০৮. মদীনায় রসূলের দূত ও তার ঈর্ষনীয় সাফল্য

বাইয়েত শেষ হয়ে গেল এবং হজ্জ ও শেষ হলো। রসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগত লোকদের সাথে মদীনায় তাঁর প্রথম দুত পাঠালেন। মুসলমানদের ইসলামের শিক্ষা প্রদান এবং যারা এখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি তাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত প্রদানই ছিল এই দুত প্রেরণের উদ্দেশ্য। প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহণকারী যুবক মসআব ইবনে ওমায়ের আবদারী (রাঃ) কে আল্লাহর রসুল মদীনায় প্রেরণ করেন।
হযরত মসআব ইবনে ওমায়ের (রাঃ) মদীনায় পৌঁছে হযরত আসআদ ইবনে যুরারা (রাঃ) এর ঘরে অবস্থান করেন। এরপর উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে উভয়ে মদীনাবাসিদের ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। এ সময় হযরত মসআব “মুকরিউন” উপাধি লাভ করেন। এর অর্থ শিক্ষক বা মোয়াল্লেম।
দ্বীনের তাবলিগ করার ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্যের একটি বিস্ময়কর ঘটনা রয়েছে। যোরারাকে তিনি সঙ্গে নিয়ে একদিন বনি আব্দুল আশহাল এবং বনি যোহরের মহল্লায় যান। সেখানে বনি যোবায়ের একটি বাগানে মারক নামে একটি জলাশয়ের কিনারায় বসেন। তাদের কাছে কয়েকজন মসুলমানও সমবেত হন। বনি আশহাল গোত্রের সর্দার ছিলেন সা’দ ইবনে মায়া’য এবং উছায়েদ ইবনে খোযায়ের। তারা নবাগত মুসলমানদের আগমণের সংবাদ পেলেন। হযরত সা’দ অপর সর্দার উছায়েদ ইবনে খোযায়েরকে বললেন, তুমি গিয়ে দেখে এসো, ব্যাপারটা কি। ওদের বলবে যে, তোমরা কি আমাদের দুর্বল লোকেদর বোকা বানাতে চাও ? তাদের ধমক দিবে এবং আমাদের মহল্লায় আসতে নিষেধ করবে। আস’য়াদ ইবনে যোরারা আমার খালাতো ভাই, এ কারণেই তোমাকে পাঠাচ্ছি, না হলে আমি নিজেই যেতাম।
উছায়েদ নিজের বর্শা তুলে উভয়ের কাছে গেলেন। হযরত আস’য়াদ তাকে আসতে দেখে হযরত মসআবকে বললেন, কওমের একজন সর্দার তোমার কাছে আসছে। তার ব্যাপারে আল্লাহর রহমত মনে মনে কামনা করো। হযরত মসআব বললেন, তিনি যদি বসেন তাহলে আমি তার সাথে কথা বলব। উছায়েদ পৌছেই ক্ষেপে গেলেন। বললেন, আপনারা কেন আমাদের এলাকায় এসেছেন ? আপনারা কি আমাদের দুর্বল লোকদের বোকা বানাতে চান ? প্রাণের মায়া থাকলে কেটে পড়ুন। হযরত মসআব বললেন, আপনি আমাদের কাছে বসুন। কিছু কথা শুনুন। পছন্দ হলে গ্রহণ করবেন, পছন্দ না হলে করবেন না। হযরত উছায়েদ বললেন, কথাতো ঠিকই। এরপর তিনি নিজের বর্শা মাটিতে পুঁতে বসে পড়লেন। হযরত মসআব (রাঃ) ইসলামের কথা বলতে শুরু করলেন। কোরআন তেলাওয়াত করলেন। পরে তিনি বলেছেন, উছায়েদ কিছুই বলার আগেই আমি তার চেহারায় ইসলামের চমক লক্ষ্য করেছি। সব কথা শুনে উছায়েদ বললেন, কথা তো খুব ভাল। আপনারা কাউকে ইসলামে কিভাবে দীক্ষিত করেন? হযরত মসআব বললেন, আপনাকে গোসল করে পাক কাপড় পড়তে হবে। এরপর কালেমা তাইয়্যেবার সাক্ষ্য দিতে হবে এবং দু’রাকাত নামাজ আদায় করতে হবে। উছায়েদ সবই করলেন এরপর বললেন, আমাদের গোত্রে আরো একজন সর্দার রয়েছেন। তিনি যদি ইসলামে দীক্ষা নেন, তবে আমাদের গোত্রে আর কেউ বাদ থাকবে না। আমি তাকে এখনই আপনাদের কাছে পাঠাচ্ছি।
এরপর হযরত উছায়েদ তার বর্শা নিয়ে সা’দ ইবনে মায়া’য এর কাছে গেলেন। সা’দ উছায়েদকে দেখে বললেন, এই লোকটি যে চেহারা নিয়ে গিয়েছিলো, তার চেয়ে অন্য রকম চেহারা নিয়ে ফিরে এসেছে। উছায়েদকে সা’দ জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি করেছো ? উছায়েদ বললেন, আমি তাদের সাথে আলাপ করেছি,কিন্ত আপত্তিকর কিছুই পাইনি। তবে আমি তাদের নিষেধ করেছি। তারা বলেছে আপনারা যা চান আমরা তাই করবো। আমি শুনেছি, বনি হারেছা গোত্রের লোকেরা আসআদ ইবনে যোরারাকে হত্যা করতে চায়। এর কারণ হচ্ছে তিনি আপনার খালাতো ভাই। ওরা আপনার সাথে করা অঙ্গিকার ভঙ্গ করতে চায়। এ কথা শোনামাত্র সা’দ ক্রোধে অধীর হয়ে বর্শা হাতে ওদের কাছে পৌঁছুলেন। গিয়ে দেখেন দু’জনেই নিশ্চিন্তে বসে আছেন। তিনি বুঝতে পারলেন উছায়েদ চেয়েছে যে আমি দু’জন আগন্তুকের সাথে কখা বলি। সা’দ তাদের সামনে গিয়ে রুক্ষ ভাষায় বললেন, খোদার কসম হে আবু আনাস, তোমার এবং আমার মধ্যে যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকতো, তবে তুমি এমন কাজ করতে পারতে না। আমাদের এলকায় এসে তোমরা এমন কাজ করছো যা আমাদের পছন্দনীয় না।
হযরত আসয়াদ হযরত মসআবকে আগেই বলেছিলেন যে, এমন একজন লোক আসছেন যিনি তার গোত্রের প্রভাবশালী নেতা। যদি তিনি তোমার কথা শুনেন, তবে তার পিছনে কেউ বাদ থাকবে না। এ কারণে হযরম মসআব হযরত সা’দকে বললেন, আপনি বসুন, কিছু কথা শুনুন। ভালো না লাগলে শুনবেন না। হযরত সা’দ বললেন, ঠিকইতো। এ কথা বলে তিনিও বর্শা মাটিতে পুঁতে বসে পরলেন। হযরত মসআব তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কোরআন তেলাওয়াত করলেন। হযরত মসআব পরে বলেছেন, সা’দ বলার আগেই আমি তার চেহারায় ইসলামে চমক লক্ষ্য করেছি। সা’দ বললেন, তোমরা ইসলাম গ্রহণের পর কি করো ? মসআব বললেন আপনি গোসল করুন, এরপর পাক কাপড় পরুন, এরপর কলেমায়ে শাহাদাতে স্বাক্ষ্য দিবেন। তারপর দু’রাকাত নামাজ আদায় করবেন। তারপর সা’দ ইবনে মা’আয তাই করলেন।
ইসলাম গ্রহণের পর আনুষ্ঠানিকতা শেষে হযরত সা’দ নিজের গোত্রের লোকদের কাছে ফিরে গেলেন। লোকের বললো, আপনি ভিন্ন চেহারায় ফিরে এসেছেন মনে হচ্ছে। হযরত সা’দ বললেন, তোমরা আমাকে কেমন লোক মনে করো, হে বনী আবদেল আশহাল ? সবাই বললো, আপনি হচ্ছেন আমাদের নেতা। বুদ্ধি-বিবেচনার ক্ষেত্রে সবার চেয়ে বেশী। হযরত সা’দ বললেন, আচ্ছা তবে শুনো, তোমরা যতক্ষন পর্যন্ত আল্লাহ রব্বুল আলামীন এবং তাঁ প্রিয় রসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর ঈমান না আনবে, ততক্ষন পর্যন্ত তোমাদের সাথে কথা বলা আমার জন্য হারাম। বিকেল পর্যন্ত গোত্রের নারী-পরুষ সবাই ইসলাম গ্রহণ করলেন। উসাইরেম নামক একজন লোক সে সময় ঈমান আনেনি। তিনি ওহুদের যুদ্ধের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধে শরীক হয়ে শহিদ হন। তিনি কোন নামাযও আদায় করেননি। রসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সম্পর্কে বলেছেন, অল্প আমল করে সে অনেক বেশী পুরস্কার পেয়েছে।
হযরত মসআব ও হযরত আসয়াদ ইবনে যোরারার ঘরে অবস্থান করেই ইসলামের দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ করেন। এই দাওয়াতে আনসারদের প্রত্যেক পরিবারেই কয়েকজন করে নারী-পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তী হজ্জ মৌসুম আসার আগে হযরত মসআব ইবনে ওমায়ের (রাঃ) সাফল্যের সু-সংবাদ নিয়ে আল্লাহর রসুল হযরম মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট মক্কায় হাজির হন। তিনি প্রিয় রসুল আকায়ে নামদার তাজেদারে মাদীনা হযরত মোহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে ইয়াসরেবের গোত্র সমূহের অবস্থা, তাদের যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষ কৌশল এবং অন্যান্য যোগ্যতা সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন।