০৩. সামবেদীয় সীমন্তোন্নয়ন

০৩. সামবেদীয় সীমন্তোন্নয়নং *

প্রথমগর্ভের চতুর্থ, ষষ্ঠ বা অষ্টম মাসে সীমন্তোন্নয়ন সংস্কার সম্পাদন করিবে। গর্ভাধান, পুংসবন ও সীমন্তোন্নয়ন এই সকল সংস্কারক্রিয়াগুলির পৌর্ব্বাপর্য্যনিয়ম হেতু তত্তদনুসারেই কর্ত্তব্য। যদি দৈবাৎ যথাকালে গর্ভাধান ও পুংসবন কর্ম্ম নির্ব্বাহিত না হয়, তাহা হইলে সীমন্তোন্নয়নদিবসে শাট্যায়নহোমাদিরূপ প্রায়শ্চিত্ত করিয়া গর্ভাধান ও পুংসবন কর্ম্ম সমাপন পূর্ব্বক সীমন্তোন্নয়ন নির্ব্বাহ করিবে। প্রথমতঃ পতি স্নান ও বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ সমাপন পূর্ব্বক মঙ্গলনামা অগ্নি স্থাপন করিয়া বিরূপাক্ষজপান্তা কুশণ্ডিকা সমাধা করত সঙ্কল্প করিবে। “ওঁ অদ্যেত্যাদি এতন্মদীয়পত্ন্যা যথাকালে গর্ভাধানপুংসবনকর্ম্মণোরকরণজনিত দোষ প্রশমন শাট্যায়নহোমমহং কুর্ব্বীয়” এই বাক্য সঙ্কল্প করিয়া যথাবৎ শাট্যায়ন হোম করিবে। অনন্তর যথোক্ত গর্ভাধান ও পুংসবন কর্ম্ম সমাপন পূর্ব্বক প্রাতঃ কৃতস্নানা বধূকে অগ্নির পশ্চিম দিকে স্বীয় দক্ষিণভাগে উদগগ্র কুশোপরি প্রাঙ্মুখীভাবে উপবেশন করাইয়া প্রকৃতকর্ম্মারম্ভে প্রাদেশপ্রমাণ ঘৃতাক্ত সমিধ তূষ্ণীভাবে অগ্নিতে হোম করতঃ মহাব্যাহৃতিহোম সম্পাদন করিবে। “প্রজাপরির্‌ঋষির্গায়ত্রীচ্ছন্দোহগ্নির্দ্দেবতা মহাব্যাহৃতিহোমে বিনিযোগঃ। ওঁ ভূঃ স্বাহা।” ইত্যাদি মূলের লিখিত মন্ত্রে মহাব্যাহৃতি হোম করিতে হয়। তৎপরে পতি বধূর পৃষ্ঠভাগে পূর্ব্বাভিমুখে থাকিয়া একবৃন্তস্থিত পক্ক উডুম্বর-ফলদ্বয় পট্টসূত্রাদি দ্বারা গাঁথিয়া আচারানুসারে তৎসহ সূর্বর্ণদিগঠিত বাসুদেবপাদদ্বয়, যদপ্রতিকৃতি এবং নিম্ব, সর্ষপ, ভল্লাতক, বচ প্রভৃতি লইয়া “প্রজাপতির্‌ঋষিরনুষ্টুপ্‌ছন্দঃ স্ত্রী দেবতা উড়ুম্বরফলযুগলবন্ধনে বিনিয়োগঃ। ওঁ অয়মূর্জ্জাবতো বৃক্ষ ঊর্জ্জীব ফলিনী ভব। পর্ণং বনস্পতে নুত্বা নুত্বা চ সুয়তাং রয়িং” এই মন্ত্রে অর্থাৎ “হে কল্যাণি! তুমি উর্জ্জম্বল উডুস্বর তরু হইতেও ঊর্জ্জম্বলফলসমন্নিতা হও। হে বনস্পতে! যেরূপ পর্ণের পর পর্ণের উৎপত্তি হইয়া সমৃদ্ধি জন্মে, সেইরূপ এই বধূতে পুত্ররূপ মহাধন সঞ্জাত হউক্‌।” এই মন্ত্র পড়িয়া বধূর কণ্ঠদেশে উহা লম্বিত করিয়া দিবে। ১।।

অনন্তর কুশগুচ্ছত্রয় লইয়া “প্রজাপতির্‌ঋষির্গায়ত্রীচ্ছন্দোহগ্নির্দ্দেবতা দর্ভপিঞ্জলীভিঃ সীমন্তোন্নয়নে বিনিয়োগঃ। ওঁ তূঃ।” এই মন্ত্র দ্বারা গর্ভিণীর সীমন্তভাগের কেশ উন্নীত করিয়া সেই কুশগুচ্ছ কেশপাশে স্থাপন করিবে। পরে পুনরায় কুশগুচ্ছত্রয় লইয়া “প্রজাপতির্‌ঋষিরুষ্ণীক্‌ছন্দ বায়ুর্দেবতা দ্ররভপিঞ্জলীভিঃ সীমস্তোন্নয়নে বিনিয়োগঃ ওঁ ভুবঃ।” এই মন্ত্ৰে পূৰ্ববৎ সীমন্ত উন্নীত করিয়া সেই কুশগুচ্ছও কেশপাশে স্থাপন করিবে। তৎপরে পুনৰ্ব্বার কুশগুচ্ছত্রয় লইয়া “প্রজাপতির্‌ঋষিররনুষ্টু পছন্দঃ সূর্য্যো দেবতা দর্ভপিঞ্জলীভিঃ সীমন্তোন্নয়নে বিনিয়োগঃ। ওঁ স্ব।” এই মন্ত্ৰে পূৰ্ববং সীমন্ত উন্নীত  করিয়া পূর্বের ন্যায় কুশগুচ্ছ কেশপাশে স্থাপন করিবে। অনন্তর শরকাষ্টিকা লইয়া “প্রজাপতিঋষিস্ত্রিষ্টুপ্‌ ছন্দঃ স্ত্রী দেবতা শরেণ সীমন্তোন্নয়নে বিনিয়োগঃ। ওঁ যেনাদিতেঃ সীমানং নয়তি প্রজাপতিৰ্মহতে সৌভগায় তেনাহমস্যৈ সীমানং নয়ামি প্রজামস্যৈ জরদৃষ্টিং কৃণোমি” এই মন্ত্রে অর্থাৎ “প্রজাপতি কশ্যপ যে শর দ্বারা দেবজননী অদিতির সৌভাগ্য সম্পাদনার্থ সীমন্তোন্নয়ন করিয়াছিলেন, সেই শর দ্বারা আমি গর্ভিণীর সীমন্তোন্নয়ন করত ইঁহার পুত্র পৌত্র প্রভৃতিকে স্বীয় স্বীয় জরাবস্থা যাবৎ দীর্ঘজীবী করিতেছি।” এই মন্ত্ৰ পড়িয়া শর দ্বারা সমস্ত উন্নীত করত শর যথাবৎ স্থাপন করিবে।।২।।

তদনন্তর পতি সূত্রপূর্ণ নলিকা লইয়া তদ্বারা পূৰ্ববং সীমন্ত উন্নীত করত সেই নলিকা পূৰ্ব্বের ন্যায় স্থাপন করিবে। . “প্রজাপতিঋষির্জ্জগতীচ্ছন্দো রাক দেবতা সূত্রপূর্ণতর্কুণা সীমন্তোন্নয়নে বিনিয়োগঃ। ওঁ রাকামহং সুহবাং সুষ্টুভী হবে শৃণোতু নঃ সুভগা বোধতু ত্মন সীব্যত্বয়ঃ সূচ্যা অচ্ছিদ্যমানয়া দদাতু বীরং শতদায়ুমুখ্যং” এই মন্ত্রে অর্থাৎ “আমি শোভনস্তুতি দ্বারা শোভনাঙ্গ পৌর্ণমাসীকে আহবান করিতেছি। (১) তিনি আমাদিগের শোভনবাণী শ্রবণ পূর্বক অবধারণ করুন, অচ্ছিদ্যমান সূচিক্রিয়া দ্বারা পুত্র-পৌত্ৰাদি উৎপাদনকৰ্ম্ম অনুস্যূত করুন এবং ভূরিদাতা একটি পুত্র সমর্পণ করুন।“ এই মন্ত্র পাঠ করিয়া উক্ত ক্রিয়া অর্থাৎ সীমন্ত উন্নীত করবে।।৩।।

তৎপরে ত্রিশ্বেতা শললী লইয়া উক্তপ্রকারে সীমন্তোন্নয়ন করত বললী স্থাপন করিতে হয়। “প্রজাপতিঋষিৰ্জ্জগতীচ্ছন্দো রাক দেবতা ত্রিশ্বেতয়া শলল্যা সীমন্তোন্নয়নে বিনিয়োগঃ। ওঁ যাস্তে রাকে সুমতঃ সুপেশসো যাভর্দদাসি দাশুষে বসুনি তাভির্নোহদ্য সুমনা উপাগহি সহস্রপোষং সুভগে রনাণা।“ এই মন্ত্রে শললী দ্বারা সীমন্ত উন্নীত করবে। উক্ত মন্ত্রের অর্থ এই যে—হে পৌর্ণমাসি! তুমি তোমার যে শোভনমতি দ্বারা যজমানকে ঐশ্বৰ্য্য, সমন্বিত করিয়া থাক, সেই বুদ্ধিযুক্ত হইয়া অদ্য প্রফুল্ল চিত্তে আমাদিগের সন্নিহিত হও। হে সুভগে! আমাদিগকে সহস্ৰপোষী পুত্র সমর্পণ কর।।৪।।

অবশেষে পতি উপরিদত্ত ঘৃতবিশিষ্ট, তিলতণ্ডুলমাষযুক্ত কৃষররূপ স্থালীপাক অর্থাৎ সঘৃত চরু দেখাইয়া গর্ভিণীকে জিজ্ঞাসা করিবেন, “কি দেখিতেছ?” তখন পত্নী সেই চরু দর্শন করিলে তাহাকে “প্রজাপতিঋষিঃ স্ত্রী দেবতা স্থালীপাকাবেক্ষণে বিনিয়োগঃ। ওঁ প্রজাং পশুন সৌভাগ্যং মহৎ দীর্ঘায়ুষ্ট্রং পত্যুঃ।” এই মন্ত্র পাঠ করাইবেন অর্থাৎ পত্নী বলিবেন যে, আমি প্রজা (পুত্রপৌত্ৰাদি) দেখিতেছি, পশু (গো-মহিষাদি ) সৌভাগ্য দেখিতেছি এবং মদীয় পতির দীর্ঘজীবন দর্শন করিতেছি।।৫।।

তদনন্তর মহাব্যাহতি হোম করিয়া প্রদেশপ্রমাণ ঘৃতাক্ত সমিধ্‌ তুষ্ণীভাবে অগ্নিতে আহুতি দিয়া প্রকৃত কৰ্ম্ম সমাপন পূর্বক সৰ্ব্বকৰ্ম্ম সাধারণ শাট্যায়ন হোমাদি বামদেব্যগানান্ত উদীচ্য কৰ্ম্ম সমাপন করত কৰ্ম্মকারয়িতৃ-ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা প্রদান করিবে । পরে পতিপুত্রবতী নারীগণ বধূকে বেদীর উপরে উখাপিত করিয়া কলসবারি দ্বারা স্নানাদি মঙ্গলকৰ্ম্ম সম্পাদন করিবেন এবং বন্ধুকে কহিবেন, “তুমি বীরপ্রসবিনী হও, জীববৎসা হও, জীবপতিকী হও।” অবশেষে গর্ভিণী সেই কৃষর ভোজন করিবেন।

ইতি সামবেদীয় সীমন্তোন্নয়ন।

——————-
* গর্ভাবস্থায় তৃতীয় সংস্কার সীমন্তোন্নয়ন। এই সংস্কারটিও গর্ভাবস্থার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। গর্ভ গ্রহণের ছয় হইতে ৮ মাসের মধ্যে গর্ভ বিনষ্ট হইবার বিলক্ষণ সম্ভব, এই জন্য গর্ভগ্রহণের পর ষষ্ঠ বা অষ্টম মাসে এই সংস্কার সম্পাদন করিতে হয়। ইহার মূল ক্রিয়াটি গর্ভণীর সীমন্ত বা সিঁতি তুলিয়া দেওয়া। সীমন্ত তুলিয়া দেওয়া হইলে গর্ভিণী স্ত্রী আর তৎপরে প্রসবযাবৎ অনুলেপনাদিতে অনুলিপ্তা, মাল্যাদিধারিণী, শৃঙ্গারবেশে অলঙ্কৃতা বা পতিগামিনী হয়েন না। পুংসবনের পর শুভলক্ষণে এই সংস্কারটি সম্পাদন করিতে হয়। এই সংস্কারে বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ ও চরুপাকাদি সম্পাদন পূর্ব্বক স্বামী একবৃন্তস্থ পরিপক্ক যজ্ঞডুম্বদ্বয় ও অন্যান্য কতিপয় মাঙ্গল্য দ্রব্য গর্ভিণীর গলে পট্টসূত্রযোগে লম্বিত করত যে মন্ত্র শুনাইয়া থাকেন, তাহা পর্যালোচনা করিলেই স্পষ্ট প্রতীত হইবে যে, এমন প্রীতি ও আনন্দবর্দ্ধক, সুদূরদৃষ্টিপ্রদায়ক পবিত্র কার্য্য বোধ হয় আর নাই; সুতরাং এ সংস্কার আমাদের দেষ হইতে বিলুপ্ত হওয়া একান্ত দুঃখের বিষয়।

(১)পুৰ্ব্বে গর্ভাধানসংস্কারকালে অমাবস্যার অন্তর্গত শশিকলার আবাহন হইয়াছিল, অধুনা গর্ভ পূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়াছে, সুতরাং এক্ষণে রাকা পৌণমাসীর আহ্বান হইতেছে।