমতে গুরুত্বেরও স্পার্শন প্রত্যক্ষ হয়। নন্যেরা বায়ু ও তদমত কোন কোন সংখ্যার স্পার্শন প্রত্যক্ষ স্বীকার করিয়া থাকেন।

(৪) বাচস্পতিমিশ্রমতে আত্মার পরিমাণ ও একত্ব সংখ্যার মানস প্রত্যক্ষ হইয় থাকে ।

(৫) অক্ষপাদ দর্শনের সহিত ঔলূক্য দর্শনের অনেকাংশে ঐকমত্য আছে । সুতরাং যে ষে পদার্থ ঔলুক্য দর্শনে নির্দিষ্ট হইয়াছে তৎসমুদায় এবং প্রসিদ্ধ পদার্থ সকলের লক্ষণ বা উদাহরণাদি প্রদর্শন করা নিষ্প্রয়োজন বিবেচনায় এস্থলে আত্মা ও শরীর পদার্থ প্রভূতিও লক্ষিত হইবে না।

(৬) ইহার উদাহরণ যথাক্রমে বালক ও নাস্তিকগণ ।

(৭)  অন্যোন্যাশ্রয়াদি পাঁচ প্রকার তর্কের লক্ষণ মাধবাচার্য্যকৃত সৰ্ব্বদর্শনসংগ্রহে নির্দিষ্ট নাই এবং অতিশয় কঠিন বলিয়া উহা পরিত্যক্ত হইল।

(৮) যে কারণবশতঃ পাঁচ প্রকার তর্কের লক্ষণ নির্দিষ্ট কয় নাই, সেই কারণবশতঃই এ স্থলে পাঁচ প্রকার হেত্বাভাসের লক্ষণ লক্ষিত হইল না, এবং পরেও জাতি এবং নিগ্রহন্থানের বিশেষ বিশেষ লক্ষণ লক্ষিত জুইবে না ।

(৯) ইহাতে অনেক আপত্তি উথাপিত হইতে পারে বটে, কিন্তু সে সকল আপত্তি অন্যান্য গ্রন্থে নিরাকৃত হইয়াছে, বিস্তারিত ভয়ে এ স্থানে প্রদর্শিত হইল না।

 

(প্রুফরীড আবশ্যক)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *