০২. সামবেদীয় পুংসবন

সামবেদীয় পুংসবন *

প্রথম গর্ভের তৃতীয় মাসের প্রারম্ভে শুভদিনে প্রাতঃকালে পতি স্নান ও বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পূর্ব্বক চন্দ্রনামা অগ্নিকে স্থাপন করিয়া বিরূপাক্ষজাপান্তা কুশণ্ডিকা সমাপন করিবে। পরে কৃতস্নানা বধূকে অগ্নির পশ্চিমভাগে স্বীয় দক্ষিণদিকে উদগগ্র কুশোপরি প্রাঙ্মুখীভাবে উপবেশন করাইয়া প্রকৃতকর্ম্মারম্ভে প্রাদেশপ্রমাণ ঘৃতাক্ত সমিধ্‌ অগ্নিতে তূষ্ণীম্ভাবে হোম করত মহাব্যাহৃতিহোম করিবে। মূলের লিখিত “প্রজাপতির্‌ঋষির্গায়ত্রীচ্ছন্দোহগ্নির্দ্দেবতা মহাব্যাহৃতিহোমে বিনিযোগঃ ওঁ ভূঃস্বাহা” ইত্যাদি মন্ত্রে হোম করিতে হয়। তদন্তরপতি গাত্রোত্থান পূর্ব্বক বধূর পৃষ্ঠভাগে থাকিয়া তদীয় দক্ষিণ স্কন্ধ স্পর্শ করত দক্ষিণ হস্ত দ্বারা অব্যবহিত নাভিদেশ স্পর্শ করিবে এবং “প্রজাপতির্‌ঋষিরনুষ্টুপ্‌ ছন্দো মিত্রাবরুণাশ্ব্যগ্নিবায়বো দেবতাঃ পুংসবনে বিনিযোগঃ। ওঁ পুমাংসৌ মিত্রাবরুণৌ পুমাংসাবশ্বিনাবুভৌ। পুমানগ্নিশ্চ বায়ুশ্চ পুমান্‌ গর্ভস্তবোদরে।।” অর্থাৎ “মিত্রাবরুণ দেবতাদ্বয় পুরুষ, অশ্বিনীকুমারদ্বয় পুরুষ, অগ্নি ও বায়ু ইঁহারাও পুরুষ, সুতরাং তোমার গর্ভেও পুরুষের আবির্ভাব হইয়াছে।” এই মন্ত্র পাঠ করিবে।১।

অপর পুংসবনার্থ বটবৃক্ষের পূর্ব্বোক্তরশাখাস্থিত ফলদ্বয়যুক্তা, কৃমি কর্ত্তৃক অনুপহত করিবে। যব ও মাষকলায়ের গুড়কত্রয় দ্বারা অভিমন্ত্রিত করিতে হয়। সপ্ত মন্ত্রের ঋষ্যাদি সাধারন অর্থাৎ “প্রজাপতির্‌ঋষিঃ সোমবরুণবসুরুদ্রাদিত্যমরুদ্বিশ্বেদেবা দেবতা ন্যাগ্রোধশুঙ্গাপতি ক্রমণে বিনিয়োগঃ” ইহাই ঋষ্যাদি জানিবে। “হে বটশুঙ্গে, তুমি যদি সোমদেবতাকা হও, তবে তোমাকে ওষধিপতি চন্দ্রমার নিকট হইতে গ্রহণ করিতেছিএ। (১)। যদি তুমি বরুণদেবতাকা হও, তবে বরুণরাজার নিকট হইতে তোমাকে গ্রহণ করিতেছি। (২)। যদি তুমি বসুগণদেবতাকা হও, তবে তোমাকে বসুগণসকাশ হইতে গ্রহণ করিতেছি। (৩)। যদি তুমি রুদ্রদেবতাকা হও, তাহা হইলে রুদ্রগণ-সকাশ হইতে তোমাকে গ্রহণ করিতেছি। (৪)। যদি তুমি আদিত্যদেবতাকা হও, তবে আদিত্যগনসকাশ হইতে তোমাকে গ্রহণ করিতেছি। (৫)। যদি তুমি মরুদ্দেবতাকা হও, তবে মরুদগণসকাশ হইতে তোমাকে গ্রহণ করিতেছি। (৬)। যদি তুমি বিশ্বেদেবদেবতাকা হও, তবে বিশ্বেদেবগণ-সকাশ হইতে তোমাকে গ্রহণ করিতেছি। (৭)। এই সপ্তমন্ত্রদ্বারা বটশুঙ্গা আনয়ন করিবে। ২।

অনন্তর “প্রজাপতির্‌ঋষিরোষধয়ো দেবতা ন্যগ্রোধশুঙ্গাচ্ছেদনে বিনিয়োগঃ। ওঁ ওষধয়ঃ সুমনসোহস্যাং বীর্য্যং সমাধতু ইদং কর্ম্ম করিষ্যতি” এই মন্ত্রে অর্থাৎ “হে ওষধিগণ! তোমার প্রসন্নচিত্ত হইয়া এই ক্রীত বটশুঙ্গাতে সামর্থ অর্পণ কর; যেহেতু ইহা পুংসবন কর্ম্ম সমাহিত করিবে।” এই মন্ত্র পাঠ করিয়ে বৃক্ষ হইতে বটশুঙ্গা আহরণ করিবে। ৩।

পরে ঐ বটশুঙ্গা তৃণবেষ্টিতা করিতা শূন্যে রাখিতে হয়। অনন্তর ব্রহ্মচারী, কুমারী, গর্ভবতী নারো অথবা শ্রুতস্বাধ্যায়শীল ব্রাহ্মণ যথাচারে কৃতশোভন নামক অগ্নির উত্তর দিকে প্রক্ষালিত শিলাতলে নীহারজল দ্বারা লোষ্ট্রযোগ্রে ঐ বটশুঙ্গা পুনঃ পুনঃ পেষণ করিবে। পরে অগ্নির পশ্চিম ভাগে উদগগ্রকুশোপরি পশ্চিমাভিমুখে উপবিষ্টা বধূকে পূর্ব্বদিগানতমস্তকা করিয়া পতি তৎপৃষ্ঠভাবে থাকিয়া দক্ষিণ হস্তের অঙ্গুষ্ঠ ও অনামিকা দ্বারা বস্ত্রবদ্ধ পেষিত বটশুঙ্গ গ্রহণ পূর্ব্বক সেই গর্ভবতী বধূর দক্ষিণনাসারন্ধে সেই বটশুঙ্গারস নিক্ষেপ করিবে। “প্রজাপতির্‌ঋষিরনুষ্টুপ্‌ ছন্দোহগ্নিন্দ্রবৃহস্পতিতয়ো দেবতা ন্যাগ্রোধশুঙ্গারসদানে বিনিয়োগঃ। ওঁ পুমানগ্নিঃ পুমানিন্দ্রঃ পুমান্‌দেবো বৃহস্পতিঃ। পুমাংসং পুত্রং বিন্দস্ব তং পুমাননুজায়তাং” এই মন্ত্রে অর্থাৎ “অগ্নি পুরুষ, ইন্দ্র পুরুষ, বৃহস্পতিদেবও পুরুষ; তুমিও তদ্রুপ বুদ্ধিবিভবসদৃশ পুত্র লাভ কর এবং সেই জাত পুত্রের পরে অন্য পুত্রও জন্ম গ্রহণ করুক” এই মন্ত্রআপ্টহ পূর্ব্বক বটশুঙ্গারস নিক্ষেপ করিতে হয়। ৪।

তৎপরে মহাব্যাহৃতিহোম করিয়া প্রাদেশপ্রমাণ ঘৃতাক্ত সমিধ্‌ অগ্নিতে তূষ্ণীম্ভাবে হোম করত সর্ব্বকর্ম্মসাধারণ শাট্যায়নহোমাদি বামদেব্যগানান্ত উদীচ্য কর্ম্ম সমাপন করিয়া কর্ম্মকারয়িতৃব্রাহ্মণকে দক্ষিণা প্রদান করিবে।

 

ইতি সামবেদীয় পুংসবন।

—————————————-

* গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় সংস্কারকে পুংসবন কহে। এই সংস্কার গর্ভরক্ষার পক্ষে বিশেষ উপযোগী সন্দেহ নাই। গর্ভ গ্রহণের তিন হইতে চারিমাসের মধ্যে গর্ভ নষ্ট হইবার অনেক সম্ভাবনা, এই জন্য তৃতীয় মাসের দশদিনের মধ্যেই পুংসবনসংস্কার নির্ব্বাহের ব্যবস্থা নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। পুংসবন শব্দে পুত্র সন্তানের উৎপত্তি। গর্ভস্থ ভ্রুণ পুত্র হইবে কি পুত্রী হইবে, চতুর্থমাসের মধ্যে তাহা অবধারণ করা যায় না; বিশেষতঃ সকলদেশীয়া স্ত্রীলোকেই কন্যা অপেক্ষা অধিকপরিমানণে পুত্র কামনা করেন। এই জন্যই পুংসবন-সংস্কার নির্ব্বাহ করিতে হয়। কারণ এই সংস্কারে যে মন্ত্র পাঠ করিতে হয়, তাহা শুনিবামাত্র গার্ভণীর হৃদয় আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠে; সেই আনন্দাতিরেক বশতঃ গর্ভাবস্থায় আলস্য, ভয়, বমনাদিজনিত অবসাদ প্রভৃতি বিদূরিত হয় এবং গর্ভপোষণের শক্তি যেন পুনরায় সমুদ্ভূত হইতে থাকে। সেই মন্ত্র উপরে মূলে লিখিত আছে, অর্থাৎ “মিত্রাবরুণ দেবদ্বয় পুরুষ, অশ্বিনীকুমারযুগল পুরুষ, অগ্নি ও বায়ু ইঁহারাও পুরুষ, তোমার গর্ভে পুরুষেরই আবির্ভাব হইয়াছে।” পতি যখন ইত্যাদি প্রকার মন্ত্র পাঠ করিতে থাকেন, তখন তাহা শুনিয়া যে গর্ভিণীর হৃদয় আনন্দে উচ্ছ্বর্সিত হইবে, ইহা বিচিত্র নহে এবং সেই আনন্দাতিরেক বশতঃ যে মহাফল উৎপন্ন হইবে, তাহাতেই বা সন্দেহ কি? এতদ্ভিন্ন পুংসবন সংস্কারে ফলদ্বয়যুক্ত বটশুঙ্গা মাষকলায় ও যবের সহিত গর্ভিণীর নাসিকা স্পর্শ করাইয়া শুকাঁইকার বা নাসাতে তদ্রসনিক্ষেপের ব্যবস্থা আছে। যদিও আমরা বিশেষ না জানি, কিন্তু ঐ সকল দ্রব্যে যে গর্ভরক্ষার বিশেষ শক্তি আছে, তাহাতে সন্দেহ নাই; অধিকন্তু আয়ুর্ব্বেদেও লিখিত আছে যে বটফল দ্বারা যোনিদোষ বিনষ্ট হয়। যাহা হউক, এই সকল কারণে স্পষ্টই বোধগম্য হয় যে পুংসবন সংস্কার নির্ব্বাহ করা অবশ্য কর্ত্তব্য।